• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

২৯. বার-শিমলের পথে একলা হাঁটতে

লাইব্রেরি » বিমল মিত্র » সাহেব বিবি গোলাম » ২৯. বার-শিমলের পথে একলা হাঁটতে

বার-শিমলের পথে একলা হাঁটতে হাঁটতে ক’দিন আগেকার একটা ঘটনা মনে পড়লে ভূতনাথের।

হঠাৎ ভূতনাথের মনে হলো—তাই তো—এতক্ষণ মনে ছিল —বংশী যে বার-বার করে বলে দিয়েছিল সকাল সকাল বাড়ি আসতে। ছোটবৌঠান হয় তো সেজে-গুজে তৈরি হয়ে বসে থাকবে। মিয়াজান গাড়ি নিয়ে হাজির। হয় তত বংশী সারা বাড়ি খোঁজাখুজি চালিয়েছে। এখন আর বড়বাড়ির সে-জাঁক নেই। দুটুকবাবুর গানের আসরই বসে না। সারা উঠোনটা এখন যেন খাঁ খাঁ করে। শুধু যেন শূন্য পুরীর সামনে ব্রিজ সিং বন্দুক নিয়ে ঝিমোয়। আগে পায়চারি করতে, এখন ঝিমোয়। হাবুল দত্ত এখন এসে সেই যে ঢোকে মেয়ে-জামাই-এর ঘরে আর বেরোয় সেই রাত্রে! কী ফুস-মন্তর দেয় কে জানে। মেজবাবু একাই চালিয়েছে তার নৈশ উৎসব। আজো হাসিনী আসে, মেজ মাঠাকরুণ আসে, পানের ডিবে নিয়ে বড়মাঠাকরুণও আসে সেদিন হঠাৎ নান্নে বাঈ-এর নাচ-গানও হয়ে গেল। কিন্তু তেমন যেন জমলো না। বাঈজী এলে তিন দিন ধরে গানবাজনা চলতে আগে। একদিনে কখনও শেষ হয়নি আসর। নান্নে বাঈ গজল গেয়েছে, ঠুংরি গেয়েছে, কিন্তু তেমন বাহবা পায়ান যেন এবার। মেজবাবুর যেন তেমন মেজাজ ছিল না। নাচতে নাচতে মোহর তুলে নিয়েছে ঠোট দিয়ে। কিন্তু ওই একবারই। আর মোহরু পড়েনি রূপোর থালায়। এবার যাবার সময় বেনারসীর চমকদার ওড়নাও পেয়েছে। যেমন পায় অন্যবার। কিন্তু তেমন খুশি হয়নি যেন বাঈজী। মুন্নালাল তেমন করে সারেঙ্গী বাজাতে বাজাতে লুটিয়ে পড়েনি আসরের ওপর। নান্নে বাঈ-এর ঘোমটা ততটা ফাঁক হয়নি নাচতে নাচতে। তাল কেটে গিয়েছে বার বার। আসরের পর অনেক রাত্রে মেজবাবুর খাস কামরায় ডাকও পড়েনি তার! এ যেন নেহাৎ নিয়ম রক্ষা। আহা, এসেছে আশা করেফিরে যাবে! এমনি ভাব।

আর ছোটবাবু! ছোটবাবু কেন আবার যাবে জানবাজারে? কিসের বিরোধ বাধলে বৌঠানের সঙ্গে! মদ কি খায়নি ভালো করে ছোটবৌঠান! কায়দা-কানুনে কিছু ত্রুটি ছিল কি? কিম্বা হয় তো ঠিক বিয়ে করা স্ত্রীকে নিয়ে তেমন ফুর্তি হয় না। যেমন করে চুনীদাসী আদর করে আপ্যায়ন করে ঠিক তেমনটি হয় তো হয় না পটেশ্বরী বৌঠানের। কিন্তু চুনীদাসীকেও তো সেদিন ভালো করে দেখেছে ভূতনাথ! চুনীদাসী তাকে সেদিন ‘ভালোমানুষবাবু’ বলে ডেকেছিল! সত্যিই বাহাদুরি আছে চুনীদাসীর! বার-শিমলেয় যেতে-যেতে সেদিনকার ঘটনাটা মনে পড়লে ভূতনাথের।

সেদিন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলো ভূতনাথ, দেখতে পেয়েছে বৃন্দাবন? বললে—আমি চুনীদাসীকে বলেছিলাম আপনি আসবেন—তা চলুন এখন, এই তো দু পা গেলেই আমাদের বাড়ি।

-না, না, তা হতেই পারে না বৃন্দাবন, আমার অন্য কাজ আছে, বিশ্বাস করো।

টানাটানি। কিছুতেই ছাড়ে না।

ভূতনাথ বললে—আমার অনেক কাজ হাতে, জানো তো পরের বাড়িতে থাকি—সময়ে না খেলে…

—সে আমি শুনছি না শালাবাবু।

—আচ্ছা, যাবো একদিন কথা দিচ্ছি—কিন্তু আজ নয়।

–না শালাববু, সে হবে না।

শেষ পর্যন্ত যেতেই হলো। আগে একদিন মাত্র ভূতনাথ এসেছিল বংশীর সঙ্গে। সেই দরজা পেরিয়েই সরু একফালি বারান্দা। তারপরেই ওপরে ওঠবার সিঁড়ি।

বৃন্দাবন আগে আগে চলতে লাগলো। বললে—চলে আসুন। শালাবাবু। ওপরে গিয়ে বৃন্দাবন যেন কাকে লক্ষ্য করে বললেদেখো গো কাকে নিয়ে এসেছি!

–কে রে? মেয়ে গলায় কে যেন সাড়া দেয়। মনে হলো যেন চুনীদাসীর গলার আওয়াজের মতন।

—এই দেখো, চিনতে পারো!

ভূতনাথ একেবারে ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এক গা গয়না পরা চুনীদাসী বসে আছে তখন ফরাশের ওপর। সামনে পানের ডাবর। চুন, সুপুরি, লবঙ্গ, এলাচের কৌটো। মোটা হয়েছে যেন আরো। ফরসা টক টক করছে গায়ের রং। পাতাকাটা চুল। ভূতনাথকে দেখে বাঁ হাত দিয়ে একটু ঘোমটা উঠিয়ে দিলে মাথায়।

–ওমা, তাই বলি, এসো, এসো।

রীতিমতো আদর অভ্যর্থনা। বৃন্দাবন ফরাশের সামনেটা একটু ঝেড়ে-ঝুড়ে সাফ করে দিলে। বললে-বসুন এখানে শালাবাবু আয়েশ করে—তারপর তাকিয়াটাও একটু সরিয়ে দিলে ভূতনাথের দিকে।

বৃন্দাবন বললে—ভারী ভালোমানুষ এই আমাদের শালাবাবু, ছোটমা’র জন্যে কী কষ্টটাই না করে, জানলে চুনী।

সামনে দুটো পানের খিলি একটা রেকাবিতে করে এগিয়ে দিয়ে চুনীদাসী বললে—আহা, তা করবে না গা, যে ভালোমানুষ হয় তার সবই ভালো-খাও ভালোমানুষবাবু, পান খাও—ভাই।

ভূতনাথ যেন অবাক হয়ে গিয়েছে। দেয়ালের গায়ের তাকে থরেথরে সাজানো বোতলের সারি। ওপাশে ঝালর দিয়ে ঢাকা একটা কী জিনিষ। বোধহয় হারমোনিয়ম। তার পাশেই উপুড় করা একজোড়া বাঁয়া তবলা। তারই পাশে একজোড়া ঘুঙুর। আর ঠিক মাথার ওপর দেয়ালের গায়ে ঝুলছে একখানা তেল রং-এর ছবি। ছোটকর্তার।

বৃন্দাবন বললে বেশ আয়েশ করে তাকিয়া হেলান দিয়ে বসুন শালাবাবু-অমন আড়ষ্ট হয়ে আছেন কেন?

ভূতনাথ হেলান দিয়ে বসে বললে—কই, আড়ষ্ট হয়ে নেই তো?

-হ্যাঁ, দিব্যি গা এলিয়ে দিন, দিয়ে চুনীর সঙ্গে গল্প করুন। ক’দিন থেকে ভাবছি অত করে বলে এলুম শালাবাবুকে, একবার এলেন না। তা চুনী বলছিল আসবে নিশ্চয়ই, বলেছে যখন ভালোমানুষবাবু, তখন আসবে নিশ্চয়ই।

চুনী পান চিবোতে চিবোতে বললে—সত্যি ভাই, ভালোমানুষবাবু, বলছিলুম ক’দিন ধরে, বলি সেই গেল, এত করে আসতে বলে দিলাম, একদিন এল না। একবার ভাবলাম নিজেই আবার যাই…তা গাড়িটা বেচে দিয়েছি শুনেছো বোধ হয়—তা এত রোগা হয়ে গিয়েছে কেন ভালোমানুষবাবু।

তারপর কী যেন ভেবে নিয়ে ডাকলে—ওরে বিন্দাবন—

ভূতনাথেরও হঠাৎ নজরে পড়লো বৃন্দাবন কোথাও নেই। অথচ এতক্ষণ এখানেই ছিল!

—যাই গো, বলে পাশের কোথা থেকে বৃন্দাবনের সাড়া এল।

—পাখীটাকে ছোলা দিয়েছিস? এই দেখোনা, এই এক জ্বালা হয়েছে, ক’দিন থেকে পাখীটা মুখে কিছু কাটছে না ভাই, সাত দিকে সাত ঝঞ্চাট হয়েছে আমার ছোটবেলা থেকে পুষেছি কি না, এখন মায়া পড়ে গিয়েছে।

বৃন্দাবন এল। চুনীদাসী বললে—থাকোকে ডেকে দে তো।

ভূতনাথ চারদিকে চেয়ে-চেয়ে দেখতে লাগলো। ছোটবৌঠানের ঘরের সঙ্গে এ-ঘরের অনেক তফাৎ। কয়েকটা ছবি দেয়ালের গায়ে ঝুলছে। বিলিতি ছবি বলে মনে হয়। শাড়ি খসে পড়েছে পরীদের গা থেকে। জলে স্নান করতে নেমেছে একজন পরী। পাহাড়ের ঝরণার ধারে একটি পরী নিজের শরীরটার ছায়া দেখছে আপন মনে। কোথাও তিনটে পরী অপরূপ ভঙ্গী করে দাঁড়িয়ে আছে। কাপড়-জামার বালাই নেই কারো।

ঘরের মধ্যে, যেন একটা কিসের তীব্র গন্ধ। অথচ ছোটবৌঠানের ঘরে গেলেই সব সময় ধূপ-ধুনোর গন্ধ নাকে আসে। কিন্তু এখানে অন্যরকম। অচেনা একটা উত্তেজনা আসে আপনা থেকেই। বিছানাটা খুব পুরু। বসতেই আধ হাত গর্ত হয়ে যায়। মোটা-মোটা খান পাঁচ-ছয় তাকিয়া। বিছানার ওপরেই পানের রেকাবি, মশলার কৌটো। আর ঘরের এক কোণে একটা গড়গড়া। তলাটা রূপোর মতো ঝক ঝক করছে।

চুনীদাসী বললে—অমন আড়ষ্ট হয়ে বসে কেন ভালোমানুষবাবু, ভালো করে হেলান দাও ভাই।

ভূতনাথ দেখলে চুনীদাসীর নাকেও একটা হীরের নাকছাবি। অনেকটা যেন বৌঠানের নকল। কিন্তু চুনীদাসী পান খায় বৌঠানের চেয়ে বেশি। সেদিন এই বিছানার ওপরেই ছোটকর্তা শুয়ে ছিল। কিন্তু সেদিন চুনীদাসীকে এত সুন্দর মনে হয়নি। আজ যেন বড় ভালো লাগতে লাগলো চুনীদাসীকে।

চুনীদাসী খানিক পরে বললে—তামাক দিতে বলবে? তারপর ভূতনাথের মুখের ভাব লক্ষ্য করে বললে-তোমার ভয় নেই ভালোমানুষবাবু, বামুনের হুঁকোও আছে।

তামাক খায় না শুনে চুনীদাসী কিন্তু অবাক হলো না। বললে —আমারও তামাক খেতে ভালো লাগে না—আর তেমন তামাক আনতেও পারে না বিন্দাবন, ছোটবাবু রাগ করে বিন্দাবনের ওপর, আগে ছোটবাবু তামাক খেতো, ঘর একেবারে গন্ধে ভরপুর হয়ে যেতো—সব জিনিষে আজকাল আগুন লেগেছে ভাই।

ভূতনাথ বললে-একটু জল বরং দাও—জল তেষ্টা পেয়েছে।

-জল কেন, সরবৎ দিক না।

–না, সরবৎ দরকার নেই, জলই যথেষ্ট।

—সরবৎ তো হচ্ছে—তৈরি হচ্ছে, হলেই দিয়ে যাবে। রোজই সরবৎ হয় আমার এখানে, ছোটকর্তা খেতে কিনা-ছোটকা কেমন আছে আজকাল ভালোমানুষবাবু?

ভূতনাথ বললে—সেই রকমই—একবার ওঠেন, আবার পড়েন।

-কেউ দেখে না বুঝি? চুনীদাসী বলতে লাগলো—আমি কত সাবধানে রাখতাম তাকে—কোনোদিন যদি বেশি মদ খেয়ে ফেলতো, বারণ করতাম, বলতাম। অথচ কারো সহ্য হলো না—তা ছোটকর্তা কি ওষুধ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে?

ভূতনাথ বললে—আমি ঠিক জানি না, বংশী,জানে।

—ওই একটা বদমাইস, বংশী। আমাকে বলে কিনা বেবুশ্যে। শুনিছি সব, বড়বাড়ির কি আমিই প্রথম নাকি? মেজদি’র বাবার মেয়েমানুষ নেই? কলকাতার কোনো বাড়ির খবর জানতে তো আর বাকি নেই। এখানে সবাইকে আসতে হয়েছে, কালীপূজোর দিন ছোটবাবুকে কে বাঁচালে শুনি? নইলে আগুনে পুড়ে তে একাকার হয়ে যাচ্ছিলো! তা তো বংশী জানে না।

ভূতনাথের চোখে বিস্ময় দেখে চুনীদাসী বললে—সে খবর জানো না?

ভূতনাথ বললে—শুনিনি তো!

-ওই যে পাশের বাড়িটা দেখছো, ওর দক্ষিণে যে বাড়িটা, ওইখানে থাকে কতকগুলো মাগী, বাজারের মেয়েমানুষ, তা সেবার কালীপুজোর সময় ও-বাড়ির বাবুরা তুবড়ি জ্বালাচ্ছে খুব, ছোটকর্তার সঙ্গে আমিও বাজি দেখতে উঠেছি ছাদের ওপর। একটা বাজি এসে পড়লো একেবারে আমার বাড়ির উঠোনে—আর সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠেছে সুখী।

–সুখী কে?

–আমার আগে একটা টিয়াপাখী ছিল, তার খাঁচার ওপর এসে পড়েছে একেবারে—আর চেঁচাচ্ছে খুব। মরতে মরতে নেমে এলুম নিচে, দেখি তখন সুখীর শেষ অবস্থা ভাই, কেঁদে তো আমি বাঁচিনে–তা ছোটকর্তাকে চেনো তো তুমি, রেগে গেলে ও-মানুষের জ্ঞান থাকে না, বললে—এখুনি তুবড়ি কিনে আনো-হাজার টাকার তুবড়ি।

–হাজার টাকার তুবড়ি?

–ছোটকর্তার তো হাজার ছাড়া কথা নেই—হাজার টাকা বলেই খালাস-তা বিন্দাবন গেল তুবড়ি কিনতে—কিন্তু হাজার টাকার তুবড়ি কি চাট্টিখানি কথা! তা যা পাওয়া গেল, কুড়িয়েবাড়িয়ে তখুনি নিয়ে এল কিনে।

ছোটকর্তা বলেছোঁড়ো সবাই ওদের দিকে।

তা সেদিন সবাই এসেছিল, মধুসূদন, লোচন, আমার দারোয়ান, চাকর, সবাই।

—মধুসূদন কি এখানে আসে নাকি? ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে।

-হ্যাঁ, রোজই তো আসে। ওরা তো আমার দেশের লোক। রোজ সরবৎ খেয়ে যায়—তা তুমি জানতে না ভালোমানুষবাবু? মধুসূদন আসে, লোচন আসে, মাঝে-মাঝে শ্যামসুন্দর, বেণী, আগে শশীও আসতো, বিন্দাবন যে সরবৎটা তৈরি করে ভালল, ওর যে নাম-ডাক আছে কলকাতায়।

তারপর চেঁচিয়ে ডাকলে চুনীদাসী হ্যাঁ রে, সরবৎ হলো তোদের? তা তারপর কী হলো বলি—শোনো ভাই।

চুনীদাসী আর একটা পান মুখে পুরে দিলে। তারপর বোঁটায় করে খানিকটা চুন। তারপর জর্দার কৌটো খুলে মুখে পুরে দিলে খানিকটা। একমুখ পান, রসে বোধ হয় সমস্ত মুখখানা ভরে উঠেছে। তারপর সরে গিয়ে ফরাশের বাইরে পিকদানিটায় খানিকটা পিক ফেলে মুখ মুছতে মুছতে বললে—পান মুখে দিয়ে গল্প করতে পারি নে ভাই আমি।

ভূতনাথ বললে—তারপর কী হলো?

আবার মুখে রস জমে উঠেছে। চুনীদাসী আবার সরে গিয়ে পিক ফেললে। বললে—দূর হোক গে ছাই, মুখটা ধুয়েই ফেলি। জদা খেয়ে তোমার সঙ্গে গল্প করতে জুত হচ্ছে না, ডাকলে— থাকো, এক ঘটি জল দে তো মেয়ে?

চুনীদাসীর পান খাওয়া, দোক্তা খাওয়া, ওঠা-বসা সমস্ত দেখতে দেখতে ভূতনাথের কেমন যেন একটা অদ্ভুত কথা মনে হলো। এই মেয়েকে নাচলে কেমন দেখাবে, কে জানে। ছোটকর্তা তো অল্পে সন্তুষ্ট নয়! ছোটবাবুকে তৃপ্তি যে-সে দিতে পারে না। শুধু রূপ, আর রূপের বাহার থাকলেই চলবে না। সে-রূপের প্রকাশ চাই। অঙ্গভঙ্গি চাই। রূপকে বিকৃত করে, বিশ্লেষণ করে তবে ছোটকর্তার শান্তি। এই ঘর। এই ঘরের মধ্যেই এতদিন ছোট কর্তা তার পরিতৃপ্তি খুঁজেছে এবং পেয়েছে। কিন্তু চুনীদাসীকে বাইরে থেকে দেখে তো কিছু বোঝা যায় না। কোথায় এর বৈশিষ্ট্য। কোথায় এর বৈচিত্র্য। এই মেয়েই হাসিতে, গানে, কথায়, নাচে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে ছোটকর্তাকে। এখন দেখলে কেমন অবাক লাগে! অথচ বড়বাড়িতে যারা পেশাদার নাচিয়ে গাইয়ে আসে, তাদের দেখেই বোঝা যায়। কজ্জনবাঈ, নাগ্নে বাঈ-তাদের চোখের চাউনি আলাদা। তাদের চোখও নাচে অনবরত। নান্নে বাঈ যখন গজল গাইছিল—নয়ন না মেরে—’, তখন তা বোঝা যায়। হাসিনীকেও ধরা সহজ নয়। বড়মাঠাকরুণ বয়েসকালে নাচতে পারতো। পা দেখলে ধরা যায় এখনও। একএকদিন গাড়িতে ওঠবার সময় পায়ের যেটুকু কাপড় সরে গিয়েছে তা দেখে বুঝেছে ভূতনাথ। বুড়ী হয়ে গেলেও আঁটোসাঁটো দেহ। কিন্তু এই চুনীদাসী যেন এক আশ্চর্য মেয়েমানুষ। ভূতনাথের এমন মেয়েমানুষের সঙ্গে এই প্রথম মুখোমুখি কথা বলা।

চুনীদাসী গল্প করে যায়। বলে—তুবড়ি ফাটছে দমাদম শব্দে। ও-বাড়িতে ছাদের আলসের ওপর সার-সার চল্লিশটা তুবড়ি বসিয়ে চল্লিশটা মেয়ে একসঙ্গে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। চল্লিশটা তুবড়ি অন্ধকার আকাশের দিকে মুখ করে শো শো শব্দে ফুলের তোড়ার মত উড়ে চলেছে। একসঙ্গে চল্লিশটা মেয়ের হুল্লোড়। আর তাদের এক শ’ বাবুর। পাড়াটা মাত হয়ে উঠেছে। ছাদের ওপরেই মাদুর পেতে হারমোনিয়ম নিয়ে নাচ-গান চলেছে। এক শ’ বাবু একসঙ্গে চিৎকার করে ওঠে—কেয়াবাৎ-কেয়াবাৎ

হঠাৎ এদিক থেকে বিন্দাবনও ছুড়লো তুবড়ি। তুবড়ির ঝাঁক! ও-মা-গো-বলে ছিটকে পড়লো মেয়েদের দল! গানবাজনা মাথায় উঠলো তাদের। শাড়িতে, সেমিজে আগুনের ফুল্কি লেগেছে। উদ্দাম হয়ে উঠেছে আসর। তারপর আরো তুবড়ির ঝক গিয়ে পড়লো আবার।

ছোটকর্তা বললেন—দে বৃন্দাবন, সব মাগীদের পুড়িয়ে মার, পাঁচ আনার তুবড়ি নিয়ে বাজি পোড়াতে আসে।

নিচে ছিল মুসলমানদের হোটেল। সেখানে গিয়েও পড়লো কয়েকটা। রাস্তায় লোক জমে গেল। এক-একটা তুবড়ি শোঁ শোঁ করতে করতে যায় আর ছাদের ওপর পড়ে ছত্রখান হয়ে যায়, আগুনের ফোয়ারা ছোটে। কিলবিল করে ওঠে মাগীগুলো। মাগীরা বলে—এ কী কাণ্ড মা, পালিয়ে যাই নিচে।

কিন্তু বাবুরা.ছাড়বে কেন? তারা পয়সা খরচ করে ফুর্তি করতে এসেছে, এত সহজে মাটি হবে সব! দু’একটা মাগী মরলো কি গেল, তাতে তাদের কী। সারা বছরে যাদের বাবু জোটে না, কালীপূজোর দিন তাদের ঘরেও লোক আসে। দুটো ভালো-মন্দ জিনিষ পেট ভরে খেতে পায়। মাংস হয়, ভালো ভালো মদ আসে—ভালো জামা-কাপড় পায়, সেদিনটা এমন করে নষ্ট হবে নাকি! গঙ্গায় গিয়ে দেখেছি, পানসির ভাড়া চৌডবল হয়ে গিয়েছে। কালীপূজো, কার্তিক পূজো—এগুলোই তো ওদের মরশুম। গল্প করতে করতে চুনীদাসী আবার ডাকলে-সরবৎ হলো তোর বিন্দাবন?

ভূতনাথ বললে–তারপর?

-তারপর একটা তুবড়ি এসে পড়লো একেবারে ছোটকর্তার গায়ের…

হঠাৎ বৃন্দাবন সরবৎ নিয়ে ঘরে ঢুকলো। বললে—ধরুন শালাবাবু।

বিছানার পাশে রাখলো দু’ গেলাশ সরবৎ। রূপোর গ্লাশ। বেশ ঝকঝক করছে। ওপরে বৃন্দাবনী কাজ করা। একটাতে লেখা চুনীদাসীর নাম। আর একটাতে কৌস্তুভমণি চৌধুরীর। ছোটকর্তার গেলাশটা ভূতনাথের সামনে রাখলো বৃন্দাবন। আবার বললে-চেঁ-চো করে মেরে দিন শালাবাবু, দেরি করবেন না।

বৃন্দাবন চলে গেল। ভূতনাথ বললে–কিসের সরবৎ এ?

—খেয়েই দেখোনা ভালমানুষবাবু, তেঁতুল দিয়ে বেশ করে গেলাশ মেজে দিয়েছে, বামুনমানুষকে কি আমরা যা-তা জিনিষে খেতে দিতে পারি—নাকি আমাদের আক্কেল বিবেচনা নেই?

ভূতনাথ তবু দ্বিধা করতে লাগলো। সিদ্ধি নয় তো? সেবার ছুটুকবাবুর আসরে সিদ্ধি খেয়ে কী কাণ্ড—প্রাণ যায় আর কি—মনে হয় বুঝি সমস্ত বাড়িটা উল্টে যাচ্ছে।

চুনীদাসী ততক্ষণে নিজের গেলাশটা নিয়ে চুমুক দিতে শুরু করেছে। সমস্তটা শেষ করে মুখ দিয়ে একটা শব্দ বার করলে-–আঃ, বেশ হয়েছে সরবৎটা।

কিন্তু এদিকে আর এক কাণ্ড ঘটে গেল। সরবৎ মুখে তুলে চুমুক দিতেই মাথাটা যেন হঠাৎ ঘুরে উঠলো ভূতনাথের। আর সঙ্গে সঙ্গে হাত পিছলে গেলাশটা কাত হয়ে পড়েছে।

—ঐ যাঃ, কী হলো—চুনীদাসী হঠাৎ সামনে এগিয়ে এসে ধরতে গেল। কিন্তু তার আগেই যা হবার তা হয়ে গিয়েছে। সরবং গড়িয়ে বিছানা ভিজিয়ে দিয়েছে। একাকার হয়ে গিয়েছে সমস্তটা জায়গা। চুনীদাসী বললে–পড়ে গেল? দেখি দেখি?

তখন বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে ভূতনাথ। তার নিজের জামায় কাপড়েও পড়েছে। বিছানাটাও নষ্ট হয়ে গেল।

চুনীদাসী এগিয়ে এসে নিজের শাড়ি দিয়ে ভূতনাথের হাত মুখ মুছিয়ে দিলে। ভূতনাথের দিকে চেয়ে যেন বুঝতে পারলে ব্যাপারটা। ভূতনাথও অপ্রস্তুত হয়ে বললে—মাথাটা ঘুরে উঠলো কি না—

কিন্তু মনে হলো আর যেন বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারবে ভূতনাথ।

–এখনো ঘুরছে মাথাটা?

ভূতনাথ বললে—সরবতে কী ছিল?

—থাকবে আবার কী ভালোমানুষবাবু, সবাই খেয়েছে, এই তো আমিও খেলাম!

–তা হলে এমন করছে কেন শরীরটা। ভূতনাথের মনে হলো সে বুঝি এখনি টলে পড়বে। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। সমস্ত শরীরে যেন একটা দোলানি। ছুটুকবাবুর আসরে সিদ্ধি খেয়ে যেমন হয়েছিল এ তেমন নয়। যেন বিষ খেয়েছে সে। বিষ কখনও খায়নি ভূতনাথ। বিষ খেলে কেমন হয় তাও জানবার কথা নয়। কিন্তু তবু যেন মনে হলো তাকে এরা বিষ খাইয়েছে সত্যি-সত্যি। সমস্ত ঘরখানাও যেন তার সঙ্গে দুলছে। দেয়াল, দেয়ালের ছবি, হারমোনিয়মের বাক্স। বয়া তবলা জোড়া

-মাথাটা টিপে দেবো? চুনীদাসী ভূতনাথের মাথাটা নিয়ে নিজের কোলের ওপর রাখলো। বললে একটু ঘুমোবার চেষ্টা করো তো ভালোমানুষবাবু?

চুনীদাসীর কোলের ওপর শুয়ে কেমন যেন আরাম হলো। কেমন যেন এক অন্য ধরনের স্বস্তি। মাথার তলায় চুনীদাসীর নতুন শাড়িটা কেমন যেন খস খস করছে। চুনীদাসী কি আতর মেখেছে! আতরের গন্ধ বুক ভরে টানতে লাগলো ভূতনাথ। মনে হলো চুনীদাসী তার মাথার চুলের মধ্যে যেন আঙুল দিয়ে আস্তে আস্তে টিপে দিচ্ছে। কপালের কাছে হাতটা আসতেই কেমন আরাম লাগে। চুনীদাসীর আঙুলগুলো কী নরম!

চুনীদাসী বললে—একটু ঘুমোবার চেষ্টা করে দিকি ভালোমানুষবাবু।

ভূতনাথ বললে-তোমার কাপড়টা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

—তা যাক, এখন মাথা ধরাটা সারলো একটু? বলে নিজের কাপড় দিয়ে ভূতনাথের মুখের ঘাম মুছিয়ে দিলে চুনীদাসী।

সত্যি যেন আরাম হচ্ছে বেশ। ভূতনাথ বললে—তোমাদের খুব কষ্ট দিলাম।

-কষ্ট! কষ্ট কিসের ভালোমানুষবাবু, আজ এলে গল্প করতে, তোমাকে আমিই ডেকে পাঠিয়েছিলাম, আর কী কাণ্ড বলে দিকি?

তা তোমার কিছু ভাবনা নেই।

ভূতনাথ বললে-বংশী হয় তো খুঁজবে, আজ সকাল সকাল ফিরতে বলেছিল। কাজও ছিল একটা।

-একটু ঘুমোও, ঘুমিয়ে নাও, শরীরটা ভালো হলে তোমায় গাড়ি ডেকে পাঠিয়ে দেবো-কিচ্ছু ভেবো না।

আবার চোখ বুজতে চেষ্টা করলো ভূতনাথ। কিন্তু মাথার মধ্যে সব যেন গোলমাল হয়ে যায়। হঠাৎ একবার তন্দ্রা আসে আর মনে হয় ঘরে যেন অনেক লোকের ভিড় জমেছে। পুলিশ ঢুকেছে ঘরে। বলছে—একে খুন করেছে কে? আবার যেন মনে হলে বৃন্দাবন ঘরে ঢুকে দাত বার করে হি-হি করে হাসছে। চুনীজাসী বলছে—এইবার একে রাস্তায় ফেলে দিয়ে আয়, আর দরকার নেই। চুনীদাসীরও যেন অন্যরকম চেহারা। বোতল বার করে গেলাশে মদ ঢালছে। তারপর বললে—ডাক তো কাকে, তবলা বাজাবে। তার মধ্যে মনে হলো যেন চুনীদাসী শাড়ি খুলে ফেলেছে। চুলটা বেণী করে বেঁধে নিয়েছে। মাথায় দিয়েছে পাতলা জাফরানি ওড়না। আর মখমলের ঘাঘরা পরেছে। বুকে বেঁধেছে কঁচুলী। তারপর ওধারে কারা তবলা বাজাচ্ছে। গান গাইছে! আর ঘুরে ফিরে নাচছে চুনীদাসী। চুনীদাসীর যেন আর সে-চেহারা নেই। মাঝে মাঝে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অঙ্গভঙ্গী করছে। আসরে মদ উড়ছে, সিগারেটের ধোঁয়া জমেছে। আর ওধারে এক কোণে বসে আছে ছোটকর্তা! বসে বসে রূপোর গড়গড়া থেকে রঙিন রেশমী কাগজে মোড়া ফরসি মুখে দিয়ে ধীরে ধীরে তামাক টানছে। ঘুমের মধ্যেই মনে হলো–কখন সব এল এরা। তাকে কি কেউ দেখতে পাচ্ছে না। ভয়ে জড়সড় হয়ে চোখ মেলতেই সব দৃশ্য ছায়ার মতো যেন মিলিয়ে গেল।

চুনীদাসী ঠিক তেমনি করেই কোলে মাথাটা নিয়ে বসে আছে।

বৃন্দাবনও সামনে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। বললে—ওই চোখ চেয়েছেন শালাবাবু।

চুনীদাসীও নিচু হয়ে মুখের কাছে মুখ এনে বললে—এখন

একটু আরাম হচ্ছে ভালোমানুষবাবু?

ভূতনাথ বললে-ছোটকর্তা এসেছিল না?

—কোথায়! না তো-স্বপ্ন দেখছো তুমি। তুমি ঘুমোও, ঘুমোবার চেষ্টা করো।

বৃন্দাবন হঠাৎ বললে—আচ্ছা শালাবাবু, ছোটকর্তাকে একবার নিয়ে আসতে পারেন না এখানে, একদিন শুধু আসবে—একবার।

ভূতনাথ অভিভূতের মতো হাঁ করে চেয়ে রইল বৃন্দাবনের দিকে।

বৃন্দাবন আবার বললে-একবার যদি নিয়ে আসতে পারেন শালাবাবু তো আপনার জীবনে খাওয়া-পরার ভাবনা থাকবে না আর।

চুনীদাসীও বললে—এই দেখছে তো ভালোমানুষবাবু, এই ঘরবাড়ি, আমার গয়নাগাঁটি—সব তোমার হবে।

বৃন্দাবন বললে—ছোটমা আপনাকে আর কী দিয়েছে শুনি? এত যে করেন তার জন্যে, ভালো করে তো খেতেও দেয় না শুনেছি। কেন ওখানে পড়ে আছেন—ওই যে ছোটমা’র সক সম্পত্তি, ও-সব নেবে বংশী, মদ তত ধরিয়েছে, এখন মদের মুখে বেহুশ করে সিন্দুক খুলে সব নেবে আজ্ঞে।

চুনীদাসী বললে—আর এক কাজ করতে পারে না, ছোটবৌঠানের সঙ্গে তো তোমার খুব ভাব—একদিন একটা কিছু খাইয়ে শেষ করে দেবে একেবারে জন্মের মতো সাধ মিটে যাবে।

বৃন্দাবন বললে তার দরকার নেই, আপনি একবার ছোটকর্তাকে, আনবেন এখানে, আমি শুধু এক গেলাশ সরবৎ খাওয়াবে তাকে। এবার নতুন একরকম সরবৎ—সে খেলে আর বাড়ি ফিরতে মন চাইবে না।

এত সব কথা। কথা আর প্রশ্ন। ভূতনাথের মাথাটা আবার ঘুরতে লাগলো। চোখ বুজতেই আবার সেই সব দৃশ্য। চুনীদাসী এবার গায়ের ওড়না, ঘাঘরা, কঁচুলী সব খুলে ফেলেছে। পায়ে শুধু ঘুঙুর। ঘুরে ঘুরে উদ্দাম হয়ে নাচছে। ঘোরবার সঙ্গে সঙ্গে মাথার বেণীটা উচু হয়ে হয়ে ঘুরতে শুরু করেছে। ছোটকর্তা গড়গড়া থেকে মুখ নামিয়ে আর একবার গেলাশে চুমুক দিলে। এমন সময় যেন হুড়মুড় করে পুলিশের দল ঘরে ঢুকে পড়লো। বললে—ভূতনাথবাবুকে খুন করেছে কে? তারপর আবার যেন মনে হলো ছোটকর্তার হাতে হাতকড়া বাঁধা, চুনীদাসীর হাতে হাতকড়া বাঁধ, বৃন্দাবনের হাতে হাতকড়া বাধা, সকলকে পুলিশে ধরেছে! হঠাৎ আবার চোখ খুললো ভূতনাথ। চুনীদাসী তখনও তার মাথাটা কোলে নিয়ে তেমনি বসে আছে।

আর বৃন্দাবন দাঁড়িয়ে আছে মুখ গম্ভীর করে, আর তার পাশে রয়েছে মধুসূদন। বড়বাড়ির তোষাখানার সর্দার মধুসূদন। লোচন, শ্যামসুন্দর আর বেণী!

ভূতনাথ কেমন অবাক হয়ে গেল। ওরা এখানে কেন?

মধুসূদন বললে—যদি পারে কেউ তো শালাবাবুই পারে, শালাবাবুর সঙ্গে ছোটমা’র খুব মেলামেশা। এই তো ছুটুকবাবুর বিয়ের সময় ছোটমা’ই শালাবাবুকে কাপড়-জামা-জুতো দিয়েছে, অথচ দেখো না, আমরা এতদিন কাজ করছি, আমাদের বেলায় শুধু একখানা করে ধুতি আর গামছা।

লোচন বললে—আমি বলার মধ্যে বলেছিলাম, দৈনিক একটা করে আধলা—আর মিনি পয়সায় তামাক খেয়ে যাবে—যেমন সবাই খায়—বড়লোকের পয়সা-কে হিসেব রাখে—তাই-ই রাজী হলেন না শালাবাবু, ছোটমা’র কাছে শুনেছি পচ শ’ টাকা জমা রেখেছে, বংশী নিজে বলেছে আমাকে।

বৃন্দাবন বললে—আচ্ছা, মধুসূদন কাকা, ছোটমা’কে মদ ধরালে কে?

মধুসূদন বললে—ওই বংশী, বংশী আর ওর বোন চিন্তা—সব্বনাশ তো ওরা দুজনেই করছে।

লোচন বললে—সব্বনাশের আর বাকি আছে কি।

বৃন্দাবন বললে—তা গাড়ি কেন বেচে দিলে মেজবাবু?

বেণী বললে—ও-গাড়ি মেজবাবুর পছন্দ হলেনি যে, বিলেত থেকে নতুন গাড়ি আসছে যে বাবুর জন্যে।

মধুসূদন ধমক দেয়–তুই থাম, জানিস তো সব, এবার সুখচরের প্রেজার বসিয়ে দিয়েছে একেবারে। ছুটুকবাবুর বিয়েতে কেউ নজর দিতে এল না, কত গিয়ে বললাম—ধন্না দিলাম দোরে দোরে, বললে-বিলের জল শুকিয়েছে আজ দশ সন, গেল বছরে বাঘ এসেছিল বাদায়, ধনে পেরাণে মরছি আমরা খেয়াল নেই তোমাদের, বলে গিয়ে নায়েববাবুকে পেয়াদার পো, আমরা বাঁচলি জমিদারের নাম। মেজবাবু সব শুনে বললে—এবার আমি নিজে যাবো, চাবুক নিয়ে যাবো।

বৃন্দাবন বললে—যাবে নাকি মেজবাবু?

—মেজবাবু আর যেয়েছে। সরকার মশাই বললেও মেজবাবু গেলেও যা হবে, না গেলেও তাই হবে।

বৃন্দাবন জিজ্ঞেস করে–কী হবে?

–কলা হবে-বলে বুড়ো আঙুল উঁচু করে দেখায়। বলে— আমার কি, আমি গিয়ে উঠবে নিজের ঘরে, সুখ-ভাত কপালে

থাকে দুখ-ভাতই খাবো। কলকাতার আর সে-সুখ নেই বিন্দাবন, আমার জ্যাঠা আসতো এখানে, রথের সময় ফিরে গিয়েছে চার কুড়ি পাঁচ কুড়ি টাকা নিয়ে। যেবার সেপাইরা ক্ষেপে উঠলো কলকাতায় বারাকপুরে, সেবার কত সস্তায় জমি-জমা কিনলে, পুকুর কাটালে, তুলসীমঞ্চ করে দিলে আমাদের গাঁয়ে, সাত দিন যজ্ঞি হলো বাড়িতে।

লোচন বললে—কেন, বড়বাড়িতেই কি কম সুখ ছিল নাকি–বড়বাবু তখন বেঁচে, সকালবেলা কুস্তিটুস্তি করে এসে সবে বসেছে নাচঘরে, আমি বেশ করে তামাক সেজে দিয়েছি গড়গড়ায়, মেজাজ ভালো ছিল—সন্ধ্যেবেলা বখশিশ হয়ে গেল এক টাকা—এখন শুধু শুখো মাইনে।

বৃন্দাবন হতাশ হয়ে যায়। বলে—চুনীদাসীকে তুই বুঝিয়ে বল তো-ও যে অত ছোটবাবু ছোটবাবু করে—ছোটবাবু ছাড়া কি আর বাবু নেই কলকেতা শহরে। এই তো ঠনঠনের ছেনি দত্তর ছেলে নটে দত্ত রয়েছে—আসবে বলেছে আমাকে—কিন্তু ও কেবল বলে—ছোটবাবু।

মধুসূদন বলে–ছোটবাবুতে আর শাস নেই রে, যেটুকু আছে বংশীই সব খেয়ে নেবে—দেখিস।

ভূতনাথ আবার চোখ বুজলো। যেন সব গোলমাল হয়ে যায় আবার। মনে হয় যেন সে স্বপ্ন দেখছে। যেন সে শুয়ে আছে ছোটবৌঠানের ঘরে। ছোটবৌঠানের তখন বেসামাল অবস্থা। টানছে কেবল ভূতনাথকে। বলে—ছোটকর্তা যদি জানবাজারে যায়—আমিও থাকবে না বাড়িতে। কোথায় যাবি বল তো ভূতনাথ, বরানগরের বাগানবাড়িতে যাবি! খড়দ’র রামলীলার মেলায়? গঙ্গায় বেড়াবি পানসিতে চড়ে? তারপর হঠাৎ যেন খানিকটা আতর ঢেলে দিলে ভূতনাথের গায়ে। তারপর চিরুণী দিয়ে চুলটা আঁচড়ে দিলে। তারপর বোতল থেকে খানিকটা ঢেলে গেলাশটা বাড়িয়ে দিলে ভূতনাথের দিকে। বললে—খা, একটু চেখে দেখ।

ভূতনাথ বললে—খাবো না আমি, বমি আসবে।

-কিচ্ছু হবে না, ওরকম আমারও হতো, একটু একটু অভ্যেস কর, সব ঠিক হয়ে যাবে।

–কিন্তু কার ওপরে রাগ করে নিজের এমন সব্বনাশ করছে। বৌঠান?

—দূর, রাগ হতে যাবো কেন, দেখবি এ-খেলে আর রাগ দুঃখ কিছু থাকে না, মনে হবে তোর সব আছে, মনে হবে তোর ছেলে

আছে, সংসার আছে, স্বামী আছে—

হঠাৎ বাইরে যেন কার জুতোর মশ মশ আওয়াজ হলো। সবাই সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছে। বৃন্দাবন এক মুহূর্তে বাইরে গিয়েই আবার দৌড়ে ফিরে এসেছে ঘরে।

চুনীদাসী জিজ্ঞেস করলে—কে? কে আসছে?

-ছেনি দত্তর ছেলে নটে দত্ত, পালাও মধুসূদন খুড়ো, যা লোচন, তোর যা এ-ঘর থেকে—কালকে দত্তমশাইকে আসতে বলেছিলাম কি না?

কথাটা শুনেই চুনীদাসী ভূতনাথের মাথাটা কোল থেকে নামিয়ে দিলে। তারপর দু’হাত দিয়ে খোঁপাটা ঠিক করে নিতে নিতে বললে—ভালোমানুষবাবুকে ঘর থেকে সরিয়ে নিয়ে যা তো বিন্দাবন!

Category: সাহেব বিবি গোলাম
পূর্ববর্তী:
« ২৮. বংশী দেখতে পেয়েই দৌড়তে
পরবর্তী:
৩০. নটে দত্তকে ভূতনাথের এই প্রথম দেখা »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑