সেই উ সেন – ১.৬

ছয়

দুপুর। গার দ্যু নর্দ প্রায় নির্জন স্টেশন। রানাকে নিয়ে বিদ্যুৎবেগে ছুটে এসে থামল বারব্যান্ট এক্সপ্রেস ট্রেন। ট্যাক্সি নিয়ে প্যালেস দি লা ম্যাডেলিন ছাড়িয়ে ছোট কিন্তু সুরম্য একটা হোটেলে উঠল ও। সুপরিচিত এলাকার বিখ্যাত হোটেলগুলো এড়িয়ে যাবার অন্যতম কারণ, বেশ ক’দিন প্যারিসে থাকতে হবে ওকে, এ-সময় পরিচিত কারও চোখে পড়ে যেতে চায় না ও। রিসেপশনিস্টের সামনে কোন মেয়ে যদি হঠাৎ চিনতে পেরে ‘হাই রানা’ বলে কান ফাটায়, চোখ কপালে উঠে যাবে রিসেপশনিস্টের, কেননা রানা খাতায় নিজের নাম লিখিয়েছে অরগ্যান হিসেবে।

প্যারিসে পা দিয়েই একটা স্ট্রীট ম্যাপ কিনে নিয়েছে রানা। যে-সব বিশেষ বিশেষ জায়গা ঘুরে ফিরে দেখার ইচ্ছে, নামগুলো একটা নোটবুকে টুকে নিয়েছে। গতিবিধি এবং আচরণে নতুন ট্যুরিস্টদের স্বভাব বজায় রাখার চেষ্টা করছে ও উৎসাহী, মুগ্ধ একজন ট্যুরিস্টের মতই ঐতিহাসিক দর্শনীয় জায়গাগুলো নিয়মিত দেখতে যায়, তন্ময় হয়ে উপভোগ করে স্থাপত্য-শিল্পের মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য।

প্রথমে ধরল আর্ক ডি ট্রায়াম্পকে। ঘুরে ফিরে মনুমেন্ট দেখে অথবা কাফে দে এলিসিতে বসে প্লেস দে ইতোয়লিকে ঘিরে আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দালানগুলোর কার্নিস, ছাদ, উপরতলার সার সার জানালার গায়ে চোখ বুলায়। ঘন্টার পর ঘণ্টা বসে কফির কাপে চামচ দিয়ে চিনি নাড়ছে আর মনে মনে হিসেব কয়ছে উপরতলা থেকে আর্কের নিচের ইটারন্যাল ফ্রেমের দূরত্ব, অ্যাঙ্গেলস অভ ফায়ার, গুলি করে নিরাপদে কেটে পড়ার উপায়। এই চিরঞ্জীব অগ্নিশিখা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে নিহত ফ্রেঞ্চ সৈন্যদের ত্যাগ এবং অসমসাহসের প্রতি সম্মানস্বরূপ জ্বালানো হয়েছে। নিহতরা অধিকাংশই কর্সিকান, তাই রীতি অনুযায়ী অভিষেক অনুষ্ঠান শেষ করেই নতুন কাপ, দ্বিতীয়বার তিন বছর মেয়াদের জন্যে নির্বাচিত উ সেন, এখানে একবার আসবে ইউনিয়ন কর্মের শহীদ সদস্যদের প্রতি তার শ্রদ্ধার্ঘ্য জ্ঞাপনের জন্যে।

তিনদিন পর জায়গাটার সুবিধে অসুবিধে যোগ বিয়োগ করল রানা, ফলাফল সুবিধের নয় দেখে নিরাশ হলো। চতুর্থ দিন সকালে নতুন দ্রষ্টব্য স্থানের দিকে রওনা

হলো সে।

মন্ত ভ্যালেরিনে শহীদ ফ্রেঞ্চ রেজিস্ট্যান্স বাহিনীর গণকবরে এল রানা হাতে এক তোড়া ফুল নিয়ে, সাথে জুটিয়ে নিল একজন গাইডকে। প্রায় কিছুই শুনছে না ও, তবু দেড় মিনিটেই বকবক করে মাথা ধরাবার কারণ হয়ে দাঁড়াল লোকটা। গাইডরা সবাই জানলেও, ইউনিয়ন কর্সের কাপু অভিষেক শেষ করে এই শহীদ মিনারে ফুল দিতে আসে একথাটা অপ্রাসঙ্গিক বলেই তারা কেউ ট্যুরিস্টদেরকে জানাতে উৎসাহবোধ করে না। কিন্তু রানা বুদ্ধি করে একজন কর্সিকান গাইডকে বেছে নিয়েছে। কর্সিকান মাত্রই ইউনিয়ন কর্সের সদস্য, তা হয়তো নয়। কিন্তু এই জায়গার গুরুত্ব বিবেচনা করে এবং অভিষেক অনুষ্ঠানের নির্ধারিত সময় ঘনিয়ে আলায় ইউনিয়ন কর্স নিজেদের লোককে এখানে রাখবেই। দেখা গেল, রানার অনুমান মিথ্যে নয়। রানিং কমেন্ট্রি হঠাৎ হোঁচট খেয়ে থেমে গেল, গাইড খুব নিচু গলায়, প্রায় ফিস ফিস করে বলল, ‘মশিয়ের কি জানা আছে, ফ্রেঞ্চ রেজিস্ট্যান্সে শতকরা ষাটজন ছিল কর্সিকা দ্বীপের বাসিন্দা? সেজন্যে কর্সিকানরা গর্বিত। ওদের আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠান, বিশ্বজোড়া যার নাম ছড়িয়ে আছে, সেই ইউনিয়ন কর্সের প্রধান কাপু স্বয়ং এখানে আসেন শহীদদের প্রতি কর্সিকানদের শ্রদ্ধা জানাবার জন্যে।’

রানা কোনরকম আগ্রহ দেখাল না। শহীদ মিনারে ঢোকার পর পরই পাশের জেলখানার উঁচু পাঁচিলটা দেখে মন খারাপ হয়ে গেছে ওর। চারদিকের উঁচু বিল্ডিংগুলোর ছাদ থেকে শহীদ মিনারের মাঝারি আকারের চাতালটাকে আড়াল করে রেখেছে পাঁচিলটা। এই চাতালে দাঁড়িয়েই এক মিনিট মৌনতা অবলম্বন করে শহীদদের প্রতি সম্মান দেখাবে কাপু উ সেন। কিন্তু বাইরের কোন বহুতলা বাড়ির ছাদ থেকে তাকে দেখা যাবে না। একঘণ্টা পর গাইডকে বিদায় করে দিয়ে বেরিয়ে এল রানা।

প্লেস দে ইনভ্যালিড-এ এল রানা। দক্ষিণ দিকে প্রকাণ্ড হোটেল দি ইনভ্যালিড। এখানে নেপোলিয়নের কবর রয়েছে। বিশাল চৌরাস্তার পশ্চিম দিকটা সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করল রানার দৃষ্টিকে। রু ফ্যাবার্ত খুদে তেকোণা প্লেস দে সান্তিয়াগো দ্যু বিলির সাথে যেখানে মিশেছে, এককোণে একটা কাফেতে বসে পুরো একটা সকাল কাটাল রানা। ওর ঠিক মাথার উপর সাত কি আট তলা বিল্ডিংটা ১৪৬নং রু দে গ্রেনেল। দুই রাস্তার কোণে শেষ বাড়ি এটা। এর সামনেই রু দে গ্রেনেল রু ফ্যাবার্তের সাথে নব্বুই ডিগ্রী কোণ সৃষ্টি করে মিশেছে। বাড়িটার উপরতলা থেকে একজন অস্ত্রধারী, হিসাব কষে অনুমান করল রানা, বাগানের সামনের ভাগ, ভিতরের চাতালে ঢোকার প্রবেশ পথ, প্রায় সবটা প্লেস দি ইনভ্যালিড এবং দুই কি তিনটে রাস্তা গুলি করার আওতায় পেতে পারে। হাতের পাঁচ হিসেবে জায়গাটা উত্তরে যেতে পারে, কিন্তু বাধ্য না হলে এখান থেকে গুলি করবে না রানা। বাড়িটার যে-কোন প্রান্তে ছাদ বা জানালা থেকে পার্কিং এলাকা, প্রবেশ পথ, চাতাল, বাগান, কবর এবং রাস্তার দূরত্ব দুশো মিটারেরও বেশি। প্লেস দে সান্তিয়াগোর গায়ে প্রায় গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লাইম গাছগুলো, ১৪৬ নং বাড়িটার নিচের তলায় জানালায় দাঁড়ালে দৃষ্টিপথকে বাধা দেবে বিশাল ছাতার মত একটা শাখা, সেটার উপর বসে সাদা ফুলের মত পালক ছড়াচ্ছে ভওবান-এর স্ট্যাচুর কাঁধে ঝাঁক ঝাঁক কবুতর। কফির দাম চুকিয়ে দিয়ে কেটে পড়ল রানা।

একটা দিন কাটল নটরডেম ক্যাথেড্রালে। গলি, তস্য গলি, বাঁকানো লোহার সিঁড়ি, বাড়ির ছাদ, চিলেকোঠা – বিভিন্ন জায়গা থেকে ক্যাথেড্রালে ঢোকার জায়গাটাকে পরীক্ষা করল রানা। উৎসাহিত হবার মত একটা জায়গাও চোখে পড়ল না। সম্ভাব্য প্রতিটি জায়গাই খুব কাছে হয়ে যাচ্ছে। আবার প্লেস দ্য পারভিসের ছাদটা থেকে দূরত্ব প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি।

আজ সেপ্টেম্বরের আটাশ তারিখ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় সব শেষে এল রানা। রু দি রেনেস-এর দক্ষিণ প্রান্তের চৌরাস্তা এটা। আগের নাম ছিল প্লেস দে রেনেস, সিটি হলের ক্ষমতা গলিস্টদের হাতে আসার পর এই চৌরাস্তার নতুন নামকরণ করা হয়েছে, Place du 18 Ju।n 1940. একটা প্রাসাদোপম বাড়ির দেয়ালে সাদা মার্বেল পাথরের উপর কালো হরফে নামফলক, সেটার পাশে এসে দাঁড়াল রানা।

এই চৌরাস্তার সাথে জড়িয়ে আছে যুদ্ধের বেদনাদায়ক স্মৃতি। দক্ষিণ দিকে বিশালকায় কচ্ছপের মত গুঁড়ি মেরে রয়েছে রেলওয়ে স্টেশন গার মন্তপারনাস। ধীরে ধীরে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে রানা কংক্রিটের অতিকায় টারমাকের উপর। সার সার অসংখ্য যানবাহন মাকড়সার জালের মত জটিলতার সৃষ্টি করছে, হুড়মুড় করে গিয়ে পড়ছে বুলেভার্ড দে মন্তপারনাস, রুডি ওডেসা এবং রু দি রেনেস থেকেও অবিরাম স্রোতের মত যানবাহন বেরিয়ে এসে যোগ দিচ্ছে একই রাস্তায়, বুলেভার্ড দে মন্ত্রপারনেসে। ঘাড় ফিরিয়ে রু দে রেনেসের দু’পাশে দাঁড়ানো লম্বা, উঁচু দালানগুলোর দিকে তাকাল রানা। উঁচু দালানের উপরতলা থেকে চৌরাস্তাটা দেখা যায়। ধীরে ধীরে দক্ষিণ দিকে ফিরিয়ে আনল দৃষ্টি। স্টেশনের মস্ত এলাকা, রেলিং দিয়ে ঘেরা। প্রতিদিন গেটের ভিতরে ঢোকে হাজার হাজার গাড়ি, ট্রেন-যাত্রীদের নামিয়ে দেয়, তুলে নিয়ে বেরিয়ে আসে। একলক্ষ যাত্রী রোজ আসা যাওয়া করে এই স্টেশনে। প্যারিসের মেইন লাইন স্টেশনগুলোর মধ্যে এটা একটা। আগামী শীতে এই কোলাহল, এত ব্যস্ততা সব থেমে যাবে। এর ধোঁয়াটে ছায়ায় কত দিনের কত ঐতিহাসিক, ব্যক্তিগত স্মৃতি জমা হয়ে আছে, সব চিরকালের জন্যে মুছে সাফ হয়ে যাবে। পৌর পিতাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইতোমধ্যেই নতুন স্টেশন তৈরি করা হয়ে গেছে, পুরানোটাকে ধ্বংস করে ফেলা হবে।

রেলিংয়ের দিকে পিছন ফিরল রানা, নিচের রু দে রেনেস থেকে বেরিয়ে আসা চলমান চওড়া, সুদীর্ঘ যানবাহনের সারিগুলোর দিকে তাকাল। প্লেস দ্যু এইটিন জুন, নাইনটিন-ফরটির দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে ও। জানে, ইউনিয়ন কর্সের কাপু অভিষেকের নির্ধারিত দিনে শেষবারের মত এই জায়গাতে আসবেই। এক হপ্তা ধরে যে ক’টা জায়গা দেখেছে ও, প্রত্যেকটি জায়গাতে আসার সম্ভাবনা আছে কাপুর, কিন্তু কোন কারণ দেখা দিলে শেষ মুহূর্তে ওসব জায়গায় সে নিজে না গিয়ে প্রতিনিধি পাঠিয়েও আনুষ্ঠানিকতা সারতে পারে। কিন্তু এই জায়গার কথা আলাদা। কাপুকে এখানে আসতেই হবে: প্রতি তিন বছর পর পর, তিনশো বছর ধরে, এই জায়গায় অনুষ্ঠিত হয়ে এসেছে ইউনিয়ন কর্মের অভিষেক অনুষ্ঠান। নির্বাচিত কাপু এইখানে দাঁড়িয়ে শপথ নেবেন, সদস্যদের বীরত্বের স্বীকৃতি হিসেবে পদক দেবেন। আজ পর্যন্ত এই ব্যতিক্রম হতে দেখেনি কেউ। কাপু অসুস্থ হোক, তার জীবন বিপন্ন হোক, প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিক—কিছুতেই কিছু এসে যাবে না-সে আসবেই।

রু দে রেনেস-এর পশ্চিম প্রান্তের শেষ বাড়িটার সবচেয়ে উপরের তলা থেকে স্টেশনের সম্মুখ চাতালের দূরত্ব একশো তিরিশ মিটার। এলাকার কোণে দাঁড়ানো দুটো বাড়ির যে-কোন একটা বেছে নিতে হবে ওকে। উত্তর প্রান্তের প্রথম তিনটে বাড়ির উপরতলা থেকেও সম্মুখ চাতাল ফায়ারিং রেঞ্জের আওতায় পড়বে, কিন্তু ফায়ারিং অ্যাঙ্গেল নাক বরাবর না হয়ে বেশ খানিকটা কোনাকুনি হয়ে যায়। ওগুলোর পিছনে যে ক’টা বাড়ি রয়েছে, প্রতিটি সম্মুখ চাতাল থেকে অতিরিক্ত দূরে, সুতরাং বাতিল। বুলেভার্ড দে মন্তপারনাস-এর মুখের প্রথম তিনটে বাড়ির ব্যাপারটাও তাই। রাস্তাটা পুব দিক থেকে এসে চৌরাস্তার মাঝখান দিয়ে পশ্চিম দিকে চলে গেছে। প্রথম বাড়ি তিনটের যে-কোন একটা বেছে নিতে পারা যায়, কিন্তু সরাসরি নয়, কোনাকুনিভাবে রাইফেল তাক করে গুলি করতে হবে। এগুলোর পিছনের প্রতিটি বাড়ি অনেক বেশি দূর। রু দে রেনেস-এর পশ্চিম প্রান্তের দুটো দালান ছাড়া সম্মুখ চাতালটার কাছাকাছি আরেকটা মাত্র বিল্ডিং রয়েছে, সেটা স্টেশন বিল্ডিং। উপরের অফিস কামরার জানালাগুলোয় দাঁড়িয়ে থাকবে সশস্ত্র কর্সিকান গার্ড, কোন সন্দেহ নেই। সুতরাং, ওটাও বাদ।

পুব দিকের কোণে একটা কাফেতে গিয়ে বসল রানা। রু দি রেঁনেস-এর পশ্চিম প্রান্তের দালান তিনটে খুঁটিয়ে দেখে নিতে চাইছে ও। খোলা টেরেসে বসে আছে, কয়েক ফিট সামনে দিয়ে সগর্জনে তীর বেগে ছুটে যাচ্ছে যানবাহনের দীর্ঘ মিছিল। কফির অর্ডার দিল ও। সিগারেট ধরাল। রাস্তার অপর দিকের বাড়িগুলো দেখছে। হকারের কাছ থেকে খবরের কাগজ কিনল একটু পর। আবার কফির অর্ডার দিল। পড়ার ভান করে সামনে ধরে আছে কাগজটা, তাকিয়ে আছে রাস্তার ওপারে। তিন ঘণ্টা পর উঠল ও। শেষ প্রান্তের একটা রেস্তোরাঁয় বসে লাঞ্চ খাবার সময় পুব দিকের বাড়িগুলোর সম্মুখ ভাগ দেখে নিল। বিকেলটা এদিক থেকে ওদিকে হাঁটা-হাঁটি করে সম্ভাবনা হিসেবে যেগুলোকে বেছে নিয়েছে সেই দালানগুলোর সদর দরজার কাছ থেকে নিরীখ করে নিল। ধুলেভার্ড দে মন্তপারনাস-এর দিকে মুখ করে দাঁড়ানো বাড়িগুলোও কাছ থেকে দেখল ও। এগুলো সব অফিস বিল্ডিং, তৈরি, লোকজনের ব্যস্ততা খুব বেশি। নির্দিষ্ট তারিখের আগের দিনই অবশ্য গোটা এলাকার প্রায় সব ক’টা বাড়ি, অফিস বিল্ডিং খালি করার নির্দেশ দেয়া হবে। বাড়ি আর অফিস বিল্ডিংগুলোর মালিক ধনী কর্সিকানরা। কোনটা জায়গা কিনে তৈরি করা, কোনটা সরকারের কাছ থেকে লীজ নেয়া।

পরদিন আবার ফিরে এল রানা। দালানগুলোর সামনে দিয়ে হেঁটে এগিয়ে গেল, রাস্তা পেরিয়ে পেভমেন্টের একটা বেঞ্চে গাছের ছায়ায় বসল। ঠোঁটে সিগারেট, হাতে খবরের কাগজ, চোখের দৃষ্টি বাড়িগুলোর উপরতলার সম্মুখভাগে। পাঁচ কি ছয়তলা পর্যন্ত পাথর দিয়ে মোড়া, মাথার উপর লম্বা প্রাচীরের মত প্যারাপেট, তার উপর থেকে অত্যন্ত খাড়া ভাবে ঢালু কালো টালির ছাদ উঠে গেছে. চিলেকোঠাটাকে নিজের ছত্রছায়ায় নিয়ে। প্রাচীরের গায়ে লম্বা লম্বা ফাটল দেখা যাচ্ছে, ওগুলো জানালা। এক কালে চাকরবাকরদের কোয়ার্টার ছিল এগুলো। আজকাল গ্রীব পেনশন ভোগীরা থাকে, বাকিগুলো বেসরকারী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠানের অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ছাদ এবং জানালার উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখা হবে সেদিন, ভাবল রানা। ছাদে সশস্ত্র প্রহরী থাকাও বিচিত্র নয়। চিমনিগুলোর আড়ালে গুঁড়ি মেরে বসে থাকবে, বিনকিউলার দিয়ে নজর রাখবে উল্টো দিকের ছাদ আর জানালার দিকে। কিন্তু চিলেকোঠার নিচের ফ্লোরটা যথেষ্ট উঁচু, একজন লোক একটা কামরার অনেকটা ভিতরে অন্ধকারে বসে থাকলে উল্টোদিকের রাস্তা থেকে তাকে দেখতে পাবে না কেউ। একটু গরম পড়বে তখন, তাতে খোলা জানালা কারও মনে সন্দেহেরও উদ্রেক করবে না।

কিন্তু কামরার খুব বেশি ভির দিকে বসলে অ্যাঙ্গেল অভ ফায়ার অনেকটা আড়াআড়ি হয়ে যাবে, কেননা স্টেশনের সম্মুখ চাতালটা জানালার ঠিক সরাসরি উল্টো দিকে নয়, বেশ একটু এক পাশ ঘেঁষে। তাই রু দি রেনেস-এর দু’দিকের রাস্তার তৃতীয় বাড়ি দুটোর আশা ছেড়ে দিল রানা। অনেক কোনাকুনিভাবে গুলি ছুড়তে হবে।

হাতে এখন থাকল চারটে বাড়ি, এগুলোর মধ্যে থেকেই যে-কোন একটাকে বেছে নিতে হবে। বিকেলের মাঝামাঝি সময়ে গুলি করার সুযোগ পাবে বলে আশা করছে ও, সূর্য তখন পশ্চিম দিকে ঢলে পড়লেও তখনও আকাশের বেশ উপরে থাকবে, অন্তত স্টেশনের ছাদের উপরে তো থাকবেই—তার মানে, পুব ধারের বাড়িগুলোর জানালা দিয়ে রোদ ঢুকবে তখনও। ভেবেচিন্তে পশ্চিম দিকের দুটো বাড়ির যে-কোন একটা বেছে নেবার সিদ্ধান্ত নিল ও।

ঊনত্রিশে সেপ্টেম্বর, বিকেল চারটে পর্যন্ত অপেক্ষা করল রানা। লক্ষ করল, পশ্চিম দিকের উপরতলার জানালা গলে সরু এক আধ ফালি রোদ ঢুকছে, কিন্তু একই সময়ে পুব দিকের বাড়িগুলোর পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঝাঁ ঝাঁ রোদে পুড়ছে।

পরদিন দরজা আগলে বসে থাকা বুড়ীটাকে চোখে পড়ল রানার। ফ্ল্যাট সিস্টেমে ভাড়া দেয়া দুটো ব্লকের সদর দরজার কাছ থেকে কয়েক ফিট দূরে একটা বেঞ্চে বসে আছে ও। ওর পিছনে পেভমেন্ট, অসংখ্য লোকজন যাওয়া-আসা করছে। পেভমেন্টের পরই বাড়িটার দরজা। দরজার বাইরে একটা টুলে বসে আছে ভীষণ মোটা বুড়ী। প্যারিসের বাড়িওয়ালারা দরজা পাহারা দেবার জন্যে পঙ্গু লোক এবং বৃদ্ধা মহিলাকেই পছন্দ করে, অন্যতম কারণ এদেরকে স্বল্প বেতন দিলেই চলে। বুড়ী এদিক ওদিক তাকাচ্ছে না। মাথা নিচু করে উল বুনছে।

একবার কাছের একটা কাফে থেকে একজন ওয়েটার এসে ফ্লাস্ক ভর্তি গরম কফি দিয়ে গেল বুড়ীকে। দু’মিনিট গল্প করে গেল সে। বুড়ীর নাম মাদাম আৰ্থা, বিশ ফিট দূর থেকেও শুনতে পেল রানা।

বাড়ির ভিতর যারা ঢুকছে এবং বেরোচ্ছে, সবার সাথে সুন্দর সম্পর্ক বুড়ীর। কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে প্রায় সবাই জেনে নিচ্ছে বুড়ীর কুশল, বুড়ীও দাঁতহীন মাড়ি বের করে হাসছে, মাথা নাড়ছে, কুশলাদি জিজ্ঞেস করছে। বেলা দুটোর সময় কোত্থেকে এল কালো একটা বিড়াল। তাকে দেখেই একগাল হাসল মাদাম আর্থা। টুল থেকে নেমে দরজা পেরিয়ে সিঁড়ির নিচের জায়গাটায় মাথা নিচু করে ঢুকে গেল. সাথে সাথে বেরিয়ে এল হাতে এক বাটি দুধ নিয়ে। পেভমেন্টের উপর বাটিটা রাখতেই বিড়ালটা দুধ খেতে শুরু করল। তৃপ্তি ফুটে উঠল বুড়ীর দুই চোখে বিড়ালটার খাওয়া মন ভরে দেখছে।

চারটে বাজার একটু আগে উল বোনার সরঞ্জাম মস্ত ঘেরওয়ালা গাউনের সাইড পকেটে ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়াল মাদাম আর্থা। ছোট ছোট পা ফেলে পেভমেন্টের উপর দিয়ে হেঁটে একটা কনফেকশনারীর দোকানে গিয়ে ঢুকল। ঘাড় ফিরিয়ে বুড়ীকে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখে শান্তভাবে উঠে দাঁড়াল রানা। পেভমেন্টে ফেলে জুতো দিয়ে চেপে মারল সিগারেটটা, এই ফাঁকে দু’দিকটা দেখে নিল ভাল করে একবার। তারপর সহজ সাবলীল ভঙ্গিতে হেঁটে ঢুকে পড়ল অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকে। এলিভেটরে না চড়ে সিঁড়িটা বেছে নিল ও। নিঃশব্দ পায়ে উপরে উঠছে!

এলিভেটর শ্যাফটটাকে চক্কর মেরে উঠে গেছে সিঁড়িটা। প্রতিটি বাঁকে সিঁড়ির শেষ হয়ে গেছে ছোট্ট একটা হাফ ল্যান্ডিংয়ে পৌঁছে। প্রতি একতলা পর পর এই হাফ ল্যান্ডিংয়ের পিছনের দেয়ালে একটা করে দরজা, দরজার ওপারে স্টীলের ফায়ারএস্কেপ। পাঁচ এবং ছয়তলার মাঝখানে হাফ ল্যান্ডিংয়ে পৌঁছে পিছনের দরজাটা খুলে নিচের দিকে তাকাল রানা। ভিতরের একটা উঠানে গিয়ে নেমেছে ফায়ারএস্কেপের সিঁড়ি। উঠানটার চারদিকে অন্যান্য ব্লকের খিড়কী দরজা রয়েছে। যা কিছু দেখার দেখে নিয়ে দরজাটা নিঃশব্দে বন্ধ করে দিল রানা, জায়গা মত তুলে দিল সেফটি বারটা, তারপর হাফ ল্যান্ডিং থেকে কয়েকটা সিঁড়ি টপকে ছয়তলায় পৌঁছল। প্যাসেজের শেষ প্রান্তে বেশ চওড়া একটা সিঁড়ি দেখা যাচ্ছে, উঠে গেছে চিলেকোঠার দিকে। প্যাসেজের এক দিকে দুটো দরজা দেখা যাচ্ছে, এই ফ্ল্যাট দুটো থেকে ভিতরে উঠান দেখা যায়, অনুমান করল রানা। প্যাসেজের আরেক ধারে আরও দুটো দরজা, দরজার ভিতরের এই দুটো ফ্ল্যাট বাড়ির সম্মুখভাগের অংশ। দিক সম্পর্কে ওর অনুমান যদি সঠিক হয়, তাহলে, ভাবছে রানা, সামনের এই দুটো ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে নিচে তাকালে রু দি রেনেস দেখা যাবে, খানিকটা পাশে দেখা যাবে চৌরাস্তা এবং তার পিছনে স্টেশনের সম্মুখ চাতাল। নিচে থেকে কদিন ধরে এই ফ্ল্যাট দুটোর জানালার উপরই নজর রাখছে সে।

দরজায় কান পেতে অপেক্ষা করল রানা, কিন্তু দুটো ফ্ল্যাটের কোনটা থেকেই কোন শব্দ পেল না। তালা দুটো নেড়েচেড়ে পরীক্ষা করল। কাঠের ভিতর ঢোকানো, এবং দরজার কাঠও খুব মজবুত। কী-হোলে চোখ রেখে দেখল ও। চাবি ছাড়া খোলা অসম্ভব, দুটো তালাই ডাবল লকিং ধরনের। মাদাম আর্থার হাতে কালো ছোট্ট একটা পুরানো হাতব্যাগ দেখেছে ও, সেটায় প্রতিটা ফ্ল্যাটের একটা করে চাবি থাকার কথা, ভাবল ও।

কয়েক মুহূর্ত পর সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল রানা। ব্লকে ঢুকেছে পাঁচ মিনিটের বেশি হয়নি, কিন্তু এরই মধ্যে বুড়ী ফিরে এসেছে নিজের আস্তানায়। সিঁড়ির নিচে ছোট্ট একটা ঘর, দরজার ঝাপসা কাঁচ ভেদ করে ভিতরে চলে গেল ওর দৃষ্টি। চেয়ারে বসে রুটিতে মাখন অথবা জেলি লেপছে বুড়ী, অস্পষ্টভাবে দেখতে পেল। নিঃশব্দ, দীর্ঘ পদক্ষেপে দরজা টপকে বাইরে বেরিয়ে এল রানা।

বাঁ দিকে মোড় নিয়ে রু দি রেনেসের দিকে এগোচ্ছে ও। অ্যাপার্টমেন্টের আরও দুটো ব্লক এবং একটা পোস্ট-অফিসের পাশ ঘেঁষে এগিয়ে থামল কোণে, তারপর বাঁক নিয়ে সরু একটা রাস্তায় পড়ল। রাস্তাটার নাম রু লিটরে। পোস্ট- অফিসের পাঁচিল ঘেঁষে এগোচ্ছে এখনও সে। পাঁচিলের শেষ মাথায় মাথা-ঢাকা সরু একটা গলি। গলিমুখে দাড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাচ্ছে রানা। লাইটারের আগুন মুখের সামনে নাচানাচি করছে, এই ফাঁকে আড়চোখে গলির ভিতরটা দেখে নিচ্ছে ও। গলির গায়ে পোস্ট-অফিসের খিড়কী দরজাটা দেখা যাচ্ছে। শেষ মাথায় একটা রৌদ্র-করোজ্জ্বল উঠান। এক প্রান্তে ফায়ারএস্কেপের শেষ ধাপ ক’টার ছায়া দেখা যাচ্ছে। কষে লম্বা একটা টান মারল সিগারেটে রানা, তারপর সামনে এগোল। গুলি করে কোন্ পথে পালাবে এই প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছে ও।

রু লিটরের শেষ মাথায় পৌঁছে আবার বাঁ দিকে মোড় নিল রানা, রু দি ভ্যাগিরাদ ধরে ফিরে এল রাস্তাটা যেখানে বুলেভার্ড দে মন্তপারনাসের সাথে মিলিত হয়েছে। মোড়ের একধারে দাঁড়িয়ে মেইন রোডের এদিক ওদিক তাকাচ্ছে ট্যাক্সির জন্যে, এমন সময় একজন পুলিস মোটরসাইক্লিস্ট তীরবেগে ছুটে এসে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষে থামল রোড জাংশনে, লাফ দিয়ে নেমে স্ট্যান্ডের উপড় দাঁড় করাল মোটল সাইকেলটাকে, তারপর দু’হাত নেড়ে এবং তীক্ষ্ণ হুইসেল বাজিয়ে সমস্ত যানবাহনকে দাঁড়িয়ে পড়ার সিগন্যাল দিতে শুরু করল। রু দি ভ্যাগিরাদ থেকে বিশাল স্রোতের মত এগিয়ে আসছিল অসংখ্য যানবাহন। মুহূর্তে দাঁড়িয়ে পড়ল সবগুলো। স্টেশনের দিক থেকে বুলেভার্ডের দিকে ছুটে আসছিল আরেকটা যানবাহনের স্রোত, সেটাও স্থির হয়ে গেল। ডিউরক এর দিক থেকে যানবাহনের আরেকটা মিছিল বুলেভার্ডের দিকে আসছে, পুলিস সার্জেন্ট সেটাকে থামার নির্দেশ না দিয়ে হাত নেড়ে রাস্তার ডান দিকে সরে যাবার সিগন্যাল দিচ্ছে। মোটরসাইকেল থেকে তার নামার পর পনেরো সেকেন্ডও পেরোয়নি, এমন সময় ডিউরকের দিক থেকে ভেসে এল সাইরেনের শব্দ। দ্রুত এগিয়ে আসছে আওয়াজটা। কোণে দাঁড়িয়ে ঘাড় ফিরিয়ে বুলেভার্ড দে মন্তপারনাসের দীর্ঘ রাস্তাটার দিকে তাকাল রানা। রাস্তার দু’পাশে দু’লাইনে সার বেঁধে নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য যানবাহন, মাঝখানটা ফাঁকা। মাত্র ত্রিশ হাত দূরে হঠাৎ একটা মেয়ের উপর চোখ পড়ল রানার। নির্জন পেভমেন্টে একা দাঁড়িয়ে আছে, রানার দিকে পিছন ফিরে। দাঁড়াবার ভঙ্গিটা অত্যন্ত পরিচিত লাগছে। মেয়েটাকে চেনে নাকি সে? বেশ লম্বা মেয়েটা, ক্ষীণ কটি, প্রশস্ত কিন্তু সুগঠিত নিতম্ব, ঝিলিক দিয়ে উঠল স্মৃতিভাণ্ডারে একটা কণা-চিনতে পারছে রানা মেয়েটাকে। সিলভিও পিয়েত্রোর বোন ও, লুইসা পিয়েত্রো। সিলভিওর গ্লাস ফ্যাক্টরি ছিল ভেনিসে, কোসানোস্ট্রার পক্ষে কাজ করত। ভাই-অন্ত-প্রাণ এই লুইসা পিয়েত্রো, কিন্তু ভেনিসে রানাকে দেখে হৃদয়টা মচকে যাওয়ায় সাংঘাতিক দুর্বল হয়ে পড়েছিল সে একবার, তাতে সিলভিও এবং কোসানোস্ট্রাকে বোকা বানাতে বেশ একটু সুবিধে হয়েছিল রানার। এক সেকেন্ডে আরও অনেক কথা মনে পড়ে গেল। দ্রুত এগোল রানা লুইসা পিয়েত্রোর দিকে। দামী মিনি স্কার্ট আর হাফ হাতা ব্লাউজ পরে আছে, হাত দুটো বুকের কাছে আড়াআড়ি ভাবে ভাঁজ করা। দাঁড়িয়ে আছে আশ্চর্য এক দৃঢ়, প্রায় আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে। পাঁচশো গজ আরও সামনে, বাঁক নিয়ে ডিউরকের জাংশনে তীব্রবেগে বেরিয়ে এল এক ঝাঁক মোটরসাইকেল, সেগুলোর ঠিক পিছনেই হুড তোলা কয়েকটা প্রাইভেট কার। মোটরসাইক্লিস্টের মাথায় হলুদ হেলমেট, পরনে বুক খোলা শার্ট, শার্টের ভিতরে দেখা যাচ্ছে শোল্ডার হোলস্টারে গোঁজা রিভলভার! হুড় তোলা প্রতিটি গাড়িতে সামনে দু’জন পিছনে দু’জন আরোহী, প্রত্যেকের কঠোর চেহারা, রাস্তার দু’দিকে তীক্ষ্ণ নজর। হাতগুলো উরুর মাঝখানে পড়ে আছে, প্রয়োজন হলেই কারবাইন তুলে নেবে। প্রাইভেট কারের পিছনে পাশাপাশি এই লাইনে তিনটে গাড়ি, দু’পাশে দুটো হুড তোলা বুইক, মাঝখানে একটা রোলসরয়েস। রোলসরয়েসের পিছনে আরেক ঝাঁক হুড তোলা গাড়ির পাহারা। সেগুলোর পিছনে আবার দশজন মোটরসাইক্লিস্ট। গোটা দলটা সমান গতিতে ছুটে আসছে রাস্তা ধরে রানার দিকে।

হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল রানা। যা ভেবেছিল তা নয়, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট জিসকার দেস্তা আসছেন না। আসছে ইউনিয়ন কর্সের কাপু দোর্দণ্ডপ্রতাপ উ সেন।

রোলসরয়েসটা কাছে চলে এসেছে। বুলেট প্রুফ জানালার কাঁচ ভেদ করে ভিতরে ঢুকে গেল রানার দৃষ্টি। এক সেকেন্ডের জন্যে উ সেনের মুখটা দেখতে পেল রানা। চোখে গাঢ় রঙের সানগ্লাস। স্যাঁত করে সামনে থেকে বেরিয়ে গেল রোলসরয়েস। ‘এরপর টেলিস্কোপ দিয়ে খুব কাছে এনে মুখটা দেখব তোমার, এবং…’ চিন্তায় বাধা পড়ল রানার। লুইসা মাত্র পাঁচ গজ সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রানাকে ছাড়িয়ে চলে গেছে তার দৃষ্টি, এখনও অনুসরণ করছে রোলসরয়েসটাকে। লুইসার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে তীব্র ঘৃণায়।

চোখাচোখি হলো এক সেকেন্ডেরও কম সময়ের জন্যে। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল লুইসা পিয়েত্রো, পরমুহূর্তে ঝট্ করে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল আবার। এগিয়ে এল দ্রুত। ক্রোধের জায়গায় বিস্ময় ফুটে উঠেছে চেহারায়। ‘মাই গড! রানা? তুমি এখানে?’

‘হ্যাঁ,’ মৃদু হেসে বলল রানা। একটা হাত ধরল লুইসার। ‘তুমিও যেখানে আমিও সেখানে। মনের অবস্থাও দু’জনের একই রকম।’ একটু বিরতি নিল রানা, লক্ষ করল ভুরু কুঁচকে উঠছে লুইসার। তারপর বলল, ‘প্রতিশোধ নেবার কথা ভাবছ, তাই না?’

‘মানে?’ হাত ছাড়িয়ে নিল লুইসা, এক পা পিছিয়ে গেল। ‘তোমার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কি….

‘আমি সব জানি,’ মৃদু কণ্ঠে বলল রানা। ‘এখানে নয়, চলো কোথাও গিয়ে বসি।’

কি সব জানো তুমি? কি যা তা বলছ?’

‘তোমার ভাই ছাড়া দুনিয়ায় আর কেউ ছিল না তোমার। সেই ভাইটি আজ নেই। খবরটাই শুধু পেয়েছি আমি. লুইসা। আর কিছু জানি। উ সেনের সাথে লাগতে গেল কেন সিলভিও

অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল লুইসা। চোখে পানি এসে গেছে। তুমি যাও চাপা গলায় বলল সে। তুমিও তো শত্রু। তুমি যাও, রানা।

কাঁধ ঝাঁকাল রানা। হ্যাঁ, শত্রুতা ছিল। কিন্তু সিলভিওর সাথে, তোমার সাথে নয়। ঠিক আছে. আমাকে বিশ্বাস করতে যদি ভয় পাও চলে যাচ্ছি! তুমিও ঘরে ফিরে গিয়ে নিশ্চিন্তে অপেক্ষা করো, ব্যবস্থা করছি আমি। অল্পদিনের মধ্যেই সুখবর পাবে।’ কথাগুলো বলে আর দাঁড়াল না রানা, ঘুরে উল্টোদিকে হাঁটা ধরল।

‘শোনো।’

দাঁড়াল রানা। এগিয়ে এল লুইসা। ‘কিসের সুখবরের জন্য অপেক্ষা করব তা তো বললে না?’

তোমার জন্যে একটা খবরই সুখবর হতে পারে, সেটা কি তা আমি জানি, ‘ বলল রানা, ‘ভেঙে-চুরে বলার দরকার আছে কি?’

‘তার মানে তুমিও…তুমিও?’

‘হ্যাঁ,’ বলল রানা। ‘আমিও।’

‘তোমাকে বিশ্বাস করতে পারি?’

‘পারো।’

রানার হাত ধরল লুইসা। ‘কোথাও নিয়ে চলো আমাকে, বসব।’

কাছাকাছি একটা কাফেতে ঢুকল ওরা, বসল কোণের এক টেবিলে। কফির অর্ডার দিল রানা। পাশে বসে আছে লুইসা। নিচু গলায় কথা বলছে।

সিলভিওর সাথে উ সেনের ব্যক্তিগত কোন বিরোধ ছিল না। কোসানোস্ট্রার ড্রাগ বিজনেস ধ্বংস করে দিয়ে বাজারটা দখল করতে চেয়েছিল উ সেন। স্রেফ এই উদ্দেশ্যে সিলভিওকে খুন করেছে সে। ব্যাপারটা ঘটার আগে কিছুই জানা যায়নি। ঘটার পরও হত্যাকাণ্ডের রহস্য মীমাংসা করতে পারেনি কোসানোস্ট্রা। প্রায় তিন মাস চেষ্টা করে ব্যক্তিগতভাবে এটুকু জানতে পেরেছে লুইসা। কিভাবে?

রানার প্রশ্ন শুনে এদিক ওদিক মাথা দোলাল লুইসা। ‘অনেক বলে ফেলেছি। এবার তোমার কথা শুনব। উ সেনের ওপর তোমার কিসের রাগ? কি করতে চাইছ তুমি?’

কফি দিয়ে চলে গেল ওয়েটার।

‘দুঃখিত, লুইসা,’ সিগারেট ধরিয়ে বলল। ‘রাগের কারণটা বলতে পারি, কিন্তু কি করতে যাচ্ছি তা বলতে পারি না। তোমাকে বিশ্বাস করি না, তা নয়। আমি কোন রকম ঝুঁকি নিতে চাই না।’

মুখটা কালো হয়ে গেল লুইসার। ‘সব কথা শুনলে আমি হয়তো তোমাকে সাহায্য করতে পারতাম।

‘সাহায্য করার অবস্থায় আছ নাকি?’

‘আছি,’ চাপা, কিন্তু দৃঢ় গলায় বলল লুইসা পিয়েত্রো।

কাজের মেয়ে,’ প্রশংসার সুরে বলল রানা। ‘সাহায্য করতে চাওয়ার জন্যে ধন্যবাদ। কোন সাহায্য আমার দরকার হবে না। আমি একাই পারব।’

আমি বিশ্বাস করি না।’ স্পষ্ট জানিয়ে দিল মেয়েটা। উ সেনকে তুমি আন্ডারএস্টিমেট করছ। ওর ক্ষমতা সম্পর্কে তোমার কোন ধারণাই নেই। তোমার মত এক হাজার মাসুদ রানাকে জুতার তলায় পিষে মারতে এক ঘণ্টার বেশি লাগবে না ওর। তুমি…’

আঁতকে উঠল রানা। ‘থাক, থাক। রীতিমত ভয় লাগছে, আর শুনতে চাই না।’ কথা শেষ করেই হোঃ হোঃ করে হেসে উঠল নিজের রসিকতায়।

ভুরু কুঁচকে রানাকে তীক্ষ্ণ চোখে দেখছে লুইসা। একটু সঙ্কোচের সাথে বলল। ‘না, উ সেন সম্পর্কে তোমার কোন ভুল ধারণা থাকতে পারে না, আমারই ভুল হয়েছে। কিন্তু….

বাড়ি গিয়ে নাক ডেকে ঘুমাও,’ বলল রানা। ‘এর বেশি তোমাকে কিছু বলার নেই আমার, মনোবাঞ্ছা পূরণ হবে অচিরেই। এসো, উঠি এবার।

‘এক মিনিট,’ দ্রুত বলল লুইসা। ‘ঠিক আছে, কিভাবে কি করতে যাচ্ছ শুনতে চাইব না। কিন্তু বিশ্বাস করো, তোমাকে আমি সাহায্য করতে পারি। কিভাবে, তা খানিকটা শুনলেই বুঝতে পারবে তুমি।

‘বেশ। শুনতে আপত্তি নেই।

ফ্রেঞ্চ সুরেতের কর্নেল প্যাপেনের নাম শুনেছ?’

‘সুরেতের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর জেনারেল,’ ভুরু একটু কুঁচকে উঠেছে রানার। ‘মেয়েদের ব্যাপারে দুর্বল বলে বদনাম আছে।

ঠিক ধরেছ। ওকে গেঁথেছি আমি। হাবুডুবু খাচ্ছে আমার প্রেমে। এবার বুঝেছ?’

খানিকক্ষণ চিন্তা করল রানা। তারপর বলল, উঁহুঁ, তেমন কোন সাহায্য তুমি করতে পারবে না। তবু, ছোট্ট একটা অ্যাসাইনমেন্ট দেব তোমাকে। টেলিফোনে যোগাযোগ করা যাবে তোমার সাথে?’

‘যাবে,’ বলল লুইসা।

‘নাম্বারটা দাও আমাকে। আমি লন্ডন থেকে যোগাযোগ করব তোমার সাথে। কথাবার্তা হবে না, শুধু একটা টেলিফোন নাম্বার দেব তোমাকে। কোথাও টুকে রেখো না, মনে রেখো শুধু। ফ্রেঞ্চ পুলিসের গতিবিধি যদি আমার বিরুদ্ধে যায়, এবং সে সম্পর্কে জরুরী কোন তথ্য যদি জানতে পারো, শুধু তখনই ওই নাম্বারে ডায়াল করে জানাবে। অপর প্রান্তে কেউ রিসিভার তুলবে না, সুতরাং কোন প্রশ্ন কোরো না, উত্তর পাবে না। স্রেফ তোমার যা বলার বলে রিসিভার নামিয়ে রাখবে। বুঝেছ?’

‘পানির মত,’ বলল লুইসা। ভাল কথা, জানো তো ফ্রেঞ্চ পুলিস, সিক্রেট সার্ভিস, অ্যাকশন সার্ভিস-সবগুলোতে কর্সিকানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। উ সেন চাইলে সবগুলো প্রতিষ্ঠানকে তোমার বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলতে পারে।’

উঠে দাঁড়াল রানা, ‘মনে করিয়ে দেবার জন্যে ধন্যবাদ, লুইসা। কাউন্টারে বিল মিটিয়ে দিয়ে যাচ্ছি আমি। তুমি একটু পর বেরিয়ে যেয়ো। আবার দেখা হবে। বলে আর দাঁড়াল না রানা।

কিছু বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিয়ে চুপচাপ বসে থাকল লুইসা পিয়েত্রো। দু’জনকে এক সাথে কেউ দেখুক, রানা তা চাইছে না, বুঝতে পেরেছে সে। বিল মিটিয়ে দিয়ে একবারও পিছন ফিরে না তাকিয়ে দ্রুত কাফে থেকে বেরিয়ে গেল রানা।

আচ্ছন্নের মত কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে বসে থাকল লুইসা। হঠাৎ দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পেল সে, রানা যা করতে চাইছে তা আত্মহত্যারই নামান্তর। চেয়ার ছেড়ে ত্রস্ত পদে কাফের দরজার দিকে এগোল সে। এ স্রেফ পাগলামি! এখনও সময় আছে. ফিরিয়ে আনা যায় রানাকে।

কাফে থেকে দ্রুত বেরিয়ে এসে পেভমেন্টে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক অস্থিরভাবে তাকাচ্ছে লুইসা। নেই রানা! এরই মধ্যে জনারণ্যে মিশে গেছে সে। লুইসার ইচ্ছা হলো রানার নাম ধরে চিৎকার করে ডাকে। তারপরই মনে হলো, ডেকেও লাভ নেই, শুনতে পেলেও সাড়া দেবে না রানা, ফিরে সে আসবে না।

চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এল লুইসার। ভাই গেছে, একই পথে রওনা হয়ে গেছে আরেক লোক। বড় অদ্ভুত ছিল লোকটা, যাকে দেখে সেই যে হৃদয় মচকে ছিল, সে-আঘাত আজও সারেনি, কোনদিন সারবে না। যার জন্যে তার অন্তরের অন্তস্তলে চিরকাল বিরাজ করবে অদ্ভুত এক দুর্বলতা।