৪. খেলা ছিলো রহমতগঞ্জের মাঠে

খেলা ছিলো রহমতগঞ্জের মাঠে। বুধবার চারটায় প্লেয়ার আর সাপোর্টার নিয়ে দুটো বড় বাসে করে পিন্টুরা এসে মাঠে নামলো। লালবাগ ক্রীড়াচক্রের প্লেয়াররা আগেই এসে দুটো বল নিয়ে মাঠে ওয়ার্ম আপ করছে। ওদের সাপোর্টার সূত্রাপুরের তিনগুণ হবে। এলাকাটাও বলতে গেলে ওদেরই।

রতন ঘাবড়ে গেলো লালবাগের প্লেয়ারদের সাইজ দেখে। সূত্রাপুরের টীমে যদিও পিন্টু বয়সে সবার ছোট, তবু দুদিন প্র্যাকটিস দেখে রতনের মনে হয়েছে ও এখানে খুব একটা বেমানান নয়। পিন্টু যে রকম বল পায়ে নিয়ে তীরের মতো ছুটতে পারে সূত্রাপুরের আর কেউ দৌড়ে ওর সঙ্গে পারে না। তাছাড়া নব্বই মিনিট একটানা দমও রাখতে পারে ও। কিন্তু লালবাগের ছেলেদের যে তাগড়া শরীর-কমন বল চার্জ করতে গিয়ে যদি বেকায়দায় পিন্টুর গায়ে বাড়ি লাগে ওকে খুজেঁও পাওয়া যাবে না।

সূত্রাপুরের একজন বললো, লালবাগ নাকি ওদের টীমে তিনজন ফার্স্ট ডিভিশন প্লেয়ার এনেছে। লালবাগের টীমের চেহারা দেখে ক্যাপ্টেন লালু জেতার আশা ছেড়ে দিলো। বললো, ফার্স্ট ডিভিশনের ফরোয়ার্ড তিনটারে কড়া মার্কিং-এ রাখবো আমগো মিড ফিল্ডাররা। বেশি উপরে উইঠা আইলে এমনে যদি আটকাইতে না পারো মুখে ছ্যাপ মাইরা দিবা, দরকার ওইলে প্যান্ট টাইনা খুইলা দিবা! এমনভাবে করবা য্যান রেফারি কিছু বুঝবার না পারে।

লালুর ব্রিফিং পিন্টুর একটুও ভালো লাগলো না। মাথা নিচু করে চুপচাপ শুনে গেলো শুধু। ও জানে জেতার জন্য কিভাবে খেলতে হয়। জয় পরাজয় নিয়ে রতন মোটেই ভাবছিলো না। মাঠে আসার পর থেকে সারাক্ষণ ও ভাবছিলো পিন্টুকে অক্ষত শরীরে বাড়ি নিয়ে যেতে পারবে কিনা। মনে মনে ঠিক করলো, এ যাত্রা যদি রক্ষা পায় আর কোনোদিন এ ধরনের ধাড়িদের টুর্নামেন্টে পিন্টুকে খেলতে দেবে না।

টুর্নামেন্টটার নাম ছিলো হাজী খয়রাত হোসেন গোল্ড কাপ টুর্নামেন্ট। খয়রাত হোসেন এই এলাকার নাম করা চামড়া ব্যবসায়ী। রহমতগঞ্জ ক্লাবে মোটা টাকা চাঁদা দেন। চার বছর হলো খবরের কাগজে নাম ছাপার জন্য নিজের নামে এই গোল্ডকাপ চালু করেছেন। মস্ত বড় শরীর, তার চেয়ে বড় একটা পেট নিয়ে সাদা পাঞ্জাবী, সাদা লুঙ্গি পরে হাজী খয়রাত হোসেন বসেছিলেন লাল সাদা শামিয়ানার নিচে। তাঁর সামনে টেবিলে দুটো কাপ। বড়টা সোনার, যে দল চ্যাম্পিয়ন হবে তাদের জন্য, আর ছোটটা রুপার, রানার্স আপের জন্য। তাঁর দুপাশে এলাকার গণ্যমান্য লোকজনরা বসেছে। সাধারণ পাবলিক বসেছে সাইড লাইনের পাশে। দুই টীমের কর্মকর্তারা বসেছে ফুটবল মাঠের মাঝ লাইন বরাবর দুই দিকে।

ঠিক সাড়ে চারটায় রেফারি খেলা শুরুর বাঁশি বাজালো। টসে জিতেছিলো সূত্রাপুর। সেন্টারে রাখা বলে প্রথম পা ছোঁয়ালো পিন্টু। খেলা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাইড লাইনে কর্মকর্তাদের পাশে বসা রতন মনে মনে দেব দেবীদের নামে মানৎ করতে লাগলো, যাতে পিন্টু অক্ষত থাকে। ও আবার দেব দেবী মানে, পিন্টুর মতো নাস্তিক নয়। সব নাম শেষ হয়ে যাওয়ার পর হরিমতিয়ার কথা মনে পড়লো রতনের। মনে মনে বললো, হরিমতিয়া, তোমরা কোথায় আছো জানি না। তোমাদের পিন্টুর আজ বড় বিপদ। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করো ও যেন অক্ষত থাকে।

লালবাগ খুব হেলাফেলা করে খেলা শুরু করেছিলো। দলে তিনটা ফার্স্ট ডিভিশন প্লেয়ার, লীগে সব সময় ওপরের দিকে থাকে–সূত্রাপুরকে পাত্তা দেয়ার ওদের কোনো কারণ ছিলো না। মিনিট পনেরো পর লেফট উইং-এর কাছ থেকে গড়ানো একটা বল পেয়ে পিন্টু সোজা লালবাগের পেনাল্টি সীমানার মধ্যে ঢুকে গেলো। ওদের ব্যাক কিছু বোঝার আগেই ওকে ডজ দিয়ে কড়া শটে গোলপোস্টের বাম দিক ঘেঁষে বলটা সোজা নেট-এ পাঠিয়ে দিলো।

সূত্রাপুরের সাপোর্টারদেরও বুঝতে কয়েক মুহূর্ত সময় লাগলো ওদের দলের নতুন খেলোয়াড় পিন্টু সত্যি সত্যি গোল করেছে। রতন গো-ও-ল বলে চিৎকার করে উঠলো, আর সঙ্গে সঙ্গে সূত্রাপুরের চার পাঁচটা প্লেয়ার ছুটে গিয়ে পিন্টুকে জড়িয়ে ধরলো।

গোল দিতে পেরে সূত্রাপুরের ছেলেদের খেলার ধার বেড়ে গেলো। বল একবার ওদের পায়ে পড়লে ছাড়িয়ে নেয়া কঠিন হয়ে পড়ছিলো লালবাগের জন্য। দুবার কমন বলে চার্জ করতে গিয়ে ওদের দুই ফার্স্ট ডিভিশন বেশ ব্যথা পেয়েছিলো। এরপর থেকে ওরা তিনজন গা বাঁচিয়ে খেলতে লাগলো। কদিন বাদে ওদের লীগের খেলা। এক হাজার টাকার খ্যাপ খেলতে এসে হাত পা ভাঙতে ফাস্ট ডিভিশনের ওরা কেউ রাজী নয়। সাইড লাইন থেকে লালবাগের কোচ সমানে চাঁচাতে লাগলো। কোনো লাভ হলো না। হাফ টাইমের পাঁচ মিনিট আগে কর্ণার পেয়ে সূত্রাপুরের ক্যাপ্টেন লালু আরেকটা গোল দিয়ে দিলো।

হাফ টাইমের পর সূত্রাপুর শয়তানি শুরু করলো। বল পেয়ে লম্বা লম্বা কিক মেরে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে সময় নষ্ট করতে লাগলো। পিন্টু অবশ্য এ ধরনের নেগেটিভ খেলা পছন্দ করে না। বল পেলেই ও গোল দেয়ার চেস্টা করছিলো। এরই ভেতর লালবাগ এক ফাঁকে এক গোল শোধ করে দিলো। সূত্রাপুরের ক্যাপ্টেন বুঝে গেলো লালবাগের সঙ্গে নেগেটিভ ফুটবল খেলা চলবে না। সবাই সিরিয়াস হয়ে আক্রমণের পর আক্রমণ চালালে লালবাগের ডিফেন্স লাইনের ওপর। ওদের ফার্স্ট ডিভিশনের দুজনই ছিলো ডিফেন্সে। পিন্টু আগেই লক্ষ্য করেছিলো ফার্স্ট ডিভিশনের ওরা কায়দা করে গা বাঁচিয়ে খেলছে। খেলা শেষ হওয়ার দুই মিনিট আগে সেই সুযোগটাকে ও কাজে লাগালো। পায়ে বল পেয়ে এমনভাবে ফার্স্ট ডিভিশনের ডিফেন্ডারের দিকে তেড়ে গেলো, দেখে মনে হলো বল নয় ওদের প্লেয়ারকেই লাথি মেরে গোল পোষ্টে ঢুকিয়ে দেবে। পিন্টু কাছে আসতেই ওকে বাধা দেয়ার বদলে লালবাগের ডিফেন্ডাররা ছিটকে এক পাশে সরে গেলো। দু পা এগিয়ে গোলকিপার কিছু বোঝার আগেই বাঁ পা দিয়ে ডান দিকের বার ঘেঁষে বলটা গোলপোস্টে ঢুকিয়ে দিলো পিন্টু।

রতন চিৎকার করে ওর পাশে বসা সূত্রাপুরের দাড়িওয়ালা সেক্রেটারিকেই জড়িয়ে ধরলো। দু মিনিট পর রেফারির খেলা শেষের বাঁশী বাজলে দেখা গেলো পিন্টু সূত্রাপুরের সমর্থকদের কাঁধের ওপর।

গোল্ড কাপ নিয়ে হই হই করে ক্লাবে আসার পর সেক্রেটারি হাশমতউল্লা পিন্টুকে পুরো তিনশ টাকাই দিলো। বললো, যেই খেলা দ্যাহাইছ ফান্ডে ট্যাকা থাকলে তোমাকে হাজার টাকা দিতাম।

ক্যাপ্টেন লালু বললো, পিন্টু আমাগো টিমে রেগুলার খেলবা?

হাশমতউল্লা বললো, হ পিন্টু, এইবার লীগে আমরা থার্ড না ওইলেও ফোর্থ ওইবার চাই। চইলা আহ আমগো টীমে।

পিন্টু মৃদু হেসে মাথা নাড়লো-গ্র্যাজুয়েশনের আগে এ কথা বললে বাবা কেটে দু টুকরো করে ফেলবেন।

বি এ পাশ কইরা তো বেশি ওইলে দ্যাড় দুই হাজার টাকার ক্যারানি ওইবা। তোমার খেলার যা নমুনা দেখলাম, দুই বছর এই রকম চালাইতে পারলে দেখবা ফাস্ট ডিভিশনঅলারা তোমারে লয়া টানাটানি করতাছে। তোমাকে চিনতে আমার ভুল অয় নাই। লাইগা থাকতে পারলে একদিন তুমি লাখ লাখ টাকা কামাইবার পারবা।

একজন মন্তব্য করলো, হাশমত ভাই পাক্কা জুহুরী। আসল মাল ঠিক চিনা ফালায়।

লালু বললো, লীগে যদি নাও খ্যালো, টুর্নামেন্টে ডাকলে আইবা তো পিন্টু?

পিন্টু বললো, ক্লাসের অসুবিধে না হলে আসবে।

হাশমতউল্লা বললো, অখন থেইকা খ্যাপ পিচে তোমারে একস–না দুইস ট্যাকা দিমু। গোলের লাইগা একস।

পিন্টু কোনো কথা না বলে শুধু হাসলো। রতন বললো, বাড়ি যাবি না? সাতটা বেজে গেছে।

পিন্টু উঠে দাঁড়ালো। হাশমতউল্লা ব্যস্ত গলায় বললো, অখন বাড়ি যাইবা কি! পালোয়ানের দোকান থেইকা মোরগ পোলাউ আনবার দিছি, খায়া যাইবা।

পিন্টু মাথা নাড়লো–না হাশমত ভাই। বাড়িতে বলে আসিনি এত রাত হবে।

ক্লাব থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় লালু পিন্টুকে আবারও মনে করিয়ে দিলো। ওদের ক্লাবে খেলার কথা।

বাড়ি যেতে যেতে পিন্টু বললো, জীবনে প্রথম রোজগার করলাম! তোর জন্য কী কিনি বলতো রতন?

রতন হেসে বললো, আমার কিছু লাগবে না। টাকা জমিয়ে রাখ। কখন কী দরকার হয় কে জানে।

টাকা হাতে থাকলেই আমার খরচ করে ফেলতে ইচ্ছে করে। জমাবো কার জন্য?

কখনও যদি হরিমতিয়ারা ফিরে আসে? কিংবা ওদের মতো আর কারও সঙ্গে যদি দেখা হয়ে যায়!

কথাটা মন্দ বলিসনি। পিন্টু মৃদু হেসে বললো, ঠিক আছে, দুশ টাকা চ্যারিটি ফান্ডে থাকবে। একশ টাকা আমাদের হাত খরচ। তুই আর আপত্তি করিস না দোস্ত।

রতন কোনো কথা না বলে শুধু হাসলো।

পিন্টুদের বাসায় ফুটবল খেলে টাকা পাওয়ার খবরটা রতনই ফাঁস করলো। পিন্টুর মা শুনে অবাক হয়ে গেলেন-বলিস কি রে। এই টুকুন ছেলেকে ফুটবল খেলার জন্য টাকা দিলো!

পিন্টুর বড় বোন হাসি এসে ওকে জড়িয়ে ধরলো–তুই এত ভালো খেলিস ভাইয়া! কাল তোদের আমি সিনেমা দেখাবো।

পিন্টু নিরীহ গলায় বললো, শুধু আমাদের দেখাবে? ইরফান ভাইকে দেখাবে না?

হাসি অবাক হয়ে বললো, ইরফানকে কেন দেখাবো? ও কি পরীক্ষায় ভালো করেছে না ফুটবল ম্যাচ জিতেছে?

রতন বললো, তুমি তো জানো আপু, ইরফান ভাইই প্রথম হরিমতিয়াদের ফান্ডে দশ টাকা চাঁদা দিয়েছে।

দশ টাকা চাঁদার জন্য ইরফানকে ছবি দেখাতে হবে?

হাসির কথা শেষ না হতেই ইরফান এসে ঘরে ঢুকলো। হাতে চামড়ার পেটমোেটা ব্যাগ। পিন্টু ওকে দেখে অবাক হয়ে বললো, আরে ইরফান ভাই! এ সময়ে আপনি এখানে?

ইরফান হেসে বললো, পাশের বাড়ির পাটোয়ারি গিন্নিকে দেখতে এসেছিলাম। তোমাদের গলা আর আমার নাম শুনে ঢুকে পড়লাম।

আপনি আমাদের কথা সব শুনেছেন?

হ্যাঁ শুনেছি। তোমার আপু যে কী ভয়ানক কঞ্জুস আজ জানলাম। ঠিক আছে, ছবি আমি দেখাবো তোমাদের। কারও বেলায় কঞ্জুসি করবো না।

হাসি মুখ টিপে হাসলো, রোগীদের গলাকাটা পয়সা দিয়ে সবাই হাজী মহসিন সাজতে পারে।

মা রান্নাঘরে গিয়েছিলেন। ইরফানের গলা শুনে বেরিয়ে এসে বললেন, শুক্রবার দুপুরে তুমি আমাদের বাসায় খাবে ইরফান।

উপলক্ষ্য কী খালাম্মা?

উপলক্ষ্য আর কী! রতন আর পিন্টু পরীক্ষায় ভালো করেছে। আজ আবার ফুটবল খেলে তিনশ টাকা পেয়েছে। আমরা সবাই পিকনিক করবো। সকাল সকাল চলে এসো।

ফুটবল খেলার কথা তো শুনিনি!

ইরফানকে পিন্টুর ফুটবল টুর্নামেন্ট খেলার ঘটনাটা খুলে বললো রতন। কিভাবে গোল করেছে আর হাশমতুল্লারা কী বলেছে সেটাও বলতে ভুললো না।

ইরফান প্রশংসাভরা গলায় বললো, পিন্টু, তুমি এত ভালো খেলো, কোনো দিন তো বলোনি!

পিন্টু লাজুক হাসলো, এ আর এমন কী!

ইরফান ঘড়ি দেখে বললো, বাব্বাহ সাড়ে আটটা বাজে। এখন যাই, রোগীরা বসে আছে। পিন্টু, তোমার আগামী খেলা যার সঙ্গেই হোক আমি দেখবো। আগে থেকে জানাতে ভুলো না। যাই হাসি।

ইরফান ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর পিন্টু বললো, আপু, তোমার সিনেমা দেখানোর টাকাটা তো বেঁচে গেলো। ওটা দিয়ে এখন কি করবে?

কী করবো এখন বলবো না। পরে দেখতে পাবি। এই বলে হাসি ওর ঘরে ঢুকলো।

রতন বললো, এবার যাই রে পিন্টু! রাত অনেক হয়েছে।

চল তোকে এগিয়ে দিয়ে আসি। বলে গলা তুলে পিন্টু বললো, মা আমি রতনদের বাসায় যাচ্ছি।

.

শুক্রবার রতন আর পিন্টুকে উপলক্ষ্য করে ওদের দুই বাড়ি মিলে উৎসব করছে–এ নিয়ে ওরা যতবার ভেবেছে ততবারই রোমাঞ্চ অনুভব করেছে। রতন মনে মনে ঠিক করে ফেলেছে এ্যানুয়াল পরীক্ষায় ওকে যেভাবেই হোক থার্ড হতে হবে।

পিন্টুদের বাড়ির পেছনে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা ছিলো। পুরোনো দুটো আম গাছ আর চারটা নারকেল গাছের ছায়া প্রায় সারাদিনই পড়ে থাকে সেখানে। হাসি একবার সেখানে সবজির বাগান করে সুবিধে করতে পারেনি। ছায়াতে আদা আর হলুদ ছাড়া অন্য কিছু হয় না। পিন্টুরা আগেও কয়েকবার এ জায়গায় পিকনিক করেছে রতনের সঙ্গে। যে জন্য চুলো কোথায় হবে, থালা বাসন ধোয়া মোছা আর রান্নার আয়োজন কিভাবে করতে হবে, এটা সবাইর জানা। সকালে নটা না বাজতেই রতনদের বাড়ির সবাই এসে গেলো।

রান্নার দায়িত্ব রতন আর পিন্টুর মার ওপর। রতনের ঠাকুরমা অল্প দূরে মোড়ায় বসে তদারকি করছিলেন। দুটো আলাদা চুলোর একটায় মাছ আর মাংশ, অন্যটায় পোলাও আর নিরামিষ রান্না হবে। হাসি, তপতী আর কেতকী তরকারি কোটা, মশলা বাটা এসব করছিলো।

আগের পিকনিকে মুদির দোকানে টুকটাক জিনিস আনতে রতন আর পিন্টু যেতো। আজ রতনের মেজদা স্বপন নিজে থেকে এসে বলে গেছে, কিছু আনতে টানতে হলে বোলো, আমরা বাইরের বারান্দায় আছি।

পিকনিক নিয়ে আগের দিন থেকেই রতন আর পিন্টু উত্তেজনার আগুনে গণগণ করে জ্বলছিলো। সেই আগুনে সকাল বেলা ঘি ঢেলেছে রতনের বড়দা যতীন আর পিন্টুর আদরের আপু হাসি। যতীন ওদের দুজনকে দুটো চাইনিজ ফাউন্টেন পেন দিয়েছে। হাসি দিয়েছে দুটো নকশা করা পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবি দেখে রতন উত্তেজিত গলায় পিন্টুকে বলেছে, নিজেদের কেমন রাজা রাজা মনে হচ্ছে না!

উত্তেজনার আগুন আরেকবার লকলক করে উঠলো যখন ইরফান ওদের জন্য দুটো জিনস-এর প্যান্ট আর প্রিন্টেড সুইস ভয়েলের দুটো শার্ট আনলো। এগুলো দেখে রতন আর পিন্টু দুদিক থেকে ইরফানকে যেভাবে জড়িয়ে ধরলোবেচারার দম বন্ধ হয়ে মরার দশা হলো। আগের দিন বিকেলে ইরফান দু বাড়ির ছেলেমেয়েদের সবাইকে মধুমিতায় নিয়ে ওয়াল্ট ডিজনীর ছবি ইন সার্চ অব ক্যাস্টাওয়ে দেখিয়েছে। তারপর আবার প্যান্ট শার্ট আনবে এটা স্বপ্নেও ভাবেনি ওরা। পিন্টুর কাছে। ঈদের দিনের মতো মনে হচ্ছিলো। রতন ভাবছিলো দুর্গা পূজোতেও এত মজা হয় না।

দশটার দিকে ভিনসেন্ট স্যার, এলেন ওদের জন্য সত্যজিৎ রায় আর হুমায়ুন আহমেদের দুটো বই নিয়ে। গত কয়েক বছর ধরে তিনি স্কুলের লাইব্রেরির দায়িত্বে আছেন। ভালো করেই জানেন এই ছেলে দুটো কী ধরনের বই পছন্দ করে। রতন আর পিন্টুর বাবা ভিনসেন্ট স্যারকে দেখে দারুণ খুশি। তিনজনে মিলে চা খেতে খেতে পুরোনো দিনের সুখের সব স্মৃতি খুঁজে বেড়ালেন।

ইরফান, যতীন আর স্বপন বাইরের রেলিং ঘেরা বারান্দায় বসে রাজা উজির মারছিলো। এগারোটার দিকে সূত্রাপুরের ফুটবল টীমের ক্যাপ্টেন লালু এসে ওদের সঙ্গে যোগ দিলো। আগের দিন মার কথায় পিন্টু ক্লাবে গিয়ে লালুকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে নেমন্তন্ন করে এসেছিলো। স্বপন আর লালু একবয়সী শুধু নয়, একই স্কুলে নাইন টেন দুবছর একসঙ্গে পড়েছিলো। এস এস সি পাশ করার পর লালুর বাবা মারা যান। ওর লেখাপড়া আর বেশি এগোয়নি। লালু আসার পর স্বপন বাসা থেকে তাসের প্যাকেট এনে ব্রিজ খেলতে বসলো। পিন্টু আর রতন দুজনই স্বীকার করলো এরকম জমজমাট পিকনিক আগে কখনও হয়নি।