সেই উ সেন – ১.৭

সাত

মাসের শেষ দিনটা ব্যস্ততার মধ্যে কাটল রানার। সারাটা সকাল ফ্রিয়া মার্কেটের এক দোকান থেকে আরেক দোকানে ঢুঁ মেরে বেড়াল, কাঁধে ঝুলছে সস্তা দামের একটা নোংরা হোল্ড-অল। তেল চিটচিটে একটা বেরেট (গোলাকার কার্নিসহীন টুপি, গোটা মাথায় চেপে বসে থাকে), গোড়ালি ঢাকা এক জোড়া তালি মারা জুতো, রেলিং ব্রাদার্স থেকে ঢলঢলে একটা ট্রাউজার, এবং বিস্তর খোঁজাখুঁজি করে একটা মিলিটারি গ্রেটকোট কিনল পানির দামে। খুব ভারী হয়ে গেল গ্রেটকোটটা, কিন্তু এর চেয়ে হালকা কোথাও পাওয়া গেল না। তবে যথেষ্ট লম্বা, ওর হাঁটু থেকে চার ইঞ্চি নিচে পর্যন্ত ঢাকা পড়ে যাবে। সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।

প্যারিসের রেলিং ব্রাদার্সে পাওয়া যায় না এমন কিছু নাকি নেই, তার প্রমাণ পেল রানা হাতেনাতে। একটু খুঁজতেই দেখতে পেল প্রকাণ্ড শো-কেস ভর্তি পুরানো, দাগী মেডেলের সমারোহ। একধারে জড় করা পুরো একটা কালেকশান কিনল ও। সাথে বুকলেটও রয়েছে, তাতে ঝাপসা হয়ে যাওয়া মেডেলের ছবির নিচে পরিচিতি লেখা, পাঠককে জানাচ্ছে ফ্রেঞ্চ মিলিটারিতে কি ধরনের কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ বা কোন্ আচরণের জন্যে কোন্ মেডেল উপহার পাওয়া যায়। রু রয়্যালের কুইনিজ রেস্তোরায় হালকা লাঞ্চ খেল রানা। তারপর হোটেলে ফিরে বিল মেটাল, ব্যাগ-ব্যাগেজ গুছিয়ে নিল। দামী দুটো সুটকেসের একটার নিচে ভরল আজকের কেনা সব জিনিস। বুকলেট দেখে কয়েকটা মেডেল বেছে নিল ও। শত্রু সেনাদের সাথে লড়ার সময় অসম সাহস দেখাবার কৃতিত্বস্বরূপ এই মেডেলগুলো পাওয়া যায়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ফ্রি ফ্রেঞ্চ কোর্সে নাম লিখিয়ে লড়েছিল যারা তাদেরকে দেয়া হয়েছে মেডেল দে লা লিবারেশন, সাথে পাঁচটা চ্যাম্পিয়ন মেডেল—এই মোট ছয়টা মেডেলও বেছে রাখল ও। তারপর তিউনিসিয়ায় এবং লিবিয়ায় কৃতিত্ব দেখাবার স্বীকৃতি হিসেবে নিজেকে দুটো বীর হাকিম পদক দিল।

বাকি সব মেডেল, এবং বুকলেটটা আলাদা আলাদা ভাবে দুই রাস্তার দুই ডাস্টবিনে ফেলে দিল ও। ফিরে আসতেই হোটেলের ডেস্ক ক্লার্ক জানাল ইতেয়েলি দু নর্দ এক্সপ্রেস ব্রাসেলসের উদ্দেশে গার দু নর্দ থেকে ছাড়বে পাঁচটা পনেরোয়।

ঠিক পাঁচ মিনিট আগে স্টেশনে পৌঁছল রানা। ট্রেনে উঠে ভরপেট ডিনার খেল। সেপ্টেম্বরের শেষ মুহূর্তে পৌছে গেল ব্রাসেলসে।

.

রোম। রানা এজেন্সী। ডাক পিয়ন একটা চিঠি দিয়ে গেল ম্যাটাপ্যানকে। এয়ার ফ্রান্সের মনোগ্রাম ছাপা এনভেলাপের উপর বন্ধ ভিক্টর কাউলাস্কির হাতে লেখা ঠিকানা দেখে শরীরে একটা আনন্দের প্লাবন বয়ে গেল তার, প্রকাণ্ড ক্লিনশেভ মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল হাসিতে। বেশ অনেকদিন হলো চিঠিপত্র দেয়নি ভিক্টর। মেয়েটার খবর পাবার জন্যে মনে মনে ছটফট করছিল সে।

সময় হয়ে গেছে। মোনিকা এক্ষুণি উপর থেকে অফিসে নামবে। তাড়াতাড়ি কোটের ব্রেস্ট পকেটে এনভেলাপটা চালান করে দিল ম্যাটাপ্যান। সে একটা মেয়ের বাপ, এ খবর জানা নেই মোনিকার। ফ্রেঞ্চ বন্ধু ভিক্টর কাউলাস্কি এবং তার স্ত্রী ছাড়া এ তথ্য আর কেউ জানে না। তার জীবনে এটাই একমাত্র গোপন ব্যাপার। চিরকাল গোপনই রাখতে চায় সে।

জীবনে একটি মাত্র মেয়েকে ভাল লেগেছিল ম্যাটাপ্যানের। সে হলো ভ্যালেন্টিনার মা। ফ্রান্সে বেড়াতে গিয়ে তার সাথে পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতা

ঘনিষ্ঠতার ফল হিসেবে তার গর্ভে এল ভ্যালেন্টিনা। ম্যাটাপ্যান খবরটা শুনে এক মুহূর্ত দেরি করেনি, সাথে সাথে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু তার প্রস্তাবে রাজি হয়নি ভ্যালেন্টিনার মা। ফ্রান্স ছেড়ে ইটালীতে আসতে চায় না, এটাই ছিল তার আপত্তির কারণ। অনেক চেষ্টা করেছিল ম্যাটাপ্যান, কিন্তু মেয়েটা তার কোন কথাই শুনতে চায়নি। অগত্যা গর্ভের সন্তানটিকে রক্ষার জন্যে বন্ধু ভিক্টরের পরামর্শ চায় সে। বন্ধু বিবাহিত, কিন্তু ওদের কোন সন্তান নেই। কখনও হবেও না। সাগ্রহে তারা ম্যাটাপ্যানের সন্তানকে পালক সন্তান হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি হয়ে যায়।

ভ্যালেন্টিনা এখন ছয় বছরের মেয়ে। স্কুলে পড়াশোনা করে। ভিক্টর এবং তার স্ত্রীকেই সে নিজের মা-বাপ হিসেবে জানে।

সেদিন লাঞ্চ আওয়ারে চিঠিটা পড়ার সুযোগ পেল ম্যাটাপ্যান। অফিসের দরজা বন্ধ করে দিয়ে এনভেলাপটা খুলল সে। চিঠিটা পড়তে শুরু করল।

সংক্ষিপ্ত চিঠি, দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল ম্যাটাপ্যানের। এর আগের চিঠিতে ভিক্টরকে সে অনুরোধ করেছিল ভ্যালেন্টিনার কথা সে যেন বেশি করে লেখে।

চিঠিটা পড়তে শুরু করেই আশঙ্কায় কেঁপে উঠল ম্যাটাপ্যানের বিশাল বুকটা। ভিক্টর লিখেছে:

ভ্যালেন্টিনা সাংঘাতিক অসুস্থ। ওর লিউকোমিয়া হয়েছে। চিন্তা কোরো না। চিকিৎসা চলছে।’

লিউকোমিয়া মানে ব্লাড ক্যান্সার। চিঠি ধরা হাতটা কাপছে ম্যাটাপ্যানের। তবে কি ভ্যালেন্টিনা বাঁচবে না?

কয়েক মুহূর্ত নিষ্প্রাণ পাথরের মত চেয়ারে বসে রইল ম্যাটাপ্যান। কি করবে, ঠিক করতে পারছে না। এই মুহূর্তে তার ফ্রান্সে যাওয়া অসম্ভব। কোন্ অজুহাতে যাবে সে? কি কারণ দেখাবে মোনিকাকে?

হঠাৎ মনে পড়ল গতবার সে যখন প্যারিসে ভিক্টরদের বাড়িতে গিয়েছিল তখন ভিক্টরের স্ত্রী কথায় কথায় তাকে জানিয়েছিল, তারা বাড়িতে টেলিফোন নেবার চেষ্টা করছে। তারপর দু’বছর কেটে গেছে। এ্যাদ্দিনে নিশ্চয়ই টেলিফোন পেয়ে গেছে ওরা।

কিন্তু টেলিফোন থাকলেই বা কি, নাম্বার জানা না থাকলে যোগাযোগ করবে কিভাবে? তবু, একবার চেষ্টা করে দেখতে হবে। আজ অনেক কাজ, বাইরে বেরোবার কোন উপায়ই নেই। আগামীকাল কোন একটা অজুহাত দেখিয়ে রোমের মেন পোস্ট অফিসে গিয়ে চেষ্টা করে দেখবে সে কোন উপায় করা যায় কিনা। চোখের সামনে ভ্যালেন্টিনার কচি মুখটা ভেসে উঠতেই বিশালদেহী গরিলা ম্যাটাপ্যান শিশুর মত ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল।

.

ইটালীতে ম্যাটাপ্যান যখন ডাকপিয়নের হাত থেকে চিঠি নিচ্ছে, রানা তখন ব্রাসেলসের অ্যামিগো হোটেল ছেড়ে ট্যাক্সি নিয়ে অস্ত্র ব্যবসায়ী ম্যানিকিন পীসের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে। ঘণ্টা দুই আগে ব্রেকফাস্টে বসে মি. অরগ্যান হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়ে টেলিফোনে যোগাযোগ করেছে রানা। এগারোটার সময় অ্যাপয়েন্টমেন্ট, পীস একা অপেক্ষা করবে তার অফিসে ওর জন্যে।

রাস্তার মোড়ে সাড়ে দশটায় পৌছল রানা। ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে পায়ে হেঁটে রাস্তার শেষ মাথায় ছোট্ট একটা পার্কে ঢুকল। কাঠের বেঞ্চিতে বসে সামনে খবরের কাগজ মেলে ধরেছে। পড়ছে না, পার্কের নিচু পাঁচিলের উপর দিয়ে ওর দৃষ্টি চলে গেছে রাস্তা পেরিয়ে একটা অফিসের দরজার দিকে। বৃদ্ধ পীসের অফিস ওটা। কেউ ওখানে আসা যাওয়া করছে কিনা দেখে নিচ্ছে সতর্ক দৃষ্টিতে।

আধ ঘণ্টা পর পার্ক থেকে বেরিয়ে রাস্তা পেরোল রানা। দরজাটার সামনে দাঁড়িয়ে কলিংবেল বাজাল। প্রায় সাথে সাথে দরজা খুলে দিল বৃদ্ধ। মুখে হাসি নিয়ে অভ্যর্থনা করল রানাকে। বৃদ্ধের পাশ ঘেঁষে ভিতরে ঢুকল রানা। দরজাটা বন্ধ করে চেন লাগিয়ে দিল পীস

একই সাথে দু’জন ঘুরে দাঁড়াল দু’জনের দিকে

বেলজিয়ান লোকটাকে উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। প্রশ্ন করল রানা, ‘কোন সমস্যা দেখা দিয়েছে?’

‘হ্যাঁ…মানে, রাইফেলটাকে নিয়ে নয়, ওটা তৈরি করে ফেলেছি—কিন্তু দু’নম্বর জিনিসটাকে নিয়েই সমস্যা দেখা দিয়েছে। বলছি, তার আগে রাইফেলটা দেখুন, মশিয়ে।’

ডেস্কের উপর পড়ে আছে সমতল একটা চৌকোনা কেন। দু’ফিট লম্বা, আঠারো ইঞ্চির মত চওড়া, চার ইঞ্চি উঁচু। কেসটা খুলল পাস। সেটার দিকে একটু ঝুঁকে পড়ল রানা।

কেসের ভিতরটা সমতল একটা ট্রে-র মত, অত্যন্ত সতর্কতার সাথে মাপ নিয়ে কয়েকটা ছোট বড় ঘর তৈরি করে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রতিটি ঘরে রাইফেলের বিচ্ছিন্ন অংশগুলো খাপে খাপে বসে আছে।

‘অরিজিন্যাল কেস নয় এটা, বুঝতেই পারছেন, মশিয়ে.’ বলল বৃদ্ধ। ‘সেটা আরও অনেক লম্বা। আমি নিজে কেসটা তৈরি করেছি। নিখুঁতভাবে সব ফিট হয়ে গেছে।

কেসের কোথাও চুল পরিমাণ জায়গা পড়ে নেই, সবটুকু কাজে লাগানো হয়েছে। খোলা ট্রেটার উপর দিকের ঘরে রয়েছে ব্যারেল এবং ব্রীচ—আঠারো ইঞ্চির মধ্যেই চমৎকার জায়গা করে নিয়েছে। খোপ থেকে তুলে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছে রানা। খুবই হালকা জিনিস, দেখতে অনেকটা সাব-মেশিনগানের ব্যারেলের মত। বীচে একটা সরু বোল্ট রয়েছে, বন্ধ করা। শেষ মাথাটা পিছন দিকে গিয়ে একটা গাঁটওয়ালা হাতলের আকৃতি নিয়েছে, জিনিসটা ব্রীচের চেয়ে বড় নয়। বোল্টের বাকি অংশ ব্রীচের মধ্যেই ফিট করা হয়েছে।

বোল্টের শেষ মাথার গাঁটটা ডান হাতের তর্জনী আর বুড়ো আঙুল দিয়ে ধরল রানা, ঘড়ির কাঁটা যেদিকে ঘোরে তার উল্টো দিকে দ্রুত ঘোরাল। তালামুক্ত হয়ে একটা ডিগবাজি খেল বোল্টটা, খাঁজ কেটে তৈরি করা খোপে ঢুকে পড়ল। বোল্টটা সরে যাওয়ায় ঝকমকে ট্রে-র তলাটা দেখা যাচ্ছে এখন, ওখানে নিরীহ ভাল মানুষের মত শুয়ে থাকবে বুলেট। ব্যারেলের শেষ মাথায় অন্ধকার গর্তটাও দেখতে পাচ্ছে রানা। ঘড়ির কাঁটা যেদিকে ঘোরে, সেদিকে ঘোরাতেই নিজের জায়গায় ফিরে এল বোল্টটা।

বোল্টের শেষ মাথার ঠিক নিচেই ইস্পাতের একটা অতিরিক্ত গোল চাকতি নিপুণভাবে ওয়েল্ডিংয়ের সাহায্যে মেকানিজমের সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে। ডিস্ক বা চাকতিটা আধ ইঞ্চি মোটা, কিন্তু বিস্তার পুরো এক ইঞ্চিও নয়। উপরের অংশে অর্ধচন্দ্রের আকারে খাঁজ কাটা রয়েছে, যাতে বোল্টটা পিছু হঠার জন্যে মুক্ত জায়গা পেতে পারে। চাকতির শেষ মাথার মাঝখানে আধ ইঞ্চি গভীর একটা গর্ত দেখা যাচ্ছে, সেটার ভিতরে স্ক্রু ঢোকাবার জন্যে খাঁজ কাটা হয়েছে।

‘ওটা রাইফেলের কুঁদোর জন্যে,’ মৃদু গলায় বলল পীস।

লক্ষ করল রানা, অরিজিন্যাল রাইফেলের কাঠের কুঁদো যেখান থেকে তুলে সরিয়ে ফেলা হয়েছে সেখানে কোন দাগ-টাগ কিছুই অবশিষ্ট নেই। রাইফেলের গায়ে কুঁদোটা আটকাবার জন্যে স্ক্রু ঢোকাবার যে দুটো গর্ত ছিল সেগুলোও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। রাইফেলটাকে উল্টে নিচের দিকটা দেখছে রানা। বীচের নিচে সরু এক ফালি ছিদ্র, সেটার ভিতর দেখা যাচ্ছে বোল্টের নিচের অংশটা। বোল্টের এই অংশেই রয়েছে ফায়ারিঙ পিন, যেটা বুলেটে আঘাত করবে। ফাঁকটা দিয়ে ট্রিগারের গোড়া বেরিয়ে আছে।

পুরানো ট্রিগারের গোড়ায় ক্ষুদ্র একটা ইস্পাতের নব ঝালাই করে জুড়ে দেয়া হয়েছে, এতেও প্যাঁচ খাওয়ানো গর্ত দেখা যাচ্ছে একটা। নিঃশব্দে ছোট স্টীলের একটা টুকরো রানার হাতে তুলে দিল বৃদ্ধ। জিনিসটা এক ইঞ্চি লম্বা, বাঁকানো, এবং এক দিকের প্রান্তে প্যাঁচ কাটা। গর্তে প্যাঁচ কাটা প্রান্তটা ঢুকিয়ে দিল রানা। তর্জনী আর বুড়ো আঙুল দিয়ে দ্রুত ঘুরিয়ে প্যাঁচ কষতে শুরু করল যতক্ষণ না টাইট হয়। এটাই নতুন ট্রিগার, বেরিয়ে আছে ব্রীচের নিচে

ট্রে থেকে সরু একটা স্টীল রঙ তুলে রানার হাতে দিল বৃদ্ধ। রডের একটা প্রান্ত প্যাঁচ খাওয়ানো। স্টক অ্যাসেম্বলীর প্রথম অংশ.’ বলল সে।

গ্রীচের শেষ প্রান্তের গর্ত-মুখে রডের প্যাচ খাওয়ানো প্রান্তটা বসিয়ে ঘোরাতে শুরু করল রানা। একটু একটু করে খানিকটা ঢুকে গেল রড। এখন দেখে মনে হচ্ছে পিছন থেকে রাইফেলের একটা অবিচ্ছিন্ন অংশ হিসেবে বেরিয়ে এসেছে রডটা। নিচের দিকে ত্রিশ ডিগ্রী ঝুঁকে আছে সেটা। ব্রীচের গর্তে ঢুকে যাওয়া অংশ থেকে দু’ইঞ্চি বাদ দিয়ে রাইফেলের মেকানিজমের কাছাকাছি পর্যন্ত স্টীল রডটা সামান্য একটু চ্যাপ্টা, সমতল জায়গাটার মাঝখানে ড্রিল করে একটা গর্ত তৈরি করা হয়েছে। গর্তটা এখন সরাসরি পিছন দিকে মুখ করে আছে। বৃদ্ধ যাদুকর এবার দ্বিতীয় রডটা তুলে দিল রানার হাতে। অপেক্ষাকৃত ছোট এটা।

‘ওপরের অবলম্বন,’ বলল সে।

এটাও জায়গা মত নিখুঁত ফিট হলো। দুটো রডই পিছন দিকে বেরিয়ে আছে, ছোট একটা ভিতহীন ত্রিকোণের দুটো দিকের মত পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরে আছে। বৃদ্ধ ভিতটা তুলে দিল রানার হাতে। জিনিসটা বাঁকানো, পাঁচ কি ছয় ইঞ্চি লম্বা, কালো চামড়া দিয়ে পুরু করে মোড়া। শোল্ডার গার্ড বা রাইফেলের বাঁটের প্রতিটি প্রান্তে একটা করে ছোট গর্ত।

‘প্যাঁচ কষার কোন ব্যবস্থা রাখা হয়নি, তার দরকারও নেই,’ বলল বৃদ্ধ। ‘মশিয়ে, শুধু রড দুটোর দুই প্রান্ত দুই গর্তে ঢুকিয়ে একটু চাপ দিন।‘

তাই করল রানা। এখন রাইফেলটাকে রাইফেলের মতই দেখাচ্ছে। বাঁট- প্লেটটা কাঁধে তুলে নিল ও, বাঁ হাতে শক্ত করে ধরল ব্যারেলের নিচের দিকটা, ডান হাতের তর্জনী দিয়ে পেঁচাল ট্রিগারটাকে, বন্ধ করল বাঁ চোখ এবং ডান চোখ কুঁচকে ব্যারেল বরাবর সামনে তাকাল। দূরের দেয়ালে লক্ষ্যস্থির করে ট্রিগার টানল ও। মৃদু ক্লিক ভেসে এল ব্রীচের ভিতর থেকে।

বেলজিয়ানের দিকে ফিরল রানা। দশ ইঞ্চি লম্বা দুটো কালো টিউবের মত বস্তু দুই হাতে ধরে আছে বৃদ্ধ।

‘সাইলেন্সারটা দিন,’ বলল রানা। পীসের হাত থেকে সেটা তুলে নিল ও। তারপর রাইফেল ব্যারেলের শেষ প্রান্তটা পরখ করল। নিপুণভাবে প্যাচ কাটা হয়েছে মুখের ভেতর। সাইলেন্সারের অপেক্ষাকৃত চওড়া দিকটা ভেতরে ঢুকিয়ে দিল রানা যতক্ষণ না পুরোপুরি টাইট হয়। তারপর প্যাঁচ কষল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। ব্যারেলের প্রান্ত থেকে বেরিয়ে আছে এখন সাইলেন্সারটা। বৃদ্ধের সামনে হাত পাতল রানা। যাদুকর ওর হাতে এবার তুলে দিল টেলিস্কোপিক সাইটটা।

ব্যারেলের উপর দিকের গায়ে এক ইঞ্চি পর পর একজোড়া করে গর্ত রয়েছে, টেলিস্কোপের নিচের দিকের ক্লিপগুলো নিখুঁত ভাবে সেগুলোর ভিতর ঢুকে আটকে গেল। টেলিস্কোপ এবং ব্যারেল এখন নিখুঁত সমান্তরাল রেখায় অবস্থান করছে। আবার রাইফেলটা উপরে তুলে চোখ কুঁচকে লক্ষ্যস্থির করল রানা। দশ মিনিট আগের কয়েকটা বিচ্ছিন্ন অদ্ভুতদর্শন যান্ত্রিক অংশকে এখন আর বিদঘুটে লাগছে না। জোড়া লাগাবার পর এটা একটা হাই ভেলোসিটি, লং রেঞ্জ, ফুললি -সাইলেন্সড আততায়ীর রাইফেলে পরিণত হয়েছে। টেবিলে সেটাকে নামিয়ে রাখল রানা। মুখ তুলে তাকাল পীসের দিকে।

‘গুড,’ বলল রানা। ভেরি গুড। আই কংগ্রাচুলেট ইউ। কাজের চমৎকার একটা নমুনা দেখিয়েছেন আপনি। ধন্যবাদ।’

তৃপ্তির হাসি হাসল বৃদ্ধ।

‘এখনও দুটো কাজ বাকি রয়েছে,’ বলল রানা। ‘সাইট জিরোয়িং আর প্র্যাকটিস শট ফায়ার করা। কিছু শেল দিতে পারেন আমাকে?’

ডেস্কের দেরাজ খুলে একশো বুলেটের একটা বাক্স বের করল পীস। প্যাকেটের সীলটা ভাঙা, তা থেকে ছয়টা বুলেট সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

‘এগুলো প্র্যাকটিসের জন্যে রেখেছি,’ বলল বৃদ্ধ। মাত্র ছয়টা নিয়েছি এ-থেকে মাথায় এক্সপ্লোসিভ ভরার জন্যে।

হাতে একমুঠো শেল ঢেলে পরখ করছে রানা। প্রথম দর্শনে বুলেটগুলোকে সাংঘাতিক ক্ষুদ্র বলে মনে হয়, ভাবাই যায় না এত ছোট একটা বুলেটের পক্ষে কিভাবে ধ্বংসাত্মক কাজটা করা সম্ভব। কিন্তু এক সেকেন্ড পরই লক্ষ করল রানা, এ ক্যালিবারের এটা একটা এক্সট্রা-লং টাইপের শেল। অতিরিক্ত এক্সপ্লোসিভ চার্জের ফলে বুলেটের ভেলোসিটি সাংঘাতিকভাবে বেড়ে যাবে, সেই সাথে বেড়ে যাবে লক্ষ্যভেদ করার এবং হত্যা করার ক্ষমতা। অধিকাংশ হান্টিং বুলেটের নাক চ্যাপ্টা হয়, কিন্তু এটার আগা ছুঁচাল। শুধু তাই নয়, হান্টিং বুলেটের মত এটার মাথা সীসা দিয়ে তৈরি নয়, কাপ্রো নিকেল দিয়ে তৈরি।

‘আসল শেলগুলো?’ জানতে চাইল রানা।

ডেস্কের দেরাজ খুলে টিসু পেপারের জড়ানো বাকি ছয়টা শেল বের করল পীস। ‘অত্যন্ত নিরাপদ জায়গায় রাখি এগুলো,’ বলল সে, ‘কিন্তু আপনি আসবেন বলে একটু আগে বের করে রেখেছি।’ টিসু পেপারে মোড়া বুলেটগুলো বের করে সাদা রটারে রাখল সে।

মুঠো ভর্তি শেলগুলো কার্ডবোর্ড বাক্সে রেখে ব্লটার থেকে একটা বুলেট তুলে নিল রানা। প্রথম নজরে দেখে মনে হয় বাক্স আর ব্লটারের বুলেটগুলোর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কিন্তু এক সেকেন্ড পরই পার্থক্যটা ধরা যায়। বুলেটের একেবারে শেষ মাথার Cupron।ckel অত্যন্ত সূক্ষ্ম ভাবে ঘষে তুলে ফেলা হয়েছে, ফলে ভিতরের লিড দেখা যাচ্ছে। ছুঁচাল আগা তার তীক্ষ্ণতা সামান্য হারিয়েছে, সেই জায়গাতেই ড্রিল করে অতি ক্ষুদ্র একটা ফুটো করা হয়েছে, ফুটোটার দৈর্ঘ্য নোজ ক্যাপ পর্যন্ত অর্থাৎ এক ইঞ্চির চার ভাগের এক ভাগ। এই ফুটোয় ঢোকানো হয়েছে যতটা মার্কারী আঁটতে পারে। তারপর ফুটোটার মুখে এক ফোঁটা তরল সীসা ঢেলে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সেটা। সীসা শক্ত হবার পর ফাইল দিয়ে ঘষে ফুলে থাকা। অতিরিক্ত অংশগুলো ঝরিয়ে দিয়ে বুলেটের আগার আগের সেই ছুঁচাল চেহারা ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে।

এ ধরনের বুলেট আগেও দেখেছে রানা, কিন্তু কখনও ব্যবহার করেনি, বা ব্যবহার করার দরকার হবে বলে ভাবেনি। অনেকদিন আগেই জেনেভা কনভেনশন এই বুলেট ব্যবহার করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। মানুষের শরীরে ধাক্কা খাওয়া মাত্র ছোট একটা গ্রেনেডের মত বিস্ফোরণ ঘটায় এই এক্সপ্লোসিভ বুলেট ফায়ার করার পর তীব্র সম্মুখগতির জন্যে ভিতরের মার্কারী পিছন দিকে সেঁটে আসে, হঠাৎ স্পীড বাড়িয়ে দিলে গাড়ির আরোহী ঠিক যেভাবে সীটের সাথে সেঁটে যায়। তারপর যেই বুলেটটা মাংস, শিরা অথবা হাড়ের সাথে ধাক্কা খায় অমনি তীব্র বেগে বুলেটের সামনের দিকে ছুটে আসে মার্কারী। সীসার আবরণ শতধা বিভক্ত হয়ে চারদিকে ছুটতে শুরু করে সীসার খুদে ক্ষেপণাস্ত্র বহর নার্ভ, টিস্যু, ছিঁড়ে- ফুঁড়ে একাকার করে দেয়, পিরিচ আকারের একটা এলাকায় কিছুই অক্ষত রাখে না। মাথায় আঘাত করলে এই বুলেট উল্টোদিক দিয়ে বেরিয়ে যাবে না, কিন্তু Cran।um-এর ভিতর যা কিছু আছে সব ধ্বংস করে দেবে, চিনির দানার মত গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাবে খুলিটা।

সাবধানে বুলেটটা রেখে দিল রানা টিসু পেপারে। অনুভব করল, সাগ্রহে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে বৃদ্ধ পীস।

‘দেখে তো মনে হচ্ছে ঠিকই আছে,’ বলল রানা। ‘আপনি একজন দক্ষ কারিগর, মি. পীস। এবার সমস্যার কথা বলুন।’

উদ্বিগ্ন দেখাল পীসকে। ‘সমস্যা দেখা দিয়েছে টিউবগুলোকে নিয়ে, মশিয়ে, ‘ বলল বৃদ্ধ। ‘তার আগে একটা কথা বলে নিই। টিউবের ব্যাপারটা তেমন কঠিন হবে না মনে করে সবশেষে, মাত্র ক’দিন আগে কাজটায় হাত দিই আমি। আপনার কথামত প্রথমে অ্যালুমিনিয়ামই ব্যবহার করেছিলাম। টিউবগুলোকে যথাসম্ভব সরু করতে বলেছেন আপনি, তাই খুবই পাতলা অ্যালুমিনিয়ামের পাত কিনে আনি। মেশিনে কাটতে গিয়ে দেখলাম, জিনিসটা এতই পাতলা যে রসুনের খোসাকেও হার মানায়। সামান্য একটু চাপ পড়লেই তুবড়ে যায়। চিন্তায় পড়ে গেলাম। শেষ পর্যন্ত অনেক ভেবেচিন্তে স্টেনলেস স্টীলের সাহায্য নিলাম।

রানার প্রতিক্রিয়া লক্ষ করছে বৃদ্ধ। কিন্তু রানার চেহারায় কোন ভাবান্তর নেই।

‘দেখতে জিনিসটা হুবহু অ্যালুমিনিয়ামের মতই,’ তাড়াতাড়ি বলল পীস, ‘কিন্তু সামান্য একটু বেশি ভারী। খুবই পাতলা, অথচ গায়ে প্যাচানো খাঁজ কাটাও সম্ভব, বেঁকে যায় না। তবে জিনিসটা শক্ত বলে কাজ শেষ করতে সময় বেশি লাগছে। একটু ইতস্তত করে আবার বলল, ‘গতকাল মাত্র শুরু করেছি…’

‘ঠিক আছে,’ একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল রানা। ‘আপনার কথায় যুক্তি আছে। আসল কথা, জিনিসটা নিখুঁত চাই আমি। কবে?’

কাঁধ ঝাঁকাল পীস। ‘বলা কঠিন, মশিয়ে। পাঁচ দিনও লাগতে পারে, সাত দিনও লাগতে পারে…’

কোন রকম অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করল না রানা। বৃদ্ধের ব্যাখ্যা শেষ না হওয়া পর্যন্ত চুপ করে থাকল। তারপর খানিক চিন্তা করে বলল, ‘ঠিক আছে। আমার ট্রাভেলিং প্ল্যান একটু অদলবদল করতে হবে। যাই হোক, রাইফেল, একটা মার্কারী শেল এবং কিছু সাধারণ শেল প্র্যাকটিসের জন্যে দরকার হবে আমার কবে দিতে পারবেন, বলুন। আচ্ছা, কোন পরামর্শ দিতে পারেন, সম্পূর্ণ গোপনীয়তা রক্ষা করে নতুন একটা রাইফেল কোথাও টেস্ট করা যেতে পারে? জায়গাটা খোলামেলা হতে হবে, অন্তত একশো ত্রিশ থেকে একশো পঞ্চাশ মিটার ফাঁকা জায়গা দরকার হবে আমার।

একটু চিন্তা করে পীস বলল, ‘আরদেনেসের জঙ্গলে যেতে পারেন আপনি, মশিয়ে। বিশাল জঙ্গল, ফাঁকা জায়গাও খুঁজে পাবেন। কয়েক ঘণ্টা একা থাকার মত একমাত্র জায়গা। একদিনের মধ্যে গিয়ে ফিরে আসতে পারবেন। আজ বৃহস্পতিবার। সাপ্তাহিক ছুটি আগামীকাল থেকে শুরু হচ্ছে, জঙ্গলে বনভোজন- বিলাসীদের ভিড় থাকতে পারে। সোমবার পাঁচ তারিখ, অনায়াসে প্র্যাকটিসের জন্যে যেতে পারেন আপনি। মঙ্গল, বড়জোর বুধবারের মধ্যে বাকি সমস্ত কাজ শেষ করে ফেলতে পারব বলে আশা করি আমি।’

সন্তুষ্ট হয়ে মাথা কাত করল রানা। বলল, ‘ঠিক আছে। রাইফেল এবং অ্যামুনিশন এখনই নিয়ে যাচ্ছি। আগামী হপ্তার মঙ্গল অথবা বুধবারে যোগাযোগ করব আপনার সাথে।’

উদ্বেগের একটা ছায়া চেহারা থেকে খসে পড়ল বৃদ্ধ পীসের। মৃদু হেসে ঘাড় নাড়ল সে। বলল, ‘ঠিক আছে।’ তারপর ধীরেসুস্থে, অত্যন্ত সাবধানে একটা একটা পার্টস খুলে বিচ্ছিন্ন করল রাইফেলটাকে, অতি যত্নের সাথে ক্যারিয়িং কেসের খোপগুলোয় প্রতিটি অংশ শুইয়ে দিল। একটা খোপে ব্রাশ আর তুলো রয়েছে, টিসু পেপারে জড়ানো মার্কারী শেলটা সেই খোপের একধারে রাখল সে। কেসটা বন্ধ করে রানার হাতে দিল। তারপর শেলের কার্ডবোর্ড বাক্সটা বাড়িয়ে ধরল ওর দিকে।

বাক্সটা নিয়ে পকেটে ভরল রানা। ‘গুড বাই,’ বলে ঘুরে দাঁড়াল।

দ্রুত রানাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল পীস। হলঘরের দরজা খুলে দিয়ে এক পাশে সরে দাঁড়াল সে। দৃঢ় পদক্ষেপে দরজা পেরিয়ে ঝাঁ ঝাঁ রোদে বেরিয়ে এল রানা।

ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে ফিরে এল ও। রাইফেল ভরা কেসটা ওয়ারড্রোবের ভেতরে রেখে তালা লাগিয়ে দিল, পকেটে ভরল চাবি, তারপর রূম সার্ভিসকে ডেকে লাঞ্চের অর্ডার দিয়ে ঢুকল বাথরূমে।

সেদিন সন্ধ্যায় ছ’টার কিছু পরে রু নিউভি রেস্তোরাঁয় এল রানা। দেখল পিসিক অপেক্ষা করছে ওর জন্যে। কেবিনে না ঢুকে এক কোণের একটা টেবিলে বসেছে লোকটা, ব্যাপারটা লক্ষ করেই বুঝে নিল রানা, কোথাও কোন ঘাপলা আছে।

এগিয়ে গিয়ে মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসল ও। জানতে চাইল, ‘কাজ শেষ?’

হাড্ডিসার মুখে ধূর্ত হাসি খেলে গেল পিসিকের। বলল, ‘হ্যাঁ, কাজ শেষ। নিজের গর্ব করা হয়, তবু বলছি, এক্কেবারে নিখুঁত হয়েছে প্রতিটি কাজ।’

একটা হাত বাড়িয়ে দিল রানা। ‘দাও,’ মৃদু, কিন্তু নির্দেশের সুরে বলল সে।

রানার চোখে চোখ রেখে একটা সিগারেট ধরাল পিসিক। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে গলা খাদে নামিয়ে, প্রায় ফিসফিস করে বলল, ‘আপনি পাগল নাকি, মশিয়ে? ওসব গোপন জিনিস এখানে নিয়ে আসব, তেমন বোকা আমি নই। খদ্দেরদের নিরাপত্তার কথাটা সবচেয়ে আগে চিন্তা করতে হয় আমাকে। এই রকম প্রকাশ্য জায়গায় কাগজপত্র পরীক্ষা করা অসম্ভব। তাছাড়া, এখানে প্রচুর আলোরও অভাব রয়েছে।

‘কোথায়?’ সংক্ষেপে, ঠাণ্ডা গলায় জানতে চাইল রানা।

‘দুনিয়ার সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা, আমার স্টুডিওতে।

এক সেকেন্ডের জন্যে চোখের চার পাশ কুঁচকে উঠল রানার। ঠাণ্ডা চোখে আরও কয়েক সেকেন্ড দেখল পিসিককে। তারপর ধীরে ধীরে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ও। তর্জনী নেড়ে দাঁড়াতে নির্দেশ দিল পিসিককে, বলল, ‘চলো।’

ট্যাক্সি নিয়ে পিসিকের বেসমেন্ট স্টুডিওতে পৌঁছল ওরা। পথে আবোল- তাবোল কিছু রসিকতা করার চেষ্টা করল পিসিক, কান দিল না রানা। কিন্তু থামছে না দেখে ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে একবার তাকাল ও। ওর চোখের দৃষ্টিতে আশ্চর্য একটা শীতলতা দেখে সাথে সাথে ঠোঁটে কুলুপ আঁটল পিসিক। কিন্তু খানিক পর আড়চোখে লক্ষ করেছে রানা, ঠোঁট দুটো নড়ছে লোকটার, বিড়বিড় করছে, যেন নিজেকেই কি যেন তর্ক করে বোঝাতে চেষ্টা করছে সে।

সোয়া ছয়টা বাজে, কিন্তু রোদের ঝাঁঝঁ এখনও কম নয়। গাঢ় রঙের মস্ত একটা সানগ্লাস ছাড়া বাইরে বেরোয় না রানা, আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ওর মুখের উপরের অর্ধেক ঢাকা পড়ে গেছে সানগ্লাসে। রাস্তাটা সরু, এবং এখানে সেখানে কিছু লম্বা ফালি ছাড়া তেমন রোদ নেই কোথাও। ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিচ্ছে রানা, এই সময় মাত্র একজন বুড়ো লোক পাশ ঘেঁষে ধীরে ধীরে চলে গেল। লোকটাকে কাবু করে প্রায় মাটির সাথে নুইয়ে ফেলেছে বাতরোগে। রাস্তার দু’পাশে আর কোন লোক চোখে পড়ল না রানার

সিঁড়ির ধাপ ক’টা বেয়ে আগে আগে নেমে গেল পিসিক, ঠিক তার পিছনেই রয়েছে রানা। চাবি বের করে তালা খুলল পিসিক। দরজার ভিতর অন্ধকার, প্রথমে কিছুই দেখা গেল না। পিসিক আগে আগে ঢুকল। পিছনে রানা! আলো জ্বালার জন্যে একপাশে সরে গিয়ে দেয়াল হাতড়াতে যাবে পিসিক, তার কাঁধে একটা হাত রাখল রানা।

‘কি!’ চমকে উঠে জানতে চাইল লোকটা

‘আলো জ্বালার দরকার নেই,’ বলল রানা। হাতটা নামিয়ে নিল পিসিকের কাঁধ থেকে। আউটার অফিসে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। দরজার পাশে একটা জানালা, পর্দার ফাঁক দিয়ে স্নান দিনের আলো ঢুকছে। কামরার চেয়ার-টেবিল আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে এখন। কাঁধ ঝাঁকান পিসিক। দুটো দরজার পর্দা সরিয়ে পিছনে রানাকে নিয়ে স্টুডিওতে ঢুকল সে, ঢুকেই জ্বেলে দিল সেন্টার লাইটটা।

পকেট থেকে একটা এনভেলাপ বের করল পিসিক, খুলল সেটা, ভিতরের কাগজগুলো দেয়াল ঘেঁষে দাঁড় করানো ছোট্ট, গোলাকার মেহগনি কাঠের টেবিলটায় বের করে রাখল। তারপর দু’হাত দিয়ে ধরে কামরার মাঝখানে নিয়ে এল টেবিলটাকে, সেন্টার লাইটের নিচে নামিয়ে রাখল। স্টুডিওর শেষ প্রান্তে খুদে স্টেজের উপর জোড়া আর্ক ল্যাম্প অফ করাই থাকল।

‘প্লীজ, মশিয়ে, হাড় উঁচু হয়ে থাকা মুখের চামড়া ভাঁজ খেয়ে গেল পিসিকের, হাসছে সে, চিবুক নেড়ে টেবিলে পড়ে থাকা কার্ড তিনটির দিকে রানার দৃষ্টি আকর্ষণ করল।

নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে পিসিকের দিকে রানা। ধীরে ধীরে ঘাড় ফিরিয়ে টেবিলের দিকে তাকাল ও। হাত বাড়িয়ে তুলে নিল কার্ড। আলোর নিচে ধরে পরীক্ষা করছে সেটা।

এটা ওর ড্রাইভিং লাইসেন্স, প্রথম পৃষ্ঠায় আলাদা একটা কাগজ সাঁটা হয়েছে, তাতে লেখা: ‘মি. আলেকজান্ডার জেমস কোয়েনটিন অরগ্যান অভ লন্ডন ডব্লিউ- ওয়ান ইজ হিয়ারবাই লাইসেন্সড টু ড্রাইভ মোটর ভেহিকেলস অভ গ্রুপস ওয়ান- এ, ওয়ান-বি, টু, থ্রী, ইলেভেন, টুয়েলভ অ্যান্ড থারটিন অনলি ফ্রম টেন ডিসেম্বর নাইনটিন সেভেনটি…আনটিল নাইন ডিসেম্বর নাইনটিন সেভেনটি… ইনক্লুসিভ’। এই কথাগুলোর উপর রয়েছে লাইসেন্স নাম্বার (কল্পিত, অবশ্যই) তারপর লেখা রয়েছে, ‘লন্ডন কাউন্টি কাউন্সিল’, এর নিচে, ‘রোড ট্রাফিক অ্যাক্ট নাইনটিন সেভেনটি…’, তারপর বড় বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে, ‘ড্রাইভিং লাইসেন্স’, এবং সবশেষে, ‘ফি অভ ফিফটিন— রিসিভড’। যতদূর বুঝতে পারছে রানা, নিখুঁতভাবে জাল করা হয়েছে লাইসেন্সটা, ও উদ্দেশ্য পূরণ হবার জন্যে যথেষ্ট।

দু’নম্বর কার্ডটা, সাদামাঠা একজন ফ্রেঞ্চ কর্মজীবী লোকের পরিচয় পত্র। কার্ডটা মার্ক রোডিনের নামে, বয়স তিপ্পান্ন, জন্ম কোলমারে, প্যারিসের বাসিন্দা। আজ থেকে অনেক বছর পর যে চেহারা হবার কথা ওর সেই চেহারার একটা ফটো সাঁটা রয়েছে কার্ডে। মাঝারি করে ছাঁটা চুলের রঙ লোহায় ধরা মরচের মত! কার্ডটা ময়লা হয়ে গেছে। একজন খেটে খাওয়া লোকের কার্ড, দেখলেই বোঝা যায়।

তৃতীয় কার্ডটা খুব আগ্রহের সাথে হাতে তুলে নিল রানা। আইডেনটিটি কার্ডের ফটোটার সাথে এটায় সাঁটা ফটোটার সামান্য একটু অমিল লক্ষ করা যাচ্ছে, তার কারণ দুটো কার্ড ইস্যু করার তারিখের মধ্যে কয়েক মাসের ব্যবধান রয়েছে। প্রায় হপ্তা দুই আগে রানার যে ফটো তোলা হয়েছে তারই একটা সাঁটা রয়েছে এতেও, কিন্তু শার্টের রঙ এতে আরও গাঢ় দেখাচ্ছে, এবং চিবুকের কাছে খোঁচা খোঁচা কিছু দাড়ি দেখা যাচ্ছে। নিপুণ রি-টাচিংয়ের সাহায্যে এই পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে, ফলে একই লোকের একই সময়ে তোলা ফটো দুটোকে বিভিন্ন সময়ে তোলা ফটো বলে মনে হচ্ছে। সন্তুষ্টচিত্তে কার্ডগুলো পকেটস্থ করল রানা। তাকাল মুখ তুলে।

‘ভেরি নাইস,’ বলল ও, ‘ঠিক যেমনটি চেয়েছিলাম। আই কংগ্রাচুলেট ইউ, পিসিক। বাকি টাকাটা দিতে হয় তাহলে এবার।’ কথা শেষ করে পকেটে হাত ভরল রানা।

চোখে মুখে প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষা করছে পিসিক। একবার ঢোক গিলল। দৃষ্টি এড়াল না রানার, লোভে চকচক করছে চোখমুখ। এটা তার প্রাপ্য টাকা, তা পাবার জন্যে প্রত্যাশায় উত্তেজিত হবার কোন কারণ নেই। কোথাও ঘাপলা আছে এই ধারণা আরও দৃঢ় হলো রানার মনে। পকেট থেকে এক বান্ডিল নোট বের করল ও। বাড়িয়ে দিল পিসিকের দিকে।

টাকার বান্ডিলটা ধরল পিসিক, কিন্তু অপর প্রান্তটা এখনও ধরে আছে রানা, ছাড়েনি। ব্যাপারটা লক্ষ করে হাড্ডিসার কপালের চামড়া কুঁচকে উঠল পিসিকের মুখ তুলে তাকাল সে। ‘মশিয়ে?’

ড্রাইভিং লাইসেন্সের জেনুইন ফ্রন্ট পেজটা,’ বলল রানা, ‘কথা ছিল ওটা তুমি আমাকে ফেরত দেবে।

চৌকশ অভিনেতা লোকটা, মনে মনে স্বীকার করল রানা। ওর কথা শেষ হতেই বিস্ময়ে কপালে তুলল সে তার ভুরু জোড়া, যেন এইমাত্র মনে পড়ে গেছে কথাটা। টাকার বান্ডিলের প্রান্তটা ছেড়ে দিল সে, ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল। কয়েক পা সামনে এগোল, মাথাটা নিচু হয়ে আছে, যেন গভীরভাবে চিন্তামগ্ন, হাত দুটো পিছন দিকে, পরস্পরের সাথে আবদ্ধ। তারপর ধীরে ধীরে ঘুরল সে আবার। দ্রুত ফিরে এল রানার সামনে।

ব্যস্তভাবে বলল, ‘দুশ্চিন্তা করবেন না। আসলে, ড্রাইভিং লাইসেন্সের ফ্রন্ট পেজটা এখানে নেই। ঘাবড়াবেন না, আছে সেটা নিরাপদ জায়গাতেই ব্যাঙ্কের একটা লকারে, আমি ছাড়া কেউ হাত দিতে পারবে না সেখানে। আমার ব্যবসার ধরনটা কি তা তো মশিয়ে বুঝতেই পারেন, টু-পাইস অতিরিক্ত কামাবার সুযোগ হাতছাড়া করা যায় না। মশিয়ে কি রাগ করছেন…?’

‘কি চাও তুমি?’ শান্তভাবে জানতে চাইল রানা।

চোখ বুজল পিসিক। ‘পাঁচশো পাউন্ড পেলে মনে আর কোন খেদ থাকবে না আমার, খোদার কসম, বিলিভ মি।’

একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল রানা। মানুষ যেচে পড়ে কেন যে নিজের বিপদ ডেকে আনে…ভাবতে গিয়ে শ্রাগ করল ও।

চোখ মেলল পিসিক। বিনিময়ে ফ্রন্ট পেজটা আপনাকে দান করব। আপনি ইন্টারেস্টেড, মশিয়ে?’ লোভে চকচক করছে তার কোটরাগত চোখ দুটো।

‘ব্ল্যাকমেইলিং?’ ঠোঁটে মৃদু হাসি টেনে বলল রানা।

চটাস করে নিজের কপালের হাড়ে চাঁটি মারল পিসিক। চোখে মুখে অসহায় ভাব ফুটে উঠল তার। এদিক ওদিক মাথা দোলাচ্ছে। বলল, ‘হায় কপাল! শেষ পর্যন্ত, মশিয়ে, আপনিও আমাকে ভুল বুঝলেন! ব্ল্যাকমেইলার? আমি? খোদার কসম, ব্যাপারটা তা নয়, তার ধারে কাছেও নয়। ব্ল্যাকমেইলাররা দাবি জানায় বারবার, একবারে সন্তুষ্ট হয় না। কিন্তু আমি এই একবারই পাঁচশো পাউন্ড নেব, তারপর আর চাইব না। এবার আপনিই বলুন, ব্ল্যাকমেইলারের সাথে আমার মিলটা কোথায় দেখতে পাচ্ছেন? সবিনয়ে জানাচ্ছি, ড্রাইভিং লাইসেন্সের ফ্রন্ট পেজটাই শুধু নয়, আপনার ফটোর সমস্ত নেগেটিভ আর পজিটিভ কপি, এবং তার সাথে মেকআপ ছাড়া আপনার আসল চেহারার একটা ফটো—এটা আমি আপনার অগোচরে দ্রুত তুলেছিলাম সেদিন—ব্যাঙ্কের লকারে রেখে দিয়েছি। ফ্রন্ট পেজটার জন্যে পাঁচশো পাউন্ড, দাবিটা বেশি বলবেন?’ অসহায়ভাবে এদিক ওদিক মাথা নাড়ছে পিসিক। ‘এর কমে পারি না, বিলিভ মি। বাকিগুলোর জন্যে খুব কম করে চাইব, কিন্তু…’

‘কত?’

‘মোট?’ পিসিক একগাল হাসল। বেশি না, একহাজার পাউন্ড। খেদ তো থাকবেই না, খুশি হয়ে যাবে মনটা…’

‘ওগুলো আমার দরকার, বিনিময়ে এক হাজার পাউন্ড কিছুই নয়…. অন্যমনস্কভাবে বলল রানা।

বিজয়ীর হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল বেলজিয়ানের মুখ। ‘শুনে আনন্দ পাচ্ছি, মশিয়ে।

‘কিন্তু,’ মৃদু হাসল রানা। তোমার প্রস্তাবে আমি রাজি নই।’

বিস্ময়ে কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে পিসিকের চোখ দুটো। তারপর চোখের চার পাশ কুঁচকে উঠল তার। ‘কিন্তু কেন! বলছেন ওগুলোর তুলনায় এক হাজার পাউন্ড কিছুই না, অথচ রাজি নন—আপনার কথা ঠিক..

‘দুটো কারণে রাজি নই,’ করণীয় স্থির করে ফেলেছে রানা, কিন্তু তা করার আগে কিছু কথা কৌশলে জেনে নিতে হবে লোকটার কাছ থেকে। ‘এক, ফটোগুলোর অরিজন্যাল নেগেটিভ কপি করা হয়েছে কিনা জানা নেই আমার। যদি করে থাকো, আবার টাকা দাবি করবে তুমি। দুই, জিনিসগুলো সত্যি লকারে রেখেছ, নাকি কোন বন্ধুর কাছে রেখেছ, তাও আমার জানা নেই। সেই বন্ধুও আমার কাছ থেকে টাকা চাইবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়?’

স্বস্তির একটা হাঁফ ছাড়ল পিসিক। বলল, ‘উদ্বিগ্ন হবার কারণ নেই আপনার নিজের স্বার্থেই কোন বন্ধুকে বিশ্বাস করে এত দামী জিনিস রাখতে দিতে পারি না আমি। তাছাড়া এক হাতে ওগুলো নেবেন, অন্য হাতে টাকা দেবেন—এর মধ্যে ছলচাতুরীর অবকাশ নেই। লকারেই রেখেছি, বিশ্বাস করুন। অরিজিন্যাল ফ্রন্ট পেজটা আপনাকে দিয়ে দেবার পর ইচ্ছা থাকলেও আবার আমি টাকা চাইতে পারব না। সবাই জানে, ড্রাইভিং লাইসেন্সের একটা ফটো কপি কোনই গুরুত্ব বহন করে না, বৃটিশ কর্তৃপক্ষ ব্যাপারটা আমলই দেবে না। তাছাড়া, জাল একটা ড্রাইভিং লাইসেন্স সহ ধরা পড়লে সামান্য কিছু জরিমানা হবে আপনার, তার বেশি কিছু নয়। সুতরাং আমাকে বারবার টাকা দেয়ার চাইতে নতুন আরেকটা জাল লাইসেন্স যোগাড় করার ব্যবস্থা করবেন আপনি। ফ্রেঞ্চ কার্ড দুটো সম্পর্কেও এই কথা খাটে।’

‘সেক্ষেত্রে এখনই তা আমি করতে পারি না কেন?’ জানতে চাইল রানা। কার্ড এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স যোগাড় করতে পাঁচশো পাউন্ডের বেশি লাগবে না আমার। তোমাকে অতিরিক্ত এক হাজার পাউন্ড দিতে যাব কেন?

‘আমি ভরসা করছি আপনার সময়ের অভাবের ওপর,’ গম্ভীর হয়ে বলল পিসিক। ‘নতুন কার্ড আর লাইসেন্স যোগাড় করতে যে সময় লাগবে, আমার ধারণা, আপনার হাতে সে-সময় নেই। তাছাড়া, আমার কাজে কোন খুঁত নেই, সেজন্যে আমার করা কাজগুলো আপনি হাতছাড়া করতে রাজি হবেন বলেও মনে করি না। কাজগুলো নেবেন, সেই সাথে আমার মুখ বন্ধ করারও ব্যবস্থা করবেন—বোধহয় এ ছাড়া বিকল্প উপায় এই মুহূর্তে আপনার নেই।’

একটু চিন্তা করল রানা। কাঁধ ঝাঁকাল। বলল, ‘আমার অসুবিধাগুলো ঠিকই ধরতে পেরেছ তুমি। ঝোপ বুঝে কোপ মারা একেই বলে! কিন্তু আমার কাছে এক হাজার পাউন্ড আছে, এ-কথা তুমি ভাবছ কেন?’

মশিয়ে, আপনি একজন ইংরেজ ভদ্রলোক। পরিষ্কার বোঝা যায়। অথচ আপনি মধ্য বয়স্ক একজন ফ্রেঞ্চ শ্রমিক হিসেবে ছদ্ম পরিচয় নিতে চাইছেন। এ থেকে একটা সত্যই প্রমাণ হয়, আপনি একজন স্মাগলার। সম্ভবত ড্রাগস, না? নাকি ডায়মন্ড? যাই হোক, লাভজনক ব্যবসায় আছেন আপনি। এখন বলুন, আপনি রাজি? আগামীকাল বিনিময় পর্ব সমাধা করতে চান?’

‘ঠিক আছে,’ বলল রানা। তুমিই জিতলে। আগামীকাল দুপুরের মধ্যে এক হাজার পাউন্ড যোগাড় করতে পারব বলে আশা করি। কিন্তু একটা শর্ত আছে।’

‘শর্ত?’ চোখের চার পাশের চামড়া আবার কুঁচকে উঠল পিসিকের

‘এখানে আমি আসব না,’ বলল রানা। ‘আমি চাই না, তোমার কোন বন্ধু আড়াল থেকে আবার ফটো তুলুক আমার।’

স্বস্তির আরেকটা হাঁফ ছেড়ে হোঃ হোঃ করে হেসে উঠল হাড্ডিসার পিসিক বলল, আপনি খামোকা ভয় করছেন, মশিয়ে। আপনার ছবি তোলার কোন দরকারই নেই আমার, কারণটা আগেই বলেছি-তাতে কিছু লাভ করতে পারব না আমি—সুতরাং, কোন বন্ধুকে এখানে আমি লুকিয়ে রাখব না। হঠাৎ কেউ এসে পড়বে, সে ভয়ও নেই। কাউকে না ডাকলে আমার এই স্টুডিওতে কেউ পা দেয় না। ট্যুরিস্টদের জন্যে এখানে আমি আদি রসের ছবি তুলি কিনা, তাই এ ব্যাপারে খুব সাবধান থাকি। যাকে ডাকি শুধু সেই আসে। আগামীকাল কাউকে ডাকিনি পরশু দিন কয়েকজন আসবে, ওই আদি রসের ছবি তুলতে…’ একটা হাত তুলে তর্জনী আর বুড়ো আঙুলের মাথা একত্রিত করে ইংরেজি ) অক্ষরের মত একটা বৃত্ত তৈরি করল সে, তারপর অপর হাতের তর্জনী সেই গোলাকার গর্তে বারবার ঢোকাতে আর বের করতে শুরু করল।

মুহূর্তের জন্যে একটু হাসল রানা। তাই দেখে আনন্দে আটখানা হলো পিসিক। অট্টহাসি বেরিয়ে আসছে তার গলা থেকে, সেই সাথে আরও দ্রুত O-এর ভিতর ডান হাতের তর্জনী চালাচ্ছে। বেদম হাসিতে কাঁপছে সে, তাকে স্থির করার জন্যে একটা হাত দিয়ে তার কাঁধ ধরল রানা, মৃদু হাসি লেগে আছে ওর ঠোঁটে।

ডান পায়ের হাঁটু ভাঁজ হয়ে বিদ্যুৎ বেগে উঠে এল রানার, হাঁটুটা প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা খেল পিসিকের দুই উরুর সংযোগ স্থলে। মাথাটা তীব্র ঝাঁকি খেল সামনের দিকে, হাত দুটোর অশ্লীল ক্রিয়া থেমে গেল, মরা সাপের মত ঝুলে পড়ল শরীরের দু’দিকে। অট্টহাসিটা গলায় আটকে গেছে, বদলে ঘড় ঘড় শব্দ বেরিয়ে আসছে। হাঁটু ভাঁজ হয়ে গেল, হুড়মুড় করে পড়ে গেল মেঝেতে। আহত জায়গাটা চেপে ধরতে গেল, কিন্তু পারল না, তার আগেই জ্ঞান হারিয়ে স্থির হয়ে গেল লোকটা।

ধীরসুস্থে একটা সিগারেট ধরাল রানা। তারপর উবু হয়ে বসে পিসিকে পালস দেখল। চলছে, আধঘণ্টার আগে জ্ঞান ফিরে পাবার কোন সম্ভাবনা নেই বুঝতে পেরে উঠে দাঁড়াল ও, স্টুডিও থেকে বেরিয়ে এল আউটার অফিসে। জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরেটা দেখে নিল একবার। তাঁরপর টেবিলের কাছে ফিরে এসে তুলে নিল টেলিফোনের রিসিভার। বিশেষ একটা নাম্বারে ডায়াল করল রানা। নিজের পরিচয় দিল না, শুধু বলল, আমার কণ্ঠস্বর চিনতে পারছ?’

দুই সেকেন্ড পর অপর প্রান্ত থেকে বিস্ময় মেশানো উত্তর এল, ‘পারছি।’

স্টুডিওর লোকেশনটা সংক্ষেপে জানাল রানা। রানা এজেন্সীর স্থানীয় শাখা প্রধান বলল, ‘চিনে নেব।’

‘একটা কার্গো সরাতে হবে। লন্ড্রি ভ্যান নিয়ে এসো। অনির্দিষ্ট কালের জন্যে সরিয়ে রাখা দরকার। অসুবিধে হবে না তো?’

‘না।

রিসিভার নামিয়ে রাখল রানা। এক মুহূর্ত কি যেন চিন্তা করল। তারপর এগোল দরজার দিকে।

দরজা খুলে বেরিয়ে এল রানা। কবাট দুটো নিঃশব্দে ভিড়িয়ে দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল একতলায়, সেখান থেকে নির্জন রাস্তায়।

হেঁটে মেইন রোডে পৌঁছতে তিন মিনিট লাগল ওর। ট্যাক্সির জন্যে মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে, এমন সময় ঝড় তুলে একটা লন্ড্রি ভ্যানকে এগিয়ে আসতে দেখল ও। প্রায় ওর গা ঘেঁষে এগিয়ে গিয়ে বাঁক নিল গাড়িটা, ঢুকে পড়ল অপ্রশস্ত রাস্তায়। ড্রাইভিং সীটে বসা লোকটার সাথে চোখাচোখি হলো একবার, কিন্তু রানাকে চিনতে পারলেও আচরণে তার কোন প্রকাশ ঘটল না। দ্রুত অন্য দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল ড্রাইভার।

পরদিন শুক্রবার। দিনের বেশির ভাগটা ব্যয় হলো এটা সেটা কেনাকাটায়। একটা ক্যাম্পিং ইকুইপমেন্টের দোকান থেকে একজোড়া হাইকিং বুট কিনল ও। রেডিমেড গার্মেন্টসের দোকান থেকে লম্বা উলেন মোজা, ডেনিশ ট্রাউজার, চেক উলেন শার্ট এবং একটা হ্যাভার স্যাক নিল। এছাড়া আরও কিনল কয়েক শিট ফোম রাবার, ফিতেওয়ালা শপিং ব্যাগ, চিকণ রশির একটা বল, একটা হান্টিং নাইফ, পাতলা দুটো পেইন্ট ব্রাশ, এবং পিঙ্ক ও ব্রাউন রঙের দুটো কৌটা। বড়সড় একটা তরমুজ কেনার কথা চিন্তা করল, কিন্তু সাপ্তাহিক ছুটি শেষ হবার আগেই সেটা পচে যাবে ভেবে আপাতত সেটা না কেনারই সিদ্ধান্ত নিল।

হোটেলে ফিরে এসে আগামীকাল সকালের জন্যে একটা সেলফ-ড্রাইভ কারের ব্যবস্থা করতে বলল রিসেপশনিস্টকে রানা। কাউন্টারে জমা দিল নতুন ড্রাইভিং লাইসেন্সটা। ওর পাসপোর্ট এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স একই নাম বহন করছে এখন: আলেকজান্ডার অরগ্যান।

রিসেপশনিস্টকে আরও একটা নির্দেশ দিল রানা। বলল, ‘উইক-এন্ডের জন্যে সমুদ্রের ধারে যে-কোন হোটেলের একটা কামরা বুক করুন আমার জন্যে, কিন্তু শাওয়ার থাকতে হবে।’

পরদিন সকালে রিসেপশনিস্ট ওকে জানাল, ‘Zeebrugge-এর ফিশিং হারবার দেখা যায় হোটেলটা থেকে, কিন্তু কামরাটা খুবই সাদামাঠা এবং ছোট, চলবে আপনার?’

‘ধন্যবাদ,’ বলল রানা। ‘চলবে।’ আধঘণ্টা পর রেন্ট-এ-কারের একটা অসটিন নিয়ে রওনা হয়ে গেল ও।