উপন্যাস

১১. আগ্রা সম্পদ

আগ্রা সম্পদ

কেবিনের মধ্যে বসে রইল আমাদের কয়েদি সামনে রইল লোহার বাক্স–যে-বাক্সর লালসায় এত কু-কাণ্ড সে করেছে এবং এতদিন অপেক্ষা করে থেকেছে। লোকটা আগাগোড়া রোদে পোড়া, দুর্দান্ত এবং বেপরোয়া। মুখখানা যেন শক্ত লালচে মেহগনি কাঠ খোদাই করে তৈরি। অসংখ্য বলিরেখায় জর্জরিত সে-মুখ দেখলেই বোঝা যায় দীর্ঘদিন খোলা হাওয়ায় প্রকৃতির মধ্যে রোদ-জলে বন্য জীবন কাটিয়েছে। দাড়ি-ঢাকা থুতনির গড়নটাও অদ্ভুত, সংকল্প সাধনে অটল চরিত্রের লক্ষণ লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করার শক্তি কারোর নেই। বয়স পঞ্চাশের ধারেকাছে–কেননা ঘনকৃষ্ণ ঢেউ-খেলানো চুলের মধ্যে উঁকি দিচ্ছে অগুনতি সাদা রেখা। এমনিতে মুখটা বদ নয়, কিন্তু রেগে গেলে যে অন্য মানুষ, তা ওই গোঁয়ার থুতনি আর ভারী ভুরু দেখলেই অনুমান করা যায়, তখন মুখের চেহারা কতখানি ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে স্বচক্ষে তা দেখেছি নদীবক্ষে। হাতকড়া বদ্ধ দু-হাত কোলে রেখে, বুকের ওপর মাথা ঝুলিয়ে চুপ করে বসে থাকলেও তীক্ষ্ণ্ণ স্ফুলিঙ্গময় চোখ জোড়া অনিমেষে চেয়ে আছে এত কুকর্মের নিমিত্ত লৌহপেটিকার পানে। আমার কিন্তু মনে হল লোকটার আড়ষ্ট আর দৃঢ় মুখভাবে রাগের বদলে দুঃখ বেশি পরিস্ফুট। একবার শুধু চাইল আমার পানে ঝিকমিক চোখে দেখলাম কৌতুক জাতীয় ভাবের স্ফুরণ।

চুরুট ধরিয়ে হোমস বললে–জোনাথন স্মল, শেষটা এইরকম হওয়ার জন্যে আমি দুঃখিত।

আমিও, অকপট সুরে বললে স্মল। জানি আমি পার পাব না। ভগবানের দিব্যি, মি. শোন্টোর গায়ে আমি হাত দিইনি–বাইবেল ছুঁয়ে বলতে পারি। ওই বিটলে-কুত্তা টোঙ্গা ফস করে ছুঁড়ে বসল মারাত্মক তিরটা। কিছু করার ছিল না আমার। আমি বলিওনি তির ছুড়তে। আত্মীয় মরলে যেরকম বুক ভেঙে যায়, সেইরকম কষ্ট হয়েছিল। দড়ি দিয়ে বেধড়ক পিটিয়েছিলাম বিটলে বামনটাকে। কিন্তু তখন যা হবার হয়ে গেছে।

হোমস বললে, চুরুট নাও, স্মল। আমার ফ্লাস্ক থেকে এক ঢোক ব্রান্ডিও খাও। ভিজে একশা হয়ে গেছ দেখছি। এবার বলো তো, মি. শোল্টোর মতো প্রমাণ সাইজের মানুষকে কাবু করে ফেলবে তোমার ওই বিটলে কালো বন্ধুর মতো দুর্বল বেঁটে মানুষ দড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার সময়ে এ-বিশ্বাসটা তোমার মধ্যে ছিল কেন?

আপনি তো দেখছি অনেক খবর রাখেন। এমনভাবে বলছেন যেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজের চোখে দেখেছেন। আসলে আমি ভেবেছিলাম ঘর ফাঁকা থাকবে। বাড়ির কার কী অভ্যেস, সব নখদর্পণে ছিল বলেই জানতাম ও সময়ে মি. শোল্টো নীচের তলায় খেতে যান। লুকোছাপার ধার দিয়েও যাব না, স্যার, সব খুলে বলছি। প্রাণ বাঁচাতে গেলে এখন সত্যি বলা ছাড়া আর পথ নেই। মি. শোন্টোর বদলে বুড়ো মেজর খুন হলে একটুও অনুশোচনা হত না। এই সিগার খাওয়ার মতোই ভাবনাটাকে ফুকে উড়িয়ে দিতাম। কিন্তু কী কপাল দেখুন, যার সঙ্গে কোনো ঝগড়া নেই, সেই ভদ্রলোকের খুনের ব্যাপারে জড়িয়ে পড়লাম আমি।

তোমাকে খুনের দায়ে জড়াবে মি. অ্যাথেলনি জোন্স। আমার ঘরে উনিই তোমাকে নিয়ে আসবেন। তখন যা জান সব খুলে বললে, আমি লিখে নেব। মন খুলে যদি সব বল, তোমার উপকারে আসতে পারি। বিষটায় যে চক্ষের নিমেষে মানুষ মরে, আমি তা প্রমাণ করতে পারব। এত তাড়াতাড়ি মরে যে তুমি ঘরে ঢোকবার আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল মি. শোল্টো।

ঠিক বলেছেন, স্যার। জীবনে ওইরকম চমকাইনি। জানলা দিয়ে ভেতরে ঢুকেই দেখি ঘাড় কাত করে দাঁত খিচিয়ে আমার দিকে চেয়ে আছে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত কেঁপে উঠেছিল সেই দৃশ্য দেখে। মারতে মারতে টোঙ্গাকে আধমরা করে ফেলতাম–হাঁচড়পাঁচড় করে পালিয়ে গেল বলে। গদা আর কিছু কাটা ফেলে গিয়েছিল সেইজন্যেই। আমাকে পরে বলেছিল। সেই জন্যেই মনে হয় আমার পেছন ধরতে সুবিধে হয়েছিল আপনার। কিন্তু কী করে যে পেছন পেছন এলেন ভেবে পাচ্ছি না। তার জন্যে আপনার ওপর আমার রাগ নেই। তবে ভাগ্যের কী পরিহাস দেখুন, তিক্ত হাসল স্মল–পাঁচ লক্ষ পাউন্ডের মালিক হয়েও জীবনের অর্ধেক কাটালাম আন্দামান সাগরে ঢেউ ভাঙার পাথর বসিয়ে, বাকি অর্ধেক কাটাব ডার্টমুর জেলের নর্দমা খুঁড়ে। সওদাগর আখমেতকে যেদিন থেকে দেখছি আর আগ্রা মণিমুক্তোয় নাক গলিয়েছি, সেদিন থেকেই অভিশাপ নেমেছে আমার জীবনে, অভিশাপ থেকে নিষ্কৃতি পায়নি মণিমুক্তোর আসল মালিকও। তাকে মরতে হয়েছে খুনের দায়ে, আতঙ্ক আর অপরাধবোধে ভুগে মরতে হয়েছে মেজর শোল্টোকে, আর আমাকে সারাজীবন বেঁচে মরে থাকতে হবে স্রেফ গোলামগিরি করে।

ঠিক এই সময়ে ছোট্ট কেবিনে মুখ আর কাঁধ গলিয়ে অ্যাথেলনি জোন্স বললে, বাঃ চমৎকার ফ্যামিলি পার্টি জমেছে দেখছি। হোমস, আমাকে ফ্লাস্কটা দিন এক ঢোক খাই। কৃতিত্ব আমাদের সকলেরই অভিনন্দন প্রাপ্য সবার। আরেকটাকে জ্যান্ত ধরতে পারলাম না বলে দুঃখ হচ্ছে বটে, কিন্তু কিছু করার ছিল না। হোমস কাজটা ভালোই করলেন। অরোরাকে টেক্কা মারবার ব্যাপারেও আপনার হাত কম নয়। কী কষ্টে যে কাদা থেকে টেনে তুলতে হয়েছে তা আমিই জানি।

হোমস বললে, সব ভালো যার শেষ ভালো। তবে অরোরা যে এমন দৌড়বাজ তা জানা ছিল না।

স্মিথ বলছিল টেমস নদীতে অরোরার চাইতে জোরে যাওয়ার ক্ষমতা কোনো লঞ্চেরই নেই। একা পড়ে গিয়েছিল বলে, ইঞ্জিন সামলানোর জন্যে আর একজন সঙ্গে থাকলে টিকি ধরতে পারতাম না। তবে হ্যাঁ, নরউড কারবারের বিন্দুবিসর্গ ও জানে না।

চিৎকার করে বলল আমাদের কয়েদি, সত্যিই কিছু জানে না ও। লঞ্চ ভাড়া করেছিলাম অত জোরে যাওয়ার ক্ষমতা আর কোনো লঞ্চের নেই বলে। বলিনি কিছু? তবে টাকা দেদার। আরও দিতাম গ্রেভসএন্ডে এসমারেল্ডা জাহাজে পৌঁছে দিতে পারলে সোজা পালাতাম ব্রেজিলে।

বেশ তো, স্মিথ যদি অন্যায় না-করে থাকে, তাহলে আমরাও দেখব তার ওপর যেন কোনো অন্যায় না হয়। ক্রিমিন্যালকে আমরা যত তাড়াতাড়ি পাকড়াও করি, সাজাটা তত তাড়াতাড়ি দিই না! জোন্সের কথাবার্তা শুনে বেশ মজা পাচ্ছিলাম। ফল নিয়েই সন্তুষ্ট সে–কীভাবে ফললাভ হল তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। এর মধ্যেই কৃতিত্ব গায়ে মাখবার চেষ্টা যে হোমসের কানও এড়ায়নি, তা ওর চোখ-মুখের ফিকে হাসি দেখেই বুঝলাম।

জোন্স বললে, ডক্টর ওয়াটসন রত্নবাক্স সমেত আপনাকে ভক্স-হল ব্রিজে নামিয়ে দেবখন। বুঝতেই পারছেন বড়ো দায়িত্ব নিচ্ছি–এ ধরনের নিয়মবিরুদ্ধ কাজ কর্তারা অনুমোদন করেন না! তবে সঙ্গে একজন ইনস্পেকটর দেব দামি জিনিস নিয়ে যাচ্ছেন বলে। গাড়িতে যাবেন নিশ্চয়?

হ্যাঁ গাড়িতে যাব।

কী মুশকিল দেখুন তো, চাবি নেই যে তালা খুলব। কিন্তু কী আছে সিন্দুকে তার ফর্দ -করলেই নয়! তালাই ভাঙতে হবে দেখছি। ওহে, চাবিটা কোথায়?

নদীর তলায়, ছোট্ট করে জবাব দিল স্মল।।

হুম! খামোকা ঝামেলাটা না-করলেই পারতে। অনেক ঝামেলাই তো পোয়াতে হল তোমার জন্যে। যাই হোক, ডাক্তার হুঁশিয়ার থাকবেন কিন্তু। বাক্স নিয়ে বেকার স্ট্রিটে যাবেন। পুলিশ স্টেশনে যাওয়ার পথে আমার বেকার স্ট্রিটের বাসা হয়ে যাবেন।

ভক্সহলে ভারী লোহার বাক্স সমেত আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেল ওরা সঙ্গে রইল সরল, অমায়িক এই ইনস্পেকটর। মিনিট পনেরো পরে গাড়ি পৌছল মিসেস সিসিল ফরেস্টারের বাড়ি। এত রাতে বাড়িতে লোকের আগমন দেখে অবাক হল পরিচারক। মিসেস সিসিল ফরেস্টার সন্ধে নাগাদ বেরিয়েছেন–ফিরতে খুব রাত হতে পারে। মিস মর্সটান অবশ্য বসবার ঘরে আছেন। অগত্যা বাক্স হাতে আমি বসবার ঘরেই গেলাম–অনুগত ইনস্পেকটরকে রেখে গেলাম গাড়ির মধ্যে।

জানলার পাশে বসে ছিলেন মিস মর্সটান। পরনে সাদা স্বচ্ছ কাপড়ের পোশাক–কাঁধ আর কোমরের কাছে কেবল একটু লালের ছোঁয়া। বাক্স চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থাকায় ঢাকা দেওয়া আলোর নরম আভা খেলা করছে কোমল, গম্ভীর মুখে–যেন ধাতব স্ফুলিঙ্গ চিকমিকিয়ে উঠছে মাথাভরতি কুণ্ডলি পাকানো উদ্দাম কেশরাশির মধ্যে। একটা সাদা হাত ঝুলছে চেয়ারের পাশে–সমস্ত শরীর ঘিরে অদৃশ্য রেখায় বিচ্ছুরিত হচ্ছে যেন গভীর বিষাদ–বসবার ভঙ্গিমার মধ্যেও প্রকট হয়েছে সুগভীর বিষণ্ণতা। আমার পায়ের আওয়াজ পেয়েই অবশ্য লাফিয়ে উঠলেন চেয়ার ছেড়ে এবং ফ্যাকাশে গাল লাল হয়ে গেল আনন্দ আর বিস্ময়ের রোশনাইতে।

বললেন, একটা গাড়ি এল শুনলাম বটে। ভাবলাম তাড়াতাড়ি ফিরে এলেন মিসেস ফরেস্টার–ভাবতেই পারিনি আপনি এসেছেন। বলুন কী খবর আনলেন।

খবরের চাইতেও ভালো জিনিস এনেছি, ভারী লোহার বাক্সটা টেবিলের ওপর বসাতে বসাতে খুশি উচ্ছল প্রাণবন্ত গলায় বললাম বটে, ভেতর ভেতর কিন্তু বুক ভেঙে গেল। এসংসারে যার চাইতে বড়ো খবর আর হয় না, তাই এনেছি আপনার জন্যে। এনেছি কুবেরের ঐশ্বর্য।

লোহার বাক্সর দিকে চাইলেন মিস মর্সাটান। বললেন অত্যন্ত শীতল কণ্ঠে, এই সেই গুপ্তধন?

হ্যাঁ, সেই গুপ্তধন আগ্রার হিরেমুক্তো। অর্ধেক আপনার বাকি অর্ধেক থেডিয়াস শোল্টোর। লাখ দুয়েক পাবেন প্রত্যেকেই। বছরে দশ হাজার পাউন্ড বৃত্তি, ভাবতে পারেন? ইংল্যান্ডে আপনার মতো ধনবতী এখন ক-জন আছেন, আঙুল গুনে তা বলা যায়। বুক দশ হাত হচ্ছে না?

অতি-অভিনয় করে ফেলেছিলাম নিশ্চয়। উচ্ছাসটা যে ফাঁকা এবং অভিনয়টা যে নিষ্প্রাণ–তা লক্ষ করেই একটা ভুরু বেঁকিয়ে অদ্ভুতভাবে আমার দিকে চাইলেন মিস মর্সটান।

বললেন, এ-রত্ন আমার হলেও জানবেন ঋণী রইলাম আপনার কাছে।

আরে না, বললাম প্রতিবাদের সুরে আমার কাছে নয়–ঋণী থাকুন আমার বন্ধু শার্লক হোমসের কাছে। দুনিয়ার সমস্ত ইচ্ছাশক্তি জড়ো করলেও রত্ন উদ্ধারের সূত্র আমি বার করতে পারতাম না। ওর মতো প্রতিভাও ঘোল খেয়ে গেছে শেষ মুহূর্তেও হাত ফসকে যাচ্ছিল আর কী।

বসুন ডক্টর ওয়াটসন, বলুন গোড়া থেকে।

শেষ সাক্ষাতের পর কী ঘটেছে সবিস্তারে বর্ণনা করলাম। বললাম কীভাবে তদন্তকে নতুন ধারায় চালনা করেছে হোমস, অরোরাকে আবিষ্কার করলাম কী কৌশলে। অ্যাথেলনি জোন্স হালে পানি না-পেয়ে এল কীভাবে এবং রাতের অভিযানে বেরিয়ে টেমস নদীর জলে কী সাংঘাতিক দৌড়। দৌড়ে তবে পাকড়াও করলাম অরোরাকে। দ্বিধাবিভক্ত ঠোট আর ঝিকিমিকি চোখ নিয়ে নৈশ অ্যাডভেঞ্চারের ধারাবিবরণী তন্ময় চিত্তে শুনলেন মিস মর্সটান। অল্পের জন্যে বিষ-মাখানো তিরের মরণ চুম্বন থেকে বেঁচে গিয়েছি কীভাবে, শুনে সাদা হয়ে গেল মুখ—ভয় হল অজ্ঞান না হয়ে যান।

হন্তদন্ত হয়ে এক গেলাস জল এগিয়ে ধরতে বললেন, ও কিছু না– এই তো সামলে নিয়েছি। এ-রকম একটা ভয়ংকর বিপদের মধ্যে বন্ধুদের ঠেলে দিয়েছি ভেবে বুকটা কেমন যেন করে উঠেছিল।

বিপদ আর নেই। তা ছাড়া ভয়ংকর কিছুও তো নয়। যাকগে গা শিউরানো আর কিছু বলব না আপনাকে। ভালো ভালো কথা বলা যাক। এই নিন আপনার রত্নবাক্স! এর চাইতে ভালো কথা আর কী থাকতে পারে বলুন? প্রাণে বেঁচে ফিরে এসেছি শুধু এই বাক্স নিজের হাতে আপনাকে হাতে তুলে দেব বলে আপনিই এই ঐশ্বর্য সবার আগে দেখলে খুশি হবেন বলে।

তা হব বললেন বটে কিন্তু খুশির ঝলক ফুটল না কণ্ঠে। আসলে খুশি হব কথাটা বললেন স্রেফ সৌজন্যের খাতিরে। প্রাণ যেতে বসেছিল যে জিনিসের জন্যে, তা বয়ে নিয়ে আসার পর খুশি না-হলে মনে আঘাত পাব বলেই বললেন আমার মন রাখতে।

বললেন বাক্সের ওপর ঝুঁকে পড়ে, ভারি সুন্দর বাক্স তো! ভারতীয় কারুকার্য! তাই না?

হ্যাঁ। কাশীর ধাতুর কাজ।

ভারীও কম নয়! দু-হাতে বাক্সটাকে তোলবার চেষ্টা করে সবিস্ময়ে বললেন মিস মর্সটান শুধু বাক্সটার দামই কি কম! চাবি কোথায়?

টেমসের জলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে স্মল। মিসেস ফরেস্টারের চুল্লি খুঁচোনোর ডান্ডাটা বরং আনি।

উপবিষ্ট বুদ্ধমূর্তি খোদাই করা ভারী মোটা আলতারাপ লাগানো ছিল সিন্দুকের সামনে। লোহার ডান্ডা ঢুকিয়ে চাড় মারলাম। খটাং করে উপড়ে বেরিয়ে এল আলতারাপ। কম্পিত আঙুলে তুলে ফেললাম ডালা। চমকিত চিত্তে ফ্যাল ফ্যাল করে দু-জনে তাকিয়ে রইলাম বাক্সের গর্ভে। বাক্স একেবারেই শূন্য!

লোহার কারুকাজ করা চাদরটা এক ইঞ্চির দুই তৃতীয়াংশ পুরু। আগাগোড়া এই চাদরে মোড়া বলেই বাক্স এত ভারী। খুব দামি জিনিস বইবার উপযুক্ত করেই মজবুত, নিরেট ভাবে তৈরি বাক্স। অথচ একরতি সোনা বা হিরে মানিকও নেই ভেতরে। একদম খালি–বিলকুল শূন্য-গর্ভ!

শান্ত কণ্ঠে বললেন মিস মর্সটান, রত্ন উধাও।

কথাটা শুনলাম, মানেটা বুঝলাম এবং যেন একটা বিশমনি পাথর বুক থেকে নেমে গেল।

অলক্ষুণে এই আগ্রা-ঐশ্বর্যই যে বোঝা হয়ে মুষড়ে রেখেছিল আমাকে বোঝা নেমে যাওয়ার আগে পর্যন্ত তো এভাবে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারিনি। উপলব্ধিটা স্বার্থপরের উপলব্ধি, তা মানছি। অন্যায়, অনুচিত এবং অবিশ্বস্ত, তাও স্বীকার করছি। কিন্তু সেই মুহূর্তে একটা চিন্তায় তুরীয় আনন্দে মেতে উঠেছিলাম–স্বর্ণ প্রাচীর অদৃশ্য হয়েছে দুটি হৃদয়ের মাঝখান থেকে।

বাঁচলাম! অন্তরের অন্তস্থল থেকে ছিটকে এল মনের কথা।

ও-কথা কেন বললেন? শুধোলেন মর্স্টাটান।

তোমাকে আবার আমার নাগালের মধ্যে ফিরে পেলাম বলে! তোমাকে সত্যিই ভালোবাসি বলে। পুরুষ নারীকে যেভাবে হৃদয় দেয়, সেইভাবে আমি তোমায় হৃদয় দিয়েছি বলে, এই ঐশ্বর্য ও কথা বলার পথ বন্ধ করে রেখেছিল বলে।দুহাতে মেরির হাত তুলে নিয়ে বললাম আমি মেরিও হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল না।ঐশ্বর্য আর নেই, কথাটা বলতেও আর বাধা নেই। মেরি বাঁচালাম বললাম সেই কারণেই।

বলে দু-হাতে ওকে টেনে নিলাম কাছে। ফিসফিস করে ও বললে, তাহলে আমিও বলি তোমার মতো–আঃ! বাঁচলাম!

সেই রাতে বিশ্বের কেউ হয়তো খুইয়েছে ঐশ্বর্য, আমি কিন্তু পেয়েছি আর এক ঐশ্বর্য।