প্রহেলিকা
স্বীকার করতে লজ্জা নেই, কথাগুলো শুনেই গা শিরশির করে উঠল আমার। ডাক্তারের কণ্ঠস্বরও বেশ রোমাঞ্চিত লক্ষ করলাম, অর্থাৎ বক্তব্য বিষয় বলতে গিয়ে উনি নিজেও বিলক্ষণ বিচলিত হয়েছেন। উত্তেজনায় সামনে ঝুঁকে পড়েছে হোমস, কৌতূহল নিবিড় হলে, আগ্রহ আতীব্র হলে যেভাবে ওর চোখ জ্বলতে দেখেছি বরাবর, এখনও সেই কঠিন, শুষ্ক দীপ্তি ঠিকরে আসছে চোখের তারা থেকে।
আপনারা দেখেছেন?
আপনাকে যেরকম স্পষ্ট দেখছি, সেইভাবে দেখেছি।
কাউকে বলেননি?
বলে লাভ?
আর কেউ দেখল না, এটা কী করে হয়?
দেহ থেকে প্রায় বিশ গজ দূরে ছিল ছাপগুলো। কেউ তাই মাথা ঘামায়নি। এই কিংবদন্তি–পড়া থাকলে আমিও মাথা ঘামাতাম না।
জলাভূমিতে মেষপালকদের অনেক কুকুর আছে, তাই না?
আছে নিশ্চয়, কিন্তু এ-কুকুর ভেড়া সামলানোর কুকুর নয়।
খুব বড়ো বলছেন?
অতিকায়।
কিন্তু দেহের কাছে আসেনি?
না।
রাত কীরকম ছিল?
খারাপ। স্যাঁৎসেঁতে।
কিন্তু বৃষ্টি ঠিক পড়ছিল না?
না।
ইউ-বীথিটা কীরকম?
মাঝখানে আট ফুট চওড়া হাঁটবার রাস্তা। দু-পাশে বারো ফুট উঁচু মান্ধাতার আমলের ইউ গাছের দু-সারি ঝোপ–এত ঘন যে দুর্ভেদ্য বললেই চলে।
পায়ে-চলার-রাস্তা আর ঝোঁপের মাঝখানে কিছু আছে?
আছে, ছ-ফুট চওড়া ঘাসের পটি, দু-পাশেই।
ইউ-বীথির এক জায়গায় একটা ফটক আছে না?
আছে। ছোটো ফটক–জলাভূমির দিকে।
ঝোঁপের মাঝে ফটক ছাড়া আর কোনো ফাঁক আছে?
না।
তার মানে, ইউ-বীথিতে ঢুকতে হলে হয় বাড়ির দিক থেকে, নয় জলার দিক থেকে আসতে হবে?
একদম শেষে গ্রীবাসের ভেতর দিয়ে বেরোনোর পথ একটা আছে।
স্যার চার্লস তদূর পৌঁছোতে পেরেছিলেন?
তা; সেখান থেকে প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে পড়েছিলেন।
এবার একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জবাব দিন, ডক্টর মর্টিমার। ছাপগুলো আপনি রাস্তায় দেখেছিলেন? ঘাসের ওপর নয় তো?
ঘাসের ওপর কোনো ছাপই পড়েনি।
জলার ফটক যেদিকে, ছাপগুলো কি সেইদিকেই দেখেছিলেন?
হ্যাঁ; জলার ফটক যেদিকে সেইদিকের রাস্তার ধার ঘেঁষে।
আপনার কথা শুনে, দারুণ কৌতূহল জাগছে। আরেকটা বিষয়। ছোটো ফটকটা কি বন্ধ ছিল?
ছিল। প্যাডলক ঝুলছিল।
কত উঁচু ফটক?
ফুট চারেক।
যে কেউ টপকে আসতে পারে?
পারে।
ছোটো ফটকের পাশে কি ছাপ দেখেছেন?
সেরকম কিছু দেখিনি।
কী আশ্চর্য! কেউই কি খুঁটিয়ে দেখেনি?
আমি দেখেছি।
তার পরেও কিছু পাননি?
বড়ো গোলমেলে ব্যাপার, মি. হোমস। স্যার চার্লস সেখানে পাঁচ-দশ মিনিট দাঁড়িয়েছিলেন বুঝতে পেরেছি।
কী করে বুঝলেন?
চুরুট থেকে ছাই ঝেড়েছিলেন।
চমৎকার! ওয়াটসন, এই হল গিয়ে আমাদের মনের মতো সহযোগী। কিন্তু পায়ের ছাপ?
কাঁকর বিছোনো সামান্য ওই জায়গায় নিজের পায়ের ছাপ ফেলেছেন অনেকে। আর কারো পায়ের ছাপ আলাদা করে বার করতে পারিনি।
অসহিষ্ণু ভঙ্গিমায় হাঁটু চাপড়াল শার্লক হোমস।
ইস! আমি যদি থাকতাম তখন! কেসটা সত্যিই অসাধারণ, কৌতূহল তুঙ্গে তুলে ছাড়ে। বৈজ্ঞানিক বিশেষজ্ঞ অনেক উপাদান পাবে এ-কেস থেকে, পাবে গবেষণার বিস্তর সুযোগ। কাকর-পৃষ্ঠায় লেখা অনেক খবর আমি ঠিক পড়ে নিতাম। কিন্তু ধুলোবালি, বৃষ্টি জলে, কৌতূহলী চাষাদের কাঠের শুকতলায় সব চিহ্নই এতক্ষণে একাকার হয়ে গেছে। ডক্টর মর্টিমার, তখন আমাকে ডাকলেন না কেন! এজন্যে কিন্তু জবাবদিহি করতে হবে আপনাকে।
আপনাকে ডাকার আগে যা কিছু জেনেছি দুনিয়ার সামনে তা প্রকাশ করতে হত। কেন তা করতে চাইনি আগেই বলেছি। তা ছাড়া, তা ছাড়া–
দ্বিধা করছেন কেন?
অত্যন্ত তীক্ষ্ণ্মধী, অত্যন্ত অভিজ্ঞ গোয়েন্দারাও অসহায় হয়ে পড়ে এমন রাজ্যও কিন্তু আছে।
জিনিসটা অলৌকিক, এই বলতে চাইছেন তো?
স্পষ্টভবে তা বলিনি।
বলেননি, কিন্তু মনে মনে তাই ভাবছেন।
মি. হোমস বিয়োগান্তক সেই ঘটনার পর এমন কতকগুলো ঘটনা আমার কানে এসেছে, প্রকৃতির বাঁধা নিয়মের আওতায় যা ফেলা যায় না।
যেমন?
ভয়ংকর সেই ঘটনা ঘটবার আগে জলাভূমিতে অনেকেই একটা অদ্ভুত প্রাণী দেখেছে। বাস্কারভিল পিশাচের মতোই দেখতে তাকে। বিজ্ঞান-দুনিয়া এখনও এ-প্রাণীর হদিশ পায়নি। প্রত্যেকেই একবাক্যে বলছে, জানোয়ারটা আকারে অতিকায়, বিকট এবং প্রেতচ্ছায়ার মতন। এদের তিনজনকে আমি জেরা করেছিলাম। তিনজনের মধ্যে যে-লোকটা গাঁয়ে থাকে, মাথা তার নিরেট, কপোল-কল্পনায় ভেসে যাওয়ার পাত্র নয়। আরেকজন ঘোড়ার ডাক্তার। তৃতীয় ব্যক্তি জলার চাষা। তিনজনেই বলেছে একই কাহিনি। কিংবদন্তির পিশাচ কুকুরের মতোই একটা ভয়ংকর প্রেতচ্ছায়া নাকি ঘুরে বেড়ায় জলাভূমিতে–সাক্ষাৎ নরক থেকে তার আবির্ভাব। বিশ্বাস করুন, আতঙ্কে থমথম করেছে গোটা জলা। পাথরের মতো শক্ত যার বুকের পাটা, রাতের অন্ধকারে সে-ও আর জলা পেরোতে রাজি নয়।
বিজ্ঞানের লোক হয়ে আপনিও এইসব অতিপ্রাকৃত ব্যাপার বিশ্বাস করেন দেখছি।
বুঝতে পারছি না এ ছাড়া আর কী বিশ্বাস করা যায়।
কাঁধ ঝাঁকাল হোমস। বলল, এতাবকাল ইহজগতের ব্যাপার-স্যাপারেই সীমিত রেখেছিলাম আমার তদন্ত। বিনয়ের সঙ্গে বলব, অশুভ শক্তির সঙ্গে টক্কর দিয়েছি বহুবার। কিন্তু অশুভ শক্তিদের জনকের সঙ্গে লড়তে যাওয়াটা খুব বেশি উচ্চাশা হয়ে যায়। অবশ্য পায়ের ছাপটা যে জন্তুজগতের, আপনি তা স্বীকার করছেন।
কিংবদন্তি কুকুরটাও বস্তুজগতের কুকুরের মতোই টুটি কামড়ে ছিঁড়ে ফেলেছিল। তা সত্ত্বেও কিন্তু পৈশাচিক ছিল সে।
আরে সর্বনাশ! আপনি তো দেখছি অতিপ্রাকৃতবিদদের অনেক কাছে চলে গেছেন। ডক্টর মর্টিমার, এবার একটা কথা বলুন তো। এই যদি আপনার ধারণা হয়, তাহলে পরামর্শের জন্য আমার কাছে এসেছেন কেন? আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে স্যার চার্লসের মৃত্যু-রহস্যের তদন্ত যে একটা পণ্ডশ্রম, আপনি তা বিশ্বাস করেন। তা সত্ত্বেও চান আমি তদন্ত করি।
আমি তো বলিনি যে আমার ইচ্ছে আপনি তদন্ত করুন।
তাহলে আপনাকে সাহায্যটা করব কীভাবে?
ঘড়ির দিকে তাকালেন ডক্টর মর্টিমার। বললেন, এখন থেকে ঠিক একঘণ্টা পনেরো মিনিট পরে ওয়াটারলু স্টেশনে পৌঁছোচ্ছেন স্যার হেনরি বাস্কারভিল। কী করব তাঁকে নিয়ে, আপনি শুধু তাই বলে সাহায্য করুন আমাকে।
উত্তরাধিকারী হিসেবে আসছেন বলেই কি এই পরামর্শ চাইছেন?
হ্যাঁ। স্যার চার্লসের মৃত্যুর পর খোঁজখবর নিয়ে জানলাম তরুণ এই ভদ্রলোক কানাডায় চাষবাস নিয়ে আছেন। যদ্র খবর পেয়েছি, ভদ্রলোক সবদিক দিয়ে চমৎকার। এখন কিন্তু ডাক্তার হিসেবে এসব কথা বলছি না, বলছি স্যার চার্লসের উইলের অছি আর সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে।
আর কেউ দাবিদার নেই নিশ্চয়?
না। ইনি ছাড়া আর এক জ্ঞাতির সন্ধান পেয়েছিলাম। রোজার বাস্কারভিল–স্যার চার্লসের কনিষ্ঠ ভাই–স্যার চার্লস ছিলেন তিন ভাইয়ের মধ্যে জ্যেষ্ঠ। মেজো ভাই অল্প বয়সেই মারা যান। এই হেনরি ছেলেটা তাঁরই ছেলে। তৃতীয় ভাই রজার বংশের কুলাঙ্গার। বাস্কারভিল বংশের আদি-পুরুষদের দাপট যেন ওঁর মধ্যেই মাথা চাড়া দিয়েছিল। লোকে বলে, চেহারা চরিত্র সবদিক দিয়ে হিউগো বাস্কারভিলের দ্বিতীয় সংস্করণ তিনি। হিউগোর পারিবারিক ছবির সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। ইংল্যান্ডকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে পালিয়ে যান মধ্য-আমেরিকায়, সেখানেই হলুদ জ্বরে মারা যান ১৮৭৬ সালে। বাস্কারভিল বংশের শেষ বংশধর এখন এই হেনরি। এক ঘণ্টা পাঁচ মিনিট পরে ওয়াটারলু স্টেশনে তার সঙ্গে দেখা হবে আমার। তারবার্তায় জেনেছি সাদাষ্টন পৌঁছেছেন আজ সকালে। মি. হোমস, বলুন এখন কী করি তাঁকে নিয়ে।
বাপ-পিতামহের ভিটেয় কেন যাবেন না বলতে পারেন?
সেইটাই স্বাভাবিক, তাই না? অথচ দেখুন বাস্কারভিল বংশের যারাই ওখানে গেছে, কপাল পুড়েছে তাদের। অমঙ্গল এসেছে জীবনে। আমার বিশ্বাস মৃত্যুর আগে আমার সঙ্গে কথা বলবার সুযোগ যদি পেতেন স্যার চার্লস, শেষ বংশধরকে, তাঁর বিপুল বৈভবের একমাত্র উত্তরাধিকারীকে, করাল মৃত্যুর এহেন জায়গায় না-আসতেই বলে দিতেন। অথচ দেখুন, ওঁর উপস্থিতির ওপরেই পুরোপুরি নির্ভর করছে দীনহীন এই পল্লি অঞ্চলের সর্বাঙ্গীন সমৃদ্ধি। বাস্কারভিল হলে মানুষ যদি না-থাকে, তাহলে স্যার চার্লস যা কিছু সৎকাজ করে গেছেন, সবই মাঠে মারা যাবে। আমার স্বার্থ আছে বলেই এ-ব্যাপারে পাছে বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলি, তাই এসেছি আপনার উপদেশ নিতে।
একটু ভেবে নিল হোমস। বললে, সোজা কথায় ব্যাপারটা তাহলে এই–
আপনি মনে করেন, ডার্টমুরে এমন একটা পৈশাচিক শক্তি কাজ করছে যার ফলে বাস্কারভিল বংশধরদের পক্ষে জায়গাটা নিরাপদ নয়–কেমন? এই তো আপনার অভিমত?
সে-রকম অনেক প্রমাণ পেয়েছি, এটুকুই শুধু বলতে চাই। ঠিক কথা।
কিন্তু আপনার অতিপ্রাকৃত অনুমিতি যদি সঠিক হয়, তাহলে কিন্তু অশুভশক্তির প্রকোপ শুধু ডেভনশায়ার কেন, লন্ডন শহরেও সমানভাবে দেখা যাবে। শুধু গ্রাম্য-গির্জের পোশাক ঘরেই তাণ্ডবনাচ দেখিয়ে শয়তান ক্ষান্ত হবে, এমনটা কিন্তু কল্পনা করা কঠিন।
মি. হোমস, আপনি নিজে এসবের সংস্পর্শে সরাসরি আসেননি বলেই এমনি ধরনের কথা বলছেন–এলে কিন্তু এভাবে কথা আর বলতেন না। আপনার উপদেশ তাহলে এই : আপনি মনে করেন হেনরি বাস্কারভিল লন্ডন শহরে যতখানি নিরাপদ থাকবেন, ঠিক ততখানি নিরাপদ থাকবেন ডেভনশায়ারেও। পঞ্চাশ মিনিট পরে উনি আসছেন। বলুন কী সুপারিশ করতে চান?
মশায়, আমার সুপারিশ একটাই–আমার সামনের দরজা আঁচড়ে শেষ করে দিল আপনার স্প্যানিয়েল কুকুরটা। তাকে ডেকে নিয়ে একটা ভাড়াটে গাড়িতে চাপুন, ওয়াটারলু। স্টেশনে যান, স্যার হেনরি বাস্কারভিলের সঙ্গে দেখা করুন।
তারপর?
তারপর, যতক্ষণ না আমি এ-ব্যাপারে মনস্থির করছি ততক্ষণ তাকে কিস্সু বলবেন না।
মনস্থির করতে কতক্ষণ সময় নেবেন?
চব্বিশ ঘণ্টা। ডক্টর মর্টিমার, কাল দশটার সময়ে এই ঘরে আমার সঙ্গে আপনি দেখা করলে অত্যন্ত বাধিত হব, স্যার হেনরি বাস্কারভিলকে যদি সঙ্গে আনেন তাহলে ভবিষ্যতের কর্মপন্থা রচনা করতেও অনেক সুবিধে হবে।
তাই করব, মি. হোমস।
শার্টের আস্তিনের কপে সাক্ষাতের সময় লিখে নিলেন ডক্টর মর্টিমার। তারপর ওঁর নিজস্ব অদ্ভুত ভঙ্গিমায় উঁকি মারা কায়দায় মাথা ঠেলে বার করে, আনমনাভাবে হন হন করে এগিয়ে গেলেন দরজার দিকে। সিঁড়ির মাথায় দাঁড় করাল হোমস।
বলল, আর একটা প্রশ্ন, ডক্টর মর্টিমার। আপনি বলছিলেন, স্যার চার্লস বাস্কারভিলের মৃত্যুর আগে বেশ কয়েকজন এই শরীরী প্রেতকে টহল দিতে দেখেছে জলায়?
তিনজন দেখেছে।
মৃত্যুর পর আর কেউ দেখেছে?
আমি শুনিনি।
ধন্যবাদ। সুপ্রভাত।
চেয়ারে ফিরে এসে বসল হোমস। অন্তরে পরিতৃপ্তি প্রকাশ পেল প্রসন্ন মুখচ্ছবিতে। মনের মতো কাজ যেন এসে গেছে–পা বাড়ালেই হয়।
বেরোচ্ছ নাকি, ওয়াটসন?
আমাকে দিয়ে যদি তোমার কোনো কাজ না হয়, তাহলেই বেরোব।
ভায়া ওয়াটসন, সক্রিয় মুহূর্তেই তোমাকে আমার দরকার। কয়েকটা ব্যাপারে এ-কেস কিন্তু চমকপ্রদ, সত্যিই অদ্বিতীয়। ব্র্যাডলির দোকানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে এক পাউন্ড কড়া দা-কাটা তামাক পাঠিয়ে দিতে বলবে? ধন্যবাদ। সন্ধে পর্যন্ত যদি বাইরে কাটিয়ে দিতে পারো, তাহলে ভালোই হয়। সেই ফাঁকে অত্যন্ত ইন্টারেস্টিং এই ধাঁধার সঙ্গে আমার ধারণাগুলো মিলিয়ে নেব।
প্রগাঢ় মনঃসংযোগের প্রয়োজন দেখা দিলেই নির্জনতা আর একাকিত্ব নিতান্তই দরকার হয় বন্ধুবরের। তখন মনের দাঁড়িপাল্লায় ওজন করে দেখে কোন পয়েন্টটা কাজের আর কোনটা অকাজের। মনে মনে খাড়া করে বিকল্প অনুমিতি, একটার সঙ্গে আর একটা মিলিয়ে দেখে কোনটা বেশি কার্যকর, বিধি সাক্ষ্যপ্রমাণের গুরুত্ব যাচাই করে স্রেফ চিন্তাশক্তি দিয়ে। কাজেই সারাদিন ক্লাবে কাটালাম, সন্ধের আগে বেকার স্ট্রিটমুখো হলাম না। রাত নটায় ঢুকলাম বসবার ঘরে।
ঢুকেই প্রথমে মনে হল নিশ্চয় আগুন লেগেছে কোথাও ধোঁয়ায় ঘর ভরে গেছে, টেবিলের ওপর ল্যাম্পের আলোও ম্লান হয়ে উঠেছে ধোঁয়ার আড়ালে। ঢোকবার পর অবশ্য সে-ভয় আর রইল না। কেননা তামাক-পোড়ার গন্ধ ভেসে এল নাকে। সেইসঙ্গে কড়া তামাকের কটু, উগ্র ধোঁয়া গলায় ঢুকতেই কাশতে লাগলাম খক খক করে। ধোঁয়ার ঝাঁপসা পর্দার মধ্যে দিয়ে দেখতে পেলাম দাঁতের ফাঁকে কালো ক্লে-পাইপ কামড়ে ধরে চেয়ারে কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে হোমস। খানকয়েক পাকানো কাগজ ছড়ানো আশেপাশে।
শুধোলো, ঠান্ডা লাগিয়ে এলে নাকি, ওয়াটসন?
না, আবহাওয়াটা বিষাক্ত।
ভাগ্যিস বললে তুমি, ধোঁয়াটা খুব ঘন হয়ে উঠেছে দেখছি।
ঘন কী হে! অসহ্য!
তাহলে বরং জানলাটা খুলে দাও!
সারাদিন ক্লাবে ছিলে দেখছি। ভায়া হোমস! ঠিক বলেছি?
নিশ্চয়, কিন্তু কীভাবে–
আমার হতচকিত ভাব দেখে হেসে ওঠে হোমস।
ওয়াটসন, তোমার মধ্যে দারুণ একটা মনমাতানো তাজা ভাব দেখতে পাচ্ছি। তাই তোমারই কৃপায় পাওয়া আমার সামান্য শক্তির কসরত দেখানোর সুযোগ ছাড়তে পারিনি। কাদাটে বাদলা দিনে রাস্তায় বেরোলেন এক ভদ্রলোক। ফিরে এলেন ফিটফাট বেশে–জুতো আর টুপির চেকনাই অম্লান রেখে। অতএব তিনি সারাদিন কোথাও ঠায় বসে ছিলেন। কোথায় থাকা সম্ভব বলে মনে হয়? স্পষ্ট ব্যাপার, নয় কী?
স্পষ্টই বটে।
দুনিয়াটা স্পষ্ট জিনিসেই ঠাসা, কিন্তু চোখ মেলে দেখার সুযোগ কেউ পায় না। আমি কোথায় ছিলাম বলে মনে হয়?
ঠায় বসে ছিলে।
ঠিক উলটো। আমি ডেভনশায়ারে গিয়েছিলাম।
সূক্ষ্ম দেহে?
ঠিক বলেছ। দেহটা এই হাতল-চেয়ারে থেকেছে; অত্যন্ত পরিতাপের সঙ্গে জানাচ্ছি–আমার অবর্তমানে সে দুটো বড়ো পট-ভরতি কফি আর অবিশ্বাস্য পরিমাণ তামাক সেবা করেছে। তুমি বেরিয়ে যাওয়ার পর স্ট্যানফোর্ডের দোকান থেকে জলার সামরিক ম্যাপ আনিয়েছিলাম। এতক্ষণ সূক্ষ্মদেহে বিচরণ করছিলাম সেখানে। রাস্তা চিনতে ভুল হয়নি।
বিরাট স্কেল ম্যাপ নিশ্চয়?
খুবই বিরাট। একটা অংশ খুলে হাঁটুর ওপর মেলে ধরল হোমস। এই সেই জলা যা নিয়ে আমাদের দরকার। মাঝখানের এইটা বাস্কারভিল হল।
জঙ্গল ঘেরা?
ঠিক। ইউ-বীথিটা ম্যাপে দেখানো হয়নি। কিন্তু আমার মনে হয় সেটা এই লাইন বরাবর হবে বুঝতে পারছ নিশ্চয় জল পড়ছে লাইনের ডান দিকে। এইখানে এই যে ছোটো ছোটো বাড়ির জটলা, এই হল গ্রিমপেন পল্লি, আমাদের বন্ধু ডক্টর মর্টিমারের সদরদপ্তর। পাঁচ মাইল ব্যাসার্ধের বৃত্তের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সামান্য কিছু বাড়িঘরদোর। এই হল ল্যাফটার হল–বিবৃতিতে উল্লেখ আছে। এইখানে একটা বাড়ির চিহ্ন দেওয়া হয়েছে নিঃসন্দেহে প্রকৃতিবিদের বাসস্থান। নামটা যদূর মনে পড়ে স্টেপলটন। এইখানে দুটো জলাভূমির খামারবাড়ি–হাই টর* আর ফাউলমায়ার। তারপর চোদ্দো মাইল দূরে রয়েছে প্রিন্সটাউনের বিরাট কয়েদখানা। বিক্ষিপ্ত এই কয়েকটা জায়গায় চারপাশে আর মাঝে খাঁ-খাঁ করছে প্রাণহীন, জনহীন জলাভূমি। এই মঞ্চেই অভিনীত হয়েছে বিয়োগান্তক সেই দৃশ্য এবং এই মঞ্চেই তার পুনরাভিনয়ের চেষ্টা চালিয়ে যাব আমরা।
খুবই বন্য অঞ্চল মনে হচ্ছে।
হ্যাঁ, উপর্যুক্ত পরিবেশ। শয়তানের যদি ইচ্ছে হয় নরলোকের ব্যাপারে নাক গলানোর—
অতিপ্রাকৃত ব্যাখ্যার দিকে তাহলে তুমি নিজেই ঝুঁকছ।
শয়তানের অনুচর তো রক্ত-মাংসের প্রাণীও হতে পারে, পারে না কি? শুরুতেই দুটো প্রশ্নের মোকাবিলা করতে হবে। প্রথম, আদৌ কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কি না। দ্বিতীয়, অপরাধটা কী এবং করা হয়েছে কীভাবে? ডক্টর মর্টিমারের অনুমান যদি সত্যি হয়, সত্যিই যদি প্রকৃতির সাধারণ নিয়ম বহির্ভূত কোনো অজ্ঞাত শক্তির খেলা এ-কেসে থাকে তাহলে আমাদের তদন্তেরও ইতি এইখানে। কিন্তু এটা হল গিয়ে আমাদের শেষ অনুমিতি। এর আগের সবক-টা অনুমিতি যাচাই করার আগে এ-অনুমিতিতে ধরাশায়ী হতে আমি রাজি নই। যদি কিছু মনে না-করো, আমার মনে হয় ওই জানলাটা আবার বন্ধ করতে পারি। ব্যাপারটা অসাধারণ। কিন্তু আমি লক্ষ করেছি ঘনীভূত আবহাওয়ায় চিন্তাশক্তিও ঘনীভূত হয়–একাগ্রতা বাড়ে। চিন্তাকে ঠেলেঠুলে অবশ্য একটা বাক্সের মধ্যে ঢুকিয়ে যাচাই করে দেখিনি কতখানি সত্য কথাটা–তবে বিশ্বাসটা এসেছে যুক্তিনির্ভর পথে। কেসটা নিয়ে ভেবেছ?
হ্যাঁ, ভেবেছি। সারাদিন অনেক চিন্তা করেছি।
ভেবে কী মনে হল?
অত্যন্ত গোলমেলে।
কাঠামোটা কিন্তু সেইরকমই। তফাতও আছে। যেমন, পায়ের ছাপের পরিবর্তন। তোমার কী মনে হয়?
মর্টিমার তো বললেন বীথির ওইদিকে আঙুলে ভর দিয়ে হেঁটেছিলেন স্যার চার্লস।
তদন্তে কতগুলো মুখ যা বলেছে, উনি শুধু তার পুনরাবৃত্তি করেছেন। বীথির পথে আঙুলে ভর দিয়ে কেউ হাঁটে?
তাহলে?
দৌড়াচ্ছিলেন, ওয়াটসন, প্রাণ হাতে নিয়ে দৌড়োচ্ছিলেন, স্যার চার্লস, পড়ি কি মরি করে দৌড়োচ্ছিলেন, দৌড়াতে দৌড়াতে শেষকালে কলজে ফেটে যায়, মুখ থুবড়ে পড়ে যায় মৃতদেহটা।
কার তাড়া খেয়ে দৌড়োচ্ছিলেন?
সেইটাই তো আমাদের প্রহেলিকা। দৌড়োনোর আগে উনি যে ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়েছিলেন, সে-রকম ইঙ্গিত কিন্তু রয়েছে।
কেন বলছ?
আমি ধরে নিচ্ছি মৃত্যুর কারণটা এসেছে জলার ওপর দিয়ে। তাই যদি হয়, তাহলে বলব ভয়ের চোটে উনি বুদ্ধিশুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছিলেন। বাড়ির দিকে না-দৌড়ে, ঠিক উলটোদিকে দৌড়োচ্ছিলেন। যাযাবর জিপসির জবানবন্দি যদি সত্যি হয়, তাহলে উনি বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার করতে করতে এমন একদিকে দৌড়চ্ছিলেন যেদিক থেকে কেউ তাকে বাঁচাতে আসবে না। তারপর ধরো, সে-রাতে কার প্রতীক্ষা উনি করছিলেন? বাড়িতে বসে প্রতীক্ষা না-করে ইউ-বীথির মধ্যে দিয়ে পথ চেয়ে দাঁড়িয়েছিলেন কেন?
তোমার কি মনে হয় উনি কারো অপেক্ষায় ছিলেন?
ভদ্রলোকের বয়স হয়েছে, তার ওপর অশক্ত। সান্ধ্যভ্রমণ তাকে মানায় ঠিকই, কিন্তু সে-রাতে দারুণ ঠান্ডা পড়েছিল, ঝোড়ো হাওয়া বইছিল, মাটি স্যাঁৎসেতে ছিল। এ-পরিস্থিতিতে তার মতো মানুষের পক্ষে পাঁচ থেকে দশ মিনিট ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা কি স্বাভাবিক বলে মনে হয়? চুরুটের ছাই থেকে ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন ডক্টর মর্টিমার।
ভদ্রলোকের বাস্তববুদ্ধি এত প্রখর ভাবতে পারিনি।
উনি কিন্তু প্রতি সন্ধ্যাতেই বেড়াতেন।
প্রতি সন্ধ্যায় জলার গেটে অপেক্ষা করতেন, তা কিন্তু মনে হয় না। পক্ষান্তরে, সাক্ষীরা বলেছে উনি জলাভূমি এড়িয়ে চলতেন। অথচ সে-রাতে অপেক্ষা করেছেন ফটকের কাছে। পরের দিনই তার লন্ডন রওনা হওয়ার কথা। এবার একটা আকার নিচ্ছে কেসটা। বোধগম্য হচ্ছে। বেহালাটা এগিয়ে দেবে, ওয়াটসন? কাল সকালে স্যার হেনরি বাস্কারভিল আর ডক্টর মর্টিমারের সাক্ষাতের আগে মুলতবি থাক এ-প্রসঙ্গে যাবতীয় ভাবনাচিন্তা।