কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১৫

১৫

পৃথিবীর অন্য জায়গায় যে-নিয়ম, প্যালেস-কোর্টের সে-নিময় নয়। প্যালেস-কোর্ট পৃথিবী থেকে আলাদা। দিনের বেলাও পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন, রাত্রেও তাই। এখানে বাস করলে কোথা দিয়ে সকাল হয়, কোথা দিয়ে রাত হয় টের পাবার দরকার নেই। যারা থাকে এখানে তারা এ-পৃথিবীরই মানুষ নয়। তাদের পৃথিবী খবরের কাগজের পৃথিবী, টেলিফোনের পৃথিবী। এ পৃথিবীটা যে মাটির, এ-পৃথিবীতেও যে যুদ্ধ হয়, মহামারী হয়, এ-খবর তারা জোর করেই ভুলে থাকতে চেষ্টা করে। এ পুরোপুরি বয় বাবুর্চি খানসামা আর চাপরাসীর পৃথিবী। কোথায় কে কত ভোরে উঠে হগ্ মার্কেট থেকে ফাউল কিনে এনেছে, ভেজিটেবেল কিনে এনেছে, কখন গ্যাসের উনুন ধরিয়ে রান্না চাপিয়েছে তার খবর রাখবার প্রয়োজন এখানে কম। এখানে হুকুম আর হুকুম-তামিলের রাজ্য। কলিং- বেল্ টিপ্‌লেই বয় আসে, পৃথিবীর যাবতীয় জিনিস ঘরে এসে হাজির হয়। মুখের কথা খসানোটাই এখানে একমাত্র শারীরিক মেহনত্‌

ভোরবেলা থেকে প্যালেস-কোর্টের সামনে সার সার গাড়ি ধোয়া হয়, মোছা হয়। ধুলো ঝাড়া হয়। কার গাড়ি, ভেতরে কারা থাকে তা কেউ জানতে পারে না। যে-যার ঘরের ভেতরে পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন, যে-যার ঘরের ভেতরে পৃথিবীর সম্রাট। চালের দর যখন বাজারে চড়ে কাপড়ের দর যখন দোকানে ওঠে, যখন বাজারে চিনি পাওয়া যায় না, নুন পাওয়া যায় না, সিগারেট, চা, বিস্কুটের জন্যে যখন কলকাতা শহরে হাহাকার পড়ে যায়, তখন প্যালেস-কোর্টের ভেতরে সে খবর পৌঁছোয় না। প্যালেস-কোর্টের পৃথিবী তখন কলকাতা শহরের মধ্যে অনড় অচল স্থিতধী হয়ে মহাকালের অক্ষয় মহিমা ঘোষণা করে। প্যালেস-কোর্ট ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনও নয় যে কেউ কাউকে চিনবে। প্যালেস-কোর্ট ফ্রি-স্কুল স্ট্রীট নয় যে কেউ কাউকে ঈর্ষা করবে। প্যালেস-কোর্ট গড়িয়াহাটাও নয় যে কেউ কাউকে আকর্ষণ করবে, আবার প্যালেস-কোর্ট স্টেশন রোডও নয় যে কেউ কাউকে ভালবাসবে, প্যালেস-কোর্ট প্যালেস-কোর্টই। কলকাতা শহরে প্যালেস-কোর্টই প্যালেস-কোর্টের তুলনা।

প্যালেস-কোর্টের হদিস বলা শক্ত। চৌরঙ্গী থেকে বেরিয়ে কোন্ রাস্তায় ঢুকে কোন্ রাস্তার মোড়ে প্যালেস-কোর্ট তা প্যালেস-কোর্টের বাসিন্দারাই জানে। আর জানে তারা যারা প্যালেস-কোর্টের ফ্ল্যাট বাড়িতে প্রমোশন পাবার জন্যে উন্মুখ।

ছোট বেঁটে মত একটা লোক কিন্তু তর তর করে চেনা-লোকের মত ঢুকে পড়লো প্যালেস-কোর্টের ভেতরে। তারপর যথাস্থানে গিয়ে বেল টিপতেই একজন বেয়ারা এল।

—কাকে চাই?

—মিস্টার ঘোষালকে।

ড্রেসিং গাউন পরা মিস্টার ঘোষাল বেরিয়ে এল। মুখে চুরোট।

—হুজুর, আমি আসছি মিস্টার পালিতের কাছ থেকে, মিস্টার এন পালিত বার- য়্যাট-ল। আপনার কি একটু সময় হবে? বড় জরুরী দরকার ছিল তাঁর।

—হবে, কিন্তু সকাল ন’টার আগে, নট আফটার দ্যাট—

.

তা, তা-ই সই। পরদিন কাঁটায় কাঁটায় ঠিক ন’টার সময় নির্মল পালিতের গাড়ি এসে ঢুকলো প্যালেস-কোর্টের উঠোনে। এক লাফে নামলো গাড়ি থেকে নির্মল পালিত। তারপর তর তর করে ভেতরে ঢুকে গেল। সিগারেট ধরিয়ে। মিস্টার ঘোষাল খবর পেয়ে বেরিয়ে এল ড্রেসিং গাউন পরে। বললে-আমি কি মিস্টার পালিত বার-য়্যাট-ল’র সঙ্গে কথা বলছি?

—ইয়েস মিস্টার ঘোষাল!

—বসুন, বসুন, আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়ে খুশী হলুম! বলুন, হোয়াট ক্যান্ আই ডু ফর ইউ?

নির্মল পালিত তখন বসে পড়েছে। একবার চারদিকে চাইলে ভাল করে। হাতের ব্যাগটা রাখলে একধারে।

তারপর বললে—প্রথমেই বলে রাখি মিস্টার ঘোষাল, আমি এসেছি প্রফেশন্যাল কল্-এ। আমি প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের মিসেস ঘোষের অ্যাপয়েন্টেড লয়্যার—আমি তাঁরই ব্রীফ নিয়েছি—

—আমি আপনাকে কী হেলপ্ করতে পারি বলুন? আই অ্যাম রেডি—

—বলছি মিস্টার ঘোষাল। আপনার সাহায্যের জন্যেই তো এসেছি, অবশ্য আপনি ভেরি বিজি ম্যান আমি জানি, আপনি রেলওয়ের এক রেস্পনসিবল গেজেটেড অফিসার। আপনাকে বেশি বুঝিয়ে বলতে হবে না আমি জানি। তবু বলছি, আপনার সাহায্য পেলে আমি কৃতার্থ হয়ে যাবো—

—বলুন, কী সাহায্য দরকার?

নির্মল পালিত আর ভূমিকা করলে না। বললে— মিসেস ঘোষ এখানে আপনার কেয়ারে আছেন? মিসেস সতী ঘোষ, ওয়াইফ অব মিস্টার সনাতন ঘোষ, ওনলি সন অব মিসেস নয়নরঞ্জিনী দাসী?

মিস্টার ঘোষাল এবার চুরোটে লম্বা একটা টান দিলে। তারপর বললে—কিন্তু একটা ভুল করছেন মিস্টার পালিত—

—কী ভুল বলুন?

—মিসেস সতী ঘোষ এখানে আছেন বটে, কিন্তু আমার কেয়ারে নয়, তিনি আছেন পাশের ফ্ল্যাটে, তিনি নিজেই ফ্ল্যাটের টেনেন্ট, আমার সঙ্গে তাঁর কোনও কনসার্ন নেই—

নির্মল পালিত বললে—ওয়েল ওয়েল ভেরি গুড, আমার খুব উপকার হলো মিস্টার ঘোষাল, আমার ধারণা ছিল তিনি আপনার কেয়ারে আছেন—আমার একটা মস্ত ভুল ভাঙলো—

বলে নির্মল পালিত আবার চুরোটে টান দিলে।

—আর একটা কথা মিস্টার ঘোষাল, মিসেস ঘোষ যে এখানে আছেন, তার জন্যে আপনি তাহলে মোটেই দায়ী নন?

মিস্টার ঘোষাল হাসলো। বললে—না না, আমি দায়ী থাকবো কেন?

—না তাই জিজ্ঞেস করছি। আর একটা কথা। আপনি তাকে সঙ্গে করে এখানে নিয়ে আসেননি?

—না না, আমি কেন তাঁকে এখানে নিয়ে আসতে যাবো? তিনি আমার কে?

—তাঁর সঙ্গে আগে আপনার কোনও পরিচয়ও ছিল না?

—না না, তা কী করে থাকবে?

নির্মল পালিত বললে—দেখেছেন, আমি সব ভুল ইনফর্মেশন পেয়েছিলুম। ভাগ্যিস আপনি সব সত্যি কথা বললেন—আদারওয়াইজ মিসেস ঘোষ তো বড় মুশকিলে পড়তেন, আর অকারণে আপনাকেও লিটিগেশনের মধ্যে জড়িয়ে পড়তে হতো!

—কেন? আমি জড়িয়ে পড়তুম কেন?

নির্মল পালিত বললে—তা বুঝি জানেন না, আমাকে যে কেস্ করতে হবে আপনার নামে, আমার পয়েন্ট অব আর্গুমেন্ট হচ্ছে আপনিই মিসেস ঘোষকে এখানে এনে লুকিয়ে রেখেছেন—আর তাঁর সঙ্গে আছে দশ হাজার টাকার অর্নামেন্ট! আপনি না বললে তো খুব মুশকিলে পড়েছিলাম!

বলে উঠলো নির্মল পালিত। বললে—আমাকে ক্ষমা করবেন মিস্টার ঘোষাল, আপনার ভ্যালুয়েবল সময় নষ্ট করলাম বলে—

মিস্টার ঘোষাল বললে—তাহলে মামলা আর করছেন না?

নির্মল পালিত বললে—করবো, কিন্তু আপনার বিরুদ্ধে নয়, মামলা হবে মিসেস ঘোষের বিরুদ্ধে—

—কেন? কোন্ চার্জে?

নির্মল পালিত বললে—শাশুড়ীর দশ হাজার টাকার গয়না নিয়ে পালিয়ে আসার চার্জে! মিসেস ঘোষ স্বামীর অমতে শাশুড়ীর অমতে তো এখানে এসে উঠেছেন—

—কিন্তু সে আপনি প্রমাণ করবেন কী করে? হাউ?

—প্রমাণ আছে আমার হাতে মিস্টার ঘোষাল। প্রমাণ না থাকলে কি আর বলি! মিসেস ঘোষের হাসব্যান্ডই সাক্ষী দেবেন মিসেস ঘোষের বিরুদ্ধে—আর……

মিস্টার ঘোষাল বললে—কিন্তু শাশুড়ীর অত্যাচারে কোনও ম্যারেড লেডীর শ্বশুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার রাইট নেই বলতে চান?

—আছে, নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু গয়না চুরি করে নিয়ে আসার রাইট তো নেই তা বলে! কিছুই চুরি করবার রাইট নেই!

—কিন্তু মিসেস ঘোষ যে গয়না চুরি করেছেন, একথা আপনাকে কে বললে?

নির্মল পালিত বললে—বলেছে আমার ক্লায়েন্ট! আর তাছাড়া আমি তো নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছি তিনি এখানে আড়াই শো টাকার ফ্ল্যাট ভাড়া দিচ্ছেন—এ টাকা নইলে কোত্থেকে পাচ্ছেন তিনি? আপনি তো আর দিচ্ছেন না! আপনার কেয়ারে তো তিনি নেই! তাঁর তো অন্য কোনও সোর্স-অব-ইনকাম নেই!

মিস্টার ঘোষাল বললে—না, থাকলেও আমি জানি না—

—তিনি তো চাকরি করেন না কোথাও?

মিস্টার ঘোষাল বললে—বোধহয় না—

—চাকরি করলে অবশ্য আমার প্লীড করা শক্ত হতো! চাকরি করলে অবশ্য বলতে পারতেন যে তিনি অফিসের মাইনে থেকে ফ্ল্যাট ভাড়া দিচ্ছেন। আর তা না হলে ধরে নিতে হয় যে হয় তিনি গয়না বেচে বেচে চালাচ্ছেন, আর নয়তো আপনি তাঁর হয়ে টাকা দিচ্ছেন মাসে মাসে—অর্থাৎ আপনার কেয়ারে তিনি আছেন—অর্থাৎ আপনার বিরুদ্ধেও এডালট্রির চার্জ আসতে পারে!

নির্মল পালিত একটু থেমে বললে—আচ্ছা, আমি তাহলে আসি মিস্টার ঘোষাল, বিরক্ত করলুম বলে আমাকে ক্ষমা করবেন আপনি—

বলে নির্মল পালিত চলেই যাচ্ছিল। হঠাৎ মিস্টার ঘোষাল বাধা দিলে। বললে— আচ্ছা মিস্টার পালিত—এসব কেসে কী হতে পারে? পানিশমেন্ট কী হতে পারে?

নির্মল পালিত বললে—তা আমি কী করে বলবো মিস্টার ঘোষাল, সে ট্রাইং ম্যাজিস্ট্রেটই বলতে পারে—

বলে নির্মল পালিত চলে যাবার উদ্যোগ করতেই মিস্টার ঘোষাল আবার বললে—একটা কথা মিস্টার পালিত—

—বলুন।

—এ সম্বন্ধে আমরা একটা টার্মস অব সেটেলমেন্টএ আসতে পারি না?

নির্মল পালিত একটু থমকে দাঁড়াল খানিকক্ষণ। তারপর বললে—টার্মস অব সেটেলমেন্ট! মানে আপনি টাকা দিয়ে মিটিয়ে দিতে চান? কিন্তু মিসেস ঘোষের শাশুড়ী তাতে রাজী না হতে পারেন, মিসেস ঘোষের হাসব্যান্ডও রাজী না হতে পারেন। তবে আপনি যখন বলছেন, তখন আমি তাঁদের বলে দেখতে পারি! কিন্তু তাতে কোনও ফল হবে বলে মনে হয় না মিস্টার ঘোষাল, তাঁদের তো টাকার অভাব নেই—তাঁরা মিলিওনেয়ার লোক—

—কিন্তু আপনি?

—আমি?

নির্মল পালিত যেন চমকে উঠলো। বললে—আমাকে আপনি মিথ্যে ওবলিগেশনে ফেলছেন মিস্টার ঘোষাল। আমি এই কেসের জন্যে অলরেডি পেপার্স তৈরি করে ফেলেছি—এতে অনেক টাকা ইনভলবড় হয়ে গেছে—

—কত টাকা?

নির্মল পালিত বললে—তা অন্তত ফাইভ থাউস্যান্ড—পাঁচ হাজার টাকার মতন জড়িয়ে পড়েছে অলরেডি!

—ধরুন যদি টাকাটা আমিই দিয়েই দিই আপনাকে?

নির্মল পালিত যেন চিন্তিত হবার ভান করলে।

মিস্টার ঘোষাল বললে—আপনি ব্যস্ত হচ্ছেন কেন মিস্টার পালিত! আপনি একটু বসুন না! আসলে তো ওদের পেছনে বিধবা মেয়েমানুষ ছাড়া আর কেউ নেই—আপনি যদি কেসটা একটু ম্যানিপুলেট করেন, তাহলেই তো সব চুকে যায়। আর ফাইভ থাউজ্যান্ড যদি কম মনে করেন তো সিক্স থাউজ্যান্ড দিচ্ছি—আমি চাই না মিসেস ঘোষকে নিয়ে একটা কিছু পাবলিক স্ক্যান্ডাল হয়—

—সেটা কি আমিই চাই?

—না, সেই জন্যেই তো বলছি, মিসেস ঘোষ একজন রেসপেক্টেবল লেডী, তাঁকে নিয়ে স্ক্যান্ডাল হলে পাবলিকই হাসবে। আর সেই জন্যেই তো আমি তাঁকে এখানে শেল্টার দিয়েছি। তাঁর অবস্থা যদি আপনি দ্যাখেন তো আপনার দয়া হবে, পিটি হবে তাঁর ওপর—! তাঁকে ডাকবো এখানে?

নির্মল পালিত বললে—না ডাকবার আর কী দরকার! বিশেষ করে একজন রেসপেক্টেবল লেডীকে আমি কোর্টে টানা হ্যাঁচড়া করতে চাই না। আর সেই জন্যেই তো কোর্টে কেস্ ফাইল করবার আগে আপনার কাছে এলাম—

মিস্টার ঘোষাল তারপর তাড়াতাড়ি ভেতরে উঠে গেল। তারপর একটু পরেই আবার বেরিয়ে এসে মিস্টার পালিতের হাতে একটা প্যাকেট গুঁজে দিলে। বললে-আমি ক্যাশ্ই দিয়ে দিলাম—

ঘটনাটা ঘটলো অত্যন্ত গোপনে। প্যালেস কোর্টের বাইরের পৃথিবীর লোক কেউ কিছু জানতে পারলে না। মিস্টার ঘোষালের মত লোকও মুখে হাসি এনে ঘটনাকে সহজ করবার চেষ্টা করলে। মিস্টার পালিতও টাকাগুলো গুনে গুনে ব্যাগে পুরে ফেললে। তারপর যাবার আগে বললে—কিন্তু একটা উপকার আমার করতে হবে মিস্টার ঘোষাল!

—বলুন, কী উপকার করতে পারি?

—আপনি মিসেস ঘোষকে কোনও চাকরিতে ঢুকিয়ে দিন। এনি কাইন্ড অব জব! মানে যাতে নিজের একটা ইন্ডিপেন্ডেন্ট সোর্স অ ইনকাম থাকে। অন্তত আমি বলতে পারি যে মিসেস ঘোষ নিজের রোজগারে নিজের লাইভলি-হুড চালাচ্ছে—নইলে সমস্ত দোষটা আপনার ঘাড়ে পড়বে! তাতে আমারও উপকার, আপনারও উপকার—

—একটু চা খেয়ে যাবেন না?

কিন্তু কাজের পর নির্মল পালিত আর বসবার লোক নয়। উঠে যাচ্ছিল। হঠাৎ মিস্টার ঘোষাল বললে—দাঁড়ান, মিসেস ঘোষকে একবার ডাকি, বড় মুষড়ে পড়েছেন, আপনি একটু হোপ দিয়ে যান—

টাকাটা তখন ভেতরে পুরে ব্যাগের মুখ শক্ত করে আঁটা হয়ে গেছে। বললে—তা ডাকুন—

নির্মল পালিত চুপ করে বসে রইল কিছুক্ষণ! একবার এদিক-ওদিক চাইতে লাগলো। পয়সাওয়ালা লোক মিস্টার ঘোষাল। সিক্স থাউজ্যান্ড ক্যাশ বার করে দিয়েছে এক কথায়! টেন থাউজ্যান্ড বললেই হতো। একটু মিস-ক্যালকুলেশন হয়ে গেছে!

হঠাৎ যেন ঝড়ের মত ঘরে ঢুকলো সতী!

—আপনি কেস্ করবেন আমার নামে?

নির্মল পালিত পেছন ফিরে দেখতেই চমকে উঠলো। এই মিসেস ঘোষেরই আর এক রূপ দেখেছে নির্মল পালিত। কিন্তু আজ যেন অন্যরকম দেখালো একেবারে। কোঁকড়ানো চুলগুলো পিঠে ছড়িয়ে পড়েছে। একটা লাল নতুন শাড়ি পরেছে। ঘরের ভেতর যেমন অবস্থায় ছিল, তেমনি ভাবেই বেরিয়ে এসেছে। মিস্টার ঘোষালও পেছন- পেছন ভেতরে ঢুকেছে তার।

—আপনি কেস করবেন বলে ভয় দেখাতে এসেছেন এখানে?

নির্মল দাঁড়িয়ে উঠলো। বললে—আসুন মিসেস ঘোষ, বসুন—

সতী বললে—না, আমি বসতে আসিনি—আমি জিজ্ঞেস করছি আপনি কি আমাকে ভয় দেখাতেই এসেছেন এখানে?

নির্মল পালিত বললে—এটা আপনি কী বলছেন মিসেস ঘোষ, আমি তো আপনার ভালোর জন্যেই খবরটা দিতে এসেছিলাম—তাছাড়া আমার তো প্রফেশনই এই, কিন্তু কারো ক্ষতি হয়, কারো সর্বনাশ হয় এটা তো আমি চাই না। আমাকে মামলা করতে বললেন আপনার শাশুড়ী আপনার নামে, আমি ব্রীফও তৈরী করেছি সেই রকমভাবে, কিন্তু ভাবলাম এও তো এক স্ক্যান্ডাল। এত বড় একটা ফ্যামিলির নামে স্ক্যান্ডাল রটবে—সেটা কি ভাল!

সতী বললে—না আমি চাই, আমার নামে মামলা হোক।

—আপনি মামলা চান?

সতী বললে—হ্যাঁ চাই—

মিস্টার ঘোষাল এতক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। বললে—কিন্তু মামলা হলে যে আমরা সবাই জড়িয়ে পড়বো মিসেস ঘোষ! নিউজ পেপারে যে সব ছাপা হবে—

সতী বললে—হোক ছাপা! ছাপা হলেই তো ভাল! লোকে জানুক বড়-বড় লোকের সংসারে কী কী ঘটে, কী ধরনের অত্যাচার হয়-বড়-বড় লোকেরা বাড়ির ভেতরে কী অশান্তিতে কাটায়। লোকে জানে তারা বড় আরামে থাকে, গাড়ি চড়ে বেড়ায় আর সুখে দিন কাটায়—কিন্তু তাদের জীবনেও যে কত অসহ্য অশান্তি থাকে—তা বাইরের লোকদের জানানো উচিত!

নির্মল পালিত বললে—কিন্তু তাতে আপনার কী লাভ মিসেস ঘোষ?

—আমার লাভ আছে বলেই বলছি!

মিস্টার ঘোষাল বললে-একজ্যাক্টলি সো, সেসব বাইরের লোকদের জানানো দরকার কী? বাইরের লোকরা বড়লোকদের স্ক্যান্ডাল শুনে মিছিমিছি হাসাহাসি করবে!

—আমি তো চাই তারা হাসাহাসি করুক! জানুক সব লোকে! আর কতদিন চাপা থাকবে? একদিন না একদিন সব তো জানাজানি হয়ে যাবেই!

—কিন্তু সে তো স্ক্যান্ডাল! স্ক্যান্ডাল কি প্রকাশ হওয়া ভাল?

সতী বললে—হ্যাঁ ভাল! আর এই স্ক্যান্ডাল হবে বলেই আমি বাড়ি থেকে চলে এসেছি প্যালেস-কোর্টে! স্ক্যান্ডাল না হলে ওদের কীসের শান্তি হলো?

মিস্টার ঘোষাল বললে—কিন্তু তাতে তো আপনিও জড়িয়ে পড়বেন মিসেস ঘোষ? শুধু আপনি নয় আমিও!

সতী বললে—আমার কথা ভাববেন না আপনি, মিস্টার ঘোষাল! আমি সমস্ত স্ক্যান্ডালের ওপরে উঠে গেছি, আমার আশা ভরসা সব ফুরিয়ে গিয়েছে। আমি নিজের জন্যে আর ভাবি না। কিন্তু আমি চাই আমাকে যে কষ্ট ওরা দিলে, সে কষ্ট ওরাও পাক- আমাকে কষ্ট দিয়ে ওরা যেন পার না পায়—

নির্মল পালিত বললে—ঠিক কথা মিসেস ঘোষ, আমিও বলেছিলাম আপনার মাদার-ইন-ল’কে যে দিস ইজ রং—অ্যাবসলিউটলি রং—আপনার পুত্রবধূ ও একটা প্রপার্টি—আমি তো তাই একটা মিটমাট করবার চেষ্টাতেই আছি—

মিস্টার ঘোষাল বললে—না মিস্টার পালিত, মিটমাট আর হবে না—

সতী বললে—আমি আর মিটমাট করতে চাইও না—

নির্মল পালিত বললে—আপনার শাশুড়ীও মিটমাট করতে চান না মিসেস ঘোষ—

মিস্টার ঘোষাল বললে—কিন্তু তা বলে যেন কোর্টে আপনি যাবেন না মিস্টার পালিত—

নির্মল পালিত বললে—তা কোর্টে কি আমিই যেতে চাই মিস্টার ঘোষাল, আপনি কোর্টকে যত ভয় করেন, আমি ভয় করি তার হাজার গুণ! কিন্তু আমার যে প্রফেশনই এই—

সতী বললে—না, আপনি কোর্টেই যান, আমি কোর্টের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সকলের সামনে আমার কথা বলতে চাই—

নির্মল পালিত বললে—সবই তো বুঝলুম মিসেস ঘোষ–আপনার রাগের কারণও আমি জানি, কিন্তু আপনার হাসব্যান্ডের অসুখের কথাটাও একবার ভাবুন—জানেন তো তাঁর খুব অসুখ, মাদারের সঙ্গে তাঁর কথাবার্তাও বন্ধ! এই অবস্থায় আপনি যদি তাঁকে আঘাত দেন, তাহলে তিনি কি আর বাঁচবেন?

সতী যেন হঠাৎ চুপ হয়ে গেল। কিছুক্ষণের জন্যে তার মুখ দিয়ে আর কোনও কথা বেরোল না।

মিস্টার ঘোষাল বললে-একজ্যাক্টলি সো, মিস্টার ঘোষের কথাটাও আপনার ভাবা উচিত মিসেস ঘোষ!

সতী বললে—না, তাঁর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক আমার ঘুচে গেছে, মিস্টার ঘোষ আমার কেউ নয়, তাঁর ভালমন্দে আমার কিছু এসে যায় না—

নির্মল পালিত বললে—কিন্তু ভুলে যাচ্ছেন মিসেস ঘোষ, তিনিই আপনার লিগ্যাল হাসব্যান্ড—

—নো—

হঠাৎ সতী চিৎকার করে উঠলো। বললে–নো, হি ইজ নো-বডি টু মি! আমার কোন কনসার্ন নেই তাঁর সঙ্গে—তাঁর অসুখই হোক, আর তিনি মারাই যান, ইট ম্যাটার্স ভেরি লিটল টু মি—

নির্মল পালিত আর দাঁড়াল না। বাইরে বেরিয়ে আসছিল। সতী বললে—আপনি ওঁদের বার-য়্যাট-ল, আপনি ওঁদের গিয়ে বলে দেবেন, আমি ওঁদের মামলার ভয় করি না, আমি ওঁদের সামনে ফ্ল্যাট ভাড়া নেব, ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে আই শ্যাল্ লিভ্ মাই ওন লাইফ-দেখি রিভেঞ্জ নেওয়া কাকে বলে—

নির্মল পালিতের কিছু বলবার ছিল না। আস্তে আস্তে বাইরে চলে এল। মিস্টার ঘোষাল এসে কাছে দাঁড়াল।

নির্মল পালিত বললে—ডোন্ট বদার মিস্টার ঘোষাল, আমি আছি, আপনার ভাবনার কিছু নেই, মিসেস ঘোষ বড় এসাইটেড হয়ে উঠেছেন তো, তাই—তা আমি ওসব কথায় কিছু মনে করিনি—আফ্‌টার অল উইমেন আর উইমেন—আসলে তো মেয়েমানুষ!

বলে নির্মল পালিত নেমে গেল রাস্তায়। তারপর হঠাৎ আবার উঠে এল ওপরে। কী যেন একটা কথা বলতে ভুলে গেছে। বললে—একটা কথা বলতে ভুলে গেছি মিস্টার ঘোষাল—

—বলুন!

—আপনি যেন মিসেস ঘোষকে আবার বলবেন না এই টাকার কথাটা। জানেন তো—Men are women’s playthings; woman is devil’s.

বলে নির্মল পালিত একটা শয়তানি হাসি হেসে উঠলো হো হো করে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *