উপন্যাস

০২. আলোচনায় বসলেন মি. শার্লক হোমস

আলোচনায় বসলেন মি. শার্লক হোমস

এইসব নাটকীয় মুহূর্তের জন্যেই যেন ওত পেতে থাকে বন্ধুটি। বিস্ময়কর ঘোষণাটি শুনে সে চমকে উঠেছিল বললে বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে–এমনকী উত্তেজিতও হয়নি! দীর্ঘকাল অতি-উত্তেজনার মধ্যে থাকার ফলেই যেন কড়া পড়ে গিয়েছে ভেতরটা। তার অসাধারণ চরিত্রের মধ্যে ক্রূরতার ছিটেফোঁটাও নেই–অথচ চোখ-মুখ এই কারণেই এত সহানুভূতিহীন। আবেগের ধার ভোতা হলে কী হবে, ধীশক্তিগ্রাহ্য অনুভূতি শানিয়ে উঠেছিল অতিরিক্ত মাত্রায়। ভয়ংকর অথচ ছোট্ট ঘোষণাটি শুনে আমি শিউরে উঠলেও এই কারণেই হোমসের চোখে-মুখে ভয়াবহতার ছায়াপাতও ঘটল না। প্রশান্ত কৌশলে নিবিড় হয়ে এল মুখমণ্ডল–অতি-সংপৃক্ত দ্রবণ থেকে ক্রিস্টাল স্বস্থানে পড়তে থাকলে রসায়নবিদের চোখে-মুখে যে-কৌতূহল দেখা যায় ঠিক সেইরকম।

বলল, আশ্চর্য। সত্যিই আশ্চর্য!

আশ্চর্য হয়েছেন বলে মনে হচ্ছে না কিন্তু।

কৌতূহলী হয়েছি, মি. ম্যাক, কিন্তু খুব একটা আশ্চর্য হইনি। হব কেন বলতে পারেন? বিশেষ একটা গুরুত্বপূর্ণ মহল থেকে একখানা উড়ো চিঠিতে হুঁশিয়ারি পেলাম–বিশেষ এক ব্যক্তির সর্বনাশ ঘনিয়ে আসছে। একঘণ্টাও গেল না, জানলাম সর্বনাশটা সত্যিই এসে গেছে এবং লোকটি মারা গেছে। তাই কৌতূহলী হয়েছি কিন্তু আশ্চর্য হয়নি ঠিকই লক্ষ করেছেন।

সংক্ষেপে দু-চার কথায় চিঠি আর গুপ্ত লিখনের বৃত্তান্ত ইনস্পেকটরকে বলল হোমস। হাতের ওপর কনুই রেখে তন্ময়চিত্তে শুনল ইনস্পেকটর হলদেটে লাল প্রকাণ্ড ভুরুজোড়া জট পাকিয়ে একটা হলদে ত্রিকোণে পরিণত হল ।

বলল, সকালবেলাই গিয়েছিলাম বির্লস্টোন। যাবার পথে এখানে এসেছিলাম আপনারা যাবেন কিনা জিজ্ঞেস করতে। কিন্তু আপনার কথা শুনে এখন মনে হচ্ছে লন্ডন শহর থেকেই শুরু করা উচিত কাজ।

আমার তা মনে হয় না, বললে হোমস।

কী যে বলেন না, মি. হোমস। চিৎকার করে বললে ইনস্পেকটর। দু-এক দিনের মধ্যেই দৈনিকগুলো গরম হয়ে উঠবে বির্লস্টোন হত্যারহস্য খবরে। কিন্তু রহস্য তো এখানে–এই লন্ডন শহরে–এই শহরেরই একজন খুন হওয়ার আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল খুন হতে চলেছে। সেই লোকটিকেই এখন গ্রেপ্তার করা দরকার–সুতো টানলেই বাকি জট আপনি খুলে যাবে।।

খাঁটি কথা, মি. ম্যাক। কিন্তু তথাকথিত পোর্লককে গ্রেপ্তার করবেন কী করে?

হোমসের হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে উলটে দেখল ম্যাকডোনাল্ড।

কাম্বারওয়েলের ডাকঘরে ফেলা হয়েছে দেখছি–খুব একটা সুবিধে তাতে হবে না। নামটা বলছেন ছদ্মনাম। বাস্তবিকই এগোনোর মতো মালমশলা তেমন নেই। পোর্লককে টাকা পাঠিয়েছিলেন বলেছিলেন না?

দু-বার পাঠিয়েছি।

কীভাবে!

ক্যাম্বারওয়েলে পোস্ট অফিসে–নোটে।

নোট নিতে কে আসে কখনো দেখতে যাননি?

না।

অবাক হয়ে গেল ইনস্পেকটর–ধাক্কা খেয়েছে মনে হল।

কেন যাননি?

বিশ্বাসের মর্যাদা দিই বলে। প্রথম চিঠিতে সে আমাকে লিখেছিল–আমি যেন তাকে খুঁজে বার করার চেষ্টা না-করি। কথা দিয়েছিলাম, করব না।

আপনার কি মনে হয় লোটার পেছনে একজন লোক আছে?

মনে হয় কেন বলছেন? আমি জানি একজন আছে।

প্রফেসর যার কথা বলছিলেন?

এক্কেবারে ঠিক বলেছেন।

হাসল ইনস্পেকটর। তাকাল আমার দিকে। দেখলাম, চোখের পাতা কাঁপছে।

মি. হোমস সি-আই-ডিতে আপনার এই মাথার পোকাটা নিয়ে প্রায় আমরা হাসিঠাট্টা করি আপনার কাছে না-লুকিয়ে বলেই ফেলি–প্রফেসরের নামে আপনি এমন সব উদ্ভট কল্পনা করেন যে বলবার নয়। আমি নিজে ওঁর সম্বন্ধে খোঁজখবর নিয়েছি। ভদ্রলোক খুব মান্যগণ্য ব্যক্তি মনে হয়েছে। পণ্ডিত এবং রীতিমতো প্রতিভাবান।

প্রতিভাকে এতদূর চিনে ফেলেছেন দেখে খুশি হলাম!

কী আশ্চর্য! এ-প্রতিভার কদর না-করে থাকা যায় কি? ভদ্রলোক সম্বন্ধে আপনার মতামত শোনবার পর থেকেই ঠিক করেছিলাম একদিন দেখা করতে হবে। গ্রহণ সম্পর্কে গল্প আরম্ভ হল–কী করে যে গ্রহণ প্রসঙ্গে এসে গেলাম বলতে পারব না। উনি কিন্তু একটা রিফ্লেক্টর লণ্ঠন আর একটা গ্লোব নিয়ে এক মিনিটেই পরিষ্কার করে দিলেন ব্যাপারটা। একটা বইও পড়তে দিয়েছিলেন। কিন্তু কী জানেন, আবারভীন চালে মানুষ কি হবে, বইটায় দাঁত ফোটাতে পারিনি–মাথায় কিছুই ঢোকেনি। কথা বলেন ধীর নম্র গলায়। চুলেও পাক ধরেছে। মুখখানি বেশ পাতলা। মন্ত্রী হিসেবে খাসা মানাতেন কিন্তু। চলে আসবার সময়ে এমনভাবে হাত রাখলেন আমার কাঁধের ওপর যেন মনে হল নিষ্ঠুর বাস্তবের মধ্যে পুত্রকে পাঠানোর আগে আশীর্বাদ করছেন পিতা।

খুক-খুক করে শুকনো হেসে দু-হাত ঘষতে লাগল হোমস।

বলল, গ্রেট! সত্যিই দারণ! এবার বলুন তো বন্ধুবর ম্যাকডোনাল্ড, মর্মস্পর্শী মনোরম এই সাক্ষাৎকারটি ঘটেছিল কোথায়? প্রফেসরের পড়ার ঘরে নিশ্চয়?

ঠিক ধরেছেন।

ঘরটা সুন্দর, তাই না?

অত্যন্ত সুন্দর–ছিমছাম।

আপনি বসেছিলেন প্রফেসরের লেখবার টেবিলের সামনে?

হ্যাঁ।

আপনার চোখে রোদ পড়েছিল, ওঁর মুখ ছিল ছায়ায়?

তখন সন্ধে, তবে মনে আছে আলোটা ফিরিয়ে রাখা হয়েছিল আমার মুখের ওপর।

রাখতেই হবে। প্রফেসরের মাথার ওপর একটা ছবি লক্ষ করেছিলেন?

খুব সম্ভব ও-গুণ আপনার কাছ থেকেই পেয়েছি আমার চোখ এড়িয়ে যাওয়া এত সোজা নয়। হ্যাঁ, দেখেছি ছবিটা। একজন তরুণী মহিলা হাতে মাথা রেখে আড়চোখে দেখছেন আমাকে।

তৈলচিত্রটা জাঁ ব্যাপতিস্তি গ্রুজের আঁকা।

আগ্রহী হওয়ার প্রয়াস পেল ইনস্পেকটর।

চেয়ারে ভালোভাবে হেলান দিয়ে আঙুলগুলো ডগায় ডগায় ঠেকিয়ে হোমস বললে, জ ব্যাপতিস্তি গ্রুজ একজন ফরাসি চিত্রকর। ১৭৫০ সালের মধ্যে তার সমৃদ্ধি। আমি বলব শুধু তার কর্মজীবনের কথা। সমসাময়িকরা ওর সম্বন্ধে অত্যন্ত উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন–একই ধারণা দেখা যাচ্ছে আধুনিক সমালোচকদের মধ্যেও।

উদাসীন হয়ে এল ইনস্পেকটরের দুই চক্ষু।

বলল, আমরা বরং–

আসছি সে-পয়েন্টে, বাধা দিয়ে বললে হোমস। আপনি যাকে বির্লস্টোন হত্যারহস্য বলছেন তার সঙ্গে এইমাত্র যা বললাম তার সরাসরি এবং গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ রয়েছে। এমনকী একদিক দিয়ে হত্যারহস্যের কেন্দ্রবিন্দুও বলা চলে এই ব্যাপারটাকে।

ম্লান হেসে কাতর চোখে আমার দিকে চাইল ম্যাকডোনাল্ড।

মি. হোমস আপনি বড়ো তাড়াতাড়ি ভাবেন নাগাল ধরতে পারি না। দু-এক জায়গায় ফাঁক রেখে গেছেন–টপকাতে পারছি না। বির্লস্টোন রহস্যের সঙ্গে মৃত চিত্রকরের কী সম্পর্ক মাথায় আসছে না।

সব খবরই এক সময়ে কাজে লাগে গোয়েন্দাদের, মন্তব্য করল হোমস। ১৮৬৫ সালে পোর্টালিসে গ্রুজের আঁকা La Jeune Fill a lagneau২ নামে একটা ছবি চার হাজার পাউন্ডে বিক্রি হওয়ার মতো সামান্য একটা সংবাদও আপনার মনে অনেক চিন্তার ছায়া ফেলতে পারে।

সত্যিই তা ফেলল। অকৃত্রিম কৌতূহল ফুটে উঠতে দেখা গেল ইনস্পেকটরের চোখে-মুখে।

জের টেনে নিয়ে হোমস বললে, প্রফেসরের বেতন কত, তা খানকয়েক নির্ভরযোগ্য বই ঘাঁটলেই জানা যায়। বছরে সাতাশ পাউন্ড।

তাহলে ও-ছবি উনি কিনলেন কী করে—

আমিও তাই বলি, কিনলেন কী করে?

চিন্তাকুটিল চোখে বললে ইনস্পেকটর–আশ্চর্য ব্যাপার তো! বলে যান, মি. হোমস। বেশ লাগছে শুনতে। ফাইন বলেছেন।

খাঁটি শিল্পীর বৈশিষ্ট্য হল অকপট প্রশংসায় গলে যাবে হোমস তার ব্যতিক্রম নয়। প্রশস্তি শুনে হাসল।

বলল, বির্লস্টোনের ব্যাপারটা বলুন শুনি।

এখনও সময় আছে, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে ইনস্পেকটর। দোরগোড়ায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে এসেছি–ভিক্টোরিয়া পৌঁছোতে মিনিট কুড়ি লাগবে। কিন্তু এই ছবিটা আপনার মুখে শুনেছিলাম মি. হোমস, আপনি নাকি কখনো প্রফেসারের সামনাসামনি হননি?

না, জীবনে না।

তাহলে ঘরের মধ্যে কোথায় কী আছে জানলেন কী করে?

সেটা আরেকটা ব্যাপার, ওর ঘরে গেছিলাম তিনবার। দু-বার দু-রকমের দুটো অছিলা নিয়ে–বেরিয়ে পড়েছিলাম উনি ফিরে আসার আগেই। আর একবার ব্যাপারটা অবশ্য সরকারি গোয়েন্দার সামনে বলাটা সমীচীন হবে না–শেষের বারেই ওঁর কাগজপত্র হাঁটকেছিলাম এবং অপ্রত্যাশিত ফল পেয়েছিলাম।

গালে চুনকালি দেওয়ার মতো কিছু পেয়েছিলেন বোধ হয়?

কিছুই পাইনি। অবাক হয়েছিলাম সেই কারণেই। যাই হোক, ছবির ব্যাপারটা এখন পরিষ্কার হল তো? এ-ছবি ওই দামে কিনেছেন যখন তখন নিশ্চয় ভদ্রলোক বিরাট বড়োলোক। এত টাকা পেলেন কীভাবে? বিয়ে করেননি। পশ্চিম ইংলন্ডে স্টেশনমাস্টারের কাজ করেন ওঁর ছোটোভাই। ওঁর নিজের চেয়ারের দাম বছরে সাতাশ পাউন্ড। তা সত্ত্বেও উনি গ্রুজ পেন্টিংয়ের মালিক।

তারপর?

তারপরের সিদ্ধান্তটা দিনের আলোর মতোই সুস্পষ্ট।

আপনি বলতে চান রোজগার ওঁর অনেক এবং বিরাট এই রোজগার আসে বেআইনি পথে?

হ্যাঁ, ঠিক তাই বলতে চাই। মাকড়সার জালের ঠিক মাঝখানে বিষাক্ত যে-প্রাণীটা চুপচাপ বসে থাকে শিকারের আশায়, আঠা চটচটে বহু তন্তুর মাধ্যমেই পৌঁছানো যায় তার কাছে। এ-কথা বলার কারণ আছে বলেই বললাম। কিন্তু এই বিশেষ গ্রুজ ঘটনাটি বললাম আপনি নিজে তা লক্ষ করেছিলেন বলে।

মি. হোমস আপনার কথাগুলো কৌতূহল জাগানো। শুধু কৌতূহলই জাগায় না, তাজ্জব করে দেয়। তবে যদি আর একটু পরিষ্কার করে বলেন আমাকে তো সুবিধে হয়। কী করেন উনি ? জাল নোট ? জাল টাকা? চুরিডাকাতি? টাকাটা আসে কোন পথে?

জোনাথন ওয়াইল্ডের নাম শুনেছেন?

নামটা চেনা-চেনা লাগছে। উপন্যাসের কোনো চরিত্র কি? নাটক নভেলের ডিটেকটিভদের খুব একটা পাত্তা দিই না আমি। এরা শুধু নিজেরাই বাহাদুরি দেখিয়ে যায়–কী করে দেখাচ্ছে কাউকে বুঝতে দেয় না। ওসব পড়তে ভালো লাগে কাজে লাগে না।

জোনাথন ওয়াইল্ড ডিটেকটিভ নয়, নাটক নভেলের চরিত্রও নয়। লোকটা একটা ক্রিমিন্যাল অপরাধী সম্রাট। গত শতাব্দীতেই তার কীর্তিকাহিনির শুরু এবং শেষ ১৭৫০-এর ধারেকাছে।

তাহলে ও-লোককে নিয়ে আমার কাজ হবে না। আমি প্র্যাকটিক্যাল মানুষ বাস্তব নিয়ে কারবার করি।

মি. ম্যাক, আপনার জীবনে সবচেয়ে প্র্যাকটিক্যাল কাজ কী হওয়া উচিত জানেন? মাস তিনেক বাড়ি থেকে না-বেরিয়ে দিনে বারো ঘণ্টা হিসেবে রোজ শুধু অপরাধ ইতিহাস পড়া। সব কিছুই জানবেন ঘুরে ফিরে আসে—এমনকী এই প্রফেসর মরিয়ার্টিও। লন্ডন ক্রিমিন্যালদের শক্তির গুপ্ত উৎস ছিল জোনাথন ওয়াইল্ড শতকরা পনেরো টাকা দস্তুরির বিনিময়ে ধার দিত নিজের ব্রেন আর সংগঠন। চাকা ঘুরছে, সেই একই পাটি আবার ফিরে এসেছে। আগে যা-যা ঘটেছে, এখন তার প্রতিটি ফের ঘটবে। প্রফেসর মরিয়ার্টি সম্বন্ধে দু-চার কথা শুনলে হয়তো আপনার আগ্রহের সঞ্চার ঘটতে পারে।

আপনার সব কথাতেই আমার আগ্রহ জাগে।

এই যে শেকল, এর একদিকে রয়েছে শ-খানেক তাসের জুয়াড়ি, ব্ল্যাকমেলার, পকেটমার, গুন্ডা এবং সবরকম অপরাধী–আর একদিকে গোল্লায় যাওয়া নেপোলিয়ন সমান প্রফেসর মরিয়ার্টি এই শেকলের পয়লা নম্বর আংটাটিকে আমি চিনি। মরিয়ার্টির ডান হাত হল কর্নেল সিবাসটিয়ান মোরান–আইনের ধরাছোঁয়ার একদম বাইরে। আইনই বরং তাকে আগলে রেখে দিয়েছে। পালের এই গোদাটিকে মরিয়ার্টি কত মাইনে দেয় জানেন?

শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে।

বছরে ছ-হাজার। এই হল মার্কিন ব্যবসার নীতি উপযুক্ত মগজের উচিত দাম। মাইনের ব্যাপারটা হঠাৎ জানতে পারি। প্রধানমন্ত্রীও এত টাকা পান না। এ থেকেই বুঝবেন মরিয়ার্টির লাভ কী বিপুল এবং কী ব্যাপক তার কার্যকলাপ। আরেকটা পয়েন্ট। সম্প্রতি মরিয়ার্টির খানকয়েক চেক খুঁজে খুঁজে বের করেছিলাম–গেরস্থালির বিল মিটানোর নির্দোষ চেক। কিন্তু চেকগুলো কাটা হয়েছে ছ-টা আলাদা ব্যাঙ্কের ওপর। এ থেকে কী মনে হয় আপনার বলুন।

অদ্ভুত নিশ্চয়। কিন্তু এ থেকে আপনার কী মনে হয়?

নিজের টাকা নিয়ে গুলতানি হোক, এটা তার ইচ্ছে নয়। বিশেষ একজন যেন না-জানে কত টাকা আছে প্রফেসর মরিয়ার্টির। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তার কুড়িটা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আছে–বিরাট সম্পত্তির বেশির ভাগটাই অবশ্য আছে বিদেশের ব্যাঙ্কে–Deutsche ব্যাঙ্কে অথবা Credit Lyonnais-এ। যদি কখনো দু-এক বছর ছুটি পান, প্রফেসর মরিয়ার্টিকে নিয়ে গবেষণা করবেন।

নিজের আগ্রহেই নিজে কুঁদ হয়ে গিয়েছিল ইনস্পেকটর ম্যাকডোনাল্ড। যতই কথা এগিয়েছে, ততই যেন প্রত্যেকটা শব্দ গভীরভাবে দাগ কেটে বসে গেছে ভেতরে। কিন্তু শেষকালে জাগ্রত হল স্বচ্ছ বুদ্ধি–ঝাঁকি দিয়ে এল হাতের কাজে।

কৌতূহল জাগানো টীকাটিপ্পনী দিয়ে অন্য কথায় এনে ফেললেন মি. হোমস। মরিয়ার্টি এখন থাকুক। আসল কথা হল মরিয়ার্টির সঙ্গে বির্লস্টোন রহস্যের সম্পর্ক–যা নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন আপনি। হুঁশিয়ারি পেয়েছিলেন পোর্লক নামধারী একটি লোকের কাছ থেকে। এই সম্বন্ধেই যদি আরও কিছু বলেন তো হাতের কাজের সুবিধে হয়।

অপরাধের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে কিছু ধারণা খাড়া করা যেতে পারে। আপনার প্রথম মন্তব্য অনুসারে ধরে নিচ্ছি, খুনের মাথামুণ্ডু কিছু বোঝা যায় না। এখন যদি ধরা যায়, অপরাধটার উৎস আমরা যা সন্দেহ করছি সেইখানে–তাহলে খুনের দুটো আলাদা উদ্দেশ্য পাচ্ছি। প্রথমেই বলে রাখি, দলের লোকদের লোহার ডান্ডা নিয়ে শাসনে রাখে মরিয়ার্টি। কড়া নিয়মানুবর্তিতার অধীন প্রত্যেকেই। শাস্তির বিধান একটাই–মৃত্যু। এই ডগলাস লোকটাও হয়তো কোনোরকমে বিশ্বাসঘাতকতা করে ফেলেছিল দলের সর্দারের সঙ্গে। সর্দারের সঙ্গী স্যাঙাতদের মধ্যে কেউ টের পায়, শাস্তিস্বরূপ মরতে চলেছে ডগলাস। যাইহোক, মরতেই হল ডগলাসকে দুনিয়ার সবাই এবার জানবে তার মৃত্যুকাহিনি–ভয়ে সিঁটিয়ে থাকবে দলের অন্য লোকজন।

এটা তো গেল একটা অনুমান।

আর একটা অনুমান হল এই : মরিয়ার্টি নিজেই খুনটা ঘটিয়েছে গতানুগতিক ব্যাবসা সূত্রে। ডাকাতি-টাকাতি কিছু হয়েছে?

শুনিনি।

যদি হয় তাহলে নাকচ হয়ে যাবে প্রথম অনুমিতিটা টিকে যাবে শেষেরটা। হয় লুঠের মালের বখরার প্রতিশ্রুতি পেয়ে, আর না হয় মোটা টাকার বিনিময়ে খুনটা ঘটিয়েছে মরিয়ার্টি। দুটোই সম্ভব হতে পারে। কিন্তু যেটাই সত্যি হোক না কেন, এমনকী দুটোর কোনোটাই না হয় যদি অন্য কারণেও আসরে অবতীর্ণ হয় মরিয়ার্টি, তাহলেও আমাদের এখুনি যাওয়া দরকার বির্লস্টোনে। সমাধান সেখানে লন্ডনে নয়। প্রফেসরকে আমি চিনি! লন্ডন শহরে এমন সূত্র ফেলে ছড়িয়ে রাখবে না যা ধরে তার কাছে যাওয়া যায়।

তাহলে চলুন বির্লস্টোনেই যাওয়া যাক। চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে সোল্লাসে বললে ম্যাকডোনাল্ড। আরে সর্বনাশ! বড্ড দেরি হয়ে গেল যে। পাঁচ মিনিটের বেশি সময় দেওয়া যাবে না আপনাদের–চটপট তৈরি হয়ে নিন।

পাঁচ মিনিটই যথেষ্ট আমাদের কাছে। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে ড্রেসিং গাউন খুলে কোট পরতে পরতে বললে হোমস। মি. ম্যাক, যেতে যেতেই বলবেন পুরো ব্যাপারটা।

পুরো ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত দেখা গেল অতি সামান্য–হতাশ হতে হল শুনে। তা সত্ত্বেও যেটুকু শুনলাম তার মধ্যেই দেখা গেল এমন অনেক পয়েন্ট রয়েছে যা বিশেষজ্ঞদের নজর কাড়বার পক্ষে যথেষ্ট। সামান্য কিন্তু আশ্চর্য খুঁটিনাটি শুনতে শুনতে দু-হাত কচলে খুশিতে ঝলমলে হয়ে উঠল হোমস। বেশ কয়েক হপ্তা বেকার কেটেছে নিষ্ফল দিনযাপনের গ্লানি সুদে-আসলে পুষিয়ে নেওয়ার মোক্ষম সুযোগ এসেছে। এ-সংসারে ঈশ্বরের দেওয়া আশ্চর্য শক্তি নিয়ে অনেকে জন্মায়। কিন্তু সেই শক্তির ধারে মরচে পড়তে থাকলে, কারো কাজে না-লাগলে তখন তা শক্তির মালিককেই ভেতর থেকে কুরে কুরে খেতে থাকে। খুরের মতো ধারালো ব্রেনও দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় থাকলে মরচে পড়ে ভোতা হবার উপক্রম হয়। কাজের ডাক এলে তাই শার্লক হোমসের দু-চোখ জ্বলে ওঠে, পাণ্ডুর গালে রক্তিমাভা দেখা দেয়, সাগ্রহ মুখখানার পরতে পরতে অন্তরের কন্দর থেকে রোশনাই ছিটকে পড়ে! ভাড়াটে গাড়ির কোণে হেলান দিয়ে বসে সে একাগ্রচিত্তে শুনে গেল ম্যাকডোনাল্ডের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা–সাসেক্স রহস্যের কাহিনি। ইনস্পেকটর নিজে একটা খবরের ওপর বেশি ঝুঁকছে। দ্রুত হাতে কাগজে লেখা খবরটা তার কানে পৌঁছে দিয়ে গেছে ভোরের দুধের ট্রেন। গাঁয়ের পুলিশ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের কাছে সাহায্য চাইলে বিধিবদ্ধভাবে সে-খবর ম্যাকডোনাল্ডের কাছে পৌঁছতে দেরি হত। কিন্তু স্থানীয় পুলিশ অফিসার হোয়াইট ম্যাসোন ম্যাকডোনাল্ডের প্রাণের বন্ধু বলে খবর পাঠিয়েছে সরাসরি। তবে এ ধরনের নিরুত্তাপ রহস্যভেদের জন্যে শহরের পুলিশ বিশেষজ্ঞদের সচরাচর তলব পড়ে না।

চিঠি পড়ে শোনালো ম্যাকডোনাল্ড প্রিয় ইনস্পেকটর ম্যাকডোনাল্ড, সরকারিভাবে আপনার সাহায্য চাইছি পৃথক লেফাফায়। এ-চিঠি ব্যক্তিগতভাবে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে। সকালের কোন ট্রেনে বির্লস্টোন আসছেন টেলিগ্রাম পাঠিয়ে জানিয়ে দেবেনসেইমতো আপনাকে স্টেশনে নিতে আসব, অথবা অন্য কাজে ব্যস্ত থাকলে আর কাউকে পাঠিয়ে দেব। কেসটাকে একটা তুমুল ঝড় বলা চলে। রওনা হতে একমুহূর্তও নষ্ট করবেন না। মি. হোমসকে যদি আনতে পারেন ভালো হয় –ওঁর মাথার খোরাক পাবেন। মাঝে একজন যারা না-গেলে ভাবতেন পুরো ব্যাপারটাই যেন নাটক করার জন্যে সাজানো। বিশ্বাস করুন, এ-কেসকে তুমুল ঝড় ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।

হোমস মন্তব্য করল, আমার বন্ধুকে বোকা বলে মনে হচ্ছে না।

বোকা সে মোটেই নয়। আমার বিচারে হোয়াইট ম্যাসোন রীতিমতো করিতকর্মা পুরুষ।

আর কিছু পেয়েছেন?

দেখা হলে খুঁটিনাটি ওর মুখেই শোনা যাবে।

মি. ডগলাস বীভৎসভাবে খুন হয়েছেন এ-খবরটা তাহলে পেলেন কোথায়?

আলাদা লেফাফায় সরকারি রিপোর্টে ছিল। বীভৎস কথাটা বলা হয়নি, সরকারি ভাষায় ও-শব্দের চল নেই। নাম লেখা হয়েছে জন ডগলাস। বলা হয়েছে চোটটা লেগেছে মাথায়–শর্টগানের গুলি। জানাজানি কখন হয়েছে, সে-সময়টাও আছে রিপোর্টে–গতরাত্রে বারোটা নাগাদ। আরও বলা হয়েছে, কেসটা নিঃসন্দেহে খুনের কেস–কিন্তু কাউকে গ্রেপ্তার কার হয়নি এবং বেশ কতকগুলো মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো অসাধারণ এবং অত্যন্ত গোলমেলে বৈশিষ্ট্য আছে কেসটায়। মি. হোমস এ ছাড়া আপাতত আর কিছু পাওয়া যায়নি।

তাহলে বিষয়টা এইখানেই মুলতুবি রাখা যাক। পর্যাপ্ত তথ্য প্রমাণ না-নিয়ে অকাল সিদ্ধান্ত খাড়া করার লোভ আমাদের পেশায় কিন্তু বিষতুল্য–যতকিছু সর্বনাশের কারণ। আপাতত দুটো জিনিস নিশ্চিত দেখতে পাচ্ছি : লন্ডনের এক বিরাট ব্রেন আর সাসেক্সে এক মৃতব্যক্তি। আমরা যাচ্ছি এই দুইয়ের মাঝের শেকলটা খুঁজতে।