২. ডালপট্টির মোড়ে

ডালপট্টির মোড়ে নিউ এজ ফার্মেসিতে সন্ধ্যার পর বসে পিন্টুদের পাড়ার তরুণ ডাক্তার ইরফান। এক সময় ছাত্র ইউনিয়ন করতো, পরে কিছুদিন কমিউনিস্ট পার্টিও করেছিলো। রাশিয়ায় গর্ভাচেভের কান্ড কারখানা দেখে পার্টি করা ছেড়ে দিয়েছে। হালে জামাতীদের বিরুদ্ধে যে নির্মূল কমিটি হয়েছে সেখানে ঢুকেছে। গরিব রোগীদের কাছ থেকে ভিজিট নেয় না বলে ফার্মেসিতে সন্ধ্যার পর দাঁড়াবার জায়গা থাকে না।

বাড়ি ফেরার পথে পিন্টু আর রতন ওখানে ঢু মারলো। ফার্মেসির কর্মচারীকে পিন্টু জিজ্ঞেস করলো, ইরফান ভাই আজ কতক্ষণ থাকবেন?

পিন্টুদের ভালো করেই চেনে ছোকরা কর্মচারীটা। হেসে বললো, আইজ মনে ওইতাছে স্যারে দশটার আগে বাড়িতে যাইবার পারবো না।

ঠিক আছে। ইরফান ভাইকে বোলো আমরা এসেছিলাম। কাল বিকেলে বাসায় যাবো।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে ওদের সাতটা বাজলো। রতনদের বাড়িতে অনেক মানুষ। ছেলে মেয়েদের ভেতর কে কখন আসছে যাচ্ছে সেসব খবর রাখার মতো সময় রতনের মার নেই। পিন্টুদের বাড়ির কথা আলাদা। সন্ধ্যেবেলা ওর বাবা বাড়ি ফিরেই খবর নিয়েছেন পিন্টু কোথায়। মা নিজেও জানেন না পিন্টু কোথায়। বানিয়ে বললেন, নিশ্চয় কোথাও ফুটবল নয় ক্রিকেট নিয়ে মেতে আছে। ভেবো না, এসে যাবে।

ওকে বলে দেবে সন্ধ্যার পর বাইরে থাকা আমি পছন্দ করি না। এই বলে বাবা কাপড় পাল্টাতে ঘরে ঢুকলেন। এরপর তিনি কলতলায় যাবেন। ঘরে এসে চা খাবেন মুড়ি ভাজা দিয়ে। রতনের বাবা এলে তাঁর সঙ্গে দাবা খেলবেন। নয়তো রহমত ব্যাপারীর গদিতে যাবেন আড্ডা দিতে। রাতের খাবার খাবেন নটায়। তার আগে পিন্টুর খোঁজ পড়বে না। মা ভাবলেন এর আগে নিশ্চয় ছোঁড়াটা এসে যাবে।

পিন্টুর বাবাদের গ্রামের বাড়ি যশোরে। ওর নানার বাড়ি বর্ধমান। সাতচল্লিশের দেশ ভাগের পর নানারা খুলনার সাতক্ষিরায় বাড়ি করেছেন। এক মামা আছেন, সাতক্ষিরায় ওকালতি করেন, কখনও কোনো দরকারে ঢাকা এলে পিন্টুদের বাড়িতে ওঠেন। বাবার এক ভাই আর দুই বোন গ্রামে থাকেন। পিন্টুর ফুপুদের বিয়েও হয়েছে। গ্রামে। অনেক আগে পিন্টুর বয়সী ওর বড় ফুপুর ছেলে ফুপার সঙ্গে ঢাকা এসে ওদের বাড়িতে উঠেছিলো। বাবা মাঝে মধ্যে চিঠি লিখে খোঁজ খবর নেন। চাচা সারা বছরের চাল আর তিরিশ চল্লিশটা নারকেল পাঠিয়ে কর্তব্য সারেন। বাবার হিসেব মতো চাচার আরও পাঠানো উচিৎ তবে এ নিয়ে চাচাকে কখনও কিছু বলেননি।

রতনদের অবস্থা অন্যরকম। ওদের গ্রামের বাড়ি বিক্রমপুর। বাড়িতে এখন ওরা পাঁচ ভাই বোন থাকে। ওর বড়দি আর মেজদির বিয়ে হয়ে গেছে অনেক আগে। তার পর দুভাই যতীন আর স্বপন। বড়দা চাকরি করে, মেজদা এম, এস,সি পাশ করে দুবছর ধরে চাকরির জন্য ঘুরছে। তারপর সেজদি, বাংলায় অনার্স পড়ে ইডেন কলেজে। ছোড়দি পড়ে সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজে। রতন সবার ছোট।

ওদের কাকা, মামা, মাসি, পিসির সংখ্যাও কম নয়। ব্যবসার কাজে কিংবা মামলা মোকদ্দমার কাজে ঢাকায় এসে অনেকে হোটেলে উঠলেও দুবেলা না খেয়ে যায় না। জামাই ষষ্ঠীতে বড়দি যখন গোটা পরিবার নিয়ে বেড়াতে আসে –তখন বাড়িতে পা ফেলার জায়গা থাকে না। বাড়িতে লোকজন বেশি এলে রতন রাতে পিন্টুর সঙ্গে ঘুমায়। স্বপন হলে বন্ধুদের কাছে থেকে যায়।

সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরে রতন হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বসবে, সেজদি তপতী এসে বললল, কই আছিলি এতক্ষণ। মা আবার ফিট ওইয়া গেছে। ওষুধ আইনা দে।

রতনের মার অনেক দিনের পুরোনো ফিটের ব্যামো। কাজের চাপ বেশি থাকলে তিনি প্রায়ই জ্ঞান হারান। বিছানায় শুয়ে থাকেন একবেলা। পাড়ার পুরোনো ডাক্তার কৈলাশ হোমিওর ওষুধ খান দুই ডোজ। তারপর সুস্থ হন।

এমনিতে রতনের স্কুলের পড়া মনে থাকে না, তার ওপর পড়ার সময় এটা সেটা করতে বললে ওর ভারি রাগ হয়। আলনায় রাখা জামাটা গায়ে দিতে দিতে বললো, মা ফিট হইছে আর তোমরা বইয়া রইছ আমার লাইগা। ক্যান, মেজদারে কইতে পার নাই?

সেজদি ওর হাতে পাঁচটা টাকা গুঁজে দিয়ে বললো, ম্যালা প্যাচাল পাড়িস না। মেজদা ঘরে থাকলে তো কমু।

রতন গজ গজ করতে করতে ওষুধ আনতে গেলো। হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষার আর। মাত্র এক মাস বাকি। বাবা এমনিতে লেখাপড়ার কোনো খোঁজ নেন না। তবে পরীক্ষার রিপোর্ট কার্ড তাঁর পছন্দ না হলে এখনও চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকান। রতন ভালো করেই জানে পরীক্ষার ফল ভালো করে বাবাকে খুশি করা কী কঠিন কাজ। যেবার তপতী ক্লাস এইটে বৃত্তি পেলো সেবারই বাবার মুখে প্রথম হাসি ফুটেছিলো। এইচ.এস.সি-তে তিনটা লেটার নিয়ে ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করেছে তপতী, তারপরও বাবা বলেছেন, আর একটু মন দিয়া পড়লে স্টার মার্ক পাইতি। তাইলে আর আমার খরচের চিন্তা করতে ওইতো না।

রতন অবশ্য মনে মনে ঠিক করে রেখেছে এস.এস.সি-তে পরীক্ষার ফল যদি ভালো না হয় উঠতে বসতে বাবার গালমন্দ খাওয়া ওর পোষাবে না, সোজা কলকাতায় চলে যাবে। ওর বাবার এক খুড়তুতো ভাই চৌষট্টি সালের দাঙ্গার পর কলকাতা চলে গেছেন। সেখানেই বিয়ে থা করে থিতু হয়েছেন। ওয়েল্ডিং কারখানা বসিয়ে বড় বড় মেশিনের স্পেয়ার পার্টস বানিয়ে ম্যালা টাকা পয়সা করেছেন। বাড়িতে নিজেকে খুবই অবহেলিত মনে হয় রতনের। সবার ছোট বলে রাজ্যের কাজ ওর কাঁধেই চাপানো হয়। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত মা অবশ্য ওকে বাজারে যেতে দিতেন না। মেজদা স্বপন বাজার করতো। ও সিক্সে ওঠার পর স্বপন একবার ওদের ডিপার্টমেন্ট থেকে সাত দিনের জন্য চট্টগ্রামে যাবে, মা বললো, তুই না থাকলে হাট-বাজার করামু কারে দিয়া? স্বপন রেগে গিয়ে বলেছে, ক্যান, রতইন্যারে দিয়া করাইবা! এত বড় দামড়া পোলারে আর কতদিন আঁচলের তলে রাখবা? দশ মিনিট লাগে না সূত্রাপুরের বাজারে যাইতে!

সকালের বাজার করতে রতনের খারাপ লাগে না। হিসেব করে দুএক টাকা ওখান থেকে বাঁচানো যায় হাত খরচের জন্য। এমনিতে মা কখনও হাত খরচের পয়সা দেন না। সকালে ডাল আর একটা ভাজি দিয়ে গরম ভাত খেয়ে স্কুলে যায়। অবশ্য টিফিনে পিন্টু পেয়ারা নয়তো ঘুগনি কিনলে ওকে দিতে কখনও ভোলে না।

গলির মোড়ে পিন্টুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো রতনের। হন হন করে ডালপট্টির দিকে যাচ্ছিলো পিন্টু। অবাক হয়ে জানতে চাইলো রতন–এদিকে কোথায় যাচ্ছিস?

ওষুধের দোকানে। আপুর জন্য ডিসপ্রিন কিনতে হবে। তুই গিয়েছিলি কোথায়?

কৈলাশ ডাক্তারের কাছে। মা আবার ফিট হয়েছে।

রাতে আসবি?

আজ আসবো না। মেজদা বোধহয় হল-এ থাকবে। মেজো ভাই না থাকলে রতনের ভারি সুবিধা। গোটা তক্তপোষে ও একা শুতে পারে। হঠাৎ মনে পড়াতে পিন্টুকে বললো, ইরফান ভাইর সঙ্গে দেখা হলে হরিমতিয়াদের কথা বলিস।

বলবো। মৃদু হেসে পিন্টু বন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিলো। ওর মতো রতনের মনটাও খুব নরম।

রাত তখন প্রায় আটটা। নিউ এজ ফার্মেসীতে ইরফান ডাক্তারের রোগী তখনও ছসাতজন বসে। পিন্টু একপাতা ডিসপ্রিন কিনে পঞ্চাশ টাকার নোট দিয়েছে। বুড়ো ম্যানেজার ভাংতি টাকা গুনছেন, এমন সময় ভেতর থেকে ম্যানেজারকে কিছু বলার জন্য বাইরে এলো ইরফান। পিন্টুর হাতে ডিসপ্রিন দেখে হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করলো, এত ডিসপ্রিন কার জন্য?

আপুর মাথা ধরেছে।

হাসিকে বলবে এত ডিসনি খাওয়া ঠিক নয়। মাথা কেন ধরে সে রোগটা আগে সারানো দরকার।

হাসি এবার এম এ পরীক্ষা দেবে। ওর সঙ্গে গল্প করার জন্য সন্ধ্যায় ইরফান প্রায়ই ওদের বাড়ি যায়। পিন্টু মুখ টিপে হেসে বললো, পরীক্ষার দিন যত ঘনিয়ে আসবে আপুর মাথা ব্যথা তত বাড়বে।

ওকে বোলো কাল বিকেলে যাবো। এই বলে ইরফান চেম্বারে ঢুকতে যাবে–পিন্টু বললো, আপনার সঙ্গে জরুরী একটা কথা ছিলো ইরফান ভাই।

কী কথা? অবাক হয়ে জানতে চাইলো ইরফান। আমার পরিচিত এক গরীব মহিলাকে দেখতে যেতে হবে। খুব অসুখ, এখানে আসতে পারবে না।

কখন যেতে হবে?

কাল স্কুল থেকে ফিরে আপনাকে নিয়ে যাবো।

কোথায় যেতে হবে?

গেন্ডারিয়া স্টেশনের কাছে।

ঠিক আছে এসো। আমি বাসায় থাকবো।

হরিমতিয়ার মা সুরিয়াবালাকে দেখে ইরফানের মুখ গম্ভীর হয়ে গেলো। সারা গায়ে বাজে রকমের ঘা হয়েছে। ব্যাগ থেকে ঘায়ে লাগাবার মলম বের করে হরিমতিয়াকে ওটা লাগাবার নিয়ম বুঝিয়ে দিয়ে শেষে বললো, তোমার মার অসুখ তো ম্যালনিউট্রেশন, পুষ্টির অভাব । মাকে ভাল মতো খাওয়া দিতে হবে। পারলে কিছুদিন দুধ খাওয়াও।

হরিমতিয়া চোখের পানি ফেলে বললো, দো ওয়াক্ত দুটা সুখা রোটি দিতে পারি না মাকে, দুধ কুথায় পামু বাবুজী।

ইরফান গম্ভীর মুখে উঠে দাঁড়ালো। ওর বেশির ভাগ গরিব রোগীই এরকম অসুখে ভোগে আর এরকম কথা বলে। এসবে অভ্যস্থ হলেও প্রতিবারই ওর মন খারাপ হয়ে যায়–যখন আবার নতুন করে শুনতে হয়।

বাড়ি ফেরার পথে ইরফান পিন্টুকে জিজ্ঞেস করলো, এদের সঙ্গে তোমাদের পরিচয় হলো কিভাবে?

গতকালের ঘটনাটা ইরফানকে জানালো পিন্টু। রতন জানতে চাইলো, হরিমতিয়ার মা বাঁচবে তো ইরফান ভাই?

এ যাত্রা বাঁচলেও বেশিদিন বাঁচার আশা নেই। বয়স হয়েছে, শরীরেও কিছু নেই।

পিন্টু বললো, হরিমতিয়ার মার পথ্যের জন্য আমরা তো কিছু চাঁদা তুলতে পারি রতন!

কোত্থেকে তুলবি?

কেন, আমাদের ক্লাসে থেকে? অনেক বড়লোকের ছেলে আছে। পাঁচ দশ টাকা চাঁদা ওরা অনায়াসে দিতে পারবে।

টাকা অনেকের আছে। দেবে কিনা সেটাই হলো আসল কথা।

বলবো, দিলে সোয়াব হবে।

পিন্টু খুব ভালো বুদ্ধি বের করেছে। আমি তোমাদের ফান্ডে দশ টাকা চাঁদা দিচ্ছি। এই বলে ইরফান পকেট থেকে দশ টাকা বের করে পিন্টুর হাতে দিলো।

নিজের প্রশংসা শুনে লাজুক হেসে পিন্টু বললো, থ্যাঙ্ক ইউ ইরফান ভাই।

ক্লাসের ছেলেরা অবশ্য পির এ ধরনের আইডিয়ার বেশি প্রশংসা করতে পারলো না। ফার্স্ট বয় রেজাউল, যে রোজ গাড়িতে করে স্কুলে আসে, স্কুলের চারজন টিচার তাকে বাড়িতে গিয়ে আলাদা আলাদা বিষয় পড়ান পিন্টুর কথা শুনে ঠোঁট উল্টে বললো, খেয়ে দেয়ে আর কাজ পেলি না। কোথাকার কোন মেথরনীর জন্য ফান্ড তুলতে হবে। ফুঃ!

রেজার কথা শুনে পিন্টুর খুব রাগ হলো। রতন করুণ গলায় বললো, ওদের অবস্থা যদি নিজের চোখে দেখতি তাহলে এভাবে বলতে পারতি না। দুটো গরিব অসহায় বুড়ো মানুষ, মানুষের ভয়ে লুকিয়ে আছে সাপ খোপে ভরা এক ভূতের বাড়িতে, দুদিন খেতেও পায়নি বেচারারা!

ফকিরনী, মেথরনীদের জন্য আমার অত দরদ নেই। কাজ করে খেতে বলগে। এই বলে রেজা উঠে চলে গেলো।

ওরা টিফিন পিরিয়ডে ক্লাসে বসে আলোচনা করছিলো। পিন্টু ক্লাসের ক্যাপ্টেন বলে ওর কথায় অনেকেই বৈঠকে উপস্থিত ছিলো। ছিলো না শুধু তারাই, যারা টিফিন পিরিয়ডে বাড়িতে খেতে যায়। রেজাকে উঠে যেতে দেখে ওর সঙ্গে আরও পাঁচ জন উঠে পড়লো। যাবার সময় বখতিয়ার মুচকি হেসে বললো, তার চেয়ে সবাই চাঁদা তুলে রুচিতায় গিয়ে মোগলাই পরোটা আর কিমা খেলে দারুণ হয়! বখতিয়ারের বাবা হালে ইভেন্টিং ব্যবসা করে অনেক টাকা কামিয়েছেন।

রেজারা চলে যাওয়ার পর ক্লাসের সেকেন্ড বয় ইউসুফ বললো, শোন পিন্টু, তুই বলছিস বলে কাল আমি তোকে পাঁচ টাকা দেব। তবে এভাবে তুই কজনকে ভিক্ষা দিয়ে বাঁচাতে পারবি? দেশে ওদের মতো লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রায়ই না খেয়ে থাকে।

পিন্টু মুখ কালো করে বললো, যারা দেশ চালায় ওসব কথা তাদের গিয়ে বল। চোখের সামনে দুটো বুড়ো মানুষ না খেয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে–তাই তোদর বলছিলাম।

ইউসুফের দেখাদেখি বৈঠকে অন্য যারা ছিলো তারা সবাই চাঁদা দেয়ার ব্যাপারে রাজী হলো। যাদের সঙ্গে টাকা ছিলো তারা তখনই দিয়ে দিলো। অন্যরা বললো, কাল পরশু দেবে। রতন হিসেব করে দেখলো সবার টাকা পাওয়া গেলে সব মিলিয়ে চুরানব্বই টাকা হবে। রতনের হিসেব শুনে পিন্টু বললো, আমি আর রতন আগেই ওদের টাকা দিয়েছি। দরকার হলে আরও ছটাকা দিয়ে আমি একশ টাকা পুরো করে দেবো।

দু দিন পর যারা চাঁদা দেবে বলেছিলো, সব আদায় করার শেষে দেখা গেলো রতনের হিসেবে একটু গরমিল হয়েছে। সব মিলে চুরানব্বই নয়, নব্বই টাকা পাওয়া গেছে। রতন পিন্টুকে বললো, ইরফান ভাই যে দশ টাকা দিয়েছেন সেটা তো হিসেবে ধরিনি। ওটা ধরলে তো এমনিতেই একশ টাকা হয়ে যায়।

তিন দিন পর ইন্টার স্কুল ফুটবলের এক গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ কলেজিয়েট স্কুলের সঙ্গে। গেম চিটার রোজ বিকেলে ওদের প্র্যাকটিস করাচ্ছেন। পিন্টু বললো, মঙ্গলবারের ম্যাচটা হয়ে যাক। বুধবার গিয়ে টাকাটা দিয়ে আসবো।

রতন নিজে না খেললেও পিন্টুর খেলার সময় ওর ওপর নজর রাখে। কখন বল লেগে জখম হয় কে বলতে পারে! পিন্টুর দিকে জোরে বল আসতে দেখলে রতনের বুক ডিব ডিব করে। হরিমতিয়াদের জন্য যদিও ওর উৎকণ্ঠা ছিলো, আটা যতটুকু দিয়ে এসেছে দু দিনের বেশি চলার কথা নয়–তারপরও পিন্টুকে ফুটবলের মাঠে রেখে ওর একা যেতে ইচ্ছে হলো না। পিন্টু অবশ্য পরদিন ওর বিমর্ষ চেহারা দেখে বলেছে, এত ভাবছিস কেন? হরিমতিয়া বললো না দুদিন পর বেতন পাবে। এতে রতনের বুকের বোঝা কিছুটা হালকা হয়েছে।

মঙ্গলবার ম্যাচ জিতে দারুণ ফুর্তিতে ছিলো পিন্টু আর রতন। খেলার শেষে গেম টিচার সবাইকে কোক আর মোগলাই পরোটা খাইয়েছেন। সাইড লাইনে বসে যারা খেলা দেখছিলো তারাও বাদ পড়েনি। সবই জানে গেম টিচার বি চৌধুরী স্যার সখের জন্য চাকুরি করেন। তার বাবা যে সম্পত্তি রেখে গেছেন–হেসে খেলে জীবন কাটাতে পারবেন। তার ওপর তিনি বিয়েও করেননি। স্কুলের ছেলেদের নিজের ছেলের মতো ভালোবাসেন তিনি।

পরের দিন বিকেলে পিন্টু আর রতনের সব আনন্দ কর্পূরের মতো উবে গেলো। ভাগ্যকূলের জমিদারদের পোডড়া বাড়িতে এসে দেখে অচেনা লোকজন সেখানে লম্বা লম্বা শেকল আর ফিতা দিয়ে সব মাপজোক করছে। বাইরে ভাঙা পাচিলের পাশে মাথায় হাত দিয়ে হরিমতিয়া বসে আছে। তার পাশে এক টুকরো পুরোনো ঘেঁড়া চাটাইয়ে শুয়ে আছে ওর মা।

রতন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে হরিমতিয়া?

ওদের দুজনকে দেখে বুড়ি হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলো। বললো, আমাদের ফির নিকাল দিছে! হামলোগ কুছু করি নাই বাবুজী।

কেরানী গোছের একজন বয়স্ক লোক কয়েকটা খাতা বগলে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে পোড়া বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন। পিন্টু ওঁর সামনে দাঁড়িয়ে রুক্ষ গলায় জানতে চাইলো–এখানে কী হচ্ছে?

নাকের ডগায় ঝুলে পড়া চশমা টেনে তুলে থুতনি উচিয়ে দ্রলোক পিন্টুর দিকে তাকালেন। প্রথমে ভেবেছিলেন একটা ধমক দেবেন। পিন্টুর মাসল পাকানো শরীর আর রাগী চেহারা দেখে দমে গিয়ে বললেন, এখানে আমজাদ খান সাহেবদের নতুন কারখানা হবে।

এটা তো ভাগ্যকূলের জমিদারদের বাড়ি? আমজাদ খান এলেন কোত্থেকে?

জমিদার বাড়ি ছিলো পার্টিশনের আগে। এটা এখন শত্রু সম্পত্তি। আমজাদ খান সরকারী দলের বড় নেতা। সরকারের কাছ থেকে এটা তিনি লিজ নিয়েছেন। বলে আর দাঁড়ালেন না তিনি। পিন্টুকে পাশ কাটিয়ে হন হন করে চলে গেলেন।

হরিমতিয়ার কাছে এসে পিন্টু বললো, তোমরা এখন কোথায় যাবে?

চোখের পানি মুছে হরিমতিয়া বললো, এ মুলুকে আর থাকবো না বাবুজী। হামলোগ আপনা মুলক চলে যাবো।

সেখানে কেউ আছে তোমাদের?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে হরিমতিয়া বললো, গাঁওমে আপনা ঘর তো আছে, আমার দাদা যিখানে পয়দা হয়েছিলো। আপনা পড়োসান আছে। বাবুজী, হামলোগ সিখানে চলে যাবো।

সে তো অনেক দূর! যাবে কিভাবে?

হামারা এক গাঁও ওয়ালি ভাই সাথে যাবে। বাসে করে হামলোগ বিনাপোল যাবো। সিখান থেকে টিরিনে কলকাত্তা হয়ে মাদ্রাজ যাবো।

বর্ডার পার হবি কিভাবে? তোমাদের কি পাসপোর্ট ভিসা আছে?

বাবুজী, হামলোগ গরিব আদমি, পাসপুট কুথায় পাবো? পুলিশওয়ালাদের পা পাকাড়কে বলবো আমাদের মেহেরবানি করে ছেড়ে দিতে।

হরিমতিয়াদের জন্য পিন্টু আর রতনের মনে খুব কষ্ট হলো। কোন কালে বাপ দাদার হাত ধরে ছোট্ট হরিমতিয়া এদেশে এসেছিলো ভালো মতো থাকা খাওয়ার আশায়। বেচারি সারা জীবন মানুষের ময়লা সাফ করেছে। অথচ বুড়ো বয়সে মানুষ ওদের নোংরা ময়লার মতো ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে।

পিন্টু পকেট থেকে একশ টাকার নোটটা বের করে হরিমতিয়ার হাতে গুঁজে দিলো। ধরা গলায় বললো, এটা রাখো হরিমতিয়া, পথে লাগবে।

টাকা পেয়ে হরিমতিয়া আরেক দফা কাঁদলো। বললো, তুমরা দেওতা আছো বাবুজি। ভগমান তুমাদের ভালা করবেন।

হরিমতিয়ার কান্না দেখে রতনেরও কান্না পেলো। অতি কষ্টে কান্না চেপে বললো, তোমরা কবে যাবে হরিমতিয়া?

কাল ভোরে চলে যাবো বাবুজী। তুমাদের কথা কুনদিন ভুলবোনা বাবুজী।

হরিমতিয়া ওর ষাট বছরের জীবনে মানুষের কাছ থেকে কখনও এতখানি সহানুভুতি পায়নি। ওর ঈশ্বরের কাছে বার বার ছেলে দুটোর মঙ্গল কামনা করলো।