2 of 2

৬৪. এই ফ্ল্যাটে ঢুকতে আজ ভারী লজ্জা আর অস্বস্তি

এই ফ্ল্যাটে ঢুকতে আজ ভারী লজ্জা আর অস্বস্তি বোধ করে দীপনাথ। বহুকাল সে এরকম সংকটে পড়েনি। আজ তার পায়ের তলায় মৃদু ভূমিকম্প হয়ে চলেছে।

তারা গাড়ি থেকে নামতেই ওপরের বারান্দা থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল মণিদীপা।

বোস সাহেব বাড়িতে ঢুকবার আগে একটু সময় নিল। সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে মৃদু আন্তরিক স্বরে বলল, আপনি আজ একটু রেগে আছেন। আমার প্রোপোজাল হল, লেট আস হ্যাভ এ ফ্রাংক ডিসকাসন অ্যান্ড ট্রাই টু সেটল থিংস।

দীপনাথের আজ চাকরির ভয় নেই, কৃতজ্ঞতাবোধ নেই, সে মরিয়া। তাই চাপা গরগরে গলায় বলল, সবটাই তো আর একজিকিউটিভ মিটিং নয় বোস সাহেব।

বোস চিন্তিত মুখে দীপনাথের দিকে চেয়ে বলে, ইউ আর রিয়েলি অ্যারোগ্যান্ট। রিয়াল টাফ গাই। বাট লেট আস কিপ আওয়ার হেড টুডে।

দীপনাথ তেজের সঙ্গে বলল, দ্যাট ইজ ইয়োর হেডেক, নট মাইন। আপনি নিজের রিস্কে আমাকে এখানে এনেছেন। আমি কোনও কথা দিতে পারি না।

বোস সাহেবকে হঠাৎ খুব বিরক্ত আর ক্লান্ত দেখাল। মুখে-চোখে গভীর হতাশা। মৃদু স্বরে বলল, ঠিক আছে, আসুন।

বোস সিঁড়ি বেয়ে আস্তে আস্তে উঠছে। পিছনে দীপনাথ। দীপনাথ দেখতে পেল বোস রেলিং-এ প্রয়োজনের চেয়েও একটু বেশি ভর দিচ্ছে। প্রতিটি সিঁড়িতে উঠতেই যেন বেশ কষ্ট হচ্ছে বোস সাহেবের। মস্ত লম্বা শরীরের আকৃতির সঙ্গে প্রকৃতির তানক তফাত। দীপনাথ টের পায়, বোস ভাল নেই। খুব তাড়াতাড়িই ওর ডাক্তার দেখানো উচিত।

দোতলার চাতালে উঠে বোস একবার নিজের বুকে হাত রাখে। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে হা করে দম নেয়।

সদর দরজা খোলাই ছিল। ড্রয়িংরুমে ঢুকে বোস সাহেব মুখ ফিরিয়ে বলে, আমার ঘরে গিয়ে বসুন। আমি একটু বাথরুম থেকে আসছি।

বোস সাহেবের ঘরটা দীননাথের অচেনা নয়। করিডোরের শেষে বাঁ-হাতি ঘরটা। আগে ডান দিকে মণিদীপার ঘর। বোস সাহেব বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করতেই দীপনাথ মণিদীপার ঘরের বন্ধ দরজার নব ঘুরিয়ে ভিতরে ঢুকল। তারপর আস্তে বন্ধ করে দিল দরজাটা।

মণিদীপা একদৃষ্টে দরজার দিকে চেয়ে ছিল। তাকে দেখে একটুও চমকাল না। কিন্তু চোখে একটা অদ্ভুত বিহুল দিশেহারা দৃষ্টি। যেন কাউকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। যেন পৃথিবীর কোনও কিছুই সত্য বলে মনে হচ্ছে না। চুল এলো, মুখ শুকনো, তবু ভারী করুণ আর সুন্দর আর অসহায় এই জেদি মেয়েটিকে দেখে আজ শঙ্খের মতো আর্তনাদ করে ওঠে দীপনাথের হৃদয়। কী বলবে তা ভুলে গেল সে। মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইল।

এক-একটা পাগলা মুহূর্ত আসে মানুষের জীবনে যখন অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা থাকে না। দীপনাথের ঠিক সেই অবস্থা। পায়ের নীচে মৃদু ভূমিকম্প উঠল চৌদুনে। বোস সাহেব তার বউযের সঙ্গে দীননাথের মিলন চাইছে। এর চেয়ে সুখবর আর কী হতে পারে?

দীপনাথ নয়, তার ভিতরকার পাগলটা বিনা ভূমিকায় বলল, আমার সঙ্গে যাবে মণিদীপা?

মণিদীপা তেমনি বিহুলভাবে চেয়ে আছে।

দীপনাথ হাত বাড়িয়ে বলল, এসো। চলো যাই।

এ সমস্তই বলল দীপনাথ। কিন্তু, তীব্র শ্বাসের কষ্ট আর অসহনীয় আবেগের তাড়নায় তার কোনও কথাই মণিদীপার কানে পৌঁছল না। প্রায় ফিসফিসানির মতো তার নিজের শ্বাসবায়ুর সঙ্গে মিশে গেল মাত্র।

মণিদীপা বলল, ক’দিন ধরে ও যে কী পাগলামি শুরু করেছে।

দীননাথ আবেগের পাহাড়চূড়া থেকে নেমে এল। ভীষণ লজ্জা। ভীষণ গ্লানি। গলা যত দূর সম্ভব নরম করে এবং স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে সে বলে, কে পাগলামি করছে?

আপনাদের বোস সাহেব। কী বলছে?

যা বলছে তা আপনাকে বলা যায় না।

দীপনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, আমাকেও আজ কিছু অদ্ভুত প্রস্তাব দিয়েছেন।

কিসের প্রস্তাব?

তাও আপনাকে বলা যায় না।

মণিদীপা করুণ মুখ করে বলে, তা হলে সেই কথাই। আমাকেও বলেছে, আপনাকেও বলেছে।

দীপনাথ মাথা নেড়ে বলে, হয়তো সেই উদ্দেশ্যেই আজ উনি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন।

মণিদীপার মাজা রংও রাঙা হল এ কথায়। সে বলল, ছিঃ ছিঃ। ও কোথায় গেল?

বাথরুমে।–দীপনাথ একটু চুপ করে থেকে বলে, বাথরুমে উনি একটু সময় নেবেন বলে মনে হচ্ছে।

কেন? আমাদের আন্ডারস্ট্যান্ডিং-এর জন্য সময় দিতে?

দীপনাথ মাথা নেড়ে বলে, না। আমার সন্দেহ, উনি কোনও অসুখে ভুগছেন। ওঁর খুব তাড়াতাড়ি ডাক্তার দেখানো উচিত। এর আগেও একদিন বলেছিলাম, উনি তখন পাত্তা দেননি।

মণিদীপা মাথা নাড়ে। একটু ভেবে বলে, এরকম একটা সন্দেহ আমারও হচ্ছিল।

বিয়ের সময় ও ছিল দারুণ শক্ত সমর্থ মানুষ। এখন কেমন ফ্যাটি, উইক। অসম্ভব স্ট্রেনও যাচ্ছে।

দীপনাথ বলে, হ্যাঁ। উনি কাজ ভালবাসেন। তা ছাড়া একটা প্রায় অসামাজিক লাভ অ্যাফেয়ারে পড়ে যাওয়ায় স্ট্রেনটা বেড়েছে।

মণিদীপা খুব ম্লান হয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকে অনেকক্ষণ। তারপর যখন মুখ তোলে সেই মুখ দেখে পাষণ্ডেরও মায়া হওয়ার কথা। আস্তে করে বলে, এটা আমার ডিফিট, তাই না?

দীপনাথ অবাক হয়ে বলে, কোনটা?

এই যে বোস সাহেব তার কাজিনের সঙ্গে প্রেম করছে এর মানে তো এই দাঁড়ায় যে, আই হ্যাভ ফেইলড টু অ্যাট্রাক্ট হিম।

দীপনাথ মৃদু হেসে বলে, তাই দাঁড়ায়।

আমি তা হলে ডিফিটেড?

খানিকটা। তবে লড়াই তো এখনও চলতে পারে।

মণিদীপা মাথা নেড়ে বলে, না। লড়াই শেষ। আমি হেরো।

দীপনাথ মাথা নেড়ে বলে, আপনি ঠিক হারেননি।

তবে কি জিতেছি?

তাও নয়। আপনি আসলে যুদ্ধটাই মন দিয়ে করেননি যে।

আমার কী করার ছিল?

লোকটাকে আর-একটু বাজিয়ে দেখতে পারতেন।

লাভ নেই। বাজালে ফাঁকা আওয়াজ বেরোবে। ওর কোনও ডেথ ছিল না কখনও।

আপনি কি ডেপথওয়ালা লোককেই চেয়েছিলেন?

মণিদীপা অবাক হয়ে বলে, কে না চায়?

আপনাকে দেখে কিন্তু তা মনে হয় না।

তা হলে কী মনে হয়?

মনে হয়, আপনি ভালবাসেন প্লে-বয় টাইপ।

বাঃ! চমৎকার সব ধারণা আমার সম্পর্কে আপনাদের।

মানুষের ভুল হতেই পারে।

মণিদীপা মাথা নেড়ে বলে, ভুল নয়। একজন মহিলার প্রতি আপনাদের প্রিকনসিভড কিছু ধারণা ছিল। সেই ধারণাকে আপনারা ভাঙতে চান না। আর সেইটেই সব অশান্তির উৎস।

এই অবস্থাতেও দীপনাথ একটু হেসে বলে, আপনি বরাবর চমৎকার কথা বলেন।

আমার স্বভাবে আরও কিছু চমৎকার দিক ছিল। আপনি বা বোস সাহেব অন্ধ না হলে ঠিকই লক্ষ করতেন।

বিষণ্ণ দীপনাথ বলে, আমি তো চান্স পাইনি মণিদীপা। কিন্তু বোস সাহেব পেয়েছেন।

আপনিও অন্ধ। বোস সাহেবের কাছে আমাকে একটা ভ্যাম্পায়ার হিসেবে দাঁড় করাল কে?

আমি নই মণিদীপা।

কে আমার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা কেড়ে নিতে বোস সাহেবকে পরামর্শ দিয়েছিল?

আপনি রেগে যাচ্ছেন। কিন্তু এটা রাগের সময় নয়। আমরা তিনজনই একটা বিশ্রী সিচুয়েশনের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছি। এই অবস্থায় মাথা ঠান্ডা রাখা দরকার।

মণিদীপা একবার শুধু দু’হাতের পাতায় মুখটা আড়াল করল। পরমুহূর্তেই আড়াল সরিয়ে সোজা দীপনাথের দিকে চেয়ে বলল, আপনি আমাকে কী করতে বলেন? বোস সাহেবের মন জয় করতে প্রেম-প্রেম খেলা শুরু করব?

না। আপনি ওঁর সঙ্গে আর সে খেলা খেলতে পারেন না। সেটা আমি জানি।

তবে কি অন্য কারও সঙ্গে পারি?

সে কথা বলিনি। বিয়ের পর অনেক বছর কেটে গেলে তো আর নতুন করে রহস্যময়ী হওয়া যায় না। প্রেম জমাতে গেলে একটু রহস্য আর একটু দূরত্ব থাকা দরকার যা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্ভব নয়।

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কী সম্ভব তা কি একজন কনডেমড ব্যাচেলারের কাছ থেকে জানতে হবে?

ব্যাচেলাররাও কিছু কিছু বোঝে।

বোস সাহেব আপনার পরামর্শে চলে বলে কি মণিদীপাও চলবে ভেবেছেন?

না। দীপনাথ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, আমি অত দুরাশা করিনি।

আপনার দুরাশা আর-একটু বেশি। আপনি বোধ হয় বোস সাহেবের কাছ থেকে আমাকে ছিনিয়ে নিতে চান।

দীপনাথ গাড়লের মতো চেয়ে থাকে। মুখে কোনও কথা আসে না।

মণিদীপা মৃদু একটু হেসে বলে, তুমি বোকা! বোকা! কেন বুঝতে চাইছ না যে, বোস সাহেব নয়, টাকা নয়, আমি যাকে ভালবাসি তাকেই চাই?

পিছনেই বন্ধ দরজা। দীপনাথ আস্তে তাতে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। বলে, কাকে?

তোমাকে! তোমাকে! তোমাকে!

এলো চুল ঝাঁপিয়ে পড়ল চারধারে। তরঙ্গের মতো উঠে এল মণিদীপা। চোখে পাগলের মতো দৃষ্টি। ঠোঁটে সম্মোহন। দীপনাথ ভাবল, এই যৌবনজলতরঙ্গ রাধিবে কে?

তার পিঠে একটা, দুটো, তিনটে টোকা পড়ল। তারপর গলা খাঁকারির আওয়াজ।

চ্যাটার্জি! আই অ্যাম ওয়েটিং।

দীপনাথ তৎক্ষণাৎ ঘুরে দরজা খুলল। দরজার মাথা অবধি করাল বিশাল চেহারা নিয়ে বোস দাঁড়িয়ে। কিন্তু এক বৃদ্ধ, হতমান, রুগ্ন দৈত্য। তার না আছে নখ, না দাত, না হিংস্রতা।

আসুন, বোস সাহেব।

আর ইউ বিজি?

একটু। উই আর সরটিং আউট এ ফিউ থিংস।

দেন গো অ্যাহেড। আমি বরং আমার ঘরে…

না। এখানেই আসুন। এটা আপনার স্ত্রীর ঘর। আমি আউটসাইডার।

বোস একটু হাসে, কাঁধ তুলে ছেড়ে দেয়। তবে ঘরে ঢোকেও।

মণিদীপা হাত তিনেক দুরে থেমে আছে। নিস্তব্ধ তরঙ্গ। মুখ-চোখে অপমান ফাটো-ফাটো হয়ে আছে। থম ধরে আছে কান্না।

বোস মৃদু স্বরে বলে, আমি হয়তো ডিস্টার্ব করছি।

দীপনাথ তার হাসিমুখ তুলে বোস সাহেবের মুখের দিকে তাকায়। তারপর বলে, পাত্রী আমার পছন্দ নয় বোস সাহেব। পাত্রীরও পাত্র পছন্দ নয়।

বোস গম্ভীর হয়ে বলে, আই থট আদারওয়াইজ।

আপনি ভুল ভেবেছিলেন। মণিদীপা খুব গভীর মনের মানুষ পছন্দ করেন। আমার সেই গভীরতা নেই। আর আমি হুইমজিক্যালদের পছন্দ করি না। কিন্তু মণিদীপ হুইমজিক্যাল।

বোস দাঁড়াতে পারছে না। শরীরের ভিতরকার কোনও অপ্রতিহত দুর্বলতা কুরে কুরে খাচ্ছে তাকে। একটু আড়ষ্ট পদক্ষেপে এগিয়ে গিয়ে বোস সাহেব মণিদীপার বিছানায় বসে। সাঁই সাঁই করে খানিক দম নিয়ে বলে, বেয়ারাকে একটু খাবার জল দিতে বলো তো দীপা।

মণিদীপা একবার বোস সাহেবের দিকে তাকায়। পালানোর এমন সুযোগ আর পাবে না। ত্বরিত পায়ে সে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

একটু বাদে বেয়ারা ট্রে-তে একটা অস্বচ্ছ কাচের গ্লাস নিয়ে ঘরে ঢোকে। আর তখন করিডোরের প্রান্তে টেলিফোনে নির্ভুল ডায়ালের আওয়াজ পায় দীপনাথ।

মণিদীপা বলল, হ্যাল্লো! ডক্টর মুখার্জি আছেন? ইটস আর্জেন্ট! ভেরি আর্জেন্ট।

বোস সাহেব জলটা শেষ করে খালি গ্লাস হাতে নিয়ে শূন্য চোখে চেয়ে আছে।

দীপনাথ নিঃশব্দে দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসে। শূন্য, সব শূন্য লাগে তার এ বাড়ির। আস্তে আস্তে সে সিঁড়ি ভেঙে নামে। আর ফিরে তাকায় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *