সেই উ সেন – ২.৫

পাঁচ

ঘরের দরজা বন্ধ করে একাকী বসে আছে ব্যারনেস সিবা। চার বছরের বিবাহিত জীবনের সুখ আর দুঃখের হিসাব মেলাতে গিয়ে চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়েছে তার। মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে সে, তাই কোটিপতি প্রেমিক বৃদ্ধ হলেও সুখ-সচ্ছলতার আশায় তাকেই বিয়ে করেছে সে। তখন বোঝেনি টাকাটাই দুনিয়ার সব নয়।

বিয়ের কিছুদিন পর থেকে প্রকাণ্ড দুর্গের মত প্রাসাদে একা বন্দী জীবন কাটাতে হচ্ছে তাকে। বৃদ্ধ স্বামী স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্যে নিজের বাড়ি ছেড়ে কয়েকশো মাইল দূরের স্যানাটোরিয়ামে গেছে, জীবনের গোণা-গুণতি বাকি দিনগুলো সেখানেই থাকবে বলে স্থির করেছে সে। এদিকে চব্বিশ বছরের ভরা যৌবন নিয়ে বিশাল প্রাসাদে সে একা। এর নাম কি জীবন?

তবু স্বামীর প্রতি বেইমানী করার কথা কখনও ভাবেনি সিবা। প্রায়ই বিদ্রোহী হয়ে উঠতে চায় শরীর এবং মন, কিন্তু নির্মমভাবে নিজেকে শাসন করেছে সে, দমিয়ে রেখেছে। কিন্তু আজ এ কি মতিভ্রম হলো তার!

স্বামীকে দেখতে গিয়েছিল সিবা। ফেরার পথে চোখে পড়ে গেল এক বিদেশী। কি সে দেখেছে তার মধ্যে, নিজেও জানে না ভাল করে। দেখামাত্র বাঁধা পড়ে গেছে। লোকটার চেহারা মনে পড়লেই শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছে তার। এ অন্যায়, এ অনুচিত—নিজেকে সাবধান করার কম চেষ্টা করেনি সে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। ক্রমশ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে মন। লোকটাকে পাবার বাসনায় উন্মাদিনী হয়ে উঠতে যা বাকি এখন।

কথা বলার পর লোকটার প্রতি আকর্ষণ আরও যেন দুর্দমনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্ভবত ইংরেজ লোকটা। ভদ্রলোক বলে দুনিয়াজোড়া খ্যাতি ওদের। আর কেউ হলে তার মত সুন্দরীর সান্নিধ্যের জন্যে ভাদ্র মাসের কুকুরের স্বভাব প্রকাশ করে ফেলত, কিন্তু এ লোকের ব্যক্তিত্বই আলাদা। রূপ দেখেই ঢলে পড়েনি সে। সুযোগ পেয়েও লুফে নেয়নি।

আলোটা কি নিভিয়ে দেবে? খোলা বারান্দায় এখনও বসে আছে লোকটা, জানে সে। করিডর ধরে নিজের ঘরে ফিরতে হবে তাকে, এই ঘরের সামনে দিয়ে যেতে হবে। যায়নি, জানে সিবা। কান পেতে বসে আছে সে। পায়ের শব্দ পায়নি এখনও। অথচ রাত অনেক হলো। একা বসে বসে কি এত ভাবছে লোকটা?

এর আগে লক্ষ করেছে সিবা, গভীরভাবে কি যেন চিন্তা করে লোকটা। প্রেমিকা ফাঁকি দিয়েছে, তাই মন খারাপ? নাকি বউ পালিয়েছে? কিছু একটা হবে। মনে ওর অনেক চিন্তা, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কে জানে, লোকটা হয়তো তারই মত দুঃখী।

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সিবা। আলোটা নিভিয়ে দেয়াই ভাল। জ্বলতে দেখলে লোকটা হয়তো ভাববে তার আশায় অপেক্ষা করছে। লোকটা তাকে এতটা ছোট আর সস্তা ভাবুক তা সে চায় না। দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল সে। হাত বাড়িয়ে অফ করে দিতে যাবে সুইচটা, এমন সময় পায়ের আওয়াজ এল কানে। ছ্যাঁৎ করে উঠল বুক, রোমাঞ্চিত হলো শরীর। যদি…যদি আসত ওর ঘরে! ঢোক গিলল সিবা। অধীর উত্তেজনায় কাঁপছে সে। লোকটা কি তার ঘরের সামনে দিয়ে চলে যাবে? নাকি থামবে?

পায়ের আওয়াজ থামল। পরমুহূর্তে মৃদু নক হলো দরজায়। কি করছে, নিজেই যেন জানে না সিবা। হঠাৎ আবিষ্কার করল তার দুটো হাত কারও অনুমতির তোয়াক্কা না করেই খুলে দিয়েছে দরজাটা

করিডরে দাঁড়িয়ে মৃদু হাসছে রানা। বলল, ‘হ্যাঁ, আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি আমি।’

‘দি-দিন।’

‘ভাল লাগে।’

তাহলে আমিও পারি আপনার কেন-র উত্তর দিতে,’ উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে সিবার অনিন্দ্যসুন্দর মুখটা। হাসছে সে।

প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রানা।

‘ভাল লাগে,’ বলল সিবা। একটা হাত লম্বা করে দিল সে রানার দিকে।

এক পা এগিয়ে কামরায় ঢুকল রানা। তারপর ঘুরে দাঁড়াল। ভিতর থেকে বন্ধ করে দিল দরজাটা।

.

রাতের মধ্যেই গোটা ফ্রান্স জুড়ে নতুন অনুসন্ধান পর্বের সূচনা হলো। সান্তিনো ভ্যালেন্টি নয়, এখন খোঁজা হচ্ছে আলেকজান্ডার অরগ্যানকে। এবার অল্প সময়ের মধ্যেই সুখবর পাওয়া গেল। একটা ফ্রন্টিয়ার পোস্ট থেকে জানানো হলো আলেকজান্ডার জেমস কোয়েনটিন অরগ্যান নামে এক লোক বাইশে সেপ্টেম্বর ব্রাসেলস থেকে ছাড়া বারবান্ট এক্সপ্রেস ট্রেনযোগে ফ্রান্সে ঢুকেছে।

এক ঘণ্টা পরের ঘটনা। একই ফ্রন্টিয়ার পোস্ট থেকে রিপোর্ট এল আরেকটা। ব্রাসেলস থেকে প্যারিসগামী এবং প্যারিস থেকে ব্রাসেলসগামী প্রতিটি এক্সপ্রেস ট্রেনে নির্দিষ্ট একটা কাস্টমস ইউনিট তাদের দায়িত্ব পালন করে থাকে, তারা প্যারিস থেকে ব্রাসেলসগামী ইতোয়লি দু নর্দ এক্সপ্রেসের একত্রিশে সেপ্টেম্বর তারিখের যাত্রীদের তালিকায় অরগ্যানের নাম আবিষ্কার করেছে।

ফ্রেঞ্চ এসপিওনাজের শাখা অফিসের একজন কর্মচারী অরগ্যানের নামে পূরণ করা একটা হোটেলের কার্ড আবিষ্কার করল। কার্ডে অরগ্যানের পুরো নাম, পাসপোর্ট নাম্বার ইত্যাদি সব ঠিক আছে। এ থেকে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হলো প্লেস দে লা ম্যাডিলিনের কাছে ছোট এই হোটেলটায় বাইশে সেপ্টেম্বর থেকে ত্রিশে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছিল আলেকজান্ডার অরগ্যান।

খবর এসে পৌঁছানো মাত্র চার্লস ক্যারন এই মুহূর্তে হোটেলে হানা দেবার জন্যে অস্থির হয়ে উঠল। কিন্তু ক্লড র‍্যাঁবো তাকে শান্ত করলেন। তাঁর ইচ্ছা, কাক ভোরে চুপি চুপি তিনি নিজে গিয়ে আলাপ করবেন হোটেল মালিকের সাথে।

তাই করলেন তিনি। মালিক লোকটা নিরীহ টাইপের একজন ভালমানুষ, ক্লড র‍্যাঁবো তার সাথে কথা বলে বুঝলেন অরগ্যান এখন এই হোটেলে নেই, কার্ডে উল্লেখ করা তারিখেই হোটেল ছেড়ে চলে গেছে সে। কোথায় গেছে সে বা কোথায় যেতে পারে? হোটেল মালিক সবিনয়ে জানাল, এ ব্যাপারে তার কোন ধারণাই নেই।

পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত সাদা পোশাক পরা একজন ইন্সপেক্টরকে বোর্ডার হিসেবে হোটেলে থাকতে বলে নিজের অফিসে ফিরে এলেন ক্লড র‍্যাঁবো। এই হোটেলে অরগ্যান আবার ফিরে আসবে বলে তিনি মনে করেন না, তবে সাবধানের মার নেই ভেবে একটু সতর্কতা অবলম্বন করলেন মাত্র।

অফিসে ফিরতে সাড়ে চারটে বেজে গেল। ‘সেপ্টেম্বরে অরগ্যানের এই ভ্রমণের উদ্দেশ্য ছিল,’ চার্লস ক্যারনকে বললেন ক্লড র‍্যাঁবো, ‘খুন করার প্ল্যানটাকে যাচাই করে দেখা। বেড়াতে এসে কিভাবে কি করবে না করবে সব ঠিক করে ফিরে গেছে সে।’

এরপর হেলান দিয়ে রিভলভিং চেয়ারের কোলে ডুবে গেলেন ক্লড র‍্যাঁবো। ঠোঁটে তর্জনী ঠেকে আছে, চোখের দৃষ্টি সিলিংয়ের দিকে নিবদ্ধ। চিন্তা করছেন তিনি। হোটেলে কেন উঠল লোকটা? সামান্য হলেও হোটেলে ওঠায় ঝুঁকি থাকে, ঝুঁকি না নিলেও তো পারত। ও-এ-এস-এর অসংখ্য লোক আছে ফ্রান্সের সর্বত্র, তাদের বাড়িতে কেন আশ্রয় নেয়নি?

সম্ভাব্য একটাই উত্তর হতে পারে তার এই আচরণের। কাউকে সে বিশ্বাস করে না। কারও উপর তার পুরোপুরি অস্থিা নেই। কাজটাকে সে সাংঘাতিক গুরুত্বের সাথে নিয়েছে। এ কাজে ব্যর্থ হতে চায় না। তাই কারও সাহায্য নেবার ঝুঁকি সে নিচ্ছে না। তার মানে একা কাজ করে লোকটা। নিজের প্লট, নিজের প্ল্যান, নিজের অপারেশন। ভুয়া একটা পাসপোর্ট ব্যবহার করছে। সম্ভবত ব্যবহারে বজায় রাখছে বিনয় এবং ভদ্রতা, যাতে কারও মনে কোনরকম সন্দেহ না জাগে। হোটেলের মালিকও এই কথা বলেছে, ‘খাঁটি একজন ভদ্রলোক বলে মনে হয়েছিল তাকে আমার।’ খাঁটি একজন ভদ্রলোক, ভাবছেন ক্লড র‍্যাঁবো, এবং বিষধর সাপের মত বিপজ্জনক। একজন পুলিসের জন্যে মস্ত কঠিন বাধা, এই খাঁটি ভদ্রলোকেরা। কেউ এদেরকে ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করে না কখনও।

লন্ডন থেকে পাঠানো ভ্যালেন্টি আর অরগ্যানের ফটো দুটোর দিকে তাকালেন তিনি। ভ্যালেন্টি রূপান্তরিত হয়েছে অরগ্যানে, সেই সাথে বদলে গেছে উচ্চতা, চুলের রঙ, বয়স এবং সম্ভবত ভাব-ভঙ্গি। লোকটা কেমন, মনে মনে তার একটা ধারণা পেতে চেষ্টা করছেন তিনি। আত্মবিশ্বাসী, কোন সন্দেহ নেই। জানা নেই, কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে আচার ব্যবহারে লোকটা দারুণ স্মার্ট। এবং এ লোকের মধ্যে দুর্ভেদ্য একটা ব্যক্তিত্ব না থেকেই পারে না। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে খুন করতে আসছে, তার মানে দুনিয়ার সেরা দুঃসাহসীদের একজন সে। এবং বুদ্ধিমান। তা নাহলে এই দায়িত্ব কেউ তার ঘাড়ে চাপাত না। যোগ্য লোক, সন্দেহের অবকাশ নেই। এতবড় দায়িত্ব বোকা লোকের পক্ষে নেয়া সম্ভবই নয়। গুছানো স্বভাবের লোক, এও পরিষ্কার বোঝা যায়। তার লন্ডনের বাড়িতে এতটুকু ফালতু কিছু পাওয়া যায়নি। প্রখর দূরদৃষ্টি রয়েছে লোকটার মধ্যে। সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে প্রথম থেকেই সচেতন, এবং সৈজন্যে প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছে। নিখুঁত ভাবে মাপজোক করে উতরে যাবার সম্ভাবনা ষোলো আনা দেখলেই কেবল ঝুঁকি নেয় যত্নের সাথে, মনোযোগের সাথে কাজ করে, ফলে ভুল হয় না।

এবং ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক স্বভাবের লোক। সশস্ত্র, অবশ্যই। কিন্তু কি সেটা? বাঁ দিকের বগলের নিচে, একটা অটোমেটিক? পাঁজরের সাথে বাঁধা একটা থ্রোয়িং নাইফ? একটা রাইফেল? কিন্তু কাস্টমস চেকিংয়ের সময় সেটা লুকাবে কোথায়? এ ধরনের একটা জিনিস নিয়ে প্রেসিডেন্টের কাছাকাছি ঘেঁষবে কিভাবে, যেখানে প্রেসিডেন্টের বিশ গজের মধ্যে এমন কি মহিলাদের হ্যান্ডব্যাগ পর্যন্ত সার্চ করা হয়? প্রেসিডেন্টের যে কোন প্রকাশ্য অনুষ্ঠানের তিনশো গজের মধ্যে লম্বা কোন প্যাকেট নিয়ে যাওয়া নিষেধ, সেরকম কিছু নিয়ে কাউকে দেখা গেলে কোন প্রশ্ন না করেই ঘাড় ধরে তোলা হয় পুলিসের গাড়িতে।

এই কড়াকড়ির মধ্যে কি ভাবে সে প্রেসিডেন্টের কাছে ঘেঁষবে? সম্ভব নয়। অথচ লোকটার বিশ্বাস, সম্ভব। সম্ভব মনে না করলে দায়িত্বটা কাঁধে নিত না সে। কি ভাবে সম্ভব, একমাত্র সেই জানে। এ থেকেই পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে, এই লোক অসাধারণ প্রতিভাবান। কিভাবে কি করার কথা ভেবেছে, কেউ তা অনুমান করতে পারছে না। লোকটার সাথে দেখা হলে নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করব আমি, ভাবছেন ক্লড র‍্যাঁবো। হোক সে একজন খুনী, গুণী লোক তো বটে! গুণীর সান্নিধ্য পাওয়া সৌভাগ্য বৈকি।

আশ্চর্য এই যে, ভাবছেন তিনি, এই রকম একজন লোক সম্পর্কে ফ্রান্সের উচ্চপদস্থ অফিসারদের ধারণা, সে নাকি আর সব সাধারণ গুণ্ডাপাণ্ডাদের মতই একজন।

‘মাই গড!’ প্রায় আঁতকে উঠলেন ক্লড র‍্যাঁবো। দেখা যাচ্ছে অরগ্যান সাহেব তাঁকে পর্যন্ত দিশেহারা করে ছেড়েছে! চুরুট ধরাবার কথাটা পর্যন্ত বেমালুম ভুলে বসে আছেন তিনি।

একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে আপন মনে হাসছেন ক্লড র‍্যাঁবো, ফ্রেঞ্চকাট দাড়িতে অলসভঙ্গিতে হাত বুলাচ্ছেন আর ভাবছেন, একটা ব্যাপারে অরগ্যান পিছিয়ে আছে তাঁর চেয়ে। খুনীর বর্তমান পরিচয় জানেন তিনি। এ ব্যাপারে খুনী অজ্ঞ। এই ব্যাপারটা ছাড়া আর সব ব্যাপারে তাঁর চেয়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে আছে অরগ্যান। কিন্তু আজকের মীটিংয়ে তাঁর এই বক্তব্যটার মর্ম কেউ বুঝতে চায়নি।

সে ধরা পড়ার আগে তুমি যা জানো তা যদি সে জেনে ফেলে এবং আবার চেহারা এবং পরিচয় বদল করে, বাবা কুড, সেক্ষেত্রে তোমার কপালে মস্ত দুর্ভোগ আছে—নিজের সাথে কথা বলছেন তিনি।

‘সেক্ষেত্রে,’ অস্ফুট বললেন তিনি, ‘আর কোন আশা থাকবে না।

চার্লস ক্যারন মুখ তুলে তাকাল। বলল, ‘ঠিক বলেছেন, মশিয়ে। কোন আশা নেই অরগ্যানের।’

চটে উঠলেন ক্লড র‍্যাঁবো। ধমক মেরে বসলেন সহকারীকে। – এমন মেজাজ সাধারণত তিনি দেখান না।

.

অসংখ্য ভাঁজ খাওয়া ধবধবে সাদা চাদরটা থেকে সরে গেছে চাঁদের আলো। জানালা গলে এখনও ঢুকছে এক ফালি জ্যোছনা, কার্পেটের উপর অযত্নে পড়ে থাকা ব্রেসিয়ার আর ব্লাউজটাকে আলোকিত করে রেখেছে। বিছানায় ছায়ার মধ্যে পড়ে আছে দুটো শরীর।

চিৎ হয়ে শুয়ে আছে ব্যারনেস সিবা। চোখের দৃষ্টি সিলিংয়ের দিকে। তার বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে রানা। ওর সোনালী চুলের ভিতর কিলবিল করছে সিবার আঙুলগুলো। মধ্যরাতের মধুর উন্মাদনার কথা ভাবছে সে, মৃদু ফাঁক হলো তার ঠোঁট জোড়া, নিজের অজান্তেই পরিপূর্ণ তৃপ্তির নিঃশব্দ হাসি ফুটে উঠল মুখে।

এই রকম ভয়ঙ্কর আনন্দময় একটা রাতের প্রয়োজন ছিল তার। যা ঘটেছে, তার জন্যে কিছুতেই নিজেকে সে অপরাধী ভাবতে পারছে না। জীবনটা অবহেলার নয়, নিজেকে বঞ্চিত করার মধ্যে গর্ব বা কৃতিত্ব কিছুই নেই, এই সব যুক্তি খাড়া করে ফেলেছে সে মনে মনে। সুখের আমেজ এখনও লেগে আছে শরীরের প্রতিটি রোমকূপে। এখনও তার নেশাচ্ছন্ন ভাব কাটেনি। কিন্তু, যা ঘটার ঘটেছে, এখন দেখতে হবে কোনরকম বাড়াবাড়ি যেন না হয়ে যায়। বিছানার পাশে টেবিল ক্লকটার দিকে তাকাল সে। পোনে পাঁচটা বাজে। সোনালী চুল মুঠো করে ধরল সে, মৃদু টান দিল। ‘এই, শুনছ!’

একবার ‘উঁ’ করে উঠল ঘুমের ঘোরে রানা। ওরা দু’জনেই ভাঁজ খাওয়া চাদরের উপর বিবস্ত্র। তবে সেন্ট্রাল হিটিং কামরাটাকে উষ্ণ করে রেখেছে। সিবার বুকে অনেকটা যেন ঘুমের ঘোরেই গাল ঘষল রানা। খোঁচা খোঁচা দাড়ির ঘষায় হঠাৎ আবার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে সিবা নিজের ওপর থেকে। দুই হাতে চেপে ধরে পিষে ফেলতে চাইল রানার মাথাটা নিজের বুকের সাথে। রানার একটা হাত ওর পেটের ওপর দিয়ে ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে নিচের দিকে। শিউরে উঠে চট্‌ করে এক হাতে ধরে ফেলল সে রানার হাতটা। পাগল করে দেবে নাকি লোকটা ওকে! অনেক কষ্টে সে সামলে নিল নিজেকে।

‘না, আর নয়। প্লীজ!’

‘কেন নয়?’

‘না।’

মুখ তুলে তাকাল রানা।

‘যথেষ্ট হয়েছে, ধন্যবাদ। আর দু’ঘণ্টার মধ্যে রওনা হতে হবে আমাকে, এবং দিনের আলো ফোটার আগেই নিজের ঘরে ফিরে যাওয়া উচিত তোমার। এবার ওঠো। জানাজানি হয়ে গেলে বিপদে পড়ব আমি ‘

মর্ম অনুধাবন করতে পেরে লক্ষ্মী ছেলের মত মাথা ঝাঁকাল রানা, গড়ান খেয়ে বিছানার কিনারায় পৌছল, লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল মেঝেতে। এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজের কাপড়-চোপড় কোথায় খুঁজছে। খাটের নিচে হাতড়ে রানার কাপড়-চোপড় পেল সিবা, টেনে আনল সব চিবুকের কাছে। ‘একটা আলতো চুমোর বিনিময়ে পেতে পারো এগুলো।’

জামা-কাপড় পরা শেষ হতে বিছানার কিনারায় বসল রানা। একটা হাত সিবার ঘাড়ের পিছনে রেখে নিজের দিকে আকর্ষণ করল তাকে।

কেন করলে কাজটা?’

‘কেন জিজ্ঞেস করছ?’ পাল্টা প্রশ্ন করল সিৰা।

তোমাকে আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ে বলে মনে হয়নি আমার, তাই।’

‘তৃষ্ণার্ত ছিলাম গত তিনটে বছর।’ সত্যি কথাটাই বলে ফেলল সিবা।

‘মিটেছে তৃষ্ণা?’

‘এ তৃষ্ণা কি মিটবার?’ হেসে উঠল সিবা। ‘সমাজের কিছু কিছু বিধি-নিষেধ তুলে নেয়া উচিত। ইচ্ছে করলেই আগামী সাতটা দিন আমরা একসাথে কাটাতে পারি না। বিপদে ফেলার জন্যে উঠে পড়ে লেগে যাবে শুভাকাঙ্ক্ষীর দল।

মাথা ঝাঁকাল রানা। আলতো করে চুমো খেল সিবার ঠোঁটে। তারপর উঠে দাঁড়াল।

‘তোমার নামটা জানা হলো না।’

এক সেকেন্ড ভাবল রানা। ‘অ্যালেক্স।’

‘ইচ্ছে করলেই অপমান করতে পারতে,’ বলল সিবা, ‘তা করোনি বলে অসংখ্য ধন্যবাদ, অ্যালেক্স।’

মাথা নিচু করে আবার চুমু খেল রানা।

‘যাই। গুড নাইট, সিবা। আবার দেখা হবে কি?’

‘না,’ ফিসফিস করে বলল সিবা। ‘আসলে জানি না। হলে নিশ্চয়ই ভাল লাগবে। কিন্তু উচিত হবে না।’

‘খুব আবছা হয়ে গেল না উত্তরটা? ‘

বিদায়ের বেলা ভবিষ্যৎটাকে আবছাই থাকতে দাও না! যদি দেখা হয়, হবে। যদি না হয়, নাই হবে। সিদ্ধান্ত নেবার সুযোগটা আমরা বরং ভাগ্যের হাতেই ছেড়ে দিই না?’

মুচকি একটু হাসল রানা।

পরমুহূর্তে ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে এগোল ও। বেরিয়ে গেল কামরা ছেড়ে।

.

সকাল সাতটা। দূর থেকে দেখা গেল, বন বন করে প্যাডেল মেরে হোটেল দু সার্ফের দিকে ছুটে আসছে স্থানীয় একজন পুলিস কনস্টেবল। সাইকেল থেকে লাফ দিয়ে নামল সে। টেনেটুনে ইউনিফর্মটা ঠিকঠাক করে নিয়ে লবিতে ঢুকল। হোটেলের মালিক রিসেপশনে বসে বোর্ডারদের কামরায় রেকফাস্ট ইত্যাদি পাঠাবার কাজ তদারক করতে ব্যস্ত, কনস্টেবলকে দেখে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানাল, সে। ‘মারিয়া!’ হাঁক ছেড়ে একজন কর্মীকে ডাকল সে। ‘মশিয়ের জন্যে এক কাপ কফি নিয়ে এসো।’

এই ক’দিন রোজ আসা যাওয়া করছে কনস্টেবল লোকটা। মারিয়ার উপর তার নজর পড়েছে, মালিকের তা দৃষ্টি এড়ায়নি। একটা চেয়ার টেনে বসল কনস্টেবল।

‘এই যে, নতুন কার্ডগুলো নিন,’ কয়েকটা সাদা কার্ড বাড়িয়ে দিল মালিক কনস্টেবলের দিকে। গতকাল সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত হোটেলে নতুন যে ক’জন গেস্ট এসেছে তাদের নাম-ধাম-পরিচয় ইত্যাদির উল্লেখ রয়েছে এক একটি কার্ডে।

কার্ডগুলো হাতে নিয়ে গুনল কনস্টেবল। তাচ্ছিল্যের সাথে ঠোঁট উল্টাল সে। ‘কি যে এর অর্থ, কিছুই বুঝি না। রোজ দু’চারটে কার্ড নিতে এতটা পথ সাইকেল নিয়ে আসা কম কষ্ট নাকি!’

সহানুভূতির সাথে একটু হাসল হোটেল মালিক। পরক্ষণে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে।

সকাল সাড়ে আটটায় গ্যাপ শহরের থানা হেডকোয়ার্টারে ফিরে এল কনস্টেবল। থানা অফিসার কার্ডগুলো তার কাছ থেকে গুনে নিয়ে রেখে দিল ডেস্কের দেরাজে। আজই কোন এক সময় লিয়নস্-এর রিজিওন্যাল হেডকোয়ার্টারে পাঠাতে হবে এগুলো। সেখান থেকে সোজা চলে যাবে প্যারিসের সেন্ট্রাল রেকর্ড অফিসে

ঠিক সেই সময় হোটেল দু সার্ফের রিসেপশনে দাঁড়িয়ে বিল মেটাচ্ছে ব্যারনেস সিবা। এক মিনিট পর মার্সিডিজে চড়ে বসল সে। গাড়ির নাক পশ্চিম দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে রওনা হলো নিজের প্রকাণ্ড দুর্গের দিকে। একঘেয়ে, বন্দী জীবনে ফিরে যাচ্ছে ব্যারনেস সিবা।

উপরতলায় তখনও ঘুমাচ্ছে রানা।

.

নিজের অফিসে সহকারীদের নিয়ে গুছিয়ে বসেছে ডিটেকটিভ সুপার ম্যালকম লয়েড। ক’দিন আগের চেহারার সাথে তার বর্তমান চেহারার মিল খুঁজে পাওয়া মুশকিল। অনিদ্রা তার দুই চোখের নিচে কালো সিলমোহরের ছাপ মেরে দিয়েছে। ক্লিনশেভ মুখে আধ ইঞ্চি লম্বা দাড়ি গজিয়েছে। এই ক’দিনে তার ওজনও বেশ খানিকটা কমে গেছে।

পাশের কামরায় অত্যন্ত ব্যস্ত ভাবে কাজ করছে ছয়জন সার্জেন্ট এবং দু’জন ইন্সপেক্টর। দুটো কামরার মধ্যে যোগাযোগ রাখছে ইন্টারকম। ঠিক দশটায় ডাক এল ইন্টারকমে।

‘হ্যালো।’

‘বন্ধু অরগ্যান,’ সিনিয়র ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর অপর-প্রান্ত থেকে বলল। ‘সোমবার সকালের নির্ধারিত বি-ই-এ ফ্লাইটে চড়ে লন্ডন ত্যাগ করেছে। টিকেট বুক করা হয়েছে শনিবারে। নাম সম্পর্কে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই আলেকজান্ডার অরগ্যান। টিকেট নিয়েছে এয়ারপোর্ট থেকে, নগদ টাকা দিয়ে। ‘

‘লন্ডন থেকে কোথায়? প্যারিসে?’

‘না, সুপার। ব্রাসেলসে।’

মুহূর্তে মাথাটা পরিষ্কার হয়ে গেল ম্যালকম লয়েডের। বলল, ‘ঠিক আছে, শোনো। বেলজিয়ামে গেছে বটে, কিন্তু হয়তো ফিরেও এসেছে। এয়ার-লাইন বুকিং চেক করতে থাকো, দেখো একই নামে আর কোন বুকিং আছে কিনা। বিশেষ করে চেক করো এখনও লন্ডন ত্যাগ করেনি এমন ফ্লাইটের টিকেট বুক করা হয়েছে কিনা। সাবধান, অ্যাডভান্স বুকিং চেক করতে ভুলো না। ব্রাসেলস থেকে যদি ফিরে এসে থাকে, খবরটা পাওয়া মাত্র জানাবে আমাকে। তবে ফিরে এসেছে কিনা সে ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে। আমরা বোধহয় হারিয়ে ফেলেছি ওকে। তবে তদন্ত শুরু হবার কয়েক ঘণ্টা আগে লন্ডন ছেড়ে গেছে ও, সুতরাং এ ব্যাপারে আমাদের কোন ত্রুটি নেই।’

যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে টেলিফোন থেকে রিসিভার তুলল ম্যালকম লয়েড। অপারেটরকে বলল, ‘প্যারিসের ক্লড র‍্যাঁবোকে দিন।‘

.

দশটা বেজে পাঁচ মিনিট।

‘ধন্যবাদ, ভাই লয়েড, টেলিফোনে কথা বলছেন ব্রিটিশ স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডিটেকটিভ সুপারের সাথে ক্লড র‍্যাঁবো। ‘বেলজিয়ামের সাথে এখান থেকেই যোগাযোগ করছি আমরা। …হ্যাঁ, অবশ্যই, অরগ্যানকে আবার পাওয়া গেলেই জানাব আপনাকে।’

রিসিভার রেখে দিয়ে নতুন একটা চুরুট ধরালেন ক্লড র‍্যাঁবো। ফ্রেঞ্চ কাট দাড়িতে হাত বুলিয়ে নিলেন একবার। একান্ত সচিব চার্লস ক্যারনকে বললেন, ‘ব্রাসেলসের সুরেতের সাথে যোগাযোগ করো। এখুনি।’

.

পাহাড়ের মাথায় চড়ে বসেছে সূর্য, এই সময় ঘুম ভাঙল রানার। শাওয়ার সেরে পোশাক পরল ও। মেইড সার্ভেন্ট মারিয়ার কাছ থেকে ইস্ত্রী করা চেক স্যুটটা নিয়ে বকশিশ দিল তাকে। সাড়ে দশটার সময় আলফা নিয়ে ঢুকল শহরে। গাড়ি দাঁড় করাল পোস্টাফিসের সামনে। এখান থেকে ফোন করল প্যারিসে।

বিশ মিনিট পর ঠোঁট কামড়ে ব্যস্ততার সাথে বেরিয়ে এল রানা। কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছে। কাছাকাছি একটা হার্ডঅয়্যারের দোকান থেকে দুই টিন রঙ কিনল ও। এক টিন মিডনাইট ব্লু, আরেক টিন সাদা। অন্য একটা দোকান থেকে এক জোড়া আলাদা সাইজের ব্রাশ এবং একটা স্ক্রু ড্রাইভার কিনল ও। গাড়ির গ্লাভ কমপার্টমেন্টে জিনিসগুলো ভরে নিয়ে ফিরে এল হোটেল দু সার্ফে । রিসেপশনে থেমে মালিককে ওর বিল তৈরি করার অনুরোধ জানিয়ে উঠে গেল উপরে, লাগেজ নামিয়ে আনার জন্যে।

গাড়ির বুটে সুটকেস তিনটে এবং ব্যাক সীটে হ্যান্ডগ্রিপটা রেখে দ্রুত রিসেপশনে ফিরে এল রানা। তাড়াহুড়োর সাথে বিল মেটাল। হোটেলের মালিক একটা অস্থিরতা লক্ষ করল রানার মধ্যে। কিন্তু বিল মেটাবার পরও নড়ল না রানা। কেন যেন অপেক্ষা করছে ও। হাজার ফ্র্যাঙ্কের নোট ভাঙতি চাইল কয়েকটা। ‘দেখি আছে কিনা,’ বলে ভিতরের কামরায় চলে গেল মালিক। এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিল রানা। রেজিস্ট্রি বুকের পাতা উল্টে ব্যারনেস সিবা লা বোর্ন দে লা শিওন নামটার পাশে লেখা ঠিকানাটা দেখে নিল: হাউতে শেলনেয়ার, করেজ।

এক মিনিট পর গর্জে উঠল আলফা রোমিও। ঝড় তুলে বেরিয়ে গেল হোটেলের গেট দিয়ে।

বিপদ আঁচ করতে পেরেছে রানা।

পালাচ্ছে।

.

দুপুরের দিকে আরও মেসেজ এল ক্লড র‍্যাঁবোর অফিসে। ব্রাসেলসের সুরেত ফোন করে জানিয়েছে, সোমবারে অরগ্যান মাত্র পাঁচ ঘণ্টার জন্যে শহরে ছিল। লন্ডন থেকে বি-ই-এ-র ফ্লাইটে ব্রাসেলসে নেমেছিল বটে, কিন্তু বিকেলের আলিটালিয়া ফ্লাইট ধরে চলে গেছে মিলানে। ডেস্কে নগদ টাকা দিয়ে টিকেট নিয়েছিল সে, তবে টিকেটটা রিজার্ভ করা হয়েছিল শনিবারে, লন্ডন থেকে ফোন করে।

মুহূর্ত মাত্র দেরি না করে ক্লড র‍্যাঁবো মিলানিজ পুলিসের সাথে যোগাযোগ করার নির্দেশ দিলেন অপারেটরকে। রিসিভার নামিয়ে রেখে চুরুট ধরাতে যাবেন, ঝনঝন করে বেজে উঠল ফোন।

এবার ফোন এসেছে ফ্রেঞ্চ এসপিওনাজ থেকে। জরুরী একটা মেসেজ :

ইটালি থেকে ফ্রান্সে ঢোকার জন্যে ভেন্টিমিগলিয়া চেক পোস্টে গতকাল সকালে যে-সব ট্যুরিস্ট আসে তাদের মধ্যে একজন আলেকজান্ডার জেমস কোয়েনটিন অরগ্যান ছিল। সীমান্ত পেরোবার জন্যে প্রত্যেক ভ্রমণকারীকে একটা ফর্ম পূরণ করতে হয়, সেই পূরণ করা ফর্ম পরীক্ষা করে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

শান্তশিষ্ট ক্লড র‍্যাঁবো ফেটে পড়লেন ক্ষোভে। ‘মাই গড!’ ভুরু জোড়া কপালে তুলে একান্ত সচিবের দিকে তাকালেন তিনি। ‘প্রায় ত্রিশ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। হঠাৎ সংবিৎ ফিরে পেয়ে ভুরু কুঁচকে হাতে ধরা রিসিভারটার দিকে তাকালেন, নামিয়ে রাখতে ভুলে গেছেন তিনি। সব রাগ গিয়ে পড়ল সেটার উপর। খটাশ করে আছাড় মারলেন সেটাকে ক্রাডলের উপর।

চার্লস ক্যারন চোখেমুখে বিস্ময় এবং প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে আছে চীফের দিকে।

চুরুট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছেন ক্লড র‍্যাঁবো। আগের চেয়ে শান্ত দেখাচ্ছে তাঁকে। ‘অবশ্য, দোষ দেয়া যায় না ওদেরকে। কাল সকালেই শুধু পঁচিশ হাজারের ওপর বিদেশী লোক ঢুকেছে ফ্রান্সে, সবগুলো কার্ড চেক করা সহজ কাজ নয়। যাই হোক, দেরিতে হলেও এখন আমরা জানি প্রেসিডেন্টের হবু খুনী এখানে পৌঁছে গেছে। ফ্রান্সের ভিতরে। কোন সন্দেহ নেই। শোনো, সুপার লয়েতকে ফোন করে আমার অসংখ্য ধন্যবাদ জানাও আবার। বলো, অরগ্যান এখন ফ্রান্সে রয়েছে, এখান থেকেই তার বিরুদ্ধে যা কিছু করার করছি আমরা।’

ইউনিফর্ম পরা একজন পিয়ন ক্লড র‍্যাঁবোর ডেস্কে ধূমায়িত এক কাপ কফি রেখে গেল। সেদিকে হাত বাড়াতে যাবেন ক্লড র‍্যাঁবো, তাঁর ডান পাশে ফোনটা বেজে উঠল। লিয়নস এর থানা হেডকোয়ার্টার থেকে একজন অফিসার কথা বলছে। নিঃশব্দে শুনলেন ক্লড র‍্যাঁবো। ধীরে ধীরে আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল তাঁর মুখের চেহারা। রিসিভারে হাত চাপা দিয়ে একান্ত সচিবের দিকে তাকালেন তিনি।

‘পাওয়া গেছে ওকে। গতরাতে দু’দিনের জন্যে হোটেল দু সার্ফে উঠেছে।’ মাউথপীস থেকে হাত সরিয়ে থানা অফিসারকে বললেন, ‘শুনুন। কেন চাই অরগ্যানকে তা এই মুহূর্তে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। ব্যাপারটা টপ সিক্রেট। ফরাসী জাতির জন্যে সে একটা মস্ত হুমকি। এর বেশি কিছু জানতে চাইবেন না। জাতীয় নিরাপত্তার খাতিরে তাকে যেভাবে হোক আটক করতে হবে।…হ্যাঁ, আপনাকে কি করতে হবে বলে দিচ্ছি…’

দশ মিনিট একনাগাড়ে কথা বলে গেলেন ক্লড র‍্যাঁবো। তারপর রিসিভার নামিয়ে রাখলেন। সাথে সাথে চার্লস ক্যারনের ডেস্কে একটা ফোন বেজে উঠল।

আবার ফোন করেছে ফ্রেঞ্চ এসপিওনাজ। নতুন একটা তথ্য এইমাত্র তাদের হেডকোয়ার্টারে এসে পৌঁচেছে: অরগ্যান ফ্রান্সে ঢুকেছে ভাড়া করা একটা সাদা আলফা রোমিও স্পোর্টস টু-সিটার নিয়ে, রেজিস্ট্রেশন নম্বর—M।-61741.

‘সব থানা এবং রেডিও পুলিস পেট্রোলকে সতর্ক করে দিই?’ উত্তেজিতভাবে জানতে চাইল চার্লস ক্যারন।

‘না, এখনই নয়। সাধারণ একজন গাড়ি চোর ভাববে সবাই তাকে। শহরতলির একজন পুলিস দেখামাত্র এগিয়ে যাবে গাড়িটাকে থামাবার জন্যে। অরগ্যান থামবে না। বিপদ দেখলে তার সামনে এখন একটা পথই খোলা আছে। সোজা পুলিসের বুক বা মাথা লক্ষ্য করে গুলি করবে সে।’ দাড়িতে হাত বুলিয়ে কি যেন ভাবলেন তিনি। হোটেলে দু’দিনের জন্যে উঠেছে। কিন্তু শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত বাইরে বেরিয়ে যাবার পর হোটেলে এখনও ফিরে আসেনি সে।’

‘হোটেলের মালিকের সাথে…’

‘না, তার সাথে যোগাযোগ করা হয়নি,’ ক্লড র‍্যাঁবো বললেন, ‘তার দরকারও নেই। দু’দিনের জন্যে উঠেছে যখন, ধরে নেয়া যেতে পারে আবার সে ফিরে আসবে হোটেলে। নির্দেশ দিয়েছি সাদা পোশাক পরা সশস্ত্র লোকেরা যেন হোটেলটাকে ঘিরে রাখে। এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হলে রক্তপাত চাই না। তুমি খবর নাও, এয়ারফোর্সের যে হেলিকপ্টারটা আমাদের জন্যে তৈরি থাকার কথা সেটা কোথায় আছে। দশ মিনিটের মধ্যে রওনা হতে চাই আমি।’

ঠিক এই সময় গ্যাপ শহরে চলছে রানার বিরুদ্ধে তুমুল আয়োজন। শহর থেকে বেরিয়ে যারার প্রতিটি রাস্তার উপর ইস্পাতের তৈরি রোড ব্লকের সরঞ্জাম স্থাপন করা হচ্ছে। প্রতিটি রোড ব্লকের পিছনে বালির বস্তা সাজিয়ে উঁচু আড়াল তৈরি করা হচ্ছে। স্থানীয় মিলিটারি কাম্প থেকে দুশো কমান্ডোর একটা দলকে ডেকে পাঠানো হয়েছে। তারা বালির বস্তার পিছনে সাব-মেশিনগান নিয়ে সতর্ক থাকবে। গ্রেনোবল এবং লিয়নসেও গুলিস এবং সেনাবাহিনীর লোক ভর্তি ভারী ট্রাকের দুদ্দাড় আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে।

.

তেল আর ময়লার দাগ লাগতে পারে, তাই ট্রাউজার ছাড়া গা থেকে আর সব খুলে ফেলেছে রানা। গাছের ছায়ায় কাজ করছে, কিন্তু চারদিকে দুপুরের ঝাঁ ঝাঁ রোঁদ, ঘেমে নেয়ে উঠেছে ও। গাড়ি রঙ করার কাজটা ধরার পর দু’ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে, এক মুহূর্ত বিশ্রাম নেয়নি।

গ্যাপ ছেড়ে Veyne এবং Aspres – Sur Buech-এর ভিতর দিয়ে পশ্চিম দিকে রওনা হয়েছিল ও। প্রায় পুরো রাস্তাটা নিচের দিকে ঢালু হয়ে পাহাড় থেকে নেমে গেছে। খানিক পর পর একটা করে বাঁক। কিন্তু ফাঁকা রাস্তা, এদিকের ট্রাক ড্রাইভাররা বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালাতে অভ্যস্ত। সারাক্ষণ একটা অস্বস্তিকর তাড়া অনুভব করছে রানা, তাই সে-ও ঘণ্টায় ষাট মাইলের কমে গাড়ি চালায়নি কোথাও! Aspres পেরিয়ে আর এন নাইনটি থ্রী ধরে আঠারো মাইল ড্রোম নদীর কিনার ঘেঁষে এগিয়েছে ও। Lucen-D।o।s ছাড়িয়ে খানিকদূর এগিয়ে রাস্তা থেকে সরে এসেছে আলফা নিয়ে। অসংখ্য সাইড রোডের একটা বেছে নিয়ে জঙ্গল মোড়া পাহাড়ী এলাকায় ঢুকেছে। এদিকের পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট অনেক গ্রাম দেখতে পাওয়া যায়। গ্রামের লোকেরা যাওয়া আসা করে এমন জায়গা এড়িয়ে জঙ্গলের বেশ খানিকটা ভিতরে চলে এসেছে ও।

মাঝ বিকেলে কাজ শেষ হলো, দু’পা পিছিয়ে এল গাড়ির কাছ থেকে রানা। গাড়ির রঙ এখন চকচকে নীল, প্রায় সব জায়গার রঙ ইতোমধ্যে শুকিয়ে গেছে। নাম্বার প্লেট দুটো আগেই খুলে ফেলা হয়েছে, উল্টোভাবে পড়ে রয়েছে ঘাসের উপর। দুটোরই পিছন দিকে সাদা রঙ দিয়ে কাল্পনিক ফ্রেঞ্চ নাম্বার লেখা রয়েছে। নাম্বারগুলোর শেষ সংখ্যা দুটো পঁচাত্তর। এটা প্যারিসের রেজিস্ট্রেশন কোড। ফ্রান্সের যে-কোন রাস্তার গাড়ির সাধারণ নাম্বার এটা।

মনটা তবু খুঁত খুঁত করছে রানার। রঙটা মোটামুটি মন্দ হয়নি, কিন্তু তবু তো আনাড়ি হাতের কাজ, সন্দেহপ্রবণ যে-কোন লোকের চোখে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় রয়েছে। অস্বস্তিকর আরেকটা ব্যাপার হলো, সাদা ইটালিয়ান আলফার কাগজপত্রগুলো নীল ফ্রেঞ্চ আলফার কাগজ হিসেবে চালানো যাবে না। কোথাও রোড ব্লকের সামনে যদি পড়তে হয়, কাগজপত্র দেখিয়ে পার পাওয়ার কোন উপায় নেই।

হাতের রঙ মুছছে রানা। ভাবছে, সন্ধ্যার অন্ধকার নামার অপেক্ষায় থাকবে, নাকি এই উজ্জ্বল রোদেই ঝুঁকি নিয়ে রওনা হয়ে যাবে আবার?

অনুমান করল, ওর ভুয়া পরিচয় এবং নাম জানাজানি হয়ে যাওয়ায় কোন্ সীমান্ত দিয়ে ফ্রান্সে ঢুকেছে ও, তা আবিষ্কার করতে ফ্রেঞ্চ এসপিওনাজের খুব বেশি সময় লাগবে না। গাড়িটার নাম এবং রঙ কি তাও অজানা থাকবে না ওদের। হাজার হাজার পুলিস হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াবে গাড়িটাকে। খুন করার নির্দিষ্ট তারিখের বেশ ক’দিন আগে ফ্রান্সে ঢুকে পড়েছে ও, সুতরাং অতিরিক্ত এই ক’টা দিন গা ঢাকা দিয়ে থাকার জন্যে একটা নিরাপদ আশ্রয় দরকার ওর। ওর বিবেচনায় সেরকম একটি মাত্র আশ্রয় ওকে দিতে পারে দুশো পঞ্চাশ মাইল দূরে করেজের একটা দুর্গ। সেখানে যথাসম্ভব অল্প সময়ে পৌছবার একমাত্র উপায় গাড়ি। ঝুঁকি নেয়া হয়, ঠিক। কিন্তু এছাড়া কোন উপায়ও নেই। দেরি না করে রওনা হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল রানা। পুলিস সোনালী চুলের আলফা রোমিওর ড্রাইভারের খোঁজ শুরু করার আগেই নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে যেতে চায় ও।

নতুন নাম্বার প্লেট দুটো স্ক্রু দিয়ে এঁটে নিল রানা গাড়িতে। অবশিষ্ট রঙ এবং ব্রাশ দুটো ফেলে দিল ছুঁড়ে। গাছের ডাল থেকে নামাল সিল্কের সোয়েটার আর জ্যাকেটটা, তারপর উঠে বসল আলফার ড্রাইভিং সীটে।

আর-এন-নাইনটি-থ্রী-তে উঠে এসে রিস্টওয়াচ দেখল রানা। বিকেল তিনটে বেজে একচল্লিশ মিনিট।

শব্দ শুনে জানালার বাইরে গলা বাড়াল রানা, তাকাল আকাশের দিকে সবুজ রঙের মস্ত একটা ফড়িংয়ের মত পুবদিকে উড়ে যাচ্ছে একটা হেলিকপ্টার।

সাত মাইল পেরিয়ে একটা গ্রামে ঢুকল রানা। অপরপ্রান্ত দিয়ে বেরিয়ে যেতে হবে ওকে। চৌরাস্তায় একটা সাইনবোর্ড দেখল রানা। গ্রামের নাম লেখা রয়েছে তাতে। ছ্যাৎ করে উঠল বুকটা ওরু। ডি আই ই–ডাই, মানে মৃত্যু। শব্দটার উচ্চারণ ইংরেজী ভাষার রীতি অনুযায়ী হবে না জানে ও, তবু কেমন যেন ভয় ঢুকে গেল মনে। কুসংস্কারকে জীবনে কখনও পাত্তা দেয়নি, কিন্তু আবার ছ্যাঁৎ করে উঠল বুক যান্ত্রিক একটা শোরগোল কানে ঢুকতেই।

গ্রামের প্রায় মাঝামাঝি জায়গায় চলে এসেছে রানা। মোড় নিয়ে মেইন রোডে পড়তেই ঝকঝকে শ্বেত পাথরের ওয়র-মেমোরিয়াল দেখতে পেল। রাস্তার মাঝখানে প্রকাণ্ড একটা মোটরসাইকেলে বসে আছে কালো চামড়ার কোট পরে বিশালদেহী একজন পুলিস, মাথার উপর হাত তুলে রাস্তার ডান দিকে সরে গিয়ে থামতে নির্দেশ দিচ্ছে।

ঝড় বয়ে যাচ্ছে রানার মাথার ভিতর। গাড়ির তলায় তার দিয়ে বাঁধা রয়েছে রাইফেল ভর্তি স্টীল টিউবগুলো। গাড়িটাকে যদি থানায় নিয়ে যাওয়া হয়, অবশ্যই চেক করা হবে তন্ন তন্ন করে। না, তা হতে দিতে পারে না ও। সাথে পিস্তল বা ছুরি নেই। মুহূর্তের জন্যে দিশেহারা বোধ করল রানা। কি করবে এখন ও? সোজা এগিয়ে ধাক্কা মারবে মোটরসাইকেলে, তারপর স্পীড বাড়িয়ে পালাবার চেষ্টা করবে? সেক্ষেত্রে কয়েক মাইল এগিয়েই গাড়িটাকে ত্যাগ করতে হবে। চেহারা বদল করে ছদ্মবেশ নিতে হবে ধর্মযাজক বেনসনের। কিন্তু সাথে আয়না নেই। ওয়াশ বেসিনের সাহায্য পাবে না। তারপর হাঁটতে হবে ওকে, চারটে লাগেজ সহ। নাকি দাঁড় করাবে গাড়ি?

মাত্র পঁচিশ গজ দূরত্ব এখন। যা করার তিন সেকেন্ডের মধ্যে করতে হবে। সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করল ওকে পুলিসটা নিজেই। গাড়ির স্পীড কমিয়ে আনছে রানা, এমন সময় তড়াক করে লাফ দিয়ে নামল সে মোটরসাইকেল থেকে, ঝট্ করে তাকাল রাস্তার উল্টো দিকে।

রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে সতর্কভাবে লক্ষ্য রাখছে রানা। অপেক্ষা করছে।

যান্ত্রিক শব্দটা ক্রমশ এগিয়ে আসছে। হঠাৎ খুব কাছ থেকে তীক্ষ্ণ সাইরেনের শব্দ বেজে উঠল। শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা একটা শিহরণ নেমে এল রানার। কি ঘটতে যাচ্ছে জানা নেই ওর। যাই ঘটুক, এখন আর গাড়ি থেকে বেরোবার বা গাড়ি নিয়ে এগিয়ে বা পিছিয়ে যাবার কোন উপায় নেই। মত্ত ক্ষ্যাপা একদল ষাঁড়ের মত গ্রামে ঢুকল পুলিস কনভয়টা। চারটে সিটন, ছয়টা কালো ম্যারিয়াজ, পিছনে চারটে পুলিস ভ্যান। লাফ দিয়ে রাস্তার একপাশে সরে এল পুলিসটা, দ্রুত হাত তুলে স্যালুট করল। দাঁড়ানো আলফা ঘেঁষে সাঁ সাঁ করে বেরিয়ে গেল সব ক’টা পুলিস ভর্তি গাড়ি। প্রত্যেকের হাতে চকচকে নীলচে সাব-মেশিনগান দেখল রানা।

কপাল থেকে হাত নামিয়ে রানার দিকে গম্ভীরভাবে তাকাল পুলিসটা। হাত ইশারায় জানাল, এবার সে নিজের পথে যেতে পারে। লোকটা মোটরসাইকেলের স্টার্টারে পা দিয়ে ধাক্কা মারছে বারবার, সাঁই করে বেরিয়ে গেল রানা আলফা নিয়ে। বাঁক নিয়ে ছুটে চলল গাড়ি পশ্চিম দিকে।।

.

চারটে পঞ্চাশ মিনিটে হানা দিল ওরা হোটেল দু সার্ফে

শহর থেকে এক মাইল দূরে ল্যান্ড করল হেলিকপ্টার। ওখান থেকে একটা পুলিস কার তুলে নিল ক্লড র‍্যাঁবোকে। ঘ্যাঁচ করে থামল গাড়িটা হোটেলের সামনে। লাফ দিয়ে নিচে নামল চার্লস ক্যারন এবং ছয়জন সার্জেন্ট। সাতজন সাতটা MAT 49 সাব-মেশিনগান উঁচিয়ে এগোল ওরা, প্রত্যেকের তর্জনী ট্রিগার ছুঁয়ে আছে। ক্লড র‍্যাঁবো ওদের পিছু পিছু এগোচ্ছেন। খুবই চিন্তিত এবং অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে তাঁকে। রেলগাড়ির ইঞ্জিনের মত পিছনে চুরুটের ধোঁয়া রেখে যাচ্ছেন তিনি। শহরের সবাই জানে কোথাও কোন মহা গণ্ডগোল বেধে গেছে, কিন্তু কিছুই এখনও জানা নেই হোটেল মালিকের। শুধু একটা বিদঘুটে ব্যাপার লক্ষ করে বিস্ময়বোধ করছে সে। গত পাঁচ ঘণ্টায় একজন নতুন বোর্ডারও ওঠেনি তার হোটেলে, এবং রোজ তাজা মাছ নিয়ে আসে যে লোকটা, তারও দেখা পাওয়া যাচ্ছে না আজ।

ডেস্ক ক্লার্ক ডেকে নিয়ে এল মালিককে। সাতটা সাব-মেশিনগান দেখে বাক্‌শক্তি লোপ পেল তার। ডেস্ক ক্লার্ককে প্রশ্ন করে ক্লড র‍্যাঁবো অবগত হলেন—না, হোটেল মালিক বোবা নন। কিন্তু তাকে কথা বলাবার চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে দেখে ক্লড র‍্যাঁবো তার হাত ধরে একটা চেয়ারে বসালেন, এবং দুই আউন্স ব্র্যান্ডি খেতে দিলেন।

এরপর চার্লস ক্যারন লোকটাকে জেরা করতে শুরু করল। ধীরে ধীরে বোল ফিরে পেল লোকটা। খুব দ্রুত কথা বলার চেষ্টা করায় বেশির ভাগ শব্দই জড়িয়ে যাচ্ছে তার। ক্লড র‍্যাঁবো নিঃশব্দে শুনে যাচ্ছেন উত্তরগুলো।

পাঁচ মিনিট পর শুরু হলো হোটেল কর্মীদের জবানবন্দী গ্রহণের কাজ। বাইরে থেকে হোটেলে আরও দুটো পুলিস কার ঢুকল। কয়েক দলে ভাগ হয়ে সশস্ত্র পুলিসবাহিনী হোটেলটাকে সার্চ করল। ইতোমধ্যে হোটেলটাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছে ইউনিফর্ম পরা পাঁচশো পুলিস।

হোটেল থেকে বেরিয়ে দূরবর্তী পাহাড়ের দিকে অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে আছেন ক্লড র‍্যাঁবো। তাঁর পাশে এসে দাঁড়াল চার্লস ক্যারন।

‘সত্যিই কি লোকটা চলে গেছে, চীফ?’ জানতে চাইল ক্যারন।

‘আমি নিঃসন্দেহ।’

‘কিন্তু দু’দিনের জন্যে উঠেছিল সে। হোটেল মালিক হাত মেলায়নি তো লোকটার সাথে?’

‘না। সে বা তার কর্মচারীরা মিথ্যে কথা বলছে না। আজ সকালের দিকে সিদ্ধান্ত বদলেছে অরগ্যান। চলে গেছে। সিদ্ধান্ত কেন বদলাল? এর উত্তর আমার জানা নেই। ব্যাপারটা স্বাভাবিক নয়। রহস্যের আঁচ পাচ্ছি। কিন্তু, তার চেয়ে বড় জিজ্ঞাসা, গেলটা কোথায়? সে কি জানে আমরা তার নতুন পরিচয় জানি?’

‘তা কিভাবে জানবে! অসম্ভব। কিভাবে? তার চলে যাওয়ার নিশ্চয়ই অন্য কোন কারণ আছে।’

‘তাই যেন হয়, বাবা, তাই যেন হ্য়।’

এখন তাহলে, চীফ, সূত্র বলতে আমাদের হাতে রয়েছে গাড়ির নাম্বারটা।’

‘হ্যাঁ। ভুলটা আমিই করেছি। গাড়িটাকে দেখা মাত্র আটক করার নির্দেশ জারি করা উচিত ছিল। স্কোয়াড কারের অয়্যারলেস ব্যবহার করো। লিয়নসের পুলিস কন্ট্রোল রুমকে জানাও অল-স্টেশন অ্যালার্ট সিগন্যাল পাঠাতে হবে এখুনি। টপ ইমার্জেন্সী। সাদা আলফা রোমিও, ইটালিয়ান, নাম্বার M।-61741, খুব সাবধানে এগোতে হবে, ধারণা করা হচ্ছে গাড়ির চালক সশস্ত্র এবং তার প্রকৃতি ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক। এর সাথে বিশেষ জরুরী নির্দেশ যাবে, এই অ্যালার্ট সিগন্যাল কোনভাবেই প্রেসকে জানানো চলবে না। মেসেজে একথাও জানাতে হবে, আলফা রোমিওর চালক জানে না…সম্ভবত জানে না যে তাকে সন্দেহ করা হচ্ছে।’

.

প্রায় ছ’টা বাজে। সাগর ঘেঁষা রাস্তা দিয়ে ভ্যালেন্স শহরে পৌঁছল আলফা রোমিও। এই শহরের ভিতর দিয়েই গেছে রুট ন্যাশনাল সেভেন। লিয়নস থেকে মার্সেই এবং প্যারিস থেকে কোট ডি’ আজুরে যাবার এটাই প্রধান হাইওয়ে। রোন নদীর তীর ধরে তুফান মেলের উন্মাদ বেগে ছুটে চলেছে নীল গাড়ি। দক্ষিণ দিকে প্রসারিত রাস্তাটাকে টপকে ব্রিজ পেরোল রানা। পশ্চিম তীরের আর-এন থারটি-থ্রী ধরে সেন্ট পেরে-র দিকে যাচ্ছে ও।

সন্ধ্যার ঘন কালিমায় ঢাকা পড়ে গেল পিছনের বিশাল উপত্যকা। সেন্ট পেরে ছাড়িয়ে এসেছে রানা। ক্রমশ উঁচু হয়ে উঠে যাওয়া ম্যাসিফ সেন্ট্রাল এবং অভার্ন প্রদেশের পাহাড়ী রাস্তা ধরে ছুটছে নীল আলফা। গাড়ির স্পীড বাড়িয়েই চলেছে রানা। এলাকাটা দুর্গম, ঝুঁকি নেয়া হয়ে যাচ্ছে, জানে ও। কিন্তু এর চেয়ে অনেক বড় ঝুঁকির মুখোমুখি হতে হবে ওকে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছতে দেরি করে ফেললে।

লে পুই-এর পর রাস্তাটা আরও খাড়া উঠে গেছে। উঁচু পাহাড়ের মাথার উপর ছোট ছোট গ্রাম, নিচে আধুনিক শহর। কোথাও থামল না রানা, স্পীড কমাল না।

ক্যাসিনো শহর মন্ট ডোর-এ পৌঁছে পেট্রল নিল রানা। এর মধ্যে সিগারেট ধরাবার জন্যেও একটা মুহূর্ত নষ্ট করেনি ও।

লা বুরডেলে পৌঁছে আর-এন এইটি-নাইন ধরল রানা। উজেলের দিকে ছুটছে নীল আলফা। করেজ-এর আঞ্চলিক শহর ওটা। ব্যারনেস সিবার দুর্গ ওখানেই।

‘আর কিছু নয়,’ সুরেতের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর কর্নেল প্যাপন তার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, বিশাল পেটটা ঠেকে আছে টেবিলের কিনারায়, রাগে বেসামাল দেখাচ্ছে তাকে, ‘মশিয়ে কড র‍্যাঁবো, নিজের অযোগ্যতা প্রমাণ করেছেন আপনি। এখন যদি আমাদের প্রেসিডেন্টের কিছু হয়, তার জন্যে এককভাবে সম্পূর্ণ দায়ী থাকবেন আপনি। কী আশ্চর্য! লোকটাকে একেবারে হাতের মুঠোয় পেয়ে তাকে আপনি ছেড়ে দিলেন!’

তিন ডিপার্টমেন্টের চীফ গোয়েন্দা চূড়ামণি ক্লড র‍্যাঁবো গভীর মনোযোগের সাথে কাগজপত্র দেখছেন, যেন মত্ত হাতি কর্নেল প্যাপনের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন নন। আসলে প্যাপনকে গুরুত্ব দেন না তিনি, আচরণের দ্বারা এটাই বোঝাতে চাইছেন। লোকটার মধ্যে যুক্তি এবং বিবেচনা বোধ একেবারেই নেই, একথা তাঁর জানা ছিল। কিন্তু সে যে সেরা একটা গবেটও বটে, তা তাঁর জানা ছিল না।

ক্লড র‍্যাঁবোকে মাথা নিচু করে থাকতে দেখে কর্নেল প্যাপন ভাবল লোকটা লজ্জায় মরে যাচ্ছে। কাউকে লজ্জায় ফেলতে পারলে খুবই মজা লাগে তার। ক্লড র‍্যাঁবোকে কোণঠাসা করতে পেরেছে ভেবে বিজয়ীর ভঙ্গিতে সবার দিকে তাকাল সে। তারপর মস্ত বপু নিয়ে বসে পড়ল চেয়ারে।

প্রায় সাথে সাথে মুখ তুলে তাকালেন ক্লড র‍্যাঁবো। লালচে ফ্রেঞ্চ কাট দাড়িতে হাত বুলিয়ে নিলেন একবার। মৃদু হাসি লেগে আছে তাঁর ঠোঁটের কোণে। বললেন, ‘মাই ডিয়ার কর্নেল, কেউ যদি বলে আপনি লেখাপড়া জানেন না, তাকে আমি অবিশ্বাস করব। আপনার সামনে যে রিপোর্টটা রয়েছে সেটা দয়া করে পড়ুন একবার। তাহলেই জানতে পারবেন অরগ্যানকে আমি হাতের মুঠোয় পাইনি। আজ বারোটা পনেরো মিনিটে খবরটা পাই আমরা যে গ্যাপ শহরের হোটেল দু সার্ফে অরগ্যান নামে একজন লোক গত সন্ধ্যায় দু’দিনের জন্যে উঠেছে। বারোটা পনেরো মিনিটে, মাইন্ড ইট। কিন্তু সেখানে পৌঁছে আমরা জানলাম এগারোটা পাঁচ মিনিটে হোটেল ছেড়ে চলে গেছে সে।’

থমথম করছে সবার চেহারা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ক্লড র‍্যাঁবোর দিকে। কর্নেল প্যাপনও কটমট করে তাকিয়ে আছে।

আপনাদের অবগতির জন্যে জানাচ্ছি,’ আবার বললেন ক্লড র‍্যাঁবো। ‘মহামান্য প্রেসিডেন্টের সাথে দেখা করেছি আমি। ব্যাপারটাকে একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন প্রেসিডেন্টের যেভাবে গ্রহণ করা উচিত তিনি ঠিক সেভাবেই গ্রহণ করেছেন। এ ব্যাপারটা যাতে কোনরকম প্রচার না পায় সেদিকে নজর রাখার জন্যে আমাকে বিশেষভাবে অনুরোধ করেছেন তিনি। আমি তাঁকে কথাও দিয়েছি। এর ফলে অরগ্যানকে আটক করার ব্যাপারে অস্বাভাবিক জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। গোপনীয়তা রক্ষার স্বার্থে দেশের সব পুলিসকে অরগ্যান বা তার সাদা আলফা রোমিও গাড়িকে আটক করার ঢালাও নির্দেশ দেয়া সম্ভব ছিল না।’

‘আসল কথা ভাগ্য আমাদের সাথে অসহযোগিতা করেছে,’ মৃদু কণ্ঠে বললেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী। ‘যাই হোক, আমি এখন জানতে চাই অরগ্যানের হদিস পাওয়ার জন্যে কি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।’

‘বিকেল পাঁচটা পনেরোয় হোটেল দু সার্ফ থেকে অলস্টেশন অ্যালার্ট সিগন্যাল পাঠাবার নির্দেশ দিয়েছি আমি,’ বললেন ক্লড র‍্যাঁবো। ‘ধরে নেয়া যায় সন্ধ্যা সাতটার মধ্যেই সমস্ত রোড-পেট্রল ইউনিটে পৌঁছে গেছে সিগন্যালটা। প্রধান শহরগুলোয় ডিউটিরত পুলিসদেরকে জানাবার কাজও শুরু হয়ে গেছে, রাত শেষ হবার আগেই এ-কাজ শেষ হবে। বিপদের ভয় আছে বলে আমার নির্দেশে জানিয়েছি সাদা রঙের ইটালিয়ান আলফা রোমিও গাড়িটা হাইজ্যাক করে নিয়ে যাচ্ছে চালক, গাড়িটাকে দেখামাত্র রিজিওন্যাল হেড-কোয়ার্টারে রিপোর্ট করতে হবে। একা কোন পুলিসকে গাড়ির কাছাকাছি যেতে নিষেধ করে দিয়েছি। এই সভা যদি আমার নির্দেশ বদল করতে চায়, অবশ্যই তা করতে পারে, কিন্তু তার ফলে কোন অঘটন যদি ঘটে তাহলে তার দায়িত্ব এই সভাকেই বহন করতে হবে।’

কেউ মুখ খুলল না।

‘আপনার নির্দেশই বহাল থাকুক,’ বলল কর্নেল বোল্যান্ড। ‘বরং আর একটা নির্দেশ যোগ হওয়া দরকার।

‘বলুন।’

‘অরগ্যানকে জীবিত ধরতে হবে। আহত করা যেতে পারে, কিন্তু হত্যা করা যাবে না। অ্যাকশন সার্ভিস অরগ্যানকে তাদের হাতে পেতে চায়। এর সাথে জড়িত রয়েছে মহামান্য প্রেসিডেন্টের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্ন।

ব্লুড র‍্যাঁবো গভীর ধ্যানমগ্নতার সাথে তাকিয়ে আছেন কর্নেল বোল্যান্ডের দিকে। তিনি যেন কর্নেলের মনের কথা পড়তে চেষ্টা করছেন।

সভার সমাপ্তি ঘোষণা করা হলো মাঝরাতের দিকে। বিশ মিনিট পর থেকে আরম্ভ হলো ষোলোই অক্টোবরের প্রথম প্রহর।