2 of 2

৭৮. সানফ্লাওয়ারের শীততাপনিয়ন্ত্রিত বিশাল রিসেপশন

আজকাল প্রায়ই সানফ্লাওয়ারের শীততাপনিয়ন্ত্রিত বিশাল রিসেপশন ঘরে বুলু অর্থাৎ সোমনাথ এসে বসে থাকে দীপনাথের জন্য। কেন আসে তা জানে বলেই দীপনাথ বিরক্ত হয়। বুলু টাকার গন্ধ পেয়েছে। প্রায়ই বাবার নাম করে টাকা চায়। বলে, বাবার পুরনো চশমাটায় চলছে না। আমার অবস্থা তো জানোই। বাবা তোমারও। নিত্যি নতুন অজুহাত।

বুলুর বয়স বেশি নয়। ত্রিশের মধ্যেই। কিন্তু এর মধ্যেই জুলপি পেকেছে। চেহারায় সুস্পষ্ট মধ্যবয়সের ছাপ। দীপনাথের চেয়ে বয়সে চার-পাচ বছরের বড় বলে মনে হয়। কম বয়সে বিয়ে করলে কি মানুষ তাড়াতাড়ি বুড়োটে মেরে যায়?

বম্বে থেকে একটা শট কোর্সের ট্রেনিং সেরে ফিরে এসে প্রথম দিন অফিসে পা দিয়েই রিসেপশনে বুলুকে দেখতে পায় দীপনাথ। বিরক্ত হতে গিয়েও হল না। থমকে দাঁড়িয়ে চেয়ে রইল। বুলুর পোশাক আজ অন্যরকম। পরনে ধড়া, চুল এলোমেলো, গালে অল্প একটু দাড়ি। দীপনাথকে দেখে উঠে কাছে এল।

আবেগহীন গলায় দীপনাথ বলে, বাবা?

বুল মাথা নাড়ে, আজ সাত দিন।

দীপনাথ কোনও শোক বোধ করে না, বুকে কোনও কান্নার ঢেউ ভাঙল না, হাহাকারে ভরে গেল ভিতরটা। তবু একটা কিছু হল। হঠাৎ বড় খাঁ খাঁ লাগল চারদিক। শিলিগুড়ির কলেজপাড়ায় মস্ত একটা গাছের তলায় তারা আড্ডা মারত। সেই গাছটা কেটে ফেলার পর জায়গাটা অদ্ভুত ন্যাড়া আর করুণ দেখাত। চারদিকটা এখন অনেকটা ওইরকম। কী যেন ছিল, এখন নেই। তবে দীননাথ কোনওদিনই বটবৃক্ষের মতো তাঁর তার সন্তান-সন্ততিকে আড়াল করে ছিলেন না। গাছের কথাটা দীপনাথের মনে এল শুধু ওই থাকা না-থাকার তফাতটুকুর জন্য।

বুলু কাপড়ের খুট তুলে চোখে চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে উঠল। সানফ্লাওয়ারের দু’জন যুবতী রিসেপশনিস্ট দৃশ্যটা দেখছিল। বুলুর কান্না দেখে দীপনাথেরও ঠোঁট একটু কেঁপে উঠেছিল অজান্তে। সেটা প্রিটেনশনও হতে পারে। মা বাপ মরলে কাদা উচিত এই সংস্কার থেকে। কিন্তু রিসেপশনিস্ট দু’জনের দিকে চেয়ে সামলে গেল দীপনাথ। গলার স্বর নামিয়ে প্রশ্ন করল, সবাইকে খবর দেওয়া হয়েছে?

বুলু পাজি হতে পারে, কিন্তু বাবার শোকে তার কান্নায় কোনও প্রিটেনশন নেই। ক’দিনে সে যে অনেক কেঁদেছে তার সুস্পষ্ট ছাপ তার ফোলা মুখে। এখনও চোখ দুটি জলে ভরা, লাল। কথা না বলে মাথা নাড়ল সে, খবর দিয়েছে।

বিলুকে?

হ্যাঁ।

তুই একটু বোস। আসছি।

সানফ্লাওয়ারে দীপনাথের কোনও চেম্বার নেই। বড় হলঘরের মধ্যে একটু উঁচু কাঠের পাটাতনের মতো আয়ল্যান্ড অফিসারদের জন্য। এ রকম আয়ল্যান্ডের একটা দীপনাথের। সে তার দ্বীপটিতে উঠে চারদিকে একবার তাকাল। ভারী নিস্তব্ধ পরিচ্ছন্ন আধুনিক অফিস। রোজই সে এই অফিসটার আভিজাত্য লক্ষ করে এবং খুশি হয়। আজ এই শশাকের দিনেও হল। নিজের চেয়ারে মিনিট দুয়েক নিস্তব্ধ হয়ে বসে রইল সে। তারপর ব্রিফকেস খুলে কিছু জরুরি কাগজপত্র ফাইলে রেখে ডসন নামে তার ওপরওয়ালা সাহেবকে একটা ফোন করল। না, লম্বা ছুটি চাইল না সে। শুধু আজকের দিনটা। শ্রাদ্ধ আর ঘাট কাজের জন্য আরও দুদিন নেবে সেটাও জানিয়ে। রাখল।

ডসন তার অদ্ভুত গভীর কণ্ঠস্বরে মার্কিন উচ্চারণে বলল, ইটস ওকে। আই সিমপ্যাথাইজ।

ফোন করার পরও কিছুক্ষণ বসে থাকে দীপনাথ। সে এত স্বাভাবিক কেন তা বুঝতে পারছিল। সে তো আলবেয়ার কামুর নিস্পৃহ নায়ক নয়। ভেতো ভাবপ্রবণ বাঙালি। সত্য বটে, সে মানুষ হয়েছে পিসির কাছে, বাবার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল না, তবু বাবা তো! বুলুর মতো সে কেন কেঁদে উঠছে না?

নিজের জন্য নিজের কাছেই লজ্জা করছিল তার। অ্যাসিস্ট্যান্টকে ডেকে কাজকর্মের কিছু পরামর্শও দিল সে। খুবই স্বাভাবিকভাবে। বাবার মৃত্যুসংবাদটা সে অবশ্য প্রচার করল না।

বাইরে এসে দেখে, বুলু বসে সিগারেট ফুঁকছে। তাকে দেখেই তটস্থ হয়ে পেতলের স্ট্যান্ডওয়ালা ডাবরের মতো মস্ত অ্যাশট্রেতে সেটা ফেলে উঠে দাঁড়াল।

দীপনাথ শোক টের পাচ্ছে না ঠিকই। কিন্তু চারদিকে খাঁ খাঁ ভাবটা রয়েছে এখনও। ট্যাক্সিতে বসেও সেটা টের পাচ্ছিল। ভীষণ বৃষ্টি গেছে ক’দিন। উজ্জ্বল রোদ। ভ্যাপসা গরম। বুলুর গা থেকে কোরা কাপড়ের গা-গোলানো গন্ধ আসছে। বাবা নেই। প্রীতমও আর একভাবে নেই। মণিদীপাকে সে নিজেই দূরের মানুষ করে দিয়েছে। এই তত ভাল দীপনাথ! আস্তে আস্তে ঝরে যাচ্ছে পাতা। রিক্ত হয়ে যাচ্ছে। এবার একদিন পাহাড়ের দিকে মুখ ঘোরাবে। তারপর চলতে থাকবে। পর্বতের তো মৃত্যু নেই। নিরুদ্দেশও হয় না।

বুলুর দু’শরের বাসাটা খুবই ছোট। ভারী ঘিঞ্জি। বাইরের ঘরে একটা চৌকির ওপর শ্রীনাথ বসে আছে। চেহারাটা ভেঙেচুরে বিচ্ছিরি হয়েছে। ফর্সা গালে কাঁচা পাকা দাড়ি। চোখের কোলে জল ছিলই, দীপনাথকে দেখে বাবা নেই রে’ বলে ড়ুকরে কেঁদে উঠল।

বুলু চাপা গলায় বলে, মেজদা খুব ভেঙে পড়েছে। গত তিনদিন ধরে এখানেই আছে। সমানে কঁদিছে।

বউদি আসেনি?

প্রথম দিন খবর পেয়ে এসেছিল।

দীপনাথ জুতো ছাড়ল, তারপর গিয়ে শ্রীনাথের পাশে বসে গায়ে হাত রেখে বলে, কেঁদো না! কান্নার কী আছে! বুড়ো বয়সে বেঁচে থাকাও তত কষ্টের।

এই বলতে বলতেই দীপনাথের চোখে জল এসে গেল। এইটুকুর ভারী দরকার ছিল, নইলে ‘ওরা ভাবত, দীপনাথ বাবার জন্য দুঃখ পায়নি। চোখের জলটা সে রুমালে মূছল না। সবাই দেখুক।

কিন্তু কাঁদতে কাঁদতেও দীপনাথের যুক্তিবাদী মনে প্রশ্ন আসে। মেজদা শ্রীনাথ কি বাবাকে এতই ভালবাসত! কই, কখনও তো মনে হয়নি। বরং নিজের বাবা সম্পর্কে শ্রীনাথের ছিল নিষ্ঠুর উদাসীনতা। তবে এই কান্না আসছে কোথা থেকে? কেন এত শোক?

আসলে দুর্বলচিত্তরা অন্যের দুর্দশা, ব্যথা বা মৃত্যু দেখে নিজের দুর্দশা, ব্যথা বা মৃত্যুর ভয়ে ভেঙে পড়ে, কেঁদে আকুল হয়। এর সঙ্গে শোক বা ভালবাসার সম্পর্কই নেই। সবটাই আত্মকেন্দ্রিক।

কাঁদতে কাঁদতে হিক্কার মতো অদ্ভুত শব্দ করছিল শ্রীনাথ। মাঝে মাঝে বাবা, বাবা গো’ বলে আর্তনাদ। একবার মনে হল শ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে বুঝি!

শমিতাকে খুব ভাল করে কখনও লক্ষ করেনি দীপনাথ। দেখাও হয়েছে কম। বেশ টান টান শ্যামলা।

এইরকম একটা সংকট সময়ে শমিতা একটা ছবি আঁকা টিনের ট্রে-তে চা নিয়ে এল। কিশোরী চেহারা। মুখটার মধ্যে শ্ৰী আছে বটে, তবে বড় রোখা-চোখা মনে হয়। বুদ্ধি রাখে কিন্তু হয়তো সবটাই সদ্ধি নয়। দীপনাথ শুনেছে এই মেয়েটাই নেপথ্যে থেকে সোমনাথকে পরিচালনা করে। মেয়েটির মুখচোখ দেখে কথাটা আবশ্বাস্য মনে হয় না। মেজোবউদির সঙ্গে এদের তুমুল আড়াআড়ি! কিন্তু দীপনাথ বুঝল, শমিতা যতই চালাক চতুর হোক, মেজোবউদির সঙ্গে পাল্লায় কিছুই নয়। বুদ্ধি ছাড়াও মেজোবউদিব আর যে জিনিসটা আছে তা হল প্রবল ব্যক্তিত্ব। তা শমিতা কোথায় পাবে?

শমিতা ভারী যত্নে চা হাতে তুলে দিল। মাথায় ঘোমটাটি ঠিক মতোই টানা। ট্রে-টা একটা টেবিলে রেখে আচলে মুখ ঢেকে একটু কাঁদল। এই কান্নাটাকে খুব ফাকি বলে মনে হল না দীপ্যাথের। বাবা তো এরই হেফাজতে ছিল বহু দিন! বেড়াল পুষলেও মায়া হয়, দীননাথের মতো ঝামেলাহীন সাদামাটা মানুষের ওপর মায়া পড়তেই পারে।

কিন্তু এই সব কান্নাকাটি আর সহ্য হচ্ছিল না দীপনাথের। সংসার থেকে দূরে সরে থাকায় এইসব শোকদুঃখের সঙ্গে তার বেশি পরিচয় নেই। ভারী অস্বস্তিকর! গরম চায়ে তাড়াতাড়ি চুমুক দিতে দিতে সে বলল, শমিতা, আমি স্নান করব। তোমাদের বাথরুমে জল আছে?

আছে। সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

আর কোরা কাপড় চাই। কাছাকাছি দোকান-টোকান থাকলে বুলু বরং গিয়ে কিনে আনুক। টাকা দিচ্ছি।

বুলু বলল, ঘরের কাছেই দোকান।

দীপনাথ একশো টাকার নোট বের করে দিয়ে বলল, কী কী লাগে জানি না! সব আনিস। আর বিলুকে খবর দেওয়া হয়েছে তো?

হয়েছে। বিলু আসে প্রায় রোজই।

শ্রাদ্ধ কোথায় হবে?

বুলু কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, আমার অবস্থা তো জানো। আমি কালীঘাটেই করব ভাবছিলাম।

আলাদা করবি?

বুলু একটু হতচকিত হয়ে অসহায় গলায় বলে, একসঙ্গে করার কথা কেউ তো বলেনি।

দীপনাথ একটু বিরক্ত হয়ে বলে, এই তো আমিই বলছি।

তুমি বলছ!–বলে চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে থাকে বুলু।

শ্রীনাথ কান্না সামলে ধরা ভাঙা গলায় বলে, রতনপুবে যদি সবাই মিলে করি? বুলুর কি আপত্তি হবে?

বুলু ক্ষীণ একটু হাসির চেষ্টা করে বলে, তুমি বরং বউদির মতটা নাও। আমি গরিব মানুষ, তার ওপর তোমাদের ছোট, যা বলবে তাই করব।

অত লক্ষ্মী ছেলে অবশ্য বুলু নয়। তবু সে মত দেওয়ায় খুশি হল দীপনাথ। কিন্তু বুলু একটু চুপ করে থেকে আর-একটি যে কথা বলল তাতে খুশিটা কেটে গেল।

শমিতার দিকে একবার চেয়ে নরম গলাতেই বুলু বলল, রতনপুর তো আমাদের সকলেরই জায়গা। বাবারও খুব ইচ্ছে ছিল, সবাই মিলে সেখানে গিয়ে থাকি।

দীপনাথ গম্ভীর মুখে স্নান করতে গেল। ফিরে এসে ধড়া পড়ল। আসন পেতে বিছানায় বসল শ্রীনাথের পাশে। কিছুই আর করার নেই।

শমিতা এসে জিজ্ঞেস করে, সেজদা কি ভাত খেয়ে বেরিয়েছেন?

না। শুধু ব্রেকফাস্ট। দুপুরে অফিসেই লাঞ্চ খাওয়ার কথা।

তা হলে সকলের জন্যই হবিষ্যি চাপিয়ে দিই?

দীপনাথ মাথা নেড়ে বলল, না। আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।

তা হলে ফল কেটে দিই?

পরে দিয়ো।

স্নান করে এলেন, এখন তা হলে একটু কফি খান।

দীপনাথের এত আপ্যায়ন ভাল লাগছিল না। উদাস গলায় বলল, দাও।

কফি খাওয়ার সময় বুলু কথাটা তুলা, সেজদা, তুমি তো একসঙ্গে কাজ করার কথা বললে। কিন্তু কার কী রকম শেয়ার হবে, কাজই বা কেমন করা হবে সেসব তো জানা দরকার। আমার

অবস্থা তো জানোই।

দীপনাঙ্গ খুবই বিরক্ত বোধ করল। কিন্তু নিজের ওপর তার শক্ত নিয়ন্ত্রণ আছে বলেই রাগ দেখাল না। শান্ত স্বরে বলল, বাবার খবরটা এইমাত্র পেয়েছি, এখনই ওসব কথা ভাবতে ভাল। লাগছে না। পরে বলিস। খরচের জন্য ভাবনা নেই। বাবার জন্য তো আমি তেমন কিছু করিনি।

এ কথায় বুলুর শোকাতুর মুখেও কিছু উজ্জ্বলতা ফুটল!

শমিতা বলল, সেজদা তো মেসে থাকেন। সেখানে এসব নিয়ম পালনের অসুবিধা। আমি বলি, এই ক’টা দিন আপনি এখানেই থাকুন।

দীপনাথ মাথা নেড়ে বলল, না। রতনপুরেই যদি বাবার কাজ করতে হয় তবে আমাদের সকলেরই রতনপুরে চলে যাওয়া দরকার আজই।

বুলু বলে, কিন্তু বউদির মতামত?

বউদি অমত করবে না। বরং খুশি হবে।

এ কথায় শমিতা বা বুলু খুব সন্তুষ্ট হল না। নিজেদের মধ্যে একটা তাকাতাকি করে চুপ করে রইল।

সংসারের এই সব পরম্পর-বিমুখ চোরাস্রোত থেকে সরে থাকবার জন্যই দীপনাথ সারাটা দুপুর পড়ে ঘুমুল। ঘুমটার খুবই দরকার ছিল তার।…

তার শ্রাদ্ধ যে এত ঘটা করে হবে তা বোধ হয় দীননাথ স্বপ্নেও ভাবেনি। দীপনাথ আর তৃষা মিলে খুব কম করেও হাজার দশেক টাকা খরচ করেছে। বুলু শ’ দুই টাকা দিতে চেয়েছিল, নেয়নি। বাচ্চা যাড় থেকে শুরু করে খাট বিছানা ছাতা লাঠি কিছুই বাদ রইল না দানসামগ্রীতে। অন্তত সাতশোলোক নিমন্ত্রিত ছিল। দীননাথের ভাগ্য ভালই যে, আজ বৃষ্টিও হয়নি। সন্ধের কিছু পরে ফুটফুটে জ্যোৎস্নাও উঠেছে।

অনেক রাতে ক্লান্ত তিন ভাই আর বিলু ভাবন-ঘরে বসেছে। বহুকাল বাদে চার ভাই-বোন এই এক হওয়া। বিলু স্বভাবতই গম্ভীর, অথবা গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু দীপনাথের মনে হয়, প্রীতম নিরুদ্দেশ হওয়ায় যতটা দুর্ভাবনা বা উদ্বেগ থাকার কথা ছিল বিলুর ততটা নেই। অফিস করছে, অরুণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলছে। শুধু লোকের সামনে একটা গাম্ভীর্যের মুখোশ এঁটে নেয় মাত্র।

ছোট ভাই বুলু অনেক সুযোগ খোঁজার পর এই প্রায় রাত বারোটার কাছাকাছি সময়ে সুযোগ পেয়ে বলছিল, দাদার সম্পত্তি দাবি করে আমি হয়তো ঠিক কাজ করিনি। বউদির কাছে মাপ চাইতেও রাজি আছি। কিন্তু আমার অবস্থার কথা বিবেচনা করে যদি তোমরা সবাই মিলে একটা অংশ আমাকে দেওয়ার ব্যবস্থা করে তা হলে আমার খুব উপকার হবে।

দীপনাথ এই ব্যবস্থার ঘোর বিরোধী। সে মাথা নেড়ে বলে, তোর যখন যা দরকার আমাদের কাছে বলিস। সাধ্য মতো মেটানোর চেষ্টা করব। কিন্তু দাদার সম্পত্তির অংশ চাস কেন? দাদা যাকে ভাল বুঝেছে তাকে দিয়ে গেছে। এর ওপর আমাদের কোনও দাবি খাটে না।

দাবি করছি না তো। আর সব সময়ে তোমাদের গিয়ে ডিস্টার্ব করাও কি ভাল? মানুষ বিরক্ত হয়, খুশিমনে দেয় না। সে মায়ের পেটের ভাই হলেই কী!

এসব কথায় শ্রীনাথ বা বিলু যোগ দিচ্ছে না। চুপ করে বসে আছে।

দীপনাথ জিজ্ঞেস করে, তুই কী চাস? তোরা তো অল্প বয়সের দুটি স্বামী-স্ত্রী, বাচ্চাকাচ্চাও নেই, এখনই তোর এত অভাব কেন?

অভাব হলে কী করব বলো? বড়দা বেঁচে থাকতে আমাকে একবার বলেছিল, তুই রতনপুরে এসে থাক। তখন বিয়ে করিনি! ভাবলাম, গায়ে এসে থাকার মানেই হয় না। কিন্তু যদি থাকতাম তা হলে এই গোটা বিষয়সম্পত্তি আমারই হত।

দীপনাথ জানে, মল্লিনাথ বোকা ছিল না। সে আর যাকেই হোক কিছুতেই বুলুকে এই সম্পত্তি লিখে দিয়ে যেত না। তবে কথাটা বলল না দীপনাথ। ঘুরিয়েই বলল, তা যখন দিয়ে যায়নি তখন নিজের ভাগ্যকে মেনে নেওয়াই তো পুরুষের কাজ।

বুলু তবু ঘ্যান ঘ্যান করতে থাকে, আমি বেশি কিছু চাই না। বিঘে দশেক ধানি জমি, একটু বাজমি আর কয়েক হাজার টাকা। তা হলেই আমার হয়ে যাবে।

দীপনাথ একটু হেসে বলে, সেটাই কি এই বাজারে কিছু কম?

দাদার সম্পত্তির তুলনায় কিছুই নয়। এটুকু বউদি অনায়াসে ছাড়তে পারে।

দীপনাথ ধীরে ধীরে রেগে উঠছিল। সে হয়তো এ কথার একটা কড়া জবাব দিত। কিন্তু ঠিক এই সময়ে বাইরে একটা চেঁচামেচি শোনা গেল। সেই সঙ্গে খুব দৌড়োদৗড়ি।

পুরনো স্কুলবাড়ির দিকে তৃষা যে তিনতলা বাড়িটা তুলছে সেই দিকেই টর্চ আর লক্ষের আলো দেখা যাচ্ছে অনেক। খুব ভিড়ও।

পুরনো স্কুলবাড়ির কাছেই মল্লিনাথ একটা তিনতলা বাড়ির ভিত গেঁথে রেখেছিল। বাড়িটা করে যেতে পারেনি। প্ল্যান স্যাংশন করাই ছিল। ক্রমে সেটা আগাছায় ঢেকে যায় আর লোকে ভুলেও যায় সে কথা। ভোলেনি তৃষা। আচমকা সেই বন্যার পরই সে জঙ্গল সাফ করিয়ে খুব তাড়াতাড়ি বাড়ির কাজ শুরু করে দেয়। তিনতলা পর্যন্ত ছাদ ঢালাই হয়ে গেছে। এখন পলেস্তারা পড়বে, দরজা জানালা বসবে, মেঝেয় টালি পাতা হবে। অনেক কাজ বাকি। জ্যোৎস্নারাতে সেই অতিকায় অন্ধকার কাঠামোটা দাঁড়িয়ে থাকে পোডড়া বাড়ির মতো।

পরশু এখানে আসার পর থেকেই এই অসমাপ্ত বাড়িটা সম্পর্কে অসীম কৌতূহল শমিতার। বহুবার সে এসে ঘুরঘুর করে বাড়িটা দেখে। প্রতি তলায় তিনখানা করে শোওয়ার ঘর, ডাইনিং, ড্রয়িং, দুটো করে বাথরুম। একদম কলকাতার বড়লোকদের ফ্ল্যাটবাড়ির মতো ব্যবস্থা। কত টাকা যে খরচ হচ্ছে!

নিতাই খ্যাপা আবার তার মধ্যেই ইন্ধন জুগিয়ে এক ফাঁকে চুপি চুপি বলে গেল, ওই বাড়ির ভিতের নীচেই যে মল্লিবাবুর মেলা টাকা পোঁতা ছিল। বউদিমণি মাটি খুঁড়ে টাকা বের করেছে।

খুব বিশ্বাস না হলেও শমিতা জিজ্ঞেস করল, কত টাকা?

পাঁচ লাখ শুনেছি। মস্ত কাঠের বাক্স ভরা।

হতেও পারে। জমির দাম না ধরলেও এত বড় একটা বাড়ি করতে যে অনেক টাকার দরকার তা শমিতা জানে। এত সুন্দর ডিজাইন, এত ভাল প্ল্যানিং-এর বাড়িও বড় একটা দেখা যায় না। কাজ শেষ হলে বাড়িটা দেখতে হবে স্বপ্নের মতো।

এ বাড়ির তারা দু’টি মাত্র বউ। এই সম্পত্তি তাদের কারও স্বামীই অর্জন করেনি। মুফতে সম্পত্তিটা হাতিয়ে নিয়েছে মেজো জন। শমিতার সারা গা জ্বলে যায়। মাটির নীচে থেকে যদি সত্যিই এত টাকা পেয়ে থাকে তবে সেটা আরও একটা জ্বলুনির কারণ।

কাজের বাড়ির ভিড় পাতলা হওয়ার পর আবার কৌতূহলবশে হাঁটতে হাঁটতে জ্যোৎস্নায় এই স্বপ্নের বাড়িটার কাছে চলে এসেছিল শমিতা। এই রকম একটা বাড়ি যদি তার হত।

জ্যোৎস্নায় ধোয়া বাড়িটার চারদিকে বালি, পাথরের স্তৃপ, ইটের পাঁজা, বাঁশ, কাঠ। তার মধ্যে দাঁড়িয়ে বাড়িটার দিকে মোহাচ্ছন্ন দৃষ্টিতে চেয়ে ছিল সে।

এই সময় হঠাৎ সে দেখতে পেল, তিনতলার আলসের ওপর কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। কে? খুবই স্পষ্ট জ্যোৎস্না পড়েছে তার মুখে। তার চেয়েও বড় কথা, লোকটা মস্ত লম্বা, বিশাল চওড়া। পরনে সাদা পাজামা, বড় ঝুলের পাঞ্জাবি, বাবরি চুল।

প্রথমে বোবা হয়ে গিয়েছিল শমিতা। তারপর এক বিকট বিকারের গলায় চেঁচিয়ে উঠল, ভূত! ভূত! ভূত!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *