১৪. ধর্মে মানবতা ও মানবিক চেতনা

চতুর্দশ অধ্যায় – ধর্মে মানবতা ও মানবিক চেতনা (Humanity in Religion and Humanitarian Consciousness)

মানব হিতৈষণার শ্রেষ্ঠ বৈশিষ্ট্য

স্রষ্টাকে পাওয়ার প্রত্যাশায় সৃষ্টিকে ভালবাসা একটি উত্তম মানবিক চেতনা। তবে এর চেয়েও উত্তম চেতনা হল ইহজাগতিক ও পারলৌকিক প্রলোভনমুক্ত মানবতা। গীতা দর্শন অনুযায়ী সকল কামনা বাসনা ত্যাগ করে যে কর্ম সম্পূর্ণ নির্লোভ- নিঃস্বার্থভাবে শুধু সৃষ্টিরক্ষার স্বার্থে সমর্পিত হয় সেই কর্মই শ্রেষ্ঠ কর্ম। শ্রেষ্ঠ মানব হিতৈষণা। পরার্থে ত্যাগই প্রকৃত ত্যাগ। প্রচারমুখী ত্যাগে প্রাপকের সামান্য কল্যাণ সাধিত হলেও তা মানবতার মর্যাদাভুক্ত নয়। পরার্থে ত্যাগের বৈশিষ্ট্য কি? কবি রজনীকান্ত সেন (১৮৬৫-১৯১০) তাঁর একটি কবিতায় এ-বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন এভাবে :

নদী কভু পান নাহি করে নিজ জল,
তরুগণ নাহি খায় নিজ নিজ ফল;
গাভী কভু পান নাহি করে নিজ দুগ্ধ পান,
কাষ্ঠ দগ্ধ হয়ে করে পরে অন্ন দান,
স্বর্ণ করে নিজ রূপে অপরে শোভিত,
বংশী করে নিজ স্বরে অপরে মোহিত,
শষ্য জন্মাইয়া নাহি খায় জলধরে,
সাধুর ঐশ্বর্য শুধু পরহিত তরে।

হ্যাঁ, সাধু ও সত্যবানের ঐশ্বর্য হল পরহিত কর্মে নিজেকে নিঃস্বার্থ উৎসর্গ করা।

ইংরেজ কবি রবার্ট হেরিক মানব জীবনের ক্ষণস্থায়ীত্ব বোঝানোর জন্য একে শিশিরবিন্দু ও ড্যাফোডিল ফুলের সঙ্গে তুলনা করেছেন। সকাল বেলা শিশির বিন্দু ঘাসের পাতা প্রভাত সূর্যের নবীন আলোয় ঝলমল করে কিন্তু দুপুর গড়াতে না গড়াতেই শুকিয়ে যায়। যে শিশির বিন্দু ঝরে পড়ে তা চিরকালের জন্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ক্ষণস্থায়ী শিশির বিন্দু ও ড্যাফোডিলের তুলনায় মানুষের জীবন দীর্ঘই মনে হতে পারে কিন্তু আদি অন্তহীন মহাকালের পটভূমিতে মানুষের জীবন একটা মুহূর্ত মাত্ৰ।

বাইবেলের তথ্য অনুয়ায়ী প্রথম মানব আদমের সৃষ্টি এখন থেকে ৬ হাজার বছর আগে। কিন্তু মানুষের সৃষ্টি তো এর অনেক আগে। মিশর ও দক্ষিণ আমেরিকার পার্বত্য অঞ্চলে যে মমি পাওয়া গেছে তার বয়স প্রায় ৮/২০ হাজার বছর। ইউরোপের বিভিন্ন পর্বত গুহায় অংকিত চিত্র ও মানুষের ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ১০/১৫ হাজার বছরের পুরনো। আদিম মানব নুড়ি পাথর কুড়িয়ে ব্যবহার ও পাথর ভেঙ্গে অস্ত্র তৈরি করতে শুরু করেছিল ৫/৬ লক্ষ বছর আগে। জাভা মানব ৫ থেকে ১০ লক্ষ হাইডেলবার্গ (জার্মানী) মানব ৫ লক্ষ বছর, নিয়ানডার-থাল মানব ১ থেকে ৪ লক্ষ বছর, ক্রোম্যানগনন মানব ৪০/৫০ হাজার বছর আগে পৃথিবীতে বাস করত। অতএব দেখা যাচ্ছে এই পৃথিবীতে অসংখ্য কোটি মানুষ এসেছে এবং চলে গেছে, কোথায় তা কেউ জানে না। মানুষের এই মহামিছিল হয়ত চলতে থাকবে আরও কয়েক লক্ষ বা কোটি বছর ধরে। তারপর একদিন এই মিছিল এসেছে এবং চলে গেছে, কোথায় তা কেউ জানে না। মানুষের এই মহামিছিল বন্ধ হয়ে যাবে, পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে এবং সূর্যও যাবে নিভে। সুতরাং এ মহাবিশ্বে একজন ব্যক্তি মানুষ মহাসমুদ্রের এক বিন্দু জল ছাড়া আর কি এবং তার জীবনকাল চোখের পলক মাত্র। মৃত্যুকে যদি সীমারেখা ধরা যায় তাহলে রেখার এপাশে আমরা কয়েকশ কোটি মানুষ অবিরাম সংগ্রাম করে চলেছি অর্থবিত্ত মানসম্মান খ্যাতির জন্য। আর ওপারের বিশাল সংখ্যক মানুষ কোথায় কী করছে তা আমাদের জানা নেই। সত্যিই কি তারা কোথাও আছে না সম্পূর্ণ রূপে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে? কেউ বলে পুনরুত্থান, তারপর মহাবিচার ও স্বর্গনরক। কিন্তু এই স্বর্গনরক কোথায়? মানুষের জ্ঞান যখন সীমিত ছিল তখন তারা বলত হিমালয় ও মাউন্ট অলিমপাসের উপরে। কিন্তু এখন আর বলা যাবে না পৃথিবী ছাড়া সৌরজগতের অন্য কোন গ্রহে প্রাণী নাই সম্ভবও নয়। তাহলে কি অন্য কোন সৌরজগতে? সেতো কয়েক হাজার আলোকবর্ষ দূরে। আবার কেউ বলে ওসব কিছুই না- একেবারে মহানিদ্রা, টোটাল এনাইহিলেশন। মানুষ যে মৃত্যুকে ভয় করে তা এই অজানার জন্যই।

আল্লাহ একবার হজরত মুসাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন ‘মুসা তুমি আমার জন্য কী করছ?’ মুসা জবাব দিয়েছিলেন, আমি তো দিনরাত আপনার ইবাদত বন্দেগী করি।’ আল্লাহ বললেন ওসব তুমি কর পরকালে বেহেশতের আশায় তাই এগুলি তো তোমার নিজের কাজ। মানুষের জন্য যা করবে সেটাই তো আমার কাজ। পারস্যের কবি ওমর খৈয়ম (১০৪৮-১১২৫ খ্রি.) তাঁর এক রুবাইতে বলেছেন : দোজখের ভয়ে আর স্বর্গের লালসায় যে ইবাদত-বন্দেগী করে বস্তুত সে ভুলই করে।’

এ প্রসঙ্গে ষাটের দশকে স্কুলপাঠ্যে অন্তর্ভুক্ত ইংরেজ কবি লেই হান্ট (Leigh Hunt, 1784-1859) রচিত Abou Ben Adhem নামে কবিতাটির স্মরণ নিতে চাই:

Abou Ben Adhem

By Leigh Hunt

Abou Ben Adhem (may his tribe increase!)
A woke one night from a deep dream of peace,
And saw, within the moonlight in his room,
Making it rich, and like a lily in bloom,
An angel writing in a book of gold:-
Exceeding peace had made Ben Adhem bold,
And to the presence in the room he said,
‘What writest thou?’- The vision raised its head,
And with a look made of all sweet accord,
Answered, ‘The names of those who love the Lord’
‘And is mine one?’ said Abou. ‘Nay, not so,’
Replied the angel. Abou spoke more low,
But cheerly still; and said, ‘I pray thee, then,
Write me as one that loves his fellow men.’
The angel wrote, and vanished. The next night,
It came again with a great wakening light,
And showed the names whom love of God had blest,
And lo! Ben Abhem’s name led all the rest.

কবিতাটির অনুকথা এরূপ : প্রাচীনকালে আবু-বেন-আদম নামে একজন সৎলোক ছিল। একদিন রাতে সে তার ঘরে ঘুমিয়ে ছিল, হঠাৎ একটা মৃদু শব্দে তার ঘুম ভেঙে গেল। জেগে উঠে সে দেখল চাঁদের আলোয় তার ঘর ভরে গেছে এবং সেই আলোতে বসে এক জ্যোতির্ময় পুরুষ সোনার খাতায় মনোযোগ দিয়ে কী যেন লিখছে। আৰু সৎলোক তাই তার মনে কোন ভয় ছিল না। সে নির্ভয়ে জিজ্ঞাসা করল ‘আপনি এত মনোযোগ দিয়ে কী লিখেছেন?’ জ্যোতির্ময় পুরুষটি জবাব দিল ‘যারা আল্লাহকে ভালবাসে আমি তাদের নামের একটা তালিকা করছি।’ আমার নামটি আপনি লিখেছেন কি?’ আবু আবার জিজ্ঞাসা করল। জ্যোতির্ময় আগন্তুক তালিকাটি খুঁজে দেখে জবাব দিল, না তোমার নাম আমার তালিকায় নেই।’ তখন আবু বলল, ‘তাহলে আপনি আপনার পুস্তকে লিখুন আবু মানুষকে ভালবাসে।’

আগন্তুক তাই করল এবং অদৃশ্য হয়ে গেল। পরদিন রাতে আবার একটা শব্দে আবুর ঘুম ভেঙ্গে গেল। আবার সেই জ্যোতির্ময় পুরুষ এবং তার হাতে সেই সোনালী বই। আগন্তুক বইটি খুলে দেখাল এবং আবু দেখতে পেল তার নামটিই সকল আল্লাহ ভক্তের শীর্ষে বিরাজ করছে। এই কবিতাটির মর্মকথা হজরত মুসার সংগে আল্লাহর কথোপকথনের মর্মার্থ একই। এবং তা হল ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের চেয়ে মানবহিতকর কর্ম আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় এবং যারা মানুষের কল্যাণে কাজ করে তারাই প্রকৃত আল্লাহ প্রেমিক। তাই নজরুলের কণ্ঠ উদ্ধৃত করে বলি :

মানুষকে ঘৃণা করি
ও’কারা কোরাণ, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরিমরি!!
ও’ মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ নাও জোর ক’রে কেড়ে,
যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে
পূজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল। মূর্খরা সব শোনো,–
মানুষ এনেছে গ্রন্থ; গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।’

মানবতা ও মানবিক চেতনায় নৈতিকতার প্রভাব

প্রকৃতপক্ষে নীতিবিজ্ঞানে মানব-অভিজ্ঞতার স্বরূপ উন্মোচিত হয়। আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে তিনটি ধরনের আদর্শ উদ্ভূত হয়ে থাকে যা আবার আমাদের তিনটি সচেতন প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ : জানা (Knowing), অনুভূতি (feeling) এবং ইচ্ছা (Willing)। এই তিনটি সচেতন প্রকৃতির সঙ্গে জড়িত তিনটি উপাদান হল : সত্য, সুন্দর ও শুভ (সত্যম্ শিবম্ সুন্দরম্)। পাশ্চাত্যের বিখ্যাত দার্শনিক প্লেটো তাঁর The Laws এবং The Republic গ্রন্থে ‘সমাজ ও নৈতিকতা’ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। প্লেটো ‘নৈতিকতা’ বলতে বুঝেছেন আইনের প্রকারান্তরণকে (modification)। প্লেটো (৪২৭-৩৪৭ খ্রি. পূ.) ছিলেন ভাববাদী এবং এরিস্টটল। (৩৮৪-৩২২ খ্রি.পূ.) একজন বাস্তববাদী দার্শনিক। প্লেটোর নৈতিক ন্যায়পরায়ণতার মানদণ্ড হল নৈতিক উৎকর্ষ, আর এ্যারিস্টটলের নৈতিক ন্যায়পরায়ণতার মানদণ্ড হল সততা। আঠার থেকে উনিশ- এ দুশতকে জন স্টুয়ার্ট মিল, ইমানুয়েল কান্ট, কার্ল মার্কস, বার্ট্রান্ড রাসেল, জ্যা পল সার্ত, জি. ই. ম্যূর, জেরোমি বেন্থাম, বাটলার হিউম প্রমুখ মানুষের নৈতিকতার বহুমাত্রিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন। এঁদের আলোচনায় যা গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে তা হল মানুষের চরিত্র। চরিত্রকে ধরা হচ্ছে একপ্রকার মানসিক প্রবণতা (disposition) হিসেবে। এঁদের অনেকের আলোচনায় ‘চরিত্র’ (character) শব্দটিকে দেখানো হয়েছে কোন ঐচ্ছিক কাজের সংগঠিত ‘পরিপূর্ণ জগৎ প্রক্রিয়া’ (complete universe of system) হিসেবে। ম্যাকেঞ্জি তাঁর ব Manual of Ethics গ্রন্থে চরিত্র প্রসঙ্গে বলেন, প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে থাকে কতকগুলো কামনা (desire)। এই কামনাগুলো আবার বিভিন্ন বা এককভাবে ব্যক্তির মনস্তত্ত্বে ভূমিকা রাখে তা নয়; বরং একটা কামনা অন্যান্য কামনার সঙ্গে সমন্বিত হয়ে ব্যক্তির মধ্যে স্বাতন্ত্র্য তৈরি করে। এই স্বাতন্ত্র্যই ব্যক্তিকে অন্যান্য ব্যক্তি থেকে আলাদা করার বৈশিষ্ট্যকে চরিত্র (character) বলা হয়। চরিত্র ব্যক্তির অন্তর্গত শক্তি দ্বারা প্রকাশিত হয়ে থাকে। অন্তর্গত শক্তি আবার ব্যক্তির মধ্যে বিচারবুদ্ধির মাত্রা তৈরি করে। এই বিচারবুদ্ধি ব্যক্তির চরিত্র গঠনে নিয়ামক হিসেবেও কাজ করে থাকে। ডেমোক্রিটাস (৪৬০-৩৭০ খ্রি. পূ.) ও পিথাগোরাসের (খ্রি. পূ. ষষ্ঠ শতক) মতে, মানসিক কর্মই আত্মশুদ্ধির সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়। গ্রিক যুগে সফিস্টগণই সর্বপ্রথম নৈতিক সমস্যাকে সর্বসমক্ষে আনেন। সফিস্ট দার্শনিক প্রোটোগোরাসের বিখ্যাত উক্তি ছিল : ‘Man is the measure of all things’। কেননা জ্ঞানই মহৎ শক্তির আধার। কোন ঐশ্বর্য, প্রাচুর্য, বৈভব কিংবা রাষ্ট্রক্ষমতা জ্ঞানের শক্তির কাছে নিষ্প্রভ। এই মহৎ বাক্যটি জার্মান লোকসাহিত্যে প্রতিধ্বনিত হয়েছে এভাবে :

ঐ রাজা শ্রেষ্ঠ রাজা, যে পণ্ডিতের কাছে যায়।
ঐ পণ্ডিত নিকৃষ্ট পণ্ডিত, যে রাজার কাছে যায়।

ইংরেজি Ethics শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত বিশ্লেষণ করে অনেকে একে অভ্যাস বা আচরণ সম্পর্কীয় বিজ্ঞানও বলে থাকেন। দার্শনিক ম্যাকেঞ্জি ও লিলি এ ধারার মূল প্রবক্তা।

ইংরেজি Ethics শব্দটি এসেছে Ethios শব্দ থেকে যার অর্থ হল রীতিনীতি, আচার-আচরণ ইত্যাদি। অনেক সময় Ethics কে moral শব্দের সমার্থক ধরা হয়। Moral শব্দটি উদ্ভূত হয়েছে লাতিন শব্দ mores শব্দ থেকে যার অর্থ হল রীতিনীতি বা অভ্যাস। সুতরাং Ethics বা নীতিবিদ্যা বলতে বোঝায় মানুষের রীতি বা অভ্যাস সম্পৰ্কীয় বিজ্ঞান। সাধারণভাবে নীতিবিদ্যার সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে কেউ কেউ বলেন, ‘নীতিবিদ্যা হল মানুষের চরিত্র বা আচরণ সম্পৰ্কীয় বিজ্ঞান।’ নীতিবিদ্যা মানুষের ঐচ্ছিক ক্রিয়ার অভ্যাসের এবং চরিত্রের নৈতিক মূল্য বিচার করে অর্থাৎ এগুলো ভালত্ব-মন্দত্ব, ঔচিত্য-অনৌচিত্য প্রভৃতির লক্ষণ ও নিয়ম নির্ণয়ের চেষ্টা করে। এ ছাড়া নীতিবিদ্যাকে মানুষের জীবনের পরমার্থ সম্পর্কীয় বিজ্ঞানও বলা হয়ে থাকে অর্থাৎ Ethics is the science of the highest good of human life। দার্শনিক ম্যাকেঞ্জি নীতিবিদ্যাকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন : Ethics may be difined as the study of what is right or good in conduct. It is general theory of the conduct and considers the actions of human being with reference to their rightness or wrongness, their tendency of good or to evil. [John Mackenzie: A Manual of Eithics] ।

ম্যাকেঞ্জি নীতিবিদ্যাকে আচরণের সঠিকত্ব বা ভালত্ব সম্পর্কিত আলোচনা হিসেবে গণ্য করেন। তাঁর সংজ্ঞা অনুযায়ী নীতিবিদ্যা যথোচিত (right) এবং ভালো (good) উভয়কে আলোচনার বিষয়বস্তু করে থাকে। ইংরেজি Right শব্দটি এসেছে লাতিন Rectus থেকে যার অর্থ হল ‘আইনানুগ’ বা যা কিছু আইনসিদ্ধ। সুতরাং কোন আচরণকে নৈতিক বলা যাবে যদি তা আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। আবার good বা ভালো শব্দটি জার্মান gut শব্দ থেকে উদ্ভূত এর অর্থ হল যা শুভ (supreme good) লাভের জন্য প্রয়োজনীয়। সুতরাং এদিক থেকে good শব্দটি হল যা আমাদের সর্বোচ্চ ভালোর দিকে পরিচালিত করে এমন কিছু।

একটি পরিশীলিত সমাজব্যবস্থার জন্য প্রয়োজন হয় নৈতিকতার। নৈতিকতা মানুষের আচরণ-সংক্রান্ত কতগুলি বিধির সমন্বিত রূপ। সামাজিক স্থিতিশীলতা, সংস্থিতি কিংবা ভারসাম্য যা-ই বলি না কেন, তার জন্য প্রয়োজন নৈতিকতা। নৈতিকতার সামাজিক গুরুত্ব অপরিসীম। এ প্রসঙ্গে William Lillie তাঁর An Introduction of Ethics গ্রন্থে বলেন : We may difine ethics as the normative science of the conduct of human beings living in a societies, a science which good or bad or in some similar way দার্শনিকদের প্রদত্ত নৈতিকতার এসব সংজ্ঞায় একটি বিষয় স্পষ্ট হয় যে, সমাজকে সুসংবদ্ধ, সুশৃঙ্খল ও সুনিয়ন্ত্রিত রাখার জন্য প্রণীত আরচণই হল নৈতিকতা। গৌতম বুদ্ধ, সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল, কান্ট, মার্টিনিউ, রাসেল এবং কার্ল মার্কস প্রমুখ দার্শনিকের নৈতিক আলোচনা মূলত সুন্দর সামাজিক জীবনযাপনের উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। গৌতম বুদ্ধ (খ্রি. পূ. ছয় শতক) হলেন প্রথম চিন্তাবিদ যিনি সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নৈতিকতার কথা বলেছিলেন। সমতা, সৌহার্দ্য, এসব মিলিয়ে তিনি চেয়েছিলেন একটি সৌম্য ও ভ্রাতৃত্বের বিশ্বসমাজ গড়ে তুলতে। বুদ্ধের জীবন-দর্শনের নিরিখে বিবৃত জাতকের কাহিনীতে আমরা যে নীতিদর্শন নিরীক্ষণ করি তা কেবল বৌদ্ধধর্মের নয়, সামগ্রিকভাবে প্রাচ্য সংস্কৃতির এক মহান উত্তরাধিকার।

মানুষের নৈতিকতা সমুন্নত রাখার প্রয়াসী আরেক নীতিবাদী প্ৰবক্তা ইশপ। বুদ্ধের সমসাময়িক গ্রিস্ দেশের ইশপ নামের এই ব্যক্তিই পাশ্চাত্য নীতিবাদের আদিম কথাকার। গ্রিক সাহিত্যে ইশপের প্রথম উল্লেখ দেখা যায় হেরোডোটাসের গ্রন্থে। হেরোেডাটাসের গ্রন্থ খ্রিষ্টের জন্মের প্রায় ৪৫০ আগে রচিত। সে হিসেবে এই কথাকার খ্রিষ্টের জন্মের প্রায় ৪৫০ বছর আগে রচিত। সে হিসেবে এই কথাকার খ্রিষ্টের জন্মের প্রায় ৫৫০ বৎসর পূর্বে জীবিত ছিলেন। তিনি সেমস্ দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং অ্যাক্সন নামক এক ব্যক্তির ক্রীতদাস ছিলেন। পশুপক্ষী সম্বন্ধে কথা রচনা করতে ইশপের অদ্ভুত নৈপুণ্য জন্মেছিল। ইশপ কথিত এই কথামালাই বিশ্বসাহিত্যে Easops Fables নামে সুপরিচিত।

হিতাহিত বা নীতি বিচারের মাপকাঠি কী? হিতাহিত বা ভালোমন্দ বিবেচনার মানদণ্ড হচ্ছে মানুষের ‘বিবেক’। বিবেকের নির্দেশ যে মেনে চলে সেই নীতিবান, সেই ধার্মিক। মহাত্মা গান্ধী বলেছেন : ‘প্রত্যেক মানুষেরই বিবেক বলে একটি জিনিস আছে। এই বিবেকের আদেশ মতো যে কাজ করে সেই প্ৰকৃত ধার্মিক, বিবেকের আদেশই ঈশ্বরের আদেশ’। (এম. কে. গান্ধী : জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছিলেন : When anything prieketh they conscience, forsale it I. [Sayings of Muhammad (sm) : Abdullah Al Mamun al Suhrawardy]।

অর্থাৎ যদি কোন কিছু তোমার বিবেক দংশন করে, তা পরিত্যাগ কর। বিবেক হল আমাদের ভেতরের সেই কণ্ঠস্বর যা আমাদের সতর্ক করে দেয় যে কেউ না কেউ আমাদের উপর নজর রাখছে। বিবেক-দংশন মানব-প্রবৃত্তির একটি চিরন্তন বৈশিষ্ট্য। মানুষের মধ্যে একটি তিরস্কারকারী অনুশোচনাকারী মন রয়েছে। খারাপ কাজ করলে তা তাকে তিরস্কার করে সেইজন্য সে অনুশোচনা করে। উদ্ধত ও দুর্বিনীতি স্বভাবের মানুষের মধ্যে বিবেক হয়ত সাময়িকভাবে আচ্ছন্ন হয়ে যায়, কিন্তু এমন এক সময় আসে যখন বিবেকের কাছে সে ধরা না দিয়ে পারে না। তখন সে ভাবতে শুরু করে মর্তলোকের জীবনে কার প্রতি কোন্ অন্যায় সে করেছে। এই হিসাব-নিকাশে যখন সে দেখতে পায় যে, অন্যায়ের অংশ তার মোটেই কম নয়, তখন শিশুর মতই নিদ্রার মধ্যে দুঃস্বপ্নে সে আঁতকে ওঠে; মন তার নানা দুশ্চিন্তায় ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। বস্তুত ন্যায়-অন্যায় ও ভালোমন্দের জ্ঞান মানুষের নীতিবোধের মৌল উৎস এতে কোন সন্দেহ নেই।

ধর্মের সঙ্গে নৈতিকতার সম্পর্ক প্রগাঢ়। কারণ প্রতিটি সমাজ ব্যবস্থার নৈতিকতা বিদ্যমান। আর ধর্ম একটা নৈতিক ব্যবস্থার মধ্যেই সৃষ্টি হয়েছে, সুতরাং সেই বিশেষ সমাজের নৈতিকতার প্রচুর উপাদান ধর্ম আপন দেহে ধারণ করে বেড়ে ওঠে। ধর্মের তাই কোন স্বাধীন সত্তা নেই, সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদানকে গ্রহণ করে তার উদ্ভব।

পাশ্চাত্য চিন্তায় মানবতাবাদ

নীতিতত্ত্বের ইতিহাস ও উপেক্ষিত মানবতা

আলোচনার বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য ‘নৈতিকতা’ শব্দটির বিশ্লেষণ প্রয়োজন। খুব সহজভাবে বলতে গেলে নৈতিকতা হল নীতি সম্পর্কীয় আলোচনা। ইংরেজি ‘Morality’ শব্দই এর সমার্থক। এ সম্পর্কে প্রচলিত একটি সংজ্ঞা আছে ‘সমাজে বসবাসকারী মানুষের আচার আচরণ সম্পর্কীয় ঔচিত্য ও অনুচিত্যমূলক আলোচনাই হল নীতিবিদ্যা। সুতরাং, নীতিবিদ্যার বিষয়বস্তু ‘নৈতিকতা’ হল উচিত অনুচিতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। বুর্জোয়া তাত্ত্বিকগণ নৈতিকতাকে এর বাইরে থেকে হিসেব করতে পারেননি। তাদের নৈতিকতা উচিত-অনুচিত, ভাল-মন্দ ও ন্যায়- অন্যায় ইত্যাদি প্রত্যয়সমূহের বিশ্লেষণ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। একজন মানুষ তার নিজের সুখ লাভের জন্য সমগ্র মানুষের সুখকে তুচ্ছ করে দেখতে পারেন। কিংবা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর স্বার্থকে সংরক্ষিত করার জন্য গোটা মানব জাতির সুখকে ধুলিসাৎ করে দেবার প্রবণতা হল বুর্জোয়া তাত্ত্বিকদের নৈতিকতার আদর্শিক ভিত্তি (Ideological base)। পর পর সংঘটিত দুটি বিশ্বযুদ্ধ, জাতিগত সহিংসতা, দখলদারিত্ব ইত্যাদি মূলত এরূপ বুর্জোয়া নৈতিকতারই কার্যফল (Consequences)। বুর্জোয়া নৈতিক চিন্তার সঙ্গে ভাববাদ তথা অধিবিদ্যার একটা যুগপৎ সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এ ধরনের নৈতিকতা হয় মানুষকে ভোগবাদী করে তোলে নতুবা ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্ন সত্তায় রূপান্তরিত করে। সুতরাং, প্রচলিত নীতিবিদ্যায় দুটি ধারা বিদ্যমান-

১. ভোগবাদী নৈতিকতা (Hedonistic ethics),

২. অধিবিদ্যক নৈতিকতা (Metaphysical ethics )।

প্রথমত, প্রাচীন গ্রিক চিন্তায় প্রথম ভোগবাদী নৈতিকতার সাক্ষাৎ মেলে। তারও আগে খ্রিষ্টপূর্ব দুই হাজার বছর আগে প্রাচীন ভারতীয়দের মধ্যে ভোগবাদী নৈতিকতার অনুশীলন ছিল বলে ধারণা করা হয়। তারা মনে করতেন, ইন্দ্ৰিয় বা দৈহিক সুখের অনুসন্ধান এবং সেই সুখ উপভোগ করাই মানব জীবনের পরম ব্রত। লোকায়তিক নামে খ্যাত এই দার্শনিক সম্প্রদায় মনে করেছেন, যে কর্ম অধিকতর সুখ প্রদান করে সে কর্ম ভাল। আর যে কর্ম অধিকতর ইন্দ্রিয় সুখ প্রদান করে না সে কর্ম মন্দ। তাঁরা আরও মনে করতেন, ‘যেহেতু মানুষ মরণশীল জীব, সেহেতু, তার পক্ষে যথাসম্ভব অধিকতর আত্মসুখ উপভোগ করাই বাঞ্ছনীয়। এদিক থেকে একজন মানুষকে তখনই বুদ্ধিমান বলে মনে করা হবে যখন সে এই সুযোগের সদব্যবহার করবে।’ কিন্তু তাঁদের দর্শনের কেন্দ্রীয় লক্ষ্য ছিল ভিন্ন রকম। বস্তুতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা দিয়ে গণমানুষের নির্বিচারবাদী ও অদৃষ্টবাদী ভাবনার পরিবর্তন করে মানুষকে জাগতিক ও সামাজিক করে তোলা। যুক্তি ও বুদ্ধির আলোকে সকল কিছুর ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করার সামর্থ তৈরি করা। তৎকালীন শ্রেণিবিভক্ত বর্ণবাদী সমাজের আসল চেহারাটা উন্মোচিত করে জাগতিকতার জয়গান করাই ছিল তাদের নৈতিকতার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য। এজন্য তাঁরা মানুষের দৃষ্টিকে পারলৌকিক চিন্তা থেকে লৌকিক জীবনের প্রতি নিবিষ্ট করার জন্য ভারতীয় চার্বাক দর্শনে অনুপ্রাণিত হয়ে বলেন—

যাবজ্জীবেৎ সুখং জীবেৎ
ঋণং কৃতা ঘৃতং পিবেৎ।

আসলে এই উক্তির মূলকথা প্রোথিত ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে— যা তৎকালীন মানুষের পরাতাত্ত্বিক মোহ কাটিয়ে বাস্তববাদী করতে সহায়তা করেছিল। এ নিয়েই প্রাচীন ভারতের শ্রেণিবিভক্ত বর্ণবাদী সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে গণমানুষকে জাগিয়ে তোলার প্রেরণা উৎসারিত হয়েছিল। এ জন্য লোকায়িত দার্শনিক সম্প্রদায়কে ভোগবাদী বলা যায় না।

দ্বিতীয়ত, প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক সিনিক, সিরানিক, স্টোয়িক ও এপিকিউরিয়ান তাঁরা সকলেই দৈহিক আনন্দ, মানসিক আনন্দ ও বিশুদ্ধ চিন্তা ইত্যাদিকে নৈতিকতার ভিত্তি বলে মনে করেছেন। প্রকারান্তরে তাঁদের সকলের নৈতিক চিন্তাই পর্যবসিত হয়েছিল স্থূল ভোগবাদে। ভোগবাদী নৈতিকতাকে লোকায়তিকগণ যে উদ্দেশ্য নিয়ে গ্রহণ করেছিলেন তা ছিল মানবিক। মানুষকে সামাজিকভাবে মহিমান্বিত করাই ছিল এর লক্ষ্য। কিন্তু গ্রিকদের ক্ষেত্রে অনুরূপ কোন চিন্তার আভাস মেলে না। গ্রিকদের নৈতিক শিক্ষা ছিল অধিবিদ্যক (Metaphysical)। যদিও গ্রিক নৈতিক চিন্তা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছিল সক্রেটিসের সময় থেকে, তবু পীথাগোরাস, ডেমোক্রিটাস এবং হিরাক্লিটাসের দার্শনিক তত্ত্ববিদ্যায় কিছুটা নৈতিক ভাবাদর্শের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তাও এক ধরনের ভাবালুপতায় আবিষ্ট। যা সত্তাকে অসত্তাবান, দৃশ্যমানকে অদৃশ্যমান করার প্রয়াসে লিপ্ত ছিল। যেমন, পীথাগোরাসের নৈতিক চিন্তায় লক্ষ্য করা যায় মানুষকে স্রষ্টার সদৃশ্য করে তোলার ইউটোপিয়া। আবার, পরমাণুবাদী ডিক্রোক্রিটাস যদিও মন্দ চিন্তা ও কাজ থেকে বিরত থাকার কথা বলেছেন, তবুও তিনি নৈতিক জীবনকে পরমার্থ বলেই বিবেচনা করেছেন। আত্মাকে শুব্ধ রাখার নীতি দ্বারা হিরাক্লিটাস নৈতিকতাকে অধিবিদ্যায় রূপান্তরিত করেছেন। সুতরাং, উপযুক্ত পর্যালোচনা থেকে একটি বিষয় খুবই স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হল— গ্রিক দার্শনিকদের নীতিবিদ্যক চিন্তায় উপেক্ষিত ছিল মানুষ ও মানবতা।

পরবর্তীসময়ে বাইবেলবাদীদের মধ্যে মানুষের সর্বজনীনতা, বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধের অঙ্গীকার ব্যক্ত হয়েছিল। তাঁরা ‘Biblical golden rule’ দ্বারা সর্বজনীনতাকে নৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে কিছুটা প্রয়াসী হয়েছিল। কিন্তু খ্রিষ্টীয় ত্রিত্ববাদ ‘golden rule’-এর সর্বজনীন স্বকীয়তাকে বিনষ্ট করে দেয়। বস্তুজাগতিকতার দিক থেকে নিয়মটি আবেদন হারিয়ে ফেলে। মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ জাগ্ৰত না করে মানুষকে ‘মানব ঈশ্বর’ করার মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার বাইবেলের নৈতিকতা কার্যত পরাতাত্ত্বিক অনুধ্যানেই পর্যবসিত হয়।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে উপেক্ষিত মানুষই যেন সকল তাৎপর্যের উৎস। মানুষের অস্তিত্বের দার্শনিক শেকড় যেন এখান থেকেই প্রণীত হয়েছে, অথচ এর গূঢ়ার্থ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করে যা মানুষকে স্বেচ্ছাচারী নৈতিকতার শিক্ষা দিয়ে থাকে। আবার সক্রেটিস মানুষকে মনুষ্যত্বের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা অপেক্ষা ‘Whatever is not of knowledge is sin’ বাণীতে বেশি মনোনিবেশ দিয়েছিলেন। সক্রেটিসের মানুষ অপেক্ষা জ্ঞানতত্ত্বের প্রতি ছিল অত্যধিক আগ্রহ। প্লেটো ব্যক্তির অস্তিত্বকে ধারণার জগৎ থেকে নিঃসৃত করে বিশ্লেষণ করতে চেয়েছেন। জীবনের লক্ষ্যে চরম জগৎকে আদর্শিকভাবে মূর্তমান করে তুলতে চেয়েছেন। জীবনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং নীতি আদর্শ সব কিছু চরম আদর্শের নিমিত্তে প্লেটোর এই চূড়ান্তকরণে মানুষের অস্তিত্ব শেষ পর্যন্ত অবহেলিতই থেকে গেল। এরিস্টটল মধ্যপন্থায় শুভকে অশুভের সঙ্গে তালগোল পাকিয়ে আমাদের নীতি, আদর্শকে সংশয়াপন্ন করে তুলেছিলেন। এভাবে দেখা যায় মানুষের নৈতিকতা মানুষের মুক্তি, সাম্য ও স্বাধীনতার জন্য না হয়ে বরং মানুষকে শৃঙ্খলিত করারই শামিল হয়েছিল। এ ধারাই পরবর্তী সময়ে আধুনিক ভাববাদীদেরকে প্রভাবিত করেছিল। এ ধারার প্রাতিষ্ঠানিক অগ্রযাত্রা শুরু করেন জার্মান পণ্ডিত ইমানুয়েল কান্ট। সদিচ্ছা ও কর্তব্যবোধের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করতে গিয়ে তিনি মানুষকে মহিমান্বিত করেছেন। শর্তহীন আদর্শ, সর্বজনীন নিয়ম ও কোন কিছু লাভের জন্য মানুষকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহর না-করার ঘোষণা, এসব মিলিয়ে কান্ট মানুষের মর্যাদাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি কি এ অবস্থানে থাকতে পেরেছেন? মানুষের অস্তিত্বের আসল স্বরূপ কি তিনি দার্শনিকভাবে উদ্ঘাটন করতে পেরেছেন? এ প্রশ্ন আজও অমীমাংসিত।

প্রাচ্য চিন্তায় মানবতাবাদ

পূর্বের মত বর্তমান যুগে ধর্মের প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা, তার চাইতেও বড় কথা হচ্ছে ধর্মই সমাজের জটিল সমস্যাগুলোর জন্য প্রকৃত ঔষধ। ধর্মই পারে সামাজিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধন করে এবং মানুষের সাথে মানুষের সবরকম ভেদাভেদ দূর করে দিয়ে, বিশ্ব ঐক্যের পথকে সুগম করে দিতে। বর্তমান যুগে ধর্মের ভূমিকা হবে মানুষের সঙ্গে মানুষের প্রীতির বন্ধনকে দৃঢ় করে তোলা। অপরের প্রতি বিদ্বেষ, ঘৃণা কিংবা হিংসার মনোভাব বহন করা যথার্থ ধর্মবোধের পরচিায়ক নয়। ধর্ম প্রতিটি মানুষকে নীতিপরায়ণ, সদাচারী, ন্যায় পরায়ণ, উদার ও সংযমী হতে শিক্ষা দেবে- ব্যক্তিগত ও সামাজিক উভয় প্রকার কর্তব্য সম্পাদনে মানুষকে সমানভাবে সচেতন করে তুলবে এবং জীবনে পরম মূল্যগুলোকে আস্বাদন করে নিজের চারিত্রিক পূর্ণতা লাভে তাকে উদ্বুদ্ধ করে তুলবে। ধর্মের প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি করলে মানুষ বুঝতে পারবে যে ধর্মান্ধতা মানুষকে সংকীর্ণমনা, ক্ষুদ্রচেতা, স্বার্থপর ও নির্বিচারী করে তোলে। কিন্তু সেটা যথার্থ ধর্ম ভাবনা নয়। কেবল সামাজিক পরিসরেই নয়, বরং বিশ্বশান্তি ও ঐক্যের পথে মানুষকে যথার্থ মনুষ্যত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে পারস্পরিক মিলনের যোগসূত্রটি দৃঢ় করে তুলতে হবে। এ কঠিন কর্তব্য একমাত্র ধর্মের দ্বারাই সম্ভব। সে কারণে সামাজিক জীবনমান উন্নয়নে অতীতের তুলনায় বর্তমান যুগে ধর্মের ভূমিকা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

প্রাচ্যে মানবতাবাদের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি লাভ করেছিল গৌতম বুদ্ধের দার্শনিক চিন্তায়। সমাজে বিদ্যমান অসাম্য, অবিচার, অত্যাচার, শোষণ-বঞ্চনা তাঁকে ব্যথিত করেছিল। এই বেদনাই তাঁকে উদ্বেলিত করেছিল মানুষকে তাঁর অসীম দুঃখ, যন্ত্রণা ও কষ্ট থেকে পরিত্রাণ করতে। তাঁর সমগ্র দর্শনচিন্তায় একটি বিষয় খুবই স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাহলে মানুষের প্রতি মানুষের প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তোলা, মানুষের আত্মসম্মানবোধকে সমুন্নত করা, সর্বোপরি মানুষের মুক্তি এবং কল্যাণ সাধন করা। বুদ্ধ মানবতাকে ‘মানবজাতির’ নৈতিক মানদণ্ড করতে চেয়েছিলেন। তাঁর অহিংসনীতি, পঞ্চশীলানীতি এবং ব্রহ্মবিহারনীতিতে মানবতাবাদের একটি সামগ্রিক চিত্র পাওয়া যায়।

বুদ্ধ জগতের সকল প্রাণীকে সুখী দেখতে চেয়েছেন। পারস্পরিক সম্পর্ক যেন অহিংস, শত্রুহীন ও সেই অভিপ্রায় নিয়ে কাজ করেছিলেন। এর ভেতর দিয়ে তিনি চেয়েছিলেন বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও প্রেমের অনুশাসনকে সর্বাগ্রে স্থান দিতে। তাঁর মানবতাবাদী দর্শনে নেতিবাচক এবং ইতিবাচক পদ্ধতির প্রভাব ছিল। নেতিবাচক দার্শনিকতায় তিনি চেয়েছিলেন জগতের দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা, প্রিয়-বিচ্ছেদ, অসমতা ও বৈষম্যগুলোকে উদ্ঘাটন করতে। পাশাপাশি তাদের ভেতর দিয়ে মানুষের প্রতি মানুষের প্রেম-ভালবাসাকে উদ্বেলিত করে তুলতে আবার ইতিবাচক দার্শনিকতায় তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে দুঃখ-কষ্টকে পরিহার করা যায়।

বুদ্ধ তাঁর দর্শনে মানব স্বাধীনতা, আত্মমর্যাদা, পারস্পরিক সহিষ্ণুতাকে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছেন। মানুষের কর্ম ও প্রচেষ্টাকে উৎসাহ দিয়ে উদ্ভাসিত করার কথা তিনি বারবার বলেছেন। মানুষ যেন নৈতিক, সংযমী ও আচারনিষ্ঠ জীবনযাপন করে সেই জন্য তিনি পথনির্দেশনা দিয়েছেন। নির্দেশনায় এই বিষয়টিও তিনি অনুধাবন করেছেন যে— মানুষ নিজেই নিজের মধ্যেই নির্ভরশীল অর্থাৎ আত্মনির্ভরশীল। মানুষ নিজেই নিজের মুক্তিদাতা। মানুষের মধ্য রয়েছে সম্ভাবনা, এই কারণেই মানুষকে নির্ভর করতে হয় না অন্য কোন অধিসত্তা কিংবা ভাগ্যদেবতার উপর। মানুষ তার কর্মপ্রচেষ্টা ও সদ্ভাব দ্বারাই পারে নিজের ভাগ্য নিজে বিনির্মাণ করতে।

মানুষের প্রতি বুদ্ধের শ্রদ্ধা ও সম্মানবোধ যে কতটা গভীর ও প্রখর তার প্রমাণ মেলে যখন তিনি ঈশ্বর-ধর্ম-যজ্ঞ নিরপেক্ষ করে মানুষের কর্মশক্তির প্রতি গুরুত্ব প্রদান করেন। সুকর্ম ও মানবকল্যাণকে সর্বোৎকৃষ্ট ব্রত হিসেবে গ্রহণ করার পরামর্শ দেন। তাঁর বিশ্বাসের ভিত্তিমূলে ছিল মানুষ। সেই মানুষ তার নিজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে নিজেই তার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে নিতে পারেন।

বুদ্ধ মানবতাবাদী দর্শনের ‘অহিংসনীতি’ দ্বারা মানুষের প্রতি মানুষের ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে দৃঢ় করার কথা ঘোষণা করেছেন। সকল মানুষকে সাম্য, দয়ায় অনুপ্রাণিত করার কথা বলেছেন। তিনি অহিংসনীতি দ্বারা তৎকালীন সমাজে সামাজিক ব্যবস্থায় বিদ্যমান ‘বর্ণপ্রথা’র ন্যায় চরম বৈষম্যমূলক ও অমানবিক ব্যবস্থাকে মূলোৎপাটন করতে চেয়েছেন।

‘ব্রহ্মবিহার’ হচ্ছে বৌদ্ধ মানবতাবাদের অপর একটি দিক। এখানে তিনি চারটি নীতির কথা বলেছেন— মৈত্রী, করুণা, মুদিতা ও উপেক্ষা—এই চার নীতির সজীব উপলব্ধি দ্বারা তিনি মানুষকে প্রীতি ও মৈত্রীর বাঁধনে আবদ্ধ করতে চেয়েছেন। মৈত্রী দ্বারা তিনি অপরিমিত মানসকে বুঝিয়েছেন যা বিশ্বলোককে প্রীতি ও প্রেমের পূর্ণতায় জড়াতে পারে। বুদ্ধ মৈত্রীভাবনা দ্বারা বিশ্বচরাচরের সকল প্রাণীর কল্যাণ চিন্তা করেছেন। পরিবার ও সমাজে তিনি প্রীতির ভাব জাগ্রত করার কথা বলেছেন। আবার সমগ্র মানবজাতির মধ্যে বিদ্যমান হিংসা, দ্বন্দ্ব, বিদ্বেষ দুর করে সহাবস্থান নীতির বাস্তবায়ন চেয়েছেন। মৈত্রীভাবনার জন্য তিনি করুণা ভাবনার কথা বলেছেন। এর ফলেই মানুষ পরস্পরের প্রতি দয়া, করুণা, প্রীতি, অনুকম্পার ভাব দেখাবে। অনেকটা এইভাবে, ‘অর্তে সুত ইব পিতুঃ প্রেম জগতি’। বুদ্ধ মানবতাবাদের আরেকটি বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি হল উপেক্ষা। লোভ- অলাভ, সুখ-দুঃখ নিন্দা-প্রশংসা, মান-অপমান’ এই আট প্রকার লোক-ধর্মকে পরিহার করাই ছিল বুদ্ধ উপেক্ষানীতি। সমসাময়িক জীবনে মানবিকতার যে সঙ্কট উপেক্ষানীতির অনুশীলন দ্বারা কিছুটা হলেও লাঘব করা যায়। ‘মুদিতা’ হল এমন যা অপরের সুখে নিজেকে প্রফুল্ল করে তোলে। আর নিজের স্বার্থ বলে যখন কিছুই থাকে না তখনই এভাব পরিস্ফুট হয়। তাঁর ব্রহ্মবিহারনীতি প্রকৃতার্থেই মানবতাবাদী। মানবতার স্খলন এই চার নীতির (মৈত্রী, করুণা, মুদিতা, উপেক্ষা) যথাযথ অনুশীলনের অভাবে সংঘটিত হচ্ছে। কেননা একজন মানুষের মধ্যে যদি ন্যূনতম প্রীতি ও মৈত্রী ভাব থাকে তা হলে সে মানুষের অশান্তি কামনা না করে বরং ভ্রাতৃত্বের সুদৃঢ়তা স্থাপন করবে এটাই স্বাভাবিক। আবার মানুষের প্রতি মানুষের করুণা থাকবে বলেই সে অপরের কষ্টে যন্ত্রণায় নিজেকে উৎসর্গীকৃত করবে। অপরের সুখে সে প্রফুল্লিত হবে। উপেক্ষা করতে পারবে সকল লালসা, পরনিন্দা ও অহিতকর অকল্যাণজনিত ক্রিয়াকলাপকে। বুদ্ধ মানবতাবাদকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য চেয়েছিলেন অসদাচার, অনৈতিকতা ও শৃঙ্খলহীন জীবনাচারকে পরিহার করে সৎ চরিত্রের অনুশীলনের মাধ্যমে একজন মানুষকে সর্বোৎকৃষ্ট মানুষে রূপান্তরিত করতে। এজন্য তিনি পঞ্চশীলানীতির প্রস্তাব করেন।

মানবিক গুণাবলি ও মানবিক ভাবচিন্তার মূল নিয়েই বুদ্ধ সর্বদা ভাবনা চিন্তা করতেন এবং এ ব্যাপারে প্রিয়শিষ্যদের ধর্মদেশনা দান করতেন। মানবজাতি এবং অন্যান্য প্রাণীর প্রতি তাঁর ছিল গভীরতম অন্তর্দৃষ্টি। কোন জিজ্ঞাসু যখন তাঁকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতেন তখন তাতে তিনি বিচলিত বোধ না করে মহামতী সক্রেটিসের মত বিনীতভাবে পাল্টা প্রশ্ন করে তাকে প্রতিহত করতেন। এ ব্যাপারে তিনি যে কূটতর্কের অবতারণা করতেন তা একদিকে যেমন ছিল কার্যকরী, অন্যদিকে তেমনি ছিল চিত্তাকর্ষক। নিজের অভিজ্ঞতা ছাড়া তিনি অন্য কোন প্রাধিকার বা শ্রুতির ঘোর বিরোধী ছিলেন পুর্বাপর। যেকোন বিষয় যুক্তির আলোকে তিনি দেখার ছিলেন পক্ষপাতী। প্রতীত্যসমুৎপাদ অনুযায়ী তিনি তাঁর দার্শনিক প্রস্থানের মূল মতবাদ রচনা করেছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে এটি ভারতীয় ও পৃথিবীর চিন্তাধারায় একটি মৌলিক সংযোজনরূপে পরিণতি লাভ করেছে। অনেক ক্ষেত্রে তিনি সমালোচকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েও তা আমাদের এই ধারণার পথে, সৃষ্টির পথে অন্তরায় হয় না যে, শাক্যমুনির আদর্শ উদ্দেশ্যে ছিল পূর্বতন ও বর্তমান চিন্তাধারার উৎকর্ষ সাধন এবং ধর্মীয় ও সামাজিক আদর্শের মূল্যাবধারণ।

প্রখ্যাত জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট তাঁর ধর্মীয় কর্তব্যবোধকে ঐশী আদেশ হিসেবে গণ্য করার জন্য জোর দিয়েছেন বারবার। কর্তব্যবোধের ধারণাকে তিনি অন্তরের একটি সৎপ্রবৃত্তির স্বাভাবিক বহিপ্রকাশ বলে মনে করেন। কিন্তু তথাগত বুদ্ধ তা মনে করেননি। আমরা জানি জর্ডন নদীর পবিত্র সলিল ধারায় সিঞ্চিত হয়ে দীক্ষিত করার প্রচলিত রীতি পরিত্যাগ করে যিশুখ্রিষ্ট ‘পরিত্রাত্মার’ জীবন দিয়ে মানুষকে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত করার চেষ্টা করেছিলেন। আমাদের পুণ্যভূমি ভারতবর্ষে তারও প্রায় পাঁচশত বৎসর পূর্বে তথাগত বুদ্ধ চেয়েছিলেন মানুষকে বাহ্যিক আচারানুষ্ঠানের পরিবর্তে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আলোকে দীক্ষিত করতে। প্রকৃতপক্ষে শাক্যমুনির প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল সকল বাহ্যিক আচরণের অন্তর্নিহিত গুরুত্বকে বৃদ্ধি করা। একটি অনন্ত প্রত্যাগমনকে প্রতিহত করার জন্য ‘বাবা থেকে তার বাবা, এবং সকল বাবা থেকে প্রথম বাবায় ফিরে যাওয়া’। জুলু সদৃশ এই যুক্তির ওপর ভিত্তিশীল ব্যক্তিত্ববানের প্রচলিত বিশ্বাসের ধারণাকে তিনি বর্জন করেন, এবং ঐশীতন্ত্রের পরিবর্তে সংস্কারমুক্তিকে প্রতিস্থাপন করেন। তবে সেই সঙ্গে তিনি মানুষের মধ্যে দেবত্ব এবং স্বর্গীয় গুণাবলি প্রকাশের প্রয়োজনীয়তার ওপরও পর্যাপ্ত গুরুত্ব আরোপ করেন। সমগ্র সমাজ ও প্রকৃতির রাজ্যকে একটি উন্মুক্ত শিক্ষায়তন হিসেবে গ্রহণ করে মানুষের সুপ্ত শক্তিকে তিনি জাগ্রত করার চেষ্টা করেন। ভ্রমর যেমন ফুলের কোন ক্ষতি না করেই মধু আহরণ করে, তেমনি সকল ব্যক্তি ও বস্তুর মধ্যে থেকেই তিনি মানুষের নৈতিক গুণাবলি বিকাশের প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তিনি মনে করতেন মানবিক গুণের বিকাশ ছাড়া মানুষ তার নিজেকে উপলব্ধি করতে পারে না।

মানবতার কল্যাণ প্রতিষ্ঠায় তথাগত বুদ্ধের এই যে প্রাণপণ আকুতি ভারতীয় সভ্যতা ও জীবনধারায় তা অবশ্য নতুন নয়। উপনিষদেও আমরা ঋষির মুখে এই আকুতির প্রতিধ্বনি স্পষ্টভাবে লক্ষ করি। বৃহদারণ্যক উপনিষদে ঋষি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন :

অসতো মা সদগময়। তমসো মা জ্যোতির্গময়।
মৃত্যুর্মা অমৃতং গময়। আবীরাবীর্য এধি।
রুদ্রমতে দক্ষিণং মুখং। তেন মাং পাহি নিত্যম্।

আমাকে অসত্য থেকে সত্যে, অন্ধকার থেকে আলোকে এবং মৃত্যু থেকে অমরত্বলোকে নিয়ে চলো। হে স্বপ্রকাশ! আমার কাছে প্রকাশিত হও। রুদ্র তোমার যে প্রসন্ন মুখ, তার দ্বারা সর্বদাই আমাকে রক্ষা করো। অবিদ্যা থেকে জ্ঞানে, অচেতন থেকে সচেতনলোকে, মূঢ়তা থেকে আত্মা-অভিব্যক্তিতে, নিদ্রা থেকে জাগরণে, বন্ধন থেকে মুক্তিতে, আলস্য থেকে উদ্যমে, ক্ষুৎপিপাসা থেকে প্রাচুর্যে, ভয়ভীতি থেকে নির্ভয়ে, অনিত্যলোক থেকে নিত্যলোকে, ব্যাধিগ্রস্ত থেকে সুস্বাস্থ্যে, সংঘাত থেকে প্রশান্তিতে, প্রযত্ন থেকে ফলপ্রাপ্তিতে, উত্তরণের গতিকে সূচিত করতে এই প্রার্থনা ভারতীয় ঐতিহ্যে কোন নতুন বিষয় নয়। মহামানব বুদ্ধ এই প্রার্থনাকেই যুক্তির আলোকে উপস্থাপন করেছেন মাত্র। মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি সুমহান ভারতের ঐতিহ্যকে নতুনভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন।

সমসাময়িক পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় পুঁজির দৌরাত্ম্য মানুষকে নিতান্তই পণ্যে পরণিত করছে। মানুষকে হিসেব করা হচ্ছে বুদ্ধি ও শ্রমের সামষ্টিক কাঠামো হিসেবে। এই বুদ্ধি ও শ্রমের অবাধ পরিণতি মানুষের জীবনের মূল্যমানকে করে তুলছে তুচ্ছ ও অবহেলিত। মানুষ মানুষকে খুন করছে, একে অপরের জীবনকে অসহিষ্ণু করে তুলছে। সমগ্র বিশ্বব্যাপী এক ভয়ঙ্কর অস্থিরতা ও উন্মাদনা যা জীবনযাপনকে করে ফেলেছে জটিল, দুর্বোধ্য ও দুঃসাধ্য। এ হেন অবস্থায় পঞ্চশীলা আমাদের জীবনযাপন ব্যবস্থাকে কিছুটা হলেও সংযত ও সংস্থিত করতে সহায়ক হতে পারে। বিশ্ব চরাচরের সকল প্রাণীর প্রতি অহিংসা প্রতিষ্ঠাই তথাগত বুদ্ধের প্রথম শীলার মর্মবাণী। তিনি উপলব্ধি করেছেন মানুষের প্রতি মানুষের হিংসার মনস্তাত্ত্বিক কারণ হল অপরের সম্পদের প্রতি মোহ, এই মোহই ব্যক্তিকে অধঃপতনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বুদ্ধ মানুষকে এই অধঃপতন থেকে ফিরিয়ে আনার জন্যই চৌর্যবৃত্তিকে নিষিদ্ধ করেছেন। আবার অযাচার কিংবা অনৈতিক যৌনাচার মানুষের মুক্ত উদার হৃদয়কে কলুষিত করে, নীতিভ্রষ্ট ও আদর্শচ্যুত করতে প্রেরণা দেয়। এজন্য তিনি ব্যভিচারকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করে গেছেন। মানবজাতিকে তিনি মিথ্যা, শঠতা, কপটতা, প্রতারণা ও প্রবঞ্চনা থেকে মুক্ত থাকার কথা বলেছেন। সমসাময়িক রাজনৈতিক জীবনে বিশেষ করে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে পঞ্চশীলা নীতির সুষ্ঠু প্রয়োগ অনিবার্য হয়ে পড়েছে।

সামগ্রিকভাবে বুদ্ধের দর্শনচিন্তা ছিল মানবতাবাদকে কেন্দ্র করে। মানুষের নৈতিক স্খলন ও মূল্যবোধের অভাব থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য নিঃসন্দেহে বুদ্ধের দার্শনিক চিন্তা গুরুদায়িত্ব পালন করতে পারে। Arnold Adwin-এর ভাষায়, বুদ্ধ হলেন শ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী চিন্তাবিদ, অন্যভাবে light of universe

চীনের প্রাচীন ইতিহাসে কনফুসিয়াসের দর্শন ও হিতোপদেশে মানবতাবাদের আভাস পাওয়া যায়। কনফুসিয়াস সমাজকে পরিবারের মত ভেবেছেন- এ ভাবনার ফলেই তিনি অবস্থান নিয়েছিলেন সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে। তিনি যে সমাজনীতি বাতলে ছিলেন তাতে রাজা ও প্রজা উভয়ের দায়িত্ব সমভাবে অর্পিত ছিল। ফলে মানুষে মানুষে বিভাজনটা আর থাকল না। তাঁর দর্শনে অতিপ্রাকৃতিকতার স্থান ছিল না। বরং জগতের মধ্যেই তিনি মানুষের সমস্যা ও সঙ্কটকে চিহ্নিত করে জাগতিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই তার সমাধান খোঁজার কথা বলেছেন।

রবীন্দ্র-দার্শনিক ভাবনায় প্রচ্ছন্নভাবে হলেও মানবতাবাদী চিন্তার আভাস পাওয়া যায়। আসলে তাঁর সমগ্র সাহিত্যে পরম মঙ্গল ও জাগতিক সত্যের প্রকাশ ঘটেছে অসীম ও সীমিত সত্যের ভেতর। অসীমের মাধ্যমে তিনি সত্তাকে পরম সত্তায়, সসীমের মাধ্যমে তিনি জাগতিক বাস্তবতায় জগৎ সত্তাকে মূর্তমান করে তুলতে চেয়েছেন। এ দুয়ের ভেতর দিয়ে রবীন্দ্রনাথ হতাশাবাদের পাশাপাশি আশাবাদের বাণীও শুনিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ মানব ব্যক্তিত্বকে অসীম সীমানায় বিস্তৃত করতে চেয়েছেন, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা ও সমাজচেতনার দ্বন্দ্ব নিরসনের মাধ্যমে মানবচিত্ত প্রসারের কথা বলেছেন। এই প্রসারের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ মূলত বিশ্বমানবতাকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। যে কারণে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘আমার বুদ্ধি মানববুদ্ধি; আমার হৃদয় মানব হৃদয়, আমার কল্পনা মানব কল্পনা।’

রবীন্দ্রনাথের বিশ্বমানবিকতার ধারণা আরও ব্যক্ত হয়ে উঠেছিল অরবিন্দের মানবতাবাদী দর্শনে। অখণ্ড মানবতার আকাঙ্ক্ষায় নিবিষ্ট এই দার্শনিক ব্যক্তিত্ব নিজেকে সুমহান করে তুলতে প্রয়াসী ছিলেন। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বিকাশের লক্ষ্যে তার দার্শনিক উদ্ধৃতি ছিল দ্ব্যর্থহীন। যে কারণে অরবিন্দ বলেন—

‘Man must be sacred to man regardless of all distinctions of race. creed. colour. nationality, status, political or social advancement!’

অরবিন্দ সনাতন হিন্দুবাদী ছিলেন, কিন্তু সাম্প্রদায়িক কিংবা সঙ্কীর্ণ ছিলেন না। বিশ্বমানবতার বিকাশ সাধানের জন্য ব্যক্তি ও জাতিসত্তার নিজস্ব মূল্য ও কৃষ্টিকে তুচ্ছ করে দেখেননি। বরং ব্যক্তির বিকাশের মধ্য দিয়ে সামগ্রিকতার বিকাশ চেয়েছেন। তাঁর অন্য একটি ভাষ্যের কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়—

‘The nation unit not formed and does not exist mirely for the shake of existing; its purpose is to provide a larger mould of human aggregation in which the race, and not only classes and individuals, may move towards its full human development’

অরবিন্দ জাতি ও গোষ্ঠীর স্বার্থের কথা বলেছেন, খণ্ড খণ্ডের স্বার্থ সমুন্নত করার ভেতর দিয়ে তিনি চেয়েছেন অখণ্ড মানবজাতির বিকাশকে সমুন্নত করতে। রবীন্দ্রনাথ ও অরবিন্দ তাঁরা যদিও মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ধর্মের আশ্রয় নিয়েছেন, কিন্তু সেই ধর্ম প্রথাগত ধর্ম থেকে সম্পূর্ণ পৃথক ছিল। তাঁরা মানুষের মধ্যে সেই ঈশ্বরকে জাগ্রত করতে চেয়েছেন যিনি মানুষের অন্তরে মনুষ্যত্ব, ভক্তি, বিশ্বপ্রেম, সীমাহীন হৃদয়ের বিস্তার এবং মহামানবকে জাগ্রত করার প্রেরণা দিয়ে থাকে।

আরেকজন ধর্মসংস্কারক স্বামী বিবেকানন্দ, তাঁর দর্শন চিন্তায়ও রয়েছে মানবমুক্তির উদাত্ত আর্তি। তিনি মানুষকে এ ঐকীকরণের ভেতর দিয়ে মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। মানুষের ভেতর ব্রহ্মকে প্রকাশমান করতে চেয়েছেন। যে কারণে যাগ-যজ্ঞ অপেক্ষা মানবসেবা, হিতৈষী, প্রেম, দয়া এসবের প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। মানুষকে তিনি ‘Religion man’ হিসেবে দেখেননি। তিনি মানুষকে বিবেচনা করেছেন মনুষ্যত্ব গুণাগুণসম্পন্ন ‘বিবেকী মানুষ’ হিসেবে। যে কারণে তিনি হিন্দু গোঁড়াবাদের ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে বলতে পেরেছেন-

বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর।
জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।

মানুষের মনে এভাবেই মূর্তমান করে তুলতে চেয়েছেন ‘বিমূর্ত ঈশ্বর’কে। যে কারণে তিনি মানুষ ও জীবের সেবা করাকে সর্বোৎকৃষ্ট ধর্মীয় কর্ম হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাঁর ধর্মীয় বাণীর মূলকথা হল— ‘প্রত্যেক মানুষের মধ্যে এ দিব্যসত্তা বিরাজমান, এবং মানুষের এই দিব্যসত্তার উন্মোচন ও বিকাশ সাধন করাই সর্বোত্তম ধর্ম।’ বিবেকানন্দ – মানুষের মধ্যে অন্তর্নিহিত দিব্যসত্তার উন্মোচনের ভেতর দিয়ে সর্বজনীন প্রেম ও মানবতা জাগ্রত করতে চেয়েছেন এজন্য তিনি ধর্মীয় যাগ-যজ্ঞ, উপাসনা ও আরাধনায় লিপ্ত না থেকে বিপন্ন, হত-দরিদ্র্য, দুঃস্থ- পীড়িত ও অবহেলিত মানুষের ভাগ্য উন্নয়নকে উৎসাহিত করেছেন। বিবেকানন্দের ধর্মীয় চিন্তা হিন্দু সনাতনী ধর্মীয় চিন্তা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক ছিল। তিনি ধর্মীয় প্রার্থনা উপাসনাকে যথাযথভাবে গুরুত্বহীন করে জীবন-ব্যবস্থার ব্যবহারিক দিকটিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। এই ব্যবহারিক দিকটিই আমাদেরকে কর্মে তাড়িত করে, জনসেবায় উদ্বুদ্ধ করে। সুন্দর-সৌম্য-সামাজিক ব্যবস্থাপনায় আস্থাশীল করে, মানুষের স্বাধীনতাকে প্রতিষ্ঠা করার ভেতর দিয়ে তাকে অস্তিত্ববান করে তোলে। তাঁর উপলব্ধি এতই তীক্ষ্ণ ও ধারালো ছিল যে, যা সহজেই মানব মনকে আকৃষ্ট করতে পারে, প্রেরণাদাতা হিসেবে কাজ করতে পারে। তাঁর অবস্থান এতই সাহসী ছিল, যে কারণে তিনি বলতে পেরেছেন ক্ষুধার্ত মানুষকে ধর্মের কথা শোনানো হল তাকে অপমান করা। সর্বোপরি তাঁর ধর্মীয় চেতনার মূল কথা মানবতাবাদ—যা বিজ্ঞানমনস্কতার আদলে প্রতিষ্ঠিত ছিল।

বাঙালির মানবতাবাদী চিন্তায় দার্শনিক ক্রমবিকাশ

খ্রিষ্টপূর্বকালে ভারতের মাটিতেই জাত (বিহারে) মহাবীর (Great Hero) কর্তৃক ঘোষিত ‘অহিংসাই শ্রেষ্ঠতম ধর্ম’ (Non Voilence is the Highest Religion)-এই প্রতিপাদ্য দর্শন নিয়ে যাত্রা শুরু হয় জৈন ধর্মের। মহাবীর ছিলেন জৈন ধর্মমতের চব্বিশজন তীর্থঙ্করের অন্যতম প্রধান সর্বশ্রেষ্ঠ তীর্থঙ্কর। প্রথম তীর্থঙ্কর ছিলেন রসভাদেব। দ্বিতীয় তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথ (পরেশনাথ) ও মহাবীর ব্যতীত অন্য তীর্থঙ্করদের সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি অপ্রতুল। ভারতীয় জনজীবনে মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠায় জৈন্য ধর্মদর্শনের ভূমিকা সর্বাগ্রগণ্য। ভারত তথা পশ্চিমা বিশ্বের বহু মনীষীই জৈনধর্ম দর্শনে প্রভাবিত ও আকৃষ্ট হয়েছিলেন। জৈনধর্ম ভারতের প্রাচীনতম ধর্ম। খ্রিষ্টের জন্মের পূর্বেই ভদ্রমনা নামে এক অহিংস নীতিপ্রবক্তার হাত ধরেই এই ধর্মের উদ্ভব ও মহাবীরের মহামানবিক চেতনায় বিকাশ। মহাবীরের মৃত্যুর (৫২৭ খ্রি.) পর জৈনধর্ম দর্শনে মতাদর্শগত পার্থক্য দেয় এবং এ ধর্মটি দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে একটি ‘শ্বেতাম্বর’ অন্যটি ‘দিগম্বর অর্থাৎ নগ্ন রূপে বিকশিত হয়। এই নগ্নতার তাৎপর্য আচ্ছাদন ভিত্তিক। (অর্থাৎ সন্ন্যাসব্রত পালনে দেহে বস্ত্রধারণ নিয়ে দুই ধারার মত পার্থক্য। জৈনরা বিশ্বাস করে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড চিরন্তন ও অসৃষ্ট। তবে সৃষ্টজীবের প্রতি প্রবল জীবনানুভূতি ও জীবপ্রেমের জন্য এই ধর্ম পরবর্তী অপরার ধর্মদর্শনকেও প্রভাবিত করে। সেই সাথে বিশ্বসাহিত্যের কালজয়ী সৃষ্টিতেও রয়েছে জৈন ধর্মদর্শনের প্রভাব। এই প্রভাবের একটি সামাজিক চয়ন এরকম :

‘খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৫ অব্দে আলেকজান্ডার উত্তর-পশ্চিম ভারতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। তিনি পাঞ্জাবের আশেপাশে বেশ কয়েকজন স্থানীয় রাজন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন, এবং সব ক’টি যুদ্ধই জিতে যান। কিন্তু প্রবলপরাক্রমশালী নন্দরাজবংশের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তিনি নিজের সেনাবাহিনীকে বিশেষ উদ্দীপ্ত করতে পারেননি। নন্দরাজারা রাজধানী শহর পাটলিপুত্র (অধুনা পটনা) থেকে ভারতবর্ষের একটি বিশাল অংশ শাসন করছিলেন। আলেকজান্ডার চুপচাপ গ্রিসে ফিরে যেতে রাজি ছিলেন না। বরং আরিস্ততলের সুযোগ্য এই শিষ্য ঠিক করলেন, ভারতীয় দার্শনিক এবং সমাজ ও ধর্মতাত্ত্বিকদের সঙ্গে হালকা তত্ত্ব আলোচনায় কিছু সময় কাটানো যাক।

এক দল জৈন দার্শনিকের সঙ্গে তাঁর খুব জোরালো তর্ক হয়েছিল। বিশ্বজয়ী আলেকজান্ডার তাঁদের প্রশ্ন করেন, কেন তাঁরা তাঁর প্রতি বিশেষ আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি মোটামুটি এই রকম এক গণতান্ত্রিক বক্তব্য শুনতে পান :

রাজা আলেকজান্ডার, প্রতিটি মানুষ শুধু সেটুকু জমিরই অধিকারী যেটুকুর উপরে আমরা দাঁড়িয়ে রয়েছি। আপনিও আমাদের মতোই একজন মানুষ, কিন্তু আপনি সদাই ব্যস্ত এবং অকারণেই আপনার বাসস্থান থেকে বেরিয়ে মাইলের পর মাইল পেরিয়ে চলেছেন। আপনি নিজের কাছে এবং অন্যদের কাছে আপদবিশেষ। … শীঘ্রই আপনার মৃত্যু হবে। তখন সেটুকু মাটিই আপনার নিজস্ব থাকবে যতটুকু আপনাকে কবর দিতে লাগবে।’ (অমর্ত্য সেন, নীতি ও ন্যায্যতা : The Idea of Justice গ্রন্থের বঙ্গানুবাদ, আনন্দ পাবলিশার্স, কলিকাতা, ২০১৩)।

ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, জৈন দার্শনিকদের এই জীবনদর্শনে প্রভাবিত প্রখ্যাত রুশ ঔপন্যাসিক War and Peace প্রণেতা টলস্টয় (১৮২৮-১৯১০) তাঁর ‘How Much Land Does a Man Require’ (একজন মানুষের কতটুকু জমি দরকার) শীর্ষক বিখ্যাত গল্পটির অনুপ্রাণিত পটভূমি এই কাহিনী।

বাঙালির মানবতাবাদী চিন্তা-চেতনার ইতিহাস হাজার বছরের। বাংলা কাব্যে, সাহিত্যে, পৌরাণিক কাহিনী, লোক গাঁথা, সহজিয়া তত্ত্বে কোন না কোনভাবে মানুষ ও মানবতার প্রসঙ্গটি স্থান পেয়ে আসছে। যিশু খ্রিষ্টের জন্মেরও পূর্ব থেকে এ দেশের মানুষ বৌদ্ধ অহিংস নীতি এবং মানবতাবাদী চিন্তার সঙ্গে পরিচিত হয়। যদিও বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব এ দেশের মাটিতে তেমন স্থান করে নিতে পারেনি, তবুও বৌদ্ধ ধর্মের মানবতাবাদী দর্শনের প্রভাব এ দেশে কোন কালেই ভাঁটা পড়েনি। বঙ্গভারতের কয়েকজন লোককবি বৌদ্ধতত্ত্বের মূল স্রোতধারা থেকে বের হয়ে এসে কর্ম-মার্গ, চিত্ত-মার্গ এবং জীবন যাপনের কথা বলেন। তাঁরা হলেন চর্যাকার। এর পরবর্তী সময়ে খ্রিষ্টীয় বার/তের শতকের দিকে ইসলামের ‘ভ্রাতৃত্ববোধ’-এর ধারণায় উদ্ভাসিত ‘সুফি-সাধক’ দের প্রভাবে চৈতন্যদেব এবং তাঁর অনুসারী চণ্ডীদাসের ‘বৈষ্ণবতত্ত্বে’ মানবতাবাদ ভিন্নরূপ লাভ করে। বৈষ্ণবদের প্রেম দর্শনের প্রবল আলোড়ন ভারত তথা ভঙ্গভারতের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় বিদ্যমান কাঠামোগত বর্ণবাদের ভিত্তিতে আঘাত হানে। এভাবে বাঙালির মানবতাবাদী দার্শনিক চিন্তা মধ্যযুগের যুক্তিহীনতার বন্ধ্যাত্ব কাটিয়ে নব জাগরণের আলোক সন্ধানে অগ্রসর হতে থাকে। এমনি সন্ধিকালে বাঙালি সমাজ সংস্কারক, কবি, আধ্যাত্মবাদী চিন্তাবিদ, র‍্যাডিক্যালিস্ট এবং কল্যাণবাদীদের হাতে মানবতাবাদ ভিন্ন আঙ্গিক লাভ করে।

ব্যুৎপত্তিগতভাবে ‘মানব’ শব্দটি এসেছে ইংরেজি ‘human’ শব্দ থেকে, এটি আবার ল্যাটিন ‘homines’ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ হল ‘দয়া’ মানে ‘মানব’ এবং ‘homines’ মানে ‘মানব দয়া’। সুতরাং, ‘মানবতাবাদ’ শব্দটি দ্বারা মানবের প্রতি দয়া বা প্রীতির ভাবকে বুঝানো হয়ে থাকে। ‘মানবতাবাদ’-এ ব্যবহৃত ‘মানব’ শব্দটি বাংলা ভাষার বিশ্ব কোষের আলোকে বিশ্লেষণ করলে পাই— ‘মানব’ শব্দটির উৎপত্তি ‘মনুষ্য’ শব্দ থেকে যা মনুর তথা ‘মনু’র স্নেহভাজন ‘পুত্রবৎ’ ভাবকে নির্দেশ করে এবং এই ‘মনুষ’ শব্দকেই ‘মানব’ বলা হয়। আর মানব সম্পর্কিত আলোচনাই হল মানবতাবাদ। মানবতাবাদ প্রকৃতার্থে এমন এক জীবন-দৰ্শন, যা মানুষের মর্যাদা ও মূল্যবোধকে স্বীকার করে নেয়। মানুষকেই সকল কিছুর মূল্যায়নের মাপকাঠি হিসেবে ধরে নেয়া হয়।

‘খ্রিষ্টীয় অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতকের দিকে বৌদ্ধ ‘বজ্রযান’ সম্প্রদায়ভুক্ত একদল বাঙালি মনীষী মানব মুক্তির কথা বলেন। তাঁদের সেই ভাষিক প্রকরণের প্রকাশ ঘটেছে চর্যাগীতিকায়। চর্যাকারদের পদাবলীতেই সর্বপ্রথম বঙ্গ-মানুষের বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা ও অভিপ্রায় ব্যক্ত হয়েছে। নিম্ন, অবহেলিত, ভুখা মানুষের দুঃখ যন্ত্রণা ও কষ্টের বন্দনায় চর্যাগীতিকা হয়ে ওঠে বাঙালি মানবতাবাদের আদি মুখপত্র। সাধনতত্ত্ব, তথা ধর্মীয় নিগূঢ় ভাব মানসের স্বরূপ নিয়ে পদকর্তাগণ ব্যস্ত থাকলেও তাঁদের গীতিকায় এসেছে তৎকালীন গণসমাজের বিচিত্র অভিব্যক্তি, দরিদ্র গণমানুষের অভাব-অনটন ও মান-অভিমানের কথকতা। গুঢ়-তত্ত্ব ভাষায় চর্চাকারগণ গেয়েছেন তাঁদের নিঃসহতায় জীবনের বন্দনা—শূন্যতা ও অস্পৃশ্যতার বেড়াজালে শৃঙ্খলিত যাপিত জীবনের প্রতি দেখিয়েছেন উম্মা ও বিক্ষুব্ধ প্রকাশ। বস্তুত আশ্রয়হীন, অন্নহীন ও হতদরিদ্র গণমানুষের প্রতিচিত্র যথার্থ রূপায়ণের মাধ্যমে চর্যাগীতিকা রূপান্তরিত হয়েছে জীবন দর্শনেরই এক ভিন্ন ধারাপাতা হিসেবে।

চর্যাগীতিকা-য় লৌকিক জীবনের চরম দুর্দশার পাশাপাশি নারীর সকরুণ আর্তি প্রকাশিত হয়েছে। চর্যাকারগণ গূঢ়-ভাব মানসের সূত্রকে বর্ধিত করেছেন হতদরিদ্র, নিস্পেষিত-অসহায় মানুষের দোড়গোড়া পর্যন্ত। নিম্ন শ্রেণির নারী যাদেরকে সমাজ অবহেলিত, পতিতা বলে জনসমাজ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে- সেই নারীর বেদনার্ত হৃদয়ের কান্না চর্যার ছন্দোবদ্ধতায় উদ্ভাসিত হয়েছে। নারীর প্রতি, নিষ্পেষিত মনুষ্যত্বের প্রতি তাঁদের দরদ উদ্বেলিত হয়েছে চর্যার ছত্রে ছত্রে, নারী সমাজের চিত্র আঁকতে গিয়ে তাদের চর্যায় এমন সব নারীদের প্রসঙ্গ এসেছে যাঁরা প্রকৃতার্থেই লাঞ্ছিত, অবহেলিতা- আঁধার রাতের অভিসারে এসব নারীরা ছিল উচ্চজাতের সমাজ-বিধায়কদের প্রমোদ-সঙ্গিনী, অথচ দিনের আলোতে এসব নারীরা ছিল অস্পৃশ্যা যাঁরা উচ্চবর্ণের সমাজ পতিদের নিন্দা, অবহেলা ছাড়া আর কিছুই পেত না। এমনই বঞ্ছিতা নারী প্রসঙ্গে কাহ্নপাদ বলেন—

আলো ডোম্বি তোত্র সব করিবে সাঙ্গ
জিঘিণ কাহ্ন কাপালি জোই লাঙ্গ।

অবহেলিতা নারী কেবল সঙ্গদানের জন্যই কাঙ্ক্ষিত-এ ব্যতীত সে ঘৃণিতা ও অস্পৃশ্যা, কাহ্নপদ এই রূঢ় বাস্তবতাটি তুলে ধরেছেন এভাবে-

কইসনি হল ডোম্বী তোহারি ভাভারী আলী
অন্তে কুলিনজন মাঝে কাবালী।
তাই-লো ডোম্বী সঅল বিটালিউ
কাজন করেণ অসহয় টালিউ।
কেহো কেহো তোহোরে বিকসা বোলই
বিদুজন লাঅ তোরে কণ্ঠ ন মেলঙ্গ।

চর্যাপদে এভাবে মানুষ ও নারী, ও অবহেলিত, ঘৃণিত ও অস্পৃশ্য— সকলেরই সামাজিক অবস্থান চিহ্নিত হয়েছে— ঐতিহাসিক সূত্রের আলোকে। এভাবে চর্যাপদে স্থান পেয়েছে শোষিত, নির্যাতিত ও অবহেলিত মানুষের করুণ আর্তি।

পনের থেকে আঠার শতক-এই সময়কালে বাঙালি কবি সাহিত্যিকদের হাতে নির্মিত হয় মঙ্গলকাব্য ও ‘বৈষ্ণবতত্ত্ব’। চৈতনোত্তর কালে সুফিবাদ ও বৈষ্ণববাদের প্রভাবে লালন শাহের নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ করে ‘বাউলতত্ত্ব’ নামে আরো একটি মানবতাবাদী জীবন দর্শন। বাঙালির চিন্তা-চেতনায় আধ্যাত্মবাদী মানবতাবাদ নতুন মাত্রা সংযোগ করে।

মঙ্গলকাব্যে পৌরাণিক অবছায়ার ভেতর দিয়ে ‘মানুষ’কে আসীন করা হয়েছে দেবতার ভূমিকায়। সাহিত্য তথা কাব্য চর্চায় দেবভাষা পরিবর্তিত হল মানব ভাষা। রচনার বিষয়বস্তু হল ‘মানুষ’ এবং মানুষ কেন্দ্রিক সমাজের মিথষ্ক্রিয়া। সমসাময়িক কালের প্রবাহ, সামাজিক প্রথা এবং বর্ণবাদী সমাজের কাঠামোগত স্বরূপটি মঙ্গলকাব্যে এসেছে বার বার ভিন্ন ভিন্ন রূপক উৎপেক্ষায়।

মঙ্গলকাব্য রচনাকালীন সমাজপতিদের ছিল দোর্দণ্ড-দাপট। তারা ছিলেন ন্যায়নীতি বিবর্জিত, নিষ্ঠুর এবং অত্যাচারী। এসব শাসকদের নির্দয় স্বার্থপরতা এবং বর্ণ-বৈষম্যের প্রতি কটাক্ষ তথা বিদ্রোহী-স্বভাবের সুনিপুণ প্রকাশ ঘটেছে মঙ্গলকাব্যে। মানুষের হিংস্রতা, দ্বেষ-বিদ্বেষ এবং ভয়ঙ্কর রুদ্র মূর্তিটি প্রকাশ পেয়েছে মঙ্গলকাব্যের দেব-দেবিদের চরিত্রে। সবমিলিয়ে মঙ্গলকাব্যে তৎকালীন শোষিত-বঞ্চিত গণমানুষের বাস্তব সামাজিক অবস্থাটি প্রকাশিত হয়েছে। নিম্নশ্রেণির মানুষের প্রতি ‘মঙ্গলকাব্যে’র রয়েছে একবিশেষ ধরনের সহানুভূতি। যেকারণে দারিদ্র্য-পীড়িত জীবনের কথকতা ফুটে ওঠে মঙ্গলকাব্যের ছত্রে—

দেশে দেশে ফিরি কত ভিক্ষা করি
ক্ষুধায় অন্ন না মিলে।
গৃহিণী দুজন ঘর হইল কন
বাস করি তর তলে।

ধর্মমঙ্গল কাব্যে পাওয়া যায় নারী ও পুরুষের সমমাত্রিক সহাবস্থান। পুরুষের মত নারীরও দেশ মাতৃকার প্রতি মমত্ববোধ রয়েছে, নারী চার-দেয়ালে আবদ্ধ রক্ষিত নয়, সেও একাধারে মানুষ-স্নেহশীল। অন্নদা মঙ্গল কাব্যে আরেক গতিশীল নারী চরিত্র ‘ঈশ্বরী পাটনী’ স্বদেশবাসীর মঙ্গল কামনায় উৎকণ্ঠিত আকুতি নিয়ে বলেন, “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’। অন্যদিকে ধর্মমঙ্গল কাব্যে বীরমাতা ‘লখা’ কনিষ্ঠ সন্তান শুকার মৃত্যুতে কেঁদে ওঠে ‘হাহাকার করে লক্ষে কান্দে উভরায়’। লখার মাতৃহৃদয়ে পুত্র শোকে বিদীর্ণ, ব্যাকুল হৃদয়ের স্নেহধারায় উচ্ছ্বসিত মাতৃপ্রেম সন্তানের মৃত্যুতে পীড়িত, উদ্বিগ্ন। ধর্মমঙ্গলে নারীরা এভাবে হয়ে ওঠে জাগতিকতা ও কর্তব্যবোধের আদর্শে অনুপ্রাণিত দায়িত্বশীল ব্যক্তিত্ব। ভিন্ন ব্যক্তিত্বের ধারণা নিয়ে নারী কখনো শোষিত, নিস্পেষিত কিংবা অধঃস্তন হয়ে থাকুক, অধিকার থেকে বঞ্চিত হোক এরকম আকাঙ্ক্ষা মঙ্গল রচনাকারদের দার্শনিক মননে স্থান পায়নি। যেকারণে নারীকে ‘রমণীর’ করে না দেখে মনুষ্যত্ব চেতনায় জাগ্রত ‘মানুষ’ হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। আবার মনসামঙ্গল কাব্য ‘বেহুলা’ জেগে ওঠে তথাকথিত জাত-পাত সংস্কারের বিরুদ্ধে তেজস্বিণী নারী হিসেবে। যেকারণে সে প্রতিবাদী হয় সহমরণ যাত্রী হবার বিরুদ্ধে। যেভাবেই বিচার করি না মঙ্গলকাব্যের নারীগণ ছিলেন স্নেহশীলা, প্রগতিশীলা, পরাক্রমশালী, শৌর্যে, বীর্যে উদ্দীপ্ত প্রতিবাদী ব্যক্তিত্ব।

মঙ্গলকাব্য রচনাকালীন বঙ্গ-ভারতে ছিল শ্রেণি কৌলিণ্যের দোর্দণ্ড প্রভাব। জাত-পাতের ভেদাভেদের উপর ভিত্তি করে মানুষে মানুষে প্রতিষ্ঠিত হয় বিষম সম্পর্ক। এতে করে কেউ হয়ে উঠেন প্রভু কেউবা সেবাদাস। কিন্তু মঙ্গলকাব্যের কবিগণ এরকম জাতপাতের ঊর্ধ্বে ওঠে মানুষকে দেখতে চেয়েছেন ‘মানুষ ‘ হিসেবে। বর্ণহীন, বৈষম্যহীন তথা শ্রেণিহীন ‘মানবজাতি’, প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন, মানুষকে ‘মনুষ্যত্বগুণে’, উদ্ভাসিত করার দার্শনিকতা— এসব মিলিয়ে মঙ্গলকাব্য হয়ে উঠেছে মানবতাবাদী চিন্তার পথিকৃৎ। বাঙালির চিন্তায় ‘সুফিবাদ’-এর প্রভাব, সুফি দর্শনের গূঢ় সাধনতত্ত্ব, মানবিক মুল্য চেতনা এবং সুফি সাধকদের ভ্রাতৃত্ববোধের মৌলমন্ত্র ‘সমস্ত মানুষ আদম সন্তান এবং মানুষ পরস্পরের ভাই ও সমান মর্যাদার অধিকারী’ ইত্যাদি ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে ইসলাম ধর্মের দিকে প্রভাবিত করে। সুফিবাদের এরকম ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বস্তুত বাঙালি মানবতাবাদী চিন্তাধারাকে আধ্যাত্মবাদের দিকে নিয়ে যায়। আধ্যাত্মবাদী মানবতাবাদের চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে চৈতন্য দেব (১৪৭৮-১৫৩৩) প্রবর্তিত বৈষ্ণব ‘প্রেম দর্শনে’। চৈতন্য দেব তাঁর বিভিন্ন কাব্য এবং পদাবলীর সাহায্যে বাঙালির চিন্তায় নবতর ভাবতরঙ্গের সৃষ্টি করেন। বৈষ্ণবীয় প্রেম ও ভক্তির ঐক্যকে সামাজিক দর্শনে, ভ্রাতৃত্ববোধ ও প্রেমবোধে রূপান্তরিত করতে চেষ্টা করেন। বৈষ্ণবীয় ‘প্রেমদর্শন’ মানব-মানবীর প্রেমলীলার বিমূর্ত প্রকাশ, মানবীয় প্রেমই সর্বজনীনরূপে নিরাকৃত ঈশ্বর প্রেমে প্রকাশিত হয়। যেকারণে বৈষ্ণব পদকর্তাগণ মানবীয় কৃষ্ণের ত্রিমাসিক স্বরূপ- সৎ, চিৎ আনন্দ এবং ত্রি-মাত্রিক শক্তি ‘ভ্লাদিনী’, ‘সন্ধিনী’, ‘সংবিৎ’-এর কথা বলেন। যা মূলত বিমূর্ত পরমসত্তারই প্রকাশ। বৈষ্ণবপদাবলী প্রেমভাবকে দার্শনিকভাবে বিমূর্ত করা হয়েছে— তা যেমন সত্য, আবার রাধা-কৃষ্ণের পরম- প্রেম এবং এর অন্তর্নিহিত স্বরূপের ভেতর দিয়ে মানবীয় প্রেমেরই যে জয়গান করা হয়েছে— তা অস্বীকার করার উপায় নেই। আবার সমাজ মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ অনুসারে পদাবলীসমূহে প্রকাশিত হয়েছে সমকালীনতা, সামাজিক বাস্তবতা, মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও শ্রেণি চরিত্রের চরম প্রকাশ।

পদাকর্তাগণ ছিলেন স্বপ্নবাদী। রহস্যবাদী চিন্তার আড়ালে মানুষকে তাঁরা স্বপ্ন দেখিয়েছেন। তৎকালীন ক্লিষ্ট আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে মানুষ যেন হারিয়ে না বসে তার প্রকৃত উৎস তথা ‘মনুষ্যত্ববোধ’ : সেকারণে প্রেমলীলা, রসলীলা এবং এর ভেতর দিয়ে মানুষকে সন্ধান দিয়েছিলেন প্রকৃত মানবদর্শনের। যেকারণে পদাবলীতে সমকালীন লোকজীবনের ভয়াবহ দারিদ্র্যের কথা পাওয়া যায় না। পদাবলীর সামগ্রিক পরিবেশ আনন্দের, কৌতুকের স্নিগ্ধতার। আজীবন দারিদ্র্য ক্লিষ্টতা, অভাব-অনটনে পীড়িত মানুষের যন্ত্রণা, কামনার বিকৃত প্রতিফলনের ভেতর দিয়ে মিটিয়ে নেবার চেষ্টা ছিল। ‘সে জন্য দেখি, যে কৃষ্ণ এক কাহনের জন্য রাধা ও তার সখীদের উৎপীড়ন করছে, সে কৃষ্ণের নৌকার দাঁড়, বৈঠা, তক্তা, সবই সোনা-রূপা মানিক্য নির্মিত।…. যে রাধা দুধ-দই-ঘি-মাখনের পশরা মাথায় করে বাজারে বেচতে যান, তার শরীরে দেখি মণিমুক্তার তৈরি কঙ্কন, নুপূর, হার, নথ ঝলমল করে।’ ষোড়শ শতকে বাঙালির সামাজিক ব্যবস্থা ছিল চরম বর্ণবাদী। ব্রাহ্মণ্যবাদী ধারণার ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে সমাজ— সে সমাজে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ছিল এবং থাকবেই। ব্রাহ্মণরা ছিলেন সকল কিছুর রক্ষক, তাদের অঙ্গুলি ইশারায় সমাজ এবং সমাজের বিধায়ক পরিমণ্ডল পরিচালিত হত, বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ছিল অবহেলিত, দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত। এরকম বর্ণবাদী সমাজের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে শ্রী চৈতন্যদেব দ্ব্যর্থহীন ভাষায় উচ্চারণ করেছিলেন—

বৈষ্ণবের জাতিভেদে করিলে প্রমাদ।
বৈষ্ণবের জাতিভেদ নাহিক সংসার।

চৈতন্য দেবের এই উক্তি বাহ্মণ্যবাদী বর্ণবিভেদের পরিবেশে মানুষে মানুষে যে বিষম সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল তাতে আঘাত হেনেছিল। সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও বিশ্বমানবতার বাণী দিয়ে এক অখণ্ড মানবজাতি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন।

বৈষ্ণব দর্শনে অখণ্ড মানবজাতি প্রতিষ্ঠা, সামাজিক কল্যাণ ও মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ছিল সুসংহত। অতীন্দ্রিয় প্রেমতত্ত্বকে তাঁরা পরমার্থিক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ না রেখে মানব প্রীতিবাদে রূপান্তরিত করেন। এভাবে বৈষ্ণবদের মানবতাবাদী দর্শনের উপর ভিত্তি করেই বাঙালি উপলব্ধি করেছিল ‘জীবে ব্ৰহ্ম’ এবং ‘নরে নারায়ণ।’ খোদ চৈতন্য দেবের কাছে মানব প্রেম রূপান্তরিত হয় সর্বাত্মক মিলন কেন্দ্রে।

বৈষ্ণবদের সকল গূঢ়তত্ত্ব ও তথ্যের আড়ালে ছিল মানবতাবাদ, এই মানবতাদের চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে চণ্ডীদাসের ঘোষণায়—

চণ্ডীদাস কহে শুনহ মানুষ ভাই
সবার উপর মানুষ সত্য
তাহার উপরে নাই।

সহজিয়া মরমী ভাবতত্ত্ব— ‘বাউল-তত্ত্বে’ মানবতাবাদের ভিন্ন ধারা লক্ষ্য করা যায়। বাউল তত্ত্বের সাধকগণ বৈষ্ণববাদীদের চেয়ে আরো বেশি রহস্যবাদী, তাঁদের এই রহস্যবাদের আড়ালে রয়েছে মানবতাবাদের পাকা-পোক্ত ভিত্তি। প্রথা ও প্রচলিত সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে ওঠে, জাত-পাতহীন সাম্প্রদায়িক সমাজ আকাঙ্ক্ষা ছিল বাউল দর্শনের কেন্দ্রীয় ভাব। জাতপাত-মানবিক মূল্যবোধ খর্ব করতে পারে, যেকারণে লালন সেই জাত-পাতের থলে আগুন লাগাতে চেয়েছেন।

এবার জাত বিচারী দূরাচারী যায় তারা নব দূর হয়ে।
জাত না গেলে পাইনে হরি কি ছার জাতের গরব করি।
ছুসঁনে বলিয়ে লালন কয় জাত হাতে পেলে পোড়াতাম আগুন দিয়ে।

এরকম অসংখ্য গানে বাউল সাধকদের বর্ণহীন, শ্রেণিবিভক্তহীন, জাতপাতহীন সমাজের আকাঙ্ক্ষায় গভীরভাবে প্রোথিত ছিল। যেকারণে ভিন্ন ধর্ম, বর্ণ এবং জাত-পাতের মানুষ নিয়ে বিশ্বমানব বা সর্বজনীন মানবের সন্ধান করেছেন। সুতরাং, মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ থাকতে পারে না। ‘সকল মানুষ ভাই ভাই’। বাউলদের সাধনতত্ত্বে এভাবে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ তথা জীবন দর্শনের স্বরূপ প্রকাশিত হয়েছে।

আঠার এবং উনিশ শতকের দিকে নব্য শিক্ষিত বাঙালিদের হাতে মানবতাবাদ ভিন্নরূপ লাভ করেছিল। রামমোহন, ডিরোজিও, বিদ্যাসাগর ও অক্ষয়কুমার দত্তের নাম এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তৎকালীন ইউরোপীয় যুক্তিবাদী মানসিকতার অভিঘাত নিঃসন্দেহে রামমোহনকে (১৭৭২-১৮৮৩) প্রভাবিত করেছিল। ইউরোপীয় রেঁনেসাস, মিল ও বেহামের উদারনৈতিকতাবাদ এবং ইয়েনের সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধ তাঁকে আলোড়িত করেছিল। অদৃষ্টবাদী চিন্তা, কর্মফল, জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস এবং নিয়তি-নির্দিষ্ট বৃত্তে আবদ্ধতা-সবমিলিয়ে বাঙালির সমাজ জীবনে যে মানসিক দৈন্যদশা ছিল তার কবল থেকে মুক্ত হবার অস্থিরতা রামমোহনকে পীড়িত করেছিল। সেকারণে তিনি তুহ-উল- মুহয়াহিদীন (১৮০৩-৪) গ্রন্থে যুক্তিবাদী সত্যানুসন্ধানে লিপ্ত হন। ‘নির্বিচারবাদ, যুক্তিহীনতা সাধারণ মানুষের মনে হীনতার জন্ম দেয়। এই নীতির প্রতি তাঁর বিশ্বাস ছিল প্রগাঢ়। প্রাচীন তথা যা মানুষ গ্রহণ করেছে সহজাতভাবে অথচ এসব প্রথার মধ্যে রয়েছে ‘নীতিহীনতা ও সামাজিক স্বাচ্ছন্দ্য ধ্বংস করার প্রত্যক্ষ কারণ’— সেসব তিনি যৌক্তিকভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এ কারণেই তিনি উপলব্ধি করে বলেছেন, ‘মূর্তিপূজা সমাজের বিন্যাসটা ধ্বংস করে দেয়। অন্যত্র বলেন, ‘যে বিষয়ের কোন প্রমাণ নাই, যা যুক্তি-বিরুদ্ধ, তা একজন যুক্তিবাদী কী করে গ্রহণ বা স্বীকার করতে পারেন?’ এরকম যুক্তিবাদিতার ওপর দাঁড়িয়েই তিনি পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে, একেশ্বরবাদের পক্ষে এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধসমৃদ্ধ নতুন ধর্মের কথা চিন্তা করেন। যে ধর্মের মৌলিক কথা হল— ‘জাতি, বর্ণ ও ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের হৃদয় পরস্পরের প্রতি প্রীতি ভালোবাসা দিয়ে জয় করাই হল সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের নিকট গ্রহণীয় বিশুদ্ধ পূজা’। মানবতাবাদ সম্পর্কিত এরকম দার্শনিক চিন্তা তিনি গ্রহণ করেছিলেন খ্রিষ্টান ধর্মের উদারনৈতিক ব্যাখ্যা থেকে। তাঁর গোস্বামীর সহিত বিচার (১৮১৮) রচনায় দেখান— খ্রিষ্টান ধর্মের মূলশক্তি হল ভালবাসা, মানবপ্রেম। তাঁর প্রগাঢ় তীক্ষ্ণতা, গভীর মননশীলতাই তাঁকে প্রলুব্ধ করে খ্রিষ্টান ধর্মের মধ্যকার মানবতাবাদী প্রত্যয়টি উদ্ঘাটন করতে।

রামমোহন মানবতার প্রশ্নে অনুসন্ধান করেছিলেন একটি সর্বজনীন ধর্মমতের, যে ধর্মমতের অনুশীলন ‘সমাজের স্বার্থ’ এবং ‘ব্যক্তিস্বার্থ’– এ দুয়ের মধ্যকার বিরোধ নিরসনে সক্ষম হতে পারে, সমাজে নৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে। তাঁর মতে, ব্যক্তিস্বার্থকে তুচ্ছ করে সামষ্টিক স্বার্থকে অপেক্ষাকৃত অগ্রগণ্য করার জন্য উচ্চতর আদর্শের প্রয়োজন। এ ধরনের আদর্শ জাগতিক, বৈষয়িক স্বার্থ থেকে ভিন্ন, যা হল আধ্যাত্মিক আদর্শ। একে তিনি ‘সর্বজনীন ধর্ম’ বলে আখ্যায়িত করেন।

রামমোহনের কাছে ধর্ম হল ‘মানবধর্ম’। মনুষ্যত্ববোধ বিবর্জিত কিংবা মানুষের কল্যাণ সাধন করতে পারে না- এরকম জাগতিকতা বিচ্ছিন্ন ধৰ্ম প্ৰকৃত ধর্ম হতে পারে না। ধর্ম আধ্যাত্মিক উপলব্ধির ভেতর দিয়ে মানুষের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধ, মমত্ববোধ এবং ভ্রাতৃত্ববোধকেই মহিমান্বিত করতে চায়। এসব প্রেক্ষিত থেকে ধর্মকে আরো মানবতাবাদী করার প্রয়াসে রামমোহন ধর্ম ও যুক্তির পরস্পরিকতা স্বীকার করেন। যুক্তি যেন আমাদের চিন্তাকে সংশয়ের দিকে নিয়ে না যায়, আবার আধ্যাত্মিকতা যেন আমাদের বঞ্চিত না করে। যুক্তি ও আধ্যাত্মিকতার এরকম বোঝাপড়ার ওপর ভিত্তি করেই রামমোহন উচ্চতর আদর্শের বাস্তবায়ন চেয়েছিলেন। যার ভিত্তিতে সম্ভব মানুষ তথা মানবতার মুক্তি।

রাজা রামমোহন রায়ের মানবতাবাদী চিন্তার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে ‘সতীদাহ প্রথা’র মত সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মাধ্যমে। রক্ষণশীল হিন্দুগণ সহমরণকে হিন্দু সমাজ ও ধর্মের পরম্পরা বলে মনে করেছেন। এই ‘পরম্পরাবাদ’ জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারার মত অমানবিকতাকে উৎসাহ দেয়, তাই রামমোহন রায় এর বিরুদ্ধে সংগ্রামী অবস্থান গ্রহণ করেন। সতীদাহের বিরুদ্ধে মানুষের বিচারশক্তি ও শুভবুদ্ধিকে শাণিত করার জন্য ধর্মীয়গ্রন্থাদি থেকে উদ্ধৃতি নিয়ে গ্ৰন্থ ও প্রবন্ধ রচনা করেন। ধর্মীয় উদ্ধৃতির সহায়তা নিয়ে তিনি বলেন, ‘ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় বিধবাকে সহমরণের সায় দেয়ার অর্থ দাঁড়ায় নারী হত্যার সম্মতি দেয়া অন্যত্র বলেন, ‘স্ত্রীবধ, ব্রহ্মবধ, মাতৃহত্যা ইত্যাদি দারুণ পাতক সকল দেশাচার চলতে ধর্মরূপে গণ্য হইতে পারে না। বরঞ্চ এরূপ আচার যে দেশে হয়, সে দেশই পতিত হয়।’ রামমোহন সতীদাহ প্রথার বিপক্ষে রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। পাশাপাশি ‘প্রবর্তক’ ও ‘নিবর্তক’ রচনায় এ আন্দোলনকে দার্শনিকীকরণ করতে চেয়েছেন।

রামমোহন রাজনৈতিকভাবে বেন্থামের উপযোগবাদী তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। সেকারণে বেন্থাম নিজেই রামমোহন সম্পর্কে বলেন, intensely admired and dearly loved collaborator in the service of mankind – সকল মানুষের সুখের সর্বোচ্চকরণের প্রয়াসে গভীর অনুধ্যান, যুক্তিপ্রবণতা এবং রাজনৈতিক ভাবাদর্শের ক্ষেত্রে রামমোহন ভিন্নধারার সৃষ্টি করেছেন। সেকারণে তিনি বলতেন, স্বাধীনতা, স্বতঃস্ফূর্ত ও সদা বিকাশমান প্রক্রিয়া— যা প্রকৃতি এবং মানুষের ব্যক্তিজীবন ও গোষ্ঠীজীবনের স্বাভাবিক বিকাশে প্রয়োজন। এজন্য ব্যক্তির মত সমাজজীবনে তথা রাষ্ট্রীয়জীবনে স্বাধীনতা প্রয়োজন।

রামমোহন সমাজকে গতিময় করতে চেয়েছিলেন। সনাতন সামাজিক কুসংস্কারসমূহ গতিশীল জীবনদর্শনের আলোকে দূর করে আধুনিক সমাজধারা সৃষ্টি করার প্রয়াস ছিল তাঁর এই দর্শনের মুখ্য উদ্দেশ্য। হাজার বছরের ব্যবধানে বাঙালির চিন্তাধারায় স্রোতহীন জলাশয়ের মত যে বদ্ধদশার সৃষ্টি হয়েছে তা কাটিয়ে ওঠে বাঙালি বিশ্ব সংস্কৃতির সঙ্গে সংযোগ সৃষ্টি করতে পারবে এবং বিশ্বাসটি তাঁর মধ্যে দৃঢ়ভাবে ছিল। যেকারণে তিনি মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন আলোকিত মানুষ নিয়ে ভারতীয় সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছেন। তাঁর এক নিবন্ধে সে রকম সমাজের কাঠামো বর্ণনায় উল্লেখ করেন—

…a nation who not only are blessed with the enjoyment of civil and political liberty, but also interest themselves in promoting liberty and social happinesess as well as free inquiry into literary and religious subjects, among those nations to which their influence extends ।

সর্বোপরি রামমোহনের চিন্তা ছিল একটি বিশ্বসমাজ গড়ে তোলার স্বপ্ন- এই বিশ্ব সমাজ পড়ে তোলার প্রয়াসে বিদ্যমান ছিল মানবতাবাদী সমন্বয়ধর্মী সমাজচেতনাবোধ। এ প্রেক্ষিতে আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল যথার্থই বলেছেন :

He was the harbinger of the idea of universal Humanism. Though Voltaire and Volney had a glimpse of the resing sun of humanism, they destorted the view by patting the East against the west…. theirs was a militant Humanism as opposed to the Raja’s synthetic and universalistic point of view ।

রামমোহনের রাজনৈতিক চিন্তা, সমাজ দর্শন এবং ধর্মতাত্ত্বিক চিন্তায় সংস্কার সাধন এবং গতিশীল প্রবণতা বাঙালির সামাজিক ব্যবস্থায় আধুনিকায়নের পথ উন্মোচিত করেছে। ইউরোপীয় রেনেসাঁসের সংবেদনশীলতা, যুক্তিশীলতা দ্বারা বাঙালির চিন্তাকে আলোড়িত করেছিল, অনুপ্রেরণা দান করেছিল। কিন্তু সে অনুপ্রেরণা সঠিক পথ ধরে এগুয়নি। রেনেসাঁসের যৌক্তিকতাবাদ এবং আনন্দধর্মীতা- এ দুটিকে রামমোহন এক করে বুঝতে পারেননি। যেকারণে তাঁর চিন্তা ভারতীয় বাঙালি সমাজের সাংস্কৃতিক টানাপোড়নের চৌহদ্দি ভেঙ্গে প্রগতিশীল হতে পারেনি।

এইচ.এল.ভি. ডিরোজিও (১৮০৯-৩১) রামমোহনের প্রচলিত ধারা থেকে বের হয়ে এসেছিলেন। মুক্ত চিন্তা, মুক্তিবাদী ও বিজ্ঞান মানসকিতার দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে এই তরুণ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন রামমোহনের ‘আধা-ধর্ম আধা রাজনীতি’কে। প্রতিষ্ঠা করেন ‘ইয়ং বেঙ্গল সোসাইটি’ নামে মুক্ত চিন্তার নতুন ধারা। নব্য বাঙালির মানসলোকের অগ্রদূত ডিরোজিও ধর্মীয় রক্ষণশীলতার বৃত্ত ভেঙ্গে অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি ও মানবমহিমার উদার জয়গান গেয়েছিলেন। সংস্কারমুক্ত ও আত্মপ্রত্যয়ী মানসিকতা নিয়ে বাঙালির নবজাগরণের গতিপ্রবাহকে মানবমুখীন করে তোলেন।

ডিরোজিও তাঁর চিন্তা-চেতনা, সাহিত্য, ধর্ম তথা সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে মানবতাবাদী জীবন দর্শনের অনুশীলন করেছিলেন। বিজ্ঞান মানসিকতার আলোকে বাঙালির মানবতাবাদী ধারাকে আধুনিক প্রগতিশীল ধারণার সমপর্যায় যুক্ত করেন।

ডিরোজিও’র পরবর্তীকালে নরমপন্থী সংস্কার আন্দোলনের ভেতর দিয়ে বাঙালির মানবতাবাদী চিন্তাধারাকে যিনি গতিমুখী করতে চেয়েছিলেন তিনি হলেন পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-৯১)। বিদ্যাসাগর প্রাচীন পৌরাণিক কথামালাগুলোকে একেবারে লোকজ বাঙালি ঘরানার আদলে বিনির্মাণ করেছেন। প্রাচীন নারীর মর্মব্যথা, কষ্ট ও অন্তর্জালাকে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন— এ নারীর ভেতর তিনি চেয়েছিলেন বর্তমান ও আগামীদিনের নারীর মনুষত্ববাদী মর্যাদার আশা প্রত্যাশার ধারাবাহিক বাস্তবায়ন— সেকারণে সীতার বনবাস এবং শকুন্তলা— এ দুটি আখ্যানভাগ প্রাচীন পৌরাণিক নারীর একাকিত্ব, অসহায়ত্ব সব মিলিয়ে হাজার বছরের বাঙালি নারীর বাস্তব অবস্থাকে সরল বিষয়াভাবে চিত্রিত করতে পেরেছেন। এখানে তাঁর মনুষ্যত্ববাদী ধারারই শৈল্পিক প্রকাশ ঘটেছে।

রামমোহন হিন্দুধর্মে ‘সতীদাহ’ প্রথা উচ্ছেদ করে বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন, বিদ্যাসাগর ‘বিধবা-বিবাহ’র স্বপক্ষে শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করে রক্ষণশীল বাঙালি হিন্দু সমাজের চৈতন্যের মগ্নতা ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। তবে রামমোহন ধর্ম সংস্কারের মাধ্যমে সমাজ সংস্কার চেয়েছিলেন। এ কাজ করতে গিয়ে তিনি হিন্দু ধর্ম সংস্কারের মাধ্যমে সমাজ সংস্কার চেয়েছিলেন। এ কারণে তিনি হিন্দু ধর্ম থেকে পালিয়ে সমাজ-সংস্কারের গুরুত্বটিকে বিবেচনা করেছিলেন। বেদান্তের প্রচলিত ব্যাখ্যা থেকে আলাদা করে ‘একাত্ববাদী’ ধারা গ্রহণ করেছিলেন। অথচ ব্যক্তিগত জীবনে তিনি জাতিভেদ প্রথার গণ্ডি ছিন্ন করতে পারেননি। এখানেই ঈশ্চরন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে রামমোহনের পার্থক্য। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যে বেদান্তকে ভ্রান্ত মনে করেছেন— তার প্রভাবে থেকেই দেশ ও সমাজকে মুক্ত করার স্বপ্ন দেখেছেন। নির্পিত ভ্রান্ত-দর্শনের পথে তিনি ফিরে আসেননি।

বিদ্যাসাগরের মানবতাবাদী চিন্তার একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত হল— তাঁর শিক্ষা চিন্তা। দরিদ্র ও নিম্নশ্রেণির মানুষের শিক্ষার বিকাশের জন্য তিনি প্রগতিশীল ভূমিকা রেখেছিলেন। মানুষ যেন লোকাচার ও দাসত্বের শৃঙ্খল ভাঙ্গতে পারে— সেজন্য তিনি লোকসমাজকে ধর্ম অপেক্ষা যুক্তিশীলতার দিকে উৎসাহী করেছিলেন।

অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮২০-৮৬), ছিলেন বিদ্যাসাগরের সমসাময়িক। নিজস্ব মননগত সততা এবং বক্তব্যের যৌক্তিকতা দিয়ে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন বাঙালির সঙ্কটের স্বরূপটি। তাঁর চিন্তায় প্রকাশিত হয়েছে বাঙালির জীবন ও অস্তিত্ব সম্পর্কিত ধ্যান-অনুধ্যানের দার্শনিক বাস্তবতা। তাঁর দার্শনিক চিন্তায় বিস্তৃত পরিসরে এসেছে বহিঃস্থ প্রকৃতির সঙ্গে মানবপ্রকৃতির অন্তর্গত সম্পর্কটি। অক্ষয়কুমার অভিনব ধারায় বাহ্যজগতের রীতি নিয়মের স্বরূপ বিশ্লেষণ করেন, এসব নিয়ম-রীতির স্থিরকরণের ভিত্তিতে জীবন-যাপনের আদর্শটিও নির্ণয় করেন। যেকারণে তাঁর রচনায় যুক্তিশীলতা, মানুষের এবং প্রকৃতি একই সরলরেখায় অগ্রসর হয়েছিল।

অক্ষয় কুমার দত্তের মানবতাবাদী চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-৯৪)। তাঁর চিন্তার মূল স্বভাবধর্মটি অন্তর্নিহিত ছিল মনুষ্যত্ববোধ সমন্বিত মানবিক চেতনায়। এ চেতনার পরিপূর্ণ পরিস্ফুটনের কারণেই তিনি সনাতন পন্থীদের থেকে ছিলেন স্বতন্ত্র্য। অধিবিদ্যা কিংবা অতীন্দ্রয়বাদ বিযুক্ত ধর্মতত্ত্ব গ্রন্থটি এরকম দার্শনিক যুক্তিবাদের উপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত।

রবীন্দ্রনাথ বাঙালি চরিত্রের স্ববিরোধিতায় বিব্রত ছিলেন। বাঙালি চরিত্রের বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগর স্মরণে প্রণীত ‘চারিত্র পূজা’ প্রবন্ধে বলেছিলেন :

‘আমরা আরম্ভ করি শেষ করি না, আড়ম্বর করি কাজ করি না; যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না, যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না; ভুরিপরিমাণ বাক্যরচনা করিতে পারি, তিল পরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না, আমরা অহঙ্কার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতা লাভের চেষ্টা করি না। আমরা সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি অথচ পরের ত্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে থাকি; পরের অনুকরণে আমাদের গর্ব; পরের অনুগ্রহ আমাদের সম্মান, পরের চক্ষে ধূলি নিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিক্স এবং নিজের বাক্ চাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তিবিহ্বল হইয়া উঠাই আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য।

কিন্তু বিদ্যাসাগর ছিলেন বাঙালির এই স্ববিরোধী চরিত্রের ব্যতিক্রম। এই ব্যতিক্রম চরিত্রে রবীন্দ্রনাথের বিস্ময়বোধ ছিল। তাই এই নষ্টবঙ্গে বিদ্যাসাগরের মতো মানুষের জন্মে রবীন্দ্রনাথ বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন : ‘বিশ্বকর্মা যেখানে চার কোটি বাঙালি নির্মাণ করিতেছিলেন, সেখানে হঠাৎ দুই-একজন মানুষ গড়িয়া বসেন কেন তা বলা কঠিন’। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ বিদ্যসাগরকেই বাঙালিদের মধ্যে ‘মানুষ’ হিসেবে আখ্যাত করেছিলেন।

তবে রবীন্দ্রনাথ এই বীরভোগ্যা বসুন্ধরার প্রতি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘সাড়ে সাত কোটি বাঙালির হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি।’ এর পরেও রবীন্দ্রনাথ হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়কে জানিয়েছিলেন— ‘আমি তোমাদেরই লোক’ কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আমাদের সকলের হতে পারেনি। এর বহু দৃষ্টান্ত আছে রবীন্দ্রনাথের স্বকালে এবং তাঁর মহাপ্রয়াণের পরেও আজ অবধি।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত মাত্রই তাঁর অধীত বিদ্যার আলোকে জানেন, ধর্মে মানবতার কথা নেই এমন কোন গ্রন্থই ধর্মগ্রন্থ বলে গণ্য হয় না। আর সকল ধর্মগ্রন্থের অন্যতম উদ্দেশ্যই হল মানুষকে মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা। তবে মানুষের সবচেয়ে কঠিন কাজ তার মানুষ হওয়া। ‘পশুপাখি জন্ম থেকেই পশুপাখি; কিন্তু মানুষ জন্ম থেকেই মানুষ নয়’–একথার তাৎপর্য মানুষ জানে। আর তাই দেখা যায়, কাব্য মহাকাব্য সাহিত্য ও সংগীতে মানুষের সকল সৃজনশীলতার প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় মানুষ। মুখ্যত স্রষ্টা ও সৃষ্টিকে ঘিরেই মানুষের মানবতা ও মানবিক চেতনার উন্মেষ ও বিকাশ। তাই মানুষের মানবতার প্রথম পাঠ বলে স্বীকৃত হয়েছে হাদিসে রসূলের এই বাণী : ‘মান আরাফা নাফছাহু ফাকাদ আরাফা রাব্বাহ’ (যে নিজেকে চিনিছে, সে তার রবকে চিনেছে)। নিজেকে চেনাজানার চেষ্টা করাই হল ধার্মিকের কাজ। মানুষের জীবনে এই চেনাজানার সফলতার উপরই তার মানবতা ও মানবিক চেতনা বিকশিত হয়। মানুষের দয়া মায়া প্রেম ভালোবাসা সকল উপলব্ধির উৎস এই আত্মদর্শন। বিশ্ব সাহিত্যের সকল শ্রেষ্ঠ রচনায় প্রতিফলিত হয়েছে এ আত্মদর্শনের প্রতিধ্বনি। মানুষের জীবনের সফলতা ব্যর্থতা সকল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এই আত্মদর্শনেই আবর্তিত। এই আত্মদর্শনেই মানবিক বোধে উজ্জীবিত হয় তার ন্যায় নিষ্ঠা, জাগ্রত হয় বিবেক। যেহেতু হিতাহিত বা ভালোমন্দ বিবেচনা ও বিচারের মানদণ্ড হচ্ছে মানুষের বিবেক কেননা ‘মানুষের বিবেকই হল শ্রেষ্ঠ আদালত’। জগতের বিচারিক আদালতেও তখন ‘দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতা কেঁদে যান সমান আঘাতে’। তখন মানুষ পায় বিচারকের শ্রেষ্ঠ মানবিক বিচার, আত্মদর্শনে উদ্ভাসিত হয় মানবতা। তাই বিবেকের নির্দেশ মেনে চলাই ধার্মিকের দায়িত্ব। এই দায়িত্বে যিনি নিবিষ্ট থাকেন তিনিই প্রকৃত মানবিক মানুষ। তাঁর কাছেই প্রত্যাশিত হতে পারে প্রকৃত মানবতা।

নির্বাচিত গ্রন্থপঞ্জি

A.A. MacDonnell, Lectures on Comparative Religion; Calcutta University, Calcutta, 1925

Huston Smith, The Religions of Man; New American Library, New York, 1963

Preetybhushan Chattaypadhyay, Studies in Comparative Religions; Dashgupta & Co. Calcutta, 1971

Amartya Sen, The Idea of Justice; First published in the United Kingdom by Penguin Books Ltd. 2009

দীনেশচন্দ্র আচার্য অনূদিত মহাত্মা গান্ধী প্রণীত নীতিধর্ম; মডেল লাইব্রেরী, ঢাকা ও ময়নমনসিংহ, প্রথম সংস্করণ ১৯৩৬

মোহাম্মদ আবদুল হাই (সংকলন ও সম্পাদনা), নীতিকবিতা সংগ্রহ; সূচীপত্র, প্রথম সংস্করণ ২০০৫

মোস্তাক আহ্লাদ, চিন্তার পরিধিই সাফল্যের ভিত্তি নির্মাণ করে; গ্রন্থ কুটির, ঢাকা, ২০১৫

মোহাম্মাদ মাহবুব আলী, মির্জা গালিব; নওরোজ সাহিত্য সম্ভার, ঢাকা, ২০১৫

আবদুর রাজ্জাক, ধর্মনিরপেক্ষতা ও মানবসমাজ; র‍্যামন পাবলিশার্স, ঢাকা, ২০১৮

রমাপ্রসাদ চন্দ, ইতিহাসে বাঙালি; জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০১৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *