কালীদহের পিশাচ

কালীদহের পিশাচ

গরমের ছুটিতে অভীকের ছোটোমামা এসে ওকে মামাবাড়ি নিয়ে গেল। ওর মামাবাড়ি টাকি শহরের কাছে, ইছামতী নদী থেকে কিছুটা দূরে। অভীকের দাদু বেঁচে আছেন, দিদিমা নেই। দাদুর বয়স আশির ওপর, কিন্তু এখনও বুক টান টান করে হাঁটেন। কবজিতে যা জোর তা অনেক তরুণকেই লজ্জা দেয়।

দাদুর বাবা ছিলেন পুববাংলার ছোটোখাটো এক জমিদার, এখন যার নাম বাংলাদেশ। তখন তো আর দেশ ভাগ হবার কথা কেউ কল্পনাও করেনি, কোপটাও পড়েনি বাঙালি আর পাঞ্জাবিদের ওপর।

দেশ ভাগ হবার পরেও দাদু পুববাংলার সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেননি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই যোগাযোগ রাখা আর সম্ভব হয়নি।

দাদুর বয়স তখন পঁচিশ-ছাব্বিশ। কয়েকদিনের জন্য দেশের বাড়িতে গিয়েছিলেন। একদিন রাত্রে তাঁদের বাড়ি আক্রমণ করেছিল দুর্বৃত্তরা। সবাইকে কুপিয়ে মেরেছিল। শুধু দাদুই পালিয়ে বেঁচেছিলেন। এক প্রতিবেশী মুসলমান পরিবার তাঁকে আশ্রয় দিয়ে লুকিয়ে রেখেছিল। বিপদের আশঙ্কা করে দাদুর বাবা কিছু ধনরত্ন মাটির তলায় লুকিয়ে রেখেছিলেন। সেগুলি উদ্ধার করে সেই মুসলমান পরিবারের সাহায্যে এপার বাংলায় চলে এসেছিলেন দাদু। ইছামতী নদীর অদূরে এই জায়গায় নতুন করে বাসা বেঁধেছিলেন। তখন ওখানে লোকজনের বসতি ছিল কম। জমির দরও ছিল জলের মতো। আরও পরে ওখানে মানুষজন আসতে শুরু করেছিল।

দাদু কঠিন পরিশ্রম আর অধ্যবসায়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছিলেন। দেশ ভাগ হবার আগেই তিনি এম এ পাশ করেছিলেন, ওখানে এক ইস্কুলে মাস্টারির চাকরিও পেয়েছিলেন। ইংরেজি পড়াতেন, পরে হেডমাস্টার হয়েছিলেন। সংসারী হবার পর তিনি পাকাবাড়ি করেন। যে সোনাদানা তিনি নিয়ে এসেছিলেন তা সেসময় খুব কাজে লেগেছিল।

এই হল দাদুর ইতিহাস। অভীকের তিন মামা। বড়োমামা উকিল, মেজোমামা ডাক্তার আর ছোটোমামা কলকাতার এক বড়ো ক্লাবে ফুটবল খেলে, এখনও চাকরি পায়নি। বড়োমামা আর মেজোমামা বিয়ে করেছেন। বড়োজনের দুই ছেলেমেয়ে আর মেজোমামার এক মেয়ে। ওর মা হল তিন মামার একমাত্র বোন, তাই মামাবাড়িতে অভীকের খুব আদর। ওর বয়স তেরো, ক্লাস এইট-এ পড়ে।

দাদু জমিতে আম, কাঁঠাল আর লিচু গাছ লাগিয়েছিলেন। এখন গরমকালে সব পাকতে শুরু করেছে। ঘন দুধের মধ্যে পাকা আম গুলে চিনি আর মুড়ি মিশিয়ে যে কী অমৃত ফলাহার হয় তা অভীক জানে আর সেই লোভেই প্রত্যেক বছর গরমের ছুটিতে কয়েকদিনের জন্য ওর মামাবাড়িতে আসা চাই-ই। তা ছাড়া দাদু পুকুর কাটিয়েছেন, তাতে রুই, কাতলা, মৃগেল ছাড়াও অন্য মাছও আছে। মাছ ভাজা, মাছের ঝোল, ঝাল, টক, দুই মামি যে কতরকম রান্না করে তার ঠিক নেই।

সেদিন সন্ধেবেলা দাদুকে ঘিরে বসেছিল নাতি-নাতনিরা। সামনে একটা বড়ো রেকাবিতে গরম গরম মাছের চপ, আরেকটা রেকাবিতে আম, ফালা ফালা করে কাটা। খেতে খেতে দাদুর সঙ্গে গল্প করছিল ওরা। অভীকই প্রথম বলল, ‘দাদু, একটা ভূতের গপ্প বলো।’

‘ভূতের গপ্প।’ দাদু টান টান হয়ে বসে বললেন, ‘শুনবি? ভয় পাবি না তো!’

‘না, না,’ সবাই একসঙ্গে বলে উঠল।

‘এটা কিন্তু গপ্প নয়, সত্যি ঘটনা,’ দাদু বললেন, ‘আমার জীবনেই ঘটেছিল।’

সবাই দাদুর গা ঘেঁষে উদগ্রীব হয়ে বসল।

দাদু শুরু করলেন, ‘তখন আমার বয়স সতেরো-আঠারো, বি এ পড়ি। কলকাতার হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করি। সেবার এক ছুটিতে দেশের বাড়ি যাব বলে রওনা দিয়েছি।

‘গোয়ালন্দ থেকে আমাকে স্টিমার ধরতে হবে। গোয়ালন্দ হল বড়ো স্টিমার ঘাট। ওখানের তরমুজ বিখ্যাত, এত বড়ো বড়ো যে একজনকে মাথায় করে নিয়ে যেতে হয়। অত বড়ো তরমুজ আর কোথাও দেখিনি। সেদিন স্টিমারে কী-একটা যন্ত্র বিকল হয়েছিল তাই ছাড়তে অনেক দেরি হয়ে গেল। আমি নামব তারপাশায়, সেখান থেকে নৌকো করে যেতে হবে আমাদের গ্রামে। আমার বাবা ছিলেন জমিদার, তবে বড়ো জমিদার নয়, আশপাশের কয়েকটা গ্রাম নিয়ে ছিল তাঁর জমিদারি।

‘দুপুরে আট আনা দিয়ে এক প্লেট ভাত আর মুরগির মাংস খেলাম। সে মুরগির মাংসের রান্নার স্বাদ আজও যেন আমার জিভে লেগে আছে।

‘তারপাশা স্টিমার ঘাটে পৌঁছোতে পৌঁছোতে বিকেল হয়ে গেল। বাড়িতে আগে খবর দিইনি, দিলে বাবা নৌকো পাঠাতেন, আমাদের নিজেদের নৌকো ছিল।

‘ওখানে যাত্রীদের নেবার জন্য সার সার নৌকো অপেক্ষা করছিল। তাদের মধ্যে যাত্রীদের নিয়ে প্রায় টানাটানি পড়ে গেল। যাহোক আমি এক বুড়ো মুসলমানের নৌকো ভাড়া করলাম, তার সঙ্গে ছিল তার জোয়ান নাতি।

‘বুড়ে মাঝিকে আমার গন্তব্যস্থল বলতেই সে বলল, ‘ছোটো চৌধুরী কত্তার বাড়ি! আপনাগো বাড়ি আমি অনেকবার গেছি, আপনি বুঝি তেনার পোলা?’

‘আমার বাবাকে ছোটো চৌধুরী নামেই সবাই জানত। ওখানে আরও জমিদার ছিলেন, কেউ বড়ো চৌধুরী, কেউ মেজো চৌধুরী, এভাবেই ছিল তাঁদের পরিচয়।

‘আমি ঘাড় নেড়ে সায় দিতেই বুড়ো মাঝি বলল, ‘আপনে বুঝি বাড়িতে খবর দেন নাই, আপনাগো মাঝি আজিজ মিঞা আমার সম্বন্ধী হয়।’ তারপর একটু চিন্তা করে বলল, ‘আইজ স্টিমার এত দেরি কইরা আইল, রাত হইয়া যাইব।’

‘তা হোক না,’ আমি বললাম, ‘তুমি চিন্তা কোরো না, তোমাকে ভাড়ার ওপর বখশিশ দেব।’

‘সেকথা না দা ঠাউর,’ বুড়ো মাঝি বলল, ‘ঠিক আছে, আপনি বসেন।’ তাকে যেন কেমন চিন্তিত মনে হল।

‘আমাকে ওই স্টিমার ঘাট থেকে অনেকটা পথ যেতে হবে। পথ মানে কচুরিপানা ভরতি খাল-বিল। বুড়ো মাঝি সামনে বসে দাঁড় দিয়ে কচুরিপানা সরাচ্ছিল আর তার নাতি একটা বড়ো লগি জলের তলায় মাটিতে চাপ দিয়ে তরতর করে নৌকো এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। অসংখ্য খাল-বিল দিয়ে কেমন করে যে ওরা ঠিক পথ চিনে নৌকো নিয়ে যেত তা আমার কাছে একটা বিস্ময় ছিল। শহরের অলিগলি দিয়ে একজন ড্রাইভার যেমন পথ চিনে গাড়ি নিয়ে যায় ঠিক তেমন।

‘ক্রমে অন্ধকার নেমে এল। আলো বলতে নৌকোর মধ্যে একটা মাত্র হ্যারিকেন লণ্ঠন। সে যে কী অন্ধকার তা বলে বোঝাতে পারব না। তার মধ্যেই বুড়ো মাঝি আর তার নাতি দিব্যি নৌকো চালাচ্ছিল। তবে একটা আশার কথা, আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ ঝলমল করছিল।

‘প্রায় এক ঘণ্টা যাবার পর বুড়ো মাঝি হঠাৎ এক জায়গায় খালের পাড় ঘেঁষে নৌকো ভিড়াল। আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘এ কী, এখানে নৌকো লাগালে কেন?’

‘দা ঠাউর,’ বুড়ো মাঝি বলল, ‘আর দুইটা বাঁকের পরেই ডাকাইতে বিল। রহিম শেখের দলের ভয়ে রাইতে কেউ ওই জায়গা পার হয় না। আমারে কিছু করব না, আমি এই পথে নাও চালাইয়া বুড়ো হইয়া গেলাম, আমারে হক্কলে চেনে, কিন্তু ডর আপনার লাইগ্যা। যদি আপনার কিছু হয় তবে আমি ছোটো চৌধুরী কত্তার কাছে মুখ দেখাইতে পারুম না।’

‘রহিম শেখের নাম আমিও শুনেছিলাম। দিনের বেলায় অনেক নৌকো চলাচল করে তাই রাত্তিরেই ও দলবল নিয়ে শিকারের খোঁজে বেরোয়। শুনেছি দয়ামায়াহীন নিষ্ঠুর এক মানুষ।

‘বুড়ো মাঝি আর তার নাতি রান্নাবান্নার আয়োজনে ব্যস্ত হল। সব নৌকোয় তার ব্যবস্থা থাকে, বাড়ি গিয়ে কখন ওরা খাওয়া-দাওয়া করবে তার কোনো ঠিক নেই। যেমন আজ রাতটা এই খালের পাড়েই কাটাতে হবে।

‘হাঁড়িতে চাল ছেড়ে বুড়োর নাতি মাছ কুটতে বসে গেল। বড়ো বড়ো পারশে মাছ, আমিও ওদের সঙ্গে খাব।

‘আমি ছইয়ের বাইরে বসে চাঁদের আলোয় প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখছিলাম। অন্ধকার আর জ্যোছনা মিলে এক মায়াময় পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। হঠাৎ একটা দমকা ঠান্ডা হাওয়া আমাদের কাঁপিয়ে দিল। বুড়ো মাঝি কাজ থামিয়ে সামনের দিকে তাকিয়েছিল, সে এক অস্ফূট শব্দ করে উঠল। আমি তার দৃষ্টি লক্ষ করে তাকালাম আর চমকে উঠলাম। আমাদের নৌকো থেকে কয়েক হাত দূরে একটা ছায়ামূর্তি, চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ঢ্যাঙা রোগা সেই মূর্তি বড়ো বড়ো পা ফেলে খালের এপার থেকে ওপারে চলে গেল। ঠিক বড়ো বড়ো পা ফেলে নয়, দু-বার পা বাড়িয়েই খাল পার হল, যদিও খালটা চওড়ায় নেহাত কম নয় আর গভীরতায় এক মানুষ তো হবেই।

‘ওপারে পৌঁছে মূর্তিটা এদিকে মুখ ফিরিয়ে লম্বা একটা হাত জলে ডুবিয়ে দিল। তারপর একটা মাছ তুলে সেটা কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলল।

‘বুড়ো মাঝি কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ”দা ঠাউর রামনাম জপেন,” সে নিজেও আল্লা আল্লা বলে প্রার্থনা শুরু করে দিল। আমি রামনাম জপতে লাগলাম। ব্যাপারটা কী তা বুঝতে আমার দেরি হয়নি। একটা প্রেত রাতের অন্ধকার মাছ খেতে বেরিয়েছে।

‘আমি বোধ হয় একটু জোরেই রামনাম করেছিলাম, মূর্তিটা মুখ তুলে আমাদের দিকে তাকাল। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখলাম একটা বীভৎস মুখ। তারপরই সে মিলিয়ে গেল।

‘বুড়ো মাঝি বলল, ”আঁদারে ঠাওর হয় নাই দা ঠাউর, এটা হইল গিয়া কালীদহ। এহানে একবার একটা জেলে নাও ডুইব্যা গেছিল, একজন মরছিল। তারেই মাঝে মাঝে দেখা যায়, মাছ খাইতে আসে। এমন এক চাঁদনি রাতেই নাকি নাওটা ডুবছিল।’

‘ওরা আবার রান্নায় মন দিল। ভাত হয়ে গেছিল, কড়াইতে তখন পারশে মাছ তেলে ফুটছে, গন্ধ ছেড়েছে।

‘হঠাৎ একটা কালো লম্বা হাত শূন্য থেকে এসে ফুটন্ত কড়াই থেকে একটা মাছ তুলে নিল। তাকিয়ে দেখলাম সেই ছায়ামূর্তি নৌকোর একেবারে পাশে খালপাড়ে দাঁড়িয়ে সেই মাছটা কচমচ করে খাচ্ছে। বুড়ো মাঝির নাতি অজ্ঞান হয়ে পাটাতনের ওপর লুটিয়ে পড়ল, বুড়ো আল্লার নাম জপ করতে লাগল। আমার তখন তরুণ বয়স, মনে আর শরীরে শক্তির অভাব ছিল না। একটা চ্যালাকাঠ তুলে গনগনে আগুন ওই ছায়ামূর্তির দিকে বাড়িয়ে ধরে আমি বলে উঠলাম, ‘জয় জয় রামচন্দ্র, জয় জয় রাম।’

‘সেই মূর্তিটা রামনাম শুনে যেন থমকে গেল, আমার দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকাল। যেন ছোটো ছোটো দুটো জ্বলন্ত অঙ্গার আমাকে ভস্ম করে ফেলবে। তারপরই অদৃশ্য হল মূর্তি।

‘বুড়ো মাঝি বলল, ”আর এক দণ্ডও এহানে থাকন চলব না দা ঠাউর, যা নসিবে আছে হইব।” সে নৌকো ছেড়ে দিল। ইতিমধ্যে তার নাতির জ্ঞান হয়েছে।

‘কিন্তু নৌকো চলে না, কী ব্যাপার! তাকিয়ে দেখি পেছন দিকে একটা লম্বা কালো হাত নৌকোটাকে ধরে আছে, নৌকো এতটুকু নড়ছে না। বুড়ো মাঝি চেঁচিয়ে ওর নাতিকে বলল, ”কড়ার মাছগুলো অরে দিয়া দে, নইলে নৌকা ছাড়ব না।” নাতি উনুন থেকে কড়াই নামিয়ে হাতা দিয়ে একটা একটা করে মাছ তুলে ছুঁড়ে দিতে লাগল আর পিশাচটা সেগুলি লুফে গপগপ করে মুখে পুরতে লাগল। মাছ শেষ হবার পর সে নৌকোটা ছেড়ে দিল।

‘আধঘণ্টা যাবার পর চাঁদের আলোয় চোখে পড়ল একটা ছিপ তিরগতিতে আমাদের দিকে ছুটে আসছে। বুড়ো মাঝি কপাল চাপড়ে বলল, ‘হায় আল্লা, এবার ডাকাইতের পাল্লায় পইড়া গেলাম। আজ কী দেইখ্যা যাত্রা করেছিলাম কে জানে!’

‘আমার বুকের ভেতরটাও ধড়াস করে উঠল। পিশাচের হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে-না-পেতেই ডাকাতের হাতে, সত্যি বড়ো অশুভ দিনে যাত্রা করেছিলাম।

‘ছিপটা আমাদের কাছে আসতেই কে একজন গুরুগম্ভীর গলায় হাঁক দিয়ে বলল, ‘কেডা যায়?’

‘বুড়ো মাঝি গলা তুলে বলল, ”আমি ইমানুল হক সিরাজের বাপ।”

‘সিরাজ এক সময় নামি ফুটবল খেলোয়াড় ছিল, ঢাকা একাদশে খেলত, পরে কলকাতার বড়ো ক্লাবেও খেলেছে। মাত্র তিনদিনের জ্বরে মারা যায়। তখন তার বয়স তিরিশও পেরোয়নি। বুড়ো মাঝিই যে তার বাবা সেটা আমিও প্রথম জানলাম। পুববাংলার মানুষের কাছে খুব প্রিয় ছিল সিরাজ।

‘ছিপ থেকে এক মুহূর্ত কোনো সাড়াশব্দ এল না তারপরই গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন হল, ‘নাওয়ে কারা যায়?’

‘সোনাদিঘির ছোটো চৌধুরীর বড়োপোলা,’ বুড়ো মাঝি জবাব দিল, ‘অর কোনো ক্ষতি করিস না রহিম, আল্লার নামে তর কাছে দোয়া মাংগতাছি। ছোটোকত্তার কাছে তাইলে আর কোনোদিন আমি মুখ দেখাইতে পারুম না।’

‘আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল ফটিকের কথা। ফটিক ছিল আমাদের একজন লাঠিয়াল। কুচকুচে কালো গায়ের রং, বাবরি চুল আর তার শরীরের মাংসপেশি যেন কিলবিল করত। লাঠি খেলায় এ তল্লাটে কেউ তার সামনে দাঁড়াতে পারত না। আমার বয়স তখন এগারো কি বারো। আমি ওর খুব ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম, ফটিক দাদা বলে ডাকতাম। ফটিকও আমাকে খুব ভালোবাসত, হাতে ধরে লাঠি খেলা শেখাত। তারপর একটা ফৌজদারি মামলায় জড়িয়ে পড়ে ও নিরুদ্দেশ হয়েছিল। লোকমুখে শোনা গিয়েছিল ও রহিমের দলে যোগ দিয়েছিল। আমি গলা তুলে বললাম, ”তোমাদের মধ্যে ফটিক সর্দার বলে কেউ আছে?”

‘আবার মুহূর্তের নিস্তব্ধতা, তারপর অন্য এক গলায় কেউ বলে উঠল, ”কেডা গিজায়?”

‘আমি ছোটো চৌধুরীর বড়োছেলে রমেন্দ্র নারায়ণ,’ আমি বললাম, ‘ছোটোবেলায় ফটিক দাদা আমাকে লাঠি খেলা শেখাত।’

‘ছিপটা আমাদের নৌকোর পাশে এসে ভিড়ল। একজন লাফ দিয়ে চলে এল নৌকোয়। এতদিন পরেও আমার চিনতে ভুল হল না, আমি বলে উঠলাম, ‘ফটিক দাদা।’

‘ফটিক আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ”দা ঠাউর, কত বড়ো হইয়া গেছ তুমি। তুমি না কইলে চিনতেই পারতাম না।” তারপর বুড়ো মাঝির দিকে ফিরে বলল, ”তোমার কি আক্কেল নাই মিঞা, এতকাল নৌকা চালাইতেছ, জান না রাইতে এই পথে যাওনের কী বিপদ!’

‘বুড়ো মাঝি তাকে বলল, স্টিমার আজ অনেক দেরি করে আসায় যত বিপত্তি। তারপর সেই মেছো ভূতের কথা বলল, যে কারণে বাধ্য হয়ে আমাদের নৌকো ছাড়তে হয়েছে।

‘সব শুনে ফটিক বলল, ”খুব বাঁইচ্যা গেছ আজ। তা তোমাগো প্যাটে তো কিছু পড়ে নাই। আহা, দা ঠাউরের মুখ শুকাইয়া গ্যাছে, খুব কষ্ট হইতাছে।”

‘আমি বাধা দিয়া বললাম, ”না ফটিক দাদা, আমার কোনো কষ্ট হচ্ছে না।”

‘চুপ করো তুমি,’ ফটিক আমাকে এক ধমকে থামিয়ে দিল, তারপর বলল, ‘আমাগো খাওনের পাট চুইক্যা গ্যাছে অনেকক্ষণ। কিছুই তো নাই, থাকনের মধ্যে আছে চিড়া আর গুড়।’

‘তাই দাও,’ আমি বলে উঠলাম, আসলে আমার পেটের ভেতর চোঁ চোঁ করছিল। ফটিক ওই ছিপে গিয়ে চিড়ে আর গুড় নিয়ে এল। খিদের মুখে তাই অমৃত মনে হল। শুধু তাই নয়, ফটিকরা আমাদের অনেকটা পথ এগিয়ে দিল যাতে আর কোনো বিপদ না হয়।

‘ওরা বিদায় নেবার সময় আমি ওর হাতে পঞ্চাশটা টাকা দিতে গেলাম। আমার কাছে ওই টাকাই ছিল। তবে সে আজ অনেক বছর আগের কথা, তখন পঞ্চাশ টাকার দাম এখনকার প্রায় এক হাজার টাকা হবে। ফটিক কিন্তু কিছুতেই টাকা নিল না, উলটে আমাকে এমন ধমক দিল যে আমি আর কথা বলতে পারলাম না।

‘সেরাতের কথা আমি সারা জীবনেও ভুলব না।’

দাদু তাঁর কাহিনি শেষ করলেন। নাতি-নাতনিদের কারো মুখে কথা নেই, তারা সবাই দাদুর গায়ে গা সিটিয়ে বসে আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *