সেই উ সেন – ২.৮

আট

রাত দুটো পর্যন্ত গোটা পঞ্চাশেক ফোন করলেন ক্লড র‍্যাঁবো। বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলেন তিনি। কয়েকটা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রীয় অফিসের সাথে যোগাযোগ করে জোন নিলেন কোন ডেনিশ পাদ্রী তাদের অফিসে কোন কারণে গেছে কিনা। ঘুমে বুজে আসছে চোখ, অথচ অফিস ছেড়ে যাওয়াও সম্ভব নয়—যে-কোন মুহূর্তে জরুরী মেসেজ এসে পড়তে পারে। চার্লস ক্যারনকে সতর্ক থাকার অনুরোধ জানিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজলেন তিনি। এবং সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়লেন।

আধঘণ্টাও কাটেনি, তাঁর ঘুম ভাঙাল চার্লস ক্যারন।

‘দুঃখিত, চীফ,’ বলল সে, ‘একটা আইডিয়া এসেছে মাথায়, এই মুহূর্তে আপনার তা জানা দরকার। লোকটার কাছে এখন একটা ডেনিশ পাসপোর্ট রয়েছে, ঠিক কিনা?’

টকটকে লাল চোখ মেললেন ক্লড র‍্যাঁবো। অসীম ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে বললেন, ‘বলে যাও।

‘সম্ভাব্য মাত্র দুটো উপায়ে পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে পারে সে। হয় চুরি করেছে, নয়তো জাল করেছে। পাসপোর্টের ফটোর সাথে মিল আনার জন্যে চুলের রঙ বদল করতে হয়েছে তাকে, এ থেকে ধরে নেয়া যেতে পারে পাসপোর্টটা জাল নয়, চুরি করা।’

‘যুক্তিসঙ্গত। গো অন।’

যতদূর অনুমান করতে পারি আমরা, প্রথমবার রোম থেকে লন্ডনে পৌঁছেছিল সে প্রস্তুতিমূলক কাজগুলো সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে। সুতরাং ধরা যাক, পাসপোর্টটা সে লন্ডনেই চুরি করেছে।’

চেয়ারে নড়েচড়ে সিধে হয়ে বসলেন ক্লড র‍্যাঁবো। বললেন, ‘প্রস্তুতি নেবার জন্যে প্যারিসেও এসেছিল সে।’

‘জ্বী। তার মানে হয় প্যারিস নয় লন্ডন থেকে পাসপোর্টটা চুরি করেছে সে। এখন, প্রশ্ন করা যেতে পারে, পাসপোর্ট চুরি গেলে একজন বিদেশী ধর্মযাজকের কি করা উচিত? নিশ্চয়ই সে সাহায্যের জন্যে তার কনস্যুলেটের কাছে যাবে, ঠিক কিনা?

‘ধন্যবাদ, মাই ডিয়ার বয়। এক্ষুণি তাহলে ফোনে যোগাযোগ করো ম্যালকম লয়েডের সাথে। তারপর ফোন করো প্যারিসের ডেনিশ কন্সাল জেনারেলকে।

দুই ভদ্রলোককে বিছানা ত্যাগ করে যার যার অফিসে ছুটতে রাজি করাবার জন্যে পুরো এক ঘণ্টা ব্যয় করলেন ক্লড র‍্যাঁবো। রাত চারটের সময় ন্যাশনাল সুরেত-এর হেডকোয়ার্টার থেকে তাঁকে জানানো হলো, মধ্যরাত পর্যন্ত নয়শো আশিজন পাদ্রীর হোটেল রেজিস্ট্রেশন কার্ড পেয়েছে তারা, সেগুলো বাছাইয়ের কাজ এগিয়ে চলেছে দ্রুত।

সকাল ছয়টা। এখনও চেয়ারে জেগে বসে আছেন ক্লড র‍্যাঁবো। তাঁর অত্যন্ত অনুগত একজন সহকারী ফোন করল এই সময়। জানাল, ‘চীফ, আপনার অনুমানই সত্যি। টেপে ধরা পড়েছে একটা মেসেজ পাচারের ঘটনা। এক্ষুণি আমাদের ল্যাবরেটরিতে চলে আসুন দয়া করে।’

গাড়ি নিয়ে ছুটলেন ক্লড র‍্যাঁবো। সাথে চার্লস ক্যারনকেও নিলেন। তাঁর নির্দেশে সাথে কারবাইনটাও নিতে হলো ক্যারনকে।

নিজস্ব ডিপার্টমেন্টের বেসমেন্ট কম্যুনিকেশন ল্যাবরেটরিতে পৌঁছে একটা টেপ-রেকর্ডিং শুনলেন ক্লড র‍্যাঁবো। জোরেশোরে ক্লিক করে একটা শব্দের সাথে শুরু হলো, তারপর স্পষ্ট শোনা গেল টেলিফোনের ডায়াল ঘোরাবার আওয়াজ। গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছেন তিনি। আওয়াজের সংখ্যা গুনে তিনি বুঝলেন সাত সংখ্যার নাম্বারে টেলিফোন করা হয়েছে। এরপর ফোনের বেল বাজার শব্দ হচ্ছে। একটু পর রিসিভার তোলার আওয়াজ পাওয়া গেল। রিসিভার কেউ তুলল বটে, কিন্তু কোন কথা বলল না সে। কথা বলতে শুরু করল প্রথম পক্ষ, যে টেলিফোন করছে।

অত্যন্ত স্পষ্ট কিন্তু নিচু গলায় মেয়েটা বলে চলেছে, ‘লুইসা পিয়েত্ৰো বলছি। নারার নতুন ছদ্মবেশ ধরা পড়ে গেছে। ফ্রেঞ্চ প্রশাসন এখন একজন ডেনিশ ধর্মযাজককে খুঁজছে। প্যারিসের প্রত্যেক ধর্মযাজককে চেক করা হবে…

শ্লথ গতিতে ঘূর্ণায়মান টেপের স্কুলের দিকে চিন্তিতভাবে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকলেন ক্লড র‍্যাঁবো। টেলিফোনের রিসিভার নামিয়ে রাখার শব্দ হলো।

কত নম্বরে ফোন করল জানতে পেরেছ?’

‘জী, মশিয়ে। Mol।tor 5900.‘

‘ঠিকানা?’

অনুগত সহকারী ক্লড র‍্যাঁবোর হাতে ছোট্ট একটা চিরকুট তুলে দিল। সেটায় চোখ বুলালেন তিনি। দুটো ঠিকানা লেখা রয়েছে কাগজে। একটা ঠিকানা তাঁর অত্যন্ত পরিচিত। কর্নেল প্যাপনের বাড়ির ঠিকানা। দ্বিতীয় ঠিকানাটা বিদেশী দূতাবাস এলাকার, ঠিকানার সাথে কোন নাম নেই।

‘চলো,’ মৃদু কণ্ঠে বললেন ক্লড র‍্যাঁবো।

গাড়িতে ওঠার সময় চার্লস ক্যারন আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারল না। ‘প্রথমে কোথায় যাব আমরা, চীফ?’

মৃদু হাসলেন ক্লড র‍্যাঁবো। রহস্য ভাঙলেন না, তা আরও গভীর করে তুললেন তিনি। বললেন, ‘এক জায়গাতেই যাব। সান্তিনো ভ্যালেন্টি ওরফে আলেকজান্ডার জেমস কোয়েনটিন অরগ্যান ওরফে পাদ্রী বেনসনের সাথে কথা বলতে।’

দূতাবাস পাড়ার ছোট্ট একতলা বাড়িটায় একা রয়েছেন ক্লড র‍্যাঁবো। বন্দিনীকে কড়া সশস্ত্র প্রহরায় পাঠিয়ে দিয়েছেন তিনি। দুটো মাত্র কামরা নিয়ে বাড়িটা। একটা সুটকেসে কিছু কাগজপত্র পেয়েছেন তিনি, আর কোথাও কিছু নেই। সেই কাগজপত্রগুলো নিবিষ্ট মনে পরীক্ষা করছেন, এমন সময় প্রত্যাশিত টেলিফোনটা এল। চট করে চোখের সামনে হাত তুলে রিস্টওয়াচ দেখে নিলেন তিনি। সাতটা দশ। মৃদু হাসির রেখা ফুটল তাঁর ঠোঁটে, পরক্ষণে গম্ভীর হলেন। একটু কেশে পরিষ্কার করে নিলেন গলাটা। ঠিকঠাক করে নিচ্ছেন টাইয়ের নট, চশমাটা একটু ঠেলে জায়গা মত বসিয়ে নিলেন। আশ্চর্য রোমাঞ্চ অনুভব করছেন তিনি। সেই সাথে একটু নার্ভাস হয়ে পড়েছেন। হাত বাড়িয়ে রিসিভারটা তুললেন তিনি।

‘হ্যালো?’

কণ্ঠস্বর কানে যেতেই মুহূর্তে অনেক কিছু বুঝে নিলেন ঝানু গোয়েন্দা ক্লড র‍্যাঁবো। ভরাট কণ্ঠস্বরে আত্মবিশ্বাসের দৃঢ়তা টের পাওয়া যাচ্ছে। উচ্চারণ ভঙ্গিতে প্রমাণ হয় এ লোক মার্জিত রুচির বুদ্ধিমান লোক।

রিসিভারে হাত চাপা দিয়ে টেপ-রেকর্ডারের সুইচ অন করলেন ক্লড র‍্যাঁবো। দ্রুত হাত সরিয়ে নিলেন রিসিভার থেকে। টেপ-রেকর্ডার থেকে বেরিয়ে এল রূপার কণ্ঠস্বর, ‘পার বলছি।’

‘নতুন খবর?’

‘নেই,’ টেপ-রেকর্ডার থেকে রূপা বলছে, ‘করেজে পৌঁছে সূত্র হারিয়ে ফেলেছে ওরা।’

বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠেছে ক্লড র‍্যাঁবোর কপালে। ক্ষীণ একটু সন্দেহের উদ্রেক হলেই যেখানে আছে সেখান থেকে নিমেষে গায়েব হয়ে যাবে লোকটা। বন্দিনী পারকে বিশ্বাস করতে পারেননি তিনি। চেহারা দেখে এবং দু’মিনিটের আলাপেই তিনি বুঝে নিয়েছেন বিপদের তোয়াক্কা করার মেয়ে এ নয়, ভয় দেখিয়েও কোন কাজ হবে না—কথা বলতে দিলে কোন সন্দেহ নেই নারাকে ফাঁদটা সম্পর্কে সাবধান করে দেবে সে। এতবড় সুযোগটা ঝুঁকি নিয়ে নষ্ট করতে চাননি তিনি। তাই পারূকে দিয়ে টেপ করিয়ে নিয়েছেন কয়েকটা নির্বাচিত বাক্য। ক্লিক করে একটা শব্দ হলো। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল তাঁর। অপরপ্রান্তে রিসিভার নামিয়ে রেখেছে নারা।

রিসিভার ফেলে দিয়ে উন্মাদের মত ছুটলেন ক্লড র‍্যাঁবো। কামরা থেকে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে এলেন তিনি। ‘স্টার্ট!’ হুঙ্কার ছেড়ে নির্দেশ দিলেন উঠানে দাঁড়ানো পুলিস কার আর ভ্যানগুলোকে। পর মুহূর্তে উঁচু বারান্দা থেকে লাফ দিলেন। ‘উহ্—মরে গেছি!’ দুহাত দিয়ে কোমর চেপে ধরে ককিয়ে উঠলেন তিনি। ব্যথায় বিকৃত হয়ে উঠেছে চোখ মুখ। পুলিস কার থেকে একজন কনস্টেবল নেমে এল। লোকটা সাহায্যের হাত এগিয়ে দিতে তাকে শুধু মারতে বাকি রাখলেন ক্লড র‍্যাঁবো। ‘রেডিও অন করো, ইডিয়ট! টেলিফোন অপারেটর কি বলে শোনো!’

লোকটা ছুটে গিয়ে বসল পুলিস কারের ড্রাইভিং সীটে। হেডফোন জোড়া দুই কানে এঁটে নিয়ে ব্যস্তভাবে সুইচ অন করল সে রেডিওর। ‘উহ্ আহ্,’ করতে করতে গাড়ির দিকে এগিয়ে আসছেন ক্লড র‍্যাঁবো। একটু নড়লেই খ্যাঁচ করে ব্যথা লাগছে কোমরের কাছে। কোন রকমে গাড়িতে উঠে বসলেন তিনি।

ইতোমধ্যে দুটো পুলিস ভ্যান স্টার্ট নিয়েছে। পুলিস কারের ড্রাইভার কান থেকে হেডফোন নামিয়ে পাশে বসা ক্লড র‍্যাঁবোকে জানাল, ‘কোয়াই দেস গ্র্যান্ডস অগাস্টিনের কাছে একটা হোটেল থেকে ফোন করা হয়েছে। চিনি আমি…’

‘সাইরেন বাজাও!’ গর্জে উঠলেন ক্লড র‍্যাঁবো। দশ মিনিটের মধ্যে পৌছুতে চাই ওখানে।’

স্টার্ট নিয়ে ছোট্ট বাড়িটা থেকে বেরিয়ে এল পুলিস কার। পিছু নিল সাব- মেশিনগানধারী পুলিস ভর্তি দুটো ভ্যান। তীক্ষ্ণ সাইরেনের শব্দ তুলে ছুটে চলেছে কনভয়টা।

.

শ্যেন নদীর তীরে ছোট একটা হোটেল। কাঁচ ঘেরা টেলিফোন বুদে দাঁড়িয়ে আছে রানা। নিঃশব্দে রেখে দিল রিসিভারটা। হতভম্ব দেখাচ্ছে ওকে। চিন্তার ঝড় বয়ে যাচ্ছে মাথার ভিতর। নেই? নেই মানে? অসম্ভব! নতুন কোন খবর না থেকেই পারে না। এক জায়গায় অচল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার মানুষ কমিশেয়ার ক্লড র‍্যাঁবো নন। তাঁর নেতৃত্বে ফ্রেঞ্চ পুলিসের লোকেরা নিশ্চয়ই ইতোমধ্যে ঈগলটনের ট্যাক্সি ড্রাইভারকে খুঁজে বের করেছে। সূত্র ধরে হাউতে শেলনেয়ারে পৌঁছানো পানির মত সহজ ব্যাপার। ব্যারনেস সিবার চাকরবাকরদের কাছ থেকে দুর্গে ওর উপস্থিতি সম্পর্কে সব খবরও নিশ্চয়ই পেয়ে গেছেন ক্লড র‍্যাঁবো। রেনোয়া গাড়িটার খোঁজে চারদিকে লোক পাঠিয়ে তুল-এ সেটা পরিত্যক্ত অবস্থায় আবিষ্কার করতেও বোধহয় বেগ পেতে হয়নি। গাড়িটা পেয়েই তারা স্টেশনের কর্মচারীদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। এবং নিশ্চয়ই…তাছাড়া, আড়ষ্ট কেন রূপা আজ?

টেলিফোন বুদ থেকে দ্রুত বেরিয়ে সোজা উপরতলায় উঠে নিজের কামরায় ঢুকল রানা। লাগেজ নিয়ে নেমে এল তখুনি। রিসেপশনের কেরানীকে বলল, ‘আমার বিল দিন।’

.

সাতটা পঁচিশ। কোয়াই দেস গ্র্যান্ডস অগাস্টিন এলাকার ছোট হোটেলটার সামনে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল পুলিস কার। সেটাকে পাশ কাটিয়ে ছুটে গেল একটা পুলিস ভ্যান। দ্বিতীয় ভ্যানটা থামল কারের পিছনে। ভ্যান থেকে ঝপাঝপ নামল কারবাইনধারীরা। দেড় মিনিটের মধ্যে পঞ্চাশজন সশস্ত্র পুলিস ঘিরে ফেলল হোটেলটাকে। সাঁইত্রিশ নম্বর কামরাটাকে তছনছ করে ফেলল ওরা!

‘দুঃখিত, মশিয়ে,’ দুঃখের সাথে নয়, ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে কথা বলছে হোটেল মালিক, ‘পাদ্রী বেনসন মিনিট সাতেক আগে হোটেল ছেড়ে চলে গেছেন…

আহত কোমরে হাত রেখে ব্যথা সামলাচ্ছেন ক্লড র‍্যাঁবো। হোটেল মালিকের কথা শুনে হঠাৎ যেন সাংঘাতিক বেড়ে গেছে তাঁর কোমরের ব্যথাটা। চোখমুখ বিকৃত হয়ে উঠল তাঁর। অস্ফুট দুটো শব্দ বেরিয়ে এল শুধু, ‘হায় কপাল!’

.

আটটায় নিজের অফিসে ফিরে এসে ম্যালকম লয়েডের একটা মেসেজ পেলেন ক্লড র‍্যাঁবো। তথ্য সরবরাহে দেরি হওয়ার জন্যে দুঃখ প্রকাশ করে ম্যালকম লয়েড জানিয়েছে: মশিয়ে, আপনার অনুমানই ঠিক। সেপ্টেম্বরের চোদ্দ তারিখে একজন ডেনিশ ধর্মযাজক পাসপোর্ট হারাবার একটা ঘটনা রিপোর্ট করেছিল ডেনিশ কনস্যুলারের অফিসে। পাদ্রীর সন্দেহ, ওয়েস্ট এন্ডের একটা হোটেল থেকে চুরি গেছে সেটা, কিন্তু তার সন্দেহের পক্ষে সে কোন প্রমাণ হাজির করতে পারেনি। হোটেল ম্যানেজারের অনুরোধে ঘটনাটা সে পুলিসকে জানায়নি। তার পরিচয় কোপেনহেগেনের Pastor Per Benson. বেনসনের দৈহিক বর্ণনা এই রকম : ছয়ফিট লম্বা, নীল চোখ, লোহায় ধরা মরচের মত চুলের রঙ।

রেলওয়ে স্টেশন গার ডি’ অস্টারলিজ়ে পৌঁছে থামল ট্যাক্সিটা। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে নেমে পড়ল রানা। গত সন্ধ্যায় ট্রেন থেকে এখানেই নেমেছিল ও, ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়ে যাবার সময় সাইরেন বাজিয়ে পুলিস কনভয়কে স্টেশনে ঢুকতেও দেখেছিল। স্টেশনে ওকে না পেয়ে ক্লড র‍্যাঁবো নিশ্চয়ই সার্চ পার্টি অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছেন, এই ভেবে আজ আবার এখানে পা দিতে সাহস পাচ্ছে ও। মার্ক রোডিনের কাপড়-চোপড়, মিলিটারি গ্রেটকোট এবং রাইফেল ভর্তি সুটকেসটা লেফট-লাগেজ অফিসে জমা দিল ও। সাথের একমাত্র সুটকেসটায় রয়েছে আমেরিকান ছাত্র স্মার্টি টোয়েনের পোশাক-আশাক এবং কাগজপত্র। মেকআপের সরঞ্জাম রেখেছে ও হ্যান্ডগ্রিপটায়।

এখনও কালো স্যুটটা পরে আছে রানা। তবে ডগ কলারটাকে পোলো সোয়েটার দিয়ে ঢেকে রেখেছে। স্টেশন থেকে বেরিয়ে রাস্তার মোড়ের একটা সস্তা হোটেলে উঠল ও। রেজিস্ট্রেশন কার্ড পূরণ করার দায়িত্বটা ওর উপরই ছেড়ে দিল ডেস্ক ক্লার্ক। অলস লোকের কাজে খুঁত থাকে, এর বেলায়ও তাই ঘটল। আগন্তুকের পাসপোর্টের সাথে পূরণ করা রেজিস্ট্রেশন কার্ডটা মিলিয়ে দেখল না সে। লোকটার স্বভাব বুঝতে পৈরে সুযোগটা পুরোপুরি গ্রহণ করল রানা। রেজিস্ট্রেশন কার্ডে পাদ্রী বেনসনের নামটা পর্যন্ত উল্লেখ করেনি ও।

নিজের ঘরে ঢুকে মুখ আর চুল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল রানা। লোহায় মরচে ধরা লালচে রঙ চুল থেকে ধুয়ে বিদায় করল। চুল তার চকচকে কালো চেহারা ফিরে পেল আবার। এর-উপর কলপ লাগাল রানা। স্মার্টি টোয়েনের নারকেল ছোবড়ার মত ব্রাউন চুলের মালিক বনে গেল ও। নীলচে কন্ট্যাক্ট লেন্স জোড়া একই জায়গায় থাকল, কিন্তু গোল্ড রিমের বদলে এল মোটা ফ্রেমের আমেরিকান এগজিকিউটিভ স্পেকট্যাকলস। সুটকেসে চালান হয়ে গেল কালো ওয়াকিং শু, মোজা, শার্ট, বিব এবং ক্যারিক্যাল স্যুট, সাথে গেল কোপেনহেগেনের পাদ্রী বেনসনের পাসপোর্ট। স্নেকার্স, মোজা, জিনস, টি-শার্ট এবং উইন্ডচিটার পরল রানা। ছদ্মবেশ নেয়া পূর্ণাঙ্গ হলো। ও এখন নিউ ইয়র্ক স্টেটের মার্কিন ছাত্র স্মার্টি টোয়েন।

দুপুরের একটু আগে রওনা দেবার প্রস্তুতি শেষ করল রানা। একদিকের ব্রেস্ট পকেটে মার্কিন ছাত্রের পাসপোর্ট রেখেছে ও, আরেক পকেটে ফ্রেঞ্চ ফ্র্যাঙ্কের এক তাড়া নোট। ধর্মযাজকের সমস্ত জিনিসপত্রে ঠাসা সুটকেসটা লুকিয়ে ফেলা হয়েছে ওয়ারড্রোবের ভিতর। ওয়ারড্রোবের চাবিটা পানি নিষ্কাশনের ঝাঁঝরি পথে অদৃশ্য হয়ে গেছে। হোটেল ত্যাগ করল রানা ফায়ার এস্কেপের পথ ধরে। কেউ জানল না।

কয়েক মিনিট পর গার ডি’অস্টারলিজের লেফট-লাগেজ অফিসে আবার হাজির হলো রানা। হ্যান্ডগ্রিপটা জমা দিয়ে স্লিপ নিল, সেটা প্রথম সুটকেসের স্লিপের সাথে রাখল ব্যাক পকেটে, তারপর বেরিয়ে পড়ল নিজের পথে।

ট্যাক্সি নিয়ে লেফট ব্যাঙ্কে ফিরল রানা। বুলেভার্ড সেন্ট মিচেল এবং রু দে লা হচেটির মোড়ে ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে প্যারিসের ল্যাটিন কোয়ার্টার এলাকার ছাত্র এবং সতেজ-প্রাণ যুবকদের ঠাসা ভিড়ে মিশে গেল ও।

ফুটপাথ ঘেঁষে খুদে এক রেস্তোরাঁয় লাঞ্চ খেতে ঢুকল রানা। রাতটা কোথায় কাটাবে তাই নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছে। মনে কোন সন্দেহ নেই যে ইতোমধ্যে ক্লড র‍্যাঁবো ওর ধর্মযাজকের ছদ্ম পরিচয় আবিষ্কার করে ফেলেছেন। স্মার্টি টোয়েনকে চব্বিশ ঘণ্টার বেশি সময় দেবেন না তিনি।

অসহায় বোধ করছে রানা। কিন্তু এই অবস্থায় হাসিও পেল ওর। কে জানত, ভাবছে সে, যাকে শ্রদ্ধা করি সেই লোকই আজ সবচেয়ে ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। ‘ড্যাম দ্যাট ম্যান, র‍্যাঁবো, মনে মনে উচ্চারণ করল ও। কিন্তু উজ্জ্বল হাসল সুন্দরী ওয়েট্রেসকে দেখে, বলল, ‘থ্যাঙ্কস, ‘হানি।’

.

বেলা দশটায় প্যারিস থেকে ক্লড র‍্যাঁবোর ফোন পেল ব্রিটিশ স্পেশাল ব্রাঞ্চের সুপার ম্যালকম লয়েড। ফ্রেঞ্চ গোয়েন্দা প্রধানের অনুরোধ বেশ একটু বিচলিত এবং বিরক্ত করল তাকে। কিন্তু প্রকাশ্যে সে অত্যন্ত সমীহের সাথে কমিশেয়ার ক্লড র‍্যাঁবোকে জানাল, মশিয়ে, আমার সাধ্য মত সব করব আমি।’

ফোন ছেড়ে দিয়ে গত হপ্তার তদন্তে অংশগ্রহণকারী সিনিয়র একজন ইন্সপেক্টরকে ডেকে পাঠাল ম্যালকম লয়েড। তাকে বলল, ‘ফরাসীরা আবার সাহায্য চাইছে, বুঝলে? আবার তারা হারিয়ে ফেলেছে লোকটাকে। প্যারিসের মাঝখানে কোথাও ঘাপটি মেরে আছে সে। মশিয়ে ক্লড র‍্যাঁবোর বিশ্বাস, নতুন আরেক ছদ্ম-পরিচয় গ্রহণ করার মাল-মশলা তার সাথে আছে। অর্থাৎ, এর জন্যে নিশ্চয়ই কারও পাসপোর্ট চুরি করেছে সে।’

‘আমাদের কাজ হলো লন্ডনের সব ক’টা কনস্যুলেটে ফোন করে ট্যুরিস্টদের পাসপোর্ট চুরি বা হারানোর যতগুলো ঘটনা ঘটেছে তার একটা তালিকা সংগ্ৰহ করা, কেমন?’

রাইট। নিগ্রো আর এশিয়ানদেরকে বাদ দিয়ে, শুধু ককেশিয়ানদের তালিকা যোগাড় করতে হবে। প্রতিটি ক্ষেত্রে লোকটার শারীরিক দৈর্ঘ্য জানতে চাই আমি। পাঁচ ফিট আট ইঞ্চির ওপর সব লোক আমাদের সন্দেহের আওতায় পড়বে। নাও, ফোনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে শুরু করে দাও কাজ।’

.

প্যারিস। দৈনন্দিন মীটিংয়ের সময় বেলা দুটোয় এগিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে।

সাদাসিধে, অনাড়ম্বর ভঙ্গিতে তাঁর রিপোর্ট পড়া শেষ করলেন ক্লড র‍্যাঁবো। কারও মধ্যে উৎসাহ বা আগ্রহের ছিটেফোঁটাও দেখা গেল না। নৈরাশ্যে গুম মেরে আছে পরিবেশটা।

‘সাক্ষাৎ শয়তান!’ অবশেষে ক্রোধ আর হতাশার বহিঃপ্রকাশ ঘটল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর মুখ থেকে, ‘লোকটা যেন শয়তানের ভাগ্য নিয়ে জন্মেছে! গোটা ফ্রেঞ্চ প্রশাসনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চ্যালেঞ্জ করেছে, অথচ এখন পর্যন্ত আমরা তার আসল পরিচয় বা চেহারা সম্পর্কে কিছুই জানতে পারিনি। আমাদের জন্যে এ বড় লজ্জার কথা।’

‘না, মশিয়ে। সবটা তার ভাগ্য নয়। সবটা আমাদের ত্রুটি বা অযোগ্যতা ও নয়।’ কথা শেষ করে চুরুটে অগ্নিসংযোগ করলেন ক্লড র‍্যাঁবো।

বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সবাই তাঁর দিকে।

‘প্রতিটি পর্যায়ে কতদূর এগিয়েছি আমরা সে সম্পর্কে নিয়মিত খবরাখবর সরবরাহ করা হয়েছে তাকে,’ এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে আবার বললেন ক্লড র‍্যাঁবো। ‘সেজন্যেই তাড়াহুড়ো করে সে গ্যাপ শহর ত্যাগ করে, সেজন্যেই জাল গুটাবার ঠিক আগের মুহূর্তে ব্যারনেস সিবাকে খুন করে লা হাউতে শেলনেয়ারের দুর্গ থেকে কেটে পড়ে সে। রোজ রাতে এই সভাকে আমার অগ্রগতির রিপোর্ট পড়ে শুনিয়েছি আমি। তিনবার মাত্র কয়েক মিনিটের জন্যে তাকে আমরা ধরতে পারিনি। পার নামের একটি মেয়েকে আজ সকালে গ্রেফতার করা হয়েছে বটে, কিন্তু তার সাথে কথা বলে এখন পর্যন্ত কোন লাভ হয়নি। হয় সে কথা ফাঁস করে দেয়ার চেয়ে মৃত্যুকে শ্রেয় মনে করছে, নয়তো, আসলে সে কিছুই জানে না। সম্পূর্ণ দায়িত্ব স্বীকার করে বলছি, আজ সকালে মস্ত একটা ভুল করে ফেলেছি আমি। প্রেসিডেন্টের হবু হত্যাকারীর সাথে পারূকে কথা বলতে দেয়াই বোধহয় উচিত ছিল। তা না করে পারূর কিছু কথা টেপ করিয়ে নিই আমি, এবং লোকটা যখন ফোন করে তখন টেপ-রেকর্ডার অন করে দিই। লোকটার প্রশ্নের স্বাভাবিক উত্তর ‘ হওয়া উচিত তাই বেরিয়েছে টেপ থেকে, কিন্তু অজ্ঞাত কোন কারণে লোকটার এনে সন্দেহের উদ্রেক হয়। সেই মুহূর্তে স্থান ত্যাগ করে সে। কয়েক মিনিট পর সেখানে গিয়ে আমরা তাকে পাইনি। এর জন্যে আমি দায়ী। কিন্তু বাকি দুটো ক্ষেত্রে ভোর রাতের দিকে টেলিফোন করে সাবধান করে দেয়া হয়েছিল তাকে।

বিস্ময় আর অবিশ্বাসে স্তব্ধ হয়ে গেছে সবাই, গোগ্রাসে গিলেছে এতক্ষণ ক্লড র‍্যাঁবোর প্রতিটি শব্দ, তিনি থামতেও একচুল নড়ল না কেউ। স্পষ্ট বেঈমানীর, বিশ্বাসঘাতকতার, ডাবল-ক্রসিং-এর অভিযোগ করেছেন তিনি।

অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা গলায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বললেন, ‘আমার মনে পড়ছে, এর আগেও এ-ধরনের সন্দেহের কথা বলেছেন আপনি, মশিয়ে ক্লড রাবো। দয়া করে জানাবেন কি, আপনার সন্দেহের পক্ষে কি যুক্তি আছে?’

সন্দেহ নয়, মশিয়ে। যুক্তিও নয়। আমি বাস্তব ঘটনার কথা বলছি। যা ঘটেছে তার প্রমাণও রয়েছে আমার কাছে।’ কথা শেষ করে ছোট একটা পোর্টেবল টেপ- রেকর্ডার কোটের সাইড পকেট থেকে বের করে টেবিলে রাখলেন ক্লড র‍্যাঁবো। বোতাম টিপে অন করলেন সেটা।

প্রচণ্ড উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে সবার অন্তরাত্মা। না জানি কার বিরুদ্ধে কি প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন ক্লড র‍্যাঁবো।

দম বন্ধ করে শুনছে সবাই। টেপ করা কথোপকথনের সুরটা যান্ত্রিক আর চঞ্চল শোনাচ্ছে। সকলের সম্মোহিত দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে ছোট্ট টেপ রেকর্ডারটা। একটু পরই থেমে গেল সেটা। এখনও হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে সেটার দিকে সবাই। সুরেত-এর অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর বিশাল বপু কর্নেল প্যাপনের মুখ থেকে রক্ত নেমে গেছে, ছাইয়ের মত ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে চেহারাটা। সামনে থেকে কাগজপত্র তুলে নিজের ফোল্ডারে ভরছে সে। হাত দুটো থরথর করে কাঁপছে তার।

‘কার কণ্ঠস্বর ওটা?’ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর ভরাট কণ্ঠস্বর গুঁড়ো করে দিল জমাট নিস্তব্ধতাকে।

চুপ করে থাকলেন ক্লড র‍্যাঁবো। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল কর্নেল প্যাপন। ঝট করে ঘাড় ফিরিয়ে একযোগে তাকাল সবাই তার দিকে।

কোটের আস্তিন দিয়ে কপালের ঘাম মুছল কর্নেল। তার কোলা ব্যাঙের মত ফোলা মুখ দেখে ভয় হলো সবার, এই বুঝি ভ্যাঁ করে কেঁদে দিল!

‘আ-আমি দুঃখিত, মন্ত্রী মহোদয়।…ওটা আ-আমার একজন বা-বান্ধবীর গলা।…বর্তমানে সে আমার সাথে আ…বসবাস করছে…আ-আমি ক্ষমাপ্রার্থী।’

কামরা ছেড়ে বেরিয়ে গেল সে, নিজের দফতরে ফিরে গিয়ে পদত্যাগপত্র লেখার উদ্দেশ্যে।

সভার বাকি সবাই মাথা নিচু করে যার যার হাতের দিকে তাকিয়ে আছে।

‘ভেরি ওয়েল, কমিশেয়ার,’ শান্ত গলায় বললেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, ‘আপনার বক্তব্য আবার আপনি শুরু করুন।

নতুন করে কি ব্যবস্থা নিয়েছেন, এবার সে-বিষয়ে কথা বললেন ক্লড র‍্যাঁবো। আশা করছি, আজ সন্ধ্যার মধ্যেই লন্ডন থেকে হারানো এবং চুরি যাওয়া পাসপোর্টের তালিকা এসে যাবে। আমরা যাকে খুঁজছি তার সাথে চেহারার মিল পাওয়া যাবে গুটি কয়েক লোকের, এটা আমার ধারণা। যাদের সাথে মিল পাওয়া যাবে লন্ডনে, তাদের দেশের কনস্যুলেটের কাছ থেকে ফটো চাইব। ফটো পাওয়া গেলে মোটামুটি পরিষ্কার একটা ধারণা করা যাবে পাদ্রী বেনসনের বর্তমান চেহারা কি দাঁড়িয়েছে। সান্তিনো ভ্যালেন্টি, অরগ্যান এবং বেনসনের সাথে বর্তমান চেহারাটা বেশ কিছুটা মিলবে। ভাগ্য প্রসন্ন হলে কাল দুপুরের মধ্যে ফটোগ্রাফগুলো পেয়ে যাব বলে আশা করছি।

‘ব্যক্তিগতভাবে আমি একটা সঙ্কটে পড়ে গেছি,’ বললেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী। ‘একজন মাত্র লোককে গোটা ফ্রেঞ্চ প্রশাসন তার সমস্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করেও ধরতে পারেনি বা তার প্রকৃত পরিচয় এখনও জানতে পারেনি—কিভাবে এ খবর দিই প্রেসিডেন্টকে? জনসাধারণ্যে বা প্রকাশ্যে বের না হতে অনুরোধ করব তাঁকে, এমন সাহস আমার নেই। তাছাড়া, এ অনুরোধ তিনি রাখবেনও না। কি যে করি, বুঝতে পারছি না।’ একটু বিরতি নিয়ে আবার তিনি বললেন, ‘তবে, আরোপিত একটা নিষেধাজ্ঞা এখন তুলে নেয়া যেতে পারে বলে মনে করি। সান্তিনো ভ্যালেন্টি ওরফে অরগ্যান ওরফে বেনসন এখন একজন সাধারণ খুনী। ব্যারনেস সিবাকে তাঁর দুর্গে সে খুন করেছে। দেশময় এটা রটিয়ে দিতে এখন আর কোন বাধা নেই। পুলিস সূত্র থেকে সংবাদপত্রকে জানাতে হবে ব্যারনেস সিবার দুর্গ থেকে মহামূল্যবান অলঙ্কার এবং মোটা অঙ্কের নগদ টাকাও চুরি করে নিয়ে গেছে সে। জানাতে হবে, পুলিস ধারণা করছে হাউতে শেলনেয়ার থেকে প্যারিসের দিকে এসেছে সে, এবং এখানেই কোথাও ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে। এ ব্যাপারে কারও কিছু বলার আছে?’

লোকটাকে চোর হিসেবে চিহ্নিত করার এই উদ্যোগ পছন্দ হলো না ক্লড র‍্যাঁবোর। কিন্তু প্রতিবাদ করতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলেন তিনি। ভাবলেন, এর চেয়ে অনেক বড় বিষয়ে মুখ বুজে আছেন তিনি, আরেকটা বিষয়ে চুপ করে থাকলেই বা কি এসে যায়!

কেউই কিছু বলল না দেখে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আবার বললেন, ‘তাহলে আজ বিকেলের পত্রিকাতেই যাক খবরটা। এবং মশিয়ে ক্লড র‍্যাঁবো, লোকটার নতুন পরিচয় জানা মাত্র আপনি তা সংবাদপত্রকে জানিয়ে দেবেন, যাতে আগামী কালকের সমস্ত পত্রিকার প্রভাত সংস্করণে খবরটা মেইন হেডিং হয়। সম্ভব হলে একটা ফটোও দেবেন ওদেরকে ছাপার জন্যে।

খানিক ভাবলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, তারপর আবার বললেন, ‘লোকটার নতুন নাম জানা মাত্র, মশিয়ে ক্লড র‍্যাঁবো, সুরেতের প্রতিটি শাখা, গোয়েন্দা বিভাগ, ফ্রেঞ্চ এসপিওনাজ, পুলিস এবং এমন কি মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সকে আমার নামে নির্দেশ পাঠাবেন: প্যারিসের প্রতিটি রাস্তায় চেক পোস্ট বসিয়ে প্রতিটি লোকের কাগজপত্র পরীক্ষা করতে হবে। প্রতিটি বিভাগের সমস্ত হাই অফিশিয়াল এবং তাদের অধীনস্থ কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করে দেবার নির্দেশ এখুনি জারি করা হলো। আপাতত এখানেই আজকের সভা…’

‘মাফ করবেন, মশিয়ে,’ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে বাধা দিয়ে বলে উঠল অ্যাকশন সার্ভিস চীফ কর্নেল বোল্যান্ড। আমার একটা বক্তব্য আছে।’

সবাই তাকাল তার দিকে।

‘পার নামে যে মেয়েটিকে মশিয়ে ক্লড র‍্যাঁবো অ্যারেস্ট করেছেন,’ বলল কর্নেল বোল্যান্ড, ‘তার মুখ থেকে কথা আদায় করার দায়িত্ব অ্যাকশন সার্ভিস নিতে চায়। এ ব্যাপারে কারও কোন আপত্তি আছে?’

বিভাগীয় প্রধানরা ছাড়া বাকি সবাই একযোগে সোচ্চার হয়ে উঠল। ‘সেটাই উচিত’

‘কোন আপত্তি নেই’ এই ধরনের মন্তব্য উচ্চারিত হচ্ছে কামরার চারদিক থেকে।

হতভম্ব দেখাচ্ছে ক্লড র‍্যাঁবোকে। এর আগের কোন সভায় এরকম দৃশ্যের অবতারণা ঘটেনি। বেশ একটু অবাক হয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এবং বিভাগীয় প্রধানরাও। সাধারণ একটা প্রস্তাবকে এতগুলো লোক এমন হৈ-চৈ করে সমর্থন কেন দিচ্ছে তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অবশ্য কেউই বুঝল না।

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ক্লড র‍্যাঁবোর দিকে তাকিয়ে আছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী।

একটু কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিলেন ক্লড র‍্যাঁবো। তারপর বললেন, আমার আপত্তি আছে।’

কর্নেল বোল্যান্ড চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ক্লড র‍্যাঁবোর দিকে চোখ কুঁচকে তাকাবার এবং বিশাল শরীর নিয়ে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াবার ভঙ্গির মধ্যে আক্রমণাত্মক একটা ভাব ফুটে উঠল। জানতে চাইল, কিসের আপত্তি, মশিয়ে? আপনার আপত্তি আমরা মানবই বা কেন? মহামান্য প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে এই ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করেছে অ্যাকশন সার্ভিস। সেজন্যে আগেই শর্ত আরোপ করা হয়েছে, আপনি প্রেসিডেন্টের হবু খুনীর অবস্থান নির্ণয় করে দিয়েই সরে পড়বেন—তাকে গ্রেফতার এবং জেরা করার দায়িত্ব নেবে অ্যাকশন সার্ভিস। খুনীর সহকারিণী সম্পর্কেও এই শর্ত প্রযোজ্য। মশিয়ে, অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়ে বলতে বাধ্য হচ্ছি, সবাই মিলে আপনাকে যে ক্ষমতা আমরা দিয়েছি আপনি তার অপব্যবহার করছেন। এটা অভিপ্রেত নয়। এ প্রসঙ্গে সভাকে আমি জানাচ্ছি, গ্রেফতার করার পর পারকে কোথায় রাখা হয়েছে তাও তিনি আমাদেরকে জানাবার প্রয়োজন বোধ করেননি।’

সংখ্যায় কর্সিকানরা বেশি। চারদিক থেকে তারা সবাই প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠন।

‘এ বড় লজ্জার কথা,’ বললেন ক্লড র‍্যাঁবো। ‘এমন কথা কেউ কখনও শুনেছেন?’ প্রশ্নটা করে বিস্ময়াভিভূত চেহারা নিয়ে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকলেন তিনি। ‘অক্লান্ত পরিশ্রম করে, বুদ্ধি খাটিয়ে, ঝুঁকি নিয়ে একটা কাজে সাফল্য অর্জন করল একজন, কিন্তু ফলটা ভোগ করতে চায় আরেকজন। হাসব?’ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর দিকে চোখ পিট পিট করে তাকালেন ক্লড র‍্যাঁবো। ‘নাকি কাঁদব? আপনিই বলে দিন, মশিয়ে।

আন্তঃ বিভাগীয় উত্তেজনাটা ঠাণ্ডা করার জন্যে মৃদু হাসলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী। ক্লড র‍্যাঁবোর যুক্তি অকাট্য, তাই তাঁকেই সমর্থন করে বললেন, ‘হাসুন, মশিয়ে।

মুহূর্তে রাগে টকটকে লাল হয়ে উঠল কর্নেল বোল্যান্ডের চেহারা। জেদের সুরে বলল সে, ‘কিন্তু, মশিয়ে, নিজেই স্বীকার করেছেন পারুর মুখ থেকে কোন তথ্য আদায় করতে পারেননি—সেক্ষেত্রে, পারূকে নিজের আওতায় কেন রাখছেন তিনি? নিশ্চয়ই তার রূপ দেখার জন্যে নয়?’

দ্বিধাগ্রস্ত দেখাচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে।

‘অস্বীকার করব না, মেয়েটার রূপ দেখার মতই বটে,’ প্রৌঢ় ক্লড র‍্যাঁবো রসিকতা করতে জানেন, আজ তার প্রমাণ পাওয়া গেল। মৃদু মৃদু হাসছেন তিনি। বুড়ো মানুষ আমি, তার ওপর চিরকুমার। এই পরিস্থিতিতে কেউ যদি কল্পনায় রঙিন ফানুস ওড়ায়, দোষ দিতে পারি না। কেন নিজের ডিপার্টমেন্টে পারূকে রাখছি, এ প্রশ্নের উত্তর দেবার আগে, মশিয়ে বোল্যান্ড, আপনাকে আমি একটা প্রশ্ন করতে চাই। বলুন তো, পারকে হাতে পাবার জন্যে অ্যাকশন সার্ভিসই বা এত ব্যগ্র কেন?’

‘এই মেয়েটাকে ভয় দেখালেই খুনীর পরিকল্পনা জানা যাবে। এই মেয়েটার পেট থেকে কথা আদায় করার ওপর নির্ভর করছে মহামান্য প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা….

হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল ক্লড র‍্যাঁবোর চোখ-মুখ। তাই দেখে বিস্ময়ে হঠাৎ যেন বোবা হয়ে গেল কর্নেল বোল্যান্ড। সভায় উপস্থিত বাকি সবাইও বোকা বনে গেছে এমন একটা সিরিয়াস ব্যাপারে ক্লড ব্যাবোকে সানন্দে হাসতে দেখে।

আমি আপনার সাথে একমত নই,’ গালভরা হাসি নিয়ে মৃদু কণ্ঠে বললেন ক্লড র‍্যাঁবো। প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তার সাথে পারুর কোন সম্পর্ক নেই।’

হোয়াট!’ কামরার ভিতর যেন বোমা ফাটল। মশিয়ে, আপনি পাগলের মত কথা বলছেন…’

‘পাগলামির দেখেছেন কি!’ মৃদু মৃদু হাসছেন এখনও ক্লড র‍্যাঁবো। ভাবছি, এখন যে কথাটা বলব তা শুনে কি বলবেন আমাকে?’

‘কি…কি বলবেন আপনি?’ কণ্ঠস্বর কেঁপে গেল কর্নেল বোল্যান্ডের।

‘বলতে চাই, প্রেসিডেন্ট বিপদগ্রস্ত নন। বলতে চাই, প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়নি। বলতে চাই, যে লোকটাকে আমরা খুঁজছি সে প্রেসিডেন্টকে খুন করতে পারবে না। সে প্রেসিডেন্টকে আদৌ খুন করতে চায় কিনা সে ব্যাপারেও আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।’

বিস্ময়ে, এবং ঘটনার আকস্মিক নাটকীয় মোড় পরিবর্তনে শুধু বোবা বা স্তম্ভিত নয়—উপস্থিত সবাই যেন হার্টফেল করে মারা গেছে। এই মুহূর্তে কেউ যদি সভাকক্ষে প্রবেশ করে, সে দেখতে পাবে জড় পদার্থের মত বসে আছে সবাই, কারও চোখের পাতা বা মণি নড়ছে না, একটু শব্দ নেই কারও তরফ থেকে।

ঘাবড়ে গেছে কর্সিকানরা। তাদের দুশ্চিন্তা, কতটুকু জানে বুড়ো ভাম ক্লড র‍্যাঁবো? রানার আসল পরিচয়? তার প্রকৃত উদ্দেশ্য? রূপা কি সব কথা খুলে বলে ফেলেছে এরই মধ্যে? তাই যদি হয়, ফলস পজিশনে পড়ে যাবে কর্নেল বোল্যান্ড। তার তৈরি রিপোর্টেই বলা হয়েছিল ও-এ-এস প্রেসিডেন্টকে খুন করার জন্যে একজন দুর্ধর্ষ অপরিচিত খুনীকে লেলিয়ে দিয়েছে। এখন যদি জানাজানি হয়ে যায় তার রিপোর্ট মিথ্যে বা ভুল ছিল, মন্ত্রী পরিষদের কাছে জবাবদিহি করতে হবে তাকে। চাকরিটাও হয়তো থাকবে না।

বিপদ টের পেয়ে গেছে কর্নেল বোল্যান্ড। নড়ার শক্তি নেই তার। আক্রমণটা এল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর তরফ থেকে।

‘মশিয়ে কড় ব্যাবো,’ গমগম করে উঠল তাঁর কণ্ঠস্বর, ‘আপনি নিশ্চয়ই আমাদের সাথে ঠাট্টা করছেন না?’

সোনালী ফ্রেমের চশমাটা নাকের উপর একটু ঠেলে ঠিক মত বসিয়ে নিলেন ক্লড র‍্যাঁবো। প্রশান্ত দেখাচ্ছে তাঁকে। প্রশ্নের উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ করলেন না। বললেন, ‘সর্বশেষ খবর অনুযায়ী আমরা জানি, নতুন ছদ্মবেশ এবং ছদ্ম পরিচয় নিয়ে পাদ্রী বেনসন এখন প্যারিসেরই কোথাও আছে। মহামান্য প্রেসিডেন্ট কোথায় আছেন? শহর থেকে একশো পঁচিশ মাইল দূরে, তাঁর নিজস্ব শ্যাতোয়।

‘এ থেকে কিছুই প্রমাণ হয় না। তিনি বিশ্রাম শেষ করেই আবার প্যারিসে ফিরে আসবেন।

আসবেন। তাঁর পার্সোন্যাল সেক্রেটারির সাথে কথা বলে জেনেছি, আজ রাতেই ফিরবেন তিনি। রাত সাড়ে ন’টায়। প্যারিসের কোথায়, তা কেউ জানেন আপনারা?’ প্রশ্নটা করে সকলের দিকে উৎসুক নয়নে একবার করে তাকালেন ক্লড র‍্যাঁবো।

কেউ জানে না, সবাইকে চুপ করে থাকতে দেখে নিশ্চিন্ত হলেন ক্লড র‍্যাঁবো। দুঃখের বিষয়, আমাদের এই সভায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোন প্রতিনিধি নেই। আরও দুঃখের সাথে জানাচ্ছি, আপনারা সবাই ফ্রান্সের এক একজন রথী মহারথী হলেও, দেশের মাথা সম্পর্কে সাধারণ খবরটুকুও মনে রাখেন না। আপনাদের সকলের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, আজ থেকে এক বছর আগে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সাথে ফ্রেঞ্চ প্রেসিডেন্টের শীর্ষ সম্মেলনের একটা তারিখ নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। ওয়াশিংটনে আগামীকাল সেই শীর্ষ সম্মেলন শুরু হবে। আমাদের প্রেসিডেন্ট প্যারিসের অরলি এয়ারপোর্টে পৌছুবেন রাত সাড়ে ন’টায়। এর কয়েক মিনিট পর তিনি তাঁর ব্যক্তিগত বিমানে করে ওয়াশিংটনের উদ্দেশে রওনা হয়ে যাবেন।’

‘আরে, তাই তো!’ ঘোর ভাঙতেই কে যেন অস্ফুটে বলে উঠল।

এক পলকেই মনে পড়ে গেছে কথাটা সবার। জানা ছিল, কিন্তু মনে ছিল না কারও।

‘সেন্সর আরোপ করে প্রেসিডেন্টের রওনা হবার খবরটা আগাম ছাপতে দেয়া হয়নি,’ বললেন ক্লড র‍্যাঁবো। ‘আগামীকাল সকালের সমস্ত পত্রিকার প্রভাত সংস্করণে শীর্ষ সম্মেলন শুরু হবার খবরটা ছাপা হবে।’

প্রেসিডেন্ট সম্পূর্ণ নিরাপদ একথা আজ সাড়ে ন’টার আগে পর্যন্ত আপনি বলতে পারেন না—’

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে থামিয়ে দিয়ে ক্লড র‍্যাঁবো বললেন, পারি। সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ আজ সাড়ে ন’টা পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তার দিকটা দেখছে। প্রেসিডেন্টের গাড়িতে বুলেট প্রুফ কাঁচ লাগানো হয়েছে। তাঁর শ্যাতো ঘিরে রেখেছে যোয়ানরা। এয়ারপোর্টে তিনি আসবেন এয়ারফোর্সের হেলিকপ্টারে চড়ে। চব্বিশ ঘণ্টা আগে থেকে তাঁর ব্যক্তিগত বিমানটাকে পাহারা দেবার ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হয়েছে। প্রেসিডেন্টের পাঁচশো গজের মধ্যে অবাঞ্ছিত কেউ ঘেঁষতে পারবে না, এ নিশ্চয়তা দিচ্ছি আমি।’

‘তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, ও-এ-এস-এর ভাড়াটে খুনীর উদ্দেশ্য কি?’ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সবিনয়ে জানতে চাইলেন। ‘সে কি প্রেসিডেন্ট ফিরে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে?’

‘জানি না। প্রেসিডেন্ট ওয়াশিংটন যাবেন, এ খবর তার অজানা থাকার কথা নয়। ফিরে আসার জন্যে অপেক্ষা করবে, এও সম্ভব নয়। অপেক্ষা করার ঝুঁকি না নিয়ে আরও দেরি করে ফ্রান্সে ঢুকলেই তো পারত সে। সেজন্যেই সন্দেহ করছি, প্রেসিডেন্টকে খুন করার কোন উদ্দেশ্য হয়তো নেই লোকটার। তবে, এ কথাও বলছি, আমার সন্দেহের পক্ষে কোন প্রমাণ দাখিল করতে পারব না আমি এই মুহূর্তে।’

মেয়েটার কাছ থেকে কিছুই জানা যাচ্ছে না?’

‘আমার ডিপার্টমেন্ট চেষ্টার কোন ত্রুটি করছে না,’ বললেন ক্লড র‍্যাঁবো। ‘এই মুহূর্তেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে তাকে। তবে, আগেই বলেছি, সব কথা বলার চেয়ে মৃত্যুকেই বোধহয় শ্রেয় জ্ঞান করবে, এই ধরনের মেয়ে পার। অথবা, সবটুকু সে জানে না।

‘সেক্ষেত্রে, প্রেসিডেন্ট রওনা হবার আগ পর্যন্ত নিশ্চিন্ত হতে পারি না আমরা, ‘ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বললেন। ‘তিনি রওনা হবার পরও ব্যাপারটা চুকে যাচ্ছে না। এই লোক প্রেসিডেন্ট এবং রাষ্ট্রের জন্যে একটা হুমকি, এতে কোন সন্দেহ নেই। তাছাড়া, সে ঘৃণ্য একটা খুনী। একে আমরা চাই। এর বিচার হবে।’

সভার সমাপ্তি ঘোষণা করা হলো একটু পরই। ক্লড র‍্যাঁবো কামরা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন, পিছন থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বললেন, ‘মশিয়ে, একটা কথা। কর্নেল প্যাপনের টেলিফোনে আড়ি পাততে হবে তা আপনি জানলেন কিভাবে?

দরজার কাছে ঘুরে দাঁড়ালেন প্রৌঢ় ক্লড র‍্যাঁবো। বললেন, ‘জানতাম না। তাই গত রাতে আপনাদের সবার টেলিফোনে আড়ি পাতার আয়োজন করেছিলাম আমি।’

‘লুইসা পিয়েত্রো এখন কোথায়?’

তাকে ধরা যায়নি। আত্মহত্যা করেছে।’ প্রৌঢ় গোয়েন্দা ছোট ছোট পা ফেলে বেরিয়ে গেলেন কামরা থেকে।

বাইরে অপেক্ষা করছে একান্ত সচিব চার্লস ক্যারন। ক্লড র‍্যাঁবো তাকে বললেন, ‘একটা কথা, মানে…

চীফকে সঙ্কুচিত হতে দেখে অবাক হয়ে গেল চার্লস। ‘কি কথা, চীফ?’

‘মানে,’ ইতস্তত করছেন ক্লড র‍্যাঁবো, ‘বলছিলাম কি, আমার মেয়ে পদেমাকে যে রসুনের চাটনি….

‘প্রায়ই তো সে ওই চাটনির কথা তোলে! আর কি যে প্রশংসা করে…’

‘না, মানে, বোতলটা খালি হয়ে আছে কিনা…’

‘না, চীফ, এখনও অর্ধেকটার মত আছে…’

‘তাহলে,’ কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে ক্লড র‍্যাঁবো বললেন, ‘ধার হিসেবে ওটুকু যদি দেয় সে,… কথা দিচ্ছি, আরও কয়েক বোতল তৈরি করে দেব…হাতে এখন সময় নেই কিনা…

‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই!’ ব্যস্ত হয়ে বলল চার্লস। ‘অফিসে ফিরেই ফোন করে আনিয়ে নিচ্ছি।’ বলল বটে, কিন্তু মনে মনে ভাবল, এ কেমন হলো! একজনকে শখ করে দেয়া, তাও আবার খাবার জিনিস, ফিরে চাওয়ার কি মানে? বয়স বেশি হলে জিভের লালচ অদম্য হয়ে ওঠে, কথাটা তাহলে মিথ্যে নয়!

.

সেদিন বিকেল পাঁচটা। প্লেস দে আই’ অদেনের অদূরে একটা কাফে। খোলা চত্বরে বসে আছে রানা। সামনে বিয়ার ভর্তি গ্লাস। দু’একবার চুমুক দিয়ে গ্লাসটা রেখে দিয়েছে ও। তিক্ত, কটু লাগছে। গাঢ় রঙের চশমা পরে বহুদূর পর্যন্ত দৃশ্যমান দু’দিকের রাস্তার উপর অলস ভঙ্গিতে মাঝেমধ্যে তাকাচ্ছে। চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই রাজ্যের দুশ্চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে ওর মাথায়। কোথায় রাত কাটাবে সে? হোটেলে? না। রাত শেষ হবার আগেই ওর এই নতুন ছদ্ম পরিচয় আবিষ্কার করে ফেলবেন ক্লড র‍্যাঁবো।

সিগারেট ধরাল রানা। নিজের চারদিকটা ধীরেসুস্থে দেখে নিল একবার। ওর চোখের চশমাটা সন্দেহের কারণ সৃষ্টি করছে না, আরও অনেকেই চশমা পরে রয়েছে।

দ্বিতীয় টান মারতে যাবে সিগারেটে, কি ভেবে কুঁচকে উঠল ভুরু জোড়া। ঠোঁটের কাছ থেকে হাতটা নামিয়ে নিল রানা। মনের ভিতর একটা অসন্তোষ ভাব সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু কারণটা কি ধরতে পারছে না ও। মনের ভিতর বাস করেন একজন সর্বদর্শী, তাঁর তরফ থেকে রীতিমত তিরস্কার করা হচ্ছে তাকে। অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল রানা। ভাবছে। কোথাও কোন ভুল করেছে কি সে? দেখতে পাওয়া উচিত, কিন্তু দেখতে পাচ্ছে না, এমন কোন বিপদ কাছে চলে এসেছে? রাস্তার ডানদিকে তাকাল রানা। তারপর বাঁ দিকে। এদিক থেকে ওদিকে দৃষ্টি সরাবার ফাঁকে কাফেতেও দৃষ্টি বুলিয়ে নিল একবার। তাকিয়ে নেই কেউ ওর দিকে। বাঁ দিকের রাস্তায় যানবাহনের ভিড়ই বেশি, পথিক নেই বললেই চলে। একটা পুলিস কনভয় বাঁক নিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। পঁয়তাল্লিশ মিনিটে এটা নিয়ে পাঁচটা পুলিস কনভয় চোখে পড়ল ওর। ক্লড র‍্যাঁবো চুপ করে বসে নেই, এ সম্ভবত তারই আলামত। রাস্তার দূর প্রান্তে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। পিছনে জোড়া লাগানো একটা ট্রেইলর। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে একটা দম্পতি দূর পাহাড়ে বা সাগরবেলায় বেড়াতে যাচ্ছে। ইউরোপীয়ানদের এই এক মজার বেঁচে থাকার ধরন। দু’চার দিনের ছুটি পেলেই হয়, গাড়ির পিছনে ট্রেইলর জুড়ে তাতে গোটা সংসার চাপিয়ে রওনা হয়ে যায় দূরে কোথাও, প্রকৃতির মাঝখানে খোলা আকাশের নিচে ছুটিটা কাটিয়ে আসে। হঠাৎ চমকে উঠল রানা, পরমুহূর্তে খুশির একটা ঢেউ বয়ে গেল দেহ-মন-জুড়ে। বাহ্! কী সুন্দর সমাধান বেরিয়ে গেছে তার সমস্যার। রাত কাটানো এখন পানির মত সহজ হয়ে গেল। সবদিক থেকে নিরাপদ, সন্দেহের ঊর্ধ্বে, নিখুঁত একটাই মাত্র উপায় আছে ওর জন্যে, সেটা দেখেও দেখতে পাচ্ছিল না ও। সর্বদর্শীর তিরস্কারের অর্থ বোঝা গেল এতক্ষণে।

.

সেদিন বিকেল ছ’টা। ফ্রান্সের সমস্ত দৈনিক পত্রিকা তাদের সান্ধ্য সংস্করণের হেডিং বদল করল। সর্বশেষ সংস্করণে বড় বড় কালো হরফে হেডিং ছাপা হলো: পরমা সুন্দরী ব্যারনেস সিবা খুন!

প্যারিসের একটা পার্টিতে নাচছে সিবা, বছর কয়েক আগে তোলা তার একটা ফটো সব পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। হেডিংয়ের নিচে সবিস্তারে ব্যাখ্যা করা হয়েছে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটা।

রাস্তায় ছুটোছুটি করে হকাররা বিক্রি করছে পত্রিকা। ‘ব্যারনেস সিবা খুন! ‘ তাদের এই চিৎকারে প্যারিসের অলিগলি মুখরিত হয়ে উঠল। কিন্তু রানার কানে এসব কিছুই পৌঁছল না। চার দেয়ালের ভিতর নিজের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে ব্যস্ত এখন ও।

রাত আটটা। লন্ডন থেকে ফোন এল ম্যালকম লয়েডের। তার কণ্ঠস্বর ক্লান্ত শোনাল। কিছু কনসুলেট উৎসাহের সাথে সহযোগিতা করেছে, ক্লড র‍্যাঁবোকে জানাল সে, কিন্তু অধিকাংশ কনসুলেটের কাছ থেকে সহযোগিতা আদায় করতে গলদঘর্ম হতে হয়েছে তাকে।

গত পঞ্চাশ দিনে মেয়েমানুষ, নিগ্রো, এশিয়াটিক এবং বেঁটে বামুনরা ছাড়া আটজন বিদেশী পুরুষ-ট্যুরিস্ট লন্ডনে তাদের পাসপোর্ট হারিয়েছে। কুউ র‍্যাঁবোর প্রশ্নের উত্তরে সে জানাল, হ্যাঁ, তালিকায় এদের প্রত্যেকের নাম, চেহারার বর্ণনা এবং পাসপোর্ট নম্বর টুকে নিয়েছে সে।

‘এবার আসুন,’ ইংলিশ চ্যানেলের ওপার থেকে বলল ম্যালকম লয়েড, ‘এদের মধ্যে থেকে বাছাই করা যাক। তিনজন তাদের পাসপোর্ট হারিয়েছে এমন এক সময়ে, যখন সান্তিনো ভ্যালেন্টি লন্ডনে ছিল না বলে জানি আমরা। পয়লা সেপ্টেম্বর থেকে এয়ারলাইন্স বুকিং এবং টিকেট বিক্রির রেকর্ড, চেক করে জানতে পেরেছি আঠারোই সেপ্টেম্বরের সান্ধ্য ফ্লাইটে চড়ে সে কোপেনহেগেন যাবার উদ্দেশ্যে। BEA-এর সূত্র অনুযায়ী ব্রাসেলসে তাদের কাউন্টার থেকে একটা টিকেট কেনে সে নগদ টাকায়, এবং লন্ডনে ফিরে আসে অক্টোবরের ছয় তারিখে।’

‘রাইট,’ বললেন ক্লড র‍্যাঁবো। ‘আমরা আবিষ্কার করেছি লন্ডন ত্যাগ এবং আবার লন্ডনে ফিরে আসার মাঝখানের একটা সময় সে প্যারিসে কাটিয়েছিল। বাইশে সেপ্টেম্বর থেকে ত্রিশে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।’

তাহলে এই তিনজনের পাসপোর্ট চুরি করেনি সে, ধরে নিতে পারি,’ বলল ম্যালকম লয়েড। ‘বাকি পাঁচজনের মধ্যে একজন অস্বাভাবিক লম্বা, ছয় ফিট ছয় ইঞ্চি—তার মানে, আপনাদের ভাষায় দুই মিটারেরও বেশি। লোকটা ইটালিয়ান, তাই পাসপোর্টে তার শারীরিক বর্ণনা মিটার এবং সেন্টিমিটারে উল্লেখ করা হয়েছে, যা একজন ফ্রেঞ্চ কাস্টমস অফিসার পানির মত সহজে বুঝবে। এই পাসপোর্ট যদি ছয় ফিট লম্বা একজন লোকের কাছে থাকে, অফিসারের সন্দেহ হবেই। সুতরাং এ- ধরনের ঝুঁকি নেবে না খুনী। তার মানে, এই তালগাছের পাসপোর্টও চুরি করেনি সে।’

‘বাকি থাকে চারজন।‘

‘এদের মধ্যে একজন অস্বাভাবিক মোটা। দুশো বিয়াল্লিশ পাউন্ড। এর পাসপোর্ট ব্যবহার করতে হলে খুনীকে এত বেশি প্যাডের সাহায্য নিতে হবে যে হাঁটতেই পারবে না সে।’

‘একেও বাদ দেয়া যায়।’

‘অপর একজন বুড়ো। এর উচ্চতা খুনীর সাথে মেলে, কিন্তু বয়স সত্তর। ছদ্মবেশ নিয়ে এতটা বয়স বাড়ানো হয়তো সম্ভব, কিন্তু এর জন্যে তাকে সত্যিকার একজন থিয়েট্রিকাল মেক-আপে এক্সপার্ট লোকের সাহায্য নিয়ে মুখের জিওগ্রাফী বদলে নিতে হবে।

‘একেও বাদ দিন,’ বললেন ক্লড র‍্যাঁবো। বাকি থাকল মাত্র দু’জন।

‘এরা একজন নরওয়েজিয়ান, একজন আমেরিকান। খুনীর শারীরিক বর্ণনার সাথে মিল আছে দু’জনেরই। লম্বা, চওড়া কাঁধ, বিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে বয়স। নরওয়েজিয়ানের চুলের রঙ সোনালী। তাই ভাবছি, এর পাসপোর্ট খুনী চুরি করবে বলে মনে হয় না। অরগ্যানের চুল সোনালী ছিল, আবার কি সে চুল সোনালী করার ঝুঁকি নেবে? মনে হয় না। আরেকটা কথা। নরওয়েজিয়ান জানিয়েছে, বান্ধবীকে নিয়ে টেমস নদীতে নৌকা বিহারের সময় পাসপোর্টটা পকেট থেকে পানিতে পড়ে গেছে বলে সন্দেহ করে সে। অপরদিকে আমেরিকান ছাত্রটি লন্ডন এয়ারপোর্টের পুলিসকে শপথ করা লিখিত অভিযোগে জানিয়েছে এয়ারপোর্টের মেইন হলে পোর্টারের খোঁজে মুহূর্তের জন্যে অন্যদিকে তাকিয়েছিল সে, পরমুহূর্তে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই দেখে তাঁর হ্যান্ডগ্রিপটা নেই। এটাতেই ছিল তার পাসপোর্ট। এবার বলুন, মশিয়ে, কি ভাবছেন আপনি?’

‘মার্কিন ছাত্রটির নাম?’

‘স্মার্টি টোয়েন।’

‘স্মার্টি টোয়েন সম্পর্কে সমস্ত তথ্য,’ বললেন ক্লড র‍্যাঁবো, ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাঠিয়ে দিন এখানে। ওয়াশিংটনের পাসপোর্ট অফিস থেকে ওর একটা ফটো যোগাড় করে নিচ্ছি আমি। ধন্যবাদ, মশিয়ে লয়েড, অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। যে-কোন সময়, যে-কোন ব্যাপারে আমার কাছ থেকে সাহায্য চাওয়ার অধিকার পাওনা হয়েছে আপনার।’

সেদিন রাত দশটা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কনফারেন্স রূমে দ্বিতীয়বার মীটিং বসেছে। সবচেয়ে কম সময় স্থায়ী হলো মীটিংটা। এর এক ঘণ্টা আগেই রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার সাথে জড়িত সমস্ত ডিপার্টমেন্ট ব্যারনেস সিবার হত্যাকারী স্মার্টি টোয়েনের মিমিওগ্রাফ করা বিশদ বিবরণের কপি পেয়ে গেছে। রাতের মধ্যে তার একটা ফটো পাওয়া যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। পত্রিকাগুলোর প্রভাত সংস্করণে তা ছাপা হবে।

এয়ারপোর্ট থেকে ফিরে এসে নিজের আসনে বসলেন ক্লড র‍্যাঁবো। মীটিং শুরু হলো।

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী। সকলকে সম্বোধন করে তিনি বললেন, ‘এখানে উপস্থিত আমরা সবাই একমত হয়ে স্থির করেছিলাম যে ও-এ- এস-এর ভাড়াটে আততায়ীর পরিচয় এবং অবস্থান জানতে হলে আমাদের দরকার একজন প্রতিভাবান গোয়েন্দা। ফ্রান্সের গর্ব, বিশ্বের সেরা গোয়েন্দা মশিয়ে ক্লড র‍্যাঁবোর জন্ম দিয়েছে সে। এবং আমাদের সৌভাগ্য, তাঁর অমূল্য সহযোগিতা পেয়েছি আমরা।’ একটু বিরতি নিলেন তিনি, তারপর আবার শুরু করলেন। মশিয়ে ক্লড র‍্যাঁবোর কৃতিত্ব কতটুকু, নতুন করে তা ব্যাখ্যা করা দরকার করে না। তবু, কিছু কিছু কথা স্মরণ করার লোভ আমি সংবরণ করতে পারছি না। এক কথায়, একের পর এক দুর্লঙ্ঘ্য বাধা টপকে আমাদেরকে তিনি চমকিত করেছেন। প্যারিসের বাইরে না গিয়ে, আততায়ীর পিছু ধাওয়া না করে তিনি নির্ভুলভাবে আমাদেরকে জানিয়েছেন সান্তিনো ভ্যালেন্টি পরিচয় বদলে অরগ্যান হয়েছে, অরগ্যান থেকে বেনসন হয়েছে, এবং বেনসন থেকে হয়েছে স্মার্টি টোয়েন। তাঁর তদন্তের অগ্রগতির সমস্ত খবর এই কনফারেন্স রুম থেকে আততায়ীর কাছে ফাঁস করে দেয়া সত্ত্বেও তিনবার তিনি লোকটার অস্থায়ী আস্তানায় হানা দিতে সক্ষম হন, এবং প্রতিবারই মিনিট কয়েকের জন্যে তাকে ধরতে ব্যর্থ হন। তাঁর সর্বশেষ কৃতিত্ব হলো আততায়ীর সর্বশেষ ছদ্ম পরিচয় আবিষ্কার করা। এখন আমরা তার নাম জানি, চেহারা কেমন জানি, জানি এই শহরের গণ্ডির ভিতরই কোথাও আছে সে।’ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ক্লড র‍্যাঁবোর দিকে ফিরলেন। ‘মশিয়ে, আমরা আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ। আপনি আমাদের আন্তরিক ধন্যবাদ গ্রহণ করুন।

ছোটখাট মানুষটা, ক্লড র‍্যাঁবো, জড়সড় হয়ে বসে আছেন। এমনিতে, সাংঘাতিক লাজুক মানুষ তিনি, তার উপর কেউ তাঁর প্রশংসা শুরু করলে এমন লাল হয়ে ওঠেন যে তাঁর চেহারাটা তখন দেখার মতই হয় বটে! চুরুটটা ধরে আছেন তিনি দু’আঙুলের ফাঁকে, ধরাবার জন্যে হাত নাড়বেন সে-সাধ্য তাঁর কেড়ে নিয়েছে সঙ্কোচ।

‘মশিয়ে ক্লড র‍্যাঁবোর যাদু স্পর্শে,’ সকলের দিকে ফিরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আবার শুরু করলেন, ‘গোটা পরিস্থিতি এখন সম্পূর্ণ ভাবে আমাদের অনুকূলে এবং আয়ত্তের মধ্যে চলে এসেছে। আমরা এখন আততায়ীর নাম জানি, চেহারার বর্ণনা জানি, তার পাসপোর্টের নাম্বার জানি, পাসপোর্টে উল্লেখ করা তার জাতীয়তা জানি। আর ঘণ্টা কয় পর আমরা তার ফটো পাব। আমার নিঃসন্দেহ বিশ্বাস, আপনাদের সবার সব ক্ষমতার সুষ্ঠু প্রয়োগ হলে, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাকে আমরা মুঠোর ভিতর নিব। ইতিমধ্যেই প্যারিসের প্রতিটি পুলিস, সি-আর-এস-এর প্রত্যেক সদস্য, এসপিওনাজের সকল এজেন্ট, সুরেত-এর সমস্ত লোক, ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের প্রত্যেক গোয়েন্দাকে আলাদা আলাদা ভাবে পরিস্থিতি বুঝিয়ে দিয়ে ঠিক কি করতে হবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। রাত পোহাবার আগেই, কিংবা খুব বেশি হলে আগামীকাল দুপুর নাগাদ প্যারিসের কোথাও জায়গা পাবে না সে লুকাবার।

‘এবং আবার একবার আপনাকে অভিনন্দন জানাই, মশিয়ে ক্লড র‍্যাঁবো। সেই সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে আমি ঘোষণা করছি, তদন্তের গুরুভার এবার নামিয়ে নেয়া হলো আপনার কাঁধ থেকে। শেষের এই পর্যায়ে আপনার অমূল্য সহযোগিতা আর আমাদের দরকার নেই। আপনার দায়িত্ব আপনি পালন করেছেন, এবং পালন করেছেন তুলনাহীন দক্ষতার সাথে। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।’

কথা শেষ করে ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা করছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী।

কি যে ঘটে গেল, পরিষ্কার বুঝে উঠতে পারেননি যেন ক্লড র‍্যাঁবো। ছোটখাট, নরম মেজাজের নির্বিরোধী মানুষটাকে সাংঘাতিক বোকা বোকা দেখাচ্ছে। কয়েকবার চোখ পিট পিট করলেন তিনি। তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। ইতস্তত করছেন। এখনও যেন হৃদয়ঙ্গম করতে পারছেন না ব্যাপারটা। সত্যিই কি এরা তাঁকে দূর করে দিচ্ছে? সবচেয়ে জটিল এবং শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে? এদিক ওদিক তাকালেন তিনি। দেখলেন, তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে সবাই। হাসছে।

ঘুরে দাঁড়িয়ে কামরা থেকে বেরিয়ে গেলেন ক্লড র‍্যাঁবো।