১.১০ ‘পৃথিবীর অধিশ্বর’

১.১০ ‘পৃথিবীর অধিশ্বর

আগ্রার সাড়ে চারশ মাইল দক্ষিণপশ্চিমে, বুরহানপুরের বেলেপাথরের তৈরি দূর্গ-প্রাসাদের সম্পূর্ণ অবয়ব প্রশস্ত তপতী নদীর শান্ত জলস্রোতে প্রতিফলিত হয়। খুররম শহরটায়-দাক্ষিণাত্যে মোগল নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত–মাসখানেক পূর্বে এসেছিল এবং এখন মালিক আম্বারের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযান শুরুর বাসনায় কৃতসংকল্প হয়ে পুনরায় শহরটা ত্যাগ করছে। চারতলা বিশিষ্ট হাতির আস্তাবল, হাতিমহল থেকে বাকান ঢালু পথ দিয়ে যূথবদ্ধ হস্তিবাহিনী একপাশে প্রসারিত হয়ে অংশত আবৃতকারী ইস্পাতের বর্মে সজ্জিত হয়ে দূর্গের পাশে অবস্থিত কুচকাওয়াজ ময়দানে সমবেত হতে শুরু করেছে। তাঁদের মাহুতেরা সেখানে জম্ভগুলোর কানের পেছনে বসে, তাদের হাতে থাকা লোহার লোহার দণ্ড দিয়ে অতিকায় প্রাণীগুলোর কানের পিছনে আলতো করে টোকা দিতে তারা হাঁটু ভেঙে বসে পড়লে অন্য সহকারীরা তাঁদের পিঠে গিল্টি করা হাওদা স্থাপন করছে। হাওদাগুলো চামড়া ফালি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা হতে খুররমের প্রধান সেনাপতিরা তাদের কর্চি আর দেহরক্ষীদের নিয়ে সেখানে চার হাত পায়ের সাহায্যে উঠে বসছে, প্রতিটা হাওদায় সাধারণত তিনজন আরোহণ করছে কিন্তু বড় হাতির ক্ষেত্রে সংখ্যাটা চার। ঘর্মাক্ত দেহে কেবলমাত্র সাদা লেঙ্গট পরিহিত অবস্থায় শ্রমিকের দল অন্য হাওদাগুলোয় ছোট ছিদ্রব্যাসের কামান, গজনল তুলছে।

সবার প্রস্তুতি সম্পন্ন শেষ হতে দূর্গের প্রধান তোরণদ্বার খুলে যায় এবং সেখান দিয়ে খুররমের নিজের রণহস্তী বাইরে বের হয়ে আসে। অন্য যেকোনো হাতির চেয়ে বৃহদাকৃতি, এর পিঠে সবুজ চাঁদোয়া বিশিষ্ট একটা হাওদা যেখানে খুররম ইতিমধ্যেই, মাথায় সোনালী গিল্টি করা শিয়োস্ত্রাণ আর ফিরোজা খচিত কারুকাজ করা ইস্পাতের বর্ম পরিহিত অবস্থায় যুদ্ধের জন্য নিখুঁতভাবে সজ্জিত হয়ে, অবস্থান গ্রহণ করেছে। আরো চারটা হাতির একটা দল তাকে অনুসরণ করে। প্রথম হাতিটার হাওদার চারপাশ কারুকাজ করা মসলিনের পর্দা সোনালী ফিতে দিয়ে শক্ত করে বাঁধা রয়েছে আরজুমান্দ বানুকে কোনো ধরনের কৌতূহলী দৃষ্টি থেকে আড়াল করতে; অবশিষ্ট তিনটা হাতির প্রতিটায় চারজন করে কমলা-পাগড়ি পরিহিত রাজপুত যোদ্ধা রয়েছে, খুররমের দেহরক্ষীদের ভিতরে সবচেয়ে বিশ্বস্ত, তার আদেশ অনুযায়ী আরজুমান্দকে যেকোনো ধরনের অপমানের হাত থেকে তারা নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে রক্ষা করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। চৌকষভাবে অস্ত্র সজ্জিত প্রত্যেক রাজপুত যোদ্ধার সাথে সর্বাধুনিক গাদাবন্দুক ছাড়াও রয়েছে অপেক্ষাকৃত কম প্রাণঘাতি কিন্তু দ্রুত নিক্ষেপযোগ্য তীর আর ধুনক এবং অবশ্যই তরবারি। সযত্ন চর্চিত চওড়া গোফের আড়ালে তাদের মুখে কঠোর একটা অভিব্যক্তি ফুটে রয়েছে। তোরণদ্বারের পাশে সমবেত হওয়া অল্প সংখ্যক মানুষের ভীড়ে সামান্যতম ঝামেলার ইঙ্গিত পেতে, মোগল বাহিনীকে নেতৃত্ব শূন্য করতে বা তাঁদের নেতাকে তার সুন্দরী স্ত্রীর সাহচর্য বঞ্চিত করতে ওঁত পেতে থাকা সম্ভাব্য আততায়ীল সন্ধানে যাকে হয়ত মালিক আম্বার পাঠিয়েছে, তারা সতর্ক দৃষ্টিতে এখনও আবেক্ষণ করছে। সমবেত জনতার মাঝে অবশ্য কেবল ভক্তি ভরে মাথা নত করা আর খালি হাতে হাততালি দেয়া আর হাত নেড়ে বিদায় জানানোই চোখে পড়ে।

খুররম, আরজুমান্দ আর তাদের দেহরক্ষীদের বহনকারী হাতির পেছনে অন্য রণহস্তীগুলো এবার বিন্যস্ত হয়। পুরো দলটা একসাথে কাঠের মালবাহী ভারি শকটে স্থাপিত সূক্ষ কারুকাজ করা ব্রোঞ্জের কামান আর সেগুলোর সাথে ইতিমধ্যে জোয়াল দিয়ে বাঁধা ষাড়ের পালের পাশ দিয়ে ধীরে ধীরে ধূলিধূসরিত কুচকাওয়াজ ময়দান অতিক্রম করে। সবচেয়ে বড় কামানগুলো টেনে নেয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত দলগুলোয় সর্বোচ্চ সংখ্যক ত্রিশটি ষাড় রয়েছে সবগুলোর শিং মোগল বাহিনীর স্মারক সবুজ রঙে রঞ্জিত, প্রতি তিনটা পশুর জন্য রয়েছে একজন করে চাবুকধারী গাড়োয়ান যাতে কেউ নিজেদের কাজে অবহেলা করতে না পারে। কামানবাহী শকটগুলোর মাঝে মাঝে রয়েছে আট চাকাবিশিষ্ট উট বা খচ্চর বাহিত গোলা-বারুদ বহনকারী শকট, কামানের জন্য যেগুলোতে বারুদের বস্তা রয়েছে, বৃষ্টি আর আদ্রতার হাত থেকে রক্ষা করতে বাগুলো পানিনিরোধক বস্ত্র দিয়ে ভালো করে আবৃত করা রয়েছে আর বস্তাগুলোর পাশেই রয়েছে পাথরের অথবা লোহার তৈরি কামানের গোলা।

 খুররম আর তাঁর সঙ্গীদের বহনকারী হাতির বহর অবশেষে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তার উৎকৃষ্ট অশ্বারোহীদের বারো জনের আড়াআড়িভাবে বিন্যস্ত একটা সেনাপুরঃসর অগ্রদলের পেছনে নির্ধারিত স্থান গ্রহণ করে এবং খুররমের আদেশে তাদের প্রত্যেকের পরনে একই ধরনের সোনালী কাপড়ের পোষাক সাথে একই কাপড় দিয়ে তৈরি পাগড়ির শীর্ষভাগে সারসের লম্বা সাদা পালক পতপত করে উড়ছে। গাঢ় বর্ণের ঘোড়া তাদের সবাইকে বহন করছে এবং তাদের বর্শার অগ্রভাগে সবুজ আর সোনালী রঙের নিশান উড়ছে। আমি একটা বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত মালিক আম্বার যখন গুপ্তচর মারফত আমাদের সৈন্য সজ্জার সংবাদ জানতে পারবে, খুররম তার পাশে অবস্থানরত কর্চির উদ্দেশ্যে বলে, সে অনুধাবন করবে একজন সেনাপতি অস্ত্র আর রসদের সংস্থান ছাড়াও জনসমক্ষে নিজেদের উপস্থাপনের মত খুটিনাটি ব্যাপারেও যার মনোযোগ রয়েছে এমন একজনকে তাঁর ভয় পাওয়া উচিত। তারপরে, গর্ব আর আত্মবিশ্বাসে ভরপুর খুররম চিৎকার করে অগ্রসর হবার আদেশ দেয়। দূর্গের প্রাকার থেকে ব্রোঞ্জের তূর্য ধ্বনি ভেসে আসবার সাথে সাথে সেনাপুরঃসর অগ্রদলের মাঝ থেকে অশ্বারূঢ় তূর্যবাদকেরা প্রত্যুত্তর দেয়। তোরণগৃহ থেকে দশ ফুট পরিধির বিরাটাকৃতি নাকাড়াগুলো মন্দ্র শব্দে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয় এবং অশ্বারোহী বাদকদলের লোকেরা ঘোড়ার পিঠের দু’পাশে ঝোলানো ঢাকে সংবদ্ধ বোল বাজাতে শুরু করলে এর সাথে সঙ্গতি রেখে সৈন্যবাহিনীর সারিগুলো ধীরে ধীরে গতিশীল হয়ে উঠে।

দক্ষিণে তপতীর বালুকাময় তীরের দিকে এবং দূর্গ থেকে দূরে বহরটা এগিয়ে যেতে শুরু করলে আরও অশ্বারোহী বাহিনী তাদের সাথে এসে যোগ দেয় আর তারপরে যোগ দেয় নিম্নমানের চলনসই পোষাক পরিহিত কিন্তু তারপরেও পর্যাপ্ত অস্ত্র সজ্জিত পদাতিক বাহিনীর সারি। এঁদের পেছনে থাকে মূল মালবাহী বহরের বিভিন্ন আকৃতির শকট। সবশেষে, যখনই কোনো সেনাবাহিনী যাত্রা আরম্ভ করে, যারা পূর্বে গমন করেছে তাঁদের বাহনের খুর থেকে উত্থিত ধুলার মাঝে কাশতে কাশতে আসে সৈন্যদের প্রয়োজনীয় সেবা করতে উদ্গ্রীব সেনাছাউনি অনুসরণকারী বিশৃঙ্খল আর উচ্ছঙ্খল জনতার একটা দল এবং অস্থায়ী ছাউনিতে তারাই মনোরঞ্জন আর বিশ্রামের সুযোগ করে দেয়। যাত্রার কারণে ক্ষয়ে যাওয়া জুতো আর নতুন পোষাক তৈরি করার জন্য বহরের সাথেই রয়েছে দর্জি আর মুচির দল। তাদের সাথে আরো রয়েছে মিষ্টান্ন বিক্রিকারী হালুইকর আর সুরা বিক্রেতা। তাদের ভিতরে রয়েছে আগুন খেকোর দল, দড়াবাজ আর জাদুকরের পাশাপাশি রয়েছে আত্মমগ্ন দরবেশের একটা দল। প্রাতিজনিক প্রবোধ আর বিমুক্তি দেয়ার জন্য সৈন্যসারির সাথে যোগ দেয় অগণিত বেশ্যা, তাঁদের সবাই দেখতে সুন্দরী বা অল্পবয়সী নয় কিন্তু একবেলার ডাল ভাতের মূল্যের বিনিময়ে তাঁরা নিজেদের দেহ বিক্রি করতে উদ্গ্রীব।

*

খুররম ছয় সপ্তাহ পরে হেরেমের নির্ধারিত তাবুতে আরজুমান্দের সাথে একই শয্যায় শুয়ে থাকা অবস্থায় সে চোখ খুলে এবং দেখে ইতিমধ্যেই তার ঘুম ভেঙেছে। সে তাকে নিজের বাহুর মাঝে আলিঙ্গণ করে, দিনের লড়াইয়ের সময়ে সাবধানতা অবলম্বনের জন্য তার কাছে মিনতি করে। সে সতর্ক থাকবে বলে তাকে প্রতিশ্রুতি দেয় এবং আশ্বস্ত করে মালিক আম্বারের বাহিনীকে দুর্বল করতে সে কেবল তাদের উপরে একটা ঝটিকা আক্রমণ পরিচালনার পরিকল্পনা করেছে, সে তাঁর উষ্ণ অধর চুম্বন করে। সে তারপরে আলতো করে নিজেকে তাঁর আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করে এবং শয্যার কারুকাজ করা নীল পশমের আচ্ছাদনী একপাশে সরিয়ে দেয়। সে উঠে দাঁড়ায়, নিজের নগ্ন পেষল দেহে সবুজ রেশমের একটা আলখাল্লা জড়িয়ে নেয় এবং ভোরের প্রথম আলো অস্থায়ী শিবিরের চারপাশের নিচু পাহাড়ী এলাকাকে সোনালী আভায় গিলটি শুরু করার মুহূর্তে সে মাথা নিচু করে দ্রুত হেরেমের তাবু থেকে বের হয়ে আসে। ভোরের শীতল তাজা বাতাসে শ্বাস নেয়ার জন্য কয়েক মুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে সে পার্শ্ববর্তী একটা তাবুর দিকে এগিয়ে যায় যেখানে তার কচিঁ যুদ্ধের উপযুক্ত পোষাকে সজ্জিত হতে তাকে সাহায্য করার জন্য অপেক্ষা করছে। খুররম দ্রুত নিজের কারুকাজ করা বক্ষস্থল রক্ষাকারী বর্ম বেঁধে নেয় এবং তাঁর গলাকে সুরক্ষিত রাখতে লোহার জালির তৈরি সঞ্জাবযুক্ত তাঁর চূড়াকৃতি শিরোস্ত্রাণ পরিধান করে। সে মশলা দিয়ে তন্দুরে ঝলসান মুরগী আর গরম দুটো নান দিয়ে দ্রুত প্রাতরাশ সমাপ্ত করে, তারপরে তার কালো ঘোড়ায় আরোহণ করে এবং যেখানে তার শ্রেষ্ঠ অশ্বারোহী যোদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠিত প্রায় পাঁচ হাজারের একটা আক্রমণকারী বাহিনী অপেক্ষা করছে সেদিকে দেহরক্ষী পরিবেষ্টিত অবস্থায় এগিয়ে যায়, আক্রমণ শুরু করার জন্য মুখিয়ে থাকায়, তাঁদের বাহনগুলো অস্থির ভঙ্গিতে মাটিতে খুর দিয়ে আঘাত করছে।

‘যাত্রা করা যাক, সে তার অশ্বারোহী বাহিনী স্থূলকায় তরুণ সেনাপতি কামরান ইকবালকে বলে এবং তাঁরা যাত্রা শুরু করে। খুররম তার শিবিরের বহিঃসীমানার শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যুহের ভিতর দিয়ে অতিক্রম করার সময় সে শেষবারের মত দীর্ঘক্ষণ হেরেমের তাবুর দিকে তাকিয়ে থাকে। আরজুমান্দ সেখানে রয়েছে বলে সে খুশি। গতরাতে, আজকের সকালের এই আক্রমণ পরিকল্পনা চূড়ান্ত হবার পরে, আরজুমান্দের প্রশান্ত উপস্থিতি তাঁর দেহমন শমিত করতে সহায়তা করেছে এবং আজকের যুদ্ধ পরিস্থিতির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে সে খানিকটা ঘুমিয়ে নিতে পেরেছে। সে কালো ঘোড়ার পাজরে গুঁতো দিয়ে রুক্ষ পল্লীপ্রান্তরের উপর দিয়ে নিজের লোকদের নিয়ে প্রায় বারো মাইল দূরে অবস্থিত নির্দিষ্ট স্থানের দিকে এগিয়ে যায় যেখানে, যদি তার গুপ্তদূতদের অনুমান সঠিক হয়ে থাকে, আজ সকালের মাঝামাঝি কোনো একটা সময়ে মালিক আম্বারের বাহিনীর উপস্থিত হবার কথা।

খুররম সকাল প্রায় নয়টা নাগাদ একটা নিচু রিজের ছায়ায় তাঁর লোকদের নিয়ে যাত্রা বিরতি করে যা তাঁর অনুমিত দিক থেকে যদি মালিক আম্বারের লোকের অগ্রসর হয় তাহলে তাকে তাদের দৃষ্টিপটের আড়ালে রাখবে। সে গিল্টি করা ভঁজু-অগ্রভাগ বিশিষ্ট পর্যাণের উপর থেকে পিছলে মাটিতে নেমে এসে রিজের শীর্ষদেশের দিকে দ্রুত দৌড়ে যায়। শীর্ষের কাছাকাছি পৌঁছাবার ঠিক আগ মুহূর্তে সে পেটের উপর ভর দিয়ে মাটিতে সটান শুয়ে পড়ে এবং উঁকি দেয়। তার কয়েকজন সেনাপতি অচিরেই তার সাথে এসে যোগ দেয়। কয়েকটা ছাগল ছাড়া কেউই নড়াচড়া করছে এমন আর কিছু খুঁজে পায় না। শঙ্কাকুল দৃষ্টিতে দিগন্ত তন্নতন্ন করে প্রায় পৌনে এক ঘন্টা আবেক্ষন করার সময় তার মাথার ভিতরে দুশ্চিন্তার ঝড় বইতে থাকে যে তার গুপ্তদূতেরা হয়তো কোথাও ভুল করেছে বা মালিক আম্বার কোনোভাবে তার অভিপ্রায়ের কথা জানতে পেরেছেন এবং গুপ্তদূতদের বিভ্রান্ত করে নিজের গতিপথ পরিবর্তিত করেছেন বা এমনকি মোগল ছাউনি হয়তো আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তারপরেও খুররমের দৃষ্টিতে কিছুই আটকায় না। সে নিজেই নিজের সাথে তর্ক করতে থাকে তার কি নিজের বাহিনীর একাংশ প্রেরণ করা উচিত শিবিরে সবকিছু ঠিক আছে কিনা দেখে আসবার জন্য কিন্তু শেষে আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়। সে দশ মিনিট পরে পরম স্বস্তির সাথে পূর্বদিকে ধূলোর একটা দেখতে পায়–মালিক আম্বার যেদিক থেকে আসবে বলে সে প্রত্যাশা করেছিল। তাঁর গুপ্তদূতের দলের একজন সদস্য কয়েক মিনিট পরেই, নিরাপদ দূরত্ব থেকে মালিক আম্বারের বাহিনীর উপর পর্যায়ক্রমে নজর রাখার জন্য যাদের আদেশ দেয়া হয়েছিল, তাঁর ঘর্মাক্ত হবার কারণে চিত্রবিচিত্র খয়েরী রঙের ঘোড়ায় চেপে হাজির হয়।

‘তারা কতদূরে অবস্থান করছে?’ খুররম জানতে চায়। গ্রীষ্মের দাবদাহের কারণে দূরত্বের ধারণা অনেক সময় ভ্রান্তিজনক হয়ে উঠে।

 ‘জাহাপনা, দুই কি তিন মাইল হবে।

 ‘আমি যা ভেবেছিলাম এটা তারচেয়েও কম। তাঁরা কি ধরনের ব্যুহ বজায় রাখছে?

‘তাদের মূল বাহিনী থেকে প্রায় সোয়া মাইল দূরে পুরো বাহিনীকে ঘিরে নিজেদের গুপ্তদূতেরা বৈরী প্রতিপক্ষের সন্ধানে ভ্রমণ করছে কিন্তু আমি যেখানে অবস্থান করছিলাম সেখান থেকে দেখে অবশিষ্ট বাহিনীকে আমার বেশ শমিত মনে হয়েছে। কামান আর বারুদবাহী শকটগুলো এখনও আচ্ছাদিত রয়েছে–এই বিষয়ে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত।

 ‘তার মানে আমরা এত কাছে থাকতে পারি সেটা তারা এখনও সন্দেহ করে নি?’

 ‘জাহাপনা, আমার সেটা মনে হয় না।’

 ‘বেশ, তাঁরা অচিরেই অবগত হবে, খুররম কথা বলে, রিজ থেকে নামার জন্য সে ইতিমধ্যেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সে চিৎকার করে নিজের সেনাপতিদের ডাকে, আমরা সরাসরি তাদের আক্রমণ করতে যাচ্ছি। সবাই মনে রাখবেন তাঁদের কামানগুলো অকেজো করে দেয়াই আমাদের লক্ষ্য। আমরা তাঁদের যতবেশি সংখ্যক কামান ধ্বংস বা অকেজো করে দিতে পারবো আমরা আমাদের শত্রুর লড়াই করার ক্ষমতা ততবেশি হ্রাস করতে পারবো।’

খুররম সোয়া ঘন্টা পরে নিজের বাহিনীর পুরোভাগে অবস্থান করে মালিক আম্বারের সৈন্যসারির দিকে আস্কন্দিত বেগে ঘোড়া হাকিয়ে এগিয়ে যায়। শুষ্ক মাটির বুকে ঘোড়ার খুরের আঘাতে ঢাকের বোল উঠে আর ছিটকে উঠা ধূলিকণা তাঁদের সওয়ারীর চোখে বিদ্ধ হয় এবং তাঁদের নাক মুখ ধূলোয় কিচকিচ করতে থাকে। খুররম মৃত্যুদায়ী অভিপ্রায়ে অগ্রসর হবার সময় চারপাশ অন্ধকার করে থাকা ধূলোর মেঘের ভিতর দিয়ে দেখতে পায় যে মালিক আম্বারের লোকেরা এতক্ষণে বিপদ বুঝতে পেরেছে। অশ্বারোহী যোদ্ধারা আক্রমণ প্রতিহত করতে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিতে শুরু করে আর তোপচিরা হন্তদন্ত হয়ে কামানের উপর থেকে আবরণ সরাতে থাকে আর কামানের মুখ প্রতিপক্ষের দিকে ঘোরাবার জন্য ষাড়ের পালকে নির্বিচারে চাবুক দিয়ে আঘাত করতে থাকে, যখন অন্যেরা গোলাবারুদ বহনকারী শকট থেকে কামানের গোলা আর বারুদের বস্তা টেনে নামায়। তীরন্দাজেরা রণহস্তীর হাওদায় অবস্থান গ্রহণের জন্য বেয়ে উঠতে থাকে। তবকীরা তাঁদের বন্দুকগুলোকে প্রস্তুত করে এবং সেগুলোর দীর্ঘ ব্যারেল তেপায়ার উপর স্থাপন করে যাতে করে আরো নিখুঁতভাবে নিশানাভেদ করা যায়। খুররম আরো দেখতে পায় সূর্যের আলোয় ঝকঝক করতে থাকা বক্ষস্থল আবৃতকারী বর্ম পরিহিত একদল লোক সৈন্যব্যুহের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ব্যস্তভাবে ঘোড়া নিয়ে ছোটাছুটি করছে। তারা সম্ভবত মালিক আম্বার আর তার আধিকারিকেরা, সৈন্যদের উৎসাহ জোগাচ্ছে আর প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিচ্ছে।

আকাশের বুক চিরে ঝাঁকে ঝাঁকে তীর তাঁর বল্পিত গতিতে ধাবমান লোকদের উপরে আছড়ে পড়তে শুরু করে। তাঁর কানের পাশ দিয়ে গাদাবন্দুকের গুলি মৃত্যুর শিস বাজিয়ে যায় আর মালিক আম্বারের প্রতিরক্ষা ব্যুহ থেকে আলোর ঝলকানি আর সাদা ধোয়ার কুণ্ডলী দেখা যেতে বোঝা যায় যে শত্রুপক্ষের গুটিকয়েক তবকি এখন অন্তত গুলিবর্ষণ শুরু করেছে। সে এর কিছুক্ষণ পরেই আরো মন্দ্র একটা অভিঘাত আর উত্তাল তরঙ্গের ন্যায় ধোয়ার কুণ্ডলী উঠতে দেখলে তার মাঝে সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকে না যে এইমাত্র মালিক আম্বারের একটা কামানও যুদ্ধে যোগ দিয়েছে। খুররম দশ গজেরও কম দূরত্বে তাঁর সামনের সারির একজন যোদ্ধাকে–এক তরুণ রাজপুত নিশানা বাহক–তার পর্যাণ থেকে পেছনের দিকে ছিটকে মাটিতে আছড়ে পড়তে দেখে, হতভাগ্য অশ্বারোহী ভূপাতিত হবার সময় তার হাত থেকে সবুজ রঙের মোগল নিশানা ছিটকে যায়। তাকে অনুসরণরত–আরেকজন রাজপুত–অশ্বারোহীর বাহন ভূপাতিত দেহের কারণে হুমড়ি খায় এবং তারপরে নিশানের সাথে পা জড়িয়ে যেতে এটাও মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে, তাঁর রাজপুত সওয়ারীকে মাথার উপর দিয়ে মাটিতে ছিটকে ফেলে এবং তারপরে আরো একটা ঘোড়াকে তার আরোহীসহ ধূলোয় ফেলে দেয়। খুররম ভাবে, মালিক আম্বারের সৈন্যসারি আর মাত্র সোয়া মাইল দূরে রয়েছে। এই দূরত্ব অতিক্রম করতে যে সময় প্রয়োজন সেই অবসরে শত্রুপক্ষ খুব বেশি একটা ক্ষতিসাধন করতে পারবে বলে তার কাছে মনে হয় না। সে তার ঘোড়ার গলার কাছে সহজাত প্রবৃত্তির বশে নুয়ে এসে, সে মালিক আম্বারের কামানের অবস্থান অভিমুখে আরো সরাসরি অগ্রসর হবার অভিপ্রায়ে লাগামে মোচড় দেয় এবং ছোটার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকা কালো ঘোড়ার পাজরে দিনের প্রথমবারের মত গুঁতো দেয়।

 সে এরপরেই নিজেকে মালিক আম্বারের সৈন্যসারির মাঝে নিজেকে দেখতে পেয়ে, কামানগুলোকে সুরক্ষিত রাখতে সেগুলোর কয়েক গজ সামনে একটা ব্যুহ রচনা করে নিজের সহযোদ্ধাদের সাথে অবস্থানরত বেগুনী রঙের পাগড়ি পরিহিত এক তবকীর উদ্দেশ্যে তরবারি কোপ বসিয়ে দেয়। সে ইতিমধ্যে একবার গুলি করেছে এবং সে বন্দুকে পুনরায় গুলি ভর্তি করতে তাঁর পাশে সীসার গুলিভর্তি সাদা সুতির থলে থেকে একটা গুলি নিয়ে ইস্পাতের দণ্ডের সাহায্যে লম্বা ব্যারেলে প্রবেশ করাতে মরীয়া হয়ে চেষ্টা করছে। সে তাঁর আরাধ্য কাজ আর কখনও শেষ করতে পারবে না। খুররমের তরবারি, সেদিন সকালেই অস্ত্রাগারের তত্ত্বাবধায়ক নিখুঁতভাবে শান দিয়ে ধারালো করে তুলেছে, তবকীর মুখের একপাশে আঘাত হেনে বেচারার চোয়াল প্রায় বিচ্ছিন্ন করে তার সাদা দাঁতের সারি অনাবৃত করে ফেলে। হাতের বন্দুক ফেলে দিয়ে লোকটা মাটিতে পড়ে যেতে খুররম পেছনের দিকে একবারও না তাকিয়ে সামনের কামান আর গোলাবারুদবাহী শকটের দিকে দেহরক্ষী পরিবেষ্টিত অবস্থায় দিকে ছুটে যায়। খুররমের অবস্থান থেকে মাত্র দশ গজ দূরে একটা কামান কানে তালা ধরিয়ে দেয়া শব্দ আর সাদা ধোয়ার মেঘ সৃষ্টি করে গোলাবর্ষণ করে। খুররমের আরেকজন দেহরক্ষীর উদরে গিয়ে গোলাটা আঘাত করতে তার দেহের উপরের অংশ নিমেষে স্থানচ্যুত হয় আর তার রক্তাক্ত ঘোড়াটা সহসা তাল হারিয়ে আরেক দিকে দৌড়ে যায় তখনও তার দেহের নিচের অংশ পর্যাণে বসে রয়েছে।

বারুদের ঝাঁঝালো ধোঁয়ায় কাশতে শুরু করে, তার কান ভোঁ-ভোঁ করতে থাকে, খুররম তার ঘোড়াকে পুনরায় সামনের দিকে অগ্রসর হবার ইঙ্গিত করে, আরেকজন তোপচীকে লক্ষ্য করে তরবারি চালায় যে পাথরের অসম্ভব ভারি কামানের একটা গোলার ওজনে নুয়ে প্রায় বাঁকা হয়ে গিয়ে নিজের অস্ত্রের দিকে যাবার জন্য প্রাণান্তকর পরিশ্রম করছে। পিঠে আঘাত প্রাপ্ত হতে, লোকটার হাত থেকে পাথরের গোলাটা পড়ে যায় এবং তার সাদা রঙের নোংরা জোব্বাটা রক্ত শুষে নিতে থাকলে, সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এক মিনিট বা সম্ভবত তারও কম হবে–যুদ্ধক্ষেত্রে সময় যেন সহসাই স্থবির হয়ে উঠে–খুররম সৈন্যসারির অন্যপাশে পৌঁছে যায়। নিজের চারপাশে তাকিয়ে সে দেখতে পায় যে আরো অনেক তোপচি হাতের ইস্পাতের দণ্ড ফেলে দিয়ে নিজের অবস্থান পরিত্যাগ করে দৌড়ে পালাতে শুরু করেছে। অধিকাংশের প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয় যেহেতু তাঁর অনুগত অশ্বারোহী যোদ্ধারা তাদের তরবারি নিয়ে পেছন থেকে তাঁদের উপর চড়াও হয় তারা দৌড়াতে করায় বা বর্শা দিয়ে তাদের গেঁথে ফেলে।

খুররমের লোকজন দ্রুত তার চারপাশে সমবেত হতে আরম্ভ করে। ‘তোমাদের ভিতরে যাঁদের কীলক বিতরণ করা হয়েছে সেগুলো কামানের পশ্চাদভাগে সর্বশক্তি দিয়ে ঢুকিয়ে দেবে, সে আদেশ দেয়। যাদের কাছে কাঠের ছোট হাতুড়ি রয়েছে তারা চেষ্টা করবে কামানের সম্মুখভাগের বহনকারী শকটের চাকাগুলো ভেঙে দিতে। আর যাদের উপরে বারুদের চিহ্নরেখা তৈরি করে বারুদ বহনকারী শকটগুলো গুঁড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তারা আমরা প্রস্থান করার সাথে সাথে কাজ শুরু করে দেবে। তোমাদের কাজের সময়ে মালিক আম্বারের লোকদের আমরা বাকি যারা রয়েছি তারা ব্যস্ত রাখবো।

তার সৈন্যরা ঘোড়া থেকে নেমে যখন কাজ শুরু করবে খুররম একটা তূর্যধ্বনি শুনতে পায় এবং পোয়র স্রোতের মাঝে বিদ্যমান একটা ফাঁক দিয়ে–সে ইতিমধ্যেই বুঝতে পেরেছে যা রণক্ষেত্রকে এমন বিভ্রান্তিকর স্থানে পরিণত করে–সে মালিক আম্বারের বিশৃঙ্খল সৈন্যসারির পেছন থেকে তাঁর একদল অশ্বারোহীকে আবির্ভূত হতে দেখে এবং কৃতসংকল্প ভঙ্গিতে তাঁরই অবস্থানের দিকে হামলা করতে এগিয়ে আসতে দেখে। ‘এসো, আমরা তাঁদের মুখোমুখি হই,’ খুররম চিৎকার করে এবং তাঁর কালো ঘোড়াকে সামনে অগ্রসর হতে ইঙ্গিত করে।

সে আর তার লোকেরা তাদের ঘোড়াগুলোকে বল্পিত বেগে ধাবিত করার পূর্বেই শত্রু সৈন্য তাদের আক্রমণ করে। খুররমকে দেখে মনে হয় চিনতে পারায়, প্রতিপক্ষের গাট্টাগোট্টা দেখতে এক যোদ্ধা যে শিরোস্ত্রাণ পরার কিংবা বর্মে সজ্জিত হবার সময় পায়নি তার দিকে সরাসরি এগিয়ে যাবার জন্য লাগাম ধরে টান দেয়। খুররম তার ঘোড়াকে চক্রাকারে ঘোরায়, জটা এখন নিজের পূর্ববর্তী যুদ্ধ প্রয়াসের কারণে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে, তার মুখোমুখি হতে। তাঁর প্রতিপক্ষ অবশ্য আঘাত করার প্রথম সুযোগ লাভ করে, খুররমের বক্ষ আবৃতকারী বর্ম লক্ষ্য করে সে হাত দুলিয়ে নিজের বাঁকানো তরবারি নামিয়ে আনতে আঘাতটা নিশানা ভেদ করে আর তারপরে ইস্পাতে প্রতিহত হতে, খুররমও ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে ফলে তাঁর প্রথম আঘাতও বিফলে যায়, প্রতিপক্ষের যোদ্ধা মাথা নিচু করতে তরবারিটা উপরের বাতাস কেটে বের হয়ে যায়। কিন্তু খুররম তারপরেই, দ্রুত ভারসাম্য লাভ করে, পুনরায় তরবারি দিয়ে আঘাত করে, তাঁর তরবারির ক্ষুরধার ফলা লোকটার বুকের লম্বালম্বি হাড়ের ঠিক নিচে তাঁর স্ফীত আর অরক্ষিত উদরের গভীরে আঘাত হানে। সে অস্ত্র আর লাগাম ছুঁড়ে ফেলে এবং নিজের ক্ষতস্থান খামচে ধরে লোকটা তার ঘোড়া থেকে পাথরের মত খসে পড়ে, জটা তার প্রবল ভার থেকে মুক্ত হতেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা পরিহার করে সেখান থেকে দ্রুত অন্যদিকে ধাবিত হয়।

খুররম আক্রমণের আকষ্মিকতা শেষে জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে দম ফিরে পাবার চেষ্টা করার সময়ে নিজের চারপাশে তাকিয়ে দেখে যে মালিক আম্বারের যোদ্ধারা ক্রমশ আরো বেশি সংখ্যায় লড়াইয়ে যোগ দিচ্ছে এবং সেই সাথে এটাও লক্ষ্য করে যে তার পক্ষের বেশ কয়েকজন সৈন্য মাটিতে আহত বা নিহত অবস্থায় হাত পা ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে। সে যেমন আশা করেছিল তাঁদের এই ঝটিকা আক্রমণ ঠিক ততটাই সফল হয়েছে, মালিক আম্বারের যুদ্ধ উপকরণ আর তার শক্তি অনেকটাই তাঁরা আজ হ্রাস করেছে। তাদের অভিপ্রায় এখন যখন অর্জিত হয়েছে তখন এটাই উপযুক্ত সময় তাঁর আর তার অনুগত লোকদের নিরাপদে পশ্চাদপসারণ করা যখন তারা সেটা করতে পারবে। যথেষ্ট হয়েছে, সবাই এখনই ঘোড়ায় চাপো, কামানগুলো অকেজো করা যারা প্রায় শেষ করে ফেলেছে তাদের উদ্দেশ্যে সে চিৎকার করে। আহত কিংবা ঘোড়া হারিয়েছে এমন প্রত্যেককে তুলে নাও আর একটা ঘোড়ায় দু’জন আরোহণ করো কিন্তু তোমরা যখন স্থান ত্যাগ করবে তখন বারুদ বহনকারী শকটের চারপাশে তোমাদের সৃষ্ট বারুদের চিহ্নরেখায় অবশ্যই মনে করে অগ্নি সংযোগ করবে।

 সে তার পদাতিক হিসাবে দায়িত্ব পালনরত সৈন্যদের হুড়োহুড়ি করে নিজেদের বাহনের পর্যাণে আরোহণ করতে, সহযোদ্ধাদের পেছনে তুলে নেয়ার সময় সে তাকিয়ে থাকে। দীর্ঘদেহী এক রাজপুত আহত একজন সহযোদ্ধাকে নিজের ধুসর ঘোড়ায় তুলে নেয়া জন্য প্রাণান্ত হচ্ছে তখনই শূন্য থেকে মৃত্যু মুখে নিয়ে দুটো তীর অল্প সময়ের ব্যবধানে নেমে এসে আহত যোদ্ধাকে বিদ্ধ করে, এবং সে পেছনের দিকে উল্টে পড়ে, স্পষ্টতই মৃত্যু ভূমি স্পর্শ করার পূর্বেই হয়েছে। চলে এসো, খুররম উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে, এবং নিজের কালো ঘোড়ার পাঁজরে গোড়ালী দিয়ে গুতো দেয় যার কালো চামড়া ঘামের সাদা ফেনায় জবজব করছে। সবশেষে যাঁরা শত্রুপক্ষের এলাকা ত্যাগ করবে সে তাদের সাথে অবস্থান করে। সে তীব্র বেগে ঘোড়া দাবড়ের নেয়ার সময়, পেছনের পরিস্থিতি দেখার জন্য নিজের পর্যাণে ঘুরে গিয়ে সে তার পেছনে তাকাতে সে দেখে, মালিক আম্বারের সৈন্যদের ছোঁড়া একটা বর্শা আঘাতে, তার আরেকজন যোদ্ধা নিজের বাহন থেকে কাত হয়ে একপাশে পড়ে যাচ্ছে। হতভাগ্য লোকটার পা রেকাবে আটকে যায় এবং রেকাবের চামড়া ছিঁড়ে যাবার আগে বেশ কিছুটা দূরত্ব সে ঘোড়ার পেছনে ছেচড়ে যায়।

খুররম সহসা অনুভব করে গরম বাতাসের একটা হলকা তার পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে এবং আবারও একটা বিকট বিস্ফোরনের শব্দ তাঁর কানে তালা ধরিয়ে দেয়। বারুদবাহী শকটগুলোর একটা অন্তত বিস্ফোরিত হয়েছে। আরেকটা বিস্ফোরণের আওয়াজ ভেসে আসে এবং খুররম তাঁর বাম গালের নাকের কাছে তীব্র একটা যন্ত্রণা অনুভব করে আর তরল কিছু একটা তার মুখের উপর দিয়ে গড়িয়ে ঠোঁটের কাছে আসে। জিনিষটার স্বাদ নোনতা আর তার জীহ্বায় কেমন ধাতব একটা অনুভূতি–রক্ত। সে ঘোড়ায় চেপে ছোটার মাঝেই গালে হাত দিয়ে একটা পাতলা ধাতুব টুকরো টেনে বের করে। সে ভাবে, জিনিষটা সম্ভবত টিনের তৈরি বারুদ রাখার তোড়ং।

সে অচিরেই আবার সেই রিজের চূড়ায় ফিরে আসে যেখান থেকে সে আক্রমণ আরম্ভ করেছিল, যেখানে তাঁর বাকি সৈন্যরা পুনরায় নতুন করে গোষ্ঠীবদ্ধ হচ্ছে। সে তার ঘোড়ার প্রবলভাবে স্পন্দিত হতে থাকা পাজরে করতল দিয়ে মৃদু আঘাত করে জটাকে আদর করে, এবং আবারও নিজের পেছন দিকে তাকালে, সে দেখে যে গুটিকয়েক পিছিয়ে পড়া দলছুট মোগল সৈন্য তখনও মালিক আম্বারের বিভ্রান্ত সৈন্যদের কাছ থেকে পালিয়ে আসছে। একটা ধুসর ঘোড়ার সামনের পা ঢাল দিয়ে উপরের দিকে উঠার সময়ে নিজের দেহের ভারে বেঁকে যায় এবং বিশাল প্রাণীটা ভূপাতিত হয়, পিঠের গাট্টাগোট্টা দেখতে, ধনুকের মত বাঁকানো পায়ের আরোহী সময়মত পর্যাণ থেকে লাফ দিয়ে সরে যায়। খুররম ভালো করে খেয়াল করলে দেখে যে ঘোড়াটার পার্শ্বদেশে তরবারির বিশাল একটা ক্ষত রয়েছে। প্রাণীটা তার উপরে অর্পিত দায়িত্ব ভালোমতই পালন করেছে এবং সাহসিকতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে পিঠের আরোহীকে এত দূর পর্যন্ত নিয়ে এসেছে।

মালিক আম্বারের লোকেরা তাদের পিছু ধাওয়া করে নি। খুররম বুরহানপুর ত্যাগ করার পর থেকে অতিবাহিত দু’মাসে এমন ঘটনা আরো দু’বার ঘটেছে, তাঁদের প্রতিপক্ষ সবসময়ে কৌশলগত নিরাপদ আশ্রয়স্থলে অবস্থান অব্যাহত রেখেছে, ঝটিকা হামলায় নিজের বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারটা আপাত দৃষ্টিতে বোধহয় মেনেই নিয়েছে এবং আজ সকালের মত ঝটিকা আক্রমণের সময় নিজ পক্ষের হামলাকারীদের, তারা যখন মূল বাহিনী থেকে পৃথক হয়ে হামলা শুরু করে, তখনও তাদের অনুসরণ করার কোনো তাগিদ তার ভিতরে লক্ষ্য করা যায়নি। মালিক আম্বার মনে হচ্ছে দাক্ষিণাত্যের মালভূমির সীমান্তের লাগোয়া পাহাড়ের অভ্যন্তর পর্যন্ত পশ্চাদপসারণ অব্যাহত রাখতে সংকল্পবদ্ধ যা খুররমের আগমনের সংবাদ প্রথমবার শোনার পরে থেকেই তিনি বজায় রেখেছেন। তার সংখ্যায় অপ্রতুল সৈন্যবাহিনী এখানে যেকোনো যুদ্ধে পরিচিত ভূপ্রকৃতি নিজের সুবিধামত ব্যবহার করতে সক্ষম হবে।

খুররম তার রক্তে রঞ্জিত তরবারির ফলা পর্যাণে রক্ষিত এক টুকরো কাপড়ের সাহায্যে পরিষ্কার করে এবং পরম যত্নের সাথে আরো একবার তরবারিটাকে এর রত্নখচিত ময়ানে কোষবদ্ধ করে, হতাশা আর সন্তুষ্টির একটা মিশ্র অনুভূতির মাঝে সে বিরাজ করছে। সে মালিক আম্বারের সৈন্যবাহিনীর আরো ক্ষতি সাধন করতে পেরেছে, তাদের গোলাবর্ষণের ক্ষমতা আর সৈন্য সংখ্যা ন্যূনতম গ্রহণযোগ্য মোগল প্রাণহানির বিনিময়ে অর্জিত হওয়ায় সে সন্তুষ্ট, আর হতাশ এই জন্য যে মালিক আম্বার এখনও চূড়ান্ত নিষ্পত্তিমূলক যুদ্ধে নিজেকে নিয়োজিত করে নি। সে অবশ্য নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে মনে মনে বলে যে এমন একটা যুদ্ধের সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে খুব বেশি দিন দেরি হবে না।

*

‘দেখি, আমাকে দেখতে দাও, আরজুমান্দ আদেশের সুরে বলে। খুররম তার পরিশ্রান্ত কালো ঘোড়া নিয়ে মাত্র পাঁচ মিনিট আগেই তার অস্থায়ী সেনাছাউনিতে আস্কন্দিত বেগে এসেছে। আরজুমান্দ রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে তাকে অভ্যর্থনা জানাতে হেরেম থেকে ছুটে এসেছে, সে তাবুর উষ্ণ অভ্যন্তরভাগে মধ্যবর্তী সময়টা নিরন্তর পায়চারি করে অতিবাহিত করেছে, তার পরিচারিকারা দরবারের সাম্প্রতিক গুজবের রসালো মুখরোচক অংশ শুনিয়ে তার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করলে বা যখন জলখাবারের কথা জিজ্ঞেস করেছে সে তাদের সব কিছুরই যন্ত্রবৎ উত্তর দিয়েছে। খুররমের মুখে জমাট বাধা রক্তের দাগ দেখে সে সাথে সাথে তাকে তাবুতে ফিরিয়ে নিয়ে আসে।

‘কিস্যু হয়নি। সামান্য আচড় মাত্র। সত্যিই বলছি। ক্ষতস্থানে ইতিমধ্যেই মামাড়ি পড়া শুরু হয়েছে, খুররম প্রতিবাদ জানায় কিন্তু আরজুমান্দ সে সবে মোটেই পাত্তা না দিয়ে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করার জন্য নিম পাতার নির্যাস আনতে বলে, সে শুনেছে সংক্রমণ প্রতিরোধে এটা একটা নিশ্চিত উপায়। পরিচারিকাদের একজন হন্তদন্ত হয়ে নিম পাতার সন্ধানে যেতেই, আরজুমান্দ খুররমের বুকের বর্মের বাঁধন খুলে এবং তার দেহ থেকে সেটা সরিয়ে নেয়ার সময় সে আপন মনেই বিড়বিড় করে বলতে থাকে, ‘আল্লাহতালাকে লাখ লাখ শুকরিয়া যে আপনি নিরাপদে ফিরে এসেছেন। ‘আমি তোমাকে বলেছি সোনা আমি অবশ্যই ফিরে আসবো… তোমায় ভীষণ উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। তুমি কি নিশ্চিত যে আমার সাথে যুদ্ধযাত্রায় অংশ নেয়া তোমার জন্য সত্যিই ভালো হবে? বুরহানপুরে তুমি কি আরও শান্তিতে থাকতে না?”

না, আরজুমান্দ সাথে সাথে উত্তর দেয়, তাঁর কণ্ঠস্বর কঠোর। সংবাদের জন্য অপেক্ষার প্রহর এখানে সংক্ষিপ্ত। বার্তাবাহকের আগমনের জন্য প্রতীক্ষা করা এবং তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে তারা কি সংবাদ নিয়ে এসেছে সেটা আন্দাজ করার চেষ্টা অনেক বেশি মারাত্মক। আমি এখানে সেনাছাউনিতে আপনার সাথে থাকতে পারছি এবং আপনার ভাবনা জানতে আর চূড়ান্ত বিজয়ের ক্ষণে, আমি জানি যা অবশ্যম্ভাবী, উপস্থিত থাকতে পারবো। সে তার কথার মাঝেই তাকে আলিঙ্গণ করে, ঘামের ঝাঁঝালো গন্ধ যা তার জোব্বাকে নোংরা করেছে পাত্তা না দিয়ে।

খুররম যখন তার গালে প্রণয়স্পর্শ ফিরিয়ে দিচ্ছে, তাঁর মন তখনও ভাবতে থাকে বিজয় অর্জনের জন্য সে আরও কীভাবে তার প্রচেষ্টা জোরদার করতে পারে যা আরজুমান্দ অবশ্যম্ভাবী মনে করে। মালিক আম্বার এখনও সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রতিপক্ষ হিসাবে বর্তমান।

*

‘যুবরাজ, উন্মুক্ত প্রান্তরে যুদ্ধে আমাদের মোকাবেলা না করে মালিক আম্বার এখান থেকে পাঁচ মাইল দূরে একটা বদ্ধ একটা উপত্যকায় পশ্চাদপসারণ করেছে, কামরান ইকবাল, তাঁর গুপ্তদূতের অভিযান সমাপ্ত করে ফিরে এসে পোষাক পরিবর্তন করে যখন পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করে দাবদাহের উত্তাপে তাঁর গোলগাল মুখটায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গড়িয়ে পড়তে শুরু করে। তার লোকজন ইতিমধ্যে প্রবেশ পথে পাথর, মালবাহী শকট উল্টে রেখে আর অন্য যা কিছু তারা হাতের কাছে পেয়েছে সবকিছু দিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।

খুররম মনে মনে ভাবে, অবশেষে অপেক্ষার পালা সমাপ্ত হতে চলেছে। আক্রমণ শুরু হবার পর থেকেই যার কারণে তাকে নিজের গালে একটা অগভীর ক্ষত সহ্য করতে হয়েছে তার লোকেরা মালিক আম্বারের বাহিনীর উপরে সবসময়ে নজর রেখে এসেছে বিশেষ করে তারা যখন আহমেদনগরের সুলতানের ভূখণ্ডের দিকে ফিরে যেতে শুরু করে। খুররম পরবর্তীতে শত্রুপক্ষকে পর্যায়ক্রমিক পার্শ্ববর্তী আক্রমণ আর হয়রানিমূলক ঝটিকা হামলা চালিয়ে প্রতিপক্ষকে তাদের সব শক্ত ঘাঁটি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে যেখানে পৌঁছাতে পারলে তারা নতুন করে সৈন্য সংগ্রহ করতে পারতো। মালিক আম্বার, যিনি পশ্চাদপসারণের সময় নিজের লোকদের ভিতরে শৃঙ্খলা বজায় রাখার কঠিন কাজে আপাত দৃষ্টিতে সফল হয়েছেন, অবশেষে স্পষ্টতই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাকে এবার ঘুরে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করতে হবে। আবিসিনিয়ার ভাড়াটে যোদ্ধা প্রতিরক্ষার জন্য সবচেয়ে উপযোগী ভূখণ্ডও যদি নির্বাচিত করে থাকেও, খুররম নিজের বিজয়ের ব্যাপারে আস্থাশীল। পেছনের উপত্যকা সম্বন্ধে কি জানো? আসলেই কি সেটা কানাগলি?’

 ‘উপত্যকাটা অনেকটা বোতল আকৃতির। প্রবেশ পথটা বোতলের গলা বা বলা যায় সবচেয়ে সংকীর্ণ অংশ। দুই পাশ খাড়াভাবে উঠে গিয়েছে আর পায়ের চাপে গড়িয়ে পড়তে পারে এমন পাথর এবং আলগা নুড়িতে ঢাকা। উপত্যকার মাঝে ঝর্ণার পানিতে সৃষ্ট একটা নদী রয়েছে যা মালিক আম্বারের লোকদের পানির সংস্থান দেবে। আর সেখানে প্রচুর কাঠও রয়েছে। তাঁরা কিছু গাছ কেটে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারবে এবং তারপরেও যথেষ্ট গাছ দাঁড়িয়ে থাকবে আমাদের যেকোনো আক্রমণ বিক্ষিপ্ত করে দিতে।’

 ‘তোমার কি মনে হয়? আমরা কি এখন আক্রমণ করবো?’ শেষ যুদ্ধের সম্ভাবনায় অধৈর্য হয়ে উঠা খুররম জানতে চায়।

 ‘না, যুবরাজ। যদিও বর্তমান পরিস্থিতিতে আক্রমণ করাটাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে হচ্ছে, আমার মনে হয় সেটা ঠিক হবে না, কামরান ইকবাল বলে। উপত্যকার প্রবেশ মুখটা খুবই সংকীর্ণ আর সহজেই এলাকাটা সুরক্ষিত করা সম্ভব। আমরা যদি কেবল আমাদের সঙ্গে থাকা অশ্বারোহী যোদ্ধাদের ভরসায় আক্রমণ শুরু করি তাহলে মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবার ঝুঁকি রয়েছে। রণহস্তীর বহর আর কামানবাহী শকটগুলো এসে যোগ দেয়া পর্যন্ত আমাদের অবশ্যই অপেক্ষা করা উচিত।’

 খুররম বুঝতে পারে কামরান ইকবাল ঠিকই বলেছে। এতগুলো সপ্তাহ। কৌশলী অভিযান পরিচালনা করে মালিক আম্বারের বাহিনীকে বর্তমান অবস্থানে নিয়ে এসে এখন ব্যর্থতার সম্ভাবনা আছে জেনেও আক্রমণ করলে সে বোকামির পরিচয় দেবে। মালিক আম্বারের অবস্থা এই মুহূর্তে নিজ গুহায় কোণঠাসা অবস্থায় আহত সিংহের ন্যায়, যে এখনও অসতর্ক বা অতি উৎসাহী শিকারীকে প্রাণঘাতি আঘাত করতে সক্ষম।

*

‘আজ আমরা জয়লাভ করবো, খুররম এক ঘন্টা আগে আরজুমান্দকে বলেছে। মালিক আম্বারের সৈন্যরা যে উপত্যকায় নিজেদের স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অবরুদ্ধ করে রেখেছে সেখান থেকে আধ মাইল দূরে একটা টিলার উপরে রোকের অবস্থান থেকে সে এখন সামনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। প্রবেশ পথটা সত্যিই খুব সংকীর্ণ–কোনোমতেই দুইশ গজের বেশি চওড়া হবে না-এবং দু’পাশের পাহাড় এতটাই খাড়াভাবে উঁচু হয়েছে যে সেটা বেয়ে উপরে উঠা বিশেষ করে এমন একদল মানুষের জন্য যাদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করা হচ্ছে। মালিক আম্বারের সৈন্যরা প্রবেশ পথটা পাথর, গোড়া থেকে কেটে ফেলা গাছ এমনকি কাঁটাগাছের ঝোঁপ যা আশেপাশের এলাকায় প্রচুর জন্মে একসাথে বেঁধে গোছা করে ফেলে রাখার সাথে সাথে নিজের সাথের মালবাহী শকটগুলোও উল্টে দিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। প্রতিবন্ধকতা বরাবর নিয়মিত দূরত্বে খুররমের অতর্কিত হামলার পরেও কার্যক্ষম রয়েছে মালিক আম্বারের এমন অবশিষ্ট কামানের নল মুখ ব্যাদান করে রয়েছে।

খুররম এখন আগের চেয়েও বেশি নিশ্চিত যে গতকাল সন্ধ্যাবেলা যুদ্ধের কৌশল নির্ধারণী বৈঠকে সে ঠিকই বলেছিল যে উপত্যকার ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এসে নদীটা যেখানে বাইরে বের হয়ে এসেছে সেটাই একমাত্র সম্ভাব্য দূর্বল স্থান। মালিক আম্বারের লোকজন নদীতে বাঁধ না দিয়ে সেখানে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারবে না যা অচিরেই তাদের পেছনের স্থান প্লাবিত করে এলাকাটা পাহারা দেয়াই তাদের জন্য অসম্ভব করে তুলবে।

যুদ্ধের কৌশল নির্ধারণী সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুসারে তাঁর রণহস্তীর একটা বহর ইতিমধ্যেই আক্রমণের জন্য অগ্রসর হতে আরম্ভ করেছে, উপত্যকার প্রবেশ পথের দিকে ধীরে কিন্তু নিশ্চিন্ত নিশ্চয়তায় এগিয়ে চলেছে। খুররম কয়েকটা হাওদা থেকে গাদাবন্দুকের গুলির ঝলক দেখতে পায় এবং অন্যগুলো থেকে ভেসে আসে তাঁর বহনযোগ্য ছোট কামান–গজলের চাপা গর্জন আর ঘোয়া। হাতির বহরের ঠিক পেছনে আড়াআড়িভাবে বিন্যস্ত অশ্বারোহী যোদ্ধাদের সারি ইতিমধ্যেই সমবেত হতে শুরু করেছে প্রতিবন্ধকতায় সৃষ্ট সামান্যতম ফাটলের সর্বোচ্চ সুযোগ নিতে। খুররমের মন চাইছে তাদের সাথে থেকে আক্রমণের নেতৃত্ব দিতে কিন্তু যুক্তি দিয়ে সে জানে যে আরজুমান্দ ঠিকই বলেছে এবং কেবল তার নিরাপত্তার কথা ভেবেই না বরং সে তাকে তাঁর সেনাপতিদের পরামর্শ অনুসরণ করতে অনুরোধ করেছিল এই জন্য যে যুদ্ধক্ষেত্র আর সেখানকার ঘূর্ণায়মান ধোয়ার কুণ্ডলী আর এর অনুগামী বিভ্রান্তি থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করে রণনীতি পরিচালনা করলেই সে তার দায়িত্ব অনেকবেশি কার্যকরভাবে পালন করতে পারবে।

 মালিক আম্বারের সৈন্যদের তড়িঘড়ির করে তৈরি করা প্রতিবন্ধকতার পেছন থেকে কামানগুলো এখন গোলাবর্ষণ করতে শুরু করেছে এবং খুররম তাঁর হাতির বহরের অগ্রগামী একটা হাতিকে থমকে দাঁড়িয়ে যেতে এবং তারপরে ধীরে ধীরে একপাশে কাত হয়ে নদীতে ভূপাতিত হতে দেখে, পিঠের হাওদাটা ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়। আরেকটা হাতির ঘাড়ের দু’পাশ থেকে দুই মাহুতই নিচে আছড়ে পড়ে, সম্ভবত তবকীদের সম্মিলিত গুলিবর্ষণের একটা ঝাপটা তাদের আঘাত করেছে। হাতিটা আক্রমণের অভিমুখ থেকে নিজেকে ঘুরিয়ে নেয়, ভয় আর আতঙ্কে শুড় উঁচু করে রেখেছে। বিশাল জন্তুটা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পালাবার সময় এর গজদাঁতের সাথে সংযুক্ত ধারালো তরবারির আঘাতে পেছনে অনুসরণরত আরেকটা হাতির পা প্রায় দ্বিখণ্ডিত করে ফেললে সেটাও ভূপাতিত হয়। হাতিটা ভূপাতিত হবার সময় খুররম এর হাওদা থেকে গজনল মাটিতে আছড়ে পড়ে বিধ্বস্ত হতে দেখে। আরেকটা হাতি সেটার সাথে হোঁচট খেয়ে সামনের দিকে ছিটকে পড়লে ঘাড়ের দু’পাশ থেকে দুই মাহুতের সাথে সাথে পিঠে স্থাপিত হাওদাও স্থানচ্যুত হয়।

 হাতির বহরের গুটিকয়েক দাঁড়িয়ে থাকা সদস্য এখনও সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে কিন্তু স্বগোত্রের ভূপাতিত সহযোদ্ধাদের ধরাশায়ী দেহ পাশ কাটিয়ে অগ্রসর হওয়াটা তাদের জন্য ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে। মালিক আম্বারের প্রতিবন্ধকতায় ফাটল ধরাতে তাদের যদি সফল হতে হয় তাহলে সেদিকে যে গতিতে তাদের ছুটতে হবে সেই গতি অর্জন করা তাদের জন্য এই মুহূর্তে প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। খুররমের চোখের সামনেই আরো একটা হাতি ভূপাতিত হয়, এত মন্থরভাবে জন্তুটা ভূপাতিত হয় যে পিঠের হাওদায় অবস্থানরত চারজন যোদ্ধাই লাফিয়ে মাটিতে নামতে পারে এবং নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য পেছনের দিকে দৌড়াতে শুরু করে। খুররম হতাশ হয়ে চারজনের একজনকে, স্পষ্টতই গাদাবন্দুকের গুলির আঘাতে, মুহূর্ত পরেই মাটিতে ছিটকে পড়তে দেখে। ভূপাতিত সহযোদ্ধাকে সাহায্য করার জন্য দ্বিতীয়জন ঘুরে দাঁড়ায় কিন্তু আহত লোকটার কাছাকাছি পৌঁছাবার আগে সে নিজেই গুলিবিদ্ধ হয়। তৃতীয়জনও গুলিবিদ্ধ হয় কিন্তু তার আঘাত বোধহয় খুব একটা মারাত্মক না এবং বুকে ভর দিয়ে খুররমের অবস্থানের দিকে একটু একটু করে এগিয়ে আসতে শুরু করে। চতুর্থজন নদীর অগভীর অংশের ভিতর দিয়ে দৌড়াবার কারণে গাদাবন্দুকের গুলির আওতা থেকে প্রায় বের হয়ে আসবার মুহূর্তে সেও গুলিবিদ্ধ হয়, প্রচণ্ড আক্ষেপে বাতাসে দু’হাত ছোঁড়াছুড়ি করতে করতে মুখ নিচের দিকে দিয়ে পানিতে আছড়ে পড়ে।

ইত্যবসরে আরো অন্তত চারটা হাতি ভূপাতিত হয়েছে যখন অন্য দুইটা কি তিনটা হাতি গতিপথ পরিবর্তন করতে শুরু করেছে। বিশাল প্রাণীগুলোর একটা, মারাত্মকভাবে আহত, টলমল করতে করতে নদীর দিকে এগিয়ে গিয়ে ফোয়ারার মত উপরের দিকে পানি ছিটিয়ে দিয়ে জলশয্যা নেয়, রক্তে দ্রুত বহমান পানি লাল হয়ে যায়। খুররম মনে মনে চিন্তা করে, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো ব্যাপক হবার আগে এখনই আক্রমণ বন্ধ করা উচিত, এবং সে সাথে সাথে কালক্ষেপণ না করে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সামরিক সংবাদ বহনকারী অপেক্ষমান অশ্বারোহীকে যুদ্ধ বন্ধের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়। সে বরাবরই জানতো যে মালিক আম্বার একজন কুশলী, দক্ষ আর অভিজ্ঞ প্রতিপক্ষ। সে নিশ্চিত পোড় খাওয়া আবিসিনিয়ান সেনাপতি ভেবেছে যে উপত্যকায় ভালোভাবে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলে সে যদি মোগল বাহিনীর এতটাই ক্ষতিসাধন করতে পারে যার ফলে তারা হয় পশ্চাদপসারণ করবে, নিজেদের তার পাল্টা আক্রমণের ঝুঁকির সম্মুখীন করে, নতুবা লড়াইটাকেই নিদেনপক্ষে এতটাই দীর্ঘস্থায়ী করা যার ফলে একটা অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে যা কাজে লাগিয়ে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সে নিজেদের জন্য শান্তি আর নিরাপদ অতিক্রমণের সুবিধা আদায় করে নিতে পারবে। খুররম যদি এই দুটো সম্ভাবনার একটাও যদি মেনে নেয় তাহলে নিজের বদরাগী পিতার প্রতিক্রিয়া আন্দাজ করতে তাঁর খুব একটা কষ্ট হয় না আর সেই সাথে সে নিজের প্রথম অভিযানে সাফল্য অর্জনে ব্যর্থ হবে। তাকে এখন একটু সময় নিয়ে নতুন কৌশলের কথা ভাবতে হবে। আজ দুপুরের পরে পুনরায় আরেকদফা নিষ্ফল সম্মুখ আক্রমণ শুরু করার চেয়ে আগামী দুই কি একদিন আক্রমণ মূলতবি রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

‘আমাদের কেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে? খুররম পরে তার চারপাশে অর্ধবৃত্তাকারে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে থাকা তার সেনাপতিদের কাছে জানতে চায়।

কমপক্ষে ছয়শ সৈন্য হয় নিহত হয়েছে নতুবা মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে। আমাদের হেকিমরা কেবল তাঁদেরই চিকিৎসা করার সময় পেয়েছে যাদের বেঁচে থাকার একটা সম্ভাবনা রয়েছে বলে তাদের কাছে মনে হয়েছে। সম্ভবত একইরকম গুরুত্বপূর্ণ, আমাদের সেরা রণহস্তির ত্রিশটা মারা গেছে অথবা এত জঘন্যভাবে আহত হয়েছে যে তাদের কষ্ট লাঘব করাই করুণা প্রদর্শনের সামিল, কামরান ইকবাল পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে। ‘আমি যতটা ভয় করেছিলাম পরিস্থিতি তারচেয়েও একটু বেশি মারাত্মক। আমার মনে হয় আপাতত প্রকাশ্যে সম্মুখ আক্রমণের ধারণা আমাদের বাতিল করা উচিত। আমরা কি নিশ্চিতভাবে জানি যে উপত্যকার পেছন দিক দিয়ে বাইরে বের হবার জন্য কোনো পথ নেই আর আমরা যেমন ধারণা করেছি উপত্যকার পার্শ্বদেশ ঠিক ততটাই খাড়া হয়ে উঠে গিয়েছে।’

‘হ্যাঁ, যুবরাজ, আমরা এ ব্যাপারে যতদূর জানি তাতে তাই মনে হয়েছে। স্থানীয় অধিবাসীরা, যারা প্রায়শই তথ্যের একটা ভালো উৎস হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে, ভয়ে হয় পালিয়ে গিয়েছে বা এতটাই আতঙ্কিত যে তাঁরা দরকারি তথ্য দেবে না। আমরা যদি তথ্যের জন্য তাঁদের চাপ দেই তাহলে আমরা যা শুনতে চাই বলে তাদের মনে হবে তারা ঠিক সেটাই আমাদের বলবে আর সেটা তাহলে তখন অপ্রয়োজনীয় তথ্যের চেয়েও ভয়ঙ্কর হবে।’

 ‘আমরা আমাদের গুপ্তদূতদের কয়েকজনকে প্রেরণ করেছিলাম, নাকি আমরা শেষ পর্যন্ত পাঠাইনি, চারপাশের পাহাড়ী ঢালে ঘুরে দেখতে আর পেছন থেকে উপত্যকাটা অনুসন্ধান করতে?

 ‘হা, কিন্তু মালিক আম্বারের নিজেরও মনে হয় অসংখ্য গুপ্তদূত চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে। আমাদের লোকদের চেয়ে তাঁরা এই এলাকাটা অনেক ভালো করে চিনে বলে বেশ কয়েক দফা তারা সাফল্যের সাথে আমাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ পরিচালনা করেছিল। আক্রমণের কবল থেকে যারা বেঁচে এসেছিল আর যারা কোনো ধরনের বিপত্তি ছাড়াই অভিযান সমাপ্ত করতে পেরেছিল সবাই একই কথা বলেছে যে তারা যা দেখেছে তাতে সামনের সংকীর্ণ প্রবেশপথটাই বস্তুতক্ষে উপত্যকায় সশস্ত্র লোকজন প্রবেশের একমাত্র রাস্তা।

ভালো কথা, আমাদের আক্রমণ করার বিষয়ে আপনি কি পরামর্শ দেবেন? খুররম জিজ্ঞেস করে, কিছুক্ষণের জন্য নিজের মতামত দূরে সরিয়ে অন্যের কথা শুনতে চায়।

‘যুবরাজ, আমাদের আসলে কামানগুলোকে একটা অগ্রবর্তী স্থানে নিয়ে যাওয়া দরকার যেখান থেকে সেগুলো প্রতিবন্ধকতার সত্যিকারের ক্ষতিসাধন করতে পারবে, ওয়ালী বেগ, কৃশকায় দেখতে এক বাদশানি, খুররমের তোপচিদের মধ্যে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ এবং বয়স কম করে হলেও যুবরাজের দ্বিগুণ।

কাজটা করার চেয়ে বলাটা অনেক সহজ। তোপচিদের জন্য সামান্যতম আড়াল থাকবে না এবং তাঁরা তাঁদের কামানগুলো কার্যকর করার আগেই মালিক আম্বারের তবকিরা সহজেই তাদের পাখির মত গুলি করে ভূপাতিত করবে।’

 ‘আমরা কামানের মঞ্চের জন্য আড়াল হিসাবে মৃত হাতির দেহগুলো কেন ব্যবহার করছি না?’ কামরান ইকবাল পরামর্শের সুরে বলে।

হ্যাঁ, কিন্তু তারপরেও কামানগুলো আমাদের জায়গামত নিয়ে যেতে হবে এবং সেটা করতে গেলে আমাদের প্রচুর লোকক্ষয়ের ব্যাপারটা মেনে নিতে হবে।

খুররমের মাথায় সহসা একটা ভাবনা খেলা করে যায়। যুদ্ধের পরামর্শদাতারা আর আরজুমান্দ উভয়পক্ষই যখন সামনে থেকে যুদ্ধের নেতৃত্ব না দেয়ার পরামর্শ দেয়, তারা তখন ধোয়ার কুণ্ডলীর ফলে সৃষ্ট বিভ্রান্তিকে তাদের পক্ষের অন্যতম যুক্তি হিসাবে উপস্থাপন করেছিল। ধোয়াকে নিজের সুবিধার্থে সে কেন ব্যবহার করার কথা চিন্তা করছে না?

“আমরা কি ঘোয়ার একটা অন্তরাল তৈরি করতে পারি আড়াল হিসাবে যা ব্যবহার করে আমাদের লোকেরা কামানগুলো নিয়ে এসে মৃত হাতির দেহগুলোর পিছনে সেগুলো স্থাপন করতে পারে? সে প্রশ্ন করে। আমি সেখানে প্রচুর ঘাস আর ঝোঁপঝাড় দেখেছি যা পোড়ালে প্রচুর ধোয়া সৃষ্টি হবার কথা। কয়েক ঘন্টার ভেতরেই প্রচুর ঘাস আর ঝোঁপঝাড় আমার লোকদের পক্ষে সংগ্রহ করা সম্ভব।’

 ‘যুবরাজ, এতে কাজ হলেও হতে পারে, ওয়ালী বেগ বিষয়টা নিয়ে ভাবতে ভাবতে বলে।

কাজ হবে। আমরা আমাদের লোকদের আদেশ দিতে পারি তাঁরা যেন নিজেদের বাহুতে সবুজ বা সাদা রঙের কাপড় টুকরো বেধে রাখে যা ধূম্রমেহের ভিতরে তাদের পরস্পরকে সনাক্ত করতে সাহায্য করবে। অবিলম্বে পোড়াবার জন্য ঝোঁপঝাড় সংগ্রহ শুরু করতে লোক পাঠাবার ব্যবস্থা করেন। আমরা রাতের বেলা সেগুলো জায়গামত নিয়ে যাব, এবং ওয়ালি বেগ, আপনি ভোরের আলো ফোঁটার ঘন্টা দুয়েক আগে কামানগুলো স্থানান্তরিত করার কাজ শুরু করবেন যাতে অন্ধকারও আমাদের বাড়তি আড়াল দান করে।

*

পরদিন সকাল চারটার সময় ষাড়ের দল তাঁর প্রথম কামানটা যখন টেনে নিয়ে ধীরে ধীরে উপত্যকার প্রবেশমুখের দিকে অশ্বারোহী প্রহরী সাথে করে এগিয়ে যেতে থাকে খুররম ততক্ষণে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে গিয়েছে। বিভিন্ন স্থানে ইতিমধ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণ ঝোঁপঝাড় মজুদ করা হয়েছে যেখান থেকে বাতাস মালিক আম্বারের অবস্থান অভিমুখে ধোয়া প্রবাহিত করে, তার লোকদের দৃষ্টি ঝাপসা করে দেবে। খুররম সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ হওয়া সত্ত্বেও আশা করে যে আগামী কয়েক ঘন্টা এখন যেমন মোটামুটি প্রবল বেগে বাতাস বইছে সেটা যেন দিক পরিবর্তন না করে বা বন্ধ না হয়ে যায়। তার ধারণা প্রায় বিশ মিনিট সময় অতিবাহিত হবার পরে সে গুলির শব্দ পায়। ষাড়ের দলটার তত্ত্বাবধায়করা ইতিমধ্যেই মালিক আম্বারের বেশ কিছু অগ্রগামী প্রহরীদের মোকাবেলা করেছে যাদের সে প্রতিবন্ধকতার বাইরে মোতায়েন করেছিল। খুররম মনে মনে ভাবে, আবিসিনিয়ান আসলেই একজন চৌকষ সেনাপতি, কিন্তু আমিও নিজেকে তার সমকক্ষ হিসাবে প্রমাণ করবো। ভোরের প্রথম আলো উঁকি দিতে শুরু করেছে এবং তার পোয় ব্যবহার করার পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার সময় হয়েছে। শুকনো পাতার বহ্নৎসবশুরু করো, সে চিৎকার করে বলে, এবং সাথে সাথে একজন অশ্বারোহী তাঁর আদেশ পালনের বিষয়টা নিশ্চিত করতে এগিয়ে যায়। ওয়ালি বেগ আর তাঁর তোপচিদের আগেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে হাতির মৃতদেহগুলোর পেছনে একটা সুবিধাজনক সুরক্ষিত স্থানে তারা যখন পৌঁছাতে পারবে তখনই যেন সাথে সাথে কামান থেকে গোলাবর্ষণ করা আরম্ভ করে। সে দুই বা এক মিনিটের ভিতরেই প্রথমবারের মত কামান থেকে গোলাবর্ষণ করার ভারি মন্দ্র শব্দ শুনতে পায়, প্রায় সাথে সাথেই পটকার মত তবকিদের গুলিবর্ষণের শব্দ ভেসে আসে। যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে, এবং মূল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সে যদিও ছয়শ গজ বা তারও বেশি দূরে অবস্থান করছে তারপরেও খুররম জ্বলন্ত ঝোঁপের গন্ধ অনায়াসে চিনতে পারে। পুরোপুরি যখন সকাল হয় সে দেখে যে ধোয়ার বেশির ভাগ আসলেই মালিক আম্বারের অবস্থানের দিকে বয়ে চলেছে।

খুররম তার সেনাপতিদের কাছ থেকে প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হলেও সিদ্ধান্ত নেয় যে প্রতিবন্ধকতায় সৃষ্ট ফাটলের ভিতর দিয়ে অশ্বারোহী যোদ্ধাদের আক্রমণের নেতৃত্ব সে নিজে দেবে। সেখানে এখন যেকোনো মুহূর্তে ফাটল দেখা দেবে। সে সহিসকে ডেকে এনে নিজের বিশাল কালো ঘোড়ার পিঠে চেপে বসে এবং দুলকি চালে তার অপেক্ষমান দেহরক্ষী আর কামরান ইকবালের নেতৃত্বাধীন অন্যান্য অশ্বারোহী যোদ্ধাদের সমাবেশের দিকে এগিয়ে যায়। একজন বার্তাবাহককে মাত্র দশ মিনিট পরেই তাদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। যুবরাজ, বোয়ার কারণে ঠিক নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না কিন্তু আমাদের ধারণা আমরা নদীর কাছ থেকে বিশ গজ দূরে যেখানে মূলত মালবাহী শকট উল্টে দিয়ে আর ঝোঁপঝাড়ের সাহায্যে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছিল সেখানে একটা ফাটল সৃষ্টি করতে সফল হয়েছি।’

কামরান ইকবাল, তাহলে কি আর করা, এবার তাহলে দ্রুত অগ্রসর হওয়া যাক, খুররম উত্তেজনা চেপে রেখে আদেশ দেয়। অন্য যেকোনো যুদ্ধের আগমুহূর্তের চেয়ে নিজেকে এখন তাঁর অনেক বেশি সন্ত্রস্ত মনে হয়। তাঁর হৃৎপিণ্ড দ্রুতবেগে স্পন্দিত হচ্ছে, শিরায় অশ্বের গতি এবং তাঁর মুখ শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। সে অবশ্য ঘোড়ায় চেপে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া শুরু করতে নিজেকে বাধ্য করে মন থেকে সব ভাবনা ঝেড়ে ফেলতে এবং কেবল সামনের ব্যাপারটায় মনোনিবেশ করতে চেষ্টা করে। সে আর তার লোকজন কিছুক্ষণের ভিতরেই প্রথম মৃত হাতিটা পাশ কাটিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায় এবং বাতাসে এক ঝলকের জন্য ইতিমধ্যে শুরু হওয়া পচনের দুর্গন্ধ তাঁর নাসারন্ধ্রে এসে ধাক্কা দেয়। দুর্গন্ধ আর মৃতদেহের চারপাশে ভনভন করতে থাকা উপলবৎ বর্ণের কালো মাছির দল কারণে এর পেছনে অবস্থিত ব্রোঞ্জের বিশাল কামানগুলো থেকে গোলাবর্ষণ করা মোগল তোপচিদের জন্য একটা মারাত্মক পরীক্ষা। তারা এরপরে যে হাতির মৃতদেহটার পাশ দিয়ে যায় সেটা থেকে আরো প্রবল দুর্গন্ধ ভেসে আসে, সবচেয়ে কষ্টসহিষ্ণু পাকস্থলীর অধিকারীর পক্ষেও বমি চেপে রাখাটা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। মালিক আম্বারের লোকেরা ধোয়ার কারণে প্রায় অন্ধের মত নিজেদের কামান থেকে পাল্টা গোলাবর্ষণ আরম্ভ করে এবং ভাগ্যক্রমে তাঁদের একটা গোলা এসে মৃত হাতির উদরে বিস্ফোরিত হলে ফুলতে শুরু করা নাড়িভূড়ি ছিন্নভিন্ন হয়ে চারপাশে ছিটকে যায়–সেই সাথে দুর্গন্ধও।

সে বড় করে একটা ঢোক গিলে পাকস্থলী থেকে খাবারের উঠে আসা কোনোমতে দমন করে এবং মুখের চারপাশে জড়ানো সুতির বড় রুমালটা আরও ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে, খুররম তাঁর লোকদের অগ্রসর হবার গতি দ্রুততর করার আদেশ দেয়। ঘূর্ণায়মান ধোয়ার মাঝে বিদ্যমান একটা ফাঁকা স্থানের ভিতর দিয়ে সে দেখে যে মালিক আম্বারের প্রতিবন্ধকতা থেকে তাঁরা মাত্র তিনশ গজ বা তারও কম দূরে রয়েছে কিন্তু সেখানে কোনো ফাটল দেখতে না পেয়ে সে আতঙ্কিত হয়ে উঠে। ঘোয়ার আচ্ছাদন তারপরে আবার সরে যায় এবং এক মুহূর্তের জন্য সে তার বামপাশে নদীর কাছাকাছি ফাটলের মত কিছু একটা দেখতে পায় তারপরেই কেবল সে বিশ্বাস করে। ফাটল দেখা দিয়েছে!’ সে প্রাণপণে চিৎকার করে উঠে। ‘বামদিক দিয়ে আক্রমণ করো!

সে নিজের আদেশ অনুসরণ করে কালো ঘোড়ার পাঁজরে গুতো দিয়ে ঝড়ের বেগে ছুটতে করে। এক মিনিটেরও কম সময়ের ভিতরে ধোয়ার মাঝে অবরোধকটা আবছাভাবে আবির্ভূত হয়ে পুনরায় আবার আড়ালে চলে যায়। অবরোধকটা কেবল আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে। সে তাই বাধ্য হয় লাগাম শিথিল করতে এবং নিজের পর্যাণের উপরে সামনের দিকে ঝুঁকে এসে খুররম অবরোধকের অবশিষ্টাংশ লাফিয়ে অতিক্রম করার জন্য তার বাহনকে তাড়া দেয়, দূর থেকে দেখে যা প্রায় তিন ফিট উঁচু বলে মনে হয়। ঘোড়াটা তার নিতম্ব আর পিছনের পায়ের মাংসপেশি পুরোটা শক্তি ব্যবহার করে সামনের দিকে লাফ দিয়ে অনায়াসে প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে যায়।

সে এখন শত্রু শিবিরের ভেতরে, তাঁর দেহরক্ষীরা দ্রুততার সাথে তাকে অনুসরণ করে। তোপচিদের নিরস্ত্র করতে চেষ্টা করো, সে চিৎকার করে বলে। অবরোধক বরাবর ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে ভাসমান ধোয়ার মাঝে, সে একটা কামানের সামনে এসে পড়ে যা মুহূর্তের ভিতরে গোলাবর্ষণ করবে। সে তার ভারি কিন্তু নিখুঁত ভারসাম্যের তরবারিটা মাথার উপর থেকে মাত্র একবার অর্ধবৃত্তাকারে চালনা করে সলতেয় অগ্নি সংযোগ করতে ব্যস্ত তোপচিকে কবন্ধ করে দেয়। নিজের মুখে ছিটকে আসা উষ্ণ রক্তের স্বাদ অনুভব করার মাঝেই দ্রুত আরো দু’বার তরবারি চালিয়ে সে অন্য দু’জনের ভবলীলা সাঙ্গ করে, একজন কামানে বারুদ ভরার জন্য ব্যবহৃত লোহার দণ্ড ধরে দাঁড়িয়েছিল আর অন্যজনের হাতে ছিল কামানে ভরার জন্য বারুদের থলে। তাঁর দেহরক্ষীরা তখনও তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে অবস্থান করছিল, সে এর ভেতরেই অবরোধক বরাবর আস্কন্দিত বেগে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে আরেকটা কামানের গোলন্দাজদের তাদের সহায়তায় আহত কিংবা নিহত করে। সে এরপরে শত্রু শিবিরের আরো ভেতরে প্রবেশ করার জন্য দ্রুত বহমান নদীর নুড়িময় উপান্তের দিকে ঘুরে, তাঁর ইচ্ছে শত্রুপক্ষের আরো বেশি সংখ্যক যোদ্ধাকে যুদ্ধের জন্য প্রলুব্ধ করে টেনে আনে এবং তাঁদের ধ্বংসের নিয়ামক হয়।

সে তার লোকদের সাথে নিয়ে বেশ কয়েকজন তবকিকে কচুকাটা করে যাঁরা অবরোধকের চারপাশের লড়াই থেকে ইতিমধ্যে পালাতে শুরু করেছিল। কিন্তু সহসা মালিক আম্বারের অশ্বারোহী যোদ্ধাদের সঙ্ঘবদ্ধ একটা দল ধোয়ার ভেতর দিয়ে তাঁর ডানদিক থেকে বের হয়ে এসে পাশ থেকে তাঁর নিজস্ব অশ্বারোহীদের আক্রমণ করার জন্য প্রচণ্ড বেগে ছুটে আসে, তাদের আক্রমণের প্রাথমিক ধাক্কা সামলাতে না পেরে প্রতিপক্ষের দু’জন ভূপাতিত হয়। খুররম তাঁর আক্রমণকারীদের মুখোমুখি হবার জন্য নিজের কালো ঘোড়া চক্রাকারে ঘুরিয়ে নিয়ে দু’জন আক্রমণকারী যখন তার পাশ দিয়ে অতিক্রম করছে তখন তাদের লক্ষ্য করে তার তরবারি দিয়ে আঘাত করে চায়। তাঁর প্রতিপক্ষের একজন যোদ্ধা তাঁর আঘাত এড়িয়ে গেলেও অন্যজন নিজের পাকস্থলীতে গভীর একটা ক্ষত নিয়ে নিজের পর্যাণ থেকে মাটিতে আছড়ে পড়ে।

খুররম এরপর যখন খুব কষে লাগাম টেনে ঘুরতে চেষ্টা করে তাঁর প্রথম প্রতিপক্ষকে পুনরায় আক্রমণ করতে, আরেকজন শত্রু তার লম্বা বর্শা দিয়ে প্রাণপনে তাকে ধাক্কা দেয়। বর্শার ফলা তার বুকের বর্মে বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং ভিতরে প্রবেশ না করে পিছলে সরে যায় কিন্তু এত প্রবল শক্তিতে আঘাতটা করা হয়েছিল যে, সে ঘোরার সময় আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ায়, খুররম তার ঘোড়র উপর থেকে একপাশে ছিটকে গিয়ে হুড়মুড় করে নদীর কিনারের মাটিতে আছড়ে পড়ে। সে নিচে থেকে উপরের দিকে তাকিয়ে দেখে বর্শাধারী অশ্বারোহী পুনরায় তার দিকে বর্শা তাক করেছে। সময় মনে হয় যেন থমকে থেমে গিয়েছে এবং সহসাই তার মনে হয় আরজুমান্দকে তার আবার দেখতে খুব ইচ্ছা করছে এবং সে যদি অশ্বারোহীর গতিপথ থেকে নিজেকে সরিয়ে না নেয় তাহলে সে আর কোনোদিনই তাকে দেখতে পাবে না। সে একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করে থাকে, বস্তুতপক্ষে অশ্বারোহী প্রাণঘাতি আঘাতের জন্য বর্শা ইতিমধ্যেই পিছনে নিয়ে গিয়েছে। সে তারপরে পানির মাঝে আর নুড়িপাথরের উপর দিয়ে গড়িয়ে একপাশে সরে যায়। সে গড়িয়ে সরে যাবার ভিতরেই কোমরের পরিকর থেকে ছুঁড়ে মারার জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত করা একটা খঞ্জর টেনে বের করে এবং প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্যে সেটা ছুঁড়ে মারে। খঞ্জরটা লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে ব্যর্থ হলেও শত্রুর ঘোড়ার পশ্চাদ্ভাগে আঘাত হানলে জম্ভটা পিছনের পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পিঠের আরোহীকে পিছনের দিকে ছিটকে ফেললে বিরাট শব্দ করে সে পানিতে অবতরণ করে।

 খুররম চার হাতপায়ের উপর ভর করে নদীর অগভীর স্থানের ভিতর দিয়ে বাতাসের অভাবে খাবি খেতে থাকা লোকটা কাছে যায় এবং তার উপরে নিজেকে ছুঁড়ে দেয়। সে তার গলা আঁকড়ে ধরে, হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে কণ্ঠার হাড়ে ধাক্কা দেয় আর শক্ত করে চেপে রাখে যতক্ষণ না সে লোকটার ভিতর থেকে জীবনের সব ধরনের চিহ্ন বিলুপ্ত হয় এবং তাঁর দেহটা অসাড় হয়ে পড়ে। লাশটা একপাশে সরিয়ে রেখে, খুররম অনেক কষ্ঠ করে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়ায় এবং টলমল করতে করতে নদীর পানি থেকে উঠে আসে, তাঁর পরনের কাপড় থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে এবং পায়ের নাগড়া পানিতে বোঝাই, তারপরেও প্রাণে বেঁচে রয়েছে বলে ভাগ্যকে ধন্যবাদ দেয়। সে পানি থেকে উঠে আসার সময়েই তার এক দেহরক্ষীকে তাঁর কালোর ঘোড়ার লাগাম ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। নদীর তীরে তাঁর দেহরক্ষীদের অন্তত পাঁচজনের দেহ নিথর হয়ে পড়ে রয়েছে যখন তাঁদের দু’জন সহযোদ্ধা আরেকজনের বাহুর গভীর এক ক্ষতস্থান সেলাই করতে সাহায্য করছে, এক তরুণ রাজপুত, বেচারা দাঁতে দাঁত চেপে রেখে ক্ষতস্থান সেলাই করার সময়ে যন্ত্রণায় চিৎকার করা থেকে নিজেকে বিরত রেখেছে। খুররম অবশ্য ঘোড়ার পিঠে পুনরায় আরোহণ করে চারপাশে তাকিয়ে দেখে খুশি হয় যে তার নিজের লোকদের চেয়ে তার শত্রুদের অনেক বেশি মৃতদেহ পড়ে রয়েছে এবং তাঁরা পশ্চাদপসারণ করে, যুদ্ধক্ষেত্রের এই অংশটা মোগলদের অনুকূলে পরিত্যাগ করেছে। মালিক আম্বারের লোকেরা কোথায় গিয়েছে?

নদীর তীর বরাবর উপত্যকার শেষপ্রান্তের দিকে তাদের আরো সঙ্গীসাথীদের নিয়ে পশ্চাদপসারণ করেছে।’

‘আমরা কি অবরোধকের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছি?

 ‘হ্যাঁ, যুবরাজ, কামরান ইকবাল প্রশ্নের উত্তর দেয়, সে দ্রুত শ্বাস নিতে নিতে এই মাত্র এসে উপস্থিত হয়েছে। কয়েকটা স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিরোধ গড়ে উঠলেও আমরা সহজেই তাদের পরাস্ত করেছি।’

 ‘বেশ, পশ্চাদপসারণকারীদের তাহলে পিছু ধাওয়া করা যাক, কিন্তু হুশিয়ার। আগুন নিভতে শুরু করেছে আর ধোয়ার আড়াল দ্রুত সরে যাচ্ছে। আমরা এখন অনেক বেশি দৃশ্যমান আর তবকি এবং গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা তীরন্দাজদের কাছে আমরা এখন অনেক সহজ নিশানা। আমরা তাই দ্রুত অগ্রসর হবো আর পুরোটা সময় নদীর তীর অনুসরণ করবো যেখানে সামান্য হলেও কিছুটা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।

খুররম কথা বলার মাঝেই গোড়ালি দিয়ে তাঁর ঘোড়ার পাঁজরে আবারও গুতো দেয় এবং নদীর তীর বরাবর এগিয়ে যাওয়া শুরু করে। সে আর তার লোকজন অচিরেই যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালাতে থাকা তীরন্দাজ আর পদাতিক সৈন্যদের একটা দলকে আক্রমণ করে। সবাই নিজেদের অস্ত্র ফেলে দেয় কিন্তু একজন তীরন্দাজ সম্ভবত মৃত্যু নিশ্চিত জেনেই অবনত হয় আর খুররমের দিকে ধনুক তাক করে। খুররমের দেহরক্ষীদের একজন তাঁর পিঠে তরবারির আড়াআড়ি এক কোপ বসিয়ে দিয়ে তাকে মাটিতে ফেলে দেয় কিন্তু তার আগেই সে তার কালো পালকযুক্ত তীরে মৃত্যুর মন্ত্র দিয়ে যুবরাজের দিকে নিক্ষেপ করে। তীরটা তাঁর গিল্টি করা পর্যাণে বিদ্ধ হবার আগে তাঁর উরুতে আচড় কেটে যায়। খুররম কোনো ব্যাথা অনুভব করে না কিন্তু বেশ বুঝতে পারে তার পা বেয়ে রক্ত পড়তে শুরু করেছে। সে বিষয়টা পাত্তা না দিয়ে আরও কয়েকশ গজ ঘোড়া নিয়ে সামনে এগিয়ে যায় যতক্ষণ না একটা ফাঁকা জায়গায় স্থাপিত কয়েক সারি তাবুর কাছে এসে পৌঁছে। পুরো এলাকাটা পরিত্যক্ত মনে হয় এবং বেশ কয়েকটা তাবুতে আগুন জ্বলছে, খুব সম্ভবত মালিক আম্বারের পশ্চাদপসারণকারী লোকের কাজ।

 খুররম তাঁর দেহরক্ষীদের নিয়ে অস্থায়ী শিবির পেছনে ফেলে নদীর তীর বরাবর সামনের দিকে এগিয়ে যায় যা দু’পাশের পাহাড় ক্রমশ উঁচু এবং চারপাশ থেকে আরও ঘিরে আসায় প্রতিমুহূর্তে আরও সংকীর্ণ হয়ে আসছে। সহসা গাছের আড়াল থেকে গুলি বর্ষণের শব্দ ভেসে আসে এবং দেহরক্ষীদের একজন কপালে গাদাবন্দুকের তিলক নিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। নদীতে বিদ্যমান একটা বাঁক ঘুরতেই, খুররম সামনে গাছের কাণ্ড ফেলে তৈরি করা একটা অবরোধক দেখতে পায় যার পেছন থেকে কয়েকজন তবকী গুলি করছে। তাঁর সামনে পথটা এতটাই সংকীর্ণ যে সে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়ে সরাসরি অবরোধক অভিমুখে ঘোড়া হাকালে বন্দুকের গুলি তার চারপাশের বাতাস কেটে বের হয়ে যায়। অবশ্য, ভাগ্য তার সহায় থাকে এবং সে আর তার বাহন কালো ঘোড়াটা কোনো আচড় ছাড়াই গাছের গুঁড়ির তৈরি অবরোধক লাফিয়ে অতিক্রম করে। প্রতিরোধকারীরা প্রায় সাথে সাথে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে এবং চারপাশের গাছপালা অভিমুখে পালিয়ে যায়। কিন্তু একজন যোদ্ধা, যার গায়ের কৃষ্ণবর্ণ ত্বক আর মুখাবয়বের বৈশিষ্ট্যের কারণে তাকেও মালিক আম্বারের মতই আবিসিনিয়ান বংশোদ্ভূত বলে মনে হয়, গাছের গুঁড়িতে পা আটকে গিয়ে হাত পা ছড়িয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ে। তাকে জীবন্ত বন্দি করো!’ খুররম চিৎকার করে উঠে। তাঁর দু’জন দেহরক্ষী সাথে সাথে তাঁর আদেশ পালন করতে নিজেদের ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে মাটিতে নেমে কৃষ্ণবর্ণের পরিশ্রান্ত লোকটার দু’হাত দু’পাশ থেকে চেপে ধরে।

 ‘লোকটাকে আমার কাছে নিয়ে এসো, খুররম আদেশ দেয়। তারা তাই করে, তাঁর সামনে তাকে জোর করে হাঁটু মুড়ে বসতে বাধ্য করে। মালিক আম্বার কোথায়? খুররম দরবারে এবং বয়োজ্যেষ্ঠ আধিকারিকদের সাথে আলোচনার সময় ব্যবহৃত পার্সী বদলে হিন্দিতে প্রশ্নটা করে।

 আপনাকে যদি বন্দি করা হতো তাহলে আপনি কখনও আপনার সেনাপতির অবস্থানের কথা বলতেন না এবং আমিও বলবো না। কিন্তু সহজাত প্রবৃত্তির বশে সে আড়চোখে একবার উপত্যকার কিনারের দিকে তাকাতে নিজের অজান্তেই সে সত্যি কথা প্রকাশ করে ফেলে। সে তার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাতে নুড়িপাথরে ভর্তি পাহাড়ী ঢলের শীর্ষদেশে কয়েকটা অবয়ব দেখতে পায়। এই উপত্যকা থেকে বের হবার একটা পথ সেখানে রয়েছে, তাই না?

অবয়বগুলো দেখতে পেয়ে লোকটা অনেকটাই শমিত হয়েছে, এবং প্রশ্নের উত্তরে বলে, “আপনি যদি গাছের ডালপালা দিয়ে আমাদের তৈরি মইয়ের ব্যবস্থাকে বাইরে বের হবার পথ বলতে চান, তাহলে হ্যাঁ আছে। কিন্তু ব্যবস্থাটা আপনার কোনো কাজে লাগবে না। ঘোড়া মই ব্যবহার করতে পারবে না এবং আমাদের সেনাপতি আর তার সাথে যেসব সৈন্যরা রয়েছে তাদের জন্য উপরে আগে থেকেই ঘোড়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং আপনি পিছু ধাওয়া করার কোনো প্রচেষ্টা নেয়ার অনেক আগেই তারা নাগালের বাইরে চলে যাবে।

 ‘সে যা বলেছে সেটার সত্যতা যাচাই করে দেখো, খুররম তার দেহরক্ষীদের উদ্দেশ্যে বলে, কিন্তু হুশিয়ার। সামনে আরও আক্রমণকারী ওঁত পেতে থাকতে পারে।’

*

খুররম সেদিন সন্ধ্যাবেলা আরজুমান্দের সান্নিধ্যে শুয়ে থাকে। তার উরুর ক্ষতটা ততটা মারাত্মক নয় এবং সেখানে এখন সাদা সুতি কাপড়ের পট্টি বাধা রয়েছে আর সেও গোসল করে পরিচ্ছন্ন হয়েছে। তার লোকজন বাইরে দারুণ হৈ-হট্টগোলের মাঝে নিজেদের বিজয় উদযাপন করছে। সে কিছুটা সময় তাঁদের সাথে অতিবাহিত করেছে তারপরে হেকিমের তাবুতে গিয়ে আহতদের পরিচর্যার বিষয়ে খবর নিয়ে অবশেষে আরজুমান্দের কাছে ফিরে এসেছে। সেনাপতি হিসাবে তার প্রথম একক অভিযানে বিজয়ের আনন্দে যুদ্ধে আহত সৈন্যদের কষ্ট আর আবিসিনিয়ান যোদ্ধা যে সত্যি কথাই বলেছে–মালিক আম্বার আসলেই পালিয়ে গিয়েছে, এই তথ্য খানিকটা কালিমা লেপন করেছে। অবশ্য যুদ্ধবন্দি আর নিহত সৈন্যদের লাশ গণনা করে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে সে নিজের সাথে খুব বেশি হলে কয়েক’শ যোদ্ধা নিয়ে যেতে পেরেছে। আহমেদনগরের সুলতানের সেনাবাহিনী পরাস্ত হয়েছে। তাকে এখন শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য দেনদরবার করতে হবে। মোগল বিজয় অর্জিত হয়েছে।

*

আগ্রা দূর্গের পাশে যমুনা নদীর তীরে খুররমের সেনাবাহিনী শ্রেণীবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান রয়েছে। অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে ইস্পাতের বর্মসজ্জিত রণহস্তির সারি সুশৃঙ্খলভাবে বিন্যস্ত–যেহেতু এটা যুদ্ধের নয় উৎসবের সময়–আজ তাদের গজদাতে কোনো তরবারি সংযুক্ত করা হয়নি, যা তাঁদের মাহুতেরা সোনালী রঙ করে দিয়েছে। কমলা আর লাল রঙের পাগড়ি পরিহিত রাজপুত রক্ষীবাহিনী পরিবেষ্টিত অবস্থায় সোনালী রঙ করা শিঙের সাদা ষাড় দিয়ে টেনে নিয়ে আসা মালবাহী শকটগুলোয় রয়েছে. খুররমের বাহিনীর দখল করা ধনসম্পদ ভর্তি বাক্স।

খুররম নিজেও একেবারে সামনের সারির সেনাপতিদের থেকে বিশ কদম আগে তাঁর কালো স্ট্যালিয়নে প্রাণীটা যুদ্ধক্ষেত্রে দারুণ সাহসিকতার সাথে তাকে সহযোগিতা করেছে উপবিষ্ট অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। সোনালী রঙের আনুষ্ঠানিক মাথার সাজ আর সবুজ মখমলের ভারি পর্যাণের কাপড় যা প্রায় মাটি ছুঁইছুই করছে ঘোড়াটা অভ্যস্ত না হওয়ায় থেকে থেকেই অস্থির ভঙ্গিতে নড়াচড়া করছে আর মাথা ঝাঁকাচ্ছে। শান্ত হও বাছা, খুররম বিড়বিড় করে বলে, জন্তুটার ঘামে চিকচিক করতে থাকা গলায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয়। তোমার উচিত আমাদের নিরাপদে ফিরে আসা লোকদের উদ্যাপন করতে এবং আমাদের বিজয়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতে দেয়া। সহসা দূর্গপ্রাকারের পুরোটা দৈর্ঘ্য জুড়ে অসংখ্য ক্র্য ধ্বনিত হতে জাহাঙ্গীর সেখানে আবির্ভূত হয়ে হাত নেড়ে বিজয়ী মোগল বাহিনীকে স্বাগত জানায়।

জাহাঙ্গীরের হাতের আন্দোলিত ভঙ্গি দেখে যমুনার অপর তীরে, কনুই দিয়ে ধাক্কাধাক্কি করতে থাকা এবং আরেকটু ভালো করে দেখার জন্য চোখ কুঁচকে তাকিয়ে থাকা জনতার মাঝ থেকে উল্লসিত গর্জন ভেসে আসে। একটা খেপাটে আকাঙ্খ সহসা খুররমকে আবিষ্ট করে তার ইচ্ছে হয় নিজের ঘোড়া নিয়ে কালচে বাদামি পানি সাতরে অতিক্রম করে এবং উফুল্ল, মুগ্ধ দর্শকদের কাতারে গিয়ে যোগ দেয়। বিজয় আর জনগণের স্বহর্ষ করতালি কি সবসময়ে এত ভালো অনুভূতির সৃষ্টির করে? কিন্তু এসব চিন্তা দূরে সরিয়ে সে আবার উপরের দিকে তাকিয়ে দেখে তাঁর আব্বাজান প্রস্থান করেছেন। তাঁর কাছে যাবার এবার সময় হয়েছে। খুররম তার দেহরক্ষীদের দ্বারা অনুসৃত হয়ে দুলকি চালে ঘোড়া নিয়ে দূর্গ অভিমুখে খাড়াভাবে উঠে যাওয়া ঢালু পথটার দিকে এগিয়ে যায়। আরজুমান্দ সেখানে একটা রাজকীয় হাতির পিঠে পান্নাখচিত হাওদায়, দৃষ্টিগোচর হওয়া থেকে রেশমের পর্দা দিয়ে সৃষ্ট আড়ালে তার জন্য অপেক্ষা করছে। বারোজন অশ্বারোহী দেহরক্ষী–গুরুত্বের স্মারক হিসাবে জাহাঙ্গীরের প্রেরিত–তার হাতির পিছনে জোড়ায় জোড়ায় বিন্যস্ত হয়ে অবস্থান করছে। আগ্রায় তার স্ত্রীর বিজয়দৃপ্ত প্রত্যাবর্তনে তাঁর প্রতিরক্ষা সহচর হিসাবে সামনে অবস্থানকারী সৈন্যদের খুররম মনোনীত করেছে যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের প্রদর্শিত সাহসিকতার কথা বিবেচনা করে। খুররম সব শেষে আসা নিজের দেহরক্ষীদের আদেশ দিয়ে সামনে তার জন্য নির্ধারিত স্থানে অবস্থান নেয় এবং ঢাল দিয়ে অগ্রসর হতে সে নিজের দাস্তানাবৃত হাত দিয়ে তাঁর ক্ষুদ্র বহরের উদ্দেশ্যে ইশারা করে।

 প্রধান তোরণগৃহের নিচে দিয়ে অতিক্রম করে তারা দূর্গে প্রবেশ করতে অতিকায় দামামাগুলো গুরুগম্ভীর শব্দে বেজে উঠে এবং পরিচারকের দল গিল্টি করা গোলাপের পাপড়ি আর চাঁদ এবং তারার মত দেখতে সোনা আর রূপার তৈরি ক্ষুদ্র অলঙ্কার মুঠো মুঠো ছুঁড়ে দেয় যা তাঁদের চারপাশে ভাসতে ভাসতে নিচে পড়ে। বাঁকানো আর খাড়া ঢাল দিয়ে তাঁরা উপরে উঠা অব্যাহত রাখলে খুররম লক্ষ্য করে প্রতিটা দেয়ালে ব্রোকেডের সবুজ পট্টি বাঁধা রয়েছে। তাঁরা শীঘ্রই আরেকটা তোরণদ্বার অতিক্রম করে এবং প্রাচীরবেষ্টিত প্রধান আঙিনায় এসে পৌঁছে, যার শেষপ্রান্তে রয়েছে তাঁর আব্বাজানের বহু স্তম্ভবিশিষ্ট তিন দিক খোলা, দেওয়ানি আম। আঙিনাটা অভিজাত অমাত্যদের ভীড়ে গিজগিজ করছে কিন্তু ঠিক মধ্যেখানে গোলাপের পাপড়ি শোভিত একটা প্রশস্ত পথ খালি রাখা হয়েছে। পথটার শেষ মাথায় একটা বেদীর উপরে সিংহাসনে উপবিষ্ট অবস্থায় সে তার আব্বাজানের ঝলমলে অবয়র দেখতে পায়।

জাহাঙ্গীর যেখানে বসে রয়েছে খুররম যখন সেখান থেকে ত্রিশ ফিট দূরে রয়েছে, সে তার হাত তুলে পিছনের শোভাযাত্রাকে থামার ইঙ্গিত করে এবং ঘোড়া থেকে নেমে দাঁড়ায় যাতে করে সে তার আব্বাজানের কাছে পায়ে হেঁটে যেতে পারে। সে বেদীর দিকে দুই কি তিন কদম এগিয়েছে যখন সে জাহাঙ্গীরের ডাক শুনতে পায়, ‘দাঁড়াও। আমিই আসছি তোমার কাছে।

চারপাশ থেকে রুদ্ধশ্বাস বিস্ময়ের শব্দ ভেসে উঠে। বিজয়ী সেনাপতিকে স্বাগত জানাতে নিজের সিংহাসন থেকে সম্রাটের নেমে আসা–এমনকি আপন রক্তসম্পর্কিত আত্মীয়ের ক্ষেত্রেও–অভূতপূর্ব একটা ঘটনা। জাহাঙ্গীর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়, সিংহাসন থেকে বেদীর কিনারে হেঁটে আসে এবং মার্বেলের ছয়টা নিচু ধাপ বেয়ে নিচে নামে। খুররম তাকিয়ে দেখে তার দিকে এগিয়ে আসার সময় আব্বাজানের রত্নখচিত পাগড়ির সারসের পালক দুলছে এবং কীভাবে তার কানে, গলায় আর আঙুলের হীরকখণ্ড শুভ্র আগুনের ন্যায় জ্বলজ্বল করছে, কিন্তু সে এসব কিছু এমনভাবে তাকিয়ে দেখে যেন সে স্বপ্ন দেখছে।

 তাঁর আব্বাজান যখন মাত্র কয়েকফিট দূরে অবস্থান করছে, খুররম হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে এবং মাথা নত করে। জাহাঙ্গীর তার চুল স্পর্শ করে, তারপরে বলে, ‘জিনিষটা নিয়ে এসো।’ খুররম আড়চোখে উপরে তাকিয়ে দেখে একজন পরিচারক ছোট একটা সোনার ট্রে নিয়ে এগিয়ে আসছে যার উপরে কিছু একটা স্তূপ করা রয়েছে–কি রয়েছে সে দেখতে পায় না–আর তাঁর আব্বাজান তাঁর কাছ থেকে সেটা নেয়। খুররম আবার দৃষ্টি নত করে এবং পরমুহূর্তে সে বুঝতে পারে তাঁর আব্বাজান ট্রের জিনিষগুলো তাঁর মাথায় আলতো করে ছোঁয়ান। তাঁর চারপাশে স্বর্ণমুদ্রা আর দামী রত্নপাথর বৃষ্টির মত ঝরে পড়তে থাকে।

 ‘আমার বিজয়ী আর প্রিয়তম পুত্র তোমায় স্বাগতম, তাঁর আব্বাজান বলছে সে শুনতে পায়, তারপরে নিজের কাঁধে জাহাঙ্গীরের হাত অনুভব করে, তাকে তুলে দাঁড় করায়। আমি চাই এখানে উপস্থিত সবাই সেনাপতি এবং আমার পুত্র হিসাবে তোমার জন্য আমার উচ্চ ধারণার কথা জানুক। তোমায় নিয়ে আমার গর্বের স্মারক হিসাবে, আমি আজ তোমায় শাহ জাহান উপাধিতে ভূষিত করছি, যার মানে পৃথিবীর অধিশ্বর।’

গর্বে খুররমের বুকটা ফুলে উঠে। সে অনেক আশা নিয়ে যুদ্ধাভিযানে যাত্রা করেছিল কিন্তু সেই সাথে সে কতটা সাফল্য লাভ করতে পারবে সেটা নিয়ে খানিকটা বিচলিতও ছিল। সে এখন একটা কাজ ভালো করে সমাপ্ত করার প্রগাঢ় সন্তুষ্টি বোধ করে। সে তাঁর আব্বাজানের কাছে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছে এবং তিনিও সেটার প্রশংসা করেছেন। তাঁর আব্বাজানের উত্তরাধিকারী হিসাবে তার মনোনীত হবার উচ্চাশা পরিপূরণে নিশ্চিতভাবে এখন কোনো কিছুই আর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *