উপন্যাস

০৬. হাতেনাতে দেখাল শার্লক হোমস

হাতেনাতে দেখাল শার্লক হোমস

দু-হাত ঘষে শার্লক হোমস বললে, হাতে আধঘণ্টা সময় পাওয়া গেছে ওয়াটসন। সদ্ব্যবহার করা যাক! কেসটা আমি মেরে এনেছি। তবে আত্মবিশ্বাস জিনিসটা বেশি থাকা ভালো নয়ভুল হতে পারে। ওপর-ওপর জলের মতো সোজা কেস মনে হলেও কে জানে তলায় দারুণ ঘোর প্যাঁচ আছে কিনা।

জলের মতো সোজা বলছ। আমি তো হতভম্ব।

সোজাই তো৷ এমনভাবে বলল হোমস যেন ডাক্তারি ক্লাসে কঠিন রোগের নিদান শোনাচ্ছে ছাত্রদের। এককোণে বসে থাক, তোমার পায়ের ছাপ দিয়ে জট পাকিয়ে দিয়ো না কেসটাকে। এবার নামা যাক কাজে। পয়লা হেঁয়ালি হল এই : আততায়ীরা এসেছে কোন পথে, গেছেই-বা কোনদিক দিয়ে? কাল রাত থেকে দরজা খোলা হয়নি। কিন্তু জানলাটা? জানলার ধারে লক্ষ নিয়ে গিয়ে গোবরাটটা দেখতে দেখতে নিজের মনে উচ্চকণ্ঠে যা বলে গেল হোমস তা এই–জানলার ছিটকিনি ভেতর দিকে। ফ্রেম শক্ত। পাশে কবজা নেই। খুলে দেখা যাক। নাগালের মধ্যে জলের পাইপ নেই। ছাদও নাগালের বাইরে। তা সত্ত্বেও একটা লোক জানলা দিয়ে ঢুকেছিল ঘরে। সামান্য বৃষ্টি হয়েছিল কাল রাতে। গোবরাটের কাদায় এই তো একটা পায়ের ছাপ। একটা গোলমতো কাদার দাগও দেখেছ এখানে। মেঝেতেও রয়েছে দাগটা, রয়েছে টেবিলের পাশেও। ওয়াটসন, নিজে দ্যাখো, নিজে দ্যাখো। হাতেকলমে শিখতে যদি চাও তো নিজের চোখে দেখে যাও!

কাদার চাকতির মতো গোলাকার দাগগুলোর দিকে চাইলাম।

বললাম, এ তো পায়ের ছাপ নয়।

আমাদের কাছে এ-জিনিসের মূল্য তার চাইতেও অনেক বেশি। এ হল কাঠের খোঁটার ছাপ। গোবরাটটা দেখ–একটা ভারী বুটের ছাপ দেখতে পাবে–চওড়া ধাতুর গোড়ালি লাগানো বুটজুতত। ঠিক তার পাশেই দেখতে পাবে কাঠের খোঁটার দাগ!

কাঠের পা-ওলা লোক।

ঠিক ধরেছ, সঙ্গে যে ছিল সে কিন্তু শক্তসমর্থ চটপটে। ডাক্তার, পারবে ওই দেওয়াল বেয়ে উঠতে?

খোলা জানলা দিয়ে তাকালাম বাইরে। চাদের আলোয় এখনও ঝকঝক করছে বাড়ির কোনা। জমি থেকে ষাট ফুট উঁচুতে দাঁড়িয়ে আমি–ইটের দেওয়াল এত মসৃণ যে পায়ের আঙুল রাখবার জায়গা পর্যন্ত নেই।

অসম্ভব! একেবারেই অসম্ভব! বললাম আমি।

স্যাঙাত না-থাকলে অসম্ভব বই কী! কিন্তু যদি তোমার একজন দোস্ত থাকে ওপরে এই ঘরে? ওই যে দড়িটা তাগাড় করা রয়েছে সিঁড়ির গোড়ায়, ওই দড়ির একটা দিক। দেওয়ালের এই বিরাট হুকটার সঙ্গে বেঁধে যদি অন্য দিকটা ঝুলিয়ে দেয় নীচে? তাহলে কিন্তু তোমার একটা ঠ্যাং যদি কাঠেরও হয়, আর যদি দিব্বি তাগড়াই মজবুত স্বাস্থ্য ভোমার থাকে, দড়ি বেয়ে উঠে আসা এমন কিছু কঠিন হবে না তোমার পক্ষে। কাজ শেষ করে অবশ্য বেরিয়ে যাবে যে-পথে এসেছ সেই পথেই। তোমার স্যাঙাতও দড়ি টেনে তুলে হুক থেকে খুলে ছুঁড়ে ফেলে দেবে মইয়ের গোড়ায়, জানলা টেনে বন্ধ করে ভেতর থেকে দেবে ছিটকিনি এবং যে-পথে এসেছিল ঘরে সেই পথেই যাবে বেরিয়ে। দড়িটায় আঙুল বুলোতে বুলোতে বলল হোমস ছোট্ট হলেও আর একটা পয়েন্ট কিন্তু খেয়াল রেখ। কাঠের ঠ্যাংঅলা বন্ধুটি দড়ি বেয়ে দিব্বি উঠে এলে কী হবে, পেশায় সে খালাসি নয়। হাত তেমন কড়া পড়া নয়। লেন্সের মধ্যে দিয়ে দড়ির শেষের দিকে–যা থেকে বোঝা যায় যে বেচারি হাত ফসকে সরসর করে নেমে গিয়েছিল নীচে~ তাতেই ছালচামড়া উঠে গিয়েছিল তালু থেকে।

সব তো বুঝলাম, কিন্তু ধাঁধা তো আরও জটিল হয়ে গেল। রহস্যজনক এই স্যাঙাতটি ঘরের মধ্যে এল কী করে?

হ্যাঁ, হা, স্যাঙাত! অনেক রহস্যই ঘিরে আছে তাকে–আছে অনেক ইন্টারেস্টিং পয়েন্ট। চিন্তামগ্নভাবে আমার কথাগুলিই যেন আউড়ে গেল হোমস।কেসটা একেবারেই মামুলি হয়ে যেত সে না-থাকলে। আমার কী মনে হয় জান, এক ঠেঙে আততায়ীর স্যাঙাতটি এদেশে অপরাধের একটা নতুন ধারা প্রবর্তন করে গেল। এদেশে নতুন হলেও, ভারতবর্ষে এ-জাতীয় অপরাধ আকছার ঘটছে। যদূর মনে পড়ে, সেনেগামবিয়ায় ঠিক এ-জাতীয় একটা ঘটনা ঘটেছিল।

আমি একগুঁয়ে স্বরে ফের বললাম, কী করে সে ভেতরে এল আগে বলো। দরজা বন্ধ ভেতর থেকে, দেওয়াল বেয়ে জানলায় ওঠা অসম্ভব, তবে কি চিমনির মধ্য দিয়ে?

সম্ভব নয়। ঝাঝরি অত্যন্ত সরু তোমার আগেই তা ভাবা হয়ে গেছে।

তাহলে? আমি ছাড়বার পাত্র নই।

মাথা নাড়তে নাড়তে হোমস বললে, তবুও আমার নীতিসূত্র প্রয়োগ করতে চাও না। কতবার আর বলব তোমাকে যে অসম্ভবটা খারিজ করার পর যা পড়ে থাকবে–যত উদ্ভটই তা হোক না সার সত্য সেইটাই? আমরা জেনেছি জানলা দিয়ে সে আসেনি। দরজা দিয়েও আসেনি, চিমনি দিয়েও নামেনি। ঘরের মধ্যেও লুকিয়ে বসে থাকা সম্ভব নয়, কেননা ঘাপটি মারার মতো তেমন জায়গাও নেই। তাহলে সে এল কোত্থেকে?

ছাদের ফুটো দিয়ে বললাম সবিস্ময়ে।

ছাদের ফুটো দিয়ে। ওই পথেই তাকে নামতে হয়েছে নীচে আর কোনো রাস্তা নেই ঘরে ঢোকবার। লম্ফটা ধরো উঠে গিয়ে গবেষণা চালিয়ে আসি ছাদের ঘরে যে-ঘরে পাওয়া গেছে গুপ্তধনের বাক্স।

মই বেয়ে উঠে গেল হোমস। দু-হাতে দুটো বরগা ধরে ঝুলতে ঝুলতে শরীর তুলে নিলে চিলেকোঠায়। তারপর উপুড় হয়ে শুয়ে হাত বাড়িয়ে লম্ফটা নিল আমার হাত থেকে। মই বেয়ে আমিও উঠে গেলাম চিলেকোঠায় একই পন্থায়।

ছোটো কুঠরিটা আকারে সত্যিই খুব ছোটো লম্বায় দশফুট, চওড়ায় ছ-ফুট। মেঝে বলতে সারি সারি বরগার তলায় কাঠের বাতা আর চুনবালির পলেস্তারা। ঘরের মধ্যে তাই হাঁটতে গেলে এক বরগা থেকে আরেক বরগায় পা দিয়ে হাঁটতে হয়। আসবাবপত্র একদম নেই। মেঝেভরতি বহু বছর সঞ্চিত পুরু ধুলো। ছাদটা চুড়োর মতো এক জায়গায় গিয়ে মিশেছে–নিঃসন্দেহে বাড়ির আসল ছাদের ভেতরের দিকে।

ঢালু দেওয়ালে হাত বুলিয়ে বলল শার্লক হোমস, এই দেখ ঠেলা দরজা–ছাদে যাওয়ার পথ। এই দেখ ঠেলা মারতেই ফাঁকা হয়ে গেল–ছাদ দেখা যাচ্ছে। আস্তে আস্তে ঢালু হয়ে গেছে। পয়লা নম্বর আততায়ীর আবির্ভাব ঘটেছিল এই পথেই। এবার দেখা যাক তার ব্যক্তিসত্তার কিছু চিহ্ন পাওয়া যায় কিনা।

লম্ফ নামিয়ে মেঝের কাছে আনল হোমস। সঙ্গেসঙ্গে যেন চমকে উঠল–এ-রকম চকিত মুখচ্ছবি আজ রাতে আর একবার দেখেছি। দৃষ্টি অনুসরণ করতে গিয়ে রক্ত হিম হয়ে গেল আমার বেশ বুঝলাম ঠান্ডা হয়ে আসছে গা-হাত-পা। মেঝে ভরতি কেবল পায়ের ছাপ অগুনতি পদচিহ্ন–সুস্পষ্ট, ধ্যাবড়া মোটেই নয়। আঙুল থেকে গোড়ালি পর্যন্ত পরিষ্কারকিন্তু সে-ছাপ পূর্ণবয়স্ক পুরুষদের নয়–সাইজে তার অর্ধেক।

বললাম ফিসফিস করে, হোমস, এ যে দেখছি বাচ্চা ছেলের কাণ্ড। কী ভয়ংকর!

মুহূর্তের মধ্যে আত্মস্থ হল হোমস।

বলল, বেসামাল হয়ে পড়েছিলাম একটু। অস্বাভাবিক কিছুই নেই এখানে। স্মৃতি বিদ্রোহ না-করলে এ-ব্যাপারে তোমাকে আগেই বলতে পারতাম। আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না চলো নীচে যাই।

নীচের ঘরে আসবার পর জিজ্ঞেস করলাম, পায়ের চিহ্ন সম্বন্ধে তোমার তত্ত্বটা এবার বলো শুনি।

অসহিষ্ণু কণ্ঠে জবাব দিল হোমস, ভায়া ওয়াটসন, নিজে বিশ্লেষণ করো। আমার পদ্ধতি তুমি জান। প্রয়োগ করে দ্যাখো কী পাও। তাতে শিখতে পারবে।

আসল ঘটনা কিছু জানা যাবে বলে তো মনে হয় না। আমার মাথায় অন্তত কিছু আসছে না।

এখুনি এসে যাবে, ছাড়া ছাড়া সুরে বললে হোমস। দরকারি আর কিছু এখানে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না, তবুও দেখা যাক।

পকেট থেকে ফিতে আর লেন্স বার করে হামাগুড়ি দিয়ে ঘরময় চরকিপাক দিতে শুরু করল বন্ধুবর। লম্বা নাকটা রইল কাঠের তক্তাগুলোর কয়েক ইঞ্চি দূরে। পাখির চোখের মতো কোটরাগত পুঁতি-সদৃশ চোখ দুটো যেন জ্বলতে লাগল ভেতরের উত্তেজনায়। ফিতে দিয়ে কখনো মেপে, কখনো এক মাপের সঙ্গে আর এক মাপ মিলিয়ে নিয়ে। কখনো চুল চেরা চোখ লেন্সের মধ্যে দিয়ে ধুলোবালি কাঠ পেরেক পরীক্ষা করে হন্যে হয়ে ঘুরতে লাগল ঘরের সর্বত্র। দ্রুতসঞ্চারী ব্লাডহাউন্ড যেমন নিঃশব্দে কিন্তু ক্ষিপ্রবেগে ছোটে গন্ধের পেছনে, শার্লক হোমসও তেমনি ঝড়ের মতো পরীক্ষা করছে। অদৃশ্য সূত্রকে দৃশ্যমান করতে চাইছে। মেঝের কাছে নাক নামিয়ে দেখেশুনে তাজ্জব হয়ে গেলাম। এ-মানুষ যদি অপরাধী হত, আতীক্ষ্ণ এই বুদ্ধিবৃত্তি আর উদ্যম অপরাধী অন্বেষণে না-লাগিয়ে অপরাধ অনুষ্ঠানে বিনিয়োগ করত, তাহলে ওর মতো ভয়ংকর ক্রিমিন্যাল এদেশে আর দু-টি থাকত না। শিকারী কুকুরের মতোই শুকে শুকে ঘর দেখতে দেখতে নিজের মনেই বকর বকর করে চলেছিল হোমস। আচমকা গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে উঠল বিপুল আনন্দে।

কপাল ভালো আমাদের। খুব একটা অসুবিধে আর হবে না। নম্বর ওয়ানের কপাল খারাপ। ক্রিয়োসোট মাড়িয়ে ফেলেছে। কার্বয় চিড় খেয়েছে, ক্রিয়োসোট মেঝেতে পড়েছে, নম্বর ওয়ান বেচারা তাতে পা দিয়ে ফেলেছে। দেখে যাও ভায়া, নিজের চোখেই দেখে যাও ছোটো পায়ের পরিষ্কার ছাপখানা–হ্যাঁ, হ্যাঁ, এইখানে, উৎকট গন্ধওলা ও ক্রিয়োসোটের ঠিক পাশটিতে।

কিন্তু তাতে হল কী?

কী আবার হবে, নম্বর ওয়ান মুঠোয় এসে গেল। পৃথিবীর আরেক প্রান্ত পর্যন্ত এই গন্ধ শুকে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে এমন একটা কুকুরকে আমি চিনি। শিকারি কুত্তার দল যদি হেরিং মাছের গন্ধ শুকে গোটা একটা জেলা পেরিয়ে যায়, বিশেষভাবে শেখানো হাউন্ড উৎকৃষ্ট গন্ধ এঁকে যাবে কদ্দূর? ত্রৈরাশিক অঙ্কের মতো দাঁড়াচ্ছে ব্যাপারটা। উত্তরটা হবে… আরে সর্বনাশ! দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা দেখছি এসে গেছে।

গুরুভার পদশব্দ এবং উচ্চকণ্ঠের হট্টগোল শোনা গেল নীচের তলায় দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল হল ঘরের দরজা।

হোমস বললে, ওরা আসার আগে একটা কাজ করো। বেচারার হাত আর পায়ে তোমার হাত রাখো। কী বুঝলে?

কাঠের মতো শক্ত হয়ে গেছে মাসল।

ঠিক তাই। রাইগর মর্টিসেও হাত-পা এত শক্ত হয় না–এখন যা হয়েছে। মুখের বিকট খিঁচুনি, ঠোঁট আর দাঁতের কপট হাসির সঙ্গে হাত-পায়ের অদ্ভুত শক্ত অবস্থাটা মিলিয়ে দ্যাখো এখন কিছু পাওয়া যায় কিনা। কী মনে হচ্ছে?

মৃত্যু হয়েছে এমন একটা অ্যালকালয়েড দরুন যা সংগ্রহ করা হয়েছে গাছপালা বা লতাপাতা থেকে; শক্তিশালী বিষেরা অনেকটা স্ট্রিকনিনের মতো রক্তে মিশতেই ধনুষ্টংকারের বিক্ষেপ দেখা দিয়েছে।

মুখের পেশি টান-টান অবস্থা দেখামাত্র কিন্তু ঠিক এই কথাই আমি ভেবেছিলাম। তাই ঘরে ঢুকে আগে খুঁজেছিলাম রক্তের মধ্যে বিষ ঢুকিয়ে দেওয়ার অস্ত্রটা। তুমিও দেখেছ জিনিসটা। সামান্য একটা কাটা, আলগোছে ফুটিয়ে দেওয়া হয়েছে মাথার চামড়ায়। এবার লক্ষ করো যেখানে কাটাটা ফুটেছে সে-জায়গাটা ফেরানো রয়েছে সিলিংয়ের দিকে চেয়ারে সিধে হয়ে বসে থাকা অবস্থাতেই তা হয়েছে। এবার পরীক্ষা করে কাটাটা।

অনিচ্ছুকভাবে কাঁটাটা নিয়ে ধরলাম লম্ফর সামনে! লম্বা কালো এবং বেশ ছুঁচালো কাটা। মুখের কাছে আঠা-আঠা মতো কী যেন চকচক করছে শুকিয়ে শক্ত হয়ে গেছে। ভোতা দিকটা ছুরি দিয়ে চেঁছে গোল করে রাখা হয়েছে।

হোমস জিজ্ঞেস করল, ইংলন্ডের কাঁটা কি?

না, না, মোটেই না।

তাহলে দ্যাখো মালমশলা যা পাওয়া গেল তা থেকে একটা ন্যায্য সিদ্ধান্তে আসা যাবে। নিয়মিত কাহিনি অবশ্য এসে গেছে। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর পশ্চাদপসরণই করা কর্তব্য।

গুরুভার পদশব্দ একটু একটু করে এগিয়ে আসছিল কাছে। শব্দ বেড়ে গেল করিডরে আসার পর। তার পরেই, হোমসের মুখের কথা ফুরোনোর আগেই দুমদাম শব্দে ভারিক্কি চালে ঘরে ঢুকল রীতিমতো মোটাসোটা একটি লোক–পরনে ধূসর বর্ণের সুট। হোঁতকা চেহারা, অতিরিক্ত লাল রক্ত-ঠাসা মুখাবয়ব। চোখের নীচে ছোটো থলির মতো ড়ুমোড়ুমো মাংস ঝুলছে এবং এই ফুলোর মধ্যে থেকে ভারি অদ্ভুত এক জোড়া অতি খুদে কিন্তু চিকমিকে চোখ তীক্ষ্ণ্ণ দৃষ্টি মেলে রয়েছে সামনে। পেছন পেছন এল ইউনিফর্মধারী একজন ইনস্পেক্টর এবং থেডিয়াস শোল্টো মুখচোখ দেখে বোঝা গেল বুকের মধ্যে তখনও চেঁকির পাড় পড়ছে সমানে।

হোঁতকা লোকটা ঘরে ঢুকেই বললে ঘসঘসে ভোতা গলায়, বাঃ কারবার গরম দেখছি। চমৎকার! চমৎকার! কিন্তু এরা কারা? বাড়ি বোঝাই এত খরগোশের গর্ত কেন?

প্রশস্ত কণ্ঠে হোমস বললে, আমাকে তো আপনার চেনা উচিত, মি. অ্যাথেনি জোন্স।

আরে শার্লক হোমস যে! তাত্ত্বিক মি. শার্লক হোমস। বেশ মনে আছে আপনাকে। বিশপগেট জুয়েল কেসে কার্যকারণ আর সিদ্ধান্ত নিয়ে আপনার সারগর্ভ লেকচার কি ভোলবার? তদন্তের ঠিক পথ আপনিই ধরিয়ে দিয়েছিলেন মানছি। তবে কী জানেন, স্রেফ কপালজোরেই তা পেরেছিলেন–খুব একটা যুক্তি পরামর্শ দেখাতে পারেননি।

দেখাবার সুযোগও অবশ্য ছিল না–খুবই সোজা যুক্তির কেস।

আরে রাখুন। পারেননি সেটা স্বীকার করতে লজ্জা কীসের? যাকগে, এখানকার কেস তো দেখছি বেশ ভালোই! কী যাচ্ছেতাই কাণ্ড রে বাবা! ভেরি ব্যাড! ভেরি ব্যাড। তত্ত্বকথা শোনবার সুযোগ একদম নেই–ন্যাড়া ঘটনা, চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর মত ব্যাপার! কপাল ভালো অন্য কেস নিয়ে নরউডে হাজির ছিলাম! খবর যখন পৌঁছল, আমিও তখন ফাঁড়িতে। লোকটা কীসে মরল মনে হয়?

এ-কেসে তত্ত্বকথা শোনবার সুযোগ কোথা, শুষ্ক কণ্ঠে বললে হোমস।

তা ঠিক। তা ঠিক তবে মাঝে মাঝে তত্ত্ব আউড়ে আলটপকা কাজ হাসিল করে ফেলেন তো। কী সর্বনাশ! দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল দেখছি। পাঁচ লাখ পাউন্ডের মণিমুক্তো উধাও! জানলা খোলা ছিল না বন্ধ ছিল?

বন্ধ ছিল। কিন্তু গোবরাটে পায়ের ছাপ আছে।

বটে, বটে। জানলা যদি বন্ধই থাকে, তাহলে সে পায়ের ছাপের সঙ্গে এ-কেসের কোনো সম্পর্ক নেই। কমনসেন্স মশায়, সাধারণ বুদ্ধি। লোকটা হয়তো এমনিতেই মারা গেছে, তড়কা হয়েছিল নিশ্চয়। রত্নবাক্সটা অবশ্য উধাও হয়েছে। হা! মাথায় এসেছে একটা তত্ত্ব। এ-রকম বুদ্ধি মাঝে মাঝে এসে যায় মাথায়। সার্জেন্ট–বাইরে যান। মি. শোল্টো–আপনিও যান বাইরে আপনার বন্ধুরা ভেতরেই থাকবেন। হোমস কী মনে হয় বলুন তো? শোল্টো নিজেই স্বীকার করেছে কাল রাতে এখানে ও ছিল ভাইয়ের সঙ্গে। তড়কায় মারা গেল ভাই, হিরের বাক্স নিয়ে বেরিয়ে গেল শোল্টো! কী? কী মনে হয়?

তারপর মড়াটা দিব্বি উঠে দাঁড়িয়ে ভেতর থেকে দরজায় তালাচাবি দিয়ে এসে ফের বসে পড়ল চেয়ারে। কেমন?

হুম! গলতি রয়েছে দেখছি। তাহলে আবার কমনসেন্স খাটানো যাক। ভাইয়ের সঙ্গে এই ঘরেই ছিল থেডিয়াস শোল্টো। একটা ঝগড়াও হয়েছিল। এই পর্যন্ত খবর কিন্তু আমরা জেনেছি। ভাইটি যে তারপর মারা গিয়েছে এবং হিরে মানিকের বাক্স উধাও হয়েছে তা-ও আমরা জেনে বসে আছি। থেডিয়াস বিদেয় হওয়ার পর থেকে তার ভাইকে আর কেউ দেখেনি, বিছানাতেও শোয়নি ভাইটি। থেডিয়াস শোল্টো অত্যন্ত উদ্ৰান্ত অবস্থায় রয়েছে–বেসামাল। চেহারাটাও আর ইয়ে, মোটেই আহামরি নয়। বুঝছেন নিশ্চয় জালে ফেলছি থেডিয়াসকে এবার গুটিয়ে আনব জালের মুখ।

হোমস বললে, অনেক ঘটনাই এখনও আপনার অজানা। এই যে কাঠের টুকরোটা দেখছেন সামান্য একটা কাটা–এটা কিন্তু লোকটার কানের ওপরে মাথার চামড়ায় গাঁথা ছিল–এখনও দাগ দেখতে পারেন। আমার বিশ্বাস কাঁটাটায় বিষ মাখানো আছে। টেবিলে কাগজটা ছিল–দেখতেই পাচ্ছেন কী লেখা রয়েছে কাগজে। তার পাশেই বাঁধা হাতুড়ির মতো অদ্ভুত এই জিনিসটা। এখন বলুন আপনার তত্ত্বে ওইসব খাওয়াবেন কী করে।

বেশ ভালোভাবেই খাপ খেয়ে যায়, জাঁকালো গলায় বললে মোটা গোয়েন্দা। বাড়ি বোঝাই তো দেখছি কেবল ইন্ডিয়ান কিউরিয়সিটি–ভারতবর্ষ থেকে আমদানি হরেকরকম দুষ্প্রাপ্য জিনিস। থেডিয়াস শোল্টো কঁটাটা জোগাড় করেছে এর মধ্যে থেকেই আর যদি তাতে বিষ মাখানোই থাকে, তাহলে বুঝতে হবে মতলবটা ছিল খুন করার। কার্ডটা স্রেফ ধোঁকাবাজি পুলিশের চোখে ধূলো দেওয়ার চেষ্টা। সমস্যা একটাই–ঘর থেকে বেরোল কীভাবে শোল্টো? আ! পেয়েছি। ছাদে একটা ফুটো করা হয়েছে দেখছি।

গতরের তুলনায় রীতিমতো ক্ষিপ্রবেগে দৌড়ে গিয়ে তরতর করে মই বেয়ে ওপরে উঠে গেল হোঁতকা গোয়েন্দা গুটিসুটি মেরে ঢুকে পড়ল সংকীর্ণ চিলেকোঠায়। পর মুহূর্তে শুনলাম উল্লসিত কণ্ঠ–ঠেলা দরজা আবিষ্কার করে ফেলেছি।

কাঁধ ঝাঁকিয়ে হোমস বললে, মাঝে মাঝে বুদ্ধি খেলে যার মাথায়, আবিষ্কার তো সে করবেই! তারপর একটা প্রবচন আউড়ে গেল ফরাসি ভাষায়।

মই বেয়ে নামতে নামতে বললে অ্যাথেলনি জোন্স, দেখলেন তো, তত্তের চেয়ে ঘটনা অনেক ভালো। এ-কেসে আমার ভাবনাই শেষপর্যন্ত ঠিক হবে। ছাদে যাওয়ার ঠেলা দরজা রয়েছে চিলেকোঠায়–একটু খোলাও রয়েছে দরজাটা।

আমি খুলেছি।

তাই নাকি! আপনি খুলেছেন! দরজাটা তাহলে আপনিও দেখেছেন! দমে গেল বেচারা অ্যাথেলনি জোন্স। মরুকগে, আবিষ্কার যেই করুক না কেন, খুনি পালিয়েছে কোন পথে, তা

তো জানা গেল। ইনস্পেকটর!

ইয়েস, স্যার। সাড়া এল বাইরের করিডর থেকে।

মি. শোল্টোকে পাঠিয়ে দাও ভেতরে। মি. শোন্টো, আমার কর্তব্য আপনাকে সাবধান করে দেওয়া–এখন থেকে যা বলবেন তা আপনার বিরুদ্ধে যেতে পারে। ভাইয়ের মৃত্যুর ব্যাপারে আপনাকে গ্রেপ্তার করছি রানির নামে!।

কী হল! বলিনি আপনাদের? দু-হাত শূন্যে নিক্ষেপ করে একবার আমার আর একবার হোমসের মুখের দিকে তাকাতে তাকাতে বললে বেচারা শোল্টো।

হোমস বললে, কিছু ভাববেন না। আমি আপনাকে খালাস করব। আরে আরে করেন কী মি. তত্ত্ববাদী, আকাশের চাঁদ হাতে পাইয়ে দেওয়ার কথা দিচ্ছেন? ভুল করছেন, মি. তত্ত্ববাদী, ভুল করছেন, প্রায় খেকিয়ে উঠল ডিটেকটিভ। শেষকালে হালে পানি পাবেন না।

মি. জোন্স, আমি শুধু ওঁকে খালাসই করব না, কাল রাতে এ-ঘরে যে দু-জন লোক হাজির ছিল, তাদের একজনের নাম আর চেহারার বিবরণও আপনাকে উপহার দেব! আমার দৃঢ় বিশ্বাস তার নাম জোনাথন স্মল। লেখাপড়া বেশি শেখেনি, ছোটোখাটো চেহারা, কিন্তু খুব চটপটে, ডান পা-টা নেই। পায়ের জায়গায় লাগানো আছে একটা কাঠের খোঁটা–ভেতর দিকটা ক্ষয়ে গেছে। বাঁ-পায়ের ভারী বুটের সামনের দিকটা চৌকোনা থ্যাবড়া। গোড়ালিতে লাগানো আছে একটা লোহার বেড়। বয়েসে মাঝামাঝি, রোদে ঝলসানো চেহারা, দাগি আসামি। এতেই আপনার কাজ হবে। নিন আর একটা ফাউ। লোকটার হাতের তালুতে বেশ কিছু চামড়া দেখবেন নেই। অন্য লোকটা

আ! অন্য লোকটা? নাক কুঁচকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে কণ্ঠে ঘৃণা বৃষ্টি করলেও জোন্সের সাগ্রহ হাবভাব দেখে বোঝা গেল ওষুধ ধরেছে।

একটু অদ্ভুত টাইপের! ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল শার্লক হোমস। অবশ্য আশা রাখছি শিগগিরই আপনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব দু-জনকে। ওয়াটসন, এসো কথা আছে।

সিঁড়ির মাথায় আমাকে নিয়ে এল হোমস।

বলল, হঠাৎ এই ঘটনার ফলে যে জন্যে আসা তা কিন্তু শিকেয় উঠল।

বললাম, আমিও তাই ভাবছি! এ-অবস্থায় অভিশপ্ত এই বাড়িতে মিস মর্টানের আর থাকা উচিত নয়।

মোটেই নয়। তুমি ওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এসো। উনি থাকেন লোয়ার ক্যামবারওয়েলে মিসেস সিসিল ফরেস্টারের সঙ্গে খুব বেশি দূর নয় এখান থেকে। গাড়ি নিয়ে ফিরে এসো–অপেক্ষায় থাকব। নাকি ক্লান্ত বোধ করছ?

একদম না। ফ্যানট্যাসটিক এই কারবারের শেষপর্যন্ত না-জেনে জিরোতে পারব বলে মনে হয় না। অনেক ধকল গেছে এই জীবনে, কিন্তু আজ রাতে পর-পর যেসব অদ্ভুত চমকের মধ্যে দিয়ে গেলাম তাতে আমার ধাত ছেড়ে গিয়েছে। এত দূর যখন এসেছি, তোমার সঙ্গে থেকে শেষ না-দেখে যাচ্ছি না।

অনেক কাজ দেবে তুমি আমার সঙ্গে থাকলে। দুজনে মিলে আলাদা তদন্ত করে ফয়সালা করব কেসটার–হাঁদা জোন্স গড়ে মরুক ওর তাসের প্রাসাদ। মিস মর্সটানকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার পর আমার ইচ্ছে তুমি ল্যামবেথে যাও। সেখানে জলের ধারে পাবে তিন নম্বর পিনচিন লেন, ডান দিকের তৃতীয় বাড়ি। শেরম্যান বলে একজন লোক থাকে সেখানে। মরা পাখির পেট থেকে নাড়িভুড়ি বার করে খড়কুটো ঠেসে বিক্রি করে। জানলায় দেখবে একটা খরগোশকে ধরে আছে একটা বেজি। দরজায় ধাক্কা দিয়ে টেনে তুলবে বুড়ো শেরম্যানকে। আমার নাম করে বলবে টোবিকে এখুনি চাই। গাড়িতে চাপিয়ে টোবিকে নিয়ে সোজা চলে আসবে এখানে।

টোবি মানে একটা কুকুর তো?

হ্যাঁ, একটা অদ্ভুত দো-আঁশলা কুকুর। গন্ধ শুকে শিকার ধরবার আশ্চর্য ক্ষমতা রাখে। লন্ডনের পুরো গোয়েন্দা বাহিনির বদলে শুধু টোবির সাহায্য পেলেই আমি বর্তে যাব।

আমি নিয়ে আসছি টোবিকে। এখন বাজে একটা। তেজি ঘোড়ার গাড়ি পেলে ফিরে আসব তিনটের আগেই।

আমি ততক্ষণ বার্নস্টোনের পেট থেকে কিছু খবর বার করা যায় কিনা দেখি। মি. থেডিয়াসের মুখে শুনেছি ভারতীয় চাকরটা থাকে পাশের চিলেকোঠায়–তাকেই টোকা দিয়ে দেখা যাক যদি কিছু জানা যায়। বাকি সময়টা গ্রেট জোন্সের গোয়েন্দাগিরি দেখে আর চাষাড়ে বিদ্রপ হজম করে কাটিয়ে দেব। এ-ব্যাপারে কিন্তু অনেক সারগর্ভ মন্তব্য করে গেছেন কবি গ্যেটে।