০৯. বায়ান্ন বাজারের তিপান্ন গল্প

বায়ান্ন বাজারের তিপান্ন গল্প

স্বর্ণগ্রস্ত

ভর সন্ধ্যায় সহিদের অট্টহাসিটা পাশের গলি পর্যন্ত বিস্তৃত হলো। এলোমেলো চুল, পায়ে জীর্ণ স্যান্ডেল নিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক কালের জিগরি দোস্ত রন্টু।

“কি করবি তুই? কারে মারবি?”

কানের পাশে জুলফি মোচড়াতে লাগলো রন্টু। এই সহিদ যখন হাফপ্যান্ট পরে পাড়ার মাঠে ফুটবলে লাথি মারতো তখন সে অন্য পাড়ার ছেলেদের ঠ্যাঙাতো। ওর কাছেই প্রথমে রিভলবার দেখে সহিদ। তারপর একদিন ওর কাছেই বন্দুক-পিস্তলের হাতেখড়ি।

“কথা কস্ না ক্যান?”

উঠতি বয়সের এক ছোকরাকে আসতে দেখে চুপ মেরে গেল রন্টু। সহিদকে সম্ভ্রমের সাথে সালাম দিয়ে চলে গেল ছেলেটা। আলতো করে কেবল মাথা দোলালো সহিদ, এখন আর শব্দ করে সালামের জবাব দেয় না। সারাদিন অসংখ্য সালাম পায় সে।

“কারে মারবার চা?” প্রশ্নটা আবারও করলো রন্টুর দোস্ত।

“কাউরে মারনের লাইগা চাইতাছি না।”

সন্দেহের দৃষ্টিতে বাল্যবন্ধুর দিকে তাকালো সহিদ। রন্টু এখন ছিঁচকে মাস্তানি আর টুকটাক চাঁদাবাজি করে বেড়ায়। আর সবই করে নেশার টাকা জোগাড়ের জন্য।

“আমারে ওইটা দে…খোদার কসম, রাইতেই জিনিসটা রিটান দিমু তরে।”

তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো সহিদ। রন্টুর হাত ধরে সে এই লাইনে এসেছে সত্যি, কিন্তু আজ তার সাথে যোজন যোজন দূরত্ব। বিস্তর ফারাক। দুই বছর আগে স্বৈরাচারের পতনের পর জায়গামতো একে ওকে ধরে সরকারি দলে ঢুকে পড়ে সে, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই এলাকায় সবচেয়ে বড় নেতা বনে যায়। এখন সূত্রাপুর-কোতোয়ালী থানা তো ব্যাপারই না, এমনকি পোস্তাগোলা থেকে লালবাগ পর্যন্ত তার ক্ষমতা বিস্তৃত।

“আমারে বিশ্বাস কইরা পুরা ঘটনা না কইলে তুই একটা গুলিও পাবি না।” অবশেষে সরাসরি বলল সহিদ।

বন্ধুর মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলো রন্টু। “বিশ্বাস তো করছিলাম একবার।”

কথাটা বুঝতে একটুও বেগ পেলো না সহিদ। বছর তিনেক আগে এই রন্টু খোঁজ দিয়েছিল, ঢাকার আদালত প্রাঙ্গনের এক ভেন্ডার জাল স্ট্যাম্প বিক্রি করে। সহিদ তখন একটি ছাত্র সংগঠনের ক্যাডার। তার বন্দুক চালানোর দক্ষতা কিংবদন্তিতুল্য। রন্টুর কথামতো জাল-স্ট্যাম্প বিক্রেতাকে গিয়ে ধরলো, কাজও হলো কিন্তু বন্ধুকে এককালীন তিনহাজার টাকা ধরিয়ে দিয়ে সে বলেছিল, ফিরোজ নামের ওই জাল-স্ট্যাম্প বিক্রেতাকে যেন আর ডিস্টার্ব না করে। রন্টুর বুঝতে অসুবিধা হয়নি, জালিয়াতটার সাথে মাসোহারার ব্যবস্থা করে নিয়েছে তার জিগরি দোস্ত।

তিক্ত স্মৃতিটা সহিদের মেজাজ খারাপ করে দিলো। কাটাকাটাভাবে বলল সে, “বিশ্বাস না করবার পারলে ফোট!”

এ কথাটা আমলেই নিলো না রন্টু। “এই জিন্দেগিতে আমি যদি তর কোনো উপকার কইরা থাকি, তাইলে আমারে ওইটা দে, দোস্ত।”

“কইলাম তো, পুরা কাহিনী না কইলে গুল্লিও পাবি না।”

সহিদের বন্ধু তার চিরাচরিত হতাশার প্রকাশ ঘটালো একহাতের মুঠি দিয়ে আরেক হাতের তালুতে জোরে জোরে আঘাত করে। ছোটবেলা থেকেই রন্টুর আচার আচরণের মধ্যে একটু বেশি মাত্রায় নাটকীয়তা আর বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলার প্রবণতা আছে। তার কাছে কোনো অস্ত্র নেই, আছে শুধু চাপার জোর। এটা দিয়েও বেশ কাজ সেরে নেয় সে।

“আমি যদি ঘটনাটা কই তাইলে তুই আমার লগে বেঈমানি করবি না তো?”

সহিদের কপালে ভাঁজ পড়ল। “কী এমন ঘটনা যে, বেঈমানির কথা উঠতাছে?”

কণ্ঠটা খাদে নামিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল রন্টু, “গালকাটা ইকবাল… আলিমভাই… এয়ারপোর্ট… বিস্কুট… মনে আছে তর?”

অন্য অনেকের মতো এই গপ্পোটা সহিদও জানে। এক দিকে রায়সাহেববাজার থেকে কলতাবাজার, লক্ষীবাজার হয়ে শাখারিবাজার তাঁতীবাজার-বংশাল আর অন্য দিকে ফরাশগঞ্জ, চামারটুলি পেরিয়ে সূত্রাপুরের কাপড়ামাকানে গিয়েও গল্পটা ঘুরপাক খায়। এই গল্পের সবচেয়ে বড় কথক রন্টু নিজেই। স্বয়ং গালকাটা ইকবাল নাকি গল্পটা বলেছে তাকে।

সাতাত্তর-আটাত্তর সালের দিকে এই এলাকার প্রভাবশালী ছাত্রনেতা ছিল আলীমভাই, তার ডানহাত গালকাটা ইকবাল একদিন জানালো, তার কাছে পাক্কা খবর আছে, সন্ধ্যার দিকে কুর্মিটোলা এয়ারপোর্ট থেকে স্বর্ণের একটি চালান ঢুকবে তাঁতীবাজারে। সম্ভত স্বর্ণ-ব্যবসায়িদের মধ্যে ঝগড়া ফ্যাসাদের কারনে খবরটা বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। ব্রিফকেস ভর্তি স্বর্ণের বিস্কুটের কথা শুনে আলীমভাই নড়েচড়ে ওঠে। একটা প্রাইভেটকার নিয়ে তারা দু-জন ওঁৎ পেতে থাকে এয়ারপোর্টের বাইরে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই দেখতে পায় ঐ সময় পুরনো ঢাকার তাদের প্রতিপক্ষ নিত্যানন্দ গ্রুপের সবচেয়ে বড় দুই ক্যাডার নিতাই আর বুলেট একটা জিপ নিয়ে হাজির। দৃশ্যটা দেখে আলীমভাই রেগে গেলেও গালকাটা ইকবাল জানায়, এতে বরং সুবিধাই হয়ে গেল, তাদেরকে আর কষ্ট করে স্বর্নব্যবসায়ীর হাত থেকে ব্রিফকেসটা ছিনিয়ে নিতে হবে না। আলীমভাই তার সাগরেদের ইঙ্গিতটা ঠিকই ধরতে পেরেছিল।

যাইহোক, কাজ সেরে নিত্যানন্দ গ্রুপের ক্যাডার দু-জন যখন স্বর্ণভর্তি ব্রিফকেস নিয়ে পুরনো ঢাকায় ফিরছিল তখন গাড়ি দিয়ে তাদের পথরোধ করে ইকবাল। ব্রিফকেসভর্তি স্বর্ণ ছিনিয়ে নেবার পর তারা বেশ ফুর্তির মেজাজে ছিল, এরকম ঘটনার আশঙ্কাও করেনি ঘুণাক্ষরে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই গালকাটা ইকবাল গাড়ি থেকে নেমে পিস্তল দিয়ে গুলি করে মেরে ফেলে তাদের দুজনকে। ঘটনাটা নাকি চোখের পলকে ঘটিয়েছিল ইকবাল। রন্টু অবশ্য আরও নাটকীয়তা যোগ করে এই ঘটনাটা বয়ান করে সব সময়-এক সেকেন্ডে দুটো গুলি! দুটোই ঠিক কপালের মাঝখানে! স্পট ডেড!

এই ঘটনার দু-বছর পর আলীমভাই রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে হয়ে ওঠে বিশিষ্ট স্বর্ণ-ব্যবসায়ী! প্রতিটি ঐশ্বর্যের পেছনে যে একটি অপরাধ থাকে, এই গল্প তার আরেকটি উদাহরণ।

“তুই কি কইবার চাস?” অনেকক্ষণ পর বলল সহিদ।

“আমার কাছে পাক্কা খবর আছে, আইজকা রাইতে…আটটার পর একটা চালান ঢুকবো।”

বন্ধুর দিকে অবিশ্বাসে চেয়ে রইলো সহিদ। “কয়জন থাকবো?”

“একজনই।”

চমকে উঠল সহিদ। “একজন!” তার কাছে অবশ্য ব্যাপারটা অস্বাভাবিকও মনে হলো না। স্মাগলারা একেবারে মামুলিভাবে মালামাল বহন করে যাতে সন্দেহের সৃষ্টি না হয়।

“ইলিগ্যাল মাল…হালারপুতে চিল্লাইবারও পারবো না। আরামসে কামটা করন যাইবো।”

“তুই একলা করবার পারবি?”

আবারও মাথা ঝাঁকালো রন্টু। “হাতে পিস্তল থাকলে আমি কী করবার পারি তুই ত জানোসই।”

সহিদ এটা জানে। কিন্তু সে-সবই অতীতের কথা। এখন যে রন্টু তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে নেশাখোর, ছিঁচকে মাস্তান, চিটিং-বাটপারি করে বেড়ানো একজন।

“তুই কেমনে বুঝবি কোন লোকটা ক্যারি করতাছে?”

মুচকি হাসলো রন্টু। “ক্যারিয়ারে আমি চিনি।”

“ক্যাঠা?”

“এইটা কইয়া দিলে আর থাকে কী?”

সহিদ কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল, “আচ্ছা, এক শর্তে দিবার পারি।”

“কি শর্ত?” চঞ্চল হয়ে উঠল রন্টুর চোখমুখ।

“ফিফটি আমার ফিফটি তর।”

সমস্ত চঞ্চলতা ফিকে হয়ে গেল রন্টুর, বন্ধুর দিকে স্থিরচোখে চেয়ে থেকে আচমকা বাঁকাহাসি দিয়ে উল্টো দিকে হাঁটা ধরলো সে।

“কই যাস…খাড়া!” বন্ধুর পেছন পেছন কয়েক পা এগিয়ে গেল সহিদ। “খাড়া কইতাছি!”

ঘুরে দাঁড়ালো রন্টু। “লালচটা একটু কমা…বুঝলি?” তজৰ্নী আর বুড়ো আঙুল এক করে পরিমাণটাও দেখিয়ে দিলো সে। “তুই তো সব পাইছোস…নেতা হইছোস, বিয়া করছোস…আইতে যাইতে মানুষ তরে সেলাম দেয়…আর কী চাস?”

সহিদ কিছু বলল না। তবে শরমিন্দা হলো কি না তা-ও বোঝা গেল না।

“একটা দান মারবার চান্স পাইছিলাম, মাগার তুই এইহানেও খাবলা মারবার চাস।”

“ঠিক আছে, তুই ষাইট আমি চল্লিশ?”

রন্টুর ঝাকড়া চুল দুলে উঠল। “একটা পিস্তল দিয়া হেল্প কইরা তুই এতগুলান বিস্কুট কেমনে চাস?”

কয়েক মুহূর্তে চুপ থেকে সহিদ নতুন প্রস্তাব দিলো, “আমিও থাকলাম তর লগে? আমার মোটরসাইকেল আছে…চল, দুই বন্ধু মিলা কামটা করি?”

“এইটা সম্ভব না।”

“ক্যান?”

“তুই এই এলাকার নেতা…সবৃতে তরে চিনে। ওই ক্যারিয়ার তরে দেখলেই হোগার কাপড় মাথায় তুইল্যা উল্টা দিকে সোড় দিবো।”

মনে মনে সায় না দিয়ে পারলো না সহিদ। তাকে এই এলাকার ছেলে বুড়ো সবাই চেনে। আর অপরাধ জগতে তার চেহারাটা একটু বেশিই পরিচিত।

“ঠিক আছে, আমি মোটরসাইকেল নিয়া একটু দূরে থাকলাম, কাম হওনের পর তুই আমার কাছে আয়া পড়বি?”

থুতনি চুলকে মাথা নীচু করে ভাবতে লাগলো রন্টু।

“গালকাটা ইকবাল কইলাম চোরের উপর বাটপারি করছিল,” আগের গল্পটার কথা স্মরণ করিয়ে দিলো তাকে। “তর লগেও তো এইরহম কিছু অইবার পারে?”

“এই চালানের খবর আমি ছাড়া কেউ জানে না,” জোর দিয়ে বলল রন্টু।

“তারপরও কোনো গ্যারান্টি নাই…কহন কী হয়া যায়…?”

সহিদের কথা একটু ভেবে দেখলো সে। “ঠিক আছে, তুই বাইক লইয়া ভিক্টোরিয়াপার্কের সামনে থাকবি। কামটা আমি একলাই করুম। ব্রিফকেসটা লইয়াই আমি তর কাছে আয়া পড়ুম।”

“তুই কই থাকবি?” সহিদ জানতে চাইলো।

“শাখারি বাজারে ঢুকনের রাস্তায়।”

“ঠিক আছে।”

“তয় ফরটি-সিক্সটি না। থার্টি-সেভেনটি হইলে আছি।”

মনে মনে হেসে উঠল সহিদ। জিনিস একবার হাতে আসার পর এই ভাগাভাগি উল্টে দেয়া যাবে। “তর কথাই সই।”

.

স্বর্ণফেরি

অপেক্ষারত তিন যুবক রন্টুকে ঘরে ঢুকতে দেখে নড়েচড়ে বসলো। এদের মধ্যে সজল নামের ছেলেটার জ্বালায় অতীষ্ঠ এলাকাবাসী। দেড় বছর ধরে পুরনো ঢাকায় এই নতুন বালটা গজিয়েছে!

রন্টু তার কোমর থেকে একটা সোনালি রঙের পিস্তল বের করতেই উঠে দাঁড়ালো সজল। অস্ত্রটার দিকে অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে রইলো সে। নিজেকে মাস্তান হিসেবে ভাবলেও এখনও বড়সর কোনো দান মারতে পারেনি। তবে পিস্তলটা দেখে তার মনে হচ্ছে সেই দিন সমাগত। আর কোনো কথা না বলে পকেট থেকে একটা টাকার বান্ডিল বাড়িয়ে দিলো সে। “জায়গামতোই আছে তাইলে?”

“হ,” পিস্তলটা কোমরে গুঁজে টাকাগুলো পকেটে ভরে চুপচাপ ঘর থেকে বের হয়ে গেল রন্টু। কাজের সময় বেশি কথা বলে না কখনও।

.

স্বর্ণবিভ্রম

সহিদ তার বাইকটা রেখে দাঁড়িয়ে আছে ভিক্টোরিয়াপার্কের সামনে। অস্থিরতায় বার বার হাতঘড়ি দেখছে সে। অস্ত্র ছাড়া নিজেকে কেমন অসহায় লাগে। সেই চৌদ্দ বছর বয়স থেকে অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কোমরে ঐ জিনিসটা না থাকলে নিজেকে পুরুষই ভাবে না এখন। আর এখন তো তার শত্রুর সংখ্যাও কম নয়। বাধ্য হয়েও ওটা রাখতে হয় সব। সময়।

একটু আগে রন্টুকে তার সোনালি রঙের পিস্তলটা দিয়ে দিয়েছে। কথামতো রাত সাড়ে আটটার মধ্যে ঘটনা ঘটবে, কিন্তু পৌনে ন-টা বেজে গেলেও রন্টুর দেখা নেই। অজানা আশঙ্কা দানা বাঁধছে তার মনে। কেন। জানি মনে হচ্ছে, নেশাখোর রন্টু তাকে টোপ দিয়ে দামি পিস্তলটা বাগিয়ে নিয়েছে। এখন সস্তাদরে বিক্রি করে নেশার টাকা জোগাড় করবে। কিন্তু এ কাজটা করলে রন্টু যে বিরাট বড় বোকামি করবে সে-ব্যাপারে তার মনে কোনো সন্দেহ নেই।

এবার যদি উল্টাপাল্টা কিছু করে রন্টু তাহলে তার শাস্তি হবে কঠিন। গত বছর যে আকাম করে পার পেয়ে গেছিল সেটার কাছে আজকেরটার কোনো তুলনাই হয় না। ওটা ছিল নিছক একটা লোক ঠকানো কাজ। মহল্লার এক ধনীর বাড়ির সামনে রাখা মাইক্রোবাস দেখিয়ে পাড়ার। কলেজের এক ছেলেকে বলেছিল, এটা তার নিজের গাড়িভাড়া দেয়া হয়। ছেলেটা পিকনিকের গাড়ি ভাড়া চাইলে চার হাজার টাকা নিয়ে রন্টু বলেছিল, পরদিন সকালে গাড়িটা রেডি পাবে। কিন্তু পরদিন এলেও রন্টুর দেখা আর পায়নি সে। রন্টু তখন ময়মনসিংহ শহরে গাঙিনার পাড়ে তার আরেক জিগরি দোস্তের সাথে জমিয়ে ফেন্সি খাচ্ছে।

এই ঘটনার প্রায় এক মাস পর রন্টু মহল্লায় এলে সহিদ আর এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করেনি। যদিও প্রতারিত ছেলেটা তার কাছেই বিচার দিয়েছিল। বাল্যবন্ধু হিসেবে ব্যাপারটা নিছক হাসি-তামাশার খোরাক বানিয়ে মাফ করে দিয়েছিল সে।

কিন্তু এবার যদি সে এরকম কিছু করে…

একটা দৃশ্য তার চিন্তাভাবনায় শুধু ব্যাঘাতই ঘটালো না, রীতিমতো ঝাঁকিও দিলো। তার দিকে এগিয়ে আসছে একটা বাইক। পরক্ষণেই বুঝতে পারলো-র নয়, বোকামি করে ফেলেছে সে নিজে!

কিন্তু সহিদ কোনো কিছু করার আগেই বাইকের পেছনে বসা ছেলেটা তার দিকে পিস্তল তাক করে গুলি ছুঁড়লো।

পাঁচটা গুলির মধ্যে প্রথম দুটো গুলির শব্দ শুনতে পেলো সহিদ।

তার পর সব অন্ধকার।

.

স্বর্ণভ্রষ্ট

নিজের ঘরে খিড়কি দিয়ে খাটের নীচ থেকে একটা ট্রাঙ্ক বের করে আনলো রন্টু। বিশ বছর ধরে পড়ে থাকলেও পিস্তলটা একদম নতুন দেখাচ্ছে। সহিদের মৃত্যুর পর ঠিক করেছিল, পিস্তলটার কথা সবাই ভুলে গেলে বিক্রি করে কিছু কামাবে। তারপর বেশ কয়েকবার বিক্রি করার কথা মাথায় এলেও কেন জানি করা হয়নি। তার কাছে মনে হতো, এই পিস্তলটা বিক্রি করে দিলে সে নিঃস্ব আর অক্ষম হয়ে যাবে। ট্রাঙ্কের ভেতরে রাখা এই অস্ত্রটাই তার একমাত্র আত্মবিশ্বাস হিসেবে কাজ করেছে এতগুলো বছর ধরে। আর এভাবেই বিশটি বছর পার হয়ে গেছে কেমন করে টেরই পায়নি।

বেশ দেরিতে বিয়ে করেছে সে। তার একমাত্র মেয়েটার বয়স মাত্র আট। কঠিন অসুখ হয়েছে ওর। প্রচুর টাকার দরকার। ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজন কারো সাথে তার সম্পর্ক নেই। অভাবি আর নিঃসঙ্গ একজন মানুষ সে। বউয়ের সাথে নিত্য ঝগড়া হয়। বড়ভাই তার দোকানে বসার সুযোগও দিয়েছিল কিন্তু দোকানের ক্যাশ থেকে টাকা চুরি করে নেশা করতে গিয়ে সেই চাকরির সাথে সাথে সম্পর্কটাও খুইয়েছে। পৈতৃক সম্পত্তির ভাগাভাগিতে দুটো ঘর পেয়েছে বলে বউ-বাচ্চা নিয়ে কোনমতে সংসার করে যাচ্ছে এখন।

গতকাল অস্ত্রব্যবাসায়ী শুটার সামাদকে ফোন করে জানায় একটা বিদেশি পিস্তল বিক্রি করতে চায় সে। অভিজ্ঞ সামাদ পিস্তলের বিবরণ জেনে নিতে ভুল করেনি। সব শুনে কিছুক্ষণ পর তাকে ফোন দিয়ে জানায়, যদি ভালো দাম পেতে চায় তাহলে যেন আজ সকালে চলে আসে ওটা নিয়ে। তার সামনেই দরদাম করা হবে, বিক্রি থেকে বিশ পার্সেন্ট কমিশন দিতে হবে তাকে।

তাই আজ অনেক বছর পর আবার কোমরে পিস্তল গুঁজে ঘর থেকে। বের হয়ে গেল রন্টু।

.

স্বর্ণভঙ্গ

শুটার সামাদ প্রশংসার দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সোনালি রঙের পিস্তলটার দিকে।

“রেয়ার জিনিস…এখন আর এইসব মেশিন পাওয়া যায় না।”

উসখুস করছে রন্টু। যতো তাড়াতাড়ি বিক্রি করে চলে যাবে ততই ভালো। এটা সে কোত্থেকে পেয়েছে-এমন প্রশ্ন করা হলে কোন গল্পটা বলবে ঠিক করে রেখেছে। গল্প বানানোর ব্যাপারে তার জুড়ি নেই।

কিন্তু ঝানু ব্যবসায়ী সামাদ এ নিয়ে কোনো প্রশ্নই করলো না।

“বিশ-বাইশ বছর তো হইবোই…না?”

কথাটা শুনে রন্টুর বুক কেঁপে উঠল। বুঝতে পারলো, লম্বা একটা সময়ের পরও এই পিস্তলটার কথা সবাই ভুলে যায়নি। “কি কইতাছে…বুঝবার পারলাম না?”

“আরে, তুমি দেখি ঘাবড়ায়া যাইতাছো,” রহস্যময় হাসি দিলো সামাদ। “বিশ-বাইশ বছর আগে সহিদের কাছে আমি এই জিনিসটা বেচছিলাম।”

আলগোছে ঢোক গিললো রন্টু।

“কতো বছর পর আবার মেশিনটা হাতে পাইলাম!” পিস্তলটায় পরশ বুলিয়ে বলল, “সহিদের খুব পছন্দ হইছিল…পঁচাত্তর হাজার টাকায় বেচছিলাম ওর কাছে।”

রন্টু কোনো কথাই বলল না।

“এইটা তুমি কেমনে পাইলা আমি কিন্তু জিগামু না,” সামাদ বলল। “এইসব জাননের কোনো দরকারও নাই আমার।”

রন্টু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। সামাদ যে তার কমিশন বাড়ানোর জন্য এই চাল চালছে বুঝতে বাকি রইলো না। সে কিছু বলতে যাবে অমনি প্রায় নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে পড়ল তিন যুবক। এদের মধ্যে একজনকে সে ভালো করেই চেনে। তাকে দেখেই দ্রুত বুঝে গেল সবটা। নিজেকে সামলে নেবার আপ্রান চেষ্টা করলো সে।

“এই যে, ভাতিজা…তোমার আব্বার পিস্তল,” সোনালি রঙের পিস্তলটা তুলে ধরে বলল সামাদ। “আমি ওর কাছ থিকা শুইনাই বুঝবার পারছিলাম এইটা তোমার বাপের।”

রন্টুর দিকে খুনেদৃষ্টি নিয়ে তাকালো ছেলেটা। এখানকার এক কলেজের ছাত্ররাজনীতি করা এই ছেলে বাবার পথেই হাঁটছে। সে এখন শুটার সামাদের একজন নিময়মিত ক্রেতা।

“তাইলে আপনেই আমার বাবার লগে গাদ্দারিটা করছিলেন!”

রন্টু অবিশ্বাসে হাত নাড়িয়ে অস্বীকার করলো, তার মুখ দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না এখন।

“বাপের কাছে মেশিন থাকলে কুনো হালার সাহস হইতো না তারে গুলি করনের…আপনেই তার মেশিনটা সরাইছিলেন সজল খানকিরপোলার লগে হাত মিলাইয়া!”

দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে রন্টু বলল, “তুমি এর কথা বিশ্বাস কইরা ফালাইলা!?” অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে সামাদের দিকে ইঙ্গিত করলো রন্টু।

“হেরে বিশ্বাস না কইরা আপনেরে বিশ্বাস করুম আমি?! আমারে পাগলা কুত্তায় কামড়াইছেনি?”

গভীর করে দম নিয়ে নিলো রন্টু। তার মাথাটা কাজ করছে না আগের মতো। কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। “তাইলে হেরে বিশ্বাস কইরা তুমি বাপের দোস্তরে মারবার চাও!…আচ্ছা…মারো! মাগার তার আগে আমার দুইটা কথা হুনো,” অনেক চেষ্টা করছে চোখে পানি আনার কিন্তু আসছে না।

সহিদের ছেলের ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি।

“এই হালায় যে এত বড় গাদ্দারি করবো আমার লগে বুঝবার পারি নাই।”

শুটার সামাদ কিছু বলতে যাবে তার আগেই সহিদের ছেলে হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলো। “হে আপনের লগে কী গাদ্দারি করছে?”

“খালি আমার লগে করলে তো কথা আছিল না…হালারপো তোমার বাপের লগেও গাদ্দারি করছে।”

“তুই কী কইবার চাস!” গর্জে উঠল অস্ত্রব্যবসায়ী। সে বিশ্বাসই করতে পারছে না রন্টু এসব কী বলতে শুরু করেছে।

হাত তুলে তাকে বিরত করলো সহিদের ছেলে জিতু। “হে কেমতে বেঈমান হইলো?” তার চোখেমুখে সন্দেহ।

চেহারায় করুণ ভাব এনে, চোখদুটো ছলছল করে, যেখানে যতটুকু আবেগ আর নাটকীয়তা দেখানোর দরকার ততটুকুই দেখাতে দেখাতে রন্টু তার গল্পটা বলতে শুরু করলো :

সামাদের কাছে যে সহিদের সোনালি পিস্তলটা আছে সেটা বহু আগেই জানতো সে। অভাবে পড়ে, নেশার টাকা জোগাড় করার জন্য কিছুদিন আগে সামাদকে ভয় দেখিয়েছিল-সহিদের ছেলে এখন বড় হয়েছে, বাপের মতোই নামডাক করে ফেলেছে। সেই ছেলেকে সব বলে দিলে শুটার সামাদ ‘ফিনিশ’ হয়ে যাবে। এ কথা শুনে সামাদ সত্যি সত্যি ফিনিশ হবার ভয় পেয়ে তাকে কিছু টাকাও ধরিয়ে দেয়। সে ভালো করেই জানে, সহিদের ছেলে এসব জানতে পারলে তাকে আস্ত রাখবে না। গতকাল আবারও রন্টুর টাকার দরকার হলে সামাদকে ফোন করে, সামাদও তাকে মুখ বন্ধ রাখার জন্য কিছু টাকা দেবে বলে আজ আসতে বলে দেয়। এ কারণেই সে আজ এসেছে। কিন্তু সামাদ যে বিরাট বড় চাল দিয়ে উল্টো সহিদের ছেলেকে ম্যানেজ করে ফেলেছে সে-ব্যাপারে রন্টুর কেননা ধারণাই ছিল না। এতোক্ষণ সে যা বলল তা একদম সত্যি-এর চেয়ে বড় সত্যি দুনিয়াতে আছে কি না রন্টুর জানা নেই। এর একবিন্দুও মিথ্যে নয়।

রন্টু চেষ্টা করেও চোখে পানি আনতে পারেনি গল্পটা বলার সময়। আতঙ্কের সাথে সে দেখছে, তার কথা শুনে মিটি মিটি হাসছে সহিদের অল্পবয়সি ছেলেটা।

ওদিকে শুটার সামাদ দাঁত বের করে হাসছে আর মা-বাপ তুলে গালি দিয়ে যাচ্ছে তাকে। “খানকিরপোলায় কয় কী! কাহিনী তো ভালাই বানাইবার পারে।”

কিন্তু রন্টু এসব গায়ে না মেখে সহিদের ছেলের দিকে পূর্ণ মনোযোগ দিলো। “তুমিই কও ভাতিজা, আমি কি এইরহম একটা দামি জিনিস বিশবছর ধইরা রাখমু? আমারে পাগলে কামড়াইছে? আমার কোনো আয়রোজগার নাই, এরে ওরে ফাপড় দিয়া চলি…আমার কাছে এই পিস্তলটা থাকলে এইটা আমি ইউজ করতাম না?”

রন্টু দেখতে পেল সহিদের অল্পবয়সি ছেলেটার পিস্তল ধরা হাত উঠে আসছে তার কপাল বরাবর। “খানকির পোেলা…তুই আমারে এতিম করছো!” দাঁতে দাঁত পিষে বলল সে।

প্রমাদ গুণলো রন্টু। এই জীবনে প্রথমবারের মত তার গল্পটা কোনো রকম প্রভাব বিস্তার করতে পারলো না। নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে তার। ভয়ে চোখ বন্ধ হয়ে এলো। জোর করে চোখদুটো খোলার কথা ভাবলো না। তার বন্ধ চোখে অন্ধকারেও ভেসে উঠল আট বছরের অসুস্থ মেয়েটার মুখ। তারপরই টপ টপ করে দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল অবশেষে।

একেবারে সত্যিকারের অশ্রু!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *