উপন্যাস

০১. শার্লক হোমস

শার্লক হোমস

শার্লক হোমস এমনিতে খুব বেলায় ওঠে ঘুম থেকে। ব্যতিক্রমও অবশ্য আছে—সারারাত না-ঘুমিয়ে শিবনেত্র হয়ে বসে থাকার ঘটনাও ঘটে যখন-তখন। সেদিন এই মানুষকেই সাতসকালে বসে থাকতে দেখলাম ব্রেকফাস্ট টেবিলে। অগ্নিকুণ্ডের সামনে পাতা মোটা কম্বলের ওপর দাঁড়িয়ে আমি লাঠিটি হাতে নিলাম গত রাতে এক ভদ্রলোক দেখা করতে এসে ফেলে গেছেন লাঠিখানা। চমৎকার মোটা কাঠের ছড়ি, মাথাটা কলাকৃতি, এ ধরনের ছড়িকে বলা হয় পেন্যাঙ লইয়ার। হাতলের ঠিক নীচেই একটা চওড়া রুপোর পটি–ইঞ্চিখানেক চওড়া। ওপরে খোদাই করা–জেমস মর্টিমার, এম.আর.সি.এস. কে.সি.সি. এইচ.-এর বন্ধুবর্গ, ১৮৮৪। সেকেলে গৃহচিকিত্সকরা যে ধরনের ছড়ি নিয়ে হাঁটেন, এ-ছড়িও ঠিক সেইরকম–মর্যাদাব্যঞ্জক, নিরেট, আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনার মতো।

ওয়াটসন, ছড়ি দেখে কী বুঝলে বলো তো?

হোমস কিন্তু বসেছিল আমার দিকে পিঠ ফিরিয়ে। আমি ওকে বলিওনি কী নিয়ে তন্ময় ছিলাম এতক্ষণ।

জানলে কী করে কী দেখছি? মাথার পেছনে একজোড়া চোখ আছে মনে হচ্ছে।

মাথার পেছনে চোখ না-থাক, নিকেল-করা বেজায় চকচকে একটা কফিপট রয়েছে আমার সামনে। সে যাই হোক, ছড়ি দেখে কী মনে হল বলো দিকি ওয়াটসন। ভদ্রলোক কাল রাতে এসেছিলেন দেখা করতে, কিন্তু আমাদের কপাল খারাপ তাই দেখা হয়নি। তিনি কীরকম, কী করেন, দেখতে কেমন কিছুই জানি না। কাজেই দৈবাৎ ফেলে যাওয়া এই স্মারক নিদর্শনটি এখন যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। ছড়ি পরীক্ষা করে ভদ্রলোকের বর্ণনা কীরকম দিতে পারো শোনা যাক।

বন্ধুবরের পদ্ধতি আমি জানি। সাধ্যমতো তা অনুসরণ করলাম। বললাম, ডক্টর মর্টিমার দেখছি বেশ পসার জমিয়েছেন। বয়স্ক। শ্রদ্ধার পাত্র। স্বীকৃতি স্বরূপ পরিচিতেরা দিয়েছে এই ছড়ি।

হোমস বললে, গুড! অতি চমৎকার!

খুব সম্ভব উনি গাঁয়ের ডাক্তার। হাঁটেন বেশি।

কেন বলো তো?

ছড়িটা এককালে খুবই দেখতে বাহারি ছিল। কিন্তু এত চোট খেয়েছে যে মনে হয় শহুরে চিকিৎসকের হাতে থাকলে এমন হাল হত না। ডগায় আঁটা পুরু লোহার টুপি বেশ ক্ষয়ে এসেছে, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ছড়ি হাতে হাঁটাহাঁটি হয়েছে খুব বেশি।

এক্কেবারে ঠিক! বললে হোমস।

তারপর ধরো এই সি.সি. এইচ.-এর বন্ধুবর্গ কথাটা। স্থানীয় বাসিন্দাদের চমৎকৃত করেছিলেন শল্যচিকিৎসা দিয়ে—বিনিময়ে উপহার পেয়েছেন এই ছড়ি।

চেয়ার ঠেলে সরিয়ে সিগারেট ধরিয়ে হোমস বললে, ওয়াটসন, তুমি দেখছি আমাকেও টেক্কা মেরে গেলে! না-বলে আর পারছি না, আমার ছোটোখাটো কৃতিত্ব গুছিয়ে লিখতে গিয়ে তোমার নিজের ক্ষমতাকে ছোটো করে দেখেছ বরাবর। তুমি নিজে হয়তো আলোকময় নও, কিন্তু আলোক-পরিবাহী তো বটে। সংসারে কিছু মানুষ আছে যারা প্রতিভা নিয়ে জন্মায় না, অন্য প্রতিভাকে উদ্দীপ্ত করার অসাধারণ ক্ষমতা রাখে। ভায়া, তোমার কাছেও আমি ঋণ স্বীকার করছি।

এত কথা এর আগে কখনো ওর মুখে শুনিনি। তাই খুব আনন্দ হল শুনে। ওর প্রশংসা আর প্রচার করতে গিয়ে বহুবার আঘাত পেয়েছি ওর নিজেরই ঔদাসীন্য দেখে। গর্বও হল ওর সেই পদ্ধতিকে আয়ত্তে আনতে পেরেছি দেখে। পদ্ধতির যথার্থ প্রয়োগ দেখিয়ে ওকে তাক লাগিয়ে দিয়েছি, প্রশংসা অর্জন করেছি। ছড়িটা এবার আমার হাত থেকে নিয়ে ও খালি চোখে পর্যবেক্ষণ করল মিনিট কয়েক। তারপর যেন আগ্রহ সঞ্চারিত হল চোখে-মুখে। সিগারেট নামিয়ে রেখে ছড়ি হাতে গিয়ে দাঁড়াল জানলার সামনে এবং একটা পেটমোটা আতশকাচ নিয়ে ফের খুঁটিয়ে দেখল ছড়ির আগাপাশতলা।

তারপর ফিরে এসে বসল সোফায় ওর প্রিয় কোণটিতে। বললে, কৌতূহলোদ্দীপক এবং অসাধারণ। ছড়ির ওপর সত্যিই দু-একটা ইঙ্গিত দেখতে পাচ্ছি। বেশ কয়েকটা সিদ্ধান্তের বনেদ হিসেবে যথেষ্ট।

নিজেকে কেউকেটা মনে হল। এইরকম সুরে বললাম, আমার চোখ এড়িয়ে গেছে কি কিছু? দরকারি কিছু এড়িয়েছে বলে মনে হয়?

ভায়া ওয়াটসন, তোমার অধিকাংশ সিদ্ধান্তই ভুল। আমাকে উদ্দীপ্ত করেছ, এই কথা বললাম এই কারণে যে তোমার এইসব ভুল থেকেই মাঝে মাঝে আমি সত্যে উপনীত হয়েছি। ভুলগুলোই আমার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় সঠিক পয়েন্ট কোনদিকে। এক্ষেত্রে অবশ্য তুমি একেবারেই ভুল করেছ, তা বলব না। ভদ্রলোক সত্যিই গাঁইয়া ডাক্তার। হাঁটেনও এন্তার।

তাহলে তো ঠিকই বলেছি।

ওই পর্যন্ত ঠিক বলেছ।

ওর বেশি আর নেইও কিছু।

না, না, ভায়া ওয়াটসন, মোটেই তা নয়–একেবারেই নয়। যেমন ধরো উপহার জিনিসটা ডাক্তাররা হাসপাতাল থেকেই পায়–রুগিদের কাছ থেকে পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। সেই হাসপাতালের নামের আগে সি.সি. লেখা থাকলে বুঝতে হবে তা শেরিং ক্রস হাসপাতাল।

মনে হচ্ছে ঠিকই বলছ।

সম্ভাবনা কিন্তু সেইদিকেই। কাজ শুরু করার অনুমিতি হিসেবে এটুকু মেনে নিলে অজানা সেই ভদ্রলোককে মনে মনে আঁকার সম্পূর্ণ নতুন একটা বনেদ পাওয়া যাবে।

বেশ তো, সি. সি. এইচ. মানে ; দি শেরিং ক্রস হসপিটাল ধরে নেওয়া হয়, তা থেকে কী সিদ্ধান্ত পাওয়া যাচ্ছে?

তোমার মাথায় কিছু আসছে না? আমার পদ্ধতি তুমি জানো। প্রয়োগ কর না কেন?

আমার মাথায় কেবল অবশ্যম্ভাবী সিদ্ধান্তটাই আসছে। গাঁয়ে যাওয়ার আগে ভদ্রলোক শহরে প্র্যাকটিস করেছিলেন।

আমার মনে হয় আরও একটু বুক ঠুকে এগোনো যায়। এইভাবে দেখা যাক। এ-রকম উপহার দেওয়ার পক্ষে সবচেয়ে সম্ভবপর পরিস্থিতি কী হতে পারে? বন্ধুপ্রীতি জানাতে বন্ধুরা কোন সময়ে একত্র হতে পারে? হাসপাতালের চাকরি ছেড়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করার ঠিক আগে নিশ্চয় উপহার পেয়েছিলেন দেখতেই পাচ্ছি। বুঝতে পারছি শহুরে হাসপাতাল ছেড়ে গাঁয়ের প্র্যাকটিস আরম্ভ হয় তখনই। এই পরিবর্তনের সময়েই উপহারটা পেয়েছিলেন, এ-সিদ্ধান্ত নেওয়াটা কি খুব বাড়াবাড়ি হবে?

খুবই সম্ভবপর মনে হচ্ছে।

এবার দ্যাখো, ভদ্রলোক নিশ্চয় হাসপাতালের মাইনে-করা ডাক্তার ছিলেন না। কেননা, এ-পদ পেতে গেলে লন্ডনে জমজমাট পসার থাকা চাই। এ-রকম পসার ছেড়ে কেউ গাঁয়ে প্র্যাকটিস করতেও যায় না, তাহলে কী ছিলেন উনি? হাসপাতালে ছিলেন, কিন্তু কর্মচারী তালিকাভুক্ত ছিলেন না। তাহলে নিশ্চয় সিনিয়র স্টুডেন্টের একটু ওপরের ধাপে ছিলেন, মানে হাউস-সার্জন বা হাউস-ফিজিশিয়ান। হাসপাতাল ছেড়েছেন পাঁচ বছর আগে তারিখটা ছড়িতেই রয়েছে। ভায়া ওয়াটসন, ফলে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল তোমার মধ্যবয়স্ক, গম্ভীরবদন গৃহচিকিৎসক–সে-জায়গায় আবির্ভূত হচ্ছে একজন ছোকরা ডাক্তার, বয়স তিরিশের নীচে, অমায়িক, উচ্চাশাহীন, অন্যমনস্ক, এবং টেরিয়ারের চেয়ে একটু বড়ো আর ম্যাসটিফের চেয়ে একটু ছোটো একটা কুকুরের মালিক।

সোফায় হেলান দিয়ে বসে ধোঁয়ার রিং কড়িকাঠ অভিমুখে নিক্ষেপ করে চলল শার্লক হোমস। অবিশ্বাসের হাসি হাসলাম আমি।

বললাম, শেষদিকে যা বললে, তা যাচাই করার উপায় আমার হাতে নেই। তবে , ভদ্রলোকের বয়স আর পেশাগত কর্মজীবনের খবর যাচাই করাটা খুব কঠিন হবে না।

ডাক্তারি বই রাখার ছোটো তাক থেকে মেডিক্যাল ডিরেক্টরি নামিয়ে নামটা খুঁজে বের করলাম। মর্টিমার বেশ কয়েকজন আছেন, কিন্তু কাল রাতে আমাদের চৌকাঠ মাড়িয়েছেন, এমন মর্টিমার একজনই আছেন। প্রমাণ-লিপি পড়ে শোনালাম।

মর্টিমার জেমস্, এম.আর.সি.এস. ১৮৮২, গ্রিমপেন, ডার্টমুর, ডেভন। ১৮৮২ থেকে ১৮৮৪ পর্যন্ত শেরিংক্রন্স হসপিটালের হাউস-সার্জন। তুলনামূলক প্যাথলজির ওপর ব্যাধিমাত্রই কি পুনঃপ্রকোপ শীর্ষক প্রবন্ধ লিখে জ্যাকসন পুরস্কার বিজয়ী। সুইডিশ প্যাথলজিক্যাল সোসাইটির পত্রলেখক সদস্য। রচনাবলি : দূর পূর্বপুরুষের সঙ্গে সাদৃশ্যে কয়েকটা খেয়ালখুশি (ল্যানসেট, ১৮৮২), আমরা কি অগ্রগতির পথে? (জার্নাল অফ সাইকোলজি, মার্চ, ১৮৮৩)। গ্রিমপেন, থর্সলি এবং হাই বারোতে যাজকের অধীন অঞ্চলের মেডিক্যাল অফিসার ছিলেন।

দুষ্টু হেসে হোমস বললে, ওয়াটসন, স্থানীয় বাসিন্দাদের শল্যচিকিৎসার নৈপুণ্য দেখিয়ে চমকে দেওয়ার কোনো উল্লেখই নেই। তবে একটা কথা দারুণ বলেছ–গাঁয়ের ডাক্তারই বটে। আমার সিদ্ধান্তগুলো মোটামুটি ঠিক বলেই মনে হচ্ছে। এবার বিশেষণগুলো নিয়ে পর্যালোচনা করা যাক। যদূর মনে পড়ে, তিনটে বিশেষণ বলেছিলাম–অমায়িক, উচ্চাশাহীন, অন্যমনস্ক। আমার অভিজ্ঞতা বলে, এ-দুনিয়ার অমায়িক মানুষরাই প্রশংসিকা গ্রহণ করে, উচ্চাশাহীন ব্যক্তিরাই লন্ডনের কর্মজীবন পায়ে ঠেলে গাঁয়ের পথে পাড়ি জমায়, এবং অন্যমনস্ক পুরুষরাই এক ঘণ্টা তোমার ঘরে বসে থাকার পর নাম লেখা ভিজিটিং কার্ডের বদলে নিজের ছড়ি ফেলে যায়।

কুকুরটা?

মনিবের পেছন পেছন ছড়ি মুখে করে নিয়ে যেতে অভ্যস্ত। ভারী ছড়ি, তাই মাঝখানে কামড়ে ধরতে হয়, সেই কারণে কুকুরের দাঁতের দাগ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দাগের মাঝখানের ফাটুকু দেখেই কুকুরটার চোয়াল কতখানি চওড়া বোঝা য়ায়। ফাঁকটুকু যতখানি চওড়া হলে টেরিয়ার বলা যায়, ততখানি নয়–তার চেয়ে একটু বেশি আবার ম্যাসটিফের চোয়ালের মতোও অতখানি চওড়া নয়। আমার মনে হয়–আরে হ্যাঁ, কী কাণ্ড দেখো, এ যে দেখছি স্প্যানিয়েল কুকুর, চুলগুলো কোঁকড়া।

সোফা ছেড়ে উঠে পড়ে ঘরময় পায়চারি করতে করতে কথা বলছিল হোমস। এখন থমকে দাঁড়াল জানলার কুলুঙ্গির সামনে। কণ্ঠস্বরে এমন একটা প্রত্যয় ফুটে উঠল যে সবিস্ময়ে চোখ তুললাম আমি।।

বন্ধু, এত নিশ্চিত হচ্ছ কী করে?

অতি সহজ কারণে, দরজার সামনেই দেখতে পাচ্ছি কুকুরটাকে, মনিবের চেহারাটাও চোখে পড়ছে। যেয়ো না, ওয়াটসন। পেশার দিক দিয়ে ভদ্রলোক তোমার সতীর্থ। তুমি থাকলে আমার সুবিধেই হবে। ওয়াটসন, নিয়তির নাটকীয় মুহূর্ত সিঁড়ির ওপরকার ওই পদধ্বনির মধ্যে এগিয়ে আসছে তোমার জীবনে, ভালো হবে কি মন্দ হবে তা কিন্তু তুমি জানো না। বিজ্ঞান-সাধক ডক্টর জেমস মর্টিমার অপরাধ-বিশেষজ্ঞ শার্লক হোমসের কাছে কী অভিপ্রায় নিয়ে আসছেন জানি না। ভেতরে আসুন!

আশা করেছিলাম, মার্কামারা গাঁইয়া ডাক্তার দেখব; তাই ঘরে যিনি ঢুকলেন তাকে দেখে অবাক হলাম। মাথায় বেশ লম্বা, ছিপছিপে পাতলা চেহারা, নাক তো নয় যেন পাখির চঞ্চ, ঘনিষ্ঠ দুই ধূসর চোখের মাঝখান থেকে ঠেলে বেরিয়ে এসেছে সামনে, সোনার চশমার আড়ালে চিকমিক করছে অত্যুজ্জ্বল তীক্ষ্ণ্ণ চাহনি। বেশবাস ডাক্তারের মতোই, কিন্তু যত্নহীন; ফ্ৰককোট মলিন, ট্রাউজার্স ছেড়া–সুতো বেরিয়ে পড়েছে। বয়সে তরুণ হলেও লম্বা পিঠখানা বেঁকে গিয়েছে ধনুকের মতে, হাঁটছেন মাথা সামনের দিকে বাড়িয়ে, ভাবেসাবে উঁকি দিচ্ছে মানুষের উপকার করার সদিচ্ছা, ঘরে ঢুকতেই দৃষ্টি গিয়ে পড়ল হোমসের হাতের ছড়িটার উপর, সঙ্গেসঙ্গে দৌড়ে গেলেন হর্ষধ্বনি করে।

বললেন, বাঁচলাম! জাহাজ-অফিসে ফেলেছি কি এইখানে রেখে গেছি, ঠিক করে উঠতে পারছিলাম না। প্রাণ থাকতে এ-ছড়ি কাছছাড়া করতে পারব না।

হোমস বললে, উপহার পাওয়া ছড়ি দেখছি।

হ্যাঁ।

শেরিং ক্রস হসপিটাল থেকে?

আমার বিয়ে উপলক্ষে হাসপাতালের বন্ধুরা দিয়েছিল।

কী বিপদ! কী বিপদ! সেটা তো খুব খারাপ হল। মাথা নাড়তে নাড়তে বললে হোমস।

একটু অবাক হয়েই চশমার ফাঁক দিয়ে চোখ পিটপিট করে তাকান ডক্টর মর্টিমার।

খারাপ হল কেন?

আমাদের এই সামান্য সিদ্ধান্ত-পর্বটাকে অগোছালো করে দিলেন বলে। আপনার বিয়ে বললেন না?

হ্যাঁ। বিয়ে করার ফলে হাসপাতাল ছাড়তে হল, কনসাল্টিং প্র্যাকটিসের আশাও শিকেয় উঠল। নিজস্ব একটা আস্তানার দরকার হয়ে পড়ল সবার আগে।

তাই বলুন, খুব একটা ভুল তাহলে করিনি, বললে হোমস। এবার বলুন দিকি ডক্টর জেমস মর্টিমার

মিস্টার, মশায়, মিস্টার সামান্য এম. আর. সি. এস. আমি।

মনটাও নিশ্চয় যেরকমটি হওয়া উচিত, সেইরকম।

মি. হোমস বিজ্ঞান জগতের ভাসা ভাসা কিছু খবর রাখি, বিরাট অজানা মহাসমুদ্রের উপকূলে শামুক কুড়িয়ে বেড়াই। কথা বলছি নিশ্চয় মি. শার্লক হোমসের সঙ্গে, আর–

হ্যাঁ, ইনি আমার বন্ধু, ডক্টর ওয়াটসন।

পরিচিত হয়ে খুশি হলাম। ডক্টর ওয়াটসন, আপনার বন্ধুর সুত্রেই আপনার নাম আমি শুনেছি। মি. হোমস, আপনাকে নিয়ে কৌতুহলের শেষ নেই আমার। করোটির এ-রকম dolichocephalic গড়ন দেখতে পাব ভাবিনি, চোখের গর্তের ওপরকার হাড়ের গঠনও রীতিমতো সুগঠিত। দু-পাশের হাড় দু-খানার জোড়ের ওপর আঙুল বুলোতে চাই, আপত্তি আছে? যেকোনো নৃতত্ত্ব জাদুঘরে সাজিয়ে রাখার মতো আপনার এই করোটি। আসলটা যদ্দিন -পাচ্ছে, তদ্দিন একটা ছাপ পেলেও গৌরব বাড়বে মিউজিয়ামের। খোশামুদ করছি ভাববেন না যেন, কিন্তু দারুণ লাভ হচ্ছে আপনার করোটিখানার ওপর।

হাত নেড়ে ইঙ্গিতে বিচিত্র দর্শনার্থীকে চেয়ারে বসতে অনুরোধ জানায় শার্লক হোমস।

বলে, আমি যেমন আমার লাইনের চিন্তা নিয়ে উৎসাহী, আপনিও দেখছি সেইরকম। আপনার তর্জনী দেখে মনে হচ্ছে নিজের সিগারেট নিজেই বানান। দ্বিধা করবেন না, ধরিয়ে নিন একটা।

কাগজ আর তামাক বার করে অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় কাগজ পাকিয়ে তামাক ভরে ফেললেন। ভদ্রলোক। পোকামাকড়ের গুঁড়ের মতন চটপটে আর অস্থির তার দীর্ঘ কম্পমান আঙুল।

নীরবে বসে রইল হোমস। কিন্তু তিরের মতন চাহনি নিক্ষেপ দেখেই বুঝলাম বিচিত্র ভদ্রলোক জাগ্রত করেছেন তার কৌতূহল।

শেষকালে বললে, দেখুন মশায়, কাল রাতে আর আজ সকালে নিশ্চয় খুলিতে আঙুল বোলাবার অভিপ্রায়ে এখানে আসেননি?

না, মশাই, না; যদিও এ-সুযোগ পেয়ে আমি সুখী। মি. হোমস, আমি এসেছি কেননা প্রথমত আমার ব্যবহারিক বুদ্ধি কম, দ্বিতীয়ত হঠাৎ একটা অত্যন্ত গুরুতর আর অসাধারণ সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি বলে। যেহেতু ইউরোপে আপনিই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিশেষজ্ঞ–

বটে! বটে! জানতে পারি কি প্রথম হওয়ার সম্মানটি কার ভাগ্যে জুটেছে! একটু রুক্ষস্বরেই শুধোয় হোমস।

মসিয়ে বার্টিলন। মনটা বিজ্ঞানসম্মত ঠিক যেমনটি হওয়া উচিত। এ-সম্মান তারই প্রাপ।

তাহলে পরামর্শের জন্যে তার কাছেই যাওয়া উচিত ছিল আপনার?

আগেই বলেছি মনটা তার বিজ্ঞানসম্মত ঠিক যেমনটি হওয়া উচিত। কিন্তু ব্যবহারিক বুদ্ধির দিক দিয়ে আপনি অদ্বিতীয়–সবাই তা জানে। অজান্তে আপনার অসম্মান–

একটু করেছেন, বললে হোমস। ডক্টর মর্টিমার, আর ভনিতা না-করে সাদা কথায় দয়া করে বলুন ঠিক কী ধরনের সমস্যায় আমার সহযোগিতা আপনি চাইছেন।