৬
সেন-সাহেবের ঘরে হঠাৎ রিং বেজে উঠলো।
—ইজ্ দ্যাট্ সেন?
দীপঙ্কর বললে—স্পীকিং—
—আই অ্যাম ঘোষাল —
অনেকগুলো কাজ জমে গিয়েছিল। সেদিন ক্লিয়ার করতেই হবে! ওয়ার-ট্র্যাফিক যাবে সাউথে। ইন্ডিয়ার কোস্ট্যাল ডিফেন্সের জন্যে ওয়ার-ট্রাফিক মুভ করবে। তার প্রোগ্রাম করে দিতে হবে ডিভিসনকে। মধুও ছিল অনেকক্ষণ! সে-ও অস্থির হয়ে উঠছিল দীপঙ্করের কাজে। কে-জি-দাশবাবু শেষ পর্যন্ত চলে গেছে। ট্র্যাফিক-সেকশানের রামলিঙ্গবাবুও চলে গেছে। সকলকেই যেতে বলেছে দীপঙ্কর। সমস্ত আপিস ফাঁকা হয়ে গেছে। মিস্টার ঘোষালও চলে গেছে। আপিস থেকে সবাই চলে গেলেই যেন কতকটা শান্তি পায় দীপঙ্কর।
হঠাৎ মধু ঘরে ঢুকলো। বললে—হুজুর?
—তোর দেরি হচ্ছে না তো মধু? তোর যদি কাজ থাকে তো তুই চলে যা। আমি দারোয়ানকে ডেকে ঘর বন্ধ করতে বলবো।
—না হুজুর আমি আছি।
দীপঙ্কর আবার কাজ করতে লাগলো। গাঙ্গুলীবাবু চলে গেছে। কোথায় কতদূরে এখন গাঙ্গুলীবাবু কে জানে। ইন্টার ক্লাসের পাস গাঙ্গুলীবাবুর। হয়ত দিল্লী গিয়ে পৌছিয়েছে এখন। কিংবা লখনৌ কিম্বা গাজিয়াবাদ। কোথায় দিল্লী, কোথায় লখনৌ, কোথায় গাজিয়াবাদ কিছুই জানে না দীপঙ্কর। কখনও যায়নি ওখানে। শুধু ডায়গ্রাম দেখেছে। রেলওয়ে জাংশান সব। বলে নিজের জীবনের জাংশানেরই কোনও হিসেব পাওয়া গেল না, তার ওপর আবার রেলওয়ে জাংশান। মানুষের জীবনকে কি শান্তিতে থাকতে দেবে না কেউ! সমস্ত পৃথিবীসুদ্ধ মানুষ যেন একযোগে ষড়যন্ত্র করতে শুরু করেছে। পৃথিবীর এক প্রান্তে ইন্ডিয়া। কার টেবিলে মাখন কম পড়লো—কার গাড়িতে পেট্রল কম পড়লো, কার রুমালে আতর কম লাগলো—কলোনীকে এক্সপ্লয়েট করো। লেবাররা গোলমাল করছে, আরো বেশি মজুরি চায়—কলোনীর ওপর চাপ দাও। কলোনী না থাকে, খুঁজে বার করো কোথায় কলোনী পাওয়া যায়। ব্রিটেনের কলোনী আছে, ইউ-এস্-এর কলোনী আছে, ফ্রান্সের কলোনী আছে, কিন্তু জার্মানীর? ইটালীর? জাপানের?
একদিন ছিল, যখন মালের বদলে মাল মিলতো। তুমি দেবে চাল, আমি দেব হাঁড়ি। পরস্পরের তৈরি মাল-বদলের যুগ। তারপর এল টাকা। এল রুবল, এল লীরা, এল ফ্রাঙ্ক, এল ডলার, এল টাকা। সেই টাকা প্রয়োজনের বেশি জমতে লাগলো সে- যুগের অঘোরদাদুদের হাতে। টাকা উপায় করতে হলে চাই যজমান। আরো যজমান হলে আরো টাকা। যজমান আরো বাড়াও, কলোনী আরো বাড়াও। তখন অঘোরদাদুরদের সঙ্গে অন্য অঘোরদাদুদের ঝগড়া শুরু হলো। উনিশের একের বি ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের বাড়িতে প্রয়োজনের বেশি টাকা জমে আর সিন্দুকে ভর্তি হয়। মানুষের লোভের সীমা একদিন অভ্রভেদী হয়ে উঠলো। পাঁচিল টপকে ভেতরে ঢুকে পড়েছে ছিটে-ফোঁটার দল। বুড়ো চিৎকার করে বললে-কে রে বেটা মুখপোড়া, কে ওখানে?
কেউ উত্তর দিলে না।
অন্ধ চোখ নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে হুড়মুড় করে মুখ থুবড়ে পড়লো, বৃটেন, ফ্রান্স, ইউ-এস-এ। কিন্তু জার্মানীর আর্মি তখন পোল্যান্ডের পাঁচিল টপকে একেবারে বাড়ির উঠোনে ঢুকে পড়েছে। বসত-বাড়ির উঠোনে। আর এখানে এই ইন্ডিয়ার এক কোণে সেন-সাহেব এত রাত পর্যন্ত ওয়ার-ট্র্যাফিকের প্রোগ্রাম নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। আপিসের কামরার মধ্যে।
—এত রাত পর্যন্ত কী করছো আপিসে!
দীপঙ্কর বললে—ওয়ার-ট্র্যাফিকের প্রোগ্রাম—
—এখনও কমপ্লিট হয়নি!
দীপঙ্কর বললে—না, আর একটু দেরি আছে!
মিস্টার ঘোষাল বললে—এদিকে—এক ভীষণ বিপদ হয়েছে,—তুমি এখুনি চলে এস–
—কোথায়?
ফ্রি-স্কুল স্ট্রীটে। আমি ফ্রি-স্কুল স্ট্রীটের থানা থেকে কথা বলছি।
বলে টেলিফোনটা ছেড়ে দিলে মিস্টার ঘোষাল! দীপঙ্কর হতবাক হয়ে গেল। ফ্রি-স্কুল স্ট্রীটের থানা! ফ্রি স্কুল স্ট্রীটে তো মিস্ মাইকেলের বাড়ি। সেখানে কী হলো হঠাৎ?
তাড়াতাড়ি দরোয়ানকে ডেকে দীপঙ্কর আপিসের দরজা বন্ধ করতে বললে। তারপর ট্যাক্সি নিয়ে সোজা ফ্রি-স্কুল স্ট্রীটের দিকে চললো। শীতার্ত রাত। রাস্তার আলোগুলোর মুখে বোরখা ঢাকা। স্পষ্ট দেখা যায় না কিছু। মিস্টার ঘোষাল যেন ধূমকেতুর মত টেলিফোনে উদয় হয়ে ঝড় বাধিয়ে দিলে দীপঙ্করের জীবনে!
থানার কাছে আসতেই সামনে দাঁড়িয়ে ছিল মিস্টার ঘোষাল।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে—কী খবর? হঠাৎ ডেকে পাঠালেন কেন আমাকে?
থানার ইনস্পেক্টর তৈরিই ছিল। জিজ্ঞেস করলে–আপনি মিস্ মাইকেলকে চিনতেন?
—হ্যাঁ চিনতাম। আজ দুপুরবেলাও দেখা হয়েছে তার সঙ্গে। কেন, কী হয়েছে তার?
—দুপুর বেলা আপনার সঙ্গে মিস্ মাইকেলের কী কথা হয়েছিল?
দীপঙ্কর বললে—বিশেষ কিছু নয়, হলিউডে যাবার আগে শেষবারের মত আমার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল।
—টাকার কথা কিছু বলেছিল আপনাকে? কত টাকা প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে তুলেছিল, বলেছিল কি?
দীপঙ্কর বললে—বলেছিল, পনেরো হাজার টাকা, আর তার কাছে ছিল তিনশো টাকা—এই নিয়েই আমেরিকায় চলে যাচ্ছিল। ভিভিয়ান-লে তার বন্ধু, সেই বন্ধুর চিঠি পেয়েই আমেরিকায় যাচ্ছিল ফিল্ম্-স্টার হতে—
—আপনার সঙ্গে তার কত দিনের সম্পর্ক?
দীপঙ্কর বললে—যেদিন থেকে চাকরিতে ঢুকেছি, প্রায় সেইদিন থেকেই—
—আপনি কখনও মিস্ মাইকেলের ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন?
—গিয়েছিলুম সে অনেক দিন আগের কথা, সেই একদিনই মাত্র গিয়েছিলুম।
তারপর ইনস্পেক্টর কী যেন ভাবলে। বললে—আপনি ম্যারেড না আনম্যারেড?
দীপঙ্কর একটু বিরক্ত হলো। বললে—এত কথা কেন আমাকে জিজ্ঞেস করছেন আননেসাসারিলি?
—দরকার আছে বলেই জিজ্ঞেস করছি। আমি আশা করি আপনি আমাদের ইনভেস্টিগেশনে হেল্প্ করবেন—
দীপঙ্কর বললে—তাহলে করুন, আর কী কোশ্চেন করবার আছে করুন—
ইনস্পেক্টর বললে—আর একটা মাত্র কোশ্চেন করবো। আপনি কখনও টেররিস্ট পার্টিতে ছিলেন?
দীপঙ্কর মিস্টার ঘোষালের দিকে চাইলে। মিস্টার ঘোষাল পাশে চুপ করে বসে আছে নির্বিকারভাবে।
দীপঙ্কর বললে—না—
—কখনও কি আই-বি ব্র্যাঞ্চ থেকে আপনাকে ডেকেছিল?
দীপঙ্কর বললে—হ্যাঁ—
—সেই সময় আপনি লক্-আপে আটক ছিলেন কিছু দিন?
দীপঙ্কর বললে—হ্যাঁ—
—আমার সব কোশ্চেন শেষ হয়েছে, এখন বলুন, আমরা স্পটে যাই—
বলে ইনস্পেক্টর উঠলো চেয়ার ছেড়ে। দীপঙ্করও দাঁড়িয়ে উঠলো। মিস্টার ঘোষাল উঠলো। বেশি দূর নয়। কাছেই মিস্ মাইকেলের ফ্ল্যাট-বাড়ি ঠুলি-আঁটা ঝাপসা আলোতেও দেখা গেল ফ্ল্যাট-বাড়িটার সামনে অনেক পুলিসের ভিড়। অসংখ্য লোক জমেছে। ইনস্পেক্টর যেতেই রাস্তা পরিষ্কার হয়ে গেল। সেই কাঠের সিঁড়ি। কিন্তু সেদিন আর সেখানে পিয়ানোর আওয়াজ নেই। মেমসাহেব, দালাল, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ছোকরাদের ভিড় নেই। সিঁড়িতেও অনেক লোক দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ইনস্পেক্টর যেতেই রাস্তা পরিষ্কার হয়ে গেল। মিস্ মাইকেলের ফ্ল্যাটের দরজার সামনেও পুলিস পাহারা দিচ্ছে। ইনস্পেক্টর ঘরে ঢুকতেই দীপঙ্কর নিঃশব্দে একটা অর্তনাদ করে উঠলো। ঘরের মেঝেতে রক্ত ভেসে বেড়াচ্ছে। আর তারই মাঝখানে চিত হয়ে শুয়ে পড়ে আছে মিস্ মাইকেল! নিথর নিস্পন্দ।
দীপঙ্কর সেই দিকে চেয়েই আতঙ্কে শিউরে উঠলো। যে-গাউন পরে মিস্ মাইকেল আপিসে যেত মাঝে মাঝে সেই গউন পরা। ঠোঁটে তখনও লিপস্টিক লাগানো। হাতের কাছে ভ্যানিটি ব্যাগটা—খোলা। হাঁ করে আছে।
—কী করে এমন হলো?
সন্ধ্যে বেলা যথারীতি শপিং করে ফিরেছে মিস্ মাইকেল। মার্কেটে গণি মিয়ার সঙ্গে কথা বলেছে। মূলজীর সঙ্গে কথা বলেছে। টেলার হুকুমালীর সঙ্গে কথা বলেছে। আরো যত চেনা-শোনা শপ্-কীপার, সকলের সঙ্গে দেখা করে এসেছে। সকলকে বলে এসেছে—হলিউডে চলে যাচ্ছি কাল। সকলের কাছে বিদায় নিয়ে এসেছে। তারপর নিজের ঘরে এসে ঢুকেছে। তারপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। আগের দিন আয়াটাকে মাইনে চুকিয়ে দিয়েছিল। সে বাড়ি চলে গিয়েছিল তার। সুতরাং আর কেউ ছিল না তার সঙ্গে। একেবারে একলা ছিল নিজের ঘরে।
ইনস্পেক্টর বললে—আমি খবর পেলাম ইভনিং সাড়ে সাতটার সময়—তারপর দরজা ভেঙে ঢুকে দেখি এই কাণ্ড। আচ্ছা আপনি বলতে পারেন মিস্টার ঘোষাল, কে এ-কাজ করতে পারে?
মিস্টার ঘোষাল বললে—আমি কী করে বলবো, আমি তো আপিস থেকে সকাল- সকাল বেরিয়ে আমার প্যালেস-কোর্টের ফ্ল্যাটে চলে এসেছি, সেখান থেকে বেরোইনি! তারপরেই আপনার রিং পেলাম—
তারপর দীপঙ্করের দিকে ফিরলো ইনস্পেক্টর। বললে–আপনি বলতে পারেন মিস্টার সেন?
দীপঙ্কর বললে—কীসের কথা বলছেন?
—কেমন করে মিস্ মাইকেল খুন হলেন? কে করলে? কাকে আপনার সন্দেহ হয়?
কাকে সন্দেহ হয়! দীপঙ্কর ইনস্পেক্টরের মুখের দিকে চাইলে। এমন সহজ কথাটাও কেউ এরা বুঝতে পারে না। বহুদিন আগে ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনে যা হয়েছিল এ- ও তাই। পোল্যান্ডে যা হয়েছে, এ-ও তাই। ফ্রান্সে যা হচ্ছে এ-ও তাই। ইটালী, যুগোশ্লোভিয়া, ডেনমার্ক, রুমানিয়া, রাশিয়া, আফ্রিকা, ইন্ডিয়া—সব জায়গায় যা হচ্ছে, এ-ও তাই!
—কাকে সন্দেহ হয় আপনার?
দীপঙ্কর ইনস্পেক্টরের দিকে মুখ তুলে চাইল আবার। বললে—টাকা।