সেই উ সেন – ১.৮

আট

ব্রাসেলসে রানা যখন কেনাকাটায় ব্যস্ত, ম্যাটাপ্যান তখন রোমের মেইন পোস্ট- অফিসের ইন্টারন্যাশনাল টেলিফোন এনকোয়েরীতে প্রদর্শনীর একটা বস্তু হয়ে দাঁড়িয়ে গলদঘর্ম হচ্ছে।

আশপাশে ছোটখাট ভিড় জমে গেছে সুসজ্জিত, সভ্য গরিলাটাকে দেখার জন্যে। মন চারেক ওজনের সাত ফিট লম্বা বিশাল ম্যাটাপ্যানের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করার অরসর নেই। মনের অবস্থা খুবই খারাপ তার। মেয়ে ভ্যালেন্টিনা কেমন রইল জানার জন্যে ছটফট করছে সে।

একজন কেরানীকে সমস্যাটা বোঝাতে পেরেছে ম্যাটাপ্যান: প্যারিসের একজন লোককে ফোন করতে চায় সে। লোকটার নাম ভিক্টর কাউলাস্কি। তার বাড়ির ঠিকানাও তার জানা আছে! কিন্তু ফোন আছে কিনা জানা নেই, সুতরাং ফোন নাম্বার জানারও কোন প্রশ্ন ওঠে না। যদি থাকে, যোগাযোগ করা সম্ভব কিনা?

‘সম্ভব কিনা জানি না,’ একটা কাগজে সমস্ত তথ্য লিখে নিয়ে কেরানী বলল, ‘এই চিরকুটটা নিয়ে অপারেটরের কাছে যান, দেখুন কতদূর কি করতে পারে সে আপনার জন্যে।’

অপারেটরকে চিরকুটটা দিয়ে অপেক্ষা করছে ম্যাটাপ্যান। একঘন্টার উপর হয়ে গেছে, ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সে। অপারেটর তাকে জানিয়েছে, প্রয়োজনীয় তথ্য পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে প্যারিসের হেড পোস্ট অফিসে, সেখান থেকে উত্তর না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে তাকে।

আরও আধঘণ্টা পর সুখবর দিল অপারেটর। রিসিভারটা ম্যাটাপ্যানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে একমুখ হেসে বলল, ‘নিন, আপনার বন্ধু ভিক্টর কাউলাস্কির সাথে কথা বলুন।

‘…হ্যাঁ, ডাক্তার বলেছে, রোগটা খুবই সাংঘাতিক,’ ম্যাটাপ্যানের প্রশ্নের উত্তরে প্যারিস থেকে জানাচ্ছে তার বন্ধু এবং তার মেয়ের পালক-পিতা ভিক্টর কাউলাস্কি। হ্যাঁ, পাশের কামরায় শুয়ে আছে সে, ডাক্তার বিছানা থেকে নামতে নিষেধ করে দিয়েছে।…না-না, আগের সেই ফ্ল্যাটে নেই আমরা। এখন যেটায় আছি সেটা অনেক বড়।… কি?…ঠিকানা? দিচ্ছি…’ ধীরে ধীরে প্যারিস থেকে ঠিকানাটা দিল কাউলাস্কি। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে সেটা একটা কাগজে লিখে নিল ম্যাটাপ্যান।

ডাক্তার কি কোন রকম আশাই দেননি?’ জানতে চাইল ম্যাটাপ্যান। অপর প্রান্তে কোন সাড়া নেই দেখে তারস্বরে চেঁচাতে শুরু করল সে, ‘হ্যালো? হ্যালো?’

আবার শোনা গেল কাউলাস্কির যান্ত্রিক, অস্পষ্ট কন্ঠস্বর। ‘না…মানে কিছুই বলতে পারেননি ডাক্তার…এক মাস, এক হপ্তা— আবার এক বছরও টিকে যেতে পারে…’

বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল ম্যাটাপ্যানের। হঠাৎ সে আবিষ্কার করল রিসিভার ধরা হাতটা তার কাঁপছে। কথা বলতে গিয়ে অনুভব করল আবেগে রুদ্ধ হয়ে গেছে গলা। দ্রুত রিসিভারটা নামিয়ে রাখল সে।

.

প্যারিস। ভিক্টর কাউলাস্কির ফ্ল্যাট। স্ত্রী এবং পালক কন্যা ভ্যালেন্টিনাকে নিয়ে এই ফ্ল্যাটেই দীর্ঘদিন থেকে বসবাস করছে সে।

রোমে ম্যাটাপ্যান রিসিভার নামিয়ে রেখেছে বুঝতে পেরে কাউলাস্কিও ধীরে ধীরে ক্র্যাডলে নামিয়ে রাখল রিসিভারটা। তারপর মুখ তুলে সামনে বসা ফ্রেঞ্চ অ্যাকশন সার্ভিসের লোক দু’জনের দিকে তাকাল। দু’জনের হাতেই দুটো কোল্ট, .৪৫ পুলিস স্পেশাল, কাউলাস্কির বুক এবং কপাল লক্ষ্য করে ধরা।

‘প্যারিসে আসছে ম্যাটাপ্যান?’ দু’জনের একজন জানতে চাইল।

বলেনি আমাকে,’ রক্তশূন্য, ফ্যাকাসে হয়ে আছে কাউলাস্কির মুখের চেহারা হঠাৎ কানেকশন কেটে দিল।

‘এতবড় দুঃসংবাদ, আসতে তাকে হবেই, কি বলো?’ ফ্রেঞ্চ অ্যাকশন সার্ভিসের দ্বিতীয় লোকটা ভুরু নাচিয়ে বলল।

বোকার মত তাকিয়ে আছে কাউলাস্কি।

‘যাই হোক,’ দ্বিতীয় লোকটা বলল, ‘তোমার কাজ তুমি শেষ করেছ। এবার আরেকটু কষ্ট করতে হবে তোমাদেরকে। অন্দর মহলে গিয়ে তোমার স্ত্রীকে তাড়াতাড়ি একটা সুটকেসে কিছু প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড় গুছিয়ে নিতে বলো। আমাদের সাথে এক জায়গায় যেতে হবে তোমাদেরকে।’

‘কেন?’ ভুরু কুঁচকে জানতে চাইল কাউলাস্কি।

‘আগেই বলেছি, গোটা ব্যাপারটা অত্যন্ত গোপনীয়, এর সাথে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার, ব্যাপার জড়িত। আমরা চলে গেলে ফোন করে তুমি ম্যাটাপ্যানকে আবার সাবধান করে দাও, এ আমরা চাই না। তোমাদের চিন্তার কিছু নেই। ক’টা দিন সমুদ্রের ধারে নিখরচায় বেড়িয়ে আসবে, তার বেশি কিছু নয়। ওঠো, মিসেসকে তাড়াতাড়ি করতে বলো।’

মান মুখে বসে থাকল কাউলাস্কি। চিন্তা করছে। এদের পরিচয় সম্পর্কে সন্দেহ করার কিছু নেই। কিন্তু ম্যাটাপ্যান তার বন্ধু, তার কোন ক্ষতি হতে দিতে চায় না সে। বলল, ‘কিন্তু মি. ম্যাটাপ্যানকে কেন দরকার আপনাদের?’

কেন দরকার তা বলতে নিষেধ আছে। তবে, তার কোন ক্ষতি করা হবে না। কিছু তথ্য চাইব আমরা। ব্যস।’

কাঁধ ঝাঁকাল কাউলাস্কি। হয়তো তাই, ভাবল সে। বলল, ‘কিন্তু ভ্যালেন্টিনার কি হবে?

‘স্কুলের পাশ দিয়ে যাবার সময় গাড়ি থামাব একবার, তুলে নেব ওকে, ‘ অ্যাকশন সার্ভিসের অপেক্ষাকৃত বয়স্ক লোকটা জানাল। ‘হেডমিসট্রেসকে আগেই জানানো হয়েছে, ভ্যালেন্টিনার দাদী মৃত্যুশয্যায় তাঁকে শেষবার দেখার জন্যে ভ্যালেন্টিনাকে ছুটি দিতে হবে।’

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সোফা ত্যাগ করল কাউলাস্কি।

সাপ্তাহিক ছুটির দিন ক’টা সাগর তীরে কাটাল রানা। একজোড়া সুইমিং ট্রাঙ্ক কিনে শনিবারটা জিবরাগ এর তীরে গায়ে রোদ খেলো, কয়েকবার গোসল করল, উত্তর সাগরে, বাকি সময়টা ছোট্ট বন্দর শহরে একাকী ঘুরেফিরে বেড়াল। রোববারদিন সকালবেলা জিনিসপত্র গোছগাছ করে নিয়ে গাড়িতে উঠল। অলস ভঙ্গিতে গাড়ি চালিয়ে-গেন্ট আর ব্রাজেস-এর সরু গলিগুলোর ভিতর দিয়ে পৌঁছল ড্যাম-এ, সিকন রেস্তোরায় বাঁশের আগুনে ঝলসানো মুরগীর লাঞ্চ খেলো, তারপর গাড়ির নাক ঘুরিয়ে নিয়ে ফিরে চলল ব্রাসেলসের দিকে। হোটেলে পৌঁছে রূম- সার্ভিসকে জানিয়ে রাখল আগামীকাল ভোরে বিছানায় ব্রেকফাস্ট চাই ওর, সাথে এক প্যাকেট লাঞ্চ। কথা প্রসঙ্গে রিসেপশনিস্টকে জানাল বালজ এর যুদ্ধে নিহত ওর বড় ভাইয়ের কবর দেখার জন্যে খুব ভোরে আরডেনেসের দিকে রওনা হয়ে যাবে ও।

.

সাপ্তাহিক ছুটির দিন ক’টা বিছানায় শুয়ে কাটাল ম্যাটাপ্যান। তার ম্লান চেহারা দেখে খটকা লাগল মোনিকার। প্রশ্ন করতে ম্যাটাপ্যান সংক্ষেপে জানাল, ‘শরীরটা ভাল যাচ্ছে না।’

ক’দিন ছুটি নিলেই তো পারো, বাপু,’ রাগের সাথেই বলল কথাটা মোনিকা। রাগ করার যথেষ্ট কারণও আছে। দিনের পর দিন গাধার মত খাটে লোকটা, বিশ্রামের ধার ধারে না। এ নিয়ে অনেক বকাঝকা করেছে মোনিকা, কিন্তু হেসে উড়িয়ে দিয়েছে তার কথা ম্যাটাপ্যান। শোনো, সোমবার থেকে সাতদিন তোমাকে যদি অফিসে দেখি, মাথা খাবে আমার। এই ক’দিন কমপ্লিট রেস্ট নিতে হবে তোমাকে। ‘

একদৃষ্টিতে মোনিকার দিকে তাকিয়ে আছে ম্যাটাপ্যান। নিজেকে যতটা ভালবাসে, তারচেয়েও বুঝি বেশি ভালবাসে মোনিকাকে। কিন্তু যতই ভালবাসুক, আজ হঠাৎ সে উপলব্ধি করছে, মোনিকা তার নিজের মেয়ে নয়। তবু, মোনিকাই এখন তার একমাত্র সান্ত্বনা। নিজের মেয়েটা মরতে চলেছে।

সোমবারের ভোর। অফিসে আজ নামবে না ম্যাটাপ্যান। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে। অপ্রত্যাশিতভাবে পাওয়া সাতদিনের ছুটিটাকে কাজে লাগাবে! ফ্রান্সে যাবে সে। মেয়েকে শেষ দেখা দেখবে। মনস্থির করে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল ম্যাটাপ্যান। পা টিপে টিপে বেরোল ঘর থেকে।

.

সোমবার ভোরে সেই সময় বিছানা ছেড়ে অত্যন্ত যত্নের সাথে গোছগাছের কাজে হাত দিল রানা।

প্রথমে শাওয়ার সারল ও, দাড়ি কামাল, বিছানার পাশের টেবিলে রাখা ট্রে থেকে নিয়ে ব্রেকফাস্ট সারল। তালা খুলে ওয়ারড্রোব থেকে বের করল রাইফেল ভর্তি কেসটা। কেস খুলে এক এক করে বের করল রাইফেলের প্রতিটি পার্টস তারপর যত্নের সাথে প্রতিটি পার্টস কয়েকবার করে মুড়ল ফোম রাবার দিয়ে। সবগুলো একত্রিত করে সরু রশি দিয়ে বেঁধে একটা বান্ডিল তৈরি করল, তারপর বান্ডিলটা ঢুকিয়ে দিল রা স্যাকের নিচে। এর উপর চাপাল রঙের কৌটা আর ব্রাশগুলো, ডেনিশ ট্রাউজার, চেক শার্ট, মোজা আর বুটজোড়া। সুতো দিয়ে বোনা ফোকরওয়ালা শপিং ব্যাগটা ঢোকাল রাকস্যাকের বাইরের একটা পকেটে, দ্বিতীয় পকেটে রাখল বুলেটের বাক্সটা।

ডোরাকাটা একটা শার্টের উপর ডাভ-গ্রে রঙের লাইটওয়েট স্যুট, একজোড়া হালকা কালো লেদার স্নেকার, কালো সিল্ক দিয়ে বোনা টাই পরল রানা। রাকস্যাকটা একহাতে নিয়ে নিচের গ্যারেজে নেমে এল ও। গাড়ির বুটে রাকস্যাকটা রেখে লক করে দিল। কেবিনে গিয়ে ডেলিভারি নিল অর্ডার দিয়ে রাখা প্যাকেট লাঞ্চটা।

সকাল ন’টা। পুরানো ই-চল্লিশ হাইওয়ে ধরে ব্রাসেলস ছেড়ে নামুরের দিকে ছুটছে অসটিন ঝড়ের বেগে। সমতল তৃণভূমিতে সকালের মিঠে রোদ ঝলমল করছে, মনে হচ্ছে গরম পড়বে আজ। রোড ম্যাপ অনুযায়ী আরদেনেসের লাগোয়া ছোট্ট শহর ব্যাসটোন নব্বুই মাইল দূরে। শহর ছাড়িয়ে দক্ষিণে আরও কয়েক মাইল এগোবে রানা, পাহাড় আর জঙ্গলের কোথাও নির্জন জায়গা খুঁজে নেবে। দুপুরের মধ্যেই শ’খানেক মাইল পেরিয়ে যাওয়া সম্ভব, রাস্তার অবস্থা দেখে বুঝতে পারছে ও। ওয়ালুন প্রান্তরের মাঝখান দিয়ে সমতল রাস্তাটা সরলরেখার মত এগিয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে দিগন্তরেখার আড়ালে। গাড়ির স্পীড বাড়িয়ে ঘণ্টায় ষাট মাইল তুলল রানা।

সূর্য সুবিন্দু রেখার কাছে পৌছবার আগেই নামুর এবং মার্চ পেরিয়ে এল রানা। রাস্তার ধারের মাইলপোস্ট দেখে বুঝতে পারছে ব্যাসটোন দ্রুত এগিয়ে আসছে কাছে।

ছোট্ট শহর। উনিশশো চুয়াল্লিশ সালের শীতকালে Hasso von Manteuffel-এর K।ng T।gar ট্যাঙ্কগুলো গোলা ছুঁড়ে গোটা শহরটাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ধ্বংসের একবিন্দু চিহ্ন কোথাও অবশিষ্ট নেই দেখে মনে মনে বেলজিয়ানদের দেশপ্রেম এবং শ্রম-প্রবণতার প্রশংসা না করে পারল না রানা। ধ্বংসস্তূপের উপর নতুন করে গড়ে তুলেছে তারা শহরটাকে। এ ধরনের দৃষ্টান্ত অবশ্য গোটা ইউরোপ এবং এশিয়ার জাপান ও কোরিয়ায়ও ভূরি ভূরি লক্ষ করা যায়। প্রাসঙ্গিকভাবেই নিজের দেশ আর দেশবাসীর কথা মনে পড়ে গেল রানার। নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। দেশের বর্তমান হাল দেখে ভবিষ্যতের কথা ভাবতে ভয় হয় ওর। ছোট্ট একটু জায়গা, তাতে গিজগিজ করছে কোটি কোটি মানুষ। খরা, পোকা আর বন্যার ত্রিমুখী আক্রমণে ফসলের দফা সারা। পাব পাব করেও পাওয়া আর হচ্ছে না তেল। সীমিত সম্পদ, তাও লুটেপুটে খাচ্ছে দুর্নীতি নামের রাক্ষসটা। নৈতিকতা এখন পরাজিত সৈনিক, বেশির ভাগ মানুষ তাকে পা দিয়ে মাড়িয়ে যাচ্ছে। এসবের পরে রয়েছে আন্তর্জাতিক কূটনীতির ষড়যন্ত্র, ইজমের দৌরাত্ম্য, কর্মবিমুখতা, ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। মাছ ধরার জাল পরা, অভুক্ত, হাড্ডিসার কুলবধূ বাসন্তীর ছবিটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই গায়ের রোম দাঁড়িয়ে পড়ল রানার। কপালের পাশে দপ্ দপ্ করছে একটা শিরা।

বাঁক নিয়ে দক্ষিণ দিকে ছুটছে গাড়ি। সামনে জঙ্গলের ভিতর পাহাড়। ক্রমশ আরও গভীর হচ্ছে বনভূমি।

কাউকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, ভাবছে রানা। দেশের ভাল চাইলে কাজ করতে হবে। সবাই শুরু করুক, এই আশায় হাত পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলরে’—বাংলাদেশের বিবেকসম্পন্ন প্রতিটি লোককে এখন এই নীতিতেই চলতে হবে। ঝটপট একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল রানা। এবার দেশে ফিরে পোলট্রি ফার্ম আর গম চাষের প্রকল্পে হাত দেবে সে। অনেকদিনের পুরানো স্বপ্ন, উঠে পড়ে কাজে হাত না দিলে চিরকাল স্বপ্নই থেকে যাবে।

মেটো পথ, কিন্তু বেশ চওড়া। মাইলখানেক এগিয়ে রাস্তা ছেড়ে ঘাস বিছানো সমতল ছোট্ট মাঠে নেমে সোজা এগিয়ে আবার প্রবেশ করল বনভূমিতে। গজ বিশেক এগিয়ে মাথা সমান উঁচু ঝোপের আড়ালে দাঁড় করাল গাড়ি।

সুশীতল ছায়া চারদিকে, আশপাশে মিষ্টি মধুর পাখির কোলাহল, বাতাসে বুনো ফুলের গন্ধ—ভাল লেগে গেল জায়গাটাকে। গাড়িতে বসে একটা সিগারেট ধরাল রানা। একজনের অভাব বোধ করছে হঠাৎ। পাশে সোহানা থাকলে বড় ভাল লাগত এখন। পরমুহূর্তে কাজের কথা মনে পড়তেই উবে গেল মন থেকে রোমান্সের আমেজটুকু। কঠোর হয়ে উঠল ওর মুখের চেহারা। এর পরই হয়তো সালমার কথা মনে পড়ে যাবে। ধীরে ধীরে গাড়ি থেকে নেমে চারদিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিল একবার। হাতের সিগারেটটা পায়ের সামনে ফেলে জুতো দিয়ে মাড়িয়ে চিঁড়ে চ্যাপ্টা করল।

নব ধরে টান দিয়ে লক খুলে বুটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল ও, রাকস্যাকটা বের করে রাখল বনেটের উপর।

স্যুট খুলে গাড়ির ব্যাক সীটে ভাঁজ করে রাখল। ডেনিশ স্ন্যাকসটা পরল, ডোরাকাটা শার্ট খুলে পরল লাম্বারজ্যাক চেক শার্ট। হাইকিং বুট আর উলেন মোজা জোড়াকে জায়গা ছেড়ে দিল শহুরে স্নেকার জোড়া। বুটের ভিতর গুঁজে নিল ট্রাউজারের নিচের অংশ।

বান্ডিল খুলে এক এক করে বের করল রাইফেলের প্রতিটি অংশ। সময় নিয়ে, অত্যন্ত যত্ন এবং সাবধানতার সাথে অংশগুলো জোড়া লাগিয়ে তৈরি করে ফেলল রাইফেলটা। ট্রাউজারের এক পকেটে ঢুকিয়ে নিল সাইলেন্সার, আরেক পকেটে টেলিস্কোপ সাইট। কার্ডবোর্ডের বাক্স থেকে বিশটা শেল বের করে শার্টের বুক পকেটে ভরল, টিসু পেপারে জড়ানো এক্সপ্লোসিভ শেলটা রাখল শার্টের আরেক বুক পকেটে।

বাকি অংশগুলো জোড়া লাগিয়ে রাইফেলটা গাড়ির বনেটে রেখে আবার পিছনের বুটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল রানা। সেটা খুলে মস্ত একটা তরমুজ বের করল। গত সন্ধ্যায় হোটেলে ফেরার পথে বাজার থেকে কিনেছে এটা, সারারাত এই বুটের ভিতরই ছিল। বুটটা লক করে রঙের কৌটা, ব্রাশ এবং হান্টিং নাইফের সাথে রাকস্যাকের ভিতর রেখে দিল তরমুজটা।

গাড়িতে তালা লাগিয়ে ঠিক দুপুর বেলা রওনা হলো রানা

দশ মিনিটের মধ্যে মনের মত লম্বা, অপ্রশস্ত একটা ফাঁকা জায়গা পেয়ে গেল ও। জায়গাটার এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে অপর প্রান্তের দিকে তাকালে একশো পঞ্চাশ গজ পরিষ্কার দৃষ্টি চলে। একটা গাছের পাশে রাইফেলটা রেখে লম্বা পা ফেলে পদক্ষেপ গুনতে গুনতে এগোল, থামল একশো পঞ্চাশ পা এগিয়ে, আশপাশে তাকিয়ে রেখে আসা রাইফেলটার কাছ থেকে দেখতে পাওয়া যায় এমন একটা গাছ খুঁজছে।

গাছ নির্বাচনের পর রাকস্যাকের ভিতর থেকে সব জিনিস ঘাসের উপর নামাল ও। হাঁটু গেড়ে বসে তুলি দিয়ে তরমুজের গায়ে শিল্প চর্চা শুরু করল। ফলটার উপর এবং নিচের গাঢ় সবুজ ত্বকে তামাটে রঙের প্রলেপ দিল ও, মাঝখানে লালচে রঙ মাখাল। রঙ দুটো তরল থাকতে থাকতেই তর্জনী দিয়ে তরমুজের গায়ে এক জোড়া চোখ, একটা নাক, গোঁফ এবং মুখ আঁকল।

ফলটার মাথায় খাড়াভাবে ছুরি ঢুকিয়ে দিল ও, ছুরির হাতল ধরে ধীরে ধীরে উপরে তুলল, তারপর অত্যন্ত সাবধানে সেটাকে নামাল সুতো দিয়ে ফাঁক ফাঁক করে বোনা শপিং ব্যাগে। ফাঁকগুলো বেশ বড় বড়, সুতোটাও মিহি, তাই তরমুজের আউট লাইন বা গায়ের নকশা কিছুই ঢাকা পড়েনি।

মাটি থেকে সাত ফিট উঁচুতে গাছের কাণ্ডে ছুরিটা গাঁথল রানা। ছুরির বাঁটে ঝুলিয়ে দিল ব্যাগটা। ব্যাকগ্রাউন্ডে গাছের সবুজ ছাল, লালচে এবং বাদামী তরমুজ ঠিক একটা গম্ভীর-দর্শন মানুষের কাটা মুণ্ডুর মত ঝুলছে। দু’পা পিছিয়ে এসে নিজের শিল্পকর্মটি পরখ করল রানা। আপন মনে হাসল একটু।

রঙের কৌটা আর তুলিগুলো দূরের একটা ঝোপের ভিতর ফেলে দিল রানা। রাকস্যাকটা তুলে নিয়ে ফিরে এল রাইফেলের কাছে। প্রথমে ফিট করল সাইলেন্সার, তারপর ব্যারেলের উপর টেলিস্কোপ সাইট। বোল্টটাকে পিছনে টেনে এনে একটা কারট্রিজ ভরল ব্রীচে। টেলিস্কোপে চোখ রেখে ফাঁকা জায়গাটার শেষ প্রান্তে তাকাল। ঝুলন্ত টার্গেটটাকে একেবারে সামনে দেখতে পেল ও, ফলে অনেক বড় দেখাচ্ছে তরমুজটাকে। তরমুজের গায়ে সেঁটে থাকা ব্যাগের সুতোগুলো পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। চোখ, নাক, ঠোঁট—সব স্পষ্ট।

একটু সরে দাঁড়াল রানা, লক্ষ্য স্থির করার জন্যে হেলান দিল একটা গাছে। টেলিস্কোপের ক্রস চিহ্নটা ঠিক মত পড়েনি মাঝখানে, অ্যাডজাসটিং স্ক্রু ঘুরিয়ে সেন্টারে আনল সেটাকে। তারপর অত্যন্ত সাবধানে তরমুজের মাঝখানে লক্ষ্যস্থির করে গুলি করল।

যতটা আশা করেছিল তার চেয়ে অনেক কম ধাক্কা মারল রাইফেলটা। সাইলেন্সারটাও দারুণ সন্তুষ্ট করল ওকে। ‘পুট’ করে যে শব্দটা হলো, নির্জন একটা রাস্তার এপার থেকে গুলি করলে ওপার থেকেও বোধহয় শুনতে পাওয়া যাবে না। রাইফেলটাকে বগলদাবা করে এগিয়ে গেল রানা, দাঁড়াল তরমুজটার সামনে। ফলটার মাথার দিকে ডান পাশের কিনারা ঘেঁষে একটা ফুটো করে বেরিয়ে গেছে বুলেট, দু’টুকরো করে দিয়ে গেছে শপিং ব্যাগের একটা সুতোকে, ওপাশ দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে ঢুকে পড়েছে গাছের গায়ে। ফিরে এসে টেলিস্কোপ সাইটের সেটিং না বদলে আবার গুলি করল ও।

ফলাফল প্রায় আগের মতই, মাত্র আধ ইঞ্চির হেরফের। মোট চারবার গুলি করে নিশ্চিত হলো ও, ওর হাতের টিপ ঠিকই আছে, টেলিস্কোপটাই সামান্য গোলমাল করছে—একটু উপরে, ডান দিক ঘেঁষে লাগছে বুলেট। স্ক্রু ঘুরিয়ে রি- অ্যাডজাস্ট করে নিল টেলিস্কোপ, তারপর আবার গুলি করল।

পরবর্তী গুলিটা একটু নিচের দিকে বাঁ দিক ঘেঁষে লাগল। পুরোপুরি নিশ্চিত হবার জন্যে তরমুজের কাছে হেঁটে এসে ফুটোটা পরীক্ষা করল রানা’। মুখের নিচের বাম প্রান্তে লেগেছে বুলেট। টেলিস্কোপের নতুন পজিশন না বদলে আরও তিনটে গুলি ছুঁড়ল ও, প্রতিটি বুলেট একই এলাকায় গিয়ে বিদ্ধ হলো। দুটো স্ক্রু সামান্য ঘুরিয়ে আবার টেলিস্কোপ সাইট অ্যাডজাস্ট করল ও।

নয় নম্বর বুলেটটা তরমুজের কপাল ভেদ করে গেল, ঠিক যেখানে তাক করেছিল ও। এবার নিয়ে তৃতীয়বার তরমুজটার কাছে ফিরে এল ও। পকেট থেকে একটা সাদা চক বের করে গুলি লাগা এলাকাগুলোকে আলাদা আলাদা ভাবে চিহ্নিত করল—উপরের ডান দিকে কয়েকটা ফুটোকে আলাদা করল একটা বৃত্ত এঁকে, আরেকটা বৃত্ত আঁকল মুখের বাঁ দিকে, সবশেষে ছোট্ট একটা বৃত্ত আঁকল কপালের একমাত্র ফুটোকে ঘিরে।

এরপর গুলি ছুঁড়ে এক এক করে দুটো চোখ, নাকের ব্রীজ, উপরের ঠোঁট এবং চিবুক ফুটো করল রানা। শেষ ছয়টা গুলি দ্রুত ছুঁড়ল ও, সবগুলো মুঞ্জুর একটা পাশ লক্ষ্য করে। প্রথম তিনটে গুলি কপালের পাশ, কানের গর্ত, ঘাড় ভেদ করে গেল, পরবর্তী তিনটে ফুটো করল গাল, চোয়াল এবং খুলি। মাত্র একটা বুলেট সামান্য একটু লক্ষ্যচ্যুত হলো।

সন্তুষ্ট বোধ করছে রানা, রাইফেলটা ওকে পুরোপুরি খুশি করতে পেরেছে। পকেট থেকে বালসা-উড সিমেন্টের ছোট্ট একটা টিউব বের করল ও। টেলিস্কোপ সাইটের বর্তমান সেটিং শক্তভাবে বহাল রাখার জন্যে অ্যাডজাসটিং স্ক্রু দুটোর মাথায় খানিকটা করে তরল পদার্থ ঢেলে দিল

সিগারেট ধরিয়ে ঘাসের উপর পা ছড়িয়ে বসল রানা। আধঘণ্টা পর আঙুল দিয়ে পরীক্ষা করে দেখল স্ক্রু দুটোর উপর সিমেন্ট লোহার মত শক্ত হয়ে গেছে। উঠে দাঁড়ান ও। শার্টের বুক পকেট থেকে এক্সপ্লোসিভ বুলেটটা বের করে রাইফেলের বীচে ঢোকাল, সময় নিয়ে লক্ষ্যস্থির করল তরমুজের ঠিক মাঝখানে, তারপর ট্রিগার টিপল।

সাইলেন্সারের মুখ থেকে নীলচে ধোঁয়ার শেষ রেশটুকু এঁকেবেঁকে বেরিয়ে যেতে রাইফেলটা গাছের গায়ে ঠেস দিয়ে রাখল রানা, হেঁটে ফিরে এল ঝুলন্ত শপিং ব্যাগটার কাছে। ফাটা বেলুনের মত চুপসে গেছে ব্যাগটা, সেঁটে আছে গাছের গায়ে। প্রায় খালি হয়ে গেছে সেটা। বিশটা গুলি খেয়েও টুকরো টুকরো হয়নি তরমুজটা, কিন্তু শেষ বুলেটটা সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করেছে তাকে। প্রায় সবটাই গলে ছাতু হয়ে গেছে। ব্যাগের ফুটো গলে পড়ে গেছে মাটিতে। গাছের ছাল বেয়ে সড় সড় করে নামছে রস, সাথে লাল রঙের তরমুজ-বিচি। ব্যাগের তলায় আটকে আছে তরমুজের কয়েকটা মোটা বহিরাবরণ। ব্যাগটা ছুরির বাঁট থেকে নামিয়ে কাছাকাছি একটা ঝোপের ভিতর ফেলে দিল ও। ছুরিটা গাছের গা থেকে টান মেরে খুলে নিয়ে খাপে ভরে রাখল। রাইফেলের কাছে ফিরে এসে সিগারেট ধরাল একটা। তারপর জায়গাটা ছেড়ে চলে এল গাড়ির কাছে।

গাড়িতে বসে রাইফেলটাকে আবার বিচ্ছিন্ন করল রানা। ফোম রাবার দিয়ে প্রতিটি পার্ট মুড়ল। সবগুলো একত্রিত করে সুতো দিয়ে বেঁধে বান্ডিলটা বুট, মোজা, শার্ট এবং স্ন্যাকসের সাথে রেখে দিল রাকস্যাকে। হাতের কাজ শেষ এবার হামলা চালাল রানা প্যাকেট-লাঞ্চের উপর।

খাওয়া শেষ করে গাড়িতে স্টার্ট দিল ও, ফিরে এল মেন রোডে।

বিকেল ছয়টার একটু পর হোটেলে পৌঁছল রানা। রাকস্যাক নিয়ে উঠে এল নিজের কামরায়। টেলিফোনে রিসেপশনিস্টকে জানাল, ওর আর দরকার নেই গাড়িটার। ডিনারের জন্যে গোসল করার আগে একটা ঘণ্টা ব্যয় করল ও রাইফেলটার পিছনে। প্রত্যেকটি অংশ পরিষ্কার করে বিশেষ বিশেষ অংশগুলোয় তেল দিল, তারপর কেসে যথাযথভাবে ভরে নিয়ে ওয়ারড্রোবে তালাচাবির ভিতর বন্ধ করে রাখল। সেই রাতেরই অন্য এক সময় রাকস্যাক, সুতোর বল, ফোমরাবারের কিছু টুকরো বাইরের একটা ডাস্টবিনে ফেলে দিল ও। একুশটা ব্যবহৃত কার্ট্রিজ কেস পাক খেতে খেতে নেমে গেল মিউনিসিপ্যালিটির খালের তলায়।

.

রোম। পাঁচই অক্টোবর, সোমবার সকাল।

আবার রোমের মেইন পোস্ট-অফিসে এসেছে ম্যাটাপ্যান, ট্র্যাভেল এজেন্সীতে ফোন করে প্যারিস ফ্লাইটের সময়সূচী জেনে নিতে। ট্র্যাভেল এজেন্সী নিরাশ করল তাকে। আজকের ফ্লাইট একঘণ্টা আগে ছেড়ে গেছে। আজ আর কোন রোম টু প্যারিস সরাসরি ফ্লাইট নেই।…হ্যাঁ আগামীকাল অ্যালিটালিয়া এয়ারলাইন্সের একটা ফ্লাইট আছে, এগারোটা পনেরো মিনিটে ছেড়ে অরলি বিমানবন্দর নামবে দুপুরবেলা। রিটার্ন ফ্লাইট পরদিন। ভেবেচিন্তে আগামীকাল ফ্লাইটের একটা রিটার্ন টিকেট বুক করল ম্যাটাপ্যান। কমনমার্কেট-ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে পাসপোর্টের কোন সমস্যা না থাকায়, টিকেট বুক করতে কোন ঝক্কি পোহাতে হলো না তাকে।

.

পুরদিন সকালে একটা সুটকেস হাতে শেষবার দেখা করল রানা বৃদ্ধ ম্যানিকিন পীসের সাথে।

‘টার্গেট প্র্যাকটিস কেমন হলো!’ হাসি মুখে অভ্যর্থনা জানিয়ে নিজের অফিসরূমে রানাকে বসিয়েই জানতে চাইল পীস।

‘খুব ভাল,’ বলল রানা।

ফোম রাবার দিয়ে মোড়া কয়েকটা লম্বা প্যাকেট পায়ের কাছ থেকে তুলে ডেস্কের উপর রাখল বেলজিয়ান লোকটা। মোড়ক খুলে পাতলা টিউবগুলো একটার পাশে একটা রাখছে সে, পালিশ করা ঝকঝকে ইস্পাতের পাত দিয়ে তৈরি, দেখে মনে হচ্ছে অ্যালুমিনিয়াম। রাইফেলের পার্টস ভরা কেসটা টেনে নিয়ে খুলল সেটা। একটা করে অংশ তুলে নিয়ে সেটার জন্যে তৈরি করা টিউবে ভরছে। প্রতিটি অংশ ফিট হয়ে গেল নিখুঁতভাবে।

রাইফেলের পার্টস ভরা প্রতিটি টিউব হাতে নিয়ে নাড়া দিয়ে দেখল রানা। সন্তুষ্ট হলো ও। ‘নিখুঁত,’ মৃদু কণ্ঠে বলল। টিউবগুলো ফোম রাবারে মুড়ে নিয়ে প্রত্যেকটি ভরন ওর ফাইবার সুটকেসে।

‘মজুরি নেবার জন্যে জেদ ধরে আপনাকে আমি অসম্মান করতে চাই না, চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল রানা। কিন্তু আপনার কাজে আমি সন্তুষ্ট হয়ে সামান্য একটা জিনিস উপহার দিতে চাই।’ পকেট থেকে ছোট্ট একটা সোনালী কেস বের করে টেবিলে রাখল ও।

একটু ইতস্তত করে কেসটা তুলে নিল ম্যানিকিন পীস। সেটা খুলতেই চোখমুখ উজ্জ্বল, উদ্ভাসিত হয়ে উঠল তার। হীরের একটা অত্যন্ত দামী আঙটি রয়েছে কেসে, মশিয়ে, এত দামী জিনিস…’

তাকে বাধা দিয়ে বলল রানা, ‘দামের কথা ওঠে না। আমি আপনার গুণের মূল্য দিতে পারব না, কৃতজ্ঞতার চিহ্ন হিসেবে এটা যদি রাখেন, আমি খুশি হব।’

‘এমন দামী উপহার ফিরিয়ে দেব তেমন বোকা আমি নই,’ চোখ টিপে নকল দাঁত বের করে হাসল বৃদ্ধ।

‘আশা করি আপনার সাথে এটাই আমার শেষ দেখা,’ বলল রানা। ‘কিন্তু আবার দেখা হবে, যদি আপনি আমার নির্দেশগুলো অমান্য করেন। নির্দেশগুলোর কথা নিশ্চয়ই মনে আছে আপনার?’

‘নিশ্চয়, নিশ্চয় মনে আছে,’ তাড়াতাড়ি বলল পীস।

আপনি ভয় পান, তা আমি চাই না,’ বলল রানা। ‘জানি, আপনার মত বুদ্ধিমান লোক সতর্কতা অবলম্বন না করে পারেন না। খদ্দেরদের হাতে আপনার খুন হওয়ার আশঙ্কা সব সময়ই আছে। সেজন্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নেয়া থাকে আপনার। আমার বেলায়ও নিশ্চয়ই কোন ব্যবস্থা নিয়েছেন। সেটা ঠিক কি, আমি জানি না। হয়তো কোন উকিলের কাছে সীল করা একটা চিঠি রেখে এসেছেন, আপনার মৃত্যু সংবাদ পেলে সেটা খুলবে সে। খুলে দেখবে আজকের তারিখে শুধু আমার সাথে দেখা করার কথা ছিল আপনার। খুনী হিসেবে আমাকেই সে সন্দেহ করবে। এ-ধরনের কোন না কোন সতর্কতা আপনি অবলম্বন করেছেন, সন্দেহ নেই। সেজন্যে আপনাকে খুন করলে আমার সমস্যা মিটবে না, বরং বাড়বে।’

বৃদ্ধ ম্যানিকিন পীস স্তম্ভিত হয়ে গেছে। লোকটা যাদু জানে নাকি? ভাবছে সে। একজন উকিলের কাছে সত্যিই একটা চিঠি জমা রেখে এসেছে সে, তার মৃত্যু হলে খোলা হবে সেটা। চিঠিতে পুলিসকে জানানো হয়েছে তার বাড়ির বাগানের একটা বিশেষ পাথরের নিচে ছোট্ট একটা স্টীলের বাক্স আছে, তাতে পীসের নিজের হাতে তৈরি করা একটা তালিকায় লেখা আছে প্রত্যেকদিন তার সাথে দেখা করার জন্যে কার কার আসার কথা। প্রতিদিন তালিকায় নতুন নাম সংযোজিত হয়। আজকের তারিখে পীস লিখেছে: একজন ইংরেজ দেখা করতে আসবে, ভিনসেন্ট গগলের বন্ধু, প্রায় ছয় ফিট লম্বা, নিজের পরিচয় দেয় অরগ্যান নামে।

‘কিন্তু,’ বলছে রানা, ‘আমার সম্পর্কে কোন কথা কাউকে যদি বলেন, খবর পাব আমি, এবং ফিরে আসব। যত সাবধানই হোন, আপনি আমার হাত থেকে বাঁচতে পারবেন না। মনে রাখবেন, আমি চলে যাবার সাথে সাথে আমার অস্তিত্বের কথা সম্পূর্ণ ভুলে যেতে হবে আপনাকে।’

স্মিত হাসল বৃদ্ধ পীস। মৃদু কণ্ঠে বলল, ‘মশিয়ে, আমি শুধু একটা কথাই বলতে চাই। তা হলো, আমার তরফ থেকে আপনার কোন ক্ষতি হবে না।

‘ধন্যবাদ,’ বলে আর দাঁড়াল না রানা। ফাইবার সুটকেসটা ডেস্ক থেকে তুলে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল।

পীসের অফিস থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা মেন লাইন রেলওয়ে স্টেশনে চলে এল রানা, লেফট-লাগেজ অফিসে সুটকেসটা জমা দিয়ে টিকেট চেয়ে নিল, টিকেটটা ওয়ালেটের ভিতরের পকেটে আটকে রাখল পিন দিয়ে।

মৃদু স্বস্তির পরশ অনুভব করছে রানা। ফ্রান্স এবং বেলজিয়ামে ছুটোছুটি করে পরিকল্পনা এবং প্রস্তুতি পর্যায়ের কাজ শেষ করেছে ও। রাজসিক রেস্তোরাঁ সাইন-এ মধ্যাহ্ন ভোজন সারল ও। হেঁটে ফিরে এল অ্যামিগো হোটেলে। ফিরেই জিনিসপত্র গুছিয়ে নিল, মিটিয়ে দিল বিল। যেভাবে উঠেছিল হোটেলে ঠিক সেইভাবে বেরিয়ে এল ও-পরনে নিখুঁতভাবে ফিট করা চেক শার্ট, চোখে গাঢ় রঙের চশমা, পিছনে পোর্টারের হাতে দামী দুটো সুটকেস।

রাইফেলটা নিরাপদে রেখে যাচ্ছে ও লেফট-লাগেজ অফিসে। জাল পরিচয়পত্র তিনটে ওর স্যুটের একটা ভিতরের পকেটে রয়েছে। ট্যাক্সি নিয়ে এয়ারপোর্টে পৌছল ঠিক সময় মতই। লন্ডনগামী বোয়িং ব্রাসেলস ছাড়ল চারটের একটু পর। কাস্টমস অফিসাররা ওর একটা সুটকেস বেশ খুঁটিয়ে খুঁজে পেতে দেখল বটে, কিন্তু পেল না কিছুই। ডিনারে বেরোবার আগে সন্ধ্যা সাতটায় প্যাডিংটন প্যারেডে নিজের বাড়িতে শাওয়ার সারছে রানা।