সেই উ সেন – ২.৩

তিন

মিলান। তেরো তারিখ।

সকাল সাড়ে সাতটায় ঘুম ভাঙল রানার। রুম সার্ভিস বেড সাইড টেবিলে চা রেখে গেছে, কাত হয়ে শুয়ে চা পানের সাথে চোখ বুলাল কাগজের হেডিংগুলোয়। দশ মিনিট পর উঠে পড়ল ও। ড্রেসিং টেবিলের ছয় ফিট লম্বা আয়নার সামনে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে পনেরো মিনিট দৌড়ের রুটিন ব্যায়ামটা সেরে নিল। গায়ের ঘাম শুকাবার জন্যে দশ মিনিট সময় দিয়ে ঢুকল বাথরূমে। শাওয়ার সেরে দাড়ি কামাল, পোশাক পরল, তারপর সুটকেসের লাইনিং খুলে বের করল পাঁচ হাজার পাউন্ডের তাড়াটা। সেটা ব্রেন্টপকেটে ভরে নিয়ে নিচে নামল ব্রেকফাস্ট সারার জন্যে।

ন’টায় হোটেল থেকে বেরিয়ে রাস্তার দু’দিকে চোখ রেখে ফুটপাথ ধরে হাঁটছে রানা। পথে যতগুলো ব্যাঙ্ক চোখে পড়ল প্রত্যেকটিতে ঢুকে ভাঙিয়ে নিচ্ছে ইংলিশ পাউন্ড। দু’ঘণ্টা ব্যয় করে একহাজার পাউন্ড বদলে সমমানের ইটালিয়ান লিরা সংগ্রহ করল, বাকি চার হাজার পাউন্ডের বিনিময়ে নিল ফ্রেঞ্চ ফ্র্যাঙ্ক। কাজ শেষ করে বিশ্রামের জন্যে একটা কাফেতে বসে এক কাপ কফি পান করল ও। তারপর দ্বিতীয় কাজ সারার জন্যে কাফে থেকে বেরিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করল ফুটপাথ ধরে!

এখানে সেখানে অসংখ্য জায়গায় ঢু মেরে অবশেষে রানা শ্রমিকদের এলাকা পোর্টা গ্যারিবালডিতে পৌঁছে যা খুঁজছিল পেয়ে গেল। একসারিতে অনেকগুলো তালা মারা গ্যারেজ। এর একটা ভাড়া নিল রানা। দু’দিনের জন্যে ভাড়া গুণতে হলো পঞ্চাশ হাজার লিরা। অল্প দিনের জন্যে বলে প্রচলিত দলের চেয়ে অনেক বেশি ধরা হলো ভাড়া।

স্থানীয় একটা হার্ডঅয়্যারের দোকান থেকে এক প্রস্থ ওভারঅলস, একজোড়া মেটাল ক্লিপার, কয়েক গজ মোটা স্টীল অয়্যার, একটা শোল্ডারিং আয়রন এবং এক ফুট শোল্ডার রড কিনল রানা। একই দোকান থেকে কেনা ক্যানভাসের একটা ব্যাগে জিনিসগুলো ভরে নিয়ে ফিরে এল গ্যারেজে। ব্যাগটা রেখে বাইরে বেরিয়ে এসে তালা মারল গেটে। চাবিটা পকেটে করে শহরের পরিচ্ছন্ন এলাকায় ফিরে এল লাঞ্চ খাবার জন্যে।

লাঞ্চ শেষ করে রেস্তোরাঁ থেকেই গাইড বুক দেখে ফোন করল একটা রেন্ট- এ-কার কোম্পানীকে। প্রাথমিক আলাপ শেষ করে সন্তুষ্ট হলো রানা। একটা ট্যাক্সি নিয়ে পৌঁছল সেখানে, দেখেশুনে ভাড়া করল একটা উনিশশো বাহাত্তর মডেলের সেকেন্ড হ্যান্ড আলফা রোমিও স্পোর্টস টু সিটার। ম্যানেজারকে জানাল, পনেরো তারিখ থেকে পনেরো দিনের জন্যে ফ্রান্সে ভ্রমণ করতে যাচ্ছে সে।

পাসপোর্ট এবং ব্রিটিশ ইন্টারন্যাশনাল ড্রাইভিং লাইসেন্স সাথে নিয়েই বেরিয়েছে রানা, সুতরাং কাছাকাছি একটা ইন্সুরেন্স কোম্পানী থেকে গাড়িটা বীমা করিয়ে নিতে এক ঘণ্টার বেশি সময় লাগল না। এর জন্যে মোটা টাকা জমা দিতে হলো রানাকে, প্রায় পাঁচশো পাউন্ডের সমান। গাড়ির যদি কোন ক্ষতি হয়, ক্ষতিপূরণ বাবদ এই টাকা পাবে রেন্ট-এ-কার কোম্পানী।

লন্ডনে থাকতে অটোমোবাইল এসোসিয়েশনে সন্ধান নিয়ে আগেই জেনেছে রানা, ফ্রান্স এবং ইটালি কমন মার্কেটের সদস্য বলে ইটালিতে রেজিস্ট্রি করা কোন গাড়িকে ফ্রান্সে ঢুকতে বাধা দেয়া হয় না, যদি ড্রাইভিং লাইসেন্স, গাড়ি ভাড়া নেয়া সংক্রান্ত কাগজপত্র এবং ইন্সুরেন্স সার্টিফিকেট সাথে থাকে।

এক ফাঁকে করসো ভেনেজিয়ার অটোমোবাইল ক্লাব ইটালিয়ানোয় যেতে হলো ওকে। ডেস্কে খোঁজ নিয়ে অত্যন্ত নামকরা একটা ইন্সুরেন্স ফার্মের ঠিকানা জেনে নিল ও। ব্যক্তিগত যানবাহন যোগে বিদেশে ভ্রমণে যেতে চাইলে নিয়ম আছে আলাদাভাবে আরও একটা বীমা করিয়ে নিতে হয়। এই ইন্সুরেন্স ফার্মটির সাথে ফ্রান্সের ইন্সুরেন্স ফার্মের বিশেষ সদ্ভাব আছে, ডেস্ক ক্লার্ক জানাল ওকে, সুতরাং এখান থেকে বীমা করালে ফ্রান্সের সর্বত্র তা গুরুত্ব বহন করবে।

ইন্সুরেন্স কোম্পানী থেকে তালিকা নিয়ে কন্টিনেন্টালে ফিরল রানা। হোটেলের পার্কিং এলাকায় গাড়ি রেখে নিজের কামরায় গেল। রাইফেল ভরা সুটকেসটা নিয়ে তখুনি নেমে এসে গাড়িতে চড়ল আবার। দশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেল ভাড়া করা গ্যারেজে।

ভিতর থেকে গেট বন্ধ করে দিয়ে কাজে হাত দিল রানা। শোল্ডারিং আয়রনের প্লাগটা মাথার উপরের আলোর সকেটে ঢুকিয়ে দিল ও। আট ব্যাটারির একটা টর্চ জ্বলছে মেঝেতে ওর পাশে, সেটার আলোয় আলোকিত হয়ে আছে গাড়ির নিচেটা। একটানা দু’ঘণ্টা ধরে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে একটা একটা করে রাইফেলের বিচ্ছিন্ন অংশ ভরা স্টীল টিউবগুলো ওয়েল্ডিং করল আলফার ঢেসিসের ইনার ফ্রাঞ্জের ভিতর। টিউবগুলো মোটা কাপড় দিয়ে আগেই মুড়ে নিয়েছে রানা। স্টীল অয়্যার দিয়ে সেগুলো ফ্রাঞ্জের সাথে জড়িয়ে বেঁধে নিল। তারের প্রান্তগুলো চেসিসের কিনারায় যেখানে স্পর্শ করেছে সেখানে শোল্ডারিং আয়রনের সাহায্যে ওয়েল্ডিং করে আটকে দিল ও।

কাজ শেষ করে গাড়ির নিচ থেকে কালিঝুলি আর তেল মাখা ভূতের চেহারা নিয়ে বেরিয়ে এল রানা। হাত দুটো ব্যথায় অবশ হয়ে গেছে। তবে কাজ শেষ করার আনন্দটুকু উপভোগ করছে রানা। খুঁত নেই কোথাও। গাড়ির তলায় ঢুকে না খুঁজলে টিউবগুলোর অস্তিত্ব টের পাওয়া কারও পক্ষে সম্ভব নয়। ধুলো আর কাদায় ঢাকা পড়ে যেতেও খুব বেশি সময় নেবে না ওগুলো।

ওভারঅলস, শোল্ডারিং আয়রন, এবং অবশিষ্ট তার ক্যানভাসের ব্যাগে ভরে সেটা এক কোণার ছেঁড়া-ফাটা কাপড়-চোপড় আর কম্বলের স্তূপের ভিতর ঢুকিয়ে রাখল। মেটাল ক্লিপার জোড়া গাড়ির গ্লান্ড কমপার্টমেন্টে জায়গা করে নিল।

ইতোমধ্যে শহরে সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। বুটের ভিতর সুটকেসটা ভরে আলফার ড্রাইভিং সীটে উঠে বসল রানা। বাইরে বেরিয়ে এসে গাড়ি থামাল। বন্ধ করল গ্যারেজটা। পকেটে চাবি ফেলে ফিরে এল হোটেলে।

আধঘণ্টা বিশ্রাম নিল রানা। তারপর ককটেল আর ডিনারের জন্যে প্রস্তুতি নিতে শুরু করল। প্রথমে গরম, তারপর ঠাণ্ডা পানিতে স্নান করল। পোশাক পরল। নিচে নেমে বার-এ যাবার পথে রিসেপশন ডেস্কে থেমে জানিয়ে দিল ডিনারের পর তাকে যেন বিল দেয়া হয়, এবং পরদিন সকাল সাড়ে পাঁচটায় এক কাপ চা নিয়ে রূম সার্ভিস যেন তার ঘুম ভাঙায়।

.

লন্ডন। তেরোই অক্টোবর।

কাজ পাগল ডিটেকটিভ সুপারিনটেনডেন্ট ম্যালকম লয়েডকে বাধা দিয়ে হতাশ করা যে সম্ভব নয় তা আরেকবার প্রমাণ হয়ে গেল। গভীর রাতেই খবর পেল যে, সান্তিনো ভ্যালেন্টির তালা মারা বাড়ি তল্লাশী করার জন্যে প্রয়োজনীয় সার্চ ওয়ারেন্ট সংগ্রহ করা অনির্দিষ্টকালের জন্যে সম্ভব নয়। ম্যাজিস্ট্রেটরা কবে নাগাদ তাদের ধর্মঘট প্রত্যাহার করবে তার কোন ঠিক নেই। এটা একটা মস্ত বাধা। আর কেউ হলে সার্চ ওয়ারেন্টের অপেক্ষায় হাত গুটিয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কিছু করার কথা ভাবত না। কিন্তু কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে বিকল্প পথের অভাব কখনও ম্যালকম লয়েডের হয় না। সকাল দশটায় নিজেই সে বেরিয়ে পড়ল। তার জানা আছে, দেশে নেই বলে সন্দেহ করা হচ্ছে এমন একজন লোককে খুঁজে বের করতে হলে সবচেয়ে আগে সাহায্য নিতে হবে পেটি ফ্রান্সের পাসপোর্ট অফিসের।

নিজের পরিচয় এবং ব্যক্তিগত মধুর ব্যবহার উপহার দিয়ে পাসপোর্ট অফিসের লোকদের কাছ থেকে আন্তরিক সহযোগিতা আদায় করে নিল সে। একটা নির্জন কামরা ছেড়ে দেয়া হলো তাকে। তিনজন কেরানী তাকে সাহায্য করল।

কাজটা শুধু কঠিন নয়, ভীতিকর।

আগেই জানা গেছে, সান্তিনো ভ্যালেন্টি নামে কোন লোক ইংল্যান্ড ত্যাগ করেনি। কিন্তু সন্দেহ করা হচ্ছে লোকটা দেশে নেই। দেশ ত্যাগ করার বেআইনী অনেক পথ আছে, কিন্তু মস্ত এবং বিপজ্জনক একটা দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে যে লোক, বেআইনী পথে আন্তর্জাতিক সীমান্ত পেরোবার ঝুঁকি সে নেবে না। আইনকে সন্তুষ্ট করে এগোনো তার জন্যে সব দিক থেকে নিরাপদ। অর্থাৎ বৈধ পথেই সান্তিনো ভ্যালেন্টি ইংল্যান্ড ত্যাগ করেছে বা করার চেষ্টা করবে। তা করতে হলে পাসপোর্ট দরকার। এবং নতুন পাসপোর্ট সংগ্রহ করা ইংল্যান্ডে পানির মত সহজ কাজ। ম্যালকম লয়েডের বিশ্বাস, এই সহজ এবং নিরাপদ উপায়টাই গ্রহণ করেছে লোকটা।

কিন্তু খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেল গত দু’মাসে প্রায় পাঁচ লক্ষের মত নতুন পাসপোর্টের জন্যে আবেদনপত্র এসেছে পাসপোর্ট অফিসে, আবেদনকারীদের প্রায় সবাই যার যার পাসপোর্ট পেয়েও গেছে। প্রশ্ন হলো, এই পাঁচ লক্ষের মধ্যে সান্তিনো ভ্যালেন্টি আছে কিনা? যদি থাকে, সে কি নামে পাসপোর্টের জন্যে আবেদন করেছিল? নিজের চেহারার কি বর্ণনা দিয়েছে? এই ধরনের অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর চাই, কিন্তু পাওয়ার কোন উপায় নেই। এসব জানা থাকলে পাঁচ লক্ষ আবেদন-পত্রের ভিতর থেকে নির্দিষ্ট লোকটাকে খুঁজে বের করা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার হলেও অসম্ভব ছিল না। কিন্তু জানা না থাকলে কাজটা এক কথায় অসম্ভব।

সঙ্কট অনুধাবন করে বেশ একটু দমে গেল ম্যালকম লয়েড। অবশ্য পাঁচ মিনিট চিন্তাভাবনা করে সঙ্কট থেকে উদ্ধারের একটা পথও বের করে ফেলল সে। তার দু’জন সহকারীকে টেলিফোনে নির্দেশ দিল পাসপোর্ট অফিসে চলে আসার জন্যে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেল তারা। অত্যন্ত সাবধানে কাগজের উপর পেন্সিল দিয়ে একটা স্কেচ আঁকল সে। বলল, ‘সান্তিনো ভ্যালেন্টির চেহারার বর্ণনা অনুযায়ী এটা আঁকলাম। লোকটার চোখের মণি কালো। পাঁচ ফিট এগারো ইঞ্চি লম্বা। কাজটা কঠিন, অসংখ্য পাসপোর্টের আবেদনপত্র সাঁটা ফটোর সাথে, চেহারার বর্ণনার সাথে মেলাতে হবে এই স্কেচ। মিল পাওয়া যাচ্ছে এমন সব আবেদনপত্র আলাদা করে রাখতে হবে। আপাতত এভাবেই কাজ চালাতে হবে, তারপর দেখা যাক কি হয়।’ একটু থেমে কি যেন ভাবল সে। তারপর বলল, ‘তিনজন কেরানী সহ এখানে আমরা ছয়জন রয়েছি, অফিসে ফোন করে আরও ছয়জন সহকর্মীকে ডেকে নাও। আজকের মধ্যেই বাছাইয়ের কাজ শেষ করতে চাই আমি।’

প্রচণ্ড খাটনির কাজ, কিন্তু সহকারীরা এতটুকু বিচলিত না হয়ে সাথে সাথে উঠে পড়ে লাগল। তাই দেখে সন্তুষ্ট চিত্তে মুচকি হাসল ম্যালকম লয়েড। বলল, ‘প্রথমে গত পঞ্চাশ দিনের মধ্যে করা আবেদনপত্র চেক করো। তার মানে সত্তর থেকে আশি হাজার ফটোর সাথে মেলাতে হবে এই স্কেচ। ‘

বিকেল সাড়ে চারটে পর্যন্ত নাক গুঁজে কাজ করার পর তিন হাজার ফটোসহ আবেদনপত্র বাছাই করা সম্ভব হলো। ইতোমধ্যে ম্যালকম লয়েড নিজের অফিসে ফিরে গেছে। ঠিক পোনে পাঁচটার সময় উৎফুল্ল মনে আবার ফিরে এল সে। জানাল, একলাফে অনেকদূর এগিয়ে গেছে কাজ। বিকেল তিনটের সময় ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছে ম্যাজিস্ট্রেটরা। সাড়ে তিনটেয় সার্চ ওয়ারেন্ট পাওয়া গেছে। এবং পরবর্তী আধঘণ্টার মধ্যে সান্তিনো ভ্যালেন্টির ভাড়া করা খালি বাড়িটা তল্লাশী করাও শেষ হয়েছে। সান্তিনো ভ্যালেন্টির প্রকৃত পরিচয় জানা যায়নি বটে, কিন্তু তার বেডরূমে সান্তিনো ভ্যালেন্টি নামে ইস্যু করা পাসপোর্টটা পাওয়া গেছে। পাসপোর্টের ফটোটা সহকারীদের দিল সে। বলল, ‘তোমাদের কাজ এখন অনেক সহজ হয়ে গেল। স্কেচটাকে বাদ দিয়ে এখন তোমরা এই ফটোর সাথে মিল খোঁজো। কিন্তু সাবধান, এ লোক ছদ্মবেশ নিয়ে আছে, একথাটা ভুলো না।’

এরপর ম্যালকম লয়েড তার সহকারীদেরকে সংক্ষেপে বোঝাল, নকল বা জাল পাসপোর্ট সাধারণত কিভাবে সংগ্রহ করা হয়। ঘটনাক্রমে রানা ঠিক যে পদ্ধতিতে নকল পাসপোর্ট সংগ্রহ করেছে ম্যালকম লয়েডও সেই পদ্ধতিটা ব্যাখ্যা করল তার সহকারীদেরকে।

‘গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো,’ উপসংহার টেনে বলল সে, ‘বার্থ সার্টিফিকেট নিয়ে বেশি মাথা ঘামিয়ো না। চেক করতে হবে ডেথ সার্টিফিকেটগুলো। খুঁজতে খুঁজতে এমন একজনের আবেদনপত্র যদি পাও যে লোক বেঁচে নেই, তাহলেই মনে করবে আমরা যাকে খুঁজছি পেয়েছি তাকে।’

এরপর সহকারীদের সাহায্যার্থে নিজের অফিস থেকে ম্যালকম লয়েড রেজিস্ট্রি অভ বার্থ, ম্যারেজ অ্যান্ড ডেথ অফিসকে ফোনের মাধ্যমে জানিয়ে দিল তারা যেন তার সহকারীদেরকে জরুরী ভিত্তিতে সম্ভাব্য সবরকম সাহায্য করে।

.

সেদিন রাত দশটায় ক্লড র‍্যাঁবো তাঁর দ্বিতীয় প্রোগ্রেস রিপোর্টে জানালেন, সান্তিনো ভ্যালেন্টিকে খুঁজে বের করার ব্যাপারে ইংল্যান্ডের স্পেশাল ব্রাঞ্চ যথেষ্ট এগিয়ে গেছে!

‘শালা পাগলটার লন্ডনের বাড়ি খুঁজে পাওয়া গেছে, সুরেতের অ্যাসিসট্যান্ট ডিরেক্টর বিশাল বপু কর্নেল প্যাপন সেদিন রাতে বাড়ি ফিরে তার প্রেয়সী লুইসা পিয়েত্রোকে কোলে টেনে নিয়ে বলল, ‘ব্যাটা এবার যাবে কোথায়!’

ছ্যাঁৎ করে উঠল পিয়েত্রোর বুকটা। আধঘণ্টা পর কর্নেলের যখন নাক ডাকছে, বিছানা থেকে নেমে পা টিপে টিপে পাশের কামরায় গিয়ে ঢুকল সে। ঠিক এই সময় তেরো তারিখের সমাপ্তি ঘোষণা করে দেয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং করে বাজতে শুরু করল রাত বারোটা।

.

চোদ্দই অক্টোবর। মিলান। সকাল সাড়ে ছ’টা।

পঞ্চাশ মিনিট আগে রওনা হয়ে গেছে রানা মিলান শহরকে পিছনে ফেলে রেখে এসেছে সে। আলফা রোমিওর হুড তোলা, সকালের উষ্ণ মিঠে রোদ লাগছে ওর মুখে। চওড়া সরল রাস্তা। একহাতে স্টিয়ারিং হুইল ধরে আছে রানা। ঘণ্টায় আশি মাইল স্পীডে রাস্তার উপর দিয়ে উড়ে চলেছে রোমিও। ঠাণ্ডা বাতাসের প্রচণ্ড চাপে ওর কপালে সেঁটে আছে ক’গাছি চুল। চোখে গাঢ় রঙের চশমা।

আরেকবার দেখল রানা রোড ম্যাপটা। ফ্রেঞ্চ সীমান্ত ভেন্টিমিগলিয়া এখনও দুশো দশ কিলোমিটার দূরে—মানে প্রায় একশো ত্রিশ মাইল। দু’ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছবার ইচ্ছা ওর। সম্ভব—যদি কোন ট্রাক বহরের পিছনে আটকা পড়তে না হয়।

আটটা বাজতে দশ মিনিট বাকি। ফ্রন্টিয়ার পয়েন্টে পৌঁছে রানা দেখল দৈনন্দিন যানবাহনের ভিড় ইতোমধ্যেই জমতে শুরু করেছে।

ত্রিশ মিনিট লাইনে অপেক্ষা করার পর কাস্টমস চেকিংয়ের জন্যে লাইন থেকে বেরিয়ে ফাঁকা একটা পার্কিং এলাকায় যেতে বলা হলো ওকে। একজন ইউনিফর্ম পরা পুলিস অফিসার ওর পাসপোর্ট পরীক্ষা করছে। লোকটা অস্ফুটে একবার বলল, ‘এক মিনিট, মশিয়ে।’ পাসপোর্টটা ফিরিয়ে না দিয়ে দ্রুত কাস্টমস শেডে গিয়ে ঢুকল সে।

বিপজ্জনক মোড় নিতে পারে পরিস্থিতি, জানে রানা। কিন্তু উদ্বেগের কোন ছায়া ফুটল না ওর চেহারায়। গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দিব্যি সিগারেট ফুঁকছে। পুলিস অফিসার সিভিল ড্রেস পরা একজন লোককে সাথে নিয়ে বেরিয়ে এল কাস্টমস শেড থেকে। চোখ এড়াল না রানার, ইতোমধ্যে ওর পাসপোর্টটা হাতবদল হয়ে গেছে।

‘এটা আপনার পাসপোর্ট?’ অত্যন্ত ভদ্রতার সাথে জানতে চাইল কাস্টমস অফিসার।

‘হ্যাঁ!’

উত্তর পেয়ে নতুন করে পাসপোর্টটা পরীক্ষা করতে শুরু করল কাস্টমস অফিসার। এক সময় মুখ তুলে তাকাল রানার দিকে। বলল, ‘কিছু যদি মনে না করেন, চশমাটা নামাবেন কি?’

মৃদু হাসল রানা। নিঃশব্দে গাঢ় রঙের চশমাটা চোখ থেকে নামাল।

কাস্টমস অফিসার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখল রানার চোখ দুটো। প্রায় দশ সেকেন্ড পর আবার সে পাসপোর্টের দিকে তাকাল। কি যে বুঝল বা কি ভাবছে, অনুমান করতে পারল না রানা।

‘ফ্রান্সে কি উদ্দেশে যাচ্ছেন আপনি?’ অবশেষে পাসপোর্ট থেকে দৃষ্টি তুলে রানার মুখের দিকে তাকাল কাস্টমস অফিসার।

বেড়াতে।

‘আই সি। গাড়িটা আপনার?’

‘না। ভাড়া করা। ইটালিতে কাজ ছিল, হঠাৎ এক হপ্তার জন্যে করার কিছু নেই দেখে ফ্রান্স ভ্রমণের সুযোগটা নিতে যাচ্ছি।’

আই সি! তা গাড়ির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিশ্চয়ই আপনার সাথে আছে?’ নিঃশব্দে ইন্টারন্যাশনাল ড্রাইভিং লাইসেন্স, গাড়ি ভাড়া করার চুক্তিপত্র, এবং দুটো ইন্সুরেন্স সার্টিফিকেট বের করে দিল রানা। সাদা পোশাক পরা কাস্টমস অফিসার এক এক করে চেক করল সবগুলো।

‘সাথে লাগেজ আছে, মশিয়ে?’

আছে। বুটে তিনটে সুটকেস। এবং একটা হ্যান্ডগ্রিপ।’

‘আর কিছু নেই?’

‘না।’

বেশ। কাস্টমস হলে নিয়ে আসুন ওগুলো।’

কাস্টমস অফিসার চলে গেল, পাসপোর্টটা রানাকে ফিরিয়ে না দিয়েই। কোথাও গণ্ডগোল হয়েছে, পরিষ্কার বুঝে নিয়েছে রানা। এদিকের বর্ডারে চেকিংয়ের ব্যাপারটা নামে মাত্র, জানা আছে ওর, তার মানে আজকের এই কড়াকড়ি আরোপের পিছনে নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে। কি হতে পারে সেই কারণ? অনুমান করতে গিয়ে হার মানল রানা। কড়াকড়ি আরোপের একমাত্র কারণ ও নিজে, এ-কথাটা একবারও মনে হলো না ওর।

সুটকেসগুলো আর হ্যান্ডগ্রিপটা গাড়ি থেকে নামাতে সাহায্য করল ওকে পুলিস অফিসার। দু’জনে বয়ে নিয়ে গেল ওগুলো কাস্টমস শেডে। মিলান ত্যাগ করার আগে সুটকেস থেকে পুরানো গ্রেটকোট এবং মার্ক রোডিনের ট্রাউজার ও জুতো বের করে গুটিয়ে গোল পাকিয়ে গাড়ির বুটে রেখে দিয়েছে রানা। বাকি দুটো সুটকেস থেকে কিছু কিছু কাপড়-চোপড় নিয়ে ভরেছে তৃতীয় সুটকেসে। মার্ক রোডিনের কাগজপত্র এই সুটকেসেরই লাইনিংয়ের ভিতর সেলাই করা আছে। মেডেলগুলো সব এখন রানার পকেটে।

কাস্টমস অফিসার প্রতিটি কেস পরীক্ষা করল। এই ফাঁকে রীতি অনুযায়ী ফ্রান্সে ঢোকার অনুমতি চেয়ে একটা ফর্ম পূরণ করল রানা। কাস্টমস অফিসার সুটকেসে এমন কিছু পেল না যা দেখে উত্তেজিত হওয়ার কারণ ঘটে।

চোখের কোণ দিয়ে জানালা পথে দেখতে পাচ্ছে রানা, আলফা রোমিওর বুট সার ইঞ্জিন বনেট পরীক্ষা করছে দু’জন কাস্টমস অফিসার। গাড়ির তলাটা পরীক্ষা করার কোন লক্ষণ এখনও তাদের মধ্যে দেখতে পাচ্ছে না রানা। তাদের একজন বুট থেকে গ্রেটকোট আর ট্রাউজার বের করে ভাঁজ খুলল। দুটোই ভয়ঙ্কর নোংরা, দুর্গন্ধময়। নাক কুঁচকে উঠল অফিসারের। আপন মনে হাসল রানা। ওভারকোট আর ট্রাউজার দুটো গাড়িতে কেন রাখা হয়েছে এ প্রশ্নের উত্তর তৈরি করা আছে ওর। রাতের বেলা গাড়ির নাকটাকে শিশির-মুক্ত রাখার জন্যে ওভারকোটটা ব্যবহার করে ও। আর পুরানো কাপড়টা গাড়ি মুছতে দরকার হয়। কিন্তু শেডে ফিরে এসে দু’জন অফিসারের কেউই কোন প্রশ্ন করল না রানাকে।

ফর্মটা পূরণ করা শেষ হলো রানার, একই সময় শেষ হলো কাস্টমস অফিসারের লাগেজ চেক করা। রানার কাছ থেকে এন্ট্রি কার্ড চেয়ে নিয়ে পাসপোর্টের সাথে মিলিয়ে দেখে নিল সেটা অফিসার, তারপর রানাকে ফিরিয়ে দিল পাসপোর্টটা।

‘ধন্যবাদ, মশিয়ে,’ অত্যন্ত ভদ্রতার সাথে বলল সে রানাকে। ‘কামনা করি, আপনার ফ্রান্স ভ্রমণ সাৰ্থক হোক।

‘অসংখ্য ধন্যবাদ,’ খুশি হয়ে বলল রানা।

দশ মিনিট পর। রানাকে নিয়ে তুমুল গতিতে ছুটছে আলফা রোমিও। মেন্টন- এর পুব এলাকায় পৌঁছে একটা কাফের সামনে গাড়ি দাঁড় করাল রানা। পুরানো বন্দর আর ইয়ট বেসিনটা দেখা যায় কাফে থেকে। ধীরেসুস্থে আয়েশ করে ব্রেকফাস্ট সারল ও। তারপর করনিক-এর উপর দিয়ে মোনাকো, নীস এবং ক্যানূেস অভিমুখে রওনা হলো ঝড়ের বেগে।

.

লন্ডন। চোদ্দই অক্টোবর।

স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডিটেকটিভ সুপারিনটেনডেন্ট ম্যালকম লয়েডের নেতৃত্বে বারোজন লোক রাত জেগে পাসপোর্ট বাছাইয়ের কাজ পুরোদমে চালিয়ে যাচ্ছে। আরও পঞ্চাশ দিন আগে থেকে করা পাসপোর্টের আবেদনপত্র বাছাই করার আওতায় নিয়ে আসার ফলে এখন বারোজনের সামনে সর্বমোট আট হাজার একচল্লিশটা ফটোসহ আবেদনপত্র রয়েছে। এগুলোর সাথে সান্তিনো ভ্যালেন্টির পাসপোর্টে পাওয়া ফটোর চেহারা মেলাবার কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। ইতোমধ্যে প্রায় পঞ্চাশটা ফটোর সাথে সান্তিনো ভ্যালেন্টির চেহারার কিছু কিছু মিল পাওয়া গেছে, যদিও এ-ধরনের মিল তেমন কোন গুরুত্ব বহন করে না। ওদের জানা আছে, সান্তিনো ভ্যালেন্টি ছদ্মবেশ নিয়েছে, এবং তার ছদ্মবেশ ধারণের একমাত্র উদ্দেশ্য নিজের চেহারা যথাসম্ভব গোপন করা। কিন্তু যতই সে গোপন করার চেষ্টা করুক, তার পাসপোর্টে যে ছবিটা আছে তা সামনে থেকে তোলা, সুতরাং মুখের কাঠামো, মাথার আকৃতি, কাঁধের বিস্তার, চোখের মণি ইত্যাদি সফলতার সাথে কোনভাবেই পুরোপুরি গোপন রাখতে পারবে না সে। এই বিশ্বাস আছে বলেই এরা নিশ্চিত ভাবে জানে লোকটাকে ধরা পড়তেই হবে।

ইতোমধ্যে অন্যান্য কাজও শুরু করে দিয়েছে ম্যালকম লয়েড। বার্থ, ডেথ এবং ম্যারেজ রেজিস্ট্রি অফিসে দু’জন সহকারীকে বসিয়ে রেখেছে সে। পাসপোর্ট অফিস থেকে প্রতি একঘণ্টা পরপর কয়েকজন লোকের নাম, ঠিকানা, জন্ম তারিখ ইত্যাদি সরবরাহ করা হচ্ছে তাদেরকে টেলিফোনযোগে। তারা সাথে সাথে তথ্যগুলো সঠিক কিনা তা যাচাই করার জন্যে রেজিস্ট্রি অফিসের ফাইল পত্র ঘেঁটে দেখছে।

.

ফ্রান্স। চোদ্দই অক্টোবর। বেলা এগারোটা।

বনবন ঘুরছে রোমিওর চারটে চাকা। ক্যানেসের মাঝখান দিয়ে গাড়ি হাঁকাচ্ছে রানা। সাধারণত কোনরকম ঝুঁকি না থাকলে শহরের সেরা হোটেলে ওঠে রানা, এখানেও তার ব্যতিক্রম ঘটল না। হোটেল ম্যাজেস্টিকের সামনে গাড়ি থামিয়ে দ্রুত চিরুনি চালিয়ে মাথার চুলগুলোকে বশ করে নিল ও। অনেক্ আগে সকাল হয়েছে, তাই হলরূমে তেমন ভিড় বা ব্যস্ততা নেই। ওর পরনের দামী স্যুট, হাঁটার ভঙ্গিতে আভিজাত্য, চেহারায় আত্মবিশ্বাস আর ব্যক্তিত্ব লক্ষ করে দু’চারজন যারা রয়েছে তারা মনে করল সে একজন ইংরেজ ব্যবসায়ী। একজন বেলবয়কে ডেকে জেনে নিল ও টেলিফোন বুদটা কোনদিকে।

কাউন্টারে একটা মেয়ে বসে আছে। তার একপাশে সুইচবোর্ড, অপর পাশে টেলিফোন বুদ। পায়ের শব্দ শুনে মুখ তুলে তাকাল মেয়েটা।

‘প্লীজ গেট মি প্যারিস, মৃদু কণ্ঠে বলল রানা। ‘Mol।tor 5900।’

তিন মিনিট পর মেয়েটা ইঙ্গিত করল ওকে বুদে ঢোকার জন্যে। সাউন্ডপ্রুফ দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিল রানা।

‘হ্যালো, পারূ?’

‘হ্যালো, নারা, কাঁপা, উত্তেজিত গলায় কথা বলছে রূপা। ‘গত দু’দিন থেকে তোমার খোঁজে ইউরোপ চষে ফেলছে লহেসো, তেহারার নির্দেশে। থ্যাঙ্ক গড, ইউ হ্যাভ রাং। শোনো…।

ছ্যাৎ করে উঠল রানার বুক। মুহূর্তে পাথরের মত শক্ত হয়ে গেল শরীর। ধীরে ধীরে কুঁচকে উঠল ভুরু জোড়া। অপরপ্রান্তে কথা বলছে রূপা। শুনছে রানা। একবার শিউরে উঠল ও। ঝাড়া দশ মিনিটের আলাপে প্রায় সারাক্ষণ চুপ করে থাকল ও। চাপা গলায় ছোট্ট, দ্রুত প্রশ্ন করার সময় মাঝেমধ্যে ঠোঁট জোড়া নড়ল ওর।

কেউ লক্ষ করছে না ওকে। সুইচবোর্ডের মেয়েটা ডুবে আছে একটা রোমান্টিক উপন্যাসে। হঠাৎ তার সংবিৎ ফিরল। দেখল, টেলিফোন বুদ থেকে বেরিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে দীর্ঘদেহী বিদেশী ভদ্রলোক, গাঢ় রঙের চশমার ভিতর দিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সুইচবোর্ডের মিটার দেখে একটা বিল লিখল মেয়েটা, রানার কাছ থেকে পাওনা বুঝে নিল। কথা হলো না ওদের মধ্যে।

হল থেকে বেরিয়ে উঁচু, খোলা বারান্দায় উঠে এসে একটা টেবিল দখল করে বসল রানা। একপট কফির অর্ডার দিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে তাকাল সাগরের দিকে। রোদে পোড়া তামাটে শরীর নিয়ে পানিতে ঝাঁপ দিচ্ছে, সাঁতার কাটছে মেয়ে আর পুরুষেরা। ওয়েটার কফি দিয়ে গেল। দীর্ঘ টান দিয়ে বুক ভরে সিগারেটের ধোঁয়া নিল রানা। গভীর চিন্তামগ্ন দেখাচ্ছে ওকে।

বারান্দায় এইমাত্র আরেকটা প্রাণী এসে উঠল। সেদিকে খেয়াল নেই রানার। দেখে চমকে উঠতে হয় এমন এক রূপসী মেয়েকে নিজের অজ্ঞাতে ফাঁদে আটকে ফেলেছে রানা।

ভাবছে রানা। ম্যাটাপ্যান নেই! বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল আরেকবার। বুকের ভিতর একটা যাতনা অনুভব করছে, ঠেলে উঠে এল একটা দীর্ঘশ্বাস। এ ক্ষতি পূরণ হবার নয়। ম্যাটাপ্যান কেমন লোক ছিল এ কাউকে ব্যাখ্যা করে বোঝানো যাবে না। তার মত বিশ্বস্ত, দুঃসাহসী, নিবেদিত-প্রাণ ভক্ত জীবনে খুব কমই পেয়েছে রানা। ন্যায়ের প্রশ্নে আপসহীন, বিপদের মুখে নির্ভীক। একজন খাঁটি মানুষ বলতে যা বোঝায় ম্যাটাপ্যান ছিল ঠিক তাই।

সেই ম্যাটাপ্যান নেই! উ সেন তাকে খুন করেছে। রাগ, আক্রোশ, জেদ বা অস্থিরতা—কিছুই অনুভব করল না রানা। এ-ধরনের আঘাত খেয়ে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে যেন ও। শুধু একটা ঘৃণা বোধ ছড়িয়ে পড়ল ওর সারা শরীরে।

ম্যাটাপ্যানের মুখ থেকে ওর সান্তিনো ভ্যালেন্টি পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়েছে, এটা ভাবতে গিয়ে হোঁচট খেল রানা। কিভাবে? এ অসম্ভব! পরক্ষণে মনে পড়ল ইউনিয়ন কর্সের লোক আছে ফ্রেঞ্চ অ্যাকশন সার্ভিসে, এরা দুনিয়ার সবচেয়ে নিষ্ঠুর পদ্ধতিতে মানুষকে শারীরিক কষ্ট দিয়ে খুন করার ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ। ম্যাটাপ্যানকে কি রকম যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে ভাবতে গিয়ে শিউরে উঠল রানা।

মেয়েটা নির্নিমেষ দৃষ্টিতে দেখছে রানাকে। ওর মুখের ভাব পরিবর্তনগুলো দৃষ্টি এড়াচ্ছে না তার।

কিন্তু, ভাবছে রানা, রূপা ওকে হাতের কাজ বাতিল করে দিয়ে দেশে ফিরে যেতে বলছে কেন? নির্দেশটা নাকি স্বয়ং মেজর জেনারেল রাহাত খানের।

ওর জন্যে বি-সি-আই উদ্বিগ্ন, ভাবছে রানা, তার অবশ্য সঙ্গত কারণ আছে। কিন্তু ও এমন কিছু জানে যা বি-সি-আই জানে না, জানে না ফ্রেঞ্চ অ্যাকশন সার্ভিস এবং ইউনিয়ন কর্স। তা হলো: সে অন্য একজনের নাম ধারণ করে রওনা হয়েছে, সেই নামের আইন সম্মত পাসপোর্টও রয়েছে ওর সাথে। এছাড়াও রয়েছে আলাদা আলাদা তিন প্রস্থ জাল কাগজপত্র, দুটো বিদেশী পাসপোর্ট, পাসপোর্টগুলোর সাথে চেহারার মিল তৈরি করার প্রয়োজনীয় সমস্ত সরঞ্জাম।

ক্লড র‍্যাঁবো। এই ভদ্রলোককে ছোট করে দেখা যায় না। হাসিও পায়, দুঃখও হয়—ভাবছে রানা, যে মানুষের গুণের কথা শুনে তাঁকে শ্রদ্ধা করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে ও, ভাগ্যের কি চমকপ্রদ কৌতুক, সেই মানুষই আজ ওর সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছেন। সে যাই হোক, ক্লড র‍্যাঁবো যে একটা আশ্চর্য প্রতিভা তাতে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু তাঁর হাতেই বা সূত্র কোথায় যে ওকে খুঁজে বের করবেন তিনি? সূত্র বলতে তিনি সম্ভবত জানেন ওর চেহারার অস্পষ্ট বর্ণনা, লম্বা, বিদেশী। এ ধরনের বিদেশী লোক হাজার হাজার পাওয়া যাবে অক্টোবরের ফ্রান্সে। উ সেন চাইলেও ইউনিয়ন কর্ম বা ফ্রেঞ্চ সরকারের পক্ষে এদের সবাইকে গ্রেফতার করা তো আর সম্ভব নয়।

ওর অনুকূলে আরেকটা ব্যাপার রয়েছে। সান্তিনো ভ্যালেন্টির পাসপোর্টধারী জন লোককে খুঁজছে ইউনিয়ন কর্স এবং ফ্রেঞ্চ সরকার। বেশ তো খুঁজুক না। সম্ভব হলে খুঁজে বেরও করুক, তাতে কোন ক্ষতি নেই ওর। সে তো আর এখন সান্তিনো ভ্যালেন্টি নয়। সে আলেকজান্ডার অরগ্যান। নিজের এই পরিচয় সে প্রমাণও করতে পারবে।

ওর এই নতুন পরিচয়ের কথা ও নিজে ছাড়া দুনিয়ার আর কেউ জানে না। ফরজার পিসিক অবশ্য জানে—কিন্তু তাকে শুধু বেলজিয়ামের রানা এজেন্সীর আস্তানায় আটকে রাখারই নির্দেশ দেয়নি ও; সেই সাথে জরুরী নির্দেশ দিয়েছে চব্বিশ ঘণ্টা পর পর ওষুধ ইঞ্জেক্ট করে লোকটাকে যেন পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত অজ্ঞান করে রাখা হয়। ওর এই নির্দেশ রানা এজেন্সীর শাখা প্রধান অবশ্যই অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে, এ ব্যাপারে রানা নিঃসন্দেহ। সুতরাং, এখন ওর পরিচয় কি, কোথায় রয়েছে, ভবিষ্যতে নিজের কি পরিচয় দেবে, কোথায় যাবে ইত্যাদি সম্পর্কে কারও কিছু জানা নেই।

এসব সত্ত্বেও, বিপদের মাত্রা একলাফে কয়েক হাজার গুণ বেড়ে গেছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। ও বেঁচে আছে এবং উ সেনকে হত্যা করার প্ল্যান নিয়েছে এ কথা প্রকাশ হয়ে পড়েছে জেনেও পিছিয়ে না যাবার মানে লক্ষ লক্ষ ট্রেনিংপ্রাপ্ত দুর্ধর্ষ লোকের বিরুদ্ধে একা নিধিরামের যুদ্ধ ঘোষণা করার মত হাস্যকর ব্যাপার। এখন একমাত্র প্রশ্ন হলো: হত্যা করার জন্যে ওর প্ল্যানটা উ সেনের নিরাপত্তা প্রহরাকে পরাজিত করতে পারবে কিনা? নিজের উপর সম্পূর্ণ আস্থা রেখে ভাবল রানা—পারবে।

প্রশ্নটা তবু খচ্ খচ্ করছে মনের ভিতর। এর একটা আরও পরিষ্কার উত্তর চাই। ফিরে যাবে ও, নাকি সামনে এগিয়ে যাবে? ফিরে যাওয়া মানে নিজেকে অপমান করা, সালমাকে অপমান করা, গিলটি মিয়াকে অপমান করা, ম্যাটাপ্যানকে অপমান করা। ফিরে যাওয়া মানে একটা অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া, নিজেকে মেরুদণ্ডহীন প্রমাণিত করা। আর এগিয়ে যাওয়া মানে দ্রুত বিপদের কুটিল জালে অনুপ্রবেশ করা, যেখান থেকে ফিরে আসার পথ অচিরেই রুদ্ধ হয়ে যাবে।

পট থেকে আরেক কাপ কফি ঢালছে রানা। চুমুক দিতে গিয়ে এই প্রথম দ্বিতীয় একজনের অস্তিত্ব অনুভব করল ও। ওর পনেরো হাত সামনে, রেলিংয়ের কাছাকাছি বসে আছে মেয়েটা। আরে, ভারি সুন্দরী তো! এর বেশি কিছু ভাবল না রানা। সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল ও মেজর জেনারেল রাহাত খানের ব্যক্তিগত নির্দেশটা লঙ্ঘন করবে। ফিরে ও যাবে না।

দু’মিনিটের মধ্যে বিল মিটিয়ে দিয়ে আলফা রোমিওয় চড়ে বসল রানা। ম্যাজেস্টিক ছেড়ে ফ্রান্সের হৃৎপিণ্ডের দিকে ছুটে চলেছে কাপু উ সেনের হবু হত্যাকারী।

একটা মার্সিডিজ গাড়ি নিয়ে ওকে অনুসরণ করছে সেই মেয়েটা।