জাল বিস্তার
শার্লক হোমসকে দেখে স্যার হেনরি যতটা অবাক হলেন তার চাইতেও বেশি খুশি হলেন। কেননা, দিন কয়েক ধরে আশা করছিলেন সাম্প্রতিক ঘটনার আকর্ষণে লন্ডন থেকে আসবে হোমস। বন্ধুবরের সঙ্গে মালপত্র নেই এবং না-থাকার কোনো ব্যাখ্যাও নেই শুনে একটু ভুরু তুললেন। গোপনে সব বুঝিয়ে বললাম এবং একটু দেরি করে নৈশ আহারে বসে আমাদের অভিজ্ঞতার কিছু কিছু তাকে নিবেদন করলাম–ওঁর পক্ষে যতটুকু জানা দরকার, তার বেশি অবশ্য একটা অপ্রীতিকর কর্তব্য সারতে হল–ব্যারিমুর আর তার স্ত্রীকে ডেকে জানাতে হল সেলডেনের শোচনীয় মৃত্যুসংবাদ। ব্যারিমুরের কাছে খবরটা অপ্রশমিত স্বস্তিবোধের কারণ হলেও কেঁদে অ্যাপ্রন ভিজিয়ে ফেলল তার স্ত্রী। দুনিয়ার সামনে সেলডেন একটা জঘন্য হিংস্র পুরুষ ছাড়া কিছুই নয়–অর্ধ-পশু অর্ধ-দানবের সংমিশ্রণ। কিন্তু দিদির কাছে সে সেই ছোট্ট একগুঁয়ে খোকা–দিদির হাত জড়িয়ে ধরে বড়ো হয়ে ওঠা ছোট্ট দুষ্টু ভাইটি। যে-পুরুষের মৃত্যুতে শোক করার মতো একজন নারীরও অভাব হয়, তার মতো অভিশপ্ত অভাগা আর নেই।
ব্যারনেট বললেন, ওয়াটসন সকালে বেরিয়ে যাবার পর ঘরদোর মোছামুছি করছিলাম আমি। কথা রাখার জন্যে আমার কিন্তু বেশ খানিকটা কৃতিত্ব প্রাপ্য হয়েছে। একলা বেরোব
এ-কথা যদি আপনাদের না-দিতাম, সন্ধেটা আজকে ভালোই কাটত। কেননা স্টেপলটন খবর পাঠিয়েছিলেন ওঁদের ওখানে যাওয়ার জন্যে।
শুষ্ক কণ্ঠে হোমস বললে, সন্ধেটা আরও ভালোভাবে যে কাটত, তাতে কোনো সন্দেহই নেই আমার। আপনার ঘাড় মটকানোর জন্যে আমরা শোক আর অনুতাপে জ্বলেপুড়ে মরছিলাম শুনলে নিশ্চয় খুশি হবেন না?
চোখের পাতা পুরো খুলে গেল স্যার হেনরির, সে আবার কী?
বেচারা আপনার পোশাক পরে বেরিয়েছিল। পুলিশের ঝামেলায় পড়তে পারে আপনার চাকর। এ-পোশাক সে-ই তাকে দিয়েছিল।
তা নাও হতে পারে। যদূর জানি, কোনো পোশাকেই চিহ্ন নেই।
তাহলে আপনার চাকরের কপাল ভালো শুধু তাই নয়, আপনাদের সকলেরই। কেননা আপনারা প্রত্যেকেই এ-ব্যাপারে আইনবিরোধী কাজ করেছেন। ওয়াটসনের রিপোর্টের ভিত্তিতে দোষী আপনারা প্রত্যেকেই। বিবেকবান গোয়েন্দা হিসেবে বাড়িসুদ্ধ সবাইকে গ্রেপ্তার করাটা আমার প্রথম কর্তব্য হওয়া উচিত।
কিন্তু কেস কদ্দূর এগোল? শুধোন ব্যারনেট। জট ছাড়াতে পারবেন? এখানে আসার পর আমি আর ওয়াটসন যে-তিমিরে ছিলাম, এখনও সেই তিমিরেই রয়েছি।
খুব বেশি আর দেরি হবে বলে মনে হয় না, তার আগেই পরিস্থিতি অনেকটা প্রাঞ্জল করতে পারব। ব্যাপারটা অসাধারণ জটিল, আর অত্যন্ত কঠিন। কতকগুলো বিষয়ে এখনও আলোকপাত প্রয়োজন অবশ্য তার সূচনাও দেখা দিয়েছে!
ওয়াটসন নিশ্চয় জানিয়েছে আপনাকে এর মধ্যে আমাদের একটা অভিজ্ঞতা লাভ ঘটেছে। জলার বুকে হাউন্ডের ডাক আমরা দুজনেই শুনেছি–কাজেই কিংবদন্তিটা একেবারেই অলীক বা নিছক কুসংস্কার মানতে পারছি না। পশ্চিমে থাকার সময়ে কুকুর নিয়ে কিছু কাজ করতে হয়েছিল আমাকে, ডাক শুনলেই ধরতে পারি। এ-কুকুরকে যদি ধরতে পারেন, মুখবন্ধনী পরিয়ে গলায় চেন দিয়ে বাঁধতে পারেন তবেই বলব আপনি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা।
সাহায্য যদি করেন তাহলে মুখবন্ধনী পরিয়ে গলায় চেন দিয়ে বাঁধতে পারব বলেই আমার মনে হয়।
যা বলবেন, তাই করব।
চমৎকার। আরও একটা কথা বলব। অন্ধের মতো যা বলব তাই করতে হবে; কথায় কথায় প্রশ্ন করলে চলবে না।
যা চাইবেন, তাই হবে।
যদি করতে পারেন, তাহলে জানবেন ছোট্ট এই সমস্যার সুরাহা শিগগিরই হয়ে যাবে। আমার বিশ্বাস
আচমকা কথা বন্ধ করে আমার কাঁধের ওপর দিয়ে স্থির চোখে শুন্যে তাকাল হোমস। ল্যাম্পের আলো আছড়ে পড়ল মুখাবয়বে। দেখলাম, মুখের একটা পেশিও নড়ছে না। তন্ময় হয়ে রয়েছে চোখের চাহনি, ঠিক যেন একটা নিখুঁত খোদাই অত্যুৎকৃষ্ট প্রস্তরমূর্তি। মূর্তিমান প্রত্যাশা আর সতর্কতা।
কী হল? চেঁচিয়ে উঠলাম দু-জনেই।
চোখ নামাল হোমস। স্পষ্ট দেখলাম একটা আত্যন্তিক আবেগ চাপার চেষ্টা করছে। মুখভাব সংযত, কিন্তু দুই চক্ষু কৌতুক তরলিত।
উলটোদিকের দেওয়ালে প্রলম্বিত সারি সারি প্রতিকৃতির দিকে হস্ত সঞ্চালন করে বললে, সমঝদারের প্রশংসা গ্রহণ করুন। আমি যে আর্টের খবর রাখি, ওয়াটসন তা মানতেই চায় না। তবে সেটা নিছক ঈর্ষা, কেননা, এ-ব্যাপারে দু-জনের মত দু-রকম, এ-ছবিগুলো কিন্তু সত্যিই উঁচুদরের।
একটু অবাক হয়ে বন্ধুবরের পানে তাকিয়ে স্যার হেনরি বললেন, ভালো লাগল আপনার প্রশংসা। এসব জিনিস খুব একটা বুঝি এমন ভান করতে চাই না। ছবির চাইতে ঘোড়া বা কম বয়েসি বলদের কদরটা বুঝি বেশি। এসব জিনিসের জন্যেও সময় পান জানতাম না।
ভালো জিনিস দেখলে বুঝতে পারি–এখন যা দেখেছি, তা উঁচুদরেরই জিনিস বলতে পারি, ওদিকে নীল সিল্ক পরা ওই যে ভদ্রমহিলা, উনি নিশ্চয় নেলার। মাথায় পরচুলা পরা এই যে মোটাসোটা ভদ্রলোক, ইনি নিশ্চয় রেনল্ডস। সবই পারিবারিক প্রতিকৃতি, তাই না?
প্রত্যেকটা।
নাম জানেন?
ব্যারিমুর শিখিয়ে দিয়েছে, শিক্ষাটা রপ্তও করেছি মোটামুটি।
টেলিস্কোপ নিয়ে ওই ভদ্রলোক কে?
রিয়ার অ্যাডমিরাল বাস্কারভিল। ওয়েস্ট ইন্ডিজে রোডনীতে মোতায়েন ছিলেন। নীল কোট পরে হাতে পাকানো কাগজ নিয়ে যিনি দাঁড়িয়ে, উনি স্যার উইলিয়াম বাস্কারভিল। পিট-এর অধীনস্থ হাউস অফ কমন্স কমিটিগুলোর চেয়ারম্যান ছিলেন।
আমার সামনে এই যে অশ্বারোহী সৈনিক গায়ে কালো মখমল আর লেস-ইনি কে?
এঁর সম্পর্কে জানার অধিকার আপনার আছে। ইনিই যত নষ্টের মূল বাস্কারভিলস হাউন্ডের শুরু যিনি করেছেন–বদমাইশ শিরোমণি হিউগো। এঁকে ভুলতে পারব বলে মনে হয় না।
সাগ্রহে, সবিস্ময়ে স্থির চোখে চেয়ে রইলাম প্রতিকৃতির দিকে।
হোমস বললে, কী আশ্চর্য! দেখে তো খুব শান্ত, কুণ্ঠিত মানুষ বলে মনে হয়। চোখের মধ্যে কিন্তু দেখতে পাচ্ছি খোদ শয়তান যেন ওত পেতে রয়েছে। আমি ভেবেছিলাম দুবৃত্ত ধরনের আরও বলিষ্ঠ চেহারা দেখব।
এটাই যে যথার্থ ছবি, সে-বিষয়ে ভুল নেই। নাম আর ১৬৪৭ তারিখটা পেছনের ক্যানভাসে লেখা রয়েছে।
আর বেশি কথা বলল না হোমস। কিন্তু প্রাচীন রাজন্য প্রতিকৃতির প্রতি খুবই আকৃষ্ট হয়েছে দেখা গেল। সামনের ছবির দিকে চেয়ে থেকে শেষে করল নৈশ আহার। স্যার হেনরি নিজের ঘরে গেলে পর শুনলাম ওর চিন্তাধারার বৃত্তান্ত। শোবার ঘরের মোমবাতি হাতে নিয়ে আমাকে ফের নিয়ে গেল খাবার ঘরে এবং উঁচু করে তুলে ধরল দেওয়ালে প্রলম্বিত কালো মলিন ছবিটার সামনে।
কিছু দেখতে পাচ্ছো?
পাখির পালক গোঁজা চওড়া-কিনারা টুপির দিকে তাকালাম, কানের পাশে ঝোলা কোকড়া চুল; সাদা লেসের কলার দিয়ে ঘেরা সোজা, কঠিন মুখটি খুঁটিয়ে দেখলাম। পাশবিক মূখ। মোটেই নয়, কিন্তু নিখুঁত, শক্ত, কঠোর দৃঢ়সংবদ্ধ পাতলা ঠোঁট। হিমশীতল অসহিষ্ণু চোখ।
এইরকম দেখতে চেনো কাউকে?
চোয়ালটা অনেকটা স্যার হেনরির মতন।
হয়তো একটু আদল আছে। কিন্তু দাঁড়াও!
চেয়ারের ওপর উঠে দাঁড়াল হোমস। বাঁ-হাতে ধরল আলো, ডান বাহু বেঁকিয়ে চাপা দিল চওড়া টুপি আর লম্বা কোঁকড়া চুল।
আরে সর্বনাশ! বললাম সবিস্ময়ে।
ক্যানভ্যাসের বুকে সহসা আবির্ভূত হয়েছে স্টেপলটনের মুখ।
এই তো, দেখতে পেলে তাহলে। আমার হল ট্রেনিং-পাওয়া চোখ–মুখটাই দেখি, পারিপাট্য বাদ দিই। অপরাধ তদন্তকারীর পয়লা গুণটাই তো ছদ্মবেশ ছুঁড়ে দেখবার ক্ষমতা।
কিন্তু এ যে অবিশ্বাস্য আশ্চর্য ব্যাপার। ছবিটা ওঁর বলেও চালিয়ে দেওয়া যায়।
হ্যাঁ, একেই বলে পূর্বপুরুষের ধারায় প্রত্যাগত বংশধর–আত্মিক ও শারীরিক দিক দিয়েই। এটা হল একটা কৌতূহলোদ্দীপক দৃষ্টান্ত। শুধু পারিবারিক প্রতিকৃতি নিয়েই যদি গবেষণা করা যায়, জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস এসে যায়। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ভদ্রলোক বাস্কারভিল বংশের একজন।
শুধু তাই নয়–উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি দখলের চক্রান্তও চালাচ্ছেন।
ঠিক তাই। কালক্রমে ছবিটা চোখে পড়ায় একটা অত্যন্ত অবশ্যম্ভাবী সংযোগ সূত্রও হাতে এসে গেল। মিসিং লিঙ্ক এখন পরিষ্কার। ওয়াটসন ভদ্রলোক এখন আমাদের হাতের মুঠোয়। কাল রাত শেষ হওয়ার আগেই জালে পড়বেন। প্রজাপতি বেচারারা যেভাবে ওঁর জালে আটকে পতপতিয়ে ছটফট করে, উনিও ছটফট করবেন আমাদের জালে। একটা আলপিন, একটা ছিপি, আর একটা কার্ড ওকেও গেঁথে রেখে দেব আমাদের বেকার স্ট্রিটের সংগ্রহশালায়!
ছবির সামনে থেকে হাসতে হাসতে ফিরে এল হোমস। এভাবে ওকে বড়ো একটা হাসতে দেখা যায় না। বিরল এই হাসি যখনই শুনেছি তখনই জেনেছি দিন ঘনিয়ে আসছে কারুর।
পরের দিন বেশ ভোরে শয্যাত্যাগ করলাম। কিন্তু দেখি হোমস উঠেছে আমারও আগে। আমি যখন পোশাক পরছি, ও তখন বাগানের পথ দিয়ে ফিরছে।
দু-হাত ঘষে কাজ-চনমনে হৃষ্টকণ্ঠে বললে, ওহে, আজ আর নিশ্বেস ফেলার সময় নেই। জাল পাতা হয়ে গেছে টানা শুরু হল বলে। দিন ফুরোনোর আগেই জানা যাবে পাতলা-চোয়াল প্রকাণ্ড পাইক মাছ জালে পড়ল, না, জাল কেটে বেরিয়ে গেল।
বাদায় ঘুরে এলে নাকি?
সেলডেনের মৃত্যুর খবর গ্রিমপেন থেকে প্রিন্সটাউনে পাঠিয়ে দিলাম। তোমাদের কেউই ঝামেলায় পড়বে না। পরম বিশ্বাসী কার্টরাইটকেও খবর পাঠালাম। নইলে বেচারা ভেবে মরত। প্রভুভক্ত কুকুর যেমন প্রভুর কবর ছেড়ে নড়তে চায় না, ও বেচারিও তেমনি কুটিরের দরজার ছেড়ে আসত না–হা-হুতাশ করে মরত।
এরপর কী করবে?
স্যার হেনরির সঙ্গে দেখা করব। আরে, ওই তো উনি আসছেন?
গুডমর্নিং হোমস, বললেন বারনেট। আপনাকে এখন ঠিক সেনাধ্যক্ষের মতো মনে হচ্ছে–মুখ্য অফিসারকে ডেকে লড়াইয়ের পরিকল্পনা করছেন যেন।
পরিস্থিতি এখন হুবহু তাই। ওয়াটসন অর্ডার চাইছেন।
সে তো আমিও চাইছি।
উত্তম কথা। যদূর জানি, আজ রাতে বন্ধুবর স্টেপলটনের বাড়িতে আপনার আহারের নেমন্তন্ন আছে।
আশা করি আপনিও আসবেন। ভাই-বোন দু-জনেই খুব অতিথিবৎসল। আপনাকে দেখে খুব খুশি হবে।
ওয়াটসন আর আমার কিন্তু লন্ডন না-গেলেই নয়।
লন্ডন যাবেন?
এই পরিস্থিতিতে আমার বিশ্বাস লন্ডনে থাকলেই আমরা বেশি কাজ করতে পারব।
মুখটা লম্বা হয়ে গেল ব্যারনেটের।ভেবেছিলাম এ-ব্যাপারের শেষ পর্যন্ত আপনারা দেখে যাবেন। একার পক্ষে বাস্কারভিল আর বাদা জায়গাটা খুব আনন্দের জায়গা নয়।
ভায়া, আমার ওপর অটল আস্থা রাখুন যা বলি ঠিক তাই করুন। বন্ধুদের বলবেন, আমাদের আসার ইচ্ছে ছিল, এলে খুবই আনন্দ পেতাম কিন্তু জরুরি তলবে শহরে যেতে হয়েছে। খুব শিগগিরই ডেভনশায়ারে ফিরে আসার ইচ্ছে আছে। কথাগুলো গুছিয়ে বলতে ভুলবেন না নিশ্চয়ই?
নেহাতই যদি জোর করেন, তাহলে বলতে হবে।
বিশ্বাস করুন, এ ছাড়া কিছু করার নেই।
ব্যারনেটের মেঘাচ্ছন্ন ললাট দেখে বুঝলাম গভীর আঘাত পেয়েছেন। উনি ধরে নিয়েছেন আমরা ওঁকে ফেলে পালাচ্ছি।
বললেন শীতল কণ্ঠে, কখন যাবেন ঠিক করেছেন?
ব্রেকফাস্ট খাওয়ার পরেই। কুমবে ট্রেসি স্টেশন থেকে যাব। ওয়াটসন যে আবার ফিরে আসবে তার গ্যারান্টি হিসেবে জিনিসপত্র রেখে যাবে। ওয়াটসন, স্টেপলটনকে একটা চিরকুট লিখে জানিয়ে দাও আসতে পারছ না।
ব্যারনেট বললেন, আপনাদের সঙ্গে আমারও লন্ডন যেতে মন চাইছে। আমি একা এখানে কেন পড়ে থাকব বলতে পারেন?
কারণ, আপনার কর্তব্য কেন্দ্র এইখানে। কারণ, আপনি আমাকে কথা দিয়েছেন যা বলব তাই শুনবেন এবং এখন আমি এইখানেই আপনাকে থাকতে বলছি।
ঠিক আছে, আমি থাকব।
আর একটা নির্দেশ। আমার ইচ্ছে আপনি মেরিপিট হাউসে গাড়ি নিয়ে যাবেন। পৌঁছেই ঘোড়ার গাড়ি বাড়ি পাঠিয়ে দেবেন। ওঁদের জানিয়ে দেবেন, হেঁটে বাড়ি ফেরার ইচ্ছে আপনার।
বাদার ওপর দিয়ে হেঁটে আসব?
হ্যাঁ।
কিন্তু ঠিক এই কাজটাই আপনি আমাকে নিষেধ করেছেন বহুবার।
এবার আপনি নিরাপদে হাঁটতে পারেন। আপনার স্নায়ু আর সাহসের ওপর পরিপূর্ণ আস্থা আছে বলেই এমন কথা বললাম–নইলে বলতাম না। কিন্তু হেঁটে আসাটা একান্তই দরকার।
বেশ, তাহলে হেঁটেই আসব।
প্রাণের মায়া থাকলে সোজা রাস্তা ছেড়ে বাদার অন্য রাস্তা ভুলেও মাড়াবেন না। সোজা রাস্তা একটাই–মেরিপিট হাউস থেকে গ্রিমপেন রোড, বাড়ি ফেরার স্বাভাবিক পথ।
যা বলছেন, ঠিক তাই করব।
চমৎকার। ব্রেকফাস্ট খেয়েই বেরিয়ে পড়ব ভাবছি। তাহলে লন্ডন পৌঁছে যাব বিকেল নাগাদ।
গত রাতে হোমস স্টেপলটনকে বলেছিল বটে যে পরের দিন বিদায় নেবে এ-অঞ্চল থেকে। তা সত্ত্বেও ওর সফরসূচি শুনে বিস্মিত হলাম। আমাকেও যে সঙ্গে নিয়ে যাবে, এটা তখন মাথায় আসেনি আমার। বিশেষ করে যে-সময়টা খুবই সংকটপূর্ণ বলে নিজেই বলেছে, ঠিক সেই সময়টাতেই দু-জনেরই এ-জায়গা ছেড়ে লম্বা দেওয়ার কারণ কিছুতেই বুঝতে পারলাম না। মনে তিলমাত্র সংশয় না-রেখে অক্ষরে অক্ষরে হুকুম তামিল করা ছাড়া পথও নেই। তাই যথাসময়ে শুষ্কবদনে ক্ষুব্ধ বন্ধুর কাছে বিদায় নিয়ে দু-ঘণ্টা পরে পৌঁছোলাম কুমবে ট্রেসি স্টেশনে। গাড়ি ফিরে গেল বাস্কারভিল হলে। প্ল্যাটফর্মে একটা ছেলেকে থাকতে দেখলাম।
হুকুম আছে, স্যার?
কার্টরাইট, এই ট্রেনেই শহরে যাও। পৌঁছেই আমার নামে একটা টেলিগ্রাম পাঠাবে স্যার হেনরি বাস্কারভিলকে। বলবে, ভুল করে আমি পকেটবইটা ফেলে এসেছি। উনি খুঁজে পেলেই যেন রেজিস্টার্ড ডাকযোগে বেকার স্ট্রিটে পাঠিয়ে দেন।
ইয়েস, স্যার।
স্টেশন অফিসে গিয়ে জিজ্ঞেস করে এসো আমার নামে চিঠিপত্র এসেছে কিনা।
একটা টেলিগ্রাম নিয়ে ফিরে এল ছেলেটা। হোমস পড়ল। আমার হাতে দিল। টেলিগ্রামে লেখা আছে—
তারবার্তা পেয়েছি। স্বাক্ষরহীন গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে আসছি। পাঁচটা চল্লিশে পৌঁছোব–লেসট্রেড।
সকালে আমি একটা টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলাম–এটা তার উত্তর। পেশাদার গোয়েন্দাদের মধ্যে ওকেই আমি সেরা বলে মনে করি ওর সহযোগিতা হয়তো দরকার হতে পারে। ওয়াটসন, মিসেস লরা লায়ন্সের সঙ্গে দেখা করলে আমার বিশ্বাস সময়টা ভালোভাবে কেটে যাবে।
ওর লড়াই-পরিকল্পনা একটু একটু করে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আমরা যে সত্যিই ফিরে গেছি, এ-খবরটা স্টেপলটন ভাইবোনদের বিশ্বাস করাচ্ছে ব্যারনেটকে দিয়ে। আসলে কিন্তু আমরা থেকে যাচ্ছি। ঠিক যখন আমাদের দরকার হবে, তখন আমরা ফিরে যাচ্ছি। লন্ডন-থেকে-পাওয়া টেলিগ্রামের কথাটা যদি স্যার হেনরি উল্লেখ করেন স্টেপলটন ভাইবোনকে, তাহলে সন্দেহের শেষ ছায়াটুকুও বিদায় নেবে ওদের মন থেকে। পাতলা-চোয়াল মিষ্টি জলের পাইক-মাছের চারপাশে আমাদের জাল যে এর মধ্যেই বেশ এঁটে বসেছে, এতক্ষণে তা টের পেলাম।
অফিসে ছিল মিসেস লরা লায়ন্স। খোলাখুলি আর সোজাসুজি কথা আরম্ভ করে দিল শার্লক হোমস। যৎপরোনাস্তি তাজ্জব হয়ে গেল ভদ্রমহিলা।
স্বর্গত স্যার চার্লস বাস্কারভিলের মৃত্যুকালীন পরিস্থিতির তদন্ত করতে এসেছি আমি। এ-ব্যাপারে আপনি যা বলেছেন এবং যা চেপে গেছেন–তা আমার বন্ধু ওয়াটসন আমাকে জানিয়েছে।
কী চেপে গেছি? উদ্ধতভাবে বললে ভদ্রমহিলা। রাত দশটায় স্যার চার্লসকে ফটকে আসতে বলেছিলেন, আপনি স্বীকার করেছেন। আমরা জানি ঠিক ওই সময়ে ওই জায়গাতেই মারা গেছেন তিনি। এই দুটো ঘটনার মধ্যে যোগসূত্রটা আপনি চেপে গেছেন।
কোনো যোগসূত্ৰই নেই।
সেক্ষেত্র বলতে হবে কাকতালীয়টা বাস্তবিকই অসাধারণ। আমার কিন্তু বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত একটা যোগসূত্র আমরা বার করবই। মিসেস লায়ন্স আমি আপনার সঙ্গে অত্যন্ত খোলাখুলি কথা বলতে চাই। আমাদের চোখে স্যার চার্লসের মৃত্যুর ব্যাপার আসলে একটা খুনের কেস এবং সাক্ষ্যপ্রমাণ যা পাওয়া গেছে তাতে আপনার বন্ধু মি. স্টেপলটনই শুধু দোষী প্রতিপন্ন হবেন না–তাঁর স্ত্রী-ও জড়িয়ে পড়বেন।
তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠল ভদ্রমহিলা। বলল তীক্ষ্ণ্মস্বরে, তার স্ত্রী!
ঘটনাটা আর গোপন নেই। বোন বলে এতদিন যাকে চালিয়েছেন উনি, আসলে তিনি তার স্ত্রী।
ফের আসন গ্রহণ করেছে মিসেস লায়ন্স। শক্ত মুঠোয় চেপে ধরেছে চেয়ারের হাতল। লক্ষ করলাম, চাপের চোটে সাদা হয়ে গেছে গোলাপি নখ। ফের বললে, তার স্ত্রী! তার স্ত্রী! উনি তো বিবাহিত নন!
কাঁধ ঝাঁকি দিল শার্লক হোমস।
প্রমাণ করুন! প্রমাণ করুন! প্রমাণ যদি করতে পারেন তো বাকি কথাটা বলার দরকার হল না। দু-চোখের ভয়ংকর ঝলক দেখেই বোঝা গেল প্রমাণ করতে পারলে কী করবে ভদ্রমহিলা।
পকেট থেকে একগাদা কাগজ টেনে বার করতে করতে হোমস বলল, প্রমাণ করব বলে তৈরি হয়েই এসেছি। এই দেখুন একটা ফটো চার বছর আগে ইয়র্কে তোলা হয়েছিল–স্বামী-স্ত্রী পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। যদিও নাম লেখা রয়েছে মিস্টার এবং মিসেস ভ্যানডেলর, আপনি কিন্তু ওঁকে দেখলেই চিনবেন–মিসেসকেও চিনবেন, যদি স্বচক্ষে দেখে থাকেন। এই দেখুন বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষীর লেখা তিনটে দৈহিক বিবরণ–মিস্টার এবং মিসেস ভ্যানডেলরকে দেখতে কীরকম, তিনজনেই লিখে জানিয়েছেন। তখন এঁরা সেন্ট অলিভার্স প্রাইভেট স্কুলে ছিলেন। পড়ে দেখুন শনাক্ত করতে পারছেন কিনা।
চোখ বুলিয়ে নিল মিসেস লায়ন্স। তারপর মরিয়া মহিলার মতন দৃঢ়-সংবদ্ধ আড়ষ্ট মুখ তুলে চাইল আমাদের পানে।
বলল, আমার স্বামীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ করলে আমাকে বিয়ে করবে কথা দিয়েছে এই লোকটা। লোকটা ঠগ, শয়তান, বদমাশ–ডাহা মিথ্যে বলেছে আগাগোড়া। আজ পর্যন্ত একটা সত্যিও বলেনি। কিন্তু কেন? কেন, ভেবেছিলাম যা কিছু হচ্ছে আমার ভালোর জন্যেই হচ্ছে। কিন্তু এখন দেখছি আমি ওর হাতের যন্ত্র বই আর কিছু না। আমি যার বিশ্বাসের পাত্রী নই, সেই-বা আমার বিশ্বাসের পাত্র হতে যাবে কেন? কেন আমি তাকে আড়াল করে রাখব তার কুকর্মের ফল ভোগ করা থেকে; যা খুশি জিজ্ঞেস করুন, কিচ্ছু গোপন করব না। একটা কথা শুধু বলে রাখি! বৃদ্ধ ভদ্রলোককে চিঠিখানা লেখবার সময়ে কল্পনাও করতে পারিনি তার সর্বনাশ করতে যাচ্ছি–উনি যে আমার সত্যিকারের উপকারী বন্ধু ছিলেন।
শার্লক হোমস বললে, ম্যাডাম, আপনার কথা অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাস করি। কিন্তু অন্তরালে কী ব্যাপার হয়ে চলেছে, তা সহজে বোঝাতে গেলে সব ঘটনা গোড়া থেকে বলা দরকার। বস্তুগত ত্রুটি থাকলে শুধরে দেবেন। স্টেপলটনই এ-চিঠি পাঠানোর মতলব দিয়েছিল আপনাকে?
ও মুখে মুখে বলে গেছিল, আমি লিখে নিয়েছিলাম।
বিবাহবিচ্ছেদের মোকদ্দমার যা খরচ, স্যার চার্লসের কাছ থেকে তা পাওয়া যাবে এই উদ্দেশ্যেই চিঠি লিখতে বলেছিলেন?
ঠিক কথা।
চিঠিখানা পাঠানোর পর ওই সময়ে আপনাকে যেতে নিরস্ত করেছিলেন?
বললে, তার আত্মসম্মানে লাগছে। অন্য ব্যক্তি টাকার জোগান দেবে তবে বিবাহবিচ্ছেদ হবে এবং আমাদের মিল হবে, এটা ভাবা যায় না। সে গরিব হতে পারে, কিন্তু শেষ কপর্দকটিও ব্যয় করবে মিলনের অন্তরায় দূর করার জন্যে।
ভদ্রলোকের চরিত্রে বেশ দৃঢ়তা আছে দেখা যাচ্ছে নীতিতে অবিচলিত থাকেন। তারপর থেকে খবরের কাগজে মৃত্যুসংবাদ পড়া পর্যন্ত আর কিছু শোনেননি?
না। স্যার চার্লসের সঙ্গে আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্টের কথা যেন কাকপক্ষীও জানতে না-পারে–এই মর্মে হলফ করিয়ে নিয়েছিল আপনাকে?
হ্যাঁ। বললে, মৃত্যুটা অত্যন্ত রহস্যজনক। ঘটনাটা ফাঁস হয়ে গেলে পুলিশ নিশ্চয় আমাকে সন্দেহ করবে। দারুণ ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রেখেছিল বলতে পারেন।
তা ঠিক। আপনি কিন্তু সন্দেহ করেছিলেন?
দ্বিধায় পড়ল মিসেস লায়ন্স। চোখ নামিয়ে নিয়ে বললে, ওকে আমি চিনি। আমার ওপর যদি আস্থা রাখতে পারত, আমি তার মর্যাদা নিশ্চয় দিতাম।
শার্লক হোমস বললে, মমাটের ওপর আমার বিশ্বাস স্রেফ কপালজোরে আপনি বেঁচে গেছেন। ওঁকে আপনি কবজায় পেয়েছেন উনি তা জানতেন–তারপরেও যে বেঁচে আছেন। এখনও এইটাই যথেষ্ট। মাস কয়েক খাড়া পাহাড়ের কিনারা দিয়ে হেঁটেছেন জানবেন জীবন ঝুলছিল সুতোর ওপর। মিসেস লায়ন্স, এবার সুপ্রভাত জানিয়ে বিদায় নেব। খুব সম্ভব শিগগিরই ফের যোগাযোগ হবে।
শহর থেকে এক্সপ্রেস ট্রেন পৌঁছোনোর প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকার সময়ে হোমস বললে, কেস ক্রমশ নিটোল হয়ে আসছে। একটার পর একটা বাধা সামনে থেকে সরে যাচ্ছে। আধুনিক যুগে অত্যন্ত চাঞ্চল্যকর এবং অসাধারণ যত অপরাধ অনুষ্ঠিত হয়েছে, এ-কেস তার মধ্যে একটা। খুব শিগগিরই কেসটার একটা পরস্পর-সংযুক্ত একটানা বিবরণ শোনাবার পরিস্থিতিতে পৌঁছোব। অপরাধতত্ত্বের ছাত্ররা অনুরূপ অপরাধের সন্ধান পাবে ১৮৬৬ সালে অনুষ্ঠিত লিটল রাশিয়ার গ্রোড়নো» কেসে; নর্থ ক্যারোলিনার অ্যান্ডারসন হত্যাগুলোও প্রায় এইরকমই বটে, কিন্তু এ-কেসের একেবারেই নিজস্ব কতকগুলো বৈশিষ্ট্য আছে। এখনও পর্যন্ত দেখো চতুর-চূড়ামণি এই লোকটার বিরুদ্ধে স্পষ্ট কোনো কেস খাড়া করা যায়নি। কিন্তু আজ রাতে শয্যাগ্রহণের আগেই যদি তা স্পষ্ট না হয়, তাহলে খুবই অবাক হব আমি।
প্ল্যাটফর্ম কাঁপিয়ে ফোঁস ফোঁস ঝন ঝন শব্দে এসে পৌঁছোল লন্ডন এক্সপ্রেস। প্রথম শ্রেণির একটা কামরা থেকে তড়াক করে লাফিয়ে নামল ছোটোখাটো চেহারার বুলডগ টাইপের অতি-চটপটে একটা লোক। করমর্দন করলাম তিনজনে। শার্লক হোমসের প্রতি লেসট্রেডের সশ্রদ্ধ চাহনি দেখে বুঝলাম, প্রথম দিকে একত্র কাজের পর থেকে অনেক শিক্ষাই হয়েছে। তার। প্রথম-প্রথম যুক্তিবাদীর অনুমিতি কী পরিমাণ অবজ্ঞা জাগ্রত করত হাতেকলমে কর্মীর অন্তরে, তা এখনও জ্বলজ্বল করছে আমার স্মৃতির পর্দায়।
সুখবর আছে? শুধোয় লেসট্রেড।
বছরের সবচেয়ে বড়ো খবর আছে, বললে হোমস। কাজে নামার আগে হাতে আছে দুটো ঘণ্টা। আমার মতে সময়টা খুব ভালোভাবে কাটবে যদি এই ফাঁকে ডিনার খাওয়ার পর্বটা সেরে নিই। লেসট্রেড, তারপর ডার্টমুরের খাঁটি নৈশ-বাতাস নিশ্বাসের সঙ্গে নিয়ে গলার মধ্যে থেকে লন্ডনের কুয়াশাটা ঠেলে বার করে দিয়ো। ডার্টমুরে যাওনি বুঝি কখনো? প্রথম দর্শনের স্মৃতি এ-জীবনে আর ভুলবে বলে মনে হয় না।