১৫. জহুরি দণ্ডপথ আর রঙ্গি হিরে

১৫. জহুরি দণ্ডপথ আর রঙ্গি হিরে

রবি বুঝি সেদিন হীরক-মদিরায় হুঁশ হারিয়ে ফেলেছিল। নইলে অত গোপন কথা অমন গড়গড়িয়ে বলে যাবে কেন?

গুজরাতি জহুরিদের বাক্য-বর্ষণকে ও র্যাপিড-ফায়ার বচনমালা বলেছিল। কিন্তু ওর নিজের মুখবিবর থেকেই কথার বুলেট বেরিয়ে আসছিল মেশিনগানের বুলেট বর্ষণের মতো।

ইন্দ্র, জহুরি দণ্ডপথ লোকটা যে বালি-হিরের কারবারে এক্সপার্ট, সেটা জেনে গেলাম দালালের মারফত। এই এক যুগ এসেছে ইণ্ডিয়ায়! দালালদের যুগ। তুই যা চাস, তাই পাবি, শুধু দালাল নামকশিবানুচরদের খুশি রাখতে হবে। শিবের অনুচর বলতে কাদের বোঝাচ্ছি, তা নিশ্চয় তোকে বুঝিয়ে দিতে হবে না।

যাগগে, যাকগে, জহুরী দণ্ডপথ লোকটা গলির গলি তস্য গলির মধ্যে একটা ছোট কিন্তু যেন গান-মেটাল দিয়ে সুরক্ষিত ঘরে বসেছিল মেঝের লিনোলিয়াম। কার্পেটে। সামনে একটা মামুলি কাঠের ডেস্ক-রাইটিং ডেস্ক-যে রকম ডেস্ক আমাদের ঠাকুরদাদাদের আমলে দেখেছি—তবে এই ডেস্কে রাইটিং মেটিরিয়াল কিসসু থাকে না—শ্বেতভুজা সরস্বতীর প্রবেশ এখানে নিষেধ—থাকে শুধু মা। লক্ষ্মীর চরণ বন্দনা করবার মতো অবিকল বালির সাইজে রঙিন হিরে।

আসছি, আসছি, রঙিন হিরের অবিশ্বাস্য বর্ণনায় আসছি। সে বর্ণনা শুনলে তোর প্রত্যয় হবে না জানি, তবুও বলে যাব। তার আগে শুনে রাখ, ছোট্ট এই ঘরটার প্রতিবর্গ ইঞ্চির ওপর নজর রেখে চলেছে বেশ কয়েকটা ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা আর টিভি। চার দেওয়ালের ওপরের কোণে শুধু দেখা যাচ্ছে তাদের লেন্সের ঝিকিমিকি। বুঝে নিলাম, বিবররাসী এই ব্যক্তির চারদিকে তাগ করে রয়েছে বেশ কয়েকটা আধুনিকতম আগ্নেয়াস্ত্র-সাইলেন্সারের দৌলতে যারা বুলেটের ঝড় বইয়ে দিতে পারে-নীরবে নিঃশব্দে।

অধীর না হয়ে কান পেতে শুনে যা, ইন্দ্র। আমার জীবন বড় বাঁক নিয়েছিল এই ঘরে… অথবা, এই ঘরের পিছনকার জহর কারখানায়।

জহুরি দণ্ডপথ লোকটাকে মূর্তিমান ইন্দ্র বলা যেতে পারে… চমকে উঠলি? আরে বাবা, ইন্দ্র যে সহস্র চক্ষুর অধিকারী, তা তো একটা বাচ্চা ছেলেও জানে… এই মানব-ইন্দ্র, ইয়ে, মানবেন্দ্রর হাজার চোখ গজিয়েছে মেয়েছেলে দেখে দেখে নয়—স্রেফ হিরে দেখে দেখে।

বয়স যথেষ্ট হয়েছে। অথচ সুপুরুষ। গুজরাতিরা বোধহয় যাদবকুল থেকে এসেছে। তাই শ্রীকৃষ্ণের অঙ্গকান্তি পেয়েছে পুরোমাত্রায়। তবে মনে হয় শ্বেতসুধায় স্নান করে আসার দরুণ অর্জন করেছে অমন ধবল বরণ। দণ্ডপথ সদাহাস্যময়। জহর বণিক। হাসি তাঁর চোখের তারায় যা কালো হিরে বলেই মনে হয়—হাসি ঠোঁটে, কথাবার্তা এতই মিষ্টি যে, মনে হয় শুকনো চিড়েও ভিজিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।

আমার এই মারকাটারি ফিগার দেখে এতটুকু ভড়কে না গিয়ে আমার বচন আর অভিপ্রায় ধৈর্য সহ শ্রবণ করলেন। তারপর ওই কাঠের ডেস্কের ডালা খুলে, আমাকে ভেতরের বস্তু না দেখিয়ে, একে একে বের করলেন রুপোর বাটি।

এক-একটা বাটিতে এক-এক রঙের হিরে। সাইজে বালির দানার চাইতে বড় নয়। কিন্তু প্রতিটা বাটি থেকে ঠিকরে আসছে রামধনুর এক-একটা রং। সংক্ষেপে যাকে আমরা বলি ভিবগিওর—ভায়োলেট, ইণ্ডিগো, ব্লু, গ্রিন, ইয়োলো, অরেঞ্জ, রেড।

আমি, ইন্দ্রনাথ, আমি শ্রী রবি রে, চোখের তারা নিশ্চয় স্থির করে ফেলেছিলাম সেই অবর্ণনীয় বর্ণচ্ছটা দেখে।

জহুরি দণ্ডপথ তখন ঈষৎ হাস্য করেছিলেন।

আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, সাদা হিরে কোথায়? আসলি হিরে? এ তো সব রঙিন কাচ।

জহুরি দণ্ডপথ তারিয়ে তারিয়ে রসিয়ে রসিয়ে বলেছিলেন, মাই ডিয়ার বেঙ্গলি ফ্রেণ্ড, সাত রঙের হিরে মিশিয়ে দিলেই সাদা রঙের হিরে হয়ে যায়। এই দেখুন, বলে, ডেস্কের ভেত্র থেকে বের করেছিলেন অষ্টম বাটি—যে বাটিতে রয়েছে শুধু সাদা বালি-হিরের বালি।

আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কালো হিরে কই?

অমনি নবম বাটি বেরিয়েছিল ডেস্কের অন্দর থেকে। তাতে থই থই করছে, খুক খুক করছে কালো হিরের বালি।

হিরের চোখ নাচিয়ে জহুরি দণ্ডপথ তখন আমাকে যে হিরে-বন্দনা শুনিয়েছিলেন, তার সবটা গুছিয়ে তোকে বলতে পারব না। শুধু শুনে রাখ, এই বিশ্বে, এই ব্রহ্মাণ্ডে অযুত নিযুত সূক্ষ্ম শক্তি অজস্র বর্ণ নিয়ে খেলে বেড়াচ্ছে। মানুষের শরীর-মন-ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করছে। অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা প্রয়োগ করে এই সূক্ষ্ম শক্তিদের এক-একটা হিরের কাঠামোয় ধরে রাখা হয়েছে। এ শক্তি আছে শুধু জহুরি দণ্ডপথের। তিনি তা অর্জন করেছেন প্রাচীন পুথিতে লেখা মন্ত্রশক্তি দিয়ে। সে পুঁথি তিনি পেয়েছেন তিব্বতে।

আমি নিজে সেলসম্যান। সেলস টক দিয়ে আমাকে ভাওতা মারা যায় না। আমরা পুঁদে সেলসম্যানরা, বলেই থাকি, এক সেলসম্যান আর এক সেলসম্যানকে ঠকাতে যায় না।

তাই মনে হল, জহুরি দণ্ডপথ সত্য বলছেন।

কথা বাড়ালাম না। শুধু জানতে চাইলাম, এমন খুদে হিরে কাটাই হচ্ছে কোথায়? আটান্ন দিক তুলছে কারা?

জহুরি দণ্ডপথ আমার চোখে চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। তারপর মধুর হেসে বললেন, ইয়ংম্যান, যদি তাদের কাউকে পছন্দ হয়, তাহলে দেখাতে পারি।

আমি অবাক গলায় বলেছিলাম, আমি হিরে পছন্দ করতে এসেছি, হিরে কাটিয়েদের নয়। কিন্তু আটান্ন দিক কেটে বের করছে যারা, তাদের দেখার ইচ্ছেটা আছে।

দণ্ডপথ বললেন, তারা মনের মানুষদের মন কেটে আটান্ন দিক বের করতে পারে।

হেঁয়ালি বুঝলাম না। শুধু চেয়ে রইলাম।

দণ্ডপথ তখন যা বললেন, তা পরে বলছি। তবে… কল্পনা চিটনিসকে প্রথম দেখলাম সেই হিরে কারখানায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *