2 of 2

৭৫. আকাশে অনেক ওপরে

আকাশে অনেক ওপরে এক টুকরো অস্বাভাবিক মেঘকে দেখতে পেল শ্রীনাথ। মেঘটা গোল বলের মতো। রং লালচে। নীল আকাশ থেকে অনেকগুলো টুকরো মেঘের ভিতর থেকে এই অস্বাভাবিক গোল মেঘটা খুব দ্রুত বেগে নীচে নেমে আসছে।

খুব সঙ্গত কারণেই শ্রীনাথ বিপদের গন্ধ পাচ্ছিল। সে জানে এটা পৃথিবীর মেঘ নয়। এর জন্ম দূর মহাকাশে। আবহমান কাল ধরে মানুষের যত শত্ৰু পৃথিবীতে এসেছে এ তা থেকে আলাদা। খুব নিঃশব্দ যে মেঘ বা মেঘের ভ্রম নীচে আসছে তা আসলে একটা অতিকায় জলের ফেঁটা। ফেঁটা নয়, আসলে এক বিপুল জলের পিণ্ড। ঠিক আকাশের এক ফোটা অশ্রুর মতো দেখাচ্ছে।

দেখ-না-দেখ সেই জলপিণ্ড চলে এল কাছে! কী বিশাল তার ব্যাস! কী বিপুল তার আকার! স্তম্ভিত মূক হয়ে থাকতে হয় দৃশ্যটা দেখে। সর্বনাশ বটে, কিন্তু সেই সর্বনাশের বিশালতা দেখে কে

অতীত-ভবিষ্যৎ ভুলে যায়। বড় বিপদেরও এক প্রচণ্ড সম্মোহনশক্তি আছে।

জলের পিণ্ড এগিয়ে এল আরও কাছে। শ্রীনাথ ভেবেছিল খুব কাছেই কোথাও পড়বে। তা পড়ল না। যতক্ষণ ধরে শূন্য পেরোচ্ছিল ততক্ষণে আহ্নিক গতির বশে পৃথিবী একটু ঘুরে গেছে। তবু, খুব দূরে নয়, কাছেই কোথাও ঝম করে সেটা পড়ল। একটু কেঁপে উঠল কি পৃথিবী?

শ্রীনাথ চোখ বুজল। সমস্ত পৃথিবীকে ড়ুবিয়ে দেওয়ার পক্ষে ওই এক ফোটা জলই কি যথেষ্ট নয়? তবু চোখ খুলে সে দেখতে পায়, আকাশের সেই ঠিক একই জায়গায় আবার সেই একই রকম আর-এক ফোটা জল জন্ম নিল। নেমে আসতে লাগল।

ভাগ্যক্রমে শ্রীনাথ দাঁড়িয়ে আছে এক পাহাড়ের কোলে। দ্বিতীয় জলের ফোটা পৃথিবীতে পড়ার আগেই সে হামাগুড়ি দিয়ে উঠে যেতে লাগল ওপরের দিকে। পাহাড়চূড়ায় কয়েকটা খোড়ো ঘর, কিছু অসহায় মানুষ। শ্রীনাথ চূড়ার কাছাকাছি পৌঁছে ফিরে চেয়ে দেখল, এর মধ্যেই এত উঁচু পাহাড়টার অর্ধেকেরও বেশি জলের গ্রাসে চলে গেছে। আর-এক ফেঁটা জল পড়লে বাকি অর্ধেকও যাবে।

বাকি অর্ধেকও যাচ্ছিল। শ্রীনাথ চেয়ে থাকতে থাকতেই ঝম করে দ্বিতীয় জলপিণ্ডটাও নেমে আসে। অমনি নীচের জলরাশি বিপুল গর্জনে, ফেনায়িত অসম্ভব উঁচু ঢেউ তুলে ধেয়ে আসে ওপরের দিকে। নোংরা ঘোলা ক্ষুব্ধ ক্রুদ্ধ জলে ভাসছে মানুষের শব, ঘর, বাড়ি, তৈজসপত্র।

তবু শান্ত ধ্যানমগ্ন নীলিমায় ফের আর-এক ফোটা জল জন্ম নেয়। দেখে শ্রীনাথ। আর আতঙ্কে নীলবর্ণ হয়ে চেঁচাতে থাকে, কী হল? কী হচ্ছে আঁ!

ঠিক এই সময় তাকে ঠেলে তোলে সজল, বাবা! ও বাবা! কী হয়েছে?

ঘুম ভেঙে শ্রীনাথ উঠে বসে তড়াক করে। স্বপ্নের ঘোর এখনও কাটেনি।

বাইরে কি বৃষ্টি হচ্ছে?— সে জিজ্ঞেস করে।

সজল অবাক হয়ে বলে, হচ্ছে তো। রাত থেকেই হচ্ছে। একটানা। তোমাকে বোবায় ধরেছিল বাবা?

শ্রীনাথ অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। কথা বলতে পারে না। বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টির শব্দ। লক্ষণ ভাল নয়। বছর পাঁচেক আগে এ রকম সাংঘাতিক একটানা বৃষ্টির পর এ বাড়িতে কোমরসমান জল দাঁড়ায়। পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে সপরিবারে অন্যত্র আশ্রয় নিতে হয়েছিল তাকে। এই বৃষ্টিটাকে তাই শ্রীনাথ খুব সন্দেহ করে। স্বপ্নটাও জলেরই স্বপ্ন। কী হয় কে জানে!

শ্রীনাথ বলল, যা তো, উঠোনে কতটা জল জমেছে দেখে আয়।

সজল টর্চ হাতে উঠে দরজা খোলে, উঃ ব্বাস! খুব জল জমেছে গো বাবা। অনেক।

কতটা? –উদ্বেগে শ্রীনাথের গলা সরু হয়ে যায়।

দু’ফুট হবে।

দু’ফুট মানে অনেক জল। হাঁটুর ওপর হবে!–শ্রীনাথ উত্তেজিত গলায় বলল, তা হলে এখুনি আমাদের অন্য কোথাও চলে যাওয়া দরকার। ভিতরবাড়িতে ওরা কেউ কিছু টের পাচ্ছে না নাকি? তোর মাকে একটা খবর দে।

সজল বেশির ভাগ সময়েই শ্রীনাথের অকারণ উদ্বেগ দেখে হাসে। কিন্তু এখন হাসল না। বারান্দায় ফিরে গিয়ে উঠোনের জলে টর্চের আলো ফেলে সে দেখতে পেল স্রোত চলছে। স্রোতটা আসছে নদীর দিক থেকে। মাটির বাঁধটা যদি ভেঙে গিয়ে থাকে তবে ব্যাপারটা আর হাসিঠাট্টার নয়।

স্বপ্নটা এখনও শ্রীনাথকে তাড়া করছে। সে বিছানা ছেড়ে বাইরে এসে সজলের পাশে দাঁড়ায়।

ও বাবা! এ যে ভীষণ জল রে!

সজল বলে, তুমি অত ভেবো না তো বাবা।

তোর মাকে অনেক দিন আগেই আমি বলেছিলাম, দাদার ঘরের ওপর একটা দোতলা তুলতে। দোতলা হলে বানের জলে তেমন ভয় নেই।

এখন আর সে কথা বলে কী হবে?

জলটা বাড়ছে না? টর্চটা জ্বালা তো।

সজল টর্চ জ্বালল। জল বাড়ছে কি না বোঝা গেল না। তবে জল যে পাক খাচ্ছে, স্রোত চলছে তা বোঝা যাচ্ছিল।

ঘরের পিছন দিক থেকে বৃষ্টির শব্দের ভিতর দিয়েও একটা চেঁচামেচির শব্দ আসছিল। কান পেতে শব্দটা বোঝার চেষ্টা করছিল শ্রীনাথ। বলল, নিতাই চেঁচাচ্ছে না?

নিতাই বটে। একটু বাদে অন্ধকার ফুড়ে বৃষ্টি ভেদ করে দুই মূর্তি উঠে এল বারান্দায়। মাথায় পোঁটলা, হাঁড়ি, টিনের বাক্স।

নিতাই একগাল হেসে বলল, আগেই বুঝেছিলাম, এবারও খরা হবে। তাই সেই বোশেখ মাসে একটা বরুণ বাণ মেরে রেখেছিলাম। তাজ্জব কাণ্ড! সেই বাণে যে এতটা হবে তা বুঝতে পারিনি।

সজল টর্চটা ঘুরিয়ে নিতাইয়ের মুখে ফেলতেই নিতাই সামলে গেল। ঢোক গিলে বলল, ছোটকর্তা নাকি? হেঃ হেঃ, ভিজে একেবারে ঢোল হয়ে গেছি দেখুন!

গুল মারাটা বন্ধ করবে এবার থেকে?

নিতাই আবার ঢোক গিলল। বলতে নেই, কর্তামাকে সে ভয় খায় বটে, কিন্তু বুকের মধ্যে ততটা গুড়গুড়ুনি ওঠে না। কিন্তু এই ছোকরার মুখোমুখি পড়লেই তার আজকাল পায়ের তলায় ভূমিকম্প হতে থাকে।

নিতাইয়ের বউ কথা বলছে না। ভেজা কাপড়ে বারান্দার এক ধারে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে।

শ্রীনাথের কষ্ট হল। জিজ্ঞেস করল, তোদের শুকনো জামাকাপড় নেই?

মেয়েটা মাথা নাড়ল, নেই।

ভেজা কাপড়ে এই হাওয়ায় বসে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে যে!

এ কথায় নিতাই আর তার বউ হেসে ফেলে। নিতাই বলে, বাবুর যেমন কথা! কোন দালানকোঠাওলা বাড়ির মেয়ে যে ঠান্ডা লাগবে! বরাবর বৃষ্টি হলেই ভিজেছে। ওসব সয়ে গেছে ওর।

তোর ঠান্ডা লাগে না?

সজল সামনে না থাকলে নিতাই এ কথায় হেসে উঠত। শোনো কথা! মহাযোগী নিতাই খ্যাপার নাকি ঠান্ডা লাগবে! কিন্তু সজল খোকা থাকায় নিতাই অতটায় গেল না। বিজ্ঞের মতো একটু হেসে বলল, আজ্ঞে, আমিও রোদে-জলে মানুষ। আপনি ভাববেন না।

কিন্তু শ্রীনাথ ভাবে। আগে পৃথিবীর সম্পর্কে খানিকটা উদাসীনতা ছিল তার। আজকাল সব কিছু নিয়ে উদ্বেগ। বলল, খুব বাহাদুর তোরা বুঝেছি। এখন ঘরে গিয়ে আলনায় দেখ, গোটা কয়েক জলে কাচা ধুতি আছে। পুরনোই। দু’জনে পরে নে। যা।

বউটা মৃদু স্বরে বলে, না বাবা, আপনার পরনের ধুতি পরতে পারব না। বড্ড পাপ হবে।

তোর মাথা হবে! গুরুজনদের কথা শুনতে হয়। যা।–শ্রীনাথ ধমক দেয়।

সজল টর্চের আলোটা নিতাইয়ের বউয়ের দিকে তাক করে বলল, যাও না ভৈরবীদি। বাবা বলছে যখন, যাও।

ভৈরবী ওর নাম নয়। কিন্তু নিতাইয়ের বউযের এ নামটাই চালু হয়ে গেছে। তান্ত্রিকের বউ বলেই বোধ হয়।

টর্চের আলোয় লজ্জা পেয়ে বউটি তার তেলে কাপড়ের ঘোমটার তলায় মূখ আড়াল করে বলে, আমার শীত লাগছে না।

নিতাই অবশ্য বাবুর দু-দুটো ধুতি হাতানোর এই মওকাটা ছাড়তে চাইছিল না। বউয়ের দিকে চেয়ে বলল, বাবু হল ভগবানের মতো। তা ভগবানেব দেওয়া আলোটা বাতাসটা কলাটা মলোটা নিলে আর দোষের কী? যাও কাপড়টা ছেড়ে ফেলো গিয়ে।

বউটা জেদি আছে। রাজি হল না। চক্ষুলজ্জায় নিতাইও গেল না।

টর্চ জ্বেলেই রেখেছে সজল। জল ইঞ্চিখানেক বেড়ে গেল দেখতে না দেখতেই।

নিতাই বলে, মাটির বাঁধটা গেছে। এই সেদিনও দেখি, পরাশর ঘর তুলবে বলে বাঁধ থেকে মাটি কাটিয়ে আনছে। পইপই করে বললুম, বাপু, তোমরা সবাই যদি বাঁধের মাটি চুরি করে তা হলে কিন্তু একদিন বিপদ আছে। এই নদীর চেহারা এমনিতে ভালমানুষের মতো কিন্তু খেপলে সমদূরে।

ভিতরবাড়ির দিকে এতক্ষণে বাতি দেখা গেল। ইলেকট্রিক অনেকক্ষণ নেই। কযেকটা হ্যারিকেন আর টর্চ ঘোরাফেরা করছে। দুটো ছাতা হাতে নিয়ে দৃষ্টির মধ্যে একটা গামছা মাথায় মংলু খপাৎ খপাৎ করে জল ভেঙে এসে বলল, মা বলছেন আপনারা সব ভিতরবাড়ির বড় ঘরটায় চলে আসুন। ওটার ভিত উঁচু আছে।

শ্রীনাথ হতাশ গলায় বলে, কত আর উঁচু? এই জলে যে সৃষ্টি ভেসে যাবে। এই হারে বাড়লে সকাল নাগাদ ঘরের চালে উঠেও রক্ষা পাওয়া যাবে না।

তবু যতটা পারা যায়। আমি আপনার ঘরেব কিছু জিনিসপত্র পাটাতনে তুলে রাখি গে। আয় রে নিতাই, একটু হাত লাগাবি!–বলে নিতাইকে নিয়ে মংলু ঘরে গিয়ে ঢোকে।

সজল বাবার দিকে হাত বাড়িয়ে বলে, ঢলো বাবা।

সজলের হাতটা অবশ্য ধরল না শ্রীনাথ কিন্তু জলে নেমে পড়ল। বলল, চল। দোতলাটা তুলে রাখলে আজ এই বিপদে কিছু হত না।

তৃষা তার ঘরের দাওয়ায় মস্ত টর্চ হাতে দাঁড়িয়ে। পাশেই সরিৎ। তৃষার শাড়ি সপসপে ভেজা, চুল থেকে জল পড়ছে।

সজল জিজ্ঞেস করে, তুমি ভিজলে কী করে?

দুটো হাঁস বেরিয়ে গিয়েছিল। ধরে আনলাম।

ধরার লোক ছিল না?

কাকে ডাকব, কে শুনবে এই বৃষ্টিতে?— বলে তৃষা শ্রীনাথের দিকে চেয়ে বলে, বারান্দার ওই কোণে বালতিতে ভাল জল ভোলা আছে। হাত-পা ধুয়ে ভাল করে জল মুছে বিছানায় গিয়ে বোসো। আমি চায়ের জল চড়িয়ে এসেছি। মঞ্জু চা করে দেবে। সজলও যা।

শ্রীনাথ লক্ষ্মীছেলের মতো তাই করল। সজল শুধু ঠোঁট উলটে বলে, ঘরে বসে থাকার মানেই হয় না। আমি বরং আশপাশটা দেখে আসি, কে কী করছে।

তৃষা চাপা গলায় বলল, না। এই বৃষ্টিতে যাবে না। কাল সকালে সব খবর নিয়ে।

সজল তর্ক করল না। কিন্তু কোমরে হাত রেখে বারান্দায় বেপরোয়া এক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল।

ভিতরে কেরোসিনের স্টোভে মঞ্জু চা করছে। বিছানায় পা তুলে বসল শ্রীনাথ। অল্প আলোতেও ঘরে মেলা ঘুরঘুরে পোকাকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে। বাইরে জল জমলেই এরা ঘরে ঢুকে পড়ে। বৃষ্টিটা কিছুতেই ধরছে না।

বাইরে বৃন্দাই বোধ হয় চেঁচিয়ে জানান দিল, পশ্চিমের ঘরে জল ঢুকছে।

তৃষা ঘরে আসে। তার মুখে কোনও উদ্বেগ নেই, তবে একটা কাঠিন্য আছে। ঘরের পাটাতনের সঙ্গে একটা কাঠের মই লাগানো। একটা বাক্স হাতে তৃষা তরতর করে পাটাতনে উঠে বাক্সটা রেখে নেমে এল আবার।

শ্রীনাথ বিরক্ত হয়ে বলে, কবেই তো তোমাকে বলেছিলাম, এবার দোতলাটা করো। এসব জায়গায় জল হবেই। রাতে আমি জল নিয়ে একটা বিচ্ছিরি স্বপ্ন দেখেছি।

তৃষা তার বড় বড় চোখে চেয়ে বলে, দোতলা? দোতলা দিয়ে কী হবে? আমরা তো এখানে চিরকাল থাকব না।

থাকব না! তা হলে কোথায় যাব?

তা জানি না। তবে এখানে নয়।

এখানে নয় কেন?

এ জায়গা আমার আর ভাল লাগছে না।

শ্রীনাথ খিচিয়ে ওঠে, তোমার ভাল না লাগলেই হবে! আমরা কি সব তোমার হাতের পুতুল! আমিও পুতুল। রাগ কোরো না। আমার মনে হয়, এখানে থাকলে আমাদের কারও ভাল হবে না।

সে তো এখন বলছ। কিন্তু এক সময়ে এখানে শেকড় গেড়ে বসার জন্য তুমিই জমিজমা কিনে গেছ অন্ধের মতো, দোকান দিয়েছ, ধানকল করেছ, সেগুলোর কী হবে?

শান্ত স্বরেই তৃষা বলে, আমিই যখন করেছি তখন সে দায়ভারও আমার। তুমি তো খবর রাখো, ধানকল বেচে দিচ্ছি শিগগিরই। দোকানটার ভাল দাম পেলেই ছেড়ে দেব। জমিজমাও কিছু কিছু করে বিলি বন্দোবস্ত হচ্ছে।

শ্রীনাথ বিরক্ত হয়ে বলে, যা খুশি করো। আমার কী? আমার সম্পত্তি তো নয়।

তৃষা একটু হেসে বলল, না হলে কী হয়, খুব চিন্তায় তো পড়েছ দেখছি। অত চিন্তা কোরো না। লোকে আমার যত বদনামই করুক, কেউ অন্তত আমাকে বোকা ভাবে না।

শ্রীনাথ হঠাৎ বলল, কিন্তু আসলে তো তুমি বোকাই।

তাই নাকি?

বোকা নও? বোকা না হলে আজ তোমার সংসার এত সৃষ্টিছাড়া কেন? মেয়েমানুষের একটা সীমা আছে, গণ্ডি আছে। সেটা যে ডিঙিয়ে যায় সে নিশ্চয়ই বোকা।

তুষার তর্ক আসে না। ঝগড়া করতে সে ভালবাসে না। উপরন্তু সে দেখতে পায়, সজল দরজায় এসে দাঁড়িয়ে আছে। চৌকাঠে ঠেসান, কোমরে হাত, চোখ দুখানায় ঝলমলে কৌতুক। ওর পায়জামাটা উরু পর্যন্ত ভেজা, মাথার ঘন চুলে অজস্র ফেঁটা লেগে আছে।

তৃষা সজলের দিকে এক পলক চেয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে, পায়জামাটা পালটে নাও। ঠান্ডা লাগবে।

আমার পায়জামা-টায়জামা সব পশ্চিমের ঘরে।

আমার একটা শাড়ি প্যাঁচ দিয়ে পরে থাকো। ওই আলনায় আছে।

সজল কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, আমরা এ জায়গা ছেড়ে কোথায় যাব মা?

কোথাও যাব।

এ জায়গা আমি ছাড়ব না।

তোমার ইচ্ছেয় সব হবে নাকি?

এ জায়গায় যে আমরা সেট করে গেছি। অন্য কোথাও গেলে পুরনো বন্ধুদের কোথায় পাব?

নতুন বন্ধু হবে।

নতুন বন্ধু চাই না।

তৃষা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, না যেতে চাইলে তোমরা এখানেই থেকো।

তুমি থাকবে না?

না। আমি চলে যাব।

একা?

দরকার হলে একাই।

সজল হঠাৎ একটু হাসল, মেয়েরা একা থাকতে পারে নাকি? তোমার বাজার করে দেবে কে?

তৃষা ক্লান্ত মুখে ছেলের দিকে চেয়ে বলে, ওসব কথা এখন থাক। পায়জামাটা ছাড়বি কি না! ক’বার বলতে হবে?

আমি শাড়ি পরব না।

তা হলে মংলুকে বল, পশ্চিমের ঘর থেকে পায়জামা এনে দেবে।

আগে বলো তুমি কোথায় যাবে?

আমি তোদর সঙ্গে থাকব না। এখানেও থাকব না।

আমাদের কি তুমি দেখতে পারো না মা?

তৃষা এ কথার জবাব দিল না। খাটের তলা থেকে তোরঙ্গ টেনে বের করে ডালা খুলে জিনিসপত্র ঘাঁটতে লাগল।

সজল কিছুক্ষণ জবাবের জন্য অপেক্ষা করে বলল, বৃষ্টি কমে এসেছে। কেন খামোখা জিনিসগুলো ওপরে তুলছ?

বাস্তবিকই বাইরে বৃষ্টির ঝমাঝম শব্দ স্তিমিত রিমঝিম হয়ে বাজছে। কিন্তু তৃষা আপন মনে তার কাজ করে যেতেই লাগল।

মঞ্জু বাবাকে চা দিয়ে মায়ের কাপটা পাশে মেঝেয় রেখে বলল, মা, তোমার চা।

ভারী অস্বস্তি বোধ করছিল তৃষা। চায়ের কাপ তার অবলম্বন হল একটা। মেঝেয় বসে চায়ে চুমুক দিয়ে ছেলের দিকে চেয়ে বলল, বড়দের সব কথার মধ্যে থাকো কেন?

বড়দের কথা আবার কী? এখান থেকে চলে যাওয়ার কথা বলছিলে, কানে এল, তাই বললাম।

তৃষা ভারী হতাশ ও বিষণ্ণ মুখে বসে থাকে। এই সংসার ছেড়ে তার কি সত্যিই যাওয়ার সময় হল?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *