৭. শহরে প্রচণ্ড উত্তেজনা

পরদিন সারা শহরে প্রচণ্ড উত্তেজনা। সকালে খবরের কাগজগুলোতে বড় বড় হেডিং করা হয়েছে বাবরী মসজিদ বিধ্বস্ত। কাগজের চেহারা দেখে মনে হয় কে কত বড় হেডিং করতে পারে সেই প্রতিযোগিতায় নেমেছে সবাই। কোনো কোনো কাগজে খুবই উত্তেজক ভাষায় হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের উস্কে দিয়ে অনেক কথা লিখেছে।

সকালে ঢাকা শহরের কোনো হিন্দুর দোকান খোলেনি। যারা সরকারী চাকরি করে তাদের কেউ কেউ সাহস করে বাড়ি থেকে বের হলেও সবাই ভয়ে বাড়িতে বসে থাকলো। দু একজন বাধ্য হয়ে বাজারে গিয়ে পরিচিত দোকানিদের কাছ থেকে আজে বাজে কথা শুনে এসেছে।

রাতে রতনের সেজদি আর ছোড়দি পিন্টুদের বাসায় ছিলো। রাতে অবশ্য কোনো গন্ডগোল হয়নি। সন্ধ্যায় যা দুই একটা মিছিল বেরিয়েছিলো। পিন্টুরা পাড়ায় শান্তি কমিটি করেছে। গত রাতে ইরফান ডালপট্টি, হেমেন্দ্র দাস রোড, রূপচাঁদ লেন, সূত্রাপুর বাজার, গেন্ডারিয়া আর ফরাশগঞ্জের লোকজনদেরও মিটিং-এ ডেকেছিলো। বেশির ভাগই ছিলো তরুণ, কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। কয়েকজন সবে চাকরিতে ঢুকেছে। শুধু পিন্টু আর ডালপট্টির সোহরাব ছিলো স্কুলের ছাত্র।

মিটিং-এ ঠিক হয়েছে সবাই গ্রুপ ভাগ করে রাত জেগে পালা করে পাড়া পাহারা দেবে। কোথাও হামলা হলে সবাই মিলে শ্লোগান দেবে–জাগো জাগো বাঙ্গালী জাগো। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের আগে এ শ্লোগান দিয়ে বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলমান বৌদ্ধ-খৃষ্টান সবাই একজোট হয়েছিলো। হামলাকারীদের যেভাবে হোক ঠেকাতে হবে। গলির মুখের বাড়িগুলোর ছাদে মেয়েরা ইটের টুকরো, গরম পানি, শুকনো মরিচের গুড়ো নিয়ে তৈরি থাকবে। ছেলেরা থাকবে লাঠি হাতে। কারও যদি বন্দুক থাকে সেটাও তৈরি রাখতে হবে। মোট কথা এ এলাকায় কোনো অবস্থায় হিন্দুদের ঘরবাড়ি বা মন্দিরে কাউকে হামলা করতে দেয়া হবে না।

সকালে নাশতা খেয়েই পিন্টু ছুটলো। রতনদের বাড়িতে। পাড়ার অন্য হিন্দুরা সব চৌধুরী ভিলায় আশ্রয় নিয়েছে। তাদের বাড়ির লোহার ফটকের বাইরে চারজন বন্দুকধারী পুলিশ পাহারা দিচ্ছে। শুধু রতনরা নিজেদের বাড়িতে আছে।

রতনদের বাড়ি গিয়ে পিন্টু দেখলো ওর বাবা, বড়দা কেউ কাজে যায়নি। রতন ভেতরের বারান্দায় বসেছিলো। পিন্টু ওকে জিজ্ঞেস করলো, নাশতা করেছিস?

রতন মাথা নাড়লো। ওর মা জানতে চাইলেন, তপতী আর কেতকী কেমন আছে বাবা?

ঠিকই আছে। এ পাড়ায় কোনো গুন্ডা বদমাশকে আমরা ঢুকতে দেবো না।

রতনের বড়দা বললে, পাড়ায় না হয় কেউ এলো না। কাজে বেরোবার সাহসও তো পাচ্ছি না।

রতনের বাবা বললেন, কথা নেই বার্তা নেই পাশের বাড়ির ছেলেটা সকালে ইনকেলাব পত্রিকাটা দিয়ে গেছে পড়ার জন্য। পড়তে গিয়ে হাত পা সব হিম হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে বাংলাদেশের একজন হিন্দুও আস্ত থাকবে না।

গত রাতে ইরফান যেভাবে বলেছিলো–গম্ভীর হয়ে পিন্টু বললো, দু একদিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে কাকাবাবু।

রতনের ঠাকুরমা ভাঙা গলায় বললেন, তাই যেন হয় বাছা।

রতনের মাকে পিন্টু জিজ্ঞেস করলো, কাকিমা, বাজার থেকে কিছু আনতে হবে?

বাজার করে কী হবে বাবা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রতনের মা বললেন, আলু ভাতে ফুটিয়ে রাখবো, কারও ইচ্ছে হলে খাবে।

রতনদের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিলো বাড়ির কেউ বুঝি কিছুক্ষণ আগে মারা গেছে। পিন্টু আর কোনো কথা না বলে চলে এলো। ভেবেছিলো রতন ওকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেবে, কিন্তু ও এলো না। বারান্দায় খামের গায়ে হেলান দিয়ে যেভাবে বসেছিলো সেভাবেই বসে রইলো৷ পিন্টু বাইরে এসে বললো, রতন দরজাটা বন্ধ কর।

বাড়িতে না গিয়ে পিন্টু সোজা সূত্রাপুর বাজারে এলো। লক্ষ্য করলে বেশ কয়েকটা দোকান বন্ধ। কয়েকজন পরিচিত মাছওয়ালাকেও দেখতে পেলো না। মুদি দোকান থেকে একটা ব্যাগ কিনে দুসের মুগডাল এক কেজি তেল কিনলো। তরকারির বাজারে গিয়ে দু কেজি করে আলু, সিম আর ফুলকপি কিনলো। মাছের বাজারে গিয়ে এক কুড়ি শিং আর মাগুর মাছ কিনলো। এ রকম অবস্থা কদিন চলবে কে বলতে পারে! রতনরা বাজারে যেতে পারবে না, ঘর থেকে বেরোতে পারবে না–শেষে কি ওরা না খেয়ে মরবে?

বাজার নিয়ে পিন্টু আবার রতনদের বাড়ি এলো। বাজারের থলেটা রতনের মার হাতে দিয়ে বললো, কাকিমা, কোনো কিছুর দরকার হলে রতনকে বলবেন আমাকে খবর দিতে। পাড়ার ভেতর কোনো ভয় নেই।

রতনের মা শুকনো গলায় বললেন বটে–এসব কেন আনতে গেলে, কিন্তু তিনি ভালো করেই জানেন ঘরে কয়েক সের চাল ছাড়া খাবার কিছুই নেই। পিন্টু চলে যাওয়ার পর ভাবছিলেন ওকে দিয়ে সের দুই আলু পটল আনিয়ে নিলে ভালো হতো। ছেলেটার জন্য গভীর মমতায় তার বুক ভরে গেলো।

যাবার সময় পিন্টু রতনকে বললো, আমি একটু স্কুলের দিকে যাব। তুই দুপুরে একবার আসিস।

বাড়িতে মাকে বলে পিন্টু হাঁটতে হাঁটতে লক্ষীবাজারের দিকে গেলো। পথে ঋষিকেশ দাস রোডে একটা মিষ্টির দোকান লুট হতে দেখলো। বেশি নয় দশ বারো জন লোক লাঠি, রড, হকি ষ্টিক হাতে দোকানের কাঠের ঝাঁপ ভেঙে ফেলেছে। কয়েকজনের মুখে দাড়ি, মারমুখী চেহারা। দোকান ভাঙার পর একজন ক্যাশ বাক্স নিয়ে দৌড় দিলো আর রাস্তার টোকাইরা আঁপিয়ে পড়লো শো কেসে সাজিয়ে রাখা মিষ্টির ওপর। বোধহয় কাল বিকেলে বানানো হয়েছে, প্রায় সবগুলো থালাই ভরা ছিলো নানা রঙের মিষ্টিতে।

অল্প দূরে তামাশা দেখার জন্য তোকজন ভিড় করেছে। দূরে মোড়ের কাছে দুটো পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। এদিকে যে এত হল্লা হচ্ছে, সেদিকে ওদের নজরই নেই।

নিজের ওপরই প্রচন্ড রাগ হলো পিন্টুর। চোখের সামনে এমন একটা অন্যায় ঘটনা দেখেও ওর করার কিছু নেই। সবাই মিলে বাধা দিলে দোকান লুট করতে আসা শয়তানগুলো ঠিকই পালিয়ে যেতো। কেউ কিছু বললো না। বরং কয়েকজনের চেহারা দেখে মনে হলো এতে ওরা খুশি হয়েছে। দ্রুত পা চালিয়ে ওখান থেকে সরে এলো পিন্টু। নিজেকেই ওর অপরাধী মনে হচ্ছিলো।

সোহরাওয়ার্দী কলেজ পেরিয়ে নন্দলাল দত্ত লেনের কাছে এসে থমকে দাঁড়ালো পিন্টু। পরনে পায়জামা পাঞ্জাবি, হাতে বাজারের খালি ব্যাগ, গলির মুখে দাঁড়িয়ে ভীত সন্ত্রস্ত মুখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন বুড়ো নলিনী স্যার। গলি পেরিয়ে লক্ষীবাজারের বড় রাস্তায় নামার সাহস পাচ্ছিলেন না তিনি। স্কুলের শুরু থেকে গত দশ বছর যাকে ধূতি পাঞ্জাবি ছাড়া দেখেনি, যার চেহারায় সারাক্ষণ কর্তৃত্বপূর্ণ একটা রাগী ভাব ফুটে থাকে, তাকে ভীত অসহায় অবস্থায় এরকম পোষাকে দেখে পিন্টুর বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। কোথায় কারা কোন বাবরী মসজিদ ভেঙেছে তার জন্য নলিনী স্যারের এ অবস্থা কেন হবে এর কোনো কারণ খুঁজে পেলো না ও।

কাছে এসে নরম গলায় প্রশ্ন করলো, স্যার, আপনি কি বাজারে যাচ্ছেন?

চমকে উঠে পিন্টুর দিকে তাকালেন নলিনী স্যার। যেন অকূল সমুদ্রে ডুবতে গিয়ে একটা শক্ত অবলম্বন খুঁজে পেলেন। ভাঙা গলায় বললেন, হ্যাঁ বাবা। ওদিকে শুনছি লুটপাট আর আগুন লাগানো শুরু হয়ে গেছে। ঘরে এক মুঠো চাল নেই।

পিন্টু ওঁর হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে বললো, স্যার আপনি বাড়ি যান। আমি চাল নিয়ে আসছি।

নলিনী স্যার ওর হাতে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট গুঁজে দিয়ে বললেন, বাবা, পারলে এক সের আলুও এনো।

কথা না বাড়িয়ে পিন্টু একটা রিকশা ডেকে রায় সাহেবের বাজারে এলো। এ বাজারের অবস্থাও সূত্রাপুর বাজারের মতো। অনেকগুলো মুদির দোকান বন্ধ। মাছের বাজারও বেশ ফাঁকা। জেলেদের ভেতর এখনও হিন্দুর সংখ্যা কম নয়।

রতনদের জন্য যে রকম বাজার করেছিলো, নলিনী স্যারের জন্যেও সে রকম করলো পিন্টু। স্যারের বাড়িতে ও আগেও কয়েকবার গেছে। বাড়িতে স্যারের স্ত্রী, পিসিমা, এক বিধবা বোন আর দুই মেয়ে আছে। বাড়িতে পুরুষ মানুষ বলতে শুধু তিনি। স্যারের একটাই ছেলে, বিয়ে করে কানাডায় আছে। বাপের কোনো খোঁজ খবর নেয় না। বেতনের টাকায় সংসারের খরচ চলে না বলে স্যার বাড়িতে কোচিং ক্লাস করেন।

বাজার থেকে বেরিয়ে পিন্টু রিকশায় উঠতে যাবে এমন সময় দেখলো রড আর লাঠি হাতে কতগুলো লোক হই হই করে নবাবপুরের দিকে ছুটে যাচ্ছে। বেশির ভাগই লুঙ্গি পরা। কারো গায়ে সুয়েটার, কারও গায়ে চাদর। ওদের সামনে পায়জামা আর লম্বা কোর্তা পরা দুই কালো দাড়িওয়ালা লোক ছিলোবোঝা যায় এরাই নেতৃত্ব দিচ্ছে। মারমুখী মিছিলের শেষে কয়েকটা টোকাইও দৌড়াচ্ছে। পিন্টু জানে নবাবপুরে হিন্দুদের বেশ কিছু দোকান আছে। ওদের ক্লাসে পড়ে দীপক, নবাবপুরে ওদের বিরাট ওষুধের দোকান। তাছাড়া মরণাদের মিষ্টির দোকান, গন্ধবণিকদের পসারির দোকান, ঘোষদের দুধের আড়ত, পদ্মনিধি প্রেস,সবই নবাবপুরে। লাঠি আর রড হাতে লোকগুলোর লক্ষ্য যে এসব দোকান, বুঝতে কারও অসুবিধে হওয়ার কথা নয়।

ব্যাগ ভর্তি জিনিসপত্র দেখে নলিনী স্যার অবাক হয়ে বললেন, হারে এত সব কেনার টাকা কোথায় পেলি?

টাকা আমার কাছে ছিলো স্যার।

নিশ্চয় বাড়ির টাকা! কত খরছ হয়েছে বল, আমি দিয়ে দিচ্ছি।

বাড়ির টাকা না স্যার। এটা আমার নিজের কামাই করা টাকা।

তুই কোত্থেকে টাকা কামাই করলি?

আমি সূত্রাপুর ক্লাবে ফুটবল খেলে পেয়েছি স্যার। আপনার কাছ থেকে টাকা নিতে পারবো না।

তা হয় না–পিন্টু। তুই কেন আমার জন্য এতগুলো টাকা খরচ করবি?

স্যার, আমাদের মতো গাধা পিটিয়ে আপনি মানুষ করেছেন। সারা জীবনই আমাদের দিয়ে এসেছেন। ক্লাসে আপনিই বলেন শিক্ষক পিতার তুল্য। ছেলে হয়ে এটুকুও কি করতে পারবো না?

নলিনী স্যার পিন্টুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। খেলাধুলোর ব্যাপারে তাঁর কোনো আগ্রহ নেই বলে পিন্টুকে কখনও আলাদা ভাবে তিনি দেখেননি। ক্লাসের অন্য সব ছেলের মতোই ওকে জানেন। ও কার ছেলে, কোথায় থাকে তাও তিনি জানেন না। তাঁর নিজের ছেলে তাকে ভুলে গেছে আর এমন ঘোর বিপদের দিন কোন বাড়ির ছেলে এসে আপনজনের মতো পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, ভাবতে গিয়ে তাঁর বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। ধরা গলায় বললেন, পিন্টু, চারদিকে এত অন্যায়, অবিচার দেখে মানুষের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলাম। তোকে দেখে মনে হচ্ছে এখনো পৃথিবীর সবটুকু পাপে ভরে যায় নি। তোকে আমি প্রাণভরে আর্শীবাদ করছি বাবা, জীবনে তুই অনেক বড় হবি।

স্যারের কথা শুনে পিন্টুর কান্না পেলো। তাঁর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বললো, স্যার, আপনার আর্শীবাদের চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে!

কোনো কথা না বলে বুড়ো সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণ নলিনী ভট্টাচার্য বিধর্মী ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠলেন।

যে কজনকে খবর দেয়া সম্ভব হয়েছে সবাইকে নিয়ে বিকেলে পিন্টুদের ছাদে জরুরী বৈঠকে বসলো ইরফান। রতনদের বাসায় গিয়ে ওকে আর স্বপনকে ও নিজেই নিয়ে এসেছে। বলেছে, মার খাওয়ার ভয়ে তোরা ঘরে কেন লুকিয়ে থাকবি? কেউ মারতে এলে রুখে দাঁড়াতে হয়।

সরকারদের বড় ছেলে বাসব ইরফানদের বয়সী, সেও এসেছে বৈঠকে। পিন্টু গুণে দেখলো সব মিলিয়ে পনেরো জন। দুটো বড় চাদর বিছিয়েছিলো ছাদে। তাতেও সবার জায়গা হয়নি। রতন বসেছে পাচিলের গায়ে হেলান দিয়ে।

ইরফান বললো, আমি আজ শহরে বেরিয়েছিলাম। অবস্থা ভালো নয়। গুণ্ডারা ঢাকেশ্বরী মন্দিরে হামলা করেছে। অনেকগুলো দোকান ভেঙে লুটপাট করেছে।

পিন্টু বললো, ঋষিকেশ দাস রোডে মিষ্টির দোকান আমার চোখের সামনে লুট হয়েছে।

বাসব বললো, নগেন বাবু খবর পেয়েছেন আজ রাতে নাকি সূত্রাপুর বাজার লুট হবে।

হতে পারে। ইরফান বললো, আমাদের সব রকম খারাপ পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকতে হবে। আমি সূত্রাপুরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সঙ্গে কথা বলেছি। ওদের কমিটিতে আওয়ামী লীগ, জাসদ, বাসদ, কমিউনিস্ট পার্টি–সব দলেরই ছেলেরা আছে। বাজার পাহারা দেয়ার দায়িত্ব ওরা নিয়েছে। আমরা পাড়ায় পাড়ায় কাল রাতের মতো পাহারা দেবো। লক্ষ্য রাখতে হবে বাবরী মসজিদ ভাঙার কথা বলে কেউ যেন উত্তেজনা ছড়াতে না পারে। আমাদের বলতে হবে বাংলাদেশের হিন্দুরা বাবরী মসজিদ ভাঙেনি। একাত্তরে সালে আমরা মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান সবাই মিলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছি। দেশের জন্য হিন্দু, মুসলমান সবাই জীবন দিয়েছে। সবার এদেশে থাকার সমান অধিকার আছে। ধর্মের নামে যারা নিরীহ মানুষের ওপর হামলা করে, জিনিসপত্র লুট করে, দোকান-পাট, মন্দির, মসজিদ ভেঙে ফেলে, ঘর বাড়িতে আগুন দেয় তারা হিন্দুও না মুসলমানও না, তারা অসভ্য জানোয়ার। তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।

সবাই গভীর আগ্রহ নিয়ে ইরফানের কথা শুনছিলো। হঠাৎ দূরে লোকজনের হইচই আর শ্লোগানের শব্দ শোনা গেলো। সবাই কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করলো। সামনের রাস্তায় কয়েকটা দোকান ঝটপট করে ঝাঁপ নামিয়ে দিলো। দূরে ডালপট্টির ওদিক থেকে দাড়িওয়ালা মোল্লাদের মিছিল আসছিলো। শ্লোগান দিচ্ছে, নারায়ে তকবির……, একটা একটা মালাউন ধর, সকাল বিকাল নাশতা কর। ভারতের দালালেরা, হুশিয়ার সাবধান। হিন্দু যদি বাঁচতে চাও, বাংলা ছেড়ে ভারত যাও।

শ্লোগানের কথা শুনে রতনের বুক কেঁপে উঠলো। ইরফানের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। বললো, সবাই লাঠি নে। আমরাও মিছিল বের করবো।

পিন্টুদের ছাদে আগের দিন সন্ধ্যায় সূত্রাপুর বাজার থেকে এক মণ গজারির লাঠি এনে রাখা হয়েছিলো। ইরফানের বলার সঙ্গে সঙ্গে সবাই লাঠি হাতে নিয়ে নিচে নামলো। কয়েকজন দুই হাতে দুই লাঠি নিয়েছে।

রাস্তায় নেমেই ইরফান শ্লোগান দিলো, হিন্দু মুসলিম ভাই ভাই। অন্যরা বললো, ভাইয়ে ভাইয়ে ভেদ নাই।

শ্লোগানের শব্দ শুনে চৌধুরী ভিলা থেকে কয়েকজন যুবক বেরিয়ে এলো। ইরফান মিছিল নিয়ে বড় রাস্তায় গিয়ে গলা ফাটিয়ে শ্লোগান দিলো-মন্দির মসজিদ ভাঙে যারা, অন্যরা বললো, সব ধর্মের শক্র তারা। ইরফান বললো, তুমি কে আমি কে, সবাই বললো, বাঙ্গালী, বাঙ্গালী। ইরফান বললো, জামাত শিবির রাজাকার। অন্যেরা বললো, এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়। ইরফান বললো, তোমার আমার ঠিকানা। সবাই বললো, পদ্মা মেঘনা, যমুনা। মিছিল নিয়ে ইরফান এগিয়ে গেলো ডালপট্টির দিকে।

উল্টো দিক থেকে আসা দাড়িওয়ালাদের মিছিল ইরফানদের দেখে থমকে দাঁড়ালো। রূপচাঁদ লেনের মাহবুব ছিলো ইরফানদের মিছিলে। ও নিয়মিত নির্মূল কমিটির মিটিঙ মিছিলে যায়। ইরফানকে বললো, রাজাকার গুলারে একটা ধাওয়া দেই। ইরফান ভাই। আমি শ্লোগান দিমু। সবাই খালি কইবা জবাই কর।

মাহবুব মিছিলের মাঝখান থেকেই চেঁচিয়ে বললো, এই-ই জামাত ধর। সবাই বললো, জবাই কর।

মাহবুব লাঠি উঁচিয়ে সামনের দিকে ছুটলো। এরপর ইরফানদের মিছিলের সবাই–জামাত ধর জবাই কর, শিবির ধর জবাই কর, গোলাম ধর জবাই কর, আযম ধর জবাই কর, আবার জামাত ধর জবাই কর……. বলতে বলতে ডালপট্টির দিকে দৌড়ালো। ইরফানকে এলাকার সবাই চেনে। ওদের দৌড়াতে দেখে সামনে থেকে লোকজন সরে গেলো। কেউ মিছিলে জুটে গেলো, অনেকে রাস্তার দু পাশে দাঁড়িয়ে তালি দিয়ে ওদের উৎসাহিত করলো।

পিন্টু আর রতন আগে কখনও মিছিলে যায়নি। একুশে ফেব্রুয়ারিতে ওরা প্রভাতফেরি করে বটে, কিন্তু সেখানে গান হয়, শ্লোগান হয় না। ওরা দুজন এমনিতেই উত্তেজিত ছিলো। মাহবুবের জবাই করার শ্লোগান ওদের আরও উত্তেজিত করলো। পিন্টুর মনে হলো,যারা নিরীহ মানুষকে খুন করতে পারে, গরিব মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিতে পারে, তাদের ধরতে পারলে লাঠির বাড়ি মেরে মাথা ফাটিয়ে দেয়া উচিৎ।

ডালপট্টির মোড়ে থমকে দাঁড়ানো মোল্লাদের মিছিলটা উল্টোদিক থেকে লাঠি হাতে ভয়ঙ্কর রাগী মিছিল আসতে দেখে রণে ভঙ্গ দিলো। যে যেদিকে পারলো চোখের পলকে হাওয়া হয়ে গেলো।

ইরফানরা ডালপট্টির মোড়ে এসে থামলো। মিছিলের ভেতর থেকে একজন বললো, ইরফান ভাই আপনি কিছু বলেন।

সামনে ছিলো শিকদারদের বাড়ির উঁচু বারান্দা। এক লাফে বারান্দায় উঠে ইরফান ছোট খাট একটা বক্তৃতা দিয়ে ফেললো। পিন্টুদের ছাদে যে কথাগুলো বলেছিলা সেগুলোই আরও গুছিয়ে বললো।

পিন্টু রতনের হাত ধরে পেছনে দাঁড়িয়েছিলো। বেশ কিছু পথচারীও দাঁড়িয়ে গেছে। বক্তৃতা শুনতে। রতনের মনে হলো–ওরা একা নয়, এখন আর ভয়ের কিছু নেই।