সেই উ সেন – ২.৪

চার

ছোটখাট মানুষটা ঘন ঘন চুরুটে টান আর মেহদী রঙের ফ্রেঞ্চকাট দাড়িতে হাত বুলাবার ফাঁকে এমন সব কলকাঠি নাড়ছেন যার ফলে গোটা ফ্রান্স জুড়ে সর্বত্র ব্যস্ততার ঝড় বইতে শুরু করে দিয়েছে। দেশের চতুর্সীমার সমস্ত বর্ডার চেকপোস্টগুলো থেকে অয়্যারলেস মেসেজ এখনও আসছে। সবগুলো মেসেজের সারমর্ম, সান্তিনো ভ্যালেন্টি নামে কোন লোক বা এই চেহারার অন্য নামধারী কোন বিদেশী আগস্ট মাস থেকে আজ পর্যন্ত বর্ডার টপকে ফ্রান্সে প্রবেশ করেনি। মেসেজের শেষে সবিনয়ে ক্লড র‍্যাঁবোকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে, এই নামের বা চেহারার কোন লোককে বর্ডারে দেখা গেলে তাকে অবশ্যই আটক করা হবে।

ফ্রেঞ্চ এসপিওনাজ, সুরেত, পুলিস, অ্যাকশন সার্ভিস এবং ডিটেকটিভ ফোর্সকেও নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছেন ক্লড র‍্যাঁবো। প্যারিস এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিটি হোটেল, মেস এবং বোর্ডিংয়ের রেজিস্ট্রি বুক চেক করে রিপোর্ট নিয়ে আসছে কর্মীরা, এই নামের বা চেহারার কোন লোক কোথাও ওঠেনি। টেলিফোনযোগে ফ্রান্সের অন্যান্য শহর এবং মফঃস্বল থেকেও এই ধরনের মেসেজ প্রতি দশ মিনিটে তিন চারটে করে আসছে।

ক্লড র‍্যাঁবোর নির্দেশে ফ্রান্সের গুণ্ডাপাণ্ডাদের উপর ফ্রেঞ্চ সুরেত বিশেষ নজর রেখেছে। এরা কেউ কোন বিদেশীকে আশ্রয় দিয়েছে কিনা বা দেয় কিনা সেটা জ্ঞাত হওয়াই এই নির্দেশের উদ্দেশ্য।

প্রতিটি রিপোর্ট গ্রহণ করার পরপরই রিপোর্ট-দাতাকে পরবর্তী নির্দেশ দিচ্ছেন ক্লড র‍্যাঁবো, আবার চেক করো, আরও খবর নাও, এই লোক এ বছরের প্রথম দিকেও ফ্রান্সে এসেছিল কিনা জানতে চেষ্টা করো।

ডিটেকটিভ সুপারিনটেনডেন্ট ম্যালকম লয়েডের জরুরী বার্তা পেয়ে ক্লড র‍্যাঁবো এখন পুরোপুরি নিঃসন্দেহ, সান্তিনো ভ্যালেন্টি ইংল্যান্ডে নেই। অন্তত বেশ কিছুদিনের জন্যে বাইরে থাকার উদ্দেশ্য নিয়ে বাড়ি ছেড়েছে লোকটা—তা নাহলে দৈনন্দিন প্রয়োজনে লাগে এমন সব জিনিস, যেমন টুথব্রাশ, তোয়ালে, দাড়ি কামারার যন্ত্র, সোপ-কেস ইত্যাদি বাথরূম থেকে গায়েব হয়ে যেত না। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে খুন করার উদ্দেশ্য রয়েছে যে লোকের সে-লোক বেশ কিছুদিনের জন্যে বাড়ি ত্যাগ করেছে, সুতরাং ধরে নেয়া যেতে পারে ফ্রান্সে ঢুকেছে সে বা ঢোকার চেষ্টা করছে।

‘কিন্তু পাসপোর্টটা বাড়িতে রেখে গেছে কি মনে করে?’ জানতে চাইল সহকারী চার্লস ক্যারন।

‘সহজ ব্যাপার। ওই পাসপোর্ট তার আর দরকার নেই, তাই।’

‘নাকি ভুল করে?’

হেসে ফেললেন ক্লড র‍্যাঁবো। ‘চার্লস, মাই বয়, সান্তিনো ভ্যালেন্টিকে তুমি এখনও চেনোনি। আমি তার সম্পর্কে এ পর্যন্ত যতটুকু বুঝেছি, রীতিমত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি সে। অন্তত বুদ্ধির দৌড়ে সে কারও চেয়ে কম তো নয়ই। তার কাছ থেকে এ- ধরনের স্থূল ভুল আমি আশা করি না।’

.

দুই বৃহৎ শক্তি গরু খোঁজা করছে যাকে সেই সান্তিনো ভ্যালেন্টি ক্যানেস থেকে মার্সেই যাবার সংক্ষিপ্ত কিন্তু দুর্গম রাস্তাটা এড়িয়ে উপকূল ধরে আল্পস ম্যারিটাইমস এবং বারগাড়ির ভিতর দিয়ে ছুটে চলেছে। তেমন কোন ব্যস্ততা নেই রানার। আঘাত হানার দিনটার দেরি আছে এখনও। যথাসময়ের একটু আগেই ফ্রান্সে হাজির হয়েছে সে। অতিরিক্ত ঝুঁকি নেয়া হয়ে গেছে, তা বলা চলে না। ইউনিয়ন কর্ম এবং ফ্রেঞ্চ সরকার সান্তিনো ভ্যালেন্টিকে খুঁজছে। কিন্তু সান্তিনো ভ্যালেন্টির এখন আর কোন অস্তিত্ব নেই। সে এখন আলেকজান্ডার অরগ্যান।

বিকেলবেলা সিস্তেরোনে পৌঁছল, রানা। RN 85 হাইওয়ে দু’ভাগ হয়ে গেছে একজায়গায়, একটা শাখা ধরে উত্তর দিকে এগোল ও। সন্ধ্যা নামছে, এমন সময় ছোট্ট শহর গ্যাপে পৌঁছল। শহরের ঠিক বাইরে রুচিশীল একটা হোটেল পেয়ে গেল ও। স্যাভয়ের ডিউকদের হানটিং লজ ছিল এককালে, এখন ললাটে হোটেল দু সার্ক-এর নিওন সাইন। আরাম আয়েশ আর সুস্বাদু খাবারের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে সিটি মাপ

ইতোমধ্যে মার্সিডিজটাকে লক্ষ করেছে রানা। মেয়েটা ওর পিছু পিছু আসছে দেখে তেমন কিছু ভাবেনি ও। পিছু পিছু আসা মানে অনুসরণ করছে তা নাও হতে পারে। কিন্তু মেয়েটাকে ওর সাথেই হোটেল দু সার্ফের একটা প্রথম শ্রেণীর কামরা ভাড়া নিতে দেখে টনক নড়ল রানার। ব্যাপারটা স্রেফ কাকতালীয় বলে এখন আর মনে হচ্ছে না ওর।

নিজের কামরার দরজা বন্ধ করে দিয়ে শাওয়ার সারল রানা। সিল্কের একটা শার্টের উপর পরল ভাভ-গ্রে রঙের স্যুটটা গলায় ঝোলাল হাতে বোনা টাই। রুম মেইডকে মোটা বকশিশ দিয়ে তার হাতে চেক স্যুটটা তুলে দিল স্পঞ্জ আর ইস্ত্রি করার জন্যে।

সান্ধ্য ভোজন পরিবেশিত হলো খোলা বারান্দায়। এখান থেকে আকাশ ভরা জ্বলজ্বলে তারা, পাহাড়ের মাথা, বনভূমি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। গা জুড়ানো হু হু নাতিশীতোষ্ণ হাওয়া। একটু পরই বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠল। কালো বাদুড় উড়ে যাচ্ছে মাথার উপর দিয়ে। কাছের জঙ্গল দোলা খাচ্ছে চতুষ্পদদের দৌড়াদৌড়ি, লাফালাফিতে। মগ্নচিত্তে প্রকৃতির রূপসুধা পান করছে রান্না। এইসব একদিন ফুরিয়ে যাবে ওর জীবন থেকে। ফুরিয়ে আসছে সময়। আহা, যদি মরতে না হত! চিন্তাটা জাগতেই আপন মনে হাসল রানা। কি আছে জীবনে? এক অর্থে জীবনটা বড়ই নিরস। বেঁচে থাকাটা একঘেয়ে যান্ত্রিক। কষ্ট এড়িয়ে থাকার সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টার নাম জীবন। এমন একটা খেলা যেখানে পরাজয় অনিবার্য। তবু বেঁচে থাকাটা সৌভাগ্য বৈকি। অন্তত মানুষের সুখে সুখী হবার, দুঃখে দুঃখ বোধ করার সুযোগ পাওয়া যায়। আর কখনও বা প্রকৃতির কাছে কৃতজ্ঞ বোধ করার সুযোগ ঘটে। এই যেমন এখন। চাঁদ, ভেসে যাওয়া মেঘ, হু হু বাতাস, বনভূমির আলোড়ন, আকাশের গায়ে অলস ভঙ্গিতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ঘুম ঘুম পাহাড়, ধ্যানমগ্ন নিস্তব্ধতা এবং পাশে বসা অপরিচিতা রহস্যময়ী সুন্দরী নারীর নির্নিমেষ চাহনি—এ-সবই বড় লোভনীয়, পেলে মনে হয় জীবন বড় রোমাঞ্চকর, আর কী মধুর! কৃতজ্ঞতায় নুয়ে আসে মাথা।

‘কিছু যদি মনে না করেন…’

পাশের টেবিল থেকে ভেসে এল মার্জিত, সুরেলা কণ্ঠস্বর। সাথে সাথে তাকাল রানা মেয়েটার চোখে।

ওকে তাকাতে দেখে চুপ করে গেছে মেয়েটা।

‘কিছু বলছিলেন?’ মৃদু হেসে জানতে চাইল রানা।

‘হ্যাঁ, একটু অপ্রতিভ হলো মেয়েটা। ‘একটা প্রশ্ন করব ভাবছিলাম।‘

‘করুন।’

‘আপনি বিদেশী?’

‘হ্যাঁ,’ বলল রানা। পরমুহূর্তে অত্যন্ত বেরসিকের মত পাল্টা প্রশ্ন করল ও, কিন্তু বিদেশী হলেই যে তাকে অনুসরণ করতে হবে, এর কি মানে?’

মুহূর্তে ম্লান হয়ে গেল মেয়েটার মুখের চেহারা। দ্রুত এদিক ওদিক তাকাল সে। বারান্দায় আর মাত্র ছয় সাতজন নারী-পুরুষ রয়েছে, তবে কেউ ওদের দিকে তাকিয়ে নেই। রানার দিকে আবার তাকাল সে। কিন্তু রানার কথায় আত্মসম্মানে ঘা লেগেছে, ঢোক গিলেও কথা বলতে পারল না।

নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে রানা। মেয়েটার মনের কথা পরিষ্কার পড়তে চেষ্টা করছে ও। কি যেন এক দ্বন্দ্বে পড়ে গেছে মেয়েটা।

‘অনুসরণ করছি, একথা ঠিক নয়,’ মৃদু গলায় বলল মেয়েটা। ‘এদিকেই আসছিলাম। কিন্তু আপনি যে রুট ধরে এসেছেন সেটা ধরে হয়তো আসতাম না। ‘

‘কিন্তু এসেছেন।’

অপ্রতিভভাবে হাসল মেয়েটা। ‘হ্যাঁ।’

‘কেন?’

‘এই কেন-র উত্তর হয় না,’ ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল মেয়েটা। আপনিও কি এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন?’ হঠাৎ একেবারে খাদে নেমে গেল মেয়েটার কণ্ঠস্বর। ‘দেখি উত্তর দিতে পারেন কিনা। কেন তাকিয়ে থাকেন চাঁদের দিকে? হু হু বাতাস কেন ভাল লাগে? কেন কান পেতে নিস্তব্ধতা উপভোগ করেন? এ সবের উত্তর জানা আছে আপনার? উত্তর যদি দিতে পারেন, আমিও পারব আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে।’ বলে আর দাঁড়াল না মেয়েটা। দু’হাত দিয়ে দামী গাউনটা একটু উঁচু করে ধরে ত্রস্ত পদে চলে গেল সিঁড়ির দিকে

সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাচ্ছে মেয়েটা। সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রানা। অদ্ভুতভাবে চমকে দিয়ে গেল মেয়েটা ওকে, ভাবছে ও। বলার ভঙ্গিতে প্রগাঢ় মাধুর্য ছিল, সন্দেহ নেই। কিন্তু কি বোঝাতে চাইল সে?

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আপন মনে হাসন রানা। চলার পথে এই এক বিড়ম্বনা। প্রায়ই এই সমস্যাটা দেখা দেয় ওর জীবনে। এরা বুদ্ধিহীনা, জানে না কাকে ভাল লাগছে, জানে না এই ভাল লাগার কোন অর্থ নেই। কিংবা হয়তো সবই জানে। জেনেশুনেই হৃদয়টাকে আহত করার জন্যে বেপরোয়া হয়ে ওঠে ।

কফির কাপে চুমুক দিয়ে একটা সিগারেট ধরাল রানা। ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করছে না। অনেক রাত জাগবে আজ ও। এখানে বসে থাকবে। কেমন যেন ব্যথায় টনটন করছে হৃদয়টা। এর শুশ্রূষা একমাত্র প্রকৃতির কাছ থেকেই আশা করা যায়।

.

সমারসেট হাউজ অর্থাৎ, জন্ম, মৃত্যু এবং বিবাহ রেজিস্ট্রি অফিস থেকে ফোন এল রাত দশটায়। রিসিভার তুলল ডিটেকটিভ সুপারিনটেনডেন্ট ম্যালকম লয়েড।

ছয়জনের একটা ডিটেকটিভ সার্জেন্টের টীম সমারসেট হাউজে ডেথ সার্টিফিকেট চেক করার কাজ করছে। ফোন করছে এই টীমের নেতা। কণ্ঠস্বর ক্লান্ত, কিন্তু তাতে উত্তেজনার সুর রয়েছে। ‘আলেকজান্ডার জেমস কোয়েনটিন অরগ্যান,’ ঘোষণার সুরে বলল সে।

‘ব্যাপারটা কি তার?’ জানতে চাইল ডিটেকটিভ সুপারিনটেনডেন্ট

‘উনিশশো চল্লিশ সালের তেসরা এপ্রিলে জন্ম স্যামবোর্ন ফিশলেতে। এ বছরের চোদ্দই সেপ্টেম্বরে সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী পাসপোর্টের জন্যে ফর্ম পূরণ করে আবেদন করেছে। পরদিন ইস্যু করা হয়েছে পাসপোর্ট, আবেদনপত্রে উল্লেখ করা ঠিকানায় ডাকযোগে সেটা পাঠানো হয়েছে সতেরোই সেপ্টেম্বরে। ঠিকানাটা সম্ভবত আবেদনকারীর নিজের নয়।’

‘তার মানে?’ অধৈর্যের সাথে জানতে চাইল ম্যালকম লয়েড।

আলেকজান্ডার জেমস কোয়েনটিন অরগ্যান তার আড়াই বছর বয়সে, আটই নভেম্বর তারিখে একটা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে।’

‘হুঁ,’ ম্যালকম লয়েড উত্তেজনা চেপে রেখে গম্ভীর গলায় বলল, ‘তার মানে সম্ভবত এই আবেদনকারীই আমাদের লোক।’ খানিক চিন্তা করল সে। তারপর জানতে চাইল, ‘কত পাসপোর্ট চেক করা বাকি এখনও?’

‘শ তিনেক।’

ভুয়া দু’একটা আরও থাকতে পারে, সুতরাং ওগুলোও সব চেক করতে হবে, ‘ নির্দেশ দিল ম্যালকম লয়েড। ‘কিন্তু তুমি এই মুহূর্তে বেরিয়ে পড়ো ওখান থেকে। অরগ্যানের পাসপোর্ট যে ঠিকানায় পাঠানো হয়েছে সেটা চেক করে সাথে সাথে রিপোর্ট করো আমাকে। পাসপোর্টের আবেদনপত্রে যে ফটোটা আছে সেটাও নিয়ে আসবে। সান্তিনো ভ্যালেন্টির এই নতুন চেহারাটা দেখতে চাই আমি।’

রাত বারোটার সময় সিনিয়র ইন্সপেক্টর আবার ফোন করল ডিটেকটিভ সুপারিনটেনডেন্টকে। জানাল, ঠিকানা চেক করতে গিয়ে সে আবিষ্কার করেছে একটা তামাকের দোকান। এই দোকানটাকে অনেকেই তাদের চিঠিপত্রের অস্থায়ী ঠিকানা হিসেবে ব্যবহার করে। দোকানের মালিক উপরতলায় বাস করে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেছে কিছু পয়সার বিনিময়ে স্থায়ী ঠিকানা নেই এমন পরিচিত অপরিচিত বহু লোককে নিজের ঠিকানাটা ব্যবহার করতে দেয় সে, কিন্তু অরগ্যান নামে কোন লোক তার ঠিকানা ব্যবহার করেছে কিনা তা তার মনে নেই। তার ধারণা, অরগ্যান হয়তো মাত্র দু’বার এসেছিল তার কাছে। একবার ঠিকানা ব্যবহার করার অনুমতি নিতে, দ্বিত্বীয়বার পাসপোর্টটা সংগ্রহ করতে। তাকে সান্তিনো ভ্যালেন্টির একটা ছবি দেখানো হয়েছে, কিন্তু তা দেখে সে লোকটাকে চেনে কিনা বলতে পারেনি। এরপর তাকে অরগ্যানের ফটো দেখানো হয়। এই লোককে সে আগে দেখেছে বলে মনে করে বটে, কিন্তু পুরোপুরি নিশ্চিত নয়।

‘ব্যাটাকে পুলিসের হাতে তুলে দাও,’ বলল ম্যালকম লয়েড। তারপর সোজা চলে এসো অফিসে।’

এক মিনিট চিন্তা করল ম্যালকম লয়েড। তারপর ফোনের রিসিভার তুলে অপারেটারকে বলল, ‘প্যারিসের সাথে যোগাযোগ চাই…’

.

প্যারিস। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর কনফারেন্স রূমে মীটিং চলছে। রোজকার মত আজও ক্লড র‍্যাঁবো তাঁর প্রোগ্রেস রিপোর্ট পেশ করছেন। সভাকে তিনি জানালেন সান্তিনো ভ্যালেন্টি নামে কোন বিদেশীকে ফ্রান্সের কোথাও পাওয়া যায়নি। এটুকু নিঃসন্দেহে জানা গেছে যে আইন সম্মত কোন পথ ধরে এদেশে প্রবেশ করেনি সে। ফিশিং বোট অথবা নির্জন কোন সীমান্ত এলাকা দিয়ে অনুপ্রবেশ করার সম্ভাবনা অবশ্য উড়িয়ে দেয়া যায় না। তবে ব্যক্তিগতভাবে তিনি মনে করেন এ ধরনের কোন ঝুঁকি নেবার মত বোকা সান্তিনো ভ্যালেন্টি নয়। বেআইনীভাবে ফ্রান্সে প্রবেশ করলে তার ধরা পড়ার সম্ভাবনা ষোলো আনা। বিভিন্ন আইনরক্ষাকারী সংস্থা, হোটেল রেস্তোরাঁ, রেলওয়ে স্টেশন, নৌ-পুলিশ যে-কোন বিদেশীর পাসপোর্ট দেখতে চাইতে পারে, সেই পাসপোর্টে অফিশিয়াল স্ট্যাম্প না থাকলে লোকটাকে বিপদে পড়তে হবে। তাই এ ধরনের ভুল একমাত্র হাঁদারাম ছাড়া আর কারও কাছ আশা করা যায় না।

ব্রিটিশ স্পেশাল ব্রাঞ্চ কি ভাবছে তারও একটা বিস্তারিত বর্ণনা দিলেন কুল রাবো। ঠিক এই সময় লন্ডন থেকে ফোনে কথা বলতে চাওয়া হলো তাঁর সাথে সকলের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে তিনি দ্রুত সভাকক্ষ ত্যাগ করলেন।

বিশ মিনিট পর আবার ফিরে এলেন তিনি।

নিস্তব্ধ সভাকক্ষে ঝাড়া দশ মিনিট একা কথা বলে গেলেন ক্লড র‍্যাঁবো।

‘এখন আমাদের করণীয় কি হবে?’ ক্লড ব্যাবো থামাতেই জানতে চাইলেন সরাষ্ট্র মন্ত্রী।

‘এখন আমরা অরগ্যানকে খুঁজে বের করার জন্যে গোটা দেশ চাষ কর। ব্রিটিশ পুলিস বর্তমানে এয়ারলাইন্স টিকেট অফিস, ক্রস চ্যানেল ফেরি ইত্যাদির রেকর্ড ঘেঁটে দেখছে। কিছুক্ষণ পর পর তারা সর্বশেষ রিপোর্ট জানাবে বলে কথা দিয়েছে। অরগ্যানকে যদি ইংল্যান্ডে পাওয়া যায়, সাথে সাথে গ্রেফতার করা হবে তাকে! তাকে যদি ফ্রান্সে পাওয়া যায়…’

তখন আমরা তাকে নিয়ে মাথা ঘামার,’ দৃঢ় করে এই প্রথম কথা বলল হেড অভ দি অ্যাকশন সার্ভিসের চীফ কর্নেল বোল্যান্ড।

মুচকি হাসলেন ক্লড র‍্যাঁবো। বললেন, ‘একটা ব্যাপার খুবই রহস্যময়। মহামান্য প্রেসিডেন্টের হবু খুনীর সন্ধান এখনও পাওয়া যায়নি, অথচ অনেক আগে থেকেই আমার বন্ধুদের কেউ কেউ অত্যন্ত স্পষ্ট ভঙ্গিতে আমাকে জানিয়ে রাখছেন তাকে পাওয়া মাত্র তার ব্যাপারে মাথা ঘামানো নিষিদ্ধ হয়ে যাবে আমার জন্যে। এর কারণ আমি বুঝতে অক্ষম।’

কর্নেল বোল্যান্ড এতটুকু বিচলিত না হয়ে বলল, ‘এর কারণ সহজবোধ্য। আপনি ডিটেকটিভ ফোর্সের প্রতিনিধিত্ব করছেন। ডিটেকটিভ ফোর্সের কাজ লোকটাকে খুঁজে বের করা। এর বেশি কিছু নয়। এরপরের কাজ, যেমন লোকটাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা এবং তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা—এ দুটোই অ্যাকশন সার্ভিসের দায়িত্ব। ব্যাপারটা আর কিছুই নয়, কাজ ভাগ-বাটোয়ারার অফিশিয়াল রীতি মাত্র। আমরা চাই না অ্যাকশন সার্ভিসের দায়িত্ব আর কোন সংস্থা পালন করতে উৎসাহ বোধ করুক। তা করলে সেটাকে আমরা আমাদের ব্যাপারে অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ বলে মনে করব।’

আমি আপনার বক্তব্যের সাথে একমত,’ ক্লড র‍্যাঁবো অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বললেন। চুরুটে ফুঁক দিয়ে দাড়িতে কয়েকবার হাত বুলালেন তিনি। তারপর আবার বললেন, ‘লোকটাকে খুঁজে বের করা ডিটেকটিভ ফোর্সের কাজ, একথা আপনিও স্বীকার করছেন। জিজ্ঞেস করি, খুঁজে বের করা বলতে ঠিক কি বোঝায়? যাকে খুঁজছি আর যাকে পেয়েছি এ দু’জন একই লোক কিনা তা নিশ্চিত হবার সময়টুকু নিশ্চয়ই আমাকে দেবেন আপনি, আশা করি? বলতে চাইছি, লোকটাকে পাবার পর তার সাথে কথা বলে আমি পরিষ্কার জানতে চাই সত্যি এই লোকই প্রেসিডেন্টকে খুন করতে চেয়েছিল কিনা। সে, সুযোগ আমার প্রাপ্য। যখন বুঝব এই লোককেই আমরা খুঁজছি তখন আপনার হাতে তাকে তুলে দিতে আমার কোন আপত্তি থাকবে না। আশা করি আমার প্রস্তাবে আমি অন্যায় বা অতিরিক্ত কিছু দাবি করছি না।’

কর্নেল বোল্যান্ডের চোখ খুলে গেল। ক্লড র‍্যাঁবো যা চাইছে তা দেয়ার অর্থ সব মিথ্যে ফাঁস হয়ে যাওয়ার রাস্তা তৈরি করা। এ অসম্ভব। কিন্তু লোকটার দাবি যথার্থ। অস্বীকার করলে আরও অনেকের মনে সন্দেহ জাগবে। বলল, ঠিক আছে। আপনার প্রস্তাব মেনে নিলাম।’ কিন্তু মনে মনে সে অন্য কথা ভাবল। কাপুর সাথে আলোচনা করে একটা ব্যবস্থা পাকা করে রাখতে হবে যাতে তাৎক্ষণিক নোটিসে ঊর্ধ্বতন মহলের নির্দেশে ক্লড র‍্যাঁবোকে তাঁর এই বিশেষ দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। দায়িত্ব কেড়ে নিলে সমস্ত অধিকার হারাবে সে, মাসুদ রানার সাথে কথা বলার কোন সুযোগ পাবে না।

.

প্রেয়সীকে বুকে তুলে নিয়ে আজকের মীটিংয়ের সমস্ত বিবরণ সবিস্তারে বর্ণনা করল সুরেতের কর্নেল প্যাপন। ক্লড র‍্যাঁবোর উপর কর্নেলের এত কিসের রাগ তা অবশ্য পরিষ্কার বুঝল না লুইসা পিয়েত্রো। প্রায় শেষ রাত পর্যন্ত তার উপর পাশবিক অত্যাচার চালিয়ে অবশেষে বিশাল বপু কর্নেল ঘুমিয়ে পড়ল। পা টিপে টিপে পাশের কামরায় গেল লুইসা! দ্রুত, সংক্ষেপে কথা বলল ফোনে।

.

লন্ডন। স্পেশাল ব্রাঞ্চ।

ডিটেকটিভ সুপারিনটেনডেন্ট ম্যালকম লয়েড ঝুঁকে পড়েছে ডেস্কের উপর। রিডিং ল্যাম্পের আলোয় গভীর মনোযোগের সাথে দুটো আলাদা ফটোসহ পাসপোর্টের আবেদনপত্র পরীক্ষা করছে।

একটু পর সিধে হলো সে। বলল, ‘রেডি?’

‘স্যার,’ নিজের চেয়ারে নড়েচড়ে বসল সহকারী ইন্সপেক্টর।

‘সান্তিনো ভ্যালেন্টি: উচ্চতা, পাঁচ ফিট এগারো ইঞ্চি। চেক?’

‘স্যার।’

‘অরগ্যান: উচ্চতা ছয় ফিট।’

‘জুতোর উঁচু হিল এর কারণ, স্যার। এমন জুতো পাওয়া যায় যা পরলে আপনি আড়াই ইঞ্চি অতিরিক্ত লম্বা হয়ে উঠবেন। অনেক বেঁটে লোক এ কাণ্ড করে থাকে। তাছাড়া, পাসপোর্ট কাউন্টারে কেউ কারও পায়ের দিকে তাকায় না।

‘ঠিক আছে,’ সায় দিল ম্যালকম লয়েড। ‘ভ্যালেন্টি: চুলের রঙ ব্রাউন। ব্রাউন বলতে অনেক কিছু বোঝায়। হালকা না গাঢ় তা এখানে উল্লেখ করা হয়নি ফটোতে দেখে তো মনে হচ্ছে গাঢ় ব্রাউন। অরগ্যানের চুলের রঙও বলা হচ্ছে ব্রাউন। কিন্তু ফটোতে দেখে তো চুলগুলোকে হালকা সোনালী লাগছে আমার চোখে।

ঠিক, স্যার, কিন্তু ফটোতে সাধারণত চুলের রঙ গাঢ়ই দেখায়। নির্ভর করে আলোর কমবেশির ওপর। আমার মনে হয় অরগ্যান হবার জন্যে কলপ ব্যবহার করে চুলের রঙ হালকা করে নিয়েছে সে।’

‘মেনে নিলাম। ভ্যালেন্টি: চোখের রঙ কালো। অরগ্যান; চোখের রঙ গ্রে।’ কনট্যাক্ট লেন্স, স্যার।

‘কারেক্ট। ভ্যালেন্টি: বয়স ছত্রিশ। অরগ্যান: গত এপ্রিলে ঊনচল্লিশে পড়েছে। ‘বয়স তিন বছর না বাড়িয়ে উপায় ছিল না ওর,’ ব্যাখ্যা করল ইন্সপেক্টর। কারণ আসল অরগ্যান, যে আড়াই বছর বয়সে মারা গেছে; তার জন্ম তারিখটা বদল করা সম্ভব নয়। কিন্তু ছত্রিশ বছরের কোন লোকের পাসপোর্টে যদি বয়স লেখা থাকে ঊনচল্লিশ তাতে কিছু এসে যায় না, কেউ তাকে চ্যালেঞ্জ করবে না।’

ফটো দুটোর দিকে আবার তাকাল ম্যালকম লয়েড। ভ্যালেন্টিকে একটু মোটাসোটা দেখাচ্ছে। মুখটা ভারী। কিন্তু অরগ্যানকে মেদহীন মনে হচ্ছে, মুখটাও তেমন ভারী নয়। এই পার্থক্য সম্ভবত ফটোগ্রাফির কৃতিত্ব।

ক্লড র‍্যাঁবোকে সমস্ত তথ্য এবং ফটো পাঠাতে হয় তাহলে,’ সহকারীকে বলল ম্যালকম লয়েড।

‘হ্যাঁ। আমাদের কাজ এখানেই শেষ।’

‘শেষ? আরে না! কাজ এখনও হাজারটা বাকি। কাল এয়ারলাইন্স টিকেট অফিস, ক্রস চ্যানেল ফেরি, কন্টিনেন্টাল ট্রেন টিকেট অফিস চেক করতে হবে। লোকটার বর্তমান পরিচয় কি তা তো আমাদেরকে জানতে হবেই, সেই সাথে জানতে হবে কোথায় আছে সে এখন।’ কথা শেষ করে রিস্টওয়ার্চ দেখল সে। নিঃশব্দে শেষ হয়ে গেছে চোদ্দ তারিখ। এক মিনিট আগেই বারোটা বেজে গেছে।