১. ছুটির পর যাবি ওখানে

ছুটির পর যাবি ওখানে?

যাবো।

ছুরি নিয়েছিস?

নিয়েছি। উঁচু হয়ে থাকা পকেটটা পিন্টুকে দেখালো রতন। পাল্টা প্রশ্ন করলো, তুই নুন আর মরিচের গুঁড়ো নিয়েছিস?

হেসে স্কুল ব্যাগের ভেতর থেকে কাগজের পুরিয়া বের করে রতনকে দেখালো পিন্টু। স্কুল ছুটির পর ওরা আজ কাঁচা আম পাড়ার অভিযানে বেরোবে। গতকালই বাড়ি ফেরার সময় আলাপ করেছিলো। অভিযানের প্রস্তুতি ঠিকমতো নেয়া হয়েছে দেখে দুই বন্ধু হাসিমুখে ক্লাসের দিকে পা বাড়ালো। কারণ বুড়ো দপ্তরি কৃষ্ণপদ তখন ধীরে ধীরে ঢং ঢং করে পেতলের ঘন্টাটা বাজাচ্ছিলো।

ওরা দুজন এবার ক্লাস এইট থেকে নাইনে উঠেছে। লেখাপড়ায় খুব ভালো না হলেও পনের-মোলর নিচে কখনও নামে না। ওদের প্লেসও থাকে কাছাকাছি, কোনো কোনো বছর একজনের পরেই আরেকজন। কে ওপরে আর কে নিচে থাকলে এ নিয়ে ওরা কখনও মাথা ঘামায় না। ক্লাসের টিচাররা ওদের বলেন, মানিক জোড়। ইনফ্যান্ট ক্লাস থেকে পুরোনো ঢাকার লক্ষী বাজারের এই মিশনারি স্কুলটায় ওরা পড়ছে। কেউ বলতে পারবে না কোনোদিন ওরা ক্লাসে অনুপস্থিত ছিলো! পড়াশোনার জন্য প্রাইজ না পাক, পারফেক্ট এ্যাটেনডেন্স-এর প্রাইজটা ওদের জন্য বাঁধা। তবে ক্লাসের পড়া ভালো না লাগলেও গল্পের বই হাতের কাছে পেলেই ওরা গোগ্রাসে গিলে ফেলে। বিশেষ করে রোমাঞ্চ আর রহস্যের বই পেলে তো কথাই নেই!

কাগজিটোলার গলির মুখে পিন্টুদের বাসা আর গলির শেষ মাথায় রতনদের বাসা। স্কুলের দিন রোজ সকালে রতন বাসা থেকে বেরিয়ে পিন্টুদের দরজার বাইরে থেকে ওকে ডাকে। পিন্টু তৈরি থাকে। রতনের ডাক শোনার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে আসে। বাসায় ওরা চারজন মানুষ। বাবা, মা, বড় বোন হাসি আর ও নিজে। ঠিকে ঝি হাজেরা বুয়া সকাল বিকাল দু বেলা এসে থালা বাসন মেজে, ঘর ঝাট দিয়ে, কাপড় কেচে চলে যায়। রান্নার কাজ মা নিজে করেন। রতনদের বাড়িতে অনেক মানুষ। ভাই বোন ওরা সাত জন, মা বাবা আছেন, আর আছেন বুড়ি ঠাকুরমা। রতনরা ডাকে ঠাম্মা।

রতনের বাবা শ্যামবাজারে বসাকদের চালের আড়তে ম্যানেজারের কাজ করেন। ওর বড় ভাই যতীন ইসলামপুরে সাহাদের জুয়েলারি শপ-এর সেলসম্যান। ওদের বাড়ির অবস্থা বেশি ভালো নয়। পিন্টুর বাবা এজি অফিসে চাকরি করেন। বেতন যদিও রতনের বাবার সমানই, তবে গ্রামের বাড়ি থেকে সারা বছরের চাল আসে। যে জন্য রতনদের চেয়ে পিন্টুদের বাড়ির অবস্থা ভালো। অবশ্য ওদের বাড়িতে মানুষের সংখ্যা রতনদের তুলনায় অনেক কম, অবস্থা ভালো হওয়ার সেটাও একটা কারণ।

রতনের বাবা বয়সে পিন্টুর বাবার চেয়ে সাত আট বছরের বড় হবেন। তারপরও প্রায় সন্ধ্যায় দুজন এক সঙ্গে বসে দাবা খেলেন, নয়তো রহমত ব্যাপারীর গদিতে বসে অন্যদের সঙ্গে আড্ডা দেন। রতনকে যেমন পিন্টুদের বাড়ির কেউ বাইরের ছেলে মনে করে না, পিন্টুকেও রতনদের বাড়িতে সবাই ঘরের ছেলে মনে করে। পিন্টু ভালো আঁকতে পারে বলে রতনের ঠাকুরমা ওকে দিয়ে লক্ষী পূজোয় আলপনা আঁকিয়ে নেন। পিন্টুদের বাড়িতে শামী কাবাব খেয়ে রতন বোনদের কাছে গল্প করে। ওদের বাড়ির সবাই জানে শামী কাবাব গরুর মাংস দিয়ে বানায়। ঠাকুরমার কানে গেলে শুধু বলেন, খবরদার, চান না করে আমাকে ছুবি না। মাঝে মাঝে রতনের বড় পিসি ওদের বাড়িতে এসে এসব অনিয়মের কথা শুনলে খানিক হইচই করেন। ঠাকুরমা হেসে বলেন, আজকাল কি আর এত বাছ বিচার করে চলা যায় বাছা!

বকরি ঈদের সময় মতনের বাবাও কয়েক বার পিন্টুদের বাড়িতে গরুর গোশত খেয়েছেন, তবে সে কথা বাড়ির কাউকে বলেননি।. পিন্টুর বাবাও রতনদের বাড়িতে এসে সোনাহেন মুখ করে কাঁকড়ার ঝোল খেয়ে তারিয়ে তারিয়ে বন্ধুদের কাছে গল্প করেছেন। কচ্ছপও খেতে চেয়েছিলেন, রতনদের বাড়িতে কেউ খায় না বলে পিন্টুর বাবার খাওয়া হয়নি। পিন্টু নিজেও ওর বাবার মতো সর্বভুক। চীনারা সাপ খায় শুনে ওর এক বড়লোক মামার সঙ্গে চাইনিজ রেস্টুরেন্টে গিয়ে সাপ খেতে চেয়েছিলো। রেস্টুরেন্টের চীনা ম্যানেজার হেসে বলেছে সাপ খেতে হলে চীনে যেতে হবে। আর চীনে একবার যেতে পারলে শুধু সাপ কেন, ব্যাঙ থেকে শুরু করে অক্টোপাস পর্যন্ত সবই খেতে পাওয়া যাবে। রতন অবশ্য গরুর মাংসে মজা পেলেও সাপ ব্যাঙ ওর রুচি নেই।

সেদিন বিকেলে স্কুল ছুটির পরই দুই বন্ধু হাঁটতে হাঁটতে কাঠের পুল পার হয়ে গেন্ডারিয়া স্টেশন ছাড়িয়ে গ্রামের দিকে চলে গেলো। ভাগ্যকূলের জমিদারদের এক পরিত্যক্ত বাগানবাড়ি ওরা আগে থেকেই খুঁজে বের করেছিলো। মস্ত বড় বাড়িটা অনেক পুরোনো, বেশির ভাগ ঘরেরই দরজা জানালা নেই, মোটা চুন সুরকির আস্তর দেয়া ছোট ছোট ইটের দেয়ালও অনেক জায়গায় ভেঙে পড়েছে। সবাই বলে এ বাড়িতে বাদুড় আর কবুতর ছাড়া মস্ত বড় কালো কালো যে সব সাপ ঘুরে বেড়ায় সেগুলো আসলে নাকি জ্বীন। জমিদারদের অত্যাচারী পূর্ব পুরুষদের অনেকের আত্মা নাকি মুক্তি পেয়ে এখনও বাড়ির চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। গ্রামের কেউ ভয়ে বাড়ির ত্রিসীমানায়ও যায় না। তারপরও পিন্টু আর রতন আম পাড়ার জন্য এ বাড়িটাই বেছে নিয়েছে।

বাড়ির পেছনের বাগানে আম, লিচু, জাম, কাঁঠাল, চালতা, কামরাঙা–সব গাছই আছে। ভূতের ভয়ে মানুষ আসে না, পাকা ফল সব বাদুড়ে খায়। গত বছর থেকে পিন্টু আর রতন বাদুড়দের দলে ভিড়েছে। অবশ্য বাদুড়দের জ্বালায় পাকা ফল খাওয়ার জো নেই। কাঁচা আম বাদুড় খায় না বলেই রক্ষে।

এবার একটা গাছেই আম ধরেছে। তাও অনেক দেরিতে। একেকটা গাছের বয়স তো কম হলো না। খুনখুনে বুড়ো অযত্বের গাছগুলোতে দুতিন বছরে একবার ফল ধরে। আম গাছের গোড়ার দিকে বোলতার বাসা ছিলো। তাই ঢিল ছুঁড়ে মাত্র পাঁচটা আম পাড়তে পেরেছে ওরা। দাম শ্যাওলায় ঢাকা পুকুরের ভাঙা ঘাটে বসে সেই আম ওরা লবন আর মরিচের গুঁড়ো দিয়ে জিভে টকাস টকাস শব্দ তুলে খেলো।

জায়গাটা অস্বাভাবিক রকম চুপচাপ। এত গাছপালা তবু পাখির সাড়াশব্দ নেই। গ্রামের লোকে বলে অভিশপ্ত হানাবাড়িতে বাদুড় ছাড়া অন্য কোনো পাখি থাকে না। অন্য প্রাণীদের ভেতর একমাত্র সাপ থাকে, তাও নাকি সত্যিকারের সাপ নয়। আমের শেষ টুকরোটা চিবোতে চিবোতে পিন্টু বললো, এতদিন এখানে এলাম বাড়ির ভেতরটা কখনও দেখা হলো না।

পিন্টুর কথা রতনের পছন্দ হলো না। শুকনো মুখে বললো, বাড়ির ভেতর সাপ খোপ ছাড়া দেখার কী আছে?

এরকম বাড়িতেই গুপ্তধন থাকে।

যদি থাকে নিশ্চয় পাহারা দেয়ার জন্য যখেরা আছে।

তুই কী করে জানলি যখ আছে?

ঠাম্মার কাছে যখের কথা কত শুনেছি! ওদের এক পূর্বপুরুষ দশ ঘড়া মোহর মাটিতে পুতে দশ বছরের একটা ছেলেকে মেরে যখ বানিয়ে সেগুলো পাহারা দেয়ার জন্য বসিয়ে রেখে গেছেন। লোভে পড়ে কয়েকবার ডাকাতরা চেষ্টা করেছিলো সেগুলো উদ্ধার করতে। সব কটা মুখে রক্ত উঠে মরেছে।

ঠিক আছে, গুপ্তধনে কাজ নেই। এমনি চল না ঘুরে আসি।

যাবি? সন্ধ্যে হতে আর বেশি দেরি নেই।

বেশিক্ষণ থাকবে না। সূর্য ডোবার আগেই বেরিয়ে আসবো। বলে উঠে দাঁড়ালো পিন্টু।

ওকে ফেরানো যাবে না। একথা ভালো করেই জানে রতন। নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে পিন্টুর সঙ্গে ভাগ্যকূলের জমিদারদের ভাঙ্গা বাড়িটার দিকে পা বাড়ালো। মনে মনে ঠাকুরমার মতো করে বললো, দুর্গা দুর্গতিনাশিনী, রক্ষা কর মা!

পিন্টুর ধারণা ছিলো হানাবাড়ির ভেতর গুপ্তধন না পাক অন্তত ভয়ঙ্কর কোনো ডাকাতদলের গোপন আস্তানা আবিষ্কার করে ফেলবে। রহস্য কাহিনীগুলোতে প্রায়ই দেখা যায় হানাবাড়িগুলো হয় ভূত-প্রেত নয়তো চোর ডাকাতের আখড়া। এসব বই পড়তে পড়তে অনেক সময় ওর মনে হয়েছে ও নিজে যদি সত্যি সত্যি এমন কোনো ডাকাতের দলের সন্ধান পেতো। খবরের কাগজে ওর ছবি ছাপাতো। গলায় সোনার মেডেল পরিয়ে দেয়া হতো–আরও কত কিছু হতো, কিন্তু বাস্তব জীবন নন্দী স্যারের অংক ক্লাসের মতোই নিরস আর একঘেঁয়ে।

ভাঙা বাড়ির বারান্দাটা এক সময় শ্বেত পাথরে বাঁধানো ছিলো। বেশ কিছু চৌকো পাথরের টুকরো কারা যেন খুবলে তুলে নিয়ে গেছে। খোলা জায়গায় পোড়া ঘায়ের মতো ফ্যাকাশে লাল সুড়কি দেখা যাচ্ছে। শ্বেত পাথরের ছিটেফোঁটা টুকরো যাও আছে পুরু ধুলোর চাঁদরে সব ঢাকা পড়েছে।

বড় বড় ফাটল ধরানো সিঁড়ি বেয়ে নিচের তলার টানা বারান্দায় উঠেই রতন আঁতকে উঠলো। হাত পাঁচেক লম্বা সাপের খোলস পড়ে আছে সামনে, বোঝা যায় অল্প কিছু দিন আগে ছেড়েছে। ভয় পেয়ে ও সরে এসে পিন্টুর হাত ধরলো। পিন্টু মৃদু হেসে বললো, সাপের খোলস দেখেই এত ভয়! সত্যিকারের সাপ দেখলে না জানি কী করবি।

থাক। সামান্য রুক্ষ গলায় রতন বললো, অবহেলায় ওসব জিনিসের নাম মুখে নেয়ার দরকার নেই।

পিন্টু হাসলো, তুই দেখছি সেকেলে বুড়িদের মতো কথা বলছিস!

রতন মনে মনে বললো, যখন ধরে ঘাড় মটকে দেবে তখন টের পাবি মজাটা।

লম্বা বারান্দার ওপাশে বড় হলঘরে দরজা জানালা কিছুই নেই। ভেতরের দিকে কয়েকটা নড়বড়ে চৌকাঠের সঙ্গে এক আধখানা ক্ষয়ে যাওয়া কাঠের পাল্লা ঝুলছিলো। ধুলো আর মাকড়শার জাল দেখে মনে হয় একশ বছরে কেউ এ বাড়িতে পা রাখেনি। ওদের পায়ের সাড়া পেয়ে ঝটপট করে দুটো বাদুড় উড়ে গেলো। রতন আরেকবার আঁকড়ে ধরলো পিন্টুর হাত। স্কুল টীমে ক্রিকেট ফুটবল দুটোই খেলে পিন্টু। রতনকে অনেক বলেও খেলার মাঠে নামাতে পারেনি ও। শুধু ভূতের ভয় নয়, ক্রিকেট বলকেও ভয় পায় ও। পিন্টুর ফুটবল খেলা দেখার সময় সাইড লাইন থেকে দশ হাত দুরে গিয়ে বসে। অত বড় একটা বল কখন ছিটকে এসে নাকে মুখে লাগে সে ভয়ে সারাক্ষণ ফুটবলের মাঠে সিঁটিয়ে থাকে রতন।

হলঘরের পর দুটো কড়ি বরগা খসে পড়া ঘর পেরিয়ে বাড়ির পেছনে এসে রতন আর পিন্টু দুজনই চমকে উঠলো। এক সময় এদিকটায় বাগান ছিলো। গোটা পাঁচেক গন্ধরাজ ফুলের নড়বড়ে বুড়ো গাছ ছাড়া বাকি সব জংলা লতা আর কাঁটা ঝোপে ভরা। ডান পাশে শান বাঁধানো কুয়োতলা দেখা যাচ্ছে। কুয়োর উঁচু পাড়ের খানিকটা ভাঙা হলেও জায়গাটা বেশ পরিস্কার। একপাশে দড়ির ওপর রংচটা একটা শাড়ি শুকোতে দেখে ওরা ভীষণ অবাক হলো। শাড়িটা মোটা কাপড়ের, মাঝে মাঝে শেলাই করা, এক জায়গায় তালিমারা, বাতাসে আস্তে আস্তে দুলছে।

পিন্টু চাপা গলায় বললো, তার মানে এখানে লোক থাকে!

রতন বললো, যেই থাকুক নিশ্চয় ভালো লোক নয়।

গুন্ডাদের আখড়ায় শাড়ি আসবে কোত্থেকে?

হয়তো কাজের ঝি-টি হবে।

দেখে তো মনে হয় ফকিরণীর কাপড়।

পিন্টুর একটা হাত ধরে রতন বললো, চল ফিরে যাই। খারাপ লোক কেউ থাকলে মেরে লাশ গুম করে দেবে।

এতই সোজা! হাতের মাসল দেখিয়ে পিন্টু বললো, কে কাকে লাশ বানায় দেখে নেবো।

পিন্টুর এসব গোঁয়ার্তুমি রতনের একটুও ভালো লাগে না। আবার ওকে ছাড়া এক পাও চলতে পারে না। আপন মনে গজ গজ করতে করতে বললো, কিছু যদি হয় আমাকে দোষ দিতে পারবি না।

মুখ টিপে হেসে পিন্টু বললো, কিছুই হবে না। চল ওদিকের ঘরগুলোয় গিয়ে দেখি। গুন্ডা, বদমাশের আস্তানা হলেও বোঝা যাচ্ছে ওরা কেউ এখন নেই।

বড় বাড়িটা থেকে অল্প দূরে এক লাইনে পাশপাশি গোটা ছয়েক ঘর। ডান পাশের দুটো ঘরের ছাদ ভেঙে পড়লেও বাঁ পাশের দুটো ঘর মোটামুটি অক্ষতই বলা চলে। যদিও দেয়ালের চুন সুড়কির আস্তর খসে পড়ে ছোট ছোট লাল ইটগুলো দাঁত বের করে আছে, তবু দরজা দুটো অক্ষত ছিলো। জায়গাটাও বেশ পরিস্কার।

ঘরগুলোর দিকে ওরা কয়েক পা এগিয়ে গেলো। রতনের মনে হচ্ছিলো এই বুঝি দরজা খুলে কোমরে লাল গামছা বাঁধা টকটকে লাল চোখওয়ালা ষন্ডা মতো লোক রামদা হাতে বেরিয়ে আসবে, আর কিছু বলার আগেই এক কোপে ওদের ধড় থেকে মুন্ডুটা আলাদা করে দেবে, ঠিক যেভাবে সুরিটোলার সিংহীদের বাড়িতে কালীপূজোয় পাঁঠাবলি হয়। রতনের দিকে পিন্টুর তখন কোনো খেয়ালই নেই। আগে আগে হাঁটছিলো ও, যদিও সতর্ক ছিলো ষোলআনা।

দরজা বন্ধ করা ঘরটার কাছে এসে থমকে দাঁড়ালো ওরা। পিন্টু ভেবেছিলো ঘরে কেউ নেই, দরজা বুঝি বাইরে থেকে বন্ধ। কাছে আসতেই ওর ভুল ভাঙলো। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করা। কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। শেষ বিকেলের নরম আলোয় অসম্ভব নির্জন জায়গাটাকে মনে হচ্ছিলো পৃথিবীর বাইরে অন্য কোনো জগৎ। যে পিন্টু কোনো কিছুই ভয় পায় না ওর বুকের ভেতরটাও একটু শির শির করে উঠলো। রতনের মনে হচ্ছিলো ভাগ্যকূলের জমিদারদের অত্যাচারী পূর্বপুরুষদের অতৃপ্ত আত্মারা ওর চারপাশে কূপিত হয়ে নিঃশ্বাস ফেলছে ওদের এলাকায় অবাঞ্ছিতদের অনধিকার আগমনের জন্য।

ওদের চোখের সামনে বন্ধ দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে গেলো। অন্ধকার ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো শনের মতো সাদা চুলওয়ালা কুচকুচে কালো এক চিমসে বুড়ি। চোখ দুটো গর্তে বসা, নাকটা টিয়া পাখির ঠোঁটের মতো, হাতে একটা চকচকে বাঁকানো লাঠি। রতনের মনে হলো অন্ধকারের জগত থেকে আসা এক ডাইনির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে ওরা। এক্ষণি বুঝি বিকট শব্দে চিৎকার করে উঠবে ডাইনিটা। সঙ্গে সঙ্গে দশ বারোটা হিংস্র কালো বেড়াল ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওদের টুটি ছিঁড়ে ফেলবে আর ফিনকি দিয়ে ছিটকে আসা রক্ত শুষে খাবে ভয়ঙ্কর এই ডাইনি। ভয়ে রতনের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। দুহাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো পিন্টুর হাত।

দরজা খুলে দুটো অচেনা ছেলে দেখে বুড়ি নিজেও ভীষণ ভয় পেয়েছে। লোকজনের চোখের আড়ালে থাকার জন্য অনেক খুঁজে এই পরিত্যক্ত ভাঙা বাড়িটা বের করেছে। এখন বুঝি এটাও হাতছাড়া হয়! ভয়ে কাঁপতে কাপঁতে বুড়ি বললো, তুমরা কুথা থিকা আসছো বাবুজীরা? হামলোগ তো কুছু করি নাই।

বুড়ির কথায় হিন্দুস্তানি টান। পিন্টু জিজ্ঞেস করলো, তোমরা কারা, এখানে কি করছো?

হামার নাম হরিমতিয়া। ইখানে হামি আর আমার মা থাকি। মার বহুৎ বিমার হইয়েছে। গিলাস ফিকটরির বগলে হামাদের ঘর ভাঙ্গিয়া দিল গারমিন। মার বিমার দেখে সবলোগ ভাগাইয়া দিল। থাকনের কুন জায়গা না পাইয়ে ইখানে আসছি। বাবুসাব, হামরা কারও ক্ষেতি করি নাই।

ভয় পেয়ো না। বুড়িকে আশ্বস্ত করে পিন্টু বললো, আমরা তোমাদের কথা কাউকে বলবো না। তোমরা কি বিহারী?

না বাবু, হামাদের গাঁও মাদ্রাজে। হামার দাদা ইখানে আসছিলো কামের তালাশে। হামার বাপ দাদারা ধাঙ্গড়ের কাম করতো। মার যখন বিমার ছিল না হামিও মিনসিপালিটিতে জমাদারনির কাম করতাম। অখুন পুরা কাম করতে পারি না। টিশনে ঠিকা কাম করি। বুড়া বিমার মাকে নিয়ে কুথায় যাই বাবু! বহুৎ মুসিবতে আছি।

মার অসুখ হয়েছে হাসপাতালে যাও না কেন? ভাল ডাক্তার দেখাও।

ধাঙ্গড়দের হাসপাতালে থাকতে দেয় না বাবুজী। ডাক্তার দিখানোর রুপিয়া কই পামু? দো ওয়াক্ত সুখা রোটি ভি দিতে পারি না বিমারি মাকে। বলতে বলতে বুড়ি ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললো।

তুমি কেঁদো না হরিমতিয়া। সান্ত্বনার গলায় পিন্টু বললো, আমাদের পরিচিত এক ডাক্তার আছে। তোমার মাকে আমরা ডাক্তার দেখাবো।

কাঁদতে কাঁদতে হরিমতিয়া বললো, ভগবান তুমাদের ভালা করবেন বাবুজী। পরসু মাহিনা মিলবে। দো রোজ মাকে খানা দিতে পারি নাই।

পিন্টু রতনের কানে কানে বললো, তোর কাছে টাকা আছে?

বুড়িকে কাঁদতে দেখে রতনের ভয় কেটে গিয়ে ওর জন্য গভীর মমতায় বুকটা ভরে গেছে। বললো, তিন টাকা আছে, বলপেন কেনার জন্য রেখেছিলাম।

আমার কাছে দশ টাকা আছে। তোকে আমার একটা কলম দেবো। চল, আগে এদের কিছু খাবার কিনে দিই। এই বলে হরিমতিয়ার দিকে তাকালো পিন্টু–আমরা তোমাদের জন্য আটা আনছি। ভয় পেয়ো না।

গেন্ডারিয়া স্টেশনের আগেই একটা মুদির দোকান আছে। হেঁটে গেলে মিনিট পনেরো লাগতো। পিন্টু আর রতন দৌড়ে আসাতে সাত মিনিট লাগলো। দুজনের টাকা দিয়ে ওরা এক কেজি আটা, দুটাকার মুড়ি আর এক টাকার পেঁয়াজও কিনলো। স্কুলের বিহারী দারোয়ান কুদরত খানকে ওরা দেখেছে পেঁয়াজ দিয়ে রুটি খেতে। সূর্য ডোবার আগেই ওরা এলো হানাবাড়িতে। আটা পেয়ে অভুক্ত হরিমতিয়া–ভগবান তুমাদের.. বলে আরেক দফা কাঁদলো।

ওরা ফিরে দেখলো দরজার এক পাশে হরিমতিয়ার মা বসে আছে কুঁজো হয়ে। সারা মুখে আর গায়ের চামড়া কুঁচকে গেছে। হরিমতিয়ার কথা শুনে ওর মা মাথা তুলে চোখ পিট পিট করে কফ জমানো ঘড়ঘড়ে গলায় কী বললো কিছুই বোঝা গেলো না। চোখের পানি মুছে হরিমতিয়া বললো, মা বুলছে তুমরা দেওতা আছ। ভগমান তুমাদের পাঠাইছে।

পিন্টু হেসে বললো, আমরা দেবতা নই, মানুষ। মানুষের বিপদে মানুষকে পাশে দাঁড়াতে হয়।

কথাটা ওদের বাংলার নলিনী স্যার সব সময় বলেন। প্রাণীদের ভেতর একমাত্র মানুষই একজনের বিপদে আরেকজন পাশে এসে দাঁড়ায়। পশুদের সঙ্গে মানুষের তফাৎ হচ্ছে–পশুরা নিজের জন্য বাঁচে, মানুষ শুধু নিজের জন্য বাঁচে না, সমাজের কথাও ভাবে।

রতন বললো, হরিমতিয়া আজ আমরা যাই। কাল না হয় পরশু ডাক্তার নিয়ে আসবো।

হরিমতিয়া শুকনো গলায় বললো, জানাজানি হলে আমাদের মুসিবত হোবে বাবুজি। ফির হামার বিমারি মাকে নিয়ে বেঘর হোতে হোবে।

না না, কেউ জানবে না।

কফ জড়ানো গলায় হরিমতিয়ার মা,আবার কিছু বললো। হরিমতিয়া একটু বিব্রত হলো। একটু ভয়ে ভয়ে বললো, মা বুলছে বাবুজি তুমলোগ হিন্দু আছ না মুসলমান আছ?

পিন্টু আর রতন একে অপরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। পিন্টুর কাঁধে হাত রেখে রতন বললো, হরিমতিয়া আমরা হিন্দুও নই, মুসলমানও নই। আমরা তোমার মতোই মানুষ।