২.০৯ সম্রাটের শবাধারের অনুগমনকারী

২.৯ সম্রাটের শবাধারের অনুগমনকারী

‘শাহ সুজা, আপনার তরবারি উঁচু রাখেন নতুবা আপনি কখনও একজন দক্ষ অসিবিদ হতে পারবেন না।’ বুরহানপুরের দূর্গ-প্রাসাদের বিশাল কামরাগুলোর একটায় খুররম তার এগার বছরের ছেলেকে হাত থেকে নিজের ভেতা অনুশীলনের অস্ত্র প্রবলভাবে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করতে দেখে হাসে। খুররম সহসা সর্তক হয়ে উঠে যে তার পেছনে কামরার ভেতরে অন্য কেউ প্রবেশ করেছে। সে দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়ে তাঁর কচিদের একজনকে প্রবেশ করতে দেখে।

 ‘যুবরাজ, আমায় মার্জনা করবেন, হতভম্ব তরুণ তোতলাতে তোতলাতে কোনোমতে বলে, কিন্তু এইমাত্র পাঁচজন অশ্বারোহীর একটা দল আস্কন্দিতবেগে অঘোষিতভাবে নিচের আঙ্গিনায় এসে উপস্থিত হয়েছে। তারা দাবি করেছে সম্রাটের অস্থায়ী শিবির থেকে যাত্রা করে গত বিশদিন তাঁরা নাগাড়ে ঘোড়া হাঁকিয়েছে, পথে খাওয়া, ঘুমান আর ঘোড়া বদলাতে সামান্য সময়ের জন্য কেবল যাত্রাবিরতি করেছে। তারা বলছে আসফ খানের কাছ থেকে তাঁরা অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটা চিঠি নিয়ে এসেছে যা আপনার কাছেই কেবল ব্যক্তিগতভাবে দেয়া যায়।

খুররম সাথে সাথে নিজের তরবারি নামিয়ে রাখে এবং, চিঠির সম্ভাব্য বিষয়বস্তু নিয়ে ইতিমধ্যেই তার মনে ঝড়ের বেগে ভাবনা বইতে শুরু করেছে, কামরা ত্যাগ করে এবং নিচের আঙিনার দিকে নেমে যাওয়া সিঁড়ির দুটো ধাপ একেকবারে টপকে নিচে নামতে শুরু করে। আওরঙ্গজেব বা দারা শুকোহর কি কিছু হয়েছে? মেহেরুন্নিসা কি জাহাঙ্গীরকে রাজি করিয়েছেন তাঁদের ভূগর্ভস্থ কোনো কারাপ্রকোষ্ঠে প্রেরণ করতে? নিশ্চয়ই না… কিন্তু যদি তাই হয় তাহলে আরজুমন্দকে তিনি সেকথা কীভাবে বলবেন? কিন্তু চিঠিতে সম্ভবত জাহাঙ্গীরের প্রধান পরামর্শদাতা হিসাবে মহবত খানের নিজেকে বহাল করার উদ্ভট গল্প সম্বন্ধে আরো গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলা হয়েছে। মহবত খানের আপোষমূলক কিন্তু অদ্ভুত চিঠিগুলো এবং দূরে থাকার আর শান্ত থাকার জন্য আসফ খানের বারংবার পরামর্শের কারণেই কেবল খুররম হস্তক্ষেপ করতে কোনো ধরনের বাহিনী গঠনের প্রয়াস থেকে বিরত থেকেছে, যদিও সে বালাঘাট থেকে তাঁর পরিবারসহ পশ্চিমে বুরহানপুরে চলে এসেছে উত্তরমুখী প্রধান পথগুলোর কাছাকাছি অবস্থানের অভিপ্রায়ে। সাম্প্রতিক সংবাদ হল মেহেরুন্নিসা পুনরায় নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন এবং মহবত খান দলবল নিয়ে পাহাড়ে পালিয়ে গিয়েছে। সেই সময়ে খুররমের কাছে মহবত খানের মত এমন নেতৃস্থানীয় একজন সেনাপতির লড়াইয়ের কোনো চেষ্টা না করাটা ব্যাপারটা অদ্ভুত মনে হয়েছে। তিনি সম্ভবত আরো বড় কোনো পরিকল্পনার অংশ হিসাবে আপাতত প্রস্থান করেছেন।

 দূর্গের মধ্যবর্তী প্রাঙ্গণে নেমে এসে প্রখর সূর্যালোকে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে খুররম সাথে সাথে ধূলিধূসরিত পাঁচজন অশ্বারোহীকে দেখতে পায়, প্রত্যেকেই তখনও একটা না বরং দুটো ঘোড়ার লাগাম ধরে রয়েছে। তাঁরা প্রত্যেকে নিশ্চয়ই তাঁদের প্রধান ঘোড়ার সাথে অতিরিক্ত একটা ঘোড়া রেখেছিল যাতে যখনই প্রয়োজন হবে ঘোড়া বদল করে তাঁরা অগ্রসর হবার গতি বৃদ্ধি করতে পারে। খুররমে চোখ আলোয় সয়ে আসতে সে অন্য চারজনের থেকে খানিকটা সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দীর্ঘদেহী তরুণকে চিনতে পারে, আসফ খানের সেরা সেনাপতি আর তাঁর অন্যতম সমর্থকের পুত্র হানিফ। হানিফের নিজে আসার অর্থ একটাই খবরটা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ।

খুররম কুশল বিনিময়ে সময় নষ্ট না করে সরাসরি দীর্ঘদেহী তরুণের দিকে এগিয়ে যায়। হানিফ, তুমি আমার জন্য একটা চিঠি নিয়ে এসেছে? হানিফ সাথে সাথে তার বুকের উপর আড়াআড়িভাবে ঝুলন্ত চামড়ার থলে থেকে আসফ খানের সিলমোহরযুক্ত একটা চিঠি বের করে খুররমের হাতে তুলে দিতে সে কোনো কথা না বলে সিল ভেঙে চিঠিটা খুলে।

মহামান্য সম্রাট, তোমার আব্বাজান ইন্তেকাল করেছেন। দূর্গের আঙ্গিনায় সে খালি মাথায় দাঁড়িয়ে থাকায় মধ্যাহ্নের সূর্যের খরতাপের চেয়েও অধিক উষ্ণতায় শব্দগুলো খুররমকে দগ্ধ করে। তার আব্বাজানের মৃত্যুর কঠিন সংবাদের সাথে আসফ খান এটাও নিশ্চিত করেছেন যে আওরঙ্গজেব আর দারা শুকোহ ভালো আছে, কিন্তু তাগিদও দিয়েছেন, পদক্ষেপ নেয়ার এখন সময় হয়েছে। অন্যেরা তাঁদের সুযোগ নেয়ার আগেই দ্রুত চলে এসো এবং তোমার যা প্রাপ্য সেটা গ্রহণ করো।

চিঠির বিষয়বস্তুর কারণে স্তম্ভিত, খুররম পাঁচজনকে দ্রুততার সাথে চিঠিটা বয়ে নিয়ে আসবার জন্য সংক্ষেপে ধন্যবাদ জানায় এবং তাদের বিশ্রাম নেয়ার অনুমতি দেয়। নিজের পরিচারকদের হাত নেড়ে দূরে থাকতে বলে চিঠিটা তার হাতে ধরা অবস্থায় সে রৌদ্রস্নাত প্রাঙ্গণে একাকী দাঁড়িয়ে থাকে, সেখানে যা লেখা রয়েছে সেটার অর্থ বুঝতে চেষ্টা করে এবং সেইসাথে যা উহ্য রয়েছে। তার আব্বাজান যার সাথে গত কয়েকবছর তার দেখা হয়নি তিনি মৃত। এতটুকু স্পষ্ট। কিন্তু কীভাবে এবং কেন? মেহেরুন্নিসা কি তাকে বিষ দিয়েছে? তাছাড়া, তিনি তাঁর ভাই আসফ খানের কাছে খোলাখুলি দম্ভোক্তি করেছেন টমাস রো’র খাবারে ক্রমাগতভাবে পচা মাংস মিশিয়ে তিনি তাকে দরবার থেকে তাড়িয়েছেন। কিন্তু তার আব্বাজানের মৃত্যু থেকে তিনি কীভাবে লাভবান হতে পারেন? সম্রাটকে তার ভালবাসার বন্ধনে আটকে রাখার জন্য মেহেরুন্নিসা তাকে আফিম আর সুরার যে মিশ্রণ দিতেন তাঁর মাত্রা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি করার মাধ্যমে জাহাঙ্গীরের মৃত্যুতে তার কোনো ভূমিকা যদি থাকেও সেটা সম্ভবত আপতিক।

 সে তার আব্বাজানের মৃত্যুর প্রকৃতি নিয়ে যখন ভাবতে থাকে তখন জাহাঙ্গীরের জীবনের বিভিন্ন দৃশ্য তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠে–তাঁদের বিচ্ছেদের বছরগুলোর নয় বরং তার যৌবনের, আকবর তাকে উটে চড়ার আর দাবা খেলার জটিল বিষয়ে নির্দেশ দেয়ার সময় তাঁর আব্বাজানের একপাশে আড়ষ্ট আর বিব্রতভাবে দাঁড়িয়ে থাকা; আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সমাপ্তির পরে তার সাথে নিজের সম্পর্ক পুনর্গঠনে জাহাঙ্গীরের বাধাগ্রস্থ প্রয়াস; আকবরের মৃত্যু আর খসরুর বিদ্রোহ এবং তারপরে সুন্দর বছরগুলো যখন আরজুমান্দকে সে প্রথম বিয়ে করেছিল এবং সে ছিল তাঁর আব্বাজানের অগ্রগণ্য সেনাপতি আর বিশ্বস্ত ব্যক্তি।

খুররম এইসব স্মৃতি স্মরণ করতে বুঝতে পারে যে তার আব্বাজান তাকে ভালোবাসতো এবং সে তাকে। তার চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠতে শুরু করে। তাঁর ভাবনায় মেহেরুন্নিসা ফিরে আসতে সে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মোছে। জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে তাঁর বিচ্ছেদের মূল কারণ এই রমণী। তিনি এখনও জীবিত এবং তার দুই সন্তান মেহেরুন্নিসার কজায় রয়েছে। সম্রাটের মৃত্যুর পরবর্তী তিন সপ্তাহে তিনি নিঃসন্দেহে তিনি নিজের এবং নিজের দুই বশংবদ, শাহরিয়ার আর লাডলির জন্য পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে পরিকল্পনা করেছেন। ঠাণ্ডা মাথা, বিচক্ষণ আর স্বার্থসিদ্ধিতে নিপূণা, তিনি নিশ্চয়ই খুব বেশি সময় শোক করেন নি এবং সেও সেটা করবে না। আসফ খান যেমন বিচক্ষণতার সাথে লিখেছেন, তাকে অবশ্যই অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে হবে কিন্তু তার আগে তাকে অবশ্যই আরজুমান্দকে খবরটা জানাতে হবে।

*

না। বহু বছরের ভিতরে এই প্রথমবার আমাদের অবশ্যই পরস্পর থেকে আলাদা হতে হবে, খুররম মুখাবয়বে একগুয়ে অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলা আরজুমান্দকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করে। তুমি কি দেখতে পাচ্ছো না, আমরা যখন আমার আব্বাজানের জন্য কোনো অভিযানে যেতাম বা তার সৈন্যদের হাত থেকে বাঁচতে পলায়ন করেছিলাম সেই সময়ের চেয়ে এখনকার বিষয়টা আলাদা? আমরা একটা বিষয় জানতাম যে আমরা যদি মারা যাই তাহলে আমাদের সন্তানদের যত্ন নেয়ার জন্য আমার আব্বাজান আর তোমার আব্বাজান রয়েছেন। আমরা যখন পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম তখন তারা আমাদের সাথে নিরাপদ ছিল। আমি এখন যখন আমাদের বাহিনী বিভক্ত করছি আর মিত্র সন্ধান করছি তখন এটাই ভালো যে তুমি এখানে তাঁদের সাথে অবস্থান করো। তুমি যদি এখানে থাকো এবং আমি যদি ব্যর্থ হই-আল্লাহ্ না করেন আমি ব্যর্থ হই–তারা তোমায় পাবে তাদের রক্ষা করার জন্য অন্যথায় তারা মেহেরুন্নিসার করুণার মুখাপেক্ষী অসহায় এতিমে পরিণত হবে।

আরজুমান্দের কঠোর অভিব্যক্তি খানিকটা নরম হয়। আমি আপনার যুক্তি বুঝতে পেরেছি এবং আমি সেটা মেনেও নিচ্ছি, কিন্তু আপনার অন্য পরিকল্পনাগুলো কি যুক্তিসঙ্গত? আপনি কেন আপনার সামান্য শক্তি বিভক্ত করছেন এবং এত অল্প সংখ্যক লোক নিয়ে উত্তরে যাচ্ছেন?

 ‘আমি ভেবেছিলাম আমি ব্যাপারটা খুলে বলেছি–কারণ আমি জানি না আর কে সিংহাসনের উপর দাবি জানাতে পারে এবং সেজন্য সবচেয়ে বড় হুমকি কোথা থেকে আসতে পারে। আমাকে বেশ কয়েকটা পদক্ষেপ একই সাথে নিতে হচ্ছে। আমাকে যতজন সম্ভব তোক দ্রুত সংগ্রহ করতে হবে। আর এটা করার জন্য সবচেয়ে ভালো পন্থা হল আমার সমর্থক আর বন্ধুদের কাছে আমার বিশ্বস্ত সেনাপতিদের অধীনে সৈন্যদল প্রেরণ করে সেখান থেকে লোকবল সংগ্রহ করা। তুমি জানো আমি ইতিমধ্যে মোহন সিংকে পাঠিয়েছি মহবত খানের অবস্থান সনাক্ত করতে। পার্সী এই সেনাপতি একজন বিচক্ষণ আর প্রয়োগবাদী লোক। তিনি জানেন যে আমার সাথে নিজেকে মৈত্রীর সম্বন্ধে আবদ্ধ করার মাঝেই তাঁর চোট খাওয়া সৌভাগ্য ফিরে পাবার সবচেয়ে ভালো সুযোগ রয়েছে। আমাকে সেই সাথে গুপ্তচর আর গুপ্তদূতদের শক্তিশালী দলও প্রেরণ করতে হবে। আমি কেবল তোমার আব্বাজানকেই–তিনি যদিও ভালো মানুষ আমাদের একমাত্র চোখ আর কানের ভূমিকা পালনকারীর দায়িত্ব দিতে পারি না। সবশেষে, ঘটনাপ্রবাহের দ্রুততম সুবিধা গ্রহণের নিমিত্তে, আমার মূল বাহিনীতে পর্যাপ্তসংখ্যক লোক সমবেত হবার পরেই কেবল অনুসরণ শুরু করতে পেছনে রেখে, আমাকে দ্রুত আর সবার অগোচরে আগ্রার উদ্দেশ্যে অগ্রসর হতে হবে।’

 ‘হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কীভাবে লোকচক্ষুর আড়ালে থাকবেন?

 ‘আমি এ বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেই নি। ছোট একটা বাহিনীকেও লুকিয়ে রাখা কঠিন এবং আমি নিশ্চিত মেহেরুন্নিসা ইতিমধ্যে গুপ্তচর প্রেরণ করেছে।’

‘তাহলে গোপন না করে ছদ্মবেশ ধারণ করছেন না কেন?

কীভাবে?

 বণিকের কাফেলা হিসাবে, হতে পারে?

 না। বর্তমানের এই উপদ্রুত সময়ে যেকোনো শত্রুই কাফেলা দেখলে অনুসন্ধান করবে, সেটা তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখবে আর সম্ভব হলে কাফেলা থেকে চুরি করবে। কিন্তু তুমি ঠিকই বলেছো। ছদ্মবেশ ধারণের প্রস্তাবটা ভালো। আমি কিছু একটা ভেবে বের করবো।’

*

‘এটা কার শবাধার? খুররম ষোলটা সাদা ষাড় দিয়ে টেনে নেয়া শবযানে কালো-রেশমের ব্রোকেড দিয়ে ঢাকা মখমলের আস্তরনযুক্ত রূপার শবাধারে মধ্যাহ্নের শ্বাসরুদ্ধকর উষ্ণতায় শুয়ে থাকার সময় একটা পুরুষ কণ্ঠকে জিজ্ঞেস করতে শুনে। বাম হাতের গাঁটে কয়েকদিনের পুরান মশার কামড় ভালো করে রগড়ে দেয়ার জন্য আর বাম পা সামান্য নাড়াতে, যা ইতিমধ্যে অসাড় হয়ে উঠতে আরম্ভ করেছে, তার ভীষণ ইচ্ছা করে কিন্তু সে ভালো করেই জানে তাঁর এমন কিছু করা উচিত হবে না যার ফলে শবাধারটা নড়ে উঠে ভেতরে অবস্থানকারীকে জীবিত বলে প্রতিপন্ন করবে। তার মুখে যদিও চন্দন সুবাসিত কাপড় জড়ানো রয়েছে এবং মুখকে অভেদ্য করা হয়েছে, পচনক্রিয়ার দুর্গন্ধকে বাস্তবসম্মত করতে দশদিনের পচা বাসী মাংসের যে টুকরোটা তার শবাধারে রাখা হয়েছে সেটা কোনোভাবেই ভুলে থাকা অসম্ভব। কামানের গোলা নিক্ষেপের ছিদ্রযুক্ত বিশাল রোটাগড় দূর্গ থেকে একদল অশ্বারোহীকে লাল ধূলোর একটা ঝড় সৃষ্টি করে এগিয়ে আসতে দেখার সাথে সাথে সে শবাধারের ভিতরে অবস্থান নিয়েছে। দূগটা একটা শৃঙ্গময় উদগ্রভূমিতে অবস্থিত যা আগ্রার উত্তরপশ্চিমে প্রসারিত সড়ক আর চারপাশের অনুর্বর ভূপ্রকৃতির উপর কর্তৃত্ব বিস্তার করে রয়েছে, এবং ওয়াসিম গুলের শক্ত ঘাঁটি, মেহেরুন্নিসার সবচেয়ে নেতৃস্থানীয় সমর্থক।

 আরজুমান্দ বস্তুতপক্ষে, সে নয়, তাঁর বাহিনীর জন্য ছদ্মবেশের প্রস্তাব হিসাবে দাক্ষিণাত্যে মৃত এক তথাকথিত সেনাপতির মৃতদেহ স্বভূমে সমাধিস্থ করার জন্য শবাধারের অনুগমনকারীর ধারণা বের করেছে, বলেছে যে এই সৈন্যসারিকে খুঁটিয়ে আবেক্ষণ করার সম্ভাবনা সবচেয়ে কম। আরজুমান্দই আবার পচা মাংসের পরিমার্জন প্রস্তাব করেছিল। সে, অবশ্য, অন্য আরেকটা ভাঁওতার পরিকল্পনা করেছে তার প্রপিতামহী হামিদা যেমন আকবরের পক্ষে সমর্থক সংগ্রহের সময় নিজের স্বামী হুমায়ুনের মৃত্যুর খবর ফাঁস হওয়া রোধ করতে হুমায়ুনের মত একই উচ্চতার আর গড়নের একটা লোককে হুমায়ুন সাজিয়ে ছিলেন, খুররম তেমনি তাঁর একজন বিশ্বস্ত সেনাপতিকে তাঁর পোষাক পরিধান করে বুরহানপুর দূর্গে তাঁর ব্যক্তিগত এলাকায় প্রবেশ আর প্রস্থান করা অবস্থায় দৃশ্যমান হতে বলেছে যাতে বিভ্রম সৃষ্টি হয় যে উত্তরের উদ্দেশ্যে সে এখনও রওয়ানা হয়নি।

শবানুগমনের এই কূটচাল এখন পর্যন্ত সাফল্যের সাথেই উতরে এসেছে। তাকে মাত্র দু’বার কেবল শবাধারের আড়াল ব্যবহার করতে হয়েছে, এবং উভয়ক্ষেত্রেই শবাধার বহনকারী দলটার গম্ভীর প্রকৃতি লক্ষ্য করা মাত্র এগিয়ে আসা দলটা দিক পরিবর্তন করেছিল। খুররম সহসা হাঁচির প্রচণ্ড একটা প্রণোদনা প্রাণপণে দমন করার চেষ্টা করতে গিয়ে ভাবে যে যদিও ওয়াসিম গুলের এই আধিকারিক মনে হচ্ছে ভিন্ন প্রকৃতির। সে শবাধারের ভেতর থেকে ইতিমধ্যেই তাকে কয়েকটা মালবাহী শকট পরীক্ষা করে দেখার জন্য নিজের লোকদের আদেশ দিতে শুনেছে। তার সাথের অতিরিক্ত গাদাবন্দুক আর বারুদ হয় পশুখাবারের অনেক গভীরে বা কয়েকটা শকটের গোপন তলদেশে লুকিয়ে রাখায় দারুণ বুদ্ধির পরিচয় দেয়া হয়েছে। তন্ন তন্ন করে তল্লাশি করলে অবশ্য সেগুলো খুঁজে পাওয়া সম্ভব এই ভাবনাটা তার মাথায় উঁকি দেয়া মাত্র তার হৃৎপিণ্ড আগের চেয়ে দ্রুত গতিতে স্পন্দিত হতে শুরু করে।

হাসান খানের–যুবরাজ খুররমের বাহিনীর একজন সেনাপতি আর মূলতানের সুবেদারের আত্মীয় সম্পর্কিত ভাই–শবদেহ যা আমরা তাঁর অনুগত সমর্থকেরা পেশোয়ারে তার জন্মস্থানে সমাধিস্থ করার জন্য ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। খুররম শুনতে পায় তার একজন লোক নবাগতদের প্রশ্নের উত্তর দেয়। “গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করার সময় নিজের তাবুতে ঘামে প্রায় গোসল করার মত অবস্থায় বলা তাঁর শেষ অর্থবহ কথার প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে আমরা তাঁর শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে যাচ্ছি। খুররম অনুসন্ধিৎসু আধিকারিককে আঁতকে উঠে শ্বাস নিতে শুনে। গুটিবসন্তের কথা উল্লেখ করাটা অনুপ্রাণিত অভিব্যক্তি। রোগটা এত মারাত্মক এবং এত দ্রুত ছড়ায় যে কেউ এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি বা মৃতদেহের কাছে কখনও অবস্থান করতে চাইবে না। সে কয়েক মুহূর্ত পরে ওয়াসিম গুলের আধিকারিকের কণ্ঠস্বর শুনতে পায়, ইতিমধ্যেই খানিকটা দূরে সরে গিয়েছে, বলছে, সে যদিও একজন বিশ্বাসঘাতককে সমর্থন করেছিল, তারপরেও তাঁর বেহেশত নসীব হোক। তোমরা যেতে পারো।

*

খুররম সন্তুষ্টির সাথে হাসে যখন দুই সপ্তাহ পরে আগ্রা থেকে পঞ্চাশ মাইল দক্ষিণপূর্বে নিজের টকটকে লাল নিয়ন্ত্রক তাবুতে যখন সে নিজের চারপাশে ক্রমশ বাড়তে থাকা পরামর্শদাতাদের দিকে তাকায়। ওয়াসিম গুলের ভূখণ্ড অতিক্রম করার প্রায় সাথে সাথে তাঁর ক্ষুদ্র সৈন্যবাহিনী যে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার শবানুগমনকারী একটা দল সেই ছদ্মবেশ সে পরিত্যাগ করে। তিন দিন আগে তার বাহিনীর বিশাল একটা বহর এসে যোগ দিয়েছে, যাদের সাথে বেশ কয়েকটা রণহস্তী রয়েছে, যারা বুরহানপুর থেকে কামরান ইকবালের নেতৃত্বে অনেকটা ঘোরা পথ অনুসরণ করে এসেছে ওঁত পেতে থাকা গুপ্তচর বা গুপ্তদূতদের বিভ্রান্ত করতে। অধিকিন্তু, সে যেসব এলাকা দিয়ে অতিক্রম করেছে সেসব এলাকায় মোতায়েন রাজকীয় বাহিনীর অনেক সেনাপতি, সেই সাথে বেশ কয়েকজন অনুগত স্থানীয় শাসক, তাঁর প্রতি বিশ্বস্ততার অঙ্গীকার করেছে এবং তার বাহিনীর সাথে নিজের লোকজন নিয়ে যোগ দিয়েছে। তার বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা এখন প্রায় পনের হাজারের কাছাকাছি এবং সবাই সুসজ্জিত আর পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে।

 ‘আমরা মেহেরুন্নিসা, লাডলি আর শাহরিয়ারের সাম্প্রতিক গতিবিধি সম্পর্কে কি জানি?’ সে জিজ্ঞেস করে।

 ‘আমাদের গুপ্তচরদের ভাষ্য অনুযায়ী, একমাস পূর্বে লাহোরে শাহরিয়ার নিজেকে সম্রাট হিসাবে ঘোষণা করার পর থেকে সে সেখানেই তাঁর স্ত্রী আর শ্বাশুড়ির সাথে অবস্থান করে মৈত্রীর খোঁজে কেবল দূত প্রেরণ করছে, কামরান ইকবাল জবাব দেয়।

 ‘আর মহবত খান?

‘মোহন সিংয়ের কাছ থেকে প্রাপ্ত সর্বশেষ বার্তা অনুসারে আপনার শ্বশুর আসফ খান আর তাঁর দলবলের সাথে যোগ দেয়ার জন্য সে মহবত খান আর তার বাহিনীর সাথে ভ্রমণ করছে। সে জোর দিয়ে বলেছে যে আসফ খানের নিজের আনুগত্যের ন্যায় মহবত খানের আনুগত্যের অঙ্গীকার নিয়ে সন্দেহের আর কোনো কারণ অবশিষ্ট নেই।’

 ‘ভালো কথা। মোহন সিং ভুল করে নি আমরা এখন সেটাই আশা করতে পারি আর সেই সাথে মহবত খানেরও রাজনীতি নিয়ে অনধিকার চর্চার কারণে যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে। মোগল সাম্রাজ্যে সে যদি নিজের অবস্থান পুনরুদ্ধারের আশা করলে আমিই তার সেরা ভরসা সে নিশ্চয়ই এটুকু বোঝার মত বিচক্ষণ। মেহেরুন্নিসার সাথে সে বিরোধ নিষ্পত্তির প্রত্যাশা করতে পারে না।’

‘মোহন সিং নিশ্চিত যে মহবত খান সহজাত ভাবেই অনুগত এবং তাঁর প্রতি মেহেরুন্নিসার উদ্ধত আচরণই তাকে এমন হটকারী করে তুলেছিল। ‘আসফ খানের সাথে সে যখন আমাদের সাথে যোগ দেবে তখন আমরা তাঁর প্রতি নজর রাখবো। কবে নাগাদ আমরা তাদের আশা করতে পারি? ‘তারা অগ্রসর হবার সময় তাদের আরো বেশি সংখ্যক লোক মোতায়েনের জন্য প্রয়োজনীয় সময়ের কথা বিবেচনা করে, সম্ভবত তিন কি চার সপ্তাহ। বিশেষ করে মহবত খান রাজস্থানে নিজের পুরাতন সহযোদ্ধাদের ডেকে পাঠাবার সাথে সাথে যোদ্ধাদের সেই আতুরঘর থেকে নতুন লোক নিয়োগের জন্য বার্তাবাহক প্রেরণ করেছে।’

 ‘বেশ, আমাদের সামনে এখন তাহলে কেবল খসরুই রয়েছে, তাই না? সিংহাসনের জন্য তাকে কি এখনও পদক্ষেপ গ্রহণে আগ্রহী মনে হয়?

হ্যাঁ। আমাদের তথ্য অনুযায়ী যদিও তাঁর চোখের পাতার সেলাই খুলে তাকে তার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিতে তাঁর হাকিমদের প্রচেষ্টা কেবল আংশিক সফল হয়েছে, স্পষ্টতই অন্যদের নিজের পক্ষে টানার ক্ষমতা তার এখনও নষ্ট হয়নি। গোয়ালিওরের সুবেদারকে সে দলে টেনেছে, যেখানে সে দীর্ঘদিন বন্দি অবস্থায় ছিল, এবং সেই সাথে স্থানীয় অনেক সেনাপতিও রয়েছে, এবং সে তৃতীয়বারের মত নিজেকে সম্রাট হিসাবে ঘোষণা করেছে।

‘আর সে তৃতীয়বারের মত ব্যর্থ হবে, খুররম বলে। খসরু নাছোড়বান্দার মতো এমন অসম্ভব উচ্চাশা কেন পোষণ করছে? সে যতটুকু নবায়িত দৃষ্টিশক্তি পেয়েছে সেটা এবং তাঁর বিশ্বস্ত স্ত্রী জানির ভালোবাসা, যে নিজে বহুবছর তার সাথেই বন্দিত্ব বরণ করেছিল, তৃপ্তি নিয়ে উপভোগ করছে না? খুররম ঠোঁট কামড়ে জিজ্ঞেস করার আগে, নিজের মনে ভাবে, আমার বিরোধিতা করার জন্য তাকে কেন অবশ্যই যুদ্ধযাত্রা করতে হবে, সে কতজন লোক নিয়োগ করতে সফল হয়েছে?

 দশ হাজার সম্ভবত–যাঁদের অনেকেই আপনার আব্বাজানের বিরুদ্ধে তাঁর পূর্ববর্তী বিদ্রোহের সময় যারা নিহত হয়েছিল তাদের পুত্র আর ভ্রাতা। তারা গোয়ালিওরের অস্ত্রশালা আর কোষাগার লুট করেছে এবং তাই তাদের অস্ত্র কিংবা রসদের কোনো সমস্যা নেই।’

 ‘তাঁরা কি এখনও আগ্রা অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছে?

 ‘হ্যাঁ। আমাদের গুপ্তদূতেরা জানিয়েছে তারা আমাদের অবস্থান থেকে প্রায় পঁচিশ মাইল পশ্চিমে এবং আগ্রা থেকে চল্লিশ মাইল দূরে অবস্থান করছে।

 ‘শাহরিয়ার লাহোর ত্যাগের জন্য কোনো ধরনের উদ্যোগ না নেয়ায় এবং সেখানে তাঁর মোকাবেলা করার পূর্বে মহবত খান আর আসফ খান এবং তাঁদের সাথে আসা অতিরিক্ত বাহিনীর জন্য আমরা অপেক্ষা করলে আমরা বিচক্ষণতার পরিচয় দেব, আমার পরামর্শ হল যে আমরা প্রথমে খসরুর উচ্চাশা চিরতরে মিটিয়ে দেবো। আমরা আমাদের বেশিরভাগ মালবাহী শকট যদি এখানে রেখে যাই, আমরা তাহলে কি তাঁর সামনে যেতে এবং সে আগ্রা পৌঁছাবার আগে তাকে যুদ্ধে করতে বাধ্য করতে পারবো?

 ‘হা। গুপ্তদূতদের ভাষ্য অনুসারে সে সম্ভবত আগ্রা পৌঁছাবার আগে যতবেশী সম্ভব সমর্থক জড়ো করার আশায় দিনে আট মাইলের বেশি দূরত্ব অতিক্রম করে না। তার বাহিনী থেকে আমাদের পৃথক করে রেখেছে যে প্রান্তরটা সেটা মূলত সমভূমি যেখানে কোনো উল্লেখযোগ্য নদী নেই, অশ্বারোহী তবকি আর তীরন্দাজ আর অশ্বারোহী যোদ্ধার সাথে আমরা যদি রণহস্তীও সাথে নেই তাহলেও আটচল্লিশ ঘন্টার ভিতরে আমরা তাকে পিছু ধাওয়া করে ধরে ফেলতে পারবো।’

 ‘বেশ তাহলে, আমরা এটাই করবো। আপনি এখানে মালবাহী শকট আর ভারি কামানগুলো পাহারা দেয়ার জন্য পর্যাপ্ত সৈন্য রেখে যাবার বিষয়টা নিশ্চিত করবেন এবং অবিলম্বে প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান করেন।

*

খুররম তার ভবিষ্যত নির্ধারণ করবে যে যুদ্ধ সেটা শুরু করার জন্য ব্যগ্র হয়ে তার বাহিনীর মূল সৈন্যসারি ছেড়ে নিজের কয়েকজন দেহরক্ষী সাথে নিয়ে সামনে এগিয়ে যায় যখন দুইদিন পরে মধ্যাহ্নের ঠিক আগ মুহূর্তে ঘামে ভেজা ধুসর রঙের একটা ঘোড়া নিয়ে তার গুপ্তদূতদের একজন আস্কন্দিত বেগে তার দিকে এগিয়ে আসে।

 ‘খসরুর লোকেরা সামনে অবস্থিত একটা গ্রামের চারপাশে নিজেদের জড়ো করছে। আমরা যা ভেবেছিলাম তারা সংখ্যায় তার চেয়েও বেশি–সম্ভবত বার হাজার বা সেরকম কিছু একটা। তারা যখন আমাদের অগ্রসর হবার বিষয়টা টের পায় তারা স্পষ্টতই সিদ্ধান্ত নেয় গ্রামের খোয়ারের চারপাশের বৃত্তাকার নিচু মাটির দেয়াল এবং এমনকি গ্রামের মামুলি খেজুর-পাতার পর্ণকুটির যতটুকু সুরক্ষা দিতে সক্ষম তার সুবিধা গ্রহণ করবে। তারা কামানগুলো সুবিধাজনক স্থানে টেনে নিয়ে যেতে ব্যস্ত এবং গ্রাম থেকে কয়েকশ গজ সামনে তারা তীরন্দাজ আর তবকিদের ছোট একটা আড়াল স্থাপন করেছে।

খুররম গুপ্তদূতের প্রসারিত হাতের দিক অনুসরণ করে দাবদাহের অস্পষ্টতার মাঝে দেখে যে একটা ছোট নহরের দূরবর্তী তীর বরাবর সমতল ভূমির উপর অবস্থিত গ্রামটা ছোট আকৃতির যা বর্তমান শুকনো মওসুমে মূলত মাটির তৈরি বলে মনে হয়। লোকবলের দিক থেকে খসরুর সামান্য প্রাধান্য রয়েছে কারণ মালবাহী শকট পাহারা দেয়ার জন্য সে তার বাহিনীর উল্লেখযোগ্য একটা অংশ পেছনে রেখে এসেছে। তাঁর লোকেরা যদিও খসরুকে অতিক্রম করার যাত্রার কারণে ক্লান্ত এবং দিনটা চুল্লীর মত উত্তপ্ত, খুররম যুদ্ধের পরামর্শের জন্য বয়োজ্যেষ্ঠ সেনাপতিরা এসে তাঁর সাথে মিলিত হবার জন্য অপেক্ষা না করে খসরুর বাহিনী নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ নির্মাণ সমাপ্ত করার আগেই তাদের আক্রমণ আর বিধ্বস্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়।

‘অবিলম্বে আক্রমণ করার জন্য আমাদের অর্ধেক অশ্বারোহীদের বিন্যস্ত করার আদেশ কামরান ইকবালের কাছে পৌঁছে দাও। সে যখন সামনে থেকে গ্রামটা আক্রমণ করবে আমি আমাদের অবশিষ্ট অশ্বারোহীদের নিয়ে ছোট নহরটা অতিক্রম করবো গ্রামের পেছনে পৌঁছাতে এবং গ্রামের প্রতিরক্ষায় যারা নিয়োজিত তাঁদের পেছন থেকে আক্রমণ করবো। রণহস্তীদের তাদের হাওদায় অবস্থিত ছোট কামান নিয়ে অশ্বারোহীদের যুদ্ধক্ষেত্রে যতটা কাছ থেকে অনুসরণ করা সম্ভব করতে আদেশ দাও।’

সোয়া এক ঘন্টা বা তারও পরে, খুররম দেখে তাঁর অশ্বারোহীরা, উঁচু কালো স্ট্যালিয়নে উপবিষ্ট স্থূলকায় কামরান ইকবালের নেতৃত্বে, তার ঠিক পেছনেই চারজন নিশানবাহক রয়েছে, গ্রাম অভিমুখে তাঁদের হামলার গতি বৃদ্ধি করছে। ধূলোয় খুররমের দৃষ্টি অস্পষ্ট হতে শুরু করতে সে নিজে এবার তাঁর প্রিয় খয়েরী রঙের একটা ঘোড়ায় উপবিষ্ট হয়ে তাঁর দু’হাজার সেরা অশ্বারোহীকে নেতৃত্ব দিয়ে দ্রুতবেগে বামদিকে ঘুরে গিয়ে গ্রামটা বৃত্তাকারে বেষ্টন করতে শুরু করে। ছোট কামানের চাপা শব্দ আর গাদাবন্দুকের ক্রমাগত পটপট শব্দ শীঘ্রই বোঝায় সে খসরু তার বাহিনীকে কামরান ইকবালের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ করেছে। ধূলো আর ধোয়ার কুণ্ডলীর মাঝে বিদ্যমান শূন্যস্থানের ভিতর দিয়ে খুররম দেখতে পায় যে তার সৎ-ভাইয়ের তোপচিরা নিশানাভেদে দারুণ পারদর্শী। কামরান ইকবালের সাথের লোকদের বেশ কয়েকজনের ঘোড়া ধরাশায়ী হয়েছে। বাকিগুলো আরোহীবিহীন অবস্থায় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দূরে সরে যাচ্ছে তাঁদের লাগামগুলো ঝুলছে। খুররমের সহসা নিশানাবাহকদের একজনকে মনে হয় ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিতে চেষ্টা করছে; আক্রমণের মূল চালিকা শক্তি কেমন যেন খাপছাড়া প্রতিয়মান হতে শুরু করে। তারপরেই কুণ্ডলীকৃত ধোঁয়ার মেঘে তাঁর দৃষ্টি পুরোপুরি আচ্ছন্ন হয়ে যায়।

 খুররম সহসা সন্দেহের শরবিদ্ধ হবার যাতনা অনুভব করে। সে কি অতিরিক্ত আগ্রহ প্রদর্শন করে ফেলেছে, হয়তো হঠকারীতা হয়েছে শক্তিশালী বাহিনীর বিরুদ্ধে অবিলম্বে আক্রমণের নির্দেশ দিয়ে যখন সে তার ক্লান্ত লোকদের বিশ্রাম আর অপেক্ষা করার সুযোগ দিলে বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়া হতো? সে কি নিজের বাহিনীকে দুইবার বিভক্ত করে ভুল করেছে, প্রথমে মালবাহী শকটের বহরকে পাহারা দেয়ার জন্য শক্তিশালী একটা বাহিনী পেছনে রেখে এবং দ্বিতীয়বার দ্বিমুখী সাঁড়াশি আক্রমণের আদেশ দিয়ে? এসব চিন্তা করার জন্য এখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। সে এখন পশ্চাদপসারণ কিংবা পৃথক হবার চেষ্টা করলে আরো বেশি ভুল করবে। তার লোকেরা তাহলে খসরুর বাহিনী পাল্টা আক্রমণের মুখে পড়বে। সে রক্ষণাত্মক কৌশল গ্রহণ করেছে। তাকে অবশ্যই বৃত্তাকারে ঘুরে এসে আক্রমণের সাফল্যের উপরে তার ভবিষ্যতকে ঝুঁকির সম্মুখীন করতে হবে। খসরুর লোকেরা যদিও প্রাণপণে লড়াই করছে এবং সামনের আক্রমণকারীদের মাঝে ব্যাপক হতাহতের জন্ম দিয়েছে, তাঁরা পেছন থেকে তার আক্রমণের সামনে অবশ্যই নিজেদের পশ্চাদপসারণের পথ বন্ধ হয়ে যাবার ভয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়বে। আর তাছাড়া, কামরান ইকবাল আর তার সাথের সৈন্যরা সাহসী আর অভিযোদ্ধা যোদ্ধা। তার যদি সাময়িক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েও থাকে তারা দমে না গিয়ে বরং নতুন উদ্যমে আবার আক্রমণ করবে।

 খুররম ইতিমধ্যে নহরের প্রান্তদেশের দিকে এগিয়ে চলেছে। অনেক বন্যপ্রাণীর পায়ের চিহ্ন দ্বারা ক্ষতবিক্ষত, নহরে পানির চেয়ে আঠালো খয়েরী কাদাই বেশি, সে ভাবতে ভাবতে হাতের ইশারায় নিজের লোকদের নহর অতিক্রমের ইঙ্গিত দিয়ে নিজের খয়েরী ঘোড়াটাকে সামনের দিকে অগ্রসর হবার জন্য তাড়া দেয়। সে অচিরেই অপর পাড় ধরে সামনে এগিয়ে যেতে থাকে, পেছনে তার দেহরক্ষী আর বাকি যোদ্ধারা তাকে অনুসরণ করছে। সে অবশ্য ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখে যে বেশ কয়েকটা ঘোড়া কাদায় পড়ে রয়েছে, সম্ভবত তাদের খুর গভীর আঠালো কাদায় আটকে গিয়েছিল যখন তাঁদের অসতর্ক আরোহীরা তাদের অনর্থক চাবুকপেটা করেছিল।

সে মাথা ঘুরিয়ে পুনরায় সামনের দিকে তাকিয়ে অনুধাবন করে যে গ্রামের গরুর গোয়ালের নিচু বেষ্টনী আর মাত্র দুইশ গজ দূরে রয়েছে। দেয়ালের পিছনে লুকিয়ে থাকা তবকীরা উঠে দাঁড়িয়ে গুলি বর্ষণ করতে সে সহসা আগুনের ঝলক দেখতে পায়। গাদাবন্দুকের সীসার গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে শিস তুলে তাঁর পাশ দিয়ে চলে যায়। তার আরেকজন অশ্বারোহী, কমলা রঙের পাগড়ি পরিহিত বিশাল দাড়ির অধিকারী এক রাজপুত যোদ্ধার কপালের ঠিক মাঝে একটা গুলি এসে বিদ্ধ হয়ে তাকে ঘোড়া থেকে ছিটকে পেছনের দিকে ফেলে দিলে লোকটা পেছন থেকে আগত ঘোড়ার খুরের নিচে দলিত হবার আগে ধূলোর ভিতরে বেশ কয়েকবার গড়িয়ে যায়। আগুনের ঝলক দেখে খুররম ভাবে দেয়ালের পিছনে কমপক্ষে পঞ্চাশজন তবকি লুকিয়ে আছে। কিন্তু তারপরেও, সে আর তার লোকেরা যদি জোরে ঘোড়া ছোটায় তাহলে তাঁরা দ্বিতীয়বার গুলি করার জন্য প্রস্তুত হবার আগেই তারা তাদের কাছে পৌঁছে যেতে পারবে। কিন্তু তারপরেই তাকে হতাশ করে তীরন্দাজের দল এবার দেয়ালের আড়াল থেকে বের হয়ে আসে এবং দ্রুত তীর নিক্ষেপ করেই আবার দেয়ালের আড়ালে নিজেদের লুকিয়ে ফেলে। একটা তীর যেন সময়কে স্তব্ধ করে দিয়ে প্রায় তাকে লক্ষ্য করেই ছুটে আসছিল। সে নিজের খয়েরী ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরার আগেই তীরটা এসে ঘোড়ার মাথার ছোট ইস্পাতের বর্মে আঘাত করে এবং পিছলে যায়। তীরের ধাক্কা আর আঘাতের কারণে সৃষ্ট অভ্যাঘাত ঘোড়ার অগ্রসর হবার গতিকে ব্যাহত করে এবং জন্তুটা একপাশে পিছলে যেতে শুরু করতে খুররম প্রাণপণে ঘোড়ার উপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাবার চেষ্টা করতে থাকে এবং গায়ের জোর দিয়ে লাগাম টেনে ধরে আর ঘোড়ার গলার কাছে নুয়ে এসে সে প্রায় ভেঙে পড়া মাটির দেয়াল লাফিয়ে টপকে যেতে সক্ষম হয়, যা সেখানে চারফিটের বেশি উঁচু হবে না। তার বেশির ভাগ লোকই সাফল্যের সাথে দেয়াল টপকে যায় কিন্তু তাদের ভিতরে অন্তত দু’জনের বাহনের সামনের পা দেয়ালের পিছনে রাখা গোবরের স্তূপের উপরে গিয়ে পড়তে সামনের পা ঘোড়ার দেহের নিচ থেকে পিছলে গিয়ে তাঁদের উদরের নিচের অংশ মাটির দেয়ালে আটকে যায় এবং পিঠের আরোহীরা তাঁদের মাথার উপর দিয়ে সামনের দিকে নিক্ষিপ্ত হয়ে সজোরে মাটিতে আঁছড়ে পড়ে।

খুররম কালো রঙের আঁটসাট জ্যাকেট পরিহিত একজন আক্রমণকারীর উদ্দেশ্যে প্রচণ্ড জোরে তরবারি চালায় যে নিজের বিশাল দুই ছিলাবিশিষ্ট ধনুক দিয়ে আবারও তীর নিক্ষেপের প্রস্তুতি গ্রহণ করছিল। লোকটা সেরকম কিছু করার আগেই তরবারির ধারালো ফলা তার বুকের উপরে আড়াআড়ি আঘাত করে এবং নোকটা ধনুক ছেড়ে দিয়ে পেছনের দিকে উল্টে পড়ে যায়। খুররমের চারপাশে তার বেশ কয়েকজন লোক পর্যাণ থেকে আহত কিংবা নিহত অবস্থায় ছিটকে পড়ে। খুররম কানের ভিতরে যুদ্ধের দামামা ঝড় তুলতে শুরু করতে সে নিজের দু’জন দেহরক্ষীকে নিয়ে সরাসরি গ্রামের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করে এবং পথে একটা নিচু চালাঘর পাশ কাটিয়ে যায়। চালা ঘরের ভেতর থেকে একটা ছাগল দৌড়ে বের হয়ে এসে তাঁর দেহরক্ষীদের একজনের ঘোড়ার সামনের পায়ের নিচে এসে পড়ে। ঘোড়াটা ছাগলের উপর হোঁচট খায় এবং তার আরোহী একপাশে কাত হয়ে তালগাছের পাতার উপরে পড়ে যা দিয়ে চালা ঘরের ছাদ তৈরি করা হয়েছে। তার দেহের ভারে ছাদটা দেবে গিয়ে সে তাঁদের দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে যায়।

খুররম আর অবশিষ্ট দেহরক্ষীর ঘোড়াগুলো বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং ফলে আরো একবার তাঁদের অগ্রসর হবার গতি হ্রাস পায়। খুররম অবশ্য প্রায় সাথে সাথেই নিজের খয়েরী ঘোড়াটাকে গতিশীল করে এবং শীঘই গ্রামের একমাত্র সরু প্রধান সড়কে পৌঁছে যায়। তাঁর দৃষ্টি একমুহূর্তের জন্য সাদা রঙ করা একটা মন্দিরে আটকে যায় যেখানে লাল রঙ করা হিন্দুদের বহুভূজা দেবী কালির প্রতিকৃতি রয়েছে, দেবীর গলায় কমলা রঙের ফুলের একটা মালা। কিন্তু তারপরেই সড়কের শেষপ্রান্তে–বিশাল একটা বটবৃক্ষের পাতা আর ডালপালার কারণে সৃষ্ট ছায়ার আড়ালে আংশিকভাবে ঢাকা পড়া অবস্থায় খুররম একটা কামান দেখতে পায় একটা লোক বারুদের গর্তে এখনই আগুন দেবে। তাঁর পক্ষে যত জোরে লাগাম টেনে ধরা সম্ভব ধরে খুররম সড়কের পাশে দুটো ছোট বাসার মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থানে তার খয়েরী ঘোড়াটাকে মোচড় দিয়ে প্রবেশ করলে, বেশ কয়েকটা হাড় জিরজিরে মুরগীর ময়লা খুটে খাওয়া বাধাপ্রাপ্ত হয়, যারা পাখা ঝাঁপটে আর্তস্বরে প্রতিবাদ জানায়।

সে প্রায় সাথে সাথে কামানটা থেকে গোলাবর্ষণের আওয়াজ পায় এবং সাদা ধোঁয়ার কুণ্ডলী বাড়ির উপরে ভেসে উঠতে দেখে, এর পরেই একটা ভোতা শব্দ আর আর্তনাদ ভেসে আসে। তার একজন অশ্বারোহী আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে। তার ঠিক পেছনে অবস্থানরত দেহরক্ষী না–সেও তার সাথেই বাড়ির মাঝে ঢুকে পড়তে পেরেছে। খুররম এখন কামানের তোপচিদের বিস্মিত আর আক্রমণ করার অভিপ্রায়ে যাতে তারা পুনরায় কামান দিয়ে গোলা বর্ষণ করতে না পারে সে আর তাঁর দেহরক্ষী তাদের বাহন নিয়ে দ্রুত গতিতে কয়েকটা কাঁটাঝোঁপের ভিতর দিয়ে যা গৃহপালিত পশুর খোয়ারের দেয়াল হিসাবে কাজ করে এগিয়ে যায় এবং বাড়ির পিছনের উঠোনে থাকা দড়ির চারপায়া আর মাটির রান্নার বাসনপত্রের ভিতর দিয়ে তাঁরা এঁকেবেকে রাস্তা করে নেয় যেখান থেকে সেখানের বাসিন্দারা বহু আগেই পালিয়ে গিয়েছে।

সড়কের শেষ বাড়ির পেছনের কোণায় পৌঁছে এবং সেটাকে পাশ কাটিয়ে খুররম তাঁর ঘোড়া নিয়ে ঘুরতে সে বটবৃক্ষের ছায়ায় অবস্থিত কামানটা আর মাত্র কয়েক গজ দূরে রয়েছে দেখতে পায়। কামানের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা তোপচিদের উর্ধ্বাঙ্গ নিরাভরণ এবং মধ্যাহ্নে প্রচণ্ড দাবদাহে তারা ঘর্মাক্ত অবস্থায় কামানের নলে বারুদ আর গোলা প্রবেশ করাবার জন্য সাহসিকতার সাথে চেষ্টা করছে যখন তিন কি চারজন তবকী বটবৃক্ষের চওড়া কাণ্ডের সুরক্ষার পেছনে অবস্থান করে প্রধান সড়ক দিয়ে অগ্রসরমান তাঁর লোকদের উদ্দেশ্যে গুলিবর্ষণ করছে তোপচিরা কামানে গোলা ভরার সময় তাঁদের দূরে সরিয়ে রাখতে। কোনো কিছু চিন্তা না করে এবং হাত আর হাঁটু দিয়ে খয়েরী ঘোড়াকে সামনে যাবার জন্য তাড়া দিয়ে খুররম কামানটা লক্ষ্য করে ছুটে যায়, তার সাথের একমাত্র দেহরক্ষী তাকে অনুসরণ করে। তাদের এগিয়ে আসতে দেখে তিনজন তোপচির ভিতরে দুইজন ঘুরে দাঁড়িয়ে দৌড়ে পালাতে শুরু করলে তাঁর দেহরক্ষীর বর্শার অগ্রভাগ অনায়াসে তাঁদের পরপর বিদ্ধ করে। তৃতীয় তোপচি সাহসিকতার সাথে দাঁড়িয়ে নিজের হাতের ইস্পাতের লম্বা শলাকাটা দিয়ে খুররমকে ঘোড়ার উপর থেকে ফেলে দিতে চেষ্টা করে। লোকটার অনভ্যস্ত আঘাত লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় আর খুররম নিজের তরবারি বের করে তার নগ্ন কাঁধে প্রাণপণে আঘাত করে। তরবারির ফলা মাংসপেশী আর তন্তু ভেদ করে গভীরে প্রবেশ করে লোকটা কামানের নলের উপরে লুটিয়ে পড়তে রক্ত তাঁর ক্ষতস্থান থেকে নির্গত হয়ে চারপাশ ভিজিয়ে দিতে শুরু করে।

 ইত্যবসরে, একজন তবকি তাঁর গাদাবন্দুকের নল ঘুরিয়ে নিয়ে খুররমকে নিশানা করতে চায় কিন্তু বন্দুকের নলটা লম্বা–প্রায় ছয়ফিট–আর লোকটা উত্তেজিত। গুলি করার সময় বন্দুকটা তাঁর হাতে কাঁপতে থাকায় সীসার গুলিটা খুররম এবং তার পেছনের দেহরক্ষী দুজনকেই আঘাত করতে ব্যর্থ হয়ে তাঁদের মাথার উপর দিয়ে শিস তুলে নির্দোষভঙ্গিতে উড়ে যায়। খুররম তবকির মাথায় এত জোরে তরবারি দিয়ে আঘাত করে যে খুলির সাথে অভিঘাতের ফলে আরেকটু হলেই তরবারিটা তার হাত থেকে পড়ে যেত এবং লোকটার খুলি পাকা তরমুজের মত ফাঁক হয়ে গিয়ে, রক্ত আর মগজ ধূলোয় ছিটকে পড়ে।

 খুররম সহসা টের পায় যে খসরুর কিছু যোদ্ধা পালাতে শুরু করেছে, তাকে অনুসরণ করে গ্রামের ভিতরে প্রবেশ করা তার লোকেরা তাঁদের একেবারে কাছে অবস্থান করে পিছু ধাওয়া করছে। সে দম ফিরে পাবার মাঝেই কামরান ইকবালের লোকেরা শক্ত অবস্থানের সামনে যেখানে আক্রমণ করেছিল সেখান থেকে ভেসে আসা প্রচণ্ড লড়াইয়ের আওয়াজ শুনতে পায়। তার চোখ চারপাশে ঘুরতে থাকা ঝাঁঝাল থোয়ায় জ্বালা করতে থাকে। কয়েকটা বাড়ির তালপাতার ছাদে কামান কিংবা গাদাবন্দুকের স্ফুলিঙ্গের কারণেই নিশ্চয়ই আগুন ধরে গিয়েছে। আর এখন প্রবল বাতাসের ঝাপটা জ্বলন্ত পাতার টুকরো এক ছাদ থেকে অন্য ছাদে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে। পুরো গ্রামটা অচিরেই দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করবে।

‘খসরুর সৈন্যদের এবার পেছন থেকে আক্রমণ করা যাক- খুররম তাঁর চারপাশে সমবেত হতে শুরু করা লোকদের উদ্দেশ্যে বলে কিন্তু সে আর কিছু বলার আগেই যুদ্ধস্থলের দিক থেকে গ্রামের প্রধান সড়কের মাঝামাঝি বরাবর একটা ছোট গলি থেকে একদল অশ্বারোহী ছিটকে বের হয়ে আসে। খুররমের অশ্বারোহী যোদ্ধাদের দেখতে পেয়ে দলটার নেতা সরাসরি তাদের দিকে তরবারি উঁচু করে ধেয়ে আসে। শত্রুর দলটা তাঁদের দিকে ধেয়ে আসার মাঝেই খুররম ধোয়ার মাঝেই লক্ষ্য করে দলটার মাঝে একজন অশ্বারোহী রয়েছে যার ঘোড়ার দ্বিতীয় আরেকপ্রস্থ লাগাম রয়েছে। যা সামনে অবস্থিত একজন অশ্বারোহী ধরে রেখেছে। তাঁর আংশিক দৃষ্টিশক্তি সৎ-ভাই ছাড়া লোকটা আর কেউ হতে পারে না।

খুররম প্রধান লাগাম ধরে থাকা অশ্বারোহীর দিকে এগিয়ে যাবার জন্য তাঁর খয়েরী ঘোড়াটার পাঁজরে গুঁতো দেয়। লোকটা নিজের খালি হাতে ধরে থাকা তরবারি উঁচু করে এবং খুররমের প্রথম আঘাতটা ফিরিয়ে দেয় কিন্তু দ্বিতীয় আঘাতটা এড়িয়ে যেতে পারে না যা তাঁর কব্জির ঠিক উপর থেকে তার হাত প্রায় দ্বিখণ্ডিত করে ফেলে। ক্ষতস্থান থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে শুরু করলে সে তার হাতে ধরা লাগাম ফেলে দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যেতে শুরু করে। খুররম সহজাত প্রবৃত্তির বশে দ্রুত নিচু হয়ে লাগামটা মাটিতে পড়ার আগেই ধরে ফেলে।

 যুদ্ধক্ষেত্র থেকে খসরুর ঘোড়াটাকে–ধুসর রঙের একটা মাদি ঘোড়া–হেঁচকা টানে সরিয়ে নিয়ে আসার মাঝেই খুররম চিৎকার করে বলে, ‘আমি, খুররম। খুসরু তুমি এবার আত্মসমর্পণ করো। আমি তোমায় বন্দি করেছি। তার সৎ-ভাই কোনো কথা বলে না। তোমার জন্য কি অনেক লোক মারা যায় নি, কেবল এখন না তোমার অন্যান্য বিদ্রোহ প্রচেষ্টার সময়? কথা বলো, খুররম আবার চিৎকার করে বলে, যদি কোনো কারণে যুদ্ধের হট্টগোলের আর আগুনে জ্বলতে থাকা ছাদের পটপট শব্দের মাঝে তার আগের কথাগুলো চাপা পড়ে গিয়ে থাকে সেজন্য এবার আগের চেয়ে জোরে। খুসরুর মুখাবয়ব প্রায় আবেগহীন দেখায়। কেবল তাঁর একটা মাত্র চোখই মনে হয় কিছুটা ভাব ফুটে রয়েছে। আপাতভাবে দৃষ্টিহীন বাকি চোখটায় ফাঁকা দৃষ্টি। তালপাতার ছাদ থেকে একটা জ্বলন্ত পাতা বাতাসে উড়ে তার পাশে আসতে তার ঘোড়াটা ঝাঁকি দিয়ে নিজের মাথা সরিয়ে নিতে, খসরু কথা বলে।

 ‘আমি আত্মসমর্পণ করছি।’

*

‘আমি মধ্য এশিয়ার তৃণভূমি থেকে আগত আমার পূর্বপুরুষদের প্রাচীন রীতি অনুসারে জীবনযাপণ করেছিঃ “সিংহাসন কিংবা শবাধার”। আমি এবার তৃতীয়বারের মত সিংহাসন দখলের চেষ্টা করেছি এবং ব্যর্থ হয়েছি। আমি দু’বার শবাধারের নিয়তি এড়িয়ে যেতে পেরেছি কিন্তু আমার সাহসী সহযোদ্ধারা যা পারে নি। আমি দ্বিতীয় প্রয়াসের পরে নিজের দৃষ্টিশক্তি বিসর্জন দিয়েছিলাম। আমার স্ত্রী জানির ভালোবাসা না পেলে আমি হতাশার মাঝে পথভ্রষ্ট হতাম। আমি এখন মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। আমায় কেবল তাকে শেষবারের মত একটা চিঠি লেখার অনুমতি দাও।’

খুররমের সামনে, মাত্র বিশ মিনিট পরে, খসরু দাঁড়িয়ে থেকে দু’পাশ থেকে দু’জন প্রহরী আলতো করে তার হাত ধরে রেখেছে, সে একঘেয়ে সুরে কথা বলতে থাকে। তার সৈন্যরা তাঁর আত্মসমর্পণের আদেশ পালন করেছে এবং এখনও তাদের খোঁজা হচ্ছে আর তাঁদের পরিত্যক্ত অস্ত্রের স্তূপ জমে উঠেছে। খুররম যখন–তার মুখে এখনও ধোয়ার কালি লেগে রয়েছে এবং পরনের কাপড় আর দেহ এখনও যুদ্ধের ঘামে সিক্ত–তাঁর সৎ-ভাইয়ের দিকে তাকায় তাঁর কাছে এটা মনে হয় যে খসরু ইচ্ছাশক্তির চূড়ান্ত প্রয়োগ করে নিজেকে তার চারপাশে ঘটমান সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছে, হাল ছেড়ে দিয়ে নিয়তি তার ভাগ্যে যা রেখেছে সেটা বরণ করার জন্য সে প্রস্তুত।

এই মুহূর্তে, খসরুর মত না, সে কোনোভাবেই এতটা নিস্পৃহ থাকতে পারে না। নিজের বিজয়ে উল্লসিত এবং সিংহাসনের জন্য তার আকাঙ্খা পূরণে এটা যা কিছু অর্থ বহন করে সব কিছুর সাথে তাঁর এত বিপুল সংখ্যক লোকের নিহত হবার দুঃখ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। আহতদের ভিতরে কামরান ইকবালও রয়েছেন। গ্রামে তাঁদের সামনাসামনি হামলার প্রথম বিপর্যয়ের মুখে তিনি খুররমের লোকদের নতুনভাবে উজ্জীবিত করার সময় গাদাবন্দুকের সীসায় তাঁর বামহাত এমন জঘন্যভাবে গুঁড়িয়ে গিয়েছে যে হেকিম খুররমকে বলেছে অবিলম্বে কনুইয়ের নিচ থেকে তাঁর হাত কেটে বাদ দিলেই কেবল তাকে প্রাণে বাঁচান সম্ভব। তাঁরা ইতিমধ্যে নিজেদের শল্যচিকিৎসার শস্ত্রে শান দিতে আর রক্তপাত বন্ধ করার জন্য লোহা গরম করতে শুরু করেছেন। তার অল্পবয়সী এক কর্চির অবস্থা এরচেয়েও খারাপ। পাঁজরে তরবারির আঘাত নিয়ে মাটিতে পড়ে থাকার সময় একটা প্রায় আস্ত জ্বলন্ত তালপাতার ছাদ তার উপরে উড়ে এসে পড়েছে। খুররম যখন তাকে দেখতে গিয়েছিল তখন যন্ত্রণায় তার আর্তনাদ মানুষের চেয়ে বেশি পাশবিক মনে হয়, সে নিজেকে জোর করে বাধ্য করে তাঁর পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকাতে যেখানে চামড়া ফালিফালি হয়ে ঝুলে রয়েছে। হেকিম তাকে বলেছে তারা কেবল তাঁর ফোস্কা পড়া মুখে ফোঁটা ফোঁটা আফিম মিশ্রিত পানি দিয়ে বেহেশতের উদ্দেশ্যে তার যাত্রাকে কিছুটা সহনীয় করতে পারে। খুররম ভাবে, আল্লাহর কাছে দোয়া করি সেটা যেন তাড়াতাড়ি হয়।

 সে তাঁর আবেগহীন সৎ-ভাইয়ের দিকে, এইসব দুর্ভোগের কারণ, তাকিয়ে থাকার সময় তার ভিতরে ক্রোধ পুঞ্জীভূত হতে থাকে, এবং সে তাকে চড় মারার জন্য হাত তুলে। কিন্তু তারপরে কি মনে হতে সে নিজেকে নিরস্ত করে। কি লাভ হবে? সে ক্রোধের বশবর্তী হয়ে কিছু করবে না। তোমায় বুরহানপুরের ভূগর্ভস্থ কারাপ্রকোষ্ঠে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে তুমি আমার সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করবে। আমাদের আব্বাজান যেমন একবার করেছিলেন তেমনি ক্রোধের বশবর্তী হয়ে আমি তোমার বা তোমার সৈন্যদের শাস্তির বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেব না।

 ‘তোমার জন্য কোনো ধরনের হুমকি না হওয়ার প্রতিশ্রুতি আমি দিতে পারবো না। আমি নিজেকে চিনি। আমার মাঝে যতক্ষণ প্রাণ থাকবে ততক্ষণ উচ্চাকাঙ্খও থাকবে… আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত, খসরু উত্তর দেয়, তার মুখ এখনও ভাবলেশহীন কিন্তু কিছুক্ষণ পরে সামান্য নমনীয় কণ্ঠে সে জানতে চায়, জানি হয়তো আমার সাথে বুরহানপুরে যেতে পারে?

খুররম অনুরোধটা নাকচ করতে যাবে এমন সময় আরজুমান্দ এবং তার জন্য নিজের অনুভূতির কথা তার মনে পড়ে। তার নিজের স্ত্রীর জন্য তাঁর ভালোবাসার মানে সে তার সৎ-ভাইয়ের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে পারবে না। হ্যাঁ। তুমি যতই তার অনুপযুক্ত হও, আমি তোমার অনুরোধ কেবল তাঁর কথা ভেবেই, তোমার কথা নয়, মঞ্জুর করছি।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *