১০. ধর্মে অসহিষ্ণুতা ও স্বাতন্ত্র্য চেতনা

দশম অধ্যায় – ধর্মে অসহিষ্ণুতা ও স্বাতন্ত্র্য চেতনা (Intolerance and Identity Feelings in Religions)

অসহিষ্ণুতার ইতিবৃত্ত

মৌলবাদ বলতে কেবলমাত্র ধর্মের ও ধর্ম সম্প্রদায়ের প্রতি অসহিষ্ণুতাজনিত ধর্মীয় মৌলবাদকেই বোঝায় না। কিংবা বোঝায় না কেবলমাত্র ধর্মতন্ত্রকেই। ‘পূর্ববিধানই চূড়ান্ত’– একথা যেখানেই ঘোষিত ও স্বীকৃত, সেখানে মৌলবাদের রাজত্ব। ধর্মতন্ত্ররূপে মৌলবাদ মানুষকে ‘মেরেছে প্রাণে, মনে, বুদ্ধিতে, মুক্তিতে, মানুষের মহোৎকৃষ্ট ঐশ্বর্যকে ছারখার করেছে’ (রবীন্দ্রনাথ)। সেটা সম্ভব হয়েছে এইজন্য যে মৌলবাদের শিকড় রয়েছে আরও গভীরে মানবসমাজের উৎপাদন- নীতি পদ্ধতিতে, মানুষের জীবন-নীতিতে। সেই জীবন-নীতি তিন প্রকার— নৈরাজ্যবাদী, মৌলবাদী ও বিশুদ্ধিবাদী। প্রথমটিতে নিয়মবিহীনতার আধিপত্য, দ্বিতীয়টিতে পূর্ববিধানের এবং তৃতীয়টিতে আধিপত্য স্বাধীনতার। একই কর্মের পুনরাবৃত্তিমূলক মৌলবাদী জীবন-নীতির সমস্ত প্রকার সামাজিক মৌলবাদের জনক, সভ্যতার সমস্ত অহিতের মূল। কেবলমাত্র বিশুদ্ধিবাদী জীবন-নীতি সেই সমস্ত অহিত থেকে মানুষ ও তার সমাজকে মুক্তি দিতে পারে।

১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের ২রা এপ্রিল (১৩৩২ বঙ্গাব্দে ১৯শে চৈত্র, শুক্রবার) কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। এই দাঙ্গায় মর্মাহত হয়ে কাজী নজরুল ইসলাম ‘গণবাণী’ পত্রিকায় দুই পর্বে দুটি প্রবন্ধ লেখেন। প্রথমটি ‘মন্দির ও মসজিদ’ দ্বিতীয়টি ‘হিন্দু-মুসলমান’। হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে রচিত দুটি প্রবন্ধের মানবিক আর্তি এতই করুণ এবং বেদনাবিদূর হয়ে উদ্ভাসিত হয়েছে যে সমকালীন জনমানসের সেই নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতা এখনো আমাদের চৈতন্যে আঘাত করে। ‘মন্দির ও মসজিদ’ প্রবন্ধের শুরুতেই দাঙ্গার চিত্রে আমরা দেখি :

‘মারো শালা যবনদের!’ ‘মারো শালা কাফেরদের!’— আবার হিন্দু মুসলমানী কাণ্ড বাঁধিয়া গিয়াছে। প্রথমে কথা-কাটাকাটি, তারপর মাথা-ফাটাফাটি আরম্ভ হইয়া গেল। আল্লার এবং মা কালীর ‘প্রেস্টিজ’ রক্ষার জন্য যাহারা এতক্ষণ মাতাল হইয়া চিৎকার করিতেছিল তাহারাই যখন মার খাইয়া পড়িয়া যাইতে লাগিল, দেখিলাম-তখন আর তাহারা আল্লা মিয়া বা কালী ঠাকুরানীর নাম লইতেছে না। হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি পড়িয়া থাকিয়া এক ভাষায় আর্তনাদ করিতেছে,– ‘বাবা গো, মা গো!’—মাতৃ পরিত্যক্ত দুটি বিভিন্ন ধর্মের শিশু যেমন করিয়া এক স্বরে কাঁদিয়া তাহাদের মাকে ডাকে। দেখিলাম, হত-আহতদের ক্রন্দনে মসজিদ টলিল না, মন্দিরের পাষাণ দেবতা সাড়া দিল না। শুধু নির্বোধ মানুষের রক্তে তাহাদের বেদী চিরকলঙ্কিত হইয়া রহিল। (কাজী নজরুল ইসলাম, ‘মন্দির ও মসজিদ’)।

আসলে ধর্ম ধারণ করার জিনিস, জয় করার জিনিস। কিন্তু এটাকে ভীষণ ভয়ের বিষয় বানিয়ে তোলা হয়েছে উদ্ভটভাবে। এর মাধ্যমে উপভোগ্য আনন্দের উৎসকে দুঃখময় কৌরব নরকের দুর্ভোগে নির্বাসিত করেছে রাজসিক আনুষ্ঠানিকতার মোড়লেরা। আল্লাহর নিজের কোন পক্ষপাত ধর্ম নেই।[২২] তিনি সব ধর্মশিখরের উপরে উঠে একাসনে বিরাজমান। তিনি সকল সৃষ্টির বন্ধনে সমান করুণাময়ী। ধর্মই মানুষকে সৃষ্টির গিটে গিটে আটকে ফেলেছে। সমস্ত সৃষ্টিজগতটাই বিচিত্ৰ দৃশ্য ও অদৃশ্য সম্বন্ধসুতোর গিট তথা বন্ধনের সমাহার যাকে সম্যক ধর্মবিজ্ঞানীরা বলেন, মনের চৌম্বক আকর্ষণী ক্ষেত্র ‘মোহবন্ধন’। কোমল কিন্তু সূক্ষ্ম কঠিন ও গিট্টগুলো যিনি এক এক করে ভেতর থেকে খুলে ফেলতে পেরেছেন তিনি আর আমাদের মত রক্তমাংস বন্দি সামান্য বা সাধারণ মাটির মানুষ নয়, আকাশের মত বিশাল হৃদয় মুক্তমহাপুরুষ। তিনি যেদিকে মোড় নেন ধর্মকে সেদিকে মোড় ফেরাতেই হয়। সমস্ত ধর্মের ঊর্ধ্বে ওঠে তিনি তখন হয়ে ওঠেন মুক্তধর্মী। এই মুক্তধর্মীদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হতে পারে ধর্মমুক্তির সুচারু পথ ও পদ্ধতি। ধর্মমুক্তির সুচারু পথের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পথিক ছিলেন নজরুল। ধর্মবোধের অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে এমন সোচ্চার প্রতিবাদী কণ্ঠ বাঙালি সমাজে দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত নেই।

[২২. কুরআনে উল্লেখিত ‘ইন্না দ্বীনা এনদাল্লাহিল ইসলাম’ (৩ : ১৯ এর অংশ)। অর্থাৎ- নিশ্চয়ই ইসলাম আল্লাহর নিকটবর্তী দ্বীন। উল্লেখ্য অধিকাংশ অনুবাদে দেখা যায়— ‘নিশ্চয়ই ইসলাম আল্লাহর মনোনীত ধর্ম’। এখানে ‘নিকটবর্তী’ অর্থের পরিবর্তে ‘মনোনীত’ অনুবাদে এই তাৎপর্য ইঙ্গিত দেয় যে, ইসলাম ধর্ম ছাড়া অন্য ধর্মের মনোনয়ন আল্লাহ অনুমোদন করেননি। এ ধরনের অনুবাদে শুধু স্বাতন্ত্র্য সম্প্রসারিত হয়— শান্তি প্রতিষ্ঠা পায় না!]

বাঙালি সমাজের অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রধান প্রতীক পুরুষ কাজী নজরুল ইসলাম সমকালেই অভিহিত হয়েছিলেন ‘যুগমানব’ অভিধায়। নজরুলের মধ্যে মূর্তমান হয়ে উঠেছিল যুগমানবের সম্মিলিত মানবচেতনা। নজরুলের মত এতটা অসাম্প্রদায়িক, এতটা উদারনীতিবাদী, এতটা মানবতাবাদী মানস চৈতন্যের অধিকারী মানুষ বাঙালি সমাজে তুলনা রহিত। হিন্দু-মুসলমান এই দুটি সম্প্রদায়ের মনোজগতের দূরত্ব নিরসনে নজরুল নিজেও তাঁর রচনায় মানবিক উষ্ণতায় সহনীয় শব্দ প্রয়োগ করে হিন্দু-মুসলমানের আলিঙ্গনের পথকে সহনীয় করে তুলতে চেয়েছিলেন। এ সময়ে রবীন্দ্রনাথ লেখেন,

‘আমি হিন্দু’ ‘আমি মুসলমান’ এ কথা শুনতে শুনতে কান ঝালা-পালা হয়ে গেল। কিন্তু ‘আমি মানুষ’ এ কথা কাহাকেও বলতে শুনি না। যারা মানুষ নয়, তারা হিন্দু হোক আর মুসলমান হোক, তাদের নিয়ে জগতের কোন লাভ নেই।’ (প্রতিধ্বনি, চৈত্র ১৩৭৭)।

নজরুলের ‘মন্দির ও মসজিদ’ প্রবন্ধে দুটি সম্প্রদায়ের কল্যাণমূর্তি উপস্থাপিত হয়েছে এভাবে :

‘আমি শুনিতেছি মসজিদের আযান আর মন্দিরের শঙ্খধ্বনি। তাহা এক সাথে উত্থিত হইতেছে ঊর্ধ্বে-স্রষ্টার সিংহাসনের পানে। আমি দেখিতেছি, সারা আকাশ যেন খুশি হইয়া উঠিতেছে।’

কিন্তু নজরুলের এই সর্বমানবিক দৃষ্টিভঙ্গি সমাজের দুটি সম্প্রদায় সর্বাংশে সহ্য করেনি। নজরুলের এই মানবিক আহ্বানে সাড়া না দিয়ে ইট-সুরকি নির্মিত জড়ের মত নিষ্ক্রীয় থেকেছে। এই নিষ্ক্রীয়তা থেকেই নজরুল ধর্মের মধ্যে সত্যের আলো দেখেছেন, আবার শাস্ত্রের গোঁড়ামি দেখেছেন। তাঁর মতে, দাঙ্গা বাঁধায় শাস্ত্রওয়ালারা, যাদের নেতা ‘শয়তান’। দাঙ্গাকারীদের সম্পর্কে নজরুলের মন্তব্য :

‘ইহারা ধর্ম-মাতাল। ইহারা সত্যের আলো পান করে নাই, শাস্ত্রের এলকোহল পান করিয়াছে।’

তাই দুটি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে নজরুল তাঁর ‘হিন্দু-মুসলমান’ প্রবন্ধে এই মন্তব্য করেছেন :

হিন্দুত্ব-মুসলমানত্ব দুই-ই সওয়া যায়, কিন্তু তাদের টিকিত্ব দাড়িত্ব অসহ্য, কেননা ঐ দুটোই মারামারি বাধায়। টিকিত্ব হিন্দুত্ব নয়, ওটা হয়ত পণ্ডিত্ব। তেমনি দাড়িও ইসলমাত্ব নয়, ওটা মোল্লাত্ব। এই দুই ‘ত্ব’ মার্কা চুলের গোছা নিয়েই আজ এত চুলোচুলি। আজ যে মারামারিটা বেঁধেছে, সেটাও এই পণ্ডিত- মোল্লায় মারামারি, হিন্দু-মুসলমানে মারামারি নয়। (গণবাণী, ২ সেপ্টেম্বর, ১৯২৫)।

১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতার অ্যালবার্ট হলে নজরুলকে জাতীয় সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। সংবর্ধনা সভায় আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় তাঁর সভাপতির ভাষণে নজরুলকে ‘প্রতিভাবান বাঙালি কবি’ বলে আখ্যায়িত করেন। একই সভায় সুভাষচন্দ্র বসু কবিকে সম্ভাষণ করে বলেন, ‘আমরা যখন যুদ্ধে যাব— তখন সেখানে নজরুলের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব, তখনও তাঁর গান গাইব।’ কিন্তু সুভাষ বসুর এই সম্প্রীতি সুভাষণ নজরুল জীবনে আর প্রশান্তি বয়ে আনার সুযোগ মেলেনি। এর কিছুদিন পরেই নজরুল অত্যন্ত বেদানবিদুর হৃদয়ে এক অভিভাষণে বলেন :

বন্ধুগণ,

আপনারা যে সওগাত আজ হাতে তুলে দিলেন তা আমি মাথায় তুলে নিলুম। আমার সকল তনুমন প্রাণ আজ বীণার মতো বেজে উঠেছে, তাতে শুধু একটি মাত্র সুর ধ্বনিত হয়ে উঠেছে— আমি ধন্য হলুম, আমি ধন্য হলুম। আমায় অভিনন্দিত আপনারা সেইদিনই করেছেন, যেদিন আমার লেখা আপনাদের ভাল লেগেছে। বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের যুগে আমি জন্মগ্রহণ করেছি। এরি অভিযান সেনাদলের তুর্য বাদকের আমি একজন, এই হোক আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়।

আমি এই দেশে এই সমাজে জন্মেছি বলেই আমি এই দেশেরই এই সমাজেরই নই, আমি সকল মানুষের। কবি চায়না দান, কবি চায় অঞ্জলি কবি চায় প্রীতি। সুন্দরের ধ্যান, আর স্তব গানই আমার ধর্ম। তবু বলছি আমি শুধু সুন্দরের হাতে বীণা পায়ে পদ্মফুলই দেখিনি, তার চোখে চোখ ভরা জলও দেখেছি। শ্মশানের পথে, গোরস্থানের পথে ক্ষুধা দীর্ণ মূর্তিতে ব্যথিত পায়ে তাকে চলে যেতে দেখেছি, যুদ্ধভূমিতে তাকে দেখেছি, কারাগারের অন্ধকূপে তাকে দেখেছি, ফাঁসির মঞ্চে তাকে দেখেছি।

আমাকে বিদ্রোহী বলে খামাখা লোকের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন কেউ কেউ। এই নিরীহ জাতটাকে আছড়ে কামড়ে তেড়ে নিয়ে বেড়াবার ইচ্ছা আমার কোনদিনই নেই। আমি বিদ্রোহ করেছি বিদ্রোহের গান গেয়েছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে অত্যাচারের বিরুদ্ধে। জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ যুদ্ধ বিগ্রহ, মানুষের জীবনের একদিকে কঠোর দারিদ্র-ঋণ-অভাব, অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষাণ স্তূপের মত জমা হয়ে আছে। এই অসম ভেদ জ্ঞানকে দূর করতেই আমি এসেছিলাম। আমার কাব্য, সংগীতে কর্মজীবনে অভেদ সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম। আমি যশ চাইনা খ্যাতি চাইনা প্রতিষ্ঠা চাইনা নেতৃত্ব চাইনা। জীবন আমার যত দুঃখময়ই হোক আনন্দের গান, বেদনার গান গেয়ে যাব আমি। দিয়ে যাবো নিজেকে নিঃশেষ করে সকলের মাঝে বিলিয়ে, সকলের বাঁচার মাঝে থাকবো আমি বেঁচে। এই আমার ব্রত এই আমার সাধনা এই আমার তপস্যা।

রবীন্দ্রনাথ আমায় প্রায়ই বলতেন, ‘দেখ উন্মাদ তোর জীবনে শেলীর মত, কীটসের মত খুব বড় একটা ট্রাজেডি আছে—তুই প্রস্তুত হ।’ কিন্তু জীবনের সেই ট্রাজেডি দেখবার জন্য কতদিন অকারণে অন্যের জীবনকে অশ্রুর বর্ষায় আচ্ছন্ন করে দিয়েছি। কিন্তু আমার জীবন রয়ে গেল বিশুদ্ধ মরুভূমির কথা—আমার ছেলে মারা গেছে, আমার মন যখন তীব্র পুত্রশোকে ভেঙ্গে পড়েছে ঠিক সেই দিনে সেই সময়ে আমার বাড়িতে হাস্নাহেনা ফুটেছে। আমি প্রাণভরে সেই হাস্নাহেনার গন্ধ উপভোগ করেছিলাম। আমার কাব্য আমার গান আমার জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছে। যদি কোনদিন আপনাদের প্রেমের প্রবল টানে আমাকে আমার একাকীত্বের পরম শূন্য হতে অসময়ে নামতে হয় তাহলে সেদিন আমায় মনে করবেন না আমি সেই নজরুল; সেই নজরুল অনেকদিন আগে মৃত্যুর খিড়কি দুয়ার দিয়ে পালিয়ে গেছে। মনে করবেন পুণ্যার্থের তৃষা নিয়ে যে একটি অশান্ত তরুণ এই ধরায় এসেছিল অপূর্ণতার বেদনায় তারই বিগত আত্মা যেন স্বপ্নে আমাদের মাঝে কেঁদে গেল। যদি আর বাঁশি না বাজে— আমি কবি বলে বলছিনা, আপনাদের ভালবাসা পেয়েছিলাম সেই অধিকারে বলছি— আমায় আপনারা ক্ষমা করবেন আমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি আমি নেতা হতে আসিনি, আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম। সেই প্রেম পেলামনা বলে আমি এই প্রেমহীন নীরব পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম। যেদিন আমি চলে যাব সেদিন হয়তোবা বড় বড় সভা হবে, কত প্রশংসা কত কবিতা হয়ত বেরুবে আমার নামে, দেশপ্রেমিক-ত্যাগী বীর-বিদ্রোহী বিশেষণের পর বিশেষণ, টেবিল ভেঙ্গে ফেলবে থাপ্পর মেরে, বক্তার পর বক্তা এই অসুন্দরের শ্রদ্ধা নিবেদনের শ্রাদ্ধ দিনে- বন্ধু তুমি যেন যেওনা। যদি পার চুপটি করে বসে আমার অলিখিত জীবনের কোন একটি কথা স্মরণ করো, তোমার আঙ্গিনায় বা আশেপাশে যদি একটা ঝরা পায়ে পেষা ফুল পাও সেইটিকে বুকে চেপে বলো, বন্ধু আমি তোমায় পেয়েছি—

‘তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিবনা
কোলাহল করি সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙ্গিবনা
নিশ্চল-নিশ্চুপ আপনার মনে পুড়িব একাকী
গন্ধ বিধুর ধূপ’।। (‘যদি আর বাঁশী না বাজে’)

এরপর রবীন্দ্রনাথ তাঁর কালান্তর গ্রন্থের ‘হিন্দুমুসলমান’ প্রবন্ধে লিখেছেন :

‘পৃথিবীতে দুটি ধর্মসম্প্রদায় আছে অন্য সমস্ত ধর্মমতের সঙ্গে যাদের বিরুদ্ধতা অত্যুগ্র—সে হচ্ছে খৃস্টান আর মুসলমান-ধর্ম। তারা নিজের ধর্মকে পালন করেই সন্তুষ্ট নয়, অন্য ধর্মকে সংহার করতে উদ্যত। এইজন্যে তাদের ধর্মগ্রহণ ছাড়া তাদের সঙ্গে মেলবার অন্য কোন উপায় নেই।… হিন্দুর ধর্ম মুখ্যভাবে জন্মগত ও আচারমূলক হওয়াতে তার বেড়া আরো কঠিন। মুসলমানধর্ম স্বীকার করে মুসলমানের সঙ্গে সমানভাবে মেলা যায়, হিন্দুর সে পথও অতিশয় সংকীর্ণ আহারে ব্যবহারে মুসলমান অপর সম্প্রদায়কে নিষেধের দ্বারা প্রত্যাখ্যান করে না, হিন্দু সেখানেও সতর্ক। তাই খিলাফৎ উপলক্ষ্যে মুসলমান নিজের মসজিদে এবং অন্যত্র হিন্দুকে যত কাছে টেনেছে হিন্দু মুসলমানকে তত কাছে টানতে পারেনি।… আমি যখন প্রথম আমার জমিদারি কাজে প্রবৃত্ত হয়েছিলুম তখন দেখেছিলুম, কাছারিতে মুসলমান প্রজাকে বসতে দিতে হলে জাজিমের এক প্রান্ত তুলে দিয়ে সেইখানে তাকে স্থান দেওয়া হত। অন্য-আচার-অবলম্বীদের অশুচি বলে গণ্য করার মতো মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনের এমন বাধা আর কিছু নেই। ভারতবর্ষের এমনি কপাল যে, এখানে হিন্দু মুসলমানের মতো দুই জাত একত্র হয়েছে; ধর্মমতে হিন্দুর বাধা প্রবল নয়, আচারে প্রবল; আচারে মুসলমানের বাধা প্রবল নয়, ধর্মমতে প্রবল। এক পক্ষের যে দিকে দ্বার খোলা, অন্য পক্ষের সে দিকে দ্বার রুদ্ধ। এরা কী করে মিলবে’।

১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে ঢাকার জনজীবনে নতুন স্পন্দন সৃষ্টি হয়। ঢাকা তখন গড়ে ওঠে তৎকালীন ভারতবর্ষের একটি গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞানকেন্দ্র রূপে। এই সময়ে কাজী আবদুল ওদুদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ অধ্যাপক আবুল হুসেন আত্মপ্রকাশ করেন নতুন চিন্তাধারার নায়ক রূপে। তাঁরা সাংগঠনিক প্রয়াসের প্রয়োজন অনুভব করে গড়ে তুলেন ঢাকায় ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ এবং এই সংগঠনের মাধ্যমে তাঁরা পরিচালনা করেন ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’। চিন্তা ও কর্মের মাধ্যমে তাঁদের চেষ্টা ছিল যুক্তিহীন, বিচার- বিশ্লেষণহীন, অন্ধ-বিশ্বাসের স্থলে বিবেক-বুদ্ধির প্রতিষ্ঠা সাধন।

কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) প্রায় সমসাময়িক ‘শিখা গোষ্ঠী’র অগ্রজগণ এবং তাঁদের প্রতিষ্ঠিত ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ (১৯২৬) বাঙালির মুক্তচিন্তা চর্চা ও আন্দোলনে বিশেষভাবে স্মরণীয় সংগঠন। এই সংগঠনের পাণপুরুষ শিক্ষক আবুল হুসেন (১৮৯৬-১৯৩৮), সঙ্গে এর আদর্শ প্রণয়নে নিবেদিতপ্রাণ কাজী আবদুল ওদুদ (১৮৯৪-১৯৭০), কাজী মোতাহার হোসেন (১৮৯৭-১৯৮১) ও তসদ্দুক আহমদ। এ সংগঠনের লক্ষ্য বাস্তবায়নে এঁদের সঙ্গে ছিলেন অপেক্ষাকৃত তরুণ মোতাহার হোসেন চৌধুরী (১৯০৩-১৯৫৬), আবুল ফজল (১৯০৩-১৯৩), আবদুল কাদির (১৯০৬-১৯৮৪) প্রমুখ সাহসী আধুনিক যুবক। অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। প্রবল উৎসাহদাতা সঙ্গী কাজী নজরুল ইসলাম। এই সংগঠনের মুখপাত্র ‘শিখা’ (১৯২৭) থেকেই শুরু হয় মুক্তবুদ্ধিচর্চার আন্দোলন। শিখায় মুদ্রিত ঘোষণাবাক্য উচ্চারিত হত : ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি যেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।’ যুক্তিবাদের চর্চায় বিশ্বাসী শিখাগোষ্ঠীর সদস্যরা ছিলেন পাশ্চাত্য আধুনিক চিন্তার অনুসারী মুক্তচিন্তার সাধক এবং দেশকাল উপযোগী অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ। এঁদের আন্দোলন ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ (Emancipation of the Intellect) নামেও পরিচিতি পায়। এঁদের এই প্রেরণার উৎস বা সূত্র নিয়ে আছে নানামত। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক আহমদ রফিকের মতে ‘এঁদের প্রেরণা বা ভাবনা যতটা পাশ্চাত্য রেনেসাঁস থেকে, হয়ত ততটাই কামাল আতাতুর্কের কালাপাহাড়ি আদর্শ থেকে। বাকিটা হয়ত দেশীয় উনিশশতকী নবজাগরণ, বিশেষত, ‘ইয়ং বেঙ্গল’-এর আদর্শ থেকে’। (সংস্কৃতিকথা : যুক্তিবাদ মুক্তিচিন্তা)। অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের মতে ‘ইরানের মুতাজিলা আদর্শের সাথে শিখাগোষ্ঠীর আদর্শের অনুপ্রেরণাই বেশি স্পষ্ট’।

হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সেই রক্তাক্তকালে এই গোষ্ঠির সদস্যরা চেষ্টা করেন পশ্চাত্ত্বর্তী মুসলিম সমাজের উন্নতি সাধন করে হিন্দু ও মুসলমান উভয়ের মিলিত সাধনার মধ্য দিয়ে জাতি গঠন করতে। বাঙালি জাতি এবং ভারতীয় মহাজাতির ধারণা নিয়ে তাঁরা কাজ করছিলেন। মুসলিম সাহিত্য সমাজের কর্মধারায় হিন্দু মনীষীরাও অংশগ্রহণ করেছেন। ধর্মকে এরা প্রায়শ বিচার করতে চেয়েছেন ধর্ম নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে। ফলে তৎকালীন পূর্ব বাঙলার মুসলমান সমাজের কায়েমি স্বার্থবাদী শক্তির সঙ্গে তাঁদের বিরোধ বাধে। কাজী আবদুল ওদুদের ‘সম্মোহিত মুসলমান’ এবং আবুল হুসেনের ‘আদেশের নিগ্রহ’, ‘নিষেধের বিড়ম্বনা’, ‘শতকরা পঁয়তাল্লিশ’ প্রভৃতি প্রবন্ধের বক্তব্য নিয়ে বিরোধ চরম পর্যায়ে পৌঁছে। তখন আবুল হুসেন ও কাজী আবদুল ওদুদ নানাভাবে নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হন।

১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে আবুল হুসেনের প্রতি মানসিক অত্যাচার আরো বৃদ্ধি পায়। এই সময়ে তাঁর, ‘আদেশের নিগ্রহ’ (সাহিত্য সমাজে দ্বিতীয় বছরের প্রথম সাধারণ অধিবেশনে পঠিত— ১৯২৮) ১৩৩৬ সনের আশ্বিনের ‘শান্তি’ পত্রিকায় প্রকাশিত হলে প্রবন্ধটি সম্পর্কে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় (বিশেষত সাপ্তাহিক মোহাম্মদী ২২ কার্তিক ১৩৩৬) প্রবল বাদানুবাদের সৃষ্টি হয়। ফলে স্থানীয় উর্দুভাষী মহলেও তাঁর অনুকীর্তন ছড়িয়ে পড়ে। …

এ জীবনকে তুচ্ছ ক’রে কোন ধর্ম-সাধনাই সার্থক হ’তে পারে না। যে ধর্ম মনুষ্যের এই বিপুল জীবনের সম্পদ ও শ্রীকে বিকশিত করতে সাহায্য করে না, সে ধর্ম মিথ্যা এবং তার পূজা মানুষকে অধঃপতনের চরমে নিয়ে যায়; কিন্তু মোল্লাজী অজ্ঞেয় বেহেশতের লোভ দেখিয়ে মুসলমানকে বেশী ক’রে ক্ষুৎপিপাসায় ক্লিষ্ট ক’রে তুলেছেন। তাতে তারা অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য ভুলে গেছে এবং তাদের নিদারুণ দুঃখ-ক্লান্ত জীবন দিয়ে তারা সজোরে ধর্মশাস্ত্র, ধর্মগুরু ও ধর্ম প্রচারক এই তিনকে উপহাস ক’রে বলছে, ‘ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত যারা, তাদের আবার ধর্ম কিসের?’

কিন্তু মুসলমান ধর্মের পুরোহিত এই মূক প্রতিবাদের অর্থটি বুঝবেন কি?

এখন আর বোধহয় চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে না যে, আমাদের দৈনন্দিন জীবন সুন্দর করবার উদ্দেশ্যে যে সমস্ত ধর্মাদেশ ইসলামের মারফতে প্রচারিত হয়েছিল তার পরিণতি আজ সাধারণ মুসলমানদের জীবনে কী কদর্য চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়েছে— সে জীবনে সত্যকার ধর্মস্পৃহা ঘুচে গেছে, সে জীবন এখন আস্ফালন, অভিমান, মিথ্যা গর্ব, ভণ্ডামি, মূর্খতা ও রুচিহীনতায় পূৰ্ণ হ’য়ে উঠেছে। এ স্থলে আরও কয়েকটি আবশ্যকীয় আদেশের পরিণতি কীরূপ হয়েছে তার আলোচনা করা নিতান্ত প্রয়োজন মনে করি; যথা— হজরত বলেছেন,

১. ‘বিধবা বিবাহ দাও।’

২. ‘নারীকে পর্দায় রাখো।’

৩. ‘জাকাত, ফিরা, সাকা দাও।’

৪. ‘তেলায়ত (কোরান ইত্যাদি পাঠ) করত।

৫. ‘একাধিক বিবাহ করতে পার এবং আবশ্যক হ’লে তালাকও দিতে পার।’

৬. ‘পৈত্রিক সম্পত্তি ফারায়েজ-মত ভাগ-বাটোয়ারা কর।

কিন্তু মুসলমান সমাজ এই আদেশের উৎকৃষ্টতায় যতটা-না অনুগামী হতে পেরেছে— তারচেয়ে বেশি হয়েছে বিপদগামী। এদের নৈতিক অধগামী গন্তব্য প্রতিরোধে সঠিক শিক্ষিত আলোকিত নেতৃত্ব ছিল নিষ্ক্রিয়। অনালোকিতরাই ছিল এগিয়ে।

ঢাকার জীবনে নানা ব্যাপারে তাঁরা তখনো রীতিমতো মুরব্বিয়ানা করতেন ….মহল্লার সরদার থেকে পুলিশের বড়কর্তা, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্ট, ভাইস-চ্যান্সেলর পর্যন্ত তাঁদের কথায় উঠত-বসত।

এই সুযোগে ঢাকার নবাব পরিবার, বিশেষত নবাব হাবিবুল্লাহ ও নবাব আবদুল গনি পূর্বোল্লিখিত উর্দুভাষী মহলের প্রচারণাকে কেন্দ্র করে আবুল হুসেনকে লাঞ্ছনার শিকারে পরিণত করেন। তৎকালীন ঢাকার গাড়োয়ান সম্প্রদায়ের ‘বাইশা সমিতি’ নবাবদ্বয়ের ডানহাত হিসাবে এ বিষয়ে অগ্রণী হয়। ৮.১২.২৯ তারিখে ঢাকার আহসান মনজিলের ইসলামিয়া আনজুমান সমিতি থেকে আবুল হুসেনের তথাকথিত নাস্তিক বা ধর্মদ্রোহী মতবাদের জবাবদিহির জন্য এক বিশেষ বিজ্ঞপ্তি প্রচারিত হয়। বিজ্ঞপ্তি প্রচারিত হওয়ার পর ‘বাইশা সমিতি’র কতিপয় নেতৃত্ব- দানকারী গাড়োয়ান আবুল হুসেনকে হুমকি দেয় যে, তিনি যদি আহসান মনজিলে না-যান তবে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী, এবং গেলেও মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। তাঁকে একা যেতে হবে। কোন সঙ্গী বা আত্মরক্ষামূলক কোন কিছু সঙ্গে নেওয়া চলবে না। সেই সঙ্গে সর্বক্ষণের জন্য তাঁর বাড়িতে পাহারাও বসে, যাতে তিনি আত্মরক্ষার্থে ঢাকার বাইরে কোথাও পলায়ন করতে না পারেন। এই হুমকির মুখে আবুল হুসেন আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। তিনি বিজ্ঞপ্তি প্রচারিত হওয়ার দিন রাত্রি ৮টার সময় স্ত্রী ও পরিজনদের কাছ থেকে সম্ভাব্য মৃত্যুর জন্য চিরবিদায় নিয়ে ‘বাইশা সমিতি’র দুইজন গাড়োয়ানের সঙ্গে রাত ৯টার সময় আহসান মনজিলে উপস্থিত হন। তিনি উক্ত মনজিলে অবস্থিত ইসলামিয়া আঞ্জুমানের সভায় উপস্থিত হলে ‘আদেশের নিগ্রহ’ প্রবন্ধটি উর্দুতে অনুবাদ করে সভায় সকলের সম্মুখে পড়া হয়। প্রবন্ধটি পড়ার পর নবাব হাবিবুল্লাহ ও কতিপয় আলেম আবুল হুসেনকে উর্দু ভাষায় ইসলাম সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন করলে তিনি উর্দুতে ঐসব প্রশ্নের উত্তর দান করেন।

প্রশ্নের উত্তরে হোক, আর অন্য কোন কারণেই হোক, নবাব হাবিবুল্লাহ ও ইসলামিয়া আঞ্জুমানের সদস্যবৃন্দ বলেন যে, ‘আপনি জীবনে আর কখনো কিছু লিখবেন না— যদি এই শর্তে মুচলেকাপত্র লিখে দেন তবেই আপনার দণ্ডাদেশ শিথিল হতে পারে, বা আপনাকে ক্ষমা প্রদর্শন করা যেতে পারে।’ এর উত্তরে আবুল হুসেন বলেন, ‘আমি ধর্মীয় বিষয় নিয়ে কোন প্রবন্ধ জীবনে লিখব না, কিন্তু অন্যান্য বিষয়ে প্রবন্ধ লিখব— এই শর্তে আমার মুক্তি দেওয়া হোক।’ অবশেষে তাঁরা এই শর্তে আবুল হুসেনকে মুক্তি দিতে রাজি হন এবং আবুল হুসেন তখন এই বলে ক্ষমাপত্র লিখে দেন যে, ‘ঐ প্রবন্ধের ভাষা দ্বারা মুসলমান ভ্রাতৃবৃন্দের মনে যে বিশেষ আঘাত দিয়াছি সে জন্য আমি অপরাধী।’

এই মুচলেকাপত্র লিখে ক্ষমা চাওয়ার পর রাত তিনটার সময় ইসলামিয়া আনুজমানের দুজন সদস্যের পাহারায় তাঁকে বাড়ি পৌঁছিয়ে দেওয়া হয়।

আহসান মনজিলের এই ঘটনার আগে ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসে বলিয়াদির জমিদার খান বাহাদুর কাজেমউদ্দিন আহমদ সিদ্দিকির বৈঠকখানায় ধর্ম বিষয়ে কাজী আবদুল ওদুদ ও আবুল হুসেনের ধর্মবিশ্বাসের প্রশ্নে সওয়াল-জবাব অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

কয়েকদিন আলোচনা চলার পর, আলোচনার শেষ দিন, ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দের ২০শে আগস্ট সোমবার আবুল হুসেন উত্যক্ত হয়ে এক ঘোষণাপত্র লিখে দেন, তাতে বলেন : ‘আমি খোদার নিকট মাফ চাই এবং সমাজের নিকটও আশা করি আমার অপরাধ মার্জিত হইবে।’

ইসলামে যেসব কাজ করার জন্য আদেশ করা হয়েছে সেগুলোর এবং যেসব কাজ করতে নিষেধ করা হয়েছে সেগুলোর যৌক্তিক পুনর্বিচার আছে ‘আদেশের নিগ্রহ’ ও ‘নিষেধের বিড়ম্বনা’ শীর্ষক প্রবন্ধ দুটিতে।

আবুল হুসেনের প্রতি এই আঘাত পরোক্ষভাবে ইউরোপের মধ্যযুগের গির্জার নিপীড়নমূলক ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ব্রুনো, কোপারনিকাস, গ্যালিলিও প্রমুখের উপর গির্জার ধর্মযাজক সম্প্রদায় কর্তৃক অত্যাচারের যে উদ্দেশ্য ছিল, বিংশ শতাব্দীর ভারতে আবুল হুসেনের প্রতি অত্যাচারের সেই একই উদ্দেশ্য প্রত্যক্ষিত হয় এবং এর উদ্দেশ্যে হচ্ছে, উচ্চশ্রেণির সমাজ কর্তৃক নিম্নশ্রেণির সমাজকে অর্থনৈতিক শোষণের জন্য ধর্মকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা।… আবুল হুসেনের প্রতি নিপীড়ন ছিল উঠতি মুসলমান নিম্নবিত্ত সমাজের প্রতি মুসলিম উচ্চবিত্ত ক্ষয়িষ্ণু অভিজাত সমাজ কর্তৃক বাধাদানের একটা প্রচেষ্টা মাত্র।

স্বধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্নের অভিলাষ থেকেই ধর্মানুসারিদের মধ্যে ধর্মে অসহিষ্ণুতার সুত্রপাত। আর এই স্বধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করা তখনই সম্ভব যখন শাসক বা ক্ষমতাসীন ব্যক্তি তাঁর ইচ্ছা পূরণের জন্য ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। ইতিহাস থেকে এর প্রচুর দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা যায়। ১৪৫৩ খ্রিষ্টাব্দে তুর্কী সুলতান দ্বিতীয় মুহম্মদ খাঁ তিনশত কুড়িটি রণতরী ও দুই লক্ষ আটান্ন হাজার সৈন্যসহ গ্রিক রাজধানী কনস্টান্টিনোপল আক্রমণ (৬ই এপিল) করেন। সম্রাট কনস্টান্টাইন ব্রুটাস রোমের পোপ ও ইউরোপীয়-রাজন্যবর্গের সাহায্য প্রার্থী হলে ইউরোপের বিভিন্ন রাজ্য থেকে হাজার হাজার সৈন্য গ্রিক সম্রাটের শক্তি বৃদ্ধির জন্য যুক্ত হয়। এতদসত্ত্বেও সুলতান দ্বিতীয় মুহম্মদ খাঁ তেপ্পান্ন দিন যুদ্ধ করে কনস্টান্টিনোপল দখল করেন। সম্রাট কনস্টান্টাইন তুর্কী সৈন্যদের হাতে নিহত হন। বিজয়ী সুলতান দ্বিতীয় মুহম্মদ খাঁ সম্রাটের প্রাসাদ দখলে নিয়ে সেখানে স্বীয় বাসস্থান মনোনীত করেন। অতপর সুলতানের আদেশে কনস্টান্টিনোপল খ্রিষ্টান জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ গির্জা ‘সেন্ট সোফিয়া’ মসজিদে রূপান্তরিত হয়। বর্তমানে মুসলিম বিশ্বে এই মসজিদ ‘জামে আয়া সুফিয়া’ নামে পরিচিত। (মোহাম্মদ মতিওর রহমান, বাংলা একাডেমী ঐতিহাসিক অভিধান, পৃ. ১৫১)।

১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে ভারতীয় আর্য সমাজের নেতা স্বামী শ্রদ্ধানন্দ উত্তর ভারতের আগ্রা ও মথুরা জেলার অশিক্ষিত মালাকানা রাজপুত্র বংশীয় কতিপয় মুসলমানকে কৌশলে হিন্দু ধর্মে দীক্ষিত করেন। তবে দারুল উলুম দেওবন্দ মাদারাসার শিক্ষক ও ছাত্রদের ইসলামের সপক্ষে প্রচার অভিযানের ফলে ওই ধর্মান্তরিত হিন্দুরা পুনঃরায় ইসলাম ধর্মে ফিরে আসে। ফলে স্বামী শ্রদ্ধানন্দের এ ‘শুদ্ধীকৃত’ ধর্মান্তর অভিযান ব্যর্থ হয়। স্বামী শ্রদ্ধানন্দ রাজ-প্রতিনিধি লর্ড রিডিং-এর আহ্বানে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ফিরে এসে দিল্লির এক জনসভায় ভারতীয় মুসলমানদেরকে ‘শুদ্ধ’ (?) হয়ে পুনঃরায় হিন্দুধর্ম গ্রহণের আহ্বান জানায়। তা না হলে মুসলমানদের ভারত ত্যাগ করে আরব-পারস্যে চলে যেতে বলেন। ইতিহাসে এই ঘটনা শ্রদ্ধানন্দের ‘শুদ্ধ’ অভিযান নামে খ্যাত। (মোহাম্মদ মতিওর রহমান, বাংলা একাডেমী ঐতিহাসিক অভিধান, পৃ. ২৯৬)।

১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে আর্যসমাজের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী দয়ানন্দ স্বরস্বতী সত্যার্থ প্রকাশ গ্রন্থে মহানবী (স.)কে অভিহিত করলেন ‘বিবাদপ্রিয়’, ‘যুদ্ধপ্রিয়’ বলে। এছাড়া তিনি আরো বললেন যে ‘মহম্মদ একজন ভণ্ড— যিনি মানুষকে স্রষ্টার নামে ধোকা দেন নিজের স্বার্থ সিদ্ধির উদ্দেশ্যে’। (সত্যার্থ প্রকাশ, বারানসী, পৃ. ৬৭২-৬৮৩)। তবে ‘নিজের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে মানুষকে ধোকা দিয়েছেন এই অভিযোগ ঐতিহাসিক তথ্যে সমর্থন মেলে না। কেননা মহম্মদ (স.)-এর একাত্মবাদ প্রচার অভিযানের প্রেক্ষিতে নবী (স.)কে কোরেশ নেতারা বলেছিল তাঁর ইসলামি মিশন পরিত্যাগ করে পূর্ববর্তী মূর্তিপূজার ধর্মে থাকতে। বিনিময়ে তাঁকে আরবের বাদশা করতে লোভ দেখানো হয়েছিল। তিনি সে প্রস্তাব অত্যাখ্যান করেন। (T.W.Amold, The Preaching of Islam, p.3০ )। বাঙালি সমাজের অন্যতম ক্ষণজন্মা বিচক্ষণ ব্যক্তিত্ব যিনি নানা সময়ে হজরত মুহম্মদ (স.)-এর সাম্য, মৈত্রী, মহত্ত্ব ও ভ্রাতৃত্বের নানা উদ্ধৃতি উপস্থাপন করেছেন— সেই স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর রাজ-যোগ (১৮৯৬) বইতে লিখলেন : ‘হযরত মুহাম্মদ (সা.) যদিও ঐশীভাবে উদ্বুদ্ধ, তবে তিনি প্রশিক্ষিত যোগী ছিলেন না। হযরতের দ্বারা অনেক ক্ষতি হয়েছিল ধর্মান্ধতার জন্য; সমগ্র দেশ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, লক্ষ লক্ষ মানুষ নিহত হয়েছিল।’ (‘Vedanta Philosophy’ : Lecture by Vivekananda)।

১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম দিকে পাক-ভারত উপমহাদেশে কতিপয় উল্লেখযোগ্য অসহিষ্ণু নবী বিরোধী বই প্রকাশিত হয়। ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় লেখক পণ্ডিত কালিচরণ শর্মা বিরচিত বিচিত্র জীবন। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় পণ্ডিত চামুপতি ছন্দনামে সর্বাধিক উত্তেজনাকর ও অসহিষ্ণু গ্রন্থ রঙ্গিলা রসুল। ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় দেবী শরণ প্রণীত সাইর-ই-দোজখ (দোজখ সফর)। বিচিত্র জীবন গ্রন্থে লেখা হল যে নবী (সা.) বহু অমঙ্গলের নিকট নতি স্বীকার করেন, তাঁর সব বিয়েই ছিল অস্বাভাবিক ও অনৈতিক। আর তিনি মৃগী রোগী ছিলেন। শর্মা নবী (সা.)-এর বৈবাহিক ও যৌন জীবনের উপর অনেক অপবাদ দেন এবং বইয়ের উপসংহারের শেষে মন্তব্য করেন যে এমন ব্যক্তি ঐশ্বরিক দূত হতে পারেন না। সাইর-ই-দোজখ (দোজখ সফর) হল ইসরা ও মেরাজের সমালোচনা। এই সময়ে লাহোরে জনৈক অমুলসমান মহামানব হজরত মহম্মদ (সা.)-এর চরিত্রের প্রতি কটাক্ষপাত করে রঙিলা রসুল পুস্তক প্রণয়ন করলে ওই সময়ে দেশবাসী মুসলিম মাত্রেই বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন। এই বিক্ষুব্ধতার রেশে উপমহাদেশ জুড়ে সহিংসতারও অনেক ঘটনা ঘটে। বাংলা সাহিত্যে মুসলিম স্বাতন্ত্রবাদী ঘরানার অন্যতম প্রধান কবি অনল প্রবাহ (১৯০০) প্রণেতা সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী (১৮৮০-১৯৩১)-এর প্রতিবাদে রচনা করেন ‘রঙ্গিলা রসুল’ নামে একটি কবিতা। কবিতাটি এখানে উপস্থাপিত হল—

‘রঙ্গিলা রসুল’

‘রঙ্গিলা রসুল’ নাম শুনিয়াই তলোয়ার মুঠে পরে যে হাত,
আমার রসুলে রঙ্গিলা বলে কোন সে কাফের কোন কমজাত?
ভারত বিজেতা শাহাবুদ্দীন কোথা কোথায় তুমি হে আলমগীর?
রসুল কলঙ্ক ধুইবার লাগি দিতে বল সবে হৃদি-রুধির।
বঙ্গবিজয়ী বক্তিয়ার কোথা, বিজলী জড়ানো সে তলোয়ার
আজমীরী খাজা বাহিরিয়া এসো ভেঙ্গে ফেল তব কবর-দ্বার।
নিখিল জগৎ সৃষ্টি কারণ মানবকুলের শিরের তাজ,
তাঁহারে নিন্দে বেইমানে আজি সহিতে নারি যে দুঃখ-লাজ।
ওহদ-বদর-খাইবার জয়ী বিশ্ব সন্ত্রাসী মুসলমান,
ফের ওঠো জেগে বুকের রক্তে ধুয়ে দাও এই ঘোর অপমান।
সকল শক্তি সকল গৌরব সকল মহিমা হউক লয়,
জীবনে মরণ সার্থক মানি, যদি রসুলের গাহিবে জয়।

ক্রসেডার খ্রিষ্টানদের মধ্যে স্পেন-রাজ দ্বিতীয় ফার্দিনান্দ কর্তৃক ১২৪৮ খ্রিষ্টাব্দে নিজ রাজ্যে ‘ইকুইজিশন’ (Inquisition) নামক সহিংস নিষ্ঠুর প্রথার প্রচলন ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে আছে। রোমের পোপের আদেশে খ্রিষ্টান ব্যতীত অপর ধর্মাবলম্বী প্রজাকে জীবন্ত অবস্থায় অগ্নিকাণ্ডে নিক্ষেপ করে হত্যা করা হত। ওই নিষ্ঠুর প্রথাকে ‘ইকুইজিশন’ বলা হত। ফার্দিনান্দ স্পেনের মুসলমানদেরকে রোমান ক্যাথলিক খ্রিষ্টান ধর্মমত গ্রহণে বাধ্য করতেন, যারা অস্বীকৃত হত তাদেরকেই জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হত। ফলে লক্ষ লক্ষ মুসলমান, যারা জন্মভূমি ত্যাগ করে অন্যত্র গমনে অক্ষম ছিলেন তাঁদেরই অগ্নিকুণ্ডে প্রাণ বিসর্জন দিতে হত। (মোহাম্মদ মতিওর রহমান, বাংলা একাডেমী ঐতিহাসিক অভিধান, পৃ. 2124 )

১৫১৭ খ্রিষ্টাব্দে জার্মানীর উইটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মশাস্ত্রের অধ্যাপক মার্টিন লুথার পোপের স্বাক্ষরিত ক্ষমাপত্র ( Paper of Indulgence) বিক্রয়ের বিরুদ্ধে ‘প্রতিবাদ’ আরম্ভ করেন। লুথারের সমার্থক খ্রিষ্টানরা সেই থেকে ‘প্রোটেস্টাস্ট’ নামে আখ্যায়িত হন। মধ্যযুগের পোপগণ তাঁদের অধীনস্থ পাদরিদের সাহায্যে খ্রিষ্টান জগতের সর্বত্র তাঁদের সীলমোহরযুক্ত ‘ক্ষমাপত্র’ বিক্রয় করতেন। মৃত্যুর পর পরজগতে মুক্তির আশায় খ্রিষ্টান নরনারীরা উচ্চ মূল্যে ওই ক্ষমাপত্র ক্রয় করে রাখতেন। শবদেহ সমাধিস্থ করবার সময়ে ওই ক্ষমাপত্র কফিনের ভিতর যুক্ত করে দেয়া হত। পোপের ওই আচরণের পক্ষে ধর্মশাস্ত্রে কোন নজির না পেয়ে লুথারও তার অনুবর্তীরা খ্রিষ্টান সমাজ থেকে বহিষ্কৃত হয় বলে ঘোষিত হলেও লুথারের মত দ্রুত প্রচারিত হতে থাকে। লুথারের এই প্রতিবাদীর পরিণামে লুথারের অনুবর্তীদের জ্বলন্ত অগ্নিকাণ্ডে নিক্ষেপ করে হত্যার আদেশ জারি করে অপরাপর খ্রিষ্টান রাজাদের কাছে পোপের নির্দেশপত্র পাঠানো হয়।

তবে ধর্ম নিয়ে যুগে যুগে অনেক অসহিষ্ণু চিন্তাচেতনার প্রকাশ ও তার প্রতিফলনে মানব সমাজ নানাভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়ে আসছে। হজরত মুহম্মদ (সা.) এর মৃত্যু পরবর্তী ইসলামে খলিফা মনোনয়ন, কোরান সংকলন তথা ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় বিশ্ব জনপদে রয়েছে নানা রক্তপাতের ইতিহাস। এসব অমানবিক ঘটনার উৎসমূলে রয়েছে বিশ্বাসের বৈপরীত্য ও স্বধর্মের স্বপক্ষে শক্তি প্রয়োগ। সেই সাথে আছে ধর্মদর্শনে নানা ভিন্নতা। এই ভিন্নতা যখন কোন সাহিত্যকর্মের মধ্যে প্রকাশ পায় তখন এর অসহিষ্ণুতার মাত্রা চরম অমানবিকতার পর্যায়ে পৌঁছে। বিশ্ব ইতিহাসে এই অমানবিকতার বিপর্যয়ের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। নিকট অতীতে সংঘটিত এরকম একটি ঘটনা ভারতীয় বংশোদ্ভব ব্রিটিশ লেখক সালমান রুশদী কর্তৃক রচিত স্যাটানিক ভার্সেস (১৯৮৭) রচনা। গ্রন্থটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় কোরানের প্রত্যাদেশ ও তার সারবত্তা। সর্বোপরি এ গ্রন্থে হজরত মুহম্মদ (সা.) ও হজরত আলী (আ.) এর চরিত্র প্রশ্নবিদ্ধ করা। ইরানের ধর্মীয় নেতা ও শাসক আয়াত উল্লাহ খোমেনী (১৯০০-১৯৮৯) কর্তৃক গ্রন্থটি বিশ্বমহলে বাজেয়াপ্তসহ লেখক সালমান রুশদীর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা ছিল আশির দশকে বিশ্বব্যাপী এক আলোড়িত ঘটনা। এর আগে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে সংঘটিত অসহিষ্ণুতার ঘটনা স্মরণে আনা যায়। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে দৈনিক সংবাদ-এর সাহিত্য পাতায় কবি দাউদ হায়দার ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নার কালো বন্যায়’ শিরোনামে একটি কবিতা লেখেন। এই কবিতার আপত্তিকর পঙ্ক্তিগুলি এরকম :

… … … … …
তিমিরে আমার যাত্রা; দেখা হয় আলখেল্লায়
সজ্জিত মিথ্যুক বুদ্ধ; বসে আছে বোধিদ্রুমের ছায়াতলে
যিশু আরেক ভণ্ড; মোহাম্মদ তুখোর বদমাস; চোখে মুখে রাজনীতি।…

দিনটি ছিল শুক্রবার। বায়তুল মোকাররমের জুমা নামাজের পর মুসল্লিরা বের করে বিরাট সহিংস প্রতিবাদী মিছিল। অসংখ্য দোকানপাট ও স্থাপনা ভাঙচুর ও রক্তাক্ত সংঘর্ষের পরিসমাপ্তিত ঘটে সংখ্যাতিরিক্ত পুলিশ ডেকে। কবি সাহিত্যিকদের ভিন্ন চিন্তার বহু প্রকাশনা দৃষ্টান্ত আছে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে। ধর্মচিন্তায় ভিন্ন মত প্রকাশের কারণে আক্রান্ত হয়েছেন কবি শামসুর রাহমান, সদর উদ্দিন চিশতী, বায়েজীদ খান পন্নী, তসলিমা নাসরিনসহ আরো অনেকে। এই অসহিষ্ণু ঘটনায় ঘাতকের হাতে খুন হন অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ, অধ্যাপক অভিজিত রায়, প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন, ব্লোগার মহিউদ্দিন প্রমুখ।

হজরত মুহম্মদ (সা.) (৫৭০-৬৩২খ্রি.) বয়স যখন চল্লিশ বছর সাত মাস, মক্কা থেকে তিন মাইল দূরে অবস্থিত হেরা পর্বতগুহায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় জিবরাইল কর্তৃক প্রথম বাণীপ্রাপ্ত হন। ছশো দশ খ্রিষ্টাব্দের আঠাশে জুলাই মোতাবেক ১৭ই রজমান সোমবারে প্রথম বাণীপ্রাপ্ত হন তিনি। তাঁর মৃত্যুর নয় দিন পূর্ব পর্যন্ত (অর্থাৎ তিন রবিউল আউয়াল একাদশ হিজরির সোমবার পর্যন্ত) আল্লাহর প্রত্যাদেশ বাণী (অহি) লাভ করতে থাকেন। তাঁর মৃত্যুকালে এই প্রত্যাদেশসমূহ সংকলন গ্রন্থকারে লিপিবদ্ধ করা হয়নি। হজরত মুহম্মদ (সা.) এর মৃত্যুর ২৩ দিন পর প্রত্যাদেশ বাণীর সংকলিত নামকরণ কোরান প্রথম গ্রন্থাকারে সংকলিত করার ধারণার প্রথম প্রস্তাবক হজরত ওমর (রা.)। ওমর খলিফা আবু বকরকে এ ব্যাপারে প্রস্তাব দিলে আবু বকর প্রথম রাজি হননি (দ্রষ্টব্য: বোখারি শরিফ, ভলিয়ুম ৬, বুক ৬১, নম্বর ৫০৯)। কারণ আবু বকর জানতেন বিষয়টা স্পর্শকাতর ও কষ্টসাধ্য ব্যাপার। পরে খলিফা ওসমান (রা.) কোরানকে সংকলিত করার উদ্যোগ নেন। তখন তিনি খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, সিরিয়া, কুফা, বসরা, আজারবাইজান, মিশরসহ বিভিন্ন জায়গায় কোরান, আর মদিনায় হজরত ওমরের নির্দেশে তৈরি, তাঁর মেয়ে হাফসার কাছে গচ্ছিত কোরানের মধ্যে বিস্তর গরমিল। এছাড়াও ইমামার যুদ্ধে বহু ‘হাফিজ-এ কুরআন’ নিহত হওয়ার সংবাদে চিন্তিত হয়ে হজরত ওমর (রা.) এর পরামর্শে হজরত ওসমান (রা.) মদিনার খাজরাজ গোত্রের অ-কোরায়েশ জায়েদ বিন হারিথকে সর্বপ্রধান করে আবুল্লাহ ইবনে আল- জুবায়ের, সাদ বিন আল আস, আবদুর রহমান বিন আল-হারিস বিন হিশামসহ ১২ সদস্য বিশিষ্ট একটি কোরান সংকলন কমিটি গঠন করেন। ওসমান তাঁদের নির্দেশ দেন, মদিনার ‘ওহি’ লেখকদের সাথে যদি ভাষাগত অমিল দেখা দেয় তাহলে এ কমিটি কোরায়েশদের ভাষা অনুসরণ করবে। ওসমান আরো বলেন, ‘এই কমিটি কর্তৃক প্রণীত কোরান-ই সরকার অনুমোদিত পরিপূর্ণ ও বৈধ কোরান, এবং রাজ্যের অন্যান্য সকল কোরান অবৈধ হিসেবে গণ্য হবে (Al-Tabari, History of the Quran Compilation)। এভাবেই কোরানকে রাষ্ট্রীয় পরিচালনায় লেখা ও সম্পাদনা করা হয়। হজরত ওসমান (রা.) তাঁর নির্বাচিত সেই কমিটিকে কোরানের ৭টি কপি তৈরি করার আদেশ দেন। তারপর সাত রাজ্যে কোরানের সেই ৭টি কপি পাঠিয়ে তখনকার প্রচলিত বাকি বেসরকারি কোরানের সব কপি পুড়িয়ে (৬৫১ খ্রি.) ফেলেন। পুড়িয়ে ফেলা সে সকল লিপিবদ্ধ কোরানে কী লেখা ছিল পৃথিবীর মানুষ তা কোনদিনই জানতে পারবে না। (মোহাম্মদ মতিওর রহমান, বাংলা একাডেমী ঐতিহাসিক অভিধান; পৃ. ৫৪- ৫৫ বাংলা একাডেমী, তু. মু. ২০০৪)।

অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, হজরত মুহম্মদ (সা.)-এর মৃত্যু পরবর্তী উত্তরাধিকারী মনোনয়ন এবং কোরান সংকলন কেন্দ্রিক যেসব মত পার্থক্যের সৃষ্টি হয়, তা ইসলামের ইতিহাসে নানা রক্তপাতের মধ্যদিয়ে মানব ইতিহাসে একটি চিরস্থায়ী ক্ষতের সৃষ্টি করে। ইসলাম ধর্মের ‘আদর্শ প্রতিষ্ঠার’ এই লড়াইয়ে যে অসহিষ্ণুতার ইতিহাস স্থাপিত হয়, তা ক্রমশ রাজনৈতিক হীনস্বার্থে সম্প্রসারিত হয়ে আজ মানব বিপর্যয়ের মুখে ধাবিত হচ্ছে— এরই সুযোগ নিচ্ছে বর্তমান বিশ্বের রাজনৈতিক ধর্মাদর্শের স্বার্থান্বেষী জোট। ইসলামের এই ঐতিহাসিক ক্ষতের সুযোগ নিয়ে সেখানে তারা আরও যুক্ত করছে নানা মিথ্যাচার ও অপবাদ। এতে অসহিষ্ণুতা আরও বাড়ছে। এখন দেখা যায়, পশ্চিমা বিশ্ব একতরফাভাবে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদেরই ‘সন্ত্রাসী’ ও ‘জঙ্গী’ অভিধায় ভূষিত করছে। সেই সাথে গণমাধ্যমের স্বার্থসংশ্লিষ্ট নেতিবাচক ভূমিকাও বিষয়টিকে আরও অসহিষ্ণু করে তুলছে।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে রুশদের হাত থেকে আফগানিদের সহায়তার নামে মার্কিনিদের সহায়তার হাত আফাগানিদের প্রতি বাড়িয়ে দেওয়া থেকেই ‘জঙ্গি’ বা ‘জঙ্গিবাদ’ শব্দটির প্রচলন। ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হওয়া রাশিয়া-আফগান যুদ্ধের পর থেকেই মূলত বাংলাদেশে মৌলবাদের জন্ম। এক দশক ধরে সেই ভয়াবহ যুদ্ধে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ নিহত হয়। সেই যুদ্ধে বাংলাদেশী ‘জঙ্গিরা’ অংশ নেয় আফগানিস্তানের পক্ষে। বাংলাদেশে ‘জঙ্গিবাদ’ সমর্থনকারীরা এক সময়ে আফগান তালেবানদের সমর্থন করে শ্লোগান দিত ‘আমরা হব তালেবান, বাংলা হবে আফগান।’ ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটির ম্যানহাটনে বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন টুইন টাওয়ারে বিমান হামলার পরে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রিত বুশ প্রশাসনের মিথ্যাচার ও নিষ্ঠুরতায় এই ‘জঙ্গিতৎপরতা’ আরও বৃদ্ধি পায়। এই তৎপরতায় বাংলাদেশও আক্রান্ত হয়। কেউ কেউ একে বাংলাদেশে ‘মাদরাসা শিক্ষার কুফল’ হিসেবেও চিহ্নিত করে।

অথচ এই এশিয়া মহাদেশেই বহু মনীষী মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে অসাম্প্রদায়িক মানসচেতনা নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন, রাজনীতি করেছেন, তাঁদের নিজস্ব ধর্মীয় মূল্যবোধ সমুন্নত রেখেও পরধর্ম সহিষ্ণুতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখেছেন। স্যার আবদুল করিম গজনবী (১৮৭২-১৯৩৯), ব্যারিস্টার আবদুর রসূল (১৮৭২-১৯১৭), আবুল হাশিম (১৯০৫-১৯৭৪), শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক (১৮৭৩-১৯৬২), মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (১৮৮০-১৯৭৬), হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (১৮৯২-১৯৬৩), মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ (১৯০০-১৯৮৬)সহ আরও অনেক রাজনীতিকদের নাম স্মরণ করা যায়। এই স্মরণ তালিকায় ভারতের আবুল কালাম আজাদ (১৮৮৮- ১৯৫৮) উপমহাদেশের রাজনীতিতে অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন। কই, এঁদের জীবনাদর্শে তো কোন সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতা প্রকাশ পায়নি? ইদানিং পাচ্ছে কেন? কারা মদদ দিচ্ছে? এবং ধর্মকে দায়ী করছে? বিশেষত ইসলাম ধর্মকে তার মূল বৈশিষ্ট্য (সুশাসন ও ন্যায় বিচার নিশ্চিতের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার শপথ) থেকে সরানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে এই ধর্মের তারুণ্য শক্তিকে নানা লোভ লালসার দিকে ঠেলে দিয়ে এবং তাতে না হলে ধর্মের ভুল ব্যাখ্যায় উত্তেজিত করে এদেরকে বিপদগামী করার কৌশল অবলম্বনে জঙ্গিবাদের অভিযোগ উত্থাপন করে। আর এই অভিযোগের অন্তর্নিহিত কুশীলবদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অনুধাবন না করে গণ মাধ্যমে যে সংবাদ প্রচার করে তাতে ধর্মের মর্মবাণীকে নির্বাক করে দেয়! ধর্মচেতনার এই অপ্রয়োগের উৎস অনুসন্ধানে সৈয়দ আমীর আলী তাঁর The Spirit of Islam গ্রন্থে বলেন :

‘মানবতা ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের ধর্ম রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও বিসম্বাদের অভিশাপ এড়াতে পারেনি; যে ধর্ম বিচ্ছিন্নতাবাদী দুনিয়ায় শান্তি ও স্থৈর্য আনার জন্য এসেছিল তা ক্রদ্ধ উন্মাদনা ও শক্তি লালসার আবর্তে পড়ে নিজেই টুকরো টুকরো হয়ে পড়েছে। খ্রিষ্টধর্মে যে অমঙ্গলের জন্যে আমরা বিলাপ করি তা এসেছিল জীবনব্যবস্থার অপূর্ণতা, মানুষের প্রয়োজনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যতা থেকে, আর ইসলামে যে অমঙ্গলের বর্ণনা আমরা করি তা এসেছে পার্থিব অগ্রগতির লোভ, নৈতিক নিয়ম ও শৃঙ্খলার প্রতি অসহিষ্ণু ব্যক্তি ও শ্রেণির বৈপ্লবাত্মক প্রবৃত্তি থেকে।’ (পৃ. ৩২৯)।

সাম্প্রতিককালে আমরা এই প্রবৃত্তির প্রদর্শন দেখি ডা. ডাকির নায়েক-এর ভাষ্যে। ধর্মীয় সহিষ্ণুতার সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্যবাদী মতবাদে পুষ্ট এবং স্বধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শনের প্রতিভু এই জাকির নায়েক তাঁর চিন্তাচেতনায় ইসলামের সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্যরূপী ভাষ্যকাররূপে আবির্ভূত হন! সুনিয়ন্ত্রিত ও গোষ্ঠী মনোনীত বিভিন্ন ব্যক্তির প্রশ্নের জবাবে তিনি যে তাৎক্ষণিক যুক্তি হাজির করেন তাতে সাধারণ মানুষ সীমাবদ্ধ বুদ্ধিতে উৎফুল্ল হন— ইসলাম স্বাতন্ত্র্যবাদীরা আরও বেশি বিজয়ী মনোভাব নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। অথচ বিশেষ গোষ্ঠির কাছে এই ‘জনপ্রিয়’ জাকির নায়েক- এর বক্তব্যে কি ইসলামের মহত্ত প্রকাশিত হয়? যেমন- একজন প্রশ্ন করলেন :

‘মুসলমানরা কেন অমুসলমানদের কাফের বলে’?

জাকির নায়েক ‘কাফের’ শব্দের উৎপত্তি ও আভিধানিক ব্যাখ্যা দিয়ে অতপর অমুসলিমদের প্রতি এই গালমন্দমূলক সম্বোধন থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে তিনি পরামর্শ দেন— ‘যদি অমুসলমানরা আঘাত পান তাহলে তাদের উচিত ইসলাম গ্রহণ করা।’ (দ্র. Answers to Non-Muslims Common Questions About Islam/ ইসলাম সম্পর্কে অমুসলিমদের প্রশ্নের জবাবে ডা. জাকির নায়েক। অনুবাদ : মুহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া, প্রশ্ন ২০ পৃ. ৮০)।

ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে

রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনায় ব্যবহারবহুল ইংরেজি কমিউন্যালিজমের বাংলা প্রতিশব্দ সাম্প্রদায়িকতা। ইংরেজিতে শব্দটির আভিধানিক অর্থের সঙ্গে রাজনৈতিক পরিভাষার নিত্যব্যবহৃত এ শব্দের মিল নেই। শব্দটি এ উপমহাদেশের রাজনীতিতে প্রধানত হিন্দু-মুসলিম ধর্ম সম্প্রদায়ের বিরোধ ও বিদ্বেষ সূত্রে বেশি ব্যবহার হয়ে থাকে। তবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে জাতপাতের সংঘর্ষ কিংবা ইসলামধর্মীদের মধ্যে শিয়া-সুন্নি দাঙ্গা-হাঙ্গামাকে কোন কোন লেখক সাম্প্রদায়িক বলে অভিহিত করেন। আবু সয়ীদ আইয়ুব সাম্প্রদায়িকতা বলতে বুঝতেন ধর্মের চোখে ধর্ম-সম্প্রদায়কে এবং ব্যক্তির চেয়ে গোষ্ঠীকে বড় করে দেখা। যে নিজেকে সবসময় হিন্দু বা মুসলমান বলে ভাবতে অভ্যস্ত, অন্যের সঙ্গে পরিচিত হলে তার চরিত্র, বিদ্যাবুদ্ধি রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রভৃতির খোঁজ না নিয়ে প্রথমেই জানতে চায় লোকটি ব্রাহ্মণ না শূদ্র, হিন্দু না মুসলমান, ইহুদি না খ্রিষ্টান— সে সাম্প্রদায়িক মানুষ। বদরুদ্দীন উমরের দৃষ্টিতে কোন ব্যক্তির মনোভাবকে তখনই সাম্প্রদায়িক আখ্যা দেয়া হয়, যখন সে এক বিশেষ ধর্ম সম্প্রদায়ভুক্তির ভিত্তিতে অন্য এক ধর্ম- সম্প্রদায় এবং তার অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধচারণ ও ক্ষতিসাধন করতে প্রস্তুত থাকে। যে অর্থে শব্দটি এ উপমহাদেশে চলে আসছে সেটি একান্তই দেশের নিজস্ব তার মূলে আছে ধর্মগত বিদ্বেষ ও সংঘর্ষ এবং সেটাও প্রধান হিন্দু ও মুসলমান ধর্ম- সম্প্রদায়ের মধ্যে। সাম্প্রদায়িকতার কারণস্বরূপ এর পশ্চাতে অনেকে একমাত্র অর্থনৈতিক বৈষম্য ও রেষারেষি প্রত্যক্ষ করেন। অর্থনৈতিক বৈষম্য ঘুচে গেলে সাম্প্রদায়িক অনৈক্য থাকবে না বলে তাদের বিশ্বাস। দ্বিতীয়ত, জওহরলাল নেহেরুসহ অনেকের অভিমত হল, সাম্প্রদায়িক সমস্যাটি ইংরেজ শাসকদের ভেদনীতির পরিণাম। উল্লিখিত উভয় ধারণা যাদের কাছে সর্বাংশে গ্রহণযোগ্য নয় ও অতিসরলীকৃত হিসেবে বিবেচিত, তাদের অভিমত হল- সাম্প্রয়ায়িকতা বিষয়টি জটিল এবং ভারতীয় সমাজের একটি দীর্ঘকালের মজ্জাগত ব্যাধি। ব্রাহ্মণ্য তথা হিন্দু ধর্মের বর্ণাশ্রম থেকে বর্ণবিভেদ ও বর্ণসংঘর্ষ মজ্জাগত ব্যাধি। ব্রাহ্মণ্য তথা হিন্দু ধর্মের বর্ণাশ্রম থেকে বর্ণবিভেদ ও বর্ণসংঘর্ষ উদ্ভূত, যেটা প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। বর্ণগত অসমতার দরুণ হিন্দুরা নিজেদের মধ্যে হানাহানি করে এসেছে, আর্থিক অসাম্যের প্রশ্ন সেদিক থেকে নিতান্তই গৌণ।

সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব এবং ধর্মকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যবহার করার উদ্দেশ্য ছিল সাম্প্রদায়িক নেতৃবর্গের স্বার্থ, মূলত রাজনৈতিক স্বার্থ। সুতরাং মৌলবাদী ধর্মান্ধতার উদ্ভব ঘটল— বলা চলে যার ফলে মানবতা সভ্যতার সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাসবোধ এবং ঐতিহ্য চেতনাও হল বিপন্ন। মানুষ তখন থেকেই নিজেও মরল, অন্যকেও মারতে শুরু করল। দাঙ্গার পিছনে কাজ করে এই ধর্মকে ব্যবহার করা অথচ প্রকৃত বিচারে অধর্মের মনস্তত্ব, রবীন্দ্র-বিচারে তাই ধর্মমূঢ়তা এবং যে ধর্মকারার প্রাচীর বজ্র হানার আহ্বান জানিয়ে জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালাতে নির্দেশ দিয়েছেন তাঁর ‘ধর্মমোহ’ কবিতায়। যার প্রথম দুটি স্তবক এ-রকম :

ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে
অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে।
নাস্তিক সেও পায় বিধাতার বর,
ধার্মিকতার করে না আড়ম্বর।
শ্রদ্ধা করিয়া জ্বালে বুদ্ধির আলো,
শাস্ত্র মানে না, মানে মানুষের ভালো।

বিধর্ম বলি মারে পরধর্মেরে
নিজ ধর্মের অপমান করি ফেরে,
পিতার নামেতে হানে তাঁর সন্তানে,
আচার লইয়া বিচার নাহিকো জানে,
পূজাগৃহে তোলে রক্ত মাখানো ধ্বজা
দেবতার নামে এ যে শয়তান ভজা। (পরিশেষ )

এশন প্রশ্ন হল এ উপমহাদেশের ইতিহাসের প্রেক্ষিতে ধর্ম কখন থেকে ধর্মমোহে রূপান্তরিত হল? কি পরিস্থিতিতে? ভারতবর্ষের প্রধানতম ধর্মগুলির রূপ ও রূপান্তর, উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ, প্রচার, প্রবর্তন ও প্রসার হল কীভাবে? সমাজে তার প্রতিক্রিয়াই বা কী? প্রাচীন বা মধ্যযুগে এই জনপদে আচরিত ধর্মগুলির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক কেমন ছিল? তখন কি এই বিভেদ থেকে সংঘর্ষ হয়েছে? ঔপনিবেশিক পরিপ্রেক্ষিতে পরিস্থিতি কেমন করে ক্রমশ বদলে গেল? সেই পরিবর্তনে কী প্রভাব পড়ল আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে? স্বাধীনতা লাভের পর ধর্মনিরপেক্ষতার তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা হলেও বাস্তবে কী দেখা গেল? কেন এই সংঘর্ষ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, গণহত্যা, সন্ত্রাস এখনও অব্যাহত?

এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে আমরা স্মরণ করতে পারি কবি হৃদয়ে উদ্ভাসিত মানব ঐক্যের সেই মৌলিক অনুভূতি। যেখানে ক্ষুধা তৃষ্ণা ব্যথা বেদনার সাথে সকলেই এক হয়ে যেতে পারে। কবির আত্মউপলব্ধিতে বলি :

জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে,
সে জাতির নাম মানুষ জাতি;
একই পৃথিবীর স্তন্যে লালিত
একই রবি-শশী মোদের সাথী।
শীতাতপ ক্ষুধা তৃষ্ণার জ্বালা
সকলে আমরা সমান বুঝি,
কচি-কাঁচাগুলি ডাঁটো করে তুলি
বাঁচিবার তরে সমান যুঝি।
দোসর খুঁজি ও বাসর বাঁধি গো
জলে ডুবি, বাঁচি পাইলে ডাঙা,
কালো আর ধলো বাহিরে কেবল
ভিতরে সবারই সমান রাঙা।’

(জাতির পাঁতি/সত্যেন্দ্ৰনাথ দত্ত)

বাঙালি কবির উপরোক্ত কবিতার উপলব্ধির সাথে বিশ্বমানব সমাজের কেউ দ্বিমত পোষণ করবেন বলে মনে হয় না। এ-প্রসঙ্গে ধর্মগ্রন্থ আল কুরআন বলছে : ‘ওয়া ইন্না হাযিহি উম্মতাকুম উম্মাতান ওয়াহিদাতান ওয়া আনা রাব্বাকুম ফাত্তাকুন’ (৫ : ৪৮)। মানে, নিশ্চয়ই মানব জাতি এক ও অভিন্ন এবং আমি (আল্লাহ) তোমাদের সকলেরই একমাত্র রব/স্রষ্টা ও প্রভু ব্যতীত নই। কথাগুলি কোন বিশেষ ধর্ম বা সম্প্রদায় সম্পর্কে নয়, সকল মানব সমাজকে লক্ষ্য করেই বলা। এ বক্তব্যের সপক্ষে প্রায় সকল ধর্মেরই উদ্ধৃতি উপস্থাপন করে দেখানো যায় যে মূলত সকল ধর্মের সারকথা এক এবং অভিন্ন। তুলনামূলক ধর্মশাস্ত্রের গবেষণায় দেখা যায় প্রেরিত যুগমানব বা অবতারগণ কোন বিশেষ যুগের বা বিশেষ মানব জাতির জন্য আসেন না, আসেন সকল কালের, সকল মানুষের পথপ্রদর্শক নবী-রসূল গয়গম্বর/ অবতাররূপে। গীতা ও কোরআন ভাষ্যে আমরা পৃথিবীতে ১ লক্ষ ২৪ হাজার পয়গম্বর/অবতার/বা ‘৩৩ কোটি’ (মতান্তরে ‘কোটি’ মানে প্রকার) দেবদেবীর সন্ধান পাই। দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালনের জন্য যুগে যুগে এঁরা এসেছেন। শাস্ত্র মত অনুসারে যুগে যুগে মোট ১০৪খানি গ্রন্থ/কিতাব (দৈবি কিতাব/অপৌরুষের বাণী) মানবজাতির কাছে স্রষ্টা/আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত হয়েছে যার মধ্যে প্রধান চারখানি— ক. তৌরাত (হিন্দু মতে ঋক/ব্রাহ্মণ বেদসহ (মুসার কালাম), খ. যবুর (দাউদের গান/Psalms of David), গ. ইঞ্জিল (যিশু/হজরত ঈসার কালাম (গান); হিন্দু মতে ‘যজু’ ও ঘ. ফুরকান/কুরআন (অথর্ব)। নামগুলি বিভিন্ন ভাষা বা ধর্মগ্রন্থের হলেও মূল অর্থ একই। তাঁদের আগমনের উদ্দেশ্য এক। তাঁদের প্রচারিত বাণীও এক ও অভিন্ন। কিন্তু এই অভিন্নতা কীভাবে প্রমাণ করা যায়? তা কি শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যায় সম্ভব? ফকীর লালন শাহ্ (১৭৭৪-১৮৯০) তাই যথার্থই প্রশ্ন তুলেছেন—

কী কালাম পাঠাইলেন
আমার সাঁই দয়াময়
এক এক দেশে এক এক বাণী
কোন্ খোদা পাঠায়।।
এক যুগে যা পাঠায় কালাম
আর যুগে তা হয় কেন হারাম
দেশে দেশে এমনি তামাম
ভিন্ন দেখা যায়।
যদি একই খোদার হয় বর্ণনা
তাতে তো ভিন্ন থাকে না
মানুষের সব রচনা
তাইতো ভিন্ন হয়।
এক এক যুগে এক এক বাণী
পাঠান কি সাঁই গুণমণি
মানুষের রচনা জানি
লালন ফকীর কয়।’

লালন শাহ্ যে সৃষ্টিকর্তাকে ‘সাঁই গুণমণি’ বলেছেন, যদি তিনি একই হন, তা হলে তাঁর বাণীতে এক এক দেশে এক এক যুগে এক এক রকমের হতে পারে না। লালন শাহের এই প্রশ্নের জবাব কী? আরও প্রশ্ন রয়েছে ঈশ্বর, ভগবান, আল্লাহ, খোদা, গড (God), জিহোবা ( Jahuwa ), আহুর মাজদা, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, কৃষ্ণ, মহেশ্বর, শিব–এ নামগুলি দ্বারা কি ভিন্ন কিছু বোঝা যায়? যদি এ নামগুলি একই গুণের আধার হয়ে থাকে তবে যুগে যুগে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মগ্রন্থে এ নামগুলি ভিন্ন ভিন্ন মানব সমাজে পরিচিতি লাভ করল কেন? তাহলে কি যুগের প্রয়োজন মেটাতেই স্থান-কাল পাত্র অনুযায়ী এ নামগুলির ভিন্নতা সৃষ্টি হয়েছিল? এর উত্তর যদি হ্যাঁ- বোধক হয়, তাতেও কি ঐ ভিন্নতা মানা যায়? তাহলে সকল মনোমালিন্যের সৃষ্টি কি এই নামের ভিন্নতা[২৩] থেকে? কেউ কেউ বলেন নামে কী আসে যায়, যাকে ডাকি সেই বুঝলে হয়। এ-প্রসঙ্গে কবি রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১) কাব্য করে

বলেছেন-

‘আমি কিন্তু ডেকেই বসি/যেটাই মনে আসুক না,
যারে ডাকি সেই তো বোঝে/আর সকলে হাসুক না।’

না, বিষয়টি হাসাহাসির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। এই হাসাহাসি[২৪] থেকেই পরিণামে ফাটাফাটি এবং খুনখারাপি পর্যন্ত ঘটছে। ‘ঈশ্বর-আল্লাহ’ আর ‘ভগবান-খোদা’[২৫] নিয়ে এই উপমহাদেশে জননেতাগণ যে ধস্তাধস্তি করে আসছেন তারই সুপরিচিত নাম ‘সাম্প্রদায়িকতা’। ইতিহাসে প্রমাণ আছে এই সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প স্ফীত করেছে ইংরেজ। ভারত শাসনের সমাপ্তিলগ্নে ইংরেজ বাঙালির সম্প্রদায়- সম্প্রীতি বিনষ্ট ও বিচ্ছিন্ন করে যে বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিয়ে গেল, সে বিষবাষ্পে বাঙালির মনুষ্যসত্তা হল দ্বিখণ্ডিত। ফাটল ধরল বাঙালির হরিহর আত্মায়। হিন্দু- মুসলিম বিদ্বেষের একটি প্রাতিষ্ঠানিক ও দীর্ঘস্থায়ী বীজ বপন করে ইংরেজ উপমহাদেশে যে-শিক্ষা পদ্ধতি চালু করল তাতে কেউ কেউ ভাবল ‘স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ।’ আর এই কুমন্ত্রণা এবং মোল্লা-পুরোহিতদের ব্যাখ্যায় মানুষের ধর্মবোধ আরো জটিল হয়ে উঠল। হিন্দু মুসলমানের এই জটিলতা এখনও কাটেনি। কেন কাটেনি? কেননা একাধিক ধর্ম জানা না থাকলে নিজের ধর্ম সম্পর্কেও যথার্থ উপলব্ধি যেমন সম্ভব নয়, তেমনি পরধর্ম সহিষ্ণু হওয়াও সম্ভব নয়। অবশ্য বৌদ্ধ খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সাথে হিন্দু-মুসলমানের এই জটিলতা ততটা বৃদ্ধি পায়নি। এর কারণ যতটা না হৃদয়িক তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক।

[২৩. সর্বশক্তিমান স্রষ্টাকে মানুষ বিভিন্ন নামে ডাকে। প্রাচীন পবিত্র গ্রন্থগুলোয় তাঁকে নানা নামে চিহ্নিত করা হয়েছিল, যেমন— ইয়াওবাই (Yahweh), যেহোভা (Jehovah), ইলোহিম (Elohim), ইলা (Elah) ইত্যাদি। কিন্তু বর্তমান ধর্মগ্রন্থগুলোয় এ নামগুলোর ব্যবহার লক্ষ করা যায় না। বর্তমান বাইবেল ও তাওরাত-এ মহান স্রষ্টাকে ইংরেজিতে গড (God), ফরাসি ভাষায় ডিউ (Dieu), স্পেনীয় ভাষায় ডায়ওস (Dios), জার্মান ভাষায় গট (Gott), গ্রিক ভাষায় থিওস (Theos ) এবং অন্যান্য ভাষায় অন্যান্য নামে অভিহিত করা হয়। উপরন্তু এ নামগুলোর কোনটিই ঐশী প্রত্যাদেশসঞ্জাত নয়। তাছাড়া এ নামগুলোর প্রত্যেকটির বহুবচন ও স্ত্রীলিঙ্গ রূপ রয়েছে। গডের বহুবচন গডস (gods) ও স্ত্রীলিঙ্গ গডেস (goddess), ডিউ- এর বহুবচন ডিউক্স (dieux) ও স্ত্রীলিঙ্গ ডেসে (deesse), ডায়ওস এর বহুবচন ডায়ওসেস (dioses) ও স্ত্রীলিঙ্গ ডায়ওসা (diosa), গট-এর বহুবচন গটার (gotter) ও স্ত্রীলিঙ্গ গটিন (gottin) এবং থিওস-এর বহুবচন থিওই (theoi) ও স্ত্রীলিঙ্গ থিয়া (thea)। হিন্দুধর্মে সৃষ্টিকর্তাকে ঈশ্বর, ভগবান, মহাদেব, ব্ৰহ্ম ইত্যাদি বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়। স্ত্রীলিঙ্গ-এ নামগুলো হচ্ছে যথাক্রমে ঈশ্বরী, ভগবতী, মহাদেবী, ব্রাহ্মী ইত্যাদি। কিন্তু সর্বশক্তিমান স্রষ্টা হচ্ছেন এক এবং তাঁকে পুং বা স্ত্রী লিঙ্গে ধারণা করা যায় না। অতএব বর্তমানে বিভিন্ন ভাষায় বর্ণিত উপরোক্ত কোন নামই মহান স্রষ্টার জন্য যথোপযুক্ত নয়।

সৃষ্টিকর্তার নাম সম্বোধনে স্বাতন্ত্র্যের কারণে সৃষ্ট এই সংঘর্ষ নিরসনে লেখক মণী ভৌমিক তাঁর Code Name God গ্রন্থে সকল ধর্মের অনুসারিদের জন্য স্রষ্টার নামকে de-code করে, অর্থাৎ একটি সার্বজনীন আদর্শে স্রষ্টার নাম মনোনীত করার প্রস্তাব করেছেন।

২৪. ধর্মবোধের এই দুর্বলতা ও অদূরদর্শিতা দেখে এক মৃৎশিল্পী স্রষ্টার কাছে যে- প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল, তার উত্তর এই রক্তাক্ত ভূ-পৃষ্ঠে আজো পৌছেনি। মৃৎশিল্পীর আক্ষেপ মিশ্রিত সেই প্রশ্নটি ছিল : হে প্ৰভু, আমিও একজন কলাকার তুমিও একজন কলাকার। তুমি আমার মত অসংখ্য পুতুল তৈরি করে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছ; আর আমি তোমার অসংখ্য মূর্তি তৈরি করে এই পৃথিবীতে বিক্রি করি। কিন্তু আমার হাসি পায় যখন দেখি তোমার তৈরি পুতুলগুলি নিজেরা মারামারি করে আমার পুতুলগুলির সামনে মাথা নত করে। (মোহাম্মদ আবদুল হাই, নির্বোধের ধর্মবোধ)।

২৫. সম্প্রতি মালয়েশিয়া সরকার সেদেশে অমুসলিমদের ‘আল্লাহ্’ শব্দ ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে।]

এই রাজনৈতিক ধাক্কায় রাম রহীম জুদা হয়ে গেল। বাংলাদেশ বিভক্ত হয়ে গেল পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা নামে। অবশ্য স্বদেশী আন্দোলনের ধাক্কায় সাময়িকভাবে এই বিভক্তির আপোষরফা হল। দুই বাংলা আবার মিলিত হল। কিন্তু দাগ রয়ে গেল। সেই দাগের সূত্র ধরে আবার বৃহত্তর ভারত দুই ভাগ হয়ে গেল। দ্বিজাতি তত্ত্বের ঝোলা কাঁধে নিয়ে জন্ম নিল দুইটি রাষ্ট্রের- ভারত ও পাকিস্তান। কিন্তু ‘পাকিস্তান’ রাষ্ট্র টিকল না। পূর্ব-পশ্চিমের তেলে জলে মিশল না। ভাষা ও সংস্কৃতির ব্যবচ্ছেদে বাধ্য হল বাঙালি। কেননা যারা জলপানে তৃপ্ত হল না তারা পানি পান করল; অনেকে মাংস ভক্ষণ না করে গোশত খাওয়া সমীচীন মনে করল। এই পানি গোশতের স্বতন্ত্র নাম দিল তারা ইসলামি সংস্কৃতি। মদনমোহন তর্কালঙ্কার (১৮১৭-১৮৫৮) প্রণীত ‘আমার পণ’– ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি/সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি…’ শিশু পাঠ্যে অন্তর্ভুক্ত এ কবিতার তারা ইসলামি রূপান্তর করে পড়ল ‘ফজরে উঠিয়া আমি দিলে দিলে বলি/সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি।’ আসলে তারা ভাল হয়ে কখনও চলেনি। ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যবোধে উজ্জীবিত হয়ে তারা সাহিত্যেও নানা ঐতিহ্যের পার্থক্য প্রকট করে তুলল। গৌরব-গর্বে তারা সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে হিরো নায়ক সন্ধানী হয়ে ওঠে। এভাবেই হিন্দুর গান্ধী, মুসলিমের জিন্নাহ; হিন্দুর মহাত্মা গান্ধী, মুসলিমের কায়েদে আজম; হিন্দুর রবীন্দ্রনাথ, মুসলিমের ইকবাল/নজরুল; হিন্দুর গান্ধী টুপী, মুসলিমের জিন্নাহ টুপী; হিন্দুর অবন ঠাকুর, মুসলিমের জয়নুল আবেদীন; হিন্দুর জগদীশ, সত্যেন বসু, মুসলিমের কুদরত-ই-খুদা; হিন্দুর বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়, মুসলিমের আলিগর বিশ্ববিদ্যালয়, হিন্দুর সুভাষ-আশুতোষ; মুসলিমের ফজলুল হক-সোহরাওয়ার্দী; হিন্দুর সুনীতিকুমার, মুসলিমের ডক্টর শহীদুল্লাহ এমনি ধরনের তুলনায় ও গুণী-মানি আবিষ্কারের নেশার ঘোরে মধুসূদনের পাশে কায়কোবাদ, বঙ্কিমচন্দ্রের পাশে মীর মশাররফ হোসেন; বিদ্যাসাগরের পাশে হাজী মহসীন; সত্যজিতের পাশে জহীর রায়হান প্রভৃতির গুণমান-মহাত্ম্য উচ্চকণ্ঠে উচ্চারিত হল ত্রিশোত্তর ব্রিটিশ আমলে, পাকিস্তান যুগের এবং একালের বাংলাদেশে। ফলে সমগোত্রের হয়েও ‘আল্লাহ্ হাফেজ’ ও ‘খোদা হাফেজ’ এর মধ্যেও সৃষ্টি হল অন্তর্দ্বন্দ্ব। আর এভাবে বাঙালি নিজেরাই নিজেদের জাতীয় জীবনে একটি গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি করল। সেটি হল আত্ম পরিচয়ের সংকট। তার আত্মজিজ্ঞাসায় প্রশ্ন উত্থাপিত হল : ‘আমি মুসলমান, না বাঙালি- না বাঙালি মুসলমান?’ প্রগতিশীল মুসলমানরা ভাবলেন মুসলিম হলে বাঙালি হতে বাধা নেই। কিন্তু রক্ষণশীল মনে রয়ে গেল দ্বিধা। কেউ বললেন, ‘আমি আগে মুসলমান পরে বাঙালি’। কেউ বললেন, ‘আমি আগে বাঙালি পরে মুসলমান’। এই ‘আগে- পিছে’র দ্বন্দ্বে বাঙালি ‘মুসলমানের’ কেটে যায় চব্বিশ বছর।

অতপর সামাজিক ও রাজনৈতিক মানচিত্রে জন্ম নেয় একটি নতুন দেশ— বাংলাদেশ। এই দেশে আছে আদিবাসী, বৌদ্ধ, হিন্দু, খ্রিষ্টান ও মুসলমান। কালের যাত্রাপথে এই জনপদ নাম পেয়েছে বঙ্গ, বাঙ্গালা, পূর্ব-বাংলা, পূর্ব পাকিস্তান হালে বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা— এই চারটি মূলনীতি নিয়ে জয়যাত্রা শুরু করলেও ‘৭৫-এর আগস্টের পর রাজনীতির পট পরিবর্তনে এ যাত্রা ব্যাহত হয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে জনমনে প্রচারিত হয় ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’। রাষ্ট্রীয় আবরণে এটি ‘দ্বি-জাতিতত্ত্বেরই’ এক নব সংস্করণ। ক্ষমতার পালাবদলে রাষ্ট্রে জাতীয়তাবাদের এরকম নতুন নতুন সংস্করণে বাঙালির আত্মপরিচয়ের সংকট আরও ঘণিভূত হয়।

বাঙালির আত্মপরিচয়ের সংকট শুরু হয়েছে সেই প্রাক্-দ্রাবিড় জনগোষ্ঠী থেকেই। এই জনপদের মানুষের সেই সংকট আজও কাটেনি। তারা বারবার প্রশ্ন করছে : আমরা কি বাঙালি? বাঙালি মুসলমান? বাংলাদেশী? নাকি শুধুই মুসলমান? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা এখনও চতুর্ধারায় বিভক্ত হয়ে আছেন। এঁরা বাঙালির ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম আর ভৌগোলিক সীমারেখার জটাজালে জড়িয়ে এই উপপাদ্যটির সমাধানে আজও একমত হতে পারেননি। আত্ম পরিচয়ের সন্ধানে কেউ ফিরে গেছেন মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমিতে ইসলামি রক্তবীজের উৎসবিন্দুতে। কেউ গেছেন রামায়ণ-মহাভারতের ঐতিহ্য ঘরানায়। আবার কেউ কেউ কলম পিষছেন বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক চেতনায়। তবুও আমাদের জাতীয়তাবাদের কোন মীমাংসিত কাঠামো আজও প্রতিষ্ঠিত হল না কেন? কারণ জাতীয়তাবাদ আর দেশপ্রেম এক বস্তু নয়; জাতীয়তাবাদ আরও বেশি রাজনৈতিক। তাই এখনও নতুন প্রজন্মের প্রশ্ন : আমরা কি ‘বাঙালি’ না— ‘বাংলাদেশী’? কোনটা সঠিক? বাঙালির জাতীয়তাবাদ ভাষাভিত্তিক, এবং আত্মরক্ষামূলক। কিন্তু বাঙালির ধর্মবোধের স্বরূপ উন্মোচিত হবে কীভাবে? সহনশীলতায়? সহমর্মিতায়? না জাতীয়বোধের ঐক্যসূত্রে? রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞায়, Nationalism is a political doctrine according to which people of the same language and culture should be grouped together as a nation। এখানে people of the same এর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তবে বাঙালির অন্তরে বাহির সম্প্রদায় নির্বিশেষে এ বিষয়টির উপলব্ধি আজ ও স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। আমরা কি স্মরণে আনি, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর (১৮৫৫- ১৯৬৯) ঢাকার একটি অভিভাষণে প্রদত্ত (১৯৪৮) সেই ঘোষণাটির কথা? যে ঘোষণার তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন : ‘আমরা হিন্দু মুসলমান যেমন সত্য। তার চেয়ে বেশী সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনও আদর্শের কথা নয়; এটি একটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে তা মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি- লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকবার জো-টি নেই।’ (পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে প্রদত্ত সভাপতির অভিভাষণ, ঢাকা, ৩১.১২.১৯৪৮)।

এই জনপদে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার উন্মেষ ও বিকাশের প্রেক্ষাপটে দেখা যাচ্ছে, সাধারণ মানুষের মাঝে যে-মানবিক বোধের পরিচয় পাওয়া যায়, সম্প্রীতি চেতনায় অদম্য আগ্রহ দেখা যায়, তা সুবিধাভোগী শিক্ষিত শ্রেণির মাঝে অপ্রতুল। বাঙালির সমাজ ও সাহিত্যের প্রতিনিধিত্বকারীদের কাছে সাধারণ মানুষের যে-প্রত্যাশা ছিল, তারা তা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। তাঁরা যদি তাঁদের ‘কীর্তি’র চেয়ে আরো একটু ‘মহৎ’ হতেন, উদার হতেন, মানবিক হতেন, তবে উপমহাদেশের এই দুই সম্প্রদায় সম্পর্কিত (উপরে বর্ণিত) অসহিষ্ণুতা ও স্বাতন্ত্র্য চেতনা সম্প্রসারিত হত না। এই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে পরবর্তী প্রজন্ম আরো অসহিষ্ণু হোক— নিশ্চয়ই আমরা সে প্রত্যাশা করি না। পরবর্তী প্রজন্মের এই হোক প্রতিজ্ঞা— ‘তোমাদের ভুলের মাশুল দিয়ে যে-শিক্ষা এই বাঙালি সমাজ পেয়েছে, তার পুনরাবৃত্তি আমরা হতে দেব না।’ ধর্মবেত্তারা স্বধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচারে নিজেদের গৌরব করবেন, সাহিত্যিকরা স্বাতন্ত্র্যবোধে উজ্জীবিত হয়ে আত্মমহিমায় উদ্ভাসিত হবেন, ধর্মদর্শনের সারমর্ম জেনেও ‘স্বধর্মে নিধানং শ্রেয়’কে পরধর্ম জ্ঞানে নিন্দা করবেন, সমাজবিজ্ঞানীরা প্রচলিত-আচরিত সমাজ শৃঙ্খলা নিয়ে তত্ত্বীয় আলোচনা করবেন, অচলায়তন ভাঙতে পারবেন না- সমাজ যে তিমিরে আছে সেই তিমিরেই থাকবে– এই অবস্থা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে নিশ্চয়ই গ্রহণযোগ্য হবে না। ‘পূর্ববিধানই চূড়ান্ত’ বিবেচনায় নব প্রজন্ম উদ্দীপত হবে— সমাজ প্রগতিশীল বিধানে তা বলে না। বাঙালির সামাজিক রাজনৈতিক মানচিত্রে প্রোথিত হবে সর্বধর্মীয় রঙিন পতাকা, মানুষের মধ্যে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা অপসৃত হয়ে নির্মিত হবে সম্প্রীতির বাতাবরণ, স্বাতন্ত্র্য চেতনার পরিবর্তে উজ্জীবিত হবে সর্বমানবিক বোধ। আর নয় পশ্চাতের প্রায়শ্চিত্তের পুনরাবৃত্তি।

নির্বাচিত গ্রন্থপঞ্জি

নজমুদ্দীন মুহম্মদ, মহাত্মা গান্ধীর ভ্রম বা হিন্দু মোসলেম আবার মিলন; যশোর, ১৯২৬

রাখাল চন্দ্র নাথ, উনিশ শতক : ভাব-সংঘাত ও সমন্বয়; কে.পি. বাগচী, কলিকাতা, ১৯৮৮

কানাই বসু, নোয়াখালির পটভূমিকায় গান্ধীজি; এস.কে. পালিত এণ্ড কোং, বাঁকুড়া, ১৯৪৭

শৈলেশকুমার বন্দোপাধ্যায়, জিন্না : পাকিস্তান, নূতন ভাবনা; মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, কলিকাতা, ১৯৮৮।

রমিলা থাপার, হরবংশ মুখিয়া ও বিপিনচন্দ্র পাল, সাম্প্রদায়িকতা ও ভারত ইতিহাস রচনা (Communalism and the writing of Indian History) গ্রন্থে তনিকা সরকার কর্তৃক ইংরেজি থেকে অনূদিত কে.পি. বাগচী এন্ড কোং, কলিকাতা, ১৯৭৬

অক্ষয়কুমার দত্ত, প্রাচীন হিন্দুদিগের সমুদ্র যাত্রা ও বাণিজ্য বিস্তার; (রজনীনাথ দত্ত কর্তৃক সটীক সম্পাদিত) সংস্কৃত প্রেস ডিপোজটরি কলিকাতা, ১৯০১

রামদাস সেন, ভারত-রহস্য (ভারতবর্ষের প্রাচীন ধর্ম ও যুদ্ধবিগ্রহের ইতিহাস); কলিকাতা, ১৮৮৫

উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, হিন্দুসমাজের ইতিহাস; শ্রীগৌরাঙ্গ প্রেস, গিরীন্দ্রনাথ মিত্র, কলিকাতা, ১৯৩৩

স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি, বাংলাদেশ মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা; ঢাকা, ১৯৮৯

গৌতম নিয়োগী, ইতিহাস ও সাম্প্রদায়িকতা; পুস্তক বিপণী, কলকাতা, ১৯৯১

গৌতম নিয়োগী, হিন্দুত্বের সংকট; মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রা. লি., কলকাতা ১৪১০ বঙ্গাব্দ

মফিজুল হক, সন্ত্রাসের ব্যাকরণ; জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০১২

অভিজিৎ রায়, বিশ্বাসের ভাইরাস; জাগৃতি প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৪

মোরশেদ শফিউল হাসান, ইসলাম ও মৌলবাদ : ধর্ম ও ধর্মের রাজনীতি; পাঠক সমাবেশ, ঢাকা, ২০১৫

ভবতোষ দত্ত, বাঙালির মানবধর্ম : কে পি বাগচি, কলকাতা, পু. মু. ২০১৬

Ali Dosty, 23 Years: A Study of the Prophetic Carreer of Muhammad (নবি মুহম্মদের ২৩ বছর/মুহম্মদের নবুয়তীর ২৩ বছর), ভাষান্তর : আবুল কাশেম, সৌকত চৌধুরী, রোদেলা প্রকাশী, ঢাকা ২০১৬

নূহ-উল-আলম লেনিন, বাঙালি সমাজ ও সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতা এবং মৌলবাদ; বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০১৬

মোহাম্মদ সাদউদ্দিন, ইতিহাস ও সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতা; শোভা প্রকাশ, ঢাকা, ২০১৭

মুনতাসীর মামুন, হিন্দু-মুসলমান বিরোধ : কাজী আবদুল ওদুদ; বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০১৭

ড. আলী রীয়াজ, সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ; অঙ্কুর প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৮

আবদুর রহমান আজাদ, ইসলাম নিয়ে সাম্প্রদায়িক বিতর্ক ও মুসলিম বিশ্ব; অঙ্কুর প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৮

এ.কে মনজুরুল হক, এজিদি ধর্ম; (দ্বি.স.) র‍্যামন পাবলিশার্স, ঢাকা, ২০১৮

সদর উদ্দিন আহ্মদ চিশতি, ইসলাম ধর্মে মতভেদের কারণ; সদর প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৯

সালাহউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ আমীরুল ইসলাম, কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়, আনিসুজ্জামান মানিক সম্পাদিত বাংলাদেশ বুদ্ধিবৃত্তি : ধর্ম-সাম্প্রদায়িকতার সংকট; জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০১৯

অশোক রুদ্র, ব্রাহ্মণ্য ভাবধারা ও আধুনিক হিন্দু মন; পিপলস বুক সোসাইটি, কলকাতা, চ.মু. 2005

শঙ্করনাথ রায়, ভারতের সাধক; করুণা প্রকাশনী, কলকাতা, প্র. প্র. ১৩৯২

ভারতের সাধক-সাধিকা, তুলিকলম, কলকাতা, দ্বা-মু, ২০১০

ড. স্বপন কুমার পোদ্দার, বাংলা নাটকে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক; (১৮৫২-১৯৬০)

অক্ষর পাবলিকেশনস, আগরতলা, ত্রিপুরা। প্র/প্র/২০১৭

প্রফেসর মো. আজিজুর রহমান লসকর, স্রষ্টা বিজ্ঞান ও ধর্ম; পাণ্ডুলিপি প্রকাশন, সিলেট, ২০১৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *