১৭. বাঙালির সাংস্কৃতিক বোধে ধর্মচেতনা

সপ্তদশ অধ্যায় – বাঙালির সাংস্কৃতিক বোধে ধর্মচেতনা (Religious Consciousness in Cultural Views of Bangalis)

ধর্মের সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক

মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতী সমাঃ।
যৎ ক্রৌঞ্চ মিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্।।

ধ্রুপদী সংস্কৃত সাহিত্যে কথিত আছে, তমসা নদীর তীরে ক্রৌঞ্চ-ক্রৌঞ্চীর মিথুনক্রিয়ায় ব্যাঘাত সৃষ্টিকারী শিকারি ব্যাধের উদ্দেশে বাল্মীকি মুনির মুখে আকস্মিক উচ্চারিত এই অভিশাপবাণীই আদিকবিতা এবং বাল্মীকি আদিকবি (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : ভাষা ও ছন্দ)। শোক থেকে উচ্চারিত হয়েছিল বলে এর নাম হয়েছে শ্লোক। এই শ্লোক থেকেই পরবর্তীকালে কবিতার উৎপত্তি। বেদনাবিদ্ধ হৃদয়ই হল কবিতার জন্মভূমি। বেদনাবোধের অনুভূতি ছাড়া কবিতা সৃষ্টি হয় না। হতাশা-দুরাশা-ব্যর্থতা-বেদনার পারিপার্শ্বিকতা প্রকাশের মধ্য দিয়েই কাব্যপ্রতিভার উন্মেষ ঘটে। তবে ছন্দই কবিতার মূল প্রাণ। ছন্দোবদ্ধ পদকেই বলা হয় কবিতা। ছন্দই কবিতাকে তার স্বরূপগত বৈশিষ্ট্যে উন্নীত হতে সাহায্য করে।

পৃথিবীর তাবৎ সাহিত্যের ইতিহাসও তাই। ব্যাবিলনীয় ভাষায় খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ অব্দে রচিত পৃথিবীর প্রাচীনতম মহাকাব্য গিলগামেশ (Gilgamesh) থেকে শুরু করে আধুনিককালের কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) রচিত মেঘনাদবধ (১৮৬১) মহাকাব্য যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বাংলা কবিতার এই দীর্ঘ যাত্রাপথের ইতিহাসে নীতিমূলক কবিতা একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। চর্যাপদ থেকে শুরু করে ডাক, খনার বচন, লোক প্রবাদ প্রভৃতি পরিশীলিত রূপ নিয়ে এর শাশ্বত বাণী আজও আধুনিক কাব্যে কবিতায় স্থান পাচ্ছে। এই স্রোতধারায় সংস্কৃত সাহিত্য থেকেও প্রচুর উপাদান এসে মিশেছে বাংলা নীতি কবিতায়। নীতিশাস্ত্র তথা সুভাষিতসংগ্রহের সংখ্যা সংস্কৃত সাহিত্যেই সর্বাধিক। এর মধ্যে ভর্তৃহরির নীতিশতক, সদানন্দের নীতিমালা, শম্ভুরাজের নীতিমঞ্জরী, ঘটকর্পরের নীতিসার, স্বামী দয়ানন্দের নীতিচন্দ্রিকা সোমদেবসূরির নীতিবাক্যামৃত, ব্রজরাজ শুক্লের নীতিবিলাস, কামন্দকীয় নীতিসার, বররুচির নামে প্রচলিত নীতিরত্ন, বেতাল ভট্টের নামে প্রচলিত নীতিপ্রদীপ এবং চাণক্য পণ্ডিত রচিত চাণক্য শ্লোক সংস্কৃত সাহিত্যের সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। সংস্কৃত ভাষায় রচিত চাণক্য শ্লোকের বহু পক্তির বাংলা রূপান্তর আধুনিক নীতিকাব্যে ব্যবহৃত হচ্ছে। মানুষের সর্বমানবিকবোধে বিকশিত এসব নীতিশাস্ত্রে উল্লিখিত বচন-বাণী প্রকৃতপক্ষে ধর্মচেতনারই প্রচ্ছন্ন প্ৰকাশ।

মধ্যযুগে মুসলমানদের বাংলা সাহিত্য সাধনার প্রধানত দুটি পৃথক ধারা ছিল— রোমান্টিক রচনা ও ধর্মভিত্তিক রচনা। দ্বিতীয়টিতে ধর্মাচরণ, ব্যবহার শাস্ত্র, শরাহ – শরীয়ৎ প্রভৃতি বিষয়ে নিগূঢ় তত্ত্ব ও তথ্য ছন্দোবদ্ধ ভাষায় বর্ণিত হয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে একই ব্যক্তি রোমান্টিক রচনায় যেমন পারদর্শিতা দেখিয়েছেন তেমনি অন্য শ্রেণির রচনায়ও কম কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন নি। এর ব্যতিক্রমও যে নেই তা নয়। তবে মধ্যযুগের হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের লেখকদের অধিকাংশেরই কাব্যসাধনার মূল উপাদান সংগৃহীত হয়েছে স্ব স্ব সম্প্রদায়ের ধর্মগ্রন্থ থেকে। ফলে সে সময়কার লেখকদের লেখায় নীতিবোধ ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার দৃষ্টান্ত প্রায় সর্বত্রই বিদ্যমান। নিম্নে উদ্ধৃত কবিতা দুটি লক্ষ্য করুন :

একত্ব
বল তুমি বল ওহে খোদা একজন—
নহে কারও মুখাপেক্ষী, খোদা সে এমন।।
জন্মলাভ কারও হতে করেনি কখন।
তার সম নহে কোন জন।।
(সুরা এখলাস অবলম্বনে)

ওজন
ওজনের বেলা করিও না হেলা
মাপকাঠি তব রাখিও সমান
ঝুল রাখি ঠিক মাপিও সঠিক,
দিওনা’ক কমি তিল পরিমাণ।
(সূরা আর-রহমান অবলম্বনে)

কৃপণ
দো’য়ার বেলায় দু’হাত বাড়ায়
খোদায় দরগায় কাতরে!
দানের বেলায় সে হাত লুকায়
দুই বগলের ভিতরে।।
(হাদীস অবলম্বনে)

পথ নির্দেশ
যদি দেখি অন্ধ আর সম্মুখেতে কূপ
হব আমি মহাপাপী যদি থাকি চুপ।
(হাদীস অবলম্বনে)

বংশগৌরব
নহে আশরাফ যার আছে শুধু বংশের পরিচয়,
সেই আশরাফ জীবন যাহার পুণ্য কর্মময়।
(হাদীস অবলম্বনে)

ধর্মের সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক উভয়েরই শুরু থেকে। গ্রিক নাটকের উৎপত্তি ধর্ম থেকে। হোমার ও ভার্জিলের মহাকাব্যে ধর্মবিশ্বাস তৎকালীন গ্রিক ও রোমানদের ধর্মবিশ্বাসেরই প্রতিচ্ছবি। ইংরেজি নাটকের উৎপত্তিও খ্রিষ্টধর্মীয় ঐতিহ্য থেকে। ইরানের জাতীয় কবি ফেরদৌসীর শাহনামা, ভারতীয় মহাকাব্য রামায়ণ- মহাভারত– এসব কালোত্তীর্ণ রচনা সবগুলিই ধর্মদেশনা থেকে উদ্ভূত। বিশ্বের তাবৎ ধ্রুপদি সাহিত্যের পশ্চাতে রয়েছে এই ধর্মীয় প্রভাব। হাডসনের An Introduction to the Study of Literature গ্রন্থে রয়েছে এর বিশদ বিবরণ। সফোক্লিসের কিং ইডিপাস নাটকে যে-ধর্মীয় চেতনা উপস্থাপিত হয়েছে তা এখনো বিশ্বসমাজে এক শিহরিত বিষয়! নিকট সম্পর্কীয়র সঙ্গে (মাতা-পুত্রে) অবসম্ভাবী এবং অপ্রতিরোধ্য যৌনসম্পর্কের ধর্মীয় ভবিষ্যদ্বাণীর এই ইতিবৃত্ত এখনো বিশ্বসাহিত্য তথা সমাজবিজ্ঞানের এক আদিম মানবীয় চেতনার অভিজ্ঞান! বিশ্বসাহিত্যের অধিকাংশ শ্রেষ্ঠ রচনা নিয়তি-নির্ভর। Sophocles (459-4০5 B.C.)-এর King Oedipus তাঁর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ইডিপাসের জন্মের পর (কোন কোন বর্ণনা মতে তার জন্মের আগে) এপোলো দেবতার পক্ষ থেকে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয় যে, ইডিপাস বড় হয়ে তার পিতাকে হত্যা করবে এবং তার মাতাকে বিয়ে করবে। তার পিতামাতা (রাজা লুইস ও রানী জোকাস্টা) এই ভয়ঙ্কর ঘটনা এড়ানোর জন্য শিশু ইডিপাসকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার জীবন রক্ষা পায়। পাশ্ববর্তী রাজ্যের নিঃসন্তান রাজা-রানী তাকে আপন পুত্রস্নেহে লালন-পালন করেন। বড় হয়ে ইডিপাস সে ভবিষ্যদ্বাণীর কথা জানতে পেরে সেখান থেকে পালিয়ে থিবিস ( Thebes)-এ চলে আসে এবং ঘটনাক্রমে নিজের অজান্তে তার পিতাকে হত্যা করে এবং মাতাকে বিয়ে করে। সে অপরাধ এড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছে, কিন্তু এড়াতে পারেনি। সে নিয়তির অসহায় শিকার। আমরা একই নিষ্ঠুর নিয়তি দেখি, ইরানের জাতীয় মহাকাব্য শাহনামায় ফেরদৌসী বর্ণিত যুদ্ধক্ষেত্রে বীরযোদ্ধা পিতা রুস্তমের হাতেই আপন বীরপুত্র সোহরাবের নিয়তি-নির্ধারিত মৃত্যু। পিতা-পুত্রের পরিচয় উন্মোচিত হয় পিতা কর্তৃক পুত্রের বক্ষে বিদীর্ণ তলোয়ারের আড়ালে উঁকি দেয়া স্নেহময়ী মাতা তহমীনা কর্তৃক পুত্ৰ-হাতে বেঁধে দেয়া রক্ষাকবচ দেখে। যা আগেই মাতা তহমীনা কর্তৃক পিতা রুস্তমকে জ্ঞাত করা হয়েছিল, কিন্তু সেই রক্ষাকবচ পুত্র সোহরাবকে রক্ষা করতে পারে নি। একই ঘটনা দেখতে পাই উমাইয়া বংশের প্রথম খলিফা মু’আবিয়ার জীবনে। ভবিষ্যদ্বাণী ছিল যে, তাঁর ঔরসজাত সন্তানের হাতেই নিহত হবেন মহানবীর বংশধর। সে সময়ে মহানবীর সঙ্গে সুসম্পর্কের আতিশয্যে মু’আবিয়া এই সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন যে, তিনি আর বিয়েই করবেন না। কিন্তু এক পর্যায়ে মু’আবিয়া কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসকের পরামর্শে বৃদ্ধ বয়সে বিয়ে করতে বাধ্য হন। অতপর মু’আবিয়ার ঔরসেই জন্ম নেয় ইয়াজিদ। ইতিহাসে আমরা দেখি, ৬৭৯ খ্রিষ্টাব্দে কারবালায় সংঘঠিত সেই নিষ্ঠুর ঘটনা! নীতি-ন্যায্যতা তথা সত্যপ্রতিষ্ঠার স্বার্থে ইয়াজিদের কাছে বশ্যতা স্বীকারে অনমনীয় নবীদৌহিত্র ইমাম হোসেন (রা)-এর সপরিবারে কারবালায় (১০ই মহররম) নির্মম মৃত্যু। কারবালার এই বিষাদময় ঐতিহাসিক কাহিনীকে উপজীব্য করে মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১২) সৃষ্টি করেন তাঁর বহুল আলোচিত বিষাদ-সিন্ধু উপন্যাস। বিষাদ-সিন্ধুতে দেখানো হয়েছে, এজিদ কর্তৃক হোসেনের নিহত হওয়ার নিয়তি এড়ানোর জন্য এজিদের পিতামাতা তাকে শিশুকালে মেরে ফেলার কথা ভেবেছিলেন, কিন্তু এজিদের মুখ দেখে তারা সেটা করতে পারেননি। এ ধরনের নিয়তি নির্ভর অপ্রতিরোধ্য ঘটনা আমরা মহাভারতেও দেখি। মথুরার অত্যাচারী রাজা কংস নিজ জীবন-হন্তারক আপন ভগ্নী দেবকী-পুত্র কৃষ্ণ-বিনাশী চেষ্টা ও শত সতর্কতার মধ্যেও শুনতে হয় সেই দৈববাণী— ‘তোমারে বধিবে যে, গোকূলে বাড়িছে সে।’ বাংলা সাহিত্যেও এই গোকূল বৃদ্ধির ইতিবৃত্ত বাঙালির ধর্মচেতনায় সম্পৃক্ত হয়ে আছে!

সাহিত্যে বাঙালির ধর্মচেতনা

সরহপা রচিত দোহাকোষ-চর্যাগীতির প্রথম বারোটি দোহায় তাঁর সময়কালের ধার্মিক সম্প্রদায়ের ধর্মচিন্তায় সে-অসারতা প্রতিফলিত হয়েছে, বিভিন্ন বিচারে তা খণ্ডন করে তিনি বলেছেন—

যদি নগ্ন হলেই মুক্তি আসে তাহলে কুকুর এবং শৃগালই তো যথার্থ মুক্ত। ময়ূরের পাখা গ্রহণ করলেই যদি মোক্ষ আসে তাহলে ময়ূর এবং চমরই তো মোক্ষ লাভের অধিকারী। শিলা চুম্বন করলেই যদি জ্ঞান লাভ হয় তাহলে তো করী এবং তুরঙ্গ সর্বতোভাবে জ্ঞানী

সরহপার নিজের ভাষায় :

জই ণ গ গাবিঅ হোই মুক্তি,
তা সুণই সি অলেহ।
লোমুপাড় থেঁ অস্থি সিদ্ধি,
তা জুবই শি অম্মহ।
পিচ্ছী গহণে দিউ মোক্ষ
তা মোরহ চমরহ।।

সরহপা বলেছেন যে যথার্থ সিদ্ধির জন্য প্রয়োজন সঙ্কল্প ও অসঙ্কল্পের সমন্বয়, করুণাশূন্যতা এবং শুধুই করুণার সতীর্থতা, ধ্যান ও ধ্যানহীনতার একত্রতা। তাহলেই সহজ-স্বভাবের উজ্জীবন ঘটবে। তাঁর ভাষায় :

করুণ-রহিঅ জেজা সুন্নহিঁ লগগা।
ণউ সো পাবই উত্তিম মগগা।।
সহবা করুণা কেবল সাহ।
সো জন্মস্তরেঁ মোম খ ণ-পাবঅ।।
জুই পুন বেন্নধি জোড়ণ সাক্কঅ।
ণ-উ ভব ণউ নি-কানে থাক্কঅ।।

সরহপা চিত্তকে সকল অস্তিত্বের বীজস্বরূপ গণনা করেছেন, ভব নির্মাণ চিত্ত থেকেই বিস্মরিত হয়। কম মানুষকে বন্ধন করে, কর্মবিমুক্ত হলেই মন মুক্ত হয়। তিনি আরো বলেছেন, ইন্দ্রিয় যখন বিলীন হয় তখনই আত্মস্বভাব বিনষ্ট হয়। আত্মস্বভাব বিনষ্ট হলেই একজন সাধক সহজানন্দ তনুলাভ করে। যেখানে মানুষের ইচ্ছায় মৃত্যু ঘটে অথবা যখন মানুষের ইচ্ছার মৃত্যু ঘটে তখন অথবা সেখানে সে পরম মহাসুখ লাভ করে। এভাবে সরহপা বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর ধর্মতাত্ত্বিক জ্ঞানকে প্রকাশ করেছেন।

মধ্যযুগে যাদব বংশীয় রাজাদের শাসনামলের শেষ পর্বে শার্জদেব (১২১০- ১২৪৭ খ্রি.) প্রণীত সঙ্গীত-রত্নাকর, চৈতন্য পরবর্তী কবি ব্রজবুলি ভাষায় রচিত রাধাকৃষ্ণের প্রণয়-কাহিনীর অমর রচয়িতা মিথিলার কবি বিদ্যাপতি (১৩৮০- ১৪৬০খ্রি.), গীতাবলী রচয়িতা অযোধ্যার কবি তুলসী দাস (১৫৩২-১৬২৩খ্রি.) বাঙালির সাহিত্য-মানসে ধর্মীয় অনুসঙ্গ হিসেবে অঙ্গীভূত হয়ে আছে। লক্ষণ সেনের রাজ দরবারের সভাকবি গীতগোবিন্দ রচয়িতা জয়দেব গোস্বামী (১১৭০- ১২৪৫খ্রি.) প্রমুখ গীতিকবি যে-সব গীতিকাব্য রচনা করেছেন তাতেও মানবিক প্রেম অতিক্রম করে স্বর্গীয় সুধা পিয়াসে পর্যবসিত হয়েছে।

পৃথিবীর সকল চিরায়ত সাহিত্যই ধর্মাশ্রিত। বাংলা সাহিত্যও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ থেকে শুরু করে মধ্যযুগের বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, কবি ভারতচন্দ্র রায়ের অন্নদামঙ্গল, কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত, শাহ মুহম্মদ গরীবুল্লাহর জঙ্গনামা, কবি আবদুল হাকিমের নূরনামা, শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জুলেখা, আলাওলের পদ্মাবতী, হায়াত মামুদের জঙ্গনামা, আম্বিয়াকাহিনী, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আনন্দমঠ, মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদ সিন্ধু, কারবালা কাহিনী, গো-জীবন, ইসমাইল হোসেন সিরাজীর অনল প্রবাহ—এসবই সম্প্রদায় স্বাতন্ত্রে উজ্জীবিত। এঁরা সকলেই স্বধর্মের আদর্শ অনুসৃত লেখক। ফলে বাংলা সাহিত্যের দর্শন তথা জীবনাভিমুখ ও তার গতিপথ বিবর্তিত হয়েছে ধর্মীয় সামাজিক স্বাতন্ত্র্যে।

মধ্যযুগই বাংলা সাহিত্যে ধর্মাশ্রিত সাহিত্যচর্চার স্রোতবাহীকাল। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সাধারণত মধ্যযুগ বলতে বুঝায় ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরু থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত সময়কে। এই সুদীর্ঘ সময়কে কেউ কেউ আদি মধ্যযুগ এবং অন্ত্যমধ্যযুগ এরূপ দু’পর্বে বিভক্ত করেছেন। কেউ কেউ আবার রাজনৈতিক ঘটনা-প্রবাহের সাদৃশ্যে মধ্যযুগকে তুর্কী আমল, পাঠান আমল এবং মোগল আমল নামে বিভক্ত করার প্রয়াস পেয়েছেন। রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসের ঘনিষ্ঠ যোগসূত্রই এরূপ যুগ-বিভাজনের মূল ভিত্তি।

বাংলার সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস মোগল আমল বিশেষত্বের গৌরবে উজ্জ্বল! এই অধ্যায় ছিল বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের স্বর্ণযুগ। বাংলার হিন্দু-মুসলমানের ধর্ম-দর্শন, আচার-আচরণ, বিশ্বাস সংস্কারে স্বাতন্ত্র্য থাকা সত্ত্বেও অভিন্ন সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী এই দুটি সম্প্রদায়ের পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল সুমধুর। এমন কি বিদেশী ও বিভাষী মুসলিম শাসকদের সঙ্গেও তাদের তেমন তিক্ত সম্পর্ক ছিল না। দ্বন্দ্ব-সংঘাত যা কিছু ঘটবার ঘটেছে শাসক-শোষক শ্রেণির হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে; শাসিত ঘোষিত শ্রেণির হিন্দু- মুসলমানের জন-জীবনে সেই সংঘাতের প্রতিক্রিয়া স্পর্শ করতে পারেনি। তবে শাসক শাসিতের নিরন্তর শ্রেণি-সংঘাড়ের যে আদর্শ, মধ্যযুগের বাঙালি সমাজেও তা বর্তমান ছিল। হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের এই বিচিত্র রূপের স্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে।

সাহিত্যে বিধৃত হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের এই তথ্য-সম্পদের ওপর ঐতিহাসিকগণেরও দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়। তাঁরা হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের স্বরূপ নির্ণয় প্রসঙ্গে সাহিত্যের তথ্য যত্রতত্র ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তথ্য প্রয়োগের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকগণ সর্বদা নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। বহু ক্ষেত্রে তাঁরা সাহিত্যের তথ্য বিকৃতি ঘটিয়েছেন যার ফলে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে ব্যর্থ হয়েছেন।

মোগল আমলের বাংলার হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কের স্বরূপ নির্ণয় একটি বহু বিতর্কিত বিষয়। বিতর্কের কারণ বাংলার সামাজিক ইতিহাসের অপ্রতুলতা, বাংলায় তথ্যনিষ্ঠ ইতিহাসের সংখ্যাল্পতা। বাংলাদেশ, বাঙালি জাতি এবং বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাস ঐতিহ্যের অমূল্য আকর যে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের বিচিত্র উপাদান ও তথ্য আজও অনেক ঐতিহাসিকের দৃষ্টিবহির্ভূত। প্রকৃতপক্ষে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যই হচ্ছে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির সামাজিক ইতিহাসের দর্পণবিশেষ। মোগল আমলের বাংলার হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কের স্বরূপ নির্ণয় করতে হলে তাই স্বভাবতই রাজনৈতিক ইতিহাসের মরূপথে বিচরণ না করে কাব্য-কাননের সুরভিত তথ্যগত প্রসুন চয়ন বহুলাংশে শ্রেয়।

উল্লেখ্য যে, মোগল আমল বলতে এখানে সম্রাট আকবরের বঙ্গ বিজয় (১৫৭৬ খ্রি.) থেকে সিরাজদ্দৌলার ভাগ্যবিপর্যয় (১৭৫৭ খ্রি.) পর্যন্ত সময়কে বুঝাতে চাই। ইতিহাসের আলোকে বলা যায়, মোগল আমলের বাংলা সাহিত্য বাংলা হিন্দু-মুসলমানের যৌথ সাধনারই ফল। যদিও আদর্শ ও উদ্দেশ্যের দিক থেকে উভয় সম্প্রদায়ের সাহিত্যিকদের লক্ষ ছিল ভিন্নতর। যদিও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য মূলত ধর্মকেন্দ্রিক। মোগল আমলের হিন্দু কবিগণ যে কারণে সাহিত্য সাধনার ক্ষেত্রে ধর্মীয় চৌহদ্দির সীমা লঙ্ঘনের দুঃসাহস দেখাননি। তাঁরা শুধু ভাগবত-রামায়ণ-মহাভারতের অনুবাদ কিংবা বাংলায় লোকায়ত দেবদেবী মনসা- চণ্ডী-শিব-শীতলার জয়গান অথবা বাংলার বৈষ্ণব ধর্ম-দর্শন কেন্দ্রিক পদ পদাবলীর সৃজন-অনুশীলনেই ব্যাপৃত থেকেছেন। মুসলিম কবিগণও হিন্দু কবিগণের অনুরূপ রসূল বিজয়, রসুল চরিত, শহীদ কারবালা, জারী-জঙ্গনামা প্রভৃতি ধর্ম বিষয়ক কাব্য রচনা করেছেন। তবে তাঁরা ধর্মীয় বিষয় ছাড়া নিছক মানবিক প্রেম-প্রীতি, বিরহ-মিলন, কামনা-বাসনা কেন্দ্রিক দেশীয় গল্প-উপখ্যান এবং আরবি-ফারসি-উর্দু-হিন্দি সাহিত্যের রোমান্টিক প্রণয়োপখ্যান নিয়েও সাহিত্য সাধনা করেছেন। এমনকি তাঁরা ব্যক্তি হৃদয়ের প্রেমানুভূতির রসঘন অভিব্যক্তি ঘটিয়েছেন রাধাকৃষ্ণের নামান্তরালে বৈষ্ণব পদাবলীর মাধ্যমে। এমনিভাবে উভয় সম্প্রদায়ের কবিগণের সৃষ্ট সাহিত্যে স্ব স্ব সমাজের মানুষ ও মনন, ধর্ম ও দর্শন, আচার ও আচরণ, আশা ও আনন্দ, মিলন ও দ্বন্দ্ব, আপোষ ও বিরোধের চিত্র প্রতিবিম্বিত হয়েছে।

অষ্টাদশ শতাব্দীর খ্যাতনামা মঙ্গলকাব্য রচয়িতা কবি ভারতচন্দ্র রায় (১৭২২-১৭৬০) তাঁর অন্নদামঙ্গল কাব্যের তৃতীয় খণ্ডে বাদশাহ জাহাঙ্গীর কর্তৃক হিন্দুধর্মের নিন্দা এবং ভবানন্দ মজুমদার কর্তৃক মুসলমান ধর্মের নিন্দার মধ্য দিয়ে পরস্পরের স্বধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্নের বর্ণাঢ্য বর্ণনার সামান্য অংশ উদ্ধৃতি দিচ্ছি :

মিছা ফাঁদে পড়ি হিন্দু তাহা না বুঝিয়া।
কাফর করিল লোকে কোফর পুড়িয়া।।
দেবী বলি দেই গাছে ঘড়ায় সিন্দুর।
হায় হায় আখেরে কি হইবে হিন্দুর।।
বাঙ্গালিরে কত ভাল পশ্চিমার ঘরে।
পান পানী খানা পিনা আয়েব না করে।।
দাড়ি রাখে বাঁদী রাখে আর জবে খায়।
কান ফোঁড়ে টিকি রাখে এই মাত্র দায়।।
আমার বাসনা হয় যত হিন্দু পাই।
সুন্নত দেওয়াই আর কমলা পড়াই।।
জন কত তোমরা গোঁয়ার আছ জানি।
মিছা লয়ে ফির বেইমানী হিন্দুয়ানী।।
… … … … … …
মজুন্দার কহে জাহাপনা সেলামত।
দেবতার নিন্দা কেন কর হজরত।।
হিন্দু মুসলমান আদি জীবজন্তু যত।
ঈশ্বর সবার এক নহে দুই মত।।
পুরাণের মত ছাড়া কোরাণে কি আছে।
ভাবি দেখ আগে হিন্দু মুসলমান পাছে।।
ঈশ্বরের নূর বলি দাড়ির যতন।
টিকি কাটি নেড়া মাথা এ যুক্তি কেমন।।
কর্মবেধে যদি হয় হিন্দু গুণাগার।
সুন্নতের গুণা তবে কত গুণ তার।।

এ সময়ের অন্নদামঙ্গলসহ অন্যান্য মঙ্গলকাব্য, বৌদ্ধধর্মের জাতকের কাহিনী এবং ইংরেজ শাসনামলের প্রারম্ভে খ্রিষ্টধর্মের বাংলায় অনুবাদ কর্মের দৃষ্টান্ত সাহিত্যে ধর্মচেতনায় বিকাশপর্বের সর্বাদিক স্মরণীয় অধ্যায়।

বাঙালি সমাজের বেশির ভাগ মানুষ হল পারিবারিক ও গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন- যাপন অর্থাৎ সামাজিক দলগত জনতার জীবন। সেইসাথে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সাথে সহঅবস্থানের জীবনযাপন। এদের ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান হলেও জাতিগত পরিচয় ও ঐক্যে এঁরা বাঙালি। এই জাতিগত পরিচয়ই বাঙালির মূল ঐক্যশক্তি। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এটাই তার প্রধান পরিচয়।

সংগীতে বাঙালির ধর্মচেতনা

‘ন চ বিদ্যা সঙ্গীতাৎ পরা’– অর্থাৎ সংগীতের উপরে আর কোন বিদ্যা নাই। বৈদিক যুগে শাস্ত্রীয় সংগীতের উল্লেখ ঋগ্বেদ থেকে পাওয়া যায়। বৈদিক যুগের নিজস্ব সম্পদ সামগান। ঋগ্বেদে মৃদঙ্গ, বীণা, বাঁশী, ডমরু ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্ৰ ব্যবহারের উল্লেখ আছে। ঋক্‌ছন্দে সুরযোজনা সামগানের সৃষ্টি। এই সামগান উদাত্ত, অনুদাত্ত, ও স্বরিত—এই তিন স্বরে গীত হত। পরে এই তিন স্বর সাত স্বরে সম্প্রসারিত হয়। ‘ওঁ’ ধ্বনির মধ্যে সাত স্বরকে পাওয়া যায়। ‘ওঁ’ অর্থাৎ অগ্নিদেব—স্ত্রী স্বাহা। যেকোন যজ্ঞানুষ্ঠানে ‘ওঁ’-’স্বা’ মন্ত্রটি উচ্চারিত হয়। ‘ওঁ’-এর সাতটি স্বর—’সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি’ এবং ‘স্বাহা’ ধ্বনির মধ্যে গান্ধার স্বর ও পঞ্চম স্বর অন্তর্নিহিত থাকে। এই সামগান থেকেই মার্গ সঙ্গীত বা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত (Classical Music) এর উৎপত্তি।

পৌরাণিক সংগীতে রামায়ণ, মহাভারত, হরিবংশ, পুরাণ প্রভৃতির মধ্যেও সংগীতের উল্লেখ পাওয়া যায়। বৌদ্ধযুগেও গৌতমবুদ্ধের বাণী ধর্মীয় গীতি আকারে গীত হত। এসব বন্দনা সংগীতে সুন্দর রাগাশ্রয়ী চিত্তবিমোহিত গায়নশৈলী দ্বারা জনগণকে বৌদ্ধ ধর্মের দিকে আকৃষ্ট করা হত। এক পর্যায়ে এই ধারাটিকে ‘ধ্রুবপদ’ অর্থাৎ ঈশ্বরের গুণগাথা নামে আখ্যায়িত করা হয়। বর্তমানে এই ধারা ‘ধ্রুপদ’ নামে প্রচলিত। ‘ধ্রুপদ’ মঠে বা মন্দিরে মৃদঙ্গ সহযোগে সাধনা করা হত। ‘ধ্রুপদ’ ধামার তালে গীত হলে তা ‘ধামার’ নামে প্রচলিত হয়। গোয়ালিয়রের রাজা মানসিংহ তোমর (১৪৮৬-১৫১৬ খ্রি.) ধ্রুপদ সংগীতের প্রচলন করেন। রাজা মানসিংহের পত্নী মৃগনয়নী ধ্রুপদের সাধিকা ছিলেন। পরবর্তীকালে সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রি.) এই সংগীত বিশেষ উৎকর্ষ লাভ করে। ছত্রিশজন সংগীতজ্ঞ আকবরের দরবার অলঙ্কৃত করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে সংগীতজ্ঞ মিঞা তানসেন, বৈজু বাওড়া, রামদাস প্রমুখ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। আকবরের দরবারেই ‘দরবারী-কানাড়া’ রাগটি সৃষ্টি করেছিলেন অমর সংগীতজ্ঞ তানসেন। ‘মিঞা-কী-তোড়ি’, ‘মিঞা-কী-মল্লার’, ‘মিঞা-কী- সারং’ ইত্যাদি রাগ তানসেন কর্তৃক সৃষ্ট— যা আজও সংগীত জগতে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। বাদ্যযন্ত্র ‘রুদ্রবীণা’ ও ‘রবাব’ তাঁরই আবিষ্কার। সম্রাট আকবরের শাসনামলের আরেক গায়ক ভক্তিমতি মীরা বাঈ (১৫০৪-১৬২০ খ্রি.) মীরা বাঈয়ের শ্রীকৃষ্ণের প্রতি প্রীতি ও প্রেমাসক্তে উৎসর্গীত ভক্তিগীতি ভারতীয় সংগীত ইতিহাসে এক অনন্য কিংবদন্তি। ভারতীয় সংগীতের ইতিহাসে সেতার ও তবলার স্রষ্টা আমীর খসরু (১২১৩-১২৯৬ খ্রি.) একটি অবিস্মরণীয় নাম। সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে (১৬০৫-১৬২৭ খ্রি.) তাঁর সংগীত সভায় সংগীতজ্ঞ হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন বিলাস খাঁ। তাঁরই সৃষ্ট ‘বিলাস খাঁনী টোরী’ রাগটি আজও সংগীতমহলে স্মরণীয় হয়ে আছে।

ইসলামের দৃষ্টিতে সংগীতচর্চা কি ইসলামসম্মত অথবা ইসলাম বিরোধী? এ প্রশ্নের সর্বজন সম্মত অথবা সর্বজন গৃহীত সিদ্ধান্ত আজও অমীমাংসিত। মুসলিম জনমনে এ ধারণা অনেকটা বদ্ধমূল যে, অনৈতিক গান-বাজনা সম্পূর্ণ হারাম। কেও কেও বলেন সকল প্রকার সংগীত চর্চাই হারাম। কেননা, সংগীত চর্চা শয়তানের কাজ। বলা হয় যে, গানের সুর শয়তানের সুরের অনুকরণে করা হয়েছে। মুয়াজ্জিন যেমন আজান দিয়ে মুসল্লিদের আল্লাহ্র পথে ডাকেন, শয়তান তেমনি গানের সুরের মাধ্যমে মানুষকে নিজের পথে নিয়ে যায়।

মুসলিম ফিকাহ্ এবং আইনশাস্ত্রের এক মূলনীতি এই যে, যা অবৈধ করা হয়নি বা অবৈধ ঘোষণা করা হয়নি তা বৈধ। আল্-কুরআন এবং হাদীস দ্বারা যা অবৈধ ঘোষণা করা হয়নি ঐ সবই আমরা বৈধ ধরে নিতে পারি। কী কী কাজ অবৈধ তা নির্ধারণ করার জন্যে আল্-কুরআন এবং হাদীসের আশ্রয় নিতে হয়।

আল্-কুরআনে সংগীতের অবৈধতাসূচক সুস্পষ্ট কোন আয়াত নেই। তবুও কয়েকটি আয়াতকে সাহাবী ইবনে আব্বাস (রা.) এবং সাহাবী ইবনে মাসউদ (রা.)-এর বরাত দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয় যে, ওগুলোতে সংগীতের নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হয়। এ নিষেধাজ্ঞার সমর্থনে হাদীস এবং ফকিহ্রদের মতের উদ্ধৃতি দেওয়া হয়।

তবে হাদীস অনুসন্ধান থেকে আমরা এখানে ছয়টি দলিল উপস্থাপন করছি—

১. উট চালকের গান শুনে হজরত মহম্মদ (স.) আল্লাহর কাছে দোয়া (সহীহ বুখারী : ৬৮৯১)।

করলেন। ২ . হজরত মুহম্মদ (স.) এক সাহাবির বাসর রাত উপলক্ষে গান শুনলেন। (সুনান আবু দাউদ : ৪৮৪২)।

৩. হজরত মুহম্মদ (স.) মান্নতের গান গাওয়ার অনুমতি দিলেন। (সুনান আত তিরমিজ : ৩৬৯০)।

৪. হজরত মুহম্মদ (স.) বলেছেন, জান্নাতের হুরগণ সমবেতভাবে গান গাইবেন। (সুনানে তিরমিজি : ২৫৬৪)

৫ . হজরত মুহম্মদ (স.) উৎসবের দিন গান গাওয়ার অনুমতি দিলেন। (সহি মুসলিম : ১৯৪৫)।

৬. হজরত মুহম্মদ (স.) বিয়ের যাত্রীদের সঙ্গে গায়ক পাঠানোর নির্দেশ দিলেন। (ইবনে মাযাহ : ১৯০০)।

তাই দেখা যাচ্ছে, মদ, সুদ এবং জুয়া যেভাবে আল্-কুরআনে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে গিনা, নাগমা, সামারূপ গান বা সংগীত সম্বন্ধে সেরূপ নিষেধাজ্ঞা আল্-কুরআনে নেই। বরং ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে হজরত মুহম্মদ (স.) ইয়াসরিব (পরিবর্তিত নাম ‘মদীনাতুন্নবী’ বা ‘মদীনা’) শহরে উপনীত হওয়ার পর আকাবা উপত্যাকায় শান্তি-শপথ সম্পন্ন হলে স্থানীয় অধিবাসীদের (ইহুদী-খ্রিষ্টান- সাবেয়ীনসহ) পক্ষ থেকে শিশু-কিশোরদের সম্মিলিত কণ্ঠে পরিবেশিত এক অভ্যর্থনা-সংগীতের মাধ্যমে তাকে বরণ করা হয়। ইসলামের ইতিহাসে এটাই প্রথম সংবর্ধনা-সংগীত। সংগীতটির পূর্ণাঙ্গরূপ উপস্থাপন করছি :

তালা আল বাদরু আলাইনা (Tala Al Badru Alaina )
তা’লা আল বাদরু আলাই না
মিন থানি’য়া তিল ওয়া’দা
ওজাবা শুক’রু আলাই না
মা দা আ লিল্লাহি দা
তা’লা আল বাদরু আলাই না
মিন থানি’য়া তিল ওয়া’দা
ওজাবা শুক’রু আলাই না
মা দা আ লিল্লাহি দা
আইয়্যু হা’ল মাব উথু ফিনা
জি’তা বি’ল-আমিল মু’তা
জি’তা শার’রাফ তা’ল মদিনা
মারহাবান ইয়া খাই দ্যা
আইয়্যু হা’ল মাব উ’থু ফিনা
জি’তা বি’ল-আমিল মু’তা
জি’তা শার’রাফ তা’ল মদিনা
মারহাবান ইয়া খাইর্য দ্যা
তা’লা আল বাদরু আলাই না

বাংলা তরজমা :

পূর্ণিমার চাঁদ আমাদের উপর (কাছে) এসেছে
উপত্যকা থেকে যে উপত্যকা দিয়ে
হজরত মুহম্মদ (স.) মদিনায় প্রবেশ করেন
এবং তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা আমাদের কর্তব্য।
আমাদের অবশ্য কর্তব্য যতদিন আল্লার অস্তিত্ব
আল্লাহকে ডাকার মত কেউ থাকবে।
ওহ আমাদের পথ প্ৰদৰ্শক
আজকে আমাদের মধ্যে যিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে
আদেশ/উপদেশ নিয়ে এসেছেন
যার প্রতি আমাদের কর্ণপাত করতে হবে।
আপনি এই শহরের জন্য প্রশংসা
মর্যাদা বয়ে নিয়ে এসেছেন—
স্বাগতম আপনাকে যিনি আমাদের সঠিক পথ দেখাবেন
সঠিক পথ সম্বন্ধে বলবেন।

হজরত মুহম্মদ (স.) জীবনের উপর প্রামাণ্য তথ্যচিত্র The Message, The Miracle ইত্যাদি গণমাধ্যমের বহু জায়গায় এই সংগীতটি এখনো উচ্চারিত হচ্ছে। ক্বারী বাসেত ও উম্মে কুলসুমের কণ্ঠে গানটি শ্রোতাপ্রিয় হয়। উল্লেখ্য, আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আগত সম্মানীয় অতিথির শুভাগমন উপলক্ষে

এই আদর্শে অতিথি বরণ-সংগীত পরিবেশনের রেওয়াজ এখনো প্রচলিত আছে।

রাসূল বন্দনায় শেখ সা’দীর অমর পঙ্ক্তি—

বালাগাল উলা বিকামালিহী কাশাফাদ দুজা বিজামালিহী
হাসুনাত জামিয়ু খিসালিহী সাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহী।

বাংলা তরজমা :

সুউচ্চ শিখরে সমাসীন তিনি নিজ মহিমায়
তিমির-তমসা কাটিল তাঁর রূপের প্রভায়,
সুন্দর আর সুন্দর তাঁর স্বভাব-চরিত্র তামাম
জানাও তাঁর ও তাঁর বংশের ’পরে দরূদ-সালাম।

চার লাইনের একটি আরবি ‘না’ত’ আমাদের দেশে দরূদ হিসেবে প্রচলিত। বলতে হবে, অসম্ভব জনপ্রিয় সর্বমহলে। জ্ঞানী-গুণী পীর-মাশায়েখদের কাছে যেমন, তেমনি নারী-পুরুষ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সর্বসাধারণ মানুষের কাছেও সমানভাবে সমাদৃত। মীলাদ মাহফিলে ওয়ায়েজ যখন সুর দিয়ে না’তটি পড়েন, তখন উপস্থিত ছোট-বড় সবাই তার সংগীত মাধুরিতে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ভালবাসায় বিমোহিত হন। তাঁরাও সমস্বরে পাঠ করেন রাসূল প্রেমের আরশি, অমৃত সুধার আধার এই চতুস্পদী। না—ত বললাম এজন্য যে, এটি প্রচলিত অর্থে দরূদ নয়। ‘দরূদ’ ফারসি শব্দ। অর্থ দোয়া। কিন্তু সাধারণ দোয়াকে আমরা দরূদ বলি না। আমরা যখন আল্লাহর দরবারে প্রিয় নবীর ওপর অহরহ রহমত নাযিল করার জন্য কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, তখন সেটি হয়ে যায় দরূদ। আরবিতে সালাত। এই সালাতের হুবহু বাংলা অনুবাদ অসম্ভব। তবে দরূদ বলতে আমাদের বোধ ও চিন্তায় যে অর্থটি ফুটে ওঠে সেটিই সালাত বা নবীজীর প্রতি দরূদ। (ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী, প্রেমের আরশি, ২০১২)।

চর্যাপদের নাথগীতিকা ও মধ্যযুগের কবিদের সংগীতে ধর্মদেশনা

বাংলাভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদ, বড়ুচণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, জয়দেবের গীতগোবিন্দ বাঙালির সাংস্কৃতিক মানসে সাংগীতিক রসেই সিক্ত ও বিকশিত হয়েছে। এতদ্ভিন্ন মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যেও বাঙালি জনজীবনে যে-জীবনবোধ প্রকাশিত হয়েছে তাতেও সংগীতের অনুরণন উৎসারিত হয়েছে। বাঙালি জনজীবনে তখনও মানুষ নিয়তি নির্ভরতার বাইরে তার চিন্তা প্রসারিত করতে পারেনি। তাই তার ধর্মদেশনায় দেখা যায় প্রকৃতি নির্ভরতা ও ভাগ্যে সমর্পণের আকুতি। মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি চণ্ডীদাস রচিত নিম্নের গানটিতে রয়েছে তার প্রকৃষ্ট পরিচয় :

সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু অনলে পুড়িয়া গেল
অমিয় সাগরে সিনান করিতে সকলি গরল ভেল।।

সখি, কি মোর কপালে লেখি
শীতল বলিয়া চাঁদ সেবিনু, ভানুর কিরণ দেখি।।
উচল বলিয়া অচলে চড়ি, পরিনু অগাধ জলে
লছমী চাহিতে দারিদ্র্য বেঢ়ল, মানিক হারানু হেলে।।

নগর বসালাম সাগর বাঁধিলাম মানিক পাইবার আশে
সাগর শুকাল মানিক লুকাল অভাগীর করম দোষে।।

মধ্যযুগে রচিত এটি একটি গীতিকবিতা হলেও শিল্পী রাধারাণী দেবীর কণ্ঠে তৎকালীন প্রচলিত সুরে গ্রামোফোন কোম্পানি কর্তৃক রেকর্ড করা হয় ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে।

রামপ্রসাদের গানে ধর্মদেশনা

সমস্ত দেবদেবীর মধ্যে কালীই হল বাঙালি হিন্দুদের কাছে ‘গণতান্ত্রিক’ দেবী, এবং বাঙালির মাতৃতান্ত্রিক চেতনার প্রতিকৃতি— প্রাকৃত জনগণের অফুরন্ত শক্তির প্রতিমূর্তি। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়া যায়, দ্বাদশ-ত্ৰয়োদশ শতক থেকে বাংলাদেশে দুর্গাপূজার প্রচলন হয়েছে। বর্তমানে হিন্দু বাঙালিরা যে- পদ্ধতিতে দুর্গাপূজা করে তার প্রচলন হয়েছে ষোড়শ শতক থেকে। দুর্গাপূজার পরে কালীপূজার প্রবর্তন। বাংলাদেশে, বিশেষ করে শক্তিসাধনার ক্ষেত্রে কালীই সর্বপ্রধান। বাঙালির শক্তিসাধনা ও শক্তিসাহিত্যের ইতিহাস যে প্রাচীন তা হিন্দুশাস্ত্র থেকে বহু প্রামাণ্য তথ্য হাজির করা যায়। বৈদিক সাহিত্যে ‘কালী’ নামটি প্রথম পাওয়া যায় মুণ্ডক উপনিষদে। সেখানে কালী যজ্ঞাগ্নির সপ্তজিহ্বার একটি জিহ্বা। প্রচলিত মহাভারতে একাধিক স্থানে কালীর উল্লেখ আছে। হিন্দু তন্ত্র শাস্ত্রে প্রধানত দুটি ধারায় (অর্থাৎ দুর্গা ও চণ্ডীর ধারা) শক্তি সাধনার ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হয়। আর এই দুই শক্তিতেই সমর্পিত সমস্ত বাঙালি হিন্দু ধর্মীয় সংস্কৃতি। এই সমর্পণ থেকেই সৃষ্টি হয়েছে কালজয়ী শ্যামা সংগীত ও দুর্গা সংগীত। এই শ্যামা সংগীতের একজন অনন্য রূপকার সাধক রামপ্রসাদ সেন।

মন রে কৃষিকাজ জানো না
এমন মানব-জমিন রইল পতিত,
আবাদ করলে ফলত সোনা।।
কালী নামের দাও রে বেড়া ফসলে তছরুপ হবে না
সে যে মুক্তকেশীর শক্ত বেড়া তার কাছেতে যম ঘেঁষে না।।

অদ্য কিংবা শতাব্দান্তে বাজেয়াপ্ত হবে জানো না
এখন আপন এখতারে মন রে ও তুই চুটিয়ে ফসল কেটে নে না।
গুরুদত্ত বীজ রোপন করে ভক্তি বারি সেঁচে দে না
ও তুই একা যদি না পারিস মন রামপ্রসাদকে ডেকে নে না।।

লালন শাহের গানে ধর্মদেশনা

ফকির লালন শাহকে (১৭৭২-১৮৯০ খ্রি.) বলা হয় ‘দেলকোরান’ কবি। সংগীতে অধ্যাত্মবাদকে রূপক আকারে প্রকাশ করেছেন। তত্ত্বজ্ঞানী ছাড়া লালনের ধর্মদেশনার তাৎপর্য অনুধাবন অসম্ভব। সালাত বলতে তিনি মনে করেন ‘দায়েমী সালাত’, অর্থাৎ সার্বক্ষণিক ধ্যান। তাই তা তার সংগীতে বলেন-

যদি ইসলাম কায়েম হইত শরায়
কী জন্যে নবীজী রহেন সতের বছর হেরাগুহায়।।
পঞ্চবেনায় শরা জারি মৌলভীদের তম্বি ভারি
নবীজী কী সাধন করি নবুয়তি পায়।।
না করিলে নামাজ রোজা হাসরে হয় যদি সাজা
চল্লিশ বছর নামাজ কাজা করেছেন রসুল দয়াময়।।
কায়েম উদ্ দ্বীন হবে কীসে অহর্নিশি ভাবছি বসে
দায়েমী নামাজের দিশে লালন ফকির কয়।।

সুফি-আউল-বাউল দরবেশদের মনোমোহিনী চিত্তাকর্ষক জীবনাচরণকে কেন্দ্র করেও রচিত হয়েছে প্রচুর ভক্তিমূলক গান। বাংলাদেশে মাইজভাণ্ডারী, কাওয়ালী ইত্যাদি সুফি দর্শনের অনেক জনপ্রিয় গান রয়েছে বাংলাদেশে। যেখানে প্রকৃতই স্রষ্টায় সমর্পণ ও স্মরণ আমাদেরকে বিমোহিত করে এমন একটি গান—

হো লাল মেরী পাত
রাখিও বালা ঝুলে লালন
সিন্দরিদা সেভান দা সবাকলন্দর
দমাদম মাস্ত কলন্দর সাকি শাহবাজ কলন্দর
আলী দম দম দে অন্দর।।

পীরানে তেরা পীর সবদা ওয়ালীহে
লাকাব আব্দুল্লাহে নামে আলীহে
নামে আলী বেড়া পার লাগা ঝুলে লালন।।

শাহেনে জপনে তুহে অঙ্গ লাগায়া
মুশকিল কুশাই ভালা রঙ্গ লাগায়া
হো লাল মেরি তুহে ভাগ জাগা ঝুলে লালন।।

রওজে পে আঈ তেরে বনকে সওয়ানী
দিলকি মুরাদে মাঙ্গু থামকে জানি
হো লাল মেরী মেরী শুনলে সাদা ঝুলে লালন।।

ম্যায় দুখিয়ারী মরদি যাউয়া
নজরে করোকে তরদি যাউয়া
কোঈ নেহী মেরা তেরে সিবা ঝুলে লালন।।

লাহোরের বিখ্যাত সুফি শাহ কলন্দর (রা.) এর শানে সামি ইউসুফ রচিত এই জনপ্রিয় গানটির প্রথম শিল্পী ছিলেন রেশমা। পরবর্তীকালে দেবু ভট্টচার্যের সংগীত পরিচালনায় সমন্দর (১৯৬৮) ছবিতে গানটি কণ্ঠ দেন গোলাম নবী ও তাঁর সংগীরা। বর্তমানে গানটি রুনা লায়লাসহ আরও অনেক শিল্পীদের কণ্ঠে গীত হয়।

রবীন্দ্রনাথের সংগীত চেতনায় ধর্মদেশনা

সংগীত ও মানব জীবন পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। মানব সভ্যতার উষালগ্ন থেকেই সংগীত মানুষের সাথী। মানব জীবনের দুঃখ-বেদনায় সংগীত সান্ত্বনা হিসেবে স্বীকৃত। সংগীত সমাজের সকল স্তরে পরিব্যপ্ত। জীবনের উৎসবে সংগীত নিত্যসঙ্গী। ‘জগতের আনন্দ-যজ্ঞে’ সংগীতের নিমন্ত্রণ অনিবার্য। আধ্যাত্মিক অনুধ্যানেও সংগীত মানব ভাবনা ও বিশ্বাসকে অঙ্গিভূত করে এগিয়ে যায়। সংগীতে জাগতিক পারত্রিক সকল শক্তিই নিহিত আছে। সুরের অনুধ্যানেই উজ্জীবিত হয় এই শক্তি। আত্মনিবেদনের অনুভূতিতে যুক্ত হয়ে এই শক্তি চূড়ান্ত মানববোধে বিকশিত হয়। সৃষ্টিরহস্য ও প্রকৃতির লীলাবৈচিত্র্য স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হয় মানব অনুধ্যানে। তখন প্রকৃতির সুর আর মানুষের স্বর সমন্বিতরূপে উন্মোচিত হয় সংগীতে। প্রকৃতির এই দানকেই রবীন্দ্রনাথ কৃতজ্ঞচিত্তে বলেছেন—

পাখিরে দিয়েছে গান, গায় সেই গান,
তার বেশি করে না সে দান।
আমারে দিয়েছে স্বর, আমি তার বেশি দান করি,
আমি গান গাই।

রোম্যাঁ রোঁলার মতে সংগীতের একটি বিশ্বজনীন ভাষা আছে। The Language of Music is Universal। রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘সকল সৃষ্টির মধ্যেই একটি দ্বৈত আছে; আর একটা দিক হচ্ছে অন্তরের, আর-একটা দিক হচ্ছে তার বাহিরের বাহন। অর্থাৎ, এক দিক ভাব, আর-এক দিকে ভাষা। দুইয়ের মধ্যে প্রাণগত যোগ আছে।’ রবীন্দ্রনাথের এই অভিব্যক্তির আলোকচ্ছটা দেখি তাঁর স্রষ্টানুভূতির ঔন্দ্রজালিক অবলোকনে। স্রষ্টাকে দেখা-অদেখার অতৃপ্ত অনুভূতির ইন্দ্রজালে তিনি বিস্তার করেন এক মহাজাগতিক মায়াবল। সবকিছু বিসর্জন দিয়ে হলেও এই মহাজাগতিক শক্তির সার্বক্ষণিক সান্নিধ্য ও দর্শন কামনায় তৃপ্ত হতে চান তিনি। তাই অতৃপ্ত হৃদয়ের ব্যাকুল বাসনায় স্রষ্টার প্রতি আকুতি জানান—

মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না।
কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে, তোমারে দেখিতে দেয় না।
(মোহমেঘে তোমারে দেখিতে দেয় না।
অন্ধ করে রাখে, তোমারে দেখিতে দেয় না। )
ক্ষণিক আলোকে আঁখির পলকে তোমায় যবে পাই দেখিতে
ওহে ‘হারাই হারাই’ সদা হয় ভয়, হারাইয়া ফেলি চকিতে।
(আশা না মিটিতে হারাইয়া-পলক না পড়িতে হারাইয়া–
হৃদয় না জুড়াতে হারাইয়া ফেলি চকিতে। )
কী করিলে বলো পাইব তোমারে, রাখিব আঁখিতে আঁখিতে–
ওহে এত প্রেম আমি কোথা পাব, নাথ, তোমারে হৃদয়ে রাখিতে।
(আমার সাধ্য কিবা তোমারে-
দয়া না করিলে কে পারে–
তুমি আপনি না এলে কে পারে হৃদয়ে রাখিতে। )
আর কারো পানে চাহিব না আর, করিব হে আমি প্রাণপণ–
ওহে তুমি যদি বলো এখনি করিব বিষয়-বাসনা বিসর্জন।
(দিব শ্রীচরণে বিষয়—দিব অকাতরে বিষয়—
দিব তোমার লাগি-বাসনা বিসর্জন।)

মানুষের নানা সীমাবদ্ধতায় শেষমেশ স্রষ্টায় সমর্পিত হতে হয়। রবীন্দ্রনাথের ধর্মচেতনায়ও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। আর অহম্ বর্জন ছাড়া স্রষ্টার সমর্পিত হওয়া যায় না। তাই জীবনের সকল অপূর্ণতাকে পরম প্রাপ্তিতে উপলব্ধি করে রবীন্দ্রনাথ স্রষ্টায় আত্মনিবেদনকেই শ্রেয়জ্ঞান করেছেন। সেই শ্রেয়জ্ঞানে তিনি গেয়েছেন—

আমার  মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে।
সকল অহঙ্কার হে আমার ডুবাও চোখের জলে।।
নিজেরে করিতে গৌরব দান নিজেরে কেবলই করি অপমান,
আপনারে শুধু ঘেরিয়া ঘেরিয়া ঘুরে মরি পলে পলে।
সকল অহঙ্কার হে আমার ডুবাও চোখের জলে।।
আমারে না যেন করি প্রচার আমার আপন কাজে,
তোমারি ইচ্ছা করো হে পূর্ণ আমার জীবনমাঝে।
যাচি হে তোমার চরমশান্তি : পরাণে তোমার পরমকান্তি—
আমারে আড়াল করিয়া দাঁড়াও হৃদয়পদ্মবনে।
সকল অহঙ্কার হে আমার ডুবাও চোখের জলে।।

কেননা অন্তরের অহংকার চোখের জলে নিমজ্জিত হলে বাইরের আলো ছাড়াই অন্তরের আলোতে তাকে আরও ভাল করে দেখা যায়। ধরায় তিনি দৃশ্যমান না হলেও নিষ্কলুষ অন্তরের আলোকচ্ছটায় তিনি আরও দীপ্তমান হয়ে ওঠেন। ভক্তের হৃদয়-বীণায় তখন গেয়ে ওঠে—

চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে।
অন্তরে আজ দেখব, যখন আলোক নাহি রে।।
ধরায় যখন দাও না ধরা
হৃদয় তখন তোমায় ভরা,
এখন তোমার আপন আলোয় তোমায় চাহি রে।।
তোমায় নিয়ে খেলেছিলেম খেলার ঘরেতে।
খেলার পুতুল ভেঙে গেছে প্রলয় ঝড়েতে।
থাক তবে সেই কেবল খেলা,
হোক-না এখন প্রাণের মেলা
তারের বীণা ভাঙল, হৃদয়-বীণায় গাহি রে।।

এই হৃদয়-বীণার সুর যেন আসমুদ্র হিমাচল পরিব্যাপ্ত। জীবনে চলার পথে প্রহরীর ন্যায় প্রতি মুহূর্তে সে আরদ্ধ মুখ যেন প্রকাশিত হয়ে ওঠে। জীবনানুভূতির এই সমুদ্রসম গভীরতায় পথহারা হয়ে ভুলে নিমজ্জিত না-হয় এ চলার পথ— সে জন্যই কবি তাকে জীবনের ধ্রুবতারা নির্বাচন করেছেন। চলার পথে যাকে সার্বক্ষণিক সাথী হিসেবে পেলে তিনিই পৌঁছে দেবেন আকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে। এই ধ্রুবতারাই আজ কবি-জীবনের আলোকবর্তিকা। তাই কবি-জীবনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অঙ্গীকার—

তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা
এ সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা।
যেথা আমি যাই নাকো তুমি প্রকাশিত থাকো,
আকুল নয়নজলে ঢালো গো কিরণধারা।।
তব মুখ সদা মনে জাগিতেছে সংগোপনে,
তিলেক অন্তর হলে না হেরি কূল-কিনারা।
কখনো বিপথে যদি ভ্রমিতে চাহে এ হৃদি
অমনি ও মুখ হেরি শরমে সে হয় সারা।।

‘যেথা আমি যাই নাকো তুমি প্রকাশিত থাকো’ এই বাক্যে স্রষ্টার সার্বক্ষণিক উপস্থিতির যে-উপলব্ধি ব্যক্ত হয়েছে— তা পবিত্র কোরআনেরই প্রতিধ্বনি। কোরআনে ঘোষিত হয়েছে : ‘আল্লাহ সর্বব্যাপ্ত, তিনি ছাড়া কিছু নাই’ (৫৭:৩)। এটি বিশ্ব জগতের সকল সমর্পিত হৃদয়েরই অনুভূতি। শিল্পী দেব্ৰত বিশ্বাসের কণ্ঠে আমরাও হতে পারি রবীন্দ্রানুভূতির অবিচ্ছেদ্য অংশীদার। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের খুব প্রিয় ছিল এই গানটি। স্বামী বিবেকানন্দ প্রায়শই নিজ কণ্ঠে গানটি গেয়ে ঠাকুরের আবদার মেটাতেন।

নজরুলের সংগীত চেতনায় ধর্মদেশনা

বাঙালি সমাজে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষের ধর্মতৃষ্ণা মিটাতে নজরুলের ধর্মীয় সংগীতের আবেদন অফুরন্ত। নজরুলই একমাত্র বাঙালি সংগীত প্রতিভা যিনি হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের ধর্মীয় চেতনাকে উজ্জীবিত করে সার্থক সংগীত রচনা করেছেন। উভয় ঐতিহ্যের সম্মিলন এবং বিশ্বাসে ঐক্য স্থাপন প্রয়াসী তাঁর মত সংগীত প্রতিভা বাঙালি সমাজে দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত নেই। হিন্দু- মুসলমানের মিলন-প্রয়াসী নজরুল মানসে যেমন সৃষ্টি হয়েছে শিল্পউত্তীর্ণ ও কালউত্তীর্ণ ইসলামি গান তেমনি সৃষ্টি হয়েছে শ্যামা সংগীত ও দুর্গা সংগীত। আর এ কারণেই নজরুলের এক মুখে যেমন উচ্চারিত হয় ‘মোহাম্মদের নাম’– আর এক মুখে বন্দিত হয় ‘কালো মেয়ের পায়ের নিচে আলোর নাচন’। এই নাচানাচির মধ্যেই আবার তিনি খোদাকেও ভোলেন না। তাই নজরুলের খোদা-প্রেমের মাতাল উচ্চারণ—

খোদার প্রেমের সরাব পিয়ে বেহুঁশ হয়ে রই পরে
ছেড়ে মসজিদ আমার মুর্শিদ এল যে এই পথ ধরে।।

দুনিয়াদারীর শেষে আমার নামাজ রোজার বদলাতে
চাই না বেহেশত খোদার কাছে নিত্য মোনাজাত করে।।
কয়েস যেমন লায়লী লাগি লভিল মজনু খেতাব
যেমন ফরহাদ শিরির প্রেমে হল দিওয়ানা বেতাব
বে-খুদীতে মশগুল আমি তেমনি মোর খোদার তরে।।

এই বে-খুদী মশগুলে যখন তাঁর চৈতন্য ফেরে তখন আবার সৃষ্টি লীলার বৈচিত্র্যের বিস্ময় ঘোরে খোদাকে তিনি ‘বিরাট শিশু’র ভূমিকায় অবতীর্ণ করেন। খেয়ালি খোদার উদ্দেশ্যে গেয়ে ওঠেন—

খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে
প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলা, নিরজনে প্রভু নিরজনে।।
শূন্যে মহা আকাশে (তুমি) মগ্ন লীলা-বিলাসে
ভাঙিছ গড়িছ নিতি ক্ষণে ক্ষণে।।

তারকা রবি শশী খেলনা তব, হে উদাসী
পড়িয়া আছে রাঙা পায়ের কাছে রাশি রাশি।।

নিত্য তুমি, হে উদার সুখে দুখে অবিকার
হাসিছ খেলিছ তুমি আপন মনে।।

প্রভুর ‘প্রলয় সৃষ্টির পুতুল খেলা’য় অভিভূত হন নজরুল! নিমগ্ন হন ‘শূন্যে মহা আকাশে… লীলা-বিলাসে’।

অতঃপর নজরুল তাঁর বিশ্বাসের বিচরণ শেষে নিজেকে স্থির করেন কলেমা শাহাদাতে। কেননা তাঁর শেষ উপলব্ধি হল-

কলমা শাহাদাতে আছে খোদার জ্যোতি
ঝিনুকের বুকে লুকিয়ে থাকে যেমন মোতি।।

ঐ কমা জপে যে ঘুমের আগে
ঐ কমা জপিয়া যে প্ৰভাত জাগে
দুখের সংসার যার, সুখময় হয় তার
(তার) মুসিবত আসে নাকো, হয় না ক্ষতি।।

হরদম জপে মনে কমা যে জন
খোদায়ী তত্ত্ব তার রহে না গোপন
দীলের আয়না তার হয়ে যায় পাক সাফ
(সদা) আল্লাহর রাহে তার রহে মতি।।

এসমে আজ হতে কদর ইহার
পায় ঘরে বসে খোদা রসুলের দিদার
তাহারই হৃদয়াকাশে সাত বেহেশ্ত্‌ নাচে
আল্লার আরশে হয় আখেরে গতি
তার আল্লার আরশে হয় আখেরে গতি।।

নজরুলের এই উপলব্ধির পরিণতি ও প্রত্যাশাই কি পূরণ হয়েছে মসজিদের পাশে কবর হয়ে? তবুও আমাদের বিবেচনায় নজরুলের ধর্মদেশনা সর্বমানবিক মহত্তেই উত্তীর্ণ এক বিরল দৃষ্টান্ত! ধর্মজগতে বিশ্বাসের এ এক মহাবিস্ময়!

নজরুল রচিত শ্যামা সংগীতের অন্যতম একটি—

শ্যামা নামের লাগল আগুন দেহের ধূপকাঠিতে
যত জ্বালি সুবাস তত ছড়িয়ে পড়ে চারিভিতে।।

ভক্তি আমার ধূমের মত, ঊর্ধ্বে ওঠে অবিরত
শিব-লোকের দেব-দেউলে মা’র শ্রীচরণ পরশিতে।।

অন্তর-লোক শুদ্ধ হল পবিত্র সেই ধূপ— সুবাসে,
মার হাসিমুখ চিত্তে ভাসে চন্দ্রসম নীল আকাশে।।

সব কিছু মোর পুড়ে কবে, চিরতরে ভস্ম হবে
মা’র ললাটে আঁকব তিলক সেই ভস্ম-বিভূতিতে।।

নজরুলের আরেকটি শ্যামা সংগীত—

ব্রজগোপী খেলে হোরী
খেলে আনন্দ নব ঘন শ্যাম সাথে।।

পিরীত ফাগ মাখা গোরীর সঙ্গে
হোরী খেলে হরি উন্মাদ রঙ্গে
বসন্তে এ কোন কিশোর দূরন্ত
রাধারে জিনিতে এলো পিচকারি হাতে।।

গোপিনীরা হানে অপাঙ্গ খরশর ভ্রুকুটিবঙ্গ
অনঙ্গ আবেশে জরজর থরথর শ্যামের অঙ্গ।।

শ্যামল তনুতে হরিৎ কুঞ্জে
অশোক ফুটেছে যেন পুঞ্জে পুঞ্জে
রং-পিয়াসী মন ভ্রমর গুঞ্জে
ঢালো আরো ঢালো রং প্রেম-যমুনাতে।।

রবীন্দ্রনাথের সংগীতে ধর্মদেশনা আর নজরুলের সংগীতের ধর্মদেশনার মধ্যে যে- মানববোধ বিকশিত হয়েছে তাতে বাঙালির মানসজগতের ধর্মানুভূতি তথা প্ৰায় সমগ্র ধর্মচিন্তার নির্যাস উদ্ভাসিত হয়েছে। বাঙালির চিন্তাজগতের প্রায় সকল অনুভূতিই স্পর্শ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্র সংগীতের মূল বৈশিষ্ট্য যে বাণী ও সুরের অঙ্গাঙ্গী মিলন—তাতে তিনি আমাদের এক পরম স্রষ্টায় সমীপবর্তী করে নৈকট্যসূচক সমন্বয় সৃষ্টির মাধ্যমে স্রষ্টাউপলব্ধির সেতুবন্ধন তৈরি করে দিয়েছেন। যেখানে ধর্মভাবনা থেকে বিযুক্ত হওয়ার সুযোগ নেই। রবীন্দ্রনাথের ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মভাবনার বিস্তার এত ব্যাপক এবং সূক্ষ্ম তা আমাদের একাগ্রতায় বিঘ্ন ঘটলে পথহারাবার সতর্কতা মনে করিয়ে দেয়। রহস্যের বিস্ময়বোধে জাগ্রত করে আমাদের মানসচৈতন্য। এই বিস্ময়বোধ নজরুল চেতনায় অতটা প্লাবিত নয়— নিগূঢ় অন্তঃরহস্য উন্মোচিত নয়—অনেকটা অকপট। এখানেই রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের ধর্মদেশনার দূরত্ব ও নৈকট্য। এ প্রসঙ্গে হুমায়ূন আজাদ মন্তব্য করেছেন:

‘রবীন্দ্রনাথ করতেন রহস্যকরণ, তিনি কোন প্রথাবদ্ধ ধর্মের গীতিকার ছিলেন না; তিনি তাঁর বিশ্বাসকে ছড়িয়ে দিতেন মহাজগতের সাথে। নজরুলে সেই রহস্যীকরণ নেই, তিনি স্থূলভাবে প্রকাশ করেছেন তাঁর বিশ্বাস বা উদ্দীপনা।’

হুমায়ূন আজাদ নজরুলের ধর্মদেশনায় যে-’স্থুল প্রকাশ’ দেখছেন, আমাদের উপলব্ধিতে তা অকপট প্রকাশ বলে মনে করি। কেননা কোরআন দর্শনেও মানুষের ধর্মানুভূতি সরল পথের সন্ধান ও সহজ চিন্তার পক্ষেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

বাঙালির হৃদয়-মানসে আবেগতাড়িত কালীবন্দনার আরেকটি গানের রচয়িতা অতুলকৃষ্ণ মিত্র (১৮৫৭-১৯১২)। আবেগময়ী গানটি হল-

মা, আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল
সকলই ফুরায়ে যায় মা
জনমের শোধ ডাকি গো তোরে
কোলে তুলে নিতে আয় মা।।

পৃথিবীর কেউ ভাল তো বাসে না
এ পৃথিবী ভালবাসিতে জানে না
যেথা আছে শুধু ভালবাসাবাসি
সেথা যেতে প্রাণ চায় মা।।

বড় দাগা পেয়ে বাসনা ত্যাজেছি
বড় জ্বালা সয়ে কামনা ভুলেছি
অনেক কেঁদেছি কাঁদিতে পারি না
বুক ফেটে ভেঙে যায় মা।।

১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত এ গানটি ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দে ‘মাধবী কঙ্কন’ নাটকে প্রথম গেয়েছিলেন লালচাঁদ বড়াল। বর্তমানে পান্নালাল ভট্টাচার্যের সুরে ও কণ্ঠে গানটি গীত হচ্ছে।

বাংলা গানের ‘পঞ্চপ্রধান’ গীতিকার

বাংলা গানের দিগন্ত বিস্তারী ও ঐশ্বর্য নির্মাণে রবীন্দ্র-নজরুলের সমসাময়িক আরো তিনজন সংগীতকারের নাম যথাক্রমে— দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩খ্রি.), রজনীকান্ত সেন (১৮৬৫-১৯১০খ্রি.) ও অতুলপ্রসাদ সেন (১৮৭১-১৯৩৪খ্রি.) এঁদের রচিত গান বাংলা সংগীত সাম্রাজ্যে এঁরা ‘পঞ্চপ্রধান’ কবি হিসেবে পরিচিত। এঁদের গানও প্রঞ্চপ্রধান নামে অভিহিত। এঁরা একাধারে গীতিকার এবং সুরকার— কিন্তু কেউই কারুর সঙ্গে তুলনীয় নন। সৃষ্টি স্বকীয়তায় এঁরা সবাই স্বাতন্ত্র্যে সমুজ্জ্বল।

দ্বিজেন্দ্রলাল রায় সংগীতেও দেখা যায় স্রষ্টা সমর্পণের আকুতি। মানব জীবনের প্রশান্তির পরিসমাপ্তি কল্পনায় ও চিরশান্তির আশ্রয় লাভের এক অমর বাসনা প্রকাশিত হয়েছে নিম্নোক্ত গানটিতে—

ঐ মহাসিন্ধুর ওপার থেকে কি সঙ্গীত ভেসে আসে? (২)
কে ডাকে কাতর প্রাণে, মধুর তানে? আয় চলে আয়
ওরে আয় চলে আয় আমার পাশে—
মহাসিন্ধুর ওপার থেকে কি সঙ্গীত ভেসে আসে?
বলে আয়রে ছুটে, আয়রে ত্বরা-
হেথা নাইকো মৃত্যু, নাইকো জরা (২)
হেথা বাতাস গীতি-গন্ধভরা চির-স্নিগ্ধ মধুমাসে
হেথা চির-শ্যামল বসুন্ধরা চির-জ্যোৎস্না নীল আকাশে
মহাসিন্ধুর ওপার থেকে কি সঙ্গীত ভেসে আসে?
কেন ভুতের বোঝা বহিস পিছে?
ভুতের বেগার খেটে মরিস মিছে?
দেখ ঐ সুধাসিন্ধু উথলিছে পূর্ণ ইন্দু পরকাশে
ভুতের বোঝা ফেলে ঘরের ছেলে আয় চলে আয় আমার পাশে
মহাসিন্ধুর ওপার থেকে কি সঙ্গীত ভেসে আসে?
কেন কারা গৃহে আছিস বন্ধ?
ওরে, ওরে মূঢ়, ওরে অন্ধ (২)
ভবে সেই সে পরমানন্দ, যে আমারে ভালবাসে
কেন ঘরের ছেলে পরের কাছে পড়ে আছিস পরবাসে?
মহাসিন্ধুর ওপার থেকে কি সঙ্গীত ভেসে আসে?
ঐ মহাসিন্ধুর ওপার থেকে…

গানটিতে জগৎ সংসারকে ‘পরবাস’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাই জগতের মোহমায়া সরিয়ে এই ‘কারাগৃহ’ থেকে মুক্তিলাভের যে আহবান জানানো হয়েছে— তাকে উপেক্ষা করে কোন ধার্মিকের নির্লিপ্ত থাকা অসম্ভব। শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের খুব প্রিয় ছিল গানটি। শিল্পী মান্না দে’র কণ্ঠে যখন এই গানটি ধ্বনিত হয়— তখন আমরাও কি নির্লিপ্ত থাকতে পারি?

ভক্তিমূলক গানের আরেক স্রষ্টা রজনীকান্ত সেন। তাঁর স্রষ্টার সান্নিধ্য ও কৃপালাভের অভিপ্রায় ব্যক্ত হয়েছে এভাবে—

আমি অকৃতি অধম বলেও তো কিছু কম করে মোরে দাওনি
যা দিয়েছ তার অযোগ্য ভাবিয়া কেড়েও তো কিছু নাওনি।।

তব আশিস কুসুম ধরি নাই শিরে
পায়ে দলে গেছি দেখি নাই ফিরে
তবু দয়া করে কেবলি দিয়েছ, প্রতিদান কিছু চাওনি।।

আমি ছুটিয়া বেড়াই জানি না কি আশে
সুধা পান করে মরি গো পিয়াসে
তবু যাহা চাই সকলি পেয়েছি, তুমি তো কিছুই পাওনি।।

আমায় রাখিতে চাহ গো বাঁধনে আটিয়া
যতবার যাই বাঁধন কাটিয়া
ভাবি, ছেড়ে গেছ ফিরে চেয়ে দেখি, এক পা-ও ছেড়ে যাওনি।।

স্কুলপাঠ্য অন্তর্ভুক্ত রজনীকান্ত সেনের একটি স্মরণীয় প্রার্থনা সংগীত হল-

তুমি, নির্মল কর, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে।।
তব, পূণ্য-কিরণ দিয়ে যাক্, মোর মোহ-কালিমা ঘুচায়ে।
মলিন মর্ম মুছায়ে।
তুমি, নির্মল কর, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে।
লক্ষ্য-শূন্য লক্ষ বাসনা ছুটিছে গভীর আঁধারে,
জানি না কখন ডুবে যাবে কোন্ অকুল-গরল-পাথারে!
প্রভু, বিশ্ব-বিপদহন্তা, তুমি দাঁড়াও, রুধিয়া পন্থা;
তব, শ্রীচরণ তলে নিয়ে এস, মোর মত্ত-বাসনা গুছায়ে!
মলিন মর্ম মুছায়ে।
তুমি, নির্মল কর, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে।
আছ, অনল-অনিলে, চিরনভোনীলে, ভূধরসলিলে,
গহনে; আছ, বিটপীলতায়, জলদের গায়, শশীতারকায় তপনে।
আমি, নয়নে বসন বাঁধিয়া, ব’সে, আঁধারে মরিগো।

তাঁর নীতিকবিতা সংকলন সদ্ভাবকুসুম (১৯১৩) বাংলা সাহিত্যে একটি স্মরণীয় কাব্যগ্রন্থ। বাণী ও কল্যাণী রজনীকান্তের বিশিষ্ট গানের সঞ্চয়ন।

স্বদেশী সংগীতের পাশাপাশি ভক্তিগীতির অমর স্রষ্টা অতুলপ্রসাদ সেন। তিনিও স্রষ্টার করুণা ভিক্ষায় লেখেন—

যদি দুঃখের লাগি গড়েছ আমায় সুখ আমি নাহি চাই,
শুধু আঁধারের মাঝে হাতখানি তব খুঁজিয়া যেন পাই।।

যদি নয়নের জল না পার মোছাতে
যদি পরানের ব্যথা না পার ঘোচাতে
তবে আছ কাছে হে মোর সাথী কহিও আমারে তাই।।

যদি হৃদয়ের প্রেম নাহি চাহে কেহ
পাই অবহেলা নাই পাই সেহ
তবে দিয়েছিলে যাহা হে মোর বিধাতা ফিরিয়া লও হে তাই।।

যদি না পারি পুরাতে মনের কামনা
যায় হে বিফলে সকল সাধনা
যেন এ দীন জীবনে হে দীনের বিধি তোমারে নাহি হারাই।।

মোদের গর্ব মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা’-এই অমর পঙ্ক্তির রচয়িতা অতুলপ্রসাদ সেনের গানে যেমন আছে স্বদেশ বন্দনা, তেমনি আছে ভক্তির ব্যঞ্জনা ও প্রেমের নান্দনিক বর্ণনা। সর্বোপরি স্রষ্টায় সমর্পণও তাঁর গানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

গোলাম মোস্তফার গানে ধর্মদেশনা

বাংলাভাষায় হামদ-না’ত ও ইসলামি সংগীত রচয়িতা হিসেবে কবি গোলাম মোস্তফা (১৮৭৯-১৯৬৪) অপ্রতিদ্বন্দ্বী স্রষ্টা। বিশ্বনবী (১৯৪২) প্রণেতা হিসেবে খ্যাত কবি গোলাম মোস্তফা বাংলাভাষার অনৈসলামিক অনুষজ্ঞ দূর করার প্রয়াসে শুধু ইসলামি ঐতিহ্যের গর্ব গৌরবমণ্ডিত সাহিত্য কর্মে নিবিষ্ট থাকেন। কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য-কর্ম হিন্দু-পুরাণ নির্ভর বিধায় তা মুসলিম ঐতিহ্যের বিরোধী বলে তা তিনি প্রত্যাখ্যান করে নজরুল সাহিত্যের ‘অবাঞ্চিত’ অংশের সমালোচনা করেন। গোলাম মোস্তফা পাকিস্তান আন্দোলনের পটভূমিকায় প্রচুর ইসলামি ও দেশাত্ববোধক সংগীত রচনা করেন। তিনি গীতিসঞ্চয়ন (১৯৬৮) গ্রন্থে এগুলি সংকলিত আছে। বহুল পঠিত তাঁর একটি কবিতা—

অনন্ত অসীম প্রেমময় তুমি বিচার দিনের স্বামী
যত গুণগান হে চির মহান, তোমারই হে অন্তর্যামী।।
ভূলোকে গোলোকে সবারে ছাড়িয়া
তোমারই চরণে পড়ি লুটাইয়া
তোমারই সকাশে যাচি হে শকতি, তোমারই করুণাকামী।।

সহজ সঠিক পুণ্যপন্থা মোদেরে দাও গো বলি
চালাও সে পথে যে পথে তোমার প্রিয়জন গেছে চলি।

যে পথে তোমার চির অভিশাপ
যে পথে ভ্রান্তি চির মনস্তাপ
হে মহাচালক, মোদেরে কখনো করো না সে পথগামী।।

কুরআন শরীফের উদ্বোধনী সুরা ফাতিহার সারমর্ম অনুসৃত উল্লিখিত এ কবিতাটি দীর্ঘদিন স্কুলপাঠ্য ছিল। এটি নাত হিসেবেও পরিবেশিত হয়।

কবি আজিজুর রহমানের গানে ধর্মদেশনা

ইসলামি ঐতিহ্য উপস্থাপনভিত্তিক মানব মনে ধর্মচেতনা জাগ্রত করার অসাধারণ গীতিকার হিসেবে কবি আজিজুর রহমান (১৯১৭-১৯৭৮) বিশেষ খ্যাতিমান। তাঁর ধর্মচেতনার অন্যতম একটি গান হল-

কারো মনে তুমি দিও না আঘাত
সে আঘাত লাগে কাবার ঘরে
মানুষেরে তুমি যত কর ঘৃণা
খোদা যান তত দূরে সরে।।
একটি মানুষে খুশি করা আর
হজ্জ করে আসা হাজার বার
কী হবে তাহার খোদার দিদার
দোযখ হারাম তার তরে।।

ব্যথিত বুকের হাহাকার আর অশ্রু চোখের
ফুল ঝরে যায় পানি সে শুকায় বেহেস্তের
টলমল করে খোদার আরশ,
ব্যথিত যখন রোদন করে।।

তুমি কি চিনেছ তোমার খোদায়
মসজিদে আর নামাজ রোজায়
হায় মূঢ়, খোদা হৃদয়-কাবায়
সব মানুষেরই অন্তরে।।

কবি আজিজুর রহমানের আরেকটি গান-

নামাজী, তোর নামাজ হলো যে ভুল
মসজিদে তুই রাখলি সিজদা ছাড়ি ঈমানের মূল।।

জামাতে শামিল হয়ে নামাজের
আওড়ালি মুখে সুরা কোরানের
ভাবলি কি তুই পার হয়ে গেলি পুলসিরাতের পুল।।
আজি মিলন-তিথি বাঁধ রে কাতার মনের জায়নামাজে
আরাফাতে তোর নুইয়ে দিল নাফরমানী লাজে।।

ওজু করে শেষ তাওবা নীরে
তাহরিমা বাঁধ ভীরু নত শিরে
বন্দেগী তোর হবে রে মকবুল, কেয়ামতে পাবি কূল।।

শিল্পী আব্বাস উদ্দীনের কণ্ঠে ষাটের দশক থেকেই উল্লিখিত সংগীত দুটি এখনো শ্রোতার মানবতাবোধকে জাগ্রত করে, সতর্ক করে দেয় ঈমানের প্রকৃত অংগীকার।

মনোমোহন দত্তের গানে ধর্মদেশনা

বাঙালির ধর্মদেশনায় সর্বধর্মীয় সমন্বয়ী চিন্তা জগতে একটি উল্লেখযোগ্য নাম সংগীতকার কবি মনোমোহন দত্ত (১৮৭৮-১৯১০খ্রি.)। তাঁর গানেও পাওয়া যায় হিন্দু-মুসলমান উভয় ঐতিহ্যের সহঅবস্থান। এই সহঅবস্থানে বিশ্বাসী একটি গান এরকম—

চাই না বেহেস্ত চাই না দোযগ
আমি চাই শুধু তোমারে
আমি কে তুমি কে তুমি কে আমি কে
প্রেম কর সদা অন্তরে।।

আমারে বানাইয়া কোথা হতে এলেম
আমি-তুমি মাঝে কোথা আছ তুমি
কোথা যাব আমি তফাত কি বা আছে
রফা করে দাও একেবারে।।

চাহি না পাপ-পুণ্য, কি জন্য হয়েছ
ঘুচায়ে দাও সন্দ চাহি না ভালমন্দ
তুমি এত ছন্দ হৃদয়ে আনন্দ
দিয়ে প্রেমানন্দ ভরে।।

সদা তুমি আমায় আমি চাই তোমারে
হৃদে বেঁধে রাখি বল দাও প্রাণে
ভক্তির বন্ধনে প্রাণ ভরে দেখি
অখণ্ড মণ্ডলাকারে।।

আফতাব উদ্দীনের সুরে গীত এরকম আরও অনেক গান রয়েছে তাঁর। মলয়া, পথিক, পাথেয়, ময়না ইত্যাদি তাঁর অন্যতম সংগীত গ্রন্থ।

লোককবি আব্দুল হালিমের গানে ধর্মদেশনা

বাংলাদেশের লোক সংগীতের প্রবাদপুরুষ আব্দুল হালিম মিয়া। সংগীতকে তিনি ধর্মসংগীতে পরিণত করে মানবতার মুক্তির পথ আবিষ্কার করেছেন। তাঁর আধ্যাত্মিক গানে মানুষের আত্মিক স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্তের স্বীকৃতি মেলে। তাঁর সৃষ্ট গানের বিষয়বস্তু বহুবিচিত্র। ধর্মীয় সংগীত হামদ, নাত, তত্ত্বীয় সংগীত, সৃষ্টিতত্ত্ব, সুফিতত্ত্ব, মেরাজতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, লোকতত্ত্ব, মারফতী, মুর্শিদী, ভক্তিমূলক অসংখ্য গানের স্রষ্টা এই লোক কবি। লোক সংগীতের একটি বিশেষ ধারা ‘বিচার গান’ তাঁরই এক অভিনব সৃষ্টি। সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কিত গানের রচয়িতা হিসেবে আব্দুল হালিম মিয়া একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী গীতিকার। বাংলাদেশ বেতার-বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ, চলচ্চিত্র, গ্রামোফোন রেকর্ড প্রভৃতি গণমাধ্যম ও অন্যান্য জাতীয় প্রতিষ্ঠানে তাঁর পরিবেশিত সৃষ্টিতত্ত্বের গান স্মরণীয় হয়ে আছে। স্রষ্টার পরিচয় এবং মানব জন্মতত্ত্ব রহস্য উন্মোচিত তাঁর দুটি গানের দৃষ্টান্ত :

আল্লাহ্ তুমি অদ্বিতীয় অসীম অনন্ত…।।
অনাদির আদি তুমি তোমার লীলার নাই অন্ত………।।

পিতা যেমন পুত্রের তরে জন্ম দেয় মাতৃ উদরে
মিলনে শান্ত
(তুমি) সেরূপ করেও দাও নাই জন্ম (তোমার) কুদরতে দিগদিগন্ত…।।

পিতৃবীর্যে মাতৃগর্ভে সন্তান যেমন জন্মে ভবে
হইয়া জ্যান্ত
(তুমি) সেই রূপে না জন্ম নিলে অসীম লীলা অফুরন্ত…।।
আহাদে আহাদ তুমি নাহি পিতা নাই জননী
নহে ঘুমন্ত
হালিম বলে মানুষ হইয়া খুঁজি জন্ম জন্মান্ত…।।

আরেকটি গানে এই লোক কবি সৃষ্টির মূল রহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়েছেন—

কিসে তৈয়ার প্রোটোপ্লাজম…।।
(মালিক) যাঁরে দিছে সে জেনেছে কোথায় ছিল আগম নিগম…।।

সৃষ্টির মূলে কিবা ছিল পরমাণু কারে বল
কোথা হতে এসে ছিল নোৎফার মাঝে কীট অনুপম…।।

নর নারী সূক্ষ্ম দেহ কোথায় ছিল কয়না
আসা যাওয়া অহরহ কেহ ঘটিতেছে হর দমে দম… ।।

প্রাকৃতিক নিয়মেতে পরিবর্তন হতে হতে
অনন্ত অসীমের পথে হালিম বলে এইতো জনম…।।

বাংলা লোকগানের অবিস্মরণীয় অনেক বাণীস্রষ্টা বাঙালির ধর্মচেতনা নিত্য অনুপ্রাণিত করে আসছেন। বাঙালির লোকগানে রাধারমন দত্ত, মনোমোহন দত্ত, কবি পাগলা কানাই, ভবাপাগলা, বিজয় সরকার, রমেশ শীলসহ রয়েছে অনেক স্মরণীয় নাম।

আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী অনেক জনপ্রিয় গানের রচয়িতা গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার। স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে অকৃতজ্ঞদের পক্ষে মার্জনা ভিক্ষা করে তিনি লিখেছেন—

মঙ্গল দীপ জ্বেলে
অন্ধকারে দু’চোখ আলোয় ভরো প্রভু
তবু যারা বিশ্বাস করে না তুমি আছো
তাদের মার্জনা করো প্রভু।।

যে তুমি আলো দিতে প্রতিদিন সূর্য ওঠাও
ওদের বুঝিয়ে সেই তুমি পাথরেও ফুল যে ফোটাও
জীবন মরুতে করুণা ধারায় ঝরো প্রভু।।

বল তার কি অপরাধ জন্ম হয়েছে পাঁকে
তোমার ক্ষমা দিয়ে তুমি ফোটাও পদ্ম করে তাকে
ভুল পথে গেলে তুমি এসে হাত ধরো প্রভু।।

বাপ্পি লাহিড়ীর সুরারোপিত উপরোক্ত গানটি বাপ্পি লাহিড়ী ও লতা মঙ্গেশকারের কণ্ঠে প্রতিদান (১৯৮৩) ছবিতে জনপ্রিয়তা পায়।

আমরা জানি, সংগীত শুধু স্রষ্টানুভূতি প্রকাশে কিংবা ব্যথা-বেদনা তিরোহিতের প্রতিবিধানে বাঙ্ময় হওয়া ব্যতিরেকেও সংগীত অন্যায়ের প্রতিবাদে, অধিকার আদায়ে, নির্যাতিতের স্বপক্ষে— সর্বোপরি মানব বিপর্যয়ের সকল ক্ষেত্রে সংগীত এক অমোঘ অস্ত্র। বৈশ্বিক বলয়ে এ-রকম একটি জনপ্রিয় গান—

We shall Overcome, we shall overcome someday;
Oh! Deep in my heart, I do believe,
We shall overcome someday ।

আমেরিকার নিগ্রো জাতির জনগণকে সে দেশের শ্বেতাঙ্গদের অন্ধ-জাত্যাভিমানের জাতাকলে পিষ্ট নিগৃহীত মানুষেরা কীভাবে জেগে উঠেছিল— তার তীব্র প্রতিবাদের ইতিহাস অগ্নিস্নাত হয়ে আছে এই সংগীতে।

খ্রিষ্টধর্মের প্রটেস্টান্ট শাখার প্রবর্তক মার্টিন লুথার বলেছেন, সৃষ্টিকর্তার নিকট থেকে আমরা যেসব শ্রেষ্ঠ উপহার লাভ করেছি সংগীত সেগুলোর অন্যতম। সংগীতের আবেদন স্বর্গীয়— তাই শয়তানই এর শত্রু। শুধু শয়তান নয়— সৃজনবিরোধী সকল অশুভ শক্তি বিনাশেও সংগীত সুধা স্বর্গীয় শক্তির এক মহোত্তম মানবীয় অনুভূতি। এই বিশ্ব চরাচরে সকল বিধ্বংসী বিনাশে সংগীতের শক্তি অবিনাশী। তাই মানুষের জীবনে সংগীত এক মহা শক্তিধর শিল্পকলা। সংগীতের অসাধারণ শক্তিধর ক্ষমতা অনেক সময় মানুষকে অতিলৌকিক বিশ্বাসের দিকেও ঠেলে দিয়েছে। গ্রিক পুরাকাহিনীতে উল্লেখ আছে অরফিউসের (orpheus) নিখুঁত লয়ার (Lyre) বাদনে পশু-পাখিরা তো বশ মানতোই, এমনকি গাছপালাও নুয়ে অরফিউসের সংগীতের প্রতি শ্রদ্ধাবনত হত। সম্রাট আকবরের সভাগায়ক তানসেন গান গেয়ে বৃষ্টি নামাতে পারতেন— এ জনশ্রুতি সবার জানা। বাঁশির সুরের আকর্ষণে সাপ গর্ত থেকে এমনকি দূর অবস্থান থেকেও বাদকের দিকে ছুটে আসে এ লোকবিশ্বাস সর্বকালেই পরিব্যাপ্ত। সংগীতের ক্ষমতার অলৌকিকত্বের প্রতি লোকবিশ্বাসের ফলেই মন্ত্র এবং ঝাড়ফুঁকে ভূত-প্রেত প্রভৃতি অশুভ শক্তির বিনাশে বিশ্বাস করে মানুষ।

তবে সংগীতের সুরকে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে সেতুবন্ধনে এক ঐশ্বরিক অনুভূতির অংশীদার করেছেন মাওলানা জালালউদ্দীন রুমি। তাঁর মসনবী দর্শনে এই অভিমত ব্যক্ত হয়েছে যে, মানবাত্মা ও পরমাত্মা মূলত একই। শুধুমাত্র সৃষ্টির প্রবহমান ধারায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে দুই স্বত্ত্বা। জড়দেহ তার পূর্ব ইতিহাস বিস্মৃত। সংসার, ব্যাধি, ক্ষুধা চারদিকে বেষ্টনী করে রেখেছে। কিন্তু সৃষ্টির স্বভাবগত আকর্ষণ তার উৎসের দিকে। তাই রুমি বলছেন-

শোনো বাঁশরী (মানবাত্মা) তার বেদনায় কি গান গায়।
যেই বেনুবন থেকে তাকে চ্যুত করা হয়েছে, সেই বনের
বিরহে সে কাঁদে। আর সমবেদনার সুরে কাঁদে সকল নরনারী।

দার্শনিক আবু নাসের আল ফারাবি জানিয়েছেন কিভাবে স্পন্দন বা আন্দোলন বা Vibration-এর পর্যায়ে পেরিয়ে গ্রহ গ্রহান্তরের সংগীত আমাদের জীবনে প্রবেশাধিকার পায়। পিথাগোরাসের মতে আসমানী গোলকের মধ্যেই এই ‘কুবরাতে ফলকী’ বা অনুভূতির রঙের প্রকাশ। কোরআন শরীফে আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ রঙের কথা বলেছেন। সেই রঙেরই শ্রুত অশ্ৰুত বিকাশ চন্দ্রসূর্যসহ সাতটি গ্রহের আবর্তনে সৃষ্ট সংগীত।

আলোচ্য অধ্যায়টির আলোচনায় পূর্ণতা আনায়ন কিংবা পরিতৃপ্তির প্রত্যাশা সম্ভব নয়। কেননা এ বিষয়ে একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ প্রণয়ন করা হলেও আর এর পরিধি পূর্ণতা পেলেও আলোচনার পূর্ণতা প্রাপ্তি এক দুঃসাধ্য ব্যাপার- যা বিষয় বৈচিত্র অনুসারে স্বতন্ত্র গ্রন্থে বিন্যস্ত করা হলেও থেকে যাবে অতৃপ্তির বেদনা। কেননা বাঙালির জনজীবনে ও মানসচেতনায় ধর্মের মর্মবাণী লোকসংস্কৃতিতেই প্রতিফলিত হয়েছে সর্বাধিক। বাঙালি মননের আধ্যাত্মিক চেতনা উপলব্ধি করতে হলে বাংলার লোককবিদের সৃষ্ট ও উপলব্ধিজাত সর্বমানবিকবোধের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হবে। বাংলা গানের পঞ্চপ্রধান কবির রচনা ছাড়াও বাংলাগান তাঁর বিষয় বৈচিত্র্যে যেমন সমুজ্জ্বল তেমন এর অধ্যাত্মচেতনার বৈশিষ্ট্যও বিশ্বদরবারে সম্মানীয়ভাবে সমাদৃত। সংগীতে সর্বমানবিকবোধের দার্শনিক প্রকাশের সাফল্যে রবীন্দ্রনাথ সংগীতেই হয়েছেন নোবেলজয়ী। সংগীতেই তিনি তাঁর অধ্যাত্মচিন্তা ব্যক্ত করতে সফলতা পেয়েছেন। এই জনপদে জালাল উদ্দীন, লালন শাহ, হাছন রাজা, বিজয় সরকারসহ অসংখ্য লোককবির গানে স্রষ্টা ও সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে যে সব মানবিকবোধে বিকশিত হয়েছে তা বিশ্বসাহিত্যে বিরল। বাংলার লোক সাহিত্য ও লোক সংস্কৃতিই বাঙালির ঐশ্বর্যের উৎকৃষ্ট ধন, মানবিক চিন্তার মৌলিক নির্যাস! সাধারণ্যে ধর্মচিন্তাকে সর্বমানবিক বোধে বিকশিত করার ক্ষেত্রে এঁদের অবদান অপরিসীম।

নির্বাচিত গ্রন্থপঞ্জি

J.T. Shipley, Dictionary of World Literature; New York, 1943

আশুতোষ ভট্টাচার্য, মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস; কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৭২

মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, কবিকঙ্কনচণ্ডী (প্রথম ভাগ—শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিশ্বপতি চৌধুরী সম্পাদিত), কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, পুনর্মুদ্রণ, ১৯৭৮

মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, চণ্ডীকাব্য; (শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত), কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৫২

জয়ানন্দ, চৈতন্যমঙ্গল (নগেন্দ্রনাথ বসু সম্পাদিত), বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, কলকাতা, ১৩১২ বঙ্গাব্দ

দ্বিজবংশী দাস, মনসামঙ্গল (দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদিত), কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯২৩

রামাই পণ্ডিত, শূন্য পুরাণ (নগেন্দ্রনাথ বসু সম্পাদিত), বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, ১৩১৪ বঙ্গাব্দ

বিপ্রদাস, মনসা বিজয় (সুকুমার সেন সম্পাদিত), এশিয়াটিক সোসাইটি, কলকাতা, ১৯৫৩

রামেশ্বর ভট্টাচার্য, শিব সংকীর্তন বা শিবায়ন (যোগীলাল হালদার সম্পাদিত), কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৫৭

কৃষ্ণদাস কবিরাজ, শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত (শশিভূষণ দাশগুপ্ত সম্পাদিত), কালনা, হুগলি, ১৯৩৭

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সংগীত চিন্তা; বিশ্বভারতী, শান্তি নিকেতন, ১৪০০ বঙ্গাব্দ।

মতুয়া মহাসংঘ (সম্পা.) মতুয়া সংগীত; ওড়াকান্দি, গোপালগঞ্জ, ১৯৯৭

আনোয়ার হোসেন ফকির, লালন-সঙ্গীত; লালন মাজার শরীফ ও সেবাসদন কমিটি ছেঁউড়িয়া, কুষ্টিয়া, ২০০৬

গোপিকা রঞ্জন চক্রবর্তী, ভবাপাগলার জীবন ও গান; বাংলা একাডেমী; প্র.প্র. ১৯৯৫

সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী, গাউসুল আজম মাইজভাণ্ডারীর জীবন ও কেরামত; মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফ, চট্টগ্রাম, ২০০৭

ওয়াকিল আহমদ, মাইজভাণ্ডারি গান; গতিধারা, ঢাকা, ২০০১

শ্যামলী চক্রবর্তী, বঙ্কিমচন্দ্রের শিল্প ও সংগীত জগৎ; অক্ষর প্রকাশনী, কলকাতা, 2008

মুহম্মদ আবদুল হাই ও আনোয়ার পাশা (সম্পাদিত), ‘কালকেতু উপাখ্যান; স্টুডেন্ট ওয়েজ, ঢাকা, অষ্টম সংস্করণ, ২০১৭

করুণাময় গোস্বামী, সংগীত কোষ; পু. মু. বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ২০১৩

মোবারক হোসেন খান, সংগীত মালিকা; পু, সু. বাংলা একাডেমী, ২০০৩

ফজল-এ-খোদা, সংগীত ভাবনা; বাংলা একাডেমী, ২০১২

আমিনুর রহমান সুলতান (সং. ও সম্পা.) উপেন্দ্ৰ সংগীত; বাংলা একাডেমী, ২০১১

ওমর ফারুক, উচ্চাঙ্গ সংগীত; বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ২০০১

আবদুল ওয়াহাব, বাংলাদেশের লোকগীতি : একটি সমাজতাত্ত্বিক অধ্যয়ন; বাংলা একাডেমী, প্র.প্র. ২০০৭

মায়া রায়, নজরুল সংগীতের বৈচিত্র্য ও বিপন্নতা; ভাষা, আগরতলা, ত্রিপুরা, ২০০৮

মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান, বাংলা গান বিবিধ প্রসঙ্গ; হাওলাদার প্রকাশনী, ঢাকা, দ্বি সং. ২০১৩

আহসান হাবিব আসলাম (সং ও সম্পা.) সুরের ইন্দ্রধনু; (শতবর্ষের কালজয়ী বাংলা গান-১৯০০-২০১১) রোদেলা, ঢাকা, প্র. প্র. ২০১২

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *