তিনটে ছিন্নসূত্র
ইচ্ছে করলেই মনকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার একটা ক্ষমতা অত্যন্ত আশ্চর্য মাত্রায় উপস্থিত ছিল শার্লক হোমসের মধ্যে। ঝাড়া দু-ঘণ্টা বেলজিয়ান শিল্পীদের শিল্পকর্মের মধ্যে বেমালুম হারিয়ে ফেলল নিজেকে একেবারেই ভুলে গেল কী বিচিত্র ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছি আমরা সবাই। ছবির জগৎ সম্বন্ধে তার ধারণা খুবই স্থূল, কিন্তু প্রদর্শনীকক্ষ থেকে বেরিয়ে নর্দামবারল্যান্ড হোটেলে পৌঁছোনোর পথে ছবির আলোচনা ছাড়া আর কোনো কথার মধ্যেই গেল না।
হোটেলে যেতেই কেরানি বললে, ওপরতলায় স্যার হেনরি বাস্কারভিল অপেক্ষা করছেন আপনার জন্যে। আপনারা এলেই ওপরে নিয়ে যেতে বলেছেন আমাকে।
হোমস বললে, রেজিস্টারে একটু চোখ বুলোলে আপত্তি আছে?
একদম না।
খাতার পাতায় দেখা গেল বাস্কারভিল হোটেলে ওঠার পর আরও দুটি নাম লেখা হয়েছে। একটা থিয়োফিলাস জনসন এবং তার পরিবার নিউক্যা থেকে এসেছেন; আরেকটা মিসেস ওল্ডমোর এবং তাঁর পরিচারিকা–অ্যালটনের হাইলজ থেকে এসেছেন।
দারোয়ানের সঙ্গে যেতে যেতে হোমস বললেন, জনসন ভদ্রলোককে চিনি। উকিল মানুষ, তাই না? মাথার চুল সব সাদা, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন?
আজ্ঞে না, ইনি কয়লাখনির মালিক। খুব চটপটে। বয়স আপনার চেয়ে বেশি নয়।
জানছ কী করে উনি কী কাজ করেন? ভুল করছ মনে হচ্ছে?
আজ্ঞে না, এ হোটেলে উনি নতুন নন, অনেক বছর ধরে আসছেন। আমরা সবাই তাকে ভালোভাবেই জানি।
তাহলে তো মিটেই গেল। মিসেস ওল্ডমারের নামটাও যেন চেনা চেনা লাগছে। কৌতূহল দেখাচ্ছি বলে কিছু মনে কোরো না; তবে কী জানো, এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসে অনেক সময়ে আরেক বন্ধুর সঙ্গেও দেখা হয়ে যায়।
উনি পঙ্গু। স্বামী এককালে গ্লসেস্টারের মেয়র ছিলেন। শহরে এলেই এখানে ওঠেন।
ধন্যবাদ; উনি যে আমার পরিচিত, আর তা বলা যাবে না। ওয়াটসন, প্রশ্নগুলো করে কিন্তু একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা খাড়া করে ফেললাম, পাশাপাশি সিঁড়ি বেয়ে ওঠবার সময়ে খাটো গলায় বলল হোমস। আমাদের এই বন্ধুটিকে নিয়ে যাদের এত মাথাব্যথা, তারা কেউই এ-হোটেলে ওঠেনি সেটা জানা গেল। তার মানে দাঁড়াচ্ছে এই: স্যার হেনরিকে ওরা চোখে চোখে রাখতে যেমন উদবিগ্ন, স্যার হেনরিও যাতে ওদের দেখে না-ফেলে, সে-ব্যাপারেও সমান উদবিগ্ন। ঘটনাটা কিন্তু অতিশয় সংকেতপূর্ণ।
কীসের সংকেত?
সংকেতটা–আরে, আরে, ভায়া, এ আবার কী কাণ্ড?
সিঁড়ির মাথায় আসতেই প্রায় মুখোমখি ধাক্কা খেলাম স্বয়ং স্যার হেনরি বাস্কারভিলের সঙ্গে। রাগে মুখ লাল হয়ে উঠেছে, এক হাতে ধূলিধূসরিত পুরোনো একপাটি বুটজুতো ঝুলছে। এমনই উগ্রমূর্তি ধারণ করেছেন যে ভালো করে কথা বলতে পারছেন না। কথা যখন ফুটল, সে-কথা বোঝে কার সাধ্য। এ-রকম পশ্চিমি টানে কথা বলতে সকালে তো শুনিনি।
চিৎকার করে বললেন, ভেবেছে কি ওরা? বাঁদরামি হচ্ছে আমার সঙ্গে? ভুল জায়গায় খাপ খুলতে এসেছে, ঠেলাটা টের পাইয়ে ছাড়ব বলে দিলাম। নিখোঁজ বুটের পাটি যদি ও-ছোঁড়া উদ্ধার করতে না-পারে তো ওর একদিন কি আমার একদিন। ফষ্টিনষ্টির একটা সীমা আছে, মি. হোমস, এ-হোটেল সে-মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
এখনও বুট খুঁজছেন?
খুঁজছি এবং খুঁজে বার করবই।
কিন্তু আপনি তো বলছিলেন বাদামি বুট হারিয়েছে?
সেটা তো গেছেই, এখন গেল একটা পুরোনো কালো বুট।
সে কী! আপনি কি তাহলে বলতে চান–?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক তাই বলতে চাই। তিন জোড়া জুততার মালিক আমি–নতুন বাদামি, পুরোনো কালো, আর পেটেন্ট চামড়া–যা এখন পরে আছি। কাল রাতে সরিয়েছে একপাটি বাদামি, এখন সরাল একপাটি কালো। বুঝেছেন? কী হে? চুপ করে দাঁড়িয়ে কেন? হাঁ করে চেয়ে না-থেকে মুখে কথা বলতে কী হয়েছে?
অকুস্থলে আবির্ভূত হয়েছে জনৈক উত্তেজিত জার্মান ওয়েটার।
পেলাম না, স্যার, তন্নতন্ন করে খুঁজে এলাম সমস্ত হোটেল, কেউ কিছু বলতে পারছে না।
সূর্য ডোবার আগে যদি জুতো ফিরে না-পাই, সোজা ম্যানেজারের অফিসে যাব সেখান থেকে রাস্তায়–এ-হোটেলে আর নয়–এই বলে দিলাম।
পাওয়া যাবে স্যার, আমি বলছি পাওয়া যাবে। একটু ধৈর্য ধরুন, খুঁজে বার করবই।
যত্তোসব চোরেদের আড্ডা। জুতো চুরি বার করে দেব! মি. হোমস সামান্য এই ব্যাপারে আপনাকে কষ্ট দিতে আমি—
আমার তো মনে হয় ব্যাপারটা সামান্য নয় এবং কষ্টটুকু দিয়ে ভালোই করলেন।
তার মানে? আপনি দেখছি বিলক্ষণ সিরিয়াস?
জুতো চুরির কারণটা বুঝিয়ে দিতে পারেন?
বোঝানোর চেষ্টাও করতে চাই না। এর চাইতে উদ্ভট, সৃষ্টিছাড়া পাগলামি জীবনে কখনো দেখিনি।
সৃষ্টিছাড়া তো বটেই, চিন্তিতস্বরে বললে হোমস।
আপনার কী মনে হয়?
আমিও যে সব বুঝে ফেলেছি, তা বলব না। স্যার হেনরি, আপনার এ-কেস অত্যন্ত জটিল। বিশেষ করে আপনার কাকার মৃত্যুর পটভূমিকায় যদি বিচার করতে হয় সৃষ্টিছাড়া এই সব ঘটনা, তাহলে ধরব, সারাজীবনে আমি যে শপাঁচেক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কেসের ফয়সালা করেছি তার কোনোটাই আপনার এই কেসের মতো প্যাচালো ছিল না। তবে কী জানেন, অনেকগুলো সূত্র হাতে নিয়ে বসে আছি তো, একটা-না-একটা ধরে ঠিক পৌঁছে যাব মূল সত্যে। ভুল সূত্র ধরে হয়তো কিছুটা সময় নষ্ট করে ফেলতে পারি, কিন্তু আজ হোক কি কাল হোক–সঠিক সূত্র ধরে ফেলবই।
লাঞ্চ খেলাম তুপ্তির সঙ্গে এবং মনোরম পরিবেশে। যে-ঝামেলায় জড়িয়ে একত্র হয়েছি, তা নিয়ে কথা হল খুবই কম। প্রাইভেট রুমে বসবার পর বাস্কারভিলকে হোমস জিজ্ঞেস করল কী করবেন বলে ঠিক করলেন তিনি।
বাস্কারভিল হলে যাব।
কবে?
এই সপ্তাহের শেষে?
মোটের ওপর সিদ্ধান্তটা বুদ্ধিমানের মতোই নিয়েছেন আপনি, বললেন হোমস। আপনার পেছনে লোক ঘুরছে, তার যথেষ্ট প্রমাণ আমি পেয়েছি। লক্ষ লক্ষ লোকে ঠাসা বিরাট এই শহরে যারা আপনার ওপর নজর রেখেছে, তাদের খুঁজে বার করা বা তাদের উদ্দেশ্যটা জানা খুবই কঠিন ব্যাপার। উদ্দেশ্য যদি অশুভ হয়, আপনার অনিষ্ট করতে পারে আমরা তা আটকাতে পারব না। ডক্টর মর্টিমার, আজ সকালে আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পর আপনার পেছনে লোক লেগেছিল জানেন কি?
ভীষণ চমকে উঠলেন ডক্টর মর্টিমার। লোক লেগেছিল! কে সে?
দুর্ভাগ্যবশত সেটা বলতে পারব না। ডার্টমুরে আপনার চেনাজানা প্রতিবেশীদের মধ্যে দাড়িওয়ালা কেউ আছে? মুখভরতি দাড়ি?
না–ইয়ে, দাঁড়ান–আরে, হ্যাঁ। স্যার চার্লসের খাসচাকর ব্যারিমুরেরই তো মুখভরতি কালো চাপদাড়ি আছে।
আচ্ছা! ব্যারিমুর এখন কোথায়?
বাস্কারভিল হলের দেখাশুনা করছে।
সত্যিই সে সেখানে আছে, না কি লন্ডনে এসেছে, তা জানতে হবে।
কী করে জানবেন?
একটা টেলিগ্রাম ফর্ম দিন। স্যার হেনরির ব্যবস্থা সম্পূর্ণ? ওতেই হবে। ঠিকানা লিখুন, ব্যারিমুর, বাস্কারভিল হল। সবচেয়ে কাছের টেলিগ্রাফ অফিস কোনটা? গ্রিমপেন। ঠিক আছে, গ্রিমপেনের পোস্টমাস্টারকে আর একখানা টেলিগ্রাম পাঠাচ্ছি : মি. ব্যারিমুরের টেলিগ্রাম তার হাতে দেবেন। বাড়িতে না-পেলে, নর্দামবারল্যান্ড হোটেলে স্যার হেনরি বাস্কারভিলের কাছে ফেরত পাঠাবেন! সন্ধের আগেই জানতে পারব ব্যারিমুর ডেভনশায়ারে আছে কি নেই।
বাস্কারভিল বললেন, তা তো হল। কিন্তু এই ব্যারিমুরটি কে, ডক্টর মর্টিমার?
আগের কেয়ারটেকারের ছেলে–সে-লোকটি মারা গেছে। চার পুরুষ ধরে বাস্কারভিল হল দেখাশুনা করছে এরা। যদূর জানি, ওরা স্বামী-স্ত্রী দু-জনেই সজ্জন–গাঁয়ের প্রত্যেকে যথেষ্ট সম্মান দেয়।
বাস্কারভিল বললেন, এটাও ঠিক যে বাস্কারভিল হলে ফ্যামিলির কেউ যদ্দিন না-থাকছে, তদ্দিন এদের পোয়াবারো। কিছু না-করেই চমৎকার প্রকাণ্ড একখানা বাড়ি দিব্যি ভোগ করতে পারছে।
তা ঠিক।
স্যার চার্লসের উইলে ব্যারিমুর কিছু পেয়েছে? শুধোয় হোমস।
স্বামী-স্ত্রী দু-জনেই পাঁচশো পাউন্ড করে পেয়েছে।
আচ্ছা! ওরা কি জানে টাকা পাচ্ছে?
হ্যাঁ, জানে। উইলে কাকে কী দিয়েছেন, তাই নিয়ে কথা বলতে ভালোবাসতেন স্যার চার্লস।
ইন্টারেস্টিং ব্যাপার।
ডক্টর মর্টিমার বললেন, স্যার চার্লস ইচ্ছাপত্রে যাদের টাকা দিয়ে গেছেন, আশা করি তাদের সবাইকে সন্দেহ করবেন না। কেননা, উনি আমাকেও হাজার পাউন্ড দিয়ে গেছেন।
বটে! আর কেউ?
সামান্য অঙ্কের টাকা অনেককে দিয়েছেন–দাঁতব্য প্রতিষ্ঠানেও অনেক দান করেছেন। বাদবাকি সমস্ত পাবেন স্যার হেনরি।
বাদবাকি টাকার অঙ্কটা কী?
সাত লক্ষ চল্লিশ হাজার পাউন্ড।
বিস্ময়ে ভুরু তুলে ফেলল শার্লক হোমস। বলল, এইরকম টাকার পাহাড় এ-কেসে জড়িয়ে রয়েছে ভাবিনি।
স্যার চার্লস বড়োলোক, সবাই তা জানত। কিন্তু কতখানি বড়োলোক, তা তাঁর মৃত্যুর পর দলিল দস্তাবেজ দেখতে গিয়ে জানলাম। জমিদারির মোট মূল্য প্রায় দশ লক্ষ পাউন্ড।
বলেন কী! এ-টাকার জন্য যেকোনো ঝুঁকি নিয়ে মরণ-বাঁচন খেলা শুরু করা যায় বই কী। আর একটা প্রশ্ন, ডক্টর মর্টিমার। ধরুন, আমাদের এই তরুণ বন্ধুটির কিছু একটা হয়ে গেল অনুমিতিটা অস্বস্তিকর, ক্ষমা করবেন!–সেক্ষেত্রে জমিদারি পাবে কে?
যেহেতু স্যার চার্লসের ছোটো ভাই রোজার বাস্কারভিল বিয়ে না-করে মারা গেছেন, জমিদারি পাবে দূর সম্পর্কের তুতো ভাই ডেসমন্ডরা। জেমস ডেসমন্ডের বয়স হয়েছে, পুরুতগিরি করেন ওয়েস্টমুরল্যান্ডে।
ধন্যবাদ। খবরগুলো সত্যিই কৌতূহল জাগায়। মি. জেমস ডেসমন্ডের সঙ্গে কখনো আলাপ হয়েছে আপনার?
হয়েছে, স্যার চার্লসের সঙ্গে একবার দেখা করতে এসেছিলেন তখন। সৌম্যদর্শন পুরুষ, থাকেন সন্ন্যাসীর মতন। বেশ মনে আছে, স্যার চার্লস নিজে থেকেই পীড়াপীড়ি করা সত্ত্বেও উনি এক কপর্দকও নিতে রাজি হননি।
এইরকম সরল লোক স্যার চার্লসের লাখ লাখ টাকা পাবে?
স্যার চার্লসের জমিদারিটাই পাবে–উইলে সেইরকমই লেখা আছে। বর্তমান ওয়ারিশ অন্য উইল না-করলে টাকাও তিনি পাবেন। স্যার হেনরি যা ভালো মনে করেন, তাই করবেন।
স্যার হেনরি, উইল করেছেন আপনি?
না, মি. হোমস এখনও করিনি। সময় পেলাম কখন? গতকাল তো জানলাম জল কদ্দূর গড়িয়েছে। তবে পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, উপাধি আর জমিদারির সঙ্গে টাকাও যাবে একসঙ্গে। কাকা বেচারার ইচ্ছে ছিল সেইরকমই। সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য টাকাই যদি না-থাকে, বাস্কারভিল বংশের গৌরব কি ফিরিয়ে আনতে পারবে জমিদারির মালিক? বাড়ি, জমি, টাকা যাবে একসাথে।
ঠিক বলেছেন। স্যার হেনরি, আপনার মতো আমিও বলি আর দেরি না-করে ডেভনশায়ারে যাওয়া দরকার। শুধু একটা শর্ত আছে আমার। একলা যাবেন না কখনোই না।
ডক্টর মর্টিমার আসছেন আমার সঙ্গে।
ডক্টর মর্টিমারকে রুগি দেখতে বেরোতে হয়, ওঁর বাড়িও আপনার বাড়ি থেকে বেশ কয়েক মাইল দূরে। শত ইচ্ছে থাকলেও আপনার পাশে উনি দাঁড়াতে পারবেন না। না, না, স্যার হেনরি, আপনি আর কাউকে সঙ্গে নিন, খুব বিশ্বাসী লোক হওয়া চাই, যে আপনার পাশে পাশে থাকতে পারে।
আপনি নিজে এলে হয় না, মি. হোমস?
সে-রকম সংকট দেখা দিলে, আমি সশরীরে হাজির হতে চেষ্টা করব। কিন্তু নানা দিক থেকে ডাক আসে আমার, কনসাল্টিং প্র্যাকটিস ছড়িয়েছে অনেকদ্দূর, অনির্দিষ্টকাল লন্ডনের বাইরে থাকা আমার পক্ষে তাই সম্ভব নয়। এই মুহূর্তে ধরুন ইংলন্ডের এক পরম শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিকে দোহন করার চেষ্টা করছে এক ব্ল্যাকমেলার–আমি উঠে পড়ে না-লাগলে কেলেঙ্কারি ঠেকানো যাবে না। দেখতেই পাচ্ছেন ডার্টমুরে যাওয়া কতখানি অসম্ভব আমার পক্ষে।
তাহলে কাউকে সুপারিশ করছেন?
আমার বাহুতে হাত রাখল হোমস।
আমার এই বন্ধুটি যদি রাজি হয়, তাহলে জানবেন দুরবস্থায় যখন পড়বেন আপনার পাশে দাঁড়ানোর মতন এঁর চাইতে যোগ্য লোক আর নেই। এত জোর দিয়ে আমার চাইতে এ-কথা আর কেউ বলতে পারবে না।
ডক্টর ওয়াটসন, আপনার অশেষ অনুগ্রহ, বললেন স্যার হেনরি। আমার অবস্থা তো আপনি দেখছেনই, এ-ব্যাপারে আমি যা জানি আপনিও তাই জানেন। বাস্কারভিল হলে এসে আমার সঙ্গে থেকে শেষটা যদি দেখে যান, জীবনে আপনার উপকার ভুলব না।
অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ পেলে চিরকালই উশখুশ করে উঠি, তার ওপরে হোমসের অভিনন্দন আর ব্যারনেটের সাগ্রহ আমন্ত্রণ।
বললাম, সানন্দে আসব আপনার সঙ্গে। সময়টাকে কাজে লাগানোর পক্ষে এর চাইতে ভালো ব্যবস্থা আর হয় না।
হোমস বলল, আমাকে কিন্তু রিপোর্ট পাঠাবে বেশ দেখেশুনে। সংকট আসবেই, এলে কী করতে হবে, আমি তোমায় জানিয়ে দেব। আশা করি শনিবারেই সব ঠিক হয়ে যাবে?
ডক্টর ওয়াটসন, অসুবিধে হবে না তো?
মোটেই না।
তাহলে ওই কথাই রইল। মাঝখানে যদি উলটো কথা না-শোনেন, তাহলে শনিবার সাড়ে দশটার ট্রেনে রওনা হব প্যাডিংটন থেকে।
যাবার জন্যে যেই উঠে দাঁড়িয়েছি, অমনি বিজয়োল্লাসে চিৎকার করে উঠে স্যার হেনরি ধেয়ে গেলেন ঘরের কোণে এবং একটা ক্যাবিনেটের তলা থেকে টেনে বার করলেন একপাটি বাদামি বুট।
বললেন সোল্লাসে, আমার হারানো বুট।
শার্লক হোমস বললে, এইভাবেই যেন অনায়াসে মিলিয়ে যায় আমাদের সব অসুবিধে।
ডক্টর মর্টিমার মন্তব্য করলেন, কিন্তু এ তো ভারি আশ্চর্য ব্যাপার। লাঞ্চ খাওয়ার আগে আমি নিজে তন্নতন্ন করে খুঁজেছি ঘরটা!
আমিও খুঁজেছি, বললেন বাস্কারভিল। এক ইঞ্চিও বাদ দিইনি।
তখন তো বুট ছিল না ওখানে।
তাহলে আমরা যখন লাঞ্চ খেতে ব্যস্ত, ওয়েটার তখন রেখে গেছে।
ডেকে আনা হল জার্মান ওয়েটারকে। সে কিন্তু দিব্যি গেলে বললে, এ-ব্যাপারে কিছুই সে জানে না। বিস্তর খোঁজখবর নিয়েও রহস্য পরিষ্কার হল না। এইভাবেই রহস্য-সিরিজে যুক্ত হল আরও একটা রহস্য। প্রত্যেকটা রহস্যই ছোটো, বাহ্যত উদ্দেশ্যহীন, কিন্তু তাদের আবির্ভাব ঘটছে বিরামবিহীনভাবে এবং দ্রুতবেগে। স্যার চার্লসের মৃত্যুর করালকাহিনি ছাড়াও গত দু-দিনের মধ্যে লাইন দিয়ে এসেছে একটার পর একটা অব্যাখ্যাত ঘটনা। এর মধ্যে আছে ছাপা কাগজ সাঁটা আজব চিঠি, দু-চাকার ঘোড়ার গাড়িতে কালো দাড়িওলা রহস্যময় চর, নতুন বাদামি বুটের অন্তর্ধান, পুরোনো কালো বুটের অন্তর্ধান, এবং এখন নতুন বাদামি বুটের বিস্ময়কর প্রত্যাবর্তন। বেকার স্ট্রিটে ফেরার পথে ছ্যাকড়াগাড়ির কোণে নীরবে বসে রইল হোমস। কুঞ্চন আর শানিত মুখচ্ছবি দেখেই বুঝলাম, আমার মতো সে-ও মনে মনে এইসব অদ্ভুত আর বাহ্যত সম্পর্কহীন ঘটনাগুলোকে এক মালায় গেঁথে একটা ফ্রেমের মধ্যে আনবার চেষ্টা করছে। সমস্ত বিকেলটা আর সন্ধেটা তামাক আর চিন্তা নিয়ে এইভাবে ব্যাপৃত রইল সে।
ডিনার খাওয়ার ঠিক আগে এল দুটো টেলিগ্রাম। প্রথমটা এইরকম :–
এইমাত্র খবর পেলাম ব্যারিমুর বাস্কারভিল হলে আছে। বাস্কারভিল।
দ্বিতীয়টা :–
নির্দেশমতো তেইশটা হোটেল ঘুরেছি। কিন্তু টাইমস-এর কাটা কাগজ পাইনি।–কার্টরাইট।
দুটো সুতো ছিঁড়ল, ওয়াটসন। যে-কেসে কেবলই ব্যর্থতা, সে-কেসের মতো চনমনে কেস আর নেই–ভেতর পর্যন্ত চাঙা করে দেয়। চারদিকে তাকিয়ে থাকতে হয় নতুন সূত্রের আশায়।
যার গাড়িতে চর লেগেছিল পেছনে, এখনও সেই কোচোয়ানের খবর কিন্তু পাওনি।
তা ঠিক। সরকারি রেজিস্ট্রিতে তার নাম-ঠিকানা খুঁজে বার করার জন্যে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে দিয়েছি। জবাবটা বোধ হয় এসে গেল মনে হচ্ছে।
জবাবের চাইতেও সন্তোষজনক যে একটা কিছু এসেছে, দরজার ঘন্টাধ্বনি শুনেই তা মালুম হল। দু-হাট হয়ে গেল দরজা, রুক্ষ চেহারার একটা লোক ঢুকল ভেতরে নিঃসন্দেহে কোচোয়ান স্বয়ং।
বললে, হেডঅফিসে খবর পেলাম এই ঠিকানার এক ভদ্রলোক ২৭০৪ নম্বর গাড়ি সম্বন্ধে খোঁজ নিয়েছেন। সাত বছর গাড়ি চালাচ্ছি, আজ পর্যন্ত কেউ নালিশ করেনি। তাই সোজা ইয়ার্ড থেকে আসছি। যা বলতে চান, সামনাসামনি বলুন মশায়।
হোমস বললে, ওহে, তোমার বিরুদ্ধে কোনো নালিশই নেই আমার। ঠিক উলটোটাই বরং আছে। আমার প্রশ্নের ঠিক ঠিক জবাব যদি দাও, আধ গিনি বকশিশ পাবে।
কাষ্ঠ হেসে কোচোয়ান বললে, দিনটা দেখছি ভালোই যাচ্ছে, ভুলচুক করিনি। বলুন স্যার, কী জানতে চান?
যদি পরে দরকার হয়, তাই প্রথমে জানতে চাই নাম কী তোমার, থাকো কোথায়?
জন ক্লেটন, তিন নম্বর, টার্পে স্ট্রিট, দ্য বরো। আমার গাড়ি থাকে ওয়াটারলু স্টেশনের কাছে শিপলির গাড়ির আড্ডায়।
লিখে নিল শার্লক হোমস।
ক্লেটন, এবার বলো আজ সকাল দশটায় তোমার গাড়িতে এসে যে এ-বাড়ির ওপর নজর রেখেছিল–কী জানেনা তার সম্পর্কে। এখান থেকে দু-জন ভদ্রলোক বেরিয়ে রিজেন্ট স্ট্রিট দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময়ে গাড়ি নিয়ে তাদের পেছন পেছনও গেছিলে?
অবাক চোখে তাকাল ক্লেটন, ভাব দেখে মনে হল যেন বেশ বিব্রত বোধ করছে।
বললে, আপনি যখন সবই জেনে বসে আছেন, তখন না-বলার কোনো কারণ দেখি না। আসলে কী হয়েছিল জানেন, ভদ্রলোক আমাকে বললেন তিনি একজন ডিটেকটিভ এবং তাঁর সম্বন্ধে যেন কাউকে কিছু না-বলি।
ওহে, ব্যাপারটা সিরিয়াস। আমার কাছে একটা কথাও যদি গোপন করতে যাও তো ঝামেলায় পড়বে। তোমাকে বললেন, উনি একজন ডিটেকটিভ?
হ্যাঁ, তাই বললেন।
কখন বললেন?
চলে যাওয়ার সময়ে!
আর কিছু বললেন?
নিজের নামটা বলে গেলেন।
বিজয়-উল্লসিত চোখে আমার পানে চকিত চাহনি নিক্ষেপ করে হোমস।
তাই নাকি? নিজের নাম বলে গেলেন? ভারি অবিবেচক লোক দেখছি। কী নাম বললেন শুনি?
শার্লক হোমস।
কোচোয়ানের এহেন জবাবে বন্ধুবর যেভাবে চমকে উঠল, এভাবে কখনো তাকে চমকাতে দেখিনি। নীরব বিস্ময়ে বসে রইল ক্ষণকাল। তারপরেই ফেটে পড়ল প্রাণখোলা অট্টহাসিতে:
বাহাদুর বটে ওয়াটসন, শেষ তাসখানা কীরকম ছেড়েছে দেখলে? সত্যিই বাহাদুর, স্বীকার করতেই হবে। আমারই মতো চটপটে। এবার কিন্তু বেশ একহাত নিয়েছে আমাকে। যাক, ভদ্রলোকের নামটা তাহলে শার্লক হোমস?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
চমৎকার! কোত্থেকে তাঁকে গাড়িতে তুললে, তারপর কী কী হল–সব বলে যাও।
সাড়ে নটার সময়ে ট্রাফালগার স্কোয়ারে আমাকে ডাক দিলেন। বললেন, আমি একজন ডিটেকটিভ। দুটো গিনি দেব। সারাদিন যা-যা বলবেন, তাই করতে হবে কোনো প্রশ্ন করা চলবে না। খুশি হয়ে রাজি হলাম। প্রথমেই এলাম নর্দামবারল্যান্ড হোটেলে। দুই ভদ্রলোক হোটেল থেকে বেরিয়ে এসে আড্ডা থেকে একটা গাড়ি না-নেওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর চললাম পেছন পেছন, সামনের গাড়ি এসে দাঁড়াল এইখানে কোথায় যেন।
এই বাড়িরই দরজার সামনে বললে হোমস।
সঠিক বলতে পারব না। তবে আমার গাড়িতে যিনি উঠেছিলেন, তিনি সবই জানতেন। এই রাস্তার মাঝামাঝি গিয়ে গাড়ি দাঁড় করিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ঘণ্টা দেড়েক পরে ভদ্রলোক দু-জন বেরিয়ে এসে হাঁটতে লাগলেন। বেকার স্ট্রিট বরাবর আমরাও চললাম পেছন পেছন, তারপর–
জানি, বলল হোমস।
রিজেন্ট স্ট্রিটের তিনভাগ রাস্তা পেরোনোর পর ডিটেকটিভ ভদ্রলোক আচমকা ঠেলা-দরজা তুলে চিৎকার করে আমাকে ঝড়ের মতো ওয়াটারলু স্টেশনে যেতে বললেন। চাবুক হাঁকিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে পৌঁছে গেলাম দশ মিনিটেই। উনি তখন সত্যিকারের ভদ্রলোকের মতোই দুটো গিনি আমাকে দিয়ে স্টেশনের মধ্যে ঢুকলেন। ঢোকবার ঠিক আগে ঘুরে দাঁড়ালেন। বললেন–কাকে নিয়ে এতক্ষণ চক্কর দিলে জানা থাকলে তোমার ভালো লাগতে পারে। আমার নাম শার্লক হোমস। নামটা তখনই জানলাম।
বটে! তারপর আর দেখা হয়নি?
স্টেশনে ঢুকে যাওয়ার পর আর দেখিনি। শার্লক হোমসকে দেখতে কীরকম?
মাথা চুলকোলো কোচোয়ান। দেখুন স্যার, ভদ্রলোকের চেহারাটা আর পাঁচটা ভদ্রলোকের মত খুঁটিয়ে বলার নয়। বয়স বছর চল্লিশ, উচ্চতা মাঝামাঝি–আপনার চাইতে দু-তিন ইঞ্চি বেঁটে। ফিটফাট বাবু, ফ্যাকাশে মুখ, চৌকোনা কালো দাড়ি। এর বেশি কিছু দেখিনি।
চোখের রং?
বলতে পারব না।
আর কিচ্ছু মনে পড়ছে না?
না স্যার, কিচ্ছু না।
তাহলে এই নাও আধগিনি। আরও খবর যদি দিতে পারো আর একখানা আধগিনি তোলা রইল তোমার জন্যে। শুভরাত্রি।
শুভরাত্রি। ধন্যবাদ, স্যার!
নীরস হাসি হাসতে হাসতে বিদেয় হল জন ক্লেটন। ক্ষোভের হাসি হেসে দু-কাঁধ ঝাঁকিয়ে হোমস তাকাল আমার পানে।
বলল, তৃতীয় সুতোটাও ছিঁড়ে গেল, ওয়াটসন। যেখান থেকে শুরু করেছিলাম, শেষ-ও করলাম সেইখানে। কী ধড়িবাজ বদমাশ দেখেছ? আমার ঠিকানা সে জানত, স্যার হেনরি বাস্কারভিল যে আমার পরামর্শ নিচ্ছেন–সে-খবরও রাখত, রিজেন্ট স্ট্রিটে দেখেই আমাকে চিনেছে, গাড়ির নম্বর যখন আমি দেখেছি তখন শেষ পর্যন্ত কোচোয়ানকে পাকড়াও করে ফেলব হিসেব করে নিয়েই উদ্ধত এই সংবাদটি পাঠিয়েছে তার মুখে! ওয়াটসন, আমাদের এবারকার শত্ৰুটি কিন্তু খাঁটি ইস্পাত–আমাদের মতোই। লন্ডনে কিস্তিমাত করে গেল সে–গগাহারান হারলাম আমি। ডেভনশায়ারে কপাল ফিরবে আশা রাখি। কিন্তু মনটাকে সহজ করতে পারছি না।
কী ব্যাপারে?
তোমাকে পাঠানোর ব্যাপারে। কেসটা কুৎসিত, ওয়াটসন, অত্যন্ত বিপজ্জনক, অত্যন্ত জঘন্য। এ-কেসের যতই দেখছি, ততই উদবেগ বাড়ছে। ভায়া, হাসছ তুমি। হেসে নাও। কিন্তু আমি হাসব তখনই যখন তুমি নির্বিঘ্নে নিরাপদে আবার ফিরে আসবে বেকার স্ট্রিটে।