৬. বছর শেষের পরীক্ষা

দ্বিতীয় পর্ব

৬.

পিন্টু আর রতনদের বছর শেষের পরীক্ষা নবেম্বরেই শেষ হয়ে গেছে। ডিসেম্বরের দুই তারিখে ফলও বেরিয়ে গেলো। রতন এবার থার্ড হয়েছে। গত পরীক্ষায় ও সিক্সথ হয়েছিলো। সেবার ওতেই সবাই খুশিতে ওকে উপহার দিয়ে পিকনিক-টিকনিক করে একাকার করে ফেলেছিলো। অবশ্য পিন্টুও সেই আনন্দের সমান অংশীদার ছিলো। রতন ঠিক করেছিলো এ্যানুয়াল পরীক্ষায় আরও ভালো করবে। কোচিং ক্লাসে যাওয়ার সামর্থ ওর নেই। বাড়িতেই মেজদার কাছে পড়েছে। স্বপনের এখনও চাকরি হয়নি। কত জায়গায় দরখাস্ত দিয়েছে তার কোনো হিসেব নেই। ফিজিক্স-এ মাস্টার্স করে কলেজের মাস্টারির চাকরি দূরে থাক ব্যাংকের কেরানীর চাকরিও পায়নি। কেরানীগঞ্জে এক স্কুলে একবার দরখাস্ত করেছিলো। সার্টিফিকেট আর রেজাল্ট দেখে স্কুল কমিটির সেক্রেটারি ওকে নিতে রাজি হয়নি। বলেছে, এখন দায়ে পড়ে এখানে চাকরি করবেন, দুদিন পর ভালো অফার পেলে চলে যাবেন। আমাদের বি এস সি হলেই চলবে। এত কোয়ালিফিকেশন আমাদের দরকার নেই।

এ্যানুয়াল পরীক্ষায় পিন্টু ফোর্থ-এর ওপরে উঠতে পারেনি। এতে অবশ্য ও অখুশি নয়। নিচে যে নামেনি এই ঢের। পড়ার পেছনে ও রতনের মত সময় দিতে পারেনি। গত চার মাসে ও সূত্রাপুর বয়েজ ক্লাবের হয়ে পাঁচটা ম্যাচ খেলেছে। সেক্রেটারি হাশমতউল্লা দুদিন ওর বাড়িতে এসেছিলো। একদিন ওর বাবার সঙ্গেও কথা বলেছে। বাবার এক কথা,–এমনি মাঝে মধ্যে এক আধটা ম্যাচ খেলে সেটা এক কথা, আর ক্লাবের রেগুলার প্লেয়ার হিসেবে খেলা অন্য কথা। বি এ পাশ করার আগে ওসব হবে টবে না।

ডিসেম্বরের এগারো তারিখে সূত্রাপুরের সঙ্গে মুসলিম ইন্সটিটিউটের খেলার কথা। পিন্টু মানা করে দিয়েছে। দশ তারিখে ও, রতন আর স্বপন ভোলা যাবে। শেখরদা লিখেছে পাঁচ ছয় তারিখের মধ্যে টিকেট পাঠিয়ে দেবে। বিয়ের নেমন্তন্নর কার্ডও এসে গেছে ডাকে।

পিন্টু ঠিক করেছে এবার গিয়ে দিন পনেরো থাকবে। গতবার জুলাই মাসের গরমেও এত মজা হয়েছে যে বলার নয়। শান্ত ওকে আলাদা করে চিঠি লিখেছে-পিন্টু মামা, তুমি আসবে শুনে চরমাণিক থেকে আমার এক বন্ধু খবর পাঠিয়েছে তোমাকে নিয়ে অবশ্যই যেন ওদের বাড়িতে বেড়াতে যাই। জায়গাটা বঙ্গোপসাগরের খুবই কাছে। ওদের বাড়ি থেকে সমুদ্রের গর্জন শোনা যায়। তুমি একই সঙ্গে সমুদ্রের ভেতর সূর্য ওঠা আর সূর্য ডোবা দেখতে পাবে। চিঠির শেষে দেড় বিঘত বড় সমুদ্রের চিংড়ি খাওয়াবারও লোভও দেখিয়েছে শান্ত।

পাঁচ তারিখ সকালে লঞ্চ কোম্পানির এক লোক এসে রতনদের বাসায় ফার্স্ট ক্লাস কেবিনের তিনটা টিকেটা দিয়ে গেলো। একটা টিকেট ছিলো সিঙ্গেল কেবিনের আর দুটো আলাদা কেবিনের। সিঙ্গেলটা স্বপন নিয়েছে।

পিন্টুকে খবরটা দিতে এসে রতন উচ্ছ্বসিত গলায় বললো, ফার্স্ট ক্লাস কেবিনে রাজার হালে যাবো। প্রত্যেক কেবিনে কালার টিভি, রুম সার্ভিস–দারুণ মজা হবে।

পিন্টু নিজেও ভাবেনি শেখরদা ওদের জন্য একেবারে ডিলাক্স কেবিনের টিকেট পাঠাবে। জিজ্ঞেস করলো, স্বপনদা যাচ্ছে?

প্রথমে একটু গাঁইগুই করছিলো। টিকেট পেয়ে নিজেকে এখন ভি আই পি ভাবছে।

হারে, তোর গরম কাপড় চোপড় আছে তো? সেবার জুলাই মাসে নদীতে কেমন ঠান্ডা পড়েছিলো টের পাসনি?

রতন হেসে বললো, পুরোনো সুয়েটার যেটা আছে ওতেই হয়ে যাবে। কেবিনের দরজা বন্ধ করে বসে থাকবো, শীত আসবে কোত্থেকে?

তুই কেবিনে বসে থাকবি আর আমি রাতে একা একা ডেকে বসে ভ্যারেন্ডা ভাজবো?

তোর মতো সুয়েটার আর দামী শাল আলোয়ানওয়ালা অনেক প্যাসেঞ্জার পাবি। ফার্স্ট ক্লাসের ডেক বলে কথা!

চল ঘুরে আসি।

কোথায়?

বঙ্গবাজারে। আমি একটা জ্যাকেট কিনবো, তুইও কিনবি। গার্মেন্টস ওয়ালাদের সুন্দর সুন্দর জ্যাকেট পাওয়া যায় ওখানে।

সে তো অনেক দাম!

কে বলেছে অনেক দাম! তুই চল না আগে।

টাকা কোথায় পাবি?

কেন, এতগুলো ম্যাচ খেলার টাকা কম জমেছে?

রতন জানে গত পাঁচ ম্যাচে পিন্টু ছাব্বিশ শ টাকা পেয়েছে। কথা না বাড়িয়ে রিকশায় চেপে বঙ্গবাজারে গিয়ে দুটো কড-এর জ্যাকেট আর প্যান্ট কিনলো। একটা জ্যাকেট নীল, আরেকটা হালকা বাদামী। দুটোরই ভেতরে উলের লাইনং দেয়া। মাপ দেখার জন্য দোকানি যখন রতনকে নীল জ্যাকেটটা পরালো তখন ও পিন্টুকে বললো, এটা গায়ে দিলে আমাকে আর চেনা যাবে না।

পিন্টু বললো, তোকে ঠিক প্রিন্স অব কাগজিটোলা মনে হচ্ছে।

দুবন্ধু একসঙ্গে গলা খুলে হাসলো।

পরদিন বিকেলে রতনদের বাড়িতে মানিকগঞ্জ থেকে কন্যাপক্ষ এলো যতীনের বিয়ের তারিখ পাকা করতে। কনে দেখা আগেই হয়ে গেছে। রতন বাড়ির কাজে ব্যস্ত ছিলো। পিন্টু সন্ধ্যাবেলা ক্লাবে গিয়ে দেখলো দারুণ উত্তেজনা সেখানে। সকালে টেলিভেশনে সিএনএন-এর খবরে দেখিয়েছে ভারতের অযযাধ্যায় বাবরী মসজিদ নাকি একেবারে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে করসেবক আর বিজেপির লোকজনরা। বাবরী মসজিদ নিয়ে ঢাকার বিভিন্ন পত্রিকায় তিন চার দিন ধরে খবর বেরোচ্ছিলো। ওটা নাকি ভাঙার পাঁয়তারা চলছে। নাকি ওটা আগে রাম মন্দির ছিলো। পিন্টু খবরের কাগজে একমাত্র খেলার পাতাটাই পড়ে, সিএনএনও দেখে না। বাবরী মসজিদের খবর ক্লাবেও প্রথম শুনলো।

ক্লাবের ভেতর সবচেয়ে বেশি চাঁচাচ্ছিলো চিকা হাশমতউল্লা। হাত পা নেড়ে থু থু ছিটিয়ে ও বক্তৃতার ঢং-এ বলছিলো, মালাউনগো এইবার উচিৎ সিক্ষা দিতে ওইবো। কত বড় সাহস দ্যাখ, বাবরী মসজিদ বাইঙ্গা ফালাইছে?

সাদা দাড়িওয়ালা আরেকজন বললো, মালাউনগো সিক্ষা দিতে ওইলে অগো মন্দিরগুলা আগে বাইঙ্গা ফালান লাগবো। অহন ঠিক কর কোই থেইকা শুরু করবা।

বাংলাদ্যাশে মালাউনগো জাগা নাই।

লালু চুপচাপ বসেছিলো। ওর টীমে হিন্দু প্লেয়ার আছে দুজন। একজন মিডফিল্ডে, আরেকজন লেফট উইং-এ দারুণ খেলে। হাশমতউল্লার কথা শুনে ও একটু রেগে গিয়ে বললো, বাবরী মসজিদ যারা ভাঙ্গছে, হ্যাঁগরে গিয়া সিক্ষা দ্যান। এইহানকার হিন্দুরা কারে কী করছে?

হাশমতউল্লা ওকে ধমক দিয়ে বললো, আরে লাউলা চুপ মাইরা বয়া থাক। হিন্দুগো দালালি যারা করবো হ্যাঁগরে সিদা ইন্ডিয়া পাঠাইয়া দিমু কইলাম। আইজ থেইকা আমগো কেলাবে কুন হালায় হিন্দু ঢুকবার পারবো না।

লালু রেগে উঠে দাঁড়ালোখেলার ভিতরে কিয়ের হিন্দু মোসলমান? আপনে কী কইবার চান? অজিত আর গৌরাঙ্গরে বাদ দিয়া আমি টীম করবার পারুম?

তুই না পারস আমি পারুম। খেলার মাঠেও মোসলমানগো ইমানের পরীক্ষা দেঅন লাগবো।

সাদা দাড়িওয়ালা নিজের দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে বললো, আইজ কাইলকার পোলাপান ক্যামনে জানবো! মোহামেডান কেলাব না থাকলে পাকিস্তান পয়দা ওইতো না।

আপনের পাকিস্তানের মুখে আমি মুতি। রাগী গলায় লালু বললো, আমার টীমে কেউ হাত দিবার পারবো না।

হাশমতউল্লা চেঁচিয়ে উঠলো, আমি কেলাবের সেক্রেটারি। টীম ঠিক করুম আমি। আমার হুকুম অই মালাউন দুইটা আর কেলাবে ঢুকবার পারবো না।

থাকেন আপনের কেলাব লয়া। আমারে আর পাইবেন না। এই বলে লালু ঝড়ের বেগে ক্লাব থেকে বেরিয়ে গেলো।

অভিজ্ঞ গোলকিপার লালুকে প্রথম দিনই পিন্টুর ভালো লেগেছিলো ওর খেলার জন্য। আজ ভালো লাগলো অন্যায়ের বিরুদ্ধে ওর প্রতিবাদ করার সৎ সাহস দেখে। লালুর পেছন পেছন পিন্টুও ক্লাব থেকে বেরিয়ে এলো।

কয়েক পা দৌড়ে এসে ও লালুকে ধরে ফেললো। বললো, লালু ভাই দাঁড়ান, আপনার সঙ্গে কথা আছে।

লালু ঘুরে দাঁড়ালো পিন্টুর দিকে। ওর চোখে চোখ রেখে বললো, তুই এই রাজাকারের বাচ্চাগো টীমে খেলবি পিন্টু? রাগে দুঃখে ওর গলা রীতিমতো কাঁপছিলো।

পিন্টু শান্ত গলায় বললো, যারা এরকম নোংরা কথা বলতে পারে তাদের টীমে খেলার প্রশ্নই উঠে না।

পিন্টুকে বুকে জড়িয়ে ধরে লালু বললো, তুই খাঁটি স্পোর্টসম্যানের মত কথা কইছস পিন্টু।

বিকেলে ক্লাবে আসার পর থেকে লালু সেক্রেটারি হাশমতউল্লা আর ভাইস প্রেসিডেন্ট চোরা ফখরুর তড়পানি দেখতে দেখতে অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলো। কবে কার ছাগল চুরি করে ধরা পড়েছিলো বলে সাদা দাড়িওয়ালা ফখরুদ্দিনের নাম হয়ে গেছে চোরা ফখরু। শয়তানটা বলে কিনা,–অরা একটা মসজিদ ভাঙছে, আমরা এক হাজারটা মন্দির ভাইঙ্গা পেরতিসোধ লমু। শুনে রাগে পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে উঠেছিলো লালুর। ইচ্ছে করছিলো ওর শোলার মত নরম নড়বড়ে গলাটা এক টিপে ভেঙে ফেলে। অন্য প্লেয়াররাও সেক্রেটারির ভয়ে টু শব্দটি উচ্চারণ করেনি। এতক্ষণ পর পিন্টুর কথা শুনে ও কিছুটা আশ্বস্ত হলো।

ওরা যাচ্ছিলো ফরাশগঞ্জের দিকে। লালুর বাসা তাঁতীবাজার। হঠাৎ দূরে অস্পষ্ট শ্লোগানের শব্দ শুনে পিন্টু আর লালু দুজনই থমকে দাঁড়ালো। একটু পরে আবার শুনলো সেই শ্লোগান, এবার বেশ স্পষ্ট-নারায়ে তকবির, আল্লাহু আকবর।

লালু চাপা গলায় পিন্টুকে বললো, যা ভাবছিলাম তাই ওইছে। তগো পাড়ায় হিন্দু কয়টা পিন্টু?

হিসেব করে পিন্টু বললো, পাঁচটা। কেন লালু ভাই?

আইজ রাইতে এ্যাটাক ওইবার পারে। নাইলে কাইল ওইবো। মনে ওইতাছে রায়ট লাইগা যাইবো।

রায়ট শব্দটা শুনে পিন্টুর বুকের ভেতর ধক করে উঠলো। হিন্দু মুসলমানদের ভয়ঙ্কর রায়টের কথা ওর বাবা আর রতনের বাবাকে বলতে শুনেছে। বছর দুয়েক আগেও সূত্রাপুরে কয়েকটা হিন্দুর দোকান লুট হয়েছে। লালু বললো, রাইত ওইয়া গ্যাছে পিন্টু। বাড়িত যা। জোয়ান পোলাপাইন যা আছে সবতেরে লইয়া পাড়ায় গার্ড দে। কোন মতেই রায়ট লাগবার দিবি না। একবার লাইগা গেলে থামান যাইবো না।

সবার আগে রতনের কথা মনে হলো পিন্টুর। আমি যাই লালু ভাই, বলেই ও উল্টোদিকে দৌড় দিলো।

পিন্টুদের বসার ঘরে চুপচাপ বসেছিলেন ওর বাবা আর রতনের বাবা। দাবা খেলার কথা ওরা ভুলে গেছেন। পিন্টুর বাবা অফিসেই শুনেছেন বাবরী মসজিদ ভাঙার সংবাদ। রতনের বাবা সেদিন সরকারের গদিতে যাননি বাড়িতে যতীনের বিয়ের তারিখ পাকা করার জন্য কন্যাপক্ষ আসবে বলে। সন্ধ্যার পর অতিথিদের বিদায় দিয়ে দাবা খেলতে এসে পিন্টুর বাবার কাছে শুনলেন এই দুঃসংবাদ। অনেকক্ষণ চুপ হয়ে বসে থাকার পর আস্তে আস্তে বললেন, এরকম একটা কিছু হবে কদিন ধরেই ভয় হচ্ছিলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বললেন, শহরের অবস্থা কেমন দেখলেন? অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েছে?

পুরানা পল্টন থেকে শুরু করে ডালপট্টি পর্যন্ত হিন্দুদের যেসব দোকানপাট আছে সব দুপুরের পরই বন্ধ হয়ে গেছে। শহরে বেশ থমথমে ভাব।

কোনো মিটিং মিছিল চোখে পড়েছে?

না, অফিস থেকে আসার সময় তেমন কিছু আমার চোখে পড়েনি। কাল দৈনিক পত্রিকায় খবরটা বের হলে মনে হয় গন্ডগোল লাগবে।

এসব আর ভালো লাগে না। আক্ষেপের গলায় রতনের বাবা বললেন, আর কতদিন আমাদের এরকম ভয়ের ভেতর দিন কাটাতে হবে?

এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর পিন্টুর বাবারও জানা নেই। তবু বললেন, পাড়ায় আমরা প্রতিরোধ কমিটি করবো। ছেলেরা রাত জেগে পাহারা দেবে।

রতনের বাবা বিড়বিড় করে বললেন, সমস্যা কি এতে দূর হবে?

তপতী আর কেতকীকে আমাদের বাসায় পাঠিয়ে দিন। রতনও এসে পিন্টুর সঙ্গে থাকুক।

রাতে না হয় আগলে রাখলেন ওদের। দিনে কি ওরা ঘর থেকে বেরোবে না? স্কুল কলেজ করবে না?

এখন তো সব বন্ধ! আর দুদিন পরই ওরা ভোলা যাচ্ছে। ঢাকায় গন্ডগোল বেশি হলে তপতীরা ভোলা চলে যাক। এসব গন্ডগোল বড় শহরেই হয়। ভোলা পর্যন্ত যাবে না।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রতনের বাবা উঠে দাঁড়ালেন–তাই করতে হবে। ভয় বেশি দুই মেয়েকে নিয়ে। এই বলে বাড়ির পথে পা বাড়ালেন।

পিন্টুর বাবা পেছন থেকে তাঁকে ডাকলেন–দাদা একটু দাঁড়ান।

রতনের বাবা ঘুরে দাঁড়ালেন। পাশে ভাঁজ করে রাখা শালটা গায়ে জড়িয়ে পিন্টুর বাবা বললেন, চলুন, সরকার বাবু আর হেমাঙ্গ বাবুদের বাড়ি গিয়ে দেখে আসি ওঁরা কেমন আছেন।

রতনের বাবা বললেন, গতবার ওঁরা চৌধুরী ভিলায় ছিলেন।

পাড়ার সবচেয়ে সুরক্ষিত বাড়ি নগেন্দ্র চৌধুরীদের উঁচু পাচিল ঘেরা চৌধুরী ভিলা। ভারি লোহার গেট পাহারা দেয় দুজন বন্দুকধারী দারোয়ান, গতবার যখন রায়ট লাগার উপক্রম হয়েছিলো তখন ছয় জন পুলিশ এ বাড়ি পাহারা দিয়েছে। এককালে মস্ত জমিদার ছিলেন চৌধুরীরা । জমিজমা এখনও অনেক আছে। তাছাড়া নিজেদের লঞ্চ কোম্পানি আছে, ব্রিকফিল্ড আছে, দুটো জুয়েলারি শপও আছে। তাঁদের ভয়ের কোন কারণ নেই।

ওঁরা দুজন রাস্তায় নামতেই দেখলেন পিন্টু আর রতনকে, হন হন করে তাঁদের দিকেই আসছে। কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে পিন্টু বললো, বাবা, আমরা আজ রাতেই পাড়ায় প্রতিরোধ কমিটি করবো। ইরফান ভাই আমাদের বাসায় মিটিঙ ডেকেছেন।

পিন্টুর বাবা বললেন, মিটিঙ করছো ভালো কথা। রতনকে সঙ্গে নিয়ে এভাবে ঘুরবে পুকুর বাবা বললেনবো। ইরফান ভাই

রতন বললো, আমি পিন্টুর সঙ্গে থাকলে ক্ষতি কি কাকাবাবু?

ক্ষতি আছে বাবা। আমাদের পাড়ার সবাইকে ফেরেশতা ভাববার কারণ নেই। তোমাদের পাশের বাড়িতে থাকে মুসলিম লীগের আক্কাস আলী। মুক্তিযুদ্ধের সময় যে তোমাদের বাড়ি লুট করেছিলো। শয়তানটা এখন জামাতী হয়েছে। তোমাদেরকে এসব কমিটিতে দেখলে লোক ক্ষেপানোর সুযোগ পাবে।

ঠিক আছে রতন। তুই আমার ঘরে গিয়ে বোস। আমি বাকি সবাইকে বলে এখনই আসছি। এই বলে পিন্টু ওদের সামনের বাড়ির আশরাফকে খবর দিতে গেলো।

রতন আর পিন্টুর বাবা সরকারদের বাড়ি গিয়ে শোনেন বাড়ির কর্তা অক্ষয় সরকার চৌধুরী ভিলায় গেছেন। হেমাঙ্গ বাবুর বাড়ি গিয়ে দেখেন সেখানেও শুধু কাজের ছেলেটা আছে–বাড়ির সবাই চৌধুরী ভিলায়।

রতনের বাবাকে চৌধুরীদের বিহারী দারোয়ানটা চেনে। তাঁকে দেখে দরাজ গলায় বললো, আইয়ে বাবুজী। কিন্তু তার পেছনে পিন্টুর বাবাকে দেখে অস্বস্তি বোধ করলো।

রতনের বাবা দারোয়ানকে বললেন, হামিদ সাহেব আমার সঙ্গে এসেছেন।

দারোয়ান অনিচ্ছার সঙ্গে দরজা খুললো। দারোয়ানের হাব ভাব দেখে পিন্টুর বাবা বিরক্ত হলেন। যেন তিনি দাঙ্গা বাধাবার জন্য এসেছেন!

চৌধুরী ভিলার মস্ত বড় ড্রইং রুমে পুরোনো দিনের ভেলভেটের গদিমোড়া চেয়ারে বসেছিলেন নগেন্দ্র চৌধুরী। বয়স প্রায় সত্তরের কাছে, টকটকে ফর্সা গায়ের রঙ। পাশে দুটো সোফায় বসেছে তার দুই ছেলে, একজন ব্রিকফিল্ড দেখে, আরেকজন লঞ্চের কারবার সামলায়। অক্ষয় সরকার আর হেমাঙ্গ লাহিড়ী পাশাপাশি বসেছেন আরেকটা সোফায়। সবাই উত্তেজিত গলায় কি যেন বলাবলি করছিলেন।

রতন আর পিন্টুর বাবা ড্রইং রুমে ঢুকতেই সবাই চুপ হয়ে গেলেন। নগেন্দ্র চৌধুরী বললেন, এসো ভায়া দীপঙ্কর। তারপর, কী মনে করে হামিদ সাহেব?

শেষের কথাটা পিন্টুর বাবার উদ্দেশ্য বলা। রতনের বাবা বললেন, হামিদ সাহেব এসেছেন সবার খোঁজ খবর নিতে। আমরা অক্ষয় বাবু আর হেমাঙ্গ বাবুদের বাড়ি গিয়েছিলাম। শুনলাম ওঁরা এখানে। হামিদ সাহেবের ছেলে পাড়ায় শান্তি কমিটি না

প্রতিরোধ কমিটি বানাচ্ছে।

নিশ্চয় চাঁদা চাই!

পিন্টুর বাবা অপ্রসন্ন গলায় বললেন, আপনারা কেমন আছেন এটুকুই জানতে এসেছিলাম। ছেলেদের প্রতিরোধ কমিটির জন্য চাঁদা চাইতে আসিনি।

হেমাঙ্গ বাবু ব্যস্ত গলায় বললেন, আপনি কিছু মনে করবেন না হামিদ সাহেব। গতবার আপনার ছেলে ছিলো না। ডালপট্টির মোশারফরা সেবার শান্তি কমিটি করার নামে নগেন বাবুর কাছে থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়েছে। এক মাস পাহারা দেয়ার কথা ছিলো ওদের। একটা দোকানও পাহারা দেয়নি। সেবার সূত্রাপুরের সব কটা হিন্দুর দোকান লুট হয়েছে।

পিন্টুর বাবা রতনের বাবাকে বললেন, দাদা আপনি থাকুন, আমি যাই। পিন্টু গিয়ে তপতী আর কেতকীকে নিয়ে আসবে।

পিন্টুর বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর নগেন্দ্র চৌধুরী রতনের বাবাকে বললেন, আমরা কি মরে গেছি দীপঙ্কর বাবু? আমার এত বড় বাড়ি থাকতে আপনার মেয়েরা প্রাণ বাঁচাবার জন্য মুসলমানদের বাড়িতে আশ্রয় নেবে?

হেমাঙ্গ বাবু বললেন, আমরা জরুরী বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলাম। ওকে নিয়ে তোমার এভাবে আসা উচিত হয়নি দীপঙ্কর।

রতনের বাবা বিরক্ত হয়ে বললেন, এত বছর ধরে এ পাড়ায় আছ, হামিদ সাহেবদের মতো আর একটা সজ্জন পরিবার দেখাও দেখি!

কার পেটে কী আছে তা কি কখনও বোঝা যায়! এসব কথা এখন থাক। নগেন্দ্র চৌধুরী সবাইকে থামিয়ে দিলেন–দীপঙ্কর ভায়া কি আজ এখানে থাকবে?

না। শক্ত গায় রতনের বাবা বললেন, আপনার এখানে অক্ষয় আর হেমাঙ্গরা থাকুক। আমরা বাড়িতেই থাকবো।

তোমার যা ইচ্ছে। হ্যাঁ, কী যেন বলছিলাম! গভমেন্টের কাছে একটা রিপ্রেজেন্টেশন দিতে হবে কাল পরশুর মধ্যে।

রতনের বাবা এ আলোচনার শুরুতে ছিলেন না। পিন্টুদের সঙ্গে তাদের পরিবারের এত মেলামেশা যে হেমাঙ্গ বাবুরা পছন্দ করেন না এটা তিনি ভালো করেই জানেন। কিছুক্ষণ পর আমি যাই, বলে চৌধুরী ভিলা থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি।