৩০. একটা হাসির ঝোরা

৩০.

ভিতর থেকে এমন একটা হাসির ঝোরা ঝরঝরিয়ে নেমেছিল, নিজেকেই পাগল বলে মনে হয়েছিল। হায়, কী বলব হে, বাজ-ধরা রাখাল রাজার বংশধরের ভিটায়, মাটির ঘরের দোতলায় দাঁড়িয়ে কী দৃশ্যই দেখেছিলাম। শুধু বর্ণনাতে তার রূপ খেলে না। অনুভূতির অরূপে তার রসের ধারা বহে। ভেলকিওয়ালা যেমন ডুগডুগি বাজিয়ে হাঁকে, ‘লাগ্‌ লাগ্‌ লাগ্‌ লাগ্‌, লাগ্‌ ভেলকি লাগ্‌’ তেমনি আমার ভিতরেও ডাক লেগেছিল, লেগেছে লেগেছে লেগেছে, কৌতুকের বান লেগেছে গো।’…কিন্তু, ওহে বিদেশি, তোমার কেন গাল সুড়সুড়িয়ে উঠেছিল যে, গালে হাত বুলিয়েছিলে।

পুরুষ বলে। সব পুরুষেই এই পুরুষের লীলা কিনা! সেই চিরপুরুষের মন। মনে মনে চোখে চোখে কৌতুকের বান ডেকেছিল যে। তবু নীতিবাগীশের ভ্রূকুটিকে বড় ডরাই। সে বলতে পারে, এতে কৌতুক কোথায় দেখলে হে। দুর্নীতি মানো না কি? অধমের ভাবনা নেই?

মানি বই কী। ভাবিও বটে। তবে কিনা, ঘরের নীচে পিছনে সেই ষোলো-কুড়ির বেলায়, নীতি আর ধর্ম খুঁচিয়ে ঘা করতে ইচ্ছা হয়নি। একা একা হেসেছিলাম অনেকক্ষণ। তারপরে ভেবেছিলাম এক্ষণে আর সেখানে নেই কেউ নিশ্চয়। ভেবে জানালার কাছে গিয়ে আর একবার উঁকি দিয়েছিলাম। আহ্‌ ওহে, ভুল দেখিনি তো। এদিকে এক কাঁঠাল গাছ, ওদিকে এক তাল। তার মাঝের ছায়ায় দাঁড়িয়ে তখনও শ্রীমান, আনুমানিক কুড়ি বছর। গোঁফ তেমন তেজী নয়, আ-ছাঁটা কালো রেখাটি গাঢ় দেখাচ্ছিল। মাথার চুল বারো-চারের সূক্ষ্ম কাট, জুলপি ত্যারচা। রোগা রোগা গায়ে সোনালি সিলিকের জামা। স্পষ্ট দেখেছিলাম, জলচুড়ি তোলা কালো পাড়ের ফরাসডাঙার কাঁচি ধুতি মোটা কোঁচায় ভুঁয়ে লুটানো। পায়ে ছিল ঘি রঙের নিউকাট। তখন আর শুধু দাঁড়িয়েছিল না। সিলিক জামার পকেট থেকে বের করেছিল সিগারেটের প্যাকেট, সাহেবের মুখ ছাপানো তাতে। ইতিউতি দেখে, সিগারেট ঠোঁটে ধরে, তিন কাঠি বরবাদ করে, চতুর্থতে ধোঁয়া উদ্‌গিরণ। তবু চোরের মন। ড্যাবডেবে ডাগর চোখে কেবল চারিদিকে চোরা নিরীক্ষণ।

ভেবো না যে, হতাশ প্রেমিক মূহ্যমান, দমকা দমকা নিশ্বাস ফেলছিল, আর ধোঁয়ার ধীর টানে ব্যথা ভুলছিল। রীতিমতন হুসহাস টান, নাকে মুখে ভলকে ভলকে ধোঁয়া উদ্‌গিরণ। যেন উত্তেজনায় রনরন্‌, কেবল মতলবের ধ্যান।

আমি ভাবছিলাম, কোন নগরের নাগর উটি। কোন গৃহের অতিথি। ও মুখপোড়া কখনও গাঁয়ের হতে পারে না। তা হলে, রাত পোহাতেই অমন সাজগোজের ঠাট থাকত না। তারপরে বলতে পারি না, হতেও পারে। জলে ডোবা বঙ্গবাসী, রাঢ়ের রঙ্গ তুমি কি বুঝবে!

আরও ভাবতে হয়েছিল। ভাবতে হয়েছিল, হাত তুলে থাপ্পড়খানি যে দিয়ে গেলে মেয়ে, ঘরের পিছনে ছায়া ছায়া ঝোপ-জমিনে তোমাকে আনল কে। নিশ্চয় সকলের সমুখ দিয়ে আঁচল ধরে টেনে আনেনি।

গোয়েন্দা ভাবনা, কতক্ষণ চলত জানি না। ঠিক সে সময়েই পিছনে ডাক শুনতে পেয়েছিলাম। সে ডাক শুনে একটু অবাক লেগেছিল। গলার স্বরের জন্যে না, স্বরের মালিক মেয়েটির জন্যেও না। তাকে চিনিনি। মন বলেছিল, সে মেয়ে রাজবংশের নয়। কেন না, চেহারাতে ধরতাই মিল ছিল না। আমার পোশাকি নামখানির পিছনে একটি ‘দা’ জুড়ে সে অনায়াসে ডেকেছিল, ‘আপনার হাত-মুখ ধোবার জল দিয়েছি নীচে।’

কথাবার্তার উচ্চারণও কেমন যেন চাঁচাছোলা, সমতল, সমান সমান। রাঢ়ের চড়াই-উৎরাইয়ের উঁচু-নিচু ছিল না। রাঙা মাটির সুর ছিল না। সব মিলিয়ে তাই একটু অবাক লেগেছিল। কিন্তু ওদিকে আবার ভয়, তাড়াতাড়ি সরে এসেছিলাম জানালার কাছ থেকে। অমন কৌতুকের খেলা দেখায় ধরা দিতে পারি না। বলেছিলাম, ‘এই যে যাচ্ছি।’

সে দাঁড়িয়ে ছিল সিঁড়ির ধাপে। নোটিস দিয়ে নীচে নামবে, তাই ভেবেছিলাম। অথচ কী ব্যাজ দেখ, মেয়েটি উঠে এসেছিল ঘরে। বলেছিল, ‘ব্যাগ স্যুটকেস কিছুই তো খোলেননি। গাড়ির জামাকাপড়ও ছাড়েননি।’

তার ব্যস্ততায় আমার ব্যস্ততা। তাড়াতাড়ি জামা খুলতে খুলতে বলেছিলাম, ‘এই যে ছাড়ি।’

শুধু ব্যস্ততা নয়। যে রকম পা বাড়িয়ে ঘরে চলে এসেছিল, যদি জানালায় গিয়ে দাঁড়ায়। সেই তরাসে আমি বেশ গলা তুলেই কথা বলেছিলাম। মুখপোড়াটা যাতে সরে পড়তে পারে। তাই আবার বলেছিলাম, ‘আপনি চলুন, আমি যাচ্ছি।’

মেয়েটি হেসে ফিরেছিল। বলেছিল, ‘আমাকে “আপনি” বলছেন! আমি অনেক ছোট।’

ততখানি চোখের মাথা খাইনি হে, যাকে অষ্টাদশী না বিংশবর্ষীয়া, কী বলে, তাকেও বড় বলে ঠাহর করব। তবে কি না, মেয়ে বলে কথা! আঠারো-বিশের অচিন মেয়েকে আপনি ছাড়া বলতে জানিনি। যাকে দেখতে পাচ্ছিলাম, তার বর্ণনা দিলে বলতে হয় এক শ্যামা যুবতী। শুধু শ্যামা বললে হয় না, তার চেয়ে বেশি, শ্যাম রঙেরই পোঁচড়া আর একটু গাঢ়। কালো বলবে? বলতে পারো। কিন্তু কোথায় যেন কী একটা ছিল, কালোতে একটা আলোর রোশনাই খেলছিল। ডাগর চোখের সাদায়, কালো তারার রোশনাই। সাদা দাঁতের ঝিলিক। স্বাস্থ্যে তার চড়াই ভূমির অধর উচ্চতা, ফের উৎরাইয়ের গভীরতা। অল্প চুলের গোছাটুকুই ঘাড়ের কাছে গোছানো ছিল আলগা ফাঁসে। গায়ের সামান্য জামাটা ধুয়ে ধুয়ে রং উঠে গিয়েছিল। গাছকোমরে বাঁধা শাড়িটার সেলাই ঢাকা পড়েনি। তার কথার স্বরে যত অনায়াস সুর, ভাবে তত ছিল না। সংকোচের আড়ষ্টতা ছিল। তবে অনায়াস সুরের মধ্যে যেমন কোনও বক্রতা ছিল না, তেমনি যেন ছিল এক বিজন বনের ছায়ায় নিবিড় নম্রতা। তার চেয়েও যদি বেশি বলতে চাও, তবে বলো, তকতকে সারল্যে কোথায় যেন একটি ব্যথা বেজে যায়। বিজন ছায়ায়, সেই বিষণ্ণতার কথা। তারপরে সেই অরূপাকে দেখে এই কথাটি মনে পড়ে যায় কি না, পরাণে ভালবাসা যাকে দিয়েছ, তার রূপের বেলায় অমন হাতটান কেন। অবিশ্যি, দোহাই হে, সেই ‘এক’ রূপের ভালবাসা ভেব না। সেই এক ভালবাসা, যা সকল প্রাণে বাজে। মেয়েটি কাদের?

বলেছিলাম, ‘না, সে তো বটেই। আপনি এ বাড়ির—’

‘ওমা! আবার আপনি বলছেন?’

তা-ও তো বটে। ঠেক খেয়ে হেসেছিলাম। ও হাসতে হাসতেই বলেছিল, ‘আমরা এ তরফের আত্মীয়। তবে আমাদের বাড়ি এখানে না।’

‘ও, পূজা উপলক্ষে?’

কথা শেষ করা যায়নি। তার আগেই মাথা-ঝাঁকানো জবাব শোনা গিয়েছিল, ‘না, না, আমরা এখানেই থাকি এখন। এ বাড়িরই লাগায়ে পশ্চিমে একটা ঘর আছে, সেখানে।’

মেয়েটির মুখে হাসি ছিল। কিন্তু হাসির মধ্যে কেমন একটা ঠেক খাওয়া আড়ষ্টতা। আবার বলেছিল, মানে, আমাদের নিজেদের কিছুই নেই। এখন মলুটিতেই থাকি। আত্মীয়দের কাছে।’

কেমন আত্মীয়তা, এখন আর মনে করতে পারি না। কী একটা যেন শুনেছিলাম। কিন্তু আর কিছু জিজ্ঞেস করতে পারিনি। একটা বিড়ম্বিত পরিবারের ছবি যেন আমার চোখে ভেসেছিল। যে বিড়ম্বনার কাছে কাছে একটি অসহায়তা পা টিপে টিপে চলে।

ততক্ষণে আমার ধোয়া জামাকাপড় বের করেছিলাম। তার সঙ্গে ধৌত প্রক্ষালনের অন্যান্য সরঞ্জাম। মেয়েটি সিঁড়ির দিকে চলে গিয়ে আবার ফিরে তাকিয়েছিল। হেসে বলেছিল, ‘আপনি তা হলে আসুন। এ ঘরের নীচেই বারান্দায় জল রেখেছি।’

প্রায় ওর পিছনে পিছনেই নেমেছিলাম। উঠোনে লাল ভুঁয়ে ছোট রায় তখন তাঁর রাঙা হাত তুলে চেঁচাচ্ছিলেন, ‘আহ্‌, তু সে কথা ক্যানে বুলছিস আঁ? তু পারবি না, পারবি না, মিটে গেল। কথা বাড়ায়ে তো কুন লাভ নাই।’

যাকে বলছিলেন, সেই খড়ি-ওঠা কালো গা, কোমরে ঠেঁটি জড়ানো লোকটার কিন্তু দন্ত বিকশিত। বলেছিল, ‘ই দ্যাখ ক্যানে, আমি কি সে কথা বুলছি। সিদ্ধা শুকনো, সব করা আছে। ভাঙানটো হয় নাই। চাল দিব কুথা থেক্যা—।’

কথা শেষ করতে পারেনি সে। ছোট রায়ের রাঙা মুখে যত উত্তেজনা, গলায় তত। বলেছিলেন, ‘ন্যাকামি করার জায়গা পাস নাই, না কী, আঁ? আজ রাত্তিরে পূজা, লোকজনের আসা-যাওয়া, অখন তু বলছিস, ধান রয়েছে, চাল করা নাই? ইকে কী বলে আঁ?’

লোকটা ততক্ষণে রাঙা মুখের ঝাপটায় পিছন ফিরেছিল। বলতে বলতে গিয়েছিল, ‘আচ্ছা গ, আচ্ছা, আধ মণ চাল পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

হয়তো আরও কিছু বলতেন ছোট রায়। তার আগেই চোখ পড়ে গিয়েছিল আমার দিকে। তখন দ্যাখ ক্যানে, রায়ের কী বিব্রত ভাব! রাঙা মুখে অমনি হাসি ঝিকঝিকিয়ে উঠেছিল। বলেছিলেন, ‘ইয়াদের কী বুলব বলো দিকিনি বাবা। লিবার সোময় লিবে, আর তারপরে…।’

মাঝপথেই কথা থামিয়ে হাঁক দিয়ে উঠেছিলেন, ‘অ সুষি!’

যে দাওয়াতে আমি দাঁড়িয়ে, সেই দাওয়ারই এক পাশ থেকে জবাব এসেছিল, ‘হ্যাঁ, এই যে!’

সেই মেয়েটি, যে ডাকতে গিয়েছিল ওপরে। যার নাম সুষি। পুরো নাম কী, কে জানত। ছোট রায়ের সহজ কথাই যেন ধমকের সুরে বাজছিল। বলেছিলেন, ‘জল দিছিস?’

আমিই তাড়াতাড়ি বলে উঠেছিলাম, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, দিয়েছে।’

‘অ, আচ্ছা। কিন্তু বাবা, তুমি কি মাঠে যাবে।’

মাঠে? সেই অবস্থায় হঠাৎ মাঠে যাবার কথা কেন?

কেন, তার জবাবও পেয়েছিলাম। ছোট রায়ের রাঙা হাসি একেবারে আকৰ্ণবিস্তৃত। বলেছিলেন, ‘ব্যবস্থা যা আছে বাবা, তুমাকে আর সিখানে যেতে বুলতে ইচ্ছা করে না। বউ-ঝিয়েরা কুনরকমে যায়, আমরা সব মাঠেই যাই।’

কী অবুঝ হে, আমি আবার তখন সুষির দিকেই চেয়েছিলাম। আর সুষির নজর মাটির দিকে। পরক্ষণেই যেন ধাঁধার জবাব মিলেছিল। বলে উঠেছিলাম, ‘ও! না তার দরকার নেই।’

ছোট রায়ের হাসিতে আপ্যায়নের আকুঞ্চন। বলেছিলেন, ‘তুমি তো রাস্তাঘাট চেন না। তা হলে, কাউকে সঙ্গে পাঠাতাম। আচ্ছা বাবা, হাত-মুখ ধোও। সুষি, বউঠানকে বলে খাবার-দাবার দিস।’

বলেই কোন দিকে যেন অদৃশ্য হয়েছিলেন। তাঁর কি তখন দাঁড়াবার সময় ছিল। কারুরই ছিল না। দেখেছিলাম, উঠোনের ওপর দিয়ে গিন্নি-বউ-মেয়েদের অনবরত আনাগোনা। এ ঘর থেকে ওঘরে, এ দাওয়া থেকে ও দাওয়ায়। কারুর হাতে পেতলের পরাত, কারুর কাঁখে কলসি। কেউ চলেন শাড়ি নিঙাড়ি নিঙাড়ি, কারুর হাতে ফুলের ডালি। রান্নাঘরের দিকে তো কথাই নেই।

তার মাঝেই দাওয়ার নীচে একখানি মোটা তক্তা পাতা। পাশে জলের বালতি। লেগে যাও ধৌতকার্যে। জল নিকাশের ভাবনা নেই, ধারেই নালি কাটা ছিল। নগর চালের গোসলখানার প্রত্যাশা ছিল না। তবে কিনা, শহরের হাওয়া লাগানো শরীর কিনা। তাই একটু কুঁকড়ে যাওয়া। কিন্তু হার মানতে যাইনি। দিব্যি কাজ সেরে নিয়েছিলাম। জামা-কাপড় বদলাতে বদলাতে আবার সুষির ডাক, যে-ডাকে নামের শেষে ‘দা’। নীচে গিয়ে অন্য ঘরে খেতে বসেছিলাম বড় রায়ের পাশেই। খেতে দিয়েছিলেন স্বয়ং রায়গিন্নি। কাছে নির্দেশের অপেক্ষায় সুষি।

কিন্তু ই দ্যাখ গ, একে কী রকম জল-খাবার খাওয়া বলে। মস্ত বড় কাঁসার থালায় দেখেছিলাম প্রায় অগুনতি লুচি। তার সঙ্গে বেগুন ভাজা, নানাবিধ মিঠাই।

সে পেট কি আর আমাদের। বলেছিলাম, ‘এত দিয়েছে! খেতে পারব না যে।’

সবাই যেন হেসে বাঁচেননি। বড় রায় মুখের মধ্যে খাবার নিয়ে বলেছিলেন, ‘এত কোথায় বাবা, অই তো ক’খানি। খেয়ে নাও।’

বড় রায়ের গলা ছোট রায়ের থেকে নিচু, মার্জিত। ছোট রায় থাকলে পুরো মলুটির ভাষায় হাঁকডাক করে উঠতেন। বড়গিন্নি বলেছিলেন, ‘খেয়ে নাও বাবা, সেই তো কাল কখন সাঁঝবেলাতে দুটি মুখে দিয়ে গাড়িতে উঠেছিলে। এদিকে দুপুরে খেতে অনেক বেলা হবে।’

উপরোধে ঢেঁকি গেলা যায় জানতাম। কিন্তু সকালবেলাতে ওরকম লুচির পাঁজা না। তখন একমাত্র সুহৃদ দেখেছিলাম সুষিকে। সে বলেছিল, ‘তুলেই নিন কাকিমা, লাগলে উনি চেয়ে নেবেন।’

অতএব তুলে নিতে হয়েছিল। খেতে খেতে আরও দু’জনকে দেখেছিলাম। যিনি ঘোমটাহীনা সধবা, তিনি বড়-ছোট, দুই রায় বসানো, নীল চোখ, আগুনরাঙা বর্ণ। বুঝতে অসুবিধা হয়নি, উনি রায়সহোদরা। আর একজন মাথায় ঘোমটা রেখেছিলেন বটে। মাঝে মাঝেই ঘোমটার ফাঁকে তাঁর মুখখানি উঁকি দিচ্ছিল। সে মুখে হাসির মৌরসিপাট্টা। আন্দাজে ধরা, তিরিশে ছোঁয়া সেই মুখে হাসি কেবল ঠোঁটে ঠোঁটে না। কেবল ডাগর কালো চোখের তারায় তারায়ও না। প্রতিমার মতো মুখখানিতে, কপালের গাঢ় রঙের টিপেও হাসি যেন ছলকানো। পরিচয় প্রথম ক্ষেপেই পেয়েছিলাম, উনি ছোট রায়গিন্নি। তবে যদি পুছ করত, বড়গিন্নির শ্যাম স্নিগ্ধ বর্ণের সঙ্গে টিকলো নাক, ডাগর কালো চোখ, মায় হাসিটির সঙ্গে ছোট গিন্নির এত আদল কীসের, তবে জবাব পেতে, ওঁরাও দুই সহোদরা। দুই সহোদরের বউ, দুই সহোদরা। সেই জন্যেই বড় রায়কে শুনেছিলাম কখনও ছোটগিন্নিকে তুইলোকারি করতে, কখনও তুমি। কী ব্যাজ বল, শালি কি না ভাদ্দর বউ! যাঁকে একদা জামাইবাবু বলে জিভ ভেংচে কাঁচকলা দেখিয়েছে, তাঁকেই কিনা এখন ভাশুরঠাকুর বলে অন্য রেয়াত দিতে হচ্ছে।

তা হোক গিয়ে। আপনা-আপনিতে সে এক সুখে স্বস্তিতে ঘর করা। ভাদ্দরবউয়েরও তেমন ভাশুরঠাকুরের কাছে অসূর্যম্পশ্যা থাকবার ভয় ছিল না। বড় রায়ের হাসিটি তো বড়ই মিঠা লাগছিল। যেন, ‘কী রে, আর জিভ ভেংচে কিল দেখাবি? কেমন জব্দ হইছিস।’

খাওয়ার ব্যাপারে সেই দু’জনেও আপ্যায়নের ত্রুটি রাখেননি। ‘তা বুললে কি হয়, জোয়ান বিটাছেল্যা। এখন কত খাবে।’

তা বটে কথা। তবে কিনা, জোয়ান বিটা তেমন বীরপুরুষ ছিল না তো! রাজরাজড়ার ধরা-ছোঁয়ায় থাকেনি কভু।

খাওয়ার শেষে বড় রায় বলেছিলেন, ‘সারারাত গাড়ির ধকল গেছে। এবার গিয়ে একটু বিশ্রাম করো।’

বিশ্রাম! সে শব্দের অর্থ কী হে! বিশ্রাম করতে মলুটিতে গিয়েছিলাম নাকি। আমার ভিতর দুয়ারে যে তখন বেজায় ঝাপটা। পাল্লা একেবারে হাট করে খোলা। মন তখন মলুটির রাঙা মাটির পথে রওনা হয়ে গিয়েছে। কেবল কি মলুটি নাকি। সুরে বেজেছিল, গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ, আমার মন ভুলায় রে। আমার চোখে হাতছানি তখন, মন্দিরে মন্দিরে পোড়া ইটের চুপচাপ নিথর অনড় পুরাণের দেবদেবীদের। কাঁদরের পাথর ঝরানো, নুড়িতে নুড়িতে বাজনা বাজানো ঝোরায়। হেমন্তের নীল আকাশে, রায়মশাইদের চোখের রঙে ঝলকানো আকাশ, সবুজের চোখ জুড়ানো স্নিগ্ধতায়, আর রাজাদের গায়ের রঙে মেশানো রাঙা মৃত্তিকায়। মনের যাত্রা তখন কিংবদন্তীর দেশে।

বলেছিলাম, ‘বিশ্রাম আর কী করব, তার চেয়ে একটু ঘুরে বেড়িয়ে আসি।’

অমনি বড় রায়ের মুখের রাঙা হাসিতে একটু দুশ্চিন্তার ছায়া। বলেছিলেন, ‘তা যেতে পারো, কিন্তু একলা একলা তো পারবে না। কাউকে সঙ্গে দিতে হয়।’

কথা বলতে বলতে, ই দ্যাখ, সেই মুখপোড়া এসে হাজির হয়েছিল। মামা, না পিসেমশাই—কী বলে ডেকেছিল, এখন আর স্মরণ করতে পারি না। এসেই বলেছিল, ‘কুথাক্‌ যেতে হবে?’

বড় রায় তৎক্ষণাৎ বলেছিলেন, ‘আর সি খোঁজে তুমার দরকার নাই বাবা। নতুন মানুষকে তুমার হাতে দিয়ে তারপরে বিপদে পড়ি আর কী।’

মুখপোড়ার কপালে ঝাঁপানো বারো আনা চুলে লেগেছিল ঝটকা। বলেছিল, ‘ক্যানে, বিপদ হবে ক্যানে। কী করতে হবে বলেন না।’

দেখেছিলাম, বড় রায়ের রাঙা মিঠে হাসিখানি দিব্যি বাঁক খেতে পারে। বলেছিলেন, ‘না বাবা ধনু, তুমার হাতে ইয়াকে আমি ছাড়তে লারব।’

ধনুর বিরক্ত উৎসুক নজর তখন একবার আমার দিকে। ফিরে বড় রায়ের দিকে। আমি দেখছিলাম, তার কচি আভা গালে তখনও গোরা কিশোরীর হাতের দাগ আছে কিনা। শ্যামলা গালে সেরকম কিছু চোখে পড়েনি। কিন্তু কেন জানি না, কে যেন কেমন একটু নজর কাড়ছিল আমার। তার সঙ্গে মনও। সে যে কেবল কিশোরীর চপেটাঘাত খায়, তা না। তাকে স্বয়ং বড় রায়ও যেন ওলাই শীতলার মতো ভয়ে ভক্তি দেখাচ্ছিলেন। আমার মতো একটি জোয়ান বিটাকেও তার সঙ্গে ছেড়ে দিতে ভয় পেয়েছিলেন। তা হলে, সে ধনু তো যেমন-তেমন ধনু নয়।

তার প্রমাণও তৎক্ষণাৎ দিয়েছিল। ফরাসডাঙার কাঁচি ধুতির কোঁচায় ঝাপটা মেরে ঠোঁট উলটে বলেছিল, ‘তবে যা খুশি তাই করেন না।’

বলে চলে যাচ্ছিল। বড়গিন্নি ডেকে বলেছিলেন, ‘এই ধনু, খেয়ে যা।’

তার জবাব মাত্র এক কথায়, ‘এখন না।’

বড় রায় কিন্তু হেসেছিলেন। বলেছিলেন, ‘যা ছেলে বাবা, কী বলব। ওকে নিয়ে সব সময়ে চিন্তা, কোথায় কখন একটা গোলমাল বাধিয়ে বসবে। বিপদ-আপদ না ঘটিয়ে সুস্থ ছেলে দেশে ফিরলে হয়।’

জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘এখানে থাকে না?’

‘না, শিউড়িতে বাড়ি, আমাদের আত্মীয়।’

‘খুব ডানপিটে বুঝি?’

বড় রায় রাঙা হেসে বলেছিলেন, ‘ও যে কী পিটে নয় বাবা, তা জানি না। আছ তো দু’ দিন, দেখবে ধনুকে নিয়ে ঠিক একটা কিছু গোলমাল হয়েছে।’

কথা বলতে বলতে আমরা তখন অন্দর ছেড়ে সদরে। পূজা-দালানের উঠোনে ভিড় আরও বেড়েছিল। কেবল ছোটদের না। প্রথম প্রবেশে খালি গা কালো কালো নেংটি পরা মানুষ দেখেছিলাম, দু’ তিন জন। তখন পাঁচ-সাতজন। তারা কেউ সাঁওতাল, কেউ ঢাকী, কেউ পূজাবাড়ির কাজের লোক। ইতিমধ্যেই পালকের ঝাড় পরানো, গুটিকয় ঢাক জড়ো হয়েছিল এক পাশে। গুটি দুই কুচকুচে কালো অজা। কাঁঠালপাতা তাদের মুখের কাছে। মাঝে মাঝে ম্যা ম্যা শব্দ আর পাতা চিবনো। ছোটদের হাত নিশপিশ, থেকে থেকেই ঢাকের পিঠে কাঠি পিটিয়ে দিচ্ছিল। অপটু হাতের সেই পিটুনির শব্দে যেন মহানিশার সঙ্কেত বাজছিল। ওদিক কুমোরদের হাত অবিশ্রান্ত। কাজ চলছিল পুরা দমে। মুণ্ড আর অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মালায় হলদে রঙের প্রথম কোট লেগেছিল।

বড় রায়কে বলেছিলাম, ‘আমি একলাই ঘুরে আসি না। বেশি দূরে তো যাব না।’

তবু তাঁর দ্বিধা। বলেছিলেন, ‘ঘুরে আসতে পারবে। তবে সঙ্গে কেউ থাকলে ভাল হত। তুমি অচেনা তো, সবাই ডেকে ডেকে জিজ্ঞেসাবাদ করবে। তা বেশ, ঘুরে এস একটু। গাঁয়ের মধ্যে যদি যেতে চাও তবে দখিন দিকে যাও।’

সে-ই ভাল। উত্তরের সতীঘাট দিয়ে ঢুকেছিলাম। দক্ষিণের অচেনাতে যাওয়াই ভাল। উঠোনের পাশ দিয়েই, গ্রামের বড় রাস্তা চলে গিয়েছিল। সেই পথে এগিয়েছিলাম। বড় রায় মিথ্যা বলেননি। যা আশঙ্কা করেছিলেন, তার চেয়ে বেশি, পথে দেখা হেন ভদ্রাভদ্র ছিল না, যে ডেকে জিজ্ঞেস করেনি, ‘কোন বাড়িতে আগমন, কোথা থেকে।’ রকে বসা ভদ্র যুবার দলবল, আর কালো কিষ্কিন্দে আধ-ন্যাংটা গামছা কাঁধে লোকটাই বলো, সকলের এক প্রশ্ন। তার মধ্যে পথের ধারে লুলা মানুষটা হেসে বলেছিল, ‘অই গ, চিনতে পেরেছি, অমুক বাড়ির জামাই না? দুটো পয়সা দিয়া যান গ।’

তা না হয় দিচ্ছি, কিন্তু জামাই বলা ক্যানে হে। নতুন কি কেবল জামাই নাকি। পয়সা দিয়ে এগিয়েছিলাম। চলতে চলতে চড়াই উঠেছিলাম, তারপরে আবার উৎরাই। সেই আমার প্রথম উত্তর রাঢ়ের গ্রাম দেখা। পুবের জলে ভাসা বঙ্গের সঙ্গে বিস্তর তফাত। বাড়ির পরে বাড়ি, গায়ে গায়ে বাড়ি। লাল মাটির দেওয়াল, খড়ের চাল। তার পাশে পাশে পাকা মোকামও কম না। তবে সেই এক কথা, যত বাড়ি তার থেকে মন্দির বেশি। এত মন্দির আর কোথাও দেখিনি, তার সঙ্গে পোড়া ইটের লাল গায়ে এত কারুকার্য। দেখেছিলাম পোড়া ইটের লাল গায়ে সেথা মহাকাব্যের রচনা। রামায়ণ মহাভারতের কাহিনী। দশাননের সীতাহরণ, মৃত্যুবরণ, রামরাজ্যের নানা আলেখ্য। পাণ্ডব কৌরব কুরুক্ষেত্র স্বর্গযাত্রা। ছবি। সেই সঙ্গে পুরাণের অনেক চরিত্র, নানান কাহিনী। শুধু কি তাই নাকি। নবাবি বাদশাহি আর ফেরঙ্গ রঙ্গ কত নানা অঙ্গেভঙ্গে। আবার, সামান্য নরনারী লীলা করে নানা প্রকৃতি-প্রকারে। তবে কিনা, সবাই পড়ি পড়ি মরি মরি। অনেক মন্দিরই আগাছায়, শ্যাওলায় ঢাকা পড়েছে। কোথাও বিগ্রহের দরজার কাছেই মন্দির-চূড়া মাথা লুটিয়ে পড়েছে। দেওয়ালের গাঁথনি-ভাঙা হাড়ল গর্ত, গোখরোর বাসার ফাটল। কোথাও চিহ্ন শুধু ইটের স্তূপে, কেবল প্রাচীনের জীর্ণ গন্ধে গন্ধে।

যেন ভুলে গিয়েছিলাম, কোথায় গিয়েছি, কোন সেই দেশে। বর্তমানকে ছাড়িয়ে আমার কালের সীমানা পেরিয়ে। যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম এক পরিত্যক্ত নগরে। নিজের দৃষ্টিকে বা কী বলি, শ্রবণকেই বা কী। ওহে, আমি তখন বিরাজমান দূর অতীতে। সেথা, কত হাসি, কত কান্না, কত যুদ্ধ, কত শান্তি, কত না দীর্ঘশ্বাস, ব্যথা রবে বেজেছিল। দেখেছিলাম, বাজধরা রাখালরাজা দূর থেকে চেয়ে আছেন মলুটির বুকে।

অই, কী বুলব হে, মলুটির নিশি ডাক দিয়ে নিয়েছিল আমাকে। গ্রাম পেরিয়ে আবার উৎরাই নামিয়ে নিয়েছিল ঢলে। রাঙামাটির সেই পথের ধারে, সীমানায় দেখেছিলাম গ্রাম-সীমান্তের ঘর গৃহস্থ-পরিবারদের। বাউরি, বাগ্‌দি, হয়তো সাঁওতালও কিছু কিছু। তারপরে আবার চড়াই আর দক্ষিণে দৃষ্টি হারানো সবুজ মাঠ। আমার চোখে যেন ঝিলিক লেগেছিল। দেখেছিলাম সেই তেপান্তরে বনস্পতির ছায়ায়, কালের ঝাপটায় কালি লাগা লাল মন্দিরচূড়া। মনে পড়েছিল দক্ষিণে মৌলীক্ষা মন্দির। রাজ-উপাস্যা, গ্রামদেবী বিগ্রহ সেখানে।

চড়াই ঠেলে তেপান্তরে গিয়ে সহসা থমকে দাঁড়িয়েছিলাম। কোথা যেন কলকল ছলছল নির্ঝরের ঝরঝর বেগে নুড়ি বাজছিল রিম্‌ঝিম্ রিম্‌ঝিম্‌। কোন দেশে হে, সে কি এই ধুলার সংসারে। তবু যেন মনে হয়েছিল, সেথা এক ভিন্ন দেশ। অবাস্তব অলৌকিক। এগিয়ে গিয়েছিলাম শব্দ লক্ষ্য করে। সতীঘাটের থেকে অনেক চওড়া গভীর পুবের ঢলে নামা এক নদীনির্ঝর। তীরে তীরে বাবলার বন। বড় বড় পাথর, কালো লাল, নানা ভাবে শয়নে। যতই পশ্চিমে চাও, মৃত্তিকা আকারে চড়াও, তারপর সেই দূরে আকাশের গায়ে গভীর কালো রেখা, যেন মেঘের মতন। মেঘ নয়, নজর জানান দিয়েছিল মেঘাকৃতি পাহাড়।

নদীর কূলে কূলে পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম মন্দিরের সামনে। সেখানেও এক নয়, একাধিক। দেবীর স্বামী মহাদেব পাশে পাশে আপনাকে ছড়িয়ে ছিলেন। ইটের গায়ে সেই সব মহাকাব্যপাঠ। বনস্পতির নিবিড় ছায়ায় পাখিডাকা কুক্‌ কুক্‌ পিক্‌ পিক্‌ কিচিরমিচির রবের মধ্যে মলুটির নিশি ঘোরে আত্মহারা হয়েছিলাম। অচৈতন্য হে, যেন বাহ্যিক চেতন ছিল না। মৌলীক্ষার মন্দিরবেদিতে বসে সাল তারিখের সীমানা ছাড়িয়ে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে বসে আমার প্রথম দেখা রাঢ়ের গ্রাম মলুটির দিকে তাকিয়ে ছিলাম। যেন এক কচ্ছপের পিঠে এক জনপদ। উত্তরে কাঁদরের উৎরাই, দক্ষিণে নদীর ঢল৷ পশ্চিমে পাহাড়, পুবে নীচে নীচে তরতরিয়ে ছুটে যাওয়া ভূমি।

কতক্ষণ বসেছিলাম, জানি না। সংবিৎ ফিরেছিল গলার আওয়াজে, ‘অ্যাই যে, একলাটি বস্যা আছেন দেখছি।’

চমকে চোখ তুলে দেখেছিলাম, শ্রীমান ধনু। মুখে তার জ্বলন্ত সিগারেট।

.

৩১.

আজ্ঞে না, যদি ভেবে থাকো তোমাকে দেখে শ্রীমান ধনু মুখপোড়া মুখের জ্বলন্ত সিগারেট নামিয়ে নেবে, তবে সে ভাবনা রাখো গিয়ে নিজের ভাবনায় গুঁজে। ওসবের বালাই তার নেই। কাঁচি ধুতির কোঁচাটি ভুঁয়ে লুটিয়ে সে ধপাস করে বসেছিল মৌলীক্ষার দাওয়ায়। জবাব পাবার প্রত্যাশা করে যে সে কথা পুছ করেছিল, তা নয়। দেখতে পেয়েছিল, তাই। দাওয়ার ওপর বসে, সিগারেটে আরও গুটি কয় হুস্‌ হুস্‌ টান দিয়ে বলেছিল, ‘ইঃ, শালো কোমরটা টনটনাচ্ছে।’

শালো মানে শালা এটা জানা গিয়েছিল, সানা আর নারাণের বলদ তাড়ানো বুলি থেকেই। কিন্তু এমন কী পর্যটন করে ধনু এসেছিল যে, ‘শালো কোমরটা’ টনটনিয়ে যাচ্ছিল।

না, জিজ্ঞেস করবার সাহস হয়নি। কেবল শুনেই যাচ্ছিলাম। ভাবছিলাম, ঘুরতে ঘুরতে সে নদীর ধারে মৌলীক্ষার মন্দিরেই ঠিক এসেছিল কেন। সেই অভিসারের উদ্দেশ্যে নাকি।

সে কোমরে বার কয়েক মোচড় দিয়ে পকেট থেকে বের করেছিল সিগারেটের বাক্স। সাহেবের ছবি ছাপানো সেই বাক্স। আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘খাবেন?’

বোঝো! তুমি আবার ভাবছিলে ধনু মুখের সিগারেট নামিয়ে নেবে কিনা। তাড়াতাড়ি নিজের পকেটে হাত দিয়ে বলেছিলাম, ‘না না, আমার আছে।’

‘থাকুক না। আমারটাই খান না মশায়!’

কাঁচা মুখে পাকা সম্বোধন। শুনলে যাদের রাগ হয় তাদের হয়, আমার যেন হাসির উদ্রেক করছিল। ততক্ষণে আমার বাক্স বের করেছিলাম। বলেছিলাম, ‘ওটাতে আমার ঠিক হবে না। এটাই খাচ্ছি।’

ধনু আমার বাক্সর দিকে তাকিয়েছিল। তাকিয়ে বোধ হয় অধমের সিগারেটের ওপর একটু ছেদ্দা হয়েছিল। বলেছিল, ‘আপনারটা বেশি দামের। ভেতরের মালটাও বেশ ভাল, খেয়ে দেখেছি মৌজ হয়।’

বলে নিজেরটা ফেলে দিয়ে হাত বাড়িয়ে বলেছিল, ‘দিন তো আপনার একটো সিগারেট খাই।’

অই, ও হে, নিশ্চয় নিশ্চয়! শত হলেও, নেশার মর্ম বোঝবার একটা মানুষ। বয়সের কথা ভাবছিলে? তা অই সেই কুড়ির বেশি না। তখন কাছের থেকে আরও দেখেছিলাম, গালেতে ক্ষুরের টান লাগা সত্ত্বেও মহাশয়ের গাল তখনও নরম, রোঁয়া পাতলা। গোঁফ জোড়াটি কালো বটে, নতুন আর নরম। হতে পারে, তখন তোমার বয়স তার দ্বিগুণ না হোক, দেড়া! তা বলে এমন কোনও লেখাজোখা ছিল না, একটা সিগারেট চাইতে পারবে না।

তাড়াতাড়ি একটা সিগারেট বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। ধনু নিয়ে একবার শুঁকেছিল। বাঁয়ের বুড়ো আঙুল ঠুকে ঠুকে আগুন ধরিয়েছিল। ধোঁয়া ছেড়ে আরামসূচক শব্দ করেছিল। তারপরে জুতো জোড়া নীচে খুলে মন্দিরের দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসতে গিয়ে হঠাৎ সরে এসেছিল। বলেছিল, ‘না বাবা, তা’পরে চুক কর‍্যা একটো মেরে যাক আর কী।’

অনেক চেষ্টাচরিত্র করেও ধনুর ভাষায় আঞ্চলিকতার ছোঁয়া যাচ্ছিল না। কিন্তু চুক করে কী মারবে। বলে আবার মন্দিরের ভিতরে বাইরের দেওয়ালে সন্দেহে দেখেছিল। তখন জিজ্ঞেস না করে পারিনি, ‘কী মারবে?’

‘সাপ।’

ই দ্যাখ হে, বুক ধড়াসে গিয়েছিল আমার। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘সাপ আছে নাকি?’

ভাগ্যিস, ন্যাকা বলেনি আমাকে, এমনই ধনুর চাহনি। ডাগর চোখ দুটি গোল করে বলেছিল, ‘বলেন কি, সাপ নাই আবার? কালই তো পেল্লায় এক দুধ গোখ্‌রু দেখ্যাছি। আই বাপ্‌, তার ফণা কী! শালো আমার মাথা ছাড়ায়ে উঠেছিল।’

এই দেখ, কথা শুনে গায়ের মধ্যে কেমন করে উঠেছিল। প্রায় নিশ্বাস বন্ধ করে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তারপর?’

‘চোঁচা দৌড়! সামনে একটো পাথর ছিল, তা-ই। না হলে শালো আমাকে কাল দিইছিল আর কী। মস্ত ফাঁড়া গেছে।’

সত্যি কথা তো? তা বোধ হয় হবে। মহাশয় একটি গোলমেলে মানুষ, সন্দেহ নেই। চোখমুখ দেখে মনে হয়েছিল, মিথ্যে কথা বলবার পাত্র না। নিজেই আবার বলেছিল, ‘ই দেশে সাপ হবে না ক্যানে বুলেন। মন্দিরের ঘটা দেখেছেন। আই বাপ্‌, মন্দিরে মন্দিরে ছয়লাপ। গোটা গাঁটো ইটের পাঁজায় ভরতি। ইয়ারা সাপ পোষে। কিন্তু একটো ইটে হাত দিতে যান, ই বাবা, একেবারে খেয়্যা ফেলে দেবে।’

অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কেন।’

‘সবাই চায় তো।’

‘কী চায়?’

‘ইট। দ্যাখেন নাই, ইটের গায়ে ছাপা। ঠাকুরদেবতার ছাপ আছে না সব। আমার কাছে কত লোকে চেয়েছে, মলুটির মন্দিরের ছাপা ইট।’

‘কী করবে ইট দিয়ে?’

ধনু সিগারেটে টান দিয়ে গলগলিয়ে ধোঁয়া ছেড়েছিল ঠোঁট বাঁকিয়ে বলেছিল, ‘কে জানে, কী করবে। লিয়ে যেতে পারলে পয়সা মিলবে বুলেছে। যা তা লোক না তারা, লেখাপড়া জানা লোক।’

ধনুর কথা শুনে মনে হয়েছিল, যেন সে অন্য সমাজ থেকে এসেছে, শিক্ষিতজনদের কেউ না। যাকে বলো ভদ্রজন। যেন কথা বলছিল গ্রামের অন্ত্যজ, সানা কিংবা নারাণ। অথচ সে যে ভদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে, তার ছাপ সর্বাঙ্গে। ইস্তক, সিল্কের পাঞ্জাবির ফাঁকে কাঁধের কাছে পৈতাগাছটিও দেখা যাচ্ছিল।

আমি ভাবছিলাম শিক্ষিত ভদ্রজনদের কথা। যাঁরা মলুটির মন্দিরের পোড়া ইটের কারুকার্য পয়সা দিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। অজানা ছিল না, প্রাচীন বস্তু সংগ্রহের নেশা অনেক মানুষের। কেউ সাজায় আপন সংগ্রহশালা, কেউ দশজনের। তখন মনে পড়েছিল, নগরের বিশিষ্ট মানুষের ঘরে দেখেছি, হাল আমলের ঝকঝকে আসবাবের গায়ে প্রাচীন সংগ্রহ। সরকারি আর বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘরে প্রাচীনের নানান উপাচার। কাঠ, পাথর, মাটি, যা পাওয়া গিয়েছে। ধনু মিথ্যা বলেনি। এই অধমের মনেও-সে ঔৎসুক্য জাগিয়েছিল। কল্পনা করেছিলাম, পোড়া ইটের কারুকার্য কাব্যকথা আমার ঘরের দেওয়াল জুড়ে। নিজের ঘরের সাঁঝবেলার আঁধার-আঁধার ছায়ায় দেওয়ালের দিকে চেয়ে আমি যেন চলে গিয়েছি সেই মুনিঋষির যুগে। সেই যখন পরাশর নামে মুনি দেহলগ্ন মৎস্যগন্ধা কোলে। হরিণী সোহাগে মগ্ন শকুন্তলা। কীচকে যবে বধে ভীম, অর্জুন যবে শোনে শ্রীমদ্‌ভাগবত শ্রীকৃষ্ণমুখে। আর যবে ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি দেখে প্রথম নারী। তারপরে, অশোকবনেতে সীতা রাক্ষসী বেষ্টিতা, রামচন্দ্র পূজেন দশভূজা।

কল্পনা করেছিলাম, মলুটির ভাঙা মন্দিরের ধূলায় ছড়ানো সংগ্রহে আপন ঘর সাজিয়ে চলে যাব দূরে, সেই বিস্ময়কর যুগে। যে যুগের কথা যত শুনি, মিটে নাই, মিটিল না, মিটিবে না আশা।

ধনুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তা কী হল, নিয়ে যেতে পারলে না?’

ধনুর মুখ একেবারে বিরক্তিতে কোঁচকানো। ঠোঁট উলটে বলেছিল, ‘কতবার চেষ্টা করেছি। দু-একখান লিয়ে যে যাই নাই, তা লয়। একবার ধরা পড়ে গেছলাম, ই বাপ্‌, সবাই মিলে শালো এই মারে তো সেই মারে। ক্যানে বাবা, ইট গুঁড়ায়ে খাবে নাকি। যেন সোনাদানা লিয়ে যেইছি।’

বলেছিলাম, ‘সব তো পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে।’

ধনু আমার কথায় উৎসাহ পেয়েছিল। বলেছিল, ‘নষ্ট কি বুলছেন মশায়। দ্যাখেন গা, ছোট ছোট বাচ্চাগুলাতে পুতুল খেলছে ওগুলান দিয়ে। ঢ্যালা করে খেলছে। আর আমি দুটো পয়সা রোজগার করতে গেলে, মার ব্যাটাকে।’

ধনুর কথায় হাসি সামলানো দায় হয়েছিল। সত্যিই তো, যা দিয়ে ছেলেপিলেরা পুতুলখেলা খেলছে, তা দিয়ে যদি ধনুর কিছু সিগারেটের খরচ জুটত, তাতে কেন বাগড়া বাপু। বেচারি! আবার বলেছিল, ‘উয়াদের অই এক কথা, পচুক ধসুক, গুঁড়া গুঁড়া হোক, গাঁয়ের জিনিস বাইরে লিয়ে যেতে পারবে না। লাও ইবারে ঠ্যালা! কুবেরের ধন হে, যখ দিয়ে রেখেছে।’

তা বটে। ধনুর কথায় মলুটির মনের খবর মিলেছিল। মলুটির মন ধনুর না। তার কাছে যা ছিল পড়ে পাওয়া ষোলো আনা, নগদ বিদায়ের কিছু ট্যাঁকের কড়ি, মলুটির মানুষের কাছে তা পবিত্র ঐতিহ্য। যে দিনগুলো হারিয়েছে, সেই দিনের কথা সেই ভাঙা ইটের ছাপে ছাপে। পূর্বপুরুষের স্মৃতি বুক দিয়ে আগলানো সংরক্ষণের বস্তু। মলুটির ইতিহাস সেইসব জীর্ণ মন্দিরে, যার ভাঙন আর ধ্বংস তাদের দেখতে হচ্ছে অসহায় চোখ মেলে। বাজ-ধরা রাখালরাজার বংশধরদের ধনু কোথায় পাবে হে। সে এসেছিল আত্মীয়তার সুতো ধরে শিউড়ির হাট থেকে। বাজারের কেনা-বেচায় তার লেনাদেনা। যে ভদ্রজনদের সঙ্গে তার দেওয়া-নেওয়ার কারবার, তাঁদের মনও সে জানে না।

তবে কিনা এমন বলব না, ভদ্র বিশিষ্টদের প্রাচীন সংগ্রহের মন মলুটির মানুষ বোঝেন। ‘মলুটির কাছে যা বংশের চিহ্ন, পূর্বপুরুষের স্মৃতি, নগরের সংগ্রহকারীর কাছে তা প্রাচীন সংগ্রহ। দুয়েতে ফারাক বিস্তর, তার কোনও মিলজুল নেই। ধনুর কথায় যেটুকু ঔৎসুক্য জেগেছিল, মলুটির মনের কথা ভেবে তা নিবে গিয়েছিল।

ইতিমধ্যে আমার সিগারেট ফুরিয়েছিল, ধনুর না। ঘুনসি পুড়িয়ে বিড়ি খাওয়া জানতাম। অমন ঠোঁট পুড়িয়ে সিগারেট চোষা দেখিনি। ভেবেছিলাম, ধনু আগুনটুকু সুদ্ধ খাবে নাকি। তার চেয়ে সে তো অনায়াসে বলতে পারত ‘জমল না, আর একটা দিন তো মশায়।’

তবে আগুন আর তাকে খেতে হয়নি, অঙ্গারের একটি টুকরো তাকে ফেলতে হয়েছিল। ফেলেই কোঁচা দিয়ে মুখ মুছে প্রথম প্রশ্নে আওয়াজ দিয়েছিল, ‘কলকাতা থেকে এসেছেন, না?’

বলেছিলাম, ‘না, কাছাকাছি।’

যদি ভাব ধনু তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলছিল, তা হলে ভুল। চোখ আর মনের এত স্থিরতা ছিল না যে, এক দিকে ধেয়ান থাকবে। জিজ্ঞাসা যদি মুখের দিকে চেয়ে, জবাব শোনা আকাশের দিকে নজর করে। কেন না, তখন হয়তো একটা পাখি উড়ে যাচ্ছিল। কিংবা তা-ই বা কেন হে। মনের মধ্যে যে বহু ভুবনের ভাবনা। ডাগর চোখ দুটি মেলে অন্যমনস্ক হতে কতটুকু সময় লাগে!

আমার কথা শুনে অন্য দিকে চেয়ে বলেছিল, ‘অ, পিসে যেখানকে কাজ করে সেখানকার লোক আপনি!’

ধরে নিতে হয়েছিল ধনু বড় রায়ের কথা বলেছিল। বলেছিলাম। ‘হ্যাঁ। রায়মশাই তোমার পিসেমশাই হন বুঝি?’

‘অই আর কি, অনেক দূরের।’

তেমন গদগদ ভাব ছিল না ধনুর। রাজবংশের আত্মীয়তার গৌরব যেন তেমন তার মনে ছিল না। তার মন তখন অন্য স্রোতে বইছিল। বলেছিল, ‘তবে কলকাতায় যেইছি, দু’বার যেইছি।’

সংবাদে রীতিমতো গুরুত্ব আরোপিত। পকেট থেকে বাক্স বের করে আর একটা সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বলেছিল, ‘ওসব বাকি রাখি নাই। যা বুলবেন, সব দেখ্যা এসেছি কলকাতায়। সিনেমা থিয়েটার চিড়িয়াখানা ভিকটারিয়া—সব সব। ইস্কুলে পড়বার সময়েই যেইছিলাম।’

জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কার সঙ্গে গেছলে?’

ধনু চোখ ঘুরিয়ে হেসে বলেছিল, ‘ই বাবা, কার সঙ্গে আবার, একলাই।’

‘একলা?’

‘হুঁ, ইস্কুল পালিয়ে যেইছিলাম তো।’

ই বাবা। সে যে গুণধর ছেলে হে। একা একা ইস্কুল পালিয়ে মহাশয় শিউড়ি থেকে কলকাতায় গিয়েছিলেন! শুনে মনে হয়েছিল, এ যে আত্মার কথা শুনছি। নিজের মধ্যে পলাতকের ডানা-ঝটপটানি চিরদিনের। ধনুর গলায় যেন শ্রোতার নিজের প্রতিধ্বনি। অচিনের হাতছানি তাকেও ঘরছাড়া করত নাকি! পাগলা ডাকে ডেকে নিয়ে যেত!

জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কেন গেছলে?’

‘দেখব বুলে।’

এর বেশি আর কী জবাব প্রত্যাশা করতে পারত। শিউড়ির ছেলে, কলকাতা দেখবে বলে গিয়েছিল। তবু জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘ভয় করেনি?’

অন্যমনস্ক জবাব দিয়েছিল, ‘নাঃ!’

ভয় আবার কী হে। দেখব বলে গিয়েছিলাম, ব্যস। ধনুর কথার তেমনি ভাব। আবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘বাড়িতে কিছু বলেনি?’

খুব সহজ গলাতেই বলেছিল, ‘খুব বেড়ন দিইছিল বাবা। হাত-পা বেঁধে রেখেছিল। দোকানের পয়সা চুরি করেছিলাম-কিনা।’

বাঃ, বাহ্‌বা বাহ্‌বা ধনু। ঘোরপ্যাঁচ নেই, সোজা কথা সোজা-ই বলেছিল। আবার বলেছিল, ‘না হলে পয়সা পাব কুথা বলেন। চাইলে তো আর দিত না।’

অগত্যা না বলেই নিতে হয়েছিল। আর না বলে নেবার নামই তো চুরি। অতএব শাস্তি তো জরুর। কিন্তু এমন একটু সংবাদ দেবার সময়ে ধনু মন্দিরের দেওয়ালের দিকে নিবিষ্ট চোখে তাকিয়ে ছিল। ভাবনা অন্য দিকে, কথা আর-এক দিকে। কী মতলবে মন ঘুরছিল কে জানে। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তোমাদের দোকান আছে বুঝি?’

‘হুঁ, শিউড়িতে। সে জন্যেই তো শিউড়িতে থাকি। আমাদিগের ঘর তো মল্লারপুরে।’

খবরে কিছু গোলমাল পাবে না। যা জিজ্ঞেস করবে, দেড়া দ্বিগুণ জবাব পাবে। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘লেখাপড়া তা হলে শিউড়িতেই?’

সে বড় ব্যাজ কথা। ধনু চোখ ফিরিয়ে একবার আমার দিকে তাকিয়েছিল। একটু যেন অস্বস্তি, হাসি একটি বিব্রত। এসব কথাবার্তা জিজ্ঞেস করা ক্যানে মশায়। বলেছিল, ‘হুঁ, অই বেশি দূর পড়ি-টরি নাই, লেখাপড়া হল না।’

কী করবে বল। যা হল না তা সে কী করে করবে। সিগারেটটা ফেলে দিয়ে কপালে ঝাঁপানো বারো আনা চুলে একটা ঝাঁকানি দিয়েছিল। বলেছিল, ‘আর কতক্ষণ ইখানে থাকবেন। যাবেন না?’

হাতের ঘড়ির কাঁটা আর সূর্য একযোগে মাপামাপি, একেবারে মাঝখানে। বলেছিলাম, ‘হ্যাঁ, এবার ফিরব।’

ধনু মন্দিরের দাওয়া থেকে নেমে জুতোয় পা গলিয়েছিল। বলেছিল, ‘পিসে ভাবলে, আমার সঙ্গে আপনাকে দিলে কুথা না কুথা লিয়ে যাব। ক্যানে বাবা, তুমাদিগের মল্‌টিতে আবার লিয়ে যাব কুথা। বিশ্বাস নাই লোকের, তো কী বুলব বলেন। ব্যানাগুড়ি যেইছেন?’

কস্মিনকালেও সে জায়গার নাম শুনিনি। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘সেটা আবার কোথায়?’

‘বেশি দূরে না। খ্রিস্টানদের মিশন আছে সিখানে। আমার সঙ্গে দিলে সিখানে লিয়ে যেতাম। এতক্ষণ ঘুরে আসা যেত।’

আফসোস। আমারও কপাল খারাপ, ধনুও মোটেই বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। তবে সে আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল, ‘যান তো আমাকে বুলবেন, লিয়ে যাব। কিন্তু উয়াদের বুলবেন না, তা হলেই ফস্‌কা।’

মনেতে বাসনা প্রবল, তবু কথা দিতে পারিনি। ধনুর সঙ্গে কোথাও বেড়াতে যাবার যোগ্যতাও তো চাই। তবে কিনা, আঁতের কথা যদি বলি, ধনুকে আমার খারাপ লাগেনি। তার মধ্যে আমি যেন একটি সরল সোজা স্ফটিকস্বচ্ছ ছেলে দেখেছিলাম। টগবগানো তেলে যেন বাঁধন-ছেঁড়া অশ্ব। লাফিয়ে দাপিয়ে ছুটছে জীবনের নানান মাঠে, খানাখন্দে। সব কিছু তার পায়ের তলায় গুঁড়ানো। কোথায় যে তার গতি, কে জানে।

মৌলীক্ষার চারপাশে ইটের পাঁচিলের বেড়া। এখানে-ওখানে ডাঙা। ফাঁকে ফাঁকে গাছ গজিয়েছে, ইটে ইটে শ্যাওলা। মন্দিরের মতোই। বেলা বারোটাতেও মৌলীক্ষার থান জুড়ে নিবিড় ছায়া। পাখিদের কূজন সেথা সর্বক্ষণ। উঠতে ইচ্ছা না করলেও সময়ের মুখ চেয়ে উঠতেই হয়েছিল। মাঠে আসতে আসতে ধনুর গালের দিকে তাকিয়েছিলাম। সেই চাপড়দৃশ্য আবার আমার মনে পড়েছিল। ইচ্ছা করেছিল, জিজ্ঞেস করি, সেই অঘটনের ঘটনাটা কী।

উ রে বাবা, সে সাহস আমার ছিল না। যা স্পষ্টবক্তা ছেলে, কী বলবে, কী শুনতে হবে, কে জানত। বরং বলেছিলাম, ‘মলুটি বেশ সুন্দর—।’

কথা শেষ করতে দেয়নি ধনু। বলে উঠেছিল, ‘ছাই। কী আছে ইখানে? কিছু নাই। অই কালীপুজোটা বেশ জমে, তাই আসি ফি-বছর।’

এর পরে ধনুকে আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ভূ-বৈচিত্র্য বলার সাহস হয়নি আমার। কিন্তু শোনো হে শোনো, এত তাড়াতাড়ি আপন চিন্তায় যেয়ো না। ধনু আবার বলে উঠেছিল, ‘তবে বিয়াটা আমি ইখানেই করব।’

আমার শ্রবণে যেন বেজায় ধাক্কার চমক লেগেছিল। কিছু আর পুছ করতে হয়নি, কেবল জোরে জোরে গলা খাঁকারি দিয়ে শব্দ করেছিলাম, ‘অ!’

দেখেছিলাম, আমার সঙ্কোচে ধনুর বিন্দুমাত্র ধেয়ান নেই। তার দৃষ্টি তখন গাঁয়ের দিকে। আবার বলেছিল, ‘অই পর্যন্তই। ব্যস। আর না।’

তার মুখের দিকে না তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘ঠিকঠাক হয়ে গেছে নাকি?’

ধনুর স্পষ্ট জবাব, ‘হয় নাই হবেক। মেয়্যাটোকে আমার পছন্দ হয়েছে। তা’পরে জানি না, ই যা দেশ বাবা, কী বুলবে কে জানে।’

তখন আর যেন ঠিক আমাকে বলেনি, ধনুর কথা আত্মগত। দেশ যে কেমন, তা তো গালেই জানা গিয়েছে। ধনুর তা হলে আরও জানা বাকি ছিল। পাত্রীটি যে কে, অনুমান করতে পারছিলাম। দেখতে বেমানান হবে না, হলফ করে বলতে পারতাম। তারপর গুণভেদাভেদে কোথায় যেতে পারে, কে জানত। সে মেয়ে কাদের ঘরের বালা, কোন বংশের কন্যা, তা-ই বা কে জানত। থাপ্পড়ের তেজ দেখে তো মনে হয়েছিল, মানিনী মহারানিতুল্যা। তারপরেও ধনুর সাহস ছিল।

অনেকক্ষণ কথা বলেনি ধনু। আমি অবাক যত হয়েছিলাম, তত যেন ভিতরে ভিতরে তরঙ্গিয়া উঠেছিল হাসির ফোয়ারা। সে হাসি ধরে রাখা যেন দায় হয়েছিল। প্রেমের কিছু রকম দেখেছিলাম, অমন দেখিনি। কিন্তু হাসতে ভরসা পাইনি। পাছে অমন, দপদপানো প্রাণটি আহত হয়ে পড়ে। কিংবা কে জানত, থাপ্পড়ের জ্বালাটা যদি আমার প্রতিই রুদ্র হয়ে উঠত।

মাঠ দিয়ে যখন উত্তরের ঢালুতে নামতে চলেছি, তখন নজর পড়েছিল, এক ঝাড় তালবনের দিকে। এতগুলো গাছ, একসঙ্গে জড়াজড়ি করা, তখনও চোখে পড়েনি। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘ওটা কি তালবন?’

ধনু আমার নজর ধরে চোখ তুলে বলেছিল, ‘উইটো? না, তালবন ক্যানে হবে, উটো তো পুখর।’

পুখর অর্থে পুকুর। কিন্তু পুকুর কোথাও চোখে পড়েনি, চারপাশ ফাঁকার মাঝখানে হঠাৎ এক দঙ্গল তাল গাছই শুধু দেখেছিলাম। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘পুকুর আছে বুঝি ওখানে?’

‘হুঁ, পুখরের চারপাশে তাল গাছ। ইদিকপানে সব উরকম দেখবেন। যাবেন উখানে?’

হ্যাঁ, নজর মন সবই টানছিল। বলেছিলাম, ‘চলো যাই।’

ধনুর পরবর্তী প্রশ্ন একেবারে সোজাসুজি, ‘পাখানা যাবেন?’

তারপরেই অমন প্রাকৃতিক প্রশ্ন কেন। বলেছিলাম, ‘না তো।’

ধনু সহজ ভাবেই বলেছিল, ‘পুখর আছে তো। যেলে জল সরতে পারতেন।’

সেই জন্যেই বলা। আমার কথা থেকে তার বোধ হয় সেইরকমই মনে হয়েছিল। ছোট রায়ের কথা মনে পড়েছিল।

চারপাশে উঁচু, পাড়, মাঝখানে পুকুর। যেন একখানি স্থির আয়না। তার ধারে ধারে তাল গাছের স্পষ্ট ছায়া, মাঝখানে নীল আকাশ। দেখেছিলাম, যুবতী বুড়ি দুই বউ মাত্র স্নান করছে। বাউরি বাগ্‌দি হবে। কিন্তু আরও যেন কাদের কথা শুনতে পাচ্ছিলাম। অস্পষ্ট মেয়েপুরুষের দুটি-চারটি কথা, একটু-আধটু হাসি।

দেখেছিলাম, ধনুও যেন সেই হাসিকথায় উৎকর্ণ। সে ক্ৰমে পশ্চিম দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। আমিও তার সঙ্গে সঙ্গে গিয়েছিলাম। একেবারে পশ্চিম পাড়ের পিছনের ঢালুতে, তাল গাছের ছায়ায় দুই নারী, এক পুরুষ। যুবা পুরুষের মাথায় ঝাঁকড়া চুল, তাতে গামছা বাঁধা, খালি গা, নেংটি পরা। দুই যুবতীর গায়ে শাড়ির আঁচল, খোঁপায় গোঁজা কাঠের কাঁকই। যদি বল শালীনতা কাকে বলে, তবে নগর চালে মিলত না। পা ছড়িয়ে বসা যুবতীদের অঙ্গে বাঁকা শিথিল ভাব। তিনজনের রংই কালো কুচকুচো চোখে একটু লালের ছোঁয়া, তাতে আবার যেন ঝলক লাগা ঝিকিমিকি।

তিনজনের মাঝখানে এক হাঁড়ি। হাঁড়ির থেকে জালা বললে মানানসই। কম করে পনেরো সেরের পাত্র। গুটিকয় ছোট ছোট মাটির ভাঁড়। তারপরে আর পুছ করার কিছু ছিল না। গন্ধেতেই টের পাওয়া যাচ্ছিল, হাঁড়িতে কী অমৃত আছে। তিনজনের একটু পান চলছিল, সেই সঙ্গে হাসি আলাপন। দেখেই যেন চেনা যাচ্ছিল, ওরা সাঁওতাল।

দাঁড়াবার প্রয়োজন ছিল না, তা-ই ফিরতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু ধনুর পা যেন মাটিতে গেঁথে গিয়েছিল। সে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কী করছিস রে তুরা?’

জবাব দিয়েছিল যুবা মরদ, হেসে ঢুলুঢুলু চোখে, ‘ক্যানে, দেখতে পাঁইছিস নাই, তাড়ি খাইছি কি বটে! আঁ, কী রে, দেখতে পাঁইছিস নাই, না কী? আঁ?’

একবারে পুছ হয় না, বারে বারে বলেছিল। তারপরে তিনজনেই চোখে চোখে চেয়ে হেসেছিল।

ধনু আবার জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কোন ঘরের প্রজা তুরা। পূজা লিয়ে আসছিস ক্যানে?’

যুবাটি ঘাড় নাড়িয়ে বলেছিল, ‘হঁ হঁ হঁ, হঁ রে। আট আনার ছোট তরপের আমরা। তু কুন ঘরকে আঁইছিস, তুকে চিনতে লারছি?’

ধনু বলেছিল, ‘ছ তরফের বড় ঘরে।’

‘অই, তা বলতে লাগে কিনা, আঁ। পা ধুলা দে।’

বলে যুবাটি টলতে টলতে উঠে এগিয়ে এসেছিল। দু’ হাত দিয়ে প্রায় খামচি কেটেছিল ধনুর পায়ে।

ধনু একেবারে নির্বিকার। যেন পায়ের ধুলা দেওয়াটা তার স্বভাব ব্যাপার। তারপরেই মাতাল জোয়ানটি আমার পায়ের কাছে এসেছিল। আমি পেছিয়ে গিয়ে বলেছিলাম, ‘থাক, থাক।’

‘ক্যানে, থাকবে ক্যানে। তু কুন ঘরকে আঁইছিস?’

জবাব দিয়েছিল ধনু। বলেছিল, ‘অই এক ঘর।’

আমি তখন ধনুকে ডাক দিয়েছিলাম, ‘চলো, আমরা যাই।’

দাঁড়াও হে, এত তাড়াতাড়ি! তার আগে ধনুর কথা শোনো, ‘খাবেন নাকি একটু?’

আবার সেই আমার শ্রবণে বাজ! চমকানো গলায় বলেছিলাম, ‘তাড়ি?’

ধনু তো অসহজ কথা বলতে জানে না। বলেছিল, ‘হঁ, ই টাটকা তাড়ি লয় বটে, সময় তো এখন না। মশলা মেশানো দোকানের মাল। তা একটু খেলে কিছু হবে না। আসেন।’

বলে সে নিজেই বসেছিল। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তুমি খাবে নাকি?’

‘খেয়ে যাই একটু। কী রে, মাল আছে তো?’

একটি যুবতী বলে উঠেছিল, ‘আছে বটে কি, খা না।’

ধন্য আমার প্রথম দেখা রাঢ়ের স্মৃতি। প্রথম দেখা রাঢ় আমাকে ধনুকেও দেখিয়েছিল। ই কী ছেলে গা বাবা। বলেছিল কিনা তাড়ি খেয়ে ফিরবে। কিছুতে কি মানামানি নেই। একটি মেয়ে তখন জালা কাত করে ছোট একটা হাঁড়িতে তাড়ি ঢালছিল। এমনি না, আবার নিজের ধোয়া শাড়ির আঁচল দিয়ে ছেঁকে। আর ধনুর দিকে চেয়ে হাসছিল মিটিমিটি। ধনু হাসছিল না, সে তাকিয়েছিল হাঁড়ির মুখের দিকে। আবার গান ধরেছিল, ‘আমার মা বুলেছে, মা খাবি তু মায়ের নামে…।’

সুরে পুরো টপ্পা। ধনুর গলায় তেমন আসেনি। কিন্তু আর দাঁড়িয়ে থাকবার উপায় ছিল না। বলেছিলাম, ‘ধনু, তা হলে আমি যাই?’

এক কথায়, এক জবাব, ‘আসেন।’

যেন আমি তার অচেনা। এক কথায় বিদায়। বিদায় দিয়ে জালার মুখে মাছি তাড়াতে শুরু করেছিল। কিন্তু পুকুর ধারে এসে পথ একটু ঘুরতে হয়েছিল। তাই না জিজ্ঞেস করে পারিনি, ‘কোন দিক দিয়ে যাব?’

না তাকিয়েই বলেছিল, ‘উত্তর-পুবের কোণ বরাবর যান, গাঁয়ের দিকে রাস্তা আছে।’

ফিরতে ফিরতে কয়েক মুহূর্ত মনটা বিমর্ষ হয়েছিল। পরমুহূর্তেই ধনু যেন একটা বিস্ময়ের মতো ঝিলিক দিয়ে উঠেছিল আমার মনে। ওর ভিতরে বাইরে কী ছিল, জানি না। মনে হয়েছিল, জগৎ-সংসারে সে যেন এক একলা পথিক। বাঁধন-ছাড়া, আত্মহারা, যেন আপন চেনাতেও নেই। যেন ওর পাওনা বলে কিছু ছিল না, তাই ভয় ছিল না। কোথায় যে গন্তব্য, কোথায় ঘর করণ, কোনও ঠিক নেই। চরাচরের সকল নিমন্ত্রণ নিয়ে যেন বসেছিল। এমনকী, গোরা কিশোরীর চপেটাঘাতও। কিন্তু তাড়ি খেয়ে সকলের সামনে বাড়ি ফিরবে কেমন করে।

সে ভাবনা ভেবে আমার লাভ ছিল না। কেবল আমি বলে নয়, বিশ্বাস হয়েছিল, ধনুর ভাবনা ভেবে কারুর লাভ ছিল না।

ছোট ছোট ঝাড়ালো বাবলা বনের মাঝখান দিয়ে পায়ে-হাঁটা লাল সিঁথে-পথ। সেই পথে চলতে চলতে, ধনুর ভাবনার মাঝখানে আমার কানে মাদলের বাজনা বেজেছিল। যেন কোন দূরে, দূরের প্রান্তে অস্পষ্ট বাজনা একটু একটু করে স্পষ্ট হচ্ছিল, ডিম্ ডিম্‌ ডিম্‌, ডিম্‌ ডিম্‌ ডিম্‌!… আমি অবাক হয়ে পিছনের সেই আকাশে-ঠেকানো কালো-রেখা পাহাড়ের দিকে তাকিয়েছিলাম।

কোথা থেকে শব্দ আসছিল, বুঝতে পারিনি। কেবল মনে হচ্ছিল, এক নয়, একাধিক অস্পষ্ট মাদলের শব্দ দূরে দূরে বাজছে। কাছে কাছে আসছে। কালের এক আদিম যুগে যেন আমি হারিয়ে যাচ্ছিলাম। ক্রমে। মলুটির সে আর এক নিশিঘোর। যেন আস্তে আস্তে আচ্ছন্ন করছিল।

‘এই যে বাবা, কুথা গেলছিলে?’

তাকিয়ে দেখেছিলাম সামনেই ছোট রায়। তার পাশে এক সৌম্য বৃদ্ধ, যাঁর বড় বড় বুকে ঠেকানো দাড়ি আর গোঁফে একটি প্রসন্ন গাম্ভীর্য ফুটেছিল। দু’জনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন গ্রামে ঢোকবার মুখে এক খড়ের চালের নীচে।

বলেছিলাম, ‘মাঠ থেকে।’

ছোট রায় বলেছিলেন, ‘এসো, তুমার সঙ্গে চাটুয্যেমশায়কে আলাপ করিয়ে দেই।’

পরিচয়ের পর চাটুয্যেমশায় বলেছিলেন, ‘বড় সুখী হলাম বাবা। এসো, আমাদিগের বাড়ি হয়ে যাবে।’

ছোট রায়ের দিকে ফিরে বলেছিলেন, ‘তুমি যাও, উয়াকে আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি পরে।’

গোঁফদাড়িতে ঢাকা, খালি গা, পৈতা গলায়, হাতে একটি মোটা লাঠি চাটুয্যেমশাইয়ের।

বলেছিলেন, ‘চলো, তুমার সঙ্গে একটু কথা বলি যেয়ে। মলুটির সব গল্প শুনেছ?’

‘আজ্ঞে না।’

‘চলো, মলুটির গল্প শুনবে।’

.

৩২.

ইটের পাঁচিল, কাঠের দরজা, লাল উঠোন পেরিয়ে চাটুয্যেমশাই নিয়ে গিয়েছিলেন পাকা মোকামে। বাঁধানো দাওয়ার ওপরে দরজার চৌকাঠের কাছে নারকেল-ছোবড়ার পা-মোছা। শানের মেঝে, ঘরের মধ্যে খাটের ওপর পরিপাটি বিছানা। কাচের আলমারিতে কেতাব। এক পাশে ঢাকনা দেওয়া টেবল, খান দুয়েক চেয়ার, একটি আরামকেদারা। খোলা জানলা দিয়ে ধানের মরাই চোখে পড়েছিল। ওদিকে পাঁচিলের ধারে তাল গাছের আড়ালে দেখেছিলাম এক ভাঙা মন্দিরের চূড়া। তবু যেন সব মিলিয়ে পাকা মোকামের ঘরে একটু আধুনিকতার ছোঁয়া।

রাঙা মাটির ঢেউ খেলানো গ্রামে সে ঘর রাজগৃহ না। রাজাদের কুলীন জামাইয়ের ঘর। সে বাড়িতে কালীপূজার সাজনবাজন কিছু ছিল না। লোকলস্কর হাঁকডাক, তত্ত্ব-তল্লাশ, কিছু না। সেখানে ভাব আলাদা, রকম ভিন্ন। যেন মলুটির সুরে বাঁধা না, তালে কিঞ্চিৎ অমিল। মলুটির ঘরে সেথা মলুটি দূরস্থ। চাটুয্যেমশাইয়ের পুত্রবধূ নাতির সঙ্গে আলাপে দূর শহরের আদল মিলেছিল। কেবল ভাবে-ব্যঞ্জনাতে না, ভাষে আর ভাষ্যেও। চায়ের পেয়ালাতেও দূরের ছায়া, অ-মলুটি স্বাদ। তবে কিনা, সেই অসময়ে চা পেয়ে কৃতার্থ হয়েছিলাম। ধনু অধমকে ফেলে যেভাবে নিজের তৃষ্ণা মেটাতে বসে গিয়েছিল, সেই চমক খাওয়া হতাশায়, তৃষ্ণা লেগেছিল আমারও। নেশার তৃষ্ণা সেও বটে, তফাত কেবল তাড়ি আর চায়ে, পরিমাপের কমবেশিতে।

তারপর শ্যাম সৌম্য শ্মশ্রুগুম্ফ মোটা উপবীতের উর্দি পরা, জামাই চাটুয্যে বলেছিলেন বাঘা কুলীন কাকে বলে। তিনি সেই বাঘা কুলীনের বংশধর। একদা রাজকন্যার পাণিগ্রহণ করে মলুটিতে এসেছিলেন। তবে কি না, ‘সেই মলুটি কী আর আছে? নাই। সে মলুটি নাই, সে মানুষেরা নাই। এখন যা দেখছ বাবা সেকালের পাইপয়সাও না। আমি যখন প্রথম এসেছিলাম, তখন ছিটেফোঁটা দেখেছি। যজ্ঞি-বাড়িতে কাজকর্ম খাওনা-দাওন হয়ে গেলে তারপরে যেমনটা হয়। সেই রকম দেখেছিলাম। এখন তাও নাই…।’

দেখেছিলাম চাটুয্যেমশাইয়ের বুড়ো চোখের নজরে উজান টান। যবে রাজকন্যার কর ধারণে কুলীন পুত্র এসেছিলেন স্বপ্নের দেশে, সেই স্বপ্নে যেন হারিয়ে গিয়েছিলেন। দাড়ি কাঁপিয়ে, নিশ্বাস ফেলে স্বপ্ন দেখা স্বরে বলেছিলেন, ‘কোথায় গেলেন বসন্ত মুখুজ্জে, আর কোথায় এসে ঠেকেছে আজকের মলুটি।’

না জিজ্ঞেস করে পারিনি, ‘বসন্ত মুখুজ্জে কে?’

চাটুয্যেমশাই যেন সেই হারানো সময়ের ওপার থেকে বলেছিলেন, ‘কেন, যিনি রাজা বাজবসন্ত। যিনি বাদশাহের বাজ ধরেছিলেন, যার পুরস্কার এই রাজ্য, রাজ উপাধি। তাঁর নাম ছিল বসন্ত মুখুজ্জে। বাদশা তাঁকে উপাধি দিয়েছিলেন, রাজা বাজবসন্ত। এঁরা তো আসলে মুখুজ্জে, ভরদ্বাজ গোত্র। রায় হল এঁদের বাদশাহী খেতাব।’

আমার চিন্তায় যিনি রাখালরাজা, তিনিই রাজা বাজবসন্ত। সেই রূপকথার পুরুষ। কিন্তু শ্রবণে আমার ঠেক লাগছিল চাটুয্যেমশাইয়ের বচনে। প্রথম সম্বোধনে যেমন মলুটির বুলি শুনেছিলাম তাঁর মুখ থেকে, ঘরে বসে কথা বলার সময় বচনের ধরন-ধারণ আলাদা।

হবে হয়তো, রাজকাহিনী ভাবতে গিয়ে নতুন শ্রোতার সামনে ভাষা বদলেছিলেন। সেটা সহবত কি না জানি না, কিন্তু আমার শ্রবণ যেন উৎকর্ণ ছিল ঢেউ-খেলানো রাঙা মাটির বুলি শুনব বলে।

সে আক্ষেপ পরে আর ছিল না, যখন মলুটির রূপকথার রাজ্যে আমিও হারিয়ে গিয়েছিলাম। তবে রূপকথার গায়ে যখন নামধাম সাল-তারিখের দাগ লাগে, তখন তা ইতিহাস। চাটুয্যেমশাই ইতিহাস শুনিয়েছিলেন। কিন্তু সেই যে এক কথা, সে দেশ কিংবদন্তীর মায়ের দেশ। ঐতিহাসিক বলে মানো না-মানো, জানবে কিংবদন্তীর সৃষ্টি সেথা পলে পলে। কেন না, রাজা বাজবসন্ত মারা গিয়েছিলেন মাত্র আঠারো বছর বয়সে। কারণ, তাঁর ওপরে যে গুরুর অভিশাপ ছিল!

সেই যে এক পথ-চলা সন্ন্যাসী বসন্তকে দেখেছিলেন সাপের ফণার ছায়ায় নিদ্রিত, তিনি দীক্ষা দিয়েছিলেন সেই গরু-চরানো ছেলেকে। সেটা অন্যায়। কেন না, রাজা যে তার আগেই কুলগুরুর কাছে দীক্ষিত ছিলেন। কুলগুরু তাই বলেছিলেন, ‘কুলগুরু ছেড়ে তুমি নতুন গুরুর দীক্ষা নিয়েছ, ওহে তোমার অকালমৃত্যু হবে।’

তাই তাঁর অকালমৃত্যু হয়েছিল। তাঁর ছেলে রাজা রামসার গল্প শুনিয়েছিলেন চাটুয্যেমশাই। বলেছিলেন, ‘এ রায় পরিবার দেখে বাবা, সেই রাজাদের বুঝতে পারবে না। রাজা রামসা, তেমনি রাজা, দিল্লির বাদশা যার বিরুদ্ধে লড়তে পাঠিয়েছিলেন লক্ষ সেপাই। সে বড় ডাকাবুকো ক্ষ্যাপা রাজা। আশেপাশে যত রাজ্য, সব তিনি থাবা দিয়ে কেড়ে নিয়েছিলেন। সবাই গিয়ে নালিশ করলে বাদশাকে। বাদশা পাঁচ হাজার সেপাই পাঠিয়ে দিলেন রামসাকে ধরে আনতে। অত সহজে কি রামসা কাবু হন। বাদশার সেপাইদের হারিয়ে দিলেন লড়াইয়ে।

‘কী, বাদশার হার! ক্ষেপে গিয়ে পাঠালেন লক্ষ সেপাই। ওদিকে কাশীতে টনক নড়ে গেল সেই সন্ন্যাসীর, যিনি বসন্তকে মন্ত্র দিয়েছিলেন। তিনি এসে রামসাকে বললেন—মূর্খ, করেছিস কি, এত তোর দর্প! এবার কী দিয়ে সামলাবি।

‘রামসাও তখন ভয় পেয়েছেন। শত হলেও এক লক্ষ বাদশাহী সেপাই, চাট্টিখানি কথা না। তবে এবার বলুন গুরুদেব, উপায় কী করি!

‘গুরু বললেন, উপায় এক, চল দিল্লি। পরিবার পরিজনকে লুকিয়ে রেখে, গুরুর সঙ্গে সেই রাত্রেই দিল্লি যাত্রা। দিল্লিতে ছিলেন গুরুদেবের চেনা এক ফকির। সেই ফকিরের সঙ্গে বাদশার ভারী আশনাই। বাদশা ফকিরকে খুব ছেদ্দা ভক্তি করেন। গুরু গিয়ে ধরলেন সেই ফকিরকে, আপনি রামসাকে বাঁচান।

‘ফকির ভেবে-চিন্তে বললেন, বাদশার মুখের কথা, তাকে তো একেবারে ঝুটা করা যায় না। রামসার গর্দান যখন চেয়েছেন, তখন তার বদলে কিছু দিতেই হবে। কী দিতে হবে? রক্ত, হ্যাঁ, রক্ত দিতে হবে।

‘তখন ফকির রামসাকে সব শিখিয়ে-পড়িয়ে দিলেন। সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন দরবারে। রামসাকে রেখে গেলেন আড়ালে। বলে গেলেন, ঠিক যে সময়ে যে ভাবে আসতে বলেছি, সেই মতো আসবে। বলে, দরবারের মধ্যে গেলেন। বাদশা ফকিরকে অভ্যর্থনা করলেন। বললেন, অসময়ে যে?

‘ফকির বললেন, আপনার কাছে একজনের প্রাণ ভিক্ষা করতে এসেছি। শুনেই সম্রাট বললেন, কেবল বাঙ্গালা মুলুকের রাজা রামসার প্রাণ ভিক্ষে চাইবেন না।

‘তা বললে তো হয় না। ফকির বললেন, আপনি হলেন ভারতেশ্বর, প্রজারা আপনার ছেলে। আপনার রাগের সামনে কি তারা কখনও দাঁড়াতে পারে? কিন্তু সে যদি অন্যায় বুঝে আপনার কাছে ক্ষমা চায়, আপনি কি তা না করে পারেন? রামসা এখন তার অপরাধ বুঝেছে, অনুশোচনা করছে। আজ সে আপনার পায়ে পড়তে এসেছে।

‘এই কথা বলা মাত্রই, রামসা ছুটে এলেন। হাতের ছুরি দিয়ে বুড়ো আঙুল কেটে বসে পড়লেন সম্রাটের পায়ের কাছে। ফকির বললেন, এই যে রামসা। আপনি ওর মাথা চেয়েছিলেন। তার পরিবর্তে ও আপনাকে রক্ত দিয়েছে। আপনি খুশি হয়ে ক্ষমা করুন।

‘রামসার চোখে তখন জল। দেখে বাদশার প্রাণে দয়া হল, তিনি তাকে ক্ষমা করলেন। হুকুম জারি করলেন, লক্ষ সৈন্য রাজধানীতে ফিরে আসুক। কিন্তু রামসার নামে যেন তাঁকে আর কখনও কিছু শুনতে না হয়।’

চাটুয্যেমশাই বলেছিলেন, ‘সেই থেকে ক্ষ্যাপা রাজা রামসা শান্ত হলেন। কিন্তু সে সব মানুষ ছিলেন আলাদা। আজকের মলুটিতে সেরকম মানুষ আর নেই।’

তাঁর নিশ্বাস পড়েছিল। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম, আজকের মলুটিতে রাজা রামসা আর কোনওদিনই ফিরে আসবেন না। কারণ, সম্রাটের ভারতবর্ষ নেই, রামসার মলুটিও নেই। তবে যদি পুছ করো, এ কাহিনী কবেকার, দিল্লির কোন বাদশাহের আমলে, তা হলে বড় ব্যাজ। কিন্তু জানবে, এ কাহিনী রূপকথা না, ইতিহাস।

তা যদি না হবে, তবে আলিলকি খাঁয়ের সঙ্গে যে রাজাদের যুদ্ধ হয়েছিল, সে তো আর রূপকথা নয় হে৷ সেই যুদ্ধের থেকে তো মলুটিতে আগমন। তার আগে রাজাদের রাজ্য ছিল ডামরাতে। ডামরার পাশে রাজনগর। তার মালেক আলিলকি খাঁ। রামসা যেমন তাদের গায়ে এক সময়ে থাবা মেরেছিল, তেমনি থাবা মেরেছিল রাজনগরের খাঁ। তবে, দু-দুবার মার খেয়ে ফিরেছিল। তারপরে তিন বছর একেবারে চুপচাপ।

তখন রাজা ছিলেন রাজচন্দ্র। দুই ভাই তার সঙ্গী। রামচন্দ্র আর মহাদেব। দাদার কথায় ওঠা বসা। দেশে যখন শান্তি, তখন রামচন্দ্র আর মহাদেব, সপরিবারে গেলেন তীর্থে। খবর গেল আলিলকি খাঁর কানে। শেয়ালের অমনি গোঁফে হাসি। রাতের অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়ল ডামরার বুকের ওপরে।

এমন আচমকা মারের ঠেলায় রাজচন্দ্রের সেপাইরা মারা পড়তে লাগল। দেখে রাজচন্দ্র অস্থির। তিনি নিজেও ঝাঁপিয়ে পড়লেন তাদের সঙ্গে। অবস্থা যে সুবিধার না, তা বুঝেছিল সেনাপতি নারায়ণ দলুই। সে তাড়াতাড়ি রাজবাড়িতে গিয়ে রানিমাকে বললে, ছেলেপিলে নিয়ে চলুন, নইলে উপায় নাই। ইজ্জত প্রাণ সবই যাবে।

রানি রাজি, কিন্তু যাওয়া হবে কোথায়। দলুই বললে, কাছেই মলুটির জঙ্গলে। সেখানে রাজাদের এক গুপ্তঘর আছে। রানি চলে গেলেন দলুইয়ের সঙ্গে মলুটিতে। এই মলুটিতে। তখন ছিল জঙ্গল, জন্তু-জানোয়ারের রাজ্য।

রাজচন্দ্র আর ফেরেননি, আলিলকি তাঁর মুণ্ড নিয়েছিল। সেই সঙ্গে লুট করেছিল ধনাগার, কোষাগার। তারপরে ফিরে এলেন রামচন্দ্র আর মহাদেব। দাদা হারিয়ে দু’জনে কেঁদে কেঁদে বাঁচেন না। ভ্রাতৃবধু বললেন, কেঁদে লাভ নেই, আলিলকির মুণ্ড এনে দাও আমাকে। তার রক্তে পা ধোবো।

তখন মলুটিতে রাজধানী করে সাজো সাজো রব উঠল। আলিলকির মুণ্ড চাই। কিন্তু তার আগে খোদা তাঁর নিজের কাজ রোগে সেরেছিলেন। ভয়ঙ্কর এক কাল রোগে আলিলকি অক্কা পেয়েছিল।

চাটুয্যেমশাইয়ের বলবার কথা সে-ই। তখন মলুটিতে যোদ্ধা ছিল, বীর ছিল, ধার্মিক ছিল। শ্বশুরগৃহের পুরনো দিনের স্মৃতিতে বুড়ো জামাইটির বুক কাঁপিয়ে নিশ্বাস পড়েছিল। আর আমার চোখে ভাসছিল সেই জঙ্গলে মলুটির অন্ধকার রাত। যে অন্ধকার রাতে নারায়ণ দলুইয়ের সঙ্গে রানি এসে হাজির হলেন এখানে। এই মলুটিতে। বর্তমানের কেউ কি জানত, কোথায় সেই রাজাদের গুপ্তঘর? কোথায় এসে উঠেছিলেন রানি?

চাটুয্যেমশাইয়ের রূপকথার ঝোলা যত বড়, আমার শ্রবণ মন তার চেয়ে ছোট না। বাংলা দেশের গ্রামে গ্রামে গল্প, পাড়ায় পাড়ায় রূপকথা। তার ওপরে মলুটি, তার বৈশিষ্ট্য আরও বেশি। কেন না, চাটুয্যেমশাই জানিয়েছিলেন, মলুটির রায়েরা বারো ভুঁইঞার এক ভুঁইঞা। বাংলার বারো ভূঁইঞাদের সকলেরই অনেক কাহিনী।

রাজা রামচন্দ্রের গল্প শোনা ছিল বড় রায়ের কাছেই। যাঁর স্ত্রী ইচ্ছামৃত্যু বরণ করে স্বামীর পায়ে দেহ রেখেছিলেন। যাঁর শ্মশানক্ষেত্র নাকি মলুটির সতীঘাট। তা বলে ভেবো না, ধর্ম করতে গিয়ে রাজারা গেরুয়া পরেছে, জটা রেখেছে। সেসব তাঁরা করেননি, ধার্মিক ছিলেন তাঁরা মনেপ্রাণে।

আবার তেমনি বিষয়ী ছিলেন রাজা আনন্দচন্দ্র। অন্যায় ভাবে না, ন্যায়ের বিষয়ী। তিনি ব্রাহ্মণবিদায়ের নিয়ম করে গিয়েছিলেন। আনন্দ ছিলেন রসিক সুজন, তাঁর সভায় ছিল রসিকদের আনাগোনা। এক ছিল স্বভাব-কবি, নাম গঙ্গানারায়ণ। চাটুয্যেমশাই আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন সেই কবির কবিতা—‘শোনো তবে বলি, মলুটিতে তখন কবি কেমন কবিতা লিখত। রানি কহে কহ গিরি, ব্রজেন্দ্রনন্দন হরি, কী রূপে করিলা রাসলীলা। গোপীগণ সঙ্গে মেলি, কৌতুকে করেন কেলি, রাসরঙ্গ কেমন করিলা।’

কবিতা তো বলেননি, বৃদ্ধ জামাইটি যেন মন্ত্রোচ্চারণ করেছিলেন। কোন যুগেতে বাস করো, কোন কবিদের কবিতা পড়ো, সেসব কথা মনে করে লাভ ছিল না। তখন মলুটির কথকতা, কথক চাটুয্যেমশাই, তুমি শ্রোতা। তবে মিথ্য বলব না, সে আবৃত্তিতে আমার মন মজেছিল। কেন কিনা, আপন ধ্যান-ধেয়ানে মগ্ন মনে, যে যা ভাবে, তার মাধুর্য আলাদা।

শুধু কি তাই! আবৃত্তির পরে গান?

বলেছিলাম, ‘শুনব।’

অমনি দাড়ি কাঁপিয়ে, ভুরু কুঁচকে, সভাকবির গান গেয়েছিলেন গুনগুনিয়ে,

‘নব নীরদ বর্ণ, কি সে পণ্য, শ্যাম চাঁদ রূপ হেরে;

হাতে বাঁশি, অধর হাসি, রূপে ভুবন আলো করে।

গুচ্ছ শিখিপুচ্ছ শিরে তুচ্ছ কোটি কাম হেরে

উচ্চ জাতি কুল ধরম, সরমে সতী

সতী জাতি ছাড়ে।’…

কুলমজানো ঠাকুরের গান বটে, কীর্তনের সুর না। ভৈরবীতে টপ্পার ঝোঁক মেশানো। চাটুয্যেমশাইয়ের গলায় অবিশ্যি জোর ছিল না। শ্লেষ্মার দাপটও প্রবল। তবু অমন গান অনেক কাল শুনিনি। বলেছিলাম, ‘বাঃ, আপনি তো বেশ গাইতে পারেন।’

আহ্‌, ছি, অমন করে লজ্জা দিয়ে না হে। চাটুয্যেমশাইয়ের শ্যাম মুখখানি, দাড়িসুদ্ধ যেন রাঙা হয়ে উঠেছিল। বলেছিলেন, ‘না না, গাইতে আবার পারি নাকি। অই একটু তোমাকে শোনাব বলে।’…

কত কথা শুনবে হে। মলুটির কথা কি এক দুপুরে শেষ হয়! এক দিনে বা এক রাতেও কি হয়। যদি শুনতে পারতে, তবে চাটুয্যেমশাই সারা জীবনব্যাপী শোনাতে পারতেন। কথার মাঝখানে একবার পুত্রবধু এসে বলেছিলেন, ‘বাবা, মলুটির গল্প শুনে ওঁর কি হবে। আর কত বলবেন!’

চাটুয্যেমশাই হেসে ভেষেছিলেন, ‘গল্প বলো না বউমা, ইতিহাস। শুনলাম কিনা, এ আবার বই-টই লেখে, এদের সব জেনে রাখা ভাল।’

সেই বিচারের পর না শুনি আমি কেমন করে। তা ছাড়া, শুনতে ভাল লেগেছিল। গানের পরে তা-ই আবার বলেছিলেন, ‘শুনবে তবে, বাঘ মারার গল্প শুনবে। মহাদেবের নাতির ছেলে পুতি, তার নাম ছিল হরচন্দ্র। হরচন্দ্রের মায়ের ছিল মইষি। মইষি বুঝলে তা বাবা, যার নাম মহিষী। সে বড় দুধেল মইষি ছিল বুঝলে। তা, এই মলুটির চারপাশে তখন ভীষণ জঙ্গল। রাখাল মইষি চরাচ্ছিল মাঠে। প্রকাণ্ড এক বাঘ সেই মইষিকে মুখে করে নিয়ে গিয়েছিল। হরচন্দ্রের মায়ের বুকে শেল হানল, সেই মইষি তাঁর বড় প্রিয়। ছেলেকে ডেকে বললেন, যে বাঘ আমার মইষির রক্ত খেয়েছে, সে-বাঘ জ্যান্ত ধরে নিয়ে আসা চাই, না হলে আমার অন্নজল বিষ।

‘হরচন্দ্র তেমনি বীর। মায়ের আদেশ তখুনি শিরোধার্য। না হলে, মায়ের অন্নজল ত্যাগ। হরচন্দ্র তির ধনুক নিয়ে গেলেন জঙ্গলে। রক্তের দাগ ধরে ধরে। এক ঝোপের ধারে গিয়ে দেখেন, বাঘ মইষির বুকের ওপর বসে রক্ত খাচ্ছে। তির মারা তো চলে না, বাঘ মরে যাবে। জ্যান্ত নিতে হবে। তাই শুধু তিরটা হাত দিয়ে গায়ে ছুড়ে মারলেন। যেমনি মারা, তেমনি বাঘের লাফ। লাফ দিয়ে পড়তে এল হরচন্দ্রের ওপর। হরচন্দ্র তাকে জাপটে ধরল গলায়। ধরে, সেই ভাবেই নিয়ে এল মায়ের কাছে।

‘মাও তেমনি। বললে, রাখ ওইভাবে ধরে। ওকে আমি নিজের হাতে মারব। বলে ঘর থেকে ধারালো কাটারি এনে, বাঘের মাথায় এক কোপ। তাতেই শেষ। ভাবো, এমন লোকও বংশে ছিল।’

শুনতে শুনতে বড় রায়ের মুখখানি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল। যাঁকে আমি আমার ছেলেবেলা থেকেই দেখেছি রেলের কোট গায়ে দেওয়া, টিকেট সংগ্রহকারী। মলুটির গল্পের শেষ নেই, তবু চাটুয্যেমশাইকেও থামতে হয়েছিল। সবেমাত্র তখন বামা ক্ষ্যাপার প্রসঙ্গ তুলেছিলেন, ‘এই যে তোমরা সাধক বামাক্ষ্যাপার কথা শোনো, জানো তো উনি এই মলুটিতে এসেছিলেন চাকরি করতে। তাঁর মা বলেছিলেন, তুমি মলুটির রাজাদের কাছে গিয়ে চাকরি চাও। কিন্তু চাইলেই তো হয় না। বামাচরণ লেখাপড়া জানতেন না। তাঁকে দিয়ে এস্টেটের কী কাজ হবে! রাজা বললেন, কী কাজ তুমি করবে?

‘বামাচরণ বললেন, আমাকে আপনাদের নারায়ণের পূজারি করে দিন। তথাস্তু, তাই হল। বছর দুয়েক সে কাজ করেছিলেন তিনি। কিন্তু তারা দেবী যাঁকে ডাক দিয়েছেন, তার কি ওসব নিয়ে বেশি দিন থাকা চলে? মলুটি থেকে চলে গেলেন তারাপুরে, শিমুলতলার শ্মশানে। শুরু হল তান্ত্রিক—।’

সেই পর্যন্তই। ঘরের দরজায় একটা ছায়া পড়তে দেখেছিলাম। তাকিয়ে দেখিনি। গলার স্বর শুনে ফিরতে হয়েছিল দু’জনকেই। দেখেছিলাম, সুষি। বলেছিল, ‘জ্যাঠা আপনাকে বাড়ি যেতে বললেন, অনেক বেলা হয়েছে।’

তখন হাত তুলে সময় দেখেছিলাম। বেলা দুটো। ডাক শুনে চাটুয্যেমশাইয়ের দিকে তাকিয়েছিলাম। তার বৃদ্ধ চোখে যেন কয়েক মুহূর্তের চেতনাহীন ভ্রান্তি ছিল। তারপরে, সেই যে উজান বাওয়া নজরে চলে গিয়েছিলেন দূরান্তের মলুটিতে, সেখান থেকে ফিরে এসেছিলেন আস্তে আস্তে। বলেছিলেন, ‘সুষি নাকি।’

‘হ্যাঁ।’

‘অ তুকে ডাকতে পাঠয়েছে বুঝি?’

‘হ্যাঁ, বেলা তো অনেক হল, ওর চান-টান হয়নি।’

তখন পুত্রবধূ এসে বলেছিলেন, ‘বাবা এবার আপনাকেও চান করতে যেতে হবে।’ নিরুপায় হতাশ বিমর্ষ চাটুয্যেমশাই। বুঝতে অসুবিধা হয়নি, বেঁচে আছেন মলুটির অতীতে। এ যুগটা তার কাছে রসহীন বিবর্ণ, কেবল দিনযাপনের প্রাণধারণ। শেষ দিনের প্রতীক্ষা। তবু, যতদিন আছেন, ততদিন মলুটির রূপকথার কথক তিনি। মলুটির সন্তান নন, মলুটির প্রেমিক। বলেছিলেন, ‘ও বেলা আবার এসো, আরও বলব, অনেক কথা বলব।’

সেখানে যে গতিবিধি সবই আমার ইচ্ছা, তা না। তবু ‘আচ্ছা’ বলে পা বাড়িয়েছিলাম। চাটুয্যেমশাই আবার বলে উঠেছিলেন, ‘কাল দুপুরে তুমি আমাদের বাড়িতে খাবে।’

সে বিষয়েও আমার মতামত দেবার কিছু ছিল না। মতামতের অধিকার বড় রায়ের। তবু আগের মতন সম্মতি জানিয়ে এসেছিলাম। সুষির সঙ্গে রাস্তায় যখন এসেছিলাম, দেখেছিলাম, ছায়া লম্বা আর বাঁকা হয়ে পড়েছে। তবু মলুটির পথে পা দিয়ে, চাটুয্যেমশাইয়ের কথাই বারে বারে মনে পড়েছিল। যে মলুটিতে লৌকিক, অলৌকিক, অনেক ঘটনা আর হাজার কিংবদন্তীর জন্ম হয়েছে।

সুষি জিজ্ঞেস করেছিল, ‘সেই তখন বেরিয়ে—এতক্ষণ এখানেই ছিলেন?’

বলেছিলাম, ‘না, মৌলীক্ষার মাঠে গিয়েছিলাম।’

বলতে গিয়ে মনে পড়েছিল ধনুর কথা। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘ধনু বাড়ি গেছে?’

সুষি ওর কালো চোখে অবাক ঝিলিক হেনে বলেছিল, ‘না। কেন বলুন তো।’

ধনুর কথায় সবাই শশব্যস্ত। বলেছিলাম, ‘না, তাকে মাঠে দেখেছিলাম কি না।’

তবুও সুষি চোখ সরাতে দেরি করছিল। শুধু আমার মুখের ওপর চোখ রাখেনি। আমার চোখ দিয়ে মনেতে ডুব দিতে চেয়েছিল। জানতাম, ধনুর ব্যাপার বলেই। সুষি মুখে চোখ রেখে খোঁজ করছিল, কোনও অঘটনের ছায়া সেখানে পড়েছে কি না।

অঘটন না, তবে সেই তাড়ির জালা শেষ করে ধনু যদি বাড়ি ফিরে থাকে, তা হলে অবস্থাটা কেমন দাঁড়াতে পারে, সেই ভয়ের কথাটাই, ভয়ে ভয়ে বলেছিলাম সুষিকে।

সুষি হেসেছিল খিলখিলিয়ে। বলেছিল, ‘তা-ই ভাল। আমি ভাবছি, অন্য কিছু নাকি। ও যে তাড়ি খায়, সে কথা সবাই জানে। তবে জ্যাঠার সামনে আসবে না। বাড়িতেও ঢুকবে না।’

‘তবে খাবে কোথায়?’

সুষি নির্বিকার হেসে বলেছিল, ‘সে কথাও ধনুই বলতে পারে। হয়তো যাদের সঙ্গে তাড়ি খাচ্ছে, তাদের সঙ্গেই একটা ব্যবস্থা হবে।’

তা বটে। ধনুকে যা দেখেছিলাম, তার পক্ষে সেটা খুব আশ্চর্যের না। কিন্তু আর একটা কথা মনের মধ্যে দপদপিয়ে উঠেছিল। সুষিকে জিজ্ঞেস করব কি না ভাবছিলাম, সেই কিশোরীটি কে, ধনুর গালে যে থাপ্পড় মারতে পারে।

কিন্তু তার আগে সুষিই জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আর কাউকে দেখলেন ওর সঙ্গে?’

‘আর কেউ মানে?’

সুষি একটু ঠোঁট টিপে হেসেছিল। অন্যদিকে চেয়ে বলেছিল, ‘কোনও মেয়েটেয়ে?’

বলে চোখ ফিরিয়ে তাকিয়েছিল আমার দিকে। কিন্তু আমি জবাব দেবার আগেই, সুষি হঠাৎ নিজের মনেই হেসে উঠে, মুখে আঁচল চেপেছিল। আমি দেখেছিলাম, সেই হাসিতে যেন চপেটাঘাত আর বালিকা রহস্যের ইঙ্গিত আছে।

.

৩৩.

অবাক হয়ে চেয়ে ছিলাম সুষির দিকে। এই কি অবাক কাণ্ড দেখ হে, তার কথায় চপেটাঘাত আর বালিকা-রহস্যের যে ইঙ্গিতই থাক, তা বলে কি ধনুর সঙ্গে মাঠে-ঘাটে মেয়ের দেখাও মিলতে পারে। সে কথা জিজ্ঞেস করবার আগেই ঠেক। সুষি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে আঁচল নামিয়ে নিয়েছিল মুখ থেকে। যেন ঝটিতি সহবতে, মেয়ে একেবারে কম্প্রবক্ষে নম্রনেত্রপাত।

চোখ তুলে সামনে তাকিয়ে দেখেছিলাম দীর্ঘদেহ প্রৌঢ় ব্যক্তি। খালি গা, খালি পা, সামান্য খাটো ধুতি, গলায় উপবীত। চক্ষে দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, ঈষৎ আরক্ত। জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কুথা গেছ্‌ছিলি র‍্যা?’

সুষি যেন শঙ্কিত সম্ভ্রমে ভয়-পাওয়া বিহঙ্গী। বলেছিল, ‘দিনদাদের বাড়ি।’

পরবর্তী প্রশ্ন,, আওয়াজ উঠেছিল গম্ভীর গোঙানো গলায়, ‘ইটি কে?’

সুষি তেমনি করেই জবাব দিয়েছিল, ‘জ্যাঠার সঙ্গে এসেছেন, জ্যাঠা যেখানে চাকরি করেন সেখান থেকে। দিনদাদের বাড়ি গেছলেন, ডাকতে গেছলাম।’

‘অ।’

অস্ফুট মোটা একটি শব্দ মাত্র। তারপরে ভিনদেশির দিকে একবার দৃষ্টিপাত। সুষি আমার দিকে ফিরে বলেছিল, ‘বড় পিসেমশাই।’

ইঙ্গিতটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি। তাড়াতাড়ি নিচু হয়ে হাত বাড়িয়ে পায়ের ধুলা নিয়েছিলাম। সেই শান্ত বজ্রস্বরে আবার আওয়াজ উঠেছিল, ‘থাক বাবা থাক, জয়স্তু। পরে দেখা হবে। অ সুষি, আমাদিগের ঘর লিয়ে যাস ক্যানে একবারটি।’

‘যাব।’

গোরা ব্রাহ্মণ তখন অগ্রগামী। আর কোনও কথা বলেননি। সুষি বলেছিল, ‘আপনি যাঁদের বাড়ি এসেছেন, সে বাড়ির বড় জামাই উনি। খুব রাশভারী লোক।’

বলবার দরকার ছিল না। দেখে-শুনেই মালুম হয়েছিল। কেবল রাশভারী কেন, তার চেয়ে বেশি। মহাদেবের মতো আচ্ছন্ন গম্ভীর, কিন্তু রুদ্র হয়ে উঠতে যাঁর সময় লাগে না। বলেছিলাম, ‘তুমি যেন ভয় পেয়ে গেছ।’

সুষি বলেছিল, ‘সবাই পায়। আপনার সঙ্গে হেসে কথা বলতে বলতে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি। যদি কিছু বলে উঠতেন। বাবা রে, ওঁকে ভীষণ ভয় পাই।’

তা বটে! সোমত্থ মেয়্যা, আন্‌কা পুরুষের সঙ্গে হেসে কথা বুলতে বুলতে যাবে কী হে! হায়া বুলে কিছু নাই না কী। তবে কিনা, রাঙা ভুঁয়ে রাঙা রাঙা পা দু’খানি ফেলে চলে যাওয়া খালি-গা ব্রাহ্মণটিকে দেখে মনে কেমন সম্ভ্রমের উদয় হয়েছিল। কিন্তু উত্থাপিত প্রসঙ্গ আবার ঢেউ দিয়েছিল।

জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘ধনুর সঙ্গে মেয়েরা কি মাঠেও যায় নাকি?’

সুষির কালো মুখে আবার হাসির ঝলক লেগেছিল। যে হাসি লজ্জা দিয়ে রাঙানো। বলেছিল, ‘মেয়েরা নয়, একজন।’

বলেছিলাম, ‘পুকুরের ধারে যেখানে সে বসল, সেখানেও তো দু’জন মেয়ে ছিল।’

‘না, না, তারা না। গাঁয়ের মেয়ে।’

মনে তখন আমার রহস্যের রং। ভেবেছিলাম, টিপে দেখি না। বলেছিলাম, ও! বছর পনেরো ষোলো বয়সের মেয়ে কী?’

সুষির ডাগর চোখ দু’টি প্রায় গোল হয়ে উঠেছিল। গলায় তরাস দিয়ে বলেছিল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওইরকম, চোদ্দো-পনেরোর বেশি না।’

হুম্! হদিসের কপাট খুলছিল। তা-ই আর একটু চাড় দিয়েছিলাম, ‘রংটা ফরসা, শাড়ি পরা, দেখতে-শুনতে মন্দ না!’

শুনে সুষি দাঁড়িয়ে পড়েছিল প্রায়। সেই তরাসী গলায় বলেছিল, ‘হ্যাঁ। ধনুর সঙ্গে মাঠে দেখেছেন নাকি?’

সুষির চোখে পলক পড়েনি। মুখ-ভরা বিস্ময়। একটু যদি বা ভয়, কিন্তু ঈর্ষা একবিন্দু না। হাসি চেপে বলেছিলাম, ‘দেখেছি। তবে মাঠে না।’

‘কোথায় তবে?’

সুষি তখন আমার মুখে রহস্য দেখছিল। বলেছিলাম, ‘সকালবেলা দেখেছিলাম সেই দোতলার ঘরের পেছনে।’

সুষি কয়েক মুহূর্ত কথা বলতে পারেনি। কিন্তু ইতিমধ্যেই তার ভয়-তরাসী চোখের কূলে হাসির বান চুঁইয়ে আসছিল। আমি ঘরের পিছনের দৃশ্য বর্ণনা করেছিলাম। সুষি হেসে বাঁচেনি। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘সেই মেয়ের কথাই জিজ্ঞেস করছ বোধ হয়।’

তখন আবার সুষির ভারী লজ্জা। বলছিল, ‘হ্যাঁ। ওর নাম তৃপ্তি। খুব সুন্দর না দেখতে?’

সে কথা স্বীকার করতেই হয়েছিল, তৃপ্তি রূপসী। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘ধনুর গালে যে চাঁটি মারতে পারে সে কি আবার তার সঙ্গে মাঠে-ঘাটেও যেতে পারে?’

সুষি ঘাড় দুলিয়ে বলেছিল, ‘পারে। তিপুর মতো মেয়ে পারে।’

‘ওই মারের পরেও?’

‘হ্যাঁ। ধনুও কি ওকে ছেড়ে কথা বলে নাকি। ধনু মারে না?’

না, অই গ, ওহে প্রেমের দেবতা, অমন মারন-ধরন প্রেম-কথা তখন ইস্তক শোনা ছিল না। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘দু’জনেই মারামারি করে নাকি?’

সুষি বলেছিল, ‘ধনুই মারে বেশি। তখন নিশ্চয় ধনু কোনও বাজে কথা বলেছিল, তাই—।’

কথা শেষ করেনি সুষি। অ-বলা ইঙ্গিতের লজ্জায় গলায় ঠেক লেগেছিল। তবু না জিজ্ঞেস করে পারিনি, ‘তৃপ্তি কাদের বাড়ির মেয়ে?’

আমরা তখন একটা পথের বাঁকে। একটি আধ-কাঁচা আধ-পাকা ইটের দেওয়ালের ঘরের পাশে মাটির ঘরে মেশামেশি এমনি বাড়ির দিকে আঙুল দেখিয়ে সুষি বলেছিল, ‘ওই বাঁড়ুজ্জেদের বাড়ির মেয়ে।’ বলে সুষি আমার দিকে তাকিয়ে আবার একটু হেসেছিল। বলেছিল, ‘ধনু মারুক ধরুক যাই করুক, দেখবেন তিপু আবার ঘুরে-ফিরে ঠিক ওর কাছে যাবে।’

বটে! সে যে একেবারে পাকা প্রেম, জবর ভিতের গাঁথনি। কিন্তু গ্রামের মধ্যে এমন অনাচার! চ্যাঙড়া-চেঙড়িকে শাসন করার কেউ ছিল না নাকি। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কেউ কিছু বলে না ওদের?’

সুষি জিব কেটে চোখ বড় করেছিল, ‘ওমা, বলবে কী। কেউ কিছু জানে নাকি!’

‘তুমি তো জানো দেখি।’

‘ওমা, আমি তো লুকিয়ে জানি।’

তাও তো বটে। প্রেমের খবর আবার জানাজানি করে জানা হয় নাকি। সুষি আবার বলেছিল, ‘আমি যে জানি তা ওরা জানে না।’

তা-ই বা ওরা জানবে কী করে। ওদের তা জানতে নেই। তবে, দু’টিকেই যেমন ভয়ডরহীন ডাকা-ডাকিনী মনে হয়েছিল, জানাজানি হলেও যে তাদের কিছু আসে-যায়, তেমন মনে হয়নি। তা ছাড়া, ধনু তো আগেই আমার কাছে ঘোষণা করেছিল, বিয়েটা সে সেই গ্রামেই করবে। তারপরে আর কোনও সম্পর্ক নেই। কিন্তু যতই আমি দু’জনের কথা ভেবেছিলাম, ততই যেন এক হাসির ঝরা কুলকুলিয়ে যাচ্ছিল আমার ভিতরে।

জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘ওদের কি বিয়ে হবে নাকি?’

সুষি বলেছিল, ‘ধনু তো তাই পণ করে বসে আছে।’

‘বলেছে নাকি?’

‘সবাইকেই। ধনুর তো কিছু রাখ-ঢাক নেই। নিজের পিসা-পিসিকেও বলেছে, তিপুকে ও বিয়ে করবে।’ বলে সুষি আমার দিকে তাকিয়েছিল। তারপরে, সুষি কেন হেসে উঠেছিল তাও জানি না। তার সঙ্গে আমিও কেন, তাও বুঝতে পারিনি।

কিন্তু মিছা বুলা না হে। একেবারে কি বুঝতে পারনি? পেরেছিলো। বুঝতে পেরেছিলে, হাসির কারণ আর কিছু না। মনেতে কেমন একটা বাদ্যি ঝনঝনিয়ে উঠেছিল। তা-ই হাসি।

ইতিমধ্যে আমরা পূজা-দালানের উঠোনে এসে পড়েছিলাম। দেখেছিলাম, সাঁওতাল প্রজাদের সংখ্যা আরও বেড়েছে। সেই সঙ্গে অজা, বলির পশু। তা-ই কাঁঠালপাতার ছড়াছড়ি। তবে প্রজারা কেউ একলা আসেনি। সকলেই সপরিবারে। শিশুরা কেউ তাদের কোলে, কেউ মায়ের পাশে ভুঁয়ে নিদ্রামগ্ন। নয়তো কালো মেয়ের খোলা বুকে শিশুর অঝোর অমৃতপান। সকলেরই চোখে যেন এক অলৌকিক দৃষ্টি। সবাই দেখছিল প্রতিমা রং-করা। যতটুকু দেখে গিয়েছিলাম, রং তার থেকে তখন বেশি লেগেছিল। কালীর পায়ের তলায় মহাদেবের গায়ে খড়িগোলা মাখানো হয়েছিল। প্রতিমার কালো রঙে ঝলক দিয়েছিল। ছিন্নমুণ্ডের নাক মুখ চোখে লেগেছিল রং। উঠোনে আরও দেখেছিলাম, ঢাকের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। একটা জায়গা সাদা-কালো পালকের বাঁকানো শিখায় ঢাকা পড়ে গিয়েছিল।

বাড়ির মধ্যে ঢুকতে-না-ঢুকতে বড় রায়। স্নান-শেষে গামছা পরে ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিলেন। দেখেই বলেছিলেন, ‘ইস্‌ দেখ দিকি, বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে, এখনও চান-খাওয়ার দেখা নেই। যাও, যাও বাবা, তাড়াতাড়ি একটু মাথায় জল দিয়ে এসো।’

সকালের খাবার সময় শুনেছিলাম ভিন্ন কথা। খেতে নাকি অনেক বেলা হবে। এখন আবার অন্য কথা। অনেক নাকি দেরি হয়ে গিয়েছে। তবে রাঙা হাসিটুকু মুখে ছিল ঠিক। আবার বলেছিলেন, ‘চাটুয্যেমশাই ধরে রেখেছিলেন বুঝি?’

জবাব দিয়েছিল সুষি, ‘আমি না গেলে এখনও ছাড়তেন না।’

‘অই বলে কে, পাগল মানুষ।’

সুষি আবার বলেছিল, ‘কাল দুপুরে ওঁকে ওঁদের বাড়িতে খাবার কথা বলেছেন!’

বড় রায়ের ভুরু কুঁচকে উঠেছিল। আওয়াজ দিয়েছিলেন, ‘কী?’

তখন তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন বড় গিন্নি। তিনি বলে উঠেছিলেন, ‘আ দূর, তাই কি হয় নাকি। আজ রাতে পূজা, কাল ঘরে আমার কত কী। কাল কি পরের বাড়িতে খেতে দিতে পারি। ঠাকুর-জামাই যেন কী।’

বড় রায় রাঙা মুখখানি ঢেউ খেলিয়ে বলেছিলেন, ‘অগ, না, না, চাটুয্যেমশায়ের খেয়াল নাই। তুমি যাও, যাও বাবা, চান করে এসো। সুষি, ওকে জল দে মা তাড়াতাড়ি।’

আমি জামাকাপড় ছেড়ে স্নানের সরঞ্জাম আনতে যাচ্ছিলাম ওপরে। কিন্তু ঠেক লেগেছিল জল এনে দেবার কথায়। তা-ই সরে গিয়ে সুষিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তোমরা চান করো কোথায়?’

‘কাঁদরে, উত্তরের কাঁদরে।’

‘আমিও সেখানেই যাব।’

‘না, না।’

সুষির কথা শুনিনি আর। চলে গিয়েছিলাম ওপরে। নীচে এসে দেখেছিলাম, সুষি দাওয়ায় দাঁড়িয়ে। বাড়িটাকে দেখে মনে হচ্ছিল, আরও লোক বেড়েছে। আরও ব্যস্ততা, আরও কণ্ঠস্বরের ভিড়। সুষিকে বলেছিলাম, ‘বাড়ির ছেলেদের কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। চাকর-বাকর কেউ থাকলে একটু কাঁদরের রাস্তাটা—।’

সুষি বলেছিল, ‘সত্যি কাঁদরেই যাবেন? শরীর খারাপ করবে না?’

বলেছিলাম, ‘দেখা যাক।’

‘তা হলে চলুন, আমিই নিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু—।’

সুষি কথা শেষ না করে দাওয়া থেকে নেমে আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসেছিল। বলেছিল, ‘জ্যাঠা বকলে আমি কিছু জানি না।’

বচনেই বোঝা যাচ্ছিল, সুষি অনেক সহজ হয়েছে। বলেছিলাম, ‘না হয় আমিই জানব।’ কিন্তু এত বেলায় জল টানাটানি চলে না। ‘তার চেয়ে এতটা হেঁটে কাঁদরে যাওয়া ভাল।’

বলে বাড়ির পিছন দিক দিয়ে এক নতুন রাস্তায় যেতে যেতে সুষি হেসেছিল খিলখিলিয়ে। আর তখনই একটি ঘর দেখিয়ে বলেছিল, ‘আমরা এ ঘরে থাকি।’

ঘরের কাছে তাল গাছ, তার পাশে এক নিম। সেই ছায়াতে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক বিধবা। আমাকে দেখেই ঘোমটা একটু টেনে দিয়েছিলেন, বয়সে যদিও প্রৌঢ়া। তবে কিনা, বয়স বলে তো কথা না। কথা হল স্বজাত আর প্রথা নিয়ে।

সুষি আমাকে ঘর দেখিয়ে সেই মহিলাকে বলেছিল, ‘মা, কাঁদর থেকে আসছি। তুমি উপোসের শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকো না। একটু শুয়ে থাকো গে।’

সুষির মা তাঁর থানের ঘোমটার আড়াল থেকে একবার আমাকে দেখেছিলেন। আমি চলতে চলতে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘উপোস কেন?’

সুষি বলেছিল, ‘অমাবস্যা পড়েছে বেলা বারোটার পর। তা ছাড়া পুজোপাটের দিন মা খায় না।’

বলে সুষি একবার ফিরে তাকিয়েছিল মায়ের দিকে। এমন কিছু অভিনব দৃশ্য নয়। তবু সেই যে সুষি কালো মেয়েটি, এলো চুলে আলগা খোঁপা, ডাগর চোখ, স্বাস্থ্যবতী, চলনে এক স্বভাব-প্রকৃতির ছন্দ, বলনে হাস্যময়ী ব্ৰীড়া, তাকে এক কোন ঠাঁই নিরালা ঘরে, যেখানে আরও ভাইবোন আছে, আর ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকেন বিধবা মা, সব মিলিয়ে কী যেন এক সুর বেজে যায়। সেই যে এক গান শোনা ছিল, “আমি কাঁদর ভরা হাসি হেসেছি” তেমনি মনে হয়েছিল। কেন যে অমন মনে হয়েছিল, তা জানি না।

‘কুথা চললে গ সুষি দিদি?’

দেখেছিলাম দেওয়ালে ফাটল-ধরা মাটির ঘরের সামনে এক মেয়ে। রুক্ষু চুল, একবেড়ে খাটো শাড়ি পরা, কষ্টিপাথরে কাটা এক মূর্তি। পাথর যেমন ভাঙে, টুকরো হয়, কিন্তু নম্রতা জানে না, সেই মতো। এ সেই যুবতী না, যাকে দেখেছিলাম ঢোকবার পথে, কাঁদরের পাথরের ওপর। এ আর একজন, যার চোখ ঢুলুঢুলু, গা ঢিসঢিস। মেটে সিঁদুরের দাগ তার রুক্ষু চুলের সিঁথায়। জিজ্ঞাসা সুষি দিদিকে, ঢুলুঢুলু নজরখানি বিদেশির চোখে চোখে।

সুষি বলেছিল, ‘কাঁদরে।’

চোখের মণি ঘুরিয়ে পুছ করেছিল, ‘ইটো?’

‘বড় তরফের অতিথি।’

‘তুমি নাওয়াতে লিয়ে যেইছ?’

‘কাঁদর দেখাতে যাচ্ছি।’

‘অই। তাই তো বুইলছি।’

বুললে কী হবে গ কালিন্দী মেয়্যা, তুমার লজরে যে আন্ কথা দেখি। সুষি যেন কোপ জানত না, কটাক্ষও না। বলেছিল, ‘খোয়ারি কাটেনি বুঝি তোর।’

ততক্ষণে আমরা একটু এগিয়ে গিয়েছিলাম। হাসির ঝরায় জবাব এসেছিল, ‘অই গ, কাটে নাই। কত্তার ইচ্ছায় কম্‌মো, দ্যাখ ক্যানে, লোকের তো এখনও হুঁশ নাই, ঘরে পড়ে রল্‌ছে।’

তখন সুষির আর এক মূর্তি। ঘাড় ফিরিয়ে কটাক্ষ করে হেসেছিল। বলেছিল, ‘আজ রাত্রে আবার পূজা। তোদের দু’টোর কি মরণ নেই?’

জবাবে শুধু হাসির আওয়াজ শোনা গিয়েছিল। যেন বেলোয়ারি চুড়ি ঝনঝনানো হাসি। সুষি আমার দিকে ফিরে বলেছিল, ‘বাউরি। স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই কী মদ যে খায়, বাবা বাবা!’

‘তাই নাকি?’

‘হ্যাঁ, নিজেরাই ঘরে তৈরি করে। কাল রাত্রে তো কী মাতলামি দু’জনে। যত মারামারি করে, তত হাসাহাসি করে। আর কান্নাকাটিও তত।’

শুধু হাসি, শুধু কান্না, শুধু বিবাদ না। সব মিলিয়ে একাকার। তা নইলে আর মাতলামি কীসের। আর সে মাতলামি দেখে যে সুষিরা বেশ মজা পায়, ব্যঞ্জনাতে সেই কথা। সুষি আরও বলেছিল, ‘কালীপুজো আসবার আগেই সব ক্ষেপে ওঠে। আজ যে কী করবে, দেখবেন।’

দেখব, দেখতেই তো গিয়েছিলাম। কিন্তু তখন পথের ওপর পাথর ছড়াছড়ি। অতিথিকে সাবধানে চলতে হচ্ছিল। মৃত্তিকা ঢালুতে গড়িয়ে যাচ্ছিল। কোথাও কাঁকর বিছানো রক্তভূমি, কোথাও দূর্বা-ছাওয়া সবুজ। মাঝে মাঝে আম-কাঁঠাল, তাল-তেঁতুলের ছায়া। কলসি কাঁখে ভেজা কাপড়ের ঘোমটা শালীনতায় ঢাকা হয়ে গিয়েছিল বউ-ঝিয়েরা। গামছা-পরা পুরুষেরা। তার মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ ঠিকই ছিল, ‘ইটো কে?’ তবে কাঁদরে তখন ভিড় কম।

কাঁদরের ওপারে পাথুরে ভুঁই যেন ঘাড় উঁচিয়ে উঠেছিল। শাল-তালের ছায়ায় ঢাকা মৃত্তিকা আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে হারিয়ে গিয়েছিল। মাঝখানে কাঁদর, একটু বাঁয়ে বেঁকে ডাইনের মোড়ে অদৃশ্য হয়েছিল। নীল জল ছলছল কলকলিয়ে ধারায় বইছিল। স্বচ্ছ জলের নীচে পাথরের নুড়ি আর বেলেমাটি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল।

অমন জলে অবগাহন হয় না, শয়নে স্নান হয়েছিল। কোমরের বেশি জল ছিল না। কিন্তু ঠান্ডা আর মিষ্টি স্বাদ। হাত দিয়ে ছিটিয়ে ছিটিয়ে মেখেছিলাম। স্রোতের টানে নিজেকে ঠেকিয়ে রেখেছিলাম বড় পাথরের ঠেক দিয়ে। দেখে সুষি হেসেছিল পাড়ে দাঁড়িয়ে।

জল থেকে যখন উঠেছিলাম তখন আমার সর্বাঙ্গ জুড়ে এক শীতল শান্তি। জলে মধু ছিল কিনা জানি না, মাদকের নেশা লেগেছিল যেন। বাড়ি ফিরে গিয়ে বড় রায় আর ছোট রায়ের সঙ্গে খেয়ে সেই যে শুয়েছিলাম আর কোনও হুঁশ ছিল না। যখন হুঁশ হয়েছিল, তখন গভীর অন্ধকার। কেবল মোটা দরাজ গলায় কোথা থেকে যেন গান ভেসে আসছিল—

‘অ মা, বাজবে গা মহেশের হৃদে

আর লাচিস না গ ক্ষ্যাপা মাগী।

মরে নাই দেব বেঁচ্যা আছে

যগে রইছে মহাযগী,

আর লাচিস না গ ক্ষ্যাপা মাগী।’…

সুরেতে রামপ্রসাদী, কথায় কিঞ্চিৎ ভিন্নতর। ক্ষণিকের বিভ্রম লেগেছিল, ঘোর অন্ধকারে। বুঝতে পারিনি কোথায় আছি। কোন দুনিয়ায়, কোন সংসারে, কালাকালের কোন সীমায়। তখনও স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম—

‘যা দেখি তুর চরণের জোর

লাচলে শিবের ভাঙবে পাঁজর

অ গ মা, বিষখেকো দেব লয় হে সজোর

তু লেগে উয়ার মন বিবাগী।’…

সেই চেতনহীন অন্ধকার বিভ্রমে আবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল কালো প্রতিমা। কিন্তু স্থান কাল কিছুই মনে পড়েনি। সেই মুহূর্তেই আমার নাকে এক তিক্ত টক রসের গন্ধ লেগেছিল। হাত সরাতে গিয়ে হঠাৎ কীসের সঙ্গে ঠেকেছিল। কালো কুচকুচে অন্ধকারে আমার কেমন গা ছমছমিয়ে উঠেছিল। হাত বাড়িয়ে আর একটু দেখে মনে হয়েছিল, শায়িত এক মানুষের শরীর। সর্বাঙ্গে তার জামাকাপড় জড়ানো। তখনই এক অস্পষ্ট পায়ের শব্দ, নাকি অস্ফুট একটু ঝনৎকার, কী যেন শুনেছিলাম। তারপরেই অস্পষ্ট ডাক, ‘ধনুদা, এই ধনুদা!’

ডাক শেষ হতে না হতেই আলোর রেশ পড়েছিল মাটির দেওয়ালে। সুষির গলা আমি শুনতে পেয়েছিলাম, ‘ওখানে কে রে?’

জবাব বাজেনি। আবার প্রশ্ন, ‘কে ওখানে।’

তখন জবাব বেজেছিল, ‘আমি তিপু।’

তৃপ্তি! অই গ, কী বুলব হে, আমার পাশে তবে ধনুবাবু শুয়েছিলেন এসে। তাই এমন তিক্ত টক রসের গন্ধ! তাই অন্ধকারে চুপি চুপি তিপুর আবির্ভাব। আমি মলুটিতে রয়েছি। সেইদিন কালীপূজা। ভাবতে ভাবতেই বাতি হাতে উঠে এসেছিল সুষি। আর বাইরে গানের শব্দ ডুবিয়ে হঠাৎ একবার ঢাক বেজে উঠেছিল।

.

৩৪.

কী পালার কোন দৃশ্য যে ঘটতে যাচ্ছিল, তেমন আন্দাজ করতে পারিনি। অন্ধকারে মঞ্চসজ্জা, পাত্রপাত্রীর অবস্থান অনুমান করতে পাচ্ছিলাম। কাল—রাত্রি। স্থান—মাটির ঘরের দ্বিতল। সেথায় পাত্র আমি বসা, ধনু সোয়া, নিশ্চিত নেশা ও নিদ্রায় অচৈতন্য। সিঁড়ির কাছে কোথাও তৃপ্তি। নীচে থেকে আগমন ঘটছিল সুষির। কেবল, একবার ঢাক বেজে ওঠার শব্দে আমার মনটা দুরদুরিয়ে উঠেছিল। নিশাযোগে কালীপূজা দেখা বুঝি হারাই।

বাতি যত এগিয়ে এসেছিল সুষির হাতে, দেখেছিলাম, এক মূর্তি সিঁড়ির ধারে; সরু সিঁড়ি, দু’জনাতে পাশাপাশি কুলায় না। সুষি বলেছিল, ‘এখানে দাঁড়িয়ে কেন, ঘরে ঢোক। আমাকে উঠতে দে।’

তৃপ্তি ঘরে ঢুকে পাশ নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। হ্যারিকেন হাতে উঠে এসেছিল সুষি। সুষির সঙ্গে চোখাচোখি হতেই ওর ঠোঁটের কোণে দেখেছিলাম হাসির টিপুনি। চোখেতে তারই ঝলক, তার মধ্যেই একটু আড়চোখে দেখে নেওয়া তিপুকে। যেন সুষির নিজের দেখা না, আমাকে দেখানো।

দেখেছিলাম, সে নায়িকা যে চোখের তৃপ্তি, সন্দেহ ছিল না। তার চেয়ে বলো, নয়নসুখ বরং বলতে ইচ্ছা করেছিল, গোরোচনা গোরী নবীনা কিশোরী। একেবারে পাকা কুমোরের হাতে গড়া প্রতিমামুখ। পূজার উৎসবের সাজ গায়ে। লাল শাড়ি লাল জামা। আটপৌরে ধরনে না, পোশাকি চালের ফেত্তা ছিল শাড়িতে। উৎসবের সাজ কি না! সামনে থেকে টেনে আঁচড়ানো চুলে খোঁপা বাঁধা, তাতে ঝুমকা রুপোর কাঁটা। কপালে খয়েরি রঙের টিপ। তার ওপরে টুকুস হিমানী পাউডার পড়েনি, তা বলতে পারবে না। ডাগর চোখ দুটিতে কাজল মাখায়, আরও যেন ডাগর লেগেছিল। পায়ে যে কেবল আলতা মেখেছিল, তা না। নতুন চামড়ার গন্ধ পেতে পারো, এমন নয়া রুপালি রঙের স্যান্ডেল পরেছিল। পূজার উৎসবের সাজ কি না!

সব মিলিয়ে, এ সব বলতে পারো, চোখের তৃপ্তি। সেই সঙ্গে আরও ছিল, গন্ধ তৃপ্তি। কী সৌগন্ধ যে মেখে এসেছিল মেয়ে, ঘরে ছড়িয়ে গিয়েছিল।

দেখেশুনে তারপরে ধনুর দিকে নজর না পড়ে যায়নি। শ্রীমানের রূপের রুচির প্রশংসা না করে উপায় ছিল না। কিন্তু হায়, মুখপোড়া, ‘উমা ত্যাজে ভাঙ খেয়ে, সাপ জড়িয়ে রইলি পড়ে।’ ধনুর তখন সেই দশা। আই কী বুইলব হে, জলচুড়িপাড় কাঁচিধুতির কোঁচার পত্তন আধখানা ধুলায় পড়ে। সিল্কের পাঞ্জাবির দশা দেখলে জন্তুতেও কাঁদত। কুঁচকে দলা পাকিয়ে, গোটা গায়ে যেন লেপটে ছিল। হাত-পা এলোপাথাড়ি ছড়ানো। অঘোরে ঘুমের গাঢ় নিশ্বাস।

বলতে যত সময়, দেখতে তত লাগেনি। একবার এদিক, একবার ওদিক করতেই, সুষি বলেছিস, ‘ক’বার এসে দেখে গেছি। আপনি খুব ঘুমোচ্ছেন, তাই আর ডাকিনি।’

আমি সুষির দিকে তাকিয়েছিলাম। তার চোখমুখে যে কেবল হাসি চাপবার ঝলকানি, তা না। কিছু লাজে লাজানো ভাবও ছিল। সুষি একটু লজ্জায়ও পড়েছিল। আমি বলেছিলাম, ‘ডাকলেই পারতে। এখন কত রাত?’

সুষি বলেছিল, ‘রাত কোথায়! একটু আগেই সন্ধ্যাবাতি দেখানো হয়েছে।’

যাক, পূজা হারাইনি। নিদ্রা কেবল গত রাত্রি জাগরণের মাসুল আদায় করেছিল। সুষি আবার বলেছিল, ‘জেঠি খালি বলছেন, আপনাকে চা দেওয়া হচ্ছে না। হয়তো উঠে বসে আছেন। তাই কয়েকবার দেখে গেছি, উঠেছেন কি না। চা নিয়ে আসব?’

শুয়ে মাতালের মতোই বলে উঠেছিলাম, ‘নিশ্চয়।’

দিবানিদ্রার জড়তা কাটাবার আর কী ওষুধ ছিল। যেন, চা আনতে যাবে বলেই তৃপ্তির দিকে ফিরে সুষি থমকে দাঁড়িয়েছিল। আসলে, কথা বলে একটু লজ্জা কাটাবার চেষ্টা। বলেছিল, ‘তিপু কি ধনুকে ডাকছিলি নাকি?’

তিপুর প্রতিমা-চক্ষু একবার অচেনাকে দেখে নিয়েছিল। তার আগে অনেকবারই দেখে নিয়েছিল। একটু সঙ্কোচ ছিল না, তা নয়। তবে, অনায়াসেই ঘাড় দুলিয়ে বলেছিল, ‘হ্যাঁ।’

তারপরেই সুষির দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘দুপুরে খায় নাই, না?’ বক্তার সঙ্কোচ নেই, শ্রোত্রীর লজ্জা। যেন এমন একটা প্রশ্ন সুষি আশা করেনি। তা-ই প্রায় চমক খাওয়াটা হাসি দিয়ে সামলে বলেছিল, ‘খাবে কী, ধনু তো এলই প্রায় সাঁঝবেলায়। কারুর সঙ্গে কথাবার্তা নেই, একেবারে এসে শুয়ে পড়েছে।’

শুনতে শুনতে তিপুর নজর বিদ্ধ ধনুর ঘুমন্ত মুখে। সেই নজরে বেজায় কোপ। বলেছিল, ‘দেখ তো কাণ্ড। খাওয়াদাওয়া নেই। সব্বাই পূজা দেখতে যেইছে, এ ঘুম লাগাচ্ছে। একটু ডেকে দাও তো সুষিদি।’

সুষি বলেছিল, ‘তুই ডাক না।’

আবার একবার অচেনা লোকটার দিকে তিপুর নজর পড়েছিল। ওইটুকুই যা বাধা। আমি উঠে দাঁড়াইনি কেবল, বারান্দা যাবার দরজা দিয়ে বাইরে গিয়েছিলাম। সুষি বলেছিল, ‘আমি আপনার চা নিয়ে আসছি।’

সেও নীচে চলে গিয়েছিল। উঠোনের দিকে নজর দেবার অবকাশ পাইনি। যেখানে আমার শ্রবণ ছিল, নজর মনে মনে সেইখানেতেই। শুনেছিলাম, ‘এই ধনুদা, ধনুদা! শুইনছ, এই ধনুদা, উঠ ক্যানে, শুইনছ।’

তারপরেই ডাকার স্বর, ‘অ্যাঁ—কে রা?’

‘অই, চিনতে লারছ গ ধনুদা?’

ধনুর দ্বিতীয় কথায় ঘুমের রেশ কম ছিল। শুনেছিলাম, ‘কে, তিপু?’

‘হ্যাঁ। উঠ।’

‘নাঃ, তু যা। তু আমার সাথে কথা বলিস না। মেয়েছেলে হয়ে তু আমার গায়ে হাত তুলিস…।’

‘এই ধনুদা, আর শুয়ো না বইলছি। তুমি যখন আমাকে মারো, তখন?’

‘আমি বিটাছেলে। বিটাছেলেকে তু মারবি? যা, আমি ঘুমাব।’

‘ই দ্যাখ ক্যানে, এই ধনুদা, তোমার নিশা কাটে নাই। লজ্জা করে না ইসব কইরতে, আবার মেজাজ দেখাল্‌ছ। উঠবে কি না, পূজা দেখবে না?’

‘না না না, তু যা। আমার ইচ্ছে হয়েছে নিশা করেছি, আরও কইর্‌ব, তু যা। কথা বলিস না।’

চোখে দেখতে পাইনি, মনে হয়েছিল, ধনু আবার লুটিয়ে পড়েছে বিছানায়। আর সম্ভবত তৃপ্তি তাকে ধরে টেনে তোলবার চেষ্টা করেছিল। গলার স্বরে সেইরকমই মনে হয়েছিল, ‘উঠ বইল্‌ছি, ধনুদা উঠ। আমি তোমাকে শুতে দেব না।’

জবাব, ‘আহ্, ছাড় বইলছি; মারব মুখে এক থাপ্পড়।’

‘তা-ই মার ক্যানে। তুমি কি মারো না? কাল আমার চুল ছিঁড়ে দাও নাই? উঠ বইল্‌ছি, উঠ।’

‘না না না। আমি তোর মুখ দেখতে চাই না। তু যা।’

ইতিমধ্যে আবার সুষির আবির্ভাব হয়েছিল। তার গলা শুনতে পেয়েছিলাম, ‘তোরা কী করছিস। মারামারি করবি নাকি!’

তৃপ্তির জবাব, ‘দ্যাখ ক্যানে সুষিদি, কিছুতেই উঠছে না। আবার বইলছে, আমার মুখ দেখবে না। লজ্জাও নাই। কুটুম বাড়ি বসে কাঁড়ি কাঁড়ি তাড়ি গিলে, আবার মেজাজ দেখাল্‌ছে।’

ধনুর বাণী, ‘একশো বার দেখাব। তু যা, আমি পূজা দেখব না, কুথাও যাব না। এই সুষি, একে যেতে বল তো। লইলে একটা কাণ্ড হবে বলে দিচ্ছি।’

তিপুর ঠোঁট নিশ্চয় বেঁকে উঠেছিল, চোখের নজর তাই। বিদ্রূপে ঢেউ দিয়ে বলেছিল, ‘ইস্‌, মুরোদ। কাণ্ড হবে।’

তখন সুষির গলা শোনা গিয়েছিল, ‘আহ্‌, তোরা কী করছিস। জ্যাঠা, জেঠি শুনলে বুঝি ভাল হবে। তুই এখন যা তিপু, ঝগড়া করিস না।’

সুষির গলায় ধমকের সুর। কয়েক মুহূর্ত কারুর কথাই শোনা যায়নি। তারপরে হঠাৎ তিপুর একেবারে নতুন স্বর শোনা গিয়েছিল। যে স্বর কেবল স্ফুরিত না, একটু মোচড় লাগানো, ‘বেশ, আমি যেইছি, মনে থাকে যেন।’

দোতলার মাটির মেঝে কেঁপেছিল কি না, টের পাইনি। দুপ্‌ দুপ্‌ আওয়াজ পেয়েছিলাম। তিপু অন্তর্ধান করেছিল। সুষির গলায় ডাক এসেছিল, ‘আপনি কি বারান্দায়?’

জবাব দিয়ে ঘরে ঢুকেছিলাম। দেখেছিলাম, ধনু পূর্ববৎ শায়িত। সে যে এতক্ষণ ঝগড়া করছিল, কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। সুষির দিকে তাকিয়েছিলাম। সে ঠোঁট টিপে হেসে, চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিয়েছিল।

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে, মনে মনে বলেছিলাম, জীবনে এমন পালা দেখাও আমার কপালে ছিল। এমন বিবাদ বচন শোনাও ছিল ভাগ্যে। অই কী বইলব হে, তাতে নীতির ঝাপটা লাগেনি আমার প্রাণে। অনাচারের ব্যাজে দেখিনি কোথাও। ভাল বলো মন্দ বলো, সেই আমার প্রথম-দেখা-রাঢ়ের-প্রাণে টুকুস রং লেগে গিয়েছিল। চায়ে চুমুক দিতে দিতে, রসের ভাগীদার সুষির দিকে তাকিয়েছিলাম। দেখেছিলাম, উদ্‌গত হাসির ধারা ওই চোখে মুখে ঝরঝরিয়ে পড়তে চাইছে। চোখের কোণ দিয়ে একবার ধনুকে দেখে, মুখে আঁচল চেপে এগিয়ে গিয়েছিল সিঁড়ির দিকে। তারপরে মুখ থেকে আঁচল সরিয়ে বলেছিল, ‘নীচে আপনার হাতমুখ ধোয়ার জল আছে। দেরি করবেন না। জ্যাঠা বারবার আপনার কথা জিজ্ঞেস করছেন।’

অবুঝের মতো জিজ্ঞেস করে ফেলেছিলাম, ‘কেন?’

সুষি বলেছিল, ‘আপনি সব দেখবেন শুনবেন, তাই।’

তাও তো বটে। আমি যে উৎসবের বাড়ির অতিথি। আমার কি কেবল ঘরে বসে থাকা চলে। আবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘গান করছে কে?’

সুষি হেসে বলেছিল, ‘সে এক হাজার মানুষ। নীচে এসে দেখবেন।’

সুষি চলে গিয়েছিল। আমিও আর দেরি করিনি। চা শেষ করেই নীচে নেমেছিলাম। যজ্ঞিবাড়ি বটে! তখন নতুন রূপ খুলেছিল। উঠোনের এক পাশে জ্বলছিল কারবাইডের বাতি। ঘরে ঘরে হ্যারিকেন। ঘরে উঠোনে কত মেয়েপুরুষের যে জটলা। বোঝা যাচ্ছিল, অতিথি আত্মীয় কুটুমের ভিড় ইতিমধ্যে আরও অনেক বেড়েছে। এখানে দু’জন, ওখানে চারজন, ঘরে উঠোনে গুচ্ছ গুচ্ছ জটলা। অনেকদিন পরে সবার দেখাশোনা। সকলের অনেক কথা। ‘অ, তা-ই তো বলি, ই বিটি কার গ। খাসা হয়েছে। ছেলে দেখাশোনা চইলছে তো? একদিকে যখন এই কথা, আর একদিকে তখন, ‘না, সে চাকরি হলো কুথা। দেখি, বানপুরের সাহেব তো বইলছে বিটাকে একবার লিয়ে যেতে।’ কিংবা অন্য দিকে, ‘তা আমি কালীপূজার সময়, পেত্যেক বছরই আসি। এক বাড়ি তো না, ছ’ বাড়িতে নেমন্তন্ন।’ তারপর হাসির লহর।

কেবল, দক্ষিণের ভিটেখানিই যা একটু ফাঁকা-ফাঁকা। তাও হাতমুখ ধুতে ধুতেই অচেনার ওপর অনেক নজর পড়েছিল। নজরের সেই এক ভাষা, ‘ইটো কে বটে!’

ওদিকে পূজা-দালানের উঠোন থেকে হ্যাজাকের ধবধবে আলোর ঝলক গলির গায়ে পড়েছিল। সেই ফাঁক দিয়ে যতটুকু নজর যায়। দেখেছিলাম, সেখানেও ভিড় কম, না। বাক-জটলা সেখানেও। গান ভেসে আসছিল, সেখান থেকেই তখনও শুনতে পাচ্ছিলাম।

অই অই অই সমরে বিহরে শ্যামা…।

গলা তো না, বজ্রনাদ। তার মধ্যে কোথায় যেন একটু ক্ষ্যাপা ভাবের ঘোর। সেই ভাবের জন্যেই বজ্রনাদেও একটা যেন মিঠে ঝঙ্কারের আমেজ। কে গাইছিল। সুষি বলে গিয়েছিল, ‘এক মজার মানুষ।’

আর আমার তর সয়নি। কোনওরকমে হাতমুখ ধুয়ে ওপরে গিয়ে জামাকাপড় পরে একটু ভব্য হয়ে নীচে নেমে এসেছিলাম। উত্তরের ঘরের কাছে যেতেই প্রথম দেখা ছোট রায়ের সঙ্গে। দেখেছিলাম, রাঙা রায়ের গায়ে তখন গরদের একখানি লালপাড় শাড়ি। পূজা বলে কথা। তার আয়োজন তো আর কাপাস পরে হয় না। তার মধ্যেই আবার সাবধানতা। পাছে ছুঁয়ে ফেলি৷ রাঙা হাসি হেসে বলেছিলেন, ‘অ্যাই যে বাবা, এসেছ? ঘুমটুম হয়েছিল তো? চা দিয়েছিল? পূজাপাটের বাড়ি বাবা, একটু নিজে থেকে দেখেশুনে লিয়ো।’

কোন কথাটার জবাব দেবে? জবাব তোমার কাছে কেউ প্রত্যাশা করেনি। ঘাড় নেড়েছিল, তাই যথেষ্ট। তিনি সরে যেতেই, পিছন পিছন বড় রায়। রাঙা বর্ণে যেন দ্বিগুণ ঝলক। হাতে কলাপাতা, তাতে জলে ভেজানো আতপচাল। গন্তব্য পূজাদালানে নিশ্চয়ই। পূজার আয়োজনে ব্যস্ত। তাঁর অঙ্গেও একখানি গরদের কাপড়, কিন্তু শাড়ি না। থমকে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘এই যে বাবা, উঠেছ?’ এর পরে তো আর কথা বলতে পারব না। তুমি নিজে থেকে সব ঘুরে-টুরে দেখ। ছেলেরা আসবে কয়েকজন, তোমাকে ডেকে নিয়ে যাবে, ঘোরাবে বেড়াবে, কেমন?’

বলেই এক দিকে ফিরে একজনকে ডেকেছিলেন। এক যুবককে। তার সঙ্গে আরও দু’জন। বড় রায় পরিচয় দিয়ে আলাপ করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘একে লিয়ে সব দেখা-টেখা তোরা।’

তারপরেই তিনি অন্তর্ধান করেছিলেন। প্রয়োজন না থাকলেও তিনজনের সঙ্গে ঘুরেছিলাম। আগে গিয়েছিলাম পূজা-দালানের উঠোনে।

তখন আর দিনের বেলার সেই উঠোন না। হ্যাজাকের আলোয়, ভিড়ে তার চেহারা তখন আলাদা। দশ-বারোখানি ঢাক এক জায়গাতে সার দেওয়া। দশ-বারো পালকের নিশানে দোলা। ঢাকীদের ভিড় সেখানে। সেই সময়ের মধ্যেই, দেখেছিলাম, কম করে বিশ-পঁচিশটি অজা। কেউ করে ম্যা ম্যা, কেউ ভ্যা ভ্যা। তার সঙ্গেই বেড়েছিল সাঁওতাল প্রজাদের ভিড়। গামছা আর কাপড় পেতে পরিবারগুলো নিজেদের সীমানা ভাগ করে নিয়েছিল।

ওদিকে কুমোরের কাজ তখনও চলছিল। প্রতিমা প্রায় শেষ। যদিও রং লাগানো চলছিল তখনও। তখন কেবল বিশেষ বিশেষ কাজ। জিভের লাল রং, ললাটের নয়ন আঁকা, গহনাতে সোনালি তুলির লেপন। চালচিত্রও প্রায় শেষ। বাকি কেবল একটি জিনিস, সেখানে কিছুই ছোঁয়ানো হয়নি। প্রতিমার চোখের তারা। চোখের দুই কোণে লাল রংটুকুও ছোঁয়ানো হয়েছিল। তবু চোখের তারা ছিল না বলে প্রতিমা যেন মাটির পুতুল তখনও। তাতে প্রাণসঞ্চার হয়নি।

তা ছাড়া, ডাকের সাজের কিছু কিঞ্চিৎ কাজ চলছিল। নয়া চেনাদের একজন বুঝিয়ে দিয়েছিল, শোলার তৈরি পদ্মফুলের গায়ে যেসব চিহ্ন আঁকা ছিল, সবই তন্ত্রমতের নানান প্রতীক। মলুটির কালীপূজা তন্ত্রমতের পূজা। জেনেছিলাম, কারণবারি ছাড়া সে পূজা অবিধেয়। কারণবারি ছাড়া পূজা বিফল। কারণই জাগ্রত, কারণ পবিত্র। আর সে কারণ তোমার, ফটাস করে বোতলের মুখ খুলে, ঢকঢকিয়ে পান করা না। সে কারণবারি পবিত্র মতে, পবিত্র মনে তৈরি।

প্রতিমার সাজ, পূজার আয়োজন সমানে চলছিল। বাড়ির ভিতর থেকে আসছিল নানান উপচার-নৈবেদ্যের থালা। তার মধ্যে সব থেকে আকর্ষণীয়, উঠোনের এক ধারে কালী নামের ক্ষ্যাপা গায়ক। তাকে ঘিরে সব থেকে ভিড় বেশি।

কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম গায়কের। কালীর ছেলে বটে। বাতি সরিয়ে নিলে, গায়ককে খুঁজে পাওয়া যেত না, এমন নিকষ কালো রং। কিন্তু গায়ে আর কোমরের চিলতে কাপড় দুখানি, যেন রাঢ়ের মাটি গুলে ছোপানো। হঠাৎ দেখে মনে হয়েছিল মাথায় বুঝি জটা। জটা না, ঝাঁকড়া চুলে তেলের ভাঁজ ছিল না। রাঙা ধুলায় কাঁচাপাকা চুলের গোছ যেন শণনুড়ি। তবে অই, কী বইলব হে, মানুষের চোখ না। কোকিলের। লাল বলে তার বিচার হয় না, বলো অক্তবণনো। চোখের দিকে চেয়ে থাকা যাইনি। মুখের হাসিটিও যেমন-তেমন না। চোখ পাকানো ক্ষ্যাপা হাসি। আবার হাসতে হাসতে চোখ ভেসে যায়। চিৎকার করে তখন গায়ক মা মা বলে একেবারে অবশ বিবশ।

একের পর এক, থামবার নাম ছিল না। আপনাকে আপনি পুছ করেছিলাম, একে গান বলে, না ডাক বলে। গায়ক যেন ধন্দ ধরিয়েছিল। কখনও যেন মা-হারানো ছেলের শোক-বিষাদের কাঁদন। কখনও হাসন নাচন কোঁদন। আবার অন্যতরও ছিল। যেমন, ছোট রায় যখন মস্ত একখানি পেতলের থালা নিয়ে পূজাদালানে উঠতে যাচ্ছিলেন, গায়ক হাঁক দিয়ে উঠেছিল, ‘অই গ কত্তা, বাসন লিয়ে যান কুথা। শোনেন গ, শোনেন।

বলেই গান ধরে দিয়েছিল,

‘অই হে, এমনি করে মাজবি বাসন,

দেখা যায় রে আপন বদন—

তখন বাসন মাঝে দেখবি মায়ের সেই চরণ।’

ছোট রায় দাঁড়িয়ে শুনে, রাঙা হাসি ছিটিয়ে আবার উঠতে যাচ্ছিলেন। গায়ক তৎক্ষণাৎ আবার গেয়ে উঠেছিল:

‘অই ওহে, বাসনে মলা থাকলে

মায়ের চরণ নাহি মিলে

ঝাপসা আয়নায় হয় না কভু মুখ দরশন।’

ছোট রায় অমনি থালাখানি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখেছিলেন। গান শুনে তাঁর ধন্দ বাসন সাফা আছে কিনা। তা-ই দেখে গায়ক খলখলিয়ে হেসে উঠেছিল। যেন, রহস্য করে গোপন কথা বলে, তেমনি ভাবে চোখ ঢুলুঢুলু করে ছড়া কেটে বলেছিল, ‘ওহে, বিরজা পার হলে পরে, বাসনেতে ছায়া পড়ে। রূপে ভোবন আলো করে, শেতল হয় হে তপ্ত জীবন।…বুইলেন গ কত্তা। টুকুস চন্নামেত্ত কিন্তুক চাই।’

বলে, রক্তবর্ণ চোখে ইশারা করে হেসেছিল। ছোট রায় হাত তুলে হেসে বলেছিলেন, ‘হবে হবে।’

যারা ঘিরে দাঁড়িয়েছিল, তারাও অনেকে হেসে উঠেছিল। কে একজন বলেছিল, ‘মায়ের চন্নামেত্ত তো সারা রাতই হবে। এখনও তো পেটে আছে।’

গায়ক দাঁত দেখিয়ে হেসেছিল। গান গেয়ে উঠেছিল আবার,

‘ওহে কালী কুণ্ডলিনী, শম্ভুভাবিনী

জাগ মা অন্তরে শ্যামা, জাগ হে অন্তরে।’

অমন গায়ককে কী বলে তা জানি না। কাকে অমন ডাকাডাকি, ডেকে হাসাহাসি কাঁদাকাঁদি, কিছুই জানি না। যেন পাশে দাঁড়িয়ে, ভিন জগতের বোল বলে। ভাবের চালাচালি করে। এমন চোখ পাইনি যে, প্রতিমাকে প্রতিমা ছাড়া আর কিছু দেখি। না মনে, না চোখে। কেমন করে অমন মা মা বলে ডাক দেওয়া যায়। হাসা কাঁদা যায়, আমার অনুভবের অগম্য।

তবে কি না সে কথাও কবুল করি, গায়কের ভাবেতে যেন ভাব লেগেছিল। কেন, তাও জানি না। বোধ হয় গায়কেতে ছল ছিল না। সাচ্চা ভাবের এক দান আছে। সেই দান মিলেছিল শ্রবণ মন ভরে। যেমন কিনা পুত্রহারা শোকাতুরা কান্না দেখলে বুকে মোচড়ায়, তেমনি। তোমার পুত্রশোক নাই-বা যদি থাকে, তবু যেমন মোচড়ায়, তেমনি। তেমনি করেই গায়কের ভাবে ভাব লেগেছিল। তার তালেতে দোলা লেগেছিল। হাসিতে হাসি। আবার যখন কালী ক্ষ্যাপা, জলে ভেসে গেয়েছিল, ‘কী খেলা খেলাও মা তুমি, জীবন্ত পুতুলি সনে। সে-ই জানে তোর খেলার মর্ম, যে থাকে তোর সদা ধ্যানে’ তখন কেন যে মন টাটিয়ে গিয়েছিল তাও বুঝতে পারিনি।

তখন লোকটির মুখ থেকে চোখ সরাতে পারিনি। আমি শক্ত দুনিয়ায় খোঁচা খেয়ে চলা মানুষ। জীবন-ধারণের কোথাও আমার কালীর খবর নেই। তবু ভাল বলো মন্দ বলো, দীর্ঘশ্বাসে যেন এক পাষাণভার নামতে চেয়েছিল কোথা থেকে। কেন তা জানি না।

শুনেছিলাম, গায়কের আগমন হয়েছিল তারাপীঠ থেকে। সেখানে শিমুলতলার মহাশ্মশানে তার বাস, যেখানে নাকি বামাচরণ বামাক্ষ্যাপা হয়েছিলেন। গায়কও আর এক ক্ষ্যাপা। সকলের মুখে তাঁর নাম শুনেছিলাম ক্ষ্যাপা গোবিন্‌। জানি না, এযুগে আর বামাক্ষ্যাপা হয় কিনা কেউ। ক্ষ্যাপা গোবিন্‌ তেমন সাধক কি না, তাও আমার অজানা ছিল। কিন্তু বামাক্ষ্যাপার তত্ত্ব-রহস্য কিছু আমার জানা নেই। ক্ষ্যাপা গোবিনের গানের রস আমার মনে নানান খেলা খেলিয়েছিল। প্রত্যেক বছর কালীপূজার সময় নাকি তার আবির্ভাব হত।

কতক্ষণ গান শুনেছিলাম জানি না। এক সময়ে হঠাৎ ঢাক বেজে উঠেছিল। একটা না, একসঙ্গে অনেকগুলো। প্রথমেই, ঢাকীর দগর দিয়েছিল। গান চাপা পড়ে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল জগৎ-সংসার সকলই যেন কাঁপছে। একসঙ্গে এত ঢাকের দগর দেওয়া আর কখনও শুনিনি। বুকে, রক্তে, মস্তিষ্কে সেই শব্দ যেন কোনও অন্য লোকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। মানুষের কণ্ঠস্বর শুনিনি। কেবল দু-একটা ভীত অজার স্খলিত অসহায় অবাক ডাক কেমন করে যেন কানে এসেছিল।

তখন চারদিকেই যেন একটা বিশেষ ছুটোছুটি। কেউ যেন বসে ছিল না। প্রতিমার দিকে তাকিয়ে দেখেছিলাম, চোখের তারায় জীবন্ত দৃষ্টি। আমার সঙ্গে একেবারে মুখোমুখি, চোখাচোখি। পরমুহূর্তেই দুম করে পটকা ফেটেছিল। ফুলঝুরি জ্বালিয়ে ছোটরা ধিতাং ধিতাং নাচ শুরু করেছিল।

বড় রায় যাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন, তাদের একজন কানের কাছে মুখ এনে বলেছিল, ‘চলুন, অন্যান্য বাড়ি একটু দেখে আসি।’

আমি যেন একটা ঘোরের মধ্যেই তাদের সঙ্গে চলে গিয়েছিলাম। অন্ধকার পথের ওপরে নাকি। কার ঘন অন্ধকারে তৈরি মানুষের মূর্তিরা আমার চারপাশে চলাফেরা করছিল। আর আমার মনে হয়েছিল চারদিকে কেবল ঢাকের বাজনা। গোটা মলুটি যেন ঢাকের বাজনায় সহসা বাঁধা পড়ে গিয়েছে। কাঁপছে থরথরিয়ে। দূরান্তের কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখেছিলাম, আকাশও যেন তারা ঝিকমিকিয়ে কাঁপছে। মলুটির বুকে যেন কী এক অলৌকিকতা নেমে আসছে। আর সেই অলৌকিক ঘোরের মধ্যে আমি হারিয়ে যাচ্ছিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *