৫. আজ কি পূর্ণিমা

আজ কি পূর্ণিমা?

শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর দিয়ে ঘুটঘুট করে পানি কেটে এগিয়ে চলেছে ভোলাগামী তিন তলা বিশাল লঞ্চ কোকো-২। রাত তখন বারোটা। ডেকের যাত্রীরা প্রায় সকলেই চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। খোলা নদীতে গভীর রাতে আষাঢ়ের বাতাসও গায়ে কাঁপন ধরায়। দিগন্তজোড়া অবারিত আকাশ আর প্রান্তরে কোনো বাধা না পেয়ে ভেজা বাতাস হু হু করে বইছিলো। নদীর পানিতে সেই বাতাস ছোট ঘোট ঢেউয়ের কাঁপন তুলেছে। গলাননা রুপোর মতো টলটলে জ্যোৎস্না ঢেউয়ের মাথায় চকচক করছে। রতনের মনে হচ্ছিলো নদীর বুকে হাজার হাজার দেয়ালির আলো জ্বলছে।

বাতাসে পিন্টুর কথা শুনতে পায়নি ও। পিন্টু আবার ওকে জিজ্ঞেস করলো, আজ কি পূর্ণিমা?

আজ নয়, গতকাল ছিলো পূর্ণিমা। সবজান্তার মতো জবাব দিলো রতন।

পিন্টু মুগ্ধ গলায় বললো, ঢাকায় কোনোদিন এত সুন্দর জ্যোত্মা দেখতে পাবি না।

সুন্দর খারাপ কোনো জ্যোৎস্লাই আজ পর্যন্ত ঢাকা শহরে দেখিনি।

না দেখলে বুঝলি কী করে কাল পূর্ণিমা ছিলো?

এটা না বোঝার কী আছে! পঞ্জিকা ছাড়া ঠাম্মা এক পাও চলতে পারেন না। বাড়ির সবাইকে জানতে হয় কবে অমাবস্যা কবে পূর্ণিমা আর কবে একাদশী।

নদীর বাঁকে অচেনা গ্রামের ঘাটে কালো কালো নৌকা বাঁধা রয়েছে। কিছুক্ষণ আগেও এসব নৌকায় জোনাকির মতো মিটমিটে আলো ছিলো। এখন সেখানে শুধু জমাটবাঁধা অন্ধকার। পিন্টু বললো, মাঝে মাঝে আমার কী ইচ্ছে করে জানিস?

কী ইচ্ছে করে?

এরকম লঞ্চে কিংবা ট্রেনে দূরে কোথাও যাওয়ার পথে হঠাৎ যদি একেবারে অচেনা কোনো ছোট্ট ঘাটে বা ষ্টেশনে নেমে পড়ি তাহলে বেশ হয়।

ডাকাতের খপ্পরে পড়লে পরনের কাপড় সুদ্ধো খুলে নেবে।

তুই একটা কী রে রতন। সারাক্ষণ তো মাথায় খালি চোর-ডাকাত আর ভুত পেত্নী গিজ গিজ করছে।

ভরা জ্যোত্যায় খোলা নদীর ভেতর এভাবে দাঁড়িয়ে থাকাটা রতনের পছন্দ ছিলো । এ সময় যত অতৃপ্ত আর কুপিত আত্মারা ভর করার জন্য মানুষের শরীর খুঁজে বেড়ায়। নেহাৎ পিন্টুকে সঙ্গ দেয়ার জন্য ও দাঁড়িয়েছিলো। বাড়িতে থাকলে এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়তো। পিন্টু এ সময় ভূতের কথা বলাতে রতন খুবই বিরক্ত হলো। গম্ভীর গলায় বললো, আমার ঘুম পাচ্ছে। শুবি তো চল।

প্লীজ রতন, আর একটু দেখি!

ঠান্ডা লেগে সর্দি কাশি হলে পরে টের পাবি। এত কী দেখার আছে তাও তো বুঝি না।

দেখার চোখ থাকলেই দেখা যায়। তাকিয়ে দেখ, লঞ্চ এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সামনের ঘরবাড়ি, গাছপালা, মাঠ ঘাট সবই বদলে যাচ্ছে। নদী বাঁক নিচ্ছে। এক মিনিট পরে কী দেখবো কিছুই জানি না। আর তুই বলছিস দেখার কিছু নেই?

এসব আমি অনেক দেখেছি। এখন শুতে চল। ভোরে উঠে আবার দেখিস।

তুই এক্কেবারে বেরসিক। এটা বলে পিন্টু রতনের সঙ্গে শুতে গেলো।

লঞ্চে উঠেই ওরা ডেকের ওপর চাদর বিছিয়ে শোয়ার জায়গা করে নিয়েছে। দুজনের হাত ব্যাগ দুটো রেখেছে মাথার কাছে। অল্প দূরে দুটো আনসার বসে ঝিমোচ্ছে। ওদের পাশে ছিলো গ্রামের দুই বুড়ো। তারাও ততক্ষণে ঘুমিয়ে কাদা হয়ে গেছে। দূরে একটা ছোট বাচ্চা ওয়াও করে কেঁদে উঠে আবার থেমে গেলো। লঞ্চের একঘেয়ে শব্দ ছাড়া কোথাও কোনো শব্দ নেই।

রতন একটা পাতলা চাদর গায়ে জড়িয়ে কুঁকড়ে শুয়েছিলো। পিন্টু মোটা বেড কভার এনেছিলো। বললো, ওভাবে শুয়েছিস কেন? আমার চাঁদরের তলায় আয়।

রতন কোনো কথা না বলে পিন্টুর কাছে এসে শুলো। ওর ভারি ঘুম পেয়েছিলো। পিন্টু আগে কখনও লঞ্চে ওঠেনি। উত্তেজনায় ওর চোখে ঘুমের লেশমাত্র ছিলো না। একবার ভাবলো রতনের সঙ্গে গল্প করে রাত কাটিয়ে দেবে। নদীর ভেতর ভোরের সূর্য কেমন লাগে দেখতে হবে। রতনের দিকে তাকিয়ে দেখলো ও গভীর ঘুমে ডুবে গেছে। ওর শ্যামলা, রোগা মুখটা বড় অসহায় আর নিষ্পাপ মনে হচ্ছে।

পিন্টু জানে ও ছাড়া রতনের আর কোনো বন্ধু নেই। বাড়ির অবস্থা ভালো নয় বলে ক্লাসেও সব সময় আড়ষ্ট থাকে রতন। গায়ে পড়ে কারও সঙ্গে মিশতে যায় না। টিচাররা অবশ্য সবাই ওকে পছন্দ করেন ক্লাসের সবচেয়ে শান্ত ছেলে বলে। একবারই শুধু রতনকে রাগতে দেখেছিলো পিন্টু। তখন ওরা ক্লাস সেভেনে পড়ে। সেবার ঢাকেশ্বরী মন্দিরে কততগুলো গুন্ডা হামলা করেছিলো বলে শহরে খুব উত্তেজনা ছিলো। সেই উত্তেজনার ঢেউ ওদের মিশনারি স্কুলেও এসে পৌঁছেছিলো। ক্লাস টেন-এর সঞ্জয় সূত্রাপুরে থাকে। ছুটির পর রতনকে বলেছিলো তুই আমার সঙ্গে বাড়ি যাবি। রতন রাজী হয় নি। বলেছে, না সঞ্জয়দা, আমি পিন্টুর সঙ্গে যাবো। পিন্টু একটু দূরে দাঁড়িয়েছিলো। রতনের কথা শুনে সঞ্জয় ওকে টিটকিরি মেরে বলেছে, তোর লজ্জা করে না, গরুখোরদের সঙ্গে এরকম মাখামাখি করতে! পিঠে যখন ছুরি মারবে তখন টের পাবি। সঞ্জয়ের কথা শুনে রতনের চোখ মুখ লাল হয়ে গেলো। উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে চিৎকার করে বললো, খবরদার সঞ্জয়দা, পিন্টুকে নিয়ে একটাও বাজে কথা বলবে না।

সঞ্জয় কী বলেছিলো পিন্টু শোনেনি। রতনের উত্তেজনা দেখে ও কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো কী হয়েছে রে রতন? কথার জবাব না দিয়ে রতন লাল চোখে সঞ্জয়ের দিকে একবার তাকিয়ে পিন্টুর হাত ধরে বললো, বাড়ি চল।

পিন্টু যখন ফুটবল কিংবা ক্রিকেট খেলে রতন তখন ভয় পেয়ে কী রকম সিটিয়ে থাকে সে কথা ওর অজানা নয়। একবার ওদের ওপরের ক্লাসের সঙ্গে খেলার সময় রাফ ট্যাকলিং-এ পড়ে পিন্টুর নাক দিয়ে রক্ত বেরিয়েছিলো। সবাই যখন পিন্টুর নাকে মুখে বরফ ঘষছে, রতন তখন কেঁদে আকুল। পিন্টুকেই উঠে গিয়ে ওর কান্না থামাতে হয়েছে।

পুরোনো সব কথা ভাবতে ভাবতে পিন্টু এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো। শেষ রাতে স্বপ্ন দেখলো ও আর রতন ছোট্ট হলুদ পাখি হয়ে আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ এক বাজপাখির তাড়া খেয়ে দুজন প্রাণপণে উড়তে লাগলো। পিন্টু অনেক দূর এগিয়ে গেছে, রতন উড়তে পারছে না। পিন্টু ঘুরে এসে তেড়ে গেলো হিংস্র বাজের দিকে। রতন আর্তনাদ করে উঠলো, পিন্টু পালিয়ে যা। ওর কথা পিন্টু শুনলো না। রতন ওর আগে উড়ে এসে বাজপাখিটার ওপর হামলা করলো। ছোট্ট রতনপাখিকে নখে বিঁধিয়ে নিয়ে বাজপাখিটা দ্রুত মেঘের আড়ালে হারিয়ে গেলো। পিন্টু চিৎকার করে কেঁদে উঠলো না, রতন না।

কী হয়েছে পিন্টু! খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস? রতনের হাতের ঠেলায় পিন্টু চোখ মেলে তাকালো। রতন আবার বললো, ঘুমের ভেতরে তুই কাঁদছিলি।

পিন্টু কোনো কথা না বলে বাইরে তাকালো। ভোর হতে আর বেশি দেরি নেই। পুবের আকাশ ফ্যাকাশে হয়ে এসেছে। লঞ্চটা দাঁড়িয়েছিলো। পিন্টু জিজ্ঞেস করলো, আমরা এখন কোথায়? লঞ্চ থেমে আছে কেন?

জেলেরা মাছ তুলছে লঞ্চে। দেখবি কী রকম চকচকে ইলিশ মাছ!

পিন্টু উঠে বসলো। ওপরের ডেকের যাত্রীরা সবাই ঘুমে অচেতন। ওরা দুজন ফার্স্ট ক্লাসের ডেকের দিকে এগিয়ে গেলো। লঞ্চের একেবারে সামনের ফাঁকা ডেকে ফাইবার গ্লাসের কয়েকটা চেয়ার পাতা। রতন আর পিন্টু দুটো চেয়ার টেনে একপাশে বসলো।

নিচে বড় নৌকা থেকে জেলেরা লঞ্চে মাছ তুলছে। নৌকার খোলর ভেতর বরফকুচির ভেতর রূপোলি ইলিশের ছড়াছড়ি। নদীর ওপর কুয়াশার চাদর বিছানো। নদীর কুল কিনারা কিছুই দেখা যাচ্ছে না। পিন্টু জিজ্ঞেস করলো, এ নদীর নাম কী?

এখনও আমরা মেঘনার ওপর আছি। কিছুক্ষণ পর তেতুলিয়া নদীতে গিয়ে ঢুকবো।

মাছ তোলা নিয়ে জেলেদের হইহল্লা বোধহয় লঞ্চের সারেং-এর পছন্দ হচ্ছিলো না। বেশ কয়েকবার ভেপু বাজালো। ঢং ঢং করে ঘন্টা বাজালো। জেলেরা তড়িঘড়ি মাছের বড় বড় বাঁশের চাঙারি লঞ্চে তুলে দিয়ে নৌকা নিয়ে দূরে সরে গেলো। লঞ্চ আবার ঘুট ঘুট ঘুট শব্দ করে মেঘনার মোহনার দিকে এগিয়ে চললো।

পুব আকাশের ফিকে সাদা রঙটা ধীরে ধীরে সারা আকাশে ছড়িয়ে পড়লো। দিনের প্রথম সূর্য ওদের মুখে আলোর আবির মাখিয়ে দিলো। ভোরের আলো মাখা ঠান্ডা ভেজা বাতাস আদর করে ওদের চুল এলোমেলো করে দিলো। আর তখনই দুটো হলুদ পাখি হয়ে সূর্যের দিকে উড়ে যেতে ইচ্ছে হলো পিন্টুর।

কিছুক্ষণ পর লুঙ্গি পরা ছোট্ট একটা ছেলে এসে বললো, স্যার চা লাগবো?

পিন্টু বললো, দু কাপ চা আর বিস্কিট দাও।

একটু পরে চা ওয়ালা দু কাপ চা আর চারটা নোনতা বিস্কুট আনলো। রতন ওকে জিজ্ঞেস করলো, পানি আনতে পারবে?

ক্যান পারুম না? বলে দু গ্লাস পানি দিয়ে গেলো ছেলেটা।

ফার্স্ট ক্লাসের কেবিনগুলোর শেষ মাথায় আয়না বসানো বড় বেসিনে গিয়ে রতন আর পিন্টু মুখ ধুয়ে এলো। তারপর চা খেতে খেতে ওরা মেঘনার মোহনায় টকটকে লাল সূর্যকে ধীরে ধীরে ওপরে উঠতে দেখলো। ফার্স্ট ক্লাসের যাত্রীদের তখনও ঘুম ভাঙেনি।

অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর রতন পিন্টুকে জিজ্ঞেস করলো, শেষ রাতে কী স্বপ্ন দেখছিলি পিন্টু? তোর ফোঁপানো দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো।

স্বপ্নের কথা বলতে পিন্টু লজ্জা পাচ্ছিলো। তবু আস্তে আস্তে রতনকে ওর দেখা পুরো স্বপ্নটার কথা বললো।

ডেকের রেলিং-এর ওপর হাত রেখে দাঁড়িয়ে ছিলো পিন্টু। ওর হাতের ওপর হাত রেখে রতন মৃদু হেসে বললো, তুই থাকতে বাজপাখি কেন, কোনো কিছুই ভয় পাই না আমি।

মৃদু হেসে পিন্টু বললো, আমি জানি।

লঞ্চের মুখ ধীরে ধীরে ডান দিকে ঘুরে গেলো। নদীর দুই তীরের ঘরবাড়ি গাছপালা কাছে চলে এলো। মেঘনার বিশালতার কাছে তেতুলিয়া নদীকে মনে হয় খালের মতো। কুয়াশার ফিনফিনে চাদর বিছানো মাঠে চাষীরা লাঙল দিচ্ছে। জেলেরা তিনকোণা ধর্মজাল দিয়ে পানি থেকে মাছ ঘেঁকে তুলছে। পানির ওপরে জাল ভোলার সঙ্গে সঙ্গে ছোট ছোট রূপোলি মাছগুলো ঝলমল করে উঠছে। রতন বললো, চল, আমাদের জায়গায় যাই। লোকজন না আবার বিছানা মাড়িয়ে দেয়।

এত সুন্দর জায়গা থেকে পিন্টুর যেতে ইচ্ছে করছিলো না। তবু রতনের কথায় যেতে হলো। ডেকে যারা শুয়েছিলো তাদের অনেকে উঠে বসেছে। কেউ ব্যাগ গোছাচ্ছে। কেউ চা খাচ্ছে। রতন বললো, আর আধাঘন্টার ভেতর আমরা ভোলা পৌঁছে যাবো।

পিন্টুর মনে হলো, ভোলা যদি আরও দূরে হতো, যেতে যদি আরও দু তিন দিন লাগতো তাহলে মন্দ হতো না। মানুষ যা ভাবে সব সময় তা কি হয়!

রতন বললো, কি রে, বাড়ির জন্য মন খারাপ করছে?

ধ্যাৎ! কচি খোকা নাকি বাড়ির জন্য মন খারাপ করবে! ভাবছিলাম লঞ্চ জার্নিটাও আরও লম্বা হলেই পারতো।

রতন হেসে বললো, বেশি লম্বা নয় বলেই ভালো লাগছে। দু তিন দিন এরকম পানিতে থাকলে ডাঙায় উঠার জন্য ছটফট করতি।

ভোলার দিদির বাড়িতে আগেও দুবার এসেছে রতন। ঘাট থেকে রিকশা নিয়ে উকিল পাড়া আসতে ওদের মিনিট কুড়ির মতো সময় লাগলো। রতনের জামাইবাবু শেখরদা বাড়িতেই ছিলো। রিকশা এসে কাঠের দোতলা বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াতেই বড়দির সাত আট বছরের ফুটফুটে মেয়ে ভেতর থেকে ছুটে এলো। রতনকে দেখে ছোট মামা আসছে, ছোট মামা আসছে, বলে আবার ছুটে গেলো বাড়ির ভেতরে। পিন্টু রিকশার ভাড়া না মেটাতেই দিদি আর জামাই বাবু বেরিয়ে এলো। পিন্টুকে রিকশার ভাড়া দিতে দেখে হা হা করে উঠলো জামাই বাবু–এইটা কি কর পিন্টু বাবু, তুমি অতিথি মানুষ, রিকশার ভাড়া তুমি ক্যান দিবা! বলে রিকশাঅলাকে ধমক দেয়ার ভান করলো–তোর সাহস তো কম না রমিজউদ্দিন, আমার অতিথের কাছ থেইকা ভাড়া লস!

রিকশাওয়ালা সঙ্গে সঙ্গে দশ টাকার নোটটা পিন্টুর হাতে গুঁজে দিয়ে লজ্জায় জিব কেটে বললো, আমি ক্যামনে জানুম উকিল বাবু ওনারা আমনেগো অতিথ! জামাইবাবুকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রিকশা নিয়ে সে হনহন করে চলে গেলো।

পিন্টু বললো, এটা ঠিক হলো না শেখরদা। ওকে তো সারাদিনই কারও না কারও মেহমানকে বইতে হবে।

ও আমার কাছ থেইকা ভাড়া নিবো। তুমি ক্যান দিবা? শহরে আমার একটা মান সম্মান আছে না! না কি গো শালাবাবু। শেষের কথাটা বলা হলো রতনকে।

রতন কিছু বলার আগে ওর বড়দি বললো, আগে ঘরে চলো তো পিন্টু! তোমাদের শেখরদার পাল্লায় পড়লে সারাদিন কথা শুনতে হবে!

শেখরদা হেসে বললো, গিন্নি কথা বেইচা সংসার চলে। কথারে এত ঘিন্না কর ক্যান!

তোমার কথা কোর্টে গিয়া সরকারী উকিলরে শুনাইও। বলতে বলতে বড়দি সবাইকে নিয়ে ঘরে ঢুকলো।

রতনের বড়দির বড় ছেলে শান্ত বাড়িতে ছিলো না। রতনের চেয়ে মাত্র ছ মাসের ছোট, লালমোহনে ওর পিসির বাড়ি গেছে বিয়ে খেতে! রতন জিজ্ঞেস করলো, শান্ত কবে আইবো বড়দি?

বিয়া ওইবো আইজ। কাইল আইয়া পড়বো। তোরা আইবি হুইনা কি যাইবার চায়? আজ অর বাপের মামলার তারিখ, যাইবার পারবো না বইলা জোর কইরা পাঠাইছি।

শান্তকে রতনদের বাড়িতে আগে দেখেছে পিন্টু। ভেবেছিলো ও থাকলে ঘুরে বেড়ানোর সুবিধে হবে। ভাগ্যিস্য কালই এসে পড়বে। নইলে ঘরে বসে পিন্টুর সঙ্গে লুডু নয় ক্যারাম খেলতে হতো।

শেখরদা কোর্টে যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছিলো। আজ নাকি ওর সাংঘাতিক এক খুনের মামলার শুনানি হবে। রতনকে বললো, চান টান কইরা ইচ্ছা করলে তোমার বন্ধুরে শহরটা গুরায়া দেখাইতে পার। দ্যাখনের যদিও কিছুই নাই।

বড়দি বললো, আইজ গুরাগুরির কাম নাই। এতদূর থেইকা আইছে। আইজ রেস্ট লয়া কাইল শান্তরে নিয়া গুরতে পারবো।

পিন্টুর অবশ্য ঘুরতে যেতে আপত্তি ছিলো না, তবে রতন বললো, হ শেখরদা, আইজ আর বাইর ওমু না।

পিন্টু আর রতনের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে দোতলায় শান্ত থাকার ঘরে। এ ঘরটা অতিথি-কুটুম্বদের জন্য রাখা হয়েছে। দোতালায় ঘর দুটোই, তিনদিকে ঘেরা বারান্দা। ঘরের মেঝে, দেয়াল সবই কাঠের, ওপরে শুধু টিন। তবে টিনের তলায় কাঠের সিলিং রয়েছে। ঘরের একপাশে পুরোনো দিনের বনেদি প্যটার্নের একটা বড় খাট, পাশে কাঠের আলমারি, অন্য দিকের দেয়ালে পড়ার টেবিলের মতো উঁচু সেকেলে ড্রেসিং টেবিল। দুটো কাঠের চেয়ার রয়েছে টেবিলটার পাশে। দেয়ালে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব আর সারদা মায়ের ছবিওয়ালা একটা বাংলা ক্যালেন্ডার ঝুলছে। ছবিতে দুজনের মাথা থেকে জ্যোতি বেরুচ্ছে।

দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে ওরা শান্তর ঘরে ঢুকলো। ওর পড়ার টেবিলের পাশে ছোট একটা বুক শেলফ ভর্তি গল্পের বই। বেশির ভাগই সেবা প্রকাশনীর পেপার ব্যাক। ওখান থেকে দুটো ওয়েস্টার্ন কাহিনীর বই নিয়ে ওরা সন্ধ্যে পর্যন্ত নিজেদের ঘরে কাটিয়ে দিলো। বড়দির ছোট মেয়ে চুমকি যখন ওদের চা খেতে ডাকতে এলো তখনও ওদের বই শেষ হয়নি।

নিচে বসার ঘরে চা নিয়ে বড়দি অপেক্ষা করছিলো। শেখরদা কোর্ট থেকে ফিরে কাপড় বদলাতে গেছে। চায়ের সঙ্গে নাশতার বহর দেখে পিন্টু আঁতকে উঠলো। দুপুরে তিন রকমের মাছ আর চার পাঁচ রকমের ভাজি, নিরামিষ, ছেচকি খেয়ে পেটে তিল ধারণের জায়গা নেই। এখন আবার বড়দি লুচি, আলুর দম, ভাজি আর সুজির মোহনভোগ তৈরী করেছে। পিন্টু কাতর গলায় বললো, দুপুরে এত কিছু খেয়েছি এরপর এসব খেতে হলে দম আটকে মরে যাবো বড়দি।

বালাই ষাট। এ আবার কেমন কথা। কোন দুপুরে খেয়েছে, এখন প্রায় ছটা বাজে। খেয়ে না হয় নদীর ধার থেকে ঘুরে এসো। সব হজম হয়ে যাবে।

বড়দিকে খুশি করার জন্য গোটা চারেক লুচি পিন্টুকে খেতেই হলো। রতন দুটোর। বেশি খেলো না। বড়দি বললো, না খাইয়া তো দিন দিন চামচিকা হইতাছস। দ্যাখছস পিন্টুর কী সোন্দর স্বাস্থ্য?

তর্ক করে লাভ নেই জেনে রতন নিরবে হাসলো। পিন্টু চা খাওয়া শেষ করে রতনকে বললো, চল, একটু হেঁটে আসি। খাওয়ার যা বহর দেখছি, সাতদিন থাকলে সাত কেজি ওজন বাড়বে।

রতন হেসে বললো, তোর বাড়তে পারে, আমার বাড়বে না।

হাঁটতে হাঁটতে পিন্টু আর রতন কলেজের দিকে গেলো। খুবই ছোট শহর ভোলা। পিন্টুদের যশোরের চার ভাগের এক ভাগও হবে না। রাস্তায় একটা গাড়িও দেখতে পেলো না ওরা। শুধু রিকশা আর সাইকেল। রতন বলল, শহরের ভেতর বাস সার্ভিস নেই।

ভোলা কলেজের সামনে বিরাট মাঠ। তারপর ধান ক্ষেত। দুপুরের দিকে বেশ গরম পড়েছিলো। এখন চমৎকার বাতাস বইছে। পিন্টু আর রতন মাঠে বসে থাকলে বেশ কিছুক্ষণ। পিন্টু বললো, কী রকম তাজা বাতাস দেখেছিস? কোনো ধুলো নেই, ধোঁয়া নেই, ইচ্ছে করছে এখানেই থেকে যাই।

দুদিন পর যখন দেখবি এখানে কালার টেলিভিশন নেই, ভিসিআর নেই, ফুটবল লীগের খেলা নেই, তখন ঠিকই ঢাকা যাওয়ার জন্য ফটফট করবি।

আটটার দিকে বাড়ি ফিরে পিন্টু দেখলো বসার ঘরে অচেনা এক ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা বসে আছেন। ভদ্রমহিলা বয়সে বড়দির অনেক বড় হবেন, পরনে লালপাড় গরদের শাড়ি। কপালে বড় সিদুরের টিপ। রতন পিন্টুর কানে কানে বললো, শেখরদার বড় ভাই রণেনদা আর বৌদি কুঞ্জের হাটে থাকে।

পিন্টু ঘরে ঢুকতেই শেখরদা ওর দাদা বৌদির সঙ্গে ওকে পরিচয় করিয়ে দিলো। রতন ওদের নমস্কার দিলো। পিন্টু হাত তুলে বললো, আদাব।

রণেনদা হেসে বললেন, এসেছিলাম আমার বড় মেয়ের বিয়ের নেমন্তন্ন করতে। রতন, তোমরা তো আসবেই, পিন্টুকেও সঙ্গে এনো। আসবে তো পিন্টু?

পিন্টু অবাক হয়ে বললো, কবে বিয়ে, কোথায়?

হাতে অনেক সময় আছে। ডিসেম্বরের বারো তারিখ বিয়ে। ছেলের বাড়ি চরফ্যাশন। বিয়ে এখানেই হবে।

পিন্টু মৃদু হেসে রতনকে জিজ্ঞেস করলো, কী রে আসবি?

শেখরদা বললো, আসবে না কেন? আমি সবার জন্য টিকেট পাঠিয়ে দেবো। আমাদের পরের জেনারেশনের প্রথম বিয়ে এটা। কলকাতা থেকে বাজি আনাবো।

শেখরদার বৌদিও বললেন, এসো কিন্তু ভাই। তোমার বাবা মাকেও নেমন্তন্ন করবো। শান্তর মার কাছে তোমাদের বাড়ির কথা অনেক শুনেছি।

পিন্টু লজ্জা পেলো–-ঠিক আছে, আসবো। বলে ওপরে গিয়ে রতনকে বললো, জানা নেই, শোনা নেই, শেখরদার ভাই কিভাবে নেমন্তন্ন করে ফেললেন দেখলি? আমিও বলে দিলাম আসবো।

রতন বললো, জানা নেই মানে আগে দেখিস নি। বৌদি কী বললেন শুনলি না? বড়দির কাছে তোদের বাড়ির কথা অনেক শুনেছেন।

তুই আসবি?

আসা যাবে। তখন তো স্কুলে ছুটি থাকবে। একটু হেসে রতন এর সঙ্গে যোগ করলো–তাছাড়া টিকেট পাঠাচ্ছে শেখরদা।

পরদিন দুপুরের আগেই শান্ত এলো। পিন্টুকে দেখে উচ্ছ্বসিত গলায় বললো, পিন্টু মামা, তুমি আসছো জেনে কী যে খুশি হয়েছি। আমাদের পাড়ার ক্লাবের একটা ফুটবল টীম আছে। ওরা তোমার খেলা দেখবে বলেছে।

রতন হেসে বললো, পিন্টু এখন টাকা ছাড়া বাইরে খেলে না।

শান্ত বললো, টাকা না, আমরা পিন্টু মামাকে সংবর্ধনা দেবো। আমাকে বলেছে। মানপত্র লিখে দিতে। পরদিন থেকে শান্তদের ক্লাবে খেলা, ছেলেদের কোচিং করা, কলেজ রোডের এক টুর্নামেন্ট পুরস্কার বিতরণ, শেখরদার ভাই বোনদের বাসার নেমন্তন্ন খাওয়া আর সবাই মিলে নৌকায় নদীতে ঘোরার ভেতর দিয়ে ভোলার দিনগুলো কিভাবে কেটে গেলো ওরা টেরই পেলো না।