পঞ্চদশ অধ্যায় – ধর্মে মানব ঐক্য ও সমন্বয়ী চেতনা (Unity in Humans and Unifing Consciousness in Religion)
মানব ঐক্যের মহান সাধক লালন শাহ
মানুষের প্রতি মানুষের শোষণ-বঞ্চনা-অবিচার-অবজ্ঞার চির অবসান কামনা করে শ্রেণিহীন শোষণমুক্ত এক অভিনব সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন মরমীসাধক লালন শাহ (১৭৭২-১৮৯০)। তাঁর কাতর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে :
এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে।
যেদিন হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান/জাতি-গোত্র নাহি রবে।।
শোনায়ে লোভের বুলি/ নেবেনা কাঁধের ঝুলি
ইতর-আতরাফ বলি/দূরে ঠেলেনা দেবে।
আমির ফকির হয়ে এক ঠাঁই/সবার পাওনা খাবে সবাই
আশরাফ বলিয়া রেহাই ভবে/কেউ নাহি পাবে
ধর্ম-কুল-গোত্র-জাতি/তুলবে না গো কেহ জিগির
কেঁদে বলে লালন ফকির/কে মোরে দেখায়ে দেবে।।
উচ্চ-নীচু, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য-ব্যবধান লালন অনুমোদন করেননি বলেই ‘ধনী- গরীব কেন ভুবনে রয়’ বলে সৃষ্টিকর্তার ‘ন্যায়বিচার’ সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। তাঁর আন্তরিক প্রত্যাশা, ধর্ম-কুল গোত্র-জাতিহীন সাম্যশাসিত সমাজে ‘আমির-ফকির এক হয়ে এক ঠাঁই/সবার পাওনা খাবে সবাই’ মানবাত্মার লাঞ্ছনায় কাতর, মানুষের দুর্দশা-দুঃখে ব্যথিত, মানবমুক্তি প্রত্যাশায় ব্যাকুল লালনের এ ব্যতিক্রমী উচ্চারণ তাঁকে অনায়াসে শোষিতজনের পরম বান্ধব সমাজমনস্ক এক অসাধারণ মরমী-মনীষী হিসেবে চিহ্নিত করে। আবহমান বাংলার সংস্কার ও শোষণের অচলায়তনের দুর্গে এমন শক্ত আঘাত এসেছে এক নিরক্ষর গ্রাম্য সাধকের নিকট থেকে— নিঃসন্দেহে এটি একটি বিস্ময়কর ঘটনা। লালনের সাহসী সামাজিক ভূমিকার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আছে তাঁর পরম বান্ধব কাঙাল হরিনাথকে জমিদারের সহিংস আক্রোশ থেকে রক্ষা করার ঘটনায়। হরিনাথ তাঁর গ্রামবাৰ্ত্তা প্রকাশিকা পত্রিকায় শিলাইদহের ঠাকুর-জমিদারদের প্রজা-পীড়নের সংবাদ প্রকাশ করলে জমিদার পক্ষ তাঁর ওপর অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। প্রতিরোধ স্পৃহায় জমিদারপক্ষ কাঙালকে শায়েস্তা করার জন্যে দেশীয় লাঠিয়াল ও পাঞ্জাবি গুণ্ডা নিয়োগ করেন। কাঙালের অপ্রকাশিত ‘দিনপঞ্জি’ থেকে জানা যায়, ‘জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনীর হাত থেকে বিপন্ন বন্ধু নিজের লাঠি হাতে সেই লাঠিয়ালের দলকে আচ্ছা করে ঢিঢ করে সুহৃদ কৃষকবন্ধু হরিনাথকে রক্ষা করেন।’ (হেমাঙ্গ বিশ্বাস, লোকসঙ্গীত সমীক্ষা : বাংলা ও আসাম, কলকাতা, জ্যৈষ্ঠ ১৩৮৫; পৃ. ৬৭-৬৮)।
লালন তাঁর উদার ও প্রগতিশীল মানসিকতার কারণে সমকালীন সমাজে যথেষ্টই নিন্দিত ও নিগৃহীত হয়েছিলেন। হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোকেরাই লালনের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন; উত্তরকালেও লালন-বিরোধী আন্দোলন স্তিমিত হয়নি। মুসলমানের চোখে লালন ‘বে-শরা বে-দাতী নাড়ার ফকির’; আবার হিন্দুর নিকটে ‘ব্রাত্য-কদাচারী’ হিসেবে চিহ্নিত। ধর্মগুরু ও সমাজপতি উভয়ের নিকটেই লালনের বাণী ও শিক্ষা অস্বীকৃত হয়েছে। কিন্তু লালন তাঁর ধর্মবাণীকে সমাজ শিক্ষার বাহন করে ক্রমশ তাঁর আকাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে যাত্রা অব্যাহত রেখেছিলেন।
লালনের গান সমাজ-সম্পর্কের ধারা বেয়ে সাম্প্রদায়িকতা-জাতিভেদ-ছুঁৎমার্গ ইত্যাদি যুগসমস্যাকে চিহ্নিত করে তার সমাধানের ইঙ্গিত দিয়েছিল। এ প্রয়াসের মাধ্যমে লালন সমাজ সচেতন, মানবতাবাদী ও প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির যে পরিচয় দিয়েছেন তার স্বরূপ নির্ণয় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান। লালনের এ ঐতিহাসিক ভূমিকাকে কেউ কেউ বাংলার নবজাগৃতি ঋত্বিক রাজা রামামোহন রায়ের (১৭৭২- ১৮৩৩) অবদানের সঙ্গে তুলনা করতে চেয়েছেন। এ প্রসঙ্গে অন্নদাশঙ্কর রায় মন্তব্য করেছেন : ‘বাংলার লোকমানসের দেয়ালী উৎসবে লালনেরও সেই গুরুত্ব’। (লালন ও তাঁর গান, কলকাতা, বুদ্ধ পূর্ণিমা ১৩৮৫, পৃ. ২৪)।
অধ্যাপক অমলেন্দু দে-ও লোকায়ত জীবনে লালনের সুগভীর প্রভাব এবং নবজাগৃতির প্রেক্ষাপটে লালন ও রামমোহনের ভূমিকার তুলনামূলক আলোচনার গুরুত্ব স্বীকার করেছেন। (বাঙালী বুদ্ধিজীবী ও বিচ্ছিন্নতাবাদ, কলকাতা, ৯ মে ১৯৭৪, পৃ. ৫)।
আমাদের বিশ্বাস নবজাগৃতির পটভূমিকায় রামমোহন ও লালনের তুলনামূলক আলোচনা হলে দেখা যাবে লালনের অসাম্প্রদায়িক চেতনা, মানবতাবাদ, সংস্কার ও জাতিভেদ-বিরুদ্ধ মনোভাবের ঐতিহাসিক গুরুত্ব কতখানি। জানা যাবে লালনের মানবিক মূল্যবোধ ও মানবধর্মী চিন্তাধারার প্রভাব বাংলার গ্রামদেশের প্রাকৃত জনগোষ্ঠী এবং নগরবাসী কিছু শিক্ষিত কৃতী পুরুষের মনেও কী গভীর প্রভাব মুদ্রিত করেছিল, কতখানি আন্তরিক ও অকৃত্রিম ছিল সেই প্রচেষ্টা। নবজাগৃতির অন্যতম শর্ত যে অসাম্প্রদায়িক মানববাদ তা এ অশিক্ষিত গ্রামসাধকের বাণী ও সাধনার ভেতরেই প্রকৃত অর্থে সত্য হয়ে উঠেছিল— প্রাণ পেয়েছিল। যথার্থই গ্রাম-বাংলার এ মানবতাবাদী মুক্তবুদ্ধি আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন লালন শাহ।
মূলত লালনের গানের অসামান্য শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য, উচ্চাঙ্গের দর্শন ও প্রবল মানবিকতাবোধের জন্যে রবীন্দ্রনাথ থেকে অন্নদাশংকর রায় এবং বিদেশে ধীমান Dimock থেকে Charles Capwell লালনের গানের প্রতি আকৃষ্ট হন।
বাউলগান লৌকিক সমাজের অধ্যাত্ম সাধনার অবলম্বন হলেও লালনের হাতে তা অধিকতর সামাজিক তাৎপর্য ও মানবিক বিশ্বাসে সমৃদ্ধ হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। লালনের গানে ধর্ম-সমন্বয়, সম্প্রদায়-সম্প্রীতি, মানব মহিমাবোধ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, আচারসর্বস্ব ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধতা, বর্ণশোষণ- জাতিভেদ ও ছুঁৎ-মার্গের প্রতি ঘৃণা, সামাজিক অবিচার ও অসাম্যের অবসান কামনা ইত্যাদি বিষয় স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত। মূলত তাঁর বিদ্রোহ চিরাচরিত শাস্ত্র- আচার ও প্রচলিত সমাজ ধর্মের বিরুদ্ধে। এসব বক্তব্যের ভেতর দিয়ে তাঁর উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও মানবতাবাদী মনের পরিচয় পাওয়া যায়। লালন তাঁর আন্তরিক বোধ- বিশ্বাসকে অকপটে তাঁর গানে প্রকাশ করেছেন। তাঁর আদর্শ ও জীবনচারণের সঙ্গে তাঁর বক্তব্যের কোন অমিল হয়নি— বিরোধ বাধেনি কখনও।
লালনের গানে মানব বন্দনা ও মানব মহিমা যেভাবে প্রাধান্য পেয়ে কীর্তিত হয়েছে তা যথার্থই যুগ দুর্লভ। ক্ষণস্থায়ী মানবজীবনকে সুকর্মে উদ্বুদ্ধ করার আহ্বান জানিয়ে লালন বলেছেন—
অনন্তরূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই
শুনি মানবের উত্তম কিছুই নাই
দেব-দেবতাগণ করে আরাধন
জন্ম নিতে মানবে।।
কত ভাগ্যের ফলে না জানি
মন রে পেয়েছো এ মানব তরণী
বেয়ে যাও ত্বরায় সুধারায়
যেন ভারা না ডোবে।।
সাধন-ভজনের পথ-নির্দেশের জন্যে দেব-দেউল কিংবা কোন প্রত্যাদেশ নয়, মর্ত্যের মানব গুরুকেই অবলম্বন করা হয়েছে। দুর্লভ মানব জনমের গুরুত্ব, মানবমুখী চেতনা ও মানবিক মূল্যবোধ এভাবে লালনের গানে জয়ী হয়েছে।
এদেশের সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনে জাতিভেদ ও ছুঁৎমার্গ দুষ্টক্ষতের মত বিরাজিত ছিল। এ কু-প্রথা ও কু-সংস্কার ধর্মকে আশ্রয় করে সমাজ জীবনে শক্ত আসন প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছিল। মানুষের মনে এ সংস্কার ও ভেদবুদ্ধি এমন গভীর ছাপ ফেলেছে যে, সহজে ও সমূলে এর উচ্ছেদ সম্ভব হয়নি। লালন এরই বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। লালন জানতেন, শুদ্ধ সাধনভক্তির জোরে অবজ্ঞাত তন্তুবায় কবীর ও অস্পৃশ্য চর্মকার রাম দাসও মহাসাধনার বলে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। তাই তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে-
ভক্তির দ্বারে দ্বারে বাঁধা আছেন সাঁই।
হিন্দু কি যবন কালে তাঁর। জাতের বিচার নাই।।
ভক্ত কবির জেতে জোলা/ প্রেম ভক্তিতে মাতোয়ালা।।
হিন্দু-মুসলমান ঐক্য ভারতেতিহাসের এক উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য। ক্ষিতিমোহন সেন তাঁর ভারতে হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত সাধনা গ্রন্থে তিনি তিনি হিন্দু-মুসলমানের সামাজিক সমন্বয়ের অটুট চিত্র উপস্থাপন করেছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর পরিচয় গ্রন্থের ‘হিন্দু- বিশ্ববিদ্যালয়’ শীর্ষক প্রবন্ধে (১৯১১) লিখেছেন :
‘মুসলমানের মুসলমানি মাথা তুলিয়া উঠিল। এখন সে মুসলমানরূপেই প্রবল হইতে চায়, হিন্দুর সঙ্গে মিশিয়া গিয়া প্রবল হইতে চায় না।… (অথচ) কিছুকাল পূর্বে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে এই স্বাতন্ত্র্য— অনুভূতি ছিল না’।
মুসলমানরা এই স্বাতন্ত্র্য হওয়ার সুযোগ পায় সাধারণ হিন্দুদের ঔদার্যে। সাধারণ হিন্দুরাই এদেশে আগত সুফিদের সর্বাধিক সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত হতে সহায়তা করেছেন। হৃদয়গত ঔদার্যেই মন্দিরের শঙ্খধ্বনি, মসজিদের আজান আর গির্জার ঘণ্টার ধ্বনি এদের কানে প্রীতির উন্মেষ ঘটিয়েছে। সাম্প্রদায়িক হওয়া সত্ত্বেও হিন্দু তার সন্তানের অসুখ হলে ছোটে সনাতন পীরের কাছে। মুসলমান ছোটে শীতলাতলায় জলপড়া আনতে। সত্যনারায়ণ পূজোয় হিন্দুরা আজ যে সিন্নি ব্যবহার করে তা তো মসজিদের সিন্নি। এই সাধারণ শ্রেণিরাই হিন্দু-মুসলমানের সত্যিকার মিলনে অকৃত্রিম ভূমিকা রাখে। এঁরা জাত-পাতের বেড়া ডিঙিয়ে মানব ঐক্যের ভিত রচনা করে। এঁরাই প্রথম উপলব্ধি করে বিভিন্ন ধর্মের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে আত্মস্থ করে না-এগোলে প্রকৃত মিলন সম্ভব নয়। হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের রক্ষণশীল অংশের কাছে ক্রমশ সর্ব মানবিকবোধ সহনীয় করে তোলায় এদেরই কৃতিত্ব। এরা বুঝেছিল :
‘স্বাতন্ত্রের গৌরবোধ জন্মিলেই মানুষ দুঃখ স্বীকার করিয়াও আপনাকে বড় করিয়া তুলিতে চাহিবে। বড় হইয়া উঠিলে তখনই পরস্পরের মিলন সত্যকার সামগ্রী হইবে। দীনতার মিলন, অধীনতার মিলন, এবং দায়ে পড়িয়া মিলন গোঁজামিল মাত্র।’
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, আর্য-অনার্যের সময় থেকেই ক্রমাগত গ্রহণ-বর্জনের প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে ভারতে মিশ্র-সংস্কৃতি সৃষ্টি হয়েছে। এই সাংস্কৃতিক ভাণ্ডারে ইসলামি ঐতিহ্য একটি মূল্যবান ও বৃহত্তর সংযোজন। এই সমন্বিত আদর্শে ভারতে যেমন বিশুদ্ধ হিন্দু-সংস্কৃতি নেই, তেমনি নেই বিশুদ্ধ ইসলামি-সংস্কৃতিও। যা আছে তা হল সমন্বয়ী রূপ। উভয়ের সম্মিলন।
ধর্মগ্রন্থে উল্লিখিত মহাপুরুষদের বৈশিষ্ট্য
বৌদ্ধ ধর্মে ভক্তমাল-এ উল্লিখিত 32 Sings of Great Man এবং হিন্দু ধর্মের সামুদ্রিক শাস্ত্রে উল্লিখিত 32 Major Marks of Great Man-এর জ্যোতিষ তত্ত্বে মহাপুরুষদের অঙ্গে ৩২টি লক্ষণ দেখতে পাওয়া যায়। জ্যোতিষ তত্ত্বে সামুদ্রিক শাস্ত্রে বলা হয়েছে—
পঞ্চদীর্ঘঃ পঞ্চসূক্ষ্ম সপ্তরক্ত ষড় ন্নতঃ।
ত্রিহ্রস্ব-পৃথু-গম্ভীরো দ্বাত্রিংশল্লক্ষণো মহান্।।
শরীরের পাঁচটি অঙ্গ দীর্ঘ নাসিকা, বাহু, চিবুক, চক্ষু এবং হাঁটু।
পাঁচটি অঙ্গ সূক্ষ্ম— ত্বক, অঙ্গুলিপর্ব, লোম এবং চুল।
সাতটি অঙ্গ রক্তিম— চক্ষু, পায়ের তালু, হাতের তালু, মুখের তালু, জিহ্বা, নখ, অধর ও ওষ্ঠ।
ছয়টি অঙ্গ উন্নত— বুক, কাঁধ, নখ, নাক, কোমর এবং মুখ।
তিনটি অঙ্গ হ্রস— গলা, জানু ও উপস্থ।
তিনটি অঙ্গ প্রশস্ত— কোমর, ললাট এবং বক্ষ।
তিনটি অঙ্গ গম্ভীর নাভি, কণ্ঠস্বর ও স্বত্ব।
মহান জ্যোতিষতত্ত্ববিদ শ্রীনীলাম্বর চক্রবর্তী যখন শিশু শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর অঙ্গে এই সমস্ত লক্ষণই দেখলেন তখন অত্যন্ত চমৎকৃত হলেন। তিনি তার কন্যা শচীদেবী ও জামাতা জগন্নাথ মিশ্রকে বললেন, সাধারণ শিশু এ নয়।
ধর্মতত্ত্ব দর্শনের আলোকে দেখা যায় নবী-রাসূল ও প্রেরিত পরম পুরুষ তথা মহামানবের জীবনেও এ রকম লক্ষণ চিহ্নিত করা যায়। ঐশীপ্রসূত এসব জ্যোতিষ্মান মহামানবের জীবনের ৫টি প্রধান লক্ষণ হল :
১. স্বশিক্ষিত হন।
২. স্বসমাজে নির্যাতিত ও নিগৃহীত হন।
৩. জন্মস্থান ত্যাগে বাধ্য হন।
৪. সর্ব মানবিক গুণাবলির হন।
৫. ইলহাম (ঐশীজ্ঞান) প্রাপ্ত হন।
মহাপুরুষদের মধ্যে উপরোল্লিখিত ৫টি লক্ষণের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণের প্রারম্ভ সূত্র ও দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যায়—
অনুসন্ধানে দেখা যাবে জগতের সকল মহামানবই স্বশিক্ষিত। এঁদের কারো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। কেননা মহাজন বাক্য স্মরণে এনে বলা যায়— ‘সুশিক্ষিত লোক মাত্রই স্বশিক্ষিত।’ এঁরা জীবনে এ জগতের প্রচলিত বিধিবিধানে আবিষ্ট অনাচার অবিচার অপসারণে প্রতিবাদী হন, বিধায় স্বসমাজে সুবিধাভোগী অবিবেচক শ্রেণির কাছে এঁরা নির্যাতিত ও নিগৃহীত হন। প্রতিপক্ষের এই নির্যাতন ও নিগৃহে অতিষ্ঠ হয়ে একপর্যায়ে জন্মস্থান ত্যাগে অর্থাৎ (migration বা হিজরতে) বাধ্য হন। সংক্ষিপ্ত দৃষ্টান্তে আমরা শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকা থেকে বৃন্দাবন, গৌতম বুদ্ধের কপিলাবস্তু থেকে কুশীনগর, যিশুখ্রিষ্টের জেরুজালেম থেকে বেথলহেম, হজরত মহম্মদ (স.) এর মক্কা থেকে মদিনা হিজরতের অনিবার্যতার ঘটনা উল্লেখ করতে পারি। মহামানবের মহামানবিক জীবনের বৈশিষ্ট্যে দেখা যায়, এঁরা সাধারণত সর্বমানবিক গুণাবলির অধিকারী হন। এঁরা সকল অবস্থায় সর্বসহনীয় ও সর্বমানবিক বোধে বিকশিত হন। এঁদের সকল জ্ঞানের উৎস ঐশীপ্রসূত (maditation, ধ্যান বা তাসাউফের মাধ্যমে) প্রাপ্ত হন। (সূত্র : Mohammad Abdul Hye, Code of Theological Philosophy) ।
বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে আল্লাহর ধারণায় মৌলিক সাদৃশ্য
‘আল্লাহ’ শব্দটি প্রথম উল্লেখিত হয় হজরত মুসা (আ.) এর উপর নাজিলকৃত আসমানি কিতাব তৌরাত শরীফ-এ (প্রথম খণ্ড, পরদায়েশ ১০ : ১৫)। পরবর্তীকালে শব্দটি কোরআনে উল্লেখিত হয় এবং স্রষ্টার একাত্মবোধক অর্থে ব্যবহৃত হয়। ইসলাম ধর্মে ‘আল্লাহ’ শব্দের কোন দ্ব্যর্থক অর্থবোধক শব্দ ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তবে আল্লাহর বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলি সম্পর্কে এমন অনেক বর্ণনা রয়েছে, যা কোরআন, বাইবেল ও উপনিষদে প্রায় অভিন্ন।
কুরআনে আল্লাহর গুণাবলী সম্পর্কে বলা হয়েছে : ‘পৃথিবীর সব গাছ যদি কলম হয়, আর এই যে সমুদ্র, এর সঙ্গে যদি সাত সমুদ্র যোগ দিয়ে কালি হয়, তবুও আল্লাহর গুণাবলী লিখে শেষ করা যাবে না।’ (সুরা : লুকমান আয়াত : ২৭)। কুরআনে আরও বলা হয়েছে : ‘বলো, আমার প্রতিপালকের বাণী (লেখার জন্য) সমুদ্র যদি কালি হয়, তবে আমার প্রতিপালকের কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই সমুদ্র নিঃশেষ হয়ে যাবে, এর সাহায্যার্থে এর মতো (আর একটি সমুদ্র) আনলেও।’ (সুরা কাহাফ : ১০৯)। একটি সংস্কৃত শ্লোকেও একই কথা একটু ভিন্নভাবে বলা হয়েছে :
‘অসিত গিরি সমং স্যাৎ কজ্জলং
সিন্ধু পাত্রে সুর তরুবর শাখা লেখনি
পত্ৰমুর্বী লিখতি যদি গৃহিতা সারদা সর্বকালং
তদপি-ব গুণা নামীশ পারং না যাতি।’
অর্থাৎ সকল সমুদ্রে নীল পর্বত মিশিয়ে যদি কালি তৈরি করা হয়, আর সমস্ত বৃক্ষরাজির শাখা যদি কলমে পরিণত হয়, আর পৃথিবীরূপ বিস্তৃত কাগজে যদি অনন্ত কাল ধরে লেখা হয়, তথাপি ঈশ্বরের গুণসমূহের সীমা পাওয়া যাবে না। উপনিষদে বলা হয়েছে :
‘একম্ ইভাদ্বিতীম্। নেহনা নাস্তি কিঞ্চন।
নারং কুচিন বভুবকচিৎ।
অর্থাৎ (ঈশ্বর) এক, অদ্বিতীয়। তিনি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই। তিনি কাউকে জন্ম দেন নি এবং তাঁকেও কেউ জন্ম দেয়নি। আরবি বাইবেলে বলা হয়েছে : ‘আর রাব্বু ইলাহুনা রাব্বু ওয়াহেদুন’ (মার্ক-১২ : ২৯)। অর্থাৎ ঈশ্বর আমাদের উপাস্য, তিনি একক। কুরআনে বলা হয়েছে : ‘বলো, তুমি আল্লাহ (যিনি) অদ্বিতীয়। আল্লাহ সবার নির্ভরস্থল। তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তাঁকেও কেউ জন্ম দেয়নি। আর তাঁর সমতুল্য কেউ নেই।’ (সুরা ইখলাস)। আল্লাহর প্রকৃত রূপ অবলোকন করতে মানুষের অক্ষমতা প্রকাশ করে কুরআনে বলা হয়েছে : ‘দৃষ্টিসমূহ তাঁকে পরিবেষ্টন করতে পারে না। অবশ্য তিনি দৃষ্টিসমূহকে পরিবেষ্টন করে আছেন। তিনি অত্যন্ত সূক্ষ্মদর্শী সুবিজ্ঞ। (সুরা আন্’আম : ১০৩)। একই কথা বলা হয়েছে উপনিষদেও :
‘যচ্চক্ষুষা ন পশ্যাতি যেন চক্ষুংষি পশ্যতি
সূক্ষাচ্চ তৎসূক্ষ্ম তরং বিভাতি, সর্বেত্তি বেদ্যং।
(Svetas Vatara-8 : 20) ।
অর্থাৎ কোন চোখ তাঁকে ধরতে পারবে না। তবে তিনি চোখের অন্তস্থলে ধরা দিয়ে থাকেন। তিনি সূক্ষ্ম থেকেও সূক্ষ্মতর এবং সর্বজ্ঞ। উপনিষদে বলা হয়েছে : ‘ঈশাবাস্য মিদং সর্বং সৎকিঞ্চ জগতাং।’ অর্থাৎ ঈশ্বর জগতের সব কিছুকে বেষ্টন করে আছেন। কুরআনের ভাষায় : ‘ওয়া কানাল্লাহু বিকুল্লে শাইঈম মহিত।’ অর্থাৎ আল্লাহ সকল কিছু বেষ্টন করে আছেন। সমাজ হচ্ছে একদল মানুষের জীবনের বিশ্বাসগত দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা গঠিত, যা তাদের অভিন্ন বিশ্বাসের রূপকাঠামোর মধ্যে স্থান পেয়েছে। এ কারণে সমাজ ইতিহাসের পথপরিক্রমার তিনটি উপাদান দ্বারা গঠিত হয়েছে। যথা— মানুষ, প্রকৃতি এবং সামাজিক সম্পর্ক তথা আন্তঃবন্ধন। এই প্রেক্ষাপটে মানুষ দু’ধরনের অভিজ্ঞতার অংশীদার হয়েছে : ১. প্রকৃতির সাথে যোগাযোগ ২. মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগ। এ দুটি যোগাযোগ একে অপর থেকে ভিন্ন এবং অপেক্ষাকৃত স্বাধীন ও স্বতন্ত্র। তবে ধর্ম দর্শনের আলোকে মানুষের এই সম্পর্ক চেতনা আরো এক ধাপ সম্প্রসারিত হয়েছে এভাবে : ১ মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক, ২. মানুষের সাথে প্রকৃতির সম্পর্ক এবং মানুষের সাথে স্রষ্টার সম্পর্ক। মানব সমাজে এই তিনটি আন্তঃবন্ধন সুদৃঢ় হলে মানব ঐক্য প্রত্যাশা করা যায়।
একটি সামাজিক জীবন হিসেবে মানুষের বৃহত্তম সত্তাই হল তার সামাজিক সত্তা। মানুষের আত্মোপলব্ধি বা পূর্ণতা আসে সমাজের মাধ্যমেই। সমাজ বহির্ভূত মানুষের পক্ষে জীবনের পরম কল্যাণ লাভ করা সম্ভব নয়। জন কেয়ার্ড ভাববাদীদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যক্তির এবং সমাজের সম্পর্ক সম্বন্ধে বলেছেন : ‘সমাজ বহির্ভূত ব্যক্তি প্রকৃত মানুষ নয়, সে মানব তার একটি খণ্ডমাত্র। যে নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক উপাদান মানুষের জীবনের সারবস্তু সে তার থেকে বঞ্চিত’। (John Caird, Introduction to Philosophy of Religion, P. 229 )।
ধর্মতত্ত্বের বিশিষ্ট গবেষক বেঞ্জামিন ওয়াকার বলেন : প্যাগান আরবদের সময়ে কাবাগৃহে তিনশ’ ষাটটি মূর্তির মধ্যে প্রধান দেবী ছিলেন তিনজন, দেবতা শ্রেষ্ঠ মাত্র একজন। সে তিন দেবী হলেন— লাত বা আল্লাত, উজ্জা ও মানাত। এবং দেবতা হলেন— এল, আল অথবা আল্লাহ। উল্লেখ্য, যে আরব গোত্ররা যারা হেজাজে বাস করত তাদের প্রধান দেবতা ছিল আল্লাহ, (২৯ : ৬১)। আল্লাহ শব্দের মূল (root) হচ্ছে ‘আল’ অর্থ ‘গড’। এর ভিত্তি হচ্ছে ‘এল’ সেমেটিক ভাষায় স্বর্গীয় নামের কেন্দ্র (nucleus of the divine name)। আল্লাহ শব্দটি গড়ের (God) সাথে জড়িত; যেমন ব্যাবিলিয়ন ও এসিরিয়নে ‘ইলু’, ক্যানানাইটে এল, হিব্র ইলোহিম, আর্মেনিয়ানে আলাহা, নাবাতিয়ানে এলহ বা আলহ মধ্য আরবে ইলাহ। আরও উল্লেখ্য যে, এই প্রধান দেবতার কোন মূর্তি ছিল না, ছিল একটা ছায়া ভাব। এই ছায়া ছায়া ভাবের আল্লাহর ছোটখাটো দেব-দেবীদের মত জনপ্রিয়তা ছিল না। অন্যান্য দেব-দেবী থেকে আল্লাকে আলাদা করে রাখার জন্য নাম দেয়া হয়েছিল আল্লাহ God Most High। প্রাক্ ইসলামি আরব এর ছায়া ছায়া প্রধান দেবতা আল্লাহকে একেশ্বরবাদিত্বের প্রতীক বলে ধরে মান্য করত এবং এইসব আরবরা ছোটখাটো দেব-দেবীর বহুবাদিত্বে বিশ্বাসী ছিল না। এমনকি ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা ঐ সময়ে এই দেবতাকে আল্লাহ বলে শ্রদ্ধা করত। এই নামের কারণে প্রাক্-ইসলামি আরবে বহু মানুষের নামকরণ করা হয়েছিল। যেমন নবী মহম্মদ-এর বাবার নাম ছিল আবদুল্লাহ, (অর্থাৎ) আল্লাহর দাস। তিনি ছিলেন প্যাগান আরব, মুসলিম নয়। খ্রিষ্টানদের মাঝে নাম ছিল আবদেল্লাস (Abdellas)। একজন বিশপের গ্রিক নাম ছিল আবদুল্লা (Abdulla )।
কাবাঘর আল্লাহর পূজা করা হত, এই কারণে এই ঘরের নাম ছিল বায়তুল্লাহ House of Allah (আল্লাহর ঘর)। প্রাক্-ইসলামি কবিতায় আল্লাহকে কাবার প্রভু Lord of the Kaaba বলা হয়েছে। ইসলামপূর্ব আরবের প্রধান কবি ইমরুল কায়েসের (৪৮০-৫৪০ খ্রি.) কবিতায় এর দৃষ্টান্ত আছে। তীর্থযাত্রীরা তাওয়াফ- এর সময় উচ্চারণ করত ‘লাব্বাইক’ বলে। যা এখনো করে। এর অর্থ ‘আমি আল্লাহর ঘরে হাজির।’ আল্লাহর কাছেও মাধ্যমিক দেব-দেবী, যাদের আল্লাহর সাথী-সঙ্গী বলা হয়, তাদের কাছে প্যাগান আরবদের অর্ঘ্য প্রণালির কথা কোরানে উল্লেখ আছে (৬ : ১৩৭)। মক্কাবাসীরা যেমন উল্লেখ করেছিল যে, এ ধরনের পূজা প্রণালি আল্লাহ বারণ করেন নি (৬ : ১৪৯)। আল্লাত, উজ্জা এবং মানাত নামে প্রধান তিনজন নারী দেবতার নাম উল্লেখ আছে কোরানে (৫৩ : ১৯- ২০)[৩২]। হেজাজের এই তিন দেবী গ্রহমণ্ডলীর সভানেত্রী। এদের আল্লাহর কন্যা (বানাতাল্লাহ) বলা হয়। কোন কোন পণ্ডিত মনে করেন যে আল-লাত-এর নাম টানা হয়েছে আল্লাহর নাম থেকে কেননা আল শব্দটা পুরুষ প্রকৃতি। নাবাতিয়ানরা একে যুদ্ধের দেবী বলে মানত। হেরোডোটাস আললাতকে আরবদের মহান দেবী বলে উল্লেখ করেছেন। এর সাথে অন্য দুটি দেবী উজ্জাকে বলা হয় আরবের প্রেমের দেবী, তাঁর থানে (পীঠস্থানে) বলির ব্যবস্থা ছিল এবং মানাত ছিলেন ভাগ্যের দেবী। নাবাতিয়ানদের কাছে এই দুই দেবী অজানা ছিল না। কাবা ঘরে তাওয়াফে সময় প্যাগান কোরাইশরা এই দেবীদের নাম উচ্চারণ করত’ (Benjamin Wakar, The Foundation of Islam. P. 43-45) ।
[৩২. কোরানে সর্বমোট চৌদ্দজন দেবীর নাম পাওয়া যায়। উল্লিখিত তিনজন আল্লাত, উজ্জা এবং মানাত-এর নাম পাওয়া যায় সূরা নাজম (নক্ষত্র)-এ, আর অপর এগার জনের মধ্যে ওয়াদ্দা, সুওয়া, ইয়াগুছা, ইয়াউকা ও নাছরা— এই পাঁচজনের নাম নূহ (নূহ নবী) সুরায় উল্লেখ আছে। অন্য ছয়জন— রুজমা, জিবত, রাশাদ, তাগুত, বাআল ও আজর-এর যথাক্রমে— মদ্দাস্সির (বস্ত্রাবৃত), নিসা (নারীগণ), ছা’ফ (শ্রেণি) ও আনআম (গ্রাম্যপশু) সুরাসমূহে উল্লেখ আছে। (এদের পূর্বাপর পূর্ণাঙ্গ পরিচয়ের বিশদ বিবরণের জন্য দেখুন : তারিখে আরদুল কোরআন, ২৮৫১৯ ইতকান ২/৩৬২৩৬৯)।]
হিন্দুদের বিশ্বাস, সংস্কার, উৎসবাদির সঙ্গে অত্যাশ্চর্য সাদৃশ্য আবিষ্কার করেছেন বহু লেখক-গবেষক। গত শতকে নজরুলের কবিতায় উচ্চারিত হয়েছিল: ‘মোরা এক বৃন্তে দুটো কুসুম/হিন্দু-মুসলমান।’ নজরুল এই উচ্চারণে উদ্ভুত হওয়ার পশ্চাতেও রয়েছে অনেক ঐতিহাসিক কারণ। ধর্মে ধর্মে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে কালের করাল গ্রাসে তার বহু ক্ষতচিহ্ন বেদনা জাগালেও সুমধুর স্মৃতিপটে ফিরে গেলেন সহোদরসম সুসম্পর্কের ঐক্যসূত্রে। এ বিষয়ে ভারতীয় গবেষক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ হেল বাকী তাঁর Sanskrit Legacy to the Arab Intellectual Heritages শীর্ষক গ্রন্থে দেখিয়েছেন প্রাচীন মুসলমানদের উদারতা ও ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের সম্মান ও প্রীতি প্রদর্শনের সুখকর স্মৃতি। ভারতের হিন্দু পণ্ডিতদের চিকিৎসা পদ্ধতির সাথে আরবীয় পণ্ডিতদের চিকিৎসা পদ্ধতির পারস্পরিক নীরিক্ষাধর্মী বহু গবেষণার কথা উল্লেখ করেন তিনি। একজন ভারতীয় রাজা নবী মুহম্মদের কাছে সুগন্ধি আচার পাঠিয়েছিলেন। ভারতবর্ষ থেকে নবী সুগন্ধী উপহার পেতেন এই তথ্য পরবর্তীকালের অনেক লেখকই উল্লেখ করেছেন।
বাঙালির ধর্মচিন্তায় মানবধর্মের উন্মেষ
সমাসবদ্ধ পদরূপে ‘মানবধর্ম’ শব্দটি বাংলা ভাষার কোনও অভিধানে নেই। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাশের বাংলা ভাষার অভিধান, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ ও রাজশেখর বসুর চলন্তিকায় শব্দটি নেই। ষষ্ঠি তৎপরুষ সমাসবদ্ধ মানবের ধর্ম-ই-মানবধর্মবিহিত অর্থে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী মানবধর্ম শব্দটি প্রথম প্রয়োগ করেছেন। (রামেন্দ্র রচনাবলির দ্বিতীয় খণ্ডে ‘কর্মকথা’ পৃ. ৫৩)। তাই বলা যায়— Bacon-এর ভাষায় The word is new, the thing is old । ইহলৌকিকতা, মানবমহিমা, যুক্তিবাদ ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ হচ্ছে ‘হিউম্যানিজম’ বা মানবধর্মের কুললক্ষণ। ‘স্বনির্মাণের প্রাজাতিক প্রসিদ্ধিই মানবতন্ত্রের মূলকথা। নির্বোধ, নিরর্থক, নিরুদ্দেশ, নিস্পৃহ নিরাশ্বাস জগতে মানুষ সাময়িকভাবে হলেও জ্ঞান, অর্থবহতা, রূপকল্পনা, স্বাধীনতা, সুবেদিতা ও ভবিষ্ণুতার জনক ও ধারক হচ্ছে মানুষ। মানবধর্মত বিচারের দুটি দিক রয়েছে—হৃদয়ের দিক ও বিচারবুদ্ধির দিক। বাঙালি চিন্তকদের কাছে মানবধর্মের ধর্মাশ্রিত ও মানবহিতকর দিকটি প্রবল হয়ে উঠেছিল। ফলে পাশ্চাত্য ভাবুকদের মানবধর্ম আর আমাদের ভাবুকদের মানবধর্ম এক ছিল না, প্রাচ্য মানবধর্ম ভোগবাদী নয়। সর্বপল্লীরাধাকৃষ্ণণ যেভাবে বলেছেন— True humanism tells us that there is something more in man then in apparent in his ordinary conciousness, something which frames ideal and thoughts a finer spiritual presence, which makes him dissatisfied with mere earthly pursuits। রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) মানবচিন্তাকে ব্রহ্মবাদের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছিলেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫) তাঁর ব্যক্তিজীবনে যে আদর্শকে মেনে চলতেন, তা ছিল মহানির্বাণতন্ত্রের একটি বচন—
‘ব্রহ্মনিষ্টোঃ গৃহস্থ সাৎ তত্ত্বজ্ঞান পরায়ণঃ।
যদ কর্ম প্রকুর্বীত তদবক্ষণি সমর্পয়েৎ।।
এ আদর্শ রামমোহনও মানতেন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় মহাভারতের একটি উক্তি। ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলছেন— ‘গুহ্য একটি তত্ত্ব তোমাকে বলছি, মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর আর কিছু নেই’। (হুহ্যং ব্রহ্ম তদিদং বো ব্রবীমি। ন মানুষাচ্ছেষ্ঠতরং হি কিঞ্চিৎ)। এভাবে মানবমূল্যের এক দীপ্র প্রবাহ প্রাচীনকাল থেকেই প্রবাহিত ছিল, যা অষ্টাদশ-ঊনবিংশশতকের ভাবুকরা আত্মস্থ করেছিলেন।
মধ্যযুগে চৈতন্যচরিতামৃতের ঘোষণা— ‘কৃষ্ণের যতেক লীলা সর্বোত্তম নরলীলা’। মানবধর্মের এ বোধ বাঙালি চিন্তকরা পেয়েছিলেন তাঁর কাছ থেকে। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে অথর্ববেদের ‘ভূমিসূক্তের’ কথা। যেখানে পৃথিবী ও মানুষের প্রতি গভীর অনুরাগ ঝরে পড়ছে—
‘তুমিই অন্নদা, তুমিই যোগাও ধান আর যব।
পাঁচটি জাতির নরগোষ্ঠি তোমারই রচনা।
তুমি পর্জন্যদয়তা, বর্ষাভোগ্যা
হে পৃথিবী, তোমাকে প্ৰণাম।
সুভদ্রা কল্যাণময়ী হয়ে তুমি প্রতিষ্ঠিত কর
হে ভূমি আমাকে, হে জননী আমাকে সঙ্গতিময় কর
তুমি দ্যুলোকের সাথে। আমাকে নিহিত কর
শ্রীতে, সমৃদ্ধিতে, তুমি কবি– হে ভূমি আমার।
অথর্ববেদের দশম কাণ্ডের দ্বিতীয় সূক্তের ৩৩টি ঋক এই মানুষেরই স্তবগান। পঞ্চদশ কাণ্ডটি ব্রাত্যদের নিয়ে লেখা। ব্রাত্যরা ছিলেন বেদবাহ্য বস্তুতান্ত্রিক চিন্তক। তাঁরা সতত পরিব্রাজক ছিলেন। মানুষকে ইহ জাগতিকতার দিকে নিয়ে যেতে চাইতেন। বেদ বিরোধী ছিলেন বলে এদের সম্পর্কে তেমন তথ্য পাওয়া যায় না। এদেরকে বলা যেতে পারে আদি মানবতান্ত্রিক। তন্ত্রশাস্ত্রেও সংসারকেই মোক্ষলাভের স্থান বলে অভিহিত করা হয়েছে। মোহিতলাল মজুমদার (১৮৮৮- ১৯৫২) উল্লেখ করেছেন এই উক্তিটি—
‘যোগো যোগায়তে সাক্ষাৎ দুষ্কৃতৎ সুকৃতায়তে।
মোক্ষায়তে হি সংসারঃ কৌলধর্মে কুলেশ্বরী।।
এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হল- ‘মোক্ষায়তে হি সংসার’ উক্তিটির মধ্যে রয়েছে সংসারের প্রতি বৈরাগ্য নয়— মোক্ষলাভের কেন্দ্রভূমি সংসার এ কথা মনে রাখতে হবে।
আধুনিককালে রামমোহন মানবতত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। তবে তিনি বৈদান্তিক বুদ্ধিকে নির্ভর করেই মানবভাবুক হতে চেয়েছিলেন। ইয়ং বেঙ্গলদের প্রবল যুক্তিবাদও তাঁর মধ্যে সক্রিয় ছিল। ব্রহ্মবাদের ভেতর দিয়ে মানবধর্মে যেতে চেয়েছিলেন বলেই হয়ত ডিরোজিও তাঁকে বলেছিলেন— হাফ লিবারেল বা অর্ধেক প্রগতিবাদী। শিক্ষাক্ষেত্রে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ধর্মক্ষেত্রে দেবেন্দ্রনাথ, বিজ্ঞানে অক্ষয়কুমার মানবধর্মের কথা বলেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র ‘মানবধর্ম’ শব্দটি ব্যবহার করেননি তবে ‘ধর্মতত্ত্বে’ মনুষ্যধর্ম বিষয়ে আলোচনা করেছেন। অক্ষয় কুমার দত্ত বাহ্য প্রকৃতির সাথে মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার গ্রন্থে ‘ধর্মনীতি’ শব্দটির প্রয়োগ করেছেন। তিনি লিখেছেন— ‘মানুষের কতকগুলি শক্তি আছে। আমি তাহার বৃত্তি নাম দিয়াছি। সেইগুলির অনুশীলন, প্রস্ফুরণ ও চরিতার্থতায় মনুষ্যতত্ত্ব। তাহাই মানুষের ধর্ম।’
সমগ্রতাকে স্পর্শ করার সাধনাই মানবধর্ম। বেদে, পুরাণে, বুদ্ধের প্রেমে, খ্রিষ্টের করুণায়, হজরতের সাম্যবোধে, বাংলার বাউলদের রহস্যময় কায়া সাধনায়, শাস্ত্র-শাসনের বাইরে গিয়ে মানুষরতনকে চিনে নেবার আকুলতা থেকেই মানবধর্ম অভিব্যঞ্জনা লাভ করেছে। রবীন্দ্রনাথের দুটি ভাষণে এই তত্ত্বে অবয়ব লাভ করেছে। ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে অক্সফোর্ডে প্রদত্ত Religion of Man, ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেয়া কমলা বক্তৃতায় ‘মানুষের ধর্ম’, ওয়ালটেয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষণ ‘Man’ (১৯৩৩)-এ রবীন্দ্রনাথের মানবধর্মকে তাঁর জীবন ধর্মের ভাষ্যরূপে পাই। বিশ্বকবি যখন বলেন,
‘শুধু এইটুকু জানি, তারি লাগি রাত্রি অন্ধকারে
চলেছে মানবযাত্রী যুগ হতে যুগান্তর পানে
ঝড়ঝঞ্ঝা বজ্রপাতে জ্বালায়ে ধরিব সবখানে
অন্তর প্রদীপখানি।’
হেমন্তবালা দেবীকে লেখা একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘আমার ঠাকুরের ধ্যান তোমার কাছে রাখলুম সমস্ত পৃথিবীর ইতিহাসের মাঝখানে, সকল বীরের তপস্যায়, সকল প্রেমিকের ত্যাগে’। এসব লেখা রবীন্দ্রনাথের নয়, তার মর্মস্থলে যে কবি আছে তারই, সে কবির আসন সকল দেশেই, সকল মানুষের অন্তরে-…।
যোগেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ আমাদের উপযোগী করে ‘হিউম্যানিজম’ শব্দটির নাম রাখতে চেয়েছিলেন ‘নারায়ণী।’ প্রবোধচন্দ্র সেন ‘নারায়ণী’ শব্দটির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেছিলেন ‘ভারতীয় ভাব-কল্পনার অভিপ্রায়’–এই শব্দটি প্রকাশ করতে সক্ষম।
রবীন্দ্রনাথ মধ্যযুগের কবি রজ্জবকে উদ্ধৃত করে বলেছেন Religion of Man God man (Nara-Narayana) is the definition, it is not a delusion but truth। তাঁর মানবতান্ত্রিক মনোভঙ্গি রীতি চমৎকারভাবে প্রকাশিত হয়েছে একটি কবিতায়–
‘হে চিরকালের মানুষ, হে সকল মানুষের মানুষ
পরিত্রাণ করো।
ভেদ চিহ্নের তিলকপরা
সংকীর্ণতার ঔদ্ধত্য থেকে।
হে মহান পুরুষ, ধন্য আমি, দেখেছি তোমাকে
তামসের পরপার হতে
আমি ব্রাত্য, আমি জাতিহারা।’ (পত্রপূট)
বৈশ্বিক ধারণায় মানবধর্ম
ফরাসি দার্শনিক আগুস্ত কোঁতে (১৭৯৭-১৮৫৮) ‘পজিটিভিজম’ নামে যে তত্ত্ব প্রচার করেন তার অনুরাগী তিনজন ব্রিটিশ রাজকর্মচারী হেনরী কটন, জেখম গেডেম ও স্যামুয়েল লব। তাঁদের প্রেরণায় কলকাতায় পজিটিভিজম ক্লাব গঠিত হয়। বঙ্কিম, ভুদেব মুখোপাধ্যায়, কবি বিহারীলাল তার অনুগামী হন। এভাবে এ দেশের ভাবুকদের মধ্যে মানবধর্মের অন্য একটি রূপ পটভূমি রচনা করে। বেকন, ডেকার্ট, লক, হিউম, বেন্থাম, ডারউইন স্পেন্সার ও রাসেলের ভাবধারা এবং পশ্চিমের জানালা খুলে যায় বাঙালি ভাবুকের সামনে।
শুধু বাঙালি সমাজেই এই মানবভাবনার চেতনা বিকাশ বিস্তৃত হয়েছিল তা নয়, মহারাষ্ট্রের জ্যোতিরাও ফুলে (১৮২৭-১৮৯০) ‘গোলামগিরি’ বা Slavery in the Civilised British Government under the clock of Brahminism ATE ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধী অথচ মানবতাবাদের পক্ষে ‘সেলফ রেসপেক্ট’ বা আত্মমর্যাদার আন্দোলন করেন। তিনি মনুস্মৃতি মানবধর্ম, শাস্ত্রকে বিবেক বিরোধী বই বলে প্রত্যাখ্যান করেন। অথচ মনুর এই পুঁথি পড়ে জানা যায় ‘অবর’—অর্থাৎ শূদ্রের কাছেও শুভ বিদ্যা শ্রদ্ধা সহকারে শিক্ষা করা উচিত বলে নির্দেশ দিয়েছেন ২/২৩৮ শ্লোকে। জনৈক গবেষক দেখিয়েছেন জার্মান দার্শনিক নিৎসের (১৮৪৪- ১৯০০) বিখ্যাত ‘Philosophy of Superman’-এর কিছু প্রেরণা যুগিয়েছিল মনুস্মৃতি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিখাগোষ্ঠি বুদ্ধির মুক্তির আন্দোলন করে মানবধর্মের এক নতুন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিকশিত করে। বুদ্ধি যেখানে সীমিত, জ্ঞান সেখানে সংকীর্ণ, মুক্তি সেখানে অসম্ভব—এই মানবধর্মের প্রত্যয় ছিল কাজী আবদুল ওদুদ প্রমুখ চিন্তকের। এ বিষয়ে শিবনারায়ণের ব্যাখ্যা তাৎপর্যপূর্ণ। সংক্ষেপে মানবধর্মের ভাবুকদের চিন্তাযোগের একটা রূপরেখা আঁকার চেষ্টা করেছেন তিনি। দার্শনিক মহামানব্রতের ‘মানবধর্ম’ প্রসঙ্গটি এখানে স্মরণ করা যায়। ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকার শিকাগো শহরে World Felloship of Faith শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে Religion of Man শীর্ষক বক্তৃতায় হিন্দুধর্মকে তিনি ‘Religion of a gentleman’ (ভদ্রলোকের ধর্ম) বলে অভিহিত করেন।
সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীর য়ূরোপ বুঝতে পেরেছিল মানুষই সৃষ্টিনেমির কেন্দ্র। ফরাসি ভাষায় যাকে বলে ‘Pumouniversale’ অর্থাৎ ‘বিশ্বমানব’— সেই মানবই হচ্ছে আমাদের পূজার বস্তু। এ অভিজ্ঞতা মনস্পতি মহানামব্রতের হয়েছিল আমেরিকায়। পাশ্চাত্য প্রব্রজ্যা তাঁকে প্রাণিত করেছিল আচারশীল বৈষ্ণব হয়েও মানবধর্মের কাছে নত হতে।
মহানামজি মনু রচিত মানবধর্মশাস্ত্র থেকে অহিংসা, অচৌর্য, শুচি, সংযম ও সত্য নামক মৌলনীতিকে গ্রহণ করে পাশ্চাত্যে শুদ্ধ মানব হওয়ার কথা বলেছিলেন এক নতুন অভিধায় Religion of gentletman বা ভদ্রলোকের ধর্ম বলে। তাঁর আদর্শ অনুসৃত ধর্মগুরু জগদ্বন্ধু সুন্দর বলেছেন— ‘ভদ্রকে বিগ্রহ বলে।’ ‘বিদ্রোহ’ মানে যেখানে বিশেষভাবে রূপ পরিগ্রহ করা হয়েছে, সেই বিশেষ রূপ হচ্ছে ‘ভদ্ৰ’। এটাই মানবধর্মের উপপাদ্য।
খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে একজন ভারতীয় দার্শনিক গ্রিস দেশে গিয়ে প্রখ্যাত গবেষণার বিষয় নিয়েছিলেন মানুষের জীবন। এ কথা শুনে ভারতীয় দার্শনিক মৃদু হেসে বললেন, ঈশ্বরকে উপলব্ধি না করেই মানব জীবনকে জানতে চান? তা তো সম্ভব নয়। ড. মহানামব্রতেরও সম্ভবত এই একই অভিমত। Dharma of Man নামের ক্ষুদ্র পুস্তিকায় প্রসঙ্গটিকে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন।
‘মানবধর্ম’ নামের মাত্র ৪২ পৃষ্ঠার বই দার্শনিক মহানামব্রতের তাবৎ চিন্তা মানবধর্মকে কেন্দ্র করেই বৃত্তায়ত। প্রারম্ভেই তিনি ‘ধর্ম’ শব্দটির মৌল অর্থ-ব্যঞ্জনা বিষয়ে ব্যাখ্যাতা হয়েছেন। তিনি বলেছেন, ধর্ম হচ্ছে মানুষের essential property বা inherent quality ‘ধর্ম’ শব্দটিকে ইংরেজিতে অনুবাদ করা যায় এমন শব্দ ইংরেজি অভিধানে নেই। Religion শব্দটি ‘ধর্ম’ শব্দের সমার্থক নয়। বিষয়টি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, মানুষ আর পশুতে পার্থক্য এই যে, পশু ধর্ম নিয়ে জন্মায় আর মানুষকে মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হয়।
মনু কথিত পঞ্চতত্ত্বের আলোকে মানুষকে শুদ্ধ মানুষ হতে হবে, আর তার ব্যত্যয় হল ড. ব্রহ্মচারীর ভাষায় ‘মনুষ্যত্ব’ নামে একটা গুণ, যদি দেখ যে, এটা নেই, তাহলে তাকে মানুষ বলতে পারা যায় না (মানবধর্ম, পৃ. ১২)। কাউকে হিংসা করা যাবে না, পরদ্রব্য চুরি করা যাবে না, দেহে মনে শুচিতা রক্ষা করতে
হবে, সংযম পালন করতে হবে— সবশেষে সত্যকে আশ্রয় করে চলতে হবে। তবেই মানুষ হবে শুদ্ধতম মানুষ। তখন তার অভিযাত্রা দেবত্বের দিকে। দেবত্ব বা দিব্যতা একটা উচ্চতর মানসিক অবস্থার নাম। মানুষকে শেষে সেই দিব্য প্রকাশের কাছেই যেতে হবে। এই পর্যায়কে ড. মহানাম তুলনা করেছেন ‘মম সাধৰ্মমগতাঃ’ অর্থাৎ মানুষকে শেষে আমার ধর্ম লাভ করতে হবে। স্রষ্টা বলেছেন, আমার ধর্ম পাবে মানুষ। এই পাওয়ার জন্যেই মানুষ সব সাধনকে নিয়োজিত করবে। ‘শিক্ষা’ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে মহানাম বলেন— ‘ভূমিটা লাভ হয়নি। কোথায় দাঁড়িয়ে যে বিশ্বটাকে দেখতে হবে তা লাভ হয়নি—’অলব্ধভূমিং গত্বা’– যেখানে দাঁড়ালে আপনার জীবন, আমার জীবন, সমগ্র জীবনটা ঠিক দেখতে পাওয়া যাবে, সেই স্থানটি লাভ না হলে, জীবনের যতকিছু সম্ভার সবই ব্যর্থ হয়ে যাবে।
মহানামব্রতজী মানুষকে যেখানে নিয়ে যেতে চান—সেই পর্যায়কে বলা যায়— নরকে নরোত্তম করা নয়, নরকে নারায়ণ করারই তিনি উচ্চমূল্যের সাধ্য বলে মনে করেন। টমাস পেইন তাঁর The Age of Reason গ্রন্থে লিখেছেন : I believe in equality of man, and I believe that religions duties consist in doing our fellow creatures happy। মানবতার এই সাধর্ম আমাদেরকে মুগ্ধ করে। একই রকম উচ্চারণ দেখি স্বামী বিবেকানন্দের লেখায় – Man is to become divine by realising the divine. ভাবুকতার অবাক করা মিল খুঁজে
Bertend Russell- A Freeman’s Worship Mysticism and Logic (1954) এবং শিবনারায়ণ রায়ের যে আলোকে অনেক আঁধার জন স্টুয়ার্ট মিলের Three Essays on Religion গ্রন্থের প্রতিপাদ্যের সঙ্গে। বৈষ্ণববেদান্তে (Vaisnave Bedanta – The Philosophy of Sir Jiva Gaswami) নামক শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিসন্দর্ভে মহানামব্রতজী একটি অধ্যায় যুক্ত করেছেন Bhajana-Discipline and dedication নামে সেখানেও শুদ্ধতম মানুষের কথা বলা হয়েছে। মানুষকে দাঁড়াতে হবে যে ভূমিতে, সেই স্থানই হচ্ছে মানুষের মনের মানুষের পৃথিবী। The Dharma of mankind is humanness and man has to acquire it. Hence all of us must first learn and practice his Dharma of humaneness। আচার্য মহানামব্রত বলেছেন, ‘মানবধর্ম, সকলের ধর্ম।’ ‘মত’ বা ‘ইজম’ হচ্ছে উদার আকাশকে জানালা থেকে দেখা। মানবধর্ম হচ্ছে সবুজ প্রান্তরে দাঁড়িয়ে নীলিমার নীলে একাত্ম হয়ে যাওয়া। মানব সভ্যতার সুরক্ষা আর মানবিকী জীবনচর্যার সুভদ্ৰ কৃষ্টি নির্মাণের জন্যে মানবধর্মই একমাত্র অবলম্বন হওয়া উচিত— এ কথাটাই তাঁর চূড়ান্ত অভিমত।
The original term of ‘Dharma’ means ‘Sanatana’ or internal. Acharya Mahanambrataji said in his ‘Phelalabvaishys’ (an introduction to Bhagavatam)- When a man loves God it is called ‘Iswar prem’ or loves of God, when man loves his fellow beings, it is called- ‘Manavpriti’ or Loves of mankind, There is a close affinity between the two। ‘ঈশ্বরপ্রেম’ ও ‘মানবপ্রীতি’ এক সময় একই সমতলে গিয়ে গন্তব্যমুখী হয় মানবতার। বেদে একটা প্রার্থনা আছে— ‘আমাদের মনকে ভদ্র কর, প্রসন্ন কর, পবিত্র কর।’ এই যে ‘ভদ্র’ করার আকুলতা— সেখানে মানবতা তর্জনী উঁচিয়ে বলছে আমার স্বরূপ লাভ করো। মানবধর্ম গ্রন্থটির মধ্যে আটটি বিষয় প্রকরণ রয়েছে :
১. ধর্ম কাকে বলে?
২. মানবধর্ম অর্থাৎ মনুষ্যত্ব। ৩. মনুষ্যত্বের পাঁচটি লক্ষণ।
৪. মনুষ্যত্বের পরের ধাপ দেবত্ব।
৫. ইংরেজিতে রিলিজিয়ন, সংস্কৃতে ‘মতম’।
৬. মনুষ্যত্ব শিখতে হবে, শেখাতে হবে।
৭. সনাতনধর্মের আসল নাম মানবধর্ম।
৮. একটিই শ্লোগান মানুষ্যত্বলাভ কর।
‘মানবধর্ম’ পাঠ করে ড. অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন— ‘একখানি ক্ষীণ কলেবর আলোচনায় তাঁর মনন ও মনীষা, দার্শনিক প্রত্যয় ও জ্ঞান ভূয়িষ্ট চিন্তাধারার এমন সূক্ষ্ম দূরবগাহ প্রকাশ ঘটেছে যে বৃহৎ গ্রন্থেও তাঁর সাক্ষাৎ পাওয়া যায় না। তথ্য-তত্ত্ব ও ক্রান্তিদর্শী দৃষ্টি না থাকলে এত স্বল্প পরিসরের মধ্যে জ্ঞানের খনি উন্মুক্ত করা যায় না। বিষয়সূচির দিকে তাকালে উপলব্ধি করা যায় উক্তিটি কত সত্য ও অতলস্পর্শী। অধ্যাত্ম মার্গের সাধক বিশ্লেষণ করেই বৈজ্ঞানিক মনোভঙ্গিতে, কখনও যুক্তির উপর আবেগকে মার্গের সাধক বিশ্লেষণ করেই অসিত কুমার বলেছেন গ্রন্থটি ‘অক্ষয় বটের বীজ’। আমরা মনে করি এক ‘মনোময় মহাদ্রুম’। প্রসঙ্গের প্রতিটি চিন্তনকে চিন্ময় ভাবনায় প্রকাশ করেছেন মহানাম। আমরা স্পর্শ করেছি প্রতিটি প্রকরণকেই। উপলব্ধি করেছি ভাবুক মহানামের আরেক রস প্রস্থানকে, যা চিন্তার লাবণ্যে অমিত বিত্ত।
‘ফেলালব ভাষ্য’ ছিল রসমাধুরীতে ভরা— মানবধর্ম হচ্ছে মননের মধুতে ভরা। সূত্রধর্মী আঙ্গিক প্রয়োগের ফলে তার চিন্তা এখানে মিতবাক ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। বিস্তার না হয়ে হয়েছে ঘনীভূত। এতে লাভ হয়েছে, সহজেই তাঁর মানবধর্ম বিষয়ক ভাববৃত্তকে প্রদক্ষিণ করে আসা যায়। পরিধি যদি আরও বিস্তারবহুল হত— হয়ত সহজে আমরা অনুসরণ করতে পারতাম না।
বৈষ্ণবীয় আচার ও নিষ্ঠার অনুগত থেকেও যে তিনি এমন মুক্তবুদ্ধির চাষ করেছেন সেটাই এক বিস্ময়! সেখানে প্রায় বৈপ্লবিকভাবনার ক্ষেত্রাধিকারী হয়ে বসে আছেন। অধ্যাত্ম ভাবকে অস্বীকার না করে, মানুষের সমগ্রতাকে স্পর্শ করেছেন লোক কল্যাণ চিন্তায়। এখানেই দার্শনিক মহানামব্রতের শ্রেষ্ঠত্ব। বিরোধী বাতাসে কখনও ‘তমসা ধিকৃত’ হয়নি তাঁর চিন্তাযোগ।
অভিনিবেশী মনে বিচার করলে দেখা যাবে, মহানামব্রতের মানবধর্ম অস্বীকার করেনি অধ্যাত্ম-চেতনাও ত্যাগী মন্ত্রের জীবনচর্যাকে। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে এলেন গঠশালক ও শিবনারায়ণ রায় যুগ্মভাবে যে বই প্রকাশ করেছিলেন In man’s own image নামে, সেখানে তাঁরা মানবধর্মকে বস্তুতান্ত্রিকতার ভেতরেই স্থাপন করেছেন। তাঁরা অস্বীকার করেছেন ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতাকে। সাম্যবাদ বা কমিউনিজমের মতাদর্শে তাঁরা স্থাপন করেছেন তাঁদের চিন্তাসূত্র। এ প্রসঙ্গে একটি উক্তির কথা স্মরণ করা যায়—নিরীশ্বরবাদী কমিউনিজম নানা রূপে চরিত্রে তখন বহুরূপী It is a cap that has lost it shape, because everybody wear’s it। সাম্যবাদ এমন একটি টুপি, যার আকার নষ্ট হয়ে গেছে, বহু ব্যবহারে জিনিসটা জীর্ণ হয়ে পড়েছে। জীবনের চরম অবস্থা বুঝাতে গিয়ে মানবধর্মের পুরোধা প্রবক্তা ড. ব্রহ্মচারী লিখেছেন— ‘মেন একটা আননোন ফ্যাক্টর আছে, যা না জানলে জীবনের অঙ্ক মেলে না।’ (মানবধর্ম, পৃ. ১৭) আবার বলেছেন— ‘মানুষের ভেতরে একটি ঘুমন্ত শক্তি আছে, একটি ডিভাইন সম্পর্ক আছে, একটা দেবত্ব আছে। তাই তো মানুষ মানুষের চেয়ে অনেক বড় হতে পারে’। (মানবধর্ম, পৃ. ২১) ‘মতের’ খোয়াড় বন্দী মানুষকে তিনি দাঁড় করে দিয়েছেন মহামানবের সাগর তীরে।
একজন দার্শনিক মানুষের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন— ‘মানুষ ডানাবিহীন দ্বিপদ জন্তু ছাড়া আর কিছুই নয়’। এখন যদি একটা পাখির ডানা কেটে বলা হয় এটা মানুষ আমরা কি এ সংজ্ঞা মেনে নেব? আরেকজন লিখেছেন— Man is a creature full of natural error। মানুষের জীবন কি শুধু ভুল ত্রুটিতে ভরা? নাকি একই লেখকের উক্তি আবার স্মরণ করব— মানুষ মানুষের কাছে দুর্বোধ্য। এসব নেতিবাচক সংজ্ঞা আলোচ্য মানবধর্মের চিন্তার সঙ্গে সম্পর্কে যুক্ত নয়। তুমি থেকে ভূমার গন্তব্যে যাওয়ার ‘পথ চলার বিধি বিধান’ ও নৈতিকতার এক আলাদা ঘরানা মহানামের মানবধর্মে বিভাসিত। বরং নজরুলের সৃষ্টিবীক্ষায় বিষয়টি দেখি আরও বেশি বৈশ্বিক ও সর্বমানবিক প্রকাশে উচ্ছ্বসিত উচ্চারণে উদ্ভাসিত হয়— ‘আমি বিশ্বের মহা বিস্ময় আমি বিশ্ব বিধাত্রির।’ কেননা মানুষের মানবধর্ম যদি স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হয়— তখন মানুষই হয়ে ওঠে বিশ্বের বিস্ময়!
প্রখ্যাত মানবতাত্ত্বিক ভবতোষ দত্ত তাঁর বাঙালির মানবধর্ম গ্রন্থ অমোঘ উচ্চারণ করেছেন— ‘আমরা হিউম্যানিজম বলতে যা বুঝি বাঙালির ধর্ম সংস্কৃতিতে মানবকেন্দ্রিকতা তা নয়। হিউম্যানিজমের একটি বিশেষ অর্থই ইতিহাসে স্বীকৃত, বাঙালির ধর্মাশ্রিত মানবতা তার সঙ্গে মেলে না। বস্তুত এই জন্য আমরা একে বাঙালির মানবধর্ম বলি’। উনিশ শতকে যে হিউম্যানিজম আমাদের জাগরণ ঘটিয়ে তুলেছিল সেটা অন্য বস্তু। সেই অন্য জিনিসই পাওয়া যাবে ড. মহানামব্রতের বিবেচনায়। তাঁর মানবতন্ত্রকে বলা যায় বৈষ্ণব বৈদান্তিক মানবধর্ম। যেখানে বস্তু পৃথিবী ও ভাব পৃথিবী এক জায়গায় এসে মিলিত হয়েছে। এ মিলনে কেউ তার নিজস্বতা হারায়নি! এখানে মানবধর্ম মানে শাশ্বতধর্ম। এখানে মানুষ কোনও অনাধ্যাত্মিক পথের যাত্রী নয়।
আমেরিকার শিকাগো শহরে যে ধর্মসভা হয়েছিল সেখানে সাতটি ধর্মের লোক বক্তব্য উপস্থাপন করেছিলেন। বিষয় ছিল Whether religion can provide an adequate philosophy of life a modern man। আধুনিক মানুষের জন্যে ধর্ম কোনও যুক্তিগ্রাহ্য সমাধান দিতে পারে কি? বিভিন্ন ধর্ম মতের লোকেরা নিজ নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করেন এবং অন্য ধর্মকে সহ্য করার কথা বলেন। ড. ব্রহ্মচারী বলেন, অন্য ধর্মকে সহ্য করব কেন। সব ধর্মকে শ্রদ্ধা করব। ভদ্রজনের ধর্মকে নাম দেব Religion of gentleman। তিনি বলেন মানবধর্মের অন্য পরিভাষা হচ্ছে হিন্দুধর্ম। এ ধর্ম কখনও কোনও ধর্মান্তরের চেষ্টা করেনি। কখনও অজ্ঞতা ও দারিদ্রতার সুযোগ কোনও নিম্নবর্গের ধর্মকে পদদলিত করেনি। সকলের জন্যেই এ ধর্ম। সকলেই এ ধর্মের। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ধ্রুব উদ্ধৃতি করা যায়। হেমন্তবালা দেবীকে লেখা এক পত্রে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন— ‘আমি হিন্দু সমাজে জন্মগ্রহণ করেছি। আমি ব্রাহ্ম সমাজভুক্ত। আমার ধর্ম বিশ্বজনীনতা। সেটাই হিন্দুধর্ম।’ রবীন্দ্রনাথের ধর্ম কী? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। সার্বজনীনতাই হিন্দুধর্ম অর্থাৎ মানবধর্ম। ‘মেরুতন্ত্র’ বলেছেন, ‘হীনমদোষয়তি ইতি হিন্দু’ অর্থাৎ হীন কাজ যে করে না সেই হিন্দু। এ সংজ্ঞা মানব ধর্মেরই।
Hinduism[৩৩] শব্দটি যারা তৈরি করেছেন, তাঁরা প্রকাণ্ড ভুল করেছেন। Hindu তো একটা Ism নয়। হিন্দুর মধ্যেই তো বহু ‘ইজম্’ (মানবধর্ম-পৃ. ২৩)। ড. ব্রহ্মচারী যখন এ অভিমত দেন তখন মনে হয় মানসতায় তিনি রবীন্দ্রনাথের খুব কাছাকাছি। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামও বলেছেন ‘টীকীত্ব’ ‘হিন্দুত্ব’ নয়। মানবধর্মই হচ্ছে হিন্দুত্ব।
[৩৩. হিন্দুর মধ্যেই তো বহু ইজম্ রয়েছে। যেমন শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব, আর্যসমাজী, ব্রাহ্ম ইত্যাদি। এগুলো সবই ‘মতম্’। হিন্দু একটা ধর্ম, বিরাট ধর্ম— তার মধ্যে বহু মত থাকতে পারে। আমার শুধু দেখা প্রয়োজন, আমি আপনার মতকে শ্রদ্ধা করি কিনা, এবং আপনি আমার মতকে শ্রদ্ধা করেন কিনা। ইংরেজীতে আর একটি বিশ্রী শব্দ আছে religious toleration । tolerance অর্থ সহ্যগুণ, পরমত সহিষ্ণুতা। কিন্তু আপনার মতকে আমি সহ্য করতে যাব কেন? সহ্য করার অর্থ কী? আপনি আমার প্রতিবেশী। আমি ভাল, কিন্তু আপনি ভাল লোক নন— এ অবস্থায় আমি কী করব? প্রতিবেশী হিসাবে সহ্য করে যাব। এ তা নয়। আমি আপনার মতকে শ্রদ্ধা করি, আপনার মতকে appreciate করি, tolerate করি না, আপনি যে মতে আছেন, আচার্য করে নিয়ে যে পথে যাচ্ছেন, তাতে আমার গভীর শ্রদ্ধা আছে। আমি আমার মতে আছি। আমি আমার মাকে ভক্তি করি, আপনি আপনার মাকে ভক্তি করেন, গভীর ভক্তি করেন- তাতে তো আমারও আনন্দ। তেমনি প্রত্যেক মতকে, প্রত্যেক ‘ইজ্জ্ম’কে শ্রদ্ধা করতে হবে, এ শিক্ষাই তো মানবধর্ম দিয়ে থাকে। সবচেয়ে বড় প্রয়োজন কি? মানুষ চুরি করবে না, মিথ্যা বলবে না, হিংসা করবে না, পরের ক্ষতি করবে না— তবেই হল ধর্মরাজ।’ (ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারী কর্তৃক ‘World Fellowship of Faiths’ শীর্ষক আমেরিকায় প্রদত্ত বক্তৃতার ইংরেজি নামকরণ করেন ‘Religion of a Gentlemen’ ভদ্রলোকের ধর্ম। পরে এটি বাংলায় ‘মানবধর্ম’ নামে বহুল প্রচারিত হয়।]
ঈশ্বর নাই! ঈশ্বর আছেন!!- নামক সুপ্রদ্ধি গ্রন্থে মহানামব্রতজী লিখেছেন ‘সকলকে বলিয়াছি— মানুষের ধর্ম মনুষ্যত্ব। অহিংসা, অচৌর্য, সত্য, শৌচ, সংযম ইহাই মানব জাতেরই ধর্ম। সকলকে আগে মানব হইতে হইবে, তারপর যে মত ইচ্ছা গ্রহণ কর। গীতা কৃষ্ণের মত, কোরান ইসলামের মত, আর বাইবেল যিশুর মত; যাহারা যেমন ইচ্ছা গ্রহণ করিবার অধিকার আছে’। তিনি হজরত ওমরের একটা কাহিনী এ সম্পর্কে বিভিন্ন ভাষণে বলতেন। একদিন ধর্মসভায় ভাষণ দেবার জন্যে খলিফা ওমর মদিনা থেকে বাগদাদ যাচ্ছিলেন মরুভূমির মধ্য উটে চড়ে। সঙ্গে একজন ভৃত্য উটের লাগাম ধরে হেঁটে যাচ্ছিল। যখন নামাজের সময় হল ওমর উটের ওপর থেকে নেমে সঙ্গী ভৃত্যকে নিয়ে নামাজ আদায় করেন। নামাজ শেষে খলিফা ওমর ভাবেন- আমরা দুজনের একসঙ্গে নামাজ পড়লাম। কোরানের একই সুরা পাঠ করলাম। একইভাবে প্রার্থনা করলাম। খোদার চোখে সবাই সমান। তাই আমি উটে চড়ে যাব আর সে গরম বালুতে পায়ে ফোসকা লয়ে যাবে। সেটা তো উচিত নয়। তখন হজরত ওমর নিজে ঘোড়ার লাগাম ধরে চললেন, ভৃত্যকে উটের উপর বসিয়ে দিলেন। এ কাহিনীতে মানবমূল্যের এক অতি উচ্চ উদাহরণ উদ্ভাসিত হয়।
উল্লিখিত ঘটনার পটভূমি নিয়েই নজরুল রচনা করেন তাঁর অবিস্মরণীয় উপদেশমূলক কবিতা ‘উমর ফারুক।’ দশ স্তবকের এই দীর্ঘ কবিতার শেষ স্তবকটি এরকম :
ভৃত্য চড়িল উটের পৃষ্ঠে উমর ধরিল রশি,
মানুষে স্বর্গে তুলিয়া ধরিয়া ধূলায় নামিল শশী!
জানি না, সেদিন আকাশে পুষ্প-বৃষ্টি হইল কিনা,
কী গান গাহিল মানুষে সেদিন বন্দি বিশ্ববীণা!
জানি না, সেদিন ফেরেশ্তা তব ক’রেছে কি না স্তব
অনাগত কাল গেয়েছিল শুধু ‘জয় জয় হে মানব।’
প্রকৃতপক্ষে সৃষ্টির সেবাই স্রষ্টার সপক্ষের কাজ। সৃষ্টিকুলের সবাইকে মনুষ্যত্বে উদ্বুদ্ধ করাই সকল ধর্মশাস্ত্রের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। মানুষের স্বপ্রচেষ্টায় প্রয়োজন মনুষ্যত্বের উদ্বোধন। কিন্তু মানুষের মনুষত্ব উদ্বোধিত হয় না কেন? এর অন্তরায়গুলি কী? রবীন্দ্রনাথ এর উত্তর খুঁজে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে :
‘হিন্দু নিজেকে ধর্মপ্রাণ বলিয়া পরিচয় দেয়, মুসলমানও তাই দেয়। অর্থাৎ ধর্মের বাহিরে উভয়ের জীবনের অতি অল্প অংশই অবশিষ্ট থাকে। এই কারণে এরা নিজ নিজ ধর্ম দ্বারাই পরস্পরকে এ জগতের অন্য সকলকে যথাসম্ভব দূরে ঠেলিয়া রাখে। এই যে দূরত্বের ভেদ করে এরা নিজেদের চারিদিকে অত্যন্ত মজবুত করে গেঁথে রেখেছে, তাতে করে সকল মানুষের সঙ্গে সত্য যোগে মনুষ্যত্বের যে প্রসার হয়, তা এদের মধ্যে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। (‘সমস্যা’)।
ধর্মে মানব ঐক্য ও সমন্বয়ী চেতনাই পারে এই বাধা দূর করতে।
ভাগবত ব্যাখ্যায়ও মহানামব্রতজি মানবতার জয়গান গেয়েছেন। ‘মানবপ্রীতি দাঁড়াইতে পারে না ঈশ্বর প্রেমের সুদৃঢ় ভিত্তিভূমি ছাড়া। মানবপ্রীতি, বিশ্বপ্রেম এসবও সম্পূর্ণ অসম্ভব শ্রীভগবানের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক না হইলে।’ ‘মানবধর্ম’ এই প্রত্যয়টি যে সর্বক্ষেত্রেই প্রয়োগ করা যায়। ‘ফেলালব ভাষ্য’ তার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।
মহানামের মানবধর্ম তাঁর সাধনপুণ্য জীবন চিন্তারই সুমহান আদর্শরূপে বর্ণিত। বিশ শতকের তৃতীয় দশকে রবীন্দ্রনাথ ‘মানুষের ধর্ম’ নিয়ে ইংরেজি ও বাংলায় ভাষণ দান করেন। এ সময়েই বাঙালির মনন ধারায় আরো কয়েকটি চিন্তাধারা এসে যুক্ত হয়। গান্ধী, মার্কস ও ফ্রয়েড এরা এ সময়েই নিজনিজ চিন্তাধারা বাঙালির মনোলোক দখল করে নেন। গান্ধী কিংবা মার্কস বাঙালির রাষ্ট্র ভাবনার ক্ষেত্রকে মানবতাবাদের দিকে নিয়ে যেতে মানবেন্দ্রনাথ রায় ‘নবমানবতাবাদ’ নিয়ে আসেন এ সময়েই। মানুষের সমাজ ও সমস্যা গুরুত্ব পায় তাঁদের চিন্তায়। এ প্রেক্ষিতে ড. মহানামব্রতের মানবচিন্তন একটা আলাদা মাত্রাকে যোগ করে। এটি ফলিত কোন বিষয় নয়, আমাদের বিশ্বাস ও আচরণের মধ্যে মানবিক গুণাবলির বিস্তার করতে চান। ফলে তাঁর মানবধর্ম ধরা দেয় প্রাচ্যের বিরুদ্ধে দ্রোহরূপে— এটাই তাঁর বৈশিষ্ট্য। তাঁর মানবধর্ম ধর্মাশ্রিত হয়েও সর্বমানবিক।
বিষয়টি তাঁর কাছে জ্ঞানচর্চার বিষয় নয়— জীবনে, বিশ্বাসে মূর্ত করার বিষয়। কোন দার্শনিক বিষয় নয়— জীবনে প্রয়োগ করার জীবনশাস্ত্র দেববাদ মানবতাবাদেরই নামান্তর যেমনটি বলেন বিপিন চন্দ্র পাল (১৮০৮-১৯৩২)। ‘বাংলার দেববাদ আছে সত্য কিন্তু বাংলায় যে সকল দেবদেবী পূজা প্রচলিত তাহাদের সকলের মধ্যেই একটা উদ্ভূত মানবতা ফুটিয়ে উঠিয়াছে।’
শিকাগো ভাষণে মহানামব্রতজি একটি কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন সেখানেই কবি আত্মা ও কাব্যশিল্পের ব্যঞ্জনা-মুখর হয়েছে নান্দনিক মানবধর্ম চেতনা :
The Whole world our family
The sky our canopy, nature our bed
Earth our world mother, all beings brothers.
‘সমস্ত বিশ্ব একটি গ্রহ পরিবার
আকাশ আমাদের আচ্ছাদন,
প্রকৃতি আমাদের শয্যা–
পৃথিবী আমাদের মাতা,
জগতের সকল প্রাণী আমাদের ভাই।‘
মহানবীর বিদায় হজ্বের ভাষণে মানব ঐক্যের আহ্বান
৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে হজরত মুহম্মদ (সা.) জীবনের শেষ হজ (হিজ্জাতুল বিদা) সম্পাদনের মানসে প্রায় এক লক্ষ শিষ্যসহ মক্কা যাত্রা করেন (২৫ জুলকদ)। পথিমধ্যে বিভিন্ন জনপদের শত সহস্র তীর্থযাত্রী তাঁর সঙ্গে যোগদান করেন। হজের দিন ‘আরাফাত’-এর বিশাল প্রান্তরে তিনি সমবেত জনমণ্ডলীকে লক্ষ্য করে উপদেশ দান করেন :
‘হে জনমণ্ডলী, আমার কথা মনোযোগ পূর্বক শ্রবণ কর। তোমাদের সঙ্গে একত্রে এই হজে যোগদান করিবার সুযোগ ভবিষ্যতে সম্ভবত আমার আর হইবে না। অন্ধযুগের সমস্ত কু-সংস্কার, বিশ্বাস, অনাচার ও কুশিদ গ্রহণ আজ হইতে রহিত হইল। একের অপরাধে অন্যকে দণ্ড প্রদান করা যাইবে না। পিতার অপরাধে পুত্রকে এবং পুত্রের অপরাধে পিতাকে দায়ী করা চলিবে না। অদ্যকার এই দিন যেমন মহান, এই মাস যেমন মহিমাপূর্ণ, কাবা যেরূপ পবিত্র প্রত্যেক মুসলমানদের, শোণিত-বিন্দু, জীবন, ধনসম্পদ ও মান-সম্ভ্রম তদ্রূপ পবিত্ৰ। হে মুসলমানগণ, সাবধান, নেতার আদেশ কখনও লঙ্ঘন করিও না। যদি কোন কাফ্রি ক্রীতদাসও তোমাদের নেতা নির্বাচিত হয় এবং সে যদি আল্লাহর কুরআন অনুসারে তোমাদিগকে পরিচালনা করে, তবে অবনত মস্তকে তাহার আদেশ পালন করিবে। দেশভেদে বা বংশানুযায়ী মানুষের প্রাধান্যের কোন কারণ নাই। সকল মানুষই আদম হইতে এবং আদম (আঃ) মাটি হইতে উৎপন্ন। মনে রাখিবে, সকল মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই এবং সকলকে লইয়া এক ভ্রাতৃ- সমাজ গঠিত। তোমরা পৌত্তলিকতা, চুরি, মিথ্যাভাষণ ও ব্যভিচার হইতে দূরে থাকিবে। সাবধান, কোন মানুষের প্রতি অত্যাচার করিও না, অত্যাচার করিও না, অত্যাচার করিও না। সাবধান, কাহারো অসম্মতিতে তাহার সামান্য ধনও গ্রহণ করিও না। মনে রাখিও, একদিন তোমাদিগকে আল্লাহর সম্মুখে তোমাদের কৃতকর্মের জন্য জবাবদিহী করিতে হইবে। হে জনগণ, নারীদের প্রতি নির্মম ব্যবহার করিও না। নিশ্চয় জানিও, তোমাদের সহধর্মিণীদের উপর তোমাদের যেরূপ দাবী ও স্বত্ব আছে, তোমাদের উপরও তাহাদের তদ্রুপ দাবী ও স্বত্ব রহিয়াছে। তোমরাই এই নিঃসহায় নারীদের একমাত্র সহায়। সাবধান, তোমাদের দাসদাসীদের উপর অত্যাচার করিও না; ইহাদের অন্তরে ব্যথা দিও না; তোমরা যাই খাইবে, তাহাদিগকে তাহাই খাওয়াইবে; তোমরা যাহা পরিবে, তাহাদিগকে তাহাই পরাইবে। মনে রাখিবে, তাহারা তোমাদের মত মানুষ। সাবধান, ধর্ম সম্বন্ধে বাড়াবাড়ি করিও না। এই কারণে তোমাদের পূর্ববর্তী বহু জাতি ধ্বংসপ্রাপ্ত হইয়াছে। তোমরা বংশের গৌরব করিও না। যে নিজ বংশকে হেয় মনে করিয়া অপর কোন বংশের নামে আত্ম-পরিচয় প্রদান করে, তাহার উপর আল্লাহ্র অভিসম্পাত। আমি দুইটি জিনিস রাখিয়া যাইতেছি- আল্লাহর কুরআন ও তাঁহার রসূলের সুন্নত (আদর্শ)।[৩৪]
৩৪. হজরত মুহম্মদ (স.) এই ভাষণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি নির্দেশনার ক্ষেত্রে দুটি মত প্রচলিত দেখা যায়। নির্দেশনাটি হল :
‘আমি তোমাদের জন্য দুটি মূল্যবান জিনিস রেখে যাচ্ছি’-
একটি হচ্ছে কোরআন অপরটি হচ্ছে আমার সুন্নাহ।’
ইমাম মালেক তাঁর মুয়াত্তা হাদিস গ্রন্থে এ হাসিদকে মুরছাল হাদিস বলে উল্লেখ করেছেন। মুরছাল হাদিস হচ্ছে যার বর্ণনাক্রম ঠিক নেই, অর্থাৎ সনদ ঠিক নেই, যার বর্ণনা রাসুলুল্লাহ্ (সা.) পর্যন্ত পৌছাই নাই তথা তাবেঈন কর্তৃক বর্ণিত নয়। তাবেঈনরা বলছেন—
আমি তোমাদের নিকট দুইটি জিনিস রেখে যাচ্ছি যা একটি থেকে অপরটি অভিন্ন, তা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব যা আসমান থেকে জমিন পর্যন্ত একটি দৃঢ় রজ্জু— অপরটি হচ্ছে আমার আহলে বাইত। এরা হাউজে কাওসারে না পৌঁছা পর্যন্ত একটি অপরটি থেকে পৃথক হবে না, আমি আমার আহলে বাইত সম্পর্কে তোমাদেরকে আল্লাহর কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি।
(হাদিসে মুতায়াতির। সূত্র : মুসলিম, ৬ষ্ঠ খণ্ড, কিতাবুল ফাযাইল, পৃ. ১০২, শিয়া, সুন্নি উভয় সূত্রে বর্ণিত)।]
যে পর্যন্ত তোমরা ঐ দুইটি দৃঢ়রূপে ধারণ করিয়া চলিবে, সে পর্যন্ত বিপথগামী হইবে না। নিশ্চয় জানিবে, আমার পর আর কোন নবী নাই, আমিই শেষ নবী। যাহারা উপস্থিত আছ তাহারা অনুপস্থিত ব্যক্তিদের নিকট আমার এই বাণীসকল পৌঁছাইয়া দিও। হয়ত, অনুপস্থিত ব্যক্তিদের অনেকেই ইহা দ্বারা সমধিক উপকৃত হইবে।’ এই কথা বলিতে বলিতে তিনি ঊর্ধ্ব দিকে লক্ষ্য করিয়া আবেগভরে বলিয়া উঠিলেন, ‘প্রভো হে, আমি কি তোমার বাণী পৌঁছাইয়া দিয়াছি? আমি কি আমার কর্তব্য সম্পাদন করিয়াছি?’ অমনি লক্ষ কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হইল, ‘নিশ্চয়, নিশ্চয়।’ হজরত (সাঃ) পূর্বাপেক্ষা আবাবেগে বলিয়া উঠিলেন, ‘প্রভো হে, শ্রবণ কর, স্বাক্ষী থাক।‘
এই সময়ে পবিত্র কুরআনের সর্বশেষ বাণী অবতীর্ণ হইল— ‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম পূর্ণ করিলাম, তোমাদের উপর আমার দান সম্পূর্ণ করিলাম এবং ইসলামকেই তোমাদের জন্য ধর্ম মনোনীত করিলাম। (মোহাম্মদ মতিওর রহমান, বাংলা একাডেমী ঐতিহাসিক অভিধান, পৃ. ৫৩)।
বিদায় হজ্ব মানবীয় মূল্যবোধের এক মহিমান্বিত নির্দেশনা। মানবীয় গুণাবলি বিকাশে ও উৎকর্ষ সাধনে বিবেকতাড়িত যাবতীয় মহৎ কর্মে অবিচল থাকার নির্দেশনা। মানুষের মানবীয়বোধকে সর্বদা জাগ্রত করে রাখার সতর্কবার্তা। এ কারণেই কোরআনে আল্লাহ বলছেন: আমি আপনাকে সত্যসহ পাঠিয়েছি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে (৩৫:২৪)। মহানবি (স) আল্লাহর নির্দেশিত সেই দায়িত্বই পালন করেছেন বিদায় হজ্বে। তবে মানুষের মানবিক মূল্যবোধ উত্তরণে বিদায় হজ্বের ভূমিকা অনুপ্রাণিত করে কিনা তা নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে রয়েছে নানা মত। সমাজবিজ্ঞানী ভিক্টর জে স্টিংগারের Do Our Values Come from God? নামক সুবিখ্যাত গ্রন্থে দেখিয়েছেন, মানুষের মানবীয় মূল্যবোধ কোন স্বর্গীয় মঙ্গলবার্তা (divinely inspired good) দ্বারা আদিষ্ট নয়। তিনি মনে করেন, মানুষের ভালোত্ব ঈশ্বরনির্ভর (good exists independent of God) নয়। কেননা নির্ভেজাল ভালোত্ব তার নিজের জন্যই প্রয়োজন— তাই এটি স্বপ্রণোদিত ও স্বপ্রজ্ঞাপ্রসূত। এখানে মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ধাক্কাধাক্কিতে ঈশ্বরের হস্তক্ষেপ ‘ন্যায় বিচারক’ হিসেবে শোভন নয়। তাতে মানবীয় বোধবুদ্ধির মর্যাদা বিলুপ্ত হয়। তাই মানববোধ সচেতন ব্যক্তিদের বক্তব্য হল : Do unto them as you would have them do unto you— অর্থাৎ অপরের প্রতি সেই আচরণটিই করো যা তুমি নিজের প্রতি আশা করতে পারতে। উল্টোভাবে বলা যায়- তুমি তোমার নিজের জন্যে যা পছন্দ করো না, অপরের প্রতি তা করতে যেয়ো না। তাই মানব ঐক্য প্রতিষ্ঠায় পরহিতে পরিচালিত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের গুরুত্ব শাস্ত্রবাণীর চেয়েও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।
এ প্রসঙ্গে ওমর খৈয়মকে স্মরণ করে বলা যায়—
Nor there is any prophet save the mind
of man, who wanders through the dark to find
the paradise that is in me and you.
তাই বহুমত ও পথ প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য-
So there are many ways and many traps
And many guides, and which of them is Lord?
For verily Mahamet has the sword
And he may have the truth, perhaps perhaps.
(FitzGerald, Rubayet-e-Omar Khayyam)
(বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য : Mohammad Abdul Hye, Islamic Attitude Toward Non Muslims) ।
কেননা ধর্মের বিভিন্নতা স্রষ্টারই সৃষ্টি হোক কিংবা মানুষের সৃষ্টি হোক সেই বিতর্কে যুক্ত না হয়েও জীবনবোধে যুক্ত হয়ে মানব ঐক্য অসম্ভব নয়। যদিও জন্মগতভাবে প্রাপ্ত ধর্মবিশ্বাসের মধ্যেই সবাই বেড়ে ওঠে। তবে কোন ধর্মবিশ্বাসের কারণে মানববোধ বিঘ্নিত হতে পারে না- যদি তার জীবনবোধে ধর্মবোধের প্রজ্ঞায় পূর্ণতা পায়। যেহেতু মানুষ তাই পায় যা সে করে। এই কর্মফল অনুযায়ী তার মনুষ্যত্ব নির্ধারিত। অতএব বৈচিত্র্যের মধ্যেই ঐক্য অনুধাবন করা মানবিকতাবোধের মহোত্তম পন্থা। এই পথেই সফলতা পেয়েছে প্রজ্ঞাপূর্ণ মানুষ। প্রজ্ঞাপূর্ণ মানুষই সর্বমানবিক। কোন মহামানবই স্বতন্ত্র ও খণ্ডিত জীবনবোধে বিকশিত নয়। তাই মানবিক মান্যতায় প্রীতি ও প্রচ্ছন্নতায় মানুষকে গ্রহণ করতে পারলে ধর্মে মানব ঐক্য অসম্ভব নয়।
সুফি দর্শনেও সর্বমানবিক উপলব্ধি হল : ‘একটি হৃদয়ের ভিতরে শত শত গোপন পথ রয়েছে, সমস্ত অজানা এবং দৃঢ়ভাবে তাঁর নশ্বর প্রাণীর কাছে বন্ধ, পথটি কীভাবে খুলতে হবে তা কেবল তিনিই জানেন।’ আর শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তি মাত্রই জানেন মানব ঐক্যের অফুরন্ত প্রেরণায় বুদ্ধের বাণী, খ্রিষ্টের বাণী, কৃষ্ণের বাণীর সম্মিলিত সারমর্ম বিশ্ব মানবের ঐক্যবদ্ধতা। সর্বোপরি মহানবীর বিদায় হজ্বের ভাষণে প্রত্যাশিত মানব ঐক্যের আহ্বান অনুসরণ করলে কারো দ্বিমত পোষণ করার সুযোগ থাকে না।
নির্বাচিত গ্রন্থপঞ্জি
Muhammad Abdur Rabb, Persian Mysticism, Abu Yazid Al- Bistami, Karachi, 1971
Allama Sir Abdullah al-Mamun Suhrawardy, Sayings of Muhammad (sm); Islamic Foundation Bangladesh, Dhaka, 1978 Syyed Hossein Nasr, Religion and the Order of Nature; Tehran, Harazom, 1980
Benjamin Wakar, The Foundation of Islam, London, 1981
শামসুদ্দীন মুহাম্মদ ইসহাক, বিশ্বপ্রেমিক রুমী; ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, ১৯৮১
মোহম্মদ বরকতুল্লাহ, মানুষের ধর্ম; ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, ১৯৮৭
ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারী, মানবধর্ম; প্রভু জগদ্বন্ধু মহাপ্রকাশ মঠ, ঢাকা ১৯৯৩
ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ (সম্পা), মহানবী (সা)-এর বিদায় হজের ভাষণের গুরুত্ব ও তাৎপর্য, ঢাকা, ২০০৫
সাবির আহমেদ চৌধুরী, সর্বজনীন মানবধর্ম; গদ্যপদ্য, ঢাকা, ২০১২
হিলালুজ্জামান হেলাল, কোরানে মানুষ তত্ত্ব; র্যামন পাবলিশার্স, ঢাকা, ২০১৩
শফিকুর রহমান, পার্থিক জগৎ; জাতীয় সাহিত্য প্রকাশন, ঢাকা ২০১৪
পরমেশ চৌধুরী, বেদের ভবিষ্যদ্বাণী এবং ইসলাম ধর্ম; সাগ্নিক বুকস, কলিকাতা, ২০১৫
মহানামব্রত ব্রহ্মাচারী, মানবধর্ম; শ্রীমহানামব্রত কালচারাল এণ্ড ওয়েলফেরার ট্রাস্ট, শ্রীশ্রীমহানাম অঙ্গন, রঘুনাথপুর (বাগুইহাটী) কলিকাতা, অ. সং ১৪০৮
বঙ্গাব্দ আবদেল মাননান, ফকির লালন শাহের সৃষ্টিতত্ত্বের গান; ধ্যানবিন্দু, ঢাকা, প্র.প্র. ২০১৭
এম এ বারী চিশতী, কোরআন কী বলে; সদর প্রকাশনী, ঢাকা, প্র. প্র. ২০১৭
ড. আহমদ শরীফ, মানবতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা; সন্দেশ, ঢাকা, ২০১৯
সদর উদ্দিন আহ্মদ চিশতী, ইসলামি ধর্মে মতভেদের কারণ; র্যামন পাবলিশার্স, ঢাকা ২০১৯