সেই উ সেন – ১.৫

পাঁচ

ফ্রেঞ্চ সিক্রেট সার্ভিসের পুরো নাম :

Service de Documentation Exterieure et de Contre-Espionage, সংক্ষেপে SDECE. SDECE কয়েকটা ডিপার্টমেন্টে বিভক্ত, প্রতিটি আলাদা আলাদা এলাকা বেছে নিয়ে স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করে—তবে মূল উদ্দেশ্য প্রতিটি ডিপার্টমেন্টেরই এক, ফ্রান্সের বাইরে এবং ভিতরে এসপিওনাজ এবং কাউন্টার এসপিওনাজ পরিচালনা করা। এলাকা বিভিন্ন হলেও এক ডিপার্টমেন্ট আরেক ডিপার্টমেন্টের এলাকায় প্রয়োজন হলেই নাক গলায়, বা সাহায্যের জন্যে হাত পাতে।

সার্ভিস ওয়ান নির্ভেজাল ইন্টেলিজেন্সের ব্যাপারে মাথা ঘামায়, এই ডিপার্টমেন্ট আবার কয়েকটা ব্যুরোতে বিভক্ত। ডিপার্টমেন্টের সংক্ষিপ্ত সাঙ্কেতিক প্রতীক হলো R. R-1, ইন্টেলিজেন্স অ্যানালিসিস; R – 2,ইস্টার্ন ইউরোপ; R-3, ওয়েস্টার্ন ইউরোপ; R-4,আফ্রিকা; R-5, মিডল ইস্ট; R-6, ফার ইস্ট; R-7, আমেরিকা— ওয়েস্টার্ন হেমিসফেয়ার।

সার্ভিস টু-এর দায়িত্ব কাউন্টার এসপিওনাজ পরিচালনা করা। সার্ভিস থ্রী এবং সার্ভিস ফোর একটা অফিসে বসে কমিউনিস্ট শক্তিগুলো সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার ছক তৈরি করে। সার্ভিস সিক্স দেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে চোখ রাখে। দেশের প্রশাসন নিয়ে মাথা ঘামায় সার্ভিস সেভেন।

সার্ভিস ফাইভের এক শব্দে নামকরণ করা হয়েছে: অ্যাকশন। প্যারিসের উত্তর-পুবে Porte des L।las-এর কাছে বিশাল এক বিল্ডিং জুড়ে অ্যাকশন সার্ভিসের হেডকোয়ার্টার। এই হেডকোয়ার্টারের অধীনে কয়েক হাজার দুর্ধর্ষ এজেন্ট ফ্রান্সের ভিতরে এবং বাইরে কাজ করছে। এদের বেশিরভাগই কর্সিকান

বুদ্ধি, সাহস, স্বাস্থ্য সন্তোষজনক বিবেচিত হলে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট থেকে এদেরকে ছেঁকে তুলে নিয়ে পাঠানো হয় Satory Camp-এ, সেখানে মানুষ এবং বস্তুকে ধ্বংস করার জন্যে যত রকম কৌশল আছে সব শেখানো হয়। ওখান থেকে ট্রেনিং পেয়ে এরা স্মল আর্মস ফাইটিংয়ে, আন-আর্মড কমব্যাট কারাতে এবং জুড়োয় পারদর্শী হয়ে ওঠে। এরপর এরা রেডিও কমিউনিকেশন কোর্স শেষ করে, স্যাবোটাজের ধরন-ধারণ শেখে, টরচারসহ এবং টরচারবিহীন ইনটারোগেশন- পদ্ধতি আয়ত্ত করে, শেখে কিডন্যাপ করার কৌশল, পায় মানুষ খুন করার নিপুণ শিক্ষা।

এদের কেউ কেউ শুধু ফ্রেঞ্চ ভাষা জানে, অনেকেই একাধিক ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারে। দায়িত্ব পালনের সময় প্রয়োজনে খুন করার স্বাধীনতা রয়েছে এদের, এবং এ ক্ষমতা এরা প্রায়ই ব্যবহার করে থাকে।

SDECE-এর ডিরেক্টর, জেনারেল ইউজেনি গুইবাউড ফ্রেঞ্চ মেনল্যান্ডের অধিবাসী। কিন্তু সবক’টা ডিপার্টমেন্টের প্রধান কর্সিকান। এর অন্যতম কারণ সম্ভবত এই যে ফ্রেঞ্চ সিক্রেট সার্ভিসের প্রতিটি শাখায় কর্সিকানরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ আঞ্চলিক সচেতনতা কর্সিকানদের মধ্যে অত্যন্ত প্রকট, হেড অভ দি ডিপার্টমেন্ট তাদের নিজেদের একজন হওয়ায় গর্বিত কর্সিকানরা কাজে উৎসাহ বোধ করে।

সেদিন সকালে রানা যখন বারব্যান্ট এক্সপ্রেসে চড়ছে, ঠিক সেই সময় প্যারিসে নিজের চেম্বারে রিভলভিং চেয়ারে বসে ডেস্কের উপর ঝুঁকে একটা সদ্য আগত রিপোর্টে চোখ বুলাচ্ছে অ্যাকশন সার্ভিসের কর্সিকান হেড অভ দি ডিপার্টমেন্ট কর্নেল বোল্যান্ড। প্রকাণ্ডদেহী কর্নেলের মাথা জোড়া চকচকে টাক। মুখটা চৌকো। বাঘের মত ভয় পায় সবাই এই লোককে। সাংঘাতিক বদমেজাজী।

ছোট একটা রিপোর্ট, কিন্তু কর্নেলের টনক নড়িয়ে দেবার জন্যে যথেষ্ট। রিপোর্টটা এসেছে অ্যাকশন সার্ভিসের ইটালি-এজেন্টের কাছ থেকে। মেসেজের সারমর্ম হলো: আগস্ট মাসের আটাশ তারিখ থেকে চলতি মাসের চার তারিখ পর্যন্ত রানা এজেন্সীর রোম শাখায় নাকি অস্বাভাবিক একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। অ্যাকশন সার্ভিসের ওই এজেন্টের কানে এ সম্পর্কে একটা গুজব আসে চলতি মাসের ছয় তারিখে। গুজবটায় কোন নির্দিষ্ট তথ্য বা পরিষ্কার কোন বক্তব্য ছিল না। গুজবটার উৎস সম্পর্কেও উক্ত এজেন্ট কিছু জানতে পারেনি। যাই হোক, গুজবটা শোনা মাত্র রানা এজেন্সীর রোম শাখার উপর নজর রাখার ব্যবস্থা করা হয় এবং তদন্ত চালিয়ে দেখা যায় আগস্টের আটাশ তারিখ থেকে চলতি মাসের চার তারিখ পর্যন্ত ক্লায়েন্টদের জন্যে রানা এজেন্সী অজ্ঞাত কারণে বন্ধ ছিল। বন্ধ থাকলেও এজেন্সীর সদস্যরা দুই শিফটে বারো ঘণ্টা পর পর অফিস-বাড়িতে প্রবেশ করেছে এবং বেরিয়ে গেছে। তদন্তে আরও প্রকাশ, এজেন্সীর ব্রাঞ্চ-চীফ মারদাস্ত্রোয়ানি মোনিকা আলাবিনোর দোতলার বাসস্থান এবং নিচের অফিসে কড়া প্রহরার ব্যবস্থা করা হয়েছিল এই আট দিনের জন্যে। প্রহরীদের নেতৃত্বে সম্ভবত এজেন্সীর কর্মচারী সাবদেনা ম্যাটাপ্যান ছিল।’ এই আটদিন বাড়ি এবং অফিস ছেড়ে কোথাও তাকে কেউ বেরোতে দেখেনি। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক এবং রহস্যময়, তাই হেডকোয়ার্টারে রিপোর্ট করা হলো। রানা এজেন্সীর রোম শাখার বর্তমান আচরণ সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। চব্বিশ ঘণ্টা নজর রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

পর পর দু’বার পড়ে ফাইলটা বন্ধ করল কর্নেল বোল্যান্ড। রিভলভিং চেয়ারে হেলান দিয়ে একটা ডি নোবিলি চুরুট ধরিয়ে চোখ বুজল। চিন্তা করছে।

কয়েক বছর আগের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে কর্নেলের। নিজেকে সে কারও চেয়ে কম যোগ্য বলে মনে করে না বটে, কিন্তু একসাথে তিনটে প্রমোশন পেয়ে অ্যাকশন সার্ভিসের হেড অভ দি ডিপার্টমেন্ট হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। ধাপে ধাপে উন্নতি করে কোন দিনই সে এত বড় ক্ষমতার আসনে উঠতে পারত না, তার আগেই অবসর গ্রহণের সময় হয়ে যেত। যা সম্ভব নয়, কোন কালে সে আশা করেনি, তাই ঘটে গেছে তার জীবনে। দিনকে রাত করতে পারে, রাতকে করতে পারে দিন, কাপু সম্পর্কে এই কথাটা প্রায়ই শুনত সে। ঠিক বিশ্বাস করত না, কিন্তু তাই বলে কাপুর প্রতি আনুগত্য এবং শ্রদ্ধা প্রকাশে কখনও ত্রুটি করেনি সে। এই আনুগত্যেরই প্রতিদান দিয়েছেন কাপু উ সেন। যোগ্য সম্ভাব্য তিন প্রার্থীকে কোন রকম সুযোগ না দিয়ে তাকে তুলে এনে বসিয়ে দিয়েছেন এই ক্ষমতার সিংহাসনে। প্রশাসনে কাপুর সাংঘাতিক প্রভাব আছে, তা আরেকবার প্রমাণিত হলো। সে আজ দু’বছর আগের কথা।

অ্যাকশন সার্ভিসের সর্বময় কর্তা হবার পর থেকে তার ঘাড়ে ইউনিয়ন কর্সের কিছু কিছু গুরুতর কাজের দায়িত্ব এসে চাপে। কাপু উ সেন প্রচ্ছন্ন আভাস দিয়ে তাকে বলেছেন, তাঁর সম্ভাব্য উত্তরাধিকারীদের তালিকায় একেবারে নিচের দিকে কর্নেল বোল্যান্ডের নাম তিনি রাখবেন কিনা ভেবে দেখবেন, যদি সে সফলতার সাথে ইউনিয়ন কর্সের সেবা করে তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারে।

আজ থেকে দু’বছর আগে যে কাজগুলো কাপ্পু উ সেন তাকে দিয়েছিলেন, তার মধ্যে একটি ছিল মাসুদ রানা এবং তার ইনভেস্টিগেশন ফার্ম ‘রানা এজেন্সী’ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে ফাইল তৈরি করা। মাসুদ রানা সম্পর্কে মোটামুটি জানা ছিল কর্নেলের। বি.সি.আই-এর অন্যতম দুর্ধর্ষ এজেন্ট। বার্মায় উ সেনের সাথে একবার টক্কর খেয়েছিল। সুদর্শন, ক্ষিপ্রবুদ্ধি এই স্মার্ট বাংলাদেশীর উপর কাপু উ সেনের রাগ বা দ্বেষ কিছুই প্রকাশ পায়নি তখন। তিনি শুধু তথ্য সংগ্রহ করতে বলেই চুপ করে গিয়েছিলেন। তারপর হঠাৎ কিছুদিন আগে তাকে ডেকে পাঠিয়ে জানতে চাইলেন, ‘মাসুদ রানার খবর কি?’

প্রশ্নের আকস্মিকতায় একটু চমকে উঠলেও এক সেকেন্ড পর গড় গড় করে মাসুদ রানার সর্বশেষ সংবাদ দিল সে।

সুসজ্জিত বিশাল হলরূমে পায়চারি করছেন অন্ধ কাপু। জড়োসড়ো হয়ে একটা সোফার এক ধারে বসে আছে কর্নেল বোল্যান্ড। কাপুর সামনে এলেই শ্রদ্ধায়, বিস্ময়ে কেমন যেন অভিভূত হয়ে পড়ে সে। আর সব কাপুর সাথে বর্তমান কাপুর কোন তুলনাই হয় না। কাপু উ সেনকে ঠিক রক্ত-মাংসের মানুষ বলে মনে হয় না। অনেকেরই বদ্ধমূল ধারণা, অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী তিনি। দেবতাদের অকুণ্ঠ সমর্থন এবং সাহায্য পাচ্ছেন প্রতিমুহূর্তে। তা নাহলে তিনি ‘হও’ বললেই সব কিছু হয়ে যায় কিভাবে, ‘মরো’ বললেই শত্রুরা মরে যায় কিভাবে!

এর আগে কাপু উঁ সেনের এই উত্তেজিত মূর্তি কখনও দেখেনি কর্নেল বোল্যান্ড। লাল কার্পেটে মোড়া বিশ গজ লম্বা হলরুমে কয়েক সেট কালো চামড়া মোড়া সোফা, মেহগনি কাঠের আরাম কেদারা, চেয়ার-টেবিল, মিনিবার ইত্যাদির মাঝখানে দ্রুত পায়চারি করছেন তিনি। চোখের দৃষ্টি উপরের সিলিংয়ের দিকে। ছয় ফিট ছয় ইঞ্চি লম্বা, সরু কোমর, প্রশস্ত কিন্তু আড়ষ্ট কাঁধ, পিঠটা খাড়া ঢালের মত। পরনে ডাবল-ব্রেস্টেড অ্যাশ কালারের মোহায়ের স্যুট। মাথার চুল প্রতিভাবানদের যেমন থাকে, এলোমেলো। কাপুর চোখে গাঢ় রঙের সান গ্লাস, ওটার হ্যান্ডেল থেকে চিকণ একটা তার বেরিয়ে এসে ঢুকেছে কোটের ব্রেস্ট পকেটে। কোন কিছু না ছুঁয়ে, না ধরে, ঠাহর করার কোন রকম চেষ্টা না করে স্বাভাবিক মানুষের মত হলরূমের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত হাঁটাহাঁটি করছেন তিনি। মুখটা লাল হয়ে আছে। মৃদু, ভরাট গলায় কথা বলছেন, সারা ঘরে গমগম করছে তাঁর কণ্ঠস্বর ।

‘দুর্লভ একটা ব্যক্তিত্ব সন্দেহ নেই। প্রতিভাবান পুরুষ। কিন্তু মাসুদ রানার দুর্ভাগ্য, সে কর্সিকান হয়ে জন্মায়নি। জন্মালে কাপ হিসেবে আরেকজন যোগ্য পথ প্রদর্শককে পাবার সৌভাগ্য হত তোমাদের।’ হঠাৎ পায়চারি থামিয়ে কর্নেলের সামনে দাঁড়ালেন তিনি। ভাবাবেগ প্রকাশ করে ফেলে নিজের উপর একটু যেন অসন্তুষ্ট হয়েছেন বলে মনে হলো। ধীরে ধীরে অদ্ভুত একটা হাসি ফুটে উঠল তাঁর ঠোঁটে। ‘কথা দিয়েছিলাম প্রতিশোধ নেব। সময়টাও ভেবে রেখেছিলাম মনে মনে। সেই সময় এখন হয়েছে। অভিষেকের খুব বেশি দেরি নেই। কর্নেল, মাসুদ রানাকে দেয়া আমার সেই প্রতিশ্রুতি অভিষেক উৎসবের আগেই রক্ষা করতে চাই। তুমি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করো। জ্যান্ত চাই আমি ওকে।

দ্রুত উঠে দাঁড়াল কর্নেল বোল্যান্ড। অসীম শ্রদ্ধায় মাথাটা নত করে বলল, ‘তাই হবে, মশিয়ে।’

তর্জনী নেড়ে কর্নেলকে বসতে নির্দেশ দিলেন উ সেন। ‘তোমার ফাইলে ওর সম্পর্কে যে তথ্য নেই, সেটা জেনে নাও। যদি চায়, একাই ইউনিয়ন কর্সের মন্ত ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখে সে। সুতরাং, আঁট ঘাট বেঁধে, অত্যন্ত সাবধানে এগুতে হবে তোমাকে। ফাঁক পেয়ে যদি বেরিয়ে যেতে পারে, সাংঘাতিক বিপদ হয়ে দেখা দেবে পরে। আহত করে ধরতে হবে ওকে, তা নাহলে কোনদিন ধরা যাবে না। কি যে চিন্তা করলেন কাপু, তারপর বললেন, ‘বি. সি-আইয়ের কোন দায়িত্ব যখন তার কাঁধে থাকবে না, শুধু তখনই আহত করবে। আভাসে হলেও, বি. সি-আইকে আমরা বোঝাতে চাই, তাদের সাথে আমাদের কোন শত্রুতা নেই। যদিও তাতে লাভ হবে না কিছু, মাসুদ রানা খুন হলে তারা তাদের সমস্ত ক্ষমতা দিয়ে আমাদের পিছনে লাগবেই। কিন্তু, কূটনৈতিক পর্যায়ে বিরোধটা মিটিয়ে ফেলার সময় শক্তিশালী যুক্তি হিসেবে হাতে কিছু রাখতে পারলে ভাল হয়।’ কথা শেষ করে ঘুরে দাঁড়ালেন কাপু, দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন হঠাৎ, পিছন ফিরলেন না, বললেন, ‘কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে রিপোর্ট করার দরকার নেই। কাজ শেষ হয়ে গেলে তুমি নিজে এসে দেখা কোরো।’ যান্ত্রিক পুতুলের মত ধীর ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেলেন তিনি।

মাসুদ রানা সম্পর্কে তাকে অযথা সাবধান করেননি কাপু, কথাটা ক’দিন পরই বুঝতে পেরেছিল কর্নেল বোল্যান্ড। ইউনিয়ন কর্মের দুর্ধর্ষ কয়েকজন লোক পর পর কয়েকবার ব্যর্থ হলো মাসুদ রানাকে আহত করতে। তৃতীয়বার তো সব ক’টা মারাই পড়ল তার হাতে।

ব্যর্থতার খবর শুনে কোন মন্তব্য করেননি কাপু উ সেন। শিষ্যদের ওপর রাগ বা রানার উপর আক্রোশ, কিছুই প্রকাশ পায়নি তাঁর প্রশান্ত ভাব-ভঙ্গিতে। মৃদু কণ্ঠে বললেন, ‘একটা অ্যামবুশের প্ল্যান দিচ্ছি। আমি চাই দায়িত্বটা লেফটেন্যান্ট কর্নেল জাঁ থেরিকে দেয়া হোক।’

কর্নেল তখুনি বুঝতে পেরেছিল, মাসুদ রানাকে আহত করে ধরার ব্যাপারে কাপু উ সেন নিজস্ব কৌশলের কিছু অবদান রাখতে চাইছেন।

মাসুদ রানাকে আহত করার নিখুঁত একটা ছক পাকাপোক্ত ভাবে সাজিয়ে দিলেন কাপু উ সেন। প্ল্যানটা শুনেই বুকের ভিতর লাফ দিয়ে উঠেছিল কলজেটা লেফটেন্যান্ট কর্নেল জাঁ থেরির। কাপুর প্রতি শ্রদ্ধার মাত্রা সহস্র গুণ বেড়ে গিয়েছিল তার। এমন নিটোল, নিশ্ছিদ্র অ্যামবুশের পরিকল্পনা শুধু একজন প্রতিভাবানের মগজ থেকেই বেরোতে পারে।

কিন্তু সূর্যাস্তের সময় জানার জন্যে ভুল করে এক বছর আগের পঞ্জিকা দেখেই এমন সুন্দর প্ল্যানটার সর্বনাশ ঘটিয়ে ফেলল সে। ক্ষোভে, দুঃখে, ভয়ে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয় সে। কিন্তু তাকে মৃত্যুর দরজা থেকে টেনে সরিয়ে আনে কর্নেল বোল্যান্ড। জাঁ থেরিকে সে বলেছিল, ‘তোমার ব্যর্থতার খবর কাপুকে দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বরং, আরেকবার চেষ্টা করে দেখো। এবারও যদি ব্যর্থ হও, কথা দিচ্ছি, আত্মহত্যা করতে নিষেধ করব না। তখন তোমার পথ আমাকেও অনুসরণ করতে হবে কিনা।

একটু বিরতি নিয়ে জাঁ থেরিকে সে বলেছিল, ‘মাসুদ রানা রোম থেকে ঢাকায় ফিরে যাবে বলেই মনে করি। তার আগেই তোমরা চলে যাও ওখানে। গোপনে শুধু তোমাকে বলছি, আহত করার দরকার নেই—আপদটাকে একেবারে শেষ করে দাও। সাবধান, কাপু যেন একথা না শোনেন। তাহলে ঘাড়ে গর্দান থাকবে না আমার।

অবশেষে পঁচিশ তারিখে মেসেজ এল: টাইম বোমার বিস্ফোরণে মাসুদ রানা মারা গেছে। সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।

কিন্তু বিস্তারিত রিপোর্ট যখন এসে পৌঁছল, সন্তুষ্ট হতে পারল না কর্নেল বোল্যান্ড। অকুস্থল থেকে দুটো লাশ এবং একটা অচেতন দেহ অ্যাম্বুলেন্স যোগে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বটে, কিন্তু মৃত মাসুদ রানার লাশের চেহারা কেউ দেখেনি। জাঁ থেরি নিজে ছবি তুলেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে সাদা চাদরে ঢাকা দুটো লাশ। লম্বা চুল দেখে একটা লাশ চেনা যায়, ওটা রানা এজেন্সীর ঢাকা শাখার কর্মচারী মিস সালমার, কিন্তু অপর লাশটা চাদর দিয়ে পুরোপুরি ঢাকা, চেনার কোন উপায় নেই। আহত লোকটার নাম গিলটি মিয়া, রানা এজেন্সীর ঢাকা শাখার প্রধান, তাকে সরাসরি মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু মিস সালমা এবং অপর লাশটিকে নিয়ে দ্বিতীয় অ্যাম্বুলেন্স হাসপাতালে না গিয়ে, অনুসরণরত জাঁ থেরির লোককে ফাঁকি দিয়ে অন্য দিকে চলে যায়। সেই অ্যাম্বুলেন্স বা লাশ দুটোর আর কোন সন্ধান করা যায়নি। এখন, প্রশ্ন হলো, দ্বিতীয় লাশটি যে মাসুদ রানার ছিল, তার প্রমাণ কি?

কোন প্রমাণ নেই।

তবে, জাঁ থেরির বক্তব্য অনুযায়ী, দ্বিতীয় লাশটা রানার ছাড়া আর কারও হতেই পারে না। বোমা ফাটার সময় রানা অফিসেই ছিল, এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত। সেই মুহূর্তে অফিসে আর মাত্র দু’জন ছিল—সালমা এবং গিলটি মিয়া। সুতরাং, দ্বিতীয় লাশটা মাসুদ রানার ছাড়া আর কারও হবার কোন প্রশ্নই ওঠে না।

ঠিক। যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু মনের খুঁত খুঁতে ভাবটা তবু দূর হয়নি কর্নেল বোল্যান্ডের। সেজন্যেই রিপোর্ট করার জন্যে কাপুর সাথে দেখা করতে গিয়ে ঠিক যা ঘটেছে তাই বলেছে সে, মাসুদ রানাকে খুন করা হয়েছে, পরিষ্কার ভাবে এই কথাটা উচ্চারণ করেনি।

রিপোর্ট শুনে গম্ভীর হয়ে ছিলেন উ সেন। কোন মন্তব্য বা কোন প্রশ্ন করেননি তিনি। খানিক পর উত্তেজিতভাবে পায়চারি করতে করতে চাপা কণ্ঠে শুধু বলেছিলেন, ‘গেট আউট!’

ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে পালিয়ে এসেছিল সেদিন কর্নেল বোল্যান্ড। বুঝতে অসুবিধে হয়নি, তার উপর চটে গেছেন কাপু। কপাল মন্দ তার, কি আর করা!

ধীরে ধীরে চোখ খুলে ডি নোবিলি চুরুটটায় আবার অগ্নি-সংযোগ করল কর্নেল বোল্যান্ড। ডেস্কের উপর সদ্য আগত রিপোর্টের দিকে আরেকবার তাকাল। এর মানে কি? রানা এজেন্সীর রোম শাখা অফিসে আট দিনের জন্যে অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল—কেন? কেউ এসেছিল ওখানে? কে হতে পারে? রানা…ভয়ের একটা হিম শীতল স্রোত বয়ে গেল কর্নেলের শরীরে…তাই যদি হয়, ভাবছে সে, আত্মহত্যা করা ছাড়া কোন উপায় থাকবে না তার। যাই হোক, আসল রহস্যটা দ্রুত জানার চেষ্টা করতে হবে। এ ব্যাপারে অবহেলা করা চলে না। ইন্টারকমের সুইচ অন করে সেক্রেটারিকে নির্দেশ দিল, ‘রানা এজেন্সীর রোম শাখার সদস্য সাবদেনা ম্যাটাপ্যানের ফাইল পাঠাও। কুইক!’

এক মিনিট পরই দেখা গেল ম্যাটাপ্যানের ফাইল খুলে গভীর মনোযোগের সাথে পাঠ নিচ্ছে কর্নেল বোল্যান্ড। তথ্যগুলো এ ভাবে ফাইলবন্দী করা হয়েছে:

সাবদেনা ম্যাটাপ্যান

জন্ম: ১৯২৮

শিক্ষা: অ্যাকাডেমিক কোয়ালিফিকেশন নেই। ইংরেজী, ইটালি এবং কিছু কিছু বাংলা জানে।

জাতীয়তা: ইটালিয়ান।

চেহারার বর্ণনা: সাত ফিট লম্বা, প্রকাণ্ড গরিলার মত শরীর। কপালে লম্বা কাটা দাগ।

পেশাগত জীবন: প্রথম জীবনে কাউন্ট মারদাস্ত্রোয়ানি ডোনান্টো ল্যাগারাস ডি আলবিনোর এবং বর্তমানে তার মেয়ে মোনিকা আলবিনো খেদমত করেই জীবনটা কাটিয়ে দিচ্ছে।

বর্তমান পেশা: রানা এজেন্সীর সদস্য, মোনিকা আলবিনোর সেক্রেটারি কাম বডিগার্ড।

বর্তমান ঠিকানা : রোম, রানা এজেন্সীর শাখা অফিস।

অতিরিক্ত তথ্য: মোনিকা আলবিনো হাওয়া বদল করতে ফ্রান্সে আসে ১৯৭১ সালে, সাথে ছিল ম্যাটাপ্যান। সে সময় প্যারিসের একটা মেয়ের সাথে ম্যাটাপ্যানের ঘনিষ্ঠতা হয়, ঘনিষ্ঠতার ফলে মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। মেয়েটিকে সে বিয়ে করেনি। কিন্তু নিজ ঔরস জাত সন্তানকে যাতে ভূমিষ্ঠ হবার আগেই মেরে ফেলা না হয় তার জন্যে সে দায়িত্ব দিয়ে যায় তার এক নিঃসন্তান বন্ধু এবং বন্ধু-পত্নীকে। এরা ফ্রান্সেরই বাসিন্দা। এদের সাথে ম্যাটাপ্যানের একটা মৌখিক চুক্তি হয়। ভূমিষ্ঠ না হওয়া পর্যন্ত গর্ভে সন্তান ধারণ করার জন্যে মেয়েটিকে কিছু টাকা দেবার ব্যবস্থা হয়। টাকাটা ম্যাটাপ্যান এবং নিঃসন্তান দম্পতি ভাগাভাগি করে দেয়। ঠিক হয়, সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পর তাকে পালক-সন্তান হিসেবে গ্রহণ করবে তার বন্ধু এবং বন্ধু-পত্নী।

যথা সময়ে সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। একটি মেয়ে। এখন তার বয়স সাত। বছর দুই আগে মেয়েকে দেখার জন্যে ফ্রান্সে এসেছিল ম্যাটাপ্যান। সেই শেষ।

ম্যাটাপ্যানের বন্ধুর নাম: ভিক্টর কাউলাস্কি। ঠিকানা: দিসতে দ্যু বুলেভার্ড, প্যারিস।

মেয়েটার নাম: ভ্যালেন্টিনা!

মেয়ের খবর সংগ্রহ করার জন্যে ম্যাটাপ্যান নিয়মিত চিঠি লেখে। ভিক্টর কাউলাস্কিও উত্তর দেয়।

ফাইলটা পড়া শেষ হতেই একটা বুদ্ধি ঝিলিক দিয়ে উঠল অ্যাকশন সার্ভিসের হেড অভ দি ডিপার্টমেন্ট কর্নেল বোল্যান্ডের মাথায়। ম্যাটাপ্যানকে চাই তার। সে- ই বলতে পারবে রানা এজেন্সীর রোম শাখায় আট দিনের জন্যে অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল কেন। ম্যাটাপ্যানকে প্যারিসে টেনে আনার বুদ্ধি এসে গেছে তার মাথায়। ইন্টারকমের সুইচ অন করে সেক্রেটারিকে ডাকল সে, ‘আমার চেম্বারে এসো। এখুনি ‘