৯. ধর্মে পরমত সহিষ্ণুতা ও সম্প্রীতি চেতনা

নবম অধ্যায় – ধর্মে পরমত সহিষ্ণুতা ও সম্প্রীতি চেতনা (Religious Tolarance and Interfaith Harmony)

যদি না হয় সুভাষিত মন তবে তা ‘অঙ্গবিহীন আলিঙ্গন’

আপাতগ্রাহ্য ধারণায় অতি সহজ ছোট্ট একটি শব্দ সম্প্রীতি- যার আভিধানিক অর্থ— প্রণয়, সদ্ভাব, সন্তোষ, তৃপ্তি। এই নির্লিপ্ত বিশেষ্য পদটিকে নিয়ে আলোচনা ও বিতর্কের অন্ত নেই। পরস্পরের মধ্যে প্রীতি-ভালোবাসা যেমন থাকবে, তেমনি থাকবে অন্তর দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপার, থাকবে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও ত্যাগ- তিতিক্ষার ব্যাপারও। সম্প্রীতি বাতাসের মতন এমন একটি অদৃশ্য বস্তু যা চোখে না দেখা গেলেও বোঝা যায়, অনুভব ও অনুমান করা যায়। যাকে বলে মনশ্চক্ষু বা অন্তর্ভুক্ষু দিয়ে নিরীক্ষণ বা অন্তরাবলোকন। আর এই নিরীক্ষণ বা অবলোকন যেমন একতরফা হয় না, তেমনি মনের মধ্যে কালিমা থাকলেও হয় না। অর্থাৎ, তার জন্য চাই পরিচ্ছন্ন চিন্তাধারা, উভয়ের নীতি ও আদর্শগত সাম্য, মানবিক বা হার্দিক সমন্বয় এবং সর্বোপরি উভয়ত কিছুটা উৎসর্জনের খোলামেলা মনোভাব। অন্তর মেশালে তবে তার অন্তরের পরিচয়টা বুঝেই পারস্পরিক সহযোগিতা, আস্থা ও বিশ্বাসের হাত বাড়িয়ে দিতে হয়। সেই প্রসারিত হাতগুলি অটুটভাবে আবদ্ধ হলেই গড়ে উঠতে পারে সম্প্রীতির আবহ, বাতাবরণ বা পরিমণ্ডল।

জাগতিক নিয়মে কোন কিছুই এককভাবে হতে পারে না। ‘দেবে আর নেবে, মেলাবে, মিলিবে, যাবে না ফিরে’ –কবির এই বাণীটুকু শুধু বৃহত্তর প্রেক্ষিতেরই আবেদন নয়, তা শুরু করতে হবে নিজের পরিবার থেকেই। পরিবার থেকে পাড়া তথা গ্রাম ও সমাজ, সমাজ থেকে জেলা হয়ে বিভাগ এবং তার পরে দেশ। তারও পরে সমগ্র বিশ্ব। এইভাবেই তৈরি করতে হয় সম্প্রীতির প্রসারণশীল পরিধি। Charity begans at home – তাই শুরুটা হবে নিজ থেকেই। পরিবার তথা সমাজে সব মানুষই তো চায় সামাজিক শৃঙ্খলায় সমাজবদ্ধ হয়ে ঐক্য-প্রীতি- মৈত্রীর বন্ধনে নিজেদের মধ্যে পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য নিয়েও বিরাজমান হতে। কথাতেই তো আছে United we stand, divided we fall – অর্থাৎ, টিকে থাকতে গেলে একতাবদ্ধ হতেই হয়, বিভাজিত হলে, পড়ে যেতে হয়। কিন্তু এই যে ঐক্য— তারও অন্তর্নিহিত জিয়নকাঠি বা যাদুকাঠি সেই সম্প্রীতিই। এই সম্প্রীতির ফর্মূলা নিয়েই চালিত হয় সমাজ, চলে রাজ্য ও দেশ, চলে সারা বিশ্ব। একটু এদিক ওদিক হলেই স্বপ্নভঙ্গ কিংবা ছন্দপতন।

সম্প্রীতির গাঁথুনি মজবুত রাখতে গেলে সব মানুষই মনুষ্যত্বের বিচারে স্বচ্ছ ও মূল্যবোধসম্পন্ন হতেই হবে। জল আর তেল যেমন মেশে না, সৎ আর অসতের মধ্যে তেমনি ঐক্য বা সন্ধি হয় না। হলেও তো টেকসই হয় না। তাই সম্প্রীতি-স্থাপনের লক্ষ্যে আগুয়ান হতে গেলে হিংসা-দ্বেষ-কুটিলতা-পঙ্কিলতা এসব যেমন পরিহার করতে হবে, তেমনি সবাইকেই ভাবতে হবে এক গোত্রীয় অর্থাৎ, ‘জগৎ জুড়িয়া আছে এক জাতি, সে জাতির নাম মানুষ জাতি’। আমাদের বংশানুক্রমিক অর্জিত যে অসুয়াবোধ এবং প্রতিহনন—প্রবৃত্তি, তার নিরসন বা নিষ্কাশন না-করতে পারলে সম্প্রীতির মন্দির নির্মাণ করা যাবে না কোনভাবেই। ‘হিংসা যে দিন যাইবে দুনিয়া ছাড়ি’/সব তরবারি হইবে সে দিন কাষ্ঠের তরবারি’। অন্যভাবে বললে, সব তরবারিকে কাষ্ঠের তরবারিতে পরিণত করতে গেলে হিংসাকে দুনিয়া থেকে বিদায় দিতেই হবে। কিন্তু সে কাজ আদৌ সহজ নয়। আজকে সম্প্রীতিকে যে অবগুণ্ঠনে আবৃত করে সারা বিশ্বে স্রেফ একটা থিওরিটিক্যাল তকমা দেওয়ার প্রয়াস ও প্রহসন শুরু হয়েছে তা সোনার পাথরবাটিতে কাঁঠালের আমসত্ত্ব খাওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। নিছক কপোতকল্পনা নিয়ে আকাশকুসুম রচনার চেষ্টা না করে সামর্থ্যানুযায়ী স্বকীয় বলয়েই সম্প্রীতির পাঠ এখন সকলেরই নেওয়া খুবই জরুরি। এবং তা অতি অবশ্যই for the people, by the people, of the people, অর্থাৎ মানুষের জন্যই মানুষ। মানুষই সব। তাছাড়া অন্য আর কিছুই নয়। তাই, ‘শুনহ মানুষ ভাই, সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ সারা বিশ্বের সমস্ত ধর্মশাস্ত্রেই মানুষকে সবচেয়ে ওপরে রেখে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। বিশ্বের তাবড়- তাবড় মনীষীরাও মানুষের সংহতি-শান্তি-মৈত্রীর সপক্ষে সোচ্চার হয়েছেন, নয়ত বিশ্বজনদরবারে আবেদন করেছেন, সওয়ার করেছেন সর্বধর্ম-সমন্বয়ের পক্ষে। তবুও তো এখনও দেখতে পাই এক মানুষে আগুন জ্বালায়, পোহায় অপর জন। সমস্ত জাতি-ধর্ম-গোত্র-বর্ণ-মতবাদ নির্বিশেষে মানুষ জাতিকেই বৃহত্তর ও বিশ্বজনীন মৈত্রী সম্প্রীতির স্বার্থে সব সময় সসম্মানে পুরোভাগে রাখতে হবে। কেননা অন্তরে যদি উদ্ভাসিত না হয় সুভাষিত মন— তখন সকল সুভাষণই হয়ে যায় ‘অঙ্গবিহীন আলিঙ্গন’।

‘অদ্ভূদ আঁধারে’ নিমজ্জিত রাজনীতি : সম্প্রীতির অন্তরায়

মুখে সম্প্রীতি বা সংহতির কথা সবাই বললেও দলীয় আদর্শগত কারণেই দলের মতাদর্শনির্বিশেষে রাজনৈতিক দলগুলি এ ব্যাপারে সর্বান্তঃকরণে একই ছাতার তলায় দাঁড়াতে পারে না। বাধ্যবাধকতা একটা থাকেই। তবু জাতীয় কোন ইস্যুতে বা বিপর্যয়ে তাদের মনে রাখতে হবে— ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন? কাণ্ডারী, বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার’। কিন্তু বাস্তবে যা, তা অতি দুর্ভাগ্যজনক মনে হলেও, তাদের মনোজগতে অস্থিরতা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সন্ত্রাসবাদিতা, উগ্রপন্থা বা রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবম্বিধ সামাজিক অপরাধেও সমস্ত রাজনৈতিক দলের অবস্থান সব সময় আশাব্যঞ্জক বা ইতিবাচক হয় না। দেখা যায় না স্বদেশে নিমজ্জিত সন্তানকে হাত ধরে তোলার নিঃস্বার্থ হিতৈষী অসামাজিক বিবিধ কার্যকলাপ, দলীয় বেলেল্লাপনাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও অনেক সময় কোন না কোন দলের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদত থাকার অভিযোগ উত্থাপিত হয়। এতে দেশের আভ্যন্তরীণ স্থিতি যেমন বিপন্ন, তেমনি রাজনৈতিক অস্থিরতা হেতু দেশের অন্তরস্থ শক্তি কিছুটা হলেও দুর্বল হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। এই সুযোগে দেশের ভেতরে যে লাগামহীন পরিবেশ তৈরি হয় তাতে সুযোগসন্ধানীরা অধিক মাত্রায় মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। নীট ফল, জাতীয় সংহতি ও সম্প্রীতির অবনমন। রাজনৈতিক দলগুলির এ ক্ষেত্র যে দায়বদ্ধতা ও দায়িত্বশীলতা দেশ তথা দেশের নাগরিকদের প্রতি পালনীয়, তা সদর্থক পর্যায়ে লক্ষিত হয় না। দলগুলির কাছে তখন একটা আদর্শ থাকে : ‘ভাগের মাকে কুমিরে খাক/মায়ের চেয়ে স্বার্থ বড়’। তাদের কাছে বিষয়টা : ‘টুকরো রুটি টুকরো করিস যত/বিড়াল ভাবে, বেশ তো/এটাই হোক’। এই অবস্থায় হানাহানি, ডামাডোলের ফলে রাজনৈতিক দলগুলির সমর্থকদের মধ্যেও সুসম্পর্ক ও সম্প্রীতির ব্যাপক অভাব লক্ষ্যণীয় হয়ে ওঠে। এ সম্প্রীতি-বিরলতা ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্রই, গ্রামাঞ্চলেও। গ্রামাঞ্চলে হিন্দু- মুসলমান পাশাপাশি বাস করলেও সদ্ভাব-সম্প্রীতি তো দূরঅস্ত, দুপক্ষীয় সমর্থকদের মধ্যে রা-কথা পর্যন্ত নেই। অধিকন্তু, নিত্যই চলে শরীকি সংঘর্ষ ও রাজনৈতিক সংকীর্ণতাই রামকে রহিম থেকে, হেমাকে হালিমা থেকে, এমনকী ভাই-ভাই আর পিতা-পুত্রকেও পৃথক করে দিচ্ছে। এটা বলতে খুব কষ্ট হলেও রূঢ় বাস্তব। ‘ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলি ‘আজ কেমন যেন নেতিয়ে পড়েছে, হারিয়ে ফেলেছে তাদের মানবিক সৌন্দর্য। অথচ সম্প্রীতি নিয়ে নেতাদের মুখে ফুলঝুরির অন্ত নেই। অথচ একই আকাশের নীচে/সারা পৃথিবীটা। তবু কেন এত খণ্ড-খণ্ড মাটি/এবং খণ্ড খণ্ড আলো ও বাতাস, টুকরো-টুকরো ভূমি…’।

সমস্ত জাতীয়তাবোধকে দলমতনির্বিশেষে নিয়ে আসতে হবে এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে। সেই আহ্বান তো ছিল স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের

এসে হে আর্য, এসো অনার্য, হিন্দু-মুসলমান
এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ, এসো এসো খ্রিষ্টান।
মা’র অভিষেকে এসো এসো ত্বরা।
মঙ্গলঘট হয়নি যে ভরা
সবার পরশে পবিত্র-করা তীর্থনীরে
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।

মা-র অভিষেকে যে মঙ্গলঘট সবার পরশে পবিত্র-করা তীর্থনীরে ভর্তি করতে বলেন কবি, তা নামান্তরে সম্প্রীতিই। উভয় দেশের সংবিধানও তো সেই কথাই বলেছে। সেখানে না থাকবে ধর্মান্ধতা, না থাকবে বিভেদকামিতা বা সাম্প্রদায়িকতা। ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে দ্বেষ-হিংসা-ক্রোধ পরিহার করে সবাইকেই হতে হবে এক পরিবারের সদস্যের মতন। আমরা যদি সেই মানবিক রাজনীতি পেতে চাই তবে রাজনীতিতে বিরাজমান ‘অদ্ভুদ আঁধার’ অপসারণ করতে হবে। আর এটা সম্ভব হবে মানবিক মানুষকে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে।

সম্প্রীতির উজ্জ্বল অতীত অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ!

গণতান্ত্রিক কোন শাসন ব্যবস্থায় কোন অনৈক্য থাকা চলে না। থাকা চলে না কোন রাজনৈতিক প্রতারণাও। নৈতিকতার সমতায় শোষিত নিপীড়িত যে গোষ্ঠী তাও থাকার কথা নয়। কিন্তু আছে সবই। আছে শোষক-শোষিতের দ্বন্দ্বও। এসব থাকলে তো সম্প্রীতির বিনাশ ঘটাই স্বাভাবিক। ধনী-দরিদ্রের যে আর্থসামাজিক দূরত্ব তাও অনেক ক্ষেত্রে প্রভু ভৃত্যের সম্পর্কের পর্যায়ে চলে যাওয়ায় মানবিক সংযোগটুকুও বিলীন হয়ে যাচ্ছে অবিশ্বাস আর ভীতির ঘেরাটোপে। দারিদ্র ও অজ্ঞতার সুযোগে অর্থনৈতিক দিক থেকে দুর্বল নিরক্ষর মানুষজনের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণই শুধু নয়, অত্যাচারও করা হয়ে থাকে। এতেই বাড়ে দূরত্ব। সেই দূরত্ব সম্প্রীতির ভিত বা সেতুকে নড়বড়ে করে দেয়।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়, তা হল এক শ্রেণির নাগরিকের মূল্যবোধহীনতা, বিবেকহীনতা, ভালো মন্দ বোঝার জ্ঞানের অভাব। তা না থাকলে তো ব্যক্তি স্বাধীনতা সাম্য-মৈত্রী-ভ্রাতৃত্ববোধকে লালন-পালন করা তো দূরস্থান মর্যাদাই দেওয়া যাবে না। বন্ধু করা যাবে না জাতি-শ্রেণি-গোষ্ঠী মানুষ-এদের ভেতরে দুর্বলদের ওপরে শোষণ পীড়ন আর অত্যাচার। হিংসা ও প্রতিশোধস্পৃহা যেমন পরিহার করতে হবে তেমনি পরিহার করতে হবে উগ্রপন্থাকেও। ‘উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না’। ‘অত্যাচারীর খড়গকৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না’–এ রকম পরিবেশকে নিশ্চিত করতে আমরা কি পারব? পারলেই, সম্প্রীতির মূল্য বাড়বে, সফল হবে মানবতার সেতুবন্ধন, দৃঢ় হবে মৈত্রী-শক্তি ও সংহতি। ‘আসিতেছে শুভ দিন’ এই উচ্চারণে তবুও আশাবাদী হয়েই পথ চলতে হবে সামনের দিকে, ‘সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’— এই অঙ্গীকারে আত্মবিশ্বাসে গেয়ে যেতে হবে সম্প্রীতির চিরন্তনতার অক্ষয় সংগীত। ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’— শাহ আবদুল করিমের গাওয়া এ গান বাঙালির সম্প্রীতি বন্ধনের স্মৃতিকে স্মরণ করিয়ে দেয়। সম্প্রীতির অতীত গৌরব গর্বে ভেসে ওঠে আমাদের বিলুপ্ত হৃদয়। আমরা যদি এই বিলুপ্ত হৃদয় পুনরুদ্ধার করতে চাই তাহলে প্রথমেই প্রয়োজন সুস্থ গণতান্ত্রিক সমাজকাঠামো এবং সেই সাথে ধর্মবোধে মানবচেতনার মৌলিক বিকাশ 1

সম্প্রীতির ফাগুন হাওয়ায়

সম্প্রীতি শব্দটিকে বিশ্লেষণ করলে আমরা পাই (সং-সম+প্রীতি) যার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল প্রণয়ন বা সম্ভাব। অর্থাৎ সম্ভাবযুক্ত সহবস্থা। প্রেম, প্রীতি ভালবাসার পথ ধরে নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখা ও পরের জীবনের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করা। এবং তাকে বর্ধনের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য সহায়ক শক্তি হিসাবে তার পাশে দাঁড়ানো।

সম্প্রীতি কথাটি শুধু কয়েকটি বর্গের সমষ্টিতে গড়া একট শব্দমাত্র নয়, জীবনের বর্ণমালায় এটি একটি বিরাট তাৎপর্য বহন করে। রঙে, রসে, ছন্দে জীবনকে সাজাতে এর অবদান অপরিসীম। তাই যুগ যুগ ধরে এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, নানাভাবে, নানা আঙ্গিকে। তাই এর রক্ষা ও প্রয়োগ সম্বন্ধে যেমন একদিকে সচেষ্ট হয়েছেন আল্লার ফেরেস্তা ও যুগাবতার যাঁরা তাঁরা, অন্যদিকে বিভিন্ন মনীষী, সাহিত্যিক, কবি দার্শনিকদের কণ্ঠেও প্রতিধ্বনিত হয়েছে এই একই সুরের রেশ।

তবুও সম্প্রীতির অভাব পরিলক্ষিত হয় বার বার। সভ্যতার জয় যাত্রার অগ্রগতির সাথে সাথে নিয়ত পরিবর্তন ঘটছে কই? বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ভাষায় খাঁচার উন্নতি হলেও পাখির উন্নতি হচ্ছে কোথায়?

বর্তমানে এ অবস্থায় আরো অবনতি ঘটেছে। পৃথিবী জুড়ে লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েও মানুষের সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। মনে ভেসে ওঠে মিতালী মুখার্জীর গাওয়া সেই গান— ‘এই দুনিয়া আর সেই দুনিয়া নাই, মানুষ নামে মানুষ আছে দুনিয়া বোঝাই।’… কেন এই অমানুষের বোঝা? কারণ ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের মস্তিষ্ককে সমৃদ্ধ করলেও অন্তরকে প্রসারিত করছে না। বিশ্বকেন্দ্ৰিক না হয়ে আমরা হচ্ছি আত্মকেন্দ্রিক। ব্যক্তিগত লোভ-লালসা, দম্ভ, ক্ষমতার মোহ বিনাশ করছে আমাদের পারস্পরিক সম্প্রীতি। সৃষ্টি করছে পরস্পরের মধ্যে ভেদ বুদ্ধি, তৈরি করছে পারস্পরিক কলহের বাতাবরণ। তাই বিশ্ব জুড়ে আজ পেশীবলের দাপাদাপি, অস্ত্রের ঝঝানানি, সত্য ন্যায়ের কণ্ঠ রোধ করার ঘৃণ্য চক্রান্ত।

সাম্প্রদায়িক ভেদ, বুদ্ধি দেশ মাতৃকার অঙ্গচ্ছেদ ঘটিয়ে তাকে করছে খণ্ডিত ও দ্বিধাবিভক্ত। মনুষ্যত্বের অবনমন ঘটাচ্ছে প্রতিনিয়ত। সুপ্ত মানব সত্ত্বা ডুকরে ডুকরে কাঁদছে আর চোখের জল ফেলছে গোপন ব্যথায়। অথচ আমরা প্রত্যেকেই উচ্চঃস্বরে বলছি সম্প্রীতি রক্ষার কথা। এই প্রসঙ্গে এ যুগের জীবনদিশারী, যুগ- কল্যাণকারী শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের (১৮৮৮-১৯৯৬) একটি বাণী উল্লেখ করা যায়—

‘কর্ম নাই চিন্তা সৎ, পাথর পিছল নরক পথ। অর্থাৎ সম্প্রীতির কথা আমরা মুখে বললেও কেমনে সেটি রক্ষিত হবে সে চিন্তা আমরা করছি না। গতানুগতিক জীবন ধারায় চলতেই আমরা বেশি অভ্যস্ত।’ (আলোচনা প্রসঙ্গে)।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ যে কথা বলছেন জীবনে জীবন যোগ করা, নইলে ব্যর্থ এ প্রাণের পসরা সে কথাও আমরা ভুলে গেছি। উপনিষদের সেই বাণী ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ তাও আজ তলিয়ে গেছে বিস্মৃতির অতল আঁধারে। এ আঁধারকে আলোকিত করতে ধর্মবোধে সর্বমানবিক বোধ বিকাশ অপরিহার্য। সামাজিক সাংস্কৃতিক উদ্দেশ্যমুখী বহু উদ্যোগ থাকলেও মানুষের মনের ময়লা দূর হয় না কেন?

অথচ এই সম্প্রীতি শব্দটির মধ্যেই নিহিত রয়েছে বিশ্বকে ধরে রাখার মূল চাবি কাঠি। এখন প্রশ্ন এই সম্প্রীতি আসবে কেমন করে। এ প্রশ্নের সমাধানী ইঙ্গিতও দিয়ে গেছেন যুগত্রাতা, যুগকল্যাণকারী মানবগণ। একমাত্র সেবা, ভালোবাস, পারস্পরিক সাহনুভূতি ও মমত্ববোধের অনুশীলনের মধ্যে দিয়েই দেশ ও সমাজে তৈরি হতে পারে সম্প্রীতির বাতাবরণ। ব্যক্তিগত জীবনে এ সমস্ত সদগুণগুলির একমাত্র অনুশীলন ও তার বহিঃপ্রকাশের মধ্য দিয়ে আসতে পারে ব্যক্তি তথা সমাজ জীবনে সম্প্রীতি ও সহানুভূতি। যা একজনকে টেনে আনবে আর একজনের হৃদয়ের কাছে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে পবিত্র বাইবেলের বাণী :

Love your neigbour, as you Love yourself : James 2:8 ।

আবার পবিত্র কোরানেও উল্লিখিত হয়েছে আল্লাহতায়ালার সেই একই নির্দেশ :

Those who nurse the people, Allah makes them more Honourable

-Holy Quran ।

এ বিষয়ে স্বামী বিবেকানন্দ ও তাঁর জীবনের আত্মোপলব্ধি ও সত্যের কথা উপহার দিয়ে গেছে সমগ্র মানব সমাজকে। যেটি সম্প্রীতি রক্ষার ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে।

Help and not Fight (বিভেদ নয় সহায়তা),

Assimilation and not Destruction (বিনাশ নয় পরস্পরের ভাব গ্রহণ), Harmony and Peace, and not Dissension (মত বিরোধ নয়, সমন্বয় ও শান্তি)।

ভিন্ন ধর্মাবলম্বী, বিভিন্ন ভাষাভাষি ও বিভিন্ন জাতির বাস এই বাংলাদেশে তথা বাঙালি সমাজে। ভিন্ন সংস্কৃতি বাতাবরণ ও জল হাওয়ায় তারা লালিত ও পুষ্ট। বৈচিত্রময় জীবন ধারার সাথে ও ঐক্য আনার প্রচেষ্টায় সরব হয়েছেন বিভিন্ন মনীষীগণ। রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠেও ধ্বনিত হয়েছে সেই সুর—

পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার, হোথা হতে সবে আনে উপহার
দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে যাবে না ফিরে।

রামধনুর সাতরঙের মধ্যে একই রঙের প্রতিফলন দেখতে চেয়েছেন মনীষীগণ। মহাকালের রথের গতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে মানব সভ্যতার অগ্রগতির রথ ছুটে চলেছে ত্বরিৎগতিতে। তবু কোথায় যেন ঘটছে কীসের একটা ছন্দপতন। এ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আজও ঘটছে, সাম্প্রদায়িক লড়াই মানবিক বিপর্যয়। ফলশ্রুতিতে অকালে ঝরে পড়েছে কত অসহায় প্রাণ। স্বামীহারা হচ্ছেন কত দয়িত, সন্তানহারা কত মায়ের চোখের জল শুকাচ্ছে ব্যথার অনলে, সন্তানহারা কত পিতা চোখের জল ফেলছেন নিভৃতে, নির্জনে। এটা বড় লজ্জা ও দুঃখের বিষয়।

সম্প্রদায়গত সমস্যা পৃথিবীর প্রায় সবদেশেই কমবেশি ছড়িয়ে আছে। সম্প্রদায় সঙ্কোচনকেই আমন্ত্রণ করে, প্রসারণকে বিসর্জন দেয়। সম্প্রদায় দলগত প্রাধান্যকেই বড় করে তোলে, মানুষের মনুষ্যত্ব সেখানে অবহেলিত। আর এক সম্প্রদায় যখন আর এক সম্প্রদায়ের উপর প্রাধান্য চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করে তখনই শুরু হয় সাম্প্রদায়িক বিরোধ বা সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ। সমাজের কিছু অশুভ মানুষ তাদের স্বার্থ চরিতার্থ করবার জন্য এই ধরনের ঘটনাগুলোকে বিকৃতভাবে প্রচার করে। আখ্যাও দেয় ভিন্নতর নামে। আমাদের জন্য বাংলাদেশ ও পশ্চিমবাংলায় এই ধরনের ঘটনা ঘটলে তাকে আখ্যা দেওয়া হয় হিন্দু মুসলমানের দাঙ্গা। কিন্তু ইতিহাস বলে একমাত্র মুসলিম অধ্যুসিত অঞ্চলেও শিয়া-সুন্নির মধ্যে দাঙ্গা সংগঠিত হতে দেখা যায়। তবে এই সমস্ত ঘটনাগুলোর কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এদের পিছনে রয়েছে ধর্মীয় মতবিরোধ। নিজের ধর্মকে সঠিকভাবে না জানা, তার অনুশাসনবাদ সঠিকভাবে না মানা, পর ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ, ঘৃণা, অসহিষ্ণুতা এগুলিই হচ্ছে ধর্মীয় মতবিরোধের কারণ। অথচ দেখা যায়, মূল ধর্মের প্রবর্তক যারা, তারা কিন্তু সব ধর্ম মতকেই শ্রদ্ধা জানানোর কথা বলেছেন।

পবিত্র কোরআন অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ প্রদান করে : (‘তারা’) আল্লাহকে ছেড়ে যাদের ডাকে তাদের তোমরা গালি দেবে না, কেননা, তারা (সীমালংঘন করে) অজ্ঞানতাবশত আল্লাহকেও গালি দেবে।’ (৬:১০৮)

পবিত্র কোরআনের ঘোষণা স্পষ্ট ও বলিষ্ঠ : ‘লা ইকরাহা ফিদ দ্বীন’ ধর্মের ব্যাপারে কোন জোর জবরদস্তি নেই। (২:২৫৬)

হজরত মুহম্মদ (সা.)-এর ঘোষিত ঐতিহাসিক মদীনা সনদপত্র তার গৌরবময় ঔজ্জ্বল্য নিয়ে আজও দীপ্যমান। সহাবস্থায়, সহিষ্ণুতা, পরধর্মের প্রতি সহনশীলতা এবং বিভিন্ন ধর্মমতের মধ্যে মৈত্রীর উজ্জ্বল স্বাক্ষর বহন করে। এই সনদপত্র ইতিহাসে নজিরবিহীন। মহানবী (সা.) নাজরান থেকে আগত ৬০ জন সদস্য সম্বলিত একটি খ্রিষ্টান প্রতিনিধি দলকে তাঁর নিজ মসজিদের অভ্যন্তরে অর্থাৎ মদিনাস্থ মজিসদে নববীতে তাঁদের সান্ধ্য আরাধনা সম্পন্ন করতে অনুমতি প্রদান করেছিলেন। রাসূলে (সা.) নজিরববিহীন ঔদার্যে একই মসজিদের অভ্যন্তরে একই সময়ে দুই পৃথক মতের অনুসারীরা তাদের আরাধনা সম্পন্ন করে। এই হল সত্যিকারের ইসলাম দীক্ষা। এর ব্যত্যয় হলে ইসলামের আদর্শ ক্ষুণ্ন হয়। ইসলামের অর্থ যে শান্তি তাও বিঘ্নিত হয়।

এই একই সুরের অনুসরণ শোনা যায় গুরু নানকজীর কণ্ঠে :

There is neither a Hindu,
Nor a Musalman
All are human beings
Born of the one Supreme Being (Wahe Guruji )।

আবার পবিত্র কোরআনে মহান হাদিস শরীফে সৃষ্টিকর্তা মানুষকে একক জাতি বলে অভিহিত করেছেন পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ সমগ্র মানব সত্ত্বার অবিচ্ছেদ্য

অংশ।

অনুরূপ কথা বাইবেলেও রয়েছে :

Thou shall love the neighbour as thyself (St. Mathew 22 / 39 ) (তোমার প্রতিবেশীকে তুমি নিজ সত্ত্বার মতন করেই ভালবাসবে)।

বিভিন্ন ধর্ম-প্রবক্তা প্রেরিত পুরুষদের উদ্ধৃত বাণী থেকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যেতে পারে যে, সকল ধর্মই এক ও অভিন্ন সূত্র থেকে উৎসারিত, একই সুর অনুরণিত হয় প্রতিটি ধর্মের তন্ত্রীতে, মানব কল্যাণের একই ব্যঞ্জনা একই মুর্ছনা শ্ৰুত বা প্রতিবিম্বিত হয় প্রতিটি ধর্মশাস্ত্র। স্বভাবতই একমাত্র ধর্মই পারে জাতির সংহতি সুদৃঢ় ও মজবুত করে তুলতে, সমাজ ও সংসার থেকে অপরাধ নির্মূল করতে। মানুষের কোন প্রয়াসই তা যতই আন্তরিক বা সুনিবিড় হোক না কেন সফল হবে না যদি তা সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ পরিপুষ্ট না হয়।

Cowper এর ভাষায়, ‘Oars alone can never prevail to reach the distant coast/the breath of haven must swell the said/or all the toil is lost।’ অর্থাৎ ঈশ্বরের অনুগ্রহ ছাড়া মানুষের অস্তিত্ব রক্ষা ও জীবন বর্ধন কোন কিছুই সম্ভব নয়। ঈশ্বরই হচ্ছেন সব কিছুর ধারক ও বাহক।

ঈশ্বরের প্রেরিত পুরুষ যাঁরা তাঁরা হলেন আদর্শ। ধর্মে মূর্ত হয় আদর্শ। এই আদর্শকে স্মরণ, মনন ও জীবন চালায় তাঁর নীতি বিধান নিত্য অভ্যাসের মধ্য দিয়ে ধর্ম সার্থক হয় প্রত্যেকের জীবনে। হিন্দু যারা ঈশ্বরকে কখনও কৃষ্ণ, কখনও শিব, কখনও বিষ্ণু প্রভৃতির নামে পুজা করে। খ্রিষ্টানেরা করে যিশুর, মুসলমানেরা করেন আল্লাহতায়ালার। প্রকৃতপক্ষে এদের মধ্যে কোন ভেদ নেই। পবিত্র কোরান শরীফে বলা হয়েছে :

তোমার আল্লার ও রসুলের অনুসরণ কর।

পবিত্র বাইবেলে যিশুখ্রিষ্ট বলেছেন :

I am the way, the truth, and the life, ( St. John, 1316)। তাঁরা কারও বা কোন সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য ধ্বংস করতে আসেন না, তাঁরা সকলের বৈশিষ্ট্য পুরণ করতে আসেন। মহামতী যিশুর কথায় :

I have come not to destroy but of fulfill (St. John 1416)।

ধর্ম শব্দটি এসেছে ধৃত ধাতু থেকে। ধৃ ধাতুর অর্থ ধারণ করা। অর্থাৎ ধর্ম সব কিছুই ধারণ করে।

অর্থাৎ সপারিপার্শ্বিক অন্যকে বাঁড়িয়ে নিজে বাঁচাকেই তিনি ধর্ম বলেছেন। এই বিশ্ব সংসারে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র প্রত্যেকেই একের সাথে একে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। এর ব্যত্যয় ঘটলে ব্যক্তি জীবন বিপর্যস্ত হয় সমাজ ও বিপর্যস্ত হয়। পরস্পরের মধ্যে প্রেমপ্রীতি ভালবাসা ও মমত্ববোধ বিনষ্ট হয়।

জীবৎকালে আচরণে ও চরিত্রে ঔজ্জ্বল্য হয়ে ওঠাই ধর্ম। প্রকৃত ধর্ম আচরণের মধ্যে দিয়ে মানুষ মানবিক আচরণে সমৃদ্ধ হয়। যা মানুষের সাথে মানুষের বন্ধন রচনায় প্রেরণা জোগায়। এখানে মানবপ্রেমিক রবীন্দ্রনাথের একটি কথা স্মরণে আনা যায়—

মানুষ বলেই মানুষের যে মূল্য সেই টিকেই সহজ প্রীতির সঙ্গে স্বীকার করাই প্রকৃত ধর্ম বুদ্ধি। আবার, The object of Dharma is to attend truth in all its purification and to enlighten existence। অর্থাৎ ধর্মের লক্ষণ হল সত্যের শুদ্ধতায় উপনীত হওয়া, যার মাধ্যমে মানুষের অস্তিত্ব হয়ে উঠবে আলোকজ্জ্বল।

এই প্রসঙ্গে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘সত্যবাদিতা সর্বদাই মুক্তির পথ প্রশস্ত করে, এবং মিথ্যাচরিতা ধ্বংসের পথ ত্বরান্বিত করে তোলে’। যখন সমস্ত মানুষ সত্যের আলোকে ধর্মকে উপলব্ধি করতে পারবে, তখন আর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সমাজ দেহকে কলুষিত করবে না ও পারস্পরিক সম্প্রীতিও নষ্ট হবে না। কোন বিদ্বেষ বিষ মানুষের জীবনকে আর বিষাক্ত করে তুলবে না। সকলের অন্তর জুড়ে বইবে সম্প্রীতির মলয় বাতাস। এটিই আমাদের সকলের অভিপ্রেত। এছাড়া আমরা যতই চেষ্টা করি না কেন সম্প্রীতি কিন্তু দূর অন্তই থেকে যাবে।

ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা বনাম সম্প্রীতি

আবহমান কাল ধরে বিভিন্ন ধর্মকে বিকৃত করেছে কিছু স্বার্থন্বেষী ক্ষমতাবান মানুষ নিজেদের স্বার্থে। হিন্দুধর্মও তার ব্যতিক্রম নয়। প্রত্যেক দেশেই সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মমতাবলম্বী মানুষের নৈতিক দায়িত্ব থাকা উচিত সংখ্যালঘিষ্ঠ অন্যান্য ধর্মের মানুষদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা এবং তারা যাতে স্বাধীনভাবে ও নির্ভয়ে নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারে তার জন্য এগিয়ে আসা। এটাই এক ধর্মনিরপেক্ষ দেশের মূলশক্তি। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে সারা পৃথিবীতে অনেক দেশে বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষেও এটা বার বার লঙ্ঘিত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। যে সব দেশ আপামর জনসাধারণের শিক্ষা, প্রগতি, বিজ্ঞান এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে এগিয়ে, সেখানে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও হানাহানি অনেক কম। যেমন ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, চীন, আমেরিকায় তুলনামূলকভাবে এটা বেশি তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত ও আধা উন্নত দেশগুলোতে, যেখানে প্রকৃত শিক্ষার উন্মেষ অনেক কম এবং দারিদ্র বেশি। মনে রাখতে হবে দরিদ্র ও অশিক্ষিত মানুষদের ধর্মের সুড়সুড়ি দিয়ে রাজনৈতিক, সামাজিক আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থ চরিতার্থ করা অপেক্ষাকৃত সহজ। এর জন্য প্রকৃত অর্থে দরকার শিক্ষার প্রসার, নারী জাগরণ এবং আধুনিক চিন্তাধারা ও দারিদ্র দূরীকরণ। মনে রাখতে হবে মানুষের একটাই ধর্ম, মানবধর্ম। একটাই জাত, মানবজাত। এর প্রচারে এগিয়ে এসেছেন অনেক দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক। বাঙালি সমাজেও রামকৃষ্ণদেব, স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, অভিভক্ত বাংলার লালন ফকির এবং অনেক সাহিত্যিক, কবি তাঁদের লেখনীতে মনুষ্যত্ব ও বিবেককে ধর্মীয় গোঁড়ামির অনেক ওপরে স্থান দিয়েছেন। কথামৃত গ্রন্থে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলেছেন, ‘যত মত তত পথ’। স্বামীজী তার জীব ও বাণীতে ছিলেন এক আধুনিক ভারতের পথিকৃৎ। ধর্ম সম্পর্কে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক। সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার গণ্ডী ভেঙে, বিভিন্ন সম্প্রদায়কে একত্র করে চেয়েছিলেন এক মহাজাতি। ধর্মের মূলতত্ত্ব অধ্যাত্মবাদ অনুশীলন করতে পারে সব ধর্মের মানুষ। ‘বৈদান্তিক মস্তিষ্ক ও ঐশ্লামিক দেহ’ তাঁর নিজস্ব চিন্তার ফসল। ধর্মীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি বারবার ভাষণ দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘হও ধরমেতে ধীর-হও করমেতে বীর-হও উন্নত শির নাহি ভয়।’ ধর্মের বিভাজনের নামে অনাচারে আরও তীব্র ছিলেন নজরুল ইসলাম। তাই তিনি কবিতা ও গানে লিখেছেন ‘মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান’ বা ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন?’

দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতার আগে থেকেই হিন্দু ও মুসলিম ভাইদের মধ্যে ধর্মীয় সম্প্রীতির জন্য একটা অনবরত চেষ্টা ছিল। কিন্তু এর বিপরীত ঘূর্ণাবর্তও ছিল তার ফলস্বরূপ মহম্মদ আলি জিন্নার কংগ্রেস ত্যাগ মুসলিম লীগ গঠন, দ্বিজাতি তত্ত্ব, দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও হানাহানি, ব্রিটিশ শাসকের ঘোলা জলে মাছ ধরা এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসও গান্ধীজির মধ্যে বিরোধ ও ব্রিটিশ কুটনীতির কাছে আত্মসমর্পণ। এ সবের নিট ফল অবিভক্ত ভারত ভেঙে ভারতবর্ষ ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম। বিনা দোষে কত হিন্দু, মুসলিম ভাই-বোন, পিতা-মাতা, আত্মীয়-পরিজন নিজদেশে পরবাসী হয়ে গেল। নিঃস্ব, অসহায় কত মানুষের চোখের জলে বিষাক্ত হয়ে গেল বহু সংগ্রামের স্বাধীনতা। ধর্মীয় উন্মাদনা ও রাজনৈতিক কারবারিদের হাতে বিকিয়ে গেল মনুষ্যত্ব ও ধর্মের সহনশীলতা। এখন কোন্ পথে আমরা এই সহনশীলতাকে পুন বিকশিত করবো? আপাতত সিদ্ধান্ত এটাই দেশভাগ মেনেই সবাই এবার এক শক্তিশালী, ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি সমাজ আত্মবন্ধনে আবদ্ধ হব— এটাই হবে এখন আমাদের আত্মপ্রত্যয়ের দৃঢ় অঙ্গীকার।

বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের পাশাপাশি হিন্দু, খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধ তো আছেই আরো আছে বাহাই ও শিখ ধর্মের অনুসারী। সেই সাথে আদিবাসীদের মধ্যে রয়েছে তাদের আরো কতিপয় স্বতন্ত্র ধর্ম। তাই দেশের অখণ্ডতা ও অগ্রগতির জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন ধর্মনিরপেক্ষতা। আমরা সাতশ বছর মোঘল সাম্রাজ্য ও দেড়শো বছর ইংরেজের অধীন ছিলাম। আবার অনেক হিন্দু রাজাও এখানে রাজত্ব করেছেন। সুতরাং বিভিন্ন ধর্মের প্রভাব তো বাঙালির মনে আছেই। তাই তুনলামূলকভাবে অনেক দেশ থেকে আমরা অনেক ধর্মসহনশীল। আমাদের একটাই পরিচয় হওয়া উচিত—বাঙালি ও বাংলাদেশ। এখানে মুসলিম সম্প্রদায় মসজিদে যাবে, নামাজ পড়বে, জুম্মাবারে আল্লাহকে প্রার্থনা জানাবে। খুশির ঈদে হিন্দু সম্প্রদায়কেও আনন্দের ভাগ উপহার দেবে। তেমনি হিন্দু সম্প্রদায় বিভিন্ন উৎসবে মুসলিম ও খ্রিষ্টান ভাইদের আপন করে নেবে। মনে রাখতে হবে যে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাই দায়টাও তাদের বেশি। এটা ভুললে চলবে না। সারা পৃথিবীকে দেখিয়ে দিতে হবে যে বাংলাদেশ শুধু মুখে নয়, কাজেও প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ। এখন দেশের প্রধান সমস্যাগুলি হল দারিদ্র্য, অশিক্ষা, জাতপাত, অর্থনৈতিক বৈষম্য, বেকারি, বাসস্থান, সুস্বাস্থ্য। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এই সব সমস্যা সমাধানের বৈষম্য দূর করা এবং বিজ্ঞান ও কারিগরি পঠন-পাঠনে এগিয়ে যেতে হবে অনেক দূর। দূর করতে হবে অনুন্নয়ন। ধর্ম ছিল, আছে থাকবে। তাই নিয়ে অযথা উদ্বিগ্ন না হয়ে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এবং আধুনিক বাংলাদেশ গঠনে, যেখানে চিত্ত হবে ভয়শূন্য, উচ্চ রবে শির। এটা তখনই সম্ভব, যখন ধর্মীয় সম্প্রীতি পুরোপুরি বজায় থাকবে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে।

শাস্ত্রীয় অনুশাসনই কী সম্প্রীতির অন্তরায়?

অনেকে প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারেন, যেখানে বিভিন্ন ধর্মে এবং তাঁদের স্ব স্ব ধর্মগ্রন্থে নিজেদের গন্তব্যপথ স্বতন্ত্রভাবে নির্দেশিত হয়েছে সেখানে জাগতিক তথা সামাজিক সম্প্রীতি কী করে সম্ভব? তা ছাড়া ইসলাম সমর্থিত গবেষকরা দেখাচ্ছেন একমাত্র কোরআন ছাড়া পূর্বের সকল ধর্মগ্রন্থই বিকৃতির কবল থেকে রেহাই পায়নি। (দেখুন: ড. মরিস বুকাইলি, বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান, ১৯৭৫)। অতএব পৃথিবীতে একমাত্র বিশুদ্ধ ধর্মগ্রন্থ আল কোরআন। তা হলে ওই বিকৃত শাস্ত্রের ধর্মানুসারিদের করণীয় কী? কেন স্রষ্টা তাঁর ঐশী প্রত্যাদেশসমূহ একমাত্র কোরআন ছাড়া অন্য ধর্মগ্রন্থগুলি বিকৃতির কবল থেকে রক্ষা করতে পারলেন না? (বিস্তারিত দেখুন, আরজ আলী মাতুব্বর, সত্যের সন্ধান, ১৯৯৩)। স্রষ্টার এই ‘অপারগতার’ দায় কেন এখন ওই শাস্ত্রানুসারিদের নিতে হচ্ছে?

শাস্ত্রবিশুদ্ধির এই তকমা আল্লাহ কেবল একটি ধর্মানুসারির জন্য কেন নির্দিষ্ট করে রাখলেন? এসব জিজ্ঞাসার উত্তর অনুসন্ধানে কোরআন অনুসৃত সমাধানে বলা হয়েছে: “নিশ্চয় আমি মুসার কাছে তওরাত নাজিল করেছিলাম, তাতে ইহুদি জাতির পথ নির্দেশ ও আলোকবর্তিকা ছিল এবং বিজ্ঞ ও জ্ঞানীরা তদনুসারে বিধান দিত (সুরা মায়েদা : আয়াত : ৪৪)। আর ওই বিধানেই থাকত তাদের পরিত্রাণের নির্দেশনা। এই জিজ্ঞাসার উত্তরের পরিপূরক আল কোরআন-এর আরেক জায়গায় বলা হয়েছে— “নিশ্চয় যারা বিশ্বাস করে, যারা ইহুদী এবং খৃস্টান হয়েছে অথবা সাবেয়ী হেেয়ছে— এদের যে কেউ আল্লাহ্ এবং শেষ দিবসে বিশ্বাস করে ও সৎকাজ করে তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের নিকট পুরস্কার আছে। তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিত হবে না।’ (সুরা বাকারাহ: আয়াত : ৬২)। তবে স্মরণ রাখা প্রয়োজন, এই অভয় বাণী শুধু একত্ববাদীদের জন্য প্রযোজ্য, অন্য কারো জন্য নয়। তাদের জন্য বেদ বাক্যই একমাত্র ভরসা। গীতায় বলে দেয়া হয়েছে : ‘আমি যদি মিত্ররূপে সব কিছুর দিকে দৃষ্টিপাত করি তাহলে সর্বভূতও মিত্ররূপে আমাকে গ্রহণ করবে।’

ইসলামে সম্প্রীতি প্রয়াস : ইতিহাসের আলোকে

৬২১ খ্রিষ্টাব্দে আবিসিনিয়া (বর্তমান ইথিওপিয়া) প্রবাসী মুসলমানদের আচার ব্যবহার রীতিনীতি দেখে সেখানকার খ্রিষ্টান অধিবাসীরা সবিশেষ মুগ্ধ হন। সেখানকার খ্রিষ্টানদের মধ্যে বিশজন বিশিষ্ট ব্যক্তি হজরত (সা.)-এর মুখে নবধর্মের ব্যাখ্যা শুনতে আগ্রহী হয়ে মক্কায় এসে হজরত (সা.)-এর সাক্ষাৎপ্রার্থী হন। তারা হজরতের কাছে ইসলামের শিক্ষাসমূহ অবগত হয়ে ওই ধর্ম গ্রহণপূর্বক স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন।

চিরাচরিত প্রথানুযায়ী জিলহজ্ব মাসে আরবের বিভিন্ন স্থান হতে অসংখ্যতীর্থযাত্রী মক্কায় সববেত হয়। ওই যাত্রীদের কাছে হজরত (সা.) পবিত্র কোরআনের ও ইসলামের ব্যাখ্যা করেন। ফলে, বিভিন্ন গোত্রের সত্যান্বেষী ব্যক্তিবর্গ গোপনে হজরতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। ইয়াসরিববাসী (বর্তমান মদিনা) বিভিন্ন গোত্রের বারজন তীর্থযাত্রী আকাবা উপত্যকায় হজরতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ইসলামে দীক্ষাগ্রহণ পূর্বক নিম্নোক্ত শর্তসমূহে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। প্রতিজ্ঞাগুলি হল :

১. আমরা একমাত্র আল্লাহর উপাসনা করব।

২. আমরা ব্যভিচারে লিপ্ত হব না।

৩. আমরা চুরি, ডাকাতি বা কোনরূপ পরস্ব আত্মসাৎ করব না।

৪. আমরা সন্তান হত্যা বা বলিদান করব না।

৫. কারও প্রতি মিথ্যা অপবাদ বা দোষারোপ করব না।

৬. প্রত্যেক সৎকাজে আল্লাহ্র রসূলকে মেনে চলব এবং কোন ন্যায় কাজে তার অবাধ্য হব না।

এই নবদীক্ষিত ইয়াসরিববাসীদের প্রার্থনা মতে তাঁদেরকে কুরআন শিক্ষা প্রদানের জন্য হজরতের প্রতি সহচর মুসাব বিন্নে উযায়ের তাদের সঙ্গে প্রেরিত হন। এই প্রতিজ্ঞা ইসলামের ইতিহাসে ‘বাইয়াতে আকাবা’ এবং আকাবার শপথ নামে পরিচিত। (Philip K. Hitti, History of the Arabs, P. 11 )।

৬২২ খ্রিষ্টাব্দে হজরত মুহম্মদ (স.) এর মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের অব্যবহিত পরেই মক্কা থেকে বহু মুসলমান হজরতের অনুগামী হন। মক্কা থেকে আগত এই মুসলমানরা ইয়াসরিব (মদিনার তৎকালীন নাম) থেকে দুই মাইল অদূরবর্তী ‘কোবা” নামক স্থানে বসতি স্থাপন করেন। হজরত মুহম্মদ (সা.) এর অপরাপর অনুগামী সমভিব্যহারে তিনিও মুসলিমদের এই নব আবাসনে মিলিত হন। এ সময়ে সম্মিলিতভাবে আল্লাহর উপাসনার জন্য হজরত মুহম্মদ (সা.) কোবায় এক মসজিদ নির্মাণ করেন। এটাই ইসলাম জগতের সর্বপ্রথম উপাসনাগৃহ। মসজিদ নির্মাণ শেষে হজরত মুহম্মদ (সা.) তাঁর অনুগামীসহ ইয়াসরিব নগরে ফিরে আসেন। উল্লেখ্য যে, সে সময়ে ইয়াসরিব নগরে বসবাসরত বহু ইহুদী শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত ও ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গও মুহম্মদকে সাদর অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। এই সম্প্রীতির শুভদিন থেকেই ইয়াসরিব নগরের নাম পরিবর্তিত হয়ে ‘মদীনাতুন্নবী’ বা ‘মদীনা’ নামে অভিহিত হয়। এই মদীনায়ও তিনি একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। এখানে সম্মিলিতভাবে (জমাতে) নামাজ পাঠ করতে মুসলমানদের আহ্বান করবার জন্য ‘আযান’ প্রদানের রীতি প্রবর্তন করেন। আবাসীনিয়ার (বর্তমান ইথিওপিয়া) হাবসি ক্রীতদাস বেলাল তাঁর সুললিতকণ্ঠে এই নবনির্মিত মসজিদেই প্রথম আজান প্রদানকারী হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন। আর হজরত মুহম্মদ (সা.) মক্কার কাবাগৃহের দিকে মুখ করিয়ে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ার আদেশপ্রাপ্ত হন ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে। (মোহাম্মদ মতিওর রহমান, বাংলা একাডেমী ঐতিহাসিক অভিধান, পৃ. ৪৭)।

এই বৎসরই মদীনা ও পার্শ্ববর্তী পল্লীসমূহের মুসলমান, ইহুদী ও পৌত্তলিকদের নিয়ে হজরত মুহম্মদ (সা.) এক সাধারণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করেন। সেই অনুসারে ওই সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থানের লক্ষ্যে এক চুক্তিপত্র বা আন্তর্জাতিক সনদ স্বাক্ষরিত হয়, যা ইসলামের ইতিহাসে ‘মদিনা সনদ’ নামে খ্যাত। ‘মদীনা সনদ’-এ উল্লিখিত দশ দফা শান্তিচুক্তির অন্তর্ভুক্ত ছিল :

১. মদীনার মুসলমান, ইহুদী ও পৌত্তলিকগণ একজাতির (Nation) অন্তর্গত। ২. সকলে স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্মকার্য সম্পন্ন করতে পারবে। কেউ কারও ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।

৩. কোন সম্প্রদায়ই বাইরের কোন শত্রুর সাথে গুপ্ত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হবে না, বা তাদের কোন লোককে আশ্রয় দিবে না।

৪. বাইরের কোন শত্রু মদীনা আক্রমণ করলে, তিন সম্প্রদায়ের লোকে সমবেতভাবে শত্রুকে বাধা প্রধান করবে; কিন্তু প্রত্যেক সম্প্রদায়ই নিজ নিজ ব্যয়ভার বহন করবে।

৫. অমুসলমানদের মধ্যে কেউ কোন অপরাধ করলে, তা তার ব্যক্তিগত বলে গণ্য হবে। তার জন্যে তাদের সম্প্রদায়কে দায়ী করা হবে না।

৬. মুসলমানরা এই সাধারণতন্ত্রের অন্তর্গত অন্যান্য সম্প্রদায়ের প্রতি স্নেহশীল হবেন এবং তাঁদের মঙ্গলের জন্য সচেষ্ট থাকবেন।

৭. মদীনায় নরহত্যা আজ থেকে নিষিদ্ধ হল।

৮. প্রত্যেক সম্প্রদায়ের মিত্রজাতি সমূহের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা করা হবে। ৯. ‘শোণিতপণ’ পূর্বের ন্যায় বহাল থাকবে।

১০. মুহম্মদ রসূল্লাহ (সা.) এই সাধারণতন্ত্রের প্রধান নায়ক নির্বাচিত হলেন। যে সকল বিবাদ সাধারণভাবে মীমাংসিত হবে না, তা তিনি আল্লাহর বিধান মতে মীমাংসা করবেন। আল্লাহর নামে এই চিরস্থায়ী চুক্তি। যে বা যারা এই চুক্তি ভঙ্গ করবে তার বা তাদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত।

৬২৬ খ্রিষ্টাব্দে হজরত মুহম্মদ (সা.) সিনাই পর্বতের নিকটবর্তী সেন্ট কেথেরিন গির্জার প্রধান ধর্মযাজকের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করেন। এই সন্ধিপত্রের সারমর্ম হল : মুসলমানরা সাধারণভাবে খ্রিষ্টানদের রক্ষা করবেন। তাদের গির্জা ও ধর্মযাজকদের বাসস্থান সর্বপ্রকার আপদ বিপদ হতে মুক্ত রাখবেন। তাদের উপর অন্যায়ভাবে কর ধার্য করা হবে না। কোন ধর্মযাজককে মঠ হতে বিতাড়িত করা কিংবা কোন খ্রিষ্টানকে ধর্ম ত্যাগ করতে বল প্রয়োগ করা হবে না। কোন তীর্থযাত্রীকে তীর্থকাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হবে না। মুসলমানদের বাসগৃহ বা মসজিদের জন্য কোন গির্জা অধিকার করা হবে না। কোন খ্রিষ্টান মহিলা কোন মুসলমানকে বিবাহ করলে, তাকে ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করা, এমনকি বিরক্ত করাও চলবে না। কোন খ্রিষ্টান তার গির্জা বা আশ্রমের জীর্ণ সংস্কারে সাহায্যপ্রার্থী হলে, মুসলমানেরা তার অভাব মোচনে সাহায্য করবে। (ইসলাম ও আদর্শ মহাপুরুষ, পৃ. ১১১-১৪)। সৈয়দ আমীর আলীর মতে, ‘জগতের ইতিহাসে এই সনদ সংস্কৃতি সহিষ্ণুতার এক মহত্তম কীর্তিস্তম্ভ হিসেবেই যথার্থ বিবেচিত হয়েছে। ইসলামের ঐতিহাসিকগণ এই স্মরণীয় দলিলটি বিশ্বস্ততার সঙ্গে সংরক্ষিত রেখেছেন। এই দলিল মতবাদের বিস্ময়কর প্রশস্ততা ধারণার উদারতার নির্দেশক।’ (Syed Ameer Ali, The Spirit of Islam, p. 26০-61) ।

৬২৭ খ্রিষ্টাব্দে হজরত মুহম্মদ (সা.) হজব্রত উদযাপনের জন্য পনের শত অনুচরসহ মদীনা থেকে মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রার প্রাক্কালে (জিলকদ মাসে) কুরাইশ নেতা আকরামা ও খালেদ ইবনে ওলিদ কয়েক শত অশ্বারোহী সৈন্যসহ তাঁর গতিরোধ করতে এগিয়ে আসে। এ সংবাদ পেয়ে হজরত মুহম্মদ (সা.) তাঁর অনুগামীদের নিয়ে ভিন্ন পথে মক্কার নিকটবর্তী হোদায়বিয়া নামক স্থানে উপনীত হয়ে কুরাইশ নেতাদের কাছে শান্তির প্রস্তাবসহ দূত প্রেরণ করেন। কিন্তু কুরাইশ নেতৃবৃন্দ মুহম্মদ (সা.) ও তাঁর অনুগামীদের মক্কায় প্রবেশে অসম্মতি জানিয়ে প্রেরিত দূত ও হজরতের জামাতা উসমান (রা.) কে বন্দী করে। এমতাবস্থায় কুরাইশদের এই অসহিষ্ণু আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে কুরাইশ দলপতিরা হজরত মুহম্মদ (সা.) এর সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করে। ইসলামের ইতিহাসে যা ‘হোদায়াবিয়ার সন্ধি’ নামে খ্যাত। এই সন্ধির শর্তসমূহ হল :

১. মুসলমানরা এই বৎসর হোদায়াবিয়া থেকে ফিরে যাবেন।

২. আগামী বৎসর তারা মক্কায় আগমন করে তিন দিনের অধিক তথায় অবস্থান করতে পারবেন না।

৩. পথিকদের প্রয়োজনীয় অস্ত্র কোষবদ্ধ অবস্থায় তারা সঙ্গে আনতে পারবেন।

৪. মক্কায় অবস্থানকারী কোন মুসলমানকে তিনি মদীনায় নিতে পারবেন না এবং তাঁর সঙ্গে কেউ মক্কায় থাকতে ইচ্ছা করলে তিনি তাকে বারণ করবেন না।

৫. মদীনা হতে কোন পুরুষ মক্কায় পালিয়ে আসলে কুরাইশরা তাকে ফিরিয়ে দিবে না; কিন্তু মক্কা হতে কোন পুরুষ মদীনায় আশ্রয় নিলে তাকে ফিরিয়ে দিতে হবে।

৬. আরবের যেকোন গোত্র, কুরাইশগণ অথবা হজরত মুহম্মদ (সা.) এর সঙ্গে স্বাধীনভাবে মিত্রতায় আবদ্ধ হতে পারবে।

৭. দশ বৎসরের জন্য উভয় পক্ষের যুদ্ধ স্থগিত থাকবে।

উল্লেখ্য, এই সন্ধিশর্ত অনুযায়ী হজরত মুহম্মদ (সা.) ওই বৎসর তাঁর অনুচরবর্গসহ হোদায়াবিয়া হতে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ইসলাম

ইসলাম শব্দের উৎপত্তিগত শব্দ হল সালাম যার অর্থ শান্তি। এর অন্য অর্থ হল আল্লার কাছে ব্যক্তির ইচ্ছা বিসর্জন দেওয়া অর্থাৎ নিঃশর্তভাবে আল্লার কাছে আত্মসমর্পণ করা। তাই ইসলাম শান্তির ধর্ম এবং এ ধর্মের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করার মাধ্যমে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। সেই জন্যই একজন মুসলমানকে প্রকৃতপক্ষে সাধারণ মানুষের জন্য শান্তির ধারক বাহক হতে হবে। তাই একথা বলা যায় যে কোরান ও হাদীস তথা ইসলামের কোন মতেই সন্ত্রাসবাদকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় না। মানুষ মানুষের জন্য। আর সন্ত্রাস যারা সৃষ্টি করে তাদের কোন জাতি ধর্ম বর্ণ নেই। তারা এক শ্রেণির নরপিচাশ। সৃষ্টির সেরা জীব যে মানুষ, এরা সেই মানুষ পদবাচ্য হতে পারে না। তাই ইসলাম কোনভাবেই সন্ত্রাসবাদের অনুমোদন দেয় না।

ধর্ম পৃথিবীতে এসেছিল মানুষকে পশু হতে পৃথক করতে। মানুষে মানুষে বিভেদ-বিভাজন সৃষ্টি করতে নয়। মানুষকে উন্নততর জীবনবোধ শিক্ষা দিতে। শেখাতে চেয়েছিল জীব শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করতে। নিকৃষ্ট জীবের তলানিতে নামতে নয়। মানুষকে মানবিক গুণে গুণান্বিত করতে, মনুষ্যত্ব জীবন উন্নীত করতে। ধর্মের নামে ধর্মের বাহানায় পশুতে পরিণত হতে নয়। কোরান শিক্ষা দেয়, যে মানুষ একটি মানুষকে বাঁচাল বা রক্ষা করল, সে যেন সারা পৃথিবীর মানুষকে রক্ষা করল বা বাঁচাল এবং যে মানুষ একটি মানুষকে অন্যায়ভাবে হত্যা করল, সে যেন পৃথিবীর সব মানুষকে হত্যা করল। (কুরআন (৫:৩২)।

ধর্ম এসেছে পৃথিবীকে মানুষকে এক হতে, একত্র করতে। খুনোখুনি বন্ধ করতে। মানুষকে সহনশীলতা ও সহানুভূতি শেখাতে। সত্য ও সুন্দরের পথে পরিচালিত করতে, মানবতা ও মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটাতে। সমাজ জীবনে উন্নয়ন ও উত্থান ঘটাতে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, আজকের দিনে ধার্মিকের নামাবলির আড়ালে, সেই যেন বেশি ধার্মিক, যে যত বেশি অন্য ধর্ম এবং অন্য ধর্মাবলম্বীগণকে নির্বিচারে গালি গালাজ করতে পারে, নৃশংসভাবে হত্যা করতে পারে। এই মানুষগুলো কেবল অর্ধামিক নয়, ধর্মের মূলে তারা কুঠারাঘাত করে, ধর্মকে সামনে রেখে সমাজে হানাহানি খুনোখুনি বাড়ায়, হিংস্র জন্তু অপেক্ষা ও হীন, পশু অপেক্ষাও নিকৃষ্ট, এক কথায় তারা মানবকূলের শত্রু।

কোরান বলছে– আল্লা বিপর্যয় সৃষ্টিকারীকে পছন্দ করেন না।

ধর্মের ব্যাপারে জোরাজুরি নেই।

তোমার জন্য তোমার ধর্ম, আমার জন্য আমার ধর্ম।

তারা যাদের বন্দনা করে, তুমি তাদের পুজ্য বস্তু সম্বন্ধে কোন দুর্বাক্য বলো না। হে বিশ্বাসীগণ। এই সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়কে উপহাস করো না।

ধর্ম প্রসঙ্গে কোরান আরও বলে—নানা মত আছে, নানা পথ আছে কিন্তু বিবাদ-বিসম্বাদ, হানাহানি-খুনোখুনির কোন স্থান নেই।

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক লেনপুল বলেন—ইসলামে যত যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে তা সবই আত্মরক্ষামূলক, আক্রমণাত্মক নয়।

ওহোদ (মদীনার উপকণ্ঠে) বদর, খায়বর ও খন্দক সব যুদ্ধগুলিই ছিল মক্কাবাসীদের আগবাড়িয়ে আক্রমণ। মক্কার ইহুদী ও কোরেশগণের যোগ-সাজসে সংঘটিত। মক্কা হতে ২৮০ কিলোমিটার দূরে মদীনার প্রান্তে। এটা ঐতিহাসিক সত্য। অবস্থানগত সত্য। কল্পনা নয়। এই সমস্ত যুদ্ধে উভয় পক্ষের বহু মানুষ হতাহত হয়েছিল। মুহম্মদ (দ.) নিজেও ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলেন। উল্টোদিকে ঐ মুহম্মদ (দ.)ই দশ হাজার সৈন্য নিয়ে মক্কা বিজয় করলেন। ঘটালেন না কোন রক্তপাত। বিশ্ব ইতিহাসে রক্তপাতহীন বিজয়ের নজীর রাখলেন। সেদিন দেখানো হয়েছিল প্রতিশোধের বিপরীতে ক্ষমা। দেওয়া হয়েছিল সকলকে মানবিক অধিকার। শান্তিতে থাকার অধিকার। শান্তিতে মক্কায় বসবাসের অধিকার। পিতৃব্য-হন্তাকে হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়েও নিঃশর্ত ক্ষমার গড়লেন নজীর।

একজন মানুষের সন্ত্রাসী হওয়ার পেছনে হয়ত কারণ থাকে। আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য সন্ত্রাসীরা হয়ত যুক্তিও খাড়া করবে। কিন্তু উপরোক্ত কথাগুলো খণ্ডন করে সন্ত্রাসী হবার রাস্তাও আর খোলা থাকে না। পৃথিবীতে মানুষ বহু দলে উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। কিন্তু স্রষ্টার পক্ষে হতে তাদের মধ্যে কোনরূপে পার্থক্যের সৃষ্টি করা হয়নি। পার্থক্য যা করেছে তা মানুষই করেছে। তারা আপনা আপনি নানা জাতি ও উপজাতিতে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। স্রষ্টা পরম করুণাবশত প্রতিটি জাতি উপজাতিকে তাদের সতর্ককারী দূত প্রেরণ করেছেন। যাতে করে কোন জাতি বলতে না পারে, ওদের মধ্যে কোন দূতের আগমন ঘটেনি। এই দূতদের সম্পর্কেও কোরান বলছে— সকলেই সমান। যেমন মানুষ হিসাবে বলছে সকল মানুষই সমান। কেউ যেন কাউকে ঘৃণার চোখে না দেখে এবং সকল দূতকেই সকলেই যেন সম্মান ও শ্রদ্ধা করে।

কোরান কোন ধর্মের, কোন ধর্মীয় দূতকেই ঘৃণা করতে শেখায়নি, বরং শ্রদ্ধা করতে শিখিয়েছে। মানুষে মানুষে বিভেদ ও বিভাজন আত্মদ্বন্দ্বের সৃষ্টিতে হয়। সকলেই এসেছিলেন বিভ্রান্ত মানব জাতিকে পথ দেখাতে। সত্য সুন্দরের মহিমা কীৰ্ত্তন করতে। সকল দূতই সকল মানুষের শিক্ষক ও পথ-প্রদর্শক।

অনেক সময় সমাজের কিছু কুচক্রী ধান্দাবাজ মানুষ নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ক্ষুণ্ন করে। মানুষ নিয়ে খেলা করে। এমন কি নর-রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করতে উঠে পড়ে লেগে যায়। কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে, একটা সম্প্রদায় আর এক সম্প্রদায়ের ধর্ম-সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা করে, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে, উভয়ে উভয়কে জানতে চিনতে চায় না। উপরন্তু অন্তরে অন্তরে ফল্গুধারার মত একে অপরের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ভাব পোষণ করে। সময়ে সময়ে সেটা বিষ- বাষ্পে পরিণত হয়ে গোটা সমাজকে আচ্ছন্ন করে। সমাজের মারাত্মক বিপত্তি- ঘটায়।

সম্প্রীতির ভ্রুণে জন্ম নেয় ভালোবাসার বকুল

সম্প্রীতি শব্দের অর্থ হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের মিলন। তাই হয়ত পুরাকালে প্রচলিত ছিল আলিঙ্গন প্রথা। শারদ উৎসব কিংবা ঈদে একে অপরকে দেখলে চেনা মানুষ কেমন যেন নুইয়ে শ্রদ্ধাভরে একে অপরকে জানিয়ে থাকে প্রীতি ও শুভেচ্ছা। যেখান থেকে জন্ম নেয় ভালোবাসার বকুল।

ভালোবাসা শব্দের উৎস প্রকৃতি। নিবিড় বন, গুচ্ছ গুচ্ছ তারা, বহমান বাতাস, পাহাড় ফুঁড়ে বেড়ে ওঠা শৃঙ্গের উত্থান, পাখিদের কলকাকলি, সবই যেন মানুষকে ভরিয়ে দিয়েছে মনের উৎফুল্লতা তবু বলব ভালোবাসার জন্য মানুষের ঋণ বোধ হয় নদীর কাছেই বেশি।

পাহাড়ের গা বেয়ে ছোটে ছোটো ধারায় নেমে আসে বৃষ্টির জল, নয়তো রোদের তাপে পাহাড়ের চূড়ায় জমে থাকা বরফগলা জল। পাহাড় অঞ্চলেই জলধারাগুলি মিলেমিশে জন্ম দেয় নদী। নদী নিজস্ব বহমান পদ্ধতিতে শাখানদী, উপনদী এর সাথে সম্পর্কের সেতু রচনা করে সাগরে মিশে থাকে, সেখানে লুকিয়ে আছে ভালোবাসার অর্ঘ।

এই নদীতেই স্নান সেরে বাল্মীকি দেখেছিল উদ্যত ব্যাধকে কপোতকে তীর মারতে। সেই দৃশ্যে বাল্মীকির কণ্ঠে প্রথম ঝরে পড়েছিল— ‘মা নিষাধ প্ৰতিষ্ঠা তমগম শাশ্বতী সমা’ কবিতার প্রথম শ্লোক। যা আজও বিবেচিত পৃথিবীর প্রথম কবিতা। কেলিরত ক্রৌঞ্চ-ক্রোঞ্চির এই তীরবিদ্ধ মানবসৃষ্ট যন্ত্রণা সমগ্র প্রাণিকূলের সপক্ষে সৃষ্টিধর্মেরই প্রতিবাদ। নামে ভাবা যায়, ভালোবাসার বকুল না জন্মালে এমন হৃদয়গ্রাহী কবিতার জন্ম হয়?

আমরা যদি পুরাকালের কথা ধরি, দেখব সম্প্রীতির জন্যই জয় এসেছে বারবার। দেবী দুর্গা অসুর বধ করতে পেরেছিল, শুধুমাত্র দেবতাদের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন ছিল বলেই অসুরদের দেহে শক্তি থাকলেও তারা পরাজিত হয়েছে বারবার সম্প্রীতির বন্ধন আলগার কারণে। যদিও বহু গ্রন্থই দেবতাদের ঐশ্বরিক শক্তির উৎস ভাণ্ডার হিসাবে বিবেচিত করেছে, কিন্তু সম্প্রীতির অনিবার্যতা তো আর অস্বীকার করা যায় না।

আমরা যদি ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে নজর দিই, দেখব আদিম মানুষ যখন জোটবদ্ধভাবে জীবন-ধারণ করত তখন তাদের মধ্যে ছিল কত আনন্দ, কত উল্লাস, কত উৎসাহ। যেদিন তাদের ভিতর শুরু হল গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, তখন তাদের ভেতর মাকড়সার মত বাসা বাঁধল ভয়ের উদ্রেক, দুচোখে হিংসার আগুন, হৃদয়ে সন্দেহের শিখা, উবে গেল ভালোবাসা, মানুষ যেন যন্ত্র হয়ে উঠতে লাগল।

ত্রেতাযুগে রামচন্দ্র রাবণবধ করেছিল শুধুমাত্র বানরদের বাঁধতে পেরেছিল সম্প্রীতির সেতুর বন্ধনে, কিন্তু রাবণ পরাজিত হওয়ার মুখ্য কারণ তার রাজ্যে ভালোবাসার বাঁধন ছিল আলগা, তাই নুন খেয়েও গুণ গেয়েছিল বিভীষণ রামচন্দ্রের।

কোন কিছুই হয়ত চিরস্থায়ী নয়, তাই শেষরক্ষা করতে পারেনি রামচন্দ্র। সেও ব্যর্থ হয়েছিল শত্রুদের বোঝাতে, তার কারণে সীতার পাতাল প্রবেশ। নিজেদের মধ্যেও বাঁধনে ধরেছিল চিড়, তাই চার ভাইকে যেতে হয়েছিল সরঙ্গু নদীতে আত্মবিসর্জনের বলি হতে।

চেষ্টার ত্রুটি করেনি শ্রীকৃষ্ণ। ভারী রাজসভায় শ্রীকৃষ্ণকেই বন্দীর কথা শুনিয়েছিল দুর্যোধন। পরিণামে কুরুক্ষেত্র। গলা ফাটিয়ে তো বলাই যায় ধর্মের জয়। তা যদি হয় সেক্ষেত্রে মহাপ্রস্থানের পথে কেন যুধিষ্ঠির হাঁটল, তার মানে কি বাঁধ যত দৃঢ়ই হোক সেও একদিন আলগা হয়, কিন্তু সেটাই বা মানা যায় কীভাবে। আমরা জানি কলিঙ্গ যুদ্ধে অশোকের পরাজয় অশোকের মধ্যে যে পরিবর্তনের ঢেউ জেগেছিল তা তো রীতিমত সততার স্বচ্ছ দলিল। যাকে স্মরণ করে আজও ভারতীয়দের পথ চলা। বৌদ্ধ অনুসারিদের মহামানবিক উৎসরণ।

সম্প্রীতির বাঁধনে বাঁধতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মহামানবের আবির্ভাব ঘটেছে। সনাতন ধর্মকে বাঁচাতে যেমন উঠে এসেছিল বৈদিক ঋষি, খ্রিষ্টধর্মকে বাঁচাতে যিশুখ্রিষ্ট, শিখ ধর্মের মহান ব্যক্তিত্ব গুরু নানক, বৈষ্ণব ধর্মের জন্য চৈতন্য, বৌদ্ধধর্মের আঙিনায় বুদ্ধদেব, তেমনি ইসলাম ধর্মের মশাল হাতে আরব মরুতে আবির্ভূত হয়েছিলেন হজরত মহম্মদ (দ.)।

সম্প্রীতি বনাম সম্প্রদায়

সম্প্রীতির কথা বলতে গেলে সম্প্রদায় ও সাম্প্রদায়িকতার কথাগুলি এসে যাবে কেননা, গোলমালটা এই জায়গা থেকেই সৃষ্টি হচ্ছে, আর সম্প্রীতির কথা ভাবছি তো সেই জন্যেই। আমাদের দেশে কৃষক সম্প্রদায়, ছাত্র সম্প্রদায়, ব্যবসায়ী সম্প্রদায় প্রভৃতি সম্প্রদায় আছে। ছাত্র সম্প্রদায়ের সঙ্গে কৃষক সম্প্রদায়ের বিরোধিতার কথা শোনা যায় না। উভয় সম্প্রদায়ের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের দৃষ্টান্ত নেই। খ্রিষ্ট বা বৌদ্ধ সম্প্রদায় ধর্মভিত্তিক সম্প্রদায় হলেও এই সম্প্রদায়ের মধ্যে রক্ষক্ষয়ী সংঘর্ষ বিরল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ইরাক-ইরান যুদ্ধ একই সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক ধর্মভিত্তিক সংঘর্ষ ঘটেছে যেগুলিকে সাম্প্রদায়িকতার বলা যায় না। বলা যায় স্বস্বার্থে নিমজ্জিত আত্মদ্বন্দ্ব। বেশকিছু স্বার্থ-সমান এমন জনগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের হলেও তা সাম্প্রদায়িক হয় যায় না— সেগুলি শ্রেণি সম্প্রদায়ভিত্তিক হয়ে যায়। যেমন, বুর্জোয়া শ্রেণি, মধ্যবিত্ত শ্রেণি, সর্বহারা শ্রেশি। অথবা এই সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পর রক্তাক্ত সংঘর্ষ হলেও সাম্প্রদায়িক হয়ে যায় না। এইভাবে, সাম্প্রদায়িক চরিত্র নানাভাবে বিবর্তিত হয়। বাংলাদেশে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক রক্তাক্ত সংঘর্ষ হলেই তাকে সাম্প্রদায়িকতার বিষ বাষ্পে ছড়ানো হয়। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এদেশের হিন্দু- মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সম্মিলিতভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। যুদ্ধ পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশে জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে মানুষ আবার শান্তিপূর্ণসহ অবস্থানের কথা চিন্তা করছে। মানুষ চিন্তা করছে সম্প্রীতি না থাকলে দেশের কল্যাণ সম্ভব নয়, স্বীয় অস্তিত্ব বজায় থাকবে না— আমরা কেউ টিকে থাকতে পারব না।

আপামর জনগণের ভাবাবেগকে উপেক্ষা করে রাষ্ট্রীয় নেতাদের অদূরদর্শিতার জন্যে নিছক ক্ষমতা লাভের লক্ষ্যে বিশাল ভারতবর্ষ দুভাগে বিভক্ত হল। অনেক মানুষ চায়নি এই দেশ ভাগ হোক, অনেক নেতাও চায়নি ভারত-পাকিস্তান একদেশ দুদেশ হোক। ধর্মীয় অনুভূতি থেকেই সম্প্রদায় থেকেই সূচিত হল সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি যার করাল অভিশাপ থেকেই হাজার হাজার মানুষ বলি। নেতৃত্বের দূরদর্শিতার অভাবে অনিবার্য হল এই অনাকাঙ্ক্ষিত দেশভাগ।

হিন্দু-মুসলমান শিখ যেন কোন ধর্মের ধার্মিকেরা ইহলোক নয়, পরলোকে তাদের দৃষ্টি নিবন্ধ রাখে— ঈশ্বর আল্লার খোঁজ করে সুখ শান্তির জন্যে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এরা সবাই পরধর্মের প্রতি অসহিষ্ণু, পরধর্মের মানুষকে বিচ্ছিন্ন রেখে, বঞ্চিত করে ইহজগতের স্বার্থে নিমগ্ন থাকে এবং এক সময় রক্তপাত ঘটায়। ধর্মের এই নেতিবাচক দিক থেকেই সাম্প্রদায়িকতা জন্ম নেয়। কিন্তু ধর্ম সাম্প্রদায়িকতার আধার কারণ নয়, বাহন। কারণ বর্তমানে যে সাম্প্রদায়িকতার বক্তব্য উত্থাপিত হচ্ছে তা হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের সংঘাতের মধ্যে দিয়ে ওঠেনি এইগুলির উত্থাপন রাজনৈতিক লক্ষ্য নিয়ে, ধর্মের নামাবলি পরিয়ে। জাতীয় আন্দোলনের ধর্মভীরু মানুষ স্ব স্ব ধর্মে গর্ববোধ করলেও তাঁরা জাতীয় আন্দোলনের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াননি।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সংস্কৃতি সাহিত্যে পণ্ডিত, খাঁটি হিন্দু বাঙালি, বিধবা বিবাহ প্রচলন করেছেন স্বধর্মের মধ্যেই, হিন্দু শাস্ত্রে মহাপণ্ডিত প্রমাণ করলেন বিধবা বিবাহ আছে শাস্ত্রে। মানুষের কল্যাণ করলেন। এই মানুষটি তো বাঙালি হিন্দু-সমাজের মানুষ কিন্তু তিনি সাম্প্রদায়িক নন। রাজা রামমোহন রায় বিদ্যাসাগরের পূর্বসূরী, ব্রাহ্ম ধর্ম প্রচার করেন, সতীদাহ প্রথা বন্ধ করতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। অথচ দেশের মধ্যে থেকেই ভারতপথিক সর্বভারতীয় মর্যাদা পেলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেশের মধ্যে থেকে সারা বিশ্বের বিশ্বকবি হয়ে রইলেন।

যাঁরা ধর্ম বিশ্বাস নির্ভর যুক্তিবাদে বিশ্বাস করতেন তাঁদের সম্প্রদায়গত মনোভাব থাকলেও সাম্প্রদায়িক মনোভাব পোষণ করতেন না।

মনে রাখতে হবে সম্প্রদায়ের সপক্ষে হিতৈষণা প্রদর্শন করে কিন্তু সে ভিন্ন সম্প্রদায়ে ঘৃণা প্রদর্শন কিংবা কারো অনিষ্ট করে না— তাকে আমরা সাম্প্রদায়িক বলতে পারি না; সহনশীলতার ক্ষেত্রে আমাদের সম্প্রীতি চেতনা ও মানসলোকের এই পার্থক্য বুঝতে হবে।

জাতীয়তাবোধ কখনই অন্যায় নয় তেমনি উগ্র জাতীয়তাবোধ নিশ্চয়ই অন্যায় কারণ, লোভ-লালসা ক্ষমতা লোভ থেকে এর উৎপত্তি। ধর্মকে অস্ত্র করে রাজনীতির কলা-কৌশল স্থাপন করে কিছু মানুষ সংঘর্ষে চালিত হয়। এই সময় মৌলবাদী শক্তিগুলি আবার মাথা চাড়া দেয়। হিন্দু মৌলবাদীরা হিন্দুত্ব ও ভারতীয়ত্বকে এক এবং অভিভাজ্য মনে করে যেহেতু ভারতবর্ষে হিন্দুরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই অবস্থায় মুসলমানেরাও বসে থাকেনি, তারা বিরোধিতা করল, স্ব-স্ব ধর্মে মৌলবাদী সৃষ্টি হল। উভয় ধর্মের মৌলবাদী সংগঠন গড়ে উঠল। বাংলাদেশেও এই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটল।

ধর্ম-বিকৃতি, ইতিহাসে বিকৃতি, ইতিহাসের মধ্যে কল্প-কাহিনি নিয়ে নভেল, নাটকের বিকৃতি হয়েছে প্রভুত। ফলে, এই বিকৃতির মধ্য দিয়ে হিন্দু সম্প্রদায় ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে ধীরে ধীরে কালক্রমে বৈরিতার সৃষ্টি হয়েছে। অন্ন-বস্ত্র- আশ্রয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি মানুষের নানান সমস্যাগুলো বাদ পড়ে গেল— মূল হয়ে উঠলো ধর্ম। পেটের ক্ষিদে বাদ পড়ে গেল— বিভাজনের খিদে বেড়ে গেল।

এই বিভাজনে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ছাড়াও ইতিহাস প্রণেতা, সাহিত্যস্রষ্টাসহ অনেককেই দায়ী করা যায়। আজকের মূল্যায়নে বলা যায়, সে সময়ের অগ্রসর সমাজের আলোকিত ব্যক্তিবৃন্দ পিছিয়ে পরা সমাজের অনালোকিত মানুষদের প্রতি যদি আরো একটু উদারতা প্রদর্শন করত তবে বাঙালির সম্প্রীতিচেতনা আরো বেশি সম্প্রসারিত ও সমৃদ্ধ হত।

একথা অনস্বীকার্য, হিন্দুধর্মের প্রথম আন্তর্জাতিক পরিচয় ঘটিয়েছিল সম্রাট জাহাঙ্গীর পুত্র দারাশিকো। তিনি ৫২টি উপনিষদ ফারসি ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। তারপর সেগুলি ইংরেজি ভাষায় অনুদিত হয়। অন্যদিকে বাংলাভাষার কোরানের বাংলা অনুবাদে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন হিন্দু ম্প্রদায়ের এক ভাই গিরীশচন্দ্র সেন।

সাম্প্রদায়িক শক্তি বা মৌলবাদী শক্তি যাই হোক উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। সারা বিশ্বের মৌলবাদীরা কোরানকে সামনে রেখে চলেন, ধর্ম- ভাঙতে না পেরে (ভুল-তর্জ্জমা করে) অনেক সময় জেদী হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু সুরা কাফেরুনের আল্লাহর নির্দেশ আছে… লা কুম্ দ্বীন কুম ওয়ালিয়া দ্বীন…. (you for your religion, me mine) তোমার ধর্ম তোমার কাছে, আমার ধর্ম আমার।

হিন্দুধর্মের মধ্যে যে পরমত সহিষ্ণুতা ও সম্প্রীতিচেতনার নানা সহিষ্ণু উপাদান আছে যা মানুষের হৃদয়কে প্রসারিত করে কিন্তু মৌলবাদী শক্তিগুলি তা হতে দেয় না।

হিন্দুধর্মের সঙ্গে আসল বিরোধ পৌত্তলিকতা নিয়ে। হিন্দুরা মূর্তিপূজা করেন, চুপ করে থাকা উচিৎ কিন্তু তা না করে ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে অকারণ ফলাও করে, রক্তঘাতী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে যাই, আমরা ভুলে যাই আমরা ধর্ম প্রচারক নই। ইসলাম ধর্মের প্রচারক তো সেই একজনই মহান নবী হজরত মহম্মদ (সা.) কিন্তু ধর্ম প্রচারের দিন শেষ হয়ে গেছে। এখন ধর্মের মর্ম উপলব্ধির সময়।

আমরা সাহিত্য আন্দোলনের মধ্য দিয়েও নিরপেক্ষ হতে পারিনি। সাহিত্য সম্ৰাট বঙ্কিমচন্দ্ৰ চট্টোপাধ্যায় তাঁর আনন্দ-মঠ উপন্যাসে ‘বন্দে মাতরম’ গান রচনা করেছিলেন। এতে দেশাত্মবোধের পরিচয় পাওয়া গেলেও হিন্দুর দেবী দুর্গাকে প্রাধান্য দেওয়া হল। মুসলমানদের দেশপ্রেম যাচাই করা হয়েছিল, এ গান গাইতে জরুরি পরীক্ষা দিতে হল তাদেরকে। কথা হল হিন্দুদের কাছে ‘আল্লাহু আকবর’ শ্লোগান যেমন আন্তরিক নয়, তেমনি মুসলমানদের কাছে ‘বন্দে মাতরম’ শ্লোগান আন্তরিক নয়। দুটোই ধর্মীয় উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত। এই গানের দু’লাইন ছাড়া, এমন কি রবীন্দ্রনাথও সমর্থন করেননি। বঙ্কিমচন্দ্রের উদ্দেশ্য ছিল আদর্শ হিন্দুরূপে হিন্দু জাতিকে প্রতিষ্ঠা করা, মুসলমানদের বিনাশ সাধন বা বিতাড়ন, কেননা, ইংরেজদের চেয়ে মুসলমানরাই শত্রু বলে বিবেচিত হয়েছিল। তাই এই গান ভারতীয় জাতীয়তাবাদের পরিপন্থি না হলেও মুসলিম জাতীয় পরিপন্থি ছিল।

সম্রাট আওরঙ্গজেবকে সবচেয়ে বেশি করে ধরা হয় তিনি মন্দির ধ্বংসকারী। তাঁর শাসনামলে হিন্দু কর্মচারির সংখ্যাই ছিল সর্বাধিক (দ্র. ঈশ্বরীপ্রসাদ ও যদুনাথ সরকার)। আওরঙ্গজেবের বাঙলা অভিযানের সময় হিন্দু রাজারা তার সহযাত্রী ছিলেন। এই হিন্দুরাজাদের রানীরা বারানসীতে এসে গঙ্গা স্নান করে বিশ্বনাথ মন্দিরে পুজা দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে সম্রাট অনুমতি দেন। এক সময় মন্দিরে পুজো দেওয়ার পর কচ্ছের হিন্দু-রানীকে খুঁজে পাওয়া গেল না। এই রানীকে মন্দিরে গর্ব গ্রহে বিগ্রহের নাচের গুপ্তস্থানে হিন্দু মোহান্তদের দ্বারা ধর্ষিত, লাঞ্ছিত অর্ধমৃতাবস্থায় খুঁজে পাওয়া গেল। সম্রাটের কাছে ক্ষুব্ধ রাজারা প্রতিকার ও শাস্তির দাবি করলেন। তাদের পীড়াপীড়িতে অপবিত্র হয়ে যাওয়া স্থান থেকে আওরঙ্গজেব বিশ্বনাথের বিগ্রহ সরিয়ে দেন, দোষীদের গ্রেপ্তার করে কঠোর শাস্তি দেন- -মন্দির ভেঙে দেন। ইতিহাসে এই সব ঘটনা মানুষের কাছে পৌঁছায় না। আবার কুতুবমিনার তৈরি করছেন নাকি বিক্রমাদিত্য। সংঘাতের দিকটাই গুরুত্ব পেল। অনত্র, হিন্দু-মুসলমান সমন্বয় সাধনকারিদের সামনে আনা হয়নি। আকবর থেকে হুসেন শাহ অনেকেই হিন্দুধর্মের অনেক বিষয় মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন, রামায়ণ মহাভারতের অনুবাদের ব্যবস্থা করেন মুসলিম রাজারা (ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতা পৃ. ২১ : ইন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়)।

ইতিহাস অনুসন্ধানে দেখা যায়, ইলিয়াস শাহী আমলেই হিন্দুরা প্রথম উচ্চ রাজপদে নিযুক্ত হন। সুলতানি আমলেই সৃষ্টি হয় মন্দির তৈরিতে নবজাগরণ।

সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের বিরুদ্ধে যারা প্রাণ দিয়ে গেলেন সেই ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মীবাঈ, নানা সাহেব, সুলতানা রিজিয়া, তাঁতীয়া, টোপী, ঝিন্দের রাণী, ফৈজবাদের আহমুদুল্লাহ, দেওয়ান মূলরাজ, নীল বিদ্রোহের নেতা, শহীদ ক্ষুদিরাম প্রভৃতি সংগামী জনগণের নামই নেই। হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব যাঁরা মাতামাতি করেছেন তাঁদের পুরোভাগে ইতিহাস বিকৃতি কী ধর্ম-বিকৃতি ঘটালো তার হিসেব নাই। বাবরি মসজিদ ভাঙা হয়েছে ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই ডিসেম্বর। অনেকেই গণমাধ্যমে দেখেছেন চারদিকে বন্দুকধারী পরিবৃত বাবরি মসজিদের মাথার উপর ঝুলে পড়া গাছের ডাল থেকে বীভৎস চেহারার তিনটি লোক পর পর লাফিয়ে গম্বুজের উপর থেকে গম্বুজের চূড়ায় লাথি মেরে হুঙ্কার ছাড়ে ‘জয় শ্রীরাম’। সাথে সাথে বেড়া টপকে কর সেবকেরা ভেতরে ঢুকতে শুরু করে হাতে শাবল, গাঁইতি ইত্যাদি নিয়ে। ভাঙ্গা হতে থাকে দীর্ঘ সময় ধরে, নিশ্চিন্ত মনে। দেখা গেল বন্দুকধারীরা বন্দুক নিচু করে মাটিতে হাত দিয়ে তিলক আঁকছেন। (ভারতীয় রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব ও তার সাম্প্রতিক গতিবিধি : শ্রী মুরারী মোহন মিত্র) আমরা তার ফলশ্রুতি জানি।

বিবদমান হিন্দু-মুসলিম যা করছে ব্রিটিশ তার সুযোগ নিয়েছে, তাদের অধীনে বহুকাল ভারতবাসী শাসনে থেকে। সারা পৃথিবীতে যে সন্ত্রাসবাদের সৃষ্টি হয়েছে তার থেকে এই বিশাল ভারতবর্ষ মুক্ত নয়। এই অবস্থায় মানুষের অর্থ নেশায় স্বাধীনতা জরুরি প্রয়োজন। ব্যক্তির অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা বাড়লে দেশের মঙ্গল। আত্ম-প্রত্যয় বিচারবোধ ও গৌরববোধ নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে, অনুসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে (সুস্থ সংস্কৃতির) জাতিকে পথ দেখাতে হবে। পুরানো হিংসা ভুলে রক্ষণশীলদের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। জাতীয় দুর্যোগের দিনে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আপামর জনসাধারণসহ কবি সাহিত্যিক, শিল্পী, রাজনীতিবিদ প্রভৃতির সমবেত প্রচেষ্টায় দেশের মঙ্গল আসবে। এর জন্যে সর্বপ্রথম যা চাই, তাহলো উদারদৃষ্টিভঙ্গী ও মানুষের প্রতি মমত্ববোধ। সুখ-শান্তিতে বসবাস করতে হলে সম্প্রীতির কথা অবশ্যই ভাবতে হবে। এখন অতীতের ভুলগুলিকে শুদ্ধ করার সময়।

ইতিহাসের আলোকে ওঁম শান্তি : ওম্ সম্প্রীতি

হাজার বছর আগে বঙ্গে শান্তি ছিল না, সম্প্রীতি ছিল আক্রান্ত। ধর্মের ভিত্তিতে বেদ পুরাণ আশ্রিত বর্ণাশ্রবাদীর শোষণ জুলুম চলছিল নীচবংশ থেকে সৃষ্টি দ্রাবিড়, ভীল, মুণ্ডা, গঙ্গারিডি সাঁওতাল ইত্যাদি জাতির উপর। এরা অসুর, শূদ্র নামে পরিচিত

ব্রাহ্মণ্যবাদীকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নির্যাতন নিষ্পেষণ নিপীড়নে সাধারণ জনজীবন ছিল বিপন্ন। সর্বত্র চলছিল ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়দের অত্যাচার, ঘৃণা অবিশ্বাস ও অন্তঃবিরোধ। উচ্চ শ্রেণির সাথে নিম্নশ্রেণির সংহতি নষ্ট হল।

বঙ্গে পাল বংশ ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ৩০০ বছর রাজত্বে শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির দারুণ বিকাশ হল। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী প্রজাদের পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মের মানুষ শান্তিতে বাস করত।

ওঁ শান্তি : ওম্ সম্প্রীতি সর্বত্র বিরাজ করত। তারপর সেন-বর্মনদের রাজত্বে বর্ণশ্রেণিভেদ প্রবল হয় উঠল। ব্রাহ্মণদের নির্দেশ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ছাড়া সবাই শুদ্র। শূদ্রদের উপর অত্যাচার নিপীড়ন এ সময়ে সহনীয় হয়ে ওঠে কেননা, তারা মানুষ নয়, মানুষের দাস।

ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্যরা ঐশ্বর্য বিলাসী কামনা বাসনায় নিমজ্জিত। ধর্মের নামে ভোগ বিলাস, শূদ্র রমণীদের দেবদাসী করে ভোগ করা, অশ্লীলতা ও যৌনতায় পূর্ণ সাহিত্য সংস্কৃতি।

ডক্টর আরনল্ড লিখেছেন, “এখানকার ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ধারক ও বাহক উচ্চবর্ণের হিন্দুদের উৎপীড়ন, অবজ্ঞা ও অমানবিক ব্যবহারে জর্জরিত হয়ে সাধারণ হিন্দুরা ইসলাম এবং তার অনুসারিদের মাঝে সাম্য ও মৈত্রীর একটা মহৎ ও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত প্রত্যক্ষ করেছিল। একটা মহৎ ঐশীবাদের সন্ধান এবং জীবন্ত ও প্রাণবন্ত নতুন সমাজ ব্যবস্থার সাক্ষ্য লাভ করেছিল’। (ডক্টর আরনল্ড : প্রিচিং অব ইসলাম, নবম অধ্যায়)। ডক্টর নীহার রঞ্জন রায় বাঙালির ইতিহাস বইটিতে লিখেছেন, ‘যে বঙ্গ ছিল আর্য সভ্যতা এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে ঘৃণিত ও অবজ্ঞাপূর্ণ, যা ছিল পাল সেনদের আমলে কম গৌরবের ও কম আদরের, সেই বঙ্গ নামেই শেষ পর্যন্ত তথা কথিত পাঠান মুসলিমদের আমলে বাংলার সমস্ত জনপদ ঐক্যবদ্ধ হল’। (ডক্টর নীহার রঞ্জন রায় : বাঙালির ইতিহাস আদি পর্ব)।

ঐতিহাসিক দীনেশচন্দ্র সেন বৃহত্বঙ্গ বইতে লিখেছেন, বৌদ্ধ ও নিম্নবর্ণের হিন্দুরা ব্রাহ্মণ্যবাদি আদিপত্য এবং তাদের নির্মূল অভিযানের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্যে বাংলার মুসলিম বিজয়কে দুবাহু বাড়িয়ে অভিনন্দন করেছিল। (দীনেশচন্দ্র সেন : বৃহৎ বঙ্গ, পৃ. ৫২৮)।

তিব্বতীয় বৌদ্ধভিক্ষু লামা তারানাথ বঙ্গদেশ পর্যটন করে ষোল শতকের বিবরণী নামে একটি বই লিখেছেন। বইটির একস্থানে লিখেছেন, বৌদ্ধরা মুসলিম বিজয়কে কেবল অভিনন্দন জানায়নি, বখতিয়ার খিলজীকে তারা বঙ্গ বিজয়ে সাহায্য করেছে।

মাত্র ১৮ জন তুর্কী সৈন্য নিয়ে উত্তর প্রদেশ থেকে বঙ্গে এসে নদীয়ায় সেনরাজা লক্ষ্মণ সেনকে পরাস্ত করে বঙ্গের সুলতান হলেন বখতিয়ার খিলজী।

বিশ্বপর্যটক ইবনে বতুতা বঙ্গ পর্যটন করে তাঁর সফর নামায় লিখেছেন ‘বৌদ্ধরা ইসলাম প্রচারকগণকে সম্মান দিতেন। নিজেদের বাড়িতে তাঁদের থাকার সুব্যবস্থা করতেন। তাঁদের প্রয়োজনীয় খাদ্য দ্রব্যের যোগানও দিতেন।’

এলফিন স্টোন তাঁর হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া বইতে লিখেছেন, “বাণিজ্যিক যোগাযোগের ভিত্তিতে ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন উপকূলে অনেক আরব উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল। আরবের অনেক এলাকায় ভারতীয়দের বসতি গড়ে উঠেছিল। ভারতে ব্যবসা থেকে সম্প্রীতি এবং ইসলাম ধর্ম প্রচার শুরু হয়েছিল। ধর্মপ্রচারকগণ জাহাজে চড়ে ভারতের বিভিন্ন উপকূলে গ্রামে ও নগরে ধর্ম প্রচার করতেন। সম্প্রীতির মধ্য দিয়ে ধর্মপ্রচার চলত’।

ডক্টর হাসান জামান তাঁর সমাজ সংস্কৃতি ও সাহিত্য নামক বইটিতে লিখেছেন, ‘ইসলাম ধর্ম প্রচারকদের সাথে কোন অস্ত্র বা বই কেতাব থাকত না। এ দেশের মানুষদের মুখের ভাষা লিখে সেই ভাষায় ইসলাম ধর্ম প্রচার করেছেন। তাঁদের লক্ষ্য ছিল, সত্যিকারের মুসলমান তৈরি করা, যারা এদেশের মুসলিম সমাজের ভিত্তিরূপে কাজ করবেন, ইসলাম প্রচারকগণ গ্রামে গ্রামে বেশি ঘুরতেন। গ্রামে বসে প্রতিবেশীর সঙ্গে সৌহার্দপূর্ণ আচরণ করতেন। বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে জনসাধারণের মধ্যে দ্বীনের দাওয়াত দিতেন।’

মাওলানা ফরিদ উদ্দীন আত্তার বাংলাদেশে ইসলাম প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘অষ্টম কিংবা নবম শতাব্দীতে একদল ইসলাম প্রচারক সাগরপথে আরব দেশ থেকে এসে সাগরের কূলে নেমে সেখানে কিছুদিন থেকে ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে যেতেন। ইসলামের প্রতি মানুষদের আকৃষ্ট করতেন এবং সফল হতেন’। ইতিহাসের কোথায়ও লেখা নেই যে, সেন রাজত্ব ধ্বংসের সময় মুসলিমদের বিরুদ্ধে বাঙালিদের রীতিমত কোন যুদ্ধবিগ্রহ হয়েছিল। বঙ্গ বিজয়ের পরে উত্তরবঙ্গে এবং পূর্ববঙ্গের হাজার হাজার বৌদ্ধ এবং নিম্নশ্রেণির হিন্দু ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়দের শাসন শোষণ অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে শান্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে।

হাজার বছর পরে আমরা দেখছি দুই বাংলায় পশ্চিমবঙ্গে দশ কোটি এবং পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশে সতেরো কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। হিন্দু, মুসলমান, জৈন, বৌদ্ধ, শিখ ইত্যাদি জাতি দুই বাংলায় বাস করছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অভাব নেই। পশ্চিমবঙ্গে বাঙালি হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ। বাংলাদেশে বাংলাভাষী মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ। আবার বাংলা ভাষায় মুসলিমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ।

সাম্প্রদায়িক কাহিনি এখন ইতিহাসের পাতায়। ওঁ শান্তির মধ্য দিয়ে সর্বত্র এখন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরাজ করছে। ওম্ সম্প্রীতি।

ভূগোল ও ভগবান : সমন্বয় কোন্ পথে

এই পৃথিবীর একটিই ভূগোল। তবে এর ভৌগোলিক বৈচিত্র্য অনেক। পৃথিবীর গঠনগত আকৃতি, অক্ষাংশ, দ্রাঘিমা, ভূমির উচ্চতা-নীচুতা, পাহাড়, সমুদ্র-মরুভূমি, সূর্যকে প্রদক্ষিণে সময়ের তারতম্য সবকিছু মিলিয়ে একই পৃথিবীর ভৌগোলিক বৈচিত্র্য অনেক রয়েছে। ফলে একই পৃথিবীর সৃষ্টি জীবনের মধ্যে এসেছে নানান তারতম্য। আকৃতিগত, গঠনগত, ভাষাগত নানান এই বৈচিত্র্য ভৌগোলিক কারণেই ঘটে গেছে। তবে গুণগত বিচারের পৃথিবীর সকল সত্ত্বার মধ্যেই ক্রিয়েচার-সত্ত্বা হিসেবে একটি সত্ত্বাই থেকে গেছে, আর ত হল পরম চৈতন্যঘন সত্ত্বা, যাকে মানুষ কল্পনা করেছে ঈশ্বর বা আল্লা বা গড় নামে।

এই সৃষ্ট-সত্ত্বা তা সে জড় অজড় যাই হোক না কেন, তা সবই স্রষ্টা-সত্ত্বার প্রতিফলিত মানস তন্মাত্র। স্রষ্টা-সত্ত্বার এই মানস তন্মাত্র সকল সৃষ্টিজীবের মধ্যেই বিরাজমান। বিজ্ঞান আরও একটু খুঁটিয়ে দেখে বলেছে, শুধু জীবের মধ্যে নয়, জড়ের মধ্যেও সেই চৈতন্যঘন সত্ত্বা বিদ্যমান। Mater is nothing but bottle- up energy, সৃষ্ট-সত্ত্বার মধ্যে মানুষ স্রষ্টা-সত্ত্বার গুণ আবিষ্কার করে স্রষ্টা বা শ্রেষ্ঠ পরিচালক। যেমন ঈশ্বর শব্দের অর্থ হচ্ছে ঈষ+বর = ঈশ্বর। ঈষ মানে পরিচালক আর বর মানে শ্রেষ্ঠ। আবার GOD মানেও তাই। G For Generator, O for Operator, D for Destractor। অর্থাৎ যিনি সৃষ্টি করেছেন, পালন করছেন এবং ধ্বংস করছেন। তেমনি আবার আলিফ, লাম, হে বা মিম শব্দেরও নিহিতার্থ হচ্ছে যিনি সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, পালনকর্তা, এবং ধ্বংস কর্তা। সুতরাং স্রষ্টা সম্পর্কে যে শব্দগুলি প্রচলিত, তার প্রত্যেকটিই সৃষ্টি-সত্ত্বার মূলীভূত কারণ। মানুষ তার সীমিত বুদ্ধির কারণে এই মূলীভূত কারণ স্রষ্টা-সত্ত্বা সম্পর্কে সম্যক ধারণা করতে না পেরে সৃষ্ট-সত্ত্বার মধ্যে আলাদা আলাদা ঈশ্বরের কল্পনা করেছে। ফলে একই স্রষ্টা-সত্ত্বা দেশ কাল পাত্রের ভিন্নতায় বিভিন্নভাবে শুধু অভিহিতই হয়নি, বরং তাই নিয়ে মানুষে মানুষে রীতিমত মারামারি, কাটাকাটি, হানাহানি লেগে আছে, যা আদিমকাল থেকে আজও বিদ্যমান। অবিলম্বে এর অবসান দরকার। আর তার জন্যই দরকার সমন্বয় চিন্তার। সৃষ্টির ইতিহাস এই পৃথিবী নবীন গ্রহ। জীবন সৃষ্টির ইতিহাস তো আরও নবীন। মাত্র কয়েক কোটি বছর। মানব প্রজাতির আবির্ভাবের ইতিহাস তো এই সেদিনের। আজ থেকে মাত্র দশ লক্ষ বছর আগে। আর মানুষের সভ্যতার যাত্রা পথ তো আরও কম সময়ের। এই তো মাত্র কিছুদিন আগে মানুষ আগুন আবিষ্কার করল। তারপর বস্ত্র, তারপর লিপি, তারপর চাকা। প্রতিটি আবিষ্কারই মানুষের সমাজকে এক একটি উন্নত সোপানে পৌঁছে দিয়েছে। অবশ্য মানুষের এই হিসেব মহাকালের সময়ের প্রেক্ষিতে। সুতরাং মহাকালের যাত্রা পথে পৃথিবী একটি নবীন গ্রহ। এই গ্রহের এখন সভ্যতার শৈশবকাল চলছে। যারা বলছেন, পৃথিবীর ধ্বংসের সময় এসে গেছে তারা ঠিক বলছেন না। আর মানুষেরও আতঙ্কিত হবার কোন কারণ নেই।

শৈশবের বাল্যখিল্যের মত সৃষ্ট-প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে বেশি বুদ্ধিমান প্রজাতি মানুষও তার সীমিত বুদ্ধি নিয়ে বিরাট স্রষ্টা সম্পর্কে মনগড়া মন্তব্য পোষণ করছে। আর স্রষ্টার বিধানকে লঙ্ঘন করে, তাকে দেশ কাল ও পাত্রের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলছে। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যকে গুরুত্ব না দিয়ে, মনষ্যসৃষ্ট বিভাজনকে বেশি করে গুরুত্ব দিচ্ছে। ফলে মানুষে মানুষে বিভেদ ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। কারণ নিজেদের অস্তিত্ব সম্পর্কে মানুষের মনে এখনো কোন সম্যক ধারণা জন্মেনি। আর এই জন্যই বারবার প্রশ্ন উঠছে সমন্বয়ের।

সমন্বয় কীসের? মানুষের সাথে মানুষের। নাকি মানুষের সাথে সমগ্র সৃষ্টির? নাকি মানুষের মানবিকতার? মানুষের সাথে মানুষের, মানুষের সাথে জীবজগতের সমন্বয়তো প্রাকৃতিক নিয়মেই হয়ে আছে। মানুষ শুধু ভুলে আছে তার সমন্বয়ের সূত্রটি। যুক্তিতে দেখা গেল পৃথিবীর সকল সৃষ্ট-সত্ত্বা, স্রষ্টা-সত্ত্বা থেকে উৎসারিত। সুতরাং সকল সৃষ্টি-সত্ত্বার সাথেই মানুষের আত্মীয়তার সম্পর্ক। মানুষ কাউকেই ঘৃণা করতে বা অবহেলা করতে বা হত্যা করতে পারে না। অথচ মানুষ অহরহ তাই করে চলেছে তার স্বল্প বুদ্ধির কারণে। আর এর পিছনে কাজ করছে স্বল্পবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের নানান ধরনের স্বার্থসংশ্লিষ্টতা বা ভাবপ্রবণ মানসিকতার।

এই মানসিকতার কারণগুলি চিহ্নিত করলে আমরা দেখতে পাই :

( Geo- Sentiment) : নিজের নিজের ভৌম অঞ্চলটাকেই শ্রেষ্ঠ মনে করে অন্য ভৌম অঞ্চলের প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ করা।

দুই. সামাজিক ভাব প্রবণতা (Sico – Sentiment) : নিজের সমাজ, নিজের গোষ্ঠী, নিজের গোত্র, নিজের আচার-আচরণ, কৃষ্টি-কালচারকে শ্রেষ্ঠ মনে করে অন্যের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা।

তিন. ধর্মীয় ভাবপ্রবণতা (Religious Sentiment) : ধর্ম (Dharma) আর ধর্মমত (Religion) এর মধ্যে পার্থক্য বুঝতে না পেরে মানুষ ধর্মমত (Religious) কেই ধর্ম বলে মনে করছে এবং নিজের নিজের ধর্মমতের প্রথা পদ্ধতিকেই শ্রেষ্ঠ মনে করে অন্য ধর্মমতের মানুষদের ওপর নানান অত্যাচার, উৎপীড়ন, নিপীড়ন করছে। পৃথিবীতে যত যুদ্ধ, হত্যালীলা সংঘটিত হয়েছে, তার বেশির ভাগ ঘটেছে এই ধর্মমতের বা ধর্মচেতনায় অসহিষ্ণুতা ও অজ্ঞতার কারণে।

চার. ভাষাগত ভাবপ্রবণতা (Linguistic Sentiment) : মানুষের বোধের ভাষা এক। কিন্তু ভৌগোলিক এবং নৃ-তাত্ত্বিক কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ভাষার সৃষ্টি হয়েছে। ভাষাগত এই ভিন্নতা নিয়েও মানুষে মানুষে ভেদ বিভেদের অন্ত নেই। কোন বিশেষ ভাষাকে স্রষ্টার মুখ নিঃসৃত ভাষা বলে অন্য ভাষাভাষি মানুষের ভাষাকে অবজ্ঞা করা হচ্ছে।

এই রকম আরও বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসহিষ্ণু অনুভূতি মানুষের মিলনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলেছে। আজ আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে মানুষকে সমস্ত রকমের অসহিষ্ণুতার ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। মানুষকে বাঁচতে হবে মানুষের পরিচয়ে। কেবলমাত্র ভৌগোলিক বৈচিত্র্যকে মেনে নিয়ে অন্য সমস্ত অসহিষ্ণু মনোবৃত্তি পরিহার করতে হবে। সমন্বয় তখনই সম্ভব।

ভৌম অসহিষ্ণু অনুভূতি ক্ষেত্রে আলোচনা করলে আমরা কী দেখব? পূর্বেই বলা হয়েছে এই পৃথিবী একটা ভূগোল। এর কোন ভূখণ্ডই কোন ভূখণ্ড থেকে আলাদা নয়। সুতরাং রাজনৈতিক কারণে যে ভৌম অঞ্চল বা দেশ গড়ে উঠেছে, তা অতীতের রাজাদের বাহুবলী ক্ষমতার দ্বারা আর বর্তমানের রাজনৈতিক নেতাদের শাসন-শোষণের মানসিকতার দ্বারা। এতে করে সত্যিকারের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক মুক্তির স্বয়ংসম্পন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চল (Economic Zone) গড়ে ওঠেনি। জলবায়ুগত কারণে যদি স্বয়ংসম্পন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হত, তা হলে সমগ্র পৃথিবীতে মোটামুটি যে চারশো ছেচল্লিশটা স্বয়ংসম্পন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠবে তারও কোন অঞ্চলই স্রষ্টার মানস কল্পনার বহিঃর্ভূত নয়। সুতরাং কোন ভৌম অঞ্চলের বৈষম্যমূলক আচরণ বা আগ্রাসন স্রষ্টার প্রতিই বৈষম্য করা। মানুষ যদি এভাবে বিষয়গুলিকে ভাবে, তা হলেই ভৌম অঞ্চলগুলোর মধ্যে সমন্বয় সম্ভব।

সামাজিক অসহিষ্ণুতাকে দূর করতে মানুষকে একে অপরের আচার আচরণ, খাদ্যাভাস, পোশাক নিতে হবে। একে অপরের কৃষ্টি-কালচার গ্রহণ করে মিলনের মহাক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। এতে করে প্রতিটি নৃ-তাত্ত্বিক জনজাতির কৃষ্টিকালচার পুষ্ট তো হবেই, সেই সাথে দূর হবে সামাজিক অসহিষ্ণুতা যা মানব মিলনের অন্তরায়।

ভাষাগত সহনশীলতার ক্ষেত্রে একই কথা খাটে। আজ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে প্রতিটি ভাষার পরিধির মধ্যে অন্যভাষার শব্দ-ভাণ্ডার এসে ঢুকে যাচ্ছে। ফলে প্রতিটি ভাষাই সমৃদ্ধ হচ্ছে। আর কোন একক ভাষা কেবল স্রষ্টার মুখ নিঃসৃত ভাষা এমন ভাবনা ঠিক নয়, সব ভাষাই স্রষ্টার ভাষা। সব ভাষাই স্রষ্টার মানস তরঙ্গ থেকে উত্থিত। সুতরাং ভাষাগত সেন্টিমেন্টের ঊর্ধ্বে উঠতে গেলে ভাষার ক্ষেত্রে ছুঁৎমার্গ পরিহার করতে হবে। মনে রাখতে হবে ভাষা-মনের ভাব প্রকাশের বাহন মাত্র। কোন্ ভাষায় কে কথা বলছে বা ধর্মগ্রন্থ পাঠ করছে সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা মনের স্বচ্ছভাব প্রকাশে সে কতটা সাবলিল এবং কল্যাণকামী। মানুষের সমন্বয় প্রচেষ্টায় ভাষাগত সমস্ত বিভেদ ভুলে গিয়ে সকল ভাষাকেই সমান গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে।

পৃথিবী এগিয়ে চলে দুটি মনোস্তত্ত্বের ভিত্তিতে। এক. সংশ্লেষাণাত্মক, দুই বিশ্লেষণাত্মক। বিশ্লেষণাত্মক মনোস্তত্ত্ব বিভাজনের পথ ধরে চলে। তাতে প্রাধান্য পায় পরস্পরের মধ্যে বিরোধিতার মধ্যে থেকে নিজের ক্ষুদ্র চিন্তাকে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের প্রয়াস। এ পথ কখনোই সমন্বয়ের পথ হতে পারে না। মানুষকে চলতে হবে সংশ্লেষণের পথে। সবাইকে সাথে নিয়ে। এখানে সবাই বলতে শুধু সকল মানুষকেই বলা হচ্ছে না। বলা হচ্ছে সকল মানুষ তো নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া নিয়ে মিলনের পথ প্রশস্ত করতে করতে এগোবেই, সেই সাথে সাথে নিতে হবে সৃষ্ট জগতের সমস্ত বিকশিত অবিকশিত সত্ত্বাকেও। মানুষ পশু পাখি উদ্ভিদ সকলেকেই সাথে নিয়ে এগিয়ে চলবে। সকলের সাথেই সমন্বয় গড়ে তুলতে হবে উপযুক্ত ব্যবহারের দ্বারা। মনে রাখতে হবে মানুষ একটি জীবনও সৃষ্টি করতে পারে না। সুতরাং কোন জীবকেই হত্যা করার অধিকার তার নেই। মানুষকে এই পৃথিবীতে ভালভাবে বাঁচতে গেলে, উদ্ভিদ, পশু-পাখি সকলকেই সাথে নিয়ে চলতে হবে। অবশ্য এ ভাবনা এখনো পর্যন্ত পরিবেশ ভাবনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। কিন্তু বৃহত্তর সমন্বয়ের চিন্তা যখন একবিংশ শতাব্দীর মানুষ করছে, তখন তাকে এ সব বিষয়কে মাথায় রেখেই করতে হবে। যদিও মানুষ এখনো পর্যন্ত মানুষে মানুষে সমন্বয়টিই ভাল করে করতে পারেনি। এক মানুষ আর এক মানুষের প্রতি হিংসা বিদ্বেষ পোষণ করছে, কেবল মাত্র নিজের নিজের ক্ষুদ্র ভাবপ্রবণতা (Sentiment)-র দ্বারা প্রভাবিত হয়। আর এই সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনুভূতির প্রভাব থেকে মুক্ত হতে গেলে মানুষকে মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতে হবে। বুদ্ধির মুক্তি ঘটাতে হবে নানান ধরনের গ্রন্থ অধ্যয়নের দ্বারা। এক স্রষ্টাকে স্বীকার করে বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে। মনে রাখতে হবে। বিশ্বপিতৃত্ব স্বীকার না করলে বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে উঠবে না। কবির ভাষায় :

এ বিশ্ব যার তার নাম মুখে নিতে
এত রক্ত। ছিল না তো জানা। প্ৰভু।
তুমি ক্ষমা করো মানুষেরে
মানুষের হাতে তুলে দাও ফুল
সব ভুল ভালবাসা হোক। তোমার এই
মুক্ত বিশ্বে, মুক্তি পাক নির্যাতিত বিশ্ব
মুক্তি পাক মানুষের অহংকারী জনপদ।

তৎকালীন সম্প্রীতি সংহতির প্রভাব

ইতিহাস শেষ কথা বলে। আমরা ইতিহাস থেকে জেনেছি ভারতবর্ষকে দ্বিধাবিভক্ত করার উদ্যোগের পিছনে ইংরেজ সরকার দেশবাসীর মনে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করতে চেয়েছিলেন। সেদিন হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে দেশের ছাত্র সম্প্রদায় সংহতি বজায় রাখতে ঘৃণ্য, সংকীর্ণ ভেদবুদ্ধির ও ক্ষুদ্র স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে ইংরেজদের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে গড়ে তুলেছিল সুদৃঢ় প্রতিরোধ। তৈরি হয়েছিল সম্প্রীতির মৈত্রীর এক বলিষ্ঠ নিবিড় মেলবন্ধন। কিন্তু তৎকালীন গোঁড়া হিন্দু এবং মৌলবাদী একে একে মাথাচাড়া দিতে শুরু করল। সেই সুযোগ ইংরেজ সরকার বঙ্গবিভাগের সক্রিয় উদ্যোগে ভাগ হয়ে গেল ভারতবর্ষ। অপরদিকে পাকিস্তান। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে তৈরি হল মুসলিম লীগ ও হিন্দু মহাসভার ন্যায় দুটি পৃথক সাম্প্রদায়িক দল। মুসলীম লীগ স্থানীয় স্বায়ত্ত শাসিত প্রতিষ্ঠানগুলি ও প্রাদেশিক কাউন্সিলগুলিতে পৃথক প্রতিনিধিত্বের দাবি করে। বিভেদকামী ইংরেজ হিন্দু মুসলিম ঐক্য দুর্বল করার দুরভিসন্ধি নিয়ে সেই দাবি মুসলিম লীগের পক্ষে মেনে নেয়। ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে মর্লি-মিন্টো ও ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে মন্টেগু চেমসফোডের আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনের বিপরীত প্রতিক্রিয়া রূপে হিন্দু মুসলিম ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় করে তোলে।

আমাদের দুর্ভাগ্য— চোরিচৌরার ঘটনায় আচমকা গান্ধীজি ঐ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন। ফলে জাতির হৃদয় সমুদ্রে সদ্যোত্থিত সেই দুর্নিবার আবেগ বিকৃত পথে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আকারে আত্মপ্রকাশ করে। ইংরেজ সরকার এটাই চাইছিল। ফলে মুসলিম সাম্পদ্রায়িক দাবি অনুসারে ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান সৃষ্টির প্রস্তাব গৃহীত হয়। শেষপর্যন্ত দ্বিখণ্ডিত হল ভারতবর্ষ। লাঞ্ছিত হল ভ্রাতৃপ্রতিম সম্পর্ক। বিনষ্ট হল সম্প্রীতি সংহতি। এখানেই শেষ নয় ঐক্য ও সংহতির মূলে এখনো চলছে কুঠারাঘাত।

পুজা অর্চনার কথা ভাবি অথবা ঈদ উৎসবে, দেখা যায় সর্বস্তরের মানুষ তাঁদের নিজ সাধ্যের মধ্যে পোশাক পরিচ্ছদ পরে দরগায় দরগায়, পাড়ায় পাড়ায় পুজা প্যান্ডেলে প্রতিমা দর্শন এবং একে অন্যকে আলীঙ্গনে ব্যস্ত। এটাই তো আমরা চাই। আমরা নিশ্চিত যতই সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠুক না কেন, সংহতি কোনভাবেই বিপন্ন হবে না।

যে কোন রাষ্ট্রের লক্ষ্যণীয় দিক সম্প্রীতি সংহতি বজায় রাখার পক্ষে। শেরশাহ পরিদর্শনে বেরিয়ে অনুভব করেছিলেন পেশোয়া থেকে দিল্লি পর্যন্ত পথ তৈরি এবং রাস্তার দুধারে গাছ লাগালে পরবর্তী সময়ে প্রজাদের এমন কি দেশের মানুষের কল্যাণ হতে পারে। পথিক ক্লান্ত হলে গাছের ছায়ায় দুদণ্ড বিশ্রাম করে আবার পথ চলা শুরু করতে পারবে। সেখানে কোন প্রশ্ন ছিল না কেবলমাত্র তাঁর মুসলমান প্রজারা এই রাস্তা ব্যবহার করবে অথবা গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নেবে। এটি আজও জিটি (Grand – Trang ) রোড নামে খ্যাত। এটা কি সম্প্রীতি সংহতির একটি ঐতিহাসিক দৃষ্টান্তের প্রশস্ত পথ নয়?

উপমহাদেশের জাতীয় সংহতির কথা বলতে গেলেই মহাপ্রভু চৈতন্যদেব, লালন ফকির, কবীরের নাম এখানে উল্লেখ করতে হয়। তৎকালীন নদীয়া জেলার অন্তর্গত নবদ্বীপ ধামে মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের আবির্ভাব। শ্রেণি স্বার্থের অত্যাচার, ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের এক যোগে শুভ্রদলন এবং মুসলিম ঘৃণা সে সময় বাংলার প্রাণকেন্দ্র নবদ্বীপকে গ্রাস করে সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়েছিল এক নৈরাজ্য। বহু অত্যাচারের মধ্যে তাঁর সংগ্রাম মাথায় করে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে মানুষের মধ্যে সাম্যের প্রতিষ্ঠা করেছিল। ব্রাহ্মণ্য ধর্মশাস্ত্রের ভিত্তি ছিল জাতপাতের জল অচলভেদ হিন্দু মুসলমানের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি। তিনি তা সম্পূর্ণ বিচূর্ণ করেছিলেন। আবার সাম্যের আদর্শ অনুযায়ী ধার্মিক মুসলমান হরিদাসকে নিজ গৃহে স্থান দিলেন। প্রথম সারির পণ্ডিত ছিলেন দবীর খাস রূপ ও সাকর মল্লিক সনাতন। মুসলিম সংসর্গের জন্য ব্রাহ্মণদের তালিকায় তাদের পতিত করা হয়েছিল। স্বয়ং চৈতন্যদেব এঁদেরই বেছে নিয়েছিলেন। তাদের ধর্মের পরমত সহিষ্ণুতা প্রতিষ্ঠার জন্য তৎকালীন এটাও একটা সংহতির শুভদিক ছিল।

বাংলায় তখন হুসেন শাহের শাসন। ন্যায় ধর্ম উদারতায়- পরধর্ম সহিষ্ণু সুলতান হুসেন শাহ আকবরের সমকক্ষ ছিলেন। তাঁর কাছে হিন্দু-মুসলমান সমদৃষ্টি। শুধু তাই নয় যোগ্য বিবেচনায়, রাজস্ব, রাজকোষ, রাজ্য রক্ষায় পরামর্শ সবই যোগ্যতাসম্পন্ন হিন্দুরাজ কর্মচারীদের হাতে ছিল। আগেই বলা হয়েছে ইতিহাস শেষ কথা বলে। হোসেন শাহের এই মহানুভব কি সম্প্রীতি সংহতির দৃষ্টান্ত নয়?

আবার বল্লালী আমলে বৈষম্যকে চিড় ধরাতে ব্যস্ত দিক শাস্ত্রের নজির দেখিয়ে তাঁরা বহু হিন্দু মুসলমানকে শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিল। এভাবে অগণিত নিম্নবর্ণের মেহনতী মানুষ ও মুসলমানেরা অস্ত্যজ, সম্পৃশ্য মেচ্ছ প্রভৃতি আখ্যায় বর্ণিত হয়ে উচ্চবর্ণের থেকে পৃথক হয়ে পড়েছিল। এই জঘন্য অমানবিকতার প্রতিক্রিয়া চৈতন্যদেব খণ্ডন করেছিলেন। আমরা এটাও জেনেছি একদা কাজীর বিচারে চৈতন্যের সাজা দেওয়ার কথা গোঁড়া সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে কিন্তু স্বয়ং কাজী দেখলেন চৈতন্যদেব-হিন্দু-মুসলমান সব শ্রেণির মানুষ নিয়ে সংকীর্তন করে তাঁরা এসেছেন। কাজী মন দিয়ে শুনলেন। চৈতন্যদেবের কথায় তাঁর কাছে ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ হল মানব ধর্ম, ভক্তির পথে জাতিধর্ম, হিন্দু- মুসলমানের কোন ভেদ নাই। সেদিন আসল কাজটা বুঝেছিলেন বিভেদকামী স্বার্থপরায়নদের প্রভাব কতটা কুরুচির কাজ। তৎকালে এটাও সম্প্রতি সংহতির মর্যাদার পরিচয় বহন করে।

রাজধানী গৌড়ের সংলগ্ন রামকেলি গ্রামে রূপ ও সনাতনের সন্ধানে যেদিন চৈতন্যদেব এলেন সামনে পিছনে অগণিত হিন্দু-মুসলমান মানুষ আর মানুষ। হুসেনশাহ স্তম্ভিত হয়ে সৈন্যদের নির্দেশ দেন কোনভাবেই এই দরবেশদের বাধা না দেওয়ার জন্য।

স্বচ্ছন্দে যান, আসুন কেউ যেন কোন বাধার সৃষ্টি না করে। সাহিত্যে যেমন হিন্দু কবিরা নবীবৃত্তান্ত এবং কারবালার বিষাদ কাহিনি নিয়ে কাব্য রচনা করতে থাকেন, তেমনি অগণিত মুসলমান কবি সুফি প্রেম ও রাধাকৃষ্ণ মিশ্রিত করে গান রচনা করেন। মধ্যযুগের এই সম্মিলিত সাহিত্য প্রয়াসের ইতিহাস হতে পারে আজকের সম্প্রীতির অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।

সমাজ বৈষম্য, সাম্প্রদায়িকতা, সংহতি এবং বিচ্ছিন্নতা বুদ্ধি আজ আমাদের পঙ্গু করে রাখার কোন জায়গা নেই। যতই গোঁড়ামি আর মৌলবাদী মাথা চাড়া দিক না কেন সাম্প্রদায়িক কলহকে স্থায়ী করে বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক জনপদে পরিণত করতে পারবে না। যেহেতু এই জনপদের মানুষের রয়েছে সম্প্রীতির দীর্ঘ ঐতিহ্য। অনেক ঐতিহাসিক ইসলামপূর্ব ভারতবর্ষ ও ইসলামপরবর্তী ভারতবর্ষে পূর্বাপর স্থানীয় ধর্ম বনাম বহিরাগত ধর্মানুসারিদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কার্যকারণ অনুসন্ধান করে দেখিয়েছেন, ওইসব ঘটনা যতটা না-ধর্মীয় অসহিষ্ণুতামূলক তারচেয়ে বেশি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

ধর্মে পরমত সহিষ্ণুতা ও সম্প্রীতিচেতনার প্রয়োজনীয়তা ও প্রাসঙ্গিকতার প্রেক্ষাপট উপস্থাপনায় দেখা যায় বিশ্বের অপরাপর জনপদে বসবাসরত বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে সহাবস্থান ও সম্প্রীতি স্থাপন যতটা সহজ, পাক-ভারত উপমহাদেশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন সুদৃঢ় করা সেই তুলনায় ততধিক জটিল। এই জটিলতা যতটা না -সামাজিক তারচেয়ে বেশি রাজনৈতিক। অর্থনৈতিক বৈষম্য, ধর্মাদর্শের বৈপরীত্য, শিক্ষায় পশ্চাদপদতা ইত্যাদি মৌলিক সমস্যা অমীমাংসিত রেখেই ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগে একটি দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত এই জনপদের মানুষের বিশেষত হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে যে-দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে তা নিরসনের যে-দীর্ঘ ইতিবৃত্ত বর্ণিত হল তাতে সহনশীলতার উদ্রেক হলেও গভীর মর্মবেদনার নিরসন হয় না। আর যতদিন পর্যন্ত রাজনীতি থেকে ধর্মকে অপসারণ করা না-যাবে, ততদিনে এই জনপদের মানুষের বিলুপ্ত হৃদয় পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে না। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘সম্প্রীতি’র নামে রাজনৈতিক নেতারা যে-সহনশীলতার কথা বলেন তা শাসক-নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমে দৃশ্যমান হলেও বাস্তবে তার সামাজিক-মানবিক কার্যকারিতা নেই। উপমহাদেশের ধর্ম সম্প্রদায়ের এই কৃত্রিম সম্পর্ককে কংগ্রেস নেতা মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ‘অঙ্গবিহীন আলিঙ্গন’ বলে অভিহিত করেছিলেন। মক্কায় জন্ম নিয়েও স্বধর্ম পালন করে রাজনীতিতে পরধর্মে সহিষ্ণুতা প্রতিষ্ঠার পথ প্রদর্শক মাওলানা আজাদের মত মানবিক রাজনীতি ও ধর্মদেশনায় প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্ব যতদিনে রাজনীতিতে না-আসবেন ততদিন রাজনীতিতে ধর্মীয় সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা নিষ্ফল ফানুস ছাড়া আর কিছুই নয়। বঙ্গবন্ধুর মধ্যে মাওলানা আজাদের সম্প্রীতি চেতনার যে-প্রজ্ঞা প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠেছিল তা নির্বাপিত না-হলে হয়ত আজ বাংলাদেশ সম্প্রীতির প্রত্যাশিত পথেই অগ্রসর হত।

নির্বাচিত গ্রন্থপঞ্জি

Syed Ameer Ali, The Spirit of Islam; Low Price Publications, Delhi P. P. 1923, Reprinted 199০, 1995, 1997.

সুরজিৎ দাশগুপ্ত, ভারতবর্ষ ও ইসলাম; ডি এম লাইব্রেরি, কলকাতা, ১৯৯১

শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র, ইসলাম প্রসঙ্গে (জন্মশতবার্ষিক সংস্করণ); সৎসঙ্গ পাবলিশিং হাউস, সৎসঙ্গ, দেওঘর, ভারত, ১৯৯১

মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আধুনিক বাংলা বাক্যে হিন্দু মুসলমান সম্পর্ক (পু.মু.); বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ২০০৪

মাহমুদা খানম, মধ্য যুগীয় বাংলা সাহিত্যে হিন্দী সুফী কাব্যের প্রভাব; বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০০8

আব্দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী, রাসূল (সা.)-এর পত্রাবলী : সন্ধিচুক্তি ও ফরমানসমূহ; ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, ২০০৫

আবু তাহের সিদ্দিকী (সম্পা), রাসূল (সা.) হুদায়বিয়ার সন্ধি; ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, ২০০৫

রওশন আলী খন্দকার (সম্পা), সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় রাসুল (সা.); ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, ২০০৫

ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ (সংকলিত), মদীনা সনদের গুরুত্ব ও তাৎপর্য; ঢাকা, ২০০৫

গোলাম আহমাদ মোর্তজা, ধর্মের সহিংস ইতিহাস; বিশ্ববঙ্গীয় প্রকাশন, কলকাতা, ২০০৯

ড. পঞ্চানন সাহা, হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক; জাতীয় সাহিত্য প্রকাশন, ঢাকা, ২০১২

কঙ্কর সিংহ, বাংলাদেশ : সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ; জাতীয় সাহিত্য প্রকাশন, ঢাকা, ২০১২

ড. পঞ্চানন সাহা, হিন্দু মুসলমান সম্পর্ক : নতুন ভাবনা; জাতীয় গ্ৰন্থ প্ৰকাশন, ঢাকা, ২০১৬

অসীম রায়, ইসলাম ও বাঙালি মুসলমান সমাজ; ধ্রুবপদ, ঢাকা, ২০১৭

শ্রীসুখময় মুখোপাধ্যায়, বাংলার ইতিহাসের দুশো বছর : স্বাধীন সুলতানদের আমল (১৩৩৮-১৫৩৮); ১ম সংস্করণ, ঢাকা, ২০১৮

মিলন দত্ত (সম্পা.), হিন্দু মুসলমান সম্পর্ক : ঐক্যের দ্বন্দ্বের, ধন্দের; দে বুক স্টোর, কলকাতা, ২০১৮

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *