২
সকাল বেলা আপিসে ঢুকেই দীপঙ্কর চাপরাসীকে বলে দিয়েছিল—কেউ যেন আমার ঘরে না ঢোকে আজ—
কে-জি-দাশবাবু, রামলিঙ্গবাবু, সুধীরবাবু যারাই দেখা করতে এসেছে, তারাই ফিরে গিয়েছে। সেন সাহেব ব্যস্ত। সময় নেই সেন-সাহেবের।
পাস-ক্লার্ক হরিশবাবু একবার দেখা করে প্রণাম করতে এসেছিল। হরিশ-বাবুর এটাই কাজ। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত সাহেবদের ঘরে ঢুকে ঢুকে ‘গুড-মর্ণিং’ করাই হরিশবাবুর নিয়ম। চিরকাল এই কাজই করে আসছে। এই করে করেই ছোট নৌকোখানাকে জীবন-বৈতরণীর ঘাটে ভেড়াতে পেরেছে। আজ সেন-সাহেবের পদোন্নতিতে হরিশবাবুরও একটা কর্তব্য ছিল। আখেরের কাজ। কিন্তু মধু আটকালো দরজার মুখেই। বললে—না বাবু, এখন ঢুকবেন না—
—ঢুকবো না কী রে? কী বলছিস তুই?
মধু বললে—হ্যাঁ বাবু, সেন-সাহেব বারণ করে দিয়েছে—
হরিশবাবু তাতেও নিরস্ত হবার লোক নয়। বললে-আমাকে চিনতে পারছিস না তুই? আমি যে পাসবাবু রে! পাস নিতে গেলে তো আমার সেকশ্যানেই যেতে হবে রে তোকে!
মধুও চালাক খুব! বললে—তাহলে শ্লিপ্ দিন —
—এই দ্যাখ, আমার কাছে আবার শ্লিপ্ চায়! আমাকে নতুন লোক পেলি নাকি?
বলতে বলতে আত্মসম্মান নিয়ে হরিশবাবু এক সময়ে চলে গেল। মধু সেদিন উঁকি মেরে দেখেছে ভেতরে। সেন-সাহেব যেন অন্য দিনের মত নয়। অন্য দিনের মত হাসিমুখ নয় সাহেবের। গম্ভীর হয়ে ঘরে ঢুকেছে। দু’ একবার ঘণ্টা বাজিয়েছে সাহেব। মধু ভেতরে গিয়ে ফাইল নিয়ে এসেছে। কিন্তু সাহেব বেশি কথা বলেনি। কেমন যেন মুখ ভার-ভার। ফাইল নিয়ে আবার চলে এসেছে। কিন্তু খানিক পরে কাচের ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখেছে সেন-সাহেব যেন অন্যমনস্ক। ফাইলের দিকেও চোখ নেই। টেবিলের দিকেও চোখ নেই। কোনও দিকেই যেন চোখ নেই সাহেবের। যেন কী ভাবছে একমনে! নতুন প্রমোশন হয়েছে বলেই কি এমনি! নতুন প্রমোশন হয়েছে বলেই রাতারাতি বদলে গেল সেন-সাহেব!
বিকেল পাঁচটার সময়ই কাঁটায় কাঁটায় সেন-সাহেব ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
মধুও অবাক হয়ে গেছে। এমন সচরাচর হয় না। মিস্টার ঘোষালের ঘরের সামনে তখন অনেক ভিড়। দীপঙ্কর সেইদিকে একবার চেয়ে দেখলে। অনেক মাড়োয়ারী, অনেক গুজরাটী, অনেক বাঙালী। নানান কাজের তাগিদ তাদের। কেউ ওয়াগন চায়, কেউ চাকরি চায়। সকলেই কোন-না-কোনও ফেবার চায় ঘোষাল সাহেবের কাছে। ঘোষাল সাহেবের পদ-বুদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে খাতির বেড়েয়ে পাবলিকের কাছে। আগে যে- কাজ রবিনসন সাহেব করতো না, সে কাজটা নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছে। সকাল থেকে ব্যস্ততা, খালি কাজ, খালি ইন্টারভিয়ু। মিস্টার ঘোষালের পদোন্নতিতে যেন উমেদারদের সুবিধেই হয়েছে।
রাস্তায় বেরিয়েও দীপঙ্করের যেন সমস্ত কিছু ব্যতিক্রম মনে হলো। এই একদিনেই যেন পৃথিবীর চেহারাটা সম্পূর্ণ বদলে গেছে। সেই কবে, কবে একদিন এইখানে এই অফিসে সামান্য চাকরি-প্রার্থী হয়ে ঢুকেছিল সে। তারপর দিনে-রাত্রে নিদ্রায়-জাগরণে চাকরিটা তার কাছে যেন অভিশাপ হয়ে উঠেছে। চাকরি তো তার প্রয়োজন ছিল। চাকরি পেয়ে সে তো বেঁচে গেছে। চাকরি পেয়েছে বলেই আজ সে স্বাধীন হয়েছে। আজ সে মাথা খাড়া করে দাঁড়িয়ে আছে সংসারে। তবু চাকরির ওপর এ-বিরাগ তার কেন? দীপঙ্কর এক-এক সময় বুঝতে পারে না কেন তার এমন হয়! যদি চাকরিরই তার প্রয়োজন ছিল তবে এত আত্মবিশ্লেষণ করবার ক্ষমতা কেন হয়েছিল! কেন সে নিজেকে এমন করে যোগ্যতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করতে চায়? সে-ও তো আরো দশজনের মত অধিকার পেয়ে নিশ্চিন্ত হলেই পারে! পৃথিবীতে কত কী আছে ভোগ করবার! কত কী আছে দেখবার, অনুভব করবার। কিছু না থাকে তো সিনেমায় গিয়েও বসতে পারে। বসে বসে সময় কাটিয়ে দিতে পারে। আজ কেন সে সারাদিন কারো সঙ্গে দেখা করলে না? মিস্ মাইকেল এসেছিল দেখা করতে, গাঙ্গুলীবাবু এসেছিল দেখা করতে। মধুকে বারণ করে দিয়েছিল দীপঙ্কর। কারো সঙ্গেই সে আজ দেখা কারবে না।
অভয়ঙ্কর টেলিফোনে কনগ্র্যাচুলে করেছে দীপঙ্করকে।
রামমূর্তিও টেলিফোন করে দীপঙ্করকে কনগ্র্যাচুলে করেছে।
আরো কত অফিসার সব। সকলের আত্মীয় হয়ে গেছে দীপঙ্কর তার প্রমোশনের সঙ্গে সঙ্গে। ওদের চোখে সত্যিই দীপঙ্কর উঁচুতে উঠেছে। সারা ক্লার্ক-মহলে তাকে নিয়েই আলোচনা হয়েছে আজ। সে-সব কানে না শুনলেও আন্দাজ করতে পারে দীপঙ্কর। তার অতীতকালের শুরু থেকে বড় হওয়ার সমস্ত কাহিনী আলোচিত হয়েছে সেকশ্যানে-সেকশ্যানে। অন্য লোকের এ-ঘটনা ঘটলে হয়ত তাদের আনন্দের কারণই ঘটতো। কিন্তু দীপঙ্কর যেন কেমন লজ্জায় ঘৃণায় মুষড়ে পড়লো! তার মাইনে বেড়েছে তাতে পৃথিবীর কার কী ক্ষতি-বৃদ্ধি হলো। তাতে তার ছাড়া আর কার ভালো হলো? তাতে কি তার মনুষ্যত্বকে সম্মান দেওয়া হলো?
মিস্টার ঘোষাল প্রথম দিনই লিস্ট্ করে দিয়েছিল। বলেছিল—এ-সব ফাইল এবার থেকে আমিই ডীল করবো সেন্—
দীপঙ্কর অবাক হয়ে গিয়েছিল। বলেছিল—আপনি কেন করবেন? আমিই করতে পারি ও-সব—
মিস্টার ঘোষাল বলেছিল—না, মিস্টার ক্রফোর্ডকে আমি বলেছি, ও-সব আমার কেস্ আমার হাতেই রাখবো—
মিস্টার ঘোষালের কেস্ মানে পাবলিকের সঙ্গে যত করেসপনডেন্স। স্টাফের প্রমোশন। ওয়াগন। যে-সব ব্যাপারে বাইরের লোকের কাছ থেকে ঘুষ নেওয়া যাবে, পাবলিকের কাছে খাতির বাড়বে, দশজন এসে তার সঙ্গেই দেখা করতে চাইবে। একটা ওয়াগন বিড়িপাতা বুক করতে পারলে যেখানে সাতশো টাকা প্রফিট্ হবে সেখানে তিনি দাবি করতে পারবেন তিনশো টাকা ব্রাইব্। স্টাফের প্রমোশনের বেলাতেও তাই। বিনা ব্রাইবে মিস্টার ঘোষালের কাছ থেকে কিছু পাওয়া যাবে না। পাবলিকও ব্রাইব্ দিতে রাজী। যে ব্রাইব্ নেবে না, সে অচল। রেলের চাকরিতে সে আনফিট্! তবু দীপঙ্করের প্রমোশন হয়েছে। তবু দীপঙ্কর ঘাড় নিচু করে প্রমোশন নিয়ে সেই চেয়ারে বসে সারাদিন কাজ করে এলো! এত বড় অপমান সে সারাদিন কেমন করে সহ্য করলো!
কালিঘাটের মোড়ে এসে ট্রাম থেকে নেমে পড়লো দীপঙ্কর। কাছেই প্রাণমথবাবুর বাড়ি। প্রাণমথবাবু ছাড়া আর কার সঙ্গে পরামর্শ করা যায় এ-বিষয়ে! আর কে সৎপরামর্শ দিতে পারে তাকে। সেই পুরোন চেনা রাস্তা সেদিনও মানুষেল ভিড়ে ভর্তি। দু’ পাশে দোকানের সারি। আলো জ্বলে রাস্তাটা উজ্জ্বল করে দিয়েছে। টিনের আর ধোঁয়ার রাজত্ব। হাঁটতে হাঁটতে প্রাণমথবাবুর বাড়ির সমানে গিয়ে একবার দ্বিধা করতে লাগলো।
প্ৰাণমথবাবু হয়ত কথাটা শুনে অবাক হয়ে যাবেন। বলবেন—তা বলে চাকরি ছেড়ে দেবে তুমি?
দীপঙ্কর বলবে—হ্যাঁ, আমি তাই ঠিক করেছি, যেখানে মানুষের মর্যাদা নেই সেখানে মাইনে নেওয়া পাপ স্যার—
প্রাণমথবাবু হয়ত বলবেন—কিন্তু সংসারে মর্যাদা কি কেউ কাউকে দেয় দীপঙ্কর? মর্যাদা যে আদায় করে নিতে হয়—জোর করে আদায় করতে হয়—
দীপঙ্কর বলবে—কিন্তু তা বলে ঝগড়া তো আমি করতে পারি না স্যার—
প্রাণমথবাবু হয়ত বলবেন—ব্যাপারটা কী হয়েছে খুলে বলো তো?
দীপঙ্কর সমস্ত খুলে বলবে। তার পোস্টের সঙ্গে যে-দায়িত্ব জড়িত, দীপঙ্করকে আপিস সেই দায়িত্ব বাদ দিয়ে শুধু পোস্টটাই দিয়েছে। শুধু পোস্টের মাইনেটাই দিয়েছে। আসল ক্ষমতাটুকু সব কেড়ে নিয়েছে। এর পরেও কি তার থাকা উচিত সেখানে? সে কি তবে সে-দায়িত্ব পালন করতে অপারগ? তবে কেন তাকে প্রমোশন দেওয়া হলো? এ-ও তো এক-রকমের অপমান! এ-ও তো তার মনুষ্যত্বের ওপর আঘাত! দায়িত্বই যদি না দিলে তো মাইনে নিয়ে সে কী করবে? দায়িত্বহীন মর্যাদা তো তার সম্মানের ওপর কটাক্ষপাত! আর যদি দায়িত্ব না-দিতে চাও তো প্রমোশন দিও না। কে চেয়েছিল তোমাদের কাছে প্রমোশন! তোমরাই প্রমোশন দিয়েছ আমাকে, এখন তোমরাই বলছো তোমার দায়িত্বের ভার আমরা কমিয়ে দিলাম। ঘুঁটো জগন্নাথের মত তুমি পোর্টফোলিওহীন মিনিস্টার হয়ে থাকো।
প্রাণমথবাবু হয়ত বলবেন—কিন্তু ছেড়ে দিলে তো সমস্যা মিটবে না তোমার! অন্য অনেক লোক আছে যারা সেই অপমান গায়ে মাখতে স্বেচ্ছায় রাজী হবে—সংসারে সুবিধেবাদীর তো অভাব নেই!
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করবে—তাহলে আমি কি করবো বলে দিন স্যার, সমস্ত দিন ধরে আমি কেবল ভাবছি, কেবল মনে হচ্ছে চাকরি ছেড়ে দিই—আমার কেউ নেই যে তার সঙ্গে পরামর্শ করবো। আমার মা নেই এখানে, কিন্তু থাকলেও মা এ-সব কথা বুঝতো না— তাই তো আপনার কাছে এসেছি
বড় রাস্তার পর সরু গলি। গলির ভেতরে প্রাণমথবাবুর বাড়িটা। অনেক ভাবতে ভাবতে বাড়িটার কাছে যেতেই দীপঙ্কর দেখলে—ঘরের ভেতরে লোক ভর্তি। ঘর- বোঝাই। সবাই খদ্দর পরা। সবাই আলোচনা করছে যেন কী নিয়ে। মধ্যেখানের চেয়ারে প্রাণমথবাবু। একটা প্রচণ্ড তর্ক বেধেছে দুজনে। কথার মধ্যে ফরওয়ার্ড ব্লক্, কংগ্রেস, বল্লভভাই প্যাটেল, পন্থজী কত কথা উঠছে।
—মশাই, গোবিন্দবল্লভ পন্থের মতন অত শক্ত নার্ভ কার আছে বলুন তো! নইলে যে-রেজিলিউশন পড়তে সবাই ভয় পেয়ে গেল, পন্থজী উঠে গড় গড় করে তাই পড়ে গেলেন! সুভাষ বোসের এগেস্টে কার দাঁড়াবার সাহস ছিল সেদিন! মহাত্মা গান্ধী পর্যন্ত সেদিন ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন!
—আজকে স্টেটস্ম্যান কী লিখেছে দেখেছেন প্রাণমথবাবু?
হঠাৎ কে যেন তাকে দেখতে পেয়েছে। ডাকলে—আরে, দীপু যে—
এতক্ষণ নজরে পড়েনি। ছিটে আর ফোঁটা দু’ভাই-ই বসে আছে আসরে। ফোঁটাই প্রথমে দেখতে পেয়েছে। বললে—মাস্টারমশাই আমাদের দীপু এসেছে। দীপুকে চেনেন তো?
প্রাণমথবাবু দীপঙ্করের দিকে চাইলেন। বললেন—কী বাবা? কী খবর?
দীপঙ্কর বললে—আপনার সঙ্গে একটু দেখা করতে এসেছিলাম স্যার—
—কী কাজ?
ফোঁটা এগিয়ে এল চেয়ার ছেড়ে। বললে—কী রে, কংগ্রেসের মেম্বার হবি নাকি?
প্রাণমথবাবু বললেন—না না, তুমি গভর্নমেন্টের চাকরি করো, তোমার মেম্বার হয়ে দরকার নেই, চাকরির ক্ষতি হতে পারে!
দীপঙ্কর বললে—চাকরি সম্বন্ধেই কথা বলতে এসেছিলাম আপনার সঙ্গে, তা এখন থাক, আমি পরে একদিন আসবো—
বলে চলেই আসছিল দীপঙ্কর। ফোঁটা বললে—তোর সঙ্গে আমার একটা কাজ আছে দীপু—তোর বাড়িতে একবার যাবো আমি—কবে তোর সময় হবে?
বলতে বলতে ফোঁটা দীপঙ্করের সঙ্গে বাইরে এল।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে—কী কাজ, এখনই বলো না?
ফোঁটা ততক্ষণে সরু গলিতে এসে দাঁড়িয়েছে। অন্ধকার জায়গাটা। সেই সাউথ- ক্যালকাটা কংগ্রেসের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফটিক ভট্টাচার্য। আজ যেন কোনও বিশেষ কারণে দীপঙ্করকে তার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে—কী এমন কাজ বলো না?
ফোঁটা বললে—তোকে কংগ্রেসের মেম্বার হতে হবে।
—আমি তো গভর্নমেন্ট অফিসার! আমার তো মেম্বারশিপ হবে না!
ফোঁটা বললে—খুব হবে! আমি বলছি হবে! আমি কংগ্রেসের ভাইস প্রেসিডেন্ট, আমি তোকে মেম্বার করে নেব, কেউ জানতে পারবে না। তুই শুধু ব্যালট্-বাক্সে ভোট দিবি—
—কিসের ভোট?
ফোঁটা বললে—প্রেসিডেন্টের ইলেকশ্যান! তুই শুধু চুপি-চুপি নামটা সই করে দিবি, তারপর ভোটের পর তোর নামটা কেটে দেব, কেউ জানতে পারবে না—তোর অফিসের কেউ জানতে পারবে না—
—কিন্তু তাতে তোমার লাভ কী?
ফোঁটা বললে—কংগ্রেসের লাভ! কংগ্রেসের লাভ মানেই দেশের লাভ! কংগ্রেসের কাজ করলে আখেরে তোরও লাভ—যখন স্বরাজ হবে, তখন চাকরিতে তোর আরও প্রমোশন হবে, সহেবরা সব চলে যাবে, তোরাই তখন একচ্ছত্র! এখন মাইনে পাচ্ছিস চারশো টাকা, তখন হবে হাজার টাকা। যে-সব পোস্টে সাহেবরা আছে এখন, সে-সব পোস্ট তখন তোদের বাঁধা—।
দীপঙ্কর বললে—আমাকে ভাই ক্ষমা করো তুমি, আমি ওর মধ্যে যাবো না- ফোঁটা বললে—আরে, স্বদেশী করতে কে তোকে বলছে, তুই শুধু ভোট দিয়ে খালাস। আর কিছু করতে হবে না তোকে।
—কিন্তু তাতে তোমার স্বার্থটা কী?
—আমার স্বার্থ আছে বলেই তো বলছি, আমি এখানকার প্রেসিডেন্ট হতে পারবো! দীপঙ্কর বললে—কেন প্রাণমথবাবু তো প্রেসিডেন্ট রয়েছেই, প্রাণমথবাবু প্রেসিডেন্ট থাকলেই তো ভাল —
ফোঁটা বললে—না রে, প্রাণমথবাবু থাকলে হবে না, প্রাণমথবাবু বড্ড ভাল লোক। অত ভাল লোক দিয়ে দেশের কাজ চলে না। যেমন কুকুর তেমনি মুগুর হতে হবে তো! মাস্টারমশাই ও সব করতে পারে না, শুধু বলে ‘অহিংসা’–আরে বাবা, অহিংসা মুখে বলা ভাল। বৃটিশ গভর্নমেন্টের মুখের সামনে ‘অহিংসা’ প্রচার করবো, কিন্তু ভেতরে- ভেতরে কার্যসিদ্ধি করতে গেলে যা-করা দরকার সব করতে হবে।—সেখানে ফেয়ার- ফাউল বলে কোনও কথা নেই! এই যেমন ভোট! ফলস্ ভোট না দিলে তো প্রাণমথবাবুকে তাড়ানো যাবে না! আর প্রাণমথবাবু যদ্দিন আছে তদ্দিন তো আমাদের কংগ্রেসেরও কোনও উন্নতি নেই—
দীপঙ্করের হতবাক মুখের ওপর হাতটা তুলে ফোঁটা আবার বললে—তা যাবো তোর কাছে, বুঝলি? ফর্ম নিয়ে যাবো—কবে যাবো?
দীপঙ্করের ঘৃণা হলো। কিছু উত্তর না দিয়ে অন্ধকারের মধ্যেই রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো এক নিঃশ্বাসে!
ফোঁটা আবার পেছন থেকে ডাকলে। বললে—শোন্ দীপু—
বলে নিজেই কাছে এল। গলা নিচু করে বললে-দ্যাখ্, তুই নিজের ভোট্টা তো দিবিই, আর তোদের পাড়ার যদি কেউ থাকে তো তাদেরও মেম্বার হতে বলবি—
দীপঙ্কর বললে-পাড়ায় আমার সঙ্গে কারো পরিচয় নেই—
ফোঁটা বললে—পরিচয় না-ই বা থাকলো, আমরা দুজনে গিয়ে পরিচয় করবো, তুই আমার সম্বন্ধে বলবি, আমি জীবনে কতবার জেল খেটেছি তা তো তুই জানিস। প্রাণমথবাবুর চেয়ে আমি কম জেল খাটিনি-কী বল?
দীপঙ্কর কিছু উত্তর দিলে না।
—আর তুই যদি টাকা চাস তা-ও দিতে পারি।
—টাকা?
দীপঙ্কর হতবাক হয়ে গেল। টাকা দিতে চায় দীপঙ্করকে!
ফোঁটা কিন্তু সে-দিকে চেয়েও দেখলে না বললে—সব টাকা দিতে রাজী আছি আমি, আমি নিজের গাঁট থেকে টাকা খরচ করবো। যত মেম্বর করে দিবি, পার-হেড্ এক টাকা করে পাবি। আর যে-মেম্বার আমাকে ভোট দেবে তাকেও দেব এক টাকা করে। রাজী আছিস?
ফোঁটা দীপঙ্করের মুখের দিকে চেয়ে দেখলে। দীপঙ্করও তখন ফোঁটার মুখের দিকে চেয়ে আছে একদৃষ্টে। দীপঙ্করের মনে হলো যেন অঘোরদাদু। অঘোরদাদুর যেন অনেক বয়েস কমে গেছে। অঘোরদাদু যেন আবার নতুন করে জন্ম নিয়েছে কালিঘাট কংগ্রেসের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফটিক ভট্টাচার্যির মধ্যে। অঘোরদাদু যেন তাকে পচা সন্দেশ দেখিয়ে লোভ দেখাচ্ছে। অঘোরদাদু যেন এবার আরো চালাক হয়েছে, আরো চতুর, আরো ধূর্ত! কবে ১৮৮৫ সালে এই কংগ্রেসের জন্ম! কত রক্তাক্ত অধ্যায় অতিক্রম করে, কত সুরেশ ব্যানার্জি, কত মদনমোহন মালব্য, কত দেশবন্ধুর ত্যাগ আর বীরত্বের মর্যাদায় পুষ্ট হয়ে এখানে এসে পৌঁছেছে, কত লোক কত জীবন যৌবন অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ জলাঞ্জলি দিয়েছে এই কংগ্রেসের নামে! সেই ছোট বেলায় দুনিকাকার আড্ডায় কত দিন কত খবরের-কাগজের তুমুল বাদ-বিতন্ডার মধ্যে কত কী শুনেছে, আজও সব মনে আছে দীপঙ্করের। সেই দেশবন্ধু সি আর দাশ সম্বন্ধেই ১৯২৫ সালে স্টেটস্ম্যান লিখেছিল— India’s evil genius, servant of chaos. His spiritual house is Moscow, the general headquarters of the forces of hate. তখন এ-কথার স্পষ্ট মানে বোঝেনি দীপঙ্কর কিম্বা কিরণ! কিন্তু রাগ হয়েছিল খুব ওই খবরের কাগজটার ওপর কতদিন কত বছর ও-কাগজখানা তারা ছোঁয়নি পর্যন্ত। তারপর সি আর দাশের মৃত্যুর দিনের সেই মনের অবস্থা, সেই সোনার কার্তিকের ঘাটের সাধুর কথা, সেদিন সমস্ত কাহিনীগুলো, সমস্ত স্মৃতিগুলো চোখের সামনে আবার ভেসে উঠলো। অন্ধকার গলিটার মধ্যে ফোঁটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তার মনে হলো এখনি এক ঘুষিতে ফোঁটার চোয়ালটা ভেঙে গুঁড়িয়ে ধুলো করে দেয়। যেমনভাবে লক্ষ্মীদির বাড়িতে অনন্ত বাবুকে ঘুষি মেরেছিল তেমনি করে মেরে মাটিতে রাস্তায় শুইয়ে ফেলে! সেই সি আর দাশের চেয়ারে বসবে ফোঁটা! যে-চেয়ারে সুভাষ বোস বসেছে যে-চেয়ারে প্রাণমথবাবু বসেছে; সেই চেয়ারে ফল্স ভোট দিয়ে বসবে ফটিক ভট্টাচার্য–ফোঁটা ভট্টাচার্য! তার চেয়ে কংগ্রেস উঠে যাক সে-ও তো ভাল। ইন্ডিয়া স্বরাজ না-পাক, তাও তো ভাল। ফোঁটা যদি কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট হয় তো চিরকাল ইন্ডিয়া পরাধীন থাকুক—সে-ও তবু সহ্য করবে! তাতেও দীপঙ্করের কোনও দুঃখ নেই।
—আচ্ছা এক টাকাতে যদি রাজী না হোস তো দু’টাকা সই। কিন্তু গ্যারান্টি দিতে হবে ভোটটা আমাকেই দেবে সবাই—
তারপর হঠাৎ ফোঁটা অধীর হয়ে উঠলো। বললে—কী রে, চললি কেন—শোন্ – শোন্—