সেই উ সেন – ১.১০

দশ

মাঝরাত। মস্ত বপু আর সারা শরীরে মণ খানেক চর্বি নিয়ে গাড়ি থেকে নামল ফ্রেঞ্চ সুরেতের উপপ্রধান কর্নেল প্যাপন। দোতলার একটা কামরায় আলো জ্বলছে দেখে লুইসা পিয়েত্রোর মুখটা ভেসে উঠল মনের পর্দায়। অমনি সারা শরীরে একটা পুলকের ঢেউ বয়ে গেল। স্ত্রী লায়নস্ ইন্টারন্যাশনালের আন্তর্জাতিক মীটিংয়ে যোগ দিতে দেশের বাইরে গেছে, এই সুযোগে সব ক’টা মহাদেশও বেড়িয়ে আসবে—এবং বাড়ি খালি থাকার সুযোগে কর্নেল প্যাপনও রোজ রাতে চুটিয়ে প্রেম করছে তার নতুন বান্ধবী লুইসা পিয়েত্রোর সাথে। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় ওঠার সময় মুচকি হাসল প্যাপন। আশ্চর্য খেল দেয় মেয়েটা, ঢোক গিলে ভাবল সে, শরীরও বটে একখানা, ঠিক যেন একটা ঢেউ ওঠা নদী। স্ত্রী ফিরে এলেও এ জিনিস হারানো চলবে না, অন্য একটা বাড়িতে গোপনে থাকার ব্যবস্থা করে দিতে হবে।

করিডরে উঠে প্যাপন দেখল লুইসা পিয়েত্রোর কামরার দরজা খোলা, পর্দা ঝুলছে। অদ্ভুত একটা তৃপ্তি বোধ করল প্যাপন। ফিরতে তার যত দেরিই হোক, তার জন্যে রাত জেগে বসে থাকে মেয়েটা। ভাবল, সে-ও লুইসার কাছে সেক্স পার্টনার হিসেবে কম লোভনীয় নয়।

পর্দা সরিয়ে বেডরূমে ঢুকল প্যাপন। বিছানা খালি, সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে লুইসা পিয়েত্রো। হাতে একটা মদের গ্লাস। কর্নেলকে দেখেই উঠে দাঁড়াল সে। কিন্তু সাথে সাথে টলতে শুরু করল। কর্নেলের মনে হলো, পিয়েত্রো বুঝি টলে পড়েই যাবে। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে দু’হাত দিয়ে মেয়েটাকে ধরল সে, টেনে বুকের উপর আনল।

ঢুলু ঢুলু চোখ মেলে কর্নেল প্যাপনকে দেখছে লুইসা পিয়েত্রো। ‘কে? কে তুমি?’ জড়িত কণ্ঠে থেমে থেমে কথা বলছে সে, ‘আমার কর্নেল প্যাপন?’ কর্নেলের বুকে মুখ ঘষতে শুরু করল সে। তারপর ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ‘তুমি নির্মম! তুমি নিষ্ঠুর! রাত জেগে দুশ্চিন্তায় ছটফট করি, অথচ একটা ফোন করে আমাকে শান্ত করার কথা তোমার মনে থাকে না।’

ব্যস্তভাবে কর্নেল বলল, ‘কতবার বলেছি তোমাকে, আমার জন্যে জেগে বসে থেকো না তুমি। জানোই তো, পুলিসের চাকরি করি, ইচ্ছা থাকলেও সব সময় ফোন করা সম্ভব নয়। তুমি…’

তুমি আমাকে ভালবাস না,’ জড়িয়ে জড়িয়ে বলল লুইসা। হাত দিয়ে কর্নেলের বুকে ধাক্কা দিয়ে তাকে সরিয়ে দিতে চাইছে। বাঁ হাতের গ্লাসটা মুখের সামনে তুলল সে। মনের দুঃখে আজ আমি মাতাল হয়েছি। তুমি যাও, আমাকে একা থাকতে দাও।

গ্লাসে চুমুক দিতে যাচ্ছে লুইসা, কিন্তু তার হাত থেকে সেটা কেড়ে নিয়ে মৃদু শব্দে হাসল কর্নেল প্যাপন। ‘মাতাল হয়েছ, ভাল করেছ। তোমার সব দুঃখ আজ কড়ায় গণ্ডায় মিটিয়ে দেব।’ নিচু হয়ে একটা হাত লুইসার হাঁটু দুটোর পিছন দিকে নিয়ে গেল কর্নেল, আরেকটা হাত লুইসার বগলের তলা দিয়ে অপর দিকের কাঁধে তুলে দিল। মাটি থেকে শূন্যে তুলে নিল সে লুইসাকে, এগোল বিছানার দিকে। কিন্তু তার পিঠে দমাদম ঘুষি মারছে লুইসা, চেঁচাচ্ছে, ‘নামাও আমাকে, ছাড়ো আমাকে…তুমি পাষাণ, একটা খবর পর্যন্ত যে দেয় না তার সাথে শোব না

হোঃ হোঃ হাসছে কর্নেল প্যাপন। বিছানায় শুইয়ে দিল সে লুইসাকে। সিধে হয়ে দাঁড়াল। দ্রুত কাপড় ছেড়ে দিগম্বর হতে ত্রিশ সেকেন্ডের বেশি সময় নিল না সে।

বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে লুইসা পিয়েত্রো। প্রকাণ্ড ভুঁড়ি, কালো লোমে ঢাকা উদোম বেঢপ শরীরটা দেখে ঘৃণায় গা রী রী করে উঠল তার। বিছানায় উঠে তার পাশে মস্ত শিম্পাঞ্জীর মত উবু হয়ে বসল কর্নেল প্যাপন। গাউনের ভিতর হাত ঢুকিয়ে অন্তর্বাস টানাটানি করছে। তার মুখের উপর থাবা বসিয়ে দিল লুইসা পিয়েত্রো। পরমুহূর্তে গড়িয়ে উপুড় হয়ে শুলো।

‘প্লীজ, লুইসা!’ আরেদনের সুরে বলল কর্নেল প্যাপন। ‘তোমাকে পাব এই আশায় সারাদিন অপেক্ষা করেছি। এখন যদি ফিরিয়ে দাও, পাগল হয়ে যাব আমি।’

‘সারাদিন করেছটা কি? আমার কথা মনে পড়েনি…

লুইসার নিতম্বে হাত রেখে কর্নেল প্যাপন বলল, ‘আরে, কি ঝামেলায় যে জড়িয়ে পড়েছি, শুনলে আঁতকে উঠবে তুমি, একনিমেষে ছুটে যাবে নেশা।

‘মিথ্যে কথা। আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করছ।’

‘আরে না!’ কর্নেল প্যাপন দু’হাত দিয়ে ধরে চিৎ করল লুইসাকে। লুইসা বাধা দিল না দেখে খই ফুটতে শুরু করল তার মুখে। ‘একটা হত্যা ষড়যন্ত্ৰ আবিষ্কৃত হয়েছে, বুঝলে? আল কাপুর বিরুদ্ধে।

মুহূর্তের জন্যে শক্ত হয়ে গেল লুইসার শরীর। ‘দূর, দূর!’ অবিশ্বাসের সুরে বলে উঠল সে, ‘স্রেফ গুল ছাড়ছ। তুমিই না বলো, তোমাদের কাকে ছুঁতে হলে ছয়শো সশস্ত্র গার্ডের লাশ টপকে যেতে হবে? তাকে খুন করতে চাইবে এমন পাগল কে আছে!’

অত্যন্ত দক্ষ হাতে লুইসার কাপড় খুলছে কর্নেল প্যাপন। বলল, ‘খবরটা মিথ্যে হতে পারে না। এমন শারীরিক কষ্ট দেয়া হয়েছে যে ম্যাটাপ্যান মিথ্যে কথা বলতেই পারে না। লোকটা কাপুর পুরানো এক শত্রু, বাংলাদেশের একজন স্পাই—মাসুদ রানা। বদ্ধ একটা পাগল, তাতে কোন সন্দেহ নেই।’

‘দূর, বিশ্বাস হয় না…’

বিশ্বাস না হবারই কথা।’ বলল কর্নেল। কাপড়চোপড় সরানো শেষ করেছে সে, এখন হাত দিয়ে স্পর্শ নিচ্ছে ঢেউ ওঠা নদীর।

আধঘণ্টা পর ঘুমিয়ে পড়েছে কর্নেল প্যাপন। নাক ডাকছে। ধীরে ধীরে বিছানা ছেড়ে নামল লুইসা পিয়েত্রো। কাপড় পরার জন্যে সময় নিল না, পা টিপে টিপে বেডরূম থেকে বেরিয়ে পাশের কামরায় ঢুকল। মাঝখানের দরজাটা নিঃশব্দে বন্ধ করল সে। দ্রুত এগিয়ে গেল টেলিফোনের দিকে।

একটা Mol।tor নাম্বার ডায়াল করল লুইসা পিয়েত্রো। অপরপ্রান্ত থেকে কারও সাড়া পাওয়া গেল না। সে জানে, অপরপ্রান্তে চালু হয়ে গেছে একটা টেপরেকর্ডার। ঝাড়া দুই মিনিট একটানা কথা বলে গেল সে। কথা শেষ করে রিসিভার নামিয়ে রাখল। তারপর দরজা খুলে পা টিপে টিপে ফিরে এল শোবার ঘরে। বিছানায় শুয়ে কর্নেলের গলা জড়িয়ে ধরল এক হাতে। লাভ নেই, জানে ও, তবু প্রার্থনা করছে মনে মনে রানার জন্যে। নিঃশব্দে ভিজে যাচ্ছে মাথার বালিশ চোখের পানিতে। সব শেষ! ঠেকিয়ে দেবে ওরা মাসুদ রানাকে। জানাজানি হয়ে গেছে সব।

.

প্যারিস। দূতাবাস পাড়ার একটি ছোট্ট, একতলা বাড়ি। গোটা বাড়িতে একটা মাত্র প্রাণী, সারারাত জেগে বসে আছে শোবার ঘরে। লুইসা পিয়েত্রোর মেসেজ পাবার পর থেকে সাতদিনের সিগারেট এক রাতে পুড়িয়ে ফেলেছে রূপা। প্যাকেটের শেষ সিগারেটটা ধরিয়ে সোফার উপর হেলান দিল ও। মনস্থির করতে পারছে না কিছুতেই। এখন তার কর্তব্য কি? মাসুদ রানার সাথে যোগাযোগ করে তাকে সব জানিয়ে দেশে ফিরে যেতে বলবে? লাভ নেই। আগেই ঢাকার মীটিংয়ে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে রানা, কারও কাছ থেকে কোন নির্দেশ বা অনুরোধ যেন তার কাছে না যায়, গেলে সে তা রক্ষা করবে না।

কিন্তু লুইসা পিয়েত্রোর মেসেজ পাবার পর চুপ করে বসে থাকাও যায় না। বিপদটা অকল্পনীয়। মরার আগে সর্বনাশ যা করার করে গেছে ম্যাটাপ্যান। ইউনিয়ন কর্স এখন জানে রানা বেঁচে আছে। শুধু তাই নয়, সান্তিনো ভ্যালেন্টি ছদ্মনাম নিয়ে রোম থেকে লন্ডনে পৌঁছেছে, এবং তার উদ্দেশ্য উ সেনকে খুন করা—কিছুই জানতে বাকি নেই ওদের। এখন শুধু সময়ের প্রশ্ন, রানা ধরা পড়বেই। আর ইউনিয়ন কর্সের হাতে ধরা পড়া মানে…মানেটা স্মরণ করতে গিয়ে শিউরে উঠল রূপা।

রানাকে সতর্ক করার চিন্তাটা মাথা থেকে সরিয়ে ফেলল রূপা। তার কথায় কান দেবে না রানা! কিন্তু হেডকোয়ার্টার থেকে যদি সরাসরি মেজর জেনারেল রাহাত খানের নির্দেশ পায়, হয়তো সিদ্ধান্ত পাল্টাবে সে। কিন্তু, ভাবছে রূপা, ঢাকার সাথে যোগাযোগ করবে কিভাবে সে? যোগাযোগ করতে গেলে ঝুঁকি নিতে হয়। ইন্টারন্যাশনাল এক্সচেঞ্জ থেকে কল বুক করলে মেসেজটা গোপন থাকবে না। উ সেন অত্যন্ত কৌশলে ফ্রান্সের সরকারী প্রশাসনকে খেপিয়ে তুলেছে রানার বিরুদ্ধে, ন্যাশনাল সুরেতের শাখা DST-এর লোকেরা নিশ্চয়ই আন্তর্জাতিক কলগুলো টেপ করার জন্যে আড়ি পাতা যন্ত্র ব্যবহার করতে শুরু করেছে এরই মধ্যে। মেসেজ পাঠাবার সময়ই হয়তো ধরা পড়ে যাবে সে। এবং ধরা পড়া মানে…আবার একবার শিউরে উঠল রূপা।

বাংলাদেশ দূতাবাসের সাহায্য নেবে কিনা ভাবল একবার। সাথে সাথে চিন্তাটাকে বাতিল করে দিল। কঠোর ভাবে নিষেধ করে দিয়েছে ঢাকা অফিস, কোনভাবেই দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ করা চলবে না। দূতাবাসে গেলে তাকে চিনতেই অস্বীকার করবে ওরা, সাহায্য করা তো দূরের কথা।

তাহলে?

ভাবতে ভাবতে সকাল হয়ে গেল। দিনের আলোয় আরও প্রকট মনে হলো সমস্যাটাকে। ওর সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের ভবিষ্যৎ। ওর ভুল সিদ্ধান্তের ফলে রানা যদি ধরা পড়ে, রানাহীন বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স কানা হয়ে যাবে। এর উপর নির্ভর করছে ওর নিজের জীবনও। ভাগ্য যদি প্রসন্ন না হয়, তাকেও দুনিয়ার বুক থেকে এক নিমেষে ঝরে পড়তে হবে অকালে!

সোফা ছেড়ে উঠল রূপা। বাথরূমে ঢুকে আধঘণ্টা ভিজল শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে। মাথাটা ঠাণ্ডা হলো না তবু। দোদুল-দোল দুলছে মন। স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছে না।

বাথরূম থেকে সেজেগুঁজে বেরোল, কিন্তু বাইরে যাবার ব্যাপারে এখনও কিছু ঠিক করেনি। কিচেনে ঢুকে কফি তৈরি করল এক কাপ। ড্রয়িংরূমে বসে ছোট ছোট চুমুক দিয়ে শেষ করল কাপটা। দরজা খুলে বারান্দা থেকে তুলে নিল সংবাদপত্রের প্রভাত সংস্করণটা। সোফায় ফিরে এসে চোখের সামনে মেলে ধরল কাগজটা। উল্লেখযোগ্য অনেক খবরই রয়েছে, কিন্তু সবই ওর কাছে তাৎপর্যহীন লাগছে। নামিয়ে রাখল কাগজটা পাশে। একটা মাত্র নাম বাজছে কানে। বারবার তার চেহারাটা ভেসে উঠছে চোখের সামনে। মাসুদ রানা।

বিপদ থেকে তাকে উদ্ধার করার পথ কি?

শেষ পর্যন্ত বেলা ন’টা বেজে গেল। অস্থিরতা কাটিয়ে উঠল রূপা। যা হয় হবে, ঝুঁকিটা নিজের উপর দিয়েই নেবে সে। ফোন করবে ঢাকায়। আন- অফিশিয়াল ফোন নাম্বার জানা আছে তার, খোঁজ করলেও এই নাম্বারে মালিককে খুঁজে পাবে না কেউ কোনদিন।

বাড়িতে তালা লাগিয়ে বেরিয়ে পড়ল রূপা। গাড়িটা গ্যারেজেই থাকল। পায়ে হেঁটে মেইন রোডে এসে হাত তুলে দাঁড় করাল ধাবমান একটা ট্যাক্সিকে। ‘জার দু নর্দে যাব,’ উঠে বসে বলল ড্রাইভারকে। স্টেশনের সম্মুখ চাতালে নেমে ট্যাক্সি ছেড়ে দিল ও। ট্যাক্সি নিয়ে ড্রাইভার অদৃশ্য হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল, তারপর পায়ে হেঁটে বেরিয়ে এল স্টেশন থেকে।

রাস্তা পেরিয়ে একটা কাফেতে ঢুকল রূপা। কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে কফি আর টেলিফোনের জন্যে একটা ধাতব চাকতির অর্ডার দিল। চাকতিটা নিয়ে কি যেন ভাবল একটু। তারপর কাউন্টারে কফি রেখে কাফের পিছন দিকে চলে গেল টেলিফোন করতে। ডাইরেক্টরী এনকোয়েরির নাম্বারে ডায়াল করে প্রশ্ন করতেই অপারেটর ওকে ইন্টারন্যাশনাল এক্সচেঞ্জের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ জানাল। ইন্টারন্যাশনাল এক্সচেঞ্জের নাম্বারটা মুখস্থ করতে করতে রিসিভার নামিয়ে রাখল রূপা।

কফির দাম চুকিয়ে দিয়ে কাফে থেকে বেরিয়ে পায়ে হেঁটে একশো মিটার এগোল রূপা, রাস্তা পেরোল, তারপর আবার একটা কাফেতে ঢুকে টেলিফোন ব্যবহার করল। এবার এনকোয়েরিকে জিজ্ঞেস করল, আন্তর্জাতিক টেলিফোন কল বুক করা যায় কাছাকাছি এমন কোন পোস্টাফিস আছে কিনা। উত্তর এল, মেইন লাইন রেলওয়ে স্টেশনের মোড়ে সে-রকম একটা পোস্টাফিস আছে।

তিন মিনিটের পথ পেরিয়ে পোস্টাফিসে পৌঁছল রূপা। সম্ভাব্য বিপদের কথা ভেবে দুরু দুরু করছে বুকের ভিতরটা। হাতের তালু ঘামছে। কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তে অটল সে। ইতস্তত না করে রিসিভার তুলল ও। ডায়াল করে অপারেটরকে বলল, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার একটা অভিজাত হোটেলের সাথে যোগাযোগ করতে চায় সে। হোটেলের একটা ফোন নাম্বারও অপারেটরকে জানাতে ভুল করল না। কিন্তু নাম্বারটা কার দখলে, বা যার সাথে সে কথা বলতে চায় তার নাম কি তা উল্লেখ করল না।

এরপর শুরু হলো প্রতীক্ষার পালা। নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে রূপা বুদের ভিতর। উদ্বেগে আর আশঙ্কায় গলা শুকিয়ে গেছে। বিশ মিনিট পেরিয়ে গেছে তবু কোন সাড়া নেই রিসিভারে। হঠাৎ ভয় পেয়ে গেল রূপা। মনে হলো,

এই মুহূর্তে পোস্টাফিস থেকে পালিয়ে যাওয়া উচিত ওর। ফ্রান্সের জাতীয় সুরেতের এসপিওনাজ শাখায় (DST) ইউনিয়ন কর্সের লোকই বেশি। তারা নিশ্চয়ই আন্তর্জাতিক টেলিফোন যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর তীক্ষ্ণ নজর রেখেছে। ঢাকায় কেউ ফোন করতে চাইলেই খবরটা জেনে যাবে তারা। ইতোমধ্যে নিশ্চয়ই জেনে গেছে। হয়তো জীপ নিয়ে রওনা হয়ে গেছে। যে-কোন মুহূর্তে পৌঁছে যাবে।

আতঙ্কে নীল হয়ে উঠল রূপার চেহারা। কি করবে, দ্রুত ভাবছে-এমন সময় অপারেটর বলল, ‘কথা বলুন।’

‘আপনি কে বলছেন?’ একটানা বিচিত্র যান্ত্রিক গোলযোগের ভিতর শোনা গেল অস্পষ্ট একটা কণ্ঠস্বর।

প্রশ্নের উত্তর দিল না রূপা, বলল, ‘আমি একজন বাঙ্গালী ভদ্রমহিলার সাথে কথা বলতে চাই। মিস নাহাসো। ওকে দিন।

রিসিভার থেকে তীব্র ঝড়ের একটানা গর্জন আসছে, তার মধ্যে অস্পষ্টভাবে কানে এল, ‘অপেক্ষা করুন।

তারপর ক্লিক-ক্লিক কতকগুলো যান্ত্রিক শব্দ ভেসে এল অপরপ্রান্ত থেকে, এবং ক্লান্ত একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘নাহাসো বলছি।’

‘আমি পারূ,’ জাপানী ভাষায় দ্রুত কথা বলছে রূপা, ‘শোনো, হাতে সময় কম। যা বলছি কাগজে টুকে নাও। শুরু করছি। নারার অস্তিত্ব প্রকাশ পেয়ে গেছে। রিপিট। নারার অস্তিত্ব প্রকাশ পেয়ে গেছে। একজনকে কথা বলানো হয়েছে। মরার আগে বলে গেছে সব। শেষ। লিখেছ?’

অস্ফুট, প্রায় শোনা গেল না সোহানার কণ্ঠস্বর, ‘হ্যাঁ।’

রিসিভার রেখে বিল মিটিয়ে পোস্টাফিস থেকে দ্রুত বেরিয়ে এল রূপা। এক মিনিটের মধ্যে মেইন লাইন স্টেশনের লোকারণ্যে হারিয়ে গেল সে।

দু’মিনিট পর পোস্টাফিসের সামনে এসে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষে থামল একটা জীপ। লাফ দিয়ে দু’জন DST-এর লোক নামল সেটা থেকে, ছুটে ঢুকে গেল দালানটার ভিতরে। সুইচবোর্ড অপারেটরের কাছ থেকে রূপার চেহারার এবং পোশাকের বর্ণনা ছাড়া আর কিছু পেল না তারা। কিন্তু এও কম পাওয়া নয়। ‘প্যারিসে শাড়ি পরা বাংলাদেশী নারী সংখ্যায় খুব বেশি নেই, সুতরাং মেয়েটাকে খুঁজে বের করতে তেমন বেগ পেতে হবে না।

.

ঢাকা। বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স।

আন্তমহাদেশীয় টেলিফোন কল রিসিভ করার জন্যে স্থানীয় একটা অভিজাত হোটেলে বি-সি-আই-এর একটা টেলিফোন আছে, প্রয়োজনে এই সেটটার সাথে সরাসরি হেডকোয়ার্টারের কমিউনিকেশন রুমের একটা সেটের সংযোগ ঘটানো যায়। বি-সি-আই-এর হাই অফিশিয়াল এবং স্পেশাল এজেন্টস ছাড়া এই সেটের নাম্বার আর কারও জানা নেই।

কমিউনিকেশন রূম থেকে উদ্ভ্রান্তের মত করিডরে বেরিয়ে এল সোহানা। হাতে কাগজের একটা টুকরো। ঠিক এই সময় নিজের কামরা থেকে বেরোল চীফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর। লাঞ্চ খেতে যাচ্ছে সে। তাকে দেখেই ছুটতে শুরু করল সোহানা।

হাইহিলের দ্রুত খটাখট শব্দ শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সোহেল। ঘুরল। হাঁপাতে হাঁপাতে তার সামনে এসে দাঁড়াল সোহানা।

‘কি…’ প্রশ্ন শুরু করে সারতে পারল না সোহেল, হাতের কাগজটা বাড়িয়ে দিল সোহানা তার দিকে। কথা বলবে, সে-শক্তি এখনও ফিরে আসেনি ওর।

ভাঁজ খুলে কাগজে লেখা মেসেজটা পড়তে শুরু করল সোহেল। ছোট্ট মেসেজ। প্রথমবার দ্রুত পড়ে গেল সোহেল। দ্বিতীয়বার প্রতিটি বাক্য পড়া শেষ করে অর্থ হৃদয়ঙ্গম করার জন্যে কয়েক সেকেন্ড বিরতি নিল। তৃতীয়বার কয়েক সেকেন্ড বিরতির ব্যবধানে পড়ছিল প্রতিটি শব্দ। চেহারায় কোনই প্রতিক্রিয়া নেই। কাগজটা থেকে মুখ তুলে তাকাল সোহানার দিকে। মৃদু গলায় বলল, ‘এসো।’ বলেই সোহানাকে পাশ কাটিয়ে নিজের কামরার দিকে এগোল সে।

সোহেলের নির্বিকার, নিরুদ্বিগ্ন হাবভাব লক্ষ করে কেমন যেন হতভম্ব হয়ে গেছে সোহানা। তিন সেকেন্ড একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকল সে। মেসেজটায় রানার জন্যে যে সাংঘাতিক বিপদের ঘোষণা রয়েছে, সোহেল ভাইয়ের কি তা নজরে পড়েনি? ভাবতে ভাবতে ঘুরে দাঁড়াল সোহানা, অনুসরণ করল সোহেলকে।

চক্কর খেয়ে গেছে সোহেলের মাথা, মুহূর্তে সুস্থতা হারিয়ে ফেলেছে সে। সোহানা ভয় পেয়ে যাবে ভেবে অতি কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছে সে। ঝড় বয়ে যাচ্ছে মাথার ভিতর। সব রাগ গিয়ে পড়ছে রানার উপর। বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে ছটফট করছিল ও। কারও কথায় কান দেয়নি। বসের উপরও একটা অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠল সোহেলের মনে। তিনি অন্তত বাধা দিতে পারতেন রানাকে।

চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে উঠল সোহেলের। কামরায় ঢুকে সোজা এগিয়ে গিয়ে বসল নিজের রিভলভিং চেয়ারে। পর্দা সরিয়ে ভিতরে ঢুকল সোহানা। নিঃশব্দে এগিয়ে এসে ডেস্কের সামনে দাঁড়াল।

‘বসো,’ গলাটা যথাসম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করে বলল সোহেল।

‘এই মুহূর্তে সাবধান করা উচিত রানাকে, তাই না?’ বসল না সোহানা, দু’হাত দিয়ে ডেস্কের কিনারা শক্ত করে ধরে ঝুঁকে পড়ল সোহেলের দিকে। দু’চোখে ব্যাকুল দৃষ্টি।

সাবধান করে কোন লাভ হবে না,’ বলল সোহেল। অপারেশন বাতিল করে ফিরে আসার জন্যে অফিশিয়াল নির্দেশ জানাতে হবে ওকে। এখন আর সফল হবার কোন আশা নেই রানার। ইতিমধ্যে ধরা পড়ে গিয়ে না থাকলেই হয়।’

‘কিন্তু যোগাযোগ করব কিভাবে?

‘ওর লন্ডনের ফোন নাম্বারে যোগাযোগ করার মধ্যে ঝুঁকি আছে,’ বলল সোহেল। আড়চোখে তাকাল ইন্টারকম সেটটার দিকে। বসের সাথে আলোচনার আগেই অফিশিয়াল নির্দেশ দিতে চায় সে রানাকে। কিন্তু আরও কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করল ও। তারপর কাঁধ ঝাঁকাল। ‘কিন্তু ঝুঁকিটা না নিয়ে এখন কোন উপায় নেই আমাদের। তুমি যাও, কমিউনিকেশন রুম থেকে সরাসরি ফোন করো রানাকে। আমি বসের চেম্বারে যাচ্ছি মীটিং ডাকার প্রস্তাব নিয়ে।

দ্রুত ঘুরে দাঁড়াল সোহানা। ছুটে বেরিয়ে গেল সে সোহেলের কামরা থেকে।

কপালে হাত দিয়ে বসে রইল সোহেল। মুহূর্তের জন্যে দুশ্চিন্তায়, উদ্বেগে বিকৃত হয়ে উঠল মুখের চেহারা। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। পরিষ্কার জানা আছে তার, একটা ফোন কল রানাকে ফিরিয়ে আনার জন্যে যথেষ্ট নয়। রানা এই অফিশিয়াল নির্দেশ গ্রাহ্যই করবে না। নিজে যা ভাল মনে করে, তাই চিরকাল করে এসেছে ও। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হবে না। রানাকে ফিরিয়ে আনতে পারে মাত্র একজনই। তিনি মেজর জেনারেল রাহাত খান। একমাত্র তাঁর কণ্ঠস্বর থেকে সরাসরি নির্দেশ পেলে গ্রাহ্য না করে পারবে না রানা।

এখন, ভাবছে সোহেল, বসকে রাজি করাতে পারলেই হয়।

ওদিকে কমিউনিকেশন রূম থেকে সরাসরি লন্ডনে রানার ফোন নাম্বারে রিঙ করছে সোহানা। ঝন ঝন করে ফোনের বেল বাজছে অপর প্রান্তে। সাড়া নেই। কেউ রিসিভার তুলছে না। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপালের স্বেদ বিন্দু মুছল সোহানা। কানের সাথে চেপে ধরে আছে রিসিভারটা। রানা নেই বাড়িতে? ধরা পড়ে গেছে? গলার কাছে একটা কান্নার প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছে সোহানা। অপরপ্রান্তে ফোনের বেল বাজছে। রিসিভার তুলছে না কেউ।

.

লন্ডন।

ঘুম থেকে আজ কাক ভোরে উঠেছে রানা। অনেক কাজ হাতে।

আগের সন্ধ্যায় সুটকেস তিনটে পরীক্ষা করার জন্যে খালি করে আবার সব জিনিস একটা একটা করে ভরে রেখেছে ও। স্পঞ্জের ব্যাগ আর দাড়ি কামাবার যন্ত্রপাতি, হ্যান্ড-গ্রিপে এই দুটো জিনিস তুলতে বাকি আছে শুধু।

ঘুম থেকে উঠে কফি তৈরি করে খেয়েছে, বাথরূম এবং শাওয়ার সেরে দাড়ি কামিয়েছে। তারপর হ্যান্ড-গ্রিপে স্পঞ্জের ব্যাগ আর দাড়ি কামাবার যন্ত্রপাতি ভরে তিনটে সুটকেসের সাথে সেটাকেও দাঁড় করিয়ে রেখেছে দরজার একপাশে।

ছোট্ট কিচেনে ঢুকে মামুলি ব্রেকফাস্ট তৈরি করল রানা। ভাজা ডিম, অরেঞ্জ জুস, এবং আরও এক কাপ কালো কফি। ব্রেকফাস্ট শেষ করে অবশিষ্ট ডিম দুটো ভেঙে বেসিনে ফেলে দিল ও, দুধের আধখালি টিনটাও উপুড় করে ধরল বেসিনে। অরেঞ্জ জুসটুকু ফেলতে গিয়ে মায়া অনুভব করল, ভাই গলায় ঢেলে খালি করল বোতলটা। আবর্জনা জমা করার প্লাস্টিকের ঢাকনিওয়ালা বাস্কেটে বোতল, দুধের খালি টিন, ডিমের খোসা ইত্যাদি ফেলল ও। ওর অনুপস্থিতিতে কিছুই যেন পচে দুর্গন্ধ না ছড়ায়।

এরপর পোশাক পরতে শুরু করল সে। বেছে নিল সিল্কের পোলো-নেকড সোয়েটার, ডাভ-গ্রে রঙের স্যুট, গাঢ় বাদামী রঙের মোজা এবং সরু কালো মোকাসিন জুতো। স্যুটের পকেটে ভরল অরগ্যানের সমস্ত ব্যক্তিগত কাগজপত্র, নগদ এক হাজার ব্রিটিশ পাউন্ড।

পোশাক পরা শেষ হলো। এরপর চোখে লাগান গাঢ় রঙের চশমাটা।

নয়টা পনেরো মিনিটে দু’হাতে দুটো করে ব্যাগ নিয়ে কামরা থেকে বেরিয়ে এল রানা। বারান্দায় হাতের জিনিস নামিয়ে রেখে দরজায় তালা মারল। কৌতূহলী প্রতিবেশীরা বিরক্ত করতে এল না কেউ। অবশ্য গত রাতে একজন এসেছিল। তাকে রানা জানিয়েছে, আইসল্যান্ডে মাছ ধরার উদ্দেশ্যে আজ রওনা হয়ে যাবে ও।

সাউথ অডলে স্ট্রীট খুব দূরে নয়, হেঁটেই পৌঁছে গেল রানা। দ্রুত ধাবমান একটা ট্যাক্সি থামাল হাত তুলে। ‘লন্ডন এয়ারপোর্ট,’ ড্রাইভারকে জানাল ও। ‘দু’নম্বর বিল্ডিং।’

ট্যাক্সি ছেড়ে দিল ড্রাইভার। ঠিক সেই সময় রানার বাড়িতে টেলিফোন বাজতে শুরু করল।

.

ঢাকা। বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স।

হাই অফিশিয়াল এবং স্পেশাল এজেন্টদের নিয়ে মীটিং বসেছে মেজর জেনারেল রাহাত খানের চেম্বারে। আলোচ্য বিষয়: রানা ইন ডেঞ্জার।

মীটিং শুরু হলো সবাইকে রূপার পাঠানো মেসেজের কপি পড়তে দিয়ে। রানা বিপদগ্রস্ত, বা তার বিপদের মাত্রা, ধরন ইত্যাদি প্রসঙ্গে আলোচনার শুরুতে কেউ কোন প্রশ্ন তুলল না। মেসেজটা পড়ার পর এ ব্যাপারে কারও মনে কোন সন্দেহের অবকাশ থাকল না যে রানার অস্তিত্ব এবং উদ্দেশ্য প্রকাশ হয়ে পড়ায় তার আর কোন আশা নেই। ইউনিয়ন কর্সের খপ্পর থেকে প্রাণে বাঁচতে হলে তাকে পিছু হটতে হবে, ফিরে আসতে হবে দেশে।

কিন্তু রানার সাথে যোগাযোগ করা হবে কিভাবে? প্রথমে এ প্রশ্ন নিয়েই আলোচনা শুরু হলো।

সোহানা তার রিপোর্টে জানাল, রানার লন্ডনের বাড়িতে ঘণ্টা দুই ধরে ফোন করেও কোন সাড়া পায়নি সে। কমিউনিকেশন রূমের একজন কর্মী দশ মিনিট পর পর এখনও রিঙ করছে, রানার সাড়া পাওয়া গেলেই খবর পাঠাবে সে।

‘রানা এখন কোথায়?’ এই প্রথম প্রশ্ন করলেন রাহাত খান। অদ্ভুত একটা ব্যতিক্রম লক্ষ করছে আজ সবাই তাঁর আচরণে। আস্ত একটা চুরুট দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে আছেন তিনি, কিন্তু তাতে অগ্নিসংযোগ করেননি। আগুন ধরাতে ভুলে গেছেন, ব্যাপারটা তাও হতে পারে না। এ ধরনের ব্যাপারে ভুলটা বড় জোর দু’এক মিনিট স্থায়ী হতে পারে, কিন্তু আগুনহীন চুরুটটাকে তিনি প্রায় মিনিট পনেরো ধরে দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে আছেন। শুধু তাই নয়, মুঠোয় রয়েছে গ্যাস লাইটারটা, সেটা নাড়াচাড়া করছেন, কখনও সেটার দিকে তাকিয়ে থাকছেন, কিন্তু চুরুট ধরাবার কোন লক্ষণ তাঁর মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। তার কণ্ঠস্বরটাও আজ কানে বাজল সবার। আশ্চর্য মৃদু শোনাল তাঁর কণ্ঠস্বর। তাতে ঝাঁঝ নেই, নেই রাগ, তিরস্কার বা কাঠিন্য।

‘কোথায়, আমরা তা জানি না,’ ম্লান গলায় বলল সোহেল। পর মুহূর্তে গলা চড়ে গেল তার, ‘কিন্তু স্যার, যেভাবেই হোক ওকে থামাতে হবে। আমাদের কারও কথা শুনবে না ও। এ ব্যাপারে আমি আপনার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ কামনা করি। গোটা ফ্রান্স চষে খুঁজে বের করে ফেলবে ওরা রানাকে. তার আগে…

নিঃশব্দে একটা তর্জনী খাড়া করলেন মেজর জেনারেল। অর্থাৎ সোহেলকে থামতে ইঙ্গিত করছেন তিনি। কথা শেষ না করে চুপ করে গেল সোহেল।

গোটা ফ্রান্স চষবে ওরা, কারেক্ট,’ রাহাত খান বললেন, ‘কিন্তু কার খোঁজে? দীর্ঘদেহী একজন বিদেশীর খোঁজে, তাই না? চলতি মৌসুমে দশ লক্ষ বিদেশী ট্যুরিস্ট ঢুকবে ফ্রান্সে। যতদূর জানি, রানাকে খুঁজে বের করার জন্যে ইউনিয়ন কর্সের হাতে তেমন কোন সূত্র নেই। রানা ছদ্মবেশ নিয়ে থাকবে, ছদ্মনাম ব্যবহার করবে, এবং একজন প্রফেশন্যাল হিসেবে অবশ্যই জাল পাসপোর্ট ব্যবহার করছে সে। সোহেলের বুকের দিকে তর্জনী খাড়া করলেন তিনি, ‘এই মুহূর্তে ওর বিপদটা কোথায় দেখতে পাচ্ছ তুমি?’

আপাদমস্তক চমকে উঠল সোহেল। বসের কথায় শুধু যে চোখ খুলে গেল তাই নয়, নিজের বুদ্ধি এবং কল্পনা শক্তির দৈন্যতা উপলব্ধি করে মনটা সেই সাথে একটু দমেও গেল। বলল, ‘কিন্তু শেষ পর্যন্ত রানা ওদেরকে ফাঁকি দিতে পারবে বলে মনে করেন, স্যার?’

গম্ভীর হলেন রাহাত খান। বললেন, ‘তা নির্ভর করে ওর আত্মবিশ্বাস, বুদ্ধি এবং প্ল্যানিংয়ের ওপর।

সোহেল বসের সাথে একা কুলিয়ে উঠতে পারছে না লক্ষ করে এবার তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল সোহানা। বলল, ‘আমি মনে করি, রানাকে সতর্ক করে দেবার প্রয়োজন আছে, স্যার। এ কাজটা রূপাই করতে পারবে, প্রথমবার রানা তাকে ফোন করলেই,’ অত্যন্ত সাবধানে, ভেবেচিন্তে কথা বলছে সোহানা, ‘এই মুহূর্তে ফ্রান্স ত্যাগ করা উচিত রানার। ও যদি না চায়, ওকে বাধ্য করা উচিত বাধ্য করার একমাত্র অস্ত্র শুধু আপনার হাতেই আছে, স্যার। আর কারও কথা শুনবে না ও।’

‘থিওরি হিসেবে তোমার এই বক্তব্য কারেক্ট,’ মেজর জেনারেল বললেন।

‘যা ঘটে গেছে, এরপর কি রানার কোন আশা আছে বলে মনে করেন আপনি?’ সোজা প্রশ্নটা সোজাভাবে করল সোহানা।

‘নেই,’ মেজর জেনারেল রাহাত খান সোজা উত্তর দিলেন। ধীরেসুস্থে চুরুটে আগুন ধরালেন তিনি। কিন্তু তাঁর হাত কাঁপছে, এটা আবিষ্কার করে কলজে শুকিয়ে গেল সোহেলের। ‘কিন্তু রানা একজন প্রফেশন্যাল। আরেক অর্থে, আমিও তাই। একজন প্রফেশন্যাল আরেকজন প্রফেশন্যালের পরিকল্পিত অপারেশনকে খাটো করে দেখতে পছন্দ করে না।

‘স্যার, ওকে ফিরিয়ে আনুন!’ আবেদনের সুরে হঠাৎ বলে উঠল সোহানা। তার কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল, কারও কারও গায়ের রোম দাঁড়িয়ে গেল সাথে সাথে। ঘন ঘন চুরুটে টান দিয়ে একরাশ ধোঁয়ার আড়ালে রাহাত খান যেন মুখ লুকালেন। সবাই শুধু তাঁর ভারী কণ্ঠস্বর শুনতে পেল, ‘পারি না। পারলে, আনতাম। নিজের পথে চলে গেছে ও। সে কোথায়, কি করতে যাচ্ছে—কিছুই জানা নেই আমাদের।

‘রূপাকে দিয়ে…

‘সম্ভব নয়,’ বললেন মেজর জেনারেল। তাতে শত্রুদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হবে রূপার অস্তিত্ব। একটু বিরতি নিলেন তিনি। এখনও তাঁর মুখ ধোঁয়ার আড়ালে অদৃশ্য। তারপর বললেন, ‘রানাকে থামাবার সাধ্য এখন কারও নেই। আমারও না। অনেক দেরি হয়ে গেছে। পরিষ্কার বুঝতে পারছি আমি—রওনা হয়ে গেছে সৈ প্যারিসের উদ্দেশে। প্রস্তুতি পর্ব শেষ হয়েছে. এইবার ঘটতে শুরু করবে ঘটনা।