৯. শ্যামবাজার থেকে

শ্যামবাজার থেকে পিন্টু আর রতন এলো ইসলামপুর। অনেকগুলো জুয়েলারি শপ এখানে। বেশির ভাগ স্বর্ণকারই হিন্দু। ফাঁকে ফাঁকে দু একটা মুসলমানদের দোকানও আছে। এসব দোকানের মালিকও আগে হিন্দু ছিলো। দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে তারা দোকান বিক্রি করে দিয়ে গেছে।

ইসলামপুরের জুয়েলারি পাড়ার একটা দোকানও ভোলা ছিলো না। দু বছর আগে বাবরী মসজিদ ভাঙা হয়েছে বলে এক পত্রিকা গুজব রটিয়ে রায়ট বাঁধিয়ে দিয়েছিলো। তখন ইসলামপুরের বেশ কয়েকটা সোনার দোকান লুট হয়েছে। জুয়েলারি পাড়ার মাথায় কোতোয়ালি পুলিশ ফাঁড়ি। পিন্টু লক্ষ্য করলো এ পাড়ায় লোকজনের চলাফেরাও খুব কম। সবাই আশঙ্কা করছে–কখন হামলা হয়। রতনের বড় ভাই যতীন কাজ করে সাহাদের দোকানে। অন্য সব দোকানের মতো সাহাদের দোকানও বন্ধ। পিন্টু বললো, সাহারা কোথায় থাকে?

ঠাটারি বাজারের বামাচরণ চক্রবর্তী রোডে।

যাবি ওখানে?

তোর যদি অসুবিধে না হয় চল।

অসুবিধে আর কি! রিকশায় করে চলে যাবোয়

রতন লক্ষ্য করেছে শহরে লোকজন আর রিকশা বাসের সংখ্যা অন্য দিনের চেয়ে কম। ঈদের পরদিন রাস্তাঘাট যেমন ফাঁকা থাকে, অনেকটা সেরকম মনে হচ্ছে, তবে লোকজনের চেহারায় উদ্বেগ আর উত্তেজনা। ওদের দিকে কেউ লক্ষ্য করেনি। বড়দার কাছে শুনেছে একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সৈন্যরা নাকি কাপড় খুলে দেখতো কে হিন্দু আর কে মুসলমান। প্রথম দিকে হিন্দু পেলেই মেরে ফেলেছে। পরে অবশ্য মুসলমানদেরও রেহাই দেয়নি, সব বাঙালিই ওদের শত্রু ছিলো।

পিন্টুদের রিকশা রথখোলার মোড় পেরিয়ে নবাবপুরের রাস্তায় বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে তখনই মানসী সিনেমার ওদিকে হইহল্লার শব্দ শোনা গেলো। নারায়ে তকবির….. অস্পষ্ট শ্লোগানও শোনা গেল। মোগলটুলির ভেতর থেকে পাঁচ ছটা লোক লোহার রড হাতে দৌড়ে গেলো সেদিকে। পিন্টু বললো, নির্ঘাত কারও দোকান লুট হচ্ছে।

রতন বললো, আর গিয়ে কাজ নেই। চল, এখান থেকে ফিরে যাই।

পিন্টুদের রিকশা ছাড়া ফুলবাড়িয়ার দিকে আর কোনো রিকশা বা গাড়ি যাচ্ছিলো না। অবশ্য এমনিতে এটা ওয়ান ওয়ে রোড। ফাঁকা ছিলো বলে পিন্টুদের রিকশাওয়ালা ইংলিশ রোড হয়ে ঘুরে না গিয়ে এদিক দিয়ে যাচ্ছিলো। উল্টো দিক থেকে জোরে প্যাডেল মেরে এগিয়ে আসছিলো এক কমবয়সী রিকশাওয়ালা। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ছেলেটা পিন্টুদের বয়স্ক রিকশাওয়ালাকে বললো, চাচা, ওইদিকে কই যাও?

ঠাটারি বাজারের মন্দিরে আগুন দিছে। হিন্দুগো দোকান লুট ওইতাছে। পুলিশ ধাওয়া দিছে। বলতে বলতে ওদের পাশ কাটিয়ে রথখোলার দিকে চলে গেলো ছোকরা রিকশাওয়ালা।

ছেলেটার কথা শুনে পিন্টুদের রিকশাওয়ালা ঘুরে তাকালো। বললো, আপনেরা কি আরও যাইবেন, না রিকশা ঘুরামু?

পিন্টু বললো, রিকশা ঘোরান। লক্ষীবাজার চলেন।

গতকাল ও স্কুলের ভেতরে যেতে পারেনি। ব্রাদাররা নিশ্চয় বলতে পারবেন ওদের হিন্দু টিচাররা কেমন আছেন। কথাটা ভাবতে গিয়ে নিজের কাছেই নিজেকে ছোট মনে হলো পিন্টুর। ওদের স্কুলে হিন্দু টিচারের সংখ্যা কম নয়, কিন্তু আগে কখনও ভাবেনি কে হিন্দু কে খৃষ্টান আর কে মুসলমান। টিচাররা নিজেরাও কখনও ছাত্রদের এসব বুঝতে দেননি। ওদের স্কুলে ঈদে মিলাদুন্নবীতে মিলাদ হয়। হিন্দু ছাত্ররা চাঁদা না দিলেও মিষ্টি খেতে যায়। সরস্বতী পূজার আয়োজন হিন্দু ছেলেরা করে, তবে মিষ্টি খাওয়ার সময় কোনো বাছ বিচার নেই। খৃষ্টান ছেলেদের সঙ্গে হিন্দু মুসলমান সবাই মিলে বড়দিন করে।

স্কুলের দিকে ওদের রিকশা যত এগিয়ে যাচ্ছিলো পিন্টুর ততই খারাপ লাগছিলো। ওখানে গিয়ে কী শুনবে, কী দেখবে কে জানে! ঠাটারি বাজারের মন্দিরে আগুন দেয়ার খবর পেয়ে নবাবপুরের বেশির ভাগ দোকানই বন্ধ হয়ে গেছে। হিন্দুর দোকানের আশেপাশে মুসলমানদের দোকানের সামনে লোকজন লাঠি হাতে পাহারা দিচ্ছে। একথা সবাই জানে আগুন হিন্দু মুসলমান চেনে না। হিন্দুর দোকানে আগুন লাগলে সে আগুন পাশের দোকানেও ছড়াবে। আগে থেকে সবাই নিজের গরজেই সাবধান হয়ে গেছে, যাতে কোনো দোকানে কেউ আগুন দিতে না পারে।

পিন্টুদের স্কুলের গেট ভেতর থেকে বন্ধ ছিলো। বাইরে থেকে কয়েকবার লোহার গেট-এ শব্দ করলো পিন্টু। গেট এর গোল ছিদ্র দিয়ে বুড়ো দপ্তরি কৃষ্ণপদর ভয়ার্ত চোখ দেখা গেলো। পিন্টু আর রতনকে দেখে আশ্বস্ত হয়ে ছোট গেটটা খুলে দিলো কৃষ্ণপদ। রতনকে দেখে বললো, তোমরা ভালো আছো রতন?

রতন মাথা নেড়ে সায় জানালো। পিন্টু জিজ্ঞেস করলো, স্যারদের খবর কিছু জানেন?

কৃষ্ণপদ বললো, ব্রাদার টমাস গিয়া ঘোষাল স্যার, নন্দী স্যার আর ভৌমিক স্যাররে ইস্কুলে নিয়া আসছে।

স্যাররা কোথায়?

ক্লাস ওয়ানের কামরা খালি কইরা ওনাগো থাকনের ব্যবস্থা করছি।

স্কুলের ভেতরে একেবারে পুব কোণে ক্লাস ইনফ্যান্ট আর ওয়ানের ক্লাস বসে একতলা এক বাড়িতে। পাশা-পাশি দুটো ঘর, সামনে বড় বারান্দা। পিন্টুরা গিয়ে দেখলো বারান্দায় পাতা দুটো বেঞ্চে বসে আছেন স্যাররা। সবার পরনে পায়জামা, গায়ে চাদর, মুখে দু দিনের না কামানো খোঁচা খোঁচা দাড়ি। স্কুলের এই তিন স্যার একা থাকেন। একজন বিয়ে করেননি। অন্য দুজনের স্ত্রী মারা গেছেন অনেক আগে। ছেলেমেয়েরা থাকে বাইরে বাইরে। স্কুলের কমবয়সী স্যাররা সবাই প্যান্ট শার্ট পরেন। বুড়ো হিন্দু স্যাররা সব সময় ধুতি পাঞ্জাবি পরেন। আজ সবার পরনে পায়জামা দেখে রতনের বুকটা ধক করে উঠলো। ওর মনে হলো বাবা যদি আজ বাইরে যেতে চান তাহলে তাকেও পায়জামা পরতে হবে। বড়দা, মেজদা অবশ্য সব সময় ঘরে পায়জামা পরে। কিন্তু বাবা ধুতি বাদ দিয়ে পায়জামা পরছেন এটা রতন মেনে নিতে পারলো না।

ভৌমিক স্যার ওদের দেখে শুকনো হেসে বললেন, কিরে তোরা কোত্থেকে এলি?

পিন্টু বললো, আপনাদের খোঁজ খবর নিতে এলাম স্যার।

এখনও বেঁছে আছি। ভৌমিক স্যারের মুখের হাসিটা কান্নার মতো মনে হলো।

নন্দী স্যার বললেন, তোদের ওদিকে গন্ডগোল হয়নি রতন?

রতন বললো, এখনও হয়নি। কাল একদল আসতে চেয়েছিলো। লাঠি নিয়ে সবাই মিলে ওদের তাড়িয়ে দিয়েছি। রাতে দল বেঁধে পাড়ায় পাহারা দিচ্ছি।

ঘোষাল স্যার বললেন, আমাদের পাশের বাড়িতে থাকে মুসলিম লীগের এক লোক। রোজ দেখা হলেই বলে কী মাষ্টার, ইন্ডিয়া কবে যাইবেন? যাইবার আগে বাড়িটা আমারে দিয়া যাইয়েন। নাকি আর কার কাছে বেইচ্যা ফালাইছেন! আপনে গো তো বিশ্বাস নেই।

ভৌমিক স্যার বললেন, নলিনী স্যারের জন্য চিন্তা হচ্ছে। ওদের পাড়ায় আর কোনো হিন্দু বাড়ি নেই।

পিন্টু বললো, আমার সঙ্গে কাল নলিনী স্যারের দেখা হয়েছিলো। ওঁদের বাজার করে দিয়েছি।

ভালো করেছিস বাবা! কৃতজ্ঞতা ভরা গলায় বললেন ভৌমিক স্যার-ওঁর জন্য খুব চিন্তা হচ্ছিলো।

নন্দী স্যার জিজ্ঞেস করলেন, শহরের অবস্থা কিছু জানিস? খবরের কাগজে দেখলাম কাল নাকি ঢাকেশ্বরী মন্দির আর সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরে হামলা করেছিলো?

রতন বললো, আজও অবস্থা ভালো নয়। আমরা ঠাটারি বাজারের দিকে যাচ্ছিলাম। পথে শুনলাম ওখানকার মন্দিরে নাকি আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভৌমিক স্যার বললেন, আমি এটাই বুঝি না, এখানে মন্দির পোড়ালে কি আর অযযাধ্যার ভাঙা বাবরী মসজিদ জোড়া লাগবে, না যারা ভেঙেছে তাদের কোনো ক্ষতি হবে! মানুষ একেবারে পাগল হয়ে গেছে।

পিন্টু বললো, মানুষ কাদের বলছেন স্যার, যারা মন্দির মসজিদ ভাঙে তারা মানুষ না জানোয়ার।

নন্দী স্যার তিক্ত গলায় বললেন, তুই ঠিক বলেছিস। এরা কেউ মানুষ নয়।

ঘোষাল স্যার বললেন, তোরা আর বাইরে থাকিস না। কোথায় কখন গন্ডগোল লাগে–বাড়ি যা।

স্কুল থেকে বেরিয়ে পিন্টু আর রতন একটা রিকশা নিলো। ওদের দুজনের বুকের ভেতর ঝড় বইছে। দুদিনের ঘটনা ওদের বয়স দশ বছর বাড়িয়ে দিয়েছে। এ সময় ওদের তো এভাবে একটার পর একটা তিক্ত অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাওয়ার কথা ছিলো না! পিন্টু আর রতন ভোলা যাবে বেড়াতে, যে জন্য পিন্টু ফকিরাপুল আর সূত্রাপুরের ফুটবল ম্যাচ পর্যন্ত খেললো না। কথা ছিলো বড় দিনের ছুটিতে বেড়াবার, খেলার, মনের আনন্দে যা ইচ্ছে করে তাই করার, অথচ এখন ওদের দাঙ্গা ঠেকানোর জন্য রাত জাগতে হচ্ছে, যারা বিপদে পড়েছে তাদের খোঁজ খবর নিতে হচ্ছে, সারাক্ষণ কাটাতে হচ্ছে প্রচন্ড এক উদ্বেগের ভেতর কখন কী ঘটে, নতুন করে আবার কোন বিপদ দেখা দেয়–শেষ পর্যন্ত সর্বনাশ ঠেকানো যাবে তো!

বিকেলে রতনদের বাড়িতে দুটো রিকশা এসে থামলো। রতনের দূর সম্পর্কের এক মামা থাকেন ডেমরার কাছে শনির আখড়ায়। তিনি সপরিবারে চলে এসেছেন।

মামী কালো বোরখা পরে এসেছিলেন। কপালের সিঁদুর মুছে ফেলেছেন। ঘরের ভেতর ঢুকে বোরখা খুলে তার পাঁচ সাত বছরের দুই ছেলে মেয়েকে নিয়ে রতনের মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন–দিদি গো, আমাগো সব শ্যাষ ওইয়া গেছে। বাড়ি ঘর, জিনিসপত্র যা আছিল কুত্তার বাচ্চারা সব আগুন দিয়া ছাই কইরা ফালাইছে।

রতনের মামা জানলেন, পরশু বিকেলে এক দফা হামলা হয়েছে, বাকিটুকু হয়েছে গতকাল। শনির মন্দির ভেঙে গুন্ডারা মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। আখড়ার চারপাশে একান্নটি পরিবার ছিলো। প্রত্যেকটি ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কাল রাতে শীতের ভেতর সবাই গাছতলায় ছিলো। ছোট ছোট বাচ্চাগুলোর কান্নায় সারা রাত চারপাশের মানুষজন ঘুমোতে পারেনি।কাল দুপুরের পর থেকে কারও পেটে কিছু পড়েনি। মামার পাঁচ বছরের ছেলেটা একেবারে নেতিয়ে পড়েছে।

দুপুরে রতন পিন্টুদের বাড়িতে খেয়েছে। স্বপন সেই সকালে বেরিয়েছে এখনও আসেনি। ওদের জন্য রাখা ভাত আর তরকারি যা ছিলো রতনের মা বের করে দিলেন তার ভাইয়ের পরিবারকে। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে দুটো কী গোগ্রাসে ভাত গিললো দেখে ওঁর কান্না পেলো। রতনের মামা মামীও খেতে বসেছিলেন। বার বার চোখের জলে ওদের পাতের ভাত একাকার হয়ে যাচ্ছিলো। ওঁরা দুজন কিছুই খেতে পারলেন না।

রতনের মামা ডেমরা ম্যাচ ফ্যাক্টরিতে চাকরি করেন। চার তারিখ বেতন পেয়ে নিজের হাত খরচের টাকাটা সঙ্গে রেখে পুরোটা রতনের মামীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। লোহার ট্রাঙ্কে রাখা ছিলো। সেই টাকা, সঙ্গে তাদের বিয়ের সময়কার আট ন ভরি সোনার গয়না যত্ন করে মামী তুলে রেখেছিলেন ছেলেমেয়েদের বিয়েতে দেয়ার জন্য। তার চোখের সামনে সেই ট্রাঙ্কটা মাথায় নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো অচেনা এক ছেলে। সঙ্গে লাঠি হাতে আও দুজন ছিলো। একজন নিয়েছে তাঁর টু ইন ওয়ান আরেকজন নিয়েছে তার সখের সেলাই মেশিনটা। কাঠের আলমারি ভেঙে শাড়ি কাপড় যা পেয়েছে একজন সেগুলো নিয়ে গেছে বিছানার চাঁদরে পোটলা বেঁধে। ছেলেমেয়ে দুটোকে বুকে চেপে ধরে ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে এসব কিছুই তিনি নিজের চোখে দেখেছেন। বাধা দেবেন কি–ওরা যে তাদের প্রাণে মারেনি এই তো বেশি! লুটপাট শেষ করে তাদের টিনের ঘরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। মামীর চোখের সামনে তার বারো বছরের সাজানো সংসার পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

রতন পাথরের মতো দাঁড়িয়ে সব শুনলো। মামীর ছোট ছেলেমেয়ে দুটোকে দেখলো থালা চেটে ভাত খেতে। মনে হলো ওদের ক্ষিদে বুঝি এখনও মেটেনি। ঠাকুরমা ছেলেমেয়ে দুটোকে কলতলায় নিয়ে হাত মুখ ধুইয়ে দিলেন। মামা অসহায় গলায় রতনের বাবাকে প্রশ্ন করলেন–দাদা, অখন আমগো কী ওইবো? আমরা কই যামু?

রতনের বাবা শুকনো গলায় বললেন, সবাইর যা অয় তোমাগোও তাই ওইবো। যাইবা কই, এইহানে থাক।

ঠাকুরমা বললেন, হ, সবাই একলগে থাকলে মনে জোর পাওন যায়।

এমন সময় পিন্টু এসে দরজার বাইরে থেকে গলা তুলে রতনকে ডাকলো দরজা খুলে রতন বেরিয়ে এলো। পিন্টু বললো, মিটিঙে যাবি না? মেজদা কই?

রতন ওর বাবাকে দরজা বন্ধ করতে বলে পিন্টুর সঙ্গে বেরুলো। বললো, মেজদা সকালে বেরিয়েছে, এখনও ফেরেনি।

পিন্টুদের ছাদের মিটিঙে রতন ওর মামা মামীর অভিজ্ঞতার কথা বললো। রাগে সবার বুকের ভেতর আগুন জ্বলে উঠলো। রতন বললো, শনির আখড়ার বেশির ভাগ মানুষের যাবার কোনো জায়গা নেই। ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের নিয়ে সবাই গাছতলায় বসে আছে। কাল সারারাত শীতে কষ্ট পেয়েছে ছোট বাচ্চারা।

ইরফান সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিলো। বললো, আমরা কালই শনির আখড়ায় যাবো রিলিফ নিয়ে। রাতের ডিউটি আগের মতো চলবে। প্রত্যেকে এখন রিলিফ তোলার জন্য বেরিয়ে পড়ো। বাচ্চাদের জামা কাপড়, কম্বল, চাদর, নগদ টাকা যা পাওয়া যায়। টাকা দিয়ে বাচ্চাদের জন্য দুধ আর বড়দের জন্য চিড়া কিনবো। তোমরা তো জানো গতবার সাইক্লোনের রিলিফ আমরা কিভাবে তুলেছিলাম।

পনেরো মিনিটের ভেতর মিটিঙ শেষ করে দিলো ইরফান। ঠিক হলো ডালপট্টি থেকে শুরু করে সূত্রাপুরের বাজার পর্যন্ত প্রত্যেকটা বাড়ি আর দোকানে যেতে হবে। একানব্বইর ঘূর্ণিঝড়ের সময় ইরফানরা এভাবেই রিলিফ তুলেছিলো। বড়রা যাবে দোকানে, হোটরা আর মেয়েরা যাবে মানুষের বাড়িতে বাড়িতে।

মেয়েদের দল বানালো হাসি। ওর দলে তপতী, কেতকী আর রূপচাঁদ লেনের ইডেনে পড়া দুটো মেয়ে ছিলো। পিন্টুদের দলে ছিলো সাতজন। বিকেল সাড়ে চারটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত ঘুরলো ওরা। যতটা পাবে ভেবেছিলো ততটা অবশ্য পাওয়া গেলো না। কয়েক জায়গায় শনির আখড়ার জন্য রিলিফ চাইতে গিয়ে পিন্টুরা উল্টো ধমক খেয়েছে। বলা বাহুল্য সেগুলো ছিলো হিন্দু বিদ্বেষীদের বাড়ি। চৌধুরী ভিলার নগেন্দ্র চৌধুরীও ওদের খালি হাতে ফিরিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, রিলিফ যা দেয়ার আমি নিজে দেবো।

রিলিফের জন্য পিন্টুরা রতনদের বাড়িতেও গিয়েছিলো। রতনের মামা যেই শুনলেন শনির আখড়ায় দুঃস্থ পরিবারদের সাহায্য করার জন্য ওরা কাল যাচ্ছে, তখন পিন্টুকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। গভীর আবেগে বললেন, তোমরা আছে বলেই ঈশ্বরের পৃথিবীতে এখনও চন্দ্র সূর্য ওঠে।

রতনদের বাড়িতে ছোটদের কাপড় ছিলো না। ওর মা আর ঠাকুরমা নিজেদের পরনের দুটো শাড়ি আর একখানা মোটা বিছানার চাদর দিয়েছেন। পিন্টুদের সবাই জামা, কাপড়, বিছানার চাদর, কম্বল এসব দিয়েছে। কেউ ওদের নগদ টাকা দেয়নি।

হাসিরা পুরোনো কাপড়ের সঙ্গে নগদ আড়াইশ টাকা মতো পেয়েছে। ইরফানরা তুলেছে তিন হাজার টাকার মতো। অন্যরা সবাই টাকা তুলেছে, নিজেরা টাকা তুলতে পারেনি দেখে পিন্টু ওর সঞ্চয় থেকে দুশ টাকা দিয়েছে। আরও দিতে চেয়েছিলো, রতন বাধা দিয়েছে। বলেছে পরেও তো কাউকে সাহায্য করতে হতে পারে।

পরদিন সকালে ইরফান দেড় টনের একটা ছোট ট্রাক জোগাড় করে আনলো। নগদ টাকা দিয়ে বাচ্চাদের দুধ, চিড়া আর মাটির সানকি কেনা হয়েছে। খাবার পরিমাণে অবশ্য যথেষ্ট ছিলো না, পরিবার পিছু বেশি হলে দুদিন চলবে।

সকাল এগারোটায় ট্রাক নিয়ে শনির আখড়ায় এলো ইরফান। পিন্টু আর রতনের মামাকেও সঙ্গে এনেছে। আখড়ায় মন্দিরটা ছিলো পাকা ইমারত। দেখে মনে হয় বুলডোজার চালিয়ে ভাঙা হয়েছে ওটা। আখড়ার ঘরবাড়ি সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এখানে সেখানে পোড়া টিন ছড়িয়ে রয়েছে। আগুনের আঁচে চারপাশের গাছগুলো পর্যন্ত ঝলসে গেছে।

রাস্তার মাথায় কয়েকজন পুলিশকে পাহারা দিতে দেখলো। রতনের মামা বললো, পরশু যখন মন্দির ভাঙা হচ্ছিলো আমরা পুলিশের ফাঁড়িতে খবর দিয়েছিলাম। কেউ আসেনি।

আখড়ায় প্রায় সব কটি পরিবার গাছের তলায় বসে আছে। ইরফানদের ট্রাক দেখে কেউ এগিয়ে এলো না। রতনের মামা ট্রাক থেকে নেমে গিয়ে তোকজনদের সঙ্গে কথা বললেন। তারপর একজন দুজন করে আসতে লাগলো। সব মিলিয়ে সেখানে তখন গোটা চল্লিশেক পরিবার ছিলো। যাদের অবস্থা বেশি খারাপ ইরফান নিজের পকেট থেকে তাদের কাউকে বিশ কাউকে ত্রিশ টাকা দিলো। এর বেশি দেয়ার সামর্থ ছিলো না ওর। ক্ষতিগ্রস্ত সবগুলো পরিবারের কর্তা আর সদস্য সংখ্যা কয়জন তার তালিকা তৈরি করলো ইরফান। পরিবারের শিশুদের সংখ্যাও আলাদাভাবে উল্লেখ করলো। বললো, আজই আমি রেডক্রসকে আপনাদের কথা জানাবো। আশা করি দু এক দিনের ভেতর ওরা সাহায্য নিয়ে আসবে।