১৩. সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশে ধর্মের ভূমিকা

ত্রয়োদশ অধ্যায় – সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশে ধর্মের ভূমিকা (The Role of Religion in Flowering of Civilization and Culture)

ইতিহাস অন্বেষায় মানব সভ্যতা

বাংলাদেশে উচ্চ মাধ্যমিকে অক্ষয়কুমার বড়াল (১৮৬০-১৯১৯) প্রণীত ‘মানব-বন্দনা’ নামে একটি কবিতা সংকলিত আছে। কবির প্রদীপ (১৮৮৪) কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত এ কবিতায় কবি মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে মানুষের অবদান ও মহিমাকে তুলে ধরেছেন। কবি মানুষকেই মানুষের দেবতা বলে গণ্য করেছেন। আধুনিক বিজ্ঞানের সাক্ষ্যপ্রমাণ ও বৈজ্ঞানিক বিবর্তনবাদী মতবাদের আলোকে রচিত এ কবিতায় পৃথিবীতে মানব সৃষ্টির রহস্য গাথা বিবৃত হয়েছে। আরও বিবৃত হয়েছে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষ যে সভ্যতা নির্মাণ করে চলেছে তারও ইতিহাস। মানুষ তার নিজ সৃষ্টিশীল প্রতিভাবলে এই পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করেছে যে আপন কর্তৃত্ব ও মহিমা তারই বন্দনা করেছেন কবি এ কবিতায়। দশটি স্তবকে উপস্থাপিত পূর্ণাঙ্গ কবিতাটি নিম্নরূপ :

সেই আদি-যুগে যবে অসহায় নর
নেত্ৰ মেলি ভবে,
চাহিয়া আকাশ পানে কারে ডেকেছিল,
দেবে না মানবে?
কাতর আহ্বান সেই মেঘে মেঘে উঠি,
লুটি গ্রহে গ্রহে,
ফিরিয়া কি আসে নাই, না পেয়ে উত্তর,
ধরায় আগ্রহে?
সেই ক্ষুব্ধ অন্ধকারে, মরুৎ গর্জনে,
কার অন্বেষণ?
সে নহে বন্দনা-গীতি, ভয়ার্ত-ক্ষুধার্ত
খুঁজিছে স্বজন!

আরক্ত প্রভাত সূর্য উদিল যখন
ভেদিয়া তিমিরে,
ধরিত্রী অরণ্যে ভরা, কর্দমে পিচ্ছিল
সলিলে শিশিরে!
শাখায় ঝাপটি পাখা গরুড় চিৎকারে
কাণ্ডে সর্পকুল,
সম্মুখে শ্বাপদ-সংঘ বদন ব্যাদানি
আছাড়ে লাঙ্গুল;
দংশিছে দংশক গাত্রে, পদে সরীসৃপ,
শূন্যে শ্যেন উড়ে;-
কে তাহারে উদ্ধারিল? দেব না মানব-
প্রস্তরে লগুড়ে?

শীর্ণ অবসন্ন দেহ, গতিশক্তিহীন,
ক্ষুধায় অস্থির;
কে দিল তুলিয়া মুখে স্বাদু পক্বফল,
পত্রপুটে নীর?
কে দিল মুছায়ে অশ্রু? কে বুলাল কর
সর্বাঙ্গে আদরে?
কে নব পল্লবে দিল রচিয়া শয়ন
আপন গহ্বরে?
দিল করে পুষ্পগুচ্ছ, শিরে পুষ্পলতা,
অতিথি সৎকার!
নিশীথে বিচিত্র সুরে বিচিত্র ভাষায়
স্বপনসম্ভার!!

8

শৈশবে কাহার সাথে জলে স্থলে ভ্রমি
শিকার-সন্ধান?
কে শিখাল ধনুর্বেদ, বহিত্র চালনা,
চর্ম পরিধান?
অর্ধগন্ধ মৃগমাংস কার সাথে বসি,
করিনু ভক্ষণ?
কাষ্ঠে কাষ্ঠে অগ্নি জ্বালি কার হস্ত ধরি
কুর্দন নর্তন?
কে শিখাল শিলাস্তূপে, অশ্বত্থের মূলে
করিতে প্রণাম?
কে শিখাল ঋতুভেদ, চন্দ্ৰ-সূর্য মেঘে
দেব-দেবী নাম?

কৈশোরে কাহার সনে মৃত্তিকা কর্ষণে
হইনু বাহির?
মধ্যাহ্নে কে দিল পাত্রে শালি অন্ন ঢালি,
দধি-দুগ্ধ-ক্ষীর?
সায়াহ্নে কুটির দ্বারে কার কণ্ঠ সাথে
নিবিদ উচ্চারি?
কার আশীর্বাদ লয়ে অগ্নি সাক্ষী করি
হইনু সংসারী?
কে দিল ঔষধি রোদে ক্ষতে প্রলেপন
স্নেহে অনুরাগে?
কার ছন্দে-সোমা গন্ধে— ইন্দ্ৰ অগ্নি বায়ু
দিল যজ্ঞ ভাগে?

যৌবনে সাহায্যে কার নগর পত্তন,
প্রাসাদ নির্মাণ?
কার ঋক্ সাম যজুঃ চরক সুশ্রুত,
সংহিতা পুরাণ?
কে গঠিল দুর্গ, সেতু, পরিখা, প্রণালী,
পথ, ঘাট, মাঠ?
কে আজ পৃথ্বিরাজ–জলে স্থলে ব্যোমে
কার রাজ্যপাট?
পঞ্চভূত বশীভূত প্রকৃতি উন্নীত
কার জ্ঞানে বলে?
ভুঞ্জিতে কাহার রাজ্য— জন্মিলেন হরি
মথুরা কোশলে?

প্রবীণ সমাজ পদে, আজি পৌঢ় আমি
জুড়ি দুই কর,
নমি, হে বিবর্ত-বুদ্ধি! বিদ্যুৎ-মোহন,
বজ্রমুষ্টিধর!
চরণে ঝটিকাগতি—ছুটিছ উধাও
দলি নীহারিকা।
উদ্দীপ্ত তেজসনেত্ৰ-হেরিছ নির্ভয়ে
সপ্তসূর্য শিখা।
গ্রহে গ্রহে আবর্তন—গভীর নিনাদ
শুনিছ শ্রবণে?
দোলে মহাকালে–কোলে অণু পরমাণু
বুঝিছ স্পৰ্শনে?

নমি, হে সাৰ্থক কাম! স্বরূপ তোমার
নিত্য অভিনব!
মর দেহে নহ মর, অমর অধিক
স্থৈর্য ধৈর্য তব?
লয়ে সলাঙ্গুল দেহ, স্থূলবুদ্ধি তুমি
জন্মিলে জগতে!
শুষিলে সাগর শেষে, রসাইলে মরু
উড়ালে পর্বতে!
গড়িলে আপন মূর্তি—দেবতালাঞ্ছন
কালের পৃষ্ঠায়!
গড়িছ ভাঙিছ তর্কে, দর্শনে, বিজ্ঞান
আপন স্রষ্টায়।

নমি তোমা নরদেব! কী গর্বে গৌরবে
দাঁড়িয়েছ তুমি!
সর্বাঙ্গে প্রভাতরশ্মি, শিরে চূর্ণ মেঘ,
পদে স্পর্শভূমি
পশ্চাতে মন্দির-শ্রেণি, সুবর্ণ কলস,
ঝলসে কিরণে;
কলকণ্ঠ-সমুত্থিত নবীন উদ্‌গীথ
গগনে পবনে।
হৃদয়-স্পন্দন সনে ঘুরিছে জগৎ
চলিছে সময়;
ভ্রূভঙ্গে-ফিরিছ সঙ্গে ক্রমব্যতিক্রম
উদয়-বিলয়।

১০

নবি আমি প্রতিজনে, আদ্বিজ-চণ্ডাল,
প্রভু, ক্রীতদাস।
সিন্ধুমূলে জলবিন্দু, বিশ্বমূলে অণু;
সমগ্রে প্রকাশ!
নমি কৃষি-তন্তুজীবী, স্থপতি, তক্ষক,
কর্ম, চর্মকার!
অদ্রিতলে শিলাখণ্ড, দৃষ্টি অগোচরে,
বহ অগ্রি-ভার!
কত রাজ্য, কত রাজা গরিছ নীরবে
হে পূজ্য, হে প্ৰিয়!
একত্বে বরেণ্য তুমি, শরণ্য এককে,
আত্মার আত্মীয়।

.

মানবসভ্যতার বিবর্তনের মধ্যদিয়েই গড়ে উঠেছে মানুষের ধর্মবিশ্বাস। আর বিবর্তনের মধ্যদিয়েই ধর্মবিশ্বাস এবং ধর্মের জাগতিক কাঠামোর ঘটছে পরিবর্তন একদিকে ধর্মের বিবর্তন যেমন প্রযুক্তি ও উৎপাদন ব্যবস্থার বিকাশের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে, অন্যদিকে ধর্ম ও মানুষের জাগতিক বিকাশকে কখনও প্রতিহত, কখনও ত্বরান্বিত করতে সহায়ক হয়েছে। সভ্যতার বিবর্তনে ধর্মের পরিবর্তন এমনও হতে পারে—জ্ঞানবিজ্ঞানের অগ্রগতি, আর্থসামাজিক পরিবর্তনের ফলে ধর্ম হয় মানবসমাজ থেকে একেবারেই অপসৃত হবে নয়ত এটি এমন চেহারা নেবে—যার সঙ্গে আজকের ধর্মের কোন মিলই থাকবে না। আবার এও সত্য যে, মানুষের জাগতিক পরিবেশ থেকে ধর্মের উদ্ভব হলেও কালে কালে ধর্ম মানুষের অবচেতন মনের গভীরে প্রবেশ করে একটা স্বকীয় চেহারা ও নিজস্ব গতিশীলতা অর্জন করে। এ অবস্থায় তার শক্তি এত বিপুল হতে পারে যে, মানুষের জাগতিক অগ্রগতিকে সে রুখে দিতে পারে।

মানব সভ্যতার শুরুতে মানুষের সামনে কোনও স্রষ্টার অস্তিত্ব ছিল না। যেমন ছিল না জগৎ বিষয়ে, জগতের যাবতীয় কিছুর সৃষ্টি সম্পর্কে প্রশ্ন, তেমনই প্রশ্ন ছিল না এ সবের কার্যকরণ সম্পর্কের হেতু ও কর্তা সম্বন্ধে অর্থাৎ মানুষের সামনে একসময় স্রষ্টা ছিল না। এক সময় স্রষ্টা এসেছে। স্রষ্টা বহু দেব-দেবীরূপে আবির্ভূত হয়েছে। কালের বিবর্তনে তা ‘বহু’ থেকে ‘এক’-এ পরিণত হয়েছে। আবার এমন একদিন আসবে যখন হয়তবা মানুষের চেতনায় আর স্রষ্টার কোনও অস্তিত্বই থাকবে না। তাহলে বিষয়টি এমন দাঁড়াল—সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানুষের সামনে যেমন ঈশ্বর ছিল না তেমনই চরম বিকশিত সভ্যতায় মানুষের সামনে শেষবারের মত ঈশ্বর থাকবেও না। কেননা ঈশ্বরতো মানুষেরই সৃষ্টি; সমাজের সৃষ্টি; মানুষের সংস্কৃতিরই সৃষ্টি। মানুষ তার ‘সময়ের প্রয়োজনে’ ঈশ্বরকে সৃষ্টি করেছিল। তদ্রূপ মানুষের প্রয়োজনেই মানুষ ঈশ্বরের বিনাশও ঘটাবে। এভাবে মানুষ একদিন বিনাশ ঘটাবে হাজারো দুঃখের রকমফের। হাজারো জাতির ধারণা প্রত্যাখ্যান করে মানুষ পরিণত হবে এক ‘মানুষ জাতি’তে। মানুষ উচ্ছেদ করবে পৃথিবীর বুকে বিচ্ছিন্নতার চিহ্ন; দেশসমূহের কথিত ভৌগোলিক সীমানা রেখা। পৃথিবী পরিণত হবে ‘এক দেশ’ ‘এক দুনিয়া’। ইতোমধ্যে মানুষ গুঁড়িয়ে দেবে ভাষার রকম-ফের, অথচ দুনিয়াব্যাপী মানুষের নাড়ির সংযোগ ঘটাবে একটি মাত্র ভাষা। এভাবেই মানুষ তার জীবনের অভিধানকে সহজ করে তুলবে; যেমন সহজ ছিল সেই প্রাক্ প্রাগৈতিহাসিক যুগে আদি পিতাদের মধ্যেকার সম্পর্ক। মানুষ বিলুপ্তি ঘটাবে তাদের মধ্যে বিরাজমান একাধিক শ্রেণি বিভাজন আর সেই সাথে অবসান ঘটবে মানুষের মানুষে দ্বন্দ্ব। মানুষের দ্বন্দ্ব থাকবে বড় জোর প্রকৃতির সাথে; প্রকৃতির বিরূপতার সাথে; যেমনটি ছিল আদি পুরুষদের মানুষ জয় করবে, মানুষ টিকে থাকবে। গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে গ্যালাক্সি থেকে গ্যালাক্সিতে মানুষ বিচরণ করবে।

আজকের প্যালেস্টাইন, লেবানন, সিরিয়ার সভ্যতা অর্থাৎ ভূমধ্যসাগরীয় পূর্ব উপকূলে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর বিস্তীর্ণ ভূমির সভ্যতার বয়স মিশরীয় সভ্যতার চেয়েও প্রাচীন। এর মধ্যে রাসসামায় আবিষ্কৃত লেখমালা হতে জানা যায়, উগারিট (সিরিয়া) সভ্যতায় তখন ৫০টি দেব ও ২৫ দেবী বাস করতেন। এর মধ্যে ‘এল’ (EL) ছিলেন সকল দেবতার বৃদ্ধ পিতা। দেবীরানি আশেরাৎ ছিলেন সমুদ্রদেবী। এই সমুদ্রদেবীর ছিল ৭০টি পুত্র। দেবদেবীদের মধ্যে ‘মট’ ছিলেন ফলপ্রসবিনি প্রকৃতি দেবী, ‘এলিন’ ছিলেন বায়ু ও বৃষ্টির অধিপতি, ‘ডানিয়েল’ ছিলেন উৎপীড়িত ও দুর্বলের রক্ষক, আর ‘ব্যাল’ ছিলেন জন্মাবধি অত্যন্ত অত্যাচারী। এই সভ্যতার আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে পরবর্তীকালের ইউফ্রেটিস ও তাইগ্রিস নদীর অববাহিকায় মেসোপটমিয়া ও নীল নদের অববাহিকায় গড়ে ওঠা মিশরীয় সভ্যতা। পরবর্তীকালে মিশরীয় সভ্যতা এতটাই বিস্তার লাভ করে যে, মিশরীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে উপনিবেশে পরিণত হয় সিরিয় সভ্যতা। সে সময়ের মিশরীয় সংস্কৃতির ইতিহাস থেকে জানা যায়, ‘এই দেশটিতে যখন দেবতা বলতে বোঝাতো কেবলমাত্র সূর্যদেবকে, যদিও মিশরীয় পুরাণে অন্য দেবতার অভাব দেখা যায়নি। মিশরে বহু শতাব্দী যাবৎ সূর্যদেবতা ছিলেন অন্তত নয় জন। যথাক্রমে রি (RE) বা রা (RA) ওসাইরিস বা অসার বা আওসার, আইসিস, হোরাস, মু (MU), রা-হরাখতি, খেপরি, আমন আর আটেন এবং তাঁদের বিশেষ বিশেষ জনের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার জন্যে সংশ্লিষ্ট সমর্থকদের মধ্যে কূট প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলেছে দীর্ঘকাল। উক্ত নয়জন সূর্য দেবতারই একজনকে উপলক্ষ্য করে পৃথিবীতে সর্বপ্রথম একশ্বরবাদ প্রচারিত হয়। অর্থাৎ সূর্যবাদ তথা সূর্য পূজার প্রথম উদ্ভব ঘটে মিসরে। এমন কি ‘ইজিপ্ট’ নামটিও সে দেশের অন্যতম সূর্য দেবতা ‘টা’র (PTAH) নাম জড়িয়ে গঠিত।’ (বেনজীন খান, ‘প্রসঙ্গ : ঈশ্বর’)।

ইসলামী স্থাপত্য শিল্পের প্রভাব ও বিস্তার

বিজ্ঞান এবং দর্শনের মত শিল্পকলা চর্চার ক্ষেত্রে মুসলিম আরবদের কোন ঐতিহ্য ছিল না, যা থেকে তারা অনুপ্রেরণা পেতে পারে। সৃজনশীল সৃষ্টিকর্মের মধ্যে প্রাক্-ইসলামি হিজাজে কেবলমাত্র কাব্যচর্চা ছিল বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। স্থাপত্য, ভাস্কর্য অথবা চিত্রকলার নিদর্শনের বাস্তবে অথবা সাহিত্যকর্মে যে উদ্দেশ্য পাওয়া যায় তা সুকুমার মূল্যবোধ বিবর্জিত এবং সেগুলোকে কদাচিত শিল্পকর্ম বলা যায়। এই তিন ক্ষেত্রের কোনটিতেই মুহম্মদ (সা.)-এর জন্মের পূর্বে শিল্পকলা উচ্চমার্গে পৌঁছাতে পারেনি। এর কোনটিই সুনির্দিষ্ট এবং মার্জিত রূপে এক অথবা দুই শতাব্দী পূর্বে আত্মপ্রকাশ করতে পারেনি। একই কথা সংগীতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আরবি যদি ধর্মীয় প্রেরণা জুগিয়ে থাকে তবে বলতে হবে যে উত্তরের (সিরিয়া ও ইরাক) বিজিত অঞ্চল শিল্পকলার উন্মেষের ক্ষেত্রে কারিগারি জ্ঞান এবং বাহ্যিক উপাদানগত গঠন সরবরাহ করে। আরব তথা মুসলিম শিল্পকলা চর্চার ক্ষেত্রে ধর্ম বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

স্থাপত্য বলতে যা সুকুমার শিল্পকলার অন্যতম প্রধান ও স্থায়ী নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃত, ইসলামে দুর্গ-প্রাসাদ এবং উপাসনালয় (মসজিদ) বোঝায়। এ কারণে উত্তর অপেক্ষা দক্ষিণ আরবে (হেজাজ) এ ধরনের স্থাপত্যিক নিদর্শন বহু পূর্বে লক্ষ্য করা যায়। হেজাজে তাঁবুই ছিল সাধারণ বাসগৃহ, উন্মুক্ত আকাশ ছিল মন্দির এবং মরুভূমির বালি ছিল সমাধি। হেজাজে কোন রাজবংশ ছিল না, তবে বিগ্রহ বা মূর্তি (হোবাল) ছিল। পৌত্তলিকতার প্রধান কেন্দ্র ছিল প্রাচীন ছাদবিহীন চতুষ্কোণাকার একটি গৃহ, যা থেকে কা’বা (cube) নামকরণ হয়েছে। সর্বপ্রাচীন বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, কা’বাগৃহ, মুহম্মদ (স.)-এর সময়ে একজন মানুষের উচ্চতার সমান ছিল এবং এর দরজা এত নিচু ছিল যে, বন্যার সময় কা’বাগৃহ জলমগ্ন হয়ে যেত। কা’বাগৃহ একজন মহিলার আগরবাতির আগুনে অগ্নিদগ্ধ হলে একজন খ্রিষ্টান (ছুতার) কর্তৃক তা পুনঃনির্মিত হয়। এই ছুতার-স্থপতি জেদ্দায় অদূরে একটি জলমগ্ন জাহাজের কাঠ এবং পাথর ব্যবহার করে কা’বা পুনঃনির্মাণ করেন। (কাঠ এবং পাথর একটির পর অপরটি স্তরে স্তরে সাজিয়ে কাবাগৃহ মজবুত করে তৈরি করা হয়)। নির্মাণ কৌশল আবিসিনীয়। যৌবনকালে মুহম্মদ (স.) (৬০৫ খ্রি.) এই কা’বাগৃহের সর্বাপেক্ষা পবিত্র কৃষ্ণপাথর স্থাপনের দায়িত্ব পালন করেন। কা’বাগৃহকে কেন্দ্র করে যে বিশালকার মসজিদ নির্মিত হয়েছে তাকে মডেল হিসেবে ব্যবহার না করে, মদিনায় নির্মিত নবীর মসজিদটি ইসলামের ধর্মীয় ইমারতের (মসিজদ) মডেল হিসেবে গৃহীত হয়েছে।

নবীর মসজিদটি ছিল খুবই সাধারণ এবং সাদামাঠা এবং এটিকে স্থাপত্যিক নিদর্শন বলা যায়। এটি প্রাথমিক অবস্থায় ছিল একটি খোলা চুরষ্কোণাকার চত্বর। পরবর্তীকালে এর এক অংশে সূর্যের তাপ থেকে রক্ষার জন্য ছাদ দেওয়া হয়। তালপাতা ও তালপাতার সাথে কাদা মিশ্রিত করে যে ছাদ তৈরি করা হয় তা তালগাছের কাণ্ডের উপর নির্ভর করে তৈরি। এ সমস্ত তালগাছ মসজিদ নির্মাণের জায়গায় পূর্ব থেকে ছিল। পার্শ্ববর্তী বাড়ির ছাদের বরাবর মসজিদের ছাদটি নির্মিত হয়। একটি তালগাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে মুহম্মদ (স.) সমবেত মুসল্লীদের উদ্দেশ্যে খুতবা পাঠ করতেন। এই গুড়িটির স্থরে পরবর্তীকালে একজন মুসল্লীর পরামর্শে, যিনি একটি খ্রিষ্টান গির্জার একটি বেদী (pulpit) দেখেছিলেন, একটি কাঠের উঁচু মিম্বর নির্মিত হয়। মক্কায় নবী করিম (স.) তাঁর সর্বশেষ ভাষণ দেন তাঁর উটের পিঠে বসে।

নামাজের সময় মুসল্লীগণ উত্তরে জেরুজালেমের দিকে মুখ ফিরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াতেন। ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে যখন কিবলা পরিবর্তনের আয়াত নাজেল হয় এবং মুহম্মদ (স.) তাঁর সাহাবীদের নিয়ে নামাজ পড়া অবস্থায় আল্লাহর নির্দেশে উত্তর থেকে দক্ষিণে মক্কার দিকে, পরে যা কিবলাতে পরিণত হয়। এই মসজিদে কিবলা নির্ধারক মিহরাবের প্রয়োজন ছিল না। উপরন্তু, প্রাথমিক পর্যায়ে কোন উঁচু স্থান থেকে (মিনারের মত) আজান দেওয়ার প্রচলন হয়নি (যেখানে দাঁড়িয়ে মুয়াজ্জিন আজান দেন)। ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন ছিলেন বিলাল নামের এক আবিসিনীয় (বর্তমান নাম ইথিওপিয়া) প্রাক্তন ক্রীতদাস। তিনি নির্দিষ্ট সময়ে পার্শ্ববর্তী গৃহে সমান্তরাল ছাদে উঠে আজান দিতেন সর্বোচ্চ স্বরে। মদিনার এই অতি সাধারণ ইমারতটিতে ভবিষ্যতে পূর্ণাঙ্গ মসজিদের সমস্ত উপাদান ছিল যেমন— লিওয়ান বা ছাদ ঘেরা নামাজের স্থান (মেঝে), মিম্বর, কিবলাহ এবং মিনার।

কুফা এবং বসরায় যে সমস্ত সেনানায়ক সামরিক ছাউনি নির্মাণ করেন, তা পরবর্তীকালে ইসলামী জ্ঞানচর্চা ও সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়। তাঁরা নবী করিম (স.)-এর সাহাবী হিসেবে তাঁর সাথে মদিনার মসজিদে নামাজ পড়তেন। কুফা ও বসরার সেনানিবাসে মসজিদ নির্মাণকালে মদিনার মসজিদের নকশা ছাড়া নির্মাতাদের কাছে অপর কোন মডেল ছিল না। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে অন্যান্য শহর দখল হয়ে (কেন্দ্রীয় বা প্রাদেশিক) রাজধানীতে পরিণত হলে, পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে। মসজিদ গির্জার অভ্যন্তরে প্রতিষ্ঠিত হয়, যার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত দেখা যাবে দামেস্কের (উমাইয়া) মসজিদে।

প্রাদেশিক বায়জানটাইন রাজধানী দামেস্ক অধিকৃত হলে দেখা যায় এই শহরে একটি প্রকাণ্ড খ্রিষ্টান গির্জা রয়েছে, যা সেন্ট জন দি ব্যাপটিস্টের গির্জা নামে পরিচিত। পূর্ববর্তী রোমীয় জুপিটারের মন্দিরের ধ্বংস্তূপের উপর সম্রাট থিওডোসিয়াস (ম. ৩০ খ্রি.) যে গির্জা নির্মাণ করেন তা বিভক্ত করা হয় এবং এর এক অংশ মুসলমানদের জন্য মসজিদ এবং অপর অংশ খ্রিষ্টানদের জন্য গির্জা হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। ৭০৫ খ্রিষ্টাব্দে খলিফা আল-ওয়ালিদ সমগ্র ইমারতটির উপর (খ্রিষ্টানদের অন্যত্র গির্জা নির্মাণের সুযোগ দেওয়া হয়) বিশালকার উমাইয়া মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। এরপর থেকে তখন এবং আজও পর্যন্ত এই অতুলনীয় মসজিদটি সমগ্র মুসলিম বিশ্বে ইসলামে মক্কা, মদিনা এবং জেরুজালেমের পর, চতুর্থ পবিত্রতম স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে আসছে। নবী ইয়াহ্ইয়ার (সেন্ট জন) সমাধিটি (যেখানে তাঁর ছিন্ন মুণ্ড রয়েছে) মসজিদের এক অংশে রয়েছে বলে মনে করা হয়। দামেস্ক মসজিদ নির্মাণে উমাইয়া খলিফা, সিরিয়া, বায়জানটাইন, মিসরীয় ও পারস্য স্থপতি, কারুশিল্পী ও চারুশিল্পী নিয়োগ করেন, যারা নির্মাণ ও অলঙ্করণে অংশগ্রহণ করেন। এ সমস্ত কারিগর নব প্রতিষ্ঠিত উমাইয়া সাম্রাজ্যের মর্যাদা এবং সম্মান সমুজ্জ্বল রাখার জন্য উমাইয়া মসজিদকে একটি অনুপম ও অনিন্দ্য সুন্দর ইমারতে রূপান্তরিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। মসজিদের দেওয়ালগুলো সোনালি এবং বহুমূল্যবান পাথরের ব্যবহারের মোজাইক করা হয়। দশম শতাব্দীর ভৌগোলিকের (আল-ইদ্রিসী) বর্ণানুযায়ী দেওয়ালের অত্যুৎকৃষ্ট অলঙ্করণে গাছপালা এবং বিভিন্ন ধরনের বস্তুর নকশা, যেমন দালানকোঠা দেখা যাবে। একজন রক্ষণশীল খলিফা (যদিও কোন প্রাণির মূর্তি, মানুষ-জীবজন্তুর প্রতিকৃতি ছিল না) এ সমস্ত দেওয়াল চিত্র (ফ্রেবস্কো) চুনের প্রলেপ দিয়ে ঢেকে দেবার নির্দেশ দেন। এরপর ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে পুনরায় এ সমস্ত দেওয়ালচিত্র পুনরাবিষ্কৃত হয়। দামেস্কর মসজিদটি সিরিয়া থেকে উত্তর আফ্রিকা ও স্পেন পর্যন্ত নির্মিত জামে মসজিদসমূহের মডেল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মোটকথা, দামেস্কের মসজিদ ইসলামি ধর্মীয় স্থাপত্যকলার একটি গ্রহণযোগ্য ও বহুল ব্যবহৃত মডেলে পরিণত হয়। ইসলামি স্থাপত্যকলায় দামেস্কের মসজিদটি স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য ও রঞ্জিত মার্বেল এবং নানাবর্ণের মোজাইকে শোভিত অলঙ্করণের অসাধারণ নিদর্শন হিসেবে এখনও অক্ষত অবস্থায় কালের স্বাক্ষর দিচ্ছে।

বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, মূল গির্জার দুটি বৈশিষ্ট্য ইসলামি স্থাপত্যে সংযোজিত হয় এবং আজ পর্যন্ত সমস্ত মসজিদে তাদের ব্যবহার অব্যাহত রয়েছে। এ দুটি হচ্ছে মিনার, খ্রিষ্টান গির্জার টাওয়ারের অনুকরণে এবং কিবলা নির্ধারক মিহরাব। আল ওয়ালিদ সেন্ট জন চার্চের দুটি টাওয়ারকে অক্ষত রাখার এবং উত্তর দিকে প্রধান একটি মিনার নির্মাণের নির্দেশ দেন। মিনার শব্দটি ‘নার’ বা জ্যোতি থেকে উদ্ভূত, কখনো কখনো এটিকে বাতিঘর ( fire place) বলা হয়ে থাকে। গির্জার টাওয়ারগুলো মূলত প্রহরীদের চূড়া ( watch tower) হিসেবে ব্যবহৃত হত; যেখানে রাতে বাতি জ্বলত। আরব ভূগোলবিদ ইবন আল-ফাকী, যিনি দামেস্ক মসজিদের সর্বপ্রাচীন বর্ণনাকারী, তিনি বলেন আল-ওয়ালিদ গির্জার একটি টাওয়ারকে অক্ষত অবস্থায় রাখেন।

অবতল এবং অশ্বখুরাকৃতি মিহরাবটি গির্জার অবতল (apse) থেকে অনুকরণ করে নির্মিত, যে apse-টি অর্ধগোলাকৃত হয়ে থাকে। পূর্বদিকে বেদীগুলো থাকায় তা দক্ষিণ দিকে মুখ করে মুসলমানগণ সহজেই গির্জাকে মসজিদে রূপান্তরিত করতে পারে। মসজিদ স্থাপত্যের ক্রম-বিকাশে মিম্বর এবং মিহরাব কারুশিল্পীরা অলঙ্করণের প্রধান আকর্ষণ হয়ে পড়ে। বিভিন্ন রঙের লতাপাতা, মোজাইক, জ্যামিতির (আরবেস্ক) এবং লিপিকলার নকশার অলঙ্করণ ইসলামি শিল্পকলাকে এক গৌরাবোজ্জ্বল পর্যায়ে নিয়ে যায়।

দামেস্ক মসজিদের পূর্বে নির্মিত এবং স্থাপত্যিক অলঙ্করণের দিক থেকে খুবই আকর্ষণীয়, যদিও স্থাপত্যকলার ক্ষেত্রে ততটা প্রভাবশালী নয়। ইমরাত হচ্ছে ডোম অভ দি রক (কুব্বাত আস সাখরা)। ৬৯১ খ্রিষ্টাব্দে জেরুজালেমে আল- ওয়ালিদের পিতা আবদুল মালেক কর্তৃক এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ইমারতের (সৌধ) ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় সেই স্থানে (বায়তুল মুকাদ্দাস) যেখানে খলিফা ওমর ৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে জেরুজালেমে এসে একটি ইবাদতগাহ নির্মাণ করেন। এ কারণে ভুল করে কুব্বাত আস সাখরাকে ওমরের মসজিদ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এই পবিত্রস্থানে এক সময়ে সোলায়মানের মন্দির, একটি রোমীয় মন্দির এবং গির্জা নির্মিত হয়েছিল। এজন্য এক স্থানটি পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ পবিত্রভূমি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে।

আবদুল মালেক জেরুজালেমে এমন একটি স্থাপত্যকীর্তি প্রতিষ্ঠা করতে চান, যা পার্শ্ববর্তী ‘চার্চ অভ দি হোলী সিপালকার’কে রীতি ও নকশার দিক থেকে অতিক্রম করতে পারে। শুধু তাই নয়, তিনি তার ভিন্নধর্মী শত্রু খ্রিষ্টানদের এই গির্জায় প্রতিদ্বন্দ্বী একটি ইমারতের পরিকল্পনা করেন। প্রতিষ্ঠিত মসজিদের নকশাকে অবস্থা করে খলিফা আবদুল মালেক একটি গম্বুজ বিশিষ্ট গোলাকার (routunda) পরিকল্পনা করেন, যা খ্রিষ্টান বায়জানটাইন গির্জা দ্বারা অনুপ্রাণিত। এখানে স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত মাল-মসলা ও ইমারতের উপকরণ ব্যবহৃত হয়। কুব্বাত-আস-সাখরার গোলাকার গম্বুজাকৃতি নকশা পরবর্তীকালে পৃথিবীর সর্বত্র মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে হুবহু অথবা সামান্য পরিবর্তন করে অনুকরণ করা হয়। এ সমস্ত ইমরাতের মধ্যে বিশেষভাবে আর্কণীয় হচ্ছে কনস্টান্টিনোপলে নির্মিত অটোমান সুলতানদের আমলের ইমারতসমূহ। উল্লেখ্য, সেন্ট সোফিয়া গির্জা রূপান্তরিত করে মসজিদে প্রতিষ্ঠা করা হয়। বায়জানটাইন আমলের গম্বুজ বিশিষ্ট গির্জা মুসলিম স্থাপত্যে বিশেষ করে অটোমান স্থাপত্যকলায় অসামান্য প্রভাব পড়ে। (গম্বুজবিশিষ্ট অষ্টকোণাকার ইমারত মুসলিমবিশ্বের সর্বত্র নির্মিত হয়েছে ডোম অভ দি রকের অনুকরণে। যেমন— সামোরার কুব্বাত-আস-সালাইবিয়া, সুলতানিয়ার ‘ওলজাইতুর সমাধি, দিল্লির লোদী আমলের সমাধি, আগ্রার তাজমহল, বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার নওগার অষ্টকোণাকার সমাধি ইত্যাদি)।

ডোম অফ দি রককে গম্বুজ (দ্বিগম্বুজ) বা কুব্বাত স্থাপনই একমাত্র স্থাপত্যিক আবিষ্কার ছিল না। ইসলামের এই অত্যুৎকৃষ্ট সৌধে মোজাইকের ব্যবহার, পাথরে কাটা নকশা এবং অন্যান্য অলঙ্করণ মোটিভ সংযোজিত হয়, যার উৎস ছিল বায়জানটাইন এবং পারস্য স্থাপত্যকলা (রঞ্চিত টালি) পুর্বাঞ্চল মোজাইকের প্রথম ব্যবহার দেখা যায় আসিরিয়দের আমলে। খলিফা আবদুল মালিক স্বাভাবিক কারণে (মুসলমানদের পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায়) বায়জানটাইন অথবা বায়জানটাইনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সিরিয় এবং পারস্য কারিগর ও কলাকুশলী নিয়োগ করেন। এর ফলে এমন অপূর্ব ও অনিন্দ্য সুন্দর ইমারত নির্মিত হয় যা (architecture masterpiece of beauty) আরব বিশ্বে তুলনাবিহীন। অটোমান তুর্কিদের আমলে, মহান সোলায়মানের (মৃ. ১৫৬৬ খ্রি.) আমলে, কনস্টান্টিনোপলে নির্মিত সোলায়মানের মসজিদ, সাফাভী আমলে মহান আব্বাস কর্তৃক নির্মিত ইসফাহানের মসজিদসমূহ, মুসলিম ভারতে মুঘল সম্রাট শাহজাহানের (মৃ. ১৬৬৬ খ্রি.) নির্মিত আগ্রার তাজমহল কুব্বাত-আস-সাখরা স্থাপত্যকীর্তি হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও এগুলো জেরুজালেমের অতুলনীয় স্মৃতিসৌধকে অতিক্রম করতে পারেনি। উল্লেখ্য যে, যখন ইসলামি দর্শন এবং বিজ্ঞানের চর্চায় ভাটা পড়ে তখন ইসলামী শিল্পকলা- স্থাপত্য, চিত্রকলা, লিপিকলার স্থান দখল করে। সমগ্র বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের নিকট ‘ডোম অব দি রক’ শুধুমাত্র প্রার্থনার (জিয়ারত) স্থানই নয়, অথবা ঐতিহাসিক এবং শিল্পকলার অত্যুৎকৃষ্ট নিদর্শনই নয়, এটি মুসলিম ধর্মীয় বিশ্বাসের অমর প্রতীক নবী করিম (সা.) বায়তুল হারাম থেকে বায়তুল মুকাদ্দাসে বোরাকে চড়ে এসে যে পাথরের উপর পায়ের ছাপ-কদম মুবারক রেখে মিরাজ বা নৈশকালীন ঊর্ধ্বগমন করেন তার উপরই এই স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়। এজন্য বর্তমানে ইসরাইলী আরব সংঘর্ষের মূল কারণ এই ইমারতের পবিত্রতা রক্ষা করা।

ডোম অব দি রকের সন্নিকটে খলিফা-আবদুল মালিক (৭০১ খ্রি.) ২ মসজিদ আল-আকসা (দূরবর্তী মসজিদ) নামে (বায়তুল মুকাদ্দাসে) একটি উপাসনালয় নির্মাণ করেন। কুরআনের সুরা বনি ইসরাইল ১৭, ১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে :

পরম ও মহিমাময় তিনি যিনি তাঁর দাসকে তাঁর নিদর্শন দেখাবার জন্য রজনীযোগে ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদ-আল-হারাম থেকে মসজিদ-আল-আকসায়, যার পরিবেশ তিনি করেছিলেন বরকতময়। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।

এই আয়াতে নবী করিম (সা.)-এর নৈশ ভ্রমণ বা ‘ইসরা’র উল্লেখ আছে। উল্লেখ্য, মসজিদ আল-আকসা যে স্থানে নির্মিত হয় সে স্থানটিতে সেন্ট মেরীর গির্জা ছিল, যা সম্রাট জাস্টিনিয়ান নির্মাণ করেন। জেরুজালেম মুসলমানদের দ্বারা অধিকৃত হবার পূর্বে পারস্যের সম্রাট (খসরু) এই গির্জাটি ধ্বংস করেন। মসজিদ নির্মাণকালে স্থপতি কারিগরেরা ভগ্নপ্রাপ্ত গির্জার উপকরণসমূহ ব্যবহার করেন। কিংবদন্তি অনুযায়ী এক সময় এখানে সোলায়মানের আস্থাবল ছিল।

৭৪৭ খ্রিষ্টাব্দে আল-আকসা মসজিদটি ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হলে আব্বাসীয় খলিফা আল-মনসুর (৭৫৪-৭৫ খ্রি.) এটি পুনঃনির্মাণ করেন। পরবর্তীকালে ক্রসেডারগণ জেরুজালেম দখল করে (একাদশ শতাব্দী) মসজিদ আল-আকসাকে গির্জা হিসেবে ব্যবহার করেন। বর্তমানে সমগ্র এলাকা বায়তুল মুকাদ্দাস বা ‘হারাম শরিফ’ নামে পবিত্র এই স্থানটিতে অসংখ্য মসজিদ, সমাধি, দরবেশদের আস্তানা, ফোয়ারা দেখা যাবে, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মহামতি সোলায়মান (সুলতান) পর্যন্ত অসংখ্য সুলতান বহু ইমারত নির্মাণ করেন। পবিত্রতা ও সূচিতার দিক থেকে বায়তুল মুকাদ্দাসের স্থান তৃতীয় অর্থাৎ মক্কা এবং মদিনার পরে পবিত্রতম জিয়ারতের স্থান হিসেবে এটি পরিগণিত।

পূর্বদিকে চীন এবং পশ্চিম দিকে স্পেন পর্যন্ত মসজিদ স্থাপত্যের বিকাশে নানা ধরনের স্থানীয় উপকরণ ব্যবহৃত করলেও মসজিদের মূল নকশা এবং কাঠামো অপরিবর্তিত থাকে। নামাজের স্থান হিসেবে মসজিদ সবসময় খুবই সাদামাটা অথচ অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন ইমারত হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। নকশা পূর্ববর্তী মসজিদের নকশা থেকে গ্রহণ করা হয় এবং প্রতিষ্ঠিত ধর্মের পবিত্রতম এবং গৌরবমণ্ডিত প্রতীক হিসেবে সমাদৃত। মসজিদের বিবর্তনে মুসলিম কৃষ্টির উৎকর্ষতার ইতিহাস বিধৃত হয়ে রয়েছে। বস্তুত, মুসলিম কৃষ্টির শ্রেষ্ঠতম প্রতীক মসজিদ, যা আন্তর্জাতিকভাবে মসজিদ, ইসলাম এবং এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মধ্যে যে আদান-প্রদান (সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে) হয় তা, নিখুঁতভাবে প্রকাশ করে। অবশ্য আধ্যাত্মিকভাবে যে সমস্ত বিশ্বাসী উচ্চমার্গে অবস্থান করেন মসজিদের বিবর্তনে তাদের এমন কিছু যায় আসে না। তিনি যখনই খোলা চত্বরে (নামাজের উদ্দেশ্যে) প্রবেশ করেন, যার চারপাশে ছাদবিশিষ্ট খিলানপথ দ্বারা পরিবেষ্টিত, তখন পার্শ্ববর্তী পরিবেশ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন এবং নিজেকে মনে করেন যে, তিনি ঊর্ধ্বাকাশে গমন করেছেন (আল্লাহর দীদার লাভের জন্য)। সুউচ্চ ও সরু (কখনো কখনো ঢালু) মিনারগুলো দেখে মনে হবে আকাশের দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করছে। মসজিদের অভ্যন্তরে (লিওয়ান) শতশত বাতির শিখায় আলোকিত ভল্ট দেখে মনে হবে তারকাখচিত আকাশের গম্বুজ। সুচারুভাবে অলঙ্কৃত মিহরাব দেখে নামাজীদেরকে ধর্মবিশ্বাসের মূল উৎস স্মরণ করিয়ে দেয়। সারি সারি স্তম্ভগুলো অনন্ত বা অসীমকে ইঙ্গিত করে। বিশ্বব্যাপী মসজিদের নামাজরত মুসল্লীগণের মধ্যে এক অনাবিল ভ্রাতৃত্ববোধ এবং অবিচ্ছেদ্য ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

কেবলমাত্র ধর্মীয় ইমারত নির্মাণেই উমাইয়া আমলের স্থাপত্যকলা সীমাবদ্ধ ছিল না। দামেস্কে খলিফাগণই প্রথম রাজকীয় প্রাসাদ নির্মাণ করেন (মদিনায় খলিফাগণ এবং নবী করিম (স.) মাটির তৈরি ঘরে বসবাস করতেন)। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, রাজধানী শহরে এ সমস্ত বিশালাকার রাজপ্রাসাদ নির্মিত হয়নি, বরঞ্চ সিরিয়ার মরুভুমিতে এ সমস্ত রাজপ্রাসাদ স্থাপিত হয়। এ সমস্ত ইমারতসমূহের হাম্মামখানা এবং বিনোদন গৃহসমূহ আনন্দস্ফূর্তি করার উপযোগী করে নির্মিত হয়। এখানে খলিফাগণ অবসর বিনোদন, নানা প্রকার খেলাধুলা এবং মরুবাসী আরবদের বিভিন্ন চিরাচরিত পেশার স্বাদ গ্রহণ করতেন। মরু-প্রাসাদে (Desert Palace) অবস্থান করে খলিফা এবং রাজকুমারেরা শিকার, মদ্যপান, স্নান এবং নর্তকীদের নৃত্য উপভোগ করতেন। এ সমস্ত রাজপ্রাসাদসমূহের মাধ্যমে কেবলমাত্র ইসলামের জাগতিক (secular) স্থাপত্যকলার উন্মেষই হয়নি, বরঞ্চ এ সমস্ত ইমারতে ইসলামের প্রথম চিত্রকলার (ফ্রোস্কো) উদ্ভব হয়। এ সমস্ত রাজপ্রাসাদ আরব মরুভূমির পশ্চিমাঞ্চলে নির্মিত হয়, যার ধ্বংসাবশেষ এখনও দেখা যাবে। পূর্বে এ সমস্ত স্থানে রোমীয় দূর্গ ছিল।

সর্বাপেক্ষা আকর্ষণীয় এবং বহুল পরিচিত রাজপ্রাসাদটি আল-ওয়ালিদ নির্মাণ করেন। এর নাম ‘কুসাইর আমরা’ (ক্ষুদ্রকার আমরা প্রাসাদ)। আরব সাহিত্যে এর কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না। ‘কুসাইর আমরা’ প্রাসাদটি মৃত সাগরের (Dead Sea) উত্তর ঘেঁষে জর্দান নদীর পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত। এই প্রাসাদে যে দেয়াল চিত্র রয়েছে তাতে ছয়জন রাজা বা শাসকের প্রতিকৃতি দেখা যাবে। এই প্রতিকৃতিগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য সেই দুজন রাজা যাদের পরাজিত করে ইসলামি রাজ্য সম্প্রসারিত হয়েছে। যেমন— পারস্যের খসরু এবং স্পেনের ভিসিগথিক রাজা রডারিক। অন্য চার রাজা হচ্ছেন আবিসিনিয় রাজা নাজ্জাসী, বায়জানটাইম রাজা, ভারতীয় রাজা, চীনের রাজা (এম এম হাসান, মুসলিম চিত্রকলা, পৃ. ৪৫)। বিষয়বস্তু নিঃসন্দেহে মুসলিম রাজবংশের গৌরব ও মর্যাদা প্রদর্শনের জন্যই নির্বাচিত করা হয়েছিল। (স্নানাগারে প্রাচীরের দেওয়ালে রাজন্যবর্গের প্রতিকৃতির সংলগ্ন বিজয়ের প্রতীকস্বরূপ যে মূর্তিটি চিত্রিত হয়েছে, এর সন্নিকটে গ্রিক শব্দ ‘নীখে’ বা বিজয় Nikhe উৎকীর্ণ হয়েছে। প্রতীকস্বরূপ যে প্রতিকৃতিগুলো অঙ্কিত হয় সেগুলোকে বিজয়, দর্শন, ইতিহাস এবং কাব্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ সমস্ত প্রতিকৃতিগুলোর নিচে গ্রিক অথবা আরবি ভাষায় নাম লিপিবদ্ধ রয়েছে। এছাড়া অনাবৃত নর্তকী, সংগীতবিশারদ এবং আমোদ-প্রমোদকারীর প্রতিকৃতি ও অঙ্কিত হয়েছে। কুসাইর আমরার অভ্যন্তর প্রাচীন গাত্রের সর্বত্র বিভিন্ন ধরনের নকশা, যেমন— ফলসম্বলিত তালগাছ, লতাপাতা, ফলমূল, ফুলদানি, গুল্মলতা, মরুভূমির পাখি রয়েছে। এ সমস্ত অসাধারণ দেওয়ালচিত্র নিঃসন্দেহে সিরিয় এবং পারস্য শিল্পী কারিগরদের সৃষ্টি। এগুলো ইসলামি শিল্পকলা ও কৃষ্টিতে বায়জানটাইন পটচিত্র এবং কৌশলের অনুপ্রবেশ বলা যেতে পারে। ক্রেসওয়েল কুসাইর আমরার ফ্রেস্কো প্রসঙ্গে বলেন, ‘কুসাইর আমরার চিত্রাবলি স্পষ্টত বায়জানটাইন ধর্মীয় শিল্পকলার স্থলে সিরিয়ার পরবর্তী হেলেনিক শিল্পরীতির অনুকরণে চিত্রিত হয়।’ অন্যদিকে হারজফেল্ডের মতে, মহিলাদের প্রতিকৃতি অঙ্গনে সাসানীয় প্রভাব দেখা যায়। সুতরাং কেবল বায়জানটাইন বলা যাবে না (মুসলিম চিত্রকলা, পৃ. ৪৭- ৪৮)।

কুশাইর আমরার অপেক্ষা বৃহদাকার এবং তুলনামুলভাবে সংরক্ষিত খিরবাত আল-মাফজারের অতুলনীয় প্রাসাদটি প্রথম ওয়ালিদের ভাই এবং উত্তরাধিকারি হিসাম (৭২৪-৪৬ খ্রি.) কর্তৃক নির্মিত। স্পেনে উমাইয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা প্রথম আবদুর রহমানের পিতামহ ছিলেন হিশাম। জেরিকোর চার মাইল উত্তরে এই প্রাসাদটি নির্মিত হয়। সম্প্রতি জেরিকোর (১৯৩৪-৪৮ খ্রি.) খিলান বেষ্টিত একটি খোলা চত্বর এবং মসজিদের ভিত আবিষ্কৃত হয়েছে। এছাড়া অপূর্ব সুন্দর মোজাইক সমৃদ্ধ হাম্মাম খানাও পাওয়া যায়।

খিরবাত আল-মাফজারের প্রাসাদের ফটকটি পাথরে খোদিত অনেক আবক্ষ- মূর্তিদ্বারা শোভিত। এ সমস্ত প্রস্তরমূর্তির মধ্যে একটি প্রাসাদের নির্মাতা খলিফা হিশাম নিজের বলে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা ধারণা করেন। দরবার ঘরের এবং হাম্মামের মেঝে মোঝাইক দ্বারা অলঙ্কৃত এবং এই অলঙ্করণে জ্যামিতিক নকশা প্রাধান্য পায়। হাম্মামখানায় প্রবেশ পথে যে হলঘরটি রয়েছে তার গম্বুজের অভ্যন্তরে অ্যাকানথাস পাতা এবং দ্রাক্ষালতা দ্বারা আবৃত। প্রাচীরে খোদিত ও মডেলকৃত ছয়টি নারী-পুরুষের আবক্ষ মূর্তি ঝুলন্ত অবস্থায় দেখা যাবে। মনুষ্যমূর্তি বা মুণ্ডগুলো কেন্দ্রীয় গোলাপের চারপাশে বিন্যস্ত—এই রীতি মধ্য-এশিয়ার স্টাকো- ভাস্কর্যে দেখা যাবে।

সিরিয়ায় অষ্টম শতাব্দীতে যে স্থাপত্যকলার উন্নতি হয় তা ত্রয়োদশ এবং চতুর্দশ শতাব্দীর দুর্গ-প্রাসাদ নির্মাণে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে। এর দৃষ্টান্ত রয়েছে স্পেনের গ্রানাডার আল-হামরা প্রাসাদে। অসংখ্য চতুর হলঘর সম্বলিত আল-হামরা প্রাসাদ স্থাপত্যিক অলঙ্করণে অপূর্ব, অনিন্দ্যসুন্দর এবং অদ্বিতীয়। এই অলঙ্করণ মোজাইক, ফ্রেস্কো ও গিল্টির মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়। এই অতুলনীয় প্রাসাদটি দেখে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আগত পর্যটকেরা স্তম্ভিত হয়ে যায়।

আল-হামরা প্রাসাদের অসংখ্য কক্ষ ‘সিংহচত্বর’ (Court of Lions) নামে পরিচিত অংশের চারপাশে নির্মিত। সিংহচত্বর নামকরণ হয়েছে বারটি পাথরের নির্মিত সিংহমূর্তি সম্বলিত একটি ফোয়ারা থেকে। অপূর্ব নকশা সম্বলিত খিলানরাজি, যাতে প্লাস্টারের মোডিং করা নকশা (ত্রি-পত্র, বহুপত্র, পরস্পর ছেদকৃত খিলান) রয়েছে। একটি অথবা জোড়া অলঙ্কৃত মার্বেলের স্তম্ভগুলো থেকে নির্মিত। স্তম্ভগুলো খুবই হালকা এবং আকর্ষণীয়। সিংহাসনের চারপাশে, ব্যবহৃত বৈচিত্র্যপূর্ণ ও আকর্ষণীয় নকশাবলি (জ্যামিতিক, লতাপাতা, অ্যারাবে স্ক, মুকারনাস, পলেস্তারা, মোজাইক রঞ্জিত টালি, লিপিকলা) এই স্থাপত্যকীর্তিকে, ‘অলঙ্করণের এক অসাধারণ জাদু বা সংগীত’ ( a rare symphony of decoration) বলা হয়েছে।

আল-হামরার অসংখ্য কক্ষের মধ্যে ‘রাষ্ট্রদূতদের হলটি’ স্থাপত্যকীর্তি ও অলঙ্করণের দিক থেকে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। বিশালাকার এবং চতুষ্কোণী এই কক্ষটি একটি গম্বুজ দ্বারা আবৃতি, যা কোণ ঠেকা (support) ব্যতীত সরাসরি দেওয়ালের উপর স্থাপিত। এই গম্বুজের অভ্যন্তর খুবই জাঁকজমকের সাথে অলঙ্কৃত ও রঞ্জিত। অন্যান্য কক্ষগুলো অনুরূপভাবে শিল্পী—কারিগরেরা অলঙ্করণে অবহেলা করেননি। কিন্তু অন্যান্য কক্ষ অপেক্ষা অভ্যর্থনা কক্ষটি অলঙ্করণের দিক থেকে অতুলনীয়।

মার্কিন দার্শনিক ও ঐতিহাসিক উইল ডুরান্ট তাঁর দশ খণ্ডে সমাপ্ত Story of Civilisation (সভ্যতার ইতিকথা) গ্রন্থে সভ্যতার বিকাশে ভারতীয় সভ্যতা বিশেষত হরপ্পা সভ্যতার অবদান ও ভারতীয় ধর্মের পরমত সহিষ্ণুতার বিশেষ প্রশংসা আছে! বর্তমান বিশ্ব সভ্যতা ভারতীয় প্রজ্ঞার কাছে কী শিখতে পারে, সে বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন : ‘ভারত আমাদের দেখাবে পরিণত মনের সহনশীলতা ও নম্রতা এবং জীবাত্মার দখলদারি মনোভাব পরিহার করে এক শান্তি ও সন্তোষপূর্ণ মানসিকতা। ভারত শেখাবে পরমতসহিষ্ণু মনের প্রশান্তি ও সকল জৈবিক সত্তার প্রতি এমন এক গভীর প্রেমানুভূতি যা শান্তির নিবিড় বেষ্টনে সকলকে ঐক্যবদ্ধ করবে।’ (Our Oriental Heritage, Vol. 1, p. 633) I

২৫০০০ মাইল পরিধির এই পৃথিবীতে বাস করছে প্রায় সাতশ কোটি বনি আদম। এই চলমান পৃথিবীর সমকালীন পরিসংখ্যান— মানবেতিহাসের সামগ্রিক চিত্র নয়। সামগ্রিক চিত্র আরও দীর্ঘ এবং তাতে আছে অনাবিষ্কৃত অনেক অজানা তথ্য— যা বিজ্ঞান বীক্ষার মধ্য দিয়েই সভ্যতার অগ্রযাত্রায় শামিল হয়। তবে পদ্ধতিগত গবেষণায় দেখা যায়, ধর্মীয় আচার আর নৃপতিবন্দনার মধ্য দিয়েই উন্মোচিত হয় শিল্পচর্চার উন্মেষপর্ব। বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতাসমূহের অন্যতম হল এই উপমহাদেশীয় অঞ্চলের সভ্যতা যা ধর্মচেতনারই অঙ্গীভূত উপাদানে সমৃদ্ধ। উপমহাদেশের বিভিন্ন মন্দিরে, জাদুঘরে ও সংগ্রহশালায় সভ্যতার বিকাশ পর্বের যেসব নিদশর্নাদি সংরক্ষিত আছে তার অধিকাংশই ধর্মীয় উপাদান। বিশেষত হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন— এই তিন ধর্মের নানা দেবদেবীর প্রস্তর মূর্তি, ধাতু মূর্তি ও গুহাচিত্রে অঙ্কিত ধর্মীয় উপাদানের সমাহার। পরবর্তীকালে ইসলাম ধর্মের প্রচার অভিযানের সাথে সংশ্লিষ্ট নানা স্মৃতিবাহী ঘটনার নিদর্শন, মুসলিম শাসকদের সমরাভিযানের সাফল্য স্মৃতিসহ সুফিদের সমাধিভিত্তিক নির্মিত খানকা-দরগা সবই আজ শিল্পকলার অঙ্গ এবং বিশ্ব সম্পদের অংশ। সভ্যতার বিকাশে এসব স্থাপনার অবদান অপরিসীম।

৬২২ খ্রিষ্টাব্দে হজরত মহম্মদ (সা.)-এর মদিনা মসজিদ ও বাসগৃহ নির্মাণের মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে ইসলামি স্থাপত্যের সূচনা। আরবদের বহুল প্রচলিত নির্মাণ ঐতিহ্য যেমন— শুষ্ক ইট, কাদামাটি, খেজুর বৃক্ষ ও খেজুরপত্র দ্বারা তাঁর মদিনা মসজিদ ও বাসগৃহ নির্মিত হয়েছিল, যাকে প্রকৃত অর্থে কোন স্থাপত্য বলা যায় না। তাছাড়া এক হাদিসে মহম্মদ (স.) ইমারত নির্মাণকে নিরুৎসাহিত করেছেন। তথাপি তাঁর মৃত্যুর অর্ধ শতক পরেই খলিফাগণ তথা মুসলিম শাসকবর্গ বিভিন্ন দেশ বিজয়ের মাধ্যমে প্রাক্-মুসলিম উন্নত সভ্যতার অধিকারী রোমান, বাইজান্টাইন ও সাসানীয়দের সংস্পর্শে আসায় ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে ইমারত নির্মাণে উৎসাহিত হন।

কোনও সভ্য সমাজই সমসত্ত্ব নয়। সেখানে নানা সংস্কৃতির নানা ‘জাতি’র নানা পটভূমির, নানা অবস্থার মানুষ পাশাপাশি বাস করে। সংগঠনশক্তি, সংখ্যাগরিষ্ঠতা, উদ্যম, উদ্যোগ, আগ্রাসী প্রতিন্যাস, রাষ্ট্রিক-আর্থিক ব্যবস্থায় দখলীস্বত্ব, উচ্চশিক্ষা ও প্রকৃষ্ট প্রযুক্তির জ্ঞান- এই সব এবং অন্যান্য নানা কারণে এক-একটি সমাজে এক-একটি গোষ্ঠী প্রধান হয়ে ওঠে। আবার সেই সমাজে কিছু গোষ্ঠী থাকে যারা ব্রাত্য, ওই সমাজের অধিবাসী হলেও যারা ওই সমাজে অচল, যে সব গোষ্ঠীর মানুষ জন্মসূত্রেই অধর্মের অধম। শেষোক্তদের ভিতরে কেউ কেউ আপন সামর্থ্য এবং অনুশীলনের ফলে হয়ত-বা প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে, হয়ত- বা সমাজপতিরা নিজেদের স্বার্থে তাদের গুণকে কাজে লাগাতে পারে, তাদের শিরোপা দিতে পারে, কিন্তু তাদের কখনও নিজেদের অন্তরঙ্গজন বলে গ্রহণ করে না। বাংলাদেশের ধর্মীয় সামাজিক প্রেক্ষাপটে এই চিত্র এখনও চোখে পড়ে। বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ দেশ, সম্প্রদায় সম্প্রীতির দেশ— একথা স্বীকৃত অবস্থায় সংবিধানের পৃষ্ঠায় লুকিয়ে আছে সমাজ মস্তিষ্কের সহনশীলতায় নয়।

আধুনিক যুগকে যদি বাদ দিই তাহলে সম্ভবত একথা বলা চলে যে মানুষের সৃজনশীল কল্পনা এবং বিবিধ শিল্পকর্মে তার রূপায়ণ অনেকখানিই ধর্মবিশ্বাসের দ্বারা চিহ্নিত। সারনাথের বুদ্ধ, মথুরার বিষ্ণু, এলিফ্যান্টার শিব, অথবা মল্লপুরের মহিষমর্দিনীকে বাদ দিয়ে এই উপমহাদেশে ভাস্কর্যের ইতিহাস অকল্পনীয়। ধর্মীয় স্থাপত্যের অসংখ্য বিস্ময়কর উদাহরণ দেখতে পাই মধ্যযুগীয় ইয়োরোপের উৎকাঙ্ক্ষায়ী গথিক ক্যাথিড্রালগুলিতে, পশ্চিম এশিয়ার নীলাভ মসজিদ মিনারেটগুলিতে, সাঁচী স্তূপে, ভূবনেশ্বর-কোনারক-খাজুরাহোর রূপোকীর্ণ মন্দিরগুলিতে। শুধু যে ভারতীয় সংগীতের একটি প্রধান অংশ ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্ত তা নয়, ইয়োরোপীয় সংগীতেও ধর্মীয় প্রভাব দীর্ঘকাল ধরে প্রবল ও ফলপ্রসূ। ইয়োরোপীয় সংগীত যাঁরা উপভোগ করেন তাঁদের দার্শনিক চিন্তা যে ধরনেরই হোক না কেন মোৎসার্ট, বেঠোফেন, হবাগনার কিংবা স্ট্রাভিনস্কির তুলনায় বাখ্ তাঁদের কম প্রিয় নন। এরই সঙ্গে লক্ষণীয় যে সব দেশেই প্রাগাধুনিক যুগের কাব্যে ধর্ম খুব বড় অংশ জুড়ে আছে। দান্তের মহাকাব্য আজও আমাদের তেমনি মুগ্ধ করে যেমন করে অনেক বৈষ্ণব পদাবলী অথবা রামপ্রসাদের শ্যামাসংগীত। ফলত কোন নাস্তিক যদি সুবেদী এবং রসিক হন, শিল্প সংগীত এবং সাহিত্যে যদি তাঁর অনুরাগ থাকে, তাহলে তিনি লক্ষ্য করতে বাধ্য যে ঐ জগতের অনেকটাই একদা ধর্মাশ্রিত ছিল, এবং আধুনিক যুগেও এই সম্পর্ক পুরোপুরি ছিন্ন হয় নি। বিশ শতকের কবিদের মধ্যে যাঁরা আমাদের বিশেষ প্রিয় তাঁদের মধ্যে যেমন আছেন সুধীন দত্ত, এলুয়ার ও নেরুদা— তেমনি আছেন রবীন্দ্রনাথ, রিলকে ও এলিয়ট। অবশ্য প্রত্যক্ষভাবে ধর্মের সঙ্গে যুক্ত নয় এমন স্থাপত্য ভাস্কর্য, চিত্রাঙ্কন, সংগীত, সাহিত্য অতীতেও রচিত হয়েছে; বর্তমান যুগে এই বিবরণ অনেক বেশি ব্যাপক এবং পরিস্ফুট। তা সত্ত্বেও প্রশ্ন থাকে, ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে শিল্পকল্পনার সম্পর্ক কী ধরনের? এই সম্পর্ক কি সমাপতনের? দু’এর মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে সে সন্নিধি দেখা দিয়েছিল তা কি আসলে আপতিক? অথবা এরা উভয়েই এক মানস-উৎস থেকে উদ্ভূত? একের কৃশায়ণ অথবা অভিক্রান্তির ফলে অন্যটি প্রবল অথবা দুর্বল হয়? এলিয়ট, মারিতা প্রমুখ অনেকে আধুনিককালে আর্টকে ধর্মবিশ্বাসের জায়গায় বসাবার চেষ্টা করেছেন এবং তাঁদের মতে এ-চেষ্টা নিতান্তই অপচেষ্টা। এলিয়ট শুধু ধর্মবিশ্বাসী নন, তিনি এ-যুগের একজন প্রধান কবি এবং সাহিত্যসমালোচক। তাঁর এই অভিযোগকে সাহিত্যানুরাগী নাস্তিক কতটা গুরুত্ব দেবেন?

শিল্পসাহিত্যের ইতিহাসে ধর্মবিশ্বাস একটি বড়ো ভূমিকা নিয়ে থাকলেও নির্ধারিত কোন ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত নয় এমন শিল্প সাহিত্য পুর্বেও রচিত হয়েছে এবং গত দুশো বছর ধরে বিভিন্ন সমাজে ধর্মবিশ্বাস থেকে বিযুক্ত শিল্পসাহিত্য ক্রমে প্রধান হয়ে উঠেছে। তন্ত্রের দ্বারা প্রভাবান্বিত হবার আগে বৌদ্ধধর্মে নারীকে প্রশ্রয় দেয়া নি। সাঁচীর তোরণে যে তুলনাবিহীন হবার আগে বৌদ্ধধর্মে নারীকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় নি। সাঁচীর তোরণে যে তুলনাবিহীন যক্ষীমূর্তি রূপ পেয়েছে অথবা অজন্তার গুহাগাত্রে একদা যে নারীরূপের বান্দা ঘোষিত হয়েছিল, তার প্রেরণা কি নির্বাণতত্ত্বে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বিশ্বাস থেকে উদ্ভূত? মেঘদূত অথবা অমরুশতক কি ধর্মীয় কাব্য? কাটুল্লুস, প্রপারটিউস, লি পো অথবা পেত্রার্ক কি ধর্মীয় কবি? দার্শনিক কবি লুক্রোটিউস তো ঘোষিতভাবেই নাস্তিক, জড়বাদী, এপিকুরসপন্থী। কিন্তু শেক্সপীয়র অথবা গ্যোয়েটের মহৎ সাহিত্যকর্মের ভিত্তি কি কোন নির্দিষ্ট ধর্মবিশ্বাস? টম জোন্‌স, ট্রিস্ট্যান শ্যান্ডি জ্যাক ও তার সঙ্গে কোন ধর্মবিশ্বাসের কি আদৌ সম্পর্ক আছে? বাগনার অথবা স্ট্রাভিনস্কীর সংগীত কি কোন কোন ধর্মবোধ থেকে উৎসারিত? অথবা ব্রানকুসীর ভাস্কর্য, রেনোয়া কিংবা পিকাসোর ছবি? রবীন্দ্রনাথের অনেক গানে তাঁর ধর্মবিশ্বাস উদ্‌ভাসিত, কিন্তু তাঁর ছবি সম্বন্ধে একথা কি বলা চলে?

ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক উদ্ভব ও সমকালীন বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট

সৃষ্টিরহস্য, জড় ও জীবনের উৎস ও পরিণতি সম্পর্কিত বিশ্বাস এবং সে অনুযায়ী সৃষ্টিরহস্যের চালিকাশক্তি পরিতৃপ্ত করে জীবনের স্বস্তি অর্জনের জন্য নির্ধারিত আচার-অনুষ্ঠান পালনকে ইংরেজিতে religion এবং বাংলায় ‘ধর্ম’ গণ্য করা হয়। পুরাতাত্ত্বিক আবিষ্কারের উপর নির্ভর করে অনুমিত হয়েছে যে, প্রায় বিশ-তিরিশ মিলেনিয়াম বছর আগে uper relaeolithic-বা ‘শেষ-পুরাপাথর পর্ব’র আদিম মানুষের মধ্যে প্রথম ধর্মীয় চেতনা স্ফুরিত হতে শুরু করেছিল। তবে সে চেতনায় কেবল দুটি ধারা বিদ্যমান ছিল। প্রথম ধারার অনুসারীগণ যখনই কোন প্রাকৃতিক শক্তি বা বস্তুর কাছে বিপন্ন বোধ করেছে তখনই সেটিকে প্রশমিত করার জন্য নানান কাল্পনিক উপায় অবলম্বন করেছে। এ ধরনের বস্তু বা শক্তির মধ্যে বিশাল আকারের পাথর খণ্ড, জলাধার, আগুন, বজ্রপাত প্রভৃতি অন্যতম। অপরদিকে, দ্বিতীয় ধারার অনুসারীগণ মাতৃকা, শিল্প, যোনি প্রভৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল। কিন্তু উভয় ধারায়াই সেকালে সেহেতু কোন সার্বজনীন নির্ধারিত আচরিক পদ্ধতি গড়ে ওঠেনি সেহেতু ইতিহাসের ঐ পর্বটিতে ধর্মীয় চেতনা প্রাতিষ্ঠানিক রূপলাভ করতে পারেনি। সেটির অভীষ্ট ছিল কেবল কোন-একটি বিশেষ বস্তু বা শক্তিকে মঙ্গল বা অমঙ্গলকারী গণ্য করে সমীহ প্রদর্শন। অর্থাৎ সেটি ছিল কেবল একটি মানসিক অবস্থার প্রতিফলন। সমাজতাত্ত্বিকগণ সেটিকে জড়বাদ, মহাপ্রাণবাদ, সর্বপ্রাণবাদ, প্রকৃতিবাদ প্রভৃতি বিভিন্ন আখ্যায় আখ্যায়িত করেছেন।

প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের জন্ম হয়েছিল দক্ষিণ বা নিম্ন-মেসপটেমিয়ার সুমেরিয় সভ্যতা পর্বে (খ্রি. পূ. ৪০০০-৩০০০ খ্রি.)। ঐ সভ্যতার উর শহরের অদূরে অবস্থিত স্থাপত্যিক জঞ্জালের মধ্যে প্রথম অনেকগুলো ছোট আকারের মূর্তিসহ ধর্মীয়ভাবাপন্ন পুরাস্থাপনার চিহ্ন আবিষ্কৃত হয়েছিল। সবচেয়ে আদিম পুরাস্থাপনাটির নাম দেয়া হয়েছিল ‘নিম খরসাগ’। সময়পর্ব ধরা হয়েছে খ্রিষ্টপূর্ব ৩১০০ খ্রি.। ঐসব নিদর্শন থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, সুমেরিয়রা বহু দেবতার পূজা করত। তাদের সমকালিক মিশরিয় সভ্যতাও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। মিশরিয়দের অন্যতম দেবতা ছিল আইসিস ও ওসিরিস প্রমুখ। এভাবে ইতিহাসের ঐ পর্বটিতে ধর্ম নগর-সভ্যতার হাত ধরে বিকশিত হতে শুরু করেছিল।

খ্রিষ্টপূর্ব দুই হাজার খ্রিষ্টাব্দের দিকে তুরস্ক ও কৃষ্ণসাগরের মধ্যবর্তী এশিয়া মাইনর এলাকার অধিবাসী হিট্টাইট ভাষা পরিবারভুক্ত একদল মানুষ বহু দেবদেবীভিত্তিক আরাধনার পুনর্জাগরণ ঘটিয়েছিল। একইভাবে গ্রিকরা শুরু করেছিল জিয়ুস, হেরা প্রভৃতি নামের দেবদেবীর পূজা। কিন্তু মিশরে বহু দেবতা ভিত্তিক পূজার পরিবর্তে ফারাও তৃতীয় আমেন বা ‘ইখনাটন’ (খ্রি. পূ. ১৪১১- ১৩৭৫) খ্রিষ্টাব্দে সূচিত করেছিল একেশ্বরবাদ। তার একেশ্বরের নাম ছিল (রে অর্থাৎ ‘সূর্যদেবতা’। মিশরিয় ফারাও ‘রাজা’গণ দাবি করত যে, তারা রে-এর বংশধর। এভাবে জন্মের গোড়ার পূর্বেই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম রাজতন্ত্রের কঠোর নিয়ন্ত্রণে দুটি প্রধান ধারা অর্থাৎ ‘একেশ্বরবাদ ও বহুঈশ্বরবাদ’-এ বিভক্ত হয়ে পড়েছিল।

খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ থেকে ৯৬০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে প্যালেস্টাইনের হিব্রু অর্থাৎ ‘সেমেটিক ও হিট্রাইট মিশেল থেকে উদ্ভূত’ মানবদল ইতিহাসে তাদের যাত্রা শুরু করেছিল। তাদের সংগঠিত করার জন্য ডেভিড নামে তাদের এক নেতা তাদের মধ্যে প্রথম একটি সংজ্ঞায়িত ধর্মমতের প্রচলন করেছিলেন। চলমান বিশ্বে সেটিরই পরিচয় ইহুদিবাদ। এভাবে ইতিহাসে সে পর্যায়ে ধর্ম রাজনৈতিক ঘরানার একটি বিশেষ অনুষঙ্গের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। হিব্রু মানবদল তাদের ধর্মকর্ম পালনের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিল উপাসনালয়। সেটির নাম ‘সেনেগগ’। ওটির ভিত্তি ছিল পৌত্তলিকতা বিবর্জিত একেশ্বরবাদ। তার সময়পর্ব পেরুতে না পেরুতেই ঐ অঞ্চলে মুসা নামে আর এক নেতার আবির্ভাব ঘটেছিল। তিনিও একেশ্বরবাদ পুঁজি করে ‘তোরাই’ নামে ভিন্ন একটি ধর্মমত প্রচার করেছিলেন, তবে অনুসারিগণের জন্য তিনি কোন উপাসনালয় প্রতিষ্ঠা করেনি। সুতরাং একেশ্বরবাদীদের মধ্যে ভাঙন ও ভাঙন থেকে প্রতিযোগিতা সূচিত হয়েছিল। অবশ্য সে অবস্থা কেবল তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং তা ধীরে ধীরে বহু দেবতাবাদী ও পৌত্তলিকদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছিল। ধর্মীয় প্রতিযোগিতায় সে কালপর্বটির আর এক বিশেষ ঘটনা হল নতুন এক বিশ্ব সাম্রাজ্য গড়ে ওঠা। অমিততেজ সে সাম্রাজ্যের নাম ছিল অ্যাশেরিয়া। অ্যাশেরিয়া সম্রাটরা নিজেদের ‘হামাস’ অর্থাৎ ‘সূর্য দেবতা’-এর পুত্র দাবি করে অধিবাসীদের বাধ্য করেছিল রাজরক্ত ধারা বহির্ভূত সাধারণ মানুষদের মধ্য থেকে উঠে আসা নেতাদের নেতৃত্বাধীন ঈশ্বরতন্ত্র।

সভ্যতার বিবর্তনে মানুষের ধর্মবিশ্বাস

মানুষের ত্রিশ-চল্লিশ হাজার বৎসরের ইতিহাসে মাত্র পাঁচ হাজার বৎসর আগে ধর্মের আবির্ভাব হয়েছিল। আর বড় বড় ধর্মগুলো গড়ে উঠেছে আরো অনেক পরে, মোটামুটি আড়াই হাজার বছর আগে থেকে। মানুষ এবং তার সভ্যতার বিবর্তন ভবিষ্যতে সুদূর প্রসারিত। সুদূর অতীত এবং অনাগত সুদূর ভবিষ্যতের তুলনায় ধর্মের বর্তমান বয়স অতি সামান্য। বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এ ভবিষ্যদবাণী খুবই যুক্তিসম্মত যে জ্ঞানবিজ্ঞানের অগ্রগতি এবং জনমনের গভীরে বিস্তার, তথা মানব সমাজের বর্তমান রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক কাঠামোর ধর্ম এমন কোন রূপ পরিগ্রহ করবে যে আজকের সংজ্ঞায় সে ধর্মকে আর চেনাই যাবে না। আবার সভ্যতার গতি নির্ণয়ে ধর্মের প্রভাব সংক্রান্ত উপরের আলোচনা থেকে আরেকটি সিদ্ধান্তও অনিবার্য হয়ে পড়ে। জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তির শক্তিতে দ্রুত পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে আগামী দিনেও যেসব দেশ অথবা জনগোষ্ঠী প্রাচীন ধর্মগ্রন্থগুলোতে অন্ধ বিশ্বাসে অচল থাকবে, তারা যে শুধু নিজেদের সভ্যতার অগ্রগতিকে আত্মঘাতী ভ্রান্ত চেতনায় প্রতিহত করবে তাই নয়, বিশ্বময় মানব প্রজাতির প্রগতিকেও তুলবে মন্থর করে। (জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায়, সভ্যতার বিবর্তনে ধর্ম)।

ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে বিভিন্ন সমকালীন বিশেষজ্ঞদের মূল্যবান রচনার একটি সঙ্কলন সম্পাদনা করেছেন A Cultural History of India (1975) এ.এল. ব্যাশাম। সেই সঙ্কলন গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি বলেছেন, ‘পৃথিবীতে মানবসভ্যতার প্রধান চারটি ধাত্রীভূমি থেকে সভ্যতা-সংস্কৃতির আলোকশিখা পৃথিবীর দিগ্বিদিকে প্রথম বিচ্ছুরিত হয়েছিল। পূর্ব থেকে পশ্চিমে সেই ধাত্রীভূমিগুলি হল যথাক্রমে চীন, ভারতীয় উপমহাদেশ, মেসোপটেমিয়া এবং ভূমধ্যসাগরীয় দেশ— বিশেষত গ্রীস এবং ইতালি। এই চারটি দেশের মধ্যে আলোক বিতরণের ভূমিকা যে দেশের সবচেয়ে বেশি তাকেই সবচেয়ে কম গুরুত্ব দেওয়া হয়। ভারতবর্ষের ধর্মসংস্কৃতি এশিয়ার অধিকাংশ দেশকেই প্রভাবিত করেছে এবং বহু উল্লেখযোগ্য মূল্যবান সাংস্কৃতিক উপাদানে সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে সমৃদ্ধ করেছে। কেবল তাই নয়, বিশেষত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তের প্রায় সব দেশ বা জাতিকেই এককালে সভ্যতা ধর্ম ও সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত করে এসেছে।’

আমরা ইতিহাস অনুসন্ধানে দেখতে পাই সমগ্র এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ক্ষেত্রে প্রথমত বৌদ্ধ এবং দ্বিতীয়ত হিন্দু ধর্মসংস্কৃতির প্রভাব কত অপরিসীম, এরপর মুসলিম বিজয়ের পর বার শতকে এই উপমহাদেশে যুক্ত হয় ইসলামী সংস্কৃতি প্রভাবিত মসজিদ-মীনার-স্মৃতিসৌধ, ধর্মশালাসহ অসংখ্য দৃষ্টিনন্দন প্রতিষ্ঠান— যার অনেকগুলি আজ বিশ্ব ঐতিহ্যের (World Heritage ) অন্তর্ভুক্ত। ঐতিহাসিক প্রামাণ্য তথ্যে দেখা যায় যে, সমগ্র মধ্য এশিয়া থেকে পূর্বে চীন এবং জাপান পর্যন্ত বৌদ্ধ সংস্কৃতির প্রভাব বিস্তৃত হয়েছিল এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বৌদ্ধ সংস্কৃতির পাশাপাশি হিন্দু সংস্কৃতি, বিশেষত শৈলেন্দ্র রাজাদের আমলে, ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল। যার নিদর্শনস্বরূপ ইন্দোনেশিয়ার অধিকাংশ জনগোষ্ঠীই পরবর্তীকালে যে কোন কারণেই হোক, ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও বোরোবুদুর এবং অন্যান্য হিন্দু-বৌদ্ধ স্মারক আজও সযত্নে রক্ষিত, রামায়ণ গান এবং নাটকাভিনয় আজ পর্যন্ত জনপ্রিয়। মুসলমানপ্রধান ইন্দোনেশিয়ার সরকারি বিমান পরিবহন সংস্থার নাম ‘গরুড় এয়ারওয়েজ।’ রাষ্ট্রীয় মুদ্রায় অঙ্কিত হয় হিন্দু পুরাণ অনুসৃত সিদ্ধিদাতা গণেশের ছবি। বালিদ্বীপসহ অন্যান্য মুসলিম আবাসনেও বাড়ির সম্মুখভাগে সজ্জিত হয় রামায়ণের ঐতিহ্য ভিত্তিক গাথাচিত্র। এতে তারা কোন ধর্মবিকারে আক্রান্ত হয় না। এছাড়া নাম- পরিচয়ে সোয়েকার্ণো, সুহার্তো বা মেঘবতী ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির নামেরই ঈষৎ পরিবর্তিত রূপ। এপ্রসঙ্গে আমরা সুকর্ণপুত্রী মেঘবতীসহ অসংখ্য মুসলিম নারীর নাম আমরা স্মরণে আনতে পারি। কাম্পুচিয়া (আদি নাম ‘কম্বোজ’), থাইল্যাণ্ড (শ্যামদেশ) কিম্বা মালয়েশিয়ায় ব্যাপকভাবে ইসলামি প্রভাব পড়লেও নামের ক্ষেত্রে নরোদম (নরোত্তম) অথবা মাহাথির মহম্মদ (মহাথের/মহাস্থবির), ইত্যাদির শব্দব্যুৎপত্তির আড়াল থেকে কয়েকশো বছর আগে ভারতীয় ধর্ম- সংস্কৃতির ঐতিহ্য উঁকি দেয়।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, ‘ধর্মের বিকারেই গ্রীস মরিয়াছে, ধর্মের বিকারেই রোম লুপ্ত হইয়াছে এবং আমাদের দুর্গতির কারণ ধর্মের মধ্যে ছাড়া আর কোথাও নাই।’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সভ্যতার সংকট)।

আফগানিস্তানের বামিয়ান প্রদেশে গৌতম বুদ্ধের দেড় হাজার বছরের প্রাচীন পাথুরে মূর্তির উপর তালিবানদের কামান দাগার সংবাদে গোটা বিশ্ব শিহরিত এবং ক্ষুব্ধ। এই ক্ষোভ স্বাভাবিক। প্রাচীন সভ্যতা-সংস্কৃতির নিদর্শন এমন বর্বরতার সঙ্গে একবিংশ শতাব্দীতে ধ্বংস হতে দেখলে ক্ষোভ জাগবে বৈকি! নিন্দায় মুখর সকলেই। ইউরোপের মধ্যযুগীয় কালপাহাড় ‘বার্বার’দের সঙ্গে তুলনা টানা এ ক্ষেত্রে অনিবার্য। অনিবার্য হুন নরপতি অ্যাটিলা, চেঙ্গিজ খান, তৈমুর লঙ, নাদির শাহ, আহমদ শাহ আবদালি ও গজনির সুলতান মামুদের সঙ্গে তুলনাও।

তুলনা কিন্তু অপেক্ষাকৃত সভ্যদের সঙ্গেও টানা দরকার। জানা দরকার, রোমানরা কীভাবে জেরুজালেমে ইহুদিদের সিনাগগ ধ্বংস করেছিল। খ্রিষ্টানরা কীভাবে ধ্বংস কিেছল স্পেনের ইসলামি স্থাপত্যকে। সুসভ্য ও সংস্কৃতিগর্বী ফরাসিরা কী ভাবে মিশর অভিযানের সময় স্ফিংক্সের মূর্তিকে লক্ষ্য করে চাঁদমারি চালিয়েছিল, নেপোলিয়ন বোনাপার্টের হস্তক্ষেপে যা কোনক্রমে রক্ষা পায়, সে- ইতিবৃত্তও প্রসঙ্গত স্মরণ করা দরকার। কী করে ভুলে যাওয়া সম্ভব দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকায় সমৃদ্ধ ঐতিহ্যশালী ইনকা, মায়া ও অ্যাজটেক সভ্যতা ধ্বংসকারী স্পেনীয়দের বর্বরতার কথা? অ্যাপাচি ইন্ডিয়ানদের সভ্যতা যে নৃশংস অমানবিকতায় মুক্ত দুনিয়ার স্থপতিরা ধ্বংস করেছিলেন, তালিবান বর্বরতা তার কাছে নিতান্তই তুচ্ছ। হাইতি-সহ ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে এবং আফ্রিকায় ফরাসি ভাগ্যান্বেষীরা যে বর্বরতার স্বাক্ষর রেখেছিল, পোর্তুগালের জেসুইট যাজকরা ব্রাজিল ও আফ্রিকায় ভূমিপুত্রদের ধর্মান্তরিত ও ‘সভ্য’ করতে যে বীভৎস শ্মশানশয্যা রচনা করেছিল। তালিবানদের বর্বরতা কি তার চেয়েও হিংস্র ছিল?

জগতের অনন্ত কোটি সৃষ্টি যেমন পরিবর্তনশীল— মানুষও তেমনি পরিবর্তনশীল; কাজেই এক যুগের আইন তার জন্য অন্য যুগে প্রচলিত হতে পারে না এবং জোর- জবরদস্তি চালাতে গেলে তৎকালীন মানুষের বিকাশ সম্ভবপর হয় না।

ইসলামের এই অপসৃয়মান ধারাকে পুনর্বিকশিত করে খলিফা আল-মামুনের সময় (জ. ১৭০ হি.) সমাজ জীবনে ইসলাম যে নৈরাশ্যের অন্ধকারে তলিয়ে গিয়েছিল মামুন সেখান থেকে উদ্ধার করেন। মামুন অবশ্য উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলেন পিতা খলিফা হারুনর রশীদ ও পিতামহ খলিফা মনসুরের গৌরবময় রাজত্বের অতীত। পিতা খলিফা হারুনর রশীদের রাজত্বকালে তাঁর দরবারে জগতের বিভিন্ন দেশ হতে বিদ্বানমণ্ডলীর গুভাগমন হত। তাঁদের সাহায্যে তিনি নান্দনিক চর্চা করতেন। ফলে সাহিত্য, বিজ্ঞান ও কলা তাঁর রাজত্বের অপরূপ দান মানব-ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। তিনিই প্রথম সংগীতকে বিজ্ঞানের দরজায় উন্নীত করেন। তাঁর আমলেই মুসলিম আইন সুপ্রতিষ্ঠিত ও বিকশিত হয়।

পিতামহ খলিফা মনসুর বৈদেশিক ভাষায় লিখিত সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইতিহাস প্রভৃতি অমূল্য রত্ন আরবি ভাষায় অনুবাদ শুরু করেছিলেন। হারুনর রশীদও সে প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন। তবে তাঁর আমলে অনুবাদ এত বেশি হয় নাই; কারণ স্বয়ং কবি হওয়ায় তিনি কবিদের প্রতি বেশি আসক্ত ছিলেন। পৃথিবীর বিস্ময়কর ক্লাসিক আরব্য রজনী তো তাঁরই মহোত্তর সৃষ্টি। আল-মামুন মনসুরের আরদ্ধ কাজ সম্পূর্ণ করেছিলেন।

তাঁর জাগতিক কীর্তির মধ্যে সবচেয়ে স্থায়ী কীর্তি মানসিক বিকাশের মাল- মসলা— যা তিনি তাঁর রাজত্বের দীর্ঘ কুড়ি বছর যাবৎ সংগ্রহ করতে নিরন্তর ব্যস্ত ছিলেন। ইতিহাস হল : নানা ভাষায় অনুবাদকদের তিনি কড়ি দিয়ে কিনে আনতেন। প্রয়োজনে দীর্ঘকালের রাজ্যের সীমানা নিয়ে চলমান যুদ্ধ মিটিয়ে ফেলতেন ভূখণ্ডের বিনিময়ে অনুবাদক সংগ্রহ করেন। হারিয়ে যাওয়া গ্রিক ও ল্যাতিন জ্ঞান-বিজ্ঞান পুনরুদ্ধারের কৃতিত্ব তাঁরই।

যেখানেই এসব বিষয়ে জ্ঞানী-গুণীর সন্ধান পেতেন তিনি জাতি-ধর্ম- নির্বিশেষে তাঁদের আহ্বান করে রাজদরবারে এনে এই সমস্ত বিষয়ের উৎকর্ষ সাধনের জন্য প্রভূত অর্থ ব্যয় করতে কুণ্ঠিত হতেন না।

সাহিত্য, বিজ্ঞান, কলা, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা হাকিমিবিদ্যা তাঁর সময় দ্রুত বিকশিত হয়েছিল। এ সমস্তই পরবর্তীকালে স্পেন ও খ্রিষ্টান ইউরোপ প্রবেশ করে। আধুনিক জগতের জ্ঞান-গুণ এই সমস্তের ওপরই প্রতিষ্ঠিত একথা আজ অস্বীকার করবে সে হিম্মত কার আছে? এমনকি রাজকার্য পরিচালনার যে ইতিহাস তারা রচনা করে গেছেন আজকে আধুনিক তথা পশ্চিমা সভ্যতা কি সে কথা কল্পনাও করতে পারে? যখন রাজকার্য পরিচালনার কাউন্সিল নিযুক্ত থেকে মুসলিম, ইহুদি, খ্রিষ্টান, সারিয়া ও অগ্নি উপাসক, জরথ্রোস্ট একত্রে বসে মুসলিম খলিফাকে রাজ্য শাসনের উপদেশ দিতেন। কী চমৎকার ঔদার্য! বিবেকের স্বাধীনতা ও উপাসনার সমস্ত সুবিধাই অমুসলিমগণ উপভোগ করার অধিকার লাভ করেছিল। এ আদর্শ জগতের অতীব বিরল।

সংস্কৃতি ও সভ্যতা : স্বকীয়তায় ও আত্মস্থতায়

পৃথিবীতে মানবজীবনের একটি প্রধানতম তাৎপর্য হচ্ছে সভ্যতা ও নগরায়ণ। যার সাথে অন্যান্য অনেক রাজনৈতিক বিষয়াবলি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পৃথিবীর বুকে সভ্যতার উন্মেষ ঘটানো এক অর্থে পৃথিবীতে মানুষের জন্য স্রষ্টার পক্ষ হতে প্রতিনিধিত্বেরই বাস্তবায়ন। তাছাড়া এটাই মাটির ধরায় মানুষের জন্য হচ্ছে সামাজিক শৃঙ্খলা ও সুসামঞ্জস্যের পরিচায়ক। এ ব্যতীত উন্নতিও অর্থহীন। বরং মানবের উন্নতি ও পূর্ণতার জন্য এটা প্রকৃত ও অবশ্যম্ভাবী একটি পূর্বশর্ত। উইল ড্যুরান্ট বলেন, ‘সভ্যতা হচ্ছে সামাজিক শৃঙ্খলা, যা সাংস্কৃতিক সৃষ্টিশীলতার উদ্ভব ঘটায়।’ (Will Durant, Our Oriental Heritage, P. 1)। যদিও সভ্যতা মূলত সমাজসমূহের সাংস্কৃতিক বিকাশের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু এর স্বরূপ ও প্রকৃতি, প্রকারভেদ, কাঠামো ইত্যাদি বিষয় নিয়ে চিন্তাবিদ ও পণ্ডিতদের মধ্যে মতপার্থক্য বেশ গভীর। সভ্যতা সম্পৰ্কীয় আলোচনায় এসব মতপার্থক্যের ফলেই এ বিষয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও মতবাদ সৃষ্টি হয়েছে।

‘সংস্কৃতি’ ও ‘সভ্যতা’ শব্দ দুটিকে অনেক সময় সমার্থক শব্দরূপে ব্যবহার করা হয়। যদিও তাদের সমার্থক শব্দরূপে ব্যবহার করা চলে না। নৃতত্ত্ববিদরা ‘সংস্কৃতি’ শব্দটিকে ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করেছেন। তাঁদের মতে জ্ঞান, বিশ্বাস, কলা, নৈতিকতা, আচার-ব্যবহার এবং সমাজের সভ্য হিসেবে মানুষের অর্জিত অভ্যাস ও কর্মদক্ষতা সবই সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। ‘সভ্যতা’ বলতে তাঁরা বোঝেন মনুষ্য সমাজের উন্নত স্তরে, শহরে এবং রাষ্ট্রে মানুষের যে কর্মকুশলতার আবির্ভাব ঘটেছে তার সমষ্টি।

কোন কোন লেখক মনে করেন, মানুষের আচরণের দুটি দিক রয়েছে— বাইরের দিক এবং ভেতরের দিক। আচরণের বাইরের দিক হল সভ্যতা, তার ভেতরের দিক হল সংস্কৃতি। এসব লেখকদের মতে সংস্কৃতির মাধ্যমেই আমাদের প্রকৃতি প্রত্যক্ষভাবে প্রকাশিত হয়। আমাদের চিন্তা-ভাবনা, কাজকর্ম, শিল্পকলা, নীতিবোধ, ধর্ম, আমোদ-প্রমোদ সবকিছুর মাধ্যমেই আমাদের সংস্কৃতির প্রকাশ। বিভিন্ন বিষয়ের আকর্ষণ ও মূল হল লক্ষ্য এবং বস্তু ও ক্রিয়া হল এই লক্ষ্য লাভ করার উপায়; আর মানুষ যত রকম যন্ত্র বা উপায় নির্ধারণ করেছে সেগুলো সব মিলিয়ে হল মানুষের সভ্যতা, পার্থিব ও শিল্প-সংক্রান্ত যত রকম ব্যবস্থা বা কৌশল এবং মানুষের জীবনকে পরিচালিত করার জন্য যত আর্থিক ও রাজনৈতিক সংগঠন, সবই সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত।

বিভিন্ন লেখক ‘সংস্কৃতি’ ও ‘সভ্যতা’র মধ্যে প্রভেদ করেছেন। গর্ডন চাইল্ড- এর মতে, ‘সংস্কৃতি’ হল পরিবেশের সাথে মানবীয় অথবা শারীরবৃত্তীয় অভিযোজনের ক্ষণস্থায়ী বস্তুভিত্তিক প্রকাশ (durable material expression) যার সাহায্যে কোন সমাজ জীবন ধারণ এবং উন্নতি বিধান করেছেন। কান্ট-এর মতে নৈতিকতা সংস্কৃতির প্রয়োজনীয় উপাদান, সংস্কৃতি মনের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার, সভ্যতার সঙ্গে ব্যক্তির বাহ্য আচরণের সম্পর্ক। ম্যাথু অ্যারনল্ডও মনে করেন যে, সংস্কৃতি হল অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া, যেহেতু মানুষের সমগ্র পূর্ণতাতেই সংস্কৃতি নিহিত, আর সভ্যতা বাইরের ব্যাপার, যা বাহ্য ঘটনার উপর নির্ভর। ম্যাকাইভার-এ মতে সংস্কৃতি হল লক্ষ্য, সভ্যতা হল সেই লাভের উপায়। তাঁর ভাষায়, সভ্যতা হল সংস্কৃতির মন্ত্র, শরীর বা পরিচ্ছদস্বরূপ। সভ্যতা রাজনীতি, অর্থনীতি এবং যন্ত্রশিল্পের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে, আর সংস্কৃতির নিজেকে প্রকাশ করে কলা, সাহিত্য, ধর্ম ও নৈতিকতার মধ্য দিয়ে। আমাদের সংস্কৃতি হল আমরা যা তাই, আমাদের সভ্যতা হল আমরা যা ব্যবহার করি।

‘Thus Civilisation is external and mechanical, utiliarian and concerned only with means, while culture as dealing exclusixvely with ends, is internal organic and Pinal,’ (Gisbert, Fundementals of Sociology, P. 286 )।

গিসবার্ট বলেন, সভ্যতা হল বাহ্যিক ও যান্ত্রিক, জনকল্যাণকর এবং উপায়ের সঙ্গে এর সম্পর্ক। কিন্তু সংস্কৃতির কাজ যেহেতু লক্ষ্য নিয়ে, সেহেতু এ হল অভ্যন্তরীণ, অর্জিত এবং সম্পূর্ণ। তিনি আরও বলেন, সভ্যতা হল যা আমাদের আছে, সংস্কৃতি হল আমরা যা তাই। (Civilisation is what we have, Culture is what we are, Ibd, P. 289) ।

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৯০-১৯৭৭) ধর্মদেশনা পরিস্ফুট হয়েছে তার ভারত সংস্কৃতি গ্রন্থে। এই গ্রন্থে আমরা তাঁর ধর্ম, দর্শন ও সাংস্কৃতিক চেতনাবোধের ব্যাপ্তি বুঝে নিতে পারি। ভারতীয় সংস্কৃতি, সভ্যতা, ধর্ম ও দর্শন এই গ্রন্থের প্রধান উপজীব্য। এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত তেরটি প্রবন্ধের মধ্যে ‘হিন্দুধর্মের স্বরূপ’, ‘হিন্দুধর্ম কাহাকে বলে?’, ‘পুরাণ ও হিন্দু সংস্কৃতি’ শীর্ষক তিনটি প্রবন্ধে তাঁর ধর্মদেশনা উপলব্ধি সহায়ক হতে পারে। ‘হিন্দুধর্মের স্বরূপ’ প্রবন্ধে ধর্মের মৌলিক দর্শন ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন :

‘হিন্দুধর্মের প্রথম বৈশিষ্ট্য, অন্য কতকগুলি ধর্মের মতো কোনও ব্যক্তি বিশেষের জীবন-কাহিনী অথবা জীবন-চরিত এবং তাঁহার প্রচারিত মতবাদের সঙ্গে অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত নহে। যেমন যিশু খ্ৰীষ্টকে বাদ দিয়া খ্রীষ্টান ধর্মের অস্তিত্বের কল্পনাই করা যায় না, জরথুস্ত্র ও বুদ্ধদেব ছাড়া জরথুশস্ত্রীয় ও বৌদ্ধ ধর্ম যেমন হয় না, মোহাম্মদের জীবনী ও শিক্ষা যেমন ইসলাম বা মোহম্মদীয় ধর্মের অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠা, হিন্দু ধর্মের সেরূপ কোনও একজনমাত্র অবতার বা তত্ত্বজ্ঞ বা ধর্মগুরুর সর্বগ্রাহিতা নাই। পৃথিবীর ইতিহাসে বিশেষ দেশে এবং বিশেষ কালে বিদ্যমান কোনও একজন মহাপুরুষকে আশ্রয় করিয়া এই অন্য ধর্মগুলি নিজ শাশ্বততত্ত্ব প্রচার করিতেছে। দেশ-কাল-পাত্র-নিবদ্ধ মনুষ্য-চরিত্রের সীমার মধ্যে হিন্দু ধর্ম তাহার স্বীকৃত তত্ত্বগুলিকে সীমাবদ্ধ করিতে চাহে নাই। হিন্দু ধর্মকে প্রাচীন মিসর, আসিরিয়া-বাবলিন, প্রাচীন গ্রীস, চীন, জাপান প্রভৃতি দেশের ধর্মের মতো একটি Natural Religion বা ‘স্বভাবজ ধর্ম’ বলা যাইতে পারে; মানুষের অভিব্যক্তির সঙ্গে তাল রাখিয়া এইরূপ ধর্মের বিকাশ হয়, এবং জীবনের নানামুখিতার মতোই এইরূপ স্বভাব- জাত ধর্ম নানামুখ। এই সমস্ত স্বভাব-জাত ধর্মকে, যেগুলি কোনও বিশেষ আচার্যের শিক্ষাময় শাস্ত্রের মধ্যে নিবদ্ধ নহে, যেগুলি ‘কেতাবী ধর্ম’ নহে, যাহা বিশ্ব-প্রপঞ্চের ও মানব জীবনের পরিচালনাকারী কতকগুলি বিধি মানে, সেই ধর্মগুলিকে প্রাচীন কালে ইউরোপে খ্রীষ্টানরা Pagan অথবা ‘জানপদ’ ধর্ম বলিত। হিন্দু ধর্মও এইরূপ Pagan ধর্ম; ইহা-ই ইহার প্রধান গৌরবের কথা, ইহার সার্থকতা এখানেই (ভারত সংস্কৃতি/হিন্দুধর্মের স্বরূপ’, পৃ. ২৪)।

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ভারত সংস্কৃতি গ্রন্থে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রকৃত সত্যকেই উদ্ঘাটন করার চেষ্টা করেছেন। এখানে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ভারতীয় সংস্কৃতির মূলে রয়েছে সেই পরম সত্য (ultimate turth), যা ভারতীয় ঋষিগণ অনন্তকাল ধরে জানার চেষ্টায় রত। তিনি আসলে ভারতীয় সংস্কৃতির মূল যে বেদ- তাকে কেন্দ্র করে যে হিন্দু ধর্মের উদ্ভব এবং বিস্তার সেই হিন্দুধর্মের বিশ্লেষণ করে প্রকৃতই একজন দার্শনিক সত্তার পরিচয় দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘পুরাণাদি তথাকথিত অর্বাচীন শাস্ত্রের মূল বস্তু বেদ অপেক্ষা আধুনিক নহে; হিন্দু চিন্তার ইতিহাসে, পুরাণের ভাবধারা বেদেরই পরিপূর্তি-বেদ ও পুরাণ, নিগম বা শ্রুতি ও আগমন, উভয়ের সমন্বয় ও অবিচ্ছেদ্য মিলনের ফলে হিন্দু ধর্ম ও চর্যার পত্তন’– যা ভারত সংস্কৃতি/পুরাণ ও হিন্দু সংস্কৃতি’ (পৃ. ১৩১) এবং ‘হিন্দু দর্শন’ একে অপরকে আলিঙ্গনবদ্ধ হয়ে রয়েই গেছে। শাস্ত্র বিশ্লেষণে ভারতীয়দের কাছে ধর্ম ও দর্শন প্রায় অভিন্ন। সেই প্রাচীনকাল থেকেই হিন্দু সমাজসংস্কৃতির কাছে ধর্ম ও দর্শন প্রায় অভিন্ন। সেই প্রাচীনকাল থেকেই হিন্দু সমাজসংস্কৃতির সঙ্গে হিন্দুধর্ম মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। তাই হিন্দু সমাজের সংস্কৃতির প্রতিফলন হিন্দু দর্শনের মধ্যে দিয়েই জানা যায়। তিনি হিন্দুধর্মের লক্ষণে বলেছেন : ‘হিন্দুধর্ম হল- ১. অব্যক্তিবিশেষনিষ্ঠ; ২. বিশেষ-আস্থামন্ত্র-নিষ্ঠতা-বিহীন, ৩. জ্ঞানানুভূতিলব্ধ— শাশ্বত সত্তানিষ্ঠ; ৪. বিশ্বাত্মানুভূতিমূলক; ৫. দুঃখ নিবৃত্তি চেষ্টাময় এবং ৬. বিশ্বন্ধর’ (পূর্বোক্ত : পৃ. ২৬)। এখন আমরা একটা জিনিস লক্ষ্য করলে দেখতে পাব যে, ভারতীয় দর্শন চিন্তায় হিন্দু দর্শন বা ভারতীয় দর্শনের মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলিও হিন্দু ধর্মের উক্ত লক্ষণ বা বৈশিষ্ট্যগুলির অনুরূপ। আসলে হিন্দুধর্ম ও হিন্দু দর্শন একটি মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ।

মানুষের সৃষ্টিশীলতায় ধর্মবিশ্বাসের প্রভাব

কেউ কেউ যুক্তিবাদী সংস্কৃতির আত্মঅন্বেষার লক্ষ্যে এ প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন যে, ‘কেন সমাজে যুক্তিবাদী চেতনার প্রসার ঘটেনি, কেন ইউরোপীয় রেনেসাঁসের দর্শন-বিজ্ঞানকেন্দ্রিক যুক্তিবাদী চেতনা বিশ্বকে জানা, জীবনের রহস্য উদ্ঘাটন, অজানাকে জানা-চেনা-বোঝা ও জয় করার মানসিকতা আমাদের মননে আকাঙ্ক্ষিত মাত্রায় প্রভাব ফেলেনি, আচারপ্রধান ধর্মীয় রক্ষণশীলতার অচলায়তন কেন ভেঙে ফেলা যায়নি— সেসব প্রশ্নের সঠিক জবাব খুঁজে পাওয়া একালে আধুনিকদের জন্য জরুরি’। (আহমদ রফিক, যুক্তিবাদী সংস্কৃতির আত্মঅন্বেষণ)। লোকায়ত দর্শনের বাস্তববাদিতা সত্ত্বেও ‘ভক্তিতে মুক্তি’ এমন তত্ত্বকথার প্রতি বাঙালির এখনো প্রবল আকর্ষণ। আর এ কারণেই রামমোহন-বিদ্যাসাগরের যুক্তিনিষ্ঠ মানবতাবাদী সমাজসংস্কার সমাজে সহজে প্রতিষ্ঠা পায়নি। এই অবস্থার কারণ অনুসন্ধানে রবীন্দ্রভাবনায় বলতে হয়, ‘আমাদের শাস্ত্রচালিত অন্ধচিত্ত’ সাধারণ শিক্ষায় আলোকিত করে তোলা সম্ভব নয়। সেখানে দরকার যুক্তি ও বিজ্ঞানের সমন্বিত আঘাত। কেননা, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘সনাতন বলে পদার্থটা আমাদের অস্থিমজ্জায়, মনে-প্রাণে হাজারখানা হয়ে আঁকড়ে আছে; তার কত দিকে কত মহল, কত দরজায় কত পাহারা, কত যুগ থেকে ট্যাকসো আদায় করে তার তহবিল হয়ে উঠেছে পর্বতপ্রমাণ।’ আসলে অন্ধ ধর্মীয় চেতনা ও রক্ষণশীল আচার বা সংস্কারে গড়া অচলায়তনের ভিত ধরে টান দিয়ে তাকে গোড়া থেকে উপড়ে ফেলতে পারাই সমাধানের উপায়। রবীন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন, চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পারেননি। (প্রাগুক্ত)।

১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকার রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তাত্ত্বিক পণ্ডিত স্যামুয়েল পি. হ্যান্টিংটন তিনি The Foreign Affairs পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখলেন The Clash of Civilization? (সভ্যতার সংঘাত?) শিরোনামে। এর তিন বছর পর এই প্রবন্ধের প্রতিপাদ্যকে বিস্তৃত করে হ্যান্টিংটন একটি বই লেখেন : The Clash of Civilizations and the Remaking of World order। সেখানে তাঁর মূল বক্তব্য ছিল :

‘আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক নতুন পর্ব শুরু হয়েছে। এই পর্ব প্ৰথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বিশ্বের পুরনো বিভাজন আর প্রাসঙ্গিক নয়, প্রাসঙ্গিক নয় ধনতন্ত্র বনাম সমাজতন্ত্রের সংঘাত, এবার মানবজাতির অভ্যন্তরীণ বিভেদ হবে চরিত্রে, সংস্কৃতিতে, সেই বিভেদই হবে সংঘাতের মূল উৎস; বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভুত্ব বিস্তার করবে সভ্যতার সংঘাত।’

ছয়টি বা সাতটি প্রধান সভ্যতার উল্লেখ করেছেন হান্টিংটন—চীনা, জাপানি, হিন্দু, ইসলামি, পশ্চিমি সভ্যতার সঙ্গে অন্যান্য সভ্যতার সংঘাত। এবং এই অন্যান্য সভ্যতার তালিকায় আবার প্রথম ও প্রধান হল ‘ইসলামি সভ্যতা’। আর পশ্চিমি সভ্যতা বলতে তিনি বোঝেন মূলত পশ্চিমি-খ্রিষ্টীয় সভ্যতা, যার নেতৃত্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

অর্থাৎ হান্টিংটনের মতে, শ্রেণিসংগ্রাম নয়, রাজনৈতিক আদর্শের দ্বন্দ্ব নয়, দুনিয়ায় এখন মূল সংগ্রাম একটাই— ‘আধুনিক’ পশ্চিমি বনাম ‘মধ্যযুগীয়’ ইসলাম। এই যে পশ্চিম অর্থ ‘আধুনিক’ যা মিন করে- সভ্য, সত্য, সুন্দর আর ইসলাম অর্থ ‘মধ্যযুগীয়’ যা মিন করে— অসভ্য, বর্বর, মিথ্যা তথা অসুন্দর; এই-ই হল অরিয়েন্টালিজম। প্রাচ্যবাদ। এহেনো মানসিক দৈন্যের বিরুদ্ধে যিনি লিখিত জবাব দিলেন তিনিই এডওয়ার্ড সাঈদ। সাঈদের বক্তব্য হল,

‘স্যামুয়েল হান্টিংটন একটি ধারণা প্রচার করতে আসরে নেমেছেন, যে ধারণাটিকে তিনি আগেই সত্য বলে স্থির করে নিয়েছেন। হান্টিংটন মোটেই নিরপেক্ষভাবে বিভিন্ন সভ্যতার তুলনামূলক বিচার করেননি, তিনি নিজেই একটি পক্ষের হয়ে লড়াই করেছেন, একটি সভ্যতাকে অন্যান্য সভ্যতার চেয়ে মহত্তর প্রমাণের জন্য ওকালতি করছেন।’

আর একথা ঠিকই এটা করতে গিয়ে হান্টিংটন বেছে নিয়েছেন ফাঁকির সহজ পথ। একটি জটিল এবং বহুমাত্রিক বিষয়কে তিনি নিজের সুবিধা মত তরল করে নিয়েছেন, সাথে কিছু চালাক চালাক কথা তত্ত্বের আকারে পেশ করেছেন, ‘সভ্যতার সংঘাত’ তেমনি একটি চালাকি।

হান্টিংটন কি হঠাৎ কোন ভূঁইফোড় চিন্তার ধারক? না। বরং পাশ্চাত্যের মহা ডিসকোর্সের অংশ। সাঈদ ওই ডিসকোর্সের বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন আমৃত্যু। তিনি তাঁর স্বচ্ছ চিন্তা আর লাগাতার লেখনীর দ্বারা দেখিয়ে গেছেন প্রতীচ্যের তুলনায় প্রাচ্যকে যেভাবে হীন ভাবা হত, বর্বর বলা হত, প্রাচ্য সেই অর্থে হীন বা বর্বর নয়। পশ্চিমই বরং পূর্বকে বর্বর আখ্যা দিয়েছে, হীন বানিয়েছে, আর তা বানিয়েছে নিজেদের প্রয়োজনেই। এবং এ পথে তাদের টেনে আনে সাম্রাজ্যবাদী জিঘাংসা। পশ্চিমের মানুষেরা এরকম জ্ঞানেরই জন্ম দিয়েছে এতকাল, যে-জ্ঞানের মূল সুরটা হল প্রাচ্য অসভ্য-বর্বর।

ধর্মবিশ্বাসে ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক প্রভাব

নূহের প্লাবনোত্তর যুগের সেমিত সংস্কৃতির আরও নিদর্শন আমরা পাই সুদীর্ঘকালের মেসোপটেমীয় সভ্যতার বিস্তৃতিতে-তৌরাত গ্রন্থে এবং অন্যান্য সমসাময়িক পশ্চিম এশীয় সভ্যতা-সংস্কৃতিতে, যার আলোকচ্ছটার প্রতিফলন রয়েছে সিরিয়ায়, প্যালেস্টাইনে, মিসরে, ফিনিসিয়ায়, ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপাঞ্চলে এবং গ্রীকো-হেলেনিক সভ্যতায়।

নবীনূহের জীবনকালের সুস্পষ্ট সময় উল্লেখ নেই বাইবেলে। শুধু বলা হয়েছে : হজরত নূহ হজরত আদমের পরবর্তী দশম পুরুষ এবং নবী ইব্রাহীমের ঊর্ধ্বতন দশম পুরুষ হচ্ছেন নবী নুহ (আ.)। কিন্তু তাঁর সমকালীন ঘটনা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রেক্ষিতে বুঝা যায়, তাঁর জীবনকাল ছিল অন্তত কমপক্ষে খ্রিষ্টের জন্মের পাঁচ হাজার বছর পূর্বে। কেননা, জাহাজ নির্মাণে কাঠ, পেরেক এবং অন্যান্য যেসব জিনিসপত্র ও হাতিয়ারের প্রয়োজন তা ব্রোঞ্জ যুগের পূর্ব ছিল অনুপস্থিত। সুতরাং নির্মাণশিল্পে তারা ব্রোঞ্জ ব্যবহার করতে এবং নৌ-শিল্প ও অন্যান্য নানাপ্রকার শিল্পকর্মে তারা ছিল সুদক্ষ হস্ত ছিল।

মধ্য যুগীয় আরব হিব্রু ও ঐতিহাসিকদের মতে, নূহের সন্তানদের মধ্যে একজনের নাম ছিল সাম। কালক্রমে তাঁরও অনুসরণকারীরা ইউফ্রেতিস-তাইগ্রীস হতে উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে ভূমধ্যসাগর উপকূল পর্যন্ত সমগ্ৰ ভূভাগে বিস্তৃত হয়ে পড়েছিল যে কারণে তাঁর নামানুসারে উক্ত অঞ্চলের নামকরণ হয়েছে শামদেশ (বর্তমান ইরাকের উত্তরাঞ্চল ও সিরিয়া)।

নূহের আর এক পুত্রের নাম ছিল কানান। তাঁর বংশধরগণ গিয়ে বসতি স্থাপন করেছিল বর্তমান কালের জর্দান, লেবানন ও ইসরাইল অঞ্চলে। আর হাম নামক তাঁর অপর পুত্রের কিছুসংখ্যক বংশধর গিয়ে বসতি স্থাপন করেছিল দক্ষিণ আরবের নযদ ও ইয়ামেন অঞ্চলে। তাঁর বংশধরগণ সে অঞ্চলে হিমায়ার ও সাবিয়ান বলে পরিচিত। কিন্তু পরবর্তীকালে তাঁর উক্ত তিন পুত্রের বংশধর ও অনুসরণকারিগণ শামের নামানুসারে সামগ্রিকভাবে ইতিহাসে সেমিতিক নামে পরিচিত— এরা নূহের বংশধর ও অনুসারী প্রাচীন সেমিটিক জাতি। গবেষক ও তত্ত্ববিদদের মতে, এরা আদি ককেসীয় মানব শ্রেণির পরবর্তী একটি শাখা। আদি এশিয়ানদের সাথে এদের সম্পর্ক ছিল অতি ঘনিষ্ঠ। ঐতিহাসিকগণ প্রাচীন ব্যাবিলনীয়, আসিরীয়, ফিনিসীয়, হিব্রু, আরব, এরামাইক, ইথিওপীয় এবং দক্ষিণ আরবের হিমায়ার ও সাবিয়ানদেরকে সেমিত জাতির অংশ বলে চিহ্নিত করেছেন। এর মাধ্যমে সুস্পষ্টরূপেই বুঝা যায় যে, সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগেই সেমিতগণ ইরাক ও এশিয়া মাইনর হতে পশ্চিমে নীলনদের ব-দ্বীপাঞ্চলসহ আটলান্টিক মহাসাগর পর্যন্ত সমগ্র ভূমধ্যসাগরীয় বলয় এবং লোহিত সাগর উপকূল ধরে আরব সাগর পর্যন্ত সমগ্র জাজিরাতুল-আরব এবং লোহিত সাগরের পশ্চিম উপকূলবর্তী ইখণ্ডপীয়ায় বিস্তৃত হয়ে পড়েছিল। তখন পশ্চিমের সিনাই অঞ্চলের সেমিটদের সরাসরি যোগাযোগ ঘটেছিল এবং পশ্চিম ইউরোপ ও আফ্রিকার ভূ-মধ্য সাগরীয় অঞ্চলের প্রাচীন জনগোষ্ঠীর সাথে। কোন কোন ঐতিহাসিকদের মতে, খ্রিষ্টপূর্ব ষোড়শ শতকের পূর্বেই সেমিত নৌ-অভিযাত্রীগণ জিবরালটারের হারহিউলেসের পিলার অতিক্রম করে স্পেনে ‘গোবিদ’ (কার্দিজ) উপকূল হয়ে ওয়াদাল কুইভার নদীর অববাহিকায় গিয়ে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। সেকালে এখানে তারা খনি হতে টিন বা লৌহ আহরণ করত।

অন্যদিকে শান বা সিরিয়া উপকূলের সেমিতদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল গ্রীক, হেলেনিক, ক্রীটান ও ভূমধ্যসাগরীয় অন্যান্য দ্বীপাঞ্চলের অধিবাসীদের সাথে। আর দক্ষিণ দিকে তারা ইউফ্রেটিস-তাইগ্রীসের ভাটি ধরে পারস্যোপসাগর হয়ে পাকিস্তানের সিন্ধু পর্যন্ত, কারো কারো ধারণা মতে দক্ষিণ-ভারত ও দক্ষিণ- পূর্ব এশিয়ার কোন কোন অঞ্চলেও নৌ-বাণিজ্য পরিচালনা করত।

অনুমান করা হয়ে যে, খ্রিষ্টের জন্মের প্রায় হাজার বছর পূর্বে ইরাক হতে হিন্দুস্তানে উপ-মহাদেশে ব্রাহ্মী লিপির বিস্তৃতি ঘটেছিল ও সেমিট গোত্রীয় ব্যাবিলনীয়-আসিরীয় বণিকদের মধ্যস্থতায়ই। আর পশ্চিম এশিয়ার সেমিট গোত্রীয় ফিনিস জাতীয় মধ্যস্থতায় সেকালে মিশরীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রভাব গিয়ে স্পর্শ করেছিল গ্রিকো-হেলেনিকদিগকে। আবার সেখান থেকে গ্রিকো-হেলিনিক সংস্কৃতি তারাই নিয়ে এসে পৌছিয়ে দিয়েছিল প্রাচীন হিন্দুস্তানী সভ্যতার দ্বারপ্রান্তে। বলতে গেলে, সেকালের বিশ্বসভ্যতার বর্ণালী প্রবাহ সারাবিশ্বে ছিটিয়ে দিয়েছিল এ সেমিটিক জাতি। কোন কোন তত্ত্ববিদদের ধারণা সেই সূত্রেই সিন্ধু উপত্যকার মহেঞ্জোদারো সভ্যতাও গড়ে ওঠে ছিল। এর মাধ্যমে অনুমিত হয় যে, সেমিট মানগোষ্ঠীর এই মহান পূর্বপুরুষ ‘হজরত নূহ’কে প্রাচীনকালের হিন্দুস্তানী আর্যপুরাণে ও সংহিতায় ‘মনু’ নামে বর্ণনা করা হয়েছে।

একইভাবে জার্মান কিংবদন্তিতেও নূহ নবী খ্যাত হয়েছেন তাদের আদি মানব মানুষ নামে। মধ্যযুগীয় আরব ঐতিহাসিকগণ হজরত নূহকে আখ্যায়িত করেছেন দ্বিতীয় আদম বলে, ড. মুহম্মদ শহীদউল্লাহর ধারণও অনুরূপই ছিল। কিন্তু এখানে এসে ঐতিহাসিকভাবে ইতিহাসের মোড় ঘুরে গেল। যে এরামাইকদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য প্রায় খ্রিষ্টপূর্ব-বছরব্যাপী বিস্তৃত ছিল, কালে কালে ফিনিসীয়দের সাথে মিশ্রিত হয়ে তাদের তীর্থপীঠ হারিয়ে গেল জনতার মধ্যে, ইতিহাস ধরে রাখতে পারল না তাদের অস্তিত্বের চিহ্ন। এখন তাদের প্রাচীন ভাষারীতির ছিটেফোঁটা আঞ্চলিক ব্যঞ্জনা ও আদি সংস্কৃতির শীর্ণ চিহ্ন রয়েছে পুরাকীর্তির ধ্বংসাবশেষে ও কিংবদন্তিতে।

সেমিট মানবগোষ্ঠীর পরবর্তী বংশধর হিব্রু ও আরব উভয়েই এবং নবী ইবরাহীমের মাধ্যমে পরস্পর আত্মীয়তায় আবদ্ধ। দৈহিক গঠন এবং প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্য, ধারণা ও বিশ্বাস, নীতি-আদর্শ ও কিংবদন্তি এবং ধর্ম, দর্শন ও ভাষাগত সম্পর্ক ইত্যাদি মানবিক সভ্যতা-সংস্কৃতি সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় সূত্রে এরা উভয়েই নবী ইব্রাহীমকে নিজেদের আদর্শ পুরুষ এবং জাতীয় পিতা বলে স্বীকার করে থাকে। হিব্রুদের বিশ্বাস নবী ইব্রাহীমের পৌত্র এবং নবী ইসহাকের পুত্র হজরত ইয়াকুব যাঁকে ইসরাইল বা আল্লাহর প্রাণ বলা হত তাঁর মধ্যস্থতায় তারা ইসরাইল বংশ, বনি-ইসরাইল। আরবদের দাবি, নবী ইব্রাহীমের অপর পুত্র ইসমাইলের বংশধরদের সংগঠিত জনসমষ্টি আরব। অবশ্য, সার্বিয়ান হিমায়ারগণ বিভিন্ন গোত্র হতে উদ্ভূত হলেও আদি উৎস সূত্রে তারা সবাই সেমিট। সুতরাং হিব্রু ও আরব উভয়ে সেমিত ও ইব্রাহীমী বংশধর।

ঐশী গ্রন্থ তৌরাত বা Old Testament সূত্রে জানা যায়, খ্রিষ্টের জন্মের প্রায় একুশ শত বছর পূর্বে মেসোপোটেমিয়ার অন্তর্গত প্রাচীন কালদিয়া দেশের উর নামক স্থানে নবী নূহের পুত্র সামের বংশে নবী ইব্রাহীম জন্মগ্রহণ করেন। তখন এ অঞ্চলে পৌত্তলিকতা বা প্রকৃতি-পূজা ছিল অত্যন্ত প্রবল।

প্লাবনের পরে কালে কালে দেশের লোকেরা নবী নূহ কর্তৃক শিক্ষাপ্রাপ্ত একেশ্বরবাদের মহান আদর্শ বিস্মৃত হয়ে চন্দ্র-সূর্য ও গ্রহ-নক্ষত্র ইত্যাদি প্রাকৃতিক পদার্থ দেবদেবী পূজায় মগ্ন হয়ে নবী ইব্রাহীম তাদের এ সভ্যতা বর্জিত অসত্য তৎপরতায় লিপ্ত দেখে গভীরভাবে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তিনি ভাবলেন : এ বিশ্ব- ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয় একক; তা না হলে প্রাকৃতিক নিয়ম-শৃঙ্খলায় অবশ্যই কিছু না কিছু বিভ্রাট-ব্যতিক্রম ঘটত। এই যে গ্রহ-নক্ষত্র ও চন্দ্র-সূর্যের নিয়ম উদয়াস্ত, নিশ্চয় সেই একক শক্তির নির্দেশে চলছে। তারই শুভ ইশারায় এসবের পরিক্রমা ও প্রকৃতির নিয়মিত রূপান্তর। এ সবই তার সৃষ্টি। সেই একমাত্র উপাস্য। একাধিক দেব-দেবীর ধারণা ভ্রান্ত, অসভ্যতা। ওই সময়ে সম্ভবত উক্ত অঞ্চলে প্রাচীন ব্যাবিলনীয় দেবতা বেল ও এনলীল, চন্দ্র দেবতা, ‘সিন’ এবং আর্য দেবতা ইন্দ্র, মিত্রাবরুণ ও নাসত্যের উপাসনা প্রচলিত ছিল।

তিনি প্রাকৃতিক অবস্থার এ নিত্যনিয়ত নিয়ম-শৃঙ্খলা দেখে লাভ করলেন একত্ববাদের মহান বাণী। দেশবাসীদিগকে আহ্বান জানালেন সেই শাশ্বত সত্যের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের জন্য। কিন্তু কেউ তাঁর আহ্বানে সাড়া দিল না। তারা তাঁর সাথে নানা কূটতর্কে অবতীর্ণ হল। তারা নিজেদের চিরাচরিত বিশ্বাসের প্রতি তাঁর অনীহা ও অশ্রদ্ধা দেখে বিরক্তিবোধ করল। তাঁকে অমানুষিক নির্যাতনে জর্জরিত করে তুলল। অগত্যা তিনি নিজের স্ত্রী সারাও সঙ্গীদিগকে সাথে নিয়ে পিতৃভূমি কালদিয়া ত্যাগ করে চলে গেলেন কানান দেশে। সেখানে গিয়ে প্রচার করলেন একেশ্বরবাদের শাশ্বত বাণী এবং বীরশেবা নামক স্থানে নির্মাণ করলেন একক আল্লাহর উপাসনা গৃহ।

বিবি সারার সন্তান-সন্তুতি হওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় তাঁরি পরামর্শক্রমে নবী ইব্রাহীম দ্বিতীয়বার বিয়ে করলেন হাজেরা নাম্নী জুরহাম গোত্রের এক আরব মহিলাকে তাঁর গর্ভে জন্ম হয় নবী ইসমাইলের। নবী ইব্রাহীমের বৃদ্ধাবস্থায় বিবি সারার গর্ভে ইসহাক নামক তাঁর আর একপুত্র জন্মগ্রহণ করেন।

প্রথমা স্ত্রী সারার ঈর্ষাপরায়ণতায় পারিবারিক অশান্তির কারণে নবী ইব্রাহীম বাধ্য হলেন ইসমাইলকে সহ বিবি হাজেরাকে আরবের ফালাত (ফারান) অঞ্চলের একটি মরূদ্যানে তাঁর পিতার ঘরে স্থানান্তরিত করতে। তিনি নিজে থেকে গেলেন সারা ও ইসহাককে নিয়ে বীরেশেবায়। কিন্তু হাজেরা ও ইসমাইলের খোঁজ-খবর নেবার জন্যে তিনি প্রায়ই ফালাতে আসতেন। এ উপলক্ষে নবী ইসমাইলের মাতুল গোত্রের আরও বহু লোক এসে সে অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে।

যে স্থানে বর্তমান কাবাগৃহ অবস্থিত ফালাত অঞ্চলের সে স্থানে নবী ইসমাইল নিজের চেষ্টায় একটি আশ্রয়গৃহ নির্মাণ করেছিলেন, আর তার চারদিকে নির্মাণ করেছিলেন নিজের ছাগল ও মেষপাল রাখার জন্যে একটি চক্রাকার খোঁয়াড়। নবী ইব্রাহীম ঐশী বাণী হতে জানতে পারেন যে, আদম উপাসনার জন্যে যে স্থানে একটি উপাসনা গৃহ নির্মাণ করেছিলেন ঘটনাক্রমে তাঁর সেই মসজিদের বিধ্বস্ত ভিতের উপরেই ইসমাইলের আশ্রয়গৃহ ও খোঁয়াড় নির্মিত হয়েছে। তাই শেষবার তিনি ইসমাইল ও হাজেরাকে দেখতে এসে উক্ত ভিতের উপর পুত্র ইসমাইলকে সাথে নিয়ে আদমের স্মৃতি জড়িত সেই উপাসনা-গৃহ পুনর্নির্মাণ করেন এবং লোকদিগকে সেই পুণ্য পীঠে এসে হজ্বব্রত পালন করার জন্যে আহ্বান জানান। তখন হতে দূর-দূরান্তের লোকেরা এসে সেখানে হজব্রত পালন করতে শুরু করে। এটিই হজরত আদমের স্মৃতি জড়িত বিশ্বে একত্ববাদের প্রাচীনতম উপাসনাগৃহ বলে কথিত। এটিই হচ্ছে মুসলিম শক্তির পবিত্র কেন্দ্রবিন্দু ‘বাইতুলহারাম’। এর কাছেই হিজাজ নামক স্থানে বিবি হাজেরা ও নবী ইসমাইলের কবর।

আরবদের সাংস্কৃতিক জীবনের ইতিহাস ও ঐতিহ্য আরও সুদীর্ঘ-নবী ইব্রাহীমের জীবনকাল হতে মহানবী হজরত মুহম্মদের (স.) জীবনকাল পর্যন্ত প্ৰায় আড়াই হাজার বছর পর্যন্ত। তার পরবর্তীকালের হিব্রু ও আরবদের বা নবী ইব্রাহীমের বংশধরদের প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং কাহিনি ও কিংবদন্তি- সমাজ ও সাংস্কৃতিক জীবনের ইতিবৃত্ত হজরত ঈসার বা যশুিখ্রিষ্টের আবির্ভাব পর্যন্ত প্রায় দু’হাজার বছরব্যাপী। এ সময়ের মধ্যে সংঘটিত হিব্রু-আরব ঐতিহ্যের কিছু কিছু সুস্পষ্ট আর কিছু অজানার অন্ধকারে নিমজ্জিত— যার কোন কোনটা বাস্তব- ভিত্তিক ঐতিহাসিক সত্য, কোন কোনটা কল্পনা- বিস্তৃত সাধারণ বিশ্বাস, আর কোন কোনটা পরবর্তীকালের নানা প্রকার মত ও মতান্তরের বিভ্রান্তিকর প্রতিরূপ 1 সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে যুগে যুগে তাই দানা বেঁধে উঠেছে বস্তনিরপেক্ষ একটা সাধারণ বিশ্বাস রূপে।

নবী ইসহাকের পুত্র, হজরত ইয়াকুবের সন্তান নবী ইউসুফকে তাঁর বৈমাত্রেয় ভাইগণ দ্বারা কুপে নিক্ষেপ, মিশরগামী ইসরাইলী বণিকগণ দ্বারা ইউসুফের উদ্ধার লাভ এবং মিশর রাজার রক্ষীবাহিনীর অধিনায়ক পোটিফারের নিকট ইউসুফকে বিক্রি, অতপর মিথ্যা অপবাদে ইউসুফের কারাবাস, পরে রাজা ফেরাউনের স্বপ্ন ব্যাখ্যা মতে রাজানুগ্রহ অর্জন এবং দুর্ভিক্ষের সময় পিতা ও ভাইদিগকে মিশরে নিয়ে আশ্রয় দান, আর তাঁর দেহত্যাগের পরে কপ্টদের অধীনে ইসরাইলীদের দাসরূপে অবস্থান ও হজরত মুসার জন্ম এবং কপ্টদের দাসত্ব হতে তাদের উদ্ধার ও প্যালেস্টাইন অঞ্চলে তাদের নিয়ে আসার পরে ইসরাইলীদের বহুকাল যাবৎ যাযাবর জীবন যাপন ইত্যাদি বাইবেলে বর্ণিত ও কুরআনে সম বর্ণনা সুদীর্ঘ পাঁচশত বছরের বিখ্যাত কাহিনি সর্বজন নন্দিত। কুরআন এর সূরা ইউসুফে এসব ঘটনাকে সুন্দরতম গল্প বলে আখ্যায়িত বলা হয়েছে।

নবী মুসা বনি ইসরাইলদেরকে প্যালেস্টাইনে এনে বহু বছর যাবত তিন মরু অঞ্চলে কঠোর যাযাবর জীবনযাপন করেন। ঐশী গ্রন্থ বা Old Testament সূত্রে জানা যায়, কালক্রমে সেখানে তিনি ঐশী বাণী হতে লাভ করেন ইসরাইলীদের জীবন-বিধান সংক্রান্ত ‘দশ-নির্দেশ’ Ten Comands-এর মহান জ্ঞান।

নবী মুসা সেই দশ-ঐশী নির্দেশ খোদিত প্রস্তর ফলকের সাথে- নিজ তাঁবুর মধ্যে একটি সৌধ স্থাপন করে তা ইসরাইলীদের কিবলা রূপে মনোনীত করেন। বহুকাল যাবত এ-কিবলা বা উপাসনা স্থান ছিল তাদের সাথে সাথে মরুভূমিতে তাঁবুর মধ্যে।

যেখানে বর্তমানকালে বাইতুল মুকাদ্দাসের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী মসজিদ অবস্থিত, ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, সেখানে এককালে সর্বপ্রথম ধর্মীয় অনুষ্ঠান আরম্ভ হয় সার্বিয়ানগণ কর্তৃক গ্রিকদেবী ভেনাসের পীঠস্থান রূপে।

গ্রিকরা স্বীয় আরাধ্য দেবীর নৈকট্য লাভের জন্য উক্ত স্থানে প্রতিষ্ঠিত একটি আকারহীন প্রস্তরবেদীর গায়ে জলপাইর তৈরি মর্দন করে নিজেদের ভক্তি-অর্ঘ্য নিবেদন করত। কালক্রমে সেটা বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়ার বহুকাল পরে ইসরাইলীগণ উক্ত স্থান অধিকার করে সেই বিধ্বস্ত বেদীমূলে নিজেদের উপাসনা মণ্ডপ স্থাপন করে এবং এসে তাদের স্থায়ী কিবলা বলে ঘোষণা করে।

হজরত দাউদ (David) নবীর জীবনকাল (খ্রি. পূ. ১০৩১-৯৭১) থেকে কয়েক শতাব্দী ব্যাপী এ অনাড়ম্বর বেদীর উপরে স্থাপিত উপাসনা মণ্ডপই ছিল তাদের কিবলা।

তারপর হজরত মুসার (খ্রি. পূ. ১৩৫১) পাঁচশত বছর পরে দাউদ নবী উক্ত স্থানে একটি উপাসনা-গৃহ নির্মাণের ইচ্ছা করেন; কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তিনি তা সুসম্পন্ন করতে পারেননি। তাঁর নির্দেশ অনুসারে তাঁর মৃত্যুর পর তারপুত্র নবী সুলাইমান (Solomon) খ্রি. পূ. ৯৮২-৯৩০ এ মসজিদের নির্মাণকাজ সম্পন্ন করেন। তিনি সে মসজিদের মেঝের একপার্শ্বে একটি কুঠরীতে নবী মুসার ‘দশ নির্দেশ’ সংরক্ষিত সৌধ স্থাপন করেন এবং তাঁর বেদী, ষষ্ঠি, অর্ঘ্যথালা, প্ৰদীপযুক্ত পিলসুজ এবং হনন পীঠ সে মসজিদের মধ্যে যথাস্থানে সাজিয়ে রাখেন। সে-ই ঐতিহাসিক ‘মসজিদুল-আকসা’– একত্ববাদের দ্বিতীয়তম প্রাচীন মসজিদ, ইসলামের প্রথম যুগে তৎকালীন মুসলিমদের কিবলাও ছিল ইসরাইলীদের জাতি- ভিত্তিক ধর্মীয় উপাসনা-গৃহটি।

একত্ববাদী ধর্মনিষ্ঠ জাতি ইহুদীরা। ইহুদীদের ধর্মাদর্শ ও দর্শন, সমাজ সংগঠন ও জাতীয় অর্থনীতি সবকিছুরই মূলেই ছিল ধর্মীয় ধ্যান-ধারণার প্রেক্ষিতে উপাসনা গৃহ ও পুরোহিত শ্রেণিকে কেন্দ্র করে। আর এ কারণেই তাদের অর্থনীতি ও রাষ্ট্রীয় সংগঠন দুই ছিল উপাসনাগৃহের অধীন। এ নীতিতে অর্থ ও সম্পদের একমাত্র মালিক ছিলেন আলো, বাতাস, পানি ও মাটির সৃষ্টিকর্তা এক আল্লাহ-সার্বভৌম অধিকার তাঁর। জনগণ শুধু এর সংরক্ষণ ও সুষম বণ্টনকারী প্রতিনিধি। তৌরাতে বলা হয়েছে : যেহেতু আল্লাহই সবকিছুর মালিক সুতরাং শস্য-ফলন, ফলমূল, মেষপাল বা অন্য পশুসম্পদ সবকিছুর এক দশমাংশের মালিক আল্লাহর উপাসনা গৃহ। রাজা বা রাজশক্তির এতে হাত নেই। এছাড়া সর্বপ্রথম উৎপন্ন ফল-ফসল, মধ্য ও তৈল, সর্বপ্রথম কর্তন করা মেষলোম ও প্রথমজাত পশুশাবক এবং এমনকি প্রথমজাত সন্তান বা তার একটা নির্ধারিত মূল্য উপাসনা-গৃহের প্রাপ্য। পুরোহিতগণ ওইগুলো ধর্মীয় প্রয়োজনে উপাসনা-গৃহে ও সাধারণের কাজে খরচ করবেন। এতদ্বতীয় সমগ্র আয়ের এক চতুর্থাংশ বরাদ্দ ছিল গরিব ও নিঃস্বদের জন্য। তাছাড়া তাদের জাতীয় সমাজ ব্যবস্থায় প্রতিবেশীর শস্যক্ষেত্রে বা ফলের বাগানে প্রবেশ করে ক্ষুধার্ত ব্যক্তির নিজের ইচ্ছামত তা ভক্ষণ করার পূর্ণ অধিকার ছিল স্বীকৃত। ইহুদীদের অর্থনীতিতে সুদ গ্রহণ করা নিষিদ্ধ ছিল। গরিব প্রতিবেশীকে অর্থ সাহায্য করার নীতি ধর্মীয় বিধান অনুসারে ছিল বাধ্যতামূলক।

তাছাড়া প্রতি পঞ্চাশতম বর্ষের সাব্বাত পর্বে ঘটা করে কৃতদাস মুক্ত করা ছিল বাধ্যতামূলক আইন। ইহুদীদের ভূমি-নীতি ছিল—যেহেতু আল্লাহই ভূসম্পত্তির একমাত্র মালিক, তাই ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে অর্থের বিনিময়ে তা হস্তান্তর বা বিক্রি করা ছিল ইহুদী ধর্মে নিষিদ্ধ। প্রত্যেকে নিজ নিজ জীবৎকালে তা ভোগের মালিক, বিক্রির জন্য নয়। ধন-সম্পদ ও শক্তির প্রতি ভালবাসা ইহুদী ধর্মে-শাস্ত্রে ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কারণ এতে জাতির প্রতি ভালোবাসা অপেক্ষা সম্পদ লিপ্সা ও ধন-দৌলতের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি পায়, ফলে জাতীয় জীবনে অনুপ্রবেশ করে দারিদ্র ও ছোট বড় ভেদ-বৈষম্য আর সাম্যতা বরখেলাপ। মহান তৌরাত ও ইঞ্জিল গ্রন্থে এসব বিধি বিধান এবং আরও বহু বিষয় অতি সুন্দররূপে বর্ণিত হয়েছে। আর এসব বিষয় সমাজে-জীবনে পুনর্বাস্তবায়ন করতে গিয়েই ঈসা মাসিহকে ক্রুশে প্রাণ দিতে হয়েছিল ইহুদী ধর্মযাজকদের স্বার্থ প্রণোদিত মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে। অনুরূপ আঁটঘাট বাঁধা অর্থনীতির কারণেই ইহুদীদের প্রাচীনকাল হতে এসব নীতি লংঘন করার প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং লংঘনও করেছিল বারবার। তাদের এ নীতি লংঘনের কথা তৌরাতে, ইঞ্জিলে এবং কুরআনে বিশদভাবে উল্লেখিত হয়েছে। সম্ভবত এ কারণেই স্বাধীনভাবে অর্থোপার্জনের উদ্দেশে তারা দেশত্যাগ করে দূর-দূরান্তে গিয়ে মুক্ত পরিবেশে যথেচ্ছ অর্থোপার্জনের মধ্য দিয়ে নাম অর্জন করেছে জিও বা ইহুদীবাদ।

তৌরাত গ্রন্থ লিপিবদ্ধ ভাষায় ছিল না, খ্রিষ্ট-পূর্ব অষ্টম শতকের পূর্বেও। ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, অতি প্রাচীনকাল হতে এর বিষয়বস্তু চলে আসছিল মুখে মুখে। খ্রিষ্টপূর্ব অঞ্চম শতকে প্রফেট আমোস, হোসিয়া, ঈসাইয়া ও মিকাহর জীবনকাল পর্যন্ত স্মৃতি-শ্রুতিরূপে। বর্তমানকালে প্রচলিত তৌরাত গ্রন্থ যাকে ওল্ড টেস্টামেন্ট বলা হয়। তার কিছু কিছু সংগ্রহ করা হয়েছে সেকালে প্রচলিত প্রাচীন কিংবদন্তি হতে আর কিছু লিপিবদ্ধ করা হয়েছে খ্রিষ্টপূর্ব অষ্টম শতকের মাঝামাঝি হতে ষষ্ঠ শতকের মাঝামাঝির মধ্যে প্রফেটদের মুখের বাণী হতে। (Beeton’s Dictionary of Universal Information) ।

সে আদিকালে শিল্পকলার ক্ষেত্রে বিশ্বের সে অঞ্চল যতটা অগ্রসরমান ছিল ভাষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রভৃতি নানা প্রকার মানবিক সভ্যতা-সংস্কৃতি ক্ষেত্রেও সে অঞ্চল ছিল ততটা উন্নত। এর নজির আমরা দেখতে পাই মহাকালের চক্রকে অগ্রাহ্য করে বিশ্বসভ্যতার প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী নিদর্শসমূহ কালের সাক্ষীরূপে দণ্ডায়মান অঞ্চলগুলোর তৎকালীন পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে—

মিশর, ফিনিসিয়া, সুমের, আসিরিয়া ও ব্যাবিলন ছিল শিল্পকলা ক্ষেত্রে অগ্রসরমান সুতরাং জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রকাশ সংক্রান্ত ভাষার ক্ষেত্রেও ছিল তারা পুরোধা। তাদের থেকে আলো লাভ করে সেকালের ইজিয়ান উপকূলে যে জ্ঞান- বিজ্ঞান ভিত্তিক সভ্যতা-সংস্কৃতির চর্চা শুরু হয়েছিল এবং যা খ্রিষ্টপূর্ব শতাব্দীগুলোতে ব্যাপকভাবে চর্চিত হয়ে গ্রিক-রোম সভ্যতা বিশ্ব-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যে যুগান্তর এনেছিল যার প্রভায় পূর্ববর্তী সভ্যতাসমূহ নিষ্প্রভ হয়ে গিয়েছিল প্রাচীন বিধ্বস্ত শিলালিপিতে। কালের গতিতে সেই ইজিয়ান জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতা সংস্কৃতি বন্দি হয়ে পড়ল রোম (বাইজেন্টাইন) ও গ্রিসের গ্রন্থাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে।

রোম সম্রাট কনস্টান্টাইন ৩১৩ খ্রিষ্টাব্দে খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণ করে সর্বসাধারণকে সে ধর্মে দীক্ষিত হতে বাধ্য করলেন। ফলে খ্রিষ্টধর্মের যাজকীয় মতাদর্শ অনুসারে বিজ্ঞান সাধনা ধর্মবিরোধী বলে ফতোয়া জারি করে গ্রিস জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা নিষিদ্ধ করা হল। রুদ্ধ হয়ে গেল প্রাচীন গ্রিক সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার দরোজা।

আর তা বন্ধ হয়ে রইল মুসলিম সভ্যতার প্রসার লাভের পূর্ব পর্যন্ত কয়েক শতাব্দী।

আরও জানার বিষয় হল, সেই যুগে সারা ইউরোপ ও এশিয়ার ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের একমাত্র ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় একচ্ছত্র অধিনায়ক ছিলেন রোম সম্রাটগণ। যে কোন ব্যাপারে তাঁদের ফরমানের ব্যতিক্রম হওয়া ছিল অসম্ভব।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, বহু প্রাচীনকাল হতে সিরিয়ার এদেসা নগরে প্রথম শ্রেণির একটি বিজ্ঞান গবেষণাগার চালু ছিল। সেখানে গ্রিক ও কপটিক ভাষায় লিখিত বিজ্ঞানের গ্রন্থরাজী সিরীয় ভাষায় অনুবাদ করা হত, কিন্তু খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতকের শেষের দিকে তৎকালীন রোম সম্রাটের নির্দেশে খ্রিষ্টান ধর্ম যাজকগণ কর্তৃক ওইগুলি বিধ্বস্ত হয় এবং বিজ্ঞানীদের উপর চালানো হয় অবর্ণনীয় নির্যাতন।

একই কারণে জাস্টিনিয়ান কর্তৃক এথেন্স হতে সেখানকার বিজ্ঞানীগণ বিতাড়িত হয়ে পারস্য সম্রাট নওশিরওয়ানের (নওশেরওয়া) শরণাপন্ন হন।

তখনকার পারস্য সম্রাট নওশেরওয়াঁ ছিলেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরম উৎসাহদাতা এবং গুণী-জ্ঞানীদের যথোপযুক্ত মর্যাদাদানকারী সম্রাট। তাঁর বিতাড়িত বিজ্ঞানীদিগকে আশ্রয়দান করে নিজের রাজ্যে পুনর্বাসিত করেন এবং বিতাড়িত বিজ্ঞানীদের দিয়ে খুজিস্তানের জান্দিশাপুরে একটি বিজ্ঞান গবেষণাগার স্থাপন করেন। এই সময় ইরাকের হারানে খ্রিষ্টান পণ্ডিতদের একটি বিজ্ঞান-গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত ছিল। একই কারণে তাও খ্রিষ্টান ধর্মযাজকগণ কর্তৃক বিধ্বস্ত হয়।

তারপর সপ্তম শতকে দামেস্কের উমাইয়া খলিফা খালিদ-ইবন-ইয়াজিদ ওই সব গ্রন্থ সংগ্রহ করে আরবী ভাষায় অনুবাদ করাতে শুরু করেন। কিন্তু তাঁর শাসনকালে উক্ত কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন করতে পারেননি।

অতপর খ্রিষ্টীয় নবম শতকে বাগদাদের আব্বাসী খলিফা আবুজাফর আল- মনসুর এবং তাঁর পরবর্তীকালে খলিফা আল-মামুন রোমে বিশেষজ্ঞ প্রেরণ করে সেখান থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বহু মূল্যবান গ্রন্থ আরবী ভাষায় অনূদিত করিয়ে বাগদাদে আনয়ন করেন। তিনি ইয়াহ ইয়া ইবন মনসুর নামক জনৈক বিজ্ঞানীর তত্ত্বাবধানে বাগদাদে ‘বাইতুল হিকমাহ’ নামে একটি বিজ্ঞান গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করে তার আলো ছড়িয়ে দেন সারা বিশ্বে। সে প্রভায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠে ইউরোপসহ সমগ্র পৃথিবী।

ধর্মীয় পবিত্র বিশ্বাসে খ্রিষ্টধর্ম মতে, রবিবারকে সপ্তাহের প্রথম দিন ধরা হয়েছে নবী ঈসা-মসিহ ইহুদীদের দ্বারা ক্রুশ বিদ্ধ হওয়ার তিনদিন পর রবিবারেই নবী ঈসা কবর হতে উঠে এসে তাঁর শিষ্যদিগকে দেখা দেন। সেই স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যই খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের কাছে রবিবার বিশ্রাম ও উপাসনার জন্য নির্ধারিত অতিপবিত্র দিন যেমন মুসলিমদের ধর্মবিশ্বাসে শুক্রবার সপ্তাহের শ্রেষ্ঠতম দিন বলে পরিগণিত হয়।

ইহুদীরা খ্রিষ্টপূর্ব ৩৭৬০ বর্ষকে পৃথিবীর সৃষ্টিকাল ধরে ইহুদীগণ এবং প্রাচীন খ্রিষ্টানগণ প্রথম মানুষ আদম ও হজরত ঈসা নবীর মধ্যবর্তী ৫০০০ বছরকে ধরে খ্রিষ্টীয় সন গণনা করতে প্রাচীনকালে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের সচেতন লোকেরা নিজেদের জাতীয় ও ধর্মীয় ক্রিয়াকর্ম এবং আচার অনুষ্ঠানাদির জন্য তাদের জাতীয় বা ধর্মীয় মহাপুরুষদের নাম স্মরণীয় করে রাখার উদ্দেশ্যে নিজস্ব পদ্ধতির বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করত। তখনকার পরবর্তীকালের সেমিট তোত্রীয় ইহুদী ও খ্রিষ্টানগণ খ্রিষ্টপূর্ব ২০১৩ বর্ষকে তাদের মহান পূর্বপুরুষ নবী ইব্রাহীমের জীবনকাল ধরে গণনা করত ‘ইব্রাহীমী সন’। চীনদেশের মানুষ খ্রিষ্টপূর্ব ২০৯ অব্দকে চীনা কিংবদন্তির মহান রাজ ইয়াঙ-এর রাজ্যাভিষেকের সন ধরে গণনা করত ‘চৈনিক সন’। বর্তমানকাল যিশু খ্রিষ্টের জন্ম-পূর্ব তৃতীয় বর্ষকে ধরে গণনা করা হয়ে থাকে আধুনিক ‘খ্রিষ্টীয় বর্ষ’।

তাছাড়া পরবর্তীকালে ৫৭ খ্রিষ্টাব্দকে বিক্রমাদিত্যের দিল্লি বিজয়ের সন ধরে ভারতীয় বর্ষ সন এবং শকরাজ শালীবাহন কর্তৃক প্রবর্তিত ৭৮ খ্রিষ্টাব্দ হতে গণনা করা হয় ‘শকাবর সন’। ঠিক তেমনি ৬২২ খ্রিষ্টাব্দকে হজরত মুহম্মদের (স.) মক্কা হতে মদীনায় হিজরতের বছর ধরে মুসলিমদের গণনা হয় ‘হিজরী বর্ষ’। হিন্দুস্তানের মোগল সম্রাট আকবর ৯৩৬ হিজরিতে বা ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন। উপমহাদেশীয় জ্যোতির্বিদগণ উক্ত সনকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য হিজরী চান্দ্র বর্ষকে সৌরবর্ষে রূপান্তরিত করে এর নামকরণ করেন ‘ফসলী সন’-বা বাঙালিদের জাতীয় সন বঙ্গাব্দ।

বর্তমান রাশিয়ার ককেসাস অঞ্চলের যে ভূভাগে আদিম কসয়েড মানবশ্রেণির বিকাশ ঘটেছিল আধুনিক রাজনৈতিক-ভৌগোলিক সীমারেখা অনুসারে দেখা যায়, সে ভূভাগের মূলভূখণ্ডই বর্তমানে সোভিয়েত রাশিয়ার অন্তর্গত। নৃতত্ত্ববিদদের ধারণা এ ভূখণ্ডেরই অন্তর্গত মানুষ নিপার ও ভল্গা অববাহিকা এবং এর পার্শ্ববর্তী উরালের পার্বত্য অঞ্চল ছিল সেকালের মোঙ্গল শ্রেণির আদিম তুর্ক-তাতারদের বিচরণক্ষেত্র।

আদিমকালে ককেসীয়গণও সেখানেই বিচরণ করত। সেখান থেকে বেরিয়ে তারা বিস্তৃত হয়ে পড়েছিল এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে। এ প্রেক্ষিতে ধারণা করা হয় যে, অত্র ভূখণ্ডের ককেসীয়গণ সেকালের মোঙ্গল শ্রেণির তুর্ক- তাতার মানব গোষ্ঠীর মিশ্রণে মিশ্রিত কয়েসীয়। স্মরণাতীতকালে তাদের কিছুসংখ্যক বংশধর সেখান হতে আরও উত্তরে গিয়ে কিয়েভ, মস্কো ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহে স্থায়ী বসতি স্থাপন করেছিল।

আরব ঐতিহাসিকগণ আদি রুশভূমি হিসাবে বর্ণনা করেছেন, বর্তমান মস্কোর উত্তর-পশ্চিমে ইলমেন হ্রদ ও লাডোলা হ্রদের মধ্যবর্তী নেতা নদীর উৎসমুখের অরণ্যময় জলাভূমি অঞ্চলকে। তবে এ সম্পর্কে মতভেদ যাই হোকনা কেন, মস্কো-কিয়েভ অঞ্চলসহ সমগ্র ইউক্রেন ও বেলোরাশিয়া বা শ্বেতরূশ অঞ্চল যে এক কালে তাদের বিচরণভূমি ছিল সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।

কোন কোন গবেষক রাশিয়ার প্রাচীনতম মানবগোষ্ঠীকে সাইথিয়ান বা Scythean বলে উল্লেখ করেছেন। আবার কেউ কেউ তাদের ধারণা করেছেন স্লাভ গোত্রীয় বলে।

সর্বশেষ গবেষণার ফলে জানা যায়, বিশুদ্ধ রুশগণ বা শ্বেতরুশ এরিয়ান গোত্রীয় মানব। সম্ভবত এ ধারণা হতেই কোন কোন নৃতত্ত্ববিদ ইরানি ও হিন্দুস্তানি আর্যদিগকে রুশদের সাথে একই শ্রেণিতে রেখে জার্মানদিগকেও সেদিকে টেনেছেন। আসলে সেই স্মরণাতীতকালে তাদের মধ্যে কী সম্পর্ক বা সম্বন্ধ ছিল তা এখনও ধারণা বা অনুমানের ঊর্ধ্বে ওঠা যায়নি।

বর্তমানকালের সাধারণ রুশীয়দের ভরাট মুখ মণ্ডল, গালের উপরিভাগের উন্নত হাড়, আয়ত চক্ষু, বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে চক্ষুর কালো মণি এবং প্রসারিত মুখগহ্বর যা হাসির সঙ্গে দুদিকে প্রসারিত হয়ে পড়ে, তাতে অনেকে মনে করেন যে, রুশদের এ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মোঙ্গল শ্রেণির লোকের সাথে দৈহিক মিশ্রণের ফলাফল।

আদিমকালে ককেসাসের অরণ্যময় পার্বত্য অঞ্চল ও তার উত্তর দিকের পাশ্ববর্তী এলাকার অধিবাসী ছিল আদিম প্রকৃতির গোত্র কেন্দ্রিক কতকগুলো দুর্ধর্ষ ও বর্বর প্রকৃতির লোক। নৃবিজ্ঞানীদের ধারণা তারাই ছিল আদিম বেলো- রাশিয়ানদের উত্তর বংশধর। তাদের রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক চেতনা বলতে কিছুই ছিল না। ধর্মবিশ্বাসের দিক হতে তারা ছিল আদিম ধরনের একপ্রকার প্রকৃতিবাদী। এশীয় তুর্কো-মোঙ্গলদের মতই লুটতরাজ আর দস্যুবৃত্তি ছিল তাদের একমাত্র উপজীবিকা। তাদের মূল আবাসভূমি ইউরোপের অন্তর্গত শ্বেত রুশীয় অঞ্চল থাকলেও ইউরোপীয় সভ্য জাতিগুলো তাদের বড় একটা খোঁজখবর রাখত না।

অথবা খবর রাখার প্রয়োজনীয়তা বোধ করত না। তারাও ওই সময়ে ইউরোপের কোথায় কী ঘটছিল তারও তোয়াক্কা রাখেনি। ফলে বহুকাল যাবৎ এ অঞ্চল ছিল সভ্যতার অন্ধকারে নিমজ্জিত, তখনকার উন্নত সভ্যজগত হতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন।

পক্ষান্তরে ককেসাস অঞ্চলের দক্ষিণ ও পূর্বদিক এবং ভল্গা-উরাল অঞ্চল ছিল মধ্য এশিয়ার আমুদরিয়া-শিরদরিয়ার ও কাজাকিস্তানের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিচরণকারী দুর্ধর্ষ মোঙ্গল-তাতার যাযাবরদের দ্বারা বেষ্টিত—তাদের স্বাধীন সার্বভৌম বিচরণ ক্ষেত্র।

তখনকার সময়ে মোঙ্গল-তাতার যাযাবরগণ প্রায়ই ভল্গা ও তার উত্তর দিকের বিভিন্ন অঞ্চলে লুটতরাজ করে বেড়াত এবং স্থানীয় বর্বর অধিবাসীদিগকে বন্দি করে নিয়ে মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন শহরে বিক্রি করে দিত। প্রতি উত্তরে তারাও সুযোগ পেলেই তুর্কো-মোঙ্গল এলাকায়

তুর্কো-মোঙ্গল এলাকায় হানা দিয়ে প্ৰতিশোধ নিত ভীষণভাবে—লুটতরাজ করত এবং লোকজন বন্দি করে নিয়ে কৃতদাসরূপে কাজে খাটাত।

তবে এ বর্বর মানবশ্রেণি ককেসীয় ছিল নাকী মোঙ্গল তা সুস্পষ্ট জানা যায় না। তা যাই হোক, এমতাবস্থায় মধ্য এশিয়ার চ্যাপ্টা মুখমণ্ডল ও কালো চোখ বিশিষ্ট মোঙ্গল শ্রেণির লোকের সাথে ভল্গা-মস্কো-কিয়েভ অঞ্চলের দীর্ঘ মুণ্ড ককেসীয় শ্রেণির রুশদের দৈহিক মিশ্রণ ছিল খুবই স্বাভাবিক। এই কারণেই সম্ভবত সাধারণ রাশিয়ানদের চেহারায় মোঙ্গল প্রভাব সুস্পষ্ট। আজকালও মস্কো- কিয়েভ অঞ্চলে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে বলিষ্ঠ বা হালকাদেহী গোঁফবিশিষ্ট কালো চক্ষু জর্জিয়ান বা আর্মেনিয়ান, ভরাট মুখমণ্ডলের কাজাকস্তানী মোঙ্গল এবং দাড়িগোঁফ বিরল কুতকুতে চোখ বিশিষ্ট চীনা বা সাধারণ মোঙ্গলিয়ান মানবশ্রেণির আনাগোনা।

ইউরোপে যখন সৃজনশীল শিল্প-সংস্কৃতির ঊষাকাল, তখনও রুশীয়দের ভাষা ছিল খুবই দুর্বল। সৃষ্টিধর্মী সাহিত্য-সংস্কৃতি ও শিক্ষাকর্মের ক্ষেত্রে মধ্যযুগীয় অন্যান্য ইউরোপীয় জাতিগুলোর তুলনায় তারা ছিল সবার পিছনে।

অত্র অঞ্চলের গোত্রকেন্দ্রিক মানবশ্রেণির অধিনায়কগণ ছিলেন স্বাধীন সার্বভৌম ভূস্বামী বা সামন্ত ভূস্বামী। তারাই ছিলেন ভূমির মূল মালিক। সাধারণ মানুষ ছিল ভূমিদাস, বলতে গেলে কৃতদাসের মতই একটা আলাদা শ্রেণি। সম্পদ সংগ্রহ বা তার প্রায়োগিক ব্যবহারের অধিকার তাদের ছিল না সাধারণ মানুষের! প্রত্যেক জমিদারেই থাকত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মিলিশিয়া বাহিনী। জমিদারগণ তাদের বাহিনি নিয়ে বর্ষার সময় জলযানে এক শুষ্ক মৌসুমে যন্ত্র চালিত গাড়িতে করে নিজ নিজ এলাকায় কর আদায়ের নামে লুটতরাজ করে বেড়াতেন। এমনকি প্রয়োজন বোধে ওই সব ভূমিদাস দলকে অন্য জমিদারের নিকট বিক্রি করার বা ধারে খাটাবার ঘটনাও তখনও ছিল নিত্য ব্যাপার।

সে সব জমিদারদের মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের কিয়েভাইট ও উত্তরাঞ্চলের মস্কোভাইটগণ ছিলেন অধিকতর শক্তিশালী ও প্রভাবশালী। এরা সবই ছিলেন আদিম ধরনের প্রকৃতিবাদী বা পৌত্তলিক।

খ্রিষ্টীয় দশম শতকে কিয়েভের ওলসা নারী পৌত্তলিক জমিদারের ভ্লাদিমির নামক প্রভাবশালী পৌত্র অত্র অঞ্চলে খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের জন্য কনস্টান্টিনোপলের প্যাট্রিয়ার্কের নিকট অনুরোধ করে সেখান থেকে মিশনারি অতপর রোম থেকে খ্রিষ্টান মিশনারী এনে প্রথমে নিজে খ্রিষ্ট ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন এবং জনসাধারণকে খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করেন।

যার কারণেই খ্রিষ্ট ধর্মের সূত্র ধরেই সর্বপ্রথম রুশভূমিতে প্রসারিত হতে থাকে পাশ্চাত্য সভ্যতার আলো, আর এ রেশ ধরেই কিয়েভের পরবর্তী শাসকগণ রোমের রক্ষণশীল রাজনীতিতে প্রায় তিনশত বছর বংশানুক্রমে সমগ্র ইউরোপীয় রুশভূমিতে সার্বভৌম শাসক রূপে দোর্দণ্ড প্রতাপে রাজত্ব করেন এবং এমনকি রোমের অনুকরণে তাঁরা নিজেদের রাষ্ট্রকে ‘হোলী রুশ রাষ্ট্র’ বলে ঘোষণা করেন। বলা বাহুল্য, এ ধর্মীয় সংস্কৃতির সূত্র ধরেই ইউরোপীয় জাতি-পুঞ্জের সাথে রুশীয়দের নৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হয়ে ওঠে। তারা পাশ্চাত্যের অনুকরণে নানা প্রকার ও প্রকৃতির শিল্পকলা, কাব্য- সাহিত্য, স্থাপত্য-ভাস্কর্য ইত্যাদি বিভিন্ন মুখী সৃষ্টিশীল তৎপরতার দিকে অগ্রসর হতে থাকে— দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠতে থাকে শহর-বন্দর ও শিল্পকলা।

রাশিয়ার উত্তরাঞ্চলের মস্কোভাইটগণ দ্বাদশ শতকের শেষের দিকে শক্তিশালী হয়ে ওঠে তারা কিয়েভাইটদিগকে পরাভূত করে রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় সকল ক্ষমতা নিজেদের হস্তগত করে নেয়। যার কারণে সমস্ত ক্ষমতা পুঞ্জিভূত হয় মস্কোতে। গড়ে উঠে ষোল শ ‘মস্ক’-এর শহর অপূর্ব সুন্দর ও সম্পদে সুষমা মণ্ডিত হয়ে। বিপ্লবের পরে মস্কোভাইট শাসকদের হাত হতেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা চলে যায় সোসালিস্টদের হাতে। চিরতরে নির্বাপিত হয়ে যায় রাজতন্ত্রের বুনিয়াদ।

যদিও মস্কো প্রাচীন শহর, কিন্তু একে প্রাচীনতম বলা যায় না। এ দাবির অধিকারী একমাত্র বর্তমান ইউক্রেন প্রদেশের রাজধানী কিয়েভর।

সংস্কৃত ভাষার আর্য শব্দটার অর্থ হচ্ছে-ভ্রাম্যাণ বা যাযাবর। পাশ্চাত্য— ভাষা বা গ্রিক ভাষায় এরিয়ান করতে যে অর্থ প্রকাশ পায় সংস্কৃত ও ইন্দো-ইরানি ভাষায় এরিয়ান এরও একই অর্থ। সরল কথায় সংস্কৃত শব্দ আর্য ও গ্রিক শব্দ এরিয়ান দুটির অর্থই যাযাবর।

ককেসীয় প্রাচীন মানবশ্রেণির প্রাচ্য শাখার উপ-মহাদেশীয় আদি আদিবাসী অস্ট্রো-এশিয়াটিক ও দ্রাবিড় বহির্ভূত মানবশ্রেণির সে সব মানুষ অতীতকালে মধ্য এশিয়া হতে এসে ইরানে যাবাবর জীবন যাপন করত, পরে তাদেরই যে শাখা- গোত্রটি সেখান থেকে আরও সম্মুখে অগ্রসর হয়ে উপমহাদেশের উত্তর ও উত্তর- পশ্চিমাঞ্চলে এসে বসতি স্থাপন করে তারাই বৈদিক আর্য বা এরিয়ান। জ্ঞানী ইরানি মানব গোষ্ঠী।

মানবতত্ত্ববিদ ব্রমেনবাক ককেসীয় মানবশ্রেণির বিস্তৃতি-অঞ্চলের যে সীমারেখার বর্ণনা করেছেন, উপমহাদেশীয় বৈদিক আর্যগণ সে সীমারেখার মধ্যে না পড়লেও তারা যে প্রাচীন ককেসীয়দেরই প্রাচ্য-এরিয়ান শাখার কোন শাখাগোত্রের উত্তর বংশধর তাতে কোনই সন্দেহ নেই। উপমহাদেশে এরা সাধারণভাবে আর্য নামে পরিচিত হলেও এদের আমরা পরবর্তীকালের বৈদিক আর্য বলে জানি। মূলত আর্য শব্দ হতেই এরিয়ান নামের উৎপত্তি।

এশিয়া ও ইউরোপের ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীকে এরিয়ান বলে ইঙ্গিত করেছেন কোন কোন তত্ত্ববিদ। আসলে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীকে যত সহজে এরিয়ান ভাষা বলে চিহ্নিত করা সম্ভব, ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষীদিগকে তত সহজে এরিয়ান বলে চিহ্নিত করা সম্ভব নয়।

যুগ যুগ ব্যাপী বিভিন্ন পরিমণ্ডলের বিভিন্ন মানব শ্রেণির সাথে পারস্পরিক মিলন মিশ্রণের ফলে দৈহিক ও মানসিক বিবর্তনের ব্যাপারতো আছেই, তাছাড়া আছে যুগে যুগে যুদ্ধ, শান্তি, রোগ-ব্যাধি, দাসপ্রথা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে মিলন মিশ্রণের কারণ সম্ভাব্য প্রাকৃতিক বিবর্তন, যে কারণে তাদের ভাষার সূত্র ধরে তাৎক্ষণিকভাবে এরিয়ান বলে চিহ্নিত করা সম্ভব নয়।

সেকালের প্রাচ্য এরিয়ান বা আর্যগণ প্রাচীনকালে এশিয়া মাইনর ও তার পার্শ্ববর্তী বিস্তীর্ণ ভূমি অঞ্চলে পশুপাল নিয়ে যাযাবর জীবন-যাপন করত। এক স্থানে কিছুকাল অবস্থানের পর পশু ও মানুষের খাদ্যের অভাব দেখা দিলে তাদের কোন কোন দল বা গোত্র নতুন চারণভূমি ও চারণ ক্ষেত্রের সন্ধানে এগিয়ে যেত অন্যদিকে।

পরপর তাদেরও অনুসরণ করত অপর দল। এমনি করে হাজার বছরের পর হাজার বছর অনিশ্চিত যাযাবর জীবনযাপন করতে করতে কালক্রমে যারা যে অঞ্চলে গিয়ে কিছুটা স্থায়ী হওয়ার পর কৃষিকর্মের সুবিধা পায় সে অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হল তাদের স্থায়ী বসতি। তারপর যুগানুক্রমে সে সব অঞ্চলে তারা তাদের এরিয়ান বা আর্য নাম।

বৈদিক আর্যদের-আগমন ঘটেছিল সিন্ধু সভ্যতার জন্মদাতা মিশ্র আর্যদের বহুকাল পরে উপ-মহাদেশে এ কথা আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। তত্ত্ববিদদের ধারণা, বৈদিক আর্যদের উপমহাদেশে আগমনের বহুকাল পূর্বে তারা ছিল দুটি ভ্রাম্যমাণ জনগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত দুটি যাযাবর দল। তাদের মধ্যে ছিল : দীর্ঘদেহ দীর্ঘমুণ্ড, নীলচক্ষু, তীক্ষ্ণাগ্র নাসিকা এবং স্বর্ণাভ কেশ বিশিষ্ট নরডিক, যাদেরকে তত্ত্ববিদগণ ইন্দো-ইউরোপীয় মানবগোষ্ঠীর একটি শাখাগোত্র বলে চিহ্নিত করেছেন। আর তারা ছিল ঘোরবর্ণ, কালো চুল, গোলমুণ্ড, খর্বকায় আলপাইন যাদের কিছু কিছু বংশধর বহুকাল পূর্বেই উপ-মহাদেশে এসে কোল বা মুণ্ডা নামে চিহ্নিত হয়েছিল। বৈদিক আর্যগণ প্রথমে বর্ণিত ভ্রাম্যমাণ দলের অধস্তন একটি শাখা গোত্ৰ।

সর্বপ্রথম বৈদিক আর্যদের পদস্পর্শ ঘটেছিল উপ-মহাদেশের কোথায় সে স্থানটির সঠিক চিহ্নিত করা না গেলেও আগমনের পর তারা যে সরস্বতী-দৃশ্যদ্বতী নদীদ্বয়ের মধ্যবর্তী যা বর্তমান পূর্ব পাঞ্জাবের আম্বালা ও কর্ণাল জেলায় অবস্থিত, যে ভূমি সুজলা সুফলা চারণভূমি অবলম্বন করে নিজেদের স্থায়ী উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল সে সম্পর্কে সকল তাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকই পূৰ্ণ একমত।

বৈদিক আর্যগণ উপমহাদেশে আগমনের সুনিশ্চিত কাল নির্ণয় নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে ঐতিহাসিক ও তত্ত্ববিদগণ সবাই একমত যে, তাদের উপমহাদেশে আগমন খ্রিষ্ট-পূর্ব ১৫০০ অব্দের পূর্বে নয়, বরং এর অব্যবহিত পরেও হতে পারে।

সেমিট জাতীয় নবী মুসার জীবনকাল খ্রিষ্ট-পূর্ব ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দে। নবী মুসা কর্তৃক ইসরাইলীদিগকে মিশর থেকে উদ্ধার করে ফিলিস্তিনে নিয়ে আসার সময় হতে ইহুদীদের নবী দাউদের জীবনকাল খ্রিষ্ট পূর্ব ১০০০ খ্রিষ্টাব্দে পর্যন্ত সময়ের মধ্যে। গ্রিসের মহাকবি হোমারের জন্মের বা জীবনকাল খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০-৮৫০ অব্দের মধ্যে প্রায় অর্ধশতাব্দী পূর্বে বৈদিক আর্যগণ উপমহাদেশে প্রবেশ করেছিল।

এ বিষয়ে অনুমান করা যায় যে অনার্য পণ্ডিত মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস যে যুগে বেদের টীকা সংযোজন ও কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কাহিনি অবলম্বনে মহাভারত কাব্য রচনায় ব্যস্ত সে যুগে সম্ভবত হোমারের ট্রয় যুদ্ধ সম্বলিত কাহিনি কাব্য ইলিয়াড ও ওডিসী গ্রিক নাগরিকদের মুখে মুখে গীত হচ্ছিল। আবার কেউ বলছেন মহাভারত হোমারের ইলিয়ড ওডিসির কাহিনির জনশ্রুতির আদলে রচিত।

ইরান হতে আগমনের সময় বৈদিক আর্যগণই সর্বপ্রথম উপমহাদেশে নিয়ে আসে মানবীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির যুগোত্তর রূপ-কল্প। এবং সাথে সাথে আমদানি করে ইন্দো-ইউরোপীয় ও ইরানি ভাষার সঞ্জীবনী শক্তি। বলতে গেলে, বৈদিক আর্য বা ইরানিদের আগমনের পর হতেই উপ-মহাদেশের প্রাগৈতিহাসিক যুগের আদিম অন্ধকার মুছে গিয়ে আস্তে আস্তে ইতিহাসের আলোকে উদ্ভাসিত হতে থাকে এখানকার উপমহাদেশের তথা ভারতের মানুষ ও জাতির প্রকৃত মানবিক জীবন চেতনা।

বৈদিক আর্য তথা ইরানিদের দ্বারাই উপমহাদেশে আমদানি হয়েছে ইরানসহ সমগ্র পশ্চিম মধ্য এশিয়া এবং ইউরোপের ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সমসাময়িক কালের সভ্যতা-সংস্কৃতির ধারা—সেখানকার জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পকলা, কৃষি প্রকল্প, নীতিশাস্ত্র, ধর্ম-দর্শন, ভাষা-সাহিত্য ও লিপিবদ্ধ ইত্যাদি— এক কথায় জীবন- সংগ্রাম ও জীবন-দর্শনের মৌল উপাদান ও উৎস।

আদিম ও মধ্য যুগের জীবন চেতনার কালজয়ী প্রবাহ। এ প্রবাহে ভেসে গেল অতীতের আদিম প্রকৃতির ভারতীয় জীবন ব্যবস্থা। শুরু হল উপ-মহাদেশীয় সভ্যতার নতুন এক যুগপ্ররিক্রমা, নতুন ভাবকল্প— বৈদিক যুগ।

বৈদিক আর্যগণ ছিল নিষ্ঠাবান ও ধার্মিক। দেহ গঠনের দিক দিয়েও ছিল সুশ্রী, স্বাস্থ্যবান ও বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী এবং সুগঠিত লৌহাস্ত্র ব্যবহারের বীর বিক্রমশালী জাতি। তাদের তুলনায় তখনকার উপমহাদেশীয় বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর লোকেরা সর্বদিক দিয়েই ছিল আদিম ও পিছু পরা।

এশিয়া হিত্তাইত ও হুররিয়ানগণ এবং ভূমধ্য সাগর উপকূলের ফিনিসীয়গণ লৌহের ব্যবহার শুরু করেছিল বৈদিক আর্যদের উপমহাদেশে আসার পূর্বেই, মহাভারতেও লৌহের বহুল ব্যবহারের উল্লেখ দেখা যায়। তবে বিশ্বাস করতে বাধা নেই যে, উপমহাদেশে আগমনের পূর্বেই এইসব জাতি গোষ্ঠীর লোকের সাথে তাদের যোগাযোগ ছিল সে সূত্রে তারা প্রাথমিকভাবে শিখেছিল লৌহাস্ত্রর ব্যবহার এবং উপমাহদেশে তারাই সর্বপ্রথম আমদানি করেছিল লৌহাস্ত্র।

নানা প্রকার শিল্পকর্মে ছিল সুদক্ষ বৈদেতিক আর্যগণ বস্ত্র বয়ন করতে জানত এবং তারা পোশাক রূপে ব্যবহার করত সাধারণ পশমী কিংবা সুতী বস্ত্র। তাছাড়া তাদের মধ্যে মৃগচর্ম, অজগরচর্ম, ব্যাঘ্রচর্ম ও সিংহ চর্মের ব্যবহারও প্রচলিত ছিল। যুদ্ধে তারা হস্তী ও রথ ব্যবহার করত। কৃষিকর্ম ও পশুপালন ছিল তাদের প্রধান উপজীবিকা।

বৈদিক যুগে আর্য সমাজে দুধের ব্যবহার ছিল প্রচুর। তবে শাক-সবজিও ব্যবহৃত হত। উৎসব অনুষ্ঠানে প্রচুর মাংস পরিবেশিত হত। প্রচুর গরুর মাংস খেত। অতিথি আপ্যায়নের জন্য গরু হত্যা বা জবাই ছিল এক প্রকার সামাজিক প্রথা যে কারণে সংস্কৃত ভাষায় অতিথিকে বলা হত ‘গোয়ো’।

সোমরস নামক এক প্রকার সুরা পান করত বৈদিক আর্যগণ পরবর্তীকালে শাস্ত্রকারগণ গো মাংস ভক্ষণ ও সুরা পান নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তখনকার সময় তাদের মধ্যে অন্য বর্ণের মাঝে বিয়ে করা নিষিদ্ধ ছিল না। মহাভারতে বর্ণিত চন্দ্র বংশীয় রাজা শান্তনু দাসরাজ কন্যা সত্যবতীকে বিয়ে করেছিলেন। সত্যবতীর গর্ভজাত সন্তান বিচিত্রবীর্য।

তাঁর দুই পুত্র ধৃত রাষ্ট্র ও পাণ্ডু যাদের কাহিনি নিয়ে মহাভারত রচিত। তারা সকলেই ছোঁয়া খাদ্য ভক্ষণ করতে পারত। তখনকার সময় কাল হতে আর্য সমাজের সতীদাহ বা মহামরণ প্রথা ধর্মীয় অলংঘনীয় আদর্শ রূপে প্রচলিত ছিল। মুঘল সম্রাট আকবর (১৫৫৬-১৬০৬) সর্ব প্রথম বৈদিক সমাজের এ অমানবিক প্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন, কিন্তু গোঁড়া ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের বিরোধিতার কারণে তিনি সে ঘোষণা বা আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন। অবশেষে ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দে লর্ড বেন্টিং রাজা রামমোহন রায়ের সহায়তায় আইন প্রয়োগ করে এ জঘন্য অমানবিক প্রথার বিলুপ্তি ঘটান।

যখন উপ-মহাদেশে তথা ভারতবর্ষে বৈদিক আর্যদের উপনিবেশ স্থাপন হয় সে সময়কালে সিন্ধু সভ্যতার জন্মদাতা যদুবংশ ছিল সেখানকার শক্তিশালী নাগরিক। সিন্ধু সভ্যতার শক্তিশালী যদুবংশের সাথেই সর্বপ্রথম বৈদিক আর্যদের সংঘাতের সূত্রপাত হয় পশু চারণ ভূমির অধিকার নিয়ে। তখন বৈদিক আর্যগণ যদুবংশের নিয়ন্ত্রিত ফল-ফসল উপযোগী কৃষিভূমি চারণ ভূমিতে বলপূর্বক অনধিকার প্রবেশ করে। তাছাড়া যদুবংশের আধিপত্যে বৈদিক আর্যদের দখলদারিত্ব সহ্য করতে পারেনি সিন্ধু সভ্যতার জন্মদাতা যদুবংশ। যে কারণে দিন দিন উভয় দলের মধ্যে অসন্তোষ ও বিরোধ তীব্র হতে তীব্রতর হয়ে উঠতে থাকে এবং অবশেষে পরিণত হয় ঘোরতর মহাযুদ্ধে।

এ যুদ্ধেই বৈদিক আর্যদের দ্বারা সিন্ধু সভ্যতার মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা বিধ্বংস হয়েছিল বলে তত্ত্ববিদদের ধারণা। এর প্রমাণ হল : প্রত্নবিদগণ মহেঞ্জোদারোতে প্রাপ্ত কংকাল-করোটি পরীক্ষা করে জানিয়েছেন যে, একটি ইমারতের ভগ্ন প্রকোষ্ঠের মধ্যে পাওয়া গেছে কতকগুলো শিশু ও বয়স্ক নর-নারীর স্তূপীকৃত কংকাল-করোটি। তাঁরা গভীরভাবে লক্ষ্য করে দেখলেন যে, কোন কোন কংকাল-করোটিতে রয়েছে তীক্ষ্ণধার ভারী অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন- সম্ভবত যুদ্ধ কুঠারের আঘাত।

তাছাড়া আরও অসংখ্য কংকাল-করোটি পাওয়া গেছে প্রকার বেষ্টিত শহরের বিভিন্ন রাস্তায়, প্রাঙ্গণে ও চত্বরে। সেই কংকাল-করোটিগুলোতেই নৃতত্ত্ববিদরা গবেষণা করে দেখেছেন তীক্ষ্ণাগ্র হাতিয়ারের আঘাতের দাগ। এ সব গবেষণার ফলাফলে নৃতত্ত্ববিদরা অনুমান করেছেন যে, অত মানুষ এক সঙ্গে মহামারী, ভূমিকম্প কিংবা সিন্ধু নদের বন্যার মত কোন নৈসর্গিক দুর্ঘটনায় নিশ্চয় মারা যেতে পারেনা। নিহত হয়েছে কোন শক্তিশালী আক্রমণকারীদের তীক্ষ্ণধার অস্ত্রের মুখে। আক্রমণকারীরা ছিল বৈদিক আর্য। কেননা ওই সময় উপমহাদেশে একমাত্র তারাই তীক্ষ্ণধার লৌহাস্ত্রের ব্যবহার জানত এবং শত্রুর বিরুদ্ধে ও শিকারে ব্যবহার করত। তাই অনেকেরই ধারণা মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা নগর বিধ্বস হয়েছে বৈদিক আর্যদের মারণাস্ত্রে বিধ্বস্ত হয়ে।

সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসপ্রাপ্ত বৈদিক আর্য ও যদু বংশের যুদ্ধে পরাজিত যদু বংশীয় শহরবাসী কোল-মুণ্ডা ইত্যাদি অস্ট্রো-এশিয়াটিক ও দ্রাবিড় মানব গোষ্ঠীর মধ্যে। মৃতর সিন্ধু শহর অমনি পড়ে রয়েছিল জনশূন্য হয়ে। যে যুদ্ধে নিহত হয়েছিল প্রায় বিশহাজার মানুষ। তবে পতিত সিন্ধু সভ্যতার সে শহরে কত মানুষ ছিল তা সঠিকভাবে জানা যায়নি।

পরে বিপর্যয়ী আর্যগণও শহর হতে মৃতআবর্জনা পরিষ্কার করে পুনরায় বাসপোযোগী করার প্রয়োজন বোধ করেনি। কারণ বৈদিক আর্যগণ শহর বাসে অভ্যস্ত ছিল না। তারা বাস করত তাঁবুতে ও তপোবনে। তাই তারা শহর বসবাস না করে প্রসারিত হয়ে পড়েছিল মাঠে ময়দানে, তৃণভূমিতে ও বিভিন্ন নদীর অববাহিকা অঞ্চলে। এ জন্যই সে যুগের বৈদিক ঋষিদের বহু বাণীতে নদ-নদী ও ফল-ফসলের দেবতার প্রশস্তি দেখা যায় বিপুল পরিমাণে।

সিন্ধু সভ্যতার মহেঞ্জোদারো পরাজিত ও বিধ্বস্ত হওয়ার পর বৈদিক আর্যরা উপমহাদেশের বিভিন্ন বসতি করতে গেলে আর্যদের বিরুদ্ধে স্থানীয় লোকদের অবিরাম চলছিল স্বার্থের সংঘাত ও প্রতিরোধ। তাদের সে সব সংঘর্ষের ঘটনা গল্পকারে বর্ণিত হয়েছে সেকালের বিভিন্ন পুরা কাহিনিতে। সম্ভবত সে সময় মহেঞ্জোদারো হরপ্পার অধিবাসীগণ তাদের সাথে একযোগে বৈদিকদের বিরোধিতা করে যাচ্ছিল এবং প্রস্তুতি নিচ্ছিল অতীতের প্রতিশোধ গ্রহণের।

তখনকার সময় বৈদিকদের প্রধান গুরু তাদের একনায়কের নাম ছিল ত্রিতসুর। ত্রিতসুর পরবর্তী নায়কের নাম দেবদাস। দেবদাসের পুত্র বা পৌত্রের নাম ছিল সুধা।

প্রাচীন স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে বৈদিকদের দ্বন্দ্ব প্রতিদ্বন্দ্বিতা দিন দিন তীব্র হতে তীব্রতর হয়ে অবশেষে আরো মহাযুদ্ধের আকার ধারণ করে।

এ যুদ্ধে পরাজিত ও বেঁচে যাওয়া ভারতের বা উপমহাদেশের স্থানীয় প্রাচীন অধিবাসীরা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে— কেউ থেকে যায় মূল গোত্রের সাথে, কেউ চলে যায় বৈদিকদের দলে। এভাবে আর্য-অনার্যের মিলন-পথ প্রাথমিকভাবে কিছুটা সুগম হলেও এ যুদ্ধোবস্থা ক্রমাগত পূর্বদিকে বিস্তৃত হতে থাকে। তখন বৈদিক নায়ক সুধা বিশ্বামিত্র নামক জনৈক পুরোহিতের পরিচালনাধীনে অনার্য নায়ক অম্বরকে যমুনা তীরে পরাজিত করেন। পরাজিত অনার্যদের নেতৃস্থানীয় গোত্রপতিগণ স্বীয় দলবলসহ কেউ আশ্রয় গ্রহণ করেন বিহার ও বঙ্গাঞ্চলে, কেউ চলে যান দাক্ষিণাত্যে ও মধ্য ভারতের নাগপুর অঞ্চলে আর কেউ গিয়ে বসতি স্থাপন করেন হিমালয়ের পাদদেশস্থ অরণ্য অঞ্চলে। এরাই ছিলেন তৎকালীন উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের গোত্র কেন্দ্রিক সুসভ্য ও সংস্কৃতিবান প্রাচীন স্থানীয় অনার্য সমাজ।

ইতিহাসের আলোকে দেখা যায়, বর্তমানকালের ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, বার্মা, নেপালসহ সবদেশ একিভূত ছিল। এই অখণ্ড জনপদে জন্মেছেন গৌতম বুদ্ধ, মহাবীর, শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীরামচন্দ্র, সাধক কবীর, গুরু নানক, শ্রীচৈতন্য- আরো অনেক আধ্যাত্মিক ধর্মীয় মহাপুরুষ। এমন কী পৃথিবীর প্রথম মানব আদমেরও পদচারণা ছিল এই জনপদে! অধিকাংশ ধর্মবিশ্বাসীরা মানেন আদম এবং তাঁর সহধর্মিণী হাওয়া প্রথম মানব মানবী। (অবশ্য নৃবিজ্ঞানে উদ্ভাবিত হয়েছে ভিন্ন তথ্য)। তবে কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা ও কিংবদন্তিমিশ্রিত তথ্যে দেখা যায়, এই আদম হাওয়ার ভারতীয় সংযোগ সভ্যতার আদি পর্বেই সূচিত হয়। প্রাচীন সিংহল তথা আধুনিক শ্রীলঙ্কার একটি পর্বতশৃঙ্গের নাম ‘আদম’স পিক’ (Adam’s Peak)। কথিত আছে যে বাবা আদমকে বেহেশত থেকে এই পর্বত-চূড়ায় নিক্ষেপ করা হয়েছিল, তাই চূড়ার নাম ‘আদমস পিক’। শৃঙ্গটির উচ্চতা ৭৫০০ ফুট। মুসলিম ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী এই স্থানটি অতিব পবিত্র। এখানে আদমের প্রথম পদচিহ্ন এখনও বিদ্যমান। স্মরণাতীতকাল থেকেই তাই মুসলিম সাধুসন্তরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে এই স্থানটি দেখতে আসেন। মরক্কো, ইরান, সিরিয়া, মিশর, সৌদিআরব, ইয়েমেন ইত্যাদি দেশ হতে আগত বহু তীর্থযাত্রীর সমাধি রয়েছে এখানে। কথিত আছে যে, বাবা আদম শ্রীলঙ্কা ও ভারতের মধ্যবর্তী সঙ্কীর্ণ প্রণালীর (পক প্রণালী) উপর একটি সেতু নির্মাণ করে ভারতে আসেন ও পরে মক্কায় যান। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে- ভারত ও শ্রীলঙ্কার মধ্যবর্তী ১৯ থেকে ৩০ মাইল দৈর্ঘ্য যে সঙ্কীর্ণ সমুদ্রটুকু রয়েছে তা এতই অগভীর যে মাঝে মাঝে এর গভীরতা মাত্র ৩ ফিট! তলদেশে লাইমস্টোন ও পাথরের চাই, মনে হয় যেন কোন পৌরাণিক সেতুর ব্রিজের ধ্বংসাবশেষ কালপ্রবাহে সমুদ্রে তলিয়ে গেছে। ১৮০৪ খ্রিষ্টাব্দের ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদরা এই তথাকথিত সেতু সার্ভে করে এবং নাম দেয় আদমের সেতু (Adam’s Bridge)। হিন্দুরা একে রামের সেতু বলে অভিহিত করে থাকে। তাদের মতে সীতা উদ্ধারের জন্যে রাজা নল ও হনুমানের সহায়তায় ভগবান রাম এই সেতুটি নির্মাণ করেন এবং রাবণ বধ করে সীতাকে উদ্ধার করেন।

এটি আসলেই কোন মানবনির্মিত সেতু নাকি প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা কোন প্রবাল প্রাচীর তা নিয়ে প্রত্নতত্ত্ববিদদের মধ্যেও রয়েছে মতভেদ। একদল পণ্ডিত মনে করেন, এটি কৃত্রিম উপায়ে তৈরি (যেমন ভারতের ভূতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগের প্রাক্তন প্রধান এস. বদ্রি নারায়ণ) এবং এর বয়স হাজার কয়েক বছর মাত্র। অন্যদল মনে করেন এটি প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা প্রবাল প্রাচীর যার বয়স কমপক্ষে সতের মিলিয়ন বছর। তা সেতুটি যেভাবেই গড়ে উঠুক- তাতে করে কিন্তু এর উপর দিয়ে সঙ্কীর্ণ সমুদ্রপথটুকু পার হওয়ার সম্ভাব্যতা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় না। আদম তাঁর স্ত্রী হাওয়ার সন্ধানে মূল ভূমিতে পদার্পণ করতে এই পথ ব্যবহার করেছেন নাকি রাম তাঁর স্ত্রী সীতা উদ্ধারের জন্য এই পথ ব্যবহার করে মূল ভূমি থেকে লঙ্কায় গিয়েছেন- তা নিয়ে দুই সম্প্রদায়ের মৌলবাদীদের বিতর্ক আজ সভ্যতাবিধ্বংসী থেকে মানববিধ্বংসীরূপে ক্রমশ উগ্র হচ্ছে। অথচ দেখা যাচ্ছে ইসলামি ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রথম নবী আদমের বিচরণক্ষেত্র যে ভারতবর্ষ— আরবদেশের লোকেরা তা মেনে নিয়েছে এবং আদম ও তাঁর পরবর্তী কয়েক পুরুষ যে ‘মূলকে হিন্দ’ বা হিন্দুস্তানে বিকশিত হয়েছিল, এ বিষয়ে তাদের মধ্যে কোন মতভেদ নেই। আদম যেহেতু সর্বপ্রথম মানুষ, সুতরাং ধরে নেয়া যায় যে মানব সভ্যতা তথা মানব-বসতির গোড়াপত্তন হয়েছিল ভারতবর্ষে- আরবদেশে নয়। তা’হলে ভারতবর্ষের মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে বিষয়টি প্রচার পায়নি কেন? ইসলামের প্রথম উন্মেষক্ষেত্র ভারতবর্ষকে পৌত্তলিকদের আবাসভূমি বলে ভারতীয় মুসলমানদের অবজ্ঞা করে থাকে কোন্ যুক্তিতে?

নির্বাচিত গ্রন্থপঞ্জি

Henry Thomas Buckle, Introduction to the History of Civilisation in England; New Edition by J.M. Robertson, 1928

Syeed Hossein Nasr, Introduction to Islam; New York, 1975

Yusuf a Qaradawi, Science and Civilization in Islam; Lahore, 1968

E.I. The Encyclopaedia of Islam; Leiden, 1979

Muhammad Hamidullah, Introduction to Islam, New Delhi, 1992

অশোক মিত্র, ইওরোপের ভাস্কর্য; আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা ১৯৯২

মোহাম্মদ আবদুল হাই, নির্বাচিত প্রবন্ধ; সূচীপত্র, ঢাকা, ২০০৫

ড. আলি নওয়াজ, খনার বচন কৃষি ও কৃষ্টি; আফসার ব্রাদার্স, ঢাকা, ২০০৮

ড. সৈয়দ মাহ্মুদুল হাসান, বিশ্বের সেরা মুসলিম স্থাপত্যকীর্তি; শোভা প্রকাশ, ঢাকা, ২০০৮

খন্দকার মাহ্মুদুল হাসান, মানব সভ্যতার ইতিকথা; শোভা প্রকাশ, ঢাকা, ২০০৮

খন্দকার মাহ্মুদুল হাসান, বিশ্বের সেরা পুরাকীর্তি; শোভা প্রকাশ, ঢাকা, ২০০৮

সুব্রত বড়ুয়া, বাঙালির ইতিহাস; অনন্যা, ঢাকা, ২০১০

মঞ্জুরুল আলম খান, সভ্যতার ইতিহাস; অনন্যা, ঢাকা, ২০১১

ব্যারিস্টার মোহাম্মদ রওশন আলী, প্রাচীন বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতি; জ্যোতিপ্রকাশ, ঢাকা, ২০১২

রেবতী বর্মণ, সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশ; জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০১২

মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, সভ্যতার সংকট ও রবীন্দ্রনাথ; অনন্যা, ঢাকা, ২০১২

 মোতাহের হোসেন চৌধুরী, সংস্কৃতি কথা (দ্বি.সং.); আহমদ পাবলিশিং হাউস, ঢাকা ২০১৪

চার্লস অ্যালেন, গড় টেরোরিস্ট : ওয়াহাবি ধর্মীয় মতবাদ এবং আধুনিক জিহাদের গুপ্ত মূলপথ (রূপান্তর : সরকার আলী মনজুর); রোদেলা প্রকাশনী, প্রফেসর মতিয়র রহমান, সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশ; মুক্তচিন্তা, ঢাকা, ২০১৭

মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, মঙ্গলকাব্যে বাঙালির আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের রূপায়ণ; শোভা প্রকাশ, ঢাকা, ২০১৮

প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য, মহাভারতে নারী; জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০১৯

স্যামুয়েল পি হান্টিংটন, দ্য ক্লাশ অব সিভিলাইজেশন (The Clash of Civilization) (অনুবাদ : রিজুওয়ানুল হক) সন্দেশ, ঢাকা, ২০১৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *