৮. ধর্মের নান্দনিকতা

অষ্টম অধ্যায় – ধর্মের নান্দনিকতা (The Aesthetics of Religions)

সৃষ্টি স্বাতন্ত্রে নান্দনিকতা

ঐতিহ্যগতভাবে নন্দনতত্ত্ব সৌন্দর্য নিয়ে আলোচনা করে, সৌন্দর্যের আদর্শ নির্ণয় করতে চায়, সৌন্দর্যের স্বরূপ উন্মোচন করতে চায় এবং সৌন্দর্যের আদর্শের আলোকে মানবাচরণ মূল্যায়ন করে। কেননা স্রষ্টার সৃষ্টি উপভোগে মানব মনে যে সৌন্দর্য চেতনার উন্মেষ ঘটে তা ধর্মোপলব্ধির বাইরের বিষয় নয়। যদিও এটি দর্শনেরই একটি অঙ্গরাজ্য। যেখানে জীবন ও জগতের বিশেষ করে সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, স্থাপত্য, নৃত্যকলা ও চারুশিল্পের নিহিতার্থের স্বরূপ বিচার করা হয় এবং মানব মনে সেগুলো থেকে প্রাপ্ত স্বরূপের মূল্যবোধের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণে ব্রতী হয়। নন্দনতত্ত্ব কেবল নান্দনিক অভিজ্ঞতা নিয়েই আলোচনা করে না, সঙ্গে সঙ্গে সে নান্দনিক, প্রত্যয়, নান্দনিক প্রতিক্রিয়া, নান্দনিক ধর্ম, নান্দনিক নীতি, নান্দনিক সুখ, নান্দনিক মূল্য, নান্দনিক মনোভাব, নান্দনিক ক্ষেত্র, নান্দনিক গুণ, নান্দনিক প্রত্যক্ষণ এবং নান্দনিক আদর্শ নিয়েও আলোচনা করে। সৌন্দর্য নন্দনতত্ত্বের অনুসৃত আদর্শ। ধর্মানুশলীনের মধ্যেও এই আদর্শ বিদ্যমান অনুসন্ধানী মনের কাছে নন্দনতত্ত্ব একটি বিস্ময়, একটি অন্তর্দৃষ্টির নাম।

সৌন্দর্যের বহু ও বিচিত্র সংজ্ঞার্থ রয়েছে। কখনো একে ‘সত্য’ হিসেবে, কখনো ‘আদর্শের প্রকাশ’ হিসেবে, কখনো ‘নান্দনিক বোধের জন্য পর্যাপ্ত ধর্মের সমন্বয়’ হিসেবে, কখনো বা ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’ (harmony in diversity), অথবা ‘স্বরূপত বস্তুর স্বতঃমূল্য’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। যখন এসব সংজ্ঞার্থের মধ্যে কোন ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা যায় না, তখনো বলা যায় যে, সৌন্দর্যের বোধ ও উপলব্ধি স্রষ্টার এক মহত্তম দান।

ধর্মের নান্দনিকতা আছে, কিন্তু সে সম্পর্কে বেশির ভাগ আলেম বা ধর্মবেত্তা অবগত নন। আমাদের ধর্ম অর্থাৎ ইসলাম যিনি প্রচার করেছেন তিনি সুন্দরের অনুরাগী ছিলেন। তিনি ফুল ভালবাসতেন, শিশুদের ভালবাসতেন, নারীকে ভালবাসতেন, সুগন্ধি ভালবাসতেন। তিনি ধর্মের বিধিবিধানকে, বিশেষ করে তাঁর নিজের জীবনচর্যাকে সাজিয়েছেন সুন্দরের নীতিতে। নামাজেরও নান্দনিকতা আছে, যা না হলে নামাজ সম্পূর্ণ হয় না। নান্দনিকতার সঙ্গে সৌন্দর্য এবং আনন্দের নিবিড় যোগাযোগ আছে। কিন্তু এ আনন্দ ও সৌন্দর্যের সঙ্গে স্বার্থের কোন লেনদেন নেই, যদিও মানুষ এ আনন্দ ও সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে। সুন্দর হতে গেলে প্রয়োজন রূপ, যা একটা কাঠামো হয়ে শূন্যতাকে অর্থময় করে। নন্দনশাস্ত্রের একটা বড় নীতি হচ্ছে অপ্রতিসমতা। সৃষ্টির কোন কিছুই একটি আর একটির মত নয় কিন্তু তবু তারা বিসদৃশ কিংবা কুৎসিত নয়। মানুষের মাথার একটি চুল অন্যটির মত নয়। প্রতিটি অনন্য। কিন্তু সব মিলে রূপময়, মোহনীয়। এই যে অসংখ্য বৃক্ষ, এদের একটি আরেকটির মত নয়। কিন্তু সব মিলিয়ে নয়নাভিরাম। আল্লাহ ও বৈচিত্র্যের দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে বলেছেন। যদি স্রষ্টার সৃষ্টির সব একইরকম হত তাহলে দৃষ্টি ক্লান্ত হত। কোরআনের বিভিন্ন স্থানে তাঁর আনন্দ, তাঁর রাগ, তাঁর অস্থিরতার প্রকাশ ঘটেছে। সাধারণ অনুবাদে তা ধরা পড়ে না। আর আমরা যারা অর্থ না বুঝে কেবল সুর করে কোরআন পড়ি, আমাদের কাছে ঐ মহান শিল্পী তো অপরিচিতই থেকে যান। আমরা কেবল স্বার্থপরের মত সওয়াব প্রার্থনা করেই ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করি কিন্তু এর মধ্যে ঐ শিল্পী যে আমাদের প্রাণভরে দেখতে বলছেন তাঁর শিল্পকর্মকে সেটা বেশির ভাগ মানুষেরই অজানা থেকে যায়। ইসলাম ধর্মে নান্দনিকতার বিষয়টি গুরুত্ব পেলেও এই ধর্মের ধর্মবেত্তা বা আলেমগণের নিকট বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত রয়ে গেছে। ইসলাম ধর্মে নান্দনিকতার বিষয়ে আলেম সমাজের জ্ঞানের অপর্যাপ্ততা বা অনীহা, যে কারণেই হোক না কেন, বিষয়টি সাধারণ মুসলমানগণের মধ্যে প্রচার পায়নি। ফলে ধর্মের মধ্যে যে নান্দনিকতা রয়েছে, এ কথাটি নিরানব্বই ভাগ মুসলমানের কাছে পাথরে প্রাণ থাকার মতই অবিশ্বাস্য মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। নান্দনিকতার বিষয়টি নামাজের সঙ্গে ও সম্পৃক্ত। মানুষ সৃষ্টিতে আল্লাহর এক বিস্ময়কর বৈচিত্র্যও প্রকাশিত হয়েছে। পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষের কারো সঙ্গে কারো চেহারার হুবহু মিল নেই। এমনকি প্রতিটি মানুষের কন্ঠস্বরেও রয়েছে স্বাতন্ত্র্য। এটিই হচ্ছে মানুষ সৃষ্টিতে আল্লাহর কারিগরি নৈপুণ্য বা নান্দনিকতা।

সর্বোপরি সৃষ্টি-স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিতকরণ পদ্ধতির অন্যতম ঐশী-নিদর্শন চিহ্ন অঙ্গুলিরেখায় (finger-print) স্রষ্টা প্রত্যেক মানবের হাতের অবয়বে আলাদা আলাদা স্বতন্ত্র রেখা সংযোজন করেছেন। যা সৃষ্টিজগতের পূর্বজাত এবং ভবিষ্যতে যত মানবপ্রাণ জন্ম নেবে তাদের প্রত্যেকের এই পদ্ধতি অব্যাহত থাকবে। আর এই স্বতন্ত্র সত্তার চিহ্নিতকরণ মেধাস্বত্ত্ব একমাত্র স্রষ্টার তাই সুপরিমিতভাবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির মধ্যে যে অপূর্ব নান্দনিকতা রয়েছে তা অবলোকন করে অভিভূত হয়েছেন ধর্মানুসারী ছাড়াও বহু চিন্তাশীল ব্যক্তি।

প্রাচীন মিশরের পিরামিডগুলো আত্মার পরলোকযাত্রা উপলক্ষেই নির্মিত হয়েছিল। ব্যাবিলনের বড় বড় টাওয়ারগুলোও (যা থেকে পরবর্তীকালে বাইবেল- এর টাওয়ার অফ ব্যাবেলের কল্পনা এসেছিল) মন্দির নির্মাণের জন্যই ব্যবহৃত হত। খ্রিষ্টপূর্ব গ্রিস ও রোমের যুক্তি ও বিজ্ঞানভিত্তিক সভ্যতায় ধর্মহীন অথবা ধর্মবিরোধী সাহিত্য ও দর্শনের অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু রোমক সাম্রাজ্যে খ্রিষ্টধর্ম প্রবর্তনের পর থেকে রেনেসাঁস ও রেফরমেশন পর্যন্ত বারো-তেরোশো বছর সমস্ত শিল্প-সাহিত্য ধর্মীয় প্রেরণা এবং ধর্মীয় বিষয়বস্তুকে নিয়েই গড়ে উঠেছিল। রেনেসাঁসের কাল থেকে ক্রমশ ধর্ম ছেড়ে মানুষ ও প্রকৃতিকে নিয়ে শিল্প-সাহিত্য গড়ে ওঠে। অষ্টাদশ শতাব্দীর জ্ঞানবাদী চিন্তাধারা এবং পরবর্তীকালের রোমান্টিক প্রবাহে ইউরোপীয় শিল্প-সাহিত্যের আরও মানবিক পরিবর্তন ঘটে। শিল্পবিপ্লব ও যন্ত্রসভ্যতার স্বরূপ এবং দুস্থ-দরিদ্র মানুষের জাগতিক দুর্দশা, যুদ্ধ এবং পৃথিবীর সাধারণ অমঙ্গল তখন থেকেই শিল্প-সাহিত্য-সংগীতের বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশেষত সমাজতান্ত্রিক চিন্তায় প্রভাবিত নান্দনিক কর্মকৃতিতে। অবশ্য পাশ্চাত্য জগতে নান্দনিক সংস্কৃতির ভিত্তি হিসেবে ধর্মের ভূমিকা এখনো গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ধর্মের উর্ধ্বলোক থেকে পৃথিবীর মাটিতে এবং মানুষের জীবনে এই সংস্কৃতির অবতরণ অনেক দিন আগেই আরম্ভ হয়েছে এবং ধর্মহীন নান্দনিক সংস্কৃতির কলেবর ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদিও এই সংস্কৃতিতে আদর্শহীন ব্যক্তিস্বার্থচেতনা এবং অন্তহীন ভোগবাদকে প্রশ্রয় দিয়ে পথভ্রষ্ট হবার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।

অজন্তা-ইলোরার স্থাপত্য-ভাস্কর্য-চিত্রকলা এবং ভারতের নাট্যশাস্ত্র থেকে যে নৃত্যগীত ও নাট্যশিল্পের পরিচয় পাওয়া যায়, তা থেকে মনে হয় যে প্রাচীন ভারতে নান্দনিক সংস্কৃতি ছিল প্রায় সম্পূর্ণই ধর্মভিত্তিক। প্রাথমিক পর্যায়ে বেদ-বেদান্ত- বেদাঙ্গের ধর্মীয় সাহিত্য ছাড়া আর কোন সাহিত্যের পরিচয় পাওয়া যায় না। পরবর্তীকালে বিশাখাদত্তের মুদ্রারাক্ষস, শূদ্রকের মৃচ্ছকটিকা, বিল্‌হনের চৌরপঞ্চাশিকা, কয়েকজন লেখকের ভাণিনাটক প্রভৃতি অল্পকিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বাকি সমস্ত সংস্কৃত সাহিত্যই রামায়ণ-মহাভারতের পৌরাণিক গল্প অথবা অন্যান্য ধর্মীয়-অলৌকিক বিষয়বস্তু নিয়ে রচিত। মধ্যযুগের ভক্তি আন্দোলনের ফলশ্রুতি হিসেবে যে সাহিত্যের সৃষ্টি হয়, তার মূল বিষয়বস্তু ছিল রাম এবং কৃষ্ণ অবতারে ভক্তি ও আত্মসমর্পণ। উত্তরমধ্যযুগের মোগল এবং রাজপুত চিত্রকলায় অবশ্য ধর্মহীন সংস্কৃতির কিছু পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ইউরোপীয় সংস্কৃতির প্রভাব অনুভূত হবার আগে পর্যন্ত হিন্দু শিল্প-সাহিত্য-নাটকে ধর্মহীন নান্দনিক সংস্কৃতির বিশেষ পরিচয় নেই। (জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায় / ‘ধর্ম, সংস্কৃতি ও অপসংস্কৃতি’)।

ইসলামি চিত্রকলায় নান্দনিকতা

স্থাপত্যকলার বিপরীতে ইসলামের চিত্রকলা, ভাস্কর্য এবং সংগীত নানাপ্রকার বাধা- বিঘ্নের সম্মুখীন হয়, যাকে যৌক্তিক এবং অযৌক্তিক উভয়ই বলা যায়। ইতিহাসে কোন আরব চিত্রকর অথবা আরব ভাস্করের নাম জানা যায় না, যদিও বহু গায়কের নাম লিপিদ্ধ আছে। পারস্য ও মুঘল চিত্রকলা বর্তমান বহুল পরিচিত এবং পাশ্চাত্যের জাদুঘরে এ সমস্ত চিত্রকর্ম সংগৃহীত রয়েছে এবং তা থেকে পারস্যের বিহ্যাদ এবং ভারতবর্ষের আবুল হাসান মনসুরসহ অসংখ্য স্বাক্ষরিত মিনিয়েচার দেখা যাবে। পাশ্চাত্যের প্রভাবে এ ধরনের পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে এবং আধুনিক শিল্পী ও ভাস্করের এমন কি গায়কের নাম ব্যাপকভাবে প্রচারিত হচ্ছে।

প্রাচীনকাল থেকে প্রত্যেক দেশেই শিল্পী চিত্রাঙ্কন করে আসছেন। এই শিল্পচর্চা চিত্রকলা অথবা ভাস্কর্য (three dimensional art) হতে পারে, যাতে জাদুর প্রভাব ছিল। শিল্পীর জন্য শিল্প—এই নীতির বশবর্তী হয়ে শিল্প যখন কোন বস্তু অঙ্কন করেন তখন তিনি কেবল সেই বস্তুকেই বিশ্বাস স্থাপন করে অর্থাৎ মৃত্যুর পর পুনঃজন্ম লাভ করবে (ইসলাম ধর্মের বিশ্বাসের মত)। যখন সমাধি দেওয়া হত তখন মৃতদেহের সাথে তাদের দৈনন্দিন ব্যবহার্য খাদ্যদ্রব্য অথবা খাদ্যদ্রব্যের স্থলে তাদের চিত্রাবলি সমাহিত করা হত। এর মূলে তাঁদের বিশ্বাস ছিল যদি প্রকৃত খাদ্যদ্রব্য নাও থাকে তবে সেগুলোর চিত্রাবলি সমান কাজ করবে।

প্রাচীন আরবগণ প্রাক্-ইসলামি যুগে বিগ্রহ পূজা করত (পৌত্তলিক)। এর প্রমাণ অসংখ্য মূর্তি অথবা প্রতিকৃতি, যা পাথর, কাঠ অথবা ধাতব পদার্থে দেখা যাবে। এগুলোর মধ্যে মক্কার কৃষ্ণপাথর (Black Stone) অন্যতম। বাগদাদের লেখক ইবনে আল-কালবী (মৃ. ৮১৯ খ্রি.) কিতাব আল আসমান (পুতুলগুলোর গ্রন্থ) নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। পবিত্র কুরআনে সাতটি মূর্তির কথা বলা হয়েছে, এগুলোর মধ্যে তিনটি দেবী, (যথা- আল-লাত, আল-মানাত এবং আল- উজ্জা), যাদেরকে ‘আল্লাহর কন্যা’ বলা হয়েছে; যদিও মক্কার কাবাগৃহের প্রধান মূর্তি হোবালের কথা বলা হয়নি। মুহম্মদ (স.)-এর জীবনী গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, ৬৩০ খ্রি. মক্কা বিজয়ের পর তিনি কা’বা ঘরে প্রবেশ করে তাঁর তরবারি বা বর্শা দিয়ে ৩৬০টি মূর্তিকে স্পর্শ করার সাথে সাথে সেগুলো মাটিতে পড়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। কা’বা ঘরের দেওয়ালে নবীদের যে প্রতিকৃতি অঙ্কিত ছিল সেগুলো জমজমের পানি দিয়ে মুছে ফেলা হয়। কেবলমাত্র একটি চিত্র অক্ষত অবস্থায় থাকে। সেটি যিশুখ্রিষ্ট এবং মেরীর ছবি, যা মুহম্মদ (স.) নিজের হাত দিয়ে ঢেকে রাখেন। (P.K. Hitti, History of the Arabs) ।

হিব্রুগণই প্রথম ঈশ্বরের নিরাকার ধ্যান-ধারণার জন্ম দেন এবং তাঁরা কোন প্রকার চিত্র বা প্রতিকৃতি অঙ্কনের বিরোধিতা করেন। হিব্রুদের এই মনোভাব ইসলামে চিত্রাঙ্কন বিরোধী অনুশাসনে কতটুকু প্রভাব ফেলেছিল তা সঠিকভাবে বলা যায় না। (পবিত্র কুর’আনে এ প্রসঙ্গে কোন স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা নেই) কোন কোন হাদিসে বর্ণিত চিত্রাঙ্কনের প্রতি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে তা জীবন্ত প্রাণীর প্রসঙ্গে, যা মানুষ অথবা জীবজন্তু হতে পারে। এই নিষেধাজ্ঞা উদ্ভিজ, লতাপাতা, অথবা যে কোন প্রকারের প্রাণহীন বস্তুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। ওল্ড টেস্টামেন্ট-এ বলা হয়েছে যে, ঈশ্বর মানুষকে তাঁর আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন বলে উল্লেখ আছে তাই সম্ভবত হাদিসে প্রতিফলিত হয়েছে। কিন্তু চিত্রাঙ্কনের ক্ষেত্রে মুসলিম ধর্মবেত্তাদের বিরোধিতার উৎস কুরআন। যদিও কুরআন স্পষ্টভাবে কোথাও চিত্রাঙ্কনে নিষেধাজ্ঞা প্রসঙ্গে বলা হয়নি। কুরআনের সুরা আল-মায়েদার ৫, ৯০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে : ‘হে বিশ্বাসীগণ, মদ-জুয়া প্রস্তর (আনসাব) এবং তীর নিক্ষেপ ভাগ্য নির্ধারণের জন্য যারা শয়তানের ঘৃণ্য কার্যকলাপের অন্তর্ভুক্ত’ ‘আনসাব’ প্রস্তর মূর্তিকে ইঙ্গিত করেছে, এতে চিত্রকলার প্রতি নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হয় না।

নিষেধাজ্ঞার মূলভিত্তি কুর’আনের ভাষা বা শব্দগত প্রয়োগের প্রয়াস। কুরআনে ‘সৃষ্টি করা’, ‘তৈরি করা’, ‘গঠন করা’ অথবা মূর্তি তৈরি করার কথা উল্লেখ আছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় : তিনিই মাতৃগর্ভে যেভাবে ইচ্ছা তোমাদের আকৃতি গঠন করেন। তিনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই; তিনি প্রবল পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়। (সুরা আলে-ইমরান, আয়াত ৬)।

‘নিশ্চয়ই আমিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করি, অতঃপর তোমাদের আকৃতি দান করি এবং তৎপর ফেরেশতাদেরকে আদমের নিকট নত হতে বলি; ইবলিস ব্যতীত সকলেই নত হয়। (যারা নত হল) সে (ইবলিস) তাদের অন্তর্ভুক্ত হল না।’ (সুরা আ’রাফ ৭, আয়াত ১১)।

আরবি ক্রিয়াশব্দ সৃষ্টি বা ‘সাওয়াব’ এবং এই মূলশব্দ থেকে উদ্ভূত ‘মুসাওয়িব’ (যার অর্থ চিত্রকর) শিল্পী কর্তৃক সৃষ্ট চিত্রকর্ম অথবা ভাস্কর কর্তৃক তৈরি মূর্তির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। উলামাগণ বলেন যে, মানুষ অথবা জীবজন্তুর প্রতিকৃতি অঙ্কন একমাত্র সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর এবং একমাত্র আল্লাহর অধিকার এবং এ অধিকারে হস্তক্ষেপ ধর্মদ্রোহিতার সামিল। নবী করিমের (স.) হাদিসে উল্লেখ আছে যে, যারা (চিত্রকরেরা) আল্লাহর সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে অনুকরণ করে তারা রোজ কিয়ামতে শাস্তি ভোগ করবে। তাঁর হাদিসের এই উক্তির সাথে তাঁর প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ সামঞ্জস্যপূর্ণ। একদিন মুহম্মদ (স.) দরজা খুলে তাঁর ঘরে প্রবেশ করার সময় দেখতে পেলেন যে, তাঁর স্ত্রী আয়েশা (রা.) চিত্রসম্বলিত একটি তালিকা কিনেছেন। এই চিত্র দেখে তিনি ঘরে প্রবেশ না করে বলেন, যে ঘরে চিত্র বা মূর্তি সম্বলিত ছবি থাকে সে ঘরে ফেরেশতা প্রবেশ করে না। একেশ্বরবাদের প্রতি কুরআনের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা ও সমর্থন এবং পৌত্তলিকতার প্রতি বারংবার নিষেধাজ্ঞা চিত্রকর্মের প্রতি ইসলামের বৈরী মনোভাবকে প্রতিষ্ঠিত করে।

চিত্রকলা এবং ভাস্কর্যের (Plastic art) প্রতি ইসলামি ধর্মবেত্তাদের নিষেধাজ্ঞা হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীর পূর্বে কার্যকরী হয়নি। তখন পর্যন্ত মদ্যপানের মত চিত্রকলার প্রতি নিষেধাজ্ঞা বা বৈরিতা কার্যকরী হয়নি। মুসলিম অভিজাতবর্গ (উমাইয়া আমলে) নিকটপ্রাচ্য সমাজে যখন বিলাসবহুল জীবনযাপন করেছিলেন তখন তাদের মধ্যে সুন্দর সৃজনশীল শিল্পকর্ম সৃষ্টির নেশা জাগে এবং তাঁরা তাঁদের অধীন প্রজাদের শিল্পকলার ক্ষেত্রে যে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা ছিল তা প্রয়োগ করে শিল্পচর্চায় পৃষ্ঠপোষকতা করেন। আব্বাসীয় খলিফা আল-মনসুরের গোলাকার বাগদাদ দুর্গের রাজপ্রাসাদের সবুজ রঙের গম্বুজের মাথায় একটি ঘোড়ার আকৃতিতে দিগনির্ণয় যন্ত্র ছিল। স্পেনের উমাইয়া খলিফা তৃতীয় আবদুর রহমান তাঁর সম্রাজ্ঞী জোহরার নামে কর্ডোভায় আল-জাহরা নামে যে রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেন তার সর্বোচ্চ শিখরে তাঁর স্ত্রী একটি ভাস্কর মূর্তি তৈরি করে স্থাপন করেন। মিসরের বিলাসপ্রিয় সুলতান খুমারাওয়াহ্ (৮৮৪-৯৫ খ্রি.), প্রাসাদে তাঁর এবং তাঁর স্ত্রীদের সোনার মুকুট পরিহিত অবস্থায় কাঠের প্রামাণ্য সাইজের ত্রি-মাত্রিক মূর্তি নির্মাণ করে স্থাপন করেন। ত্রিমাত্রিক ভাস্কর্য মূর্তিগুলো ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। যেখানে এগুলো ছিল তা ‘খোদাখানা’ বা সোনালি গৃহ নামে পরিচিত ছিল। খুমারাওয়াহ খুবই সৌখিন, বিলাসপ্রিয় ও অমিতাচারী শাসক ছিলেন। তিনি বহু অর্থ ব্যয়ে প্রাসাদের চত্বরে পারদের চৌবাচ্চা নির্মাণ করে সেখানে বিবাহ করতেন। কিন্তু প্রাসাদ, স্নানাগার ও জাগতিক ইমারতসমূহে চিত্রকলা ও ভাস্কর্যের নিদর্শন থাকলেও মসজিদে কখনো মানুষ অথবা জীবজন্তুর প্রতিকৃতি অঙ্কিত হয়নি। (ব্যতিক্রম রয়েছে কেবলমাত্র চীনের মসজিদে যেখানে ড্রাগনের মূর্তি দেখা যাবে) চিত্রকলা ও ভাস্কর্য কখনও ইসলাম ধর্ম প্রচার ও ভাবধারা প্রকাশের মাধ্যমে হিসেবে ব্যবহৃত হয়নি। যেমন বৌদ্ধ এবং খ্রিষ্ট ধর্মে প্রয়োগ করা হয়েছে। চিত্রকলা ধর্মবহির্ভূত শিল্পকলা হিসেবে মুসলিম বিশ্বে সমাদৃত হয় এবং সর্বত্র সুলতান এবং শাহজাদাগণ ছাড়াও ধনাঢ্য ও অভিজাতবর্গের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে।

চিত্রকলায় সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে বিশেষভাবে ক্ষুদ্রাকার পাণ্ডুলিপি চিত্রায়নে (miniature) প্রতিফলিত হয়। এছাড়া, দৈনন্দিন ব্যবহার্য দ্রব্যাদিতেও চিত্রকলা দেখা যাবে। ক্ষুদ্রাকার চিত্রাবলি মূলত ছিল পাণ্ডুলিপি ভিত্তিক। মিনিয়েচার চিত্রকলার দুটি প্রধান স্কুল ছিল—একটি পারস্যে, যাতে প্রতিকৃতির মুখাবয়বে চীনা- প্রভাব দেখা যাবে এবং অপরটি সিরিয়-ইরাকে (মেসোপটেমিয়), যা খ্রিষ্টান (বায়জানটাইন) প্রভাবে উদ্ভূত। সর্বপ্রাচীন আরবি চিত্রিত পাণ্ডুলিপি জ্যোতিশাস্ত্র সম্পর্কিত, যা একাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে রচিত হয়। পরবর্তী দুই শতাব্দীতে, ‘কালিলা-ওয়া-দিমনা’ এবং আল-হারিরি ‘মাকামাত’ পাণ্ডুলিপি অসংখ্য মিনিয়েচার চিত্রাবলি দ্বারা সমৃদ্ধ। এ সমস্ত চিত্রাবলি রঙিন এবং এগুলোতে মানুষ এবং জীবজন্তুর প্রতিকৃতি দেখা যাবে। জেকোবাইট এবং নেস্টোরিয়ান প্রার্থনা-গ্রন্থে যে চিত্রকর্ম রয়েছে তাদের সাথে ‘কালিলা-ওয়া-দিমনা’ অথবা মাকামাতের চিত্রাবলির স্টাইলে সাদৃশ্য রয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে মুসলমান শিল্পী অথবা পৃষ্ঠপোষকদের জীবন্ত প্রাণী অঙ্কনে বিবেকের দংশন থাকায় তারা ভিন্নধর্মাবলম্বী চিত্রকরদের প্রতিভাকে কাজে লাগান। মিনিচেয়ার চিত্রকর্মে পারস্যে মুসলিম শিল্পীগণ অসামান্য সাফল্য অর্জন করেন, যা সৃজনশীল শিল্পীদের (বিহ্যাদ, আগা মিরাক, সুলতান মুহম্মদ, আগা রিজা) প্রভৃতি চিত্রকর্মে প্রতিভাত এবং যা ইসলামি শিল্পকলায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান হিসেবে স্বীকৃত, স্থাপত্যকলার মত চিত্রকর্মে অন্য ধর্মের জনগোষ্ঠী ইসলামি শিল্পকলার প্রসারতায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

দৈনন্দিন ব্যবহৃত তৈজসপত্র ও অন্যান্য দ্রব্যাদিতে যে কারুশিল্প ব্যবহৃত হয় তা সৌখিন শিল্পের পর্যায়ে পড়ে। এর কারণ এ শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারেন বিত্তশালী বক্তিবর্গ। এই শিল্পের মাধ্যমে মুসলিম কারুশিল্পীগণ অসামান্য দক্ষতা, সৃজনশীলতা এবং অভিজ্ঞতা প্রদর্শন করেন, যা মৃৎপাত্রে, ধাতবপাত্রে, কাঁচশিল্পে ও বয়নশিল্পে প্রতিফলিত হয়েছে। ইসলামের আবির্ভাবের বহুপূর্বে পারস্য শিল্পীগণ নানা রঙ এবং নকশার সাহায্যে অসাধারণ শিল্পকর্ম সৃষ্টি করেন। ইসলামের আবির্ভাবের পরে প্রাক্-ইসলামি যুগের পারস্য শিল্পীগণ পার্শ্ববর্তী আরব শিল্পীদের শিল্পকর্মে অসামান্য প্রভাব ফেলতে সক্ষম হন। শুধু তাই নয়, তাদের সাথে সহযোগিতা করে কারুশিল্পকে উৎকর্ষতার চরম মার্গে নিয়ে যান, যা পূর্বে দেখা যায়নি। মধ্যযুগে মুসলিম মৃৎশিল্প রঙে এবং নকশার অপূর্ব সমন্বয়ে অলঙ্করণ অপূর্ব সৌন্দর্যে পরিণত হয়। উজ্জ্বল রঙের প্রয়োগে বর্ণাঢ্য মৃৎপাত্রে, যাতে মিনা করা পাত্রের গায়ে নকশা করা হয় এবং আগুনে পুড়িয়ে রঙের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করা হয় এসব শিল্পকর্মের নিপুণতায় মুসলিম কবিগণ অসাধারণ ও অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করে। যে সমস্ত মোটিভ তাঁরা ব্যবহার করেন তা মূলত লতাপাতা, ফল- মূল, জ্যামিতিক নকশা লিপিকলা এবং কখনও কখনও প্রতিকৃতি (এককভাবে নয়, লতাপাতা বা জ্যামিতিক নকশার সাথে জড়িয়ে)। পারস্য শিল্পীগণ দামেস্কে রঞ্জিত টালির ব্যবহার প্রচালন করেন। টালির সাথে মোজাইকের ব্যবহারে ইমারতের অভ্যন্তর ও বাইরের দৃশ্যাবলি খুবই আকর্ষণীয় হত। এ সময়ে টালির ব্যবহার ক্রমশ সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে বিস্তার লাভ করে। ফনেসীয় শহর টাইল এবং সিডনে, যেখানে রঞ্জিত কাচের পাত্র নির্মাণের কৌশল আবিষ্কৃত হয় সেখানে মিনা ও গিলটির কাজ পূর্ণাঙ্গতা লাভ করে। সিরিয়ার কাঁচপাত্র নির্মাণের সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে মসজিদের ঝাড়বাতি, গোলাকার নকশা (medallion) শিলালিপি এবং লতাপাতার মোটিভ। এ সমস্ত ঝাড়বাতি খ্রিষ্টান গির্জার বাতির মত ছাদের অভ্যন্তর থেকে শিকল দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হত।

কার্পেট বুনন ফেরাউনের মিশরে শুরু হয়ে ইসলামি যুগে এর উৎকর্ষ সাধিত হয়। মুসলিম যুগে কার্পেট নতুন বর্ণে ও মোটিভে শোভা পেতে থাকে। এ সমস্ত মোটিভের মধ্যে মৃগয়া এবং বাগানদৃশ্য প্রাধান্য পেয়েছে। কেবলমাত্র মিশরেই নয়, আরবদের আবির্ভাবের পূর্বে পারস্য এবং সমগ্র ‘উর্বর অর্ধ-চন্দ্রিমা’ (fertile crescent) অঞ্চলে বস্তুশিল্প ব্যাপক প্রসার লাভ করে। নানা বর্ণে ও মোটিভে তৈরি সিল্কের কাপড়, যা সিরিয়ার হস্তচালিত শিল্প হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে। ক্রসেডারগণ, পর্যটকবৃন্দ, তীর্থযাত্রীরা, ইউরোপে প্রচলিত করে, যেখানে এগুলোর অনুকরণ করে কাপড় তৈরি করা হয়। প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের জাদুঘরগুলোতে আব্বাসীয় যুগের ইরান, মিসরের ফাতেমীয় এবং সিরিয়ার মামলুকদের মনোমুগ্ধকর শিল্প নিদর্শনগুলো দর্শকদের প্রচুর আনন্দ দেয়। এ সমস্ত প্রদর্শিত বস্তুগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে আকর্ষণীয় বস্তু, কার্পেট, মৃৎপাত্র, মদের পাত্র, ধূপদান, যা পাখি অথবা অন্যান্য জীবজন্তুর আকৃতিতে নির্মিত মৃৎপাত্রের বাতি, থালা-বাটি ইত্যাদি এসব তৈজসপত্র উজ্জ্বল রঙের প্রলেপে খুবই আকর্ষণীয় এবং রংধনুর যে বর্ণাঢ্য চর্চা দেখা যায়, ধাতুর মিনাকরা পাত্রগুলো তেমনি রঙে উদ্ভাসিত।

মুসলিম শিল্পীবৃন্দ কেবলমাত্র মৃৎপাত্র উজ্জ্বল রঙের (lustre) ব্যবহারে কৃতিত্ব অর্জন করেন নি, উপরন্তু মিনা করার কৌশলের মান উন্নয়ন করেন। এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে, বিজ্ঞান এবং দর্শনে মুসলিম মনীষীগণ বহুপূর্বেই তাঁদের কৃতিত্বের স্বর্ণযুগে পৌছাবার পর এক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তি চর্চায় ভাটা পড়ে; কিন্তু এ মন্তব্য শিল্পকলা চর্চার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এক্ষেত্রে মুসলমানদের সৃজনশীলতা সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে অথবা নিষ্প্রভ হয়নি। শিল্পকলা চর্চার ক্ষেত্রে যারা এই ধারাকে সুদূরপ্রসারী করেন তারা আরব নন, তাঁরা তুর্কি অটমান, সেলজুক এবং মোঙ্গল (ইলখানী)। উল্লেখ্য যে, তৈমুরী সাফাভী বংশের রাজত্বকালে ইসলামি শিল্পকলার চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়।

আলঙ্কারিক শিল্পকলার নান্দনিকতা

ইসলামি শিল্পকলাকে প্রকৃত অর্থে আলঙ্কারিক শিল্প হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। এ কথাটি আরব শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আরব কবিদের মত আরব শিল্পীগণ তাদের শিল্পকর্মের উৎকর্ষতার জন্য প্রাথমিকভাবে ফর্ম (গঠন) পরিপাটি, এবং স্টাইলের (কৌশল) উপর নির্ভরশীল ছিল। অলঙ্করণই ছিল শিল্পপ্রতিভা বিকাশের মাধ্যম। আরব শিল্পীর প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে বিভিন্ন কর্ম ও স্টাইলের সাহায্যে এমন এক আলঙ্কারিক মোটিভ উদ্ভাবন করা যায় খুব উত্তেজনাকর বা উগ্র না হলেও সুষমামণ্ডিত। কবির মত শিল্পী তাঁর মোটিভের পুনঃব্যবহারে কুণ্ঠিত হতেন না। মূলত, একই মোটিভ ব্যবহার করাই ছিল তাঁর প্রধান কৌশল। কবিতার মত শিল্পকলায় আরব শিল্পীগণ কোন একটি বিশেষ মোটিভকে প্রাধান্য দিতেন, সমগ্র আলঙ্কারিক আঙ্গিককে নয়; যদিও সমগ্র দৃশ্যপটের মধ্যে এই একটি মোটিভ একটি ক্ষুদ্র অংশমাত্র। একটিমাত্র ক্ষেত্রে আরব শিল্পকলা আরবি কবিতা থেকে পার্থক্য হয়েছে। সেটা হচ্ছে আরব শিল্পকলার কোন একটি বিশেষ উৎস–যা দেশীয় নয়।

যে অলঙ্করণের রীতি আরব মুসলিমগণ উদ্ভাবন করেন পাশ্চাত্যে তা ‘অ্যারাবেস্ক’ নামে পরিচিত। সাধারণভাবে বিচার করলে প্রতীয়মান হবে যে, ‘অ্যারাবেস্ক’ বিষয়বস্তু এবং প্রতীকী হিসেবে বিশেষ কার্যকরী নয়। স্থাপত্যকলা, বস্ত্রশিল্প, মৃৎশিল্প, ধাতবপাত্র, কাচের তৈজসপত্র এবং গ্রন্থসমূহে ‘অ্যারাবেস্কের’ ব্যবহার নিছক অলঙ্কারিক। অষ্টম শতাব্দীতে উমাইয়া যুগে ‘অ্যারাবেস্কের’ আবির্ভাব হয় এবং পরবর্তীকালে হেলেনিস্টিক (করিন্থিয়) এবং পারস্য উপকরণ (seasoned) এতে সংযোজিত হয়। এরপর আব্বাসীয় খিলাফতে ‘অ্যারাবেস্ক ক্রক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আলঙ্কারিক মোটিভে পরিণত হয়। স্পেনসহ সমগ্র মুসলিম এলাকায় ‘অ্যারাবেস্ক’ বিস্তার লাভ করে। ‘অ্যারাবেস্কের’ প্রধান উপাদান হচ্ছে লতাপাতা, ফল-মূল, জ্যামিতিক নকশা এবং লিপিকলা অথবা শিলালিপি। এই তিনটি উপাদান একত্রীভূত, সন্নিবেশিত ও সমন্বিত হয়ে এক অপূর্ব আলঙ্কারিক প্যাটার্নে পরিণত হয়। কখনও কখনও (ধাতুর পাত্র বা স্টাকোর নকশায়) প্রাণীর (মানুষ বা জীবজন্তু) প্রতিকৃতিও দেখা যাবে। প্রতিকৃতিগুলো মৃগয়ার, ভোজ, খেলাধুলার (পোলো) দৃশ্য হয়ে থাকে এবং এগুলো গোলাকার নকশা (মেডালিয়ন) হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

উদ্ভিজ থেকে যে উপাদান গ্রহণ করা হয় তা অ্যাকানথাস, দ্রাক্ষাপাতা এবং ত্রি-পত্র (গ্রিক); এছাড়া টিউলিপ, গোলাপ এবং বাদাম ইত্যাদি প্রিয় ফুলসমূহ ব্যবহৃত হয়েছে। এ সমস্ত উপাদানগুলো কখনও হুবহু নকল করা হত না; কারণ সেগুলো দেখে মনে হবে অপ্রাকৃতিক এবং রূপান্তরিত ও গতানুগতিক, যাতে বাস্তবতার লেশমাত্র নেই। কোন কোন ক্ষেত্রে গ্রিক ক্লাসিক্যাল উদ্ভিজ (অ্যাকানথাস ও করিন্থিয়) থেকে হুবহু নকল বলে মনে হবে এবং তা এতই চিন্তাকর্ষক যে, মনে হবে হেলেনিস্টিক ঐতিহ্য বহন করে রয়েছে। তবে দ্বিতীয় উপাদান অর্থাৎ জ্যামিতিক নকশার ক্ষেত্রে একথা ঢালাওভাবে বলা যাবে না। জ্যামিতিক নকশাগুলো বিমূর্ত ধরনের। তৃতীয় উপাদান-আরবি শিলালিপি অথবা লিপিমালা মৌলিক, যা আলঙ্কারিক রীতিতে (বিভিন্ন লিপিকৌশল-কুফি, নাসখ, নাসতালিক, তুঘরা) প্রতিফলিত হয়েছে। আরবি হরফসমূহ এ ধরনের নকশা সৃষ্টিতে খুবই সহায়ক এবং একমাত্র চীনা অক্ষর ব্যতীত অপর কোন ভাষায় আরবি বর্ণমালার তুলনা হয় না। অপর কোন শিল্পকলায় লিপিকলা এরূপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেনি।

‘অ্যারাবেস্কের’ নকশা বিভিন্ন উপাদানের সংমিশ্রণে, পরস্পরের সাথে জড়িত হয়ে ছন্দায়িতভাবে প্রকাশিত হয়। বিমূর্ত জ্যামিতিকে নকশাগুলো ক্রমাগত পরপর ব্যবহৃত হয় এবং ঐন্দ্রজালিক প্যাটার্নের সৃষ্টি করে। জ্যামিতিক নকশার ব্যান্ডগুলো লতাপাতার সাথে জড়িত থাকে। জ্যামিতিক লতাপাতা এবং লিপিকলার নকশাবলি পরস্পরের সাথে জড়িত হয়ে অসংখ্য নতুন নতুন প্যাটার্নের সৃষ্টি করে। এই সৃষ্টির মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে একই মোটিভের পুনরাবৃত্তি। ‘অ্যারাবেস্কে’ আরবি হরফগুলোর আলঙ্কারিক বৈশিষ্ট্য ছাড়াও ধর্মীয় গুরুত্ব রয়েছে লতাপাতা ও জ্যামিতিক উপাদানে সৃষ্ট প্যাটার্নগুলো যখন দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলে এবং অসংখ্য বিমূর্ত নকশাগুলো তাকে যখন অনির্দিষ্ট স্থানে তার দৃষ্টি কেড়ে নেয়, তখনই দর্শক সম্বিত ফিরে পেয়ে কুরআন থেকে উদ্ধৃত আরবি লিপিমালায় দৃষ্টি নিবন্ধ করে। আরবি লিপিমালা, যা কুরআনের আয়াত, আল্লাহর নাম অথবা কবিতায় চয়ন হতে পারে, তাই ‘অ্যারাবেস্কের’ মূল ও স্থায়ী আকর্ষণ। মানুষের মূর্তি (যিশুখ্রিষ্টের ক্রসে বিদ্ধ প্রতিকৃতি) দিয়ে খ্রিষ্টান ধর্মের মূল বাণী প্রচারিত হয়েছে, যা পৌত্তলিকতা বিরোধী ইসলাম গ্রহণ করতে পারেনি। এজন্য ‘অ্যারাবেস্কের’ সৃষ্টি হয়েছে।

‘অ্যারাবেস্ক’ স্পেনে এবং গৌরবমণ্ডিত ঐতিহ্য স্থাপন করে এবং স্পেন থেকে এই অলঙ্করণ রীতি ইউরোপে প্রসারিত হয়। ইউরোপে এই রীতি ‘মরেস্ক’ (moresque)—মূল থেকে মরেস্ক, যেমন আরব থেকে ‘অ্যারাবেস্ক’ নামে বহুল পরিচিত। স্পেনিশ জাহাজগুলো নকল ‘অ্যারাবেস্ক’ বা আরবি হরফের ‘স্টাইলাইজড’ প্রকরণ এবং খ্রিষ্টান কুলজি সম্বন্ধীয় মোটিভ দ্বারা অলঙ্কৃত থাকত। সিসিলিতে আরবদের আগমনের পূর্বেই অসংখ্য আরবি লিপি অর্থ না জেনে অনুকরণ করে বিভিন্ন নকশায় ব্যবহৃত হয়। বিভিন্ন ধরনের রঞ্জিত টালিতে, যা এখনও স্পেন ও পর্তুগালে ব্যবহৃত হচ্ছে, ‘আজুলে জো’ (azulejo-al-zulayji) নামে পরিচিত। কাসকেট এবং হাতির দাঁতের বাক্স, যা খোদিত, মূল্যবান পাথরে শোভিত ও নানাবর্ণে রঞ্জিত, স্বর্ণালঙ্কারের কেস (jewel case) এবং সুগন্ধি রাখার পাত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্রাচ্যদেশীয় সিল্কের বস্ত্র, যাতে নানা রঙের বিভিন্ন ধরনের লতাপাতা এবং জ্যামিতিক নকশা দ্বারা শোভিত থাকত, (ইউরোপে) রাজন্যবর্গের পোশাক (কিংখাব), গির্জার আচ্ছাদন এবং সাধু-সন্ন্যাসীদের মূল্যবান স্মারকবস্তু রাখার থলে হিসেবে ব্যবহৃত হত। স্পেন ও সিসিলির অনুকরণের ফ্রান্স এবং ইতালিতে এবং বিশেষ করে রেনেসাঁর যুগে ইউরোপের সর্বত্র ব্যাপকভাবে ‘অ্যারাবেস্কের’ প্রয়োগ দেখা যায়। আর.ই.যাইরাযবয় তাঁর Oriental Influences in Western Art, New York, 19০5 – গ্রন্থে পাশ্চাত্য শিল্প মুসলিম শিল্পকলার প্রভাবের বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন যে, শিল্পী Fra Angelico এবং G Bellini তাঁদের চিত্রকর্মে প্রাচ্যদেশীয় পোশাক, কার্পেট বর্ডারের কুফী রীতিতে নকশাকৃত আরবি হরফ প্রভৃতি ব্যবহার করতেন। এমন কি লিওনার্দো ভিঞ্চিও ‘অ্যারাবেস্ক’ দ্বারা প্রভাবিত হন।

‘অ্যারাবেস্কে’ ব্যবহৃত হওয়া ছাড়াও লিপিকলা একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ শিল্পকলার মাধ্যমে হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে। লিপিকলার মর্যাদা নির্ভর করে আল্লাহর কালাম কুরআনের লিপিকরণে; যা আরবি ভাষায় নাজেল হয়েছে। শুধু তাই নয় আরবি লিপিকলা বা হস্তলিপি শিল্প কুরআনের আয়াতে সমর্থন লাভ করেছে-

‘নূন-শপথ কলমের এবং শপথ তারা যা লিপিবদ্ধ করে তার (কুরআন)’ (সূরা কলম ৬৮, আয়াত ১)।

‘পাঠ কর, তোমার প্রতিপালক, মহামহিমান্বিতের, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন।’ (৯ সুরা আলাক্, ৯৬, আয়াত ৩-৪)।

এভাবে আরবি লিপিকলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সমন্বিত শিল্পকলায় রূপান্তরিত হয়। লিপিকলার তাৎপর্য তখনই অনুধাবন করা যায় যখন দেখা যায় ৬৮ নম্বর সুরা কলম দিয়ে আল্লাহর বাণী লিপিবদ্ধ করা হয় তা তাঁরই শ্রেষ্ঠ দান, যা আল্লাহ প্রথম সৃষ্টি করেছেন। যুগ যুগ ধরে কুরআনের অনুলিপিকারীগণ বিশুদ্ধ ভাষায় শুধু অনুলিপি তৈরির প্রতিযোগিতা করতেন না বরং তাদের লিপিশৈলীর সৌকর্য ও লিপিত্বের দিকেও যথেষ্ট নজর দিতেন। যদি সঠিক ও সুচারুরূপে কুরআন লিপিবদ্ধ করা হয় তাহলে ধনাঢ্য ক্রেতাগণ উচ্চমূল্যে তা ক্রয় করতে দ্বিধা করতেন না।

আরবি শিলালিপির সর্বপ্রাচীন রীতি হচ্ছে কুফী, যার উৎপত্তি হয়েছে কুফানগরী থেকে। এটি কোণাকৃতি (angular) এবং এ কারণে পাঁচশত বছর ধরে এই রীতিতে কুরআনের অনুলিপি প্রস্তুত করা হয়। বক্রাকারে রীতি, যা ‘নাসখী’ নামে পরিচিত। (যার মূল শব্দের অর্থ অনুলিপি প্রণয়ন করা) কুফীর স্থান দখল করে এ দুটি লিপিশৈলী কুফী ও নাসখী আলঙ্কারিক নকশায় ব্যবহৃত হয়। আল- মামুনের রাজত্বকাল থেকে আরবী লিপিকারদের নাম আরবি সাহিত্যে সংরক্ষিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, লিপিকারদের নাম উল্লেখ থাকলেও চিত্রকর ও অন্যান্য শিল্পীদের নামে উল্লেখ পাওয়া যায় না। ইসলামি শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে একমাত্র লিপিকলায় আধুনিক লিপিকারেরা তাদের পুর্বসূরীদের অতিক্রম করতে সক্ষম হয়। কামাল আতাতুর্কের আবির্ভাবের পুর্বে তুরস্কে ‘তুঘরা’ নামে এক অপূর্ব লিপিশৈলী আবিষ্কার করে শুধু লিপিকলার মানই উন্নয়ন করেননি, বরঞ্চ সেগুলো সরকারি নথিপত্রে ব্যবহৃত হয়েছে।

সংগীতকলায় নান্দনিকতা

সংগীত মানবজাতির প্রাচীনতম বিদ্যা। ভারতীয় প্রাচীন সংগীতশাস্ত্রে এবং পুরাণসমূহে বর্ণিত হয়েছে যে, সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা মহাদেবের কাছ থেকে প্রথম সংগীত শিক্ষাপ্রাপ্ত হন। পরে তা তিনি ভরত, নারদ, রম্ভা, হু হু ও তুম্বুরু—এই পাঁচ শিষ্যকে শিক্ষা দেন। এঁদের মধ্যে ভরত মুনি দ্বারা পৃথিবীতে সংগীত প্রচারিত হয়। (কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায়, গীতসূত্রসার, পৃ. ৩২)।[২১] তবে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে শাঙ্গদেব রচিত সংগীতরত্নাকর গ্রন্থের মধ্য দিয়েই ভারতীয় সংগীতকলার কাঠামোগত আলোচনার সূত্রপাত ঘটে। এই গ্রন্থেই প্রথম সংগীতের নন্দনতাত্ত্বিক চিন্তা ও পর্যবেক্ষণমূলক বিশ্লেষণ পাওয়া যায়। সংগীত কী, কেমন, কীজন্যে, কীভাবে, কত প্রকারে এসব সব প্রশ্নের মীমাংসা করা হয়েছে এখানে। অর্থাৎ সংগীত বিষয়ক যাবতীয় পারিভাষিক শব্দ, রাগ, রূপবদ্ধ ও গঠনপ্রক্রিয়া ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ের সংজ্ঞার্থ দেওয়া হয়েছে। এতদ্ভিন্ন এসব বিষয়ের বিস্তারিত আলোচনা উপস্থাপিত হয়েছে। প্রকৃত সন্ধিৎসায় দেখা যায়, চতুর্থ শতাব্দী থেকেই সংগীত বিষয়ে নানা গ্রন্থ রচিত হতে শুরু করে। আর প্রবন্ধ সংগীতের বর্গীকরণের কাজ শুরু হয় এর পূর্ব থেকেই। এই ধারাবাহিকতায় ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী, শৌরীন্দ্রমোহন প্রমুখ যখন উনিশ শতকে এসে সংগীতগ্ৰন্থ রচনায় আরও বিস্তার ও বিস্তৃতি ঘটান, তখন এঁদের চিন্তা, আলোচনা ও বিশ্লেষণে সংগীতে আধুনিক নন্দনচিন্তা অনুগামী হয়ে ওঠে। ভারতীয় সংগীতকলার উদ্ভব ও বিকাশের এই সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্তের সঙ্গে বিশ্ব সংগীতকলার উদ্ভব ও বিকাশের ইতিবৃত্ত এক সূত্রে গাথা নয়। এরও রয়েছে ধর্মীয় ও সমাজতাত্ত্বিক নানা ঐতিহাসিক পরম্পরা। এই প্রেক্ষিতেই দেখা যায়, গ্রিক, মিশর, তুরস্ক পারস্য, আরবী প্রভৃতি জাতির মধ্যে সংগীতকলার উদ্ভব ও বিকাশে ধর্মীয়চেতনায় সাযুজ্য এবং স্বাতন্ত্র্য থাকলেও এর নান্দনিকচেতনা স্ব স্ব ধর্মদেশনা থেকেই উৎসারিত।

[২১. অবশ্য ইসলামের অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, মুসলিম সংগীত কলার সূত্রপাত ঘটে ‘কাইনা’ হত্যার শোকগাথা থেকে। আদি মানব হজরত আদম (আ.) এর সন্তান ‘কাইন’-এর ভ্রাতা আবেলকে হত্যা করেছিল। মানব ইতিহাসে এটাই ছিল সর্বপ্রথম নরহত্যা। ঐতিহাসিক মাসুদী লিখেছেন, আরবদের ধারণা কাইনের ছেলে ‘জুবাইল’ প্রথম সংগীত রচনা করেন। ওই সংগীত ছিল মৃত্যু সম্পৰ্কীয় শোকগাথা। কাইনের কন্যারা বাদ্যযন্ত্র আবিষ্কার করেন। পারিবারিক শোকাবহতার সূত্রেই তারা সংগীতে অনুরক্ত ছিল। সেই থেকেই এই প্রাচীন ঐতিহ্যের গায়িকা গোষ্ঠিকে বলা হয় ‘কায়না’ বা কাইনা। পরবর্তীকালে এই ইতিহাস ধারায় যুক্ত হয় আরেক শোকাবহ ঘটনা কারবালায় ইমাম হোসেন (রা)-এর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড পরবর্তী সৃষ্ট শোকগাথা ‘মর্সিয়া’ সংগীত।]

সুললিত শব্দ ও সুসজ্জিত ছন্দ প্রয়োগে যে সংগীতচর্চা করা হয় তা প্রাচীনকাল থেকে আরবদেশে বিদ্যমান ছিল। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, অপরাপর সেমেটিক জাতির মত আরবদের সংগীতের তত্ত্ব এবং প্রয়োগ সম্বন্ধে জানা ছিল, যদিও এ সম্বন্ধে বিশেষ বিবরণ পাওয়া যায় না। মুহম্মদ (স)-এর আবির্ভাবের পুর্বে হেজাজে সংগীতের ব্যাপক চর্চা ছিল। এর প্রধান কারণ ছিল এই যে, হেজাজ পার্শ্ববর্তী হিরা এবং গাস্সান রাজ্যের সংগীতসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রভাবের আওতায় পড়ে। হিরা ও গাস্সান রাজ্যের সংগীতসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রভাবের আওতায় পড়ে। হিরা ও গাস্সান রাজ্য দুটি পারস্য এবং সিরো-বায়জানটাইন সাম্রাজ্যের পার্শ্ববর্তী থাকায় এ দুটি রাজ্যের সংস্কৃতির বিকাশে বৈদেশিক প্রভাব থাকা খুবই স্বাভাবিক।

মদ, নারী এবং সংগীত আরব বেদুঈনের উপভোগের তিনটি প্রধান উপকরণ ছিল। হেজাজে স্থায়ীভাবে বসবাসকারীদের বাদ্যসহকারে গান এবং সংগীত সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল। উকাযের বাৎসরিক মেলা এবং কা’বার তীর্থ পালনের সাথে গান-বাজনা ও সংগীত ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। ওহি লাভের পূর্বে মুহম্মদ (স.) এ সমস্ত গান ও সংগীত অংশগ্রহণ না করলেও স্বচক্ষে এগুলো দেখেছেন। কাফেলায় যাবার সময় (‘হুদা’) ভ্রমণকারীগণ সকলে মিলে এক ধরনের সংগীতে অংশগ্রহণ করতেন ভ্রমণের ক্লান্তি দূর করার জন্য। এছাড়া প্রাক্-ইসলামি যুগে ভ্রমণের ক্লান্তি দূর করার জন্য পেশাদার গায়ক ছিলেন। এছাড়া প্রাক্-ইসলামি যুগে পেশাদার গায়ক ছিলেন যাদের মধ্যে অধিকাংশ ছিলেন মহিলা ও দাসী। মহিলারা বদর ও উহুদের যুগে গান গেয়ে মুসলিম যোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা জোগাতেন। তারা প্রাক্-ইসলামি যুগের ঐতিহ্য অনুসরণ করেন।

তৎকালীন আরবে ‘হিন্দা’ (উটচালকের গান), ‘গিনা আর-রুকবান’ (‘নাস্ব’ সংগীত শৈলীর একটি প্রকরণ/যুবক শ্রেণির গান), ‘গিনা আল-মুতকান’ (শৈল্পিক সংগীত) প্রভৃতির ব্যাপক প্রচলন ছিল- যার অনেক ঐতিহ্য আজও অবশিষ্ট আছে।

সংগীতের প্রতি মুহম্মদ (স.)-এর মনোভাব কীরূপ ছিল তা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। তাঁর সাহাবীদের মধ্যে থেকে পৌত্তলিকতার সকল চিহ্ন দূর করার জন্য তিনি সংগীতের প্রতি নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। মূলত, জাহেলিয়া যুগের যে সমস্ত রীতি, আচার-অনুষ্ঠান ছিল, যা পৌত্তলিকতার প্রতীক, তা তিনি বর্জন করার নির্দেশ দেন। কুরআনে কবিতার প্রতি প্রচণ্ড নিন্দার মূলেও একই কারণ। আরব কবিদের শুধুমাত্র কবিই বলা যাবে না, প্রথাগতভাবে তারা গায়কও বটে। তিনি কখনও কখনও তাঁর কবিতা থেকে এক বা দুটি চরণ আবৃত্তি করতেন অথবা কখনও কখনও সুমিষ্ট স্বরবিশিষ্ট কোন ব্যক্তিকে সংগীতের সুরে তার কবিতা আবৃত্তি করতে বলতেন। হিট্টি বলেন সংগীত এবং কবিতা মুহম্মদ (স.)-এর মানসপটে সবসময় প্রতিভাত ছিল। কুরআনের কোন সুরায় সংগীত সম্বন্ধে উল্লেখ পাওয়া যায় না। কোন কোন উৎসাহী ধর্মবেত্তাগণ কুরআনের নিম্নলিখিত আয়াতে সংগীত সম্বন্ধে কিছু সমর্থন দেখিয়েছেন :

‘মানুষের মধ্যে কেউ কেউ অজ্ঞতাবশত আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করার জন্য অসার বাক্য বেছে নেয় এবং আল্লাহ প্রদর্শিত পথ নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে। তাদের জন্য রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি।

যখন তার কাছে আমার আয়াত আবৃত্তি করা হয় তখন সে দম্ভভরে মুখ ফিরিয়ে নেয় যেন সে তা শুনতে পায়নি, যেন তার কান দুটি বধির। অতএব তাদের মর্মন্তুদ শাস্তির সংবাদ দাও।’ (সুরা লুকমান ৩১; আয়াত ৬-৭)।

অন্যান্য ধর্মবেত্তাগণ এ ধরনের ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান করেন এ কথা বলে যে, এই আয়াতে যা বলা হয়েছে তা প্রাচীন পারস্যের গল্পসমূহ, সংগীত প্রসঙ্গে কিছুই বলা হয়নি।

কুরআনে সংগীত সম্বন্ধে কিছু বলা না হলেও হাদিসের বিভিন্ন উৎসে নিষেধাজ্ঞা সম্বন্ধে স্পষ্ট ভাষায় তা ব্যক্ত করা হয়। একাধিক হাদিসে সংগীতের বিরোধীগণ তাদের সমর্থনে নিষেধাজ্ঞা সম্বন্ধে যুক্তি পান। এমন একটি সহী হাদিস আয়েশা (রা.) (নবী করিমের স্ত্রী) বর্ণনা করেন। একটি হাদিসে বলা হয়েছে : ‘বাদ্যযন্ত্র শয়তানের মু’য়াজ্জিন’ (অর্থাৎ সংগীত শয়তানের কাজ) পরবর্তী পর্যায়ে চারটি গোঁড়াপন্থী সুন্নী মাজহাব (উদারপন্থী ও রক্ষণশীল)-হানাফী, মালিকী, শাফি এবং হাম্বলী)। শুধু সংগীত—গান-বাজনাকেই (আল-সামা) নিষিদ্ধ করেননি, সংগীত শ্রবণকেও হারাম বলে ঘোষণা করেন। উল্লেখ্য, ধৰ্মীয় সংগীত, যেমন- জালালুদ্দীন রুমীর মৌলভী গোষ্ঠী নৃত্য ও গীতের সাথে গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে জিকির করেন, যা ‘দরবেশ নৃত্য’ নামে পরিচিত। এছাড়া, হামদ ও নাত, মর্শিয়া, জারি-সারি আল্লাহর বন্দনার জন্য করা হয়।

গানের প্রতিক্রিয়া নির্ভর করে গায়ক ও শ্রোতার উপর। সংগীত রক্তকে করতে পারে উষ্ণ ও উত্তেজিত। জীবনকে করতে পারে উচ্ছৃঙ্খল। অন্য দিকে মহৎ সংগীত চরিত্রকে দিতে পারে মাধুর্য ও পবিত্রতা। গানের প্রতি আকর্ষণ কাউকে প্রদান করে সাফল্য, মহত্ব এবং সৌন্দর্য। অন্য কারো জীবন পর্যবসিত বিফলতা ও ব্যর্থতায়। স্বর্ণকার সোনা দিয়ে অলঙ্কার গড়েন। এই অলঙ্কারের জনপ্রিয়তা নারী মহলে সর্বত্র। গানের ভুবনে সংগীতজ্ঞ স্বর্ণকারসম। স্বীয় গানের সুর নিজের ইচ্ছামত পরিবর্তন করা যায়। যেমন, স্বর্ণকার সোনার গয়নার ডিজাইন পরিবর্তন করেন।

কিন্তু আইন প্রয়োগকারী ব্যক্তিবর্গ ইসলামি শরিয়ত বিবর্জিত কার্যকলাপে জড়িত হয়ে পড়েন। এই অবস্থার সূচনা করেন অধার্মিক জোরদখলকারী উমাইয়া খলিফাগণ। শিয়া গোষ্ঠী এবং আব্বাসীয় গ্রন্থকারেরা উমাইয়াদের এই ধরনের অপবাদ দেয়। ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ, বিশেষ করে নাচ-গান-সংগীতের চর্চা শুরু হয় দ্বিতীয় উমাইয়া খলিফা প্রথম ইয়াজিদের (৬৮০-৮৪ খ্রি.) শাসনামলে; যার মাতা ছিলেন একজন খ্রিষ্টান। ইয়াজিদের রাজদরবারে নর্তক-নর্তকী ও গায়ক-গায়িকার সমাবেশ ঘটে। এদের মধ্যে অনেকে যুক্ত ছিলেন; আবার অনেকে দাস-সাদী ছিলেন। সংগীতচর্চা তাঁর উত্তরাধিকারীদের সময় একটি দরবারী রেওয়াজে পরিণত হয় এবং তাঁদের মধ্যে একজন সংগীত শ্রবণকে জীবনের সত্যিকারের সর্বশ্রেষ্ঠ আনন্দ হিসেবে মনে করেন। উমাইয়া খিলাফতে সংগীতচর্চা অব্যাহত থাকে। প্রথম ইয়াজিদ ছাড়াও আল-ওয়ালিদের দরবারে মাবাদ এবং ইবনে সুরাইজ নামে দুজন গায়ক বাস করতেন। দ্বিতীয় ইয়াজিদের হাবাবা এবং সুল্লামা নামে দুজন গায়িকা ছিল। খলিফা দ্বিতীয় ওয়ালিদ বাঁশী বাজাতে পারতেন এবং সংগীতের পৃষ্ঠপোষকতা করেন।

আব্বাসীয় খিলাফতের প্রথম দিকে সংগীতের প্রতি উদার পারস্য প্রভাবের ভাটা পড়ে। কোন কোন ধার্মিক রক্ষণশীল খলিফা দরবারে সংগীতচর্চা নিষিদ্ধ করেন। কিন্তু সংগীতের যে ঐতিহ্য বহু যুগ ধরে চলে আসছিল তা পুনরায় বলবৎ হয় এবং তা ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে। দরবারেও অভিজাতবর্গের প্রাসাদে কোন বাঁধ বা বাধাই এই স্রোতকে থামাতে পারেনি। সংগীত শ্রবণের বিরুদ্ধে যে নিষেধাজ্ঞা ছিল তা পালন অপেক্ষা অধিক লঙ্ঘিত হতে থাকে। (Henry Y. Farmer, A History of Arabian Music, London, 1929 P. 31 )।

হারুন আল-রশিদ এবং তাঁর দুই পুত্র ও উত্তরাধিকারী আল-আমিন এবং আল-মামুনের রাজদরবারে অনেক খ্যাতিমান সংগীতজ্ঞ বাস করতেন। তাঁরা কেবলমাত্র গায়কই ছিলেন না, তাদের মেধার পরিচয় পাওয়া যায় সংগীতের বিভিন্ন তাত্ত্বিক বিষয়ের আলোচনা সম্বলিত গ্রন্থাবলিতে। শুধু তাই নয়, তাঁরা গান ও কবিতা রচনা করে যশস্বী হয়েছেন। এছাড়া বহু মনীষী বসবাস করতেন। আব্বাসীয় দরবারে যারা বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা ও সুকুমার শিল্পে দক্ষ ছিলেন তাঁদের কবিতায় বহু প্রাচীন ঘটনা ও স্মৃতিকথার উল্লেখ পাওয়া যায়। অসাধারণ মেধাসম্পন্ন ও সমস্ত গায়কদের কাহিনি বলার ক্ষমতা এবং মদ্যপানের মাত্রার উপর নির্ভর করত তাদের সাথে খলিফার সঙ্গী হিসেবে থাকার যোগ্যতা। সংগীতজ্ঞদের পরে স্থান ছিল বাদকদের, যারা মোটামুটি সকলেই বীণাবাদক ছিল। যারা Viol বা বড় বেহালা বাজাত তাদের সামাজিক মর্যাদা ছিল নিকৃষ্ট। মহিলা গায়কদের উচ্চদামে ক্রয় করে দরবারে আনা হত এবং তাঁদেরকে হারেমের ‘অলঙ্কার’ বা রত্ন বলা হত। কোন কোন গায়িকা খুবই মেধাসম্পন্ন ছিলেন এবং তাদের স্মৃতিশক্তি এতই প্রখর ছিল যে, তাঁরা হাজার হাজার কবিতা ও গান আবৃত্তি করতে পারতেন। বাগদাদের রাজদরবারে বসবাসকারী গায়ক-গায়িকাগণ পরবর্তীকালে আরোব্যপন্যাসের (আরব্য রজনী) বহু কাহিনীর নায়ক-নায়িকা ছিলেন। আরব্য রজনী ছাড়াও কিতাবুল আগানীতে (সংগীতের গ্রন্থ, ২১ খণ্ড) এ ধরনের বহু ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। কিতাবুল আগানী দশম শতাব্দীর মধ্যভাগে আল-ইসফাহানী রচনা করেন। এছাড়া, আল-ইসফাহানীর সমসাময়িক কবিতা-সাহিত্যিক ইবনে আরব-রাব্বি, আল-ইকদ আল-ফরিদ (অতুলনীয় গলার হার, ৪ খণ্ড) নামে গ্রন্থ রচনা করেন, যাতে রাজদরবারে বহু কাহিনি ও ঘটনা রূপকথার উল্লেখ পাওয়া যায়। একটি কাহিনীতে বর্ণিত আছে যে, খলিফা হারুন আল-রশিদের পৃষ্ঠপোষকতায় দু শত গায়ক ও সংগীতজ্ঞ এটি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। আল-আমিনের দরবারে এক হাজার গায়ক-সংগীতবিশারদ অংশগ্রহণ করেন। কথিত আছে, এ ধরনের নাচ ও গানের অনুষ্ঠানে খলিফা আল- আমিন তাঁর পরিবার-পরিজন নিয়ে সমস্ত রাতব্যাপী অংশগ্রহণ করেন।

কবিতা ব্যতীত অপর কোন শিল্পকলা চর্চার ক্ষেত্রে আরব ইতিহাস অধিক গায়ক ও সংগীত শিল্পীদের নাম উল্লেখ রয়েছে। দুটি নাম সংগীতচর্চার ক্ষেত্রে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত ভাস্কর হয়ে রয়েছে— তাঁরা হচ্ছেন ইব্রাহিম আল-মাওসিলি এবং তাঁর পুত্র ইসহাক। আরব সংগীতের শুরু ইব্রাহিম ৭৪২ খ্রিষ্টাব্দে মসুলে জন্মগ্রহণ করেন (তার উপাধি এজন্য মাসিলি) এবং তিনি পারস্য বংশোদ্ভূত ছিলেন। তিনি যখন যুবক তখন তাঁকে হরণ করা হয় এবং বন্দী অবস্থায় তিনি দস্যুদের সংগীত (brigand song) শিখেন। আরব ঐতিহ্যবাহী গ্রন্থে বর্ণিত রয়েছে যে, তিনিই প্রথম একটি জাদুদণ্ড (wand) দিয়ে সংগীতের ছন্দপতন করতে সক্ষম। তাঁর সংগীতের প্রতি এরূপ সূক্ষ্ম অনুভূতি ছিল যে, তিরিশজন বীণাবাদকদের মধ্যে ভুল সুর বাদ্যকারী এক মহিলাকে তিনি সহজে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। হারুন যখন তাঁকে তাঁর মধ্যপানের সাথী (cup companion ) হিসেবে গ্রহণ করলেন, তিনি তাৎক্ষণিকভাবে তাঁকে (ইব্রাহিম) ১৫০,০০০ দিরহাম দেন। এছাড়া, তাঁর মাসিক ভাতা নির্ধারিত হয় ১০,০০০ দিরহাম। মাত্র একটি গান রচনার জন্য খলিফা একবার তাঁকে ১,০০,০০০ দিরহাম পুরস্কার দেন। ইব্রাহিম ৮০৪ খ্রিষ্টাব্দে বাগদাদে মৃত্যুবরণ করেন।

ইব্রাহিম আল-মাওসিলির পুত্র ও শিষ্য ইসহাক (৭৬৭-৮৫০ খ্রি.) তাঁর পিতার অসামান্য মেধা উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেন এবং সংগীতে তাঁর অসাধারণ প্রভাবের ফলে কৃতিত্বের দিক থেকে পিতাকে ছাড়িয়ে যান। সে যুগের সংগীত বিশারদ-গায়কদের কর্ণধার হিসেবে ইসহাক আরব ক্ল্যাসিক্যাল সংগীতকে মুল ধারাতে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর পিতা যেমন— হারুন, আল-আমিন এবং আল- মামুনের সভায় সুবিখ্যাত গায়ক ছিলেন, তেমনি ইসহাক আল-মামুন এবং আল- মুতাওয়াক্কিলের দরবারে সংগীতচর্চা করতেন। শুধু তাই নয়, তিনি খলিফাদের সহচর ছিলেন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী পূর্ববর্তী গায়কদের তুলনায় ইসহাক ছিলেন অধিক জ্ঞানী ও প্রভাবশালী। তিনি কেবল সংগীত বিশারদই ছিলেন না, সেই সাথে সাথে তিনি ছিলেন কবি, ভাষাবিদ, আইনজ্ঞ এবং রাজধানী বাগদাদে তাঁর গ্রন্থাগারটি ছিল বিভিন্ন গ্রন্থের সমাবেশে ভরপুর। তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণের জন্য ছাত্রদের অভাব হত না। ইসহাকের একজন প্রিয় দাসী-ছাত্রী ও গায়িকাকে মিশরের গভর্নর ৩০,০০০ দিনারের অনুরূপ অর্থ ও বায়জানটাইন সম্রাটের এক দূত এবং খোরাসানের শাসক ৪০,০০০ দিনার প্রদান করে ক্রয় করতে সম্মত হয় এবং তিনি ক্রয় করার প্রস্তাব দেন ইসহাককে। ইসহাক এক মহাসঙ্কটে পড়লে তিনি প্রতিভাবান গায়িকাকে মুক্ত করে বিয়ে করে সমস্যার সমাধান করেন। খলিফা আল-মুতাওয়াক্কিল ইসহাকের মৃত্যুতে যে শোকবাণী দেন তাতেই তাঁর মর্যাদা ও সম্মান ফুটে রয়েছে—’ইসহাকের মৃত্যুতে আমার সাম্রাজ্য শুধু একটি রত্নই হারালো না, সেই সাথে মর্যাদাহানীও হল।’

এসময়ে আরব সংগীত গ্রিক ভাষায় সংগীতের উপর লিখিত গ্রিক গ্রন্থাবলি আরবিতে অনূদিত হলে গ্রিক প্রভাব অনুপ্রবেশ করে। এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, সংগীত দর্শনের একটি অংশ এবং এ কারণে এরিস্টটলের গ্রন্থাবলিতে সংগীতের আলোচনা রয়েছে। এ কারণে গ্রিক এবং আরবি সংগীতের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য দেখা যাবে না। গ্রিক সংগীত থেকে যে প্রভাব আরব সংগীতে এসেছে তা আরব সংগীত রীতিকে অতিক্রম করতে পারেনি, বরং তা আরব সংগীতকে সমৃদ্ধ করেছে। এ সময়েই আরবি ভাষায় গ্রিক থেকে ‘মিউসিকি’/’মুসিকি’ (Musiqi- Musiqa) শব্দটি অনুপ্রবেশ করে। অবশ্য গান এবং সংগীতের জন্য আরবদের মধ্যে যে শ্রেণিগত টার্ম বা শব্দ ব্যবহৃত হয়ে আসছে তা হচ্ছে ‘গীনা’ (ghina)।

সৃজনশীল জ্ঞানচর্চার পূর্বে সব সময় অনুবাদ সাহিত্য প্রাধান্য পেয়েছে। যে সমস্ত সৃজনশীল মনীষী সংগীতের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছেন তাঁরা মূলত দার্শনিক। এঁদের পথিকৃত ছিলেন আল-কিন্দি (৮০১-৮৭৩ খ্রি.)। তিনি মামুনের দরবার অলঙ্কৃত করেছেন। তিনি সর্বপ্রথম আরবিতে সংগীতের বিভিন্ন তাত্ত্বিক বিষয় লিপিবদ্ধ করেন। তিনি গান ও সংগীতের উভয় ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ছিলেন এবং আরব সংগীতে অসামান্য অবদান রাখেন। তিনি বীণাতে চারটি তারের পর আর একটি তার সংযোগ করে পাঁচতার বিশিষ্ট বীণা উদ্ভাবন করেন। এর ফলে বিরতি ছাড়া একবারে জোড়া অকটভে (octave) পৌঁছাতে পেরেছিলেন। তিনি স্বরলিপিতে নতুন আক্ষরিক মাত্রা যোগ করে গ্রিক সংগীতে স্বরলিপিকে ছাড়িয়ে যান। চিকিৎসক হিসেবে আল-কিন্দি সংগীতের আরোগ্য বিদ্যা সংক্রান্ত গুরুত্ব সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন। কথিত আছে যে, পক্ষঘাতগ্রস্ত একজন বালককে, যাকে বাগদাদের চিকিৎসকেরা সুস্থ করতে ব্যর্থ হল, তিনি সংগীতের মূর্ছনায় সুস্থ করে তোলেন। তাঁর সংগীত সম্বন্ধীয় পনেরোটি রচনার মধ্যে, যার একটি ‘মুসিকি’ (nusiqi) নামে অভিহিত তার মাত্র পাঁচটি রক্ষা পেয়েছে।

এই দার্শনিক সংগীতজ্ঞ (আল-কিন্দি) সংগীতের ক্ষেত্রে যে ঐতিহ্য রেখে যান তা তাঁর স্বধর্মীয় মনীষীগণ অনুসরণ করেন। তাঁরা সংগীতকে অঙ্কশাস্ত্রের একটি শাখা হিসেবে গণ্য করেন। উল্লেখ্য, অঙ্কশাস্ত্র ও দর্শনের বিষয়বস্তু হিসেবে গণ্য করা হত। সংগীতের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক দিক থেকে যে স্বনামধন্য ব্যক্তি অসামান্য অবদান রেখেছেন তিনি হলেন আল-ফারাবি (৮৭০-৯৫০ খ্রি.)। তিনি তুর্কি বংশোদ্ভূত। আল-ফারাবি তত্ত্ব ও ব্যবহার প্রসঙ্গে সংগীতবিদ্যায় যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেন। তিনি আলেপ্পোর সাইফ-উদ্-দৌলালাহ আল-হামাদানীর রাজদরবারে জ্ঞানচর্চা করতেন, যা খলিফা হারুণ আল-রশিদের সমতুল্য ছিল। কথিত আছে যে, তাঁর পৃষ্ঠপোষকের উপস্থিতিতে আল ফারাবি এমন কৌশলে বাণী বাজাতে পারতেন যে, তাঁর সংগীতের জাদুতে দর্শকদের তিনি হাসাতে, কাঁদাতে, এমন কি তন্দ্রাচ্ছন্ন করতে পারতেন। কিংবদন্তি অনুযায়ী তিনি ‘রুহবাব’ বা ‘রাবাব’ (rebec, viol) আবিষ্কার করেন এবং ‘কানুন’ও (qanum-kanoon) তাঁর সৃষ্টি। অবশ্য সর্বস্বীকৃতভাবে বলা যায় যে, তিনি এ সমস্ত বাদ্যযন্ত্রের মান উন্নয়ন করেন। আল-ফারাবি সংগীত বিষয়ে পাঁচটি গ্রন্থ রচনা করেন। এর মধ্যে একটি হচ্ছে কিতাব-আল-মুসিকি আল-কবির (সংগীতের মূল গ্রন্থ)। এই গ্রন্থটি আরব সংগীত তত্ত্বের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ রচনা। ফারমার বলেন, ‘তিনি সংগীতে ব্যবহৃত ধ্বনির যে তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক ব্যাখ্যা দেন তা গ্রিক সংগীতের চেয়ে উন্নততর’ (The Encyclopedia of Islam, London, 1936, Vol. 3.P.751)। আল- ফারাবি সুফিবাদ বিশ্বাসী ছিলেন এবং এখনও তাঁর রচিত সুফি-চয়ন মরমীবাদী সুফিদের বন্দনায় আবৃত্তি করা হয়।

দর্শন-সংগীত-চিকিৎসাশাস্ত্রে যার অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছে তিনি হচ্ছেন ইবনে সিনা (Avicenna, মৃ. ১০৩৭ খ্রি.)। তিনি শুধু আরব দর্শনেই নয়, আরব সংগীতেও সর্বশেষ শ্রেষ্ঠ অবদান রেখেছেন। তাঁর সংগীত বিষয়ক তত্ত্ব ও তথ্য তিনি আল-সিফা এবং আল-নাজাহ শীর্ষক দার্শনিক গ্রন্থাবলিতে সন্নিবেশিত করেন। তিনি তৎকালীন ব্যবহৃত বাধ্যযন্ত্রের বিস্তারিত বিবরণ দেন। এছাড়া, বিলুপ্ত গ্রিক সংগীতের তথ্যাবলিও তিনি আলোচনা করেন। তাঁর পূর্বসূরী আল- কিন্দি ও আল-ফারাবির মত ইবনে সিনা দার্শনিক ছিলেন কিন্তু তিনি সুফিবাদের বিশেষ চর্চা করেননি।

সুফিবাদ সংগীতকে তিনি নতুন আঙ্গিকে নিতে সহায়তা করেন। সুফিবাদের মধ্যে সংগীত ওহী লাভের পূর্বে যে আবেগময় ও নিগূঢ় আধ্যাত্মিক মানসিকতা থাকে তা লাভে সহায়তা করে। ইসলামের আদি যুগে, মিশরের যুন-নূন (মৃ. ৮৬০ খ্রি.) নামে যে বিখ্যাত সন্ন্যাসী-দার্শনিকের জন্ম হয় তিনি যুক্তিতর্ক দিয়ে ইসলাম সংগীতের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞাকে খণ্ডন করার চেষ্টা করেন। তাঁর ভাষায়, ‘সংগীত শ্রবণ করে আল্লাহর প্রতি প্রচণ্ড ভক্তি জন্মায়, যাতে আধ্যাত্মিক যোগসূত্র স্থাপিত হয়। যে আধ্যাত্মিকভাবে, নিবিষ্ট চিত্তে সংগীত শ্রবণ করে (সামা) সে আল্লাহর নিকটবর্তী হয়; কিন্তু যে ইন্দ্রিয়াসক্ত হয়ে সংগীত শ্রবণ করেন সে ধর্মদ্রোহী।’ কিন্তু যে মহান সুফি-সাধক ও ইসলামের সর্বজন সম্মানিত ধর্মতাত্ত্বিক সংগীতের সমর্থনে গ্রহণযোগ্য যুক্তি দেন তিনি ইমাম আল-গাজ্জালী (মৃ. ১১১১ খ্রি.) তিনি তাঁর আল- সামা ওয়া আল-ওয়াজদ অর্থাৎ সংগীত এবং আধ্যাত্মিকভাবে একত্রীকরণ (‘ওয়াহদ-আল্-উজুদ’ অর্থাৎ সত্তার একীকরণ)—এই ছয়টি যুক্তি দিয়ে তিনি প্রমাণ করেন যে, কুরআন তেলাওয়াত অপেক্ষা সংগীতের মূর্ছনায় আধ্যাত্মিক মার্গে পৌঁছানো সম্ভব। আল-গাজ্জালী শুধুমাত্র গান ও সংগীতই নয়, সংগীতের সাথে সাথে (আধ্যাত্মিক মার্গে পৌঁছবার জন্য) নৃত্যকেও সমর্থন করেন। তাঁর ভাষায় সংগীত, গান এবং নৃত্য আধ্যাত্মিক অনুভূতি ও সত্তার একীকরণে সহায়ক। যাহোক, তিনি গান, সংগীত এবং নৃত্যকে কেবলমাত্র পুরুষদের মধ্যে সীমাবদ্ধ করতে বলেন (নারীদের জন্য নিষিদ্ধ, যদিও এ নিষেধাজ্ঞা সউদী আরব ছাড়া কোন মুসলিম দেশে পালিত হচ্ছে না)। আল-গাজ্জালী এবং অন্যান্য সুফিদের (মওলানা জালালুদ্দীন রুমি) অক্লান্ত চেষ্টায় ও সমর্থনে সুফি অনুষ্ঠানে সংগীত বিশেষ প্রাধান্য ও বৈশিষ্ট্য লাভ করেছে।

পূর্বদেশীয় আরব দার্শনিক ঐতিহ্য পশ্চিমদেশীয় মুসলমানদের উপর প্রভাব ফেলে। স্পেনের প্রথম মুসলিম দার্শনিক ইবনে মাসাররাহ (মৃ. ৯১৩ খ্রি.) সংগীতে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেননি। এমন কি বিখ্যাত দার্শনিক ইবনে রুশদও (মৃ. ১১৯৮ খ্রি.) অনুরূপ অনাগ্রহ প্রদর্শন করেন। ইবনে রুশদ অ্যারিস্টটলের Poetics and Rhetoric গ্রন্থটির উপর বিষদ আলোচনা ও বিশ্লেষণ করেন কিন্তু তিনি সংগীতের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখেননি। সে স্পেনীয় মুসলিম দার্শনিক- চিকিৎসক সংগীতের উপর মক্তব্য করেন বলে জানা যায় তিনি ইবনে বাজ্জা ( Avenpace, মৃ. ১১৩৮ খ্রি.) কিন্তু তাঁর কোন গ্রন্থই রক্ষা পায়নি।

সংগীতচর্চার ক্ষেত্রে অবশ্য ব্যতিক্রম দেখা যায়। আন্দালুসিয়ায় যিনি সংগীতের বিদ্যালয় বা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করে অসামান্য খ্যাতি অর্জন করেন তিনি জিরিয়াব (মৃ. ৮৬০ খ্রি.)। পারস্য বংশোদ্ভূত জিরিয়াব সংগীতে প্রাথমিক শিক্ষালাভ করেন বাগদাদে দুজন মসুলের অধিবাসী বা মাউসিলির নিকট— ইব্রাহিম ও ইসহাক। তিনি বাগদাদে শিক্ষা সমাপ্ত করেন যখন তাঁর ওস্তাদ ইসহাকের ঈর্ষার পাত্র হয়ে পড়লেন তাঁর স্বকীয় সংগীত প্রতিভার জন্য তখন জিরিয়াব উত্তর আফ্রিকায় চলে যান। সেখান থেকে তিনি খলিফা দ্বিতীয় আবদুর রহমানের (৮২২- ৫২ খ্রি.) আমন্ত্রণে কর্ডোভায় আসেন। দ্বিতীয় আবদুর রহমান কর্ডোভার দরবারকে বাগদাদের মত গৌরবমণ্ডিত দরবারে পরিণত করার প্রয়াস পান। জিরিয়াব যখন কর্ডোভা শহরের প্রান্তে এসে উপস্থিত হন তখন খলিফা স্বয়ং তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। সংগীতজ্ঞকে সাদরে আপ্যায়ন করার হয় এবং একেকটি প্রাসাদ্যোপাম অট্টালিকায়, যার মূল্য তখনকার দিনে ছিল ৪০,০০০ দিনার। তার জন্য বাৎসরিক ভাতা নির্ধারিত হয় ৫,৬৪০ দিনার। তাঁর দুজন পূর্বসূরীর মত জিরিয়াব ছিলেন একাধারে কবি, রম্যরচয়িতা, ধীমান এবং বিজ্ঞানের ছাত্র-বিশেষ করে, জ্যোতিশাস্ত্র এবং ভূগোলবিদ্যা। ইব্রাহিম ও ইসহাকের মত তিনি দাবি করেন যে, ঘুমন্ত অবস্থায় অনেক সুন্দর সুন্দর সুর শিখে ফেলেন এবং কথিত আছে যে, তিনি দশ হাজার সংগীতের শব্দ ও সুর জানতেন। দ্বিতীয় আবদুর রহমানের দরবারের যে চারজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব অসামান্য প্রভাব ফেলতে সক্ষম হন জিরিয়ার তাঁদের মধ্যে একজন। অপর তিনজন হচ্ছেন তাঁর স্ত্রী (তারুবা), তাঁর উজির (ইয়াহ্ইয়া বিন ইয়াহ্ইয়া) এবং খোজা ও হাজির (খোজা নসর) এর অন্তরঙ্গ সম্পর্কের কথা ইতিহাসে সুবিদিত। জিরিয়াবের সাথে খলিফা আবদুর রহমানের ঘনিষ্ঠতা এবং তার জন্য রাজকোষ থেকে অজস্র অর্থ ব্যয়ের জন্য খলিফাকে সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়।

জিরিয়ার সংগীতের চর্চার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছেন। তিনিই প্রথম চারটির স্থলে পাঁচটি একটি তার সংযোগ করে পাঁচটি তারের বীণার ঝঙ্কার সৃষ্টির পদ্ধতি চালু করেন। মুরগণ পাশ্চাত্য সংগীতে বিশেষ অবদান রাখেন। তারাই ম্যান্ডোলিন, চার্চ অর্গান, বীণা (lute) (‘আল-উদ’) প্রচলন করেন। এছাড়া, বেহালা রুবাব, ‘খঞ্জনী, গীটার (‘কিতাবা’ শব্দ থেকে) শিঙ্গা (আল-বুক), তাবলা (আল-তাবাল) তাদের উদ্ভাবন। কর্ডোভায় প্রতিষ্ঠিত তাঁর সংগীত বিদ্যালয়ে নিকট ও দূরাঞ্চল থেকে বহু শিক্ষার্থী যোগদান করেন। তিনিই স্পেনীয় আরব সংগীতের ঐতিহ্য সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগীতের প্রভাব স্পেন থেকে উত্তর পশ্চিম আফ্রিকায় সম্প্রসারিত হয়।

পাশ্চাত্যের সংগীত জগতে আরব সংগীতের প্রভাব যাচাই করতে হলে স্পেন এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে— যেসব বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে তার নাম জানা প্রয়োজন। মূলত ইউরোপীয় ভাষায় আরবি বাদ্যযন্ত্রের নাম সন্নিবেশিত হয়েছে। স্পেন ছাড়াও সিসিলি এবং ক্রসেডারদের আমলে সিসিয়ায়-পাশ্চাত্যে আরব সংস্কৃতির প্রচারের মাধ্যম ছিল এবং সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় যে বাদ্যযন্ত্রটি পাশ্চাত্যে অনুপ্রবেশ করেছে তা হচ্ছে লুত (Lute, আরবি ‘আল-উদ’)। এর অর্থ একখণ্ড কাঠ আরব দেশের হিরায় ‘উদ’ এর প্রচলন হয়। এরপর হেজাজে মুহম্মদ (স.)- এর জন্মের অর্ধ-শতাব্দী পূর্বে অনুপ্রবেশ করে। এরপর মুসলিম বাহিনীর সাথে ‘উদ’ সিরিয়া মিসর হয়ে উত্তর আফ্রিকায় প্রসারিত হয় এবং অবশেষে সেখান থেকে স্পেন ও সিসিলিতে এর বহুল প্রচলন দেখা যায়। ইউরোপ মহাদেশে ‘উদের’ ব্যাপক প্রসার ঘটে। অন্যান্য যে সমস্ত আরবি বাদ্যযন্ত্র পাশ্চাত্য সংগীতে প্রভাব বিস্তার করে তা হচ্ছে ‘রেবেক’ (Rebeck, ribibe, আরবি, ‘রাবাব’ থেকে) গীটার (‘কিতার’) তাম্বুরা (‘তাবল’) কানুন (Canun ‘কানুন), এবং নাক্কারা, নাকার (kettledrum)। বিজ্ঞান, দর্শন এবং শিল্পকলার অন্যান্য ক্ষেত্রের মত পাশ্চাত্য কৃষ্টিতে সংগীতে আরব অবদান ছিল খুবই উল্লেখযোগ্য। একথা বলা যায় যে, প্রাচীন ইউরোপ (গ্রিস) থেকে আরবগণ যা ধার করেছিল তা মধ্যযুগীয় ইউরোপকে সুদসহ ফেরত দেয় (সুদ অর্থ জ্ঞানবিজ্ঞান-শিল্পকলায় অসামান্য উৎকর্ষতা দ্বারা)।

কারুশিল্পে নান্দনিকতা

মুসলিম সংস্কৃতি ও শিল্পকলার পরিধি ব্যাপক এবং বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা আনার জন্য শাসকবৃন্দ মুদ্রা ব্যবস্থা চালু রাখেন। উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক সর্বপ্রথম ইসলামী মুদ্রা চালু করেন— দিনার বা স্বর্ণমুদ্রা এবং দিরহাম বা রৌপ্য মুদ্রা প্রচলিত হয়। ইসলামের ইতিহাসের সর্ব যুগে সমস্ত মুসলিম শাসিত অঞ্চলে মুদ্রা ছাপা হয়। ভারত বাংলার টানি-সানফ্রান- প্রতিষ্ঠানের সুলতান ইলতুৎমিস রৌপ্য মুদ্রা বা রূপাইয়া চালু করেন। সুলতানী আমলের মত মুঘল আমলে বাদশাহগণ-স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা ছাপান। বিশেষ করে জাহাঙ্গীরের শাসনামলে স্বর্ণমুদ্রার পাশাপাশি সোনার মোহর প্রচলিত হয়। সোনার মোহর দিয়ে তুলাদার বাদশাহ এবং শাহজাদাদের ওজন করা হত এবং পরবর্তীকালে সেগুলো বিতরণ করা হত। প্রচ্ছদের সামনে সম্রাট জাহাঙ্গীরের একটি সোনার মোহরের চিত্র ছাপা হয়েছে। সম্মুখভাগে Tropci of Cancer-এর ছবি এবং পিছনে জাহাঙ্গীরের নাম খোদিত রয়েছে। বস্তুত সকল মুসলিম বাক্যে বাংলার সুলতানী আমলসহ সোনা ও রূপার মুদ্রা ছাপা হয়। মুদ্রা মুসলিম কারু শিল্পীর এক অনবদ্য সৃষ্টি। মুদ্রা নির্দিষ্ট ওজনের হত এবং নকশা দ্বারা অলঙ্কৃত থাকত। মুদ্রার মধ্যে তিনটি বিষয়ের উল্লেখ থাকে : শাসকের নাম, মুদ্রা ছাপাবার তারিখ এবং টাকশাল।

ইসলামী শিল্পকলার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ মদিনায় মসজিদ নির্মাণের পর থেকে বিশ্বের পবিত্র মসজিদ নির্ধারিত হয়েছে। মসজিদ স্থাপত্যের পাশাপাশি অলংকরণ বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছে। এই অলংকরণে মিনাকরা টালি বা glazed tile-র বিশেষ স্থান রয়েছে। ইরান এবং তুরস্কে মিনাকরা টালির ব্যাপকভাবে ব্যবহার দেখা যায়। ইরানের কাসানে মিনাকরা টালি প্রস্তুতের যে কারখানা ছিল তা বিশ্বের উন্নতমানের টালি (mosaic faienee) প্রধান আকর্ষণ ছিল ইরানের অধিকাংশ মসজিদ মিনাকরা টালি দ্বারা আচ্ছাদিত। উদাহরণ স্বরূপ তাব্রিজের নীলা মসজিদ (Blue Mosque), ইসফাহানের মসজিদ-ই-শাহ এবং মসজিদ-ই লুৎফআল্লাহ বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। প্রচ্ছদের পিছনে উপরে ইরানের সুলতানাবাদে ত্রয়োদশ শতাব্দীর একটি তারা (Start studded) আকৃতির মিনাকরা টালি সানফ্রান্সসিকোর ডি. ইয়ামেন মেমোরিয়াল জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। ইস্তাম্বুলের সোফিয়া মসজিদ, নীল মসজিদ (Blue Mosque)সহ যে অসংখ্য ইমরাত দেখা যাবে তাদের সৌকার্য বৃদ্ধির জন্য উজ্জ্বল নানা বর্ণের সমাবেশে মিনাকরা টালির ব্যবহার দেখা যাবে। ভারতবর্ষের থানেশ্বর ও ‘মুলতান’ লাহোরে মিনাকরা টালির কারখানা ছিল। শাহজাহান (১৬২৭-১৬৫৮) নির্মিত আট্টার জামি মসজিদ নীল টালি দ্বারা আচ্ছাদিত। মুলতানের সমাধিগুলো বিশেষভাবে রুকুন-ই-আলম, ইউসুফ শাহ্ গারদেজী-সহ ইমারতগুলো টালি দ্বারা অলঙ্কৃত। লাহোরে বাইরের প্রাচীরে মুঘল আমলের টালির মোজাইক শোভা পাচ্ছে। অনুরূপভাবে বাংলায় সুলতানী আমলে লোটান মসজিদ মিনাকরা টালি দ্বারা শোভিত ছিল। এগুলো পাচার হয়ে ইংল্যান্ডের লন্ডনে ভিক্টোরিয়া ও আলবার্ট জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।

কার্পেট বুননে মুসলিম কারিগরেরা— পুরুষ ও মহিলা উভয়ে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন। ইরান, তুরস্ক, মধ্য-এশিয়ায় কার্পেট বুনন ব্যাপকতা লাভ করে। Weaving বা বুনন পশম দিয়ে তৈরি কার্পেট মাশহাদসহ ইরানের বহু শহরে এক আকর্ষণীয় শিল্প গড়ে উঠে। তুরস্কেও কার্পেট মাশহাদসহ ইরানের বহু শহরে এক আকর্ষণীয় শিল্প গড়ে উঠে। তুরস্কেও কার্পেট বুনন বিশেষ প্রাধান্য লাভ করে। প্রচ্ছদের পিছনে নিচে তুরস্কে প্রস্তুত এই জায়নামাজের (prayer carpet ) চিত্র দেখা যাবে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে প্রস্তুত এই জায়নামাজ, যাতে একটি মিহরাবের নকশা রয়েছে, বর্তমানে সানফ্রানসিস্কোর ফাইন আর্ট জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। মাজার, বাজার ও মিউজিয়াম— এই তিনটি বস্তুর আকর্ষণীয় আধিক্য তেহরান শহরে আজও দেখা যায়। তেহরান শহরে রয়েছে এরকম অনেক ‘কার্পেট মিউজিয়াম।’

মানুষের সংস্কৃতিচেতনায় নান্দনিকতা

মানুষের সংস্কৃতিচেতনা কোন ধর্মবিচ্যুত বিষয় নয়, বরং তা ধর্মসঞ্জাত জীবনানুভূতিরই অভিজ্ঞান—এই উপলব্ধির যুক্তিনিষ্ঠ ও মুক্তবুদ্ধিদীপ্ত সরস প্রবন্ধকার মোতাহের হোসেন চৌধুরীর (১৯০৩-১৯৫৬) প্রজ্ঞাপ্রসূত অভিমত হল :

‘ধর্ম সাধারণ লোকের কালচার, আর কালচার শিক্ষিত, মার্জিত লোকের ধর্ম। কালচার মানে উন্নততর জীবন সম্বন্ধে চেতনা-সৌন্দর্য, আনন্দ ও প্রেম সম্বন্ধে অবহিতি। সাধারণ লোকেরা ধর্মের মারফতেই তা পেয়ে থাকে। তাই তাদের ধর্ম থেকে বঞ্চিত করা আর কালচার থেকে বঞ্চিত করা একই কথা। ধর্ম মানে জীবনের নিয়ন্ত্রণ। মার্জিত আলোকপ্রাপ্তরা কালচারের মারফতেই নিজেদের নিয়ন্ত্রিত করে। বাইরের আদেশ নয়, ভেতরের সূক্ষ্ম চেতনাই তাদের চালক, তাই তাদের জন্য ধর্মের ততটা দরকার হয় না, বরং তাদের ওপর ধর্ম তথা বাইরের নীতি চাপাতে গেলে ক্ষতি হয়। কেননা তাতে তাদের সূক্ষ্ম চেতনাটি নষ্ট হয়ে যায়, আর সূক্ষ্ম চেতনর অপর নাম আত্মা। সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত কালচারের উদ্দেশ্য নয়— উপায়। উদ্দেশ্য, নিজের ভেতরে একটা ঈশ্বর বা আল্লা সৃষ্টি করা। যে তা করতে পেরেছে সে-ই কালচার্ড অভিধা পেতে পারে, অপরে নয়। বাইরের ধর্মকে যারা গ্রহণ করে তারা আল্লাহকে জীবনপ্রেরণা রূপে পায় না, অপরে নয়। ঠোঁটের বুলি রূপে পায়।’ (সংস্কৃত কথা, ১৯৫৮)। উনিশ শতকের শেষে এবং বিশ শতকের প্রথমে কালচার অর্থে অনুশীলনই ব্যবহৃত হত। বিশ শতকের প্রারম্ভে যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি (১৮৫৯-১৯৫৬) কালচারের মর্মার্থ লক্ষ্য করে কালচারের জন্য ‘কৃষ্টি’ শব্দটি প্রবর্তন করেন। তখন অনুশীলন বা কৃষ্টিকে অত্যন্ত গুরুতর ব্যাপার মনে করা হত— কেবল ব্যক্তিজীবনের জন্যই নয়, সামাজিক ও জাতীয় জীবনের জন্যও।

১৯২০-এর দশকে রবীন্দ্রনাথ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৯০-১৯৭৭) সহায়তায় কালচার অর্থে কৃষ্টির স্থলাভিষিক্ত করেন ‘সংস্কৃতি’কে। কালচারের বাংলা প্রতিশব্দ নিয়ে তর্কবিতর্কের ধারায় অনুশীলন ও কৃষ্টির পাশাপাশি ‘কর্ষণ’, ‘চৰ্চা’, ‘শিক্ষা’, ‘বৈদগ্ধ্য’, ‘চিৎপ্রকর্ষ’, ‘চিত্তোৎকর্ষ’, ‘চারিত্র’ প্রভৃতি শব্দও ব্যবহৃত হয়েছে এবং শব্দের বিভিন্নতার সঙ্গে মর্মগত ধারণারও কমবেশি পার্থক্য ঘটেছে। ঢাকার বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের (১৯২৬-১৯৩৮) লেখকেরা সংস্কৃতি কথাটি গ্রহণ করেছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে ঢাকার তমদ্দুন মজলিশ কালচার অর্থে ‘তমদ্দুন’ চালু করতে চেয়েছিল; কেউ কেউ তখন ‘তাহজিব’-এর পক্ষেও যুক্তি প্রদর্শন করেছিলেন। আদিতে তমদ্দুন বলে বোঝানো হত মদিনা শহরের শিক্ষিত লোকদের উন্নত রীতি-নীতি ও আচার-আচরণ। বাংলায় প্রথম থেকেই কেউ কেউ কোন প্রতিশব্দে না গিয়ে বাংলা বর্ণে লিখে কালচার শব্দটিই ব্যবহার করেছেন। ব্রিটেনে বেকন (১৫৬১-১৬২৬) থেকে, আমেরিকায় ইমার্সন (১৮০৩-১৮৮৩) থেকে এবং ইউরোপের অন্যান্য ভাষায় বেকনের কাছাকাছি সময় থেকে কালচারের ধারণার ব্যাপ্তি ও ধারাবাহিক অন্যান্য ভাষায় বেকনের কাছাকাছি সময় থেকে কালচারের ধারণার ব্যাপ্তি ও ধারাবাহিক বিকাশ ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। বাংলা ভাষার পরবর্তীকালের চিন্তায় কালচার, অনুশীলন, কৃষ্টি, কর্ষণ, চর্চা, চিত্তোৎকর্ষ, চিৎপ্রকর্ষ, সংস্কৃতি ইত্যাদি শব্দ ধর্মকে অতিক্রম করে স্বতন্ত্র অর্থ নিয়ে সামনে আসে।

অনেকের মতে, একটি অসাধারণ শিল্পকর্ম দেখতে পারা মানে এক ধরনের আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা অর্জন করা। তা দেখে একজন ভীষণ আন্দোলিত হতে পারেন, বেদনা বা সুখ অনুভব করতে পারেন। বড় ধরনের শিল্পকর্ম অবলোকন করে এই ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হলে কাউকে খুব একটা বড় মাপের পণ্ডিত হতে হয় না। কেননা মানুষের সৌন্দর্যবোধ হল সহজাত প্রবৃত্তি। মানুষের সৌন্দর্যবোধ হল এক জাতীয় তৃষ্ণা। শুধু এই বিকশিত বিশ্বে নয়, যুগ যুগ ধরে সৌন্দর্যের ব্যাপারে যে প্রসঙ্গটি বার বার চলে এসেছে, এবং সৌন্দর্যকে জানতে গিয়ে যে বিষয়টির দ্বারা লক্ষ লক্ষ বার মানুষকে বিভ্রান্ত হতে হয়েছে, তা হল আনন্দ, আমরা আমাদের পর্যবেক্ষণ থেকে যে অনুভূতি লাভ করি, সেই অনুভূতি দ্বারাই অত্যন্ত দ্রুত একটি সিদ্ধান্তের দিকে ধাবিত হই। এ কারণেই আমরা খুব কম সময়েই সত্যকে অনুধাবন করতে পারি। আসলে আমাদের আনন্দের তৃষ্ণা থেকে আমাদের সৌন্দর্যের তৃষ্ণার উদ্ভব। ফলে আমরা যে সুন্দরের নামে অসুন্দরকে চিহ্নিত করছি তেমনটি সৌন্দর্য যে কী তা চিহ্নিত করতে আমাদের সর্বদাই ভুল হচ্ছে। জগতে দৃশ্যমান বিষয়ের এমন কিছু স্তর রয়েছে, যা পৃথিবীর সব চোখেই সুন্দর বলে প্রতিভাত। সৃষ্টির মহান কারিগর আল্লাহ বলছেন যে তিনি মানুষকে সুন্দরতম কাঠামোতে সৃষ্টি করেছেন, “আমি তা সৃষ্টি করেছি মানুষকে শ্রেষ্ঠতম কাঠামোতে’। (সুরা তীন, আয়াত ৪)।

প্রতিটি ব্যক্তি তার জেনেটিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে স্বভাব আকারে মানবজাতির গোটা ইতিহাসকে সঞ্চিত রেখেছে। উদ্দেশ্য এবং কর্মকাণ্ডের দ্বারা স্বভাবের মধ্যে সঞ্চিত ঐ মহাজাগতিক ইতিহাস একটি বিশেষ দিকে অভিমুখী হতে পারে, যে কারণে এক গোত্র বা জাতিকে সাধারণ বৈশিষ্ট্যের বিচারে অন্য গোত্র বা জাতি থেকে আলাদা করে চেনা সম্ভব। সেই সাথে প্রতিটি মানবের মধ্যে সমগ্র এবং সমগ্রের ভিন্ন ভিন্ন মাত্রাকে বহনকারী ভিন্ন ভিন্ন স্রোতধারাও বহমান। কুরআনে আল্লাহ জানিয়েছেন, “হে মানুষ! আমি তোমাদের এক পুরুষ ও এক নারী হতে সৃষ্টি করেছি, পরে তোমাদের বিভক্তি করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা এক অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পার।’ (সুরা হুজোরাত, আয়াত ১৩)। ধর্মীয় সৃষ্টিতত্ত্বের আলোকে দেখা যাচ্ছে, মানবদেহের গঠনপ্রণালী যে গোটা মহাবিশ্বের সৃষ্টি প্রক্রিয়ার ধাপ সমূহের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।

সৌন্দর্যের সঙ্গে পাওয়ার বা না পাওয়ার বিষটি জড়িত, এর আলোকে আমরা এখন অত্যন্ত নিরাপদে বলতে পারি যে, আমরা আসলে কোনকিছুকে তখনই সুন্দর বলি যখন আমাদের অন্তর তা পেতে চায়। অর্থাৎ আমাদের সৌন্দর্যচেতনা আমাদের পাবার আকাঙ্ক্ষা থেকে উঠে আসে। কেন এই আকাঙ্ক্ষা? কারণ তা পেলে আমরা আনন্দিত হব বলে আমাদের অন্তর মানসে উৎফুল্লতা তৈরি হয়। এভাবে সৌন্দর্য আমাদের মধ্যে কামনার উদ্রেক করে। কামনা আমাদের চিন্তাকে ভবিষ্যৎমুখী করে দেয়। আর আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে সৌন্দর্য হল দৃশ্য- অদৃশ্য, আগত-অনাগত, জ্ঞাত-অজ্ঞাত বাস্তবতার পূর্ণাঙ্গ ভারসাম্য। দেহ মন জ্ঞান এবং ইচ্ছা এই চারটি বিষয়ের মধ্যে চিরস্থায়ী ঐক্য।

ইসলাম ধর্মে নান্দনিকতার বিষয়টি গুরুত্ব পেলেও এই ধর্মের ধর্মবেত্তা বা আলেমগণের নিকট বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত রয়ে গেছে। ইসলাম ধর্মে নান্দনিকতার বিষয়ে আলেম সমাজের জ্ঞানের অপর্যাপ্ততা বা অনীহা, যে কারণেই হোক না কেন, বিষয়টি সাধারণ মুসলমানগণের মধ্যে প্রচার পায়নি। ফলে ধর্মের মধ্যে যে নান্দনিকতা রয়েছে, এ কথাটি নিরানব্বই ভাগ মুসলমানের কাছ পাথরে প্রাণ থাকার মতই অবিশ্বাস্য মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাদের মতে ধর্ম নীতিকথার অনুশাসনে ঠাসা এমন একটি বিষয় যা মানুষকে শুধু চোখ রাঙিয়ে দেখায়। অথচ কুরআনে আল্লাহ্ স্বয়ং বলেছেন : ‘আল্লাহু জামিলুন ওয়া ইউহিব্বুল জামাল।’ অর্থাৎ আল্লাহ্ নিজে সুন্দর এবং তিনি সুন্দরকে ভালোবাসেন। কুরআনে আল্লাহ্ স্বীয় সৌন্দর্যের বর্ণনা এভাবেই দিয়েছেন : “আল্লাহ্ আকাশ ও পৃথিবীর জ্যোতি। তাঁর জ্যোতির উপমা— এক কুলুঙ্গির মধ্যে একটা প্রদীপ, প্রদীপটা কাঁচের মত, কাঁচ উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত, এটা জ্বলে পবিত্র জয়তুন গাছের তেলে যা পূর্ব দিকেরও নয়, পশ্চিমদিকেরও নয়; সে-তেল আগুনের স্পর্শ ছাড়াই যেন উজ্জ্বল আলো দেয়। জ্যোতির উপর জ্যোতি। (আল্লাহ্) যাকে ইচ্ছা তাঁর জ্যোতির দিকে পথ নির্দেশ করেন।’ (সূরা নূর : ৩৫) আল্লাহ্র এই সৌন্দর্যের স্বরূপই হচ্ছে নান্দনিকতা যা কোন ভোগের বস্তু নয়, শুধু উপলব্ধির বিষয়।

আল্লাহ্র এই সৌন্দর্য উপলব্ধি করার উপায় হিসেবে দুটি মতবাদ রয়েছে এগুলো হচ্ছে- ওয়াহদাতুল ওজুদ ও ওয়াহদাতুশ শহুদ। ওয়াহদাতুল ওজুদ মতে সৃষ্ট জগতের পরিমণ্ডলে আমরা যা কিছু প্রত্যক্ষ করি, তা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্ই অনন্ত রূপের প্রকাশমাত্র। এই মতানুসারে জগতের আদি থেকে অনাদিকাল পর্যন্ত যা কিছু প্রকাশ লাভ করেছে ও করবে সবই আল্লাহর মধ্যে নিহিত। একেই বলা হয় আল্লাহর সিফাত বা গুণ। ওজুদ তত্ত্বে বিশ্বাসীগণের মতে আল্লাহ্র তাঁর জাত ও সিফাত মিলিয়ে একক সত্তা। ওয়াহদাতুশ শহুদতত্ত্বের প্রবক্তাগণ আল্লাহ্ ও বিশ্বজগৎ এই পৃথক দুই সত্তায় আল্লাহকে দেখেন। সৃষ্টির পরিমণ্ডলে তিনি রূপ আর সৃষ্টির বাইরে তিনি অরূপ। তাঁদের মতে এই দুই রূপকে এক করে পেতে গেলে তা হবে শিরকের শামিল। একটি হাদিসে মুহম্মদ (স.) বলেছেন : ‘তোমরা সত্বর আল্লাহকে দেখবে যেমন পূর্ণিমার রাত্রে চাঁদকে দেখতে পাও।’ নান্দনিকতা ব্যতিরেকে এ ধরনের দর্শন কখনও সম্পন্ন হতে পারে না। মানুষের ঐহিক জীবনের সৌন্দর্যবোধকে নান্দনিকতা অসীমলোকে উন্নীত করে। খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী, যিনি খাজাবাবা নামেই এই উপমহাদেশে সর্বাধিক পরিচিত, তিনি বলেছেন যে, সে ব্যক্তিই উত্তম, যিনি সৌন্দর্যমুগ্ধ দৃষ্টিতে আল্লাহর বৈচিত্র্যময় প্রকৃতির দৃশ্য উপভোগ করেন ও সর্বাবস্থায় তাঁর যিকিরে মশগুল থাকেন।

নামাজে নান্দনিকতা

নান্দনিকতার বিষয়টি নামাজের সঙ্গেও সম্পৃক্ত। কুরআনে আল্লাহ্ বলেছেন : ‘হে আদম সন্তান! প্রত্যেক নামাজের সময় তোমরা সুন্দর পোশাক পরবে, পানাহার করবে, কিন্তু অপচয় করবে না। তিনি অপচয়কারীদেরকে ভালোবাসেন না। বলো, ‘আল্লাহ্ নিজের বান্দাদের জন্য যেসব সুন্দর জিনিস ও বিশুদ্ধ জীবিকা সৃষ্টি করেছেন তা কে হারাম করেছে?’ বলো, ‘পার্থিব জীবনে বিশেষ করে কিয়ামতের দিনে যারা বিশ্বাস করে এসব তাদের জন্য।’ এভাবে আমি জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য নির্দেশনসমূহ পরিষ্কার করে বয়ান করি।’ (সুরা আরাফ : ২১-৩২) আধ্যাত্মিক সাধক হাসান বসরী নামাজের সময় সুন্দর পোশাক পরিধানে অভ্যস্ত ছিলেন। তিনি বলতেন, আল্লাহ সৌন্দর্য পছন্দ করেন। তাই আমি প্রতিপালকের সামনে সুন্দর পোশাক পড়ে হাজির হই। একটি হাদিসে বলা হয়েছে : ‘নামাজ পড়ার সময় মনে করবে যেন তুমি আল্লাহকে দেখছো, যদি না পার, তাহলে মনে করবে যে আল্লাহ তোমাকে দেখছেন।’ এই বিষয়টির মধ্যেও রয়েছে নান্দনিকতা, যা ছাড়া নামাজ সম্পূর্ণ হয় না।

মানবদেহের নান্দনিকতা

মানুষ আল্লাহ্ শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি এবং জগতের সবকিছুেেকই আল্লাহ্ মানুষের অধীন করে দিয়েছেন। আল্লাহ্ কুরআনে বলেছেন : “আমি সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতর অবয়বে’। (সুরা ত্বীন : ৪)। মানবদেহ শুধুমাত্র কতগুলো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সমষ্টিই নয়। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো দেহের বিভিন্ন স্থানে এমন সুবিন্যস্তভাবে সন্নিবেশন করা হয়েছে যে, মানবদেহ এক নান্দনিক সুষমায় ভরে ওঠেছে। মানবদেহের এই নান্দনিকতাকে অ্যারিস্টটল বলেছেন Organic Unity বা আঙ্গিক ঐক্য। প্রকৃত অর্থে মানুষ বিশ্বজগতের এক ক্ষুদ্র সংস্করণ। এই মানুষের মধ্য দিয়ে আল্লাহর সৌন্দর্য পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়েছে। এ সম্পর্কে আল্লাহ্ কুরআনে আরও বলেছেন : ‘তিনি যথাযথভাবে সৃষ্টি করেছেন আকাশ ও পৃথিবী ও তোমাদেরকে আকৃতি দান করেছেন, তারপর তোমাদের আকৃতিকে করেছেন সুন্দর, আর প্রত্যাবর্তন তো তাঁরই কাছে।’ (সুরা তাগাবুন : ৩)। কুরআনের এই আয়াতটিকেও মানুষ সৃষ্টিতে আল্লাহর নান্দনিকতা প্রকাশিত হয়েছে। মানুষ সৃষ্টিতে আল্লাহর এক বিস্ময়কর বৈচিত্র্যও প্রকাশিত হয়েছে। পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষের কারো সঙ্গে কারো চেহারার হুবহু মিল নেই। এমনকি প্রতিটি মানুষের কণ্ঠস্বরেও রয়েছে স্বাতন্ত্র্য। এটিই হচ্ছে মানুষ সৃষ্টিতে আল্লাহর কারিগরি নৈপুণ্য বা নান্দনিকতা। আল্লাহ্ যে একজন নিপুণ শিল্পী সেকথা তিনি নিজেই বলেছেন মানব শিশুর গঠন প্রসঙ্গে : ‘তারপর আমি তাকে গঠন করেছি পরিমিতভাবে, আমি কত সক্ষম স্ৰষ্টা।’

কুরআনে নান্দনিকতা

একশো চৌদ্দটি সুরার ৬৬৬৬টি পঙ্ক্তিতে রচিত মহাগ্রন্থ কুরআন-ও নান্দনিকতার এক অপূর্ব নিদর্শন। আল্লাহ কর্তৃক কুরআন রচনার মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের অন্তরে সত্যের জ্যোতি প্রজ্বলিত করা। ধর্মীয় দিক বাদ দিয়ে শুধু যদি কুরআনের কাব্যগুণ বিচার করা হয়, তাহলে এটি নিঃসন্দেহে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মহাকাব্য। কবিতা বা কাব্য রচনার ক্ষেত্রে স্বরবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত, কলাবৃত্ত এ ধরনের নানা ছন্দরীতি মেনে চলা হয়। উনিশটি বর্ণের ছন্দরীতিতে সুবিন্যস্ত কুরআনের পঙ্ক্তিগুলোতে এক অসাধারণ ছন্দসুষমার পরিস্ফুটন ঘটেছে। বিষয়বস্তুর নান্দনিক উপস্থাপনা কুরআনকে কাব্যগুণ করে তুলেছে আরো সমুজ্জ্বল। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে সুরা নূরের সেই অসাধারণ আয়াতটি (আয়াত : ৩৫)র কথা যেখানে আল্লাহ্ স্বয়ং নিজের বিমূর্ত রূপকল্প বিধৃত করেছেন প্রদীপের উপমায়। আল্লাহ্র নান্দনিক অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটেছে কুরআনের আরও অনেক পঙ্ক্তিতেই। এমনি আরেকটি পঙ্ক্তি হচ্ছে : ‘শপথ (সেই গ্রহণক্ষত্রের) যারা লুকোচুরি খেলে, ছুটোছুটি করে, আর অস্ত যায়! শপথ রাত্রির শেষের ও ঊষার নিঃশ্বাসের!’ (সুরা তাকভির : ১৫-১৮) আবৃত্তির মাধ্যমে ও কুরআনের নান্দনিকতার প্রকাশ ঘটে। তাই মুহম্মদ (স.) কে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ বলেছেন : ….তুমি কুরআন আবৃত্তি করো ধীরে ধীরে, স্পষ্ট ও সুন্দরভাবে, আমি তোমার কাছে এই গুরুত্বপূর্ণ বাণী অবতীর্ণ করতে যাচ্ছি।’ (সুরা মুজ্জামিল : ৪-৫)।

নবী মুহম্মদ (স.) ফুল পছন্দ করতেন। শিশুদের ভালোবাসতেন। একটি হাদিসে বলা হয়েছে : ‘যদি একটি পয়সা জুটে, ক্ষুধার জন্য খাদ্য কিনিও। আর যদি দুটি পয়সা জুটে, তবে এক পয়সার ফুল কিনিও।’ জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতির ফলে কুরআন ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিতত্ত্ব বোঝা আগের চেয়ে এখন সহজ হয়েছে। মিরাজে গিয়ে কয়েক ঘণ্টায় মুহম্মদ (স.) এর পক্ষে সপ্ত আকাশ ভ্রমণ কীভাবে সম্ভব হয়েছিল, সে প্রশ্নের উত্তর রয়েছে আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বে। সপ্তম আকাশের সবচেয়ে উঁচুস্থানে আল্লাহর আরশ কুরসী বা চেয়ার টেবিল এবং তিনি সেখান খেকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছেন, নিরেট মূর্খ ছাড়া এ যুগে এ কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। মস্তিষ্কের ইচ্ছাশক্তি যেমন মানব দেহের সকল কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে, তেমনি আরশ কুরসীতে প্রকাশিত আল্লাহ্ ইচ্ছাশক্তিই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করছে। দোযখের ভয় আর বেহেশতের প্রলোভন দেখিয়ে মানুষকে ধর্মের দিকে টানা যাবে না। এজন্য আমাদের আলেম সমাজকে হতে হবে আরও সংবেদনশীল। পরিবর্তন করতে হবে ধর্মপ্রচারের Strategy বা কৌশল।

হিন্দুধর্মে নান্দনিকতা

হিন্দুধর্মে নান্দনিকতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশ্বের সর্বত্র প্রকৃতি ও পরিবেশের যে অপরূপ সৌন্দর্য বিরাজ করছে, তা সবই ঈশ্বরের প্রতিরূপ। জীব ও জগতের বৈচিত্র্য ঈশ্বরেরই বৈচিত্র্য। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করে তিনি তার মধ্যে শক্তিরূপে প্রবেশ করেছেন। আমরা দশদিকে যা কিছু দেখতে পাই তা সবই ঈশ্বরের নান্দনিক ও আনন্দময় রূপ। প্রকৃতি থেকে জলজ প্রাণী, স্থলজ প্রাণী ও বৃক্ষলতা সৃষ্টি হয়ে এই পৃথিবী যখন মানুষের বাসযোগ্য হয়েছে, তখনই ঈশ্বর মানুষ সৃষ্টি করেছেন এই তাঁরই আনন্দে পৃথিবীকে সুসজ্জিত করেছেন। প্রকৃতির যে বিস্ময়কর সৌন্দর্য আমরা উপভোগ করছি তা ঈশ্বরের সৌন্দর্যের প্রতিফলন। আদিতে ঈশ্বর ছিলেন একা। তাঁর ইচ্ছে হল তিনি বহু হবেন। এই ইচ্ছে পূরণ করতে তিনি নিজে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে প্রকৃতিকে সৃষ্টি করলেন। প্রকৃতি হল ঈশ্বরের সৃজনী শক্তি। ঈশ্বর স্বয়ং পুরুষ আর প্রকৃতি তাঁর স্ত্রী বা সৃজনী শক্তি। তাই প্রকৃতি এত অপরূপ, এত নান্দনিক।

বিশ্বসৃষ্টিতে নান্দনিকতা

এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির ক্ষেত্রেও নানাভাবে প্রকাশিত হয়েছে আল্লাহর নান্দনিক অবিভ্যক্ত যা কুরআনের বিভিন্ন সুরায় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। আল্লাহ্ বলেছেন : ‘আমি কি পৃথিবীকে বিস্তৃত করিনি, আর পর্বতকে করিনি কীলক স্বরূপ? আমি তোমাদেরকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছি। আমি বিশ্রামের জন্য তোমাদের নিদ্রা দিয়েছি, রাত্রিকে করেছি আবরণস্বরূপ এবং দিবসকে করেছি জীবিকা আহরণের সময়। আমি তোমাদের ওপরে সুস্থিত সপ্ত (আকাশ) নির্মাণ করেছি এবং প্রোজ্জ্বল দীপ সৃষ্টি করেছি। আমি মেঘমালা হতে মুষলধারে বৃষ্টিপাত করি, তা দিয়ে উৎপন্ন করি শস্য, উদ্ভিদ ও ঘনসন্নিবিষ্ট উদ্যান।’ (সুরা নাবা : ৬-১৬)। আল্লাহর এই বিশ্বসৃষ্টি প্রক্রিয়া যে কত নিখুঁত ও বৈচিত্র্যময় তা সুস্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে কুরআনে : ‘তিনি স্তরে স্তরে সাজিয়ে সাজিয়ে সাত আকাশ সৃষ্টি করেছেন : করুণাময় আল্লাহর সৃষ্টিতে তুমি কোন খুঁত দেখতে পাবে না। আবার তাকিয়ে দেখ, কোন ত্রুটি দেখতে পাও কিনা। তারপর তুমি বারবার তাকাও, তোমার দৃষ্টি ব্যর্থ ও ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসবে।’ (সুরা মুল্ক : ৩-৪)। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে সুরা হিজরের ১৯ নম্বর আয়াতে যেখানে আল্লাহ্ বলেছেন : ‘পৃথিবীকে আমি বিস্তৃত করেছি, আর ওর মধ্যে পর্বতমালা সৃষ্টি করেছি; আমি পৃথিবীতে প্রত্যেক বস্তু সুপরিমিতভাবে সৃষ্টি করেছি।’ সুপরিমিতভাবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির মধ্যে যে অপূর্ব নান্দনিকতা রয়েছে, তা অবলোকন করে অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন বিজ্ঞানী আইনস্টাইন। আইনস্টাইন তাঁর জীবনের শেষ সময়টুকু কাটিয়েছেন গভীর সত্য সাধনায়। তাঁর এই সাধনার ফসল Unified field Theory। এই থিওরিতে তিনি গোটা বিশ্বকে একটি বস্তু বা One unit of fact হিসেবে ধরে নিয়ে বলেছেন যে, মানবদেহের মতোই বিশ্বটাও অপূর্ব কারিগরি নান্দনিকতায় সৃষ্টি। আর তার শেষ কথা : ‘বিশ্বপ্রকৃতির রহস্য উদ্ঘাটনে যে মহানন্দ তাই প্রকৃত ধর্মীয় প্রার্থনার আনন্দ।’

ধর্মে নান্দনিকতা বোধ একটি ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের ব্যাপার। কেউ স্বধর্মের নান্দনিকতায় উচ্ছ্বসিত হলেও পরধর্মের নান্দনিকতায় তার উৎসাহ থাকে না। ফলে সকল ধর্মের সৌন্দর্য একই বরণডালায় উপস্থাপন করে স্বতন্ত্র ধর্মানুরাগীদের স্বপক্ষে অনুরাগ সৃষ্টি করা যায় না। দেখা যাবে শঙ্খধ্বনির স্বরমাধুর্য ও আজানের ধ্বনির স্বরমাধুর্যকে সমানভাবে উপভোগ করতে পারে এমন সৌন্দর্য পিয়াসী ধার্মিকদের মধ্যে বিরল। এমনকি স্বধর্মের নান্দনিকতা উপলব্ধির মত মননশীলতাও একটি সাংস্কৃতিক বোধ ও সৌন্দর্য চেতনার ব্যাপার। এই বোধ বিকশিত হতে হলে ধর্মবেত্তার আচরিত জীবন সৌন্দর্যবোধ পরিচ্ছন্ন হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের ধর্মজীবনে তথা ধর্মশাস্ত্র অনুশীলনে এই বিষয়টি সাধারণত গুরুত্ব পায় না। তা ছাড়া দরিদ্রতা, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও কুসংস্কার, সৃষ্টিজগতের সৌন্দর্য উন্মোচনে অপারগ শিক্ষাপদ্ধতি সর্বোপরি ধর্মশাস্ত্রগুলির তাফসীরকারীদের বেশিরভাগ ব্যাখ্যাকারী পরকালমুখী বিশ্লেষণে ভীতসন্ত্রস্ততার অনুগামী। এসব কারণে অধিকাংশ ধার্মিকই ধর্মের নান্দনিকতা উপভোগের অংশীদার হতে পারে না। ফলে কিছু আতর-সুরমা, মালা-তিলক ও টিকি-দাঁড়িতেই এদের সৌন্দর্য ও স্বাতন্ত্র্য সীমাবদ্ধ রাখতে দেখা যায়। সাংস্কৃতিক বোধসম্পন্ন ব্যক্তিই বোঝেন ইলোরা অজন্তা গুহার সৌন্দর্য রহস্য, কিংবা তিরুপতি-কামাক্ষা মন্দিরের নান্দনিক তাৎপর্য, কর্ডোভা-গ্রানাডা-ইস্তাম্বুল মসজিদের সৌন্দর্য, মিলানে মেরীর ধবল-সুন্দর স্মিতমুখের প্রতিমূর্তি, বাংলাদেশের মন্দির-মসজিদ-গির্জা প্যাগোডার নির্মাণশৈলীর নান্দনিকতা। ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যে উজ্জীবিত দৃষ্টিতে এই সামগ্রিক সৌন্দর্য উপভোগ সম্ভব নয়। এ সৌন্দর্য নিবেদন সকলেই এক স্রষ্টায় সমর্পিত—এরূপ ভাবনাই পারে এই সম্মিলিত সৌন্দর্য উপভোগে সহায়ক। কল্পনা করতে হবে স্রষ্টার ও সৃষ্টিজগৎ একটি বহু রঙে সুসজ্জিত মানববাগান— এখানে বহু রঙে প্রস্ফুটিত বহু মানবীয় ফুল— সকলেই স্বস্ব সৌন্দর্যে বিকশিত ও উদ্ভাসিত।

নির্বাচিত গ্রন্থপঞ্জি

Prof. Dr. Abdul Halim, Essays on History of Pak-Indian Music- Bangladesh Islamic Foundation, Dhaka, 1962

The Encyclopedia of Islam; (Vol: 3), London, 1936

W. Montogomary Wart, Muhammad at Mecca; London, 1936

W. Montogomary Wart, Muhammad at Medina; London, 1937

Philip K. Hitti, History of the Arabs; London (15th ed), 1942

Ian P. McGreal (ed.), Great Thinkers of the Eastern World; London, 1946

A. S. Geedon, Studies in the Religions of the East; London, 1944

T.W. Arnold, The Preaching of Islam; London, (1st ed, 1896) 20th ed. 1946

T.W. Arnold, The Painting of Islam; London, (1st ed. 1824 18th edi.) 1948

Henry Y. Farmer, A History of Arabian Music; London, 1929

Annie Besant, Beauties of Islam; Theosophicial Society, Adyar, Chennai, India, (2০th ed.), 1991

Salauddin Daniel, The Music and the Musical Instruments of the Arabs; Edited by Henry Gorge Farmer, London, 1915

Henry Gorge Farmar, Arabian Influence on Musiscal Theory; London, 1925

Uincent Smith, Fine Art in India and Ceylon; Oxford, 1930

Lawrence Binyon, Painting in the Far East; New York, 1959 T. W. Arnold, Painting in Islam; New York, 1965

C. Ray Craven, Indian Art : A Concise History; 1991

H. W. Janson, A History of World Art; New York, 1999

ড. রশীদুল আলম, সুফি সাধনার ভূমিকা; কাকলি প্রকাশনী, ঢাকা ২০১২

মোহাম্মদ হারুন-উর-রশীদ, ধর্মের নান্দনিকতা; অ্যাডর্ন পাবলিশার্স, ঢাকা ২০১২

এ.জেড.এম. শামসুল আলম, মুসলিম সংগীত চর্চার সোনালী ইতিহাস; বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লি. প্র. প্র. ২০১২

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *