৩. হরিমতিয়াদের জন্য টাকা

হরিমতিয়াদের জন্য টাকা তোলার ঘটনাটা স্কুলের টিচাররা জেনে গিয়েছিলেন। ক্লাসে অবশ্য পিন্টুদের কেউ কিছু বলেননি। দিন সাতেক পর বুড়ো ভিনসেন্ট রোজারিও স্যার সন্ধ্যার পর গুটি গুটি পায়ে হেঁটে পিন্টুদের বাসায় এলেন। পিন্টু আর রতনের বাবা তখন বসার ঘরে দাবা খেলছিলেন। রতনের বাবা চিনতে না পারলেও পিন্টুর বাবা ভিনসেন্ট স্যারকে ঠিকই চিনতে পারলেন। স্কুলে প্যারেন্টস ডেতে যখন অভিভাবকদের ডাকা হয় পিন্টুর বাবা কোনোবারই যেতে ভোলেন না।

ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিলো। বাইরে কড়া নাড়ার শব্দ শুনে পিন্টুর বাবা উঠে দরজা খুললেন। সামনে দাঁড়ানো হাওয়াই শার্ট আর প্যান্ট পরা বুড়ো মানুষটিকে দেখে অবাক হয়ে বললেন, আরে, ভিনসেন্ট স্যার যে! আসুন, ভেতরে আসুন।

ভিনসেন্ট স্যারের সঙ্গে রতনের বাবার পরিচয় করিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, স্যার, চা খাবেন তো?

মৃদু হেসে ভিনসেন্ট স্যার বললেন, অসুবিধে না হলে আমার আপত্তি নেই।

অসুবিধে কেন হবে। আমরা এখনও চা খাইনি। সবে মাত্র বোর্ড খুলে বসেছিলাম। এই বলে পিন্টুর বাবা গলা তুলে ছেলেকে ডাকলেন, পিন্টু, দেখে যা কে এসেছে?

আর দু সপ্তাহ পরে হাফইয়ার্লি পরীক্ষা। পরীক্ষার পর ঠিক হয়েছে ভোলায় রতনের বড়দির বাড়িতে বেড়াতে যাবে। গত শীতে বেড়াতে এসে বড়দি বার বার পিন্টুর মাকে বলে গেছে রতনের সঙ্গে পিন্টুও যেন বেড়াতে যায়। বাবা অবশ্য যথারীতি বলে দিয়েছেন পরীক্ষার ফল ভালো না হলে কোথাও যাওয়া চলবে না। সে জন্য সন্ধ্যে না হতেই পড়তে বসেছিলো পিন্টু।

হঠাৎ বাবার খুশিভরা গলায় ডাক শুনে অবাক হয়ে ও উঠে গেলো বসার ঘরে। ভিনসেন্ট স্যারকে বেতের সোফায় বসে থাকতে দেখে আরও অবাক হলো–এর আগে স্কুলের কোনো চিটার কখনও ওদের বাড়িতে আসেননি। হাত তুলে স্যারকে আদাব জানালো পিন্টু।

ভিনসেন্ট স্যার রহস্যভরা গলায় বললেন, জানি তুমি খুব অবাক হয়েছে আমাকে দেখে। বলতে আমি কেন এসেছি?।

গত পরশু ইন্টার স্কুল ফুটবলে পিন্টুরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। শেষের তিনটা খেলায় ভালো খেলার জন্য ফাইনাল খেলায় পিন্টু ছিলো দলের ক্যাপ্টেন। ওদের ক্যাপ্টেন ক্লাস টেনের বদরুল হাঁটুতে ব্যথা পেয়ে ফাইনাল খেলার দিন মাঠে নামতে পারেনি। সবাই ধরে নিয়েছিলো পিন্টুরা হারবে। গেম টিচার পর্যন্ত বিষণ্ণ মুখে বলেছিলেন, জেতার দরকার নেই। ড্র করলেও মুখরক্ষা হয়। অন্যরা বলেছে বদরুল মাঠে নেই, ডিফেন্স সামলাবে কে? আল্লা জানেন কয় গোল খেতে হয়! সেই খেলায় পিন্টুর জন্যই ওদের টীম দুই এক গোলে জিতেছে। পিন্টু ভাবলো এরই জন্যে হয়তো ভিনসেন্ট স্যার ওদের বাড়িতে এসেছেন। লাজুক হেসে বললো, আমরা ফুটবলে ইন্টার স্কুল চ্যাম্পিয়ন হয়েছি, সেজন্য এসেছেন।

ভিনসেন্ট স্যার একটু অবাক হয়ে কয়েক মুহূর্তে ভাবলেন। ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কথা তার মনে ছিলো না। তাছাড়া খেলাধুলায় কখনও তার আগ্রহও ছিলো না। কথাটা মনে পড়ায় হা হা করে গলা খুলে হাসলেন। বললেন, ফুটবল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, তার জন্য আমি কেন আসবো! ওটা তো বীরেন চৌধুরী স্যারের এলাকা!

কথার ফাঁকে পিন্টুর বাবা উঠে ভেতরে গিয়ে চায়ের কথা বলে এসেছেন। ভিনসেন্ট স্যার ওঁকে বললেন, বীরেন স্যার যখন আসেননি তখন আমিই বলি চৌধুরী সাহেব। আপনি নিশ্চয় শুনেছেন আপনার ছেলের অধিনায়কত্বে আমাদের ফুটবল টীম ইন্টার স্কুল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে?

মৃদু হেসে পিন্টুর বাবা বললেন, হ্যাঁ, শুনেছি। সারাক্ষণ তো ওসব নিয়েই পড়ে থাকে।

ভিনসেন্ট স্যার গম্ভীর হয়ে বললেন, না, সারাক্ষণ ওসব নিয়ে থাকে না। তাই যদি, থাকতো তাহলে আমাকে আজ আপনাদের বাড়িতে আসতে হতো না।

স্যারের কথা শুনে পিন্টু মনে মনে প্রমাদ গুনলো। তবে কি ক্লাস টেন-এর রবিউল গতকাল দুপুরের কথা স্যারকে বলে দিয়েছে? পিন্টুর কোনো দোষ নেই। দুপুরে টিফিনের সময় রতনকে নিয়ে বাংলাবাজার গার্লস স্কুলের সামনে রয়েল ষ্টেশনারির দোকানে গিয়েছিলো পেন্সিল কিনতে। সেভেনথ পিরিয়ডে ড্রইং ক্লাস। ড্রইং-এর রহমতুল্লাহ স্যার বলে দিয়েছিলেন পারলে যেন ওরা ফোর বি পেন্সিল আনে। পেন্সিল কিনে দোকান থেকে বের হতেই রফিক, সমীর আর মন্টুর সঙ্গে দেখা। ক্লাসে ওদের প্লেস সবার নিচে, মন্টু তো গতবার প্রমোশনই পায়নি। পিন্টুকে দেখে ওরা সবাই, ক্যাস্টন, ওস্তাদ, দোস্ত বলে হই হই করে ঝাঁপিয়ে পড়লো। বললো, এত বড় একটা ম্যাচ জিতলি–চটপটি খাওয়া।

ফাইনাল খেলা জেতার পর পিন্টুও মহা ফুর্তিতে ছিলো। সকালে বাবার কাছ থেকে পঞ্চাশ টাকা নিয়েছে বন্ধুদের খাওয়াবে বলে। রতন আর ওর জন্য দুটো পেন্সিল কিনেছে হোল টাকায়, বাকি টাকা তখন ওর পকেটে। মন্টুদের আবদার দেখে ওদের মানা করতে পারেনি। সবাই মিলে গার্লস স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে, চটপটি খেয়েছে। মন্টু আগের দিন ভিসিআর এ দারুণ হাসির এক হিন্দি ছবি দেখেছিলো। হাত পা নেড়ে ওটার গল্প বলে সবাইকে ও হাসিয়ে মারছিলো। তখনই ক্লাস টেন-এর ক্যাপ্টেন রবিউল এসে হাজির। স্কুলের দিকেই যাচ্ছিলো, ওদের হল্লা শুনে ও তাকিয়ে দেখে পিন্টুও আছে সেখানে। কাছে এসে পিন্টুকে বললো, ফুটবল চ্যাম্পিয়ন হয়ে সাপের পাঁচ পা দেখেছিস নাকি! মেয়েদের স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে যে আড্ডা মারছিস। দাঁড়া, আজই ব্রাদার হোবার্টকে গিয়ে বলবো!

সেই থেকে পিন্টু ভয়ে ভয়ে আছে–এর জন্য কখন ডাক পড়ে! ভিনসেন্ট স্যার। তাহলে বাড়ি পর্যন্ত এসেছেন এ কথা বলার জন্য? ভয়ে পিন্টুর গলা শুকিয়ে গেলো।

ভিনসেন্ট স্যারের গম্ভীর কথায় পিন্টুর বাবাও একটু ঘাবড়ে গিয়েছেন। শুকনো গলায় জানতে চাইলেন, পিন্টু স্কুলে কি অন্যায় কিছু করেছে?

না হামিদ সাহেব, পিন্টুর মতো ছেলে কখনও অন্যায় করতে পারে না। ও যা করেছে সেটা একশবার ফুটবল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার চেয়েও বড় ঘটনা। শুনে গর্বে আমার বুক ভরে গেছে। এই বলে ভিনসেন্ট স্যার হরিমতিয়াদের সাহায্য করার জন্য পিন্টু আর রতন কিভাবে চাঁদা তুলেছে সব কথা খুলে বললেন। শেষে বললেন, হেডমাস্টার আমাকে বলেছেন আপনাদের অভিনন্দন জানাবার জন্য।

ভিনসেন্ট স্যার কথাগুলো যেভাবে বললেন শুনে রতন আর পিন্টুর বাবার বুক গর্বে ভরে গেলো। পিন্টুর বাবা বললেন, আমি তো ওর দিকে তেমন নজর দিতে পারি না। আপনাদের মতো শিক্ষকদের হাতে পড়েছে বলেই এমন হয়েছে।

বাবার কথা শেষ হওয়ার আগেই পিন্টু আস্তে করে উঠে চলে গেছে ওর নিজের ঘরে। ওর কখনও মনে হয়নি হরিমতিয়াদের জন্য কিছু করাটা বিরাট কোনো ঘটনা। বরং ফুটবল খেলায় চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা একটা সাংঘাতিক ব্যাপার! কিন্তু ভিনসেন্ট স্যার যেভাবে বললেন–শুনে ওর মাথা গুলিয়ে গেছে।

চা খেতে খেতে রতনের বাবা বললেন, রতন আমাকে কখনও এ কথা বলেনি।

চা নিয়ে এসে পিন্টুর মা নাশতা তুলে দেয়ার জন্য বসেছিলেন। রতনের বাবার কথা শুনে বললেন, আসলে ছেলেরা আপনাদের ভয় পায় বলে কিছু বলে না। দিন পনেরো আগে পিন্টু কেন সন্ধ্যা অব্দি বাড়ি ফেরেনি বলে উনি রাগারাগি করলেন। হরিমতিয়াদের কথা সেদিনই আমি পিন্টুর কাছে শুনেছি। কলম কেনার পয়সা ওরা হরিমতিয়াদের দিয়ে এসেছে শুনে আমার বাজার খরচ থেকে রতন আর পিন্টুর কলম কিনে দিয়েছি।

পিন্টুর মার কথা শুনে ভিনসেন্ট স্যার গলা খুলে হাসলেন। বললেন, দেখলেন তো হামিদ সাহেব! আপনারা ছেলেদের খবর না রাখলেও মায়েরা কিন্তু সব খবর ঠিকই রাখেন।

পিন্টুর বাবা অভিমান ভরা গলায় পিন্টুর মাকে বললেন, আমাকে বললে বুঝি ওদের কলম কিনে দিতাম না!

পিন্টুর মা মুখ টিপে হেসে বললেন, ঠিক আছে, কথাটা মনে থাকবে। এবার থেকে বলবো।

ভিনসেন্ট স্যার আরেক দফা হাসলেন।

সেদিন আর দাবা খেলা জমেনি। ভিনসেন্ট স্যার নটা পর্যন্ত ছিলেন। আগেকার দিনের মানুষ কত ভালো ছিলো, দিন দিন মানুষ স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছে তিনজনে বসে এসব গল্প করলেন। নটার সময় উঠলেন ভিনসেন্ট স্যার। যাবার সময়–আপনাদের দাবা খেলাটা আজ মাটি করে দিয়ে গেলাম। এবার নিশ্চয়ই আমার মুভুপাত করবেন। বলে হা হা করে হাসলেন। পিন্টুর বাবা বিনীত গলায় বললেন, এসব কী বলছেন স্যার। দাবা তো রোজই খেলি। আপনার সঙ্গে কথা বলার সৌভাগ্য কি রোজ হবে?

লোভ দেখালে রোজ না হলেও মাসে একবার এসে আড্ডা দিয়ে যাবো। ভারি ভালো লাগলো আপনাদের সঙ্গে গল্প করে।

মাসে একবার কেন, আপনার যখন ইচ্ছে হবে চলে আসবেন। এই বলে পিন্টু আর রতনের বাবারা ভিনসেন্ট স্যারকে এগিয়ে দিলেন।

রতনের বাবা রাস্তা থেকে বিদায় নিলেন। ছেলের জন্য তাঁরও গর্ব হচ্ছিলো। সারাদিন কাজের ঝামেলায় থাকেন। সন্ধ্যায় সংসারের ঝামেলার কথা শুনতে হয় বলে আড়ত থেকে বাড়ি ফিরে আবার বেরিয়ে পড়েন। রতনের মাই এত কাল ধরে সংসারের সব কিছু সামলাচ্ছেন।

ঘরে ঢুকে রতনের বাবা গলা তুলে রতনের মাকে ডাকলেন, কই গো, তুমি গেলা কই?

রতনের মা রান্নাঘরে ছিলেন। রতনের বাবার খুশিভরা গলা শুনে অবাক হলেন। বহুদিন এ ধরনের গলা তিনি শোনেন নি। ঘুরে এসে নিচু গলায় জানতে চাইলেন, কি ওইছে?

হাসি মুখ করে রতনের বাবা বললেন, তোমার রতইন্যার কারবার দেখছো?

রতন পাশের ঘরে বসে পরীক্ষার পড়া তৈরী করছিলো। নিজের নাম শোনা মাত্র ওর কান দুটো খাড়া হয়ে গেলো। মা বললেন, ক্যান কী করছে রতইন্যায়?

ভিনসেন্ট স্যার যেভাবে হরিমতিয়ার গল্প ওঁদের বলেছিলেন সবটুকু রতনের মাকে জানালেন। শেষে বললেন, অগো হ্যাডমাস্টার স্কুলের ভিনসেন্ট স্যাররে পাঠাইছে এই খবর আমাগো কওনের লাইগা। আমার লগে পিন্টুগো বাড়িত দ্যাখা না ওইলে স্যারে আমগো বাড়িতও আইতো। কারবার দেখছ পোলার!

ততক্ষণে রতনের ঠাকুরমাও এসে ঢুকেছেন ঘরে। রতনের বাবা মহা উৎসাহে–মা হুনছ রতইন্যার কথা, বলে আরেক দফা তার মাকেও ঘটনাটা বললেন। ঠাকুরমা সব শুনে বললেন, রতইন্যায় পুরা তর বাপের স্বভাব পাইছে। তুই তহন ছোট আছিলি ঘোতনা! তর বাপে দুই কুষ্ট রুগিরে আইন্যা ঘরে তুললো। আমার হাউড়ির কী চিল্লাচিল্লি। তর বাপে কারও কথা হুনলে তো!

পিন্টুর মতো রতনও কখনও ভাবেনি হরিমতিয়াদের এভাবে সাহায্যে করার জন্য কেউ ওদের প্রশংসা করবে। বরং উল্টোটাই ওরা ভেবেছিলো, যেমন কি না ওদের ক্লাসের রেজা বলেছে। যে বাড়িতে নিজেকে সব সময় অবাঞ্ছিত মনে হয়েছে, যে বাবা মা উঠতে বসতে ওকে গাল মন্দ করেছেন, ওকে নিয়ে ওঁদের উচ্ছ্বাস দেখে আনন্দে চোখের জল ধরে রাখতে পারলো না রতন। ঠাকুরমা তখন ওর মাকে বলছেন, হুন বউ, রতন্যারে খাওনের সময় অখন থেইকা একটা ডিম দিবা। পরীক্ষা সামনে। আমারে নিত্য দুধ দ্যাওন লাগবো না। বয়স ওইছে, দুধ অখন আমার প্যাটে সয় না।

ফুটবলে স্কুল টীমকে চ্যাম্পিয়ন বানাবার জন্য আর হরিমতিয়াদের মতো গরিব দুঃখি মানুষকে সাহায্য করার জন্য প্রশংসা শুনতে শুনতে পিন্টু আর রতনের পরীক্ষার প্রস্তুতিও আগের চেয়ে অনেক ভালো হলো। হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষায় পিন্টু ফোর্থ আর রতন সিক্সৰ্থ হওয়াতে ওরা নিজেরাই অন্যদের চেয়ে বেশি অবাক হলো। রেজা এবার সেকেন্ড হয়েছে ফাষ্ট হয়েছে, ইউসুফ। পরীক্ষার রেজাল্ট দেখে রেজা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলেছে, মনে হয় মেথরনীদের অভিশাপ লেগেছে আমার ওপর। বখতিয়ার বলেছে, পিন্টুকে স্যারেরা নম্বর ঘুষ দিয়েছেন ইন্টার স্কুল ফুটবল ফাইনাল জেতার জন্য।

ওদের রিপোর্ট কার্ড দিতে গিয়ে স্কুল টিচার বলেছেন, পরীক্ষার খাতা আমি নিজে দেখেছি। ইচ্ছে করলেই ভালো করতে পারিস তোরা। এখন থেকে ছয়ের নিচে নামা চলবে না।

রিপোর্ট কার্ড নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় রতন পিন্টুকে বললো, রেজা কি বলছিলো শুনেছিস?

হরিমতিয়াদের অভিশাপে ও সেকেন্ড হয়েছে।

তাহলে বলতে হবে হরিমতিয়াদের আর্শীবাদে আমরা ভালো করেছি।

পরীক্ষায় ভালো খারাপের মধ্যে কারও অভিশাপ আর্শীবাদের কিছু নেই। ইউসুফের চেয়ে রেজা খারাপ করেছে তাই সেকেন্ড হয়েছে। আমরা আগের চেয়ে প্রিপারেশন ভালো করেছি, তাই রেজাল্টও ভালো হয়েছে।

তারপরও তাতে হরিমতিয়াদের হাত আছে।

কিভাবে?

সেদিন তোদর বাড়ি থেকে ভিনসেন্ট স্যারের কথা শুনে এসে বাবা আমাকে রীতিমতো হিরো বানিয়ে দিয়েছেন। তারপর দেখি পড়ার সময় কেউ দোকানে যেতে বলে না, খাওয়ার সময় ভালোটা আমার পাতে তুলে দেয়, মেজদা নিজে থেকে অংক আর বিজ্ঞান বুঝিয়ে দিলো। হরিমতিয়াদের উপকার না করলে কি এসব হতো!

তার মানে তুই বলতে চাইছিস, এর পর থেকে পরীক্ষার ফল ভালো করার জন্য হরিমতিয়াদের মতো কাউকে খুঁজে বের করে তাদের সাহায্যে করতে হবে?

ঠাট্টা করছিস কেন? আমরা কি পরীক্ষার ফল ভালো করার মতলবে ওদের সাহায্য করেছি?

সে কথা তো আমিও বলছি। কাউকে সাহায্য করতে চাইলে বিনা মতলবে করবি। মনে করবি এটা আমাদের দায়িত্ব। নলিনী স্যার কী বলেন ভুলে গেছিস? একমাত্র মানুষই পারে নিঃস্বার্থভাবে একে অন্যের বিপদে পাশে এসে দাঁড়াতে!

তবু একটুখানি স্বার্থ থেকেই যায়!

কিভাবে?

নলিনী স্যার একথাও বলেছেন ভালো কাজ হচ্ছে মনের সাবানের মতো। আমাদের মনে যদি ময়লা জমে ভালো কাজ করলে সেটা সাবানের মতো মনের ময়লা দূর করে দেয়।

ওসব তত্ত্ব কথা রাখ। নলিনী স্যারের কথা শুনে মনে হয় এসব লিখে একটা বই করলে মন্দ হয় না।

তত্ত্ববোধিনী কিংবা তত্ত্বপঞ্জিকা নাম দেয়া যেতে পারে।

তত্ত্বকৌমদিনী নামটাও মন্দ না। বলতে গিয়ে হেসে ফেললো রতন।

পিন্টু হেসে প্রসঙ্গ পাল্টালো–ভোলা কবে যাবো ঠিক করেছিস?

তোকে বলিনি বুঝি! বাবা বড়দিকে চিঠি লিখে দিয়েছেন, সামনের রোববারে যাচ্ছি আমরা।

তোদের বাড়ির আর কেউ যাবে নাকি?

না, শুধু তুই আর আমি।

দারুণ মজা হবে। আজ পর্যন্ত বাবা মাকে ছাড়া ঢাকার বাইরে কোথাও যাইনি।

গত বছর আমি লৌহজং মামার বাড়ি একা গেছি।

সে তত এইটুকুন পথ। কদিন থাকবি ঠিক করেছিস?

সামার ভ্যাকেশন তো পুরোটা পড়ে আছে। এক মাস থাকলেই বা অসুবিধে কী?

না রে! দশ বারোদিনের বেশি থাকা যাবে না। বাবা মা চিন্তা করবেন। তাছাড়া ভ্যাকেশনে ক্রিকেট টীমের নেট প্র্যাকটিস হবে।

আগে যাই তো! তারপর দেখা যাবে।

বাড়িতে পিন্টু আর রতনের রেজাল্ট দেখে সবাই দারুণ খুশি! দুপুরে খাওয়ার সময় পিন্টুর মা বললেন, পরীক্ষায় ভালো করেছিস, শুক্রবার দিন তোর বাবা বাসায় থাকবেন, সেদিন তোর দু চারজন বন্ধুকে ডাক, খাইয়ে দেই।

দু চারজন লাগবে না মা! পিন্টু ওর মাকে বললো, তুমি বরং রতনদের বাড়ির সবাইকে বলো! ও বাড়িতে গেলে রতনের মা, ঠাকুরমা যা করেন না!

ওদের তো বলবোই। পাড়ায় আপনজন বলতে তো ওরাই আছে। তোদের ঐ ভীম সেন স্যারকেও বলতে পারিস। সেদিন যে এসেছিলেন?

ভীম সেন নয় মা ভিনসেন্ট! পিন্টু হেসে বললো, ভিনসেন্ট রোজারিও ওঁর নাম। ঠিক আছে, ওঁকেও বলা যাবে। বাবাদের সঙ্গে ওঁর ভালো জমে।

সন্ধ্যের পর পিন্টুর বাবা যেই বেরোলেন রহমত ব্যাপারীর গদির দিকে, পিন্টুর মাও বেরোলেন রতনদের বাড়িতে নেমন্তন্ন করার জন্য। শুক্রবারে নেমন্তনের কথা বলতেই রতনের মা আর ঠাকুরমা একসঙ্গে হেসে ফেললেন। ওঁদের সঙ্গে গলা মেলালো রতনের সেজদি তপতী আর ছোড়দি কেতকী।

পিন্টুর মা হতভম্ব হয়ে চারপাশে তাকালেন। রতনের মাকে বললেন, এতে এত হাসির কী হলো দিদি! আপনারা তো আমাদের বাড়িতে আগেও খেয়েছেন।

সে কথা নয় বোন! হাসতে হাসতে রতনের মা বললেন, শুক্রবার ছুটির দিন দেখে আমরা ঠিক করেছি আপনাদের সবাইকে আমাদের বাড়িতে নেমন্তন্ন করবো।

এ কথা শুনে পিন্টুর মার মুখে হাসি ফুটলো। বললেন, এ শুক্রবারে আমাদের বাড়িতে থোক। আমি পিন্টুর বাবাকে বলে ফেলেছি। আপনারা পরের শুক্রবারে করুন।

রতনের ঠাকুরমা বললেন, না গো হাসির মা। পরের শুক্রবার ওইলো গিয়া আমার একাদশী। আমারে বাদ দিয়া তোমরা খাইবা, এইটা কেমন কথা!

তপতী বললো, অ ঠাম্মা, দুই বাড়ি মিল্যা এক লগে করলে অয় না! পিকনিক পিকনিক মনে ওইবো।

ঠাকুরমা হেসে বললেন, এইটা তুই মন্দ কস নাই। কি গো হাসির মা, একলগে পিকনিক করবা? তোমারও খরচ বাঁচে, আমারও বাঁচে।

পিন্টুর মা হেসে বললেন, খরচের কথা উঠছে কেন মাসিমা? ঠিক আছে, আমি সব জোগাড় করে রাখবো। আপনি আর দিদি গিয়ে রান্নাটা চাপিয়ে দেবেন।

সব ক্যান তুমি জোগাড় করবা? তাইলে আর পিকনিক ওইবো ক্যামনে! মাছ আর মিষ্টি আমি লইয়া যামু। তুমি পোলাও আর মুরগি করবা?

এ রাম! ঠাম্মা। তুমি মুরগি খাইবা? হাসতে হাসতে বোনের গায়ে গড়িয়ে পড়লো রতনের ছোড়দি কেতকী।

মর ছেমরি, আমি ক্যান মুরগি খামু? খাইবো তর বাপে। ছোড থাকতে ঘোতনার নাম রাখছিলাম শিয়াল। মুরগি ছাড়া ভাত খাইতে চাইতো না।

সব কথা পাকা করে পিন্টুর মা বাড়ি ফিরলেন।

রতন আর পিন্টু তখন সূত্রাপুর বয়েজ ক্লাবে। দুদিন পর লালবাগের সঙ্গে ওদের ফুটবল টুর্নামেন্ট। আজ বিকেলে খবর এসেছে সূত্রাপুরের সেন্টার ফরোয়ার্ড মাখনের স্ট্রং ডায়রিয়া হয়েছে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বারোবার বাথরুমে গেছে। বিছানায় শুয়ে চিঁচিঁ করছে আর ওরস্যালাইন খাচ্ছে।

ফাইনাল খেলার দু দিন আগে এ খবর শুনে সূত্রাপুরের ক্যাপ্টেন লালু মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছে। কত কষ্ট করে তিন তিনটা সেকেন্ড ডিভিশন টীমকে হারিয়ে, একটাকে পয়সা দিয়ে বসিয়ে এ পর্যন্ত এসেছে। শেষে কিনা তীরে এসে তরী ডুববে! ওদের একজন ইন্টার স্কুল ফুটবল কম্পিটিশনের ফাইনালে পিন্টুর খেলা দেখেছিলো। বললো অই ক্যাপ্টেন, কাগজিটোলার পিন্টুরে লইয়া লও। তোমার আমাশা রুগির থেইকা বহুৎ ভালা খেলবো।

পিন্টুর কথা লালুও শুনেছে। তক্ষুণি একটা ছেলেকে পাঠিয়ে দিলো ওকে ডাকার জন্য। পিন্টু তখন রতনকে নিয়ে ওদের একতলা বাড়ির ছাদে বসে নারকেল দিয়ে গিয়ে ভাজা চিড়ে খাচ্ছিলো। সূত্রাপুর বয়েজ ক্লাব সেকেন্ড ডিভিশন লীগে খেলে। সেখানে থেকে ডাক আসতে পিন্টুর খুশি আর ধরে না। রতনকে সঙ্গে নিয়ে তখনই চলে এলো ক্লাবে। লালুর প্রস্তাবে ও এক কথায় রাজী। ক্লাবের সেক্রেটারি হাশমতউল্লা পিন্টুকে বললো, বাইরের পিলিয়ার আমাগো ক্লাবে আগেও খেলছে। তোমাকে আমরা বুধবারের খেলার লাইগা একস ট্যাকা দিমু। আর গোল পিছে পঞ্চাস ট্যাকা। হেট্টিক করবার পারলে তিন টাকা। আমার কাছে চুরি চোট্টামির কাম পাইবা না।

টাকার কথা পিন্টু স্বপ্নেও ভাবেনি। ভেতরে ভেতরে খুশিতে ফেটে পড়লেও বাইরে প্রকাশ করলো না। গম্ভীর হয়ে বললো, প্র্যাকটিস কবে থেকে?

কাইল সকালে, ধুপখোলার মাঠে!

ঠিক আছে, সকালে আসবো। বলে সেক্রেটারিকে সালাম দিয়ে পিন্টু আর রতন ক্লাব থেকে বেরিয়ে এলো!

রাস্তায় নেমে রতন খুশিতে জড়িয়ে ধরলো পিন্টুকে–তুই সেকেন্ড ডিভিশন টীমে খেলবি! আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।

পিন্টু হেসে বললো, খেলে টাকা পাবো, এমন কথা আমিও ভাবিনি। বল এটাও হরিমতিয়াদের জন্য! পথচারীদের চমকে দিয়ে দুই বন্ধু হো হো করে হেসে উঠলো।