• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

১.০৮ কিন্তু জেদী মেয়ে সুবৰ্ণলতা

লাইব্রেরি » আশাপূর্ণা দেবী » সুবর্ণলতা (১৯৬৭) » ১.০৮ কিন্তু জেদী মেয়ে সুবৰ্ণলতা

কিন্তু জেদী মেয়ে সুবৰ্ণলতা সব কিছুই কি করে উঠতে পেরেছে?

সমুদ্র দেখবার যে বড় বাসনা ছিল তার, দেখেছিল কি সারা জীবনে? অথচ ইচ্ছেটা তাকে কম্পিত করেছিল। সেই কোন অতীতকালে!

কত বয়েস তখন সুবৰ্ণলতার যখন মুক্তকেশী পাড়ার দলের সঙ্গে শ্ৰীক্ষেত্ৰ গিয়েছিলেন?

আকস্মিক কথাটা উঠেছে, চাটুপট সব যোগাড় করে ফেলতে হবে। মুক্তকেশী দুজোড়া থান ধুতি সাজো কাচিয়ে নেন ধোবার বাড়ি থেকে। গায়ের চাদর খুন্দুকে দিয়ে কাচিয়ে নেন সাজিমাটি দিয়ে। এ ছাড়া যোগাড় কি কম? কম্বল, বালিশ, মধু, আখের গুড়, ইসবগুল, আতপ চাল, সাবু, মিশ্ৰী, খুঁটিনাটির কি অন্ত আছে? একেই তো বিদেশে বেঘোরে প্রাণটা হাতে করে যাওয়া!

মা তীৰ্থ করতে যাবেন শুনে মেয়েরা দেখা করতে আসে এক-একদিন। সুশীলা তো থেকেই গেল। কদিন। মেজ সুবালাও এল, পরদিন চলে গেল। বড় ননদকে সুবৰ্ণ বড় প্রীতির চোখে দেখে। মানুষটার মহৎ গুণ, বড় নির্বিবোধী আর শান্তিপ্রিয়। যেটা নাকি মুক্তকেশীর গর্ভজাতদের মধ্যে দুর্লভ।

এরা সকলেই অশান্তিপ্ৰিয়।

অকারণ একটা কথা কাটাকাটি, অকারণ একটা চোঁচামেচি, অকারণ একটা জটিলতার সৃষ্টি করা-এটাই যেন এদের ব্যসন! বিশেষ করে সুবৰ্ণলতার উকিল সেজ দেওরের আর সুবৰ্ণলতার প পরম গুরুর। এরা দুজন যেন এদের উপস্থিতিতে সমস্ত পরিবেশটাকে সচকিত করে রাখতে চায়, অহরহ সরবে ঘোষণা করতে চায়। আমি আছি। এই ওদের বিলাস, ওই ওদের বিকাশ।

হয়তো এমনই হয়।

যাদের মধ্যে নিজেকে বিকশিত করবার উপর্যুক্ত কোনো বিশেষ গুণ নেই, অথচ নিজেকে বিশিষ্ট দেখার ইচ্ছেটা থাকে ষোল আনা, তাদের মধ্যেই জন্ম নেয়। এই বিকৃতি। তারাই নিজের চারিদিকে একটা সোরগোলের আবর্ত তুলে বিশিষ্ট হলাম ভেবে আত্ম তৃপ্তি পায়।

প্ৰবোধ একটা মুটের সঙ্গে অথবা একটা পালকি-বোহারার সঙ্গে একটা দেড়টা পয়সা নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে এমন শব্দময় দৃশ্যের অবতারণা করতে পারে যে, পাড়াসুদ্ধ লোক সচকিত হয়ে ছুটে আসে, জানলায় জানলায় খড়খাঁড়ির ফাঁকে কৌতূহলী চোখের ভিড় বসে যায়।

প্রভাসের মহিমাটা আবার বাড়িতেই বেশি প্রকট।

প্রভাস প্ৰতি কথায় পা ঠুকে বলে, আমি শুনতে চাই কে এ কথা বলেছে! শুনতে চাই কে এ কাজ করেছে!

তারপর?

তারপর অপরাধীর জন্য তো আছেই হাতে মাথা কাটার ব্যবস্থা!

ঘোরতর মাতৃভক্ত প্রভাসচন্দ্র প্রতি পদে সংসারে তার মাতৃসম্মান ক্ষুন্ন হতে দেখে, এবং সেই কল্পিত অসম্মানকে উপলক্ষ করে ঘূর্ণিঝড় তোলে! প্রধান লক্ষ্যবিন্দু অবশ্য সুবৰ্ণলতা!

কারণ সুবৰ্ণলতাই গুরুজনদের মান-সন্মান রক্ষার নীতি, নিয়ম, ধারা, অনুচ্ছেদ ইত্যাদি মেনে চলতে তেমন উৎসাহী নয়। সুবৰ্ণলতা জানে না অকারণ গাল খেয়ে চুপ করে থাকতে হয়, সুবৰ্ণলতা জানে না। অহেতুকি খোশামোদ আর তোয়াজ করতে।

তাই সুবৰ্ণলতার নাম না করেও শব্দভেদী বাণ নিক্ষেপ করে, মাকে মান্য করে চলতে যে না পারবে, সে যেন পথ দেখে। এ ভিটেয় মাকে অপমান করে বাস করা চলবে না।

হ্যাঁ, বহু সহস্রবার পথ দেখার হুকুম পেয়ে পেয়ে তবে পথ দেখেছিল সুবৰ্ণলতা। তবু নিন্দেয় টি টি পড়েছিল সুবৰ্ণলতার-আলাদা হয়ে গিয়েছিল বলে।

হাঁড়ি ভেন্ন করা সে কথা স্বতন্ত্র, যেমন করেছে ছোটবৌ বিন্দু, তা বলে বাড়ি ভিন্ন!

কিন্তু এসব তো অনেক পরের কথা।

সুবৰ্ণলতা যখন সমুদ্রের স্বপ্ন দেখতো, তখন আলাদা হওয়ার স্বপ্ন দেখে নি।

মুক্তকেশী শ্ৰীক্ষেত্রে যাচ্ছেন।

যেখানে নাকি সমুদ্র আছে।

মুক্তকেশীর সাজিমাটিতে কাঁচা চাদর বালিশের ওয়াড় তুলে আনতে রান্নাঘরের ছাদে এল সুবর্ণ। এটাই মুক্তকেশীর বিশুদ্ধ এলাকা। এখানে তার কাঁচা কাপড় শুকোয় শুকোয় বড়ি আচার।

রোদ পড়লে এগুলি ঘরে তোলার ভার সুবর্ণর। সেচ্ছায় সে এ ভার নিয়েছে। কাপড়ে সন্ধ্যা পাবার আগেই তসর শাড়ি একখানা জড়িয়ে পাশের দিকের এই নিচু ছাদটায় নেমে আসে সুবৰ্ণ। গলির মধ্যে বাড়ি, ছাদে তার বুকচাপা হাওয়া। তাছাড়া হবেই বা কি? যে ছাদে উঠতে হয় না, নামতে হয়, সে ছাদে কোথা থেকে আসবে উত্তাল হাওয়ার স্বাদ?

তবু ভালো লাগে।

তবুও সামান্যতম মুক্তি।

উপরে বাতাস না থাক, পায়ের তলায় ঘুটে আর কয়লার গুঁড়োর তৈরি গুলোর ছড়াছড়ি থাক, তবু তো মাথার ওপর আকাশ আছে।

কাপড় শুকোতে দেওয়া দড়িতে হাত দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে সুবর্ণ এই একটুকরো আকাশের দিকে তাকিয়ে।

সমুদ্র কী ওই আকাশের মত?

না, তাতে নাকি ঢেউ আছে, তরঙ্গ আছে, গর্জন আছে। কী অপূর্ব সেই মহিমা!

সুবৰ্ণলতার শাশুড়ী মুক্তকেশী সেই মহিমুর দৃশ্য দেখবেন গিয়ে। কিন্তু মুক্তকেশীর মনের কাছে কি সেই সমুদ্রে মূল্য ধরা পড়বে? মুক্তকেশী তো কই একবারও বলছেন না। সমুদ্রদর্শনে যাচ্ছি। বলছেন জগন্নাথ-দর্শনে যাচ্ছি! বলছেন জগন্নাথ টেনেছেন!

সুবৰ্ণলতাকে তো কই সমুদ্র টান দিচ্ছে না?

সুবৰ্ণলতার আকুলতার চাইতে কি মুক্তকেশীর চিত্তের আকুলতা বেশি?

নইলে চারধাম করে নিতে পেরেছেন তিনি। আবার দ্বিতীয়বার পুরী যাচ্ছেন। রথযাত্রাকে উপলক্ষ করে। কেদারবন্দরী, দ্বারকা, মথুরা, বৃন্দাবন কত কত জায়গায় গিয়েছেন মুক্তকেশী সুবর্ণর বিয়ের আগে, পরে।

পাড়ার মহিলাদের সঙ্গে ব্যবস্থা পাকা করে ফেলে এসে ছেলেদের একত্রে ডেকে বলেন, তোমরা চার ভাই কে কি দেবে বল?

ছেলেদের মুখ শুকোলেও মুখে হারে না। বলে, তোমার যা লাগে বল মা!

এবারেও বলেছে।

তা এবারে টাকা একটু বেশি লাগবে।

রথে যাওয়া আটকে বাঁধতে হবে, পাণ্ডাপূজো করতে হবে, গুণ্ডিচাবাড়ি ভোগ দিতে হবে।

মুক্তকেশী জানতেন, টাকা দিলে প্ৰবোধই দেবে। সুবোধের নেই বলে দিতে পারবে না, আর সেজ ছোট কিপটেমির জন্যে দিতে পারবে না।

তা প্ৰবোধও কিছু কম কিপটে ছিল না, শুধু সুবর্ণর দাপটেই মুক্তহস্ত হতে হয়েছে তাকে।

প্ৰবোধের আজকাল উপার্জন বেশি, জাহাজঘাটায় মাল লেন-দেনের কাজ, কাঁচা পয়সা, তাই দায়ে-দৈবে, জামাইবাড়ির তত্ত্ব-তল্লাসের ব্যাপারে। প্ৰবোধই মার ভরসা এখন।

এই একটি কারণেই হয়তো এখনো পর্যন্ত সুবৰ্ণলতাকে মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢেলে বাড়ির বাইরে দূর করে দেন নি মুক্তকেশী! টাকাকড়ির ব্যাপারে বেঁটা একেবারে উদোমাদা। আমার স্বামীর বেশি গেলো বলে হাপসানো তো দূরের কথা, তোমার বেশি আছে তুমিই দাও বলে স্বামীকে উৎপীড়ন করে মারে।

আর বৌ তিনটে এক পয়সার মরে বাঁচে!

উমাশশী যে অত ভালো, পয়সার ব্যাপারে কঞ্জুষের রাজা!

এই যে নিত্য গঙ্গাস্নান করেন মুক্তকেশী, খরচ কি নেই তাতে? গাড়িপালকি না চড়ুন, ঠাকুরদোরে তো দু-চারটে পয়সা দিতে হয়! ভিখিরি ফকিরকেও এক-আধটা না দিলে চলে না। তাছাড়া গঙ্গার ঘাটের বাজার থেকে হলো বা দুটো ফলপাকড়, হলো বা দুটো মাটির পুতুল কেনা, এ তো আছেই। এ খরচ সুবৰ্ণলতাই হাতে গুঁজে দেয়। নিজে থেকেই দেয়।

এবারেও যে প্ৰবোধ উদার গলায় বলেছিল, সবাইকে আর এই সামান্যর জন্যে বলার কি আছে মা? তোমার আশীর্বাদে শ দুই টাকা আমিই তোমাকে দিতে পারবো –সে। ওই বৌয়ের অন্তরটিপুনিতে ছাড়া আর কিছু নয়। তবে মুক্তকেশী মর্যাদা খোয়ান নি।

মুক্তকেশী উদাসভাবে বলেছিলেন, সে তোমাদের যার যেমন ক্ষ্যামিতা, ভাইয়ে ভাইয়ে মোকাবিলা কর! আমি সবাইয়ের কাছে বলে খালাস!

বৌয়ের বদান্যতায় বিচলিত হবেন মুক্তকেশী এমন নয়।

সুবৰ্ণলতা কাঁচা কাপড় তুলে নেমে আসছিল, সহসা বড় বৌয়ের সেজ ছেলে গাবু এসে হাঁক পাড়ে, মেজ খুড়ী, দিব্বি যে ছাদে এসে হাওয়া খাওয়া হচ্ছে! ওদিকে দেখ গে যাও, ঠাকুমা তোমার পিণ্ডি চটকাচ্ছে!

হ্যাঁ, এই ভাষাতেই কথা বলতে অভ্যস্ত ওরা।

এই ভাষাই তো শুনছে অহরহ।

সুবৰ্ণ সুরু কুঁচকে বলে, কেন হলোটা কি?

হলো? হুঁ! সাতশোবার ডাকছেন, শোনো গে কেন?

ওঃ!

সাতশোবার ডেকে সাড়া না পাওয়াটাই তা হলে অপরাধ! অতএব মারাত্মক কিছু না। সুবর্ণ তাড়াতাড়ি কাঁচা কাপড় যথাস্থানে রেখে এসে বলে, মা ডাকছিলেন?

মুক্তকেশী গম্ভীর আর কঠোর কণ্ঠে বলেন, বোসো।

ঈষৎ ভয় পেয়ে চারদিকে তাকিয়ে দেখে সুবর্ণ।

কেদারনাথ ঈষৎ গাম্ভীর্যে বলেন, তা বললে কি চলে মেজ গিন্নী? মিলিয়ে নিতে হয়!

যা হয় না তা কিভাবে হবে বলুন! সুবর্ণ একেবারে সম্ভাবনার মূলেই কোপ দিয়ে বলে, ও কথা ছেড়ে দিন। আপনি আমার একটা উপকার করুন ঠাকুরজামাই, কেনা হয়ে থাকবো আপনার। মাকে বলুন আমাকে নিয়ে যেতে!

কৌতুকপ্ৰিয় কেদারনাথ ওই কেনা হয়ে থাকার প্রসঙ্গে কিছু কৌতুক কথা আমদানি করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু সুবর্ণর আবেগে থারথার মুখ দেখে সামলে নিলেন।

অবাক হয়ে বললেন, নিয়ে যেতো! কোথায় নিয়ে যেতে!

পুরীতে।

পুরীতে? তোমায় পুরী নিয়ে যাবেন আমার পূজনীয় শাশুড়ী ঠাকরুণ? তা হলেই হয়েছে!

শাশুড়ীর সম্বন্ধে সমবয়সী জামাই কেদারনাথ এ ধরনের হাস্য-পরিহাস করেই থাকেন।

সুবৰ্ণ বলে, সে আমি জানি। তাই তো আপনাকে ধরছি। আপনার দুটি পায়ে পড়ি ঠাকুরজামাই, বলুন। একবার। আপনার কথায়, না করতে পারবেন না।

আহা, বুঝছে না ভাই! বলাটাই যে নিন্দের হবে! সব বৌয়ের কথা বলতাম। সে আলাদা কথা!

সব বৌ? সুবৰ্ণ তীব্ৰ গলায় বলে, ওরা কি সমুদ্র দেখতে চায়? ওদের খালি গাদা গাদা রানা আর গাদা গাদা খাওয়ায় আহ্লাদ। আপনি একবারটি আমার কথা বলুন ঠাকুরজামাই! বলবেন, পগল-ছাগল, বড্ড ইচ্ছে হয়েছে–

কেদারনাথ হয়তো বুঝতে পারেন পাগল-ছাগলের মতই কথা বলছে মানুষটা। তবু মুখে উপর তার সব আশা ধূলিসাৎ করে দিতে পারেন না। স্নেহের গলায় বলেন, আচ্ছা বলে দেখবো।

সুবৰ্ণলতার চোখের সামনে আশার দীপ জ্বলে ওঠে।

সুবৰ্ণলতা আনন্দে ছল ছল করতে করতে বলে, বলে দেখবো নয়, এ আপনাকে করে দিতেই হবে ঠাকুরজামাই। সমুদ্র দেখতে বড় ইচ্ছে আমার। মনে হয় একবার সমুদ্র দেখতে পেলে বুঝি মরতেও দুঃখ নেই।

এই দেখ পাগল! আচ্ছা, আচ্ছা, বলে দেখবো।

অবোধ সুবৰ্ণলতা এই আশ্বাসের তেলাটুকু দিয়ে আশার দ্বীপ জেলে রাখে। সুবর্ণ মনে করে পুরীর টিকিট বুঝি কেনা হয়ে গেছে তার!

সেই থেকে এই চব্বিশ ঘণ্টা সময় সমুদ্রের স্বপ্লে ড়ুবে আছে সুবর্ণ।

হঠাৎ যেন কে ওকে সেখানে থেকে টেনে তুলে এনে পাথরে আছড়ে মারলো।

মুক্তকেশীর দরবারে বিচার বসলো। জেরা শুরু হলো, কী বলেছে তুমি কেদারকে?

সুবৰ্ণ শঙ্কিত গলায় বলে, বলেছিলাম যেতে ইচ্ছে করে—

শুধু ওই কথা বলেছ? বলনি বড়বৌ, সেজবৌ, ছোটবৌ গাদা গাদা খায়!

সুবৰ্ণ অবাক হয়ে বলে, ও কথা আবার কখন বললাম?

কেন, যখন ঠাকুরজামাইয়ের কোলের কাছে বসে আদর কাড়ানো হচ্ছিল! সাধে কি আর মেয়েমানুষকে ঘোমটা দিয়ে অন্দরে রাখার রেওয়াজ মেজ বৌমা? এই তোমার মতন লক্ষ্মীছাড়া মেয়েমানুষদের জন্যই। আরো দুটো বৌও তো কথা কয়, কই তোমার মতন কোলের কাছে বসতে চায় না তো তারা? পেবো যাই দেখে নি। তাই রক্ষে, দেখলে গুরুলঘু মানতো? ঠাকুরজামাইয়ের কাছে বসে আদর কাড়ানো হচ্ছিল! জগন্নাথে নিয়ে যাবার বাসনা জানানো হচ্ছিল! ওরা গাদা গাদা খায়, ওদের যাবার দরকার নেই, আমি সোহাগী, আমায় নিয়ে যেতে বল! বলি কেন? কেন? এত আসপদ্দা তোমার কিসের? ওরা তোমার বাবার খায়?

সুবৰ্ণর এবার প্রসঙ্গটা মনে পড়ে। অতএব বিস্ময়টা কাটে।

প্রতিবাদের সুরে বলে ওঠে, ও ভেবে ও কথা বলি নি আমি—

হঠাৎ বড়বৌয়ের বড় মেয়ে মল্লিকা খরখর করে বলে ওঠে, না বল নি বৈকি! আমি যেন শুনি নি! টোপিও শুনেছে। বল নি তুমি বড় পিসেমশাইকে, ওরা গাদা গাদা রাধে, গাদা গাদা খায়–এখন আবার মিছে কথা বলা হচ্ছে!

না, মল্লিকার দোষ নেই।

এ বাড়ির শিশুরা জ্ঞানচক্ষু উনীলনের সঙ্গে সঙ্গেই দেখে আসছে, সবাই সুবৰ্ণলতার বিপক্ষ। সুবৰ্ণলতা সকলের সমালোচনার পাত্রী। সুবৰ্ণলতাকে এক হাত নিতে পারবার চেষ্টায় সবাই তৎপর। তবে আর তাদেরও তেমন মনোভাব গড়ে উঠবে না কেন! সুবৰ্ণলতার নিজের মেয়ে পারুলও কি ওদের দলে নয়!

ছেলে দুটি অবিশ্যি মার নেওটা, কিন্তু মেয়েটা মল্লিকারই জুড়ি।

কিন্তু আজ মল্লিকার কপালে দুঃখ ছিল।

অভ্যস্ত পাকা কথাটি বলার সঙ্গে সঙ্গেই বড়-সড় একটা চড় খেল সে।

হঠাৎ যেন সুবর্ণর মাথায় আগুন জ্বলে উঠল ওর কথায়। তাই বলেছি বেশ করেছি, এক ফোঁটা মেয়ে তোর এত সর্দারী কিসের রে? বলে ঠাস করে একটা চড় তার গালে বসিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেল। খেয়াল করল না, তার বিচারসভা অসমাপ্ত কাৰ্যভাব নিয়ে স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইল সেই গমনপথের দিকে।

কিন্তু বিচারসভা কি তার কার্যভার শেষ না করে নিশ্চিন্ত হয়? মুলতুবি সভা আবার বসে না নতুন উদ্যমে।

বিচার হয়। সুবর্ণর।

সেই বিচারের সূত্রে সমুদ্রের আভাস কিছু মেলে বৈকি।

ঢেউ, তরঙ্গ, গর্জন।

লবণাক্ত স্বাদ?

তারই বা অভাব কি?

সেও তো মজুত আছে অগাধ অফুরন্ত। শুধু একবার বালুবেলায় আছড়ে পড়ার অপেক্ষা।

আচ্ছা কেদারনাথ আর সুশীলা?

তারা?

তারা তো আগেই চলে গিয়েছিল। কেদারনাথ চেষ্টা দেখবার চেষ্টায় আজও এসেছিলেন। কথা তোলার সঙ্গে সঙ্গেই উঠে পড়লো। গত কালকের ইতিহাস। তারপরই উঠলো ঝড়। পরিস্থিতির আভাস দেখেই সুশীলা বলেছিল, আমি তোমার সঙ্গে পালাই চল। চোখের ওপর বেঁটার খোয়ার দেখতে পারব না।

খোয়ার থেকে রক্ষা করবার চেষ্টা করলে বিপদ আরো বাড়ানোই হবে বেঁটার সে কথাও তো অবিদিত নেই। তবু রক্ষা হলো না।

দু-তিন ছেলের মা হবার পর মারটা ছেড়েছিল প্ৰবোধ, কিন্তু পরপুরুষের গা ঘেষে বসে আদর কাড়ানোর খবরে আর মেজাজ ঠিক রাখতে পারল না। হিংস্র জানোয়ারের মত প্ৰায় ঝাঁপিয়ে পড়ে দেয়ালে মাথা ঠুকে দিতে উচ্চারণ করলো, বল আর বুড়োর সঙ্গে কথা কইবি না! প্ৰতিজ্ঞা কর!

সুবৰ্ণ আচাড়ে-কামড়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, করব না প্ৰতিজ্ঞা।

তাহলে তোর ওই পেয়ারের বুড়োকেই খুন করে ফেলবো দেখিস!

কোরো। সংসারে দুটো বিধবা সৃষ্টি হবে এই যা। খুন করে রেহাই পাবে না, ফাঁসি যেতে হবে।

প্ৰবোধ এই দুঃসহ স্পর্ধার সামনে সহসা স্তব্ধ হয়ে যায়। হ্যাঁ, এই স্বভাব প্ৰবোধের। হয়তো দুর্বলচরিত্র মাত্রেরই এমনি স্বভাব হয়। কেঁচোকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দেখলেও তারা হঠাৎ ভয় খায়, নিজেকে সম্বরণ করে নেয়।

সুবৰ্ণলতা যদি উমাশশীর মত হতো, কবেই হয়তো প্ৰবোধ তাকে অবহেলায় ঘরে ফেলে রেখে কাঁচা পয়সার সদ্ব্যবহার করবার পথ খুঁজতে যেত। কিন্তু সুবর্ণলতার এই দুঃসহ স্পর্ধাই একটা তীব্র আকর্ষণ!

তাই প্ৰবোধ একবার হয়ে মারে, পরীক্ষণেই জ্ঞানশূন্য হয়ে পায়ে ধরতে যায়।

সেদিনও প্রথমটা স্তব্ধ হয়ে গিয়েই সহসা সুর বদলায় প্ৰবোধ। সুবৰ্ণলতার নখের আঁচড়ে বিক্ষত হাতটায় ফুঁ দিতে দিতে বলে, উঃ, নখে দাঁতে বাঘের বিষ! ফাঁসিতে লটকাতে প্ৰধান সাক্ষী বোধ হয় তুমিই হবে?

একশোবার!

প্ৰবোধের গলায় অভিমানের সুর বাজে, তা জানি। এ আপদ মরলেই যে তুমি বঁচো তা আর আমার জানতে বাকি নেই। নিজের মাছ খাওয়াটাও যে ঘুচিবে সেই সঙ্গে, সে খেয়াল আছে?

সুবৰ্ণলতা বিধ্বস্ত খোঁপাটা জড়িয়ে নিয়ে নিজের বালিশটা মাটিতে ফেলে শুয়ে পড়ে বলে, তোমাদের মতন খাওয়াটাই আমার কাছে চতুর্বর্গ নয়!

তার মানে বিধবা হতেই চাও?

চাই, তাই চাই। শুনলে তো? এখন কি করবে? আমার প্রার্থনা পূরণ করতে বিষ খাবে? না। গলায় দড়ি দেবে?

এই বৌকে কোন উপায়ে জব্দ করবেো প্ৰবোধ?

মেরে ফেলা ছাড়া করা যাবে আর কিছু?

 

অথচ আবার নিজে সে প্রকৃতির একটা নিষ্ঠুর কৌতুকের প্যাঁচে নিতান্তই জব্দ!

এত কাণ্ডের পরও ওই ত পড়ে থাকা দীর্ঘ, বলিষ্ঠ, স্বাস্থ্যে ভরপুর দেহটা যেন তাকে লক্ষ বাহু দিয়ে আকর্ষণ করতে থাকে!

তিন ছেলের মা হয়েও তো স্বাস্থ্যে এতটুকু শিথিলতা এল না!

অতএব এবার খোশামোদের পথ ধরতে হয়।

তবে সেটা কিছু বিচিত্র।

লুব্ধ পুরুষের গভীর রাত্রির সেই বিচিত্র তোয়াজের ইতিহাস অনুদ্‌ঘাটিতই থাক।

সুবৰ্ণরই বা কী উপায় আছে। এর থেকে নিস্কৃতি পাবার, মরে হাড় জুড়নো ছাড়া?

রাত্রে দরজা খুলে বেরিয়ে আসার ছেলেমানুষি আর করা চলে না এখন। চারিদিকে চল্লিশটা চোখ! ছোটগুলোর কথা মনে করলেই সেই তীব্র বাসনাও স্তিমিত হয়ে আসে।

অথচ মরবার উপকরণও তো দুর্লভ!

শাশুড়ীর একটা রাতের মালিশের ওষুধ চুরি করে লুকনো আছে বটে, কিন্তু খুব একটা আস্থা আসে না তার উপর।

আবার একবার কি লোক হাসাবে সুবৰ্ণ?

মরতে গিয়ে না মরে কেলেঙ্কারী করবে?

তার থেকে এই কথা বিশ্বাস করাই ভাল, সুবৰ্ণ কারো দিকে তাকালেই মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে ওঠে প্ৰবোধের, হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। তাই এমন কাণ্ড করে বসে।

কারণ?

কারণ তো পড়েই আছে।

ভালবাসার আধিক্য! পায়ে মাথা খুঁড়ে সেই কথাই বোঝাতে চায় প্ৰবোধ।

মেয়েটা ঠাকুমার কাছে শোয়, কিন্তু ছেলে দুটোও তো ক্রমশ বড় হয়ে উঠছে, তাদের ঘুমের গভীরতায় বিশ্বাস নেই, শেষ পর্যন্ত ওই আধিক্যটা বোঝা ছাড়া উপায়ই বা কি?

Category: সুবর্ণলতা (১৯৬৭)
পূর্ববর্তী:
« ১.০৭ মুক্তকেশীর ছোট দুই ছেলে
পরবর্তী:
১.০৯ তীৰ্থ থেকে ফিরলেন মুক্তকেশী »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑