উপন্যাস

০৪. টেকো লোকটির কাহিনি

টেকো লোকটির কাহিনি

ভারতীয় ভৃতের পেছন পেছন ঢুকলাম একটা টানা লম্বা গলিপথে। আলো খুব কম। অত্যন্ত নোংরা। আসবাবপত্রও যাচ্ছেতাই। ডান দিকের একটা দরজা ঠেলে খুলে দিতেই এক ঝলক হলদে আলো আছড়ে পড়ল আমাদের ওপর। আলোক বন্যার মাঝে দাঁড়িয়ে ছোটোখাটো চেহারা এক পুরুষ। মাথাটি অত্যন্ত উঁচু। কিনারা ঘিরে গুচ্ছ গুচ্ছ লালচে চুল। শীর্ষদেশ কেশহীন চকচকে। ঝাউগাছের মাথা ছাড়িয়ে যেন উঁচু হয়ে রয়েছে পাহাড়ের চুড়ো। দু-হাত ঘষে, সারাশরীরটাকে ঘন ঘন নাচিয়ে কঁকিয়ে, কখনো হেসে কুটি করে এক লহমার জন্যেও সুস্থিত হতে পারছিল না লোকটা! সবকিছুই হচ্ছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। প্রকৃতির খেয়ালে তার ঠোঁটজোড়া পেণ্ডুলামের মতো দুলন্ত এবং দু-সারি দাঁতও বেখাপ্পাভাবে উঁচুনীচু এবং হলদেটে নোংরা। দাঁত আর ঠোঁটে এহেন ছিরি ঢাকবার প্রয়াসে মাঝে মাঝে হস্তচালনা করছে মুখের নীচের দিকে। যাচ্ছেতাই ওই টাক সত্ত্বেও লোকটার চেহারায় কিন্তু যৌবনের ছাপ। প্রকৃতপক্ষে বয়স তার তিরিশও ছাড়ায়নি।

তীক্ষ্ণ সরু বাঁশির মতো গলায় বললে সে, আসুন মিস মর্সটান, আপনার খানসামার ঘরেই আসুন। জেন্টলমেন, আসুন আপনাদের ভৃত্যের ঘরে। এই আমার সাধের ঘর ছোট্ট কিন্তু সাজিয়েছি আমার মতন করে। দক্ষিণ লন্ডনের ধু-ধু মরুভূমির মাঝে এক টুকরো মরুদ্যান বলতে পারেন।

ঘরের চেহারা দেখে চমৎকৃত হয়েছিলাম আমরা প্রত্যেকেই। প্রথম শ্রেণির হিরে যদি তামার সেটিংয়ে থাকে, তাহলে তা যেমন বেমানান, শ্রীহীন এই ভবনের এই ঘরখানিও তেমনি খাপছাড়া। অত্যন্ত দামি আর অত্যন্ত চকমকে পর্দার পর পর্দা ঝুলছে দেওয়ালে দেওয়ালে, মাঝে মাঝে ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে খানকয়েক অত্যন্ত দামি ফ্রেমে বাঁধানো তৈলচিত্র অথবা প্রাচ্য ফুলদানি। কার্পেটটা তৈলস্ফটিক হলুদ হলুদ আর কালো রঙের এত নরম আর পুরু যে মোলায়েমভাবে পা তলিয়ে যায় নীচে যেন পা পড়ছে শৈবালস্তরে। এহেন গালচের ওপর পাতা দুটো প্রকাণ্ড সমুণ্ড বাঘের ছাল প্রাচ্য বিলাসিতার চূড়ান্ত নিদর্শন–এক কোণে মাদুরের ওপর রাখা বিশাল কোটাও এই বিলাসিতার আর একটি অঙ্গ। প্রায় অদৃশ্য সোনার সুতো থেকে ঘরের ঠিক মাঝখানে ঝুলছে একটা রুপোর পায়রা আসলে একটা লক্ষ পায়রার আকারে তৈরি। সলতে জ্বলছে, তেল পুড়ছে এবং ভারি মিষ্টি আর অতীব হালকা একটা প্রাণমাতানো সুবাসে ম-ম করছে ঘরের বাতাস।

সমগ্র শরীর ঝাঁকিয়ে, হেসে বললে খুদে লোকটা, আমার নাম থেডিয়াস শোল্টো। আপনি নিশ্চয় মিস মর্সটান। আর এই ভদ্রলোক দু-জন—

ইনি মি. শার্লক হোমস, আর ইনি ডাক্তার ওয়াটসন।

ডাক্তার? বিলক্ষণ উত্তেজনা জাগে থেডিয়াস শোল্টোর কণ্ঠে, স্টেথোেস্কাপ আছে? একটা অনুরোধ করতে পারি? হৃৎপিণ্ডের মিরট্যাল ভাটা নিয়ে বড়ো দুশ্চিন্তা আছে আমার। দয়া করে যদি একটু দেখে দেন। অ্যাওরটিকের ওপর ভরসা আছে–নেই কেবল এই মিরট্যালের ওপর। আপনার মতামত পেলে বর্তে যেতাম।

অনুরোধ রাখলাম। কান পেতে হৃৎপিণ্ডের বাজনা শুনলাম। গোলমাল কোথাও দেখলাম না–ভয় ছাড়া। সাংঘাতিক ভয় পেয়েছে লোকটা–আপাদমস্তক কাঁপছে ঠকঠক করে।

বললাম, ঠিকই আছে মনে হচ্ছে। ভয়ের কারণ নেই।

মিস মর্সটান, লঘু সুরে বললে শোল্টো, আমার উদবেগকে ক্ষমার চোখে দেখবেন। অনেক কষ্ট পেয়েছি জীবনে–মিরট্যাল ভাটা নিয়ে বরাবর দারুণ সন্দেহ ছিল মনে। ভয়ের কারণ নেই শুনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। মিস মর্সটান, হৃৎপিণ্ডের ওপর বাড়তি ধকল যদি কমাতে পারতেন আপনার বাবা, বাঁচলেও বাঁচতে পারতেন আজও !

আমার ইচ্ছে হল কষে একটা চড় মারি লোকটার গালে। মাথায় রক্ত চড়ে গেল আহাম্মুকি দেখে! এইরকম হৃদয়-ছোঁওয়া একটা বিষয় নিয়ে এভাবে কেউ কথা বলে? ক্যাবলা কোথাকার! মিস মর্সটান দেখলাম আস্তে আস্তে বসে পড়লেন, সাদা হয়ে গেল ঠোঁট, মুখ সমস্ত!

আমি জানতাম। মনে মনে জানতাম বাবা আর নেই!

সব খবরই পাবেন আমার কাছে, সেইসঙ্গে পাবেন সুবিচার, তাতে বার্থোলোমিউ ভায়া চটে গেলেও থোড়াই কেয়ার করি। বন্ধুদের এনে ভালোই করেছেন। খুব খুশি হয়েছি। কেননা, শুধু আপনার পথসঙ্গীই নন, এখন যা বলব এবং করব–তার সাক্ষীও বটে। তিন জনে রুখে দাঁড়াতে পারব বার্থোলোমিউ ভায়ার সামনে। কিন্তু বাইরের লোক না-থাকাই ভালো—পুলিশ-টুলিশ একদম বাদ। কারোর নাক গলানোর দরকার নেই–নিজেদের ব্যাপার নিজেরাই মিটিয়ে নিতে পারবখন। ঢক্কা নিনাদ বস্তুটা দু-চক্ষে দেখতে পারে না বার্থোলোমিউ ভায়া।

বলতে বলতে একটা নীচু সোফায় বসল শোল্টো এবং ছলছল নীল দুর্বল চোখে জিজ্ঞাসার ঢংয়ে চেয়ে রইল আমাদের দিকে ঘন ঘন পড়তে লাগল চোখের পাতা।

হোমস বললে, আমার দিক দিয়ে বলতে পারি, যা বলবেন তা আর কেউ জানবে না।

ওতেই হবে! মিস মর্সটান, চিয়ানতি দেব নাকি এক গেলাস? টোকে? আর কোনো মদ রাখি না। ফ্লাস্ক খুলব? না? বেশ, বেশ, তামাকের গন্ধে নিশ্চয় আপত্তি করবেন না–খাসা গন্ধ কিন্তু প্রাচ্যের তামাক তো, স্নায়ু ঠান্ডা করতে জুড়ি নেই। আমি আবার একটু নার্ভাস টাইপের একটুতেই ঘাবড়ে যাই–হুঁকোটাই আমার একমাত্র ঘুমের ওষুধ।

সরু মোমবাতি দিয়ে টিকের আগুন ধরিয়ে নিল শোল্টো। ক্ষণপরেই গুরুক গুরুক শব্দে বুদবুদ কেটে ধোঁয়া বেরিয়ে এল গোলাপজলের মধ্যে দিয়ে। গালে হাত দিয়ে মুণ্ডু বাড়িয়ে অর্ধচন্দ্রাকারে বসে রইলাম আমরা তিনজন–চকচকে উন্নত মাথা দিয়ে শরীরে ঘন ঘন ঝাঁকুনি জাগিয়ে ঠিক মাঝখানে বসে গুরুক গুরুক করে পরম অস্বস্তির সঙ্গে আলবোলা টেনে চলল বিচিত্র ব্যক্তিটি।

তারপর বললে, প্রথমে যখন ঠিক করলাম আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করব, তখনই কিন্তু আমার ঠিকানা সরাসরি জানিয়ে দিতে পারতাম আপনাদের। কিন্তু ভয় হয়, যদি আমার অনুরোধ পায়ে ঠেলে অবাঞ্ছিত লোকেদের নিয়ে হামলা জোড়েন বাড়ির মধ্যে? সেইজন্যে একটু হুঁশিয়ার হতে হল। এমনভাবে দেখাসাক্ষাতের ব্যবস্থা করলাম যাতে আমার লোক উইলিয়ামস আগে দেখতে পায় আপনাদের। ওঁর বুদ্ধি-শুদ্ধির উপর আমার অগাধ আস্থা। বলেও রেখেছিলাম, যদি তেমন বোঝে তাহলে যেন আর না-এগোয়। আমার এত সাবধানতা দয়া করে ক্ষমার চোখে দেখবেন। দেখতেই তো পাচ্ছেন, অবসর জীবনযাপন করি–রুচিও উঁচুদরের মোটাদরের নয় মোটেই। পুলিশের লোকের মতো নীরস গদ্যবৎ বস্তু দুনিয়ায় আর দু-টি নেই–সূক্ষ্মতা বা শিল্পের ধার দিয়েও যায় না। স্কুল সইতে পারিনে একদম, রক্তের মধ্যে বাধা আছে। পাঁচজনের স্কুল জটলার মধ্যেও পারতপক্ষে যাই না। দেখতে পাচ্ছেন খানদানি পরিবেশে থাকতে ভালোবাসি। নিজেকে শিল্পকর্মের পৃষ্ঠপোষকও বলি। এ হল আমার দুর্বলতা। প্রাকৃতিক দৃশ্যের তৈলচিত্রটা, আসল কোরো, ওই যে স্যালভেটর রোসা দেখছেন খুঁতখুঁতে সমালোচকের সন্দেহ হলেও ওটাও কিন্তু আসল, বুগুরা সম্বন্ধেও সংশয় রাখবেন না মনে। আধুনিক ফরাসি ছবির দিকেই আমার ঝোক বেশি।

মি, শোন্টো, বললেন মিস মর্সটান, আমি এসেছি কিন্তু আপনার কী বলার আছে

শোনবার জন্যে। রাত অনেক হল, সংক্ষেপে সারুন।

যত সংক্ষেপেই করি না কেন, সময় কিছু লাগবে। কেননা, নরউড়ে গিয়ে ব্রাদার বার্থোলোমিউয়ের সঙ্গে দেখা না-করলেই নয়। দল বেঁধেই যাব, তাতে যদি পথে আনা যায় ব্রাদার বার্থোলোমিউকে। আমি যা ভালো মনে করেছি তাই করেছি, বলে দারুণ গোসা হয়েছে। ভায়ার। কাল রাতে খুব কথা কাটাকাটিও হয়ে গেছে এই নিয়ে। কল্পনা করতে পারবেন না রেগে গেলে কী সাংঘাতিক লোক হয়ে যায় আমার এই ব্রাদারটি!

আমি সাহস করে বলে ফেললাম, নরউডেই যদি যেতে হয়, তাহলে এখুনি বেরোনোই ভালো।

হেসে উঠল খুদে শোন্টো, হাসতে হাসতে টকটকে লাল করে ফেলল কানের ডগা পর্যন্ত।

বললে উচ্চকণ্ঠে, তাতে ফল হবে না। হঠাৎ এইভাবে আপনাদের নিয়ে হাজির করলে কী বলতে কী বলে বসবে ভগবান জানেন। পরিস্থিতিটা আগে বোঝাতে দিন আমরা কে কোথায় দাঁড়িয়ে সেটা পরিষ্কার করতে দিন। প্রথমেই বলে রাখি আমার কাহিনির বেশ কয়েকটা ব্যাপার আমার কাছেও আজ পর্যন্ত ধোঁয়াটে। যা জানি শুধু তাই বলব–ঘটনা ছাড়া তার মধ্যে কিছু নেই।

বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয় আমার বাবা মেজর শোল্টো এককালে ভারতীয় সৈন্যবাহিনীতে ছিলেন। এগারো বছর আগে অবসর নিয়ে চলে এলেন আপার নরউডে উঠলেন পণ্ডিচেরী লজে। ভারতবর্ষে থাকতে থাকতে অনেক টাকা করেছিলেন উনি। দেশে ফিরলেন কুবেরের সম্পদ নিয়ে। কাড়ি কাড়ি টাকা, দামি দুপ্রাপ্য বস্তুর এক বিরাট দুর্লভ সংগ্রহ আর একদল ওই দেশের চাকরবাকর। এত সুবিধে থাকার ফলেই বাড়ি কেনা সম্ভব হয়েছিল এবং সেই থেকেই অত্যন্ত বিলাসবহুলভাবে বসবাস শুরু করলেন পণ্ডিচেরী লজে। আমি আর আমার বার্থোলোমিউ ব্রাদার ছাড়া তার আর ছেলেপুলে নেই।

ক্যাপ্টেন মটনের চাঞ্চল্যকর অন্তর্ধানের পর কাগজে কাগজে কী লেখা হয়েছিল সব মনে আছে আমার! হইচই পড়ে গিয়েছিল সারাদেশে। বাবার বন্ধু বলেই বাবার সামনেই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতাম খোলাখুলিভাবে। শেষপর্যন্ত এর অদৃষ্টে কী ঘটতে পারে এই নিয়ে অনেকরকম অনুমান করতাম, বাবাও যোগ দিতেন কথায়। ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি গোটা রহস্যটাই উনি পেটের মধ্যে লুকিয়ে বসে আছেন। ভাবতেও পারিনি উনি ছাড়া আর কেউ জানে না কী ঘটেছে মর্সটানের অদৃষ্টে।

এইটুকু শুধু বুঝেছিলাম যে দারুণ একটা রহস্য, অমোঘ একটা বিপদ ঝুলছে আমার বাবার মাথায়। একলা কখনো রাস্তায় বেরোতেন না। বাজি ফেলে লড়াই করে, এমন দু-জন প্রাইজ ফাইটার মুষ্টিযোদ্ধাকে পণ্ডিচেরী লজে কুলির চাকরি দিয়ে রেখেছিলেন। আজকে আপনাদের গাড়ি চালিয়ে আনল যে উইলিয়ামস, সে দু-জনের একজন। এককালে ইংল্যান্ডের লাইট ওয়েট চ্যাম্পিয়ান ছিল উইলিয়ামস। ভয়টা কীসের অথবা কাকে, বাবা কখনো বলেননি। তবে লক্ষ করেছি তার চক্ষুশূল ছিল কাঠের পা-অলা কোনো ব্যক্তি। একবার কাঠের পা-আলা একজন দেখেই উনি রিভলবার ছুঁড়েছিলেন। শেষকালে দেখা গেল লোকটা একটা নিরীহ ফেরিওয়ালা। বাড়ি বাড়ি যায় অর্ডার সংগ্রহ করতে। অনেক টাকা ছড়িয়ে ধামাচাপা দিয়েছিলাম সেই কেলেঙ্কারি। ভায়া আর আমি দু-জনেই তখন ভাবতাম এটা বুঝি বাবার একটা বদখেয়াল–পরে কিন্তু এমন সব ঘটনা ঘটেছে যে এ-ধারণা পালটাতে বাধ্য হয়েছি।

১৮৮২ সালে ভারতবর্ষ থেকে একটা চিঠি পেয়ে সাংঘাতিক মানসিক চোট পেলেন বাবা। প্রাতরাশ খেতে বসেছিলেন টেবিলে। চিঠিখানাও খুলেছিলেন সেখানে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন টেবিলের ওপর। তারপর থেকেই কালব্যাধি পেয়ে বসল বাবাকে তিলতিল করে এগিয়ে চললেন মৃত্যুর দিকে। কী লেখা ছিল চিঠিতে কাউকে বলেননি বাবা। তবে পাশ থেকে লক্ষ করেছিলাম চিঠির হস্তাক্ষর জড়ানো ধরনের। পিলে বৃদ্ধির জন্যে অনেকদিন ধরেই কষ্ট পাচ্ছিলেন বাবা। এই ঘটনার পর দ্রুত বেড়ে গেল রোগের প্রকোপ। এপ্রিলের শেষের দিকে শুনলাম জীবনের আশা নেই এবং শেষ দেখা দেখতে চেয়েছেন আমাদের কী যেন বলতে চান মৃত্যুর আগে।

ঘরে ঢুকে দেখলাম পিঠে বালিশ দিয়ে উঠে বসে হাপরের মতো নিশ্বাস নিচ্ছেন বাবা! ইশারায় দরজায় তালা দিয়ে বিছানার দু-পাশে এসে বসতে বললেন দু-জনকে। তারপর আমাদের হাত চেপে ধরে যন্ত্রণায় আর আবেগে ভাঙা ভাঙা স্বরে যা বললেন যদূর সম্ভব তা শোনাবার চেষ্টা করব আপনাদের।

মরতে বসেছি, কিন্তু একটা জিনিস কিছুতেই মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছি না–পাষাণ হয়ে চেপে রয়েছে আমার বিবেকের ওপর। মর্টানের অনাথ মেয়েটাকে আমি পথে বসিয়েছি। খুবই খারাপ ব্যবহার করেছি বেচারার সঙ্গে। যে অভিশপ্ত ললাভের বশবর্তী হয়ে এক মহাপাপের বোঝা টেনে চলেছি জীবনভোর, সেই ললাভের ফাঁদে পড়েই মেয়েটাকে ফাঁকি দিয়েছি অর্ধেক দৌলত ধনরত্নের অন্তত অর্ধেকের মালিকানা হওয়া উচিত ওর। অথচ সে-সম্পদ নিজেও যে ভোগ করেছি তা নয়–আগলে রেখেছি যখের মতো সাধে কি বলে অতিরিক্ত ধনলিপ্সায় মানুষ অন্ধ হয়ে যায়, নির্বোধ হয়ে যায়। কুবেরের সম্পদ দখলে রাখার আনন্দেই মাতোয়ারা হয়ে আর একজনকে বাবার অংশ দিতেও চাইছি না। কুইনাইনের শিশির পাশে মুক্তোর মুকুটটা দেখেছ? এ-মুকুট ওকে দেওয়ার জন্যেই সঙ্গে এনেছিলামকিন্তু দিচ্ছি না। কাছ ছাড়া করতেও প্রাণ চাইছে না। শোন, ছেলেরা, আগ্রা দৌলতের বেশ কিছু বখরা মেয়েটাকে দিয়ে। কিন্তু আমি না-যাওয়া পর্যন্ত কিছু দেবে না–মুকুটটাও না। এ-রকম কাহিল অবস্থায় পৌঁছেও মানুষ সেরে ওঠে–বেঁচে যায়।

শোনো বলি কীভাবে মারা গিয়েছিল মর্সটান। ওর হার্ট চিরকালই দুর্বল কিন্তু কেউ জানত না কাউকে বলত না–আমাকে ছাড়া! আমিই কেবল জানতাম ওর হৃৎপিণ্ড ধকল সইতে পারে না একদম। ভারতবর্ষে থাকার সময়ে পর পর অনেকগুলো আশ্চর্য ঘটনার ফলে বেশ কিছু ধনরত্ন হাতে আসে আমাদের দুজনের। আমি তা নিয়ে আসি ইংল্যান্ডে। মর্সটান দেশে ফিরেই সেই রাতেই সোজা আমার এখানে এসে চাইল অর্ধেক বখরা। স্টেশন থেকে হেঁটে এসেছিলেন মর্সটান দরজা খুলে দিয়েছিল লাল চৌদার–আমার অত্যন্ত বিশ্বাসী চাকর–এখন সে-ও পরলোকে। মণিমুক্তা বখরা করা হবে কীভাবে, এই নিয়ে মতান্তর হল আমার সঙ্গে মর্সটানের। বেশ কিছু চেঁচামেচিও হয়ে গেল তাই নিয়ে! রাগের মাথায় চেয়ার ছেড়ে ছিটকে গিয়েছিল মর্সটান। আচমকা বুকের বাঁ-দিকে খামচে ধরে টলতে লাগল মাতালের মতো; ছাইয়ের মতো ফ্যাকাশে হয়ে এল মুখ, তারপরেই চিতপটাং হয়ে আছড়ে পড়ল মেঝের ওপর, দড়াম করে মাথাটা ঠুকে গেল রত্নপেটিকায়। দৌড়ে গেলাম আমি। হেঁট হয়ে সভয়ে দেখলাম মারা গিয়েছে মর্সটান।

মুহ্যমানের মতো বসে রইলাম অনেকক্ষণ, ঠিক করে উঠতে পারলাম না কী করা উচিত এখন। প্রথমে ভেবেছিলাম চেঁচিয়ে লোক জড়ো করি। কিন্তু যদি সবাই উলটে সন্দেহ করে বসে যে আমিই হিরে মুক্তোর লোভে খুন করেছি মর্সটানকে? দুটো কারণে লোকের সন্দেহ এসে পড়বে আমার ওপর–প্রথমত দারুণ চেঁচামেচির পরেই মৃত্যু। দ্বিতীয়ত রত্নপেটিকার কোণে লেগে মাথা কেটে যাওয়া। দুটো ব্যাপারই যাবে আমার বিরুদ্ধে! আরও আছে। পুলিশ এলে সরকারি তদন্ত হবেই। রত্নপেটিকার গুপ্ত সংবাদও ফাঁস হয়ে যাবে–যা আমি মোটেই চাই না। মর্সটান বলেছিল কাকপক্ষীও জানে না সে কোথায় যাচ্ছে। সুতরাং খবরটা কাকপক্ষীকে গায়ে পড়ে জানানোর দরকার নেই।

এইসব সাত-পাঁচ ভাবছি, এমন সময়ে চোখ তুলে দেখি দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আমার চাকর লাল চৌদার। পা টিপে টিপে ভেতরে এসে দরজায় খিল তুলে দিল সে। বললে, ভয় কী সাহেব? কেউ জানবে না আপনি খুন করেছেন ওঁকে! আসুন, লাশটা লুকিয়ে ফেলি। আমি বললাম, আমি খুন করিনি। হাসল লাল চৌদার। মাথা নেড়ে বললে, সাহেব, আড়াল থেকে সব শুনেছি আমি। ঝগড়া শুনেছি, মাথায় মারার আওয়াজও শুনেছি, কিন্তু এই মুখে চাবি দিলাম–কেউ তা জানবে না। বাড়িসুদ্ধ লোক এখন ঘুমোচ্ছে। এই সুযোগ। চলুন সরিয়ে নিয়ে যাওয়া যাক দেহটা। শুনেই মন ঠিক করে ফেললাম। লাল চৌদার আমার পরম বিশ্বাসী চাকর–সে যদি আমাকে নিরপরাধ মনে না-করে, আদালতের জুরিরাই-বা করতে যাবে কেন? সেই রাতেই আমি আর লাল চৌদার হাওয়া করে দিলাম লাশ। পরের কয়েকদিনের মধ্যেই লন্ডনের কাগজে গরম গরম খবর ছাপা হতে লাগল ক্যাপ্টেন মটানের অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে যা বললাম তা শুনে বুঝেছ নিশ্চয় এর জন্যে আমাকে দায়ী করা চলে না। দোষ আমার একটাই–শুধু লাশ পাচার নয়, দৌলতসুদ্ধ লুকিয়ে ফেললাম। শুধু নিজের অংশ নয়, মস্টানের বখরাও আত্মসাৎ করলাম। এখন চাই সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত হোক! কাল নিয়ে এসো আমার কাছে। রত্নপেটিকা লুকিয়ে রেখেছি—

ঠিক এই সময়ে একটা ভয়াবহ পরিবর্তন দেখা গেল তাঁর চোখে-মুখে। দু-চোখ যেন। ঠিকরে বেরিয়ে এল কোটর থেকে, ঝুলে পড়ল চোয়াল, চেঁচিয়ে উঠলেন কানের পর্দা ফাটানো বিষম বিকট গলায়, বার করে দাও… বার করে দাও ওকে! হে ভগবান! হে ভগবান! জীবনে সেই চিৎকার, সেই গলা, আমি ভুলতে পারব না। উনি বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে ছিলেন আমাদের পেছন দিককার জানলায়। চকিতে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালাম সেই দিকে। দেখলাম, অন্ধকারের ভেতর থেকে কেবল একটা মুখ চেয়ে আছে আমাদের দিকে। কাচের ওপর নাক চেপে ধরায় সাদা হয়ে যাওয়া নাকের ডগা পর্যন্ত দেখতে পেলাম স্পষ্ট। দাড়িওলা লোমশ একটা মুখ; বুনো পশুর মতো দুই চোখে নারকীয় নিষ্ঠুরতা, মুখ-ভাবে গাঢ় জিঘাংসা। ভায়া আর আমি দু-জনেই দৌড়ে গেলাম জানালার সামনে–ততক্ষণে কিন্তু উধাও হয়েছে লোকটা। বাবার কাছে ফিরে এসে দেখলাম মাথা ঝুলে পড়েছে বুকের ওপর, নাড়ি আর চলছে না, থেমে গেছে হৃদঘাত।

সেই রাতেই তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম বাগান, কিন্তু আততায়ীর চিহ্ন দেখতে পেলাম না। জানালাটার নীচে কেবল দেখতে পেলাম ফুলগাছের মাটিতে একটি মাত্র পায়ের ছাপ। ওই পায়ের ছাপ না-দেখতে পেলে কিন্তু ধরে নিতাম জানালার কাছে যা দেখছি তা চোখের ভুল। গল্প শুনে ভয় পেয়ে একটা বীভৎস বন্য মুখকে কল্পনা করে নিয়েছি। কিন্তু গুপ্তচর যে অষ্টপ্রহর তৎপর আমাদের আশেপাশে সে-রকম অনেক প্রমাণ পেলাম দু-দিনেই। একদিন ভোরবেলা উঠে দেখলাম বাবার ঘরে জানলা দু-হাট করে খোলা, আলমারি আর বাক্স-প্যাটরা হাঁটকে লাটঘাট করা এবং সিন্দুকের ওপর একটা ছেড়া কাগজ সাঁটা; তাতে জড়ানো ধাঁচে লেখা–চারের সংকেত। কথাটার মানে কী, নৈশ আগন্তুকই-বা কে কিছুই জানা গেল না। বাবার কোনো জিনিসই কিন্তু খোয়া যায়নি–অথচ সব জিনিসই হাঁটকানো হয়েছে। শেষ জীবনে বাবা একটা অদ্ভুত আতঙ্কে ভুগছিলেন। সেই আতঙ্কর সঙ্গে আশ্চর্য এই ব্যাপারের যোগসূত্র থাকা স্বাভাবিক–এ ছাড়া আর কিছু মাথায় এল না আমাদের। আজও কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই একটা প্রকাণ্ড রহস্য হয়ে রয়েছে দুই ভাইয়ের কাছে।

হুঁকো নিভে গিয়েছিল। ধরিয়ে নেওয়ার জন্যে স্তব্ধ হল পুঁচকে লোকটা। তারপর কিছুক্ষণ চিন্তাবিষ্টভাবে ধোঁয়া ছাড়তে লাগল নাকমুখ দিয়ে। অত্যাশ্চর্য উপাখ্যান শুনেছি আমরা নিবিষ্ট চিত্তে। বাবার মৃত্যু-কাহিনি শুনে মড়ার মতো সাদা হয়ে গিয়েছিলেন মিস মর্সটান, ভয় হয়েছিল পাছে অজ্ঞান না হয়ে যান। পাশের টেবিলে একটা কাচের জল পাত্র ছিল। সুদৃশ্য পাত্রভেনিস থেকে আমদানি। এক গেলাস জল ঢেলে নিঃশব্দে এগিয়ে দিলাম–জল খেয়ে অনেকটা সামলে নিলেন ভদ্রমহিলা। তন্ময় মুখে হেলান দিয়ে বসেছে শার্লক হোমস–চোখের পাতা নেমে এসেছে উজ্জ্বল চোখ জোড়ার ওপর। সে-মুখের দিকে তাকিয়ে মনে পড়ল আজকেই দৈনন্দিন জীবনের একঘেয়েমি নিয়ে অভিযোগ করেছিল বন্ধুবর। এখন যে-সমস্যা হাতে এসেছে, তার জট ছাড়াতেই কাল ঘাম ছুটে যাবে–বুদ্ধিপ্রবৃত্তিকে চূড়ান্তভাবে প্রয়োগ করতে হবে। পর্যায়ক্রমে আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে স্বীয় গল্পের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে আত্মপ্রসাদ লাভ করল থেডিয়াস শোন্টো। অতিরিক্ত লম্বা নলটা মুখে লাগিয়ে গুরুক গুরুক শব্দে ধোঁয়া ছাড়ার ফাঁকে শুরু করল বিচিত্র উপাখ্যানের পরবর্তী অংশ।

বাবার মুখে গুপ্তধনের সংবাদ শুনে উত্তেজিত হয়েছিলাম দুই ভাই, আশা করি তা বুঝে নিয়েছেন। হপ্তার পর হপ্তা, মাসের পর মাস খুঁড়ে খুঁড়ে ঝাঁঝরা করে ফেললাম বাগান, কিন্তু গুপ্তধনের চিহ্ন পেলাম না। হাত কামড়াতে ইচ্ছে হচ্ছিল বাবা মরণকালে গোপন ঠিকানাটা বলতে গিয়েও বলতে পারলেন না বলে। মুক্তোর মুকুটটাই কেবল রত্নপেটিকার বাইরে রেখেছিলেন বাবা। ওই একখানা মুকুটের মূল্য বিচার করেই আঁচ করতে পারছিলাম নিখোঁজ পেটিকার ঐশ্বর্য। মুকুট নিয়ে দুই ভাই আলোচনা করেছিলেন। মুক্তোগুলো বাস্তবিকই অত্যন্ত মূল্যবান। এমন ঐশ্বর্য হাতছাড়া করার খুব একটা ইচ্ছে নেই দেখলাম ভাইয়ের। আপনারা বন্ধু মানুষ, আপনাদের বলতে বাধা নেই, বাবার অন্যায় খুব একটা বড়ো করে দেখেনি আমার ভাই। ওর মতে নাকি মুক্তোর মুকুট হাতছাড়া করলেই কানাকানি হবে তাই নিয়ে তারপরে ঝামেলায় পড়ব দু-জনে। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ওকে রাজি করালাম যাতে মিস মটানের ঠিকানা জোগাড় করে কিছুদিন অন্তর অন্তর একটি করে মুক্তো পাঠিয়ে দিতে পারি–ফলে অন্তত নিজেকে আর নিঃস্ব মনে করতে পারবেন না উনি।

মিস মর্সটান অন্তর দিয়ে বললেন, মন আপনার সত্যিই উদার। অশেষ কৃতজ্ঞ রইলাম।

হাত নেড়ে অভিনন্দনটা গ্রাহের মধ্যে না-এনে বললে খুদে ব্যক্তি :

আমরা হলাম গিয়ে আপনার অছি। আমার এই মতের সঙ্গে ভায়া বার্থোলোমিউ অবশ্য কিছুতেই একমত হতে পারেনি। অনেক টাকার মালিক আমরা। আর টাকার দরকার নেই আমার! তা ছাড়া একজন তরুণীকে এইরকম ন্যক্কারজনকভাবে পথে বসানোটাও অত্যন্ত কুরুচির ব্যাপার। এসব ব্যাপারে ফরাসি ভাষায় অনেক ভালো কথা আছে। মতান্তর এবং খিটিমিটি এমন চরমে পৌঁছোল যে ঠিক করলাম আলাদা থাকব। পণ্ডিচেরী লজ ছাড়লাম সেই কারণেই সঙ্গে আনলাম বুড়ো খিদমতগার আর উইলিয়ামসকে। গতকাল একটি খবর কানে এল। দারুণ গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘটনা ঘটেছে। গুপ্তধনের সন্ধান পাওয়া গেছে। তক্ষুনি যোগাযোগ করলাম মিস মটানের সঙ্গে। এখন চলুন সবাই মিলে গিয়ে যার যা শেয়ার বুঝেসুঝে নিই। কাল রাত্রে আমার ইচ্ছে জানিয়ে রেখেছি ব্রাদার বার্থোলোমিউকে। কাজেই এখন গেলে আমাদের স্বাগতমই জানানো হবে–অবাঞ্ছিত বলে মনে করা হবে না।

স্তব্ধ হল থোডিয়াস শোন্টো–কিন্তু ঝাঁকুনি কঁপুনি থামল না। বিলাসবহুল কেদারায় আসীন ক্ষুদ্র বপুটি মুহুর্মুহু চিড়িক দিয়ে উঠতে লাগল আত্যন্তিক উত্তেজনায়। চুপচাপ বসে রইলাম আমরা তিনজনে–মুখে টু শব্দটি নেই–মন নিমজ্জিত নিতল রহস্য সমুদ্রে। ঘটনা যে এ-রকম মোড় নেবে ভাবা যায়নি। সবার আগে তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠল হোমস।

বলল, আপনি মশায় গোড়া থেকেই কাজের কাজ করে এসেছেন। যা করেছেন, ভালোই করেছেন। যা বোঝেননি, এখুনি তা বুঝিয়ে দিতে পারি। রহস্য পরিষ্কার করে দিতে পারি। কিন্তু এখন নয়–রাত অনেক হল। মিস মর্সটান ঠিকই বলেছেন। হাতের কাজ আগে শেষ করা যাক।

উঠে পড়ল নব পরিচিত শোল্টো, যত্নের সঙ্গে গুটিয়ে রাখল হুঁকোর নল, তারপর পর্দার আড়াল থেকে বার করল একটা বেজায় লম্বা টপ-কোট ফঁস আর বোতাম ছাড়াও সলোম ভেড়ার চামড়ার তৈরি কলার যার দেখবার মতো। গুমোট রাত, তা সত্ত্বেও কোটের বোম লাগাল গলা পর্যন্ত, সবশেষে মাথায় ছিল খরগোশের চামড়া দিয়ে তৈরি কানঢাকা টুপিফলে শুধু শীর্ণ, চঞ্চল মুখখানিই বেরিয়ে রইল বাইরে বাকি শরীরটা ঢাকা পড়ল ধড়াচূড়ার আড়ালে।

অলিন্দে বেরিয়ে বলল সাফাই হিসেবে, স্বাস্থ্য আমার কাচের মতোই ঠুনকো জানবেন। তাই বাধ্য হয়ে বাবোমেসে রুগি সেজে থাকতে হয়।

গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল বাইরে, যাওয়ার ব্যবস্থাও পূর্বপরিকল্পিত। কেননা ভেতরে উঠে বসতে-না-বসতেই চাবুক হাঁকিয়ে নক্ষত্ৰবেগে গাড়ি উড়িয়ে নিয়ে চলল চালক। চাকার ঘরঘরানির ওপর গলা তুলে একনাগাড়ে কথা বলে চলল থেডিয়াস শোল্টো।

বার্থোলোমিউ কিন্তু দারুণ সেয়ানা। গুপ্তধনের হদিশ কীভাবে বের করেছে জানেন? বাগানে তন্নতন্ন করে খোঁজার পর ও বুঝছিল রত্নপেটিকা বাড়ির মধ্যেই কোথাও আছে! তাই বাড়ির প্রতিটি বর্গইঞ্চির হিসেব নিয়েছে যাতে কোনো অংশ চোখ এড়িয়ে না-যায়। মাপজোপ করতে গিয়ে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ওর টনক নড়ায়। বাড়িটা চুয়াত্তর ফুট উঁচু। কিন্তু প্রতিটা ঘরের উচ্চতা আলাদাভাবে যোগ করার পর এবং দুটো ঘরের মাঝের সঠিক ব্যবধান কত জেনে সেই যোগফলের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার পর দেখা গেল দাঁড়াচ্ছে মাত্র সত্তর ফুট। তার মানে চার ফুটের কোনো হিসেব নেই। হিসেবের বাইরে এই চার ফুট তাহলে বাড়ির মাথার দিকেই আছে। ওপরতলার সিলিং ফুটো করে দেখা গেল সত্যিই তারও ওপরে রয়েছে একটা ঘর বালি সিমেন্ট দিয়ে পরিপাটিভাবে লুকিয়ে রাখা হয়েছে চোখের আড়ালে। এহেন চিলেকোঠার ঠিক মাঝখানে দুটো বরগার ওপর রয়েছে রত্নপেটিকা। ফুটোর মধ্যে দিয়ে পেটিকা নামিয়ে ঘরেই রেখে দিয়েছে বার্থোলোমিউ। মণিমুক্তোর হিসেবও করেছে। আন্দাজ দাম প্রায় পাঁচলক্ষ পাউন্ড।

যক্ষপতির রত্নপুরীসম এই বিপুল অংশটি শুনে বিস্ফারিত চোখে আমরা চাইলাম পরস্পরের মুখের দিকে। মিস মর্সটানকে যদি তার স্বত্ত্ব পাইয়ে দিতে পারি, তাহলে রাতারাতি বরাত ফিরে যাবে তার। ছিলেন অভাবী গৃহশিক্ষয়িত্রী, হবেন ইংলন্ডের সেরা ধনবতী। সাচ্চা বন্ধুমাত্রই এ-খবরে উল্লসিত হবে, আমি কিন্তু হতে পারলাম না। বলতে মাথা কাটা যাচ্ছে, তবু বলছিনিদারুণ স্বার্থপরতায় নিমেষে মোচড় দিয়ে উঠল মনটা এবং সিসের মতো ভারী হয়ে উঠল বুকের ভেতরটা। অভিনন্দন জানাতে গেলাম, কিন্তু জিভ জড়িয়ে গেল, তোতলামি সার হল। অবশেষে বসে রইলাম মাথা হেঁট করে। নবীন সুহৃদের বকবকানির একটা বর্ণও ঢুকল না কানে। লোকটা নিঃসন্দেহে বিষাদ রোগে ভুগছে। স্বপ্নের মতো মনে পড়ে, অনর্গল অনেক রকম রোগের লক্ষণ বলে যাচ্ছিল সে এবং আমাকে পীড়াপীড়ি করছিল অসংখ্য টোটকা ওষুধের খবরাখবর নিয়ে। হাতুড়ে চিকিৎসা যদিও, তাহলে ওষুধগুলো কী দিয়ে তৈরি এবং কীভাবে কাজ করে শরীরের ভেতরে বিরামবিহীনভাবে জিজ্ঞেস করে যাচ্ছিল সেইসব তথ্য। কতকগুলো ওষুধ তো চামড়ায় মোড়া পকেট বইতে লিখেও রেখেছিল। আশা করি সে-রাতে আমি প্রশ্নের যেসব জবাব শুনিয়েছিলাম, তা তার মনে নেই। হোমস নাকি আমার দু-একটা জবাব শুনে ফেলেছিল। দু-ফেঁটার বেশি ক্যাস্টর অয়েল১২ খেলে দারুণ বিপদ হতে পারে বলবার পরেই নাকি ঘুমের ওষুধ হিসেবে অধিকমাত্রায় স্ট্রিকনিন খেতে সুপারিশ করেছিলাম। যাই হোক, গন্তব্যস্থানে গাড়ি পৌঁছোতেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম আমি। কঁকুনি দিয়ে থামল শোল্টো এবং লাফ দিয়ে নীচে নেমে দরজা খুলে ধরল চালক।

হাত ধরে মিস মর্সটানকে গাড়ির বাইরে এনে বললে থেডিয়াস শোল্টো, মিস মর্সটান, এই হল গিয়ে আমাদের পণ্ডিচেরি লজ।

[স্যার আর্থার হুঁকো বলতে নিশ্চয় আলবোলাকেই বুঝিয়েছেন! অনুবাদক।]