লজ ৩৪১, ভারমিসা
এতসব চাঞ্চল্যকর ঘটনা যে-রাতে ঘটল, তার পরেই ম্যাকমুর্দো বৃদ্ধ জ্যাকব শ্যাফটারের বাড়ি ছেড়ে দিয়ে চলে এল শহরের একদম শেষে বিধবা ম্যাকনামারার আস্তানায়। এর কিছুদিন পরেই ট্রেনের বন্ধু স্ক্যানল্যান চলে এল ভারমিসায়, উঠল সেই আস্তানাতেই, একসাথেই রইল দু-জনে। আর কোনো বোর্ডার ছিল না সেখানে। গৃহকত্রী নিজেও খুব উদার প্রকৃতির বৃদ্ধা, আইরিশ মহিলারা যেমন হয়, তাই। ওদের ব্যাপারে নাক গলায় না কখনোই। ওরাও তাই চায়। যখন যা খুশি বলার স্বাধীনতা বা কিছু করার স্বাধীনতা ছিল। পুরোপুরি–জীবনে যাদের গুপ্ত রহস্য থাকে–এ-দুটি স্বাধীনতা তাদের একান্তই দরকার। একটা সুবিধে অবশ্য করে দিয়েছে শ্যাফটার। খিদে পেলে যদি তার আস্তানায় যাওয়ার ইচ্ছে হয়, তাহলে আসতে পারে ম্যাকমুর্দো। কাজেই এট্টির সঙ্গে তার মেলামোয় ভাটা পড়েনি। বরং জোয়ার এসেছে। যতই দিন গিয়েছে, ততই দু-জনে দু-জনের আরও কাছে এগিয়ে এসেছে। সম্পর্ক আরও নিবিড়, আরও মধুময় হয়েছে। নতুন আস্তানার শোবার ঘরে নির্বিঘ্নে জাল টাকার ছাঁচ বার করে কাজ আরম্ভ করে দিয়েছিল ম্যাকমুর্দো। নানা অছিলায় চুপিসারে লজের ব্রাদাররা আসত সেখানে, মেকি মুদ্রার কিছু কিছু নমুনা পকেটে নিয়ে যেত–সুনিপুণ কৌশলে জাল করার ফলে সে-টাকা বাজারে চালাতে তিলমাত্র বেগ পেতে হত না কাউকে। এইরকম মহাগুণের অধিকারী হয়েও, আশ্চর্য এই শিল্পকে আয়ত্ত করা সত্ত্বেও ম্যাকমুর্দো কেন যে দিনভোর বাজে চাকরি নিয়ে মেতে আছে, এ-রহস্য দিবানিশি পীড়িত করেছে সঙ্গীদের। কেউ অবিশ্যি জিজ্ঞেস করলে সে জবাব দিয়েছে এইভাবে যে, চোখে পড়ার মতো কাজ-টাজ না-নিয়ে থাকলে পুলিশের নেকনজর পড়তে কতক্ষণ।
একজন পুলিশের লোক তো সত্যি সত্যিই পেছনে পড়েছিল। কিন্তু কপাল ভালো তাই ঘটনাটায় ক্ষতির বদলে লাভই বরং হয়েছে ম্যাকমুর্দোর। প্রথম মোলাকাতের পর থেকে প্রায় প্রতি সন্ধ্যাতেই ম্যাকগিন্টির সেলুনে গিয়ে বয়দের সঙ্গে আলাপ জমাত ম্যাকমুর্দো। উপত্যকার উপদ্রব বিপজ্জনক এই দুবৃত্তদের মজা করে বয় নামেই ডাকার রেওয়াজ ছিল লজের স্যাঙাতদের মধ্যে। বেপরোয়া আচার আচরণ এবং নির্ভয়ে কথা বলার সাহসিকতা তাকে আরও প্রিয় করে তুলেছিল সঙ্গীসাথিদের মধ্যে। প্রতিপক্ষকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে অতি দ্রুত ভেঁটে দেওয়ার ওর নিজস্ব পদ্ধতির জন্যেও নীচের মহলে নামডাক ছড়িয়েছে প্রচুর মারপিট দাঙ্গাহাঙ্গামা নিয়ে যারা থাকে তাদের কাছে এ-গুণের কদর আছে। এরপর আর একটা ঘটনার পর এদের চোখে আরও উঁচু শ্রদ্ধার আসন পেয়ে গেল ম্যাকমুর্দো।
একদিন রাতের ঘটনা। সেলুনে তিলধারণের জায়গা নেই। হঠাৎ খুলে গেল দরজা। গটমট করে ভেতরে এল মোলায়েম নীলরঙের ইউনিফর্ম পরা একটি লোক মাথায় কোল অ্যান্ড আয়রন পুলিশের চূড়া-উঁচু টুপি। সংঘবদ্ধ গুন্ডামির ফলে সাধারণ পুলিশ অসহায় হয়ে পড়ছে। দেখে বিশেষ এই আরক্ষাবাহিনিকে সৃষ্টি করেছে উপদ্রুত অঞ্চলের রেল আর কয়লাখনির মালিকরা। সিভিল পুলিশকে সাহায্য করাই এদের কাজ। জেলাব্যাপী আতঙ্কের অবসান ঘটানো এদের লক্ষ্য। লোকটা ঘরে ঢুকতেই চেঁচামেচি কমে এল, ফিসফাস আরম্ভ হয়ে গেল, কৌতূহলী চক্ষু সেদিকে নিবদ্ধ হল। কিন্তু আতঙ্ক-উপত্যকায় পুলিশের লোক আর বদমাশ গুন্ডার মধ্যে সম্পর্কটা এমন অদ্ভুত পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ম্যাকগিষ্টি নিজেও বার-কাউন্টারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসা পুলিশ ইনস্পেকটরকে দেখে আশ্চর্য হল না।
কাউন্টারে এসে বললে পুলিশ অফিসার, কনকনে রাত–দেখি একটা সোড়া ছাড়া হুইস্কি। কাউন্সিলর, আগে দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে বলে তো মনে পড়ছে না?
আপনিই নিশ্চয় নতুন ক্যাপ্টেন? শুধোয় ম্যাকগিন্টি।
ধরেছেন ঠিক, কাউন্সিলর। শহরের আইনরক্ষায় আপনার সাহায্য চাই, শীর্ষস্থানীয় নাগরিকদের সহযোগিতাও চাই। আমার নাম ক্যাপ্টেন মার্ভিন–কোল অ্যান্ড আয়রনের ক্যাপ্টেন মার্জিন।
হিমশীতল স্বরে ম্যাকগিন্টি বললে, ক্যাপ্টেন, আপনি না-এলেই বরং ভালোভাবে শান্তিরক্ষা করতে পারতাম। শহরের পুলিশ তো রয়েছেই–আমাদেরই পুলিশ বাইরে থেকে আমদানি করা পুলিশের দরকার দেখি না। আপনি তো এসেছেন ধনিকগোষ্ঠীর ভাড়াটে যন্ত্র হিসেবে গরিব নাগরিকদের হয় পিটিয়ে নয় গুলি করে বাহবা কিনবেন বলে।
সকৌতুকে বললে পুলিশ অফিসার, বেশ, বেশ, তা নিয়ে আর তর্কের মধ্যে যেতে চাই। আমরা তো চাই চোখে যা দেখব, কর্তব্যও করব সেইভাবে। কিন্তু চোখের দেখাটাই যে সবার সমান হয় না। গেলাস খালি করে যাবার জন্যে ফিরেছে অফিসার, এমন সময়ে চোখ পড়ল জ্যাক ম্যাকমুর্দোর ওপর। ঠিক পাশেই কুটি হেনে দাঁড়িয়ে ছিল সে। আরে! আরে! ম্যাকমুর্দোকে দৃষ্টিশরে যেন বিদ্ধ করে ফেলে অফিসার, এই তো অনেকদিনের চেনা একজন বেরিয়ে গেল।
তফাতে সরে এল ম্যাকমুর্দো।
বললে, জীবনে আপনার বন্ধু ছিলাম না, ছুঁচো টিকটিকিদের সঙ্গে আবার বন্ধুত্ব কীসের?
কাষ্ঠ হেসে অফিসার বললে, চেনা মানেই যে বন্ধু হবে কে বলছে? তুমি শিকাগোর জ্যাক মাকমুদো অস্বীকার করতে পারো?
কাঁধ ঝাঁকাল ম্যাকমুর্দো।
অস্বীকার করতে যাব কোন দুঃখে? নিজের নাম বলতে লজ্জায় মরে যাব ভেবেছেন নাকি?
কারণ আছে হে, জবর কারণ আছে।
দু-হাত মুঠি পাকিয়ে সিংহগর্জন করল ম্যাকমুর্দো, মানে? কী বলতে চান আপনি?
জ্যাক, ওসব গলাবাজিতে আমি ধসকাই না। কয়লার গাদায় আসার অনেক আগে শিকাগোয় অফিসার ছিলাম অনেকদিন। শিকাগোর বদমাশকে দেখেই চেনবার ক্ষমতা আমার আছে।
মুখ ঝুলে পড়ল ম্যাকমুর্দোর।
আপনিই কি শিকাগো সেন্ট্রালের মার্ভিন!
আজ্ঞে, তোমার সেবায় আবার এসেছি সেই টেডি মার্ভিন! জোনাস পিন্টোকে গুলি করে মারার ঘটনা এখনও আমরা ভুলিনি।
আমি তো গুলি করিনি।
করনি? নিরপেক্ষ সাক্ষীর জবানি হিসেবে মন্দ বলনি অবশ্য। জোনাস পিন্টো মরে তোমার কিন্তু সুবিধেই করে দিয়েছে, নইলে জাল টাকা বাজারে ছাড়ার দায়ে ধরা পড়তে। যাকগে যা হয়ে গেছে, তা নিয়ে আর কথা বাড়াতে চাই না। তা ছাড়া শুধু তোমাকেই একটা ব্যাপার জানিয়ে রাখি–যদিও জানানোটা আমার সরকারি দায়িত্বের মধ্যে পড়ছে না—তোমাকে ফাঁসানোর মতো অকাট্য কেস খাড়া করা যায়নি–কাজেই শিকাগোেয় ফিরে যাওয়ার রাস্তা তোমার ভোলা চাইলে কালকেই যেতে পারো।
এখানেই বেশ আছি।
আচ্ছা অসভ্য লোক তো তুমি! এমন একটা খবর দিলাম, ধন্যবাদটুকুও দিলে না।
খবরটা আশা করি আমার ভালোর জন্যেই দিয়েছেন–সেক্ষেত্রে ধন্যবাদ রইল, জবাব দেয় ম্যাকমুর্দো কিন্তু খুব একটা সদয় ভঙ্গিমায় নয়।
ক্যাপ্টেন বলে, শোনো হে, মুখে চাবি দিয়ে থাকব যদ্দিন সুবোধ থাকবে। কিন্তু বেচাল দেখলেই বিপদে পড়বে বলে দিলাম! গুডনাইট গুডনাইট, কাউন্সিলর।
বেরিয়ে গেল ক্যাপ্টেন মার্ভিন যাওয়ার আগে কিন্তু সৃষ্টি করে গেল একজন স্থানীয় নায়ককে। সুদূর শিকাগোয় ম্যাকমুদোর কীর্তিকাহিনি নিয়ে ফিসফাস হয়েছে এর আগে। প্রশ্ন করলে স্মিতমুখে এড়িয়ে গিয়েছে ম্যাকমুর্দো নিজেকে খুব বড়ো করে প্রকাশ করার অনিচ্ছেটা নীরবে প্রকাশ করছে। কিন্তু এখন সরকারিভাবে সমর্থিত হল গুজবটা। মদ্যশালার উঙ্খলার চারদিক থেকে হেঁকে ধরে আন্তরিকভাবে করমর্দন করে ধন্য ধন্য করতে লাগল শতমুখে। বিশেষ কোনো সম্প্রদায়ের গণ্ডিতে সে আবদ্ধ হইল না সেইদিন থেকে। আকণ্ঠ গিললেও মদ্য পানের তিলমাত্র লক্ষণ কোনোদিন দেখা যেত না তার আচার আচরণে। সেইরাত্রে কিন্তু দোস্ত স্ক্যানল্যান তাকে টানতে টানতে বাড়ি ফিরিয়ে না নিয়ে গেলে উৎসব মুখর রাত পার করে দিত পানাগারেই।
শনিবার রাতে লজের সদস্যদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হল ম্যাকমুর্দোর। ও ভেবেছিল শিকাগোর লজে আগে থেকেই অন্তর্ভুক্তির দরুন এখানে আবার নতুন করে আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে না। কিন্তু ভারমিসার নিজস্ব আচার অনুষ্ঠান নিয়ে গর্বের অবধি ছিল না ওখানকার সদস্যদের প্রত্যেক প্রার্থীকে যেতে হয় এইসব অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে ইউনিয়ন হাউসে একটা বড়ো ঘর সংরক্ষিত আছে এইসব কাজের জন্যে। সদস্যরা জমায়েত হয় সেই ঘরে। ভারমিসায় জড়ো হল প্রায় আট জন সদস্য। কিন্তু এই সংখ্যাই সব নয়। কেননা, উপত্যকায় লজ আছে আরও অনেক, দু-পাশের পাহাড় পেরিয়েও লজের সংখ্যা নেহাত কম নয়। গুরুতর কাজে মাঝে মাঝে বিভিন্ন লজের সদস্য বিনিময় হয় যাতে বাইরের লোক এসে কুকর্মটি করে সরে পড়ে স্থানীয় লোক চিনতে না-পারে। সারা কয়লা জেলায় এইরকম সদস্য ছড়িয়ে আছে কম করেও পাঁচ-শো জন।
আসবাবহীন অধিবেশনকক্ষে প্রকাণ্ড একটা লম্বা টেবিলের চারধারে জমায়েত হল সদস্যরা। পাশে আর একটা টেবিলভরতি কেবল বোতল আর গেলাস। কিছু সদস্য এর মধ্যেই সেদিকে তাকাতে শুরু করেছে।
টেবিলের মাথায় বসেছে ম্যাকগিন্টি। মাথায় কালো চুলের জটার ওপর চেপটা কালো মখমলের টুপি, ঘাড়ের ওপর বেগুনি রঙের শাল পৈশাচিক অনুষ্ঠানে পুরোহিত যেন। ডাইনে বাঁয়ে বসে লজের উচ্চপদস্থ সদস্যরা, টেড বলড়ুইনের ক্রূর কিন্তু সুশ্রী মুখখানাও দেখা যাচ্ছে তাদের মধ্যে। প্রত্যেকেই পদমর্যাদার প্রতীক স্বরূপ একটা-না-একটা শাল বা মেডেল গায়ে চড়িয়েছে। এদের অধিকাংশই বয়স্ক পুরুষ কিন্তু বাদবাকি সবার বয়স আঠারো থেকে পঁচিশের মধ্যে–অগ্রজের হুকুম তামিল করার জন্যে এক পায়ে খাড়া দুর্দান্ত এজেন্টের দল। বয়স্ক পুরুষদের মধ্যে অনেকের আকৃতি দেখেই কেবল বোঝা যায় ভেতরটা তাদের বাঘের মতো হিংস্র, আইনকানুনের ধার ধারে না। কিন্তু সাগ্ৰহমুখে বসে থাকা পরমোৎসাহী এই তরুণদের দেখে বিশ্বাস করাই কঠিন হবে যে আসলে তারা বিপজ্জনক মানুষ খুনির দল, নীতি আর বিবেকের সম্পূর্ণ বিকৃতির ফলে চরিত্র দুর্নীতিপরায়ণ হওয়ার দরুন খুনজখমের মধ্যে ভয়ংকর আত্মতৃপ্তি লাভ করে এবং যে-ব্যক্তি তথাকথিত পরিষ্কার কাজ-এর জন্য বিখ্যাত, তাকে সুগভীর শ্রদ্ধার চোখে দেখে। প্রকৃতি এদের বিকৃত বলেই যে-লোক কোনোদিন তাদের ক্ষতি করেনি, যাকে তারা, বহু ক্ষেত্রে জীবনে দেখেওনি, তাকেও খতম করে দেওয়ার অভিলাষে স্বেচ্ছায় এগিয়ে যায়। মরণ-মারটা আসলে কে মেরেছে, খুন হয়ে যাওয়ার পর এই নিয়ে ঝগড়া করে নিজেদের মধ্যে। নিহত ব্যক্তির মরণ চিকার এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বীভৎস বিকৃতি আর ছটফটানি নিয়ে সোল্লাসে আলোচনা করে নিজেদের মধ্যে। চিৎকার করে শোনায় সবাইকে। প্রথম প্রথম কাজকর্ম চালাত গোপনে, তারপর–এ-কাহিনি যখনকার সেই সময়ে খুনটুন ঘটতে লাগল আশ্চর্যভাবে খোলাখুলি; কারণ আর কিছুই নয়, একদিকে যেমন শান্তিরক্ষক পুলিশ বারংবার ব্যর্থ হয়েছে আইন রক্ষা করতে, আর একদিকে তেমনি প্রাণের ভয়ে কোনো সাক্ষী হাজির হয়নি সাক্ষ্য দিতে কিন্তু নিজেদের অসংখ্য সাক্ষী তৈরি থেকেছে মিথ্যে সাক্ষী দিয়ে আসার জন্যে এবং দেশের সেরা আইনজীবীকে দিয়ে কেস লড়াবার জন্য সিন্দুকভরতি টাকারও কখনো অভাব হয়নি। দীর্ঘ দশ বছর চলছে এই অত্যাচার, কিন্তু একজনকেও দণ্ড দেওয়া যায়নি। একটা বিপদকেই কেবল ভয় পেত স্কোরারসরা–স্বয়ং শিকার যে, তাকে অতর্কিতে এবং বহুজনে মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাবু করে ফেললেও মরিয়া হয়ে হানাদারদের সে প্রায়ই অক্ষত রেখে যেত না।
ম্যাকমুর্দোকে হুঁশিয়ার করে দেওয়া হয়েছিল, অগ্নিপরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে তাকেও–কিন্তু পরীক্ষাটা কী ধরনের হবে তা কেউ বলতে পারে না। ভাবগম্ভীর দু-জন ব্রাদার ওকে নিয়ে গেল বাইরের একটা ঘরে। কাঠের তক্তার পার্টিশনের মধ্যে দিয়ে কানে ভেসে এল অধিবেশনকক্ষে জমায়েত বহু কণ্ঠের গুঞ্জনধ্বনি। দু-একবার নিজের নামও শুনতে পেল, বুঝল আলোচনা হচ্ছে নতুন প্রার্থীকে নিয়ে। তারপরে ঢুকল একজন রক্ষী; বুকের ওপর আড়াআড়িভাবে সবুজ আর সোনালি ফিতে।
বললে, বডিমাস্টার হুকুম দিয়েছেন এঁদের দড়ি বেঁধে, চোখ বেঁধে মাথা ঢেকে ভেতরে নিয়ে যেতে হবে। তিনজনে মিলে তৎক্ষণাৎ খুলে ফেলল ম্যাকমুর্দোর কোট, গুটিয়ে দিল জামার আস্তিন, সবশেষে একটা দড়ি কনুয়ের ওপর দিয়ে গলিয়ে বাঁধল এঁটে। তারপর একটা পুরু কালো কাপড়ের টুপি পরিয়ে ঢেকে দিল মুখের ওপর অংশে ফলে কিছুই আর দেখতে পেল না দু-চোখে। এরপর ওকে হাত ধরে নিয়ে যাওয়া হল অধিবেশন কক্ষে।
থলির মতো টুপি থাকায় চোখে বিলকুল অন্ধকার দেখছে ম্যাকমুর্দো, অস্বস্তিও খুব। আশেপাশে বহুলোকের নড়াচড়া, ফিসফাস কথা বলার আওয়াজ এবং পরক্ষণেই দূর থেকে স্বয়ং ম্যাকগিন্টির চাপা স্বর ভেসে এল কানে কাপড়ের আবরণ ভেদ করে।
কণ্ঠস্বর বলল, জন ম্যাকমুর্দো, তুমি এনসেন্ট অর্ডার অফ ফ্রিম্যানের সদস্য?
মাথা নেড়ে সায় দেয় ম্যাকমুদো।
শিকাগোর ২৯ নম্বর লজের মেম্বার?
আবার মাথা হেলিয়ে সায় দেয় ম্যাকমুর্দো।
অন্ধকার রাত অস্বস্তিকর, বললে কণ্ঠস্বর।
পথ যে চেনে না তার কাছে জবাব দিলে ম্যাকমুর্দো।
আকাশ বড়ো মেঘলা।
হ্যাঁ। ঝড় আসছে।
ব্রাদাররা সন্তুষ্ট? শুধোয় বডিমাস্টার।
সম্মিলিত কণ্ঠে সম্মতি শোনা যায়।
ম্যাকগিন্টি বললে, ব্রাদার, তোমার চিহ্ন আর পালটা চিহ্ন দেখেই বুঝেছি আমাদেরই একজন তুমি। শোনো, এ-জেলায় আর এ-অঞ্চলের অন্যান্য জেলাতেও ভালো লোক বেছে নেওয়ার জন্যে কিছু কর্তব্য আমাদের করতে হয়। কতকগুলো পরীক্ষা আমাদের নিজস্ব পরীক্ষা দিতে তৈরি তো তুমি?
নিশ্চয়।
তোমার কলজে শক্ত তো?
নিশ্চয়।
সামনে এক কদম এগিয়ে তার প্রমাণ দাও?
কথাটা বলার সঙ্গেসঙ্গে, ম্যাকমুর্দো অনুভব করল দুটো সূচীতীক্ষ্ণ বস্তু চেপে বসেছে দুই অক্ষিগোলকের ওপর। এক পা এগোলেই চোখ দুটো হারানোর সম্ভাবনা। পরোয়া করল না ম্যাকমুর্দো। সাহসে বুক বেঁধে পা বাড়াল সামনে–অমনি তীক্ষ্ণ্ম ফলাদুটোর চাপ মিলিয়ে গেল চোখের ওপর থেকে। শোনা গেল প্রশংসার মৃদু গুঞ্জন।
কলজের জোর সত্যিই আছে, বললে একটা কণ্ঠ। যন্ত্রণা সইতে পারো?
সবাই যা পারে, আমি তাই পারি। জবাব দিলে ম্যাকমুর্দো।
দেখি পার কিনা!
কী কষ্টে যে আর্ত চিৎকারটাকে চেপে রাখতে হয়েছিল ম্যাকমুর্দোকে, তা শুধু সে-ই জানে। আচম্বিতে একটা স্নায়ু অসাড় করা অন্তরাত্মা-শিউরোনো অকথ্য যন্ত্রণা বাহু ভেদ করে যেন প্রবেশ করল শিরা উপশিরায়। যন্ত্রণাটা অকস্মাৎ তাই জ্ঞান হারাতে হারাতেও অসীম মনোবলে সামনে নিল নিজেকে, দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে, দুই হাত মুঠি পাকিয়ে অবর্ণনীয় সেই যন্ত্রণাকে গোপন করল অসামান্য ক্ষমতা বলে।
শুধু বললে, এ আর এমন কী! এর চাইতেও বেশি যন্ত্রণা আমি সইতে পারি।
এবার আর মৃদু প্রশংসা নয়, জোরালো করতালিতে ঘর যেন চৌচির হয়ে ফেটে উড়ে গেল। এ-লজে আজ পর্যন্ত কারো প্রথম আবির্ভাব এর চাইতে চমকপ্রদ হয়নি। পিঠ চাপড়ে স্বাগত জানানো হল ম্যাকমুর্দোকে, একটানে মাথা থেকে খুলে নেওয়া হল কালো আচ্ছাদন। স্মিতমুখে অভিনন্দন মুখর ব্রাদারদের মাঝে দাঁড়িয়ে রইল দুর্দান্ত ম্যাকমুর্দো–ঘন ঘন চোখের পাতা পড়তে লাগল কেবল হঠাৎ আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার জন্যে।
ব্রাদার ম্যাকমুর্দো, সবশেষে আর একটা কথা, বললে ম্যাকগিন্টি। আনুগত্য আর গোপনতার শপথ তুমি এর আগেই নিয়েছ। জানো নিশ্চয় এ-শপথ ভাঙলে শাস্তি একটাই–মুহূর্তের মধ্যে নিশ্চিন্ত মৃত্যু?
হ্যাঁ, জানি বললে ম্যাকমুর্দো।
যেকোনো পরিস্থিতিতে বডিমাস্টারের শাসন মাথা পেতে নেবে?
নেব।
তাহলে ভারমিসার ৩৪১ নম্বর লজে তোমাকে স্বাগতম জানাচ্ছি। এখন থেকে এ-লজের সমস্ত সুবিধেতে তোমার অধিকার রইল। ব্রাদার স্ক্যানল্যান, টেবিলে মদ রাখো, সুযোগ্য ব্রাদারের স্বাস্থ্যপান করা যাক।
ম্যাকমুর্দোর কোট আনা হয়েছে, কিন্তু পরবার আগে হাতের অবস্থাটা একবার দেখে নিলেও এখনও চিড়বিড়িয়ে জ্বলছে জায়গাটা। বাহুর মাংসের ওপর রক্তরঙের সুগভীর একটা চিহ্ন–সুস্পষ্ট একটা বৃত্ত মাঝে একটা ত্রিভুজ জ্বলন্ত লোহা দিয়ে ছ্যাকার চিহ্ন। পাশের দু-এক জন ব্রাদার কোটের হাতা গুটিয়ে বাহুর ওপর দাগাননা একই চিহ্ন দেখাল ম্যাকমুর্দোকে–লজের প্রতীকচিহ্ন।
বললে, প্রত্যেকেই সয়েছে এই যন্ত্রণা কিন্তু তোমার মতো বুকের পাটা কারোর দেখিনি।
আরে ছ্যাঃ! ও আর এমন কী, মুখে বলল ম্যাকমুর্দো, কিন্তু নিঃসীম যন্ত্রণায় জ্বলতে লাগল বাহু।
এই অনুষ্ঠানের পর এল মদ। মদ নিঃশেষিত হওয়ার পর ফের আরম্ভ হল লজের কার্যপরম্পরা। শিকাগোর লজের গদ্যময় মিটিং শুনে অভ্যস্ত ম্যাকমুর্দো অবাক বিস্ময়ে কান খাড়া করে শুনে গেল পরবর্তী অনুষ্ঠান।
ম্যাকগিন্টি বললে, আজকের আলোচনাসূচির প্রথমেই রয়েছে একটা চিঠি লিখেছে মার্টন কাউন্টির ২৪৯ নম্বর লজের ডিভিশন মাস্টার উইন্ডল। চিঠিটা এইঃ–
সবিনয় নিবেদন,
রে-অ্যান্ড স্টারমাশ নামে একটা কয়লাখনি আছে এদিকে। মালিকের নাম অ্যানড্র রে। এর লাশ ফেলতে হবে। গত ঋতুতে পেট্রলম্যানের সেই ব্যাপারটায় আমাদের দু-জন ব্রাদার গিয়ে কাজ সেরে এসেছিল মনে আছে নিশ্চয় তার প্রতিদানে আপনার দু-জন ব্রাদারের সহযোগিতা আমাদের প্রাপ্য হয়েছে। দু-জন কাজের লোক পাঠাবেন। লজের কোষাধ্যক্ষ হিগিন্সের ঠিকানা আপনি জানেন। হিগিন্স হবে এদের অধিনায়ক। সে-ই বলে দেবে কোথায় গিয়ে কীভাবে কাজ সারতে হবে।
ভবদীয়
জে ডব্লিউ উইল, D. M. A. 0. F.
কাজের লোকের দরকার হলে উইন্ডল কখনো বিমুখ করেনি আমাদের। আমরাও করব , একটু থামল ম্যাকগিন্টি, নিষ্প্রভ কিন্তু নারকীয় দুই চোখের দৃষ্টি ঘরময়। কে ভলান্টিয়ার হবে?
বেশ কয়েকজন তরুণ হাত তুলল। দেখে অনুমোদনসূচক হাসি হাসল বডিমাস্টার।
টাইগার করম্যাক, তুমি হলেই চলবে। গতবারের মতো এবারেও যদি পাকা হাতের খেল দেখাও, তাহলেই জানবে ভুলচুক হবে না। উইলসন, তুমিও যাবে।
শেষোক্ত ছোকরা নেহাতই ছেলেমানুষ, বয়স উনিশও পেরোয়নি। বললে, আমার তো পিস্তল নেই।
এই তোমার প্রথম কাজ, না? সত্যিই তোমার একবার রক্তস্নান দরকার। এই কাজ দিয়েই শুরু করো। পিস্তল নিয়ে ভেবো না–ঠিক সময়ে পেয়ে যাবে। সোমবার চলে যেয়ো ওখানে। তারপরেও সময় থাকবে হাতে। ফিরে এলে বিরাট অভ্যর্থনার ব্যবস্থা হবে।
পুরস্কার-টুরস্কার মিলবে এবার? জিজ্ঞেস করে করম্যাক। গাঁট্টাগোট্টা, পাশবিক চেহারার কালচে মুখ এই তরুণের টাইগার নামকরণ হয়েছে অমানুষিক হিংস্রতার জন্যে।
পুরস্কার নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না। কাজের খাতিরে কাজ করে যাও। কাজ শেষ হলে পর
হয়তো দেখবে বাক্সের তলায় কিছু ডলার জমা পড়েছে।
লোকটার অপরাধ? শুধোয় উইলসন।
কার কী অপরাধ তা জিজ্ঞেস করার দরকার তো তোমার নেই। বিচার হয়েছে সেখানে সাজার ব্যবস্থা করেছে ওখানকার লজ। আমাদের কাজ ওদের জল্লাদগিরি করা–যেমনটা ওরা আমাদের হয়ে করে দিয়ে যায়। মার্টন লজ থেকে সামনের সপ্তাহেই তো দু-জন আসছে এদিকে কিছু কাজ সারতে।
তারা কারা? কে যেন জিজ্ঞেস করে।
সেটা না-জিজ্ঞেস করাই বুদ্ধিমানের লক্ষণ। তুমি যদি কিছু না-জানো, বলতেও কিছু পারবে না, বিপদেও পড়বে না। তবে যারা আসছে তারা ওস্তাদ লোক, কাজ করে পরিষ্কার।
সময়ও হয়েছে ওদের আসবার! চেঁচিয়ে ওঠে টেড বলড়ুইন। এ-তল্লাটের অনেকেই আজকাল নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। এই তো গত সপ্তাহে আমাদের তিনজন লোককে গলা ধাক্কা দিয়েছে ফোরমেন ব্রেকার। অনেকদিন ধরেই বড্ড বেড়েছে লোকটা এবার ওকে ফুল ডোজ দেব।
কীসের ফুল ডোজ? ফিসফিস করে পাশের লোককে শুধোয় ম্যাকমুর্দো।
বাকশট কার্তুজের। অট্টহেসে বলে লোকটি, আমাদের কাজকারবার তো ওইরকমই ব্রাদার।
ম্যাকমুর্দোর অপরাধপ্রবণ অন্তর-প্রকৃতি আকৃষ্ট হয়েছিল নীচ সমিতির নারকীয় কার্যকলাপের দিকে। এখন থেকে এই সংঘেরই সদস্য সে।
বললে, এই সবই তো ভালো লাগে আমার। সাহস যার আছে, এ-জায়গা তার উপর্যুক্ত।
আশেপাশে যারা বসেছিল, কথাটা শুনে তারা হাততালি দিয়ে উঠল।
টেবিলের প্রান্ত থেকে কালো কেশর ঝাঁকিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে বডিমাস্টার–কী হল?
নতুন ব্রাদার বলছে, আমাদের ব্যাপার-স্যাপার তার মনের মতো।
তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ায় ম্যাকমুর্দো।
বলে, শ্রদ্ধেয় হুজুর, লজকে সাহায্য করার সুযোগ পেলে বর্তে যাব–লোকের দরকার হলে আমাকে নিন।
দারুণ হাততালি আরম্ভ হয়ে গেল এই কথায়। বেশ বোঝা গেল, দিগন্তপারে উঁকি দিচ্ছে নতুন এক সূর্য। এইভাবে এগিয়ে আসাটা যেন একটু বেশি দ্রুত হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হল কয়েকজন বয়স্কর কাছে।
চেয়ারম্যানের কাছেই বসে ছিল সেক্রেটারি হ্যার্যাওয়ে। মুখখানা শকুনের মতো। দাড়ির রং ধূসর। বললে, আমি বলব; লজ যতক্ষণ না কাজ দিচ্ছে, ততক্ষণ যেন ব্রাদার ম্যাকমুর্দো অপেক্ষা করে।
আমিও তাই বলতে চাই। যখনই বলবেন, বেরিয়ে পড়ব। বললে ম্যাকমুর্দো।
তোমার পালা যথাসময়ে আসবে, ব্রাদার, বললে চেয়ারম্যান। কাজে তোমার ইচ্ছে আছে এটা যখন লক্ষ করেছি, তখন কাজ দিলে নিশ্চয় তা শেষ করতেও পারবে নিখুঁতভাবে। আজ রাতেই এই একটা ছোটো কাজ আছে, ইচ্ছে করলে যেতে পারো।
কাজের মতো কাজের জন্যে অপেক্ষা করতে আমি প্রস্তুত।
তাহলেও আজ রাতে তুমি আসতে পারো। এলে বুঝবে আমাদের এই সম্প্রদায়ের লক্ষ্যটা কী। ব্যাপারটা পরে খুলে বলছি। ইতিমধ্যে–বলে আলোচনাসূচিতে চোখ বুলিয়ে নেয় ম্যাকগিন্টি–মিটিংয়ে আরও দু-একটা বিষয় তুলতে চাই। প্রথমে বলব, ব্যাঙ্কে কত টাকা আছে আমাদের, কোষাধ্যক্ষ যেন বলেন। জিম কারনাওয়েজের বিধবাকে পেনশন দিতে হবে। লজের কাজ করতে গিয়েই মরেছে সে কাজেই আমাদের দেখা দরকার বিধবা যেন পথে না-বসে।
মালি ক্রিকের চেস্টার উইলকক্সকে খুন করতে গিয়ে গত মাসে গুলি খেয়ে মরেছে জিম, পাশের লোকটি জানায় ম্যাকমুর্দোকে।
ব্যাঙ্কের খাতা সামনে রেখে বললে কোষাধ্যক্ষ, টাকাপয়সা এখন ভালোই আছে। ইদানীং ভালোই চাদা দিচ্ছে কোম্পানিগুলো। ম্যাক্সলিন্ডার অ্যান্ড কোম্পানি একাই দিয়েছে পাঁচ-শো। ওয়াকার ব্রাদার্স এক-শো পাঠিয়েছিল কিন্তু আমি তা ফেরত পাঠিয়েছি–পাঁচ-শো চেয়েছি। ঝুঁকিটা আমার! বুধবারের মধ্যে জবাব না-পেলে ওয়াইডিং গিয়ার বিকল হয়ে যাবে। গত বছর ব্রেকার পুড়িয়ে দিয়েছিলাম বলেই সুমতি হয়েছিল। ওয়েস্ট সেকশন কোলিং কোম্পানি বার্ষিক চাঁদা পাঠিয়ে দিয়েছে। যেকোনো দায়দায়িত্ব মিটিয়ে দেওয়ার মতো টাকা আমাদের হাতে আছে।
আর্চি সুইনড়নের খবর কী? শুধোয় একজন ব্রাদার।
কারবার বেচে দিয়ে তল্লাট ছেড়ে পালিয়েছে। যাওয়ার আগে আমাদের একটা চিঠি লিখে গেছে বুড়ো শয়তান! লিখেছে, ব্ল্যাকমেলারদের রাজত্বে বিরাট খনির মালিক হওয়ার চাইতে নিউইয়র্কের রাস্তার ঝাড়ুদার হওয়া অনেক ভালো। কপাল খারাপ আমাদের। চিঠিটা পেলাম ওর তল্লাট ছেড়ে পালানোর পর! উপত্যকায় আর কখনো মুখ দেখানোর সাহস হবে বলে তো মনে হয় না আমার।
চেয়ারম্যান টেবিলের যে-প্রান্তে বসে, ঠিক তার উলটো দিকের প্রান্তে উঠে দাঁড়াল একজন প্রবীণ ব্যক্তি। পরিষ্কার কামানো গাল, মুখটি মায়াদয়ায় কোমল, ভুরুর গড়ন ভালো।
বললে, কোষাধ্যক্ষ মশাই দয়া করে বলবেন কি তল্লাট ছেড়ে এই যে লোকটা পালিয়ে গেল, এর সম্পত্তি কিনেছে কে?
নিশ্চয় বলব, ব্রাদার মরিস। কিনেছে স্টেট অ্যান্ড মার্টন কাউন্ট রেলরেড কোম্পানি।
গত বছর এইভাবেই জেলা ছেড়ে পালানোর আগে খনি বেচে দিয়ে গেছে টডম্যান আর লি। কে কিনেছে এদের সম্পত্তি?
ওই একই কোম্পানি, ব্রাদার মরিস।
ইদানীং আরও কয়েকটা লোহার কারখানা বিক্রি হয়ে গেছে। বলতে পারেন, ম্যানসনের শুমানের, ভ্যান ডেহেরের আর আটউডের লোহার কারখানাগুলো কিনেছে কে?
সবক-টাই কিনেছে ওয়েস্ট গিলমারটন জেনারেল মাইনিং কোম্পানি। চেয়ারম্যান বললে, ব্রাদার মরিস, খনি আর কারখানা যখন মাথায় করে এখান থেকে বাইরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, তখন কে কিনল জেনে আমাদের দরকারটা কী?
শ্রদ্ধেয় হুজুর, দরকার অনেক। আপনাকে অসম্মান করতে চাই না, কিন্তু জানবেন এই ধরনের কেনাবেচার ব্যাপারটা আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘ দশ বছর ধরে চলছে এই রকম কেনাবেচা। আস্তে আস্তে সবকটা ছোট্ট ব্যাবসাদারকে কারবার গুটিয়ে নিতে বাধ্য করছি আমরা। পরিণামটা কী জানেন? এদের জায়গায় দেখছি রেলরোড বা জেনারেল আয়রনের মতো বিরাট বিরাট কোম্পানি যাদের ডিরেক্টররা বহাল তবিয়তে বসে আছে নিউইয়র্ক অথবা ফিলাডেলফিয়ায়–তোয়াক্কাও করে না আমাদের আমাদের ভয়ে কম্পিত নয় তাদের হৃদয়। এদের স্থানীয় কর্তাদের আমরা শায়েস্তা করতে পারি, কিন্তু তাদের জায়গায় আসবে নতুন লোক। আমাদের অবস্থা কিন্তু একটু একটু করে সঙিন হয়ে উঠছে। ছোটো ব্যাবসাদাররা আমাদের গায়ে আঁচড় কাটতেও পারবে না। সে-টাকা বা শক্তি কোনোটাই তাদের নেই। খুব বেশি নিংড়ে না-নেওয়া পর্যন্ত ওরা এখানেই থেকে যেত আমাদের দাপটে মাথা হেঁট করে থাকবে। কিন্তু এই বিরাট কোম্পানিগুলো যদি দেখে লাভের টাকায় আমরা বখরা বসাতে যাচ্ছি, খোলামকুচির মতো টাকা উড়িয়ে সর্বশক্তি দিয়ে আমাদের একে একে পাকড়াও করবে, আর কোর্টে টেনে নিয়ে যাবে।
কথাগুলো বুক কাঁপানো। মুখ শুকিয়ে গেল ঘরসুদ্ধ লোকের। ভয়ার্ত দৃষ্টিবিনিময় ঘটল সদস্যদের মধ্যে এবং শোনা গেল গুঞ্জন। পাপ করলে যে ফল পেতে হয়, এই সহজ ব্যাপারটিই মন থেকে উবে গিয়েছিল এদের একটার পর একটা খুনখারাপি করেছে, কেউ বাধা না-দেওয়ায় সর্বশক্তিমান ঈশ্বর বলে ভেবে নিয়েছিল নিজেদের। তা সত্ত্বেও ব্রাদার মরিসের কথাগুলো বরফের ছুরির মতো গেঁথে গেল দুরতম দুঃসাহসীরও অন্তরের কন্দরে।
বক্তা আরও বললে, আমার উপদেশ যদি নেন বলব, ছোটোখাটো ব্যাবসাদারদের ওপর আমরা যেন একটু কম চাপ দিই। যেদিন এদের প্রত্যেকেই পালাবে, সেদিন তো এ-সমিতির শক্তিও ভেঙে পড়বে।
অপ্রিয় সত্য কারো ভালো লাগে না। বক্তা বসতে-না-বসতেই ক্রুদ্ধ চিৎকার শোনা গেল চারদিকে। ভ্রুকুটি-কুটিল চোখে উঠে দাঁড়ায় ম্যাকগিন্টি।
বলে, ব্রাদার মরিস, কেঁউ কেঁউ করা তোমার স্বভাব। ছায়া দেখে চমকে ওঠা তোমার চরিত্র। লজের সব সদস্য এক থাকলে যুক্তরাষ্ট্রে হেন ক্ষমতা নেই যা আমাদের ছুঁতে পারে। আদালতে বার বার কি তা যাচাই হয়ে যায়নি? ছোটো কোম্পানিরা যেমন দেখেছে লড়ে যাওয়ার চাইতে টাকা দিয়ে রফা করে নেওয়া মঙ্গল, বড়ো কোম্পানিরাও ঠিক তাই করবে বলে আমি মনে করি। বলতে বলতে মাথা থেকে কালো টুপি আর কাঁধ থেকে শাল খসিয়ে এনে বললে ম্যাকগিন্টি, মিটিং প্রায় শেষ, একটা কাজ শুধু বাকি যাওয়ার আগে তা বলব। এখন হোক ভাইয়ে ভাইয়ে বন্ধন নিবিড় করার উদ্দেশ্যে খানাপিনা।
মানুষের প্রকৃতি সত্যিই বড়ো অদ্ভুত। খুন জিনিসটা এদের প্রত্যেকের কাছে একটা অত্যন্ত সহজ ব্যাপার। পরিবারের জনককে এরা খুন করেছে অসহায় বউ ছেলে মেয়ে কেঁদে ভাসিয়েছে কিন্তু এদের প্রাণ কাঁদেনি যাকে মেরেছে তার ওপর তিলমাত্র আক্রোশ নেই, তবুও তাকে ধরাধাম থেকে সরিয়ে দিতে এদের চোখের পাতা কাঁপেনি এই এরাই কিন্তু সুরেলা, বিষণ্ণ, মধুর গানবাজনায় চোখের জল ধরে রাখতে পারে না। ম্যাকমুদোর গানের গলা বড়ো চড়া কিন্তু সুরেলা। এতক্ষণের সাহসিকতা দিয়েও যাদের মন জয় করতে পারেনি, এবার কিন্তু তারাও তার পর পর দুটো গান শুনে রোমাঞ্চিত না হয়ে পারল না। প্রথম রাতের প্রথম আবির্ভাবেই নতুন ব্রাদারটি এইভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠল এবং উচ্চতর পদের পথ আপনা থেকেই প্রশস্ত হয়ে এল। ভাইয়ে ভাইয়ে সম্প্রীতি বজায় রাখার গুণপনা ছাড়াও চৌকস ফ্রি-ম্যান হতে গেলে আরও অনেক গুণের দরকার। সান্ধ্য-অধিবেশন সমাপ্ত হওয়ার আগেই পাওয়া গেল তার প্রমাণ। বোতল বোতল হুইস্কি ঘুরে এল হাতে হাতে, রক্ত গরম হয়ে উঠল প্রতিটি সদস্যের, নতুন কুকর্মের জন্য লালায়িত হয়ে উঠল প্রতিটি রক্তকণিকা–এখন সময়ে ফের উঠে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শুরু করল বডিমাস্টার।
বলল, শোনো বয়রা, এ-শহরে একটা লোক বড় বাড় বেড়েছে, তাকে একটু ভেঁটে দেওয়া দরকার। ভার দিলাম তোমাদের ওপর। হেরাল্ড পত্রিকার জেমস্ স্ট্যানজারের কথা বলছি। দেখেছ নিশ্চয় ইদানীং আবার আমাদের পিণ্ডি চটকাতে শুরু করেছে?
সমবেত গুঞ্জনধ্বনির মধ্যে প্রকাশ পেল সবার সম্মতি। কয়েকজনের অস্ফুট গালাগালও শোনা গেল। ওয়েস্টকোটের পকেট থেকে টুকরো কাগজ বার করল ম্যাকগিন্টি।
হেডিংটা শোনো–আইনশৃঙ্খলা! কয়লা এবং লৌহ জেলায় বিভীষিকার রাজত্ব। আমাদের মধ্যেই যে একটা অপরাধীদের সংগঠন রয়েছে, এক যুগ আগে কয়েকটা গুপ্ত হত্যাতেই তা প্রমাণিত হয়েছে। তারপর এই বারোটি বছরে ক্রিয়াকলাপ তো কমেইনি, বরং এত বেড়েছে যে সভ্য সমাজের একটা কলঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছি আমরা। অপশের আর সীমা নেই। এইজন্যেই কি ইউরোপের স্বৈরতন্ত্রের জ্বালায় পলাতকদের বুকে ঠাঁই দেয় এই বিরাট দেশ? আশ্রয় দেওয়ার অপরাধেই কি আশ্রয়দাতাদের ওপর আশ্রিতরা অত্যাচারের লাঠি ঘুরিয়ে যাবে? প্রাচ্যের রাজতন্ত্রে যেসব অরাজকতা আর নিপীড়নের কাহিনি পড়লে শিউরে উঠি, সেইসব ঘটনাই কি অনুষ্ঠিত হয়ে চলবে তারকালাঞ্ছিত পতাকাশোভিত এই মহাদেশে? আতঙ্ক আর নৈরাজ্য বিরাজ করবে স্বাধীনতার প্রতীক মহান এই পতাকার ছায়াতলে? এরা কারা আমরা জানি। সংঘঠনটা বিধিবদ্ধ এবং গুপ্তসমিতির নয়। কিন্তু আর কতদিন সইতে হবে? আমরা কি আর স্বাধীনভাবে যত্তো সব রাবিশ উচ্ছ্বাস। অনেকটা পড়ে ফেলেছি, আর নয়। কাগজটা টেবিলে ছুঁড়ে ফেলে দেয় চেয়ারম্যান। শুনলে তো কী লিখেছে আমাদের সম্বন্ধে? এখন তোমরাই বলো কী করা উচিত এ-লোককে নিয়ে।
খুন! রক্তজমানো কণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে এক ডজন গলা।
আমি প্রতিবাদ জানাচ্ছি, বললে ব্রাদার মরিস সেই ভদ্রলোক, ভুরু যার সুন্দর, গাল পরিষ্কার কামাননা। ভাইগণ, ফের বলছি, এ-উপত্যকায় আমরা এত চাপ সৃষ্টি করছি যে শেষ পর্যন্ত সবাই এককাট্টা হয়ে আমাদের পিষে মেরে ফেলবে। জেম্স স্ট্যানজার বৃদ্ধ মানুষ। শহরে আর জেলায় সবার শ্রদ্ধার পাত্র। এ-উপত্যকায় যেকোনো জনহিতকর ব্যাপারে তাঁর পত্রিকার যথেষ্ট অবদান রয়েছে। এ-লোককে খুন করলেই হইচই পড়ে যাবে সারাদেশে শেষপর্যন্ত ধ্বংস হতে হবে আমাদের।
ধ্বংস করা হবে কী করে, মি. ল্যাজগুটোনো? চিৎকার করে ওঠে ম্যাকগিন্টি। কে করবে? পুলিশ? ওদের অর্ধেক আমাদের টাকা খায়, বাকি অর্ধেক আমাদের ভয়ে মরে। নাকি আইন আদালত আর জজ-জুরি? সে-পরীক্ষাও কি হয়ে যায়নি, ফলাফলটা নিশ্চয় জানা আছে?
ব্রাদার মরিস বললে, বিচারপতি লিঞ্চ কেস হাতে নিতে পারেন।
প্রত্যুত্তরে শোনা গেল সম্মিলিত কণ্ঠে রাগত চিৎকার।
গলাবাজি করে বললে ম্যাকগিন্টি, একটা আঙুল তুললেই জেনো দু-শো লোক এখনই এ-শহরের এক মাথা থেকে আর এক মাথা পর্যন্ত সাফ করে ছাড়বে। পরক্ষণেই গলার স্বর উঠে গেল আরও চড়া পর্দায় বিশাল কালো ভুরু জোড়ায় লাগল ভয়ংকর ভ্রুকুটি : ব্রাদার মরিস, বেশ কিছুদিন ধরেই তোমার ওপর আমার নজর আছে জানো। তোমার নিজের কলজেতে জোর নেই–যার আছে তার জোরটুকুও কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করো যখন-তখন। আলোচনাসূচিতে যেদিন তোমার নাম উঠবে সেদিন তোমার কপালে অশেষ দুর্গতি আছে জানবে নামটা তুলব কিন্তু আমিই।
মড়ার মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেল মরিস ধপ করে বসে পড়ল চেয়ারে, নিশ্চয় হাঁটু পর্যন্ত কমজোরি হয়ে গিয়েছিল বলে। কঁপা হাতে সুরাপাত্র তুলে নিয়ে এক চুমুকে নিঃশেষ না-করা পর্যন্ত কথা ফুটল না মুখে।
বলল–শ্রদ্ধেয় হুজুর, আমার মুখে যেটুকু বলা দরকার তার বেশি যদি কিছু বলে থাকি তো ক্ষমা চাইছি আপনার কাছে, ক্ষমা চাইছি এই লজের প্রত্যেক সদস্যের কাছে। আমার আনুগত্য কতখানি তা আপনি জানেন–পাছে লজের ক্ষতি হয়ে যায় এই ভয়ে আর উৎকণ্ঠায় অনেক সময়ে অনেক কথা বলে ফেলি। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমার নিজের বিচার বুদ্ধির চেয়ে অনেক বেশি ভরসা রাখি আপনার বিচারবুদ্ধির ওপর। শ্রদ্ধেয় হুজুর, কথা দিচ্ছি। আর আপনার বিরাগভাজন হব না।
বিনয়ন কথাগুলো শুনতে শুনতে সরল হয়ে এল বডিমাস্টারের ভ্রূকুঞ্চন।
বললে, ঠিক আছে ব্রাদার মরিস, ঠিক আছে। তোমাকে শিক্ষা দেওয়ার দরকার যেদিন হবে, সেদিন জানবে সবচেয়ে দুঃখ পাব আমি নিজে। কিন্তু আমি যদ্দিন চেয়ারে আছি, কথায় কাজে আমরা সবাই এক থাকব এই লজে। বলে আশপাশে দৃষ্টি সঞ্চালন করে নিয়ে এবার বলি আমার কথা। স্ট্যানজারকে ফুলডোজ দিলে এমন গোলমাল আরম্ভ হয়ে যাবে যা আমরা চাই না। সাংবাদিকরা সব এককাট্টা। সবক-টা পত্রিকা পুলিশ আর মেলেটারি চেচিঁয়ে গলা ফাটিয়ে ফেলবে। কিন্তু লোকটাকে বেশ একটু কড়কে দিতে পার–তাতেই সাবধান হয়ে যাবে। ব্রাদার বলড়ুইন, তুমি ভার নেবে?
নিশ্চয়! সাগ্রহে বললে তরুণ বলড়ুইন।
ক-জনকে নেবে সঙ্গে?
জনাছয়েক। দরজা আগলাতে আরও দু-জন। গোওয়ার, তুমি আসবে। ম্যানসেল, তুমিও চলো। স্ক্যানল্যান, তুমি থাকবে। উইলেবাই-ভাই দু-জনও আসবে।
চেয়ারম্যান বললে, নতুন ব্রাদারকে কথা দিয়েছি কিন্তু যাওয়ার জন্যে।
ম্যাকমুর্দোর দিকে চোখ ফেরাল টেড বলড়ুইন–চাহনি দেখে বোঝা গেল সে কিচ্ছু ভোলেনি–ক্ষমাও করেনি।
বললে তেতো গলায়, বেশ তো, আসতে চায় আসুক। ব্যস, আর দরকার নেই। যত তাড়াতাড়ি কাজে নামা যায়, ততই মঙ্গল।
মাতালদের গান, চিকার, হুল্লোড়ের মধ্যে ভঙ্গ হল সভা। মদ্যশালায় তখনও হই-হুল্লোড় চলছে, কিছু ব্রাদার থেকে গেল সেখানে। কাজের ভার যাদের ওপর পড়েছে, তারা বেরিয়ে গেল দু-জন তিনজন করে যাতে কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করা না হয়। রাত বেশ ঠান্ডা, হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে ছাড়ছে। তারকাখচিত, কুয়াশামলিন আকাশে ঝলমল করছে আধখানা চাদ। একটা বড়ো বাড়ির সামনের উঠোনে গিয়ে জড়ো হল এরা। আলো ঝলমল দুটো জানলার মাঝে সোনালি হরফে লেখা ভারমিসা হেরাল্ড। ভেতর থেকে ভেসে আসছে ছাপাখানার ঘটাং ঘটাং আওয়াজ।
বলড়ুইন বলে ম্যাকমুর্দোকে, তুমি নীচে দরজার সামনে দাঁড়াও পালাবার পথ যেন খোলা থাকে। আর্থার উইলেবাই থাকবে আমার সঙ্গে, বাকি সবাই এসো আমার সঙ্গে। ভয় নেই। এই মুহূর্তে আমরা যে ইউনিয়ন বারে আছি, বারোজন সাক্ষী তৈরি হয়েছে তা বলবার জন্যে।
তখন প্রায় মাঝরাত। গৃহাভিমুখী দু-একজন মদ্যপ ছাড়া রাস্তা ফাঁকা। রাস্তা পেরিয়ে খবরের কাগজের অফিসের সামনে পৌঁছোলো ছোট্ট দলটি এবং এক ধাক্কায় দরজা খুলেই সামনের সিঁড়ি বেয়ে বেগে ওপরে উঠে গেল সদলবলে বলড়ুইন। নীচে পাহারায় রইল ম্যাকমুর্দো এবং আরেকজন। ওপরের ঘর থেকে আগে একটা চিৎকার শোনা গেল। তারপর বাঁচাও বাঁচাও আর্তচিৎকার, দুমদাম ছোটাছুটির আওয়াজ এবং চেয়ার ছিটকে পড়ার শব্দ। পরক্ষণেই দৌড়ে চাতালে বেরিয়ে এল এক ভদ্রলোক মাথার চুল সব সাদা। কিন্তু তার বেশি আর যেতে পারল না। পেছন থেকে এসে চেপে ধরল আততায়ীরা–বৃদ্ধের চশমাটা ঠনঠনঠন শব্দে সিঁড়ির ওপর দিয়ে ছিটকে এসে পড়ল ম্যাকমুর্দোর পায়ের কাছে। ধপ করে একটা আওয়াজের সঙ্গেসঙ্গে ককিয়ে উঠল বৃদ্ধ। মুখ থুবড়ে পড়েছে স্ট্যানজার এবং ছ-টা লাঠি এইসঙ্গে উঠছে আর পড়ছে দেহের নানা জায়গায়। দুমড়ে মুচড়ে দীর্ঘশীর্ণ শরীর বেঁকিয়ে চুরিয়ে প্রত্যেকটা মারের সঙ্গেসঙ্গে কাতরাচ্ছে বৃদ্ধ। আর সবাই শেষ পর্যন্ত থেমে গেলেও নিষ্ঠুর আনন্দে বিকৃত নারকীয় হাসি হাসতে হাসতে মাথার ওপর লাঠি চালাচ্ছে বলড়ুইনদু-হাতে বৃদ্ধ বৃথাই চেষ্টা করছে মাথা বাঁচাবার। রক্তে লাল হয়ে গেছে সাদা চুল। বাহুর ফাঁকে কোথাও মাথা দেখা গেলেই ঝুঁকে পড়ে সেই জায়গা টিপ করে লাঠি মারছে বলড়ুইন, এমন সময়ে ঝড়ের মতো সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসে তাকে ঠেলে সরিয়ে দিলে ম্যাকমুর্দো।
বললে, মেরে ফেলবে নাকি! ফ্যালো লাঠি!
হকচকিয়ে গেল বলড়ুইন।
পরক্ষণেই বললে গলার শির তুলে, গোল্লায় যাও তুমি! কে-হে তুমি লজে নতুন এসেই বাগড়া দিতে এসেছ আমার কাজে? সরে দাঁড়াও। বলেই লাঠি তুলল মাথার ওপর। কিন্তু তার আগেই ফস করে হিপ-পকেট থেকে পিস্তল টেনে বার করেছে ম্যাকমুদো।
তুমি সরে দাঁড়াও! আমার গায়ে হাত দিলেই মুণ্ডু উড়িয়ে দেব। খুব তো লজের দোহাই পাড়ছ, কী বলেছিল বডিমাস্টার? খুন করা চলবে না। কিন্তু তুমি তো একে খুন করতেই যাচ্ছ।
স্যাঙাতদের মধ্যে একজন বললে, ঠিক কথা।
নীচ থেকে ভেসে এল চিৎকার, তাড়াতাড়ি করো! জানলায় জানলায় আলো জ্বলে উঠছে। শহরের সমস্ত লোক তাড়া করবে তোমাদের পাঁচ মিনিটের মধ্যে।
সত্যিই রাস্তায় চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে। নীচের হল ঘরে জড়ো হচ্ছে কম্পােজিটর আর টাইপসেটাররা সাহসে বুক বাঁধছে এগিয়ে আসার জন্য। সম্পাদকের নিথর নিস্পন্দ দেহটা সিঁড়ির মাথায় ফেলে রেখে তরতরিয়ে নেমে এল আততায়ীরা, দ্রুত মিলিয়ে গেল রাস্তায় ইউনিয়ন হাউসে পৌঁছেই জনাকয়েক বেমালুম মিশে গেল ম্যাকগিন্টির সেলুনে ভিড়ের মধ্যে বার কাউন্টারে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বসকে জানিয়ে দিল, কাম ফতে এবং ভালোভাবেই। বাকি ক-জন পাশের রাস্তা দিয়ে রওনা হল যে-যার বাড়ির দিকে এদের মধ্যে রইল ম্যাকমুর্দো।