১.১২ বিষাক্ত লেখনী

১.১২ বিষাক্ত লেখনী

‘মালকিন…আপনাকে ঘুম থেকে জাগাবার জন্য আমায় মার্জনা করবেন…’

মেহেরুন্নিসা ঘুম জড়ানো চোখ খুলে সাল্লাকে বিছানার উপরে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যেখানে সে ঘুমিয়ে ছিল। আর্মেনিয়ান মেয়েটা জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে, যেন সে তার মালকিনের কামরায় দৌড়ে এসেছে। মেহেরুন্নিসা উঠে বসে, পরিত্রস্ত।

কি হয়েছে? সম্রাটের কি কিছু হয়েছে? জাহাঙ্গীর, ঘন্টাখানেক আগে তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তাঁর পরীক্ষিত রণহস্তীর একটা–খুনি খাজা নামে বহু ক্ষতচিহ্নের অধিকারী দানবাকৃতি যুদ্ধপ্রবীন এক দাঁত ভাঙা কিন্তু ডান গজদাঁত এখনও ভীষণ কার্যকর একটা পশু–এবং গোয়ালিওরের শাসনকর্তার কাছ থেকে উপহার হিসাবে প্রেরিত এর চেয়েও বিশাল আরেকটা হাতির ভিতরে অনুষ্ঠিত লড়াই দেখতে গিয়েছে। সেও সাধারণত তাঁর সাথে লড়াই দেখতে যায়–সে পর্বতাকৃতি এই প্রাণীগুলোর লড়াই উপভোগ করে যেখানে তাঁরা তাঁদের শক্তির বরাভয়ে একে অপরের বিরোধিতা করছে এবং আন্দাজ করতে চেষ্টা করে কে জিততে পারে–কিন্তু নিজেকে আজ তার খানিকটা পরিশ্রান্ত মনে হচ্ছিল আর তাই সে বিশ্রাম করার সিদ্ধান্ত নেয়।

‘মালকিন, সম্রাটের কিছু হয় নি।

 ‘কি তাহলে?

সাল্লা ময়ূরের মত দেখতে পাথর বসান একটা চুলেরকটা এগিয়ে দেয় যার কলাই করা পেখমে ছোট ছোট নীলা আর পান্না বসান রয়েছে। এটা মেহেরুন্নিসার প্রিয় চুলেরকাঁটাগুলোর একটা এবং সেদিন সকালের দিকে দেওয়ানী আমের রাজকীয় সিংহাসনের একপাশের দেয়ালে স্থাপিত জালি অন্তঃপটের পেছনে অবস্থানের সময় এটা তার চুলে ছিল যখন লাহোরের শাসনকর্তার কাছ থেকে আগত প্রতিনিধি সেখানকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা উন্নতির লক্ষ্যে গৃহীত কার্যক্রমের অগ্রগতির প্রতিবেদন পেশ করছিলেন। কাঁটাটা নিশ্চয়ই তখন তার অজান্তে চুল থেকে খুলে মাটিতে পড়েছিল কিন্তু সাল্লা নিশ্চয়ই মামুলি একটা চুলেরকটা খুঁজে পাওয়ার কথা জানাবার জন্য তাকে বিরক্ত করতে আসে নি?

 ‘জালির পেছনে আপনার আসনের উপর কাঁটাটা পড়েছিল,’ সাল্লা বলতে থাকে। আমি যখন আমার চাদর যা আমি সেখানে ফেলে এসেছিলাম আনবার জন্য গিয়ে আমি এটা খুঁজে পাই, কিন্তু আমি যখন সেখানে ছিলাম তখন আমি আড়াল থেকে হঠাৎ কিছু শুনতে পেয়েছি…’

সাল্লাকে ভীষণ বিব্রত দেখালে মেহেরুন্নিসা নিজের অজান্তে তার হাত চেপে ধরে। আমায় বল তুমি কি শুনেছো।’ তাঁর ব্যক্তিগত পরিচারিকাকে কি এত বিব্রত করেছে জানবার জন্য সে নিজেও যদিও ভীষণ উদ্গ্রীব তারপরেও সে তার কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখে।

 ‘ইংরেজ দূতমহাশয় আর তার কর্চি। অমাত্যরা সবাই সম্রাটের সাথে হাতির লড়াই দেখতে গিয়েছিল বলে তারা তখন দেওয়ানী আমে একাই ছিল। দূতমহাশয়কে আমি তাঁর কচিকে বলতে শুনেছি যে খোলাখুলি কথা বলা এখনকার মত তাঁদের জন্য নিরাপদ। আমি কৌতূহলী হয়ে উঠি আর তাই অপেক্ষা করি–আপনি জানেন যে আমি তাঁদের ভাষায় পারদর্শী। দূতমহাশয় বেদীর পাশে বেলেপাথরের স্তম্ভগুলোর একটার গায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিল আর কর্চি সম্রাটের বেদীর প্রান্তে বসেছিল।

 মেহেরুন্নিসার ভ্রু কুঁচকে ওঠে। সম্রাটের বেদীর উপর উপবেশন করাটা আদবকায়দার একটা প্রায় অচিন্তনীয় লঙ্ন কিন্তু দুই ভিনদেশী নিশ্চিতভাবেই ভেবেছিলেন তাঁদের কেউ দেখছে না। বলতে থাকো।

‘দূতমহাশয় বলেন যে তিনি ইংল্যাণ্ডে প্রেরণের জন্য একটা চিঠি মুসাবিদা করতে চান। তিনি বলেন তার প্রভুর সম্রাটের বিষয়ে সত্যি কথাটা জানবার সময় হয়েছে–যে তিনি কেবল গর্বোদ্ধতই না সেই সাথে সম্পূর্ণভাবে একজন রমণীর বশীভূত। তিনি বলেন–আমায় মার্জনা করবেন, মালকিন– যে তার দেশে আপনার মত রমণীকে লজ্জা দেয়ার জন্য ঘোড়ার লাগাম পরিয়ে রাখা হত।’

 ‘সে আর কি বলেছে?’ ক্রোধে মেহেরুন্নিসার কণ্ঠস্বর কেঁপে যায়।

‘আমি জানি না… আমি সাথে সাথে আপনাকে খুঁজে বের করার জন্য সেখান থেকে চলে আসি। আমি কি কোনো ভুল করেছি?

‘তুমি ঠিক কাজই করেছে। আমার সাথে এসো। দূতমহাশয় যদি এখনও সেখানে থাকে তাহলে তারা কি আলোচনা করছে বোঝার জন্য তোমার সাহায্য আমার প্রয়োজন হবে। সে যদিও ইংরেজি ভাষাটা আয়ত্ত করার জন্য বেশ পরিশ্রম করছে–এমনকি, সাল্লার সাহায্যে, শেকসপিয়ার নামে জনৈক ইংলিশ কবির রচিত চতুর্দশপদী কবিতা পাঠ করলেও যা রো জাহাঙ্গীরকে উপহার দিয়েছিল–মেহেরুন্নিসা খুব ভালো করেই জানে ভাষাটার উপরে তাঁর দখল এখনও সাল্লার চেয়ে অনেক দুর্বল।

মেহেরুন্নিসার আবাসন এলাকা থেকে দুই রমণী দ্রুত হাঁটতে আরম্ভ করে এবং জালির পেছনের ছোট অন্ধকারাচ্ছন্ন কক্ষটার সাথে সংযোগকারী সংকীর্ণ গলিপথ অনুসরণ করে এগিয়ে সামনের দিকে যায়। মেহেরুন্নিসা কয়েক মিনিট পরেই সাল্লাকে পেছনে নিয়ে সন্তর্পণে কক্ষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। গোলাপি বর্ণের রেশমের কাপড় দিয়ে আচ্ছাদিত একটা তেপায়ায় উপবিষ্ট হয়ে, মেহেরুন্নিসা সামনের দিকে ঝুঁকে এসে বেলেপাথরের তৈরি জালিতে খোদাই করা তারকাকৃতি গহ্বরের একটার ভিতর দিয়ে একাগ্রচিত্তে তাকায়। রো, লাল স্যাটিনের আঁটসাঁট কোট পরিহিত একটা লম্বা আর কৃশকায় কাঠামো, সাল্লা যেমন বর্ণনা করেছে, একটা স্তম্ভের গায়ে হেলান দিয়ে, ঠিক সেভাবেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। নিকোলাস ব্যালেনটাইনের সোনালী চুলভর্তি মাথাটা একটা কাগজের উপর ঝুঁকে রয়েছে যার উপরে সে এই মাত্র বালি ছিটিয়েছে। তারমানে, শ্রুতলিপি দেয়ার পর্ব সমাপ্ত হয়েছে। মেহেরুন্নিসা যারপরনাই হতাশ হয়ে পেছনের দিকে হেলান দিয়ে বসে। তারপরেই সে রো’কে বলতে শুনে, ‘আমাকে লেখাটা আবার পড়ে শোনাও বলা যায় না তুমি হয়তো কিছু লিখতে ভুলে গেছ।

‘মহামান্য সম্রাট, ব্যালেনটাইন শুরু করে, অনুচ্চ স্বরে পড়লেও সাল্লার জন্য সেটাই যথেষ্ট কোনো অপরিচিত শব্দের অর্থ মেহেরুন্নিসাকে ফিসফিস করে বলার জন্য। মোগল দরবারে আমার আগমনের পরে আঠার মাসাধিককাল অতিবাহিত হয়েছে। সম্রাট নিজেকে যে বিপুল বিলাসিতার মাঝে নিম্মজিত করে রাখেন সে বিষয়ে অতীতে বহুবার আমি লিখেছি কিন্তু তিনি গত সপ্তাহেই প্রথম আমার খাতিরে তার ভূগর্ভস্থ কোষাগারের একটা পরিদর্শনের জন্য আমায় নিমন্ত্রণ জানান। আমি সেখানে যা দেখেছি তা ভাষায় প্রকাশ করার জন্য শব্দ খুঁজে পাওয়া কঠিণ–মোমের আলোয় আলোকিত কুঠরিতে পান্না আর রুবি স্তপ হয়ে রয়েছে যার একেকটার আকৃতি আখরোটের চেয়ে বড়, রেশমের গাঁটের সাথে একটা সমুদ্র থেকে যতটা আহরণ করা সম্ভব বলে আপনি মনে করেন তারচেয়েও অধিক পরিমাণ মুক্তা সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এবং সেই সাথে সূর্যের দীপ্তি ম্লান করে দেয় এমন সব হীরকখণ্ড। আমি অবশ্য নিজের বিস্ময়বিহ্বলতা প্রকাশ না করে এমন ভঙ্গিতে মৃদু মাথা নাড়ি যেন ঐশ্বর্যের এমন বিভার সাথে আমি পরিচিত। কিন্তু সত্যি বলতে, জাহাপনা, সম্রাটের প্রিয় ঘোড়া, হাতি আর শিকারী চিতারও এমন কি আমাদের রাজকীয় খাজাঞ্জিখানার চেয়েও বেশি দামি রত্ন রয়েছে, এবং সবকিছুই সোনার উপর বসান।

 ‘সম্রাটের কাছে, যে নিজেকে, নিজের সাম্রাজ্যকে আর নিজের রাজবংশকে নিয়ে লুসিফারেরমত গর্বিত, এই চোখ ধাধন ঐশ্বর্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি নিজের প্রাচুর্য্য প্রদর্শন করতে পছন্দ করেন এবং আরেকটা বিষয় জানাতে আমার নিজেরই কষ্ট হচ্ছে যে সম্প্রতি তাঁর এই গর্ব নতুন মাত্রা লাভ করেছে। আমি আপনাকে ইতিমধ্যেই জানিয়েছি কীভাবে মানুষ আর জীবজন্তুর প্রতিকৃতির ব্যাপারে মোল্লাদের নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে–আমাকে বলা হয়েছে তার আগে তাঁর আব্বাজানও তাই করেছিলেন তিনি আপনি তাকে আপনার নিজের যে প্রতিকৃতি পাঠিয়েছিলেন সেটা কতটা পছন্দ করেছেন। তিনি তাঁর নিজের প্রতিরূপ অঙ্কন করিয়েছেন। প্রতিকৃতিটা নিয়ে তিনি ভীষণ সন্তুষ্ট যেখানে জনৈক চিত্রকর–বিসি নামে এক লোক–তাকে আমাদের ধর্মীয় পর্বে ব্যবহৃত পানপাত্রের মত দেখতে রত্নখচিত একটা পাত্রে উপবিষ্ট অবস্থায় তাকে অঙ্কন করেছে যেখানে তাঁর মাথার চারপাশে রয়েছে একটা সোনালী জ্যোতিশ্চক্র। তিনি একজন মোল্লাকে একটা কিতাব দান করছেন, জাঁহাপনা, চিত্রকর্মটায় পারস্যের শাহ আর তুরস্কের সুলতানের সাথে আপনাকেও ইচ্ছাকৃতভাবে এককোণে ক্ষুদ্র আর তুচ্ছভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সম্রাট এই চিত্রকর্মে নিজের ঔদ্ধত্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে নিজেকে পৃথিবীর অধিশ্বর বলে দাবি করেছেন।’

 মেহেরুন্নিসা তেপায়ার উপরে দেহের ভর পরিবর্তন করে। রো’র এতবড় স্পর্ধা জাহাঙ্গীর সম্বন্ধে এতটা তাচ্ছিল্য আর পৃষ্ঠপোষকতার ভান করে কথা বলছে? কিন্তু পরিচারক তখনও পড়ছে এবং সে পুনরায় তাঁর মনোযোগ পরিচারকের উপরে নিবদ্ধ করে। প্রতিটা শব্দ, তাঁদের অর্থের সূক্ষতম দ্যোতনা বোঝার চেষ্টা করাটা তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

 ‘মহামান্য জাঁহাপনা এই চিত্রকর্মটায় আপনাকে ইচ্ছাকৃতভাবে অপমান করা হয়েছে, যদিও সম্রাট যখন আমাকে এটা দেখান আমি তাকে কেবল এটাই বলেছি যে চিত্রকর তার প্রতিমূর্তি প্রায় জীবন্ত করে ফুটিয়ে তুলেছে এবং প্রতিকৃতির একত্রীকরণের বিন্যাস নিয়ে কোনো মন্তব্য করা থেকে নিজেকে বিরত রাখি। সম্রাট নিজেকে নিয়ে এতটাই আত্মগর্বে ভুগছিলেন যে তিনি আমার শীতল আবেগহীন উত্তর খেয়ালই করেননি, আমি জানতাম তিনি করবেন না। আমি বস্তুতপক্ষে তাঁর সাথে এতটাই সময় অতিবাহিত করেছি–তিনি আমার সঙ্গ পছন্দ করেন আর আমাকে প্রশ্ন করার বিষয়ে তাঁর কোনো ক্লান্তি নেই–যে তাঁর চরিত্র পর্যালোচনা করার একটা চমৎকার সুযোগ আমি পেয়েছিলাম। আমার মনে হয় যে এখন সময় হয়েছে যখন আমার উচিত তার মানসিক প্রকৃতি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা যাতে করে জাঁহাপনা আপনি যেন বুঝতে পারেন কেন, তুলা, নীল আর সুগন্ধি দ্রব্যের বাণিজ্যে সম্রাট যদিও আমাদের সামান্য কিছু ছাড় দিয়েছেন তারপরেও আরবে হজ্জ্বযাত্রী পরিবহণে ইংরেজ জাহাজগুলোকে অনুমতি দেয়ার ক্ষেত্রে আমাকে এখনও কেন কোনো স্পষ্ট উত্তর দেন নি–আপনার সাথে শেষ যোগাযোগের সময় থেকে আমি জানি যে বিষয়টা আপনার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দেবার উপক্রম করেছে।

 ‘সম্রাট জাহাঙ্গীর জটিল চরিত্রের অধিকারী একজন মানুষ যার মাঝে আমি অসংখ্য স্ববিরোধিতা লক্ষ্য করেছি। তিনি কখনও নিঃস্বার্থ, দয়ালু পরোপকারী এবং জাদুকরী ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তাঁর একটা ক্রিয়াশীল মন রয়েছে, আর অকপটে নিজের ভাবনার কথা অন্যের কাছে প্রকাশ করেন এবং পার্থিব জগত পর্যবেক্ষণে তাঁর অসীম উৎসাহ। সম্প্রতি গ্রামবাসী এক প্রজা যখন খবর নিয়ে আসে যে আকাশ থেকে একটা অতিকায় প্রায় ভষ্মীভূত উল্কাপিণ্ড আগ্রার অনতিদূরে একটা টিলার পাশে এসে আছড়ে পড়েছে, তিনি সাথে সাথে উত্তপ্ত অবস্থায় সেটাকে খুড়ে বের করার আদেশ দেন এবং সেটা থেকে আহরিত গলিত ধাতু দিয়ে তরবারি তৈরি করে সেটার শক্তি পরখ করে দেখার আদেশ দেন। তিনিই আবার সিংহের অন্ত্র পরীক্ষা করে প্রাণীটার সাহসিকতার কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায় কিনা দেখার জন্য বাদশাহী সনদবলে লোক নিযুক্ত করেন।

‘সম্রাট অবশ্য একই সাথে আবেগপ্রবণ, অস্থির আর মাত্রাতিরিক্ত বদরাগী। তিনি যদিও বেশিরভাগ বিষয়েই সহনশীল, যার ভিতরে ধর্মের বিষয়টাও রয়েছে–যদিও আমার কাছে প্রায়শই মনে হয় যে তিনি নিজে এটা সামান্যই বিশ্বাস করেন–এই তিনিই আবার ক্ষেত্র বিশেষে অদ্ভূতধরনের নিষ্ঠুর। তিনি বাহ্যিক আড়ম্বরের গুরুত্বের প্রতি সবসময়েই আস্থাশীল, নির্যাতন আর মৃত্যুদণ্ডের মত বিষয়কেও একটা জমকালো প্রদর্শনীতে পরিণত করতে সক্ষম। তিনি মনে হয় কখনো-সখনো মানুষকে হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট হতে বা জীবন্ত অবস্থায় চামড়া ছাড়ানো দেখতে পছন্দই করেন। তিনি বলেন এগুলো এমন শাস্তি যা সবসময়ে অপরাধের পরিমাপ অনুযায়ী দেয়া হয়। আমার মনে সন্দেহ নেই যে কথাটা সত্যি–অথবা যে তাঁরা শাস্তির উপযুক্ত–কিন্তু তাকিয়ে দেখার সময় আমার পাকস্থলী কেমন যেন মোচড়াতে থাকে। সম্রাট পক্ষান্তরে শাস্তি প্রদানের এইসব পদ্ধতি খুব কাছ থেকে এমনভাবে পর্যবেক্ষণ করেন যেন সেগুলো কোনো অ্যালকেমিস্টের কোনো গবেষণা, চামড়া ছাড়াবার পরে বা শূলবিদ্ধ অবস্থায় একজন মানুষের দেহ থেকে প্রাণ বায়ু বের কতক্ষণ সময় লাগে বা তাদের দেহের আভ্যন্তরীণ কার্যপ্রণালীর কতটা এইসব নির্যাতনের ফলে প্রকাশ পেয়েছে সবকিছু লিপিবদ্ধ করেন।

‘জাহাপনা, আমার কাছে কিন্তু এর চেয়েও মারাত্মক বলে যেটা মনে হয়েছে, সম্রাট একজন মহিলার দ্বারা নিজেকে পরিচালিত করার বিষয়টা অনুমোদন করেছেন। এই মেহেরুন্নিসা, যার সম্বন্ধে আমি আপনাকে আগেই অবহিত করেছি, আমি নিশ্চিত, সম্রাট আর তার শাসিত সাম্রাজ্যের উপরে তার মারাত্মক প্রভাব রয়েছে। সম্রাটের দরবারে এটা সর্বজনবিদিত যে তিনি ক্ষমতার জন্য লালায়িত এবং সবাই এটাও জানে যে তিনি তাঁর স্বামীর সুরা আর আফিমের নেশাকে উৎসাহিত করেন ক্ষমতা প্রদানের ব্যাপারে তাকে আগ্রহী করতে। তাঁর গুরুত্ব যেকোনো অমাত্য–এমনকি সম্রাটের যিনি উজির তার চেয়েও অনেক বেশি। আমি অবশ্য তাকে উপঢৌকন আর প্রশংসাসূচক বার্তা প্রেরণের বিষয়টা খেয়াল করলেও আমি দরবারে কানাঘুষো যা শুনেছি তাতে একটা বিষয়ে আমি নিশ্চিত যে তিনি আমাদের বন্ধু নন। ইংরেজ জাহাজগুলোকে হজ্জ্বযাত্রী পরিবহনের অনুমতি প্রদানের বিষয়ে সম্রাটকে আমি তাঁর অনুমতি প্রদানের বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে প্রতিবারই তিনি হাসি মুখে আমায় ধৈর্য ধারণ করতে বলেন। আমার ধারণা এই দীর্ঘসূত্রতার পিছনে সম্রাজ্ঞীর কোনো হাত রয়েছে। অমাত্যরা আমায় বলেছে যে, তিনি নিজে পার্সী বংশোদ্ভূত হলেও, মহিলা সব বিদেশীদের অবিশ্বাস করেন এবং আমাদের উদ্দেশ্যের বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন, তাঁর নিজের মতই সবাইকে স্বার্থান্বেষী মনে করেন, আমার বিশ্বাস। তিনি সেজন্যই, তাঁর সম্রাট স্বামীর কানে ফিসফিস করে পরামর্শ দেন, আমাদের সবাইকে একে অপরের বিরুদ্ধে বিরূপ ভাবাপন্ন করে তুলতে এবং এভাবেই নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধি আর সংহত করতে চান। জাহাঙ্গীরের উচিত তাকে এতটা প্রশয় না দিয়ে তাকে তার নিজের অবস্থান সম্পর্কে অবহিত করা এবং অনধিকার চর্চা থেকে বিরত রাখা।

 কিন্তু আমি অবশ্য এখনও আমাদের উদ্দেশ্য অর্জনের বিষয়ে হতাশ হইনি। সম্রাট আমাকে তাঁর বন্ধু হিসাবে বিবেচনা করেন এবং আমি যদি ধৈর্য সংবরন করতে পারি হজ্জ্বযাত্রীদের বিষয়ে আমাদের প্রস্তাব সমর্থনে আমি এখনও হয়তো তাকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হব। আমি আপনাকে পুনরায় চিঠি লিখব যখন জানাবার মত–এবং আমার বিশ্বাস অনুকূল খবর থাকবে।

নিকোলাস ব্যালানটাইন মুখ তুলে কৌতূহলী চোখে তাকায়। দারুণ।’ রো মাথা নাড়ে। সত্যি বলতে কি, অসাধারণ। আমি চাই আজ রাতেই যেন চিঠিটা সুরাটের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করা হয় যাতে করে এক সপ্তাহের ভিতরে ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়া পেরিগ্রিনে এটা তুলে দেয়া যায়। আমরা বরং এখন আমার কক্ষের দিকে যাই যেখানে গিয়ে আমি চিঠিটায় আমার মোহর লাগাতে পারবো।’

 মেহেরুন্নিসা জালির ভিতর দিয়ে ব্যালেনটাইনকে চিঠিটা ভাঁজ করে সেটা নিজের থলেতে যত্ন করে রাখতে দেখে। দুই ফিরিঙ্গি তারপরে দবরার থেকে ধীরে ধীরে বের হয়ে যায়। নতুন প্রাণশক্তি আর সংকল্প তাকে জারিত করতে তার চেহারা থেকে একটু আগের ক্লান্তিকর অভিব্যক্তি মুছে যায়। রো তার বন্ধু নয় এই বিষয়টা এখন তাঁর কাছে দিনের আলোর মত পরিষ্কার। তার চেয়েও বড় কথা সে তাচ্ছিল্যের সাথে সম্রাট সম্বন্ধে কথা বলেছে। মেহেরুন্নিসা সাল্লাকে পাশে নিয়ে বহুক্ষণ নিথর হয়ে সেখানে নির্বাক ভঙ্গিতে বসে থাকে।

*

‘লাডলি, প্রথম তিনটা পংক্তি আমায় পড়ে শোনাও।’ মেয়েটা পড়তে শুরু করলে মেহেরুন্নিসা ভাবে, তার মেয়ে, এখন দশ বছর বয়স, তার মতই চটপটে হয়েছে। কবিতা যদিও তাঁর অন্যতম প্রিয় বিষয়, সে মনোযোগ দিতে পারে না। রো’র আবাসিক কক্ষে কি চলছে পুরো সময়টা তার মাথায় কেবল এই চিন্তাই ঘুরপাক খেতে থাকে। ফিরিঙ্গিটার উপরে কীভাবে সে তাঁর চরম প্রতিশোধ নেবে এবং বস্তুতপক্ষে, সেটা নেয়াটা যথার্থ হবে কি না এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে তাঁর প্রচুর সময় অতিবাহিত হয়েছে। তার ক্রোধ প্রশমিত হবার সাথে সাথে সে রো’র চিঠির ব্যাপারে অনেক বেশি যুক্তিগতভাবে চিন্তা করতে পারে। রো, অতীতের যেকোনো দূতের ন্যায়, নিজের নৃপতির কাছে এখানে তার কতটা প্রভাব রয়েছে, মহান লোকদের জীবনের ব্যাপারে কত গভীর তার অন্তদৃষ্টি, তার নিজের দেশের স্বার্থ হাসিলের ক্ষেত্রে সে কত সুন্দরভাবে সবকিছু গুছিয়ে এনেছে, সাফল্য অর্জনের ক্ষেত্রে তাঁর ব্যর্থতার জন্য সে দায়ী নয়… সেটাই বোঝাতে চেয়েছে… সে এখন যখন অনেকটাই সুস্থির তখন এসবের জন্য সে রো’র আচরণ খানিকটা ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে প্রস্তুত।

সে এরপরেও তার ব্যাপারে রো’র দৃষ্টিভঙ্গি কোনোমতেই উপেক্ষা করতে পারে না। দরবারে বিষয়টা সুবিদিত যে সে ক্ষমতার জন্য লালায়িত, ফিরিঙ্গিটা ঠিক এভাবেই চিঠিতে লিখেছে… কিন্তু দরবারে সে তাঁর বন্ধু আর পরিচিতদের ভিতরে এমন আলোচনা সে উৎসাহিত করছে ব্যাপারটা যদি এমন হয়? পরিস্থিতি ভুল বিশ্লেষণ করায় সে নিজের উপরই বিরক্ত হয়। জাহাঙ্গীরের সাথে রো’র ঘনিষ্ঠতা সে লম্বা একটা সময় ধরে উৎসাহিত করেছে, পুরোটা সময় সে একটা বিষয় খুব ভালো করেই জানতো যে তার স্বামী দূতমহাশয়ের সঙ্গ পছন্দ করেন কিন্তু সেই সাথে তিনি ফিরিঙ্গিটার সাথে যত বেশি সময় অতিবাহিত করবেন দাপ্তরিক বিষয়ের জন্য যা তার কাছে একঘেয়ে মনে হয় তত কম সময় তিনি দিতে পারবেন এবং তাকে দায়িত্ব থেকে খানিকটা মুক্তি দিতে সে আগ্রহী–এবং যোগ্যতার সাথেই সে দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম।

 সে রোকে কোনোমতেই তাঁর অবস্থান আর সে এখন পর্যন্ত যা কিছু অর্জন করেছে এবং আরো বৃহৎ গৌবর লাভের আকাঙ্খ পোষণ করে এসব কিছু। হীন প্রতিপন্ন করার সুযোগ দিতে চায় না, পারে না। সে এখন যখন বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করছে তখন তার মনে পড়ে মাত্র দু’সপ্তাহ আগে জাহাঙ্গীর যখন তাঁর উজিরকে লাহোর দূর্গের সংস্কার কর্মসূচি সংক্রান্ত নথিপত্র অনুমোদনের জন্য তাঁর কাছে পাঠাতে বলেছিল তখন মাজিদ খানের চেহারায় সে অস্বস্তিকর একটা অভিব্যক্তি লক্ষ্য করেছিল। আরো সম্প্রতি সে হঠাৎ হেরেমে দু’জন বৃদ্ধ মহিলার কথোপকথন শুনে ফেলে– একজন জাহাঙ্গীরের পিতামহের ভগ্নি আর অন্যজন তাঁর আব্বাজানের দূরসম্পকের আত্মীয়সম্পর্কিত বোন–তাঁরা তাঁর পরিবারের প্রভাব নিয়ে খেদ প্রকাশ করছিল। গিয়াস বেগ সাম্রাজ্যের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে, আসফ বেগ আগ্রা দূর্গের সেনাপতি এবং তার কথা কি বলবো…’ সে খুব ভালো করেই বুঝতে পারে তার’ বলতে আসলে দুই বৃদ্ধা কার কথা বোঝাতে চেয়েছেন।

তাঁর মেজাজ খোশ করতে সাল্লা দীর্ঘ এক ঘন্টা ধরে তার লম্বা চুল আচড়ে বেনী করে দেয় এবং সেই সময়ের ভিতরেই সে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। রোকে যেভাবেই হোক দরবার থেকে বিতাড়িত করতে হবে।

আর আজই সেই রাত যে রাতে তার পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হবে কি না সে বুঝতে পারবে। সে সহসা উপলব্ধি করে যে লাডলি কবিতার পংক্তি পাঠ শেষ করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। চমৎকার। দারুণ হয়েছে।’ মেহেরুন্নিসা হেসে বলে, খানিকটা অপরাধবোধ অনুভব করে যে তাঁর কন্যা কেমন আবৃত্তি করেছে সে বিষয়ে তাঁর কোনো ধারণাই নেই।

*

নিকোলাস ব্যালেনটাইন বিছানায় শুয়ে থাকা তার প্রভুর ঘামে ভেজা আর নগ্ন দেহের দিকে আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে থাকে, তার লালচে মুখ এখন যন্ত্রণায় ফ্যাকাশে হয়ে আছে। আমার পেটের নাড়িভূঁড়িতে মনে হচ্ছে যেন কেউ আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে যদিও গত এক ঘন্টায় আমি ছয়বার পেট খালি করেছি,’ দূতমহাশয় চোখ বন্ধ অবস্থায়, কোঁকাতে কোঁকাতে বলে।

 ‘এসব কখন থেকে আরম্ভ হয়েছে?

 ‘রাতের খাবার শেষ করার প্রায় সাথে সাথে।

নিকোলাস ভাবে, লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে আমাশয়, হিন্দুস্তানে আগত বেশিরভাগ বহিরাগত কোনো না কোনো সময় যে রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। গন্ধ নিশ্চিতভাবে সেটাই ইঙ্গিত করছে–রো’র শয্যার নিচে প্রায় উপচে ওঠা পিতলের মূত্রাধার থেকে কামরার ভিতরে জমে থাকা দুর্গন্ধ মাথা ধরিয়ে দেয়। একজন পরিচারককে ডেকে মূত্রাধার খালি করতে আর নতুন আরেকটা দিয়ে যাবার আদেশ করে, নিকোলাস নিজেকে তার প্রভুর আরো কাছে যাবার জন্য নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে, বিছানার দু’পাশ দুই হাতে শক্ত করে ধরে থাকা অবস্থায় বেচারার শীর্ণ বুকটা হাপরের মত উঠানামা করছে যেন সে ভয় পাচ্ছে যেকোনো সময় আবার যন্ত্রণাটা ফিরে আসবে।

‘আমি একজন হেকিমকে ডেকে আনছি।’

নিকোলাস বিশ মিনিট পরে দরবারের একজন হেকিমকে, খয়েরী রঙের পাগড়ি পরিহিত খর্বাকৃতির মোটাসোটা দেখতে একটা লোক নিজের চিকিৎসার অনুসঙ্গ চামড়ার একটা থলেতে বহন করছে, নিয়ে যখন ফিরে আসে, রো তখন একজন পরিচারকের ধরে থাকা পিতলের পিকদানে নাড়িভূড়ি উল্টে আসবে এমন ভঙ্গিতে বমি করছে। তার বমি করা অবশেষে শেষ হয় এবং বিছানায় উল্টে পড়ে হেকিম তখন তার কপালে হাত রাখে তারপরে প্রথমে তার ডান চোখের এবং পরে বামচোখের পাতা তুলে দেখে। দেখি, আমাকে আপনার জিহ্বা দেখান,’ সে তাকে অনুরোধ করে। রো মুখ খুলে জিহ্বার অগ্রভাগ বের করলে, নিকোলাস সেখানে হলদে একটা কিছুর প্রলেপ দেখতে পায়। আরো বের করেন, হেকিম আদেশের সুরে বলে। রো দুর্বলভাবে তাঁর জিহ্বা আরেকটু বাইরে বের করে।

 ‘আপনি পচা কিছু একটা খেয়েছেন। গরমের সময়ে আপনার অবশ্যই আরো সতর্ক হওয়া উচিত ছিল।’

 ‘সম্রাটের আদেশে দূতমহাশয়ের সব খাবারই রাজকীয় রন্ধনশালায় প্রস্তুত করা হয়, নিকোলাস বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে বলে। অনেক যত্ন নিয়ে সেখানে…’।

পচা খাবারের দ্বারাই কেবল এসব লক্ষণের প্রাদুর্ভাব দেখা যাবে। তার দেহ খাদ্যনালীর শুরু আর শেষপ্রান্ত দিয়ে রেচনের মাধ্যমে নিজেকে পরিষ্কার করছে যার কারণে এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। নিকোলাস তখনও বিষয়টা পুরোপুরি মানতে পারছে না দেখে চিকিৎসক আরো বলেন, ‘শোন ছোকরা, জিনিষটা যদি বিষ হতো তাহলে এতক্ষণে তোমার প্রভুর ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যেতো। অবস্থা যেমন দেখছি তোমায় এটুকু আমি বলতে পারি যদি তিনি চুপচাপ শুয়ে বিশ্রাম নেন, প্রচুর পানি পান করেন আর আগামী কয়েকদিন কেবল টকদই খেয়ে থাকেন যার সাথে তুমি অবশ্যই আফিমের গুলি গুড়ো করে মিশিয়ে দেবে তাহলে তাঁর প্রাণসংশয় হবার মত কোনো কারণ এখনও ঘটেনি। আমি এখন একটা মিশ্রণ প্রস্তুত করবো। আমি কি করছি খুব খেয়াল করে দেখবে তাহলে বুঝতে পারবে তোমায় ঠিক কি করতে হবে। তুমি তাকে দুই চামচ করে প্রতিঘন্টায় খেতে দেবে–এর বেশি নয়–যতক্ষণ না আমাশয় আর সেই সংক্রান্ত অসুস্থতা পুরোপুরি বন্ধ না হয়। সবকিছু বন্ধ হবার পরে আরো তিনদিন যেন সে পানি ছাড়া আর কিছু গ্রহণ না করে। তার শারীরিক অবস্থার যদি কোনো অবনতি হয় তাহলে সাথে সাথে আমায় ডেকে আনতে লোক পাঠাবে।

নিকোলাস মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। হেকিম বিদায় নিতে সে রো’কে পরিষ্কার করতে, বিছানার চাদর বদলে দিতে আর তাকে ভীষণভাবে কাঁপতে দেখে তাঁর জন্য রাতে পরার একটা পোষাক নিয়ে আসবার জন্য একজন পরিচারকদের ডেকে আনে।

‘আমার মনে হয় আমি সম্ভবত এখানে অনেক বেশি দিন অতিবাহিত করেছি,’ রো ঝাঁকিয়ে উঠে বলে। তার নুয়ে পড়া লম্বা গোফ আর গা মুছে দেয়ায় টপটপ করে গড়িয়ে পড়তে থাকা পানির ফোঁটায় শীর্ণকায় লোকটাকে একেবারে বিষণ্ণ, মনমরা দেখায়। সবাই বলে যে এ আবহাওয়া ইউরোপের লোকদের খুব একটা সহ্য হয় না এবং আমাদের ভিতরে খুব কম লোকই রয়েছে যারা পরপর দুটো বর্ষাকাল এখানে বেঁচেবর্তে অতিবাহিত করতে পারবে।’

 ‘সাহস রাখেন। আপনি এখনও সুস্থই আছেন। পৃথিবীর যেকোনো স্থানে এটা ঘটতে পারতো…এমনকি ইংল্যান্ডেও…এবং আপনি যে উদ্দেশ্যে এখানে এসেছেন সেটা এখনও হাসিল হয়নি।’

 ‘তোমার কথাই সম্ভবত সত্যি। নিকোলাস, তুমি একটা ভালো ছেলে, তোমাকে ধন্যবাদ। আমি কখনও ভুলবো না তুমি কত যত্ন নিয়ে আমার সেবা করেছে, রো কোনোমতে মুখে একটা দুর্বল হাসি ফুটিয়ে বলে কিন্তু সহসা নতুন করে যন্ত্রণার প্রকোপ শুরু হতে তার মুখের মাংসপেশীতে একটা খিঁচুনি উঠে। আমায় এখন একা থাকতে দাও…’ সে কোনোমতে বলে এবং আরো একবার পিকদানির দিকে এগিয়ে যাবার জন্য বিছানা থেকে নিজেকে টেনে তুলে।

*

‘আমি ভেবেছিলাম সন্ধ্যেটা আপনি স্যার টমাসের সাথে অতিবাহিত করার পরিকল্পনা করেছেন?’ জাহাঙ্গীর তার কক্ষে প্রবেশ করে তাকে চুম্বন করার জন্য ঝুঁকতে মেহেরুন্নিসা তার দিকে তাকিয়ে বলে।

 ‘সে একটা বার্তা পাঠিয়েছে যে তার শরীরটা ভালো নেই।’

‘খবরটা শুনে খারাপ লাগল। আশা করি তিনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন। সে মনে মনে গভীর একটা সন্তুষ্টি অনুভব করলেও মেহেরুন্নিসা তার চোখেমুখে আন্তরিক উদ্বেগের একটা অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলে। রন্ধনশালার একজন পরিচারককে ঘুষ দিয়ে প্রচুর মশলা দেয়া ভেড়ার মাংসের তৈরি পোলাওয়ে এক টুকরো পঁচা মাংস দেয়াটা মোটেই কঠিন কাজ ছিল না যা রো খুব পছন্দ করে বলে সে জানে। সে কোনো ধরনের অপরাধবোধ অনুভব করে না–তাঁর সম্পর্কে বাজে কথা লেখার জন্য এই দুর্ভোগ তার প্রাপ্য। সে আশা করে মোগল দরবার ত্যাগ করার কথা বিবেচনা করার মত যথেষ্ট পরিমাণে অসুস্থ সে তাকে করতে পেরেছে। সম্ভবত না, কিন্তু দূতমহাশয়কে তাঁর নাড়িভূঁড়ির মাধ্যমে আক্রমণের উপায় খুঁজে পেয়ে সে বারবার এই উপায় ব্যবহার করবে যতক্ষণ না সে তাকে যথেষ্টভাবে দুর্বল করে দিয়ে তাকে দরবার থেকে বিতাড়িত করার তার লক্ষ্য অর্জিত হয়। তাঁর ধৈর্য কম এমন কথা তার শত্রুও বলবে না।

‘আমি এমনিও তোমার সাথে দেখা করতে আসতাম। আমি তোমার সাথে একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী। আমার গুপ্তচরেরা দক্ষিণ থেকে খবর নিয়ে এসেছে যে মালিক আম্বার নতুন করে আবার সৈন্য সংগ্রহ করছে। আমি ভেবেছিলাম আমরা তাকে উপযুক্ত শিক্ষা দিয়েছি কিন্তু তার ঔদ্ধত্য আর উচ্চাকাঙ্খর–দাক্ষিণাত্যের সেইসব রাজাদের মত যাঁদের পক্ষে সে লড়াই করছে–মনে হয় কোনো সীমা পরিসীমা নেই।’

‘আপনি কি আবারও খুররমকে পাঠাতে চান?

‘আমি সেটাই তোমার সাথে আলোচনা করতে চাই। সে গতবার যুদ্ধে ভালোই পারদর্শীতা প্রদর্শন করেছিল। আমি তাকে আবার পাঠাব সেটাই সে আমার কাছে আশা করবে কিন্তু আমি তাকে আবারও বিপদের মুখে ঠেলে দিতে আগ্রহী নই। আমি তাকে যতই দেখছি ততই একটা বিষয়ে আমি নিশ্চিত হচ্ছি যে আমার উত্তরাধিকারী হিসাবে তার নাম ঘোষণা করার এবং তাকে এখানে নিরাপদে রাখার সময় এসেছে। একটা সাম্রাজ্য কীভাবে পরিচালনা করতে হয় সে বিষয়ে আমার কাছে তাঁর অনেক কিছুই শিক্ষণীয় রয়েছে। আমার স্থলাভিষিক্ত হবার সময় হলে যা তাকে সাহায্য করবে। আমার আব্বাজানও যদি আমার জন্য এভাবে চিন্তা করতেন আর আমি আমার আব্বাজানের ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে চাই না।’

 মেহেরুন্নিসা দ্রুত চিন্তা করে। তাঁর সহজাত প্রবৃত্তি তাকে চিৎকার করে বলছে জাহাঙ্গীর আর খুররমকে পরস্পরের এতটা কাছাকাছি আসবার সুযোগ দেয়া তাঁর মোটেই উচিত হবে না। খুররমের যদিও আরজুমান্দের সাথে বিয়ে হয়েছে যার প্রতি সে ভীষণ অনুরক্ত এবং দু’জনের এমন নৈকট্যে তাঁর পরিবারই আখেরে লাভবান হলেও তাঁর নিজের কপালে এরফলে কেবলই দুর্ভোগ লেখা হবে। সে কোনোভাবেই এটা অনুমোদন করতে পারে না, কিন্তু সে কি বলবে? তারপরে তাঁর মাথায় একটা বুদ্ধি আসে। খুররমকে নিজের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে আপনার অনীহার কারণ আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু সে একজন গর্বিত তরুণ আর মালিক আম্বারকে মোকাবেলায় আপনি যদি তাকে পুনরায় প্রেরণ না করেন সে হয়তো অপমানিতবোধ করবে। সে শেষবার মালিক আম্বারকে বন্দি বা হত্যা করতে তার ব্যর্থতার প্রতিদান হিসাবে বিষয়টা বিবেচনা করতে পারে।

‘তো তুমি সত্যিই বিশ্বাস করো আমার তাকে পাঠানো উচিত?

 ‘হ্যাঁ। তাঁর জন্য, আবিসিনিয়ার অধিবাসীর সাথে বোঝাপড়াটা একটা অসমাপ্ত অধ্যায় আমি তাকে এমনটাই বলতে শুনেছি–এবং অন্য যেকোনো পদক্ষেপ কেবল তার মর্যাদাহানিই ঘটাবে। আর সে যখন ফিরে আসবে–আমি তার ফিরে আসবার ব্যাপারে নিশ্চিত, যদি তার নিজের জীবন ঝুঁকির সম্মুখীন না করার নির্দেশ আপনি তাকে দেন–ইতিমধ্যে তাকে আপনার উত্তরাধিকারী হিসাবে মনোনীত করবার বিষয়ে চিন্তা করার জন্য প্রচুর সময় পাওয়া যাবে। আপনার নিজেরই এখনও এমন কোনো বয়স হয়নি–এহেন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বিবেচনা করার জন্য এখনও আপনার হাতে প্রচুর সময় রয়েছে। আপনার অন্য সন্তানদের কথা আপনার ভুলে যাওয়া উচিত হবে না এবং খুররমের প্রতি আপনি যদি এতটা পক্ষপাত প্রদর্শন করেন তাহলে তাদের মনের অবস্থা কেমন হতে পারে সেটাও একটা ভেবে দেখার বিষয়।’

 ‘পারভেজ একটা মাথামোটা নির্বোধ আর বেহেড মাতাল। সে নিশ্চয়ই খসরুর চেয়ে বেশি সিংহাসন প্রত্যাশী নয়।

 ‘কিন্তু শাহরিয়ার। সে দ্রুত বেড়ে উঠছে এবং তাঁর চৌকষ হয়ে উঠার বিষয়ে আমি অনেক উৎসাহব্যঞ্জক কথা শুনতে পাই। সবাই বলে যে সে একজন দক্ষ ঘোড়সওয়ার এবং তীর-ধনুক বা গাঁদাবন্দুক দুটোতেই তাঁর নিশানা কখনও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না।

জাহাঙ্গীর মুচকি হাসে। তুমি দেখছি আমায় লজ্জায় ফেলে দিলে। আমাকে আমার নিজের সন্তানের সম্ভাবনা সম্বন্ধে তোমায় কিছু বলতে হবে না। আমি মানছি শাহরিয়ারের সাথে আমার কালেভদ্রে দেখা হয়।’

 ‘আপনার দেখা উচিত। আপনি তাহলে নিজেই তাকে যাচাই করতে পারবেন।

জাহাঙ্গীর মনে মনে ভাবে, মেহেরুন্নিসা বরাবরের মত ঠিকই বলেছে। উত্তরাধিকারী ঘোষণা করার জন্য এত তাড়াহুড়ো করার আসলেই কোনো প্রয়োজন নেই। আর সে এটাও ঠিকই বলেছে যে মালিক আম্বারের সাথে বোঝাপড়া করার জন্য তাঁর খুররমকেই সুযোগ দেয়া উচিত।

‘তোমার সহজাত প্রবৃত্তি বরাবরের মত এবারও অভ্রান্ত। তুমি পরিস্থিতি এত পরিষ্কার বিশ্লেষণ করতে পারো।

 ‘আমি কেবল আপনাকে সাহায্য করতে চাই। আর খুররম তাঁর অভিযানে রওয়ানা দেয়ার পরে আমি একটা ভোজসভার আয়োজন করে শাহরিয়ারকে আমন্ত্রণ জানাব যাতে আপনি নিজের চোখে দেখতে পান সে কত বড় হয়ে উঠেছে। আর সেদিন লাডলিকেও হয়তো আমি আমাদের সাথে যোগ দিতে বলতে পারি। মেয়েরা দ্রুত বড় হয়ে যায় এবং সেও দিনে দিনে রূপবতী আর গুনবতী হয়ে উঠছে। আমার মনে হয় তাঁর সঙ্গ আপনার ভালোই লাগবে।’

‘তবে তাই করো। কিন্তু কাজের কথা অনেক হয়েছে। তুমি আমার মনকে যথারীতি প্রশান্ত করেছে। এবার এসো দেহের উৎসবে আমরা নিজেদের ভাসিয়ে দেই। সে কথা শেষ করার আগেই আলতো করে তার গভীর-গলার কাচুলির কোরালের বোতাম খুলতে আরম্ভ করে এবং তাঁর চোখের তারায় সম্মতির আলো ফুটে উঠতে দেখে মুচকি হাসে। জাহাঙ্গীর কেবল মেহেরুন্নিসার এবং তাঁর জন্য কেবল সে জন্মেছে এবং কোনো কিছু বা কারো তাঁদের মাঝে আসা উচিত হবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *