৪. ধর্ম ও দর্শন

চতুর্থ অধ্যায় – ধর্ম ও দর্শন (Religion and Philosophy)

ধর্মে দর্শন বনাম দর্শনের ধর্ম

দর্শনের ন্যায় ধর্মও বস্তুর কারণ ও উৎপত্তি সম্পর্কে অনুসন্ধান করে। আদিকালে বিজ্ঞান সম্পর্কে মানুষের যখন কোন জ্ঞান ছিল না, তখন ধর্মই তাকে জীবনের সমস্যাবলী সমাধানের কাজে পরিচালিত ও সাহায্য করেছে। ব্যর্থতার সম্মুখীন হলেই মানুষ তারচেয়ে শক্তিশালী বলে কথিত অতিপ্রাকৃত সত্তার সাহায্য কামনা করেছে। ইহলোকের অবস্থা পরিবর্তনের ব্যর্থতা তার মনে সৃষ্টি করেছে এমন এক পরলোক বিশ্বাস ও কল্পনা, সেখানে তার সব আশা-আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হবে।

ধর্মের দুটি দিক আছে— বিশ্বাস ও কর্ম। বিশ্বাস বলতে বোঝায় জীবন পরিচালনা ও কল্যাণ সাধনসহ সেইসব মৌল ধারণাকে, যেগুলো সব ধর্মে সমানভাবে উপস্থিত। সুতরাং বলা যায়, ধর্মের লক্ষ্যই হচ্ছে মানুষের কল্যাণসাধন। আর এ লক্ষ্য অর্জনের উপায় হিসেবে ধর্ম মানুষের সামনে উপস্থাপিত করেছে কতিপয় ধারণা ও মূল্যমান। এ থেকে বোঝা যায় যে, মানুষের জন্যই ধর্ম, ধর্মের জন্য মানুষ নয়। বিভিন্ন দেশের ও বিভিন্ন সময়ের জীবনব্যবস্থা অনুযায়ী দেশান্তরে ও কালান্তরে বিভিন্ন ধর্মের আচরণ ও অনুশীলন ভিন্নতর হয়ে থাকে। ধর্মে ধর্মে যে তিক্ত বিরোধ ও সংঘর্ষ লক্ষ্য করা যায়, এ সবেরই মূলে রয়েছে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ও যাগযজ্ঞের পার্থক্য।

তাই ধর্মে ধর্মে এই তিক্ত বিরোধের অবসান প্রয়াসী বাংলার অসংখ্য লোকায়ত দার্শনিক-কবির চিন্তাজগতেও উচ্চারিত হয়েছে প্রীতি-প্রেমের পুণ্য বাঁধন সংগীত। হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত স্বার্থের স্বপক্ষে শেখ ফজলল করিমের (১৮৮২-১৯৩৬) কালজয়ী কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে এই দৰ্শন :

কোথায় স্বর্গ? কোথায় নরক? কে বলে তা বহুদূর?
মানুষেরি মাঝে স্বর্গনরক-মানুষেতে সুরাসুর।
রিপুর তাড়নে যখন মোদের বিবেক পায় গো লয়,
আত্মগ্লানির নরক অনলে তখনই পুড়িতে হয়।
প্রীতি-প্রেমের পুণ্য বাঁধনে মিলি যবে পরস্পরে
স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন আমাদেরি কুঁড়ে ঘরে।

(বাসনা/‘স্বর্গ ও নরক’)

এটি একটি নিছক ছাত্রপাঠ্য কবিতা নয়, এটি একটি দর্শন-প্রীতিপ্রেমের পুণ্য মানব দর্শন। এখানে স্বর্গ-নরকের মোহগ্রস্ততা থেকে মানুষকে মুক্ত করে পরস্পরকে প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার যে আহ্বান আছে— তাতে মানবমুক্তির দর্শনই প্রতিফলিত হয়েছে।

বাঙালির ধর্মবোধ বিকাশের স্বরূপ-সন্ধিৎসু গবেষক ও প্রকৃতি বিজ্ঞানের পথিকৃৎ লেখক অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮২০-১৮৮৬) বীজগণিতের সমীকরণ প্রণালীতে দেখিয়েছেন প্রার্থনার শক্তি মিথ্যে এবং ভুল। যেমন –

পরিশ্রম = শস্য

পরিশ্রম + প্রার্থনা = শস্য

অতএব প্রার্থনা = ০

অক্ষয়কুমার দত্ত এই সমীকরণ প্রণালীতে প্রমাণ করেছেন কৃষিজীবী লোক পরিশ্রম করেই শস্য লাভ করে; কিন্তু জগদ্বীশ্বর সমীপে প্রার্থনা দ্বারা কোন কৃষকের কস্মিনকালেও শস্য লাভ হয় না। মূলত কৰ্মই ধৰ্ম—এই দর্শনই প্রতিফলিত হয়েছে উল্লিখিত সমীকরণে।

লোকায়ত চেতনায় দৰ্শন

জীবন ও জগতের উপলব্ধিজাত অভিজ্ঞতায় অন্তর উদ্ভাসিত অনুভূতিতে মানুষের যে চিন্তার প্রতিফলন ঘটে তাকেই পরিশীলিতরূপে আমরা দর্শন নামে অভিহিত করি। এই অন্তর উদ্ভাসিত অনুভূতির দুটি দিক আছে। এর একটি হল সত্তা বিষয়ক এবং অপরটি জ্ঞানতত্ত্ব বিষয়ক। যেমন ‘কে বানাইলো এই রঙমহল খানা?’ –এটি সত্তাবিষয়ক প্রশ্ন। কিংবা আমি কে? এটিও সত্তা বিষয়ক প্রশ্ন। এই সৃষ্টিজগতের বিচিত্রমুখী প্রাণসঞ্চারিত প্রবাহমান ধারাকে কে পরিচালনা করছেন, এই সন্ধিৎসু জিজ্ঞাসা হল জ্ঞানতত্ত্ব বিষয়ক। এক্ষেত্রে মানুষ ও তার পারিপার্শ্বিক বস্তুকে যে সব দার্শনিক চিন্তার উৎসকেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করেন, বিশ্বকে পর্যায়ক্রমিকভাবে জানা সম্ভব বলে যৌক্তিকভাবে স্বীকার করেন, তারা হলেন বস্তুবাদী। আর, যারা এর বিপরীতে চেতনাকে মৌলিক ও বাস্তব এবং বস্তুকে চেতনা সজ্ঞাতরূপে ভাবেন এবং বিশ্বসম্পর্কিত জ্ঞানের সম্ভাব্যতা অস্বীকার করেন, তারা হলেন ভাববাদী। অন্যদিকে, যেসব দার্শনিকেরা সত্তাকে মৌলিক এবং চেতনাকে সত্তা-সজ্ঞাত রূপ বলে বিবেচনা করেন, তারা হলেন বাস্তববাদী। আর, এর বিপরীতে যারা চেতনাকে মৌলিক এবং সত্তাকে চেতনা সৃষ্ট রূপে বিবেচনা করেন, তারা হলেন জ্ঞানতাত্ত্বিক ভাববাদী। বিশ্বজগতে বিরাজমান এসব অমীমাংসিত দ্বন্দ্ব নিয়েই দর্শনের যাত্রা। এদিক দিয়ে বলা যায়, চিন্তা ও সমাজের দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের কারণে, দর্শনের ইতিহাস এবং শ্রেণিসংগ্রাম মুখর সমাজের ইতিহাস এগিয়ে চলছে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক রক্ষা করে। আর সে কারণেই সমাজ বিচ্ছিন্নভাবে কোন দর্শন এগোয়নি, দার্শনিক অগ্রগতি ছাড়া কোন সমাজের অগ্রগতিও সম্ভব হয়নি। বাঙালি সমাজও এর ব্যতিক্রম নয়।

বিশ্ব দর্শনের ইতিহাসে বাঙালি সমাজও দর্শনের নানা স্তর অতিক্রম করে এসেছে। দর্শনেরই এই অতিক্রমনের ধারায় বাঙালি সমাজে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক অবদান রেখেছেন লোকায়ত দার্শনিকেরা। এদের অনেকেই সৃষ্টিতত্ত্ব ব্যাখ্যার জন্য ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকারের প্রয়োজন মনে করেননি। প্রকৃতপক্ষে এরাই বাঙালির ধর্মচিন্তার মূল স্বরূপকে উন্মোচন করেছেন। আর তাই রবীন্দ্রনাথ- নজরুল-অতুল-দ্বিজেন্দ্র-রজনী প্রমুখ পঞ্চ কবির স্রষ্টায় সমর্পিত সংগীতে অণুরণিত হয়েছে মনোজাগতিক উদ্ভাসন। হাছন, লালন, মনোমোহন, বিজয়,

বিজয়, ভবাসহ অসংখ্য লোক কবির চিন্তায় স্রষ্টা ও সৃষ্টি রহস্য উন্মোচিত হয়েছে উৎকৃষ্ট মানবিক ধারায়। তাই বাংলার লোক কবির অভিজ্ঞান কণ্ঠেই উচ্চারিত হতে দেখি :

‘নানান বরণ গাভীরে ভাই একই বরণ দুধ,
জগত ভরমিয়া দেখিলাম একই মায়ের পুত।’

দর্শনের আলোকে ধর্ম ও রিলিজিয়ন

ধর্ম ও রিলিজিয়নের সম্বন্ধ বিতর্ক নিয়ে বিষয়টি এই সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছে যে, পাশ্চাত্যের ‘রিলিজিয়ন’ আর প্রাচ্যের ‘ধর্ম’ এক নয়। অর্থাৎ পাশ্চাত্যে ‘রিলিজিয়ন’-এর যে ধারণা, আর প্রাচ্যে ‘ধর্ম’ বা ‘দ্বীন’-এর যে ধারণা তা সবদিক দিয়ে এক নয়। পাশ্চাত্যে ‘ফিলসফি’ গড়ে উঠেছে অনেকটা ধর্মের আওতার বাইরে। আর হিন্দুদর্শন হোক আর মুসলিমদর্শনই হোক প্রাচ্যদর্শনের অধিকাংশই গড়ে উঠেছে ধর্মের আওতায়। তবু আমরা পাশ্চাত্যের ‘ফিলোসফি’ আর ‘রিলিজিয়ন’ অর্থে ‘ধর্মদর্শন’ কথাটি সপ্রযুক্ত না হলেও প্রয়োগ করছি। এদিক দিয়ে ধর্ম দর্শনের কাজ হল ধর্মের কতটুকু যৌক্তিকতা আছে তাই দেখা। এ কথায় অবশ্য এমন কিছু বোঝা ঠিক হবে না যে, আমরা বুদ্ধিবৃত্তির মাধ্যমে ধর্মের সবকিছু যাচাই করতে পারি; বা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির মাধ্যমে যতটুকু বুঝতে পারলাম তার মধ্যেই ধর্মের সব সত্য নিহিত অথবা শুধুমাত্র বুদ্ধিবৃত্তির মাধ্যমে আমরা ধর্মীয় সত্যের সঙ্গে নিজেদেরকে সংযুক্ত করতে পারি। সংক্ষেপে বলতে গেলে ধর্মদর্শনের প্রচেষ্টা হবে ধর্মের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তির আওতায় যা কিছু আছে তা আবিষ্কারের চেষ্টা। সাধারণত আমরা মনে করি ধর্ম হল বিশ্বাসের ব্যাপার। আর দর্শন হল বুদ্ধিবৃত্তির ব্যাপার। তাই ধর্মীয় বিশ্বাস, ধর্মীয় অনুভূতি ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে বুদ্ধিবৃত্তির মাধ্যমে যাচাই করে তার সত্যাসত্য বিচার করা হল ধর্মদর্শনের আসল উদ্দেশ্য।

দর্শন একদিকে যেমনি সমাজের অগ্রগতি সাধন করে, তেমনি সমাজকে পশ্চাদ্‌গামীও করে দিতে পারে, বিশেষ করে ধর্মদর্শনের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি বেশি থাকে। দর্শন কোন্ ভূমিকা গ্রহণ করবে তা নির্ভর করে কোন্ শ্রেণির দ্বারা দর্শন পরিচালিত হচ্ছে— নির্ভর করে সে দর্শন কি প্রগতিশীল, না প্রতিক্রিয়াশীল, এবং তা সমাজ জীবনের বাস্তব তাগিদকে সঠিকভাবে প্রতিফলিত করছে কি-না, এবং তা জনগণের স্বার্থকে কতটা সুরক্ষিত করে, তার উপর। যে দর্শন সমাজের সর্বাপেক্ষা অগ্রসর শ্রেণিসমূহ—শ্রমজীবী জনগণের স্বার্থকে প্রতিফলিত করে, এবং পুরনো সমাজ ব্যবস্থার অবসানে ও নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে, একমাত্র সে দর্শনই সমাজের প্রগতিতে গুরুত্বের অধিকারী।

কিন্তু মূল প্রশ্নটা হল, দর্শন যতই নতুন ও প্রগতিশীল হোক-না কেন, একমাত্র সে প্রগতিশীলতার দ্বারাই পুরনো সমাজ ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে দিতে ও নতুন সমাজব্যবস্থা বিনির্মাণে সমর্থ হয় না। কারণ, দর্শন একমাত্র তখনই একটা সক্রিয় শক্তিতে রূপান্তরিত হয় যখন তা জনগণের মনকে আকৃষ্ট করতে পারে, জনগণের মনের গহ্বরে তা প্রবেশ করে স্থান করে নিতে পারে। আর এরূপ প্রগতিশীল দর্শনে সমৃদ্ধ জনগণই একটা সামাজিক শক্তির বিকাশ ঘটাতে পারে, সে শক্তি মানবজীবনের বস্তুগত ও আত্মিক সমস্যাসমূহের সমাধান করতে পারে। মানুষের ধর্মদর্শনে যদি এই প্রগতিশীলচেতনা প্রতিফলিত হয় তখন সম্প্রতির সেতুবন্ধনেও সহায়ক ভূমিকা পালন করে। কিন্তু বাঙালির দর্শনচিন্তায় তথা মানস-চৈতন্যে বিশেষত হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক উন্নয়নে উভয় ধর্মের শাস্ত্রীয় পণ্ডিতদের নেতিবাচক ভূমিকারও দৃষ্টান্ত আছে। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের বিশিষ্ট গবেষক সুসাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী (১৯০৪-১৯৭৪) এ বিষয়ে তাঁর সন্ধিৎসু দৃষ্টিতে উপলব্ধি করেছেন:

‘ষড়দর্শন’ নির্মাতা আর্য মনীষীগণের ঐতিহ্যগর্বিত পুত্রপৌত্রেরা মুসলমান আগমনের পর শত শত বছর ধরে আপন আপন চতুষ্পাঠীতে দর্শন চর্চা করলেন, কিন্তু পার্শ্ববর্তী গ্রামের মাদরাসায় শত শত বছর ধরে প্লাতো থেকে আরম্ভ করে নিয়প্লাতনিজম তথা কিন্দী, ফারাবী, বুআলী সিনা, আল-গাজ্জালী, আবু-রুশদ ইত্যাদি মনীষীগণের দর্শন চর্চা হল, তার কোনও সন্ধানই পেলেন না এবং মুসলমান মৌলানাও কম গাফিলতি করলেন না— তিনি একেবারের তরেও সন্ধান করলেন না পাশের চতুষ্পঠীতে কিসের চর্চা হচ্ছে।… শ্রী চৈতন্য নাকি ইসলামের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন… কিন্তু চৈতন্যদেব উভয় ধর্মের শাস্ত্রীয় সম্মেলন করার চেষ্টা করেছিলেন বলে আমাদের জানা নেই। তার জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল হিন্দুধর্মের সংগঠন ও সংস্কার, এবং তাকে ধ্বংসের পথ থেকে নবযৌবনের পথে নিয়ে যাওয়ার। …মুসলমান যে জ্ঞানবিজ্ঞান ধর্মদর্শন সঙ্গে এনেছিলেন, এবং পরবর্তী যুগে বিশেষ করে মোগল আমলে আকবর থেকে আওরঙ্গজেব পর্যন্ত মঙ্গোল-জর্জরিত ইরান-তুরান থেকে যেসব সহস্র সহস্র কবি পণ্ডিত ধর্মজ্ঞ দার্শনিক এদেশে এসে মোগল রাজসভায় আপন কবিত্ব পাণ্ডিত্য উজাড় করে দিলেন, তার থেকে এ দেশের হিন্দু ধর্মশাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত দার্শনিকেরা কণামাত্র লাভবান হয়নি…হিন্দু পণ্ডিতের সঙ্গে তাঁদের কোনও যোগসূত্র স্থাপিত হয়নি। (সৈয়দ মুজতবা আলী, ‘বড় বাবু)।

কেন হয় নি? তথাকথিত মোল্লা-পুরোহিতদের প্রকৃত ধর্ম দর্শনের সন্ধিৎসার অভাবেই হয়নি। এরা প্রাচ্যের তথা ভারতীয় ‘ধর্ম’ দর্শনে পাশ্চাত্তের ‘রিলিজিয়ন’ মিশিয়ে ধর্মের মানবিক আবেদনকে উপেক্ষা করে ধর্মকে শুধু সম্প্রদায়গত পালা- পার্বণ এবং ওরশ-উৎসবকে বিকশিত করেছে। সেই সাথে স্বস্বার্থের প্রতিকূলে ভ্রমনিরাশে অনাগ্রাহী শাস্ত্রীয় পণ্ডিত-পুরোহিত ও কেতাবি -মোল্লাদের পাল্লায় পড়ে মানুষের মানবিক চেতনা তথা সর্বমানবিক বোধকে বাধাগ্রস্ত করেছে। মনুষ্যত্বের উদ্বোধন হয় নি।

ধর্মদর্শন অনুভবের : অনুসংগের নয়

ধর্ম হচ্ছে মানুষের মনুষ্যত্ব ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং মন্দ হতে প্রতিরক্ষায় নিরাপত্তা কপাটস্বরূপ। একইভাবে ধর্ম হচ্ছে মানুষের জন্য বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক ন্যায়পরায়ণতা প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে বড় জীবন দর্শন। ধর্ম এমন একটি বিষয় যাকে অনুভব করতে হয়, একে সংজ্ঞায়িত করা যায় না (experienced, not defined)। জগতের সব ধর্মকে প্রাচীন ও আধুনিক যে অভিধায়ই চিহ্নিত করি না কেন, এদের বিশ্বাস, বাহ্য রীতি-নীতিসহ সকল উপাদানকে মনোজগতে বিন্যাস করে বলা যায় : ধর্ম হচ্ছে অদৃশ্য শক্তিসমূহের ওপর নির্ভরতার এক অনুভূতি যা আমাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে এবং এ শক্তিসমূহের সাথে বন্ধত্বপূর্ণ সম্বন্ধে আসার আকাঙ্ক্ষা জাগায় (religion is a filing of dependence upon the unseen power which controls our destiny accompanied by a desire to come into friendly relation with them)। ধর্ম হচ্ছে এক বিশ্বাস, আমাদের নিজেদের নয়, এক শক্তিতে বিশ্বাস যা ন্যায়পরায়ণ করে তোলে এবং সেই শক্তির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ সম্বন্ধে আসার আকাঙ্ক্ষা জাগায় (religion is a belief on a power not ourself which makes for righteousness and desire to come into harmonious relation with the power)। ধর্ম হচ্ছে এক অদৃশ্য আধ্যাত্মিক সত্তার সাথে আমাদের বাস্তব সম্বন্ধের চেতনাবোধ (religion is the consciousness of our practical relations to an invisible spiritual odrer)। ধর্ম হচ্ছে ঈশ্বরের প্রতি অনুরাগ (love of God)। এ হচ্ছে অতি-আত্মার (over-soul) সাথে যোগাযোগ (communion)। এ হচ্ছে আমাদের মধ্যে বিদ্যমান উচ্চতমের প্রতি ভক্তি (It is a loyalty to the highest within us) ।

দর্শন কী? দর্শন হচ্ছে জীবন ও জগতকে ঘিরে উদ্ভূত মৌলিক সমস্যাবলির যৌক্তিক অনুসন্ধান ও সঙ্গত সমাধানের প্রয়াস। এ কারণে দর্শনকে জগৎ ও জীবনের সামগ্রিক ব্যাখ্যা ও মূলায়ন বলে অভিহিত করা হয়। Philosophy শব্দটির সূচনাকারী দার্শনিক পিথাগোরাস। তাঁর মতে, প্রজ্ঞালব্ধ জ্ঞানই প্ৰকৃত জ্ঞান। আর প্রজ্ঞানুরাগী ব্যক্তিমাত্রই দার্শনিক। Philosophy is the search for a comprehensive view of nature, if is an instrument for social progress, helping man to advance the cause of better life, free from all ills and evils ।

দেকার্তকে স্বীকার করা হয় আধুনিক দর্শনের জনকপুরুষ হিসেবে। যাকে আমরা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বলে জেনে আসছি তার প্রাথমিক ধারণা দেকার্তের পরিচর্যায় রূপ লাভ করে। তিনি প্রথানুগত্যশীল সবাইকে একেবারে চমক দিয়ে ঘোষণা করলেন আমাদের যাবতীয় সিদ্ধান্তের নিশ্চিত সাধনের উপায় এ যাবৎ অনাবিষ্কৃত। ইতোমধ্যে ফ্রান্সিস বেকনও ঘোষণা করলেন : সব কিছু বিশ্লেষণ করে তবেই গ্রহণ করা যেতে পারে। সাথে সাথে জন্ম হল বিজ্ঞানবাদের। এই মনোভঙ্গিটা গ্যালিলিও সর্ব প্রথম প্রয়োগ করলেন বিজ্ঞান বীক্ষায় : সব কিছু পরীক্ষা করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে দেকার্ত নিজস্ব যুক্তিজালে জড়িয়ে পড়ে আমদানী করলেন দর্শনে দ্বৈত ধারণা। আত্মা বা মন ও দেহ দুটি পৃথক সত্তা হিসেবে স্বীকৃতি পেল। অগস্ত কোঁতে তাঁর প্রত্যক্ষবাদের আলোকে আকম্পিত কণ্ঠে প্রথম ঘোষণা করলেন ধর্মীয় ধারণা ‘ননসেন্স’। আর্নস্ট ম্যাক ও পরবর্তীকালের মার্কিন মনোবিজ্ঞানীরা ‘চৈতন্যে’র ধারণা সরাসরি অস্বীকার করেন। পরস্পরবিরোধী দুটি দার্শনিক শ্রেণি এভাবে গড়ে উঠেছিল।

চিন্তাজগতে ধর্ম ও দর্শনের পার্থক্য উপস্থাপনকারীদের মধ্যে ইতালির স্কলাস্টিক দার্শনিক টমাস একুইনাস (১২২৬-১২৭৪) অগ্রগণ্য। একুইনাস তাঁর গুরু আলবার্টাসের ন্যায় বুদ্ধি ও বিশ্বাসের পার্থক্য নির্দেশ করেছেন। তাঁর মতে, দর্শনের বিষয়বস্তু সম্পূর্ণ যুক্তিগ্রাহ্য। দর্শন যে সত্য আবিষ্কারে আগ্রহী তাকে যুক্তির মাধ্যমে বোঝা ও প্রদর্শন করা যায়। অথচ ধর্মের বিষয়বস্তু স্রেফ বিশ্বাসের ব্যাপার।… (Bertrand Russel, History of Western Philosophy)। বাঙালি জাতির মানস গঠন ও চিন্তা বৈশিষ্ট্যের প্রতি ইঙ্গিত করতে হলে তার মনন জগতে দর্শন প্রবণতার স্বরূপ স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। যেহেতু ‘বাংলাভাষায় লিখিত দর্শনের অস্তিত্ব নেই যেমন আছে জার্মান দর্শন, ইংরেজি বা ফরাসি দর্শনের। দর্শন ইতোমধ্যে আপন সাম্রাজ্যের অধিকাংশ জায়গা ছেড়ে দিয়েছে। সাহিত্য, শিল্পকলা, বিজ্ঞান ও ধর্মসহ মানববিদ্যার বেশ কিছু শাখা স্বতন্ত্র পরিচয় লাভ করেছে। মানববিদ্যার এই জ্ঞান-বিভাজন মানুষের জ্ঞানচর্চাকে আরো সহজ করে দিয়েছে। ফলে জ্ঞানের সব শাখাতেই সবাই ঢুকতে চান না, সম্ভবও না। জ্ঞানকে ছোট ছোট ক্ষেত্রে বিভক্ত করে নিয়ে কাজ করাটাই এখন সুবিধাজনক।’ (হাসান আজিজুল হক, বাংলাদেশ দর্শন)।

আমাদের এই উপমহাদেশে দর্শন শুধুমাত্র দর্শন হিসাবে না থেকে কালক্রমে তো জীবন দর্শন, পরবর্তীকালে ধর্মে রূপান্তরিত হয়েছে। দর্শনের পূর্ব নাম ছিল ন্যায় শাস্ত্র। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) ন্যায়শাস্ত্রের নাম পরিবর্তন করে দর্শনশাস্ত্র নামটি প্রচলন করেন। আদিকালে বিজ্ঞান সম্পর্কে মানুষের যখন কোন জ্ঞান ছিল না, তখন ধর্মই তাকে জীবনের সমস্যাবলি সমাধানের কাজে পরিচালিত ও সাহায্য করেছে। বিজ্ঞান এবং ধর্মীয় গোঁড়ামির মধ্যকার লড়াইয়ের নিরীক্ষাধর্মী মার্কিন গবেষক ও দর্শনের অধ্যাপক হাওয়ার্ড সেল্সাম (১৯০৩- ১৯৭০) এর মতে ধর্মীয় বিশ্বাসের রাজ্যে বিজ্ঞানকে ঢুকতে দেওয়া উচিত নয়। বিশ্বখ্যাত গ্রন্থ The Prophet প্রণেতা খলিল জিব্রান (জ. ১৮৮৩) এর মতে, ধর্মের শুরু সেদিন, যেদিন মানুষ প্রথম উপলব্ধি করতে পেরেছিল সূর্যের আলোর সহমর্মিতা তাদের রোপিত শস্যের উপর ঝরে পড়ছে (Religion began when man discerned the sun’s compassion of the seeds which he sowed in the earth)। আর দর্শনের শুরু, সেদিন, যেদিন মানুষ মাটি থেকে উঠে আসা খাবার খেয়ে অজীর্ণতায় ভুগছিল (Philosophy began when ate the produce of the earth and suffered indigesation)। ভারতীয় দর্শনের অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তর অভিমত বাঙালির দর্শনচিন্তা মূলত তিনটি ধারায় বিকশিত হয়েছে। এতদ্ভিন্ন এই তিনটি ধারায় রয়েছে অগণিত শাখা-প্রশাখা, ধারা- উপধারা। এই তিনটি হচ্ছে : ধর্মপ্রভাবিত দর্শনচর্চা, ধর্মপ্রভাবমুক্ত দর্শনচর্চা এবং সমন্বয়ী ধারায় দর্শনচর্চা। (History of Indian Philosophy)।

অবশ্য পাশ্চাত্যের মত ভারতে ধর্ম আর দর্শনকে আলাদা করে দেখা হয় না। পশ্চিমে যে জিজ্ঞাসা থেকে দর্শনের জন্ম এখানে তা নয়। এখানে জীবনের নৈতিক ও ঐহিক গ্লানির অস্তিত্বজনিত বাস্তব প্রয়োজন বোধের চাপ থেকেই তার জন্ম। এ গ্লানি কী করে দূর করা যায়— সেই প্রশ্নটি প্রাচীন ভারতবাসীকে সবচেয়ে বেশি বিচলিত করেছিল। এ কারণে সমস্ত সম্প্রদায়ে মোক্ষ বলতে এমন এক অবস্থায় পরিকল্পনা করেছে যেখানে কোন না কোন অর্থে গ্লানি মুক্ত হওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে বলা যায়— ইউরোপীয় দর্শন পৌরাণিক প্রভাবমুক্ত, কিন্তু ভারতীয় দর্শনের (ধর্মের) বিকাশ একান্তভাবে সম্প্রদায়গত। ‘যেহেতু কোন এক সুদূর অতীতে এই সম্প্রদায়গুলির সূত্রপাত সেহেতু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অর্থেই ভারতীয় দর্শন (ধর্ম) মূলত প্রাচীন দর্শন। ভারতীয় দর্শন (ধর্ম) অতীতকে বর্জন করে অগ্রসর হতে পারেনি।’ এ বিষয়ে মার্কসের সাক্ষ্য— ‘পরিবর্তনে অলস নানা ধর্মীয় কুসংস্কার এবং প্রাচীন নীতিরীতি সমূহে আবদ্ধ ভারতীয়জন বা সমাজ দ্রুত অগ্রগতির বাধা কাটিয়ে উঠে সময়ের সঙ্গে তাল মিলাতে পারেনি।’ তাই তারা দাঁড়িয়ে থেকেছে একই জায়গায়। একই বিশ্বাস, একই রীতিনীতি এখনও নিষ্পাপ মনে লালন করে চলেছে— সেই আদি থেকে লোক পরম্পরা।

ভারতীয় দর্শনে মানুষ, প্রকৃতি ও আত্মা

ভারতীয় দর্শন পরস্পরায় ষড়দর্শনের মধ্যে নিম্বাক দর্শন, ন্যায় দর্শন, যোগ দর্শন ও বেদান্ত দর্শন এখনো জনমানসে সক্রিয়। বহুবিদ ও বহুমাত্রিক চৈতন্যে উদ্ভাসিত এই ভারতীয় দর্শন। সর্বদর্শন সংগ্রহকার সায়ণ মাধবের মতে ১৬টি ভারতীয় দর্শন হল : ১. চার্বাক দর্শন ২. বৌদ্ধ দর্শন ৩. আর্হত দর্শন. ৪. রামানুজ দর্শন ৫. পূর্ণপ্রজ্ঞ দর্শন ৬. নকুলীশ দর্শন/বা পাশুপত দর্শন ৭. শৈব দর্শন ৮. প্রত্যভিক্ষা দর্শন ৯. রসেশ্বর দর্শন ১০. ঔলূক্য দর্শন/বৈশেষিক দর্শন ১১. অক্ষপাদ দর্শন/গৌতম দর্শন ১২. জৈমিনীয় দর্শন ১৩. পাণিণি দর্শন ১৪. সাংখ্য দর্শন ১৫. পাতঞ্জল দর্শন ও ১৬. শাঙ্কর দর্শন (উত্তর মীমাংসা)।

ভারতীয় দর্শনে সৃষ্টিতত্ত্ব ব্যাখ্যা হয় এভাবে যে, অক্ষর ব্রহ্ম আনন্দ পাবার অভিপ্রায়ে নিজেকে দ্বান্দ্বিকভাবে ক্ষরণ করেন— একা একা তো কোন আনন্দ উপভোগ করা যায় না, কারো সাথে বিনিময় করতেই হয়, আর সেই জন্য মনটি যদি নিছক প্রতিধ্বনি করে তাহলে সৃষ্টি-বিচিত্রতা এগোয় না স্তুতিতে ডুবে যায়- তাই বিরহবিধুর দ্বন্দ্বময় দ্বিত্বতায় ব্রহ্ম ক্ষরিত হলেন। সেই হিসেবে ভারতীয় দর্শনে চেতনা আগে এসে গেছে; পরে এসেছে বস্তু—জীব—মানুষ। তখনকার দিনে এ জাতীয় ভাবনা (প্রজ্ঞান) ধ্যান-অনুভব জাত, আজকের দিনে তা অঙ্ক (যা এক প্রকার ধ্যানই) আশ্রিত।

এই দ্বান্দ্বিক বিভাজিত ব্রহ্মানন্দ, দুটি পাখি, একজন ফল খাচ্ছে অন্যজন নিস্পৃহভাবে বসে দেখছে— এই নিয়ে যখন মানুষের রাজত্বে পৌঁছলো, তখন ভারতীয় চিন্তকেরা কয়েকটি কূট অবস্থার মুখোমুখি হয়ে আগের আনন্দময় ধারণার মিল টানতে পারল না, যেমন নচিকেতা দেখছে মৃত্যু পথযাত্রী বাবা গরু দান করে পুণ্য কিনতে যাচ্ছে— এটা তো হবার কথা নয়। পৌরাণিক একটা চরিত্রে দেখা যায়, মহাতেজস্বী ধনবান ব্রাহ্মণ তিনি, নাম শর্বিলক, যে আসলে রাতে ডাকাত দিনে সাধক তপস্বী, এবং তার এই বিপরীত ভূমিকায় সে মোটেও কুণ্ঠিত নয়। তার যুক্তি হচ্ছে, সে রাতের পরিচয় জনসমক্ষে বলতেই পারে কিন্তু তাতে করে তার ও পরিবারের সম্মান যেমন চলে যাবে, তেমনি তার দানধ্যানও বন্ধ হয়ে যাবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে অনেক দীনদরিদ্র। দ্বিতীয়, বিশ্বে সবাই ঘাতক ও চোর চরিত্রের, শুধুমাত্র খাবার জন্যেই কি আমরা মা-বৃক্ষের পুত্রকন্যাদের হত্যা করি না—সবাই ঘাতক। এটা চিন্তকদের বোধে আলোড়ন আনে, পরিণামে ধ্বংসময় পরিবেশে ঔপনিষদিক দর্শনে একটি ধারা ঢুকিয়ে দেয়া হয়। কথা হচ্ছে, আনন্দিত ব্রহ্মের এ কোন খেলা? এর ব্যাখ্যায় চিন্তকেরা মায়ার অবতারণা করেন। জন্মান্তর যেমন কৌশল, বর্ণবিভাজন যেমন কৌশল তেমনি মায়াও আরেক কৌশল। এর গঠন এরকম হয়ে যায়, জন্মের সময় তুমি একটা সংস্কার নিয়ে জন্মালে, এবং কামক্রোধলোভমোহ ইত্যাদির জালে (অর্থাৎ এটাও আরেকটা প্রবৃত্তি) তোমাকে বেঁধে দেয়া হল, এবার তুমি পরীক্ষায় নামো, যতটা জাল কাটাবে, ততটাই তোমার উন্নতি (ব্রহ্ম আর মহেশ্বর অতঃপর এক আসনে বসে যান)। অস্তিত্বসম্পন্ন মানুষ পাপ করবেই— শ্রীকৃষ্ণ এবার বলছেন, কামনা মানুষকে পাপকর্ম করায়; আর সেটি সারা বিশ্ব জুড়ে রয়েছে, কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সময় পর ভোগ যখন নিস্পৃহ হয়ে চলেছে সে সময় ভগবান অবতীর্ণ হয়ে তার প্রতিকার করেন। ভগবান কী করে আসেন সেটা শ্রীকৃষ্ণ জানাচ্ছেন কিন্তু এই মাৎস্যন্যায়ের কোন প্রতিক্রিয়ার জোরে ভগবান আসেন তার গ্রাহ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না (জন্মান্তর তত্ত্ব দিয়ে অবশ্য তা বলা যায়, শ্রীকৃষ্ণ সে চেষ্টাও করেছিলেন)।

অর্থাৎ বলতে চাইছি, ভারতীয় দর্শন ঐ মিলটা দিতে পারেনি যে আনন্দিত রসাস্বাদনে যে সৃষ্টির শুরু সেটি হঠাৎই কেন পাপে কামে ভরে উঠল— এই পালাবদলটার মিল দেবার অভিপ্রায়ে মায়াবাদের প্রবর্তন। কিন্তু খটকা থেকেই যায়, নিৎসে এখানে যে ধারণাটি প্রবর্তন করেন যাকে সহজ কথায় অস্তিত্ব উপলব্ধির অবলোকন বলব যা হল এরকম যে, বিশ্বসৃষ্টি হয়েছে নানাবিধ শক্তির বিচরণের ফলে, এভাবে অজৈব থেকে জৈব অস্তিত্ব হয়েছে এবং প্রাণ রূপ পেয়েছে, মানুষ এসেছে। প্রাণীর থেকে মানুষ প্রথম হয়েছে interaction, striving, change ও challenge – এ ….এবং individual himself and specis as a whole এর মিথষ্ক্রিয়ার চলা তো কিছুকে ক্ষুণ্ণ করে, আমরা মনে করি প্রথমত তা প্রকৃতিকে ক্ষুণ্ন করে— নিৎসে যদিও তা বলছেন না, নিৎসে বলছেন, মানুষ মূলত কিছু ভুল (basic errors— করে থাকে, যে errors are associated with human development…। এরা চার ধরনের— ১. নিজেকে অসম্পূর্ণ হিসেবে দেখা, ২. কল্পিত গুণাবলী দিয়ে নিজেকে আবৃত করা, ৩. প্রকৃতি আর তাবৎ জীবকুলের চেয়ে সে বড় এমন ভুয়ো ধারণা পোষণ করা, ৪. নব নব দ্রব্যের আবিষ্কার ও তাকে সে সময়ের জন্য শর্তহীনভাবে ব্যবহার করা যেন ওটি না হলেই তার নয়। এই চারটি মূল ত্রুটি তার চালিকাশক্তি, এদের উৎপাটন করা মনের মানবীয় কাঠামোকে ভেঙ্গে দেয়া, তাই নিৎসের মানুষ হয়ে ওঠে endangered, sicklist, most bungled of all the animals। কী বলব একে? তমসা ঘনাচ্ছন্ন রাজসিক ভুয়ো ধারণার লালিত প্রাণ?

গীতার ধারণা হচ্ছে প্রকৃতির বশে কাজ করছি আর আমিত্ব একটা ভ্রান্ত ধারণা যা ক্ষতি করে ধ্বংসও ডাকে, তাই পরিশোধিতও হয় সেটি—তাহলে স্বধর্মে থাকি কী পরধর্মে থাকি নিঃসঙ্গচিত্তে কাজ করলেই তো সিদ্ধিলাভ হবে, সবচেয়ে বড় কথা প্রকৃতির কাজে সমাজ গড়ে উঠেছে, অর্থাৎ প্রকৃতির মূল স্রোত সমাজ অনুগামী, তাহলে সমাজবিরুদ্ধ কাজ—পাপ কাজ—আমরা করি কেন? অজুর্ন বিস্ময়ে প্রশ্ন করেন : কার দ্বারা প্ররোচিত হয়ে মানুষ ইচ্ছা না থাকলেও বলপূর্বক নিয়োজিত ব্যক্তির মত পাপ করে? কৃষ্ণ বলেন, রজোগুণোদ্ভূত কাম বা ক্রোধ মানুষকে পাপে প্রবৃত্ত করে, এই কামকে তৃপ্ত করা যায় না আর এটাই পাপের কারণ। দেখার ব্যাপার হল, ভারতীয় দর্শন যে রাজসিক গুণের কথা বিবৃত করছে ঠিক তারাই নিৎসে-দর্শনে চারটে ভ্রান্তি হয়ে এসেছে। এখান থেকে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত টানা যাবে, নিৎসের প্রভু রাজসিক ও ভৃত্য বা slave হলে তামসিক মোহাচ্ছন্ন মানুষ।

ভারতীয় দর্শনে আকর্ষণীয় চরিত্রগুলি হল মানুষ, তার প্রকৃতি ও আত্মা। আত্মা ভুমা। সে গোটা প্রকৃতিকে ঘিরে ও ছড়িয়ে রয়েছে (আধুনিক বিজ্ঞান যাকে cosmic web বলে যা কিনা চারটে মৌল শক্তির একীভূত রূপ)— তেমনি। তার তুলনায় প্রকৃতির ব্যাপ্তি কম। আর এই প্রকৃতির ফসল আমরা— জীব জড় মানুষেরা। মানুষের মনও সূক্ষ্ম জড়মাত্র। আত্মা ছাড়া পৃথিবীর সব বস্তুই জড় (ঠিক এভাবে ইলেকট্রন প্রমুখ পরমাণুপারের কণিকাদের নিয়মিত করা হয়ে থাকে আধুনিক বিজ্ঞানের বিচারে)। আত্মার সংস্পর্শে এলে মন উদ্ভাসিত হয়— সে তখন এই বিচিত্রতার মধ্যে নিজের সঙ্গে বিশ্বের অভূতপূর্ব কী অশ্রুতপূর্ব মিল খুঁজে পায়। এই অবস্থাই তুরীয়ানন্দ ব্রহ্মজ্ঞান–আত্মদর্শন কি ঈশ্বরদর্শন—একজন একেকভাবে বলার চেষ্টা করে থাকেন। মজাটা হচ্ছে, জীব বদ্ধই, সে প্রকৃতির ঘেরাটোপে মায়ার বাঁধনে থাকছে, আর আত্মজ্ঞান হচ্ছে শুদ্ধ মায়ামুক্ত জ্ঞান- অর্থাৎ বাঁধনের মধ্যে থেকেই সে শুদ্ধ জ্ঞানের দিকে যেতে চাইছে, ফলে একটা দ্বন্দ্ব এখানেও দৃশ্যমান, একদিকে শুদ্ধ জ্ঞান অন্যদিকে অশুদ্ধ জ্ঞান অথবা অজ্ঞান, দুটোই সে পেতে পারে। যদি সে মায়ার বশে বেশি বাঁধা থাকে তাহলে অজ্ঞানটাই তার প্রাপ্তি, যদি সে মায়ার বাঁধন কাটাতে পারে তাহলে সে শুদ্ধজ্ঞান পাচ্ছে। এটা নির্ভর করছে প্রকৃতিদত্ত সংস্কার ও তার ভূমাদর্শনের তীব্রতার মিথষ্ক্রিয়ার ওপর। অজ্ঞান প্রাপ্তিটাই হল তম দশা। এটা এভাবে অবলুপ্ত করা যায় : তম অজ্ঞান থেকে উৎপন্ন, দেহীর পক্ষে মোহকারী এবং তা প্রমোদ আলস্য ও নিদ্রা দিয়ে দেহীকে বেঁধে রাখার চেষ্টা করে। তম বৃদ্ধি পেলে সর্বব্যাপারে নিরাসক্তি, কর্মে অপ্রবৃত্তি, কর্তব্য কর্মে অনীহা, অনুচিত কর্মে আগ্রহ দেখা দেয় আর তার ফল অজ্ঞানতা। প্রকৃতিই এই অবস্থাটি তৈরি করে রেখেছে। আবার প্রকৃতি জ্ঞানের দিকটাও খোলা রেখেছে। এ সেই দিক যে দিকে চললে বদ্ধ জীবই ভূমার সঙ্গে একাত্ম হতে পারবে। কিন্তু এখানেও একটা গোল বাঁধে। ঋষিরা চিন্তকেরা দেখেন, জ্ঞান দুদিকের— একটা বাইরের অন্যটা ভেতরের। বাইরে দিয়ে যাওয়া যায়, সেখানকার অগণন ক্ষণিক বৈচিত্র্য দেখতে দেখতে বুঝতে বুঝতে যাওয়া যায়; আবার মনের মধ্যে দিয়ে বাইরের চাঞ্চল্য থেকে সরে এসে বাইরের আহ্বানকে অগ্রাহ্য করেও সেই আমি’তে পৌঁছানো যায় যে ‘আমি’ বিশ্ব-আমি’র সঙ্গে স্মরণাতীত সম্পর্ক। ভারতীয় দর্শন জ্ঞানকে তাই অন্তজ্ঞান ও বহিজ্ঞান হিসেবে বিভাজিত করে। প্রকৃতির যে গুণের প্রভাবে মানুষের জ্ঞান বহির্মুখ হয় তা রজ গুণ, আর যে গুণের বশে জ্ঞান অন্তর্মুখী তা সত্ত্বগুণ। এবার যখন কৃষ্ণ ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন : রজকে রাগাত্মক বলে যেন, রজ দেহীকে কর্মশক্তি দিয়ে বাঁধে… রজ বৃদ্ধি পেলে লোভ কাম প্রভৃতি নানা কর্মের উদ্যোগ ঘটে, অশান্তি বিষয় ভোগেচ্ছা প্রভৃতি দেখা দেয়… রাজসিক কর্মের ফল দুঃখ।

ভারতীয় দর্শনের বৈশিষ্ট্য

প্রাচীন গ্রিক ও ভারতীয় দর্শনকে পৃথিবীর সকল দর্শনের জনক বলে মনে করা হয়। এর মধ্যে ভারতীয় দর্শনকে মনে করা হয় এশিয়ার দর্শনসমূহের জনক। ভারতীয় দর্শনের মূল ভিত্তি বেদ।[১৪] এই বেদ থেকে ক্রমশ উৎপত্তি লাভ করেছে ষড়দর্শন, দ্বৈতবাদ, অদ্বৈতবাদ, দ্বৈত-দ্বৈতবাদ, ব্রাহ্মবাদ ও নিরীশ্বরবাদের মত দর্শনসমূহ। গীতা ভারতীয় দর্শনের একটি শীর্ষস্থানীয় গ্রন্থ; আর বলাবাহুল্য এই গীতাও বেদ-উপনিষদেরই সরল সংস্করণ।

[১৪. সকলেই জানেন, বেদ চারিটি—ঋক্, যজুঃ, সাম, অথর্ব। অনেক প্রাচীন গ্রন্থে দেখা যায় যে, বেদ তিনটি— ঋক্, যজুঃ, সাম। অথর্ব সে-সকল স্থানে গণিত হয় নাই। অথর্ব বেদ অন্য তিন বেদের পর সঙ্কলিত হইয়াছিল কিনা, সে বিচারে আমাদের কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। কিম্বদন্তী আছে যে, মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস, বেদকে এই চারি ভাগে বিভক্ত করেন। ইহাতে বুঝা যায় যে, আগে চারি বেদ ছিল না, এক বেদই ছিল। বাস্তবিক দেখা যায় যে, ঋগ্বেদের অনেক শ্লোকার্ধ্ব যজুর্বেদে ও সামবেদে পাওয়া যায়। অতএব এক সামগ্রী চারি ভাগ হইয়াছে ইহা বিবেচনা করিবার যথেষ্ট কারণ আছে। যখন বলি, ঋক্ একটি বেদ, যজুঃ একটি বেদ, তখন এমন বুঝিতে হইবে না যে, ঋগ্বেদ একখানি বই বা যজুর্বেদ একখানি বই। ফলতঃ এক একখানি বেদ লইয়া এক একটি ক্ষুদ্র লাইব্রেরী সাজান যায়। এক একখানি বেদের ভিতর অনেকগুলি গ্রন্থ আছে। একখানি বেদের তিনটি করিয়া অংশ আছে— মন্ত্র, ব্রাহ্মণ, উপনিষৎ। মন্ত্রগুলির সংগ্রহকে সংহিতা বলে, যথা— ঋগ্বেদসংহিতা, যজুর্বেদসংহিতা। সংহিতা, সকল বেদের এক একখানি, কিন্তু ব্রাহ্মণ ও উপনিষৎ অনেক। যজ্ঞের নিমিত্ত বিনিয়োগাদি সহিত মন্ত্রসকলের ব্যাখ্যা সহিত গদ্যগ্রন্থের নাম ব্রাহ্মণ। ব্রহ্মপ্রতিপাদক অংশের নাম উপনিষৎ। আবার আরণ্যক নামে কতকগুলি গ্রন্থ বেদের অংশ। এই উপনিষদই ১০৮ খানি। বেদ কে প্রণয়ন করিল? এ বিষয়ে হিন্দুদিগের মধ্যে অনেক মতবেদ আছে। এক মত এই যে, ইহা কেহই প্রণয়ন করে নাই। বেদ অপৌরুষেয় এবং চিরকালই আছে। কতকগুলি কথা আপনা হইতে চিরকাল আছে। মনুষ্য হইবার আগে, সৃষ্টি হইবার আগে হইতে, মনুষ্য- ভাষায় সঙ্কলিত কতকগুলি গদ্য গদ্য আপনা হইতে চিরকাল আছে; অধিকাংশ পাঠকই এ মত গ্রহণ করিবেন না, বোধ হয়।

আর এক মত এই যে, বেদ ঈশ্বর-প্রণীত। ঈশ্বর বসিয়া বসিয়া অগ্নিস্তব ও ইন্দ্ৰস্তব ও নদীস্তব ও অশ্বমেধ যজ্ঞ প্রভৃতির বিবিধ রচনা করিয়াছেন, ইহাও বোধহয় পাঠকের মধ্যে অনেকেই বিশ্বাস না করিতে পারেন। বেদের উৎপত্তি সম্বন্ধে আরও অনেক মত আছে, সে সকল সবিস্তারে সঙ্কলিত করিবার প্রয়োজন নাই। বেদ যে মনুষ্য-প্রণীত, তাহা বেদের আর কিছু পরিচয় পাইলেই, বোধহয় পাঠকেরা আপনারাই সিদ্ধান্ত করিতে পারিবেন। তাঁহারা আপন আপন বুদ্ধিমত মীমাংসা করেন, ইহাই আমাদের অনুরোধ। বেদ যেরূপেই প্রণীত হউক, একজন উহা সঙ্কলিত ও বিভক্ত করিয়াছে, ইহা নিঃসন্দেহ। (বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দেবতত্ত্ব ও হিন্দুধর্ম)।]

বেদান্ত দর্শন মতে, ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয় (একমেবা/দ্বিতীয়ম্)। অর্থাৎ ঈশ্বর নিজেতো এক বটেই; তিনি ব্যতীত এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে দ্বিতীয় আর কোন বস্তুর অস্তিত্ব নেই। বিশ্বের সকল কিছুই তাঁর অংশ। তাঁর থেকেই সব কিছুর উৎপত্তি। আবার তাঁর মধ্যেই সব কিছুর লয়।

ভারতীয় দর্শন মতে, ঈশ্বর অরূপ। অর্থাৎ তাঁর নির্দিষ্ট কোন রূপ নেই। তবে তিনি সর্বশক্তিমান বিধায় সাকার ও নিরাকার উভয় রূপই ধারণ করার ক্ষমতা রাখেন।

ঈশ্বরের সাকার রূপের নাম দেবতা; আর নিরাকার রূপের নাম ব্রহ্ম। কিন্তু জগতের সবকিছুই তাঁর অংশ বিধায় প্রকৃত অর্থে তিনি স্রষ্ট্রা নন। অর্থাৎ এ বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের কোন কিছুই তিনি সৃষ্টি এমনকি ধ্বংস করেন না। সবকিছুই এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় রূপান্তরিত হয় মাত্র। তবে ঈশ্বরের সাকার রূপও বর্তমান এবং যেহেতু জীব ও জড় বস্তুর এক অর্থে মৃত্যু বা ধ্বংস অনিবার্য; তাই কর্মের ভিত্তিতে স্রষ্টার প্রধান তিনটি রূপ হয়েছে কল্পিত।

এই রূপ তিনটি হচ্ছে-

১. স্রষ্টা → ব্ৰহ্মা → (স্ত্রী/মতান্তরে কন্যা → সরস্বতী) → বিদ্যাদেবী।

২. পালক → বিষ্ণু → (স্ত্রী → লক্ষ্মী) → ধনদেবী।

৩. সংহারক → মহেশ্বর → (স্ত্রী-দুর্গ) → শক্তিদেবী।

ঈশ্বর (অরূপ-নির্দিষ্ট কোন রূপ নেই অর্থে)

নিরাকার → সাকার

ব্রহ্ম → দেবতা

ব্রহ্মা → বিষ্ণু → মহেশ্বর/শিব

সরস্বতী → লক্ষ্মী → দুর্গা/কালী

স্মরণ রাখা প্রয়োজন, ভারতীয় দর্শনে উত্থাপিত এই সাকার-নিরাকার বিশ্লেষণের দ্বৈতরূপ ইসলামী দর্শনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

তাছাড়া ভারতীয় দর্শনে ঈশ্বরের নির্দিষ্ট কোন রূপ না থাকায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীগণ ও বিশ্বজগতের সকল বস্তুর রূপকে (এমনকি কল্পিত অবসাত্ব রূপও) ঈশ্বরের রূপ বলে মনে করেন। আর এই বিশ্বভূমণ্ডল পরিক্রমাকে চতুর্যুগ[১৫] রূপে আবর্তিত বলে।

[১৫. চতুর্যুগ : সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি—এই হল সনাতন শাস্ত্রের চার যুগ। সত্য যুগের পরিধি ১৭,২৮,০০০ বছর। এই যুগে মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ এই চার অবতার আবির্ভূত হন। ত্রেতাযুগের পরিধি ১২,৯৬,০০০ বছর। এই যুগের বলরাম ও বুদ্ধ এই দুই অবতারের আবির্ভাব ঘটে। দুই যুগের পর দ্বাপর যুগ। দ্বাপর যুগের পরিধি ৮,৬৪,০০০ বছর। চার যুগের চতুর্থ যুগ কলি। কলি যুগের পরিধি ৪,৩২,০০০ বছর। এই যুগের শেষে বিষ্ণু কল্কি অবতাররূপে অবতীর্ণ হবেন।]

উপনিষদে আত্মাকে পরমতত্ত্ব বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে এ কথাও বলা হয়েছে যে, জীবাত্মা ও পরমাত্মা এক, অভিন্ন। উপনিষদের ঋষিদের সুস্পষ্ট নির্দেশ- আত্মাকে জানো (আত্মানাং বিদ্ধি); আত্মাকে জানা হলে সবকিছুকে জানা হবে।

গীতায় জীবাত্মা-পরমাত্মা তত্ত্ব আলোচিত হয়েছে; ভক্তি এবং প্রেমের কথাও গীতা ভাগবতে প্রত্যক্ষগোচর। ভক্তি এবং প্রেমের মাধ্যমে স্রষ্টাকে লাভ করার জন্য যে গুরু, মুর্শিদ বা সারথীর প্রয়োজন; তারও ইঙ্গিত রয়েছে গীতায়। অর্জুন শিষ্য হয়ে তাঁর গুরুকে বলছেন— শিস্যস্তেহহং শধি মাং ত্বাং প্রপন্নম। অর্থাৎ আমি তোমার শিষ্য প্রপন্ন, আমাকে উপদেশ দাও।

বৈষ্ণবগণ কর্মফলে বিশ্বাসী নন। তাঁদের মতে, যেহেতু বিশ্বের সব কর্ম ঈশ্বরের (কৃষ্ণের) ইচ্ছায় সম্পন্ন হয়; অতএব কর্মফল নিরর্থক। সকল কর্মের সব প্রশংসা, সব নিন্দা ঈশ্বরের। [কিন্তু রামকৃষ্ণ বলেছেন—স্রষ্টার রজ্জুতে আবদ্ধ থাকলেও একটি বিশেষ সীমার মধ্যে সৃষ্টি সম্পূর্ণ স্বাধীন। এটা অনেকটা গবাদি পশুর মত। তাঁর মতে, রজ্জুতে আবদ্ধ থাকলেও নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে যেমন গবাদিপশু স্বাধীনভাবে আহার নিদ্রা, দাঁড়ানো-দৌড়ানোর ক্ষমতা রাখে; তেমনি মানুষও স্রষ্টার ইচ্ছাধীন থেকে নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে স্বাধীনভাবে ক্রিয়াকর্ম পরিচালনা করতে পারে। ফলে অবশ্যই তাকে স্বীয় কর্মের ফল ভোগ করতে হবে। (রামকৃষ্ণ কথামৃত)।

হিন্দু ধর্ম জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী। হিন্দুদের বিশ্বাস প্রত্যেক প্রাণীকেই মুক্তি লাভের পূর্ব পর্যন্ত পুন পুন জন্মগ্রহণ করতে হবে। তবে যারা অধিকাংশ সময় সৎকার্যে ব্যাপৃত থাকবে, তারা একটি নির্দিষ্ট কালের অধিকাংশ সময় স্বর্গে এবং অবশিষ্ট সময় নরকে অবস্থান করে পুনরায় মর্তে পদার্পণ করবেন। একইভাবে যারা অধিকাংশ সময় মন্দকাজে ব্যাপৃত থাকবে; তারা স্বল্প সময় স্বর্গ ও দীর্ঘকাল নরক বাসের পর পুনরায় কর্ম সম্পাদন করার জন্য পৃথিবীতে অবতীর্ণ হবেন। শতভাগ সৎকর্ম সম্পন্ন করার পূর্ব পর্যন্ত জীবনের মুক্তি নেই; আর তাই মুক্তি লাভের পূর্ব পর্যন্ত স্বীয় কর্ম অনুযায়ী মানুষ স্বর্গ-নরক-মর্ত পরিভ্রমণ করতে থাকবে। অধিকাংশ মানুষই কিছু না কিছু সৎ ও কিছুনা কিছু অসৎ কর্মে ব্যাপ্ত থাকেন; আর এই জন্য অধিকাংশ মানুষকেই মুক্তি লাভের পূর্ব পর্যন্ত স্বর্গ-নরক উভয় স্থানের স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। (শ্রীমদভগ্বদগীতা)।

ভারতের আধুনিক দার্শনিক সম্প্রদায় লোকধর্ম গুলিকে বিভাজন করেছেন নাস্তিক আর আস্তিক এর ভিত্তিতে। এখানে নাস্তিক বলতে ঈশ্বরে অবিশ্বাস নয়, ভারতীয় ধর্ম-শাস্ত্রাদির মতে– ‘বেদে আস্থা নেই যার তিনি নাস্তিক।’ সেদিক থেকে নাস্তিক সম্প্রদায় বলতে লোকায়ত, বৌদ্ধ ও জৈন এই তিনটি সম্প্রদায়কে বুঝায়। আর আস্তিক সম্প্রদায় ছয়টি— সাংখ্য, যোগ, ন্যায়, বৈশেষিক, পূর্বমীমাংসা বা মীমাংসা ও উত্তরমীমাংসা বা বেদান্ত। মূলত আস্তিক সম্প্রদায় বৈদিক শাস্ত্রাদির বিবর্তনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আর নাস্তিক বলতে প্রতিবাদী বা বেদবিরুদ্ধ। কিন্তু কবে থেকে এই বিরোধিতা? বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মমত– ‘আর্যযুগের পূর্বেই প্রচলিত ছিল, সুতরাং বৈদিক ধর্ম অপেক্ষা প্রাচীনতর।’ তাই সঙ্গত কারণেই বলা যায়, বেদ পরবর্তী সময়েই এই আস্তিক-নাস্তিক বিভাজনের সীমারেখা নির্ণীত হয়।

ভারতীয় বাঙালিদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ জাতীয়তাবাদী নেতা, অধ্যাত্মসাধক এবং দার্শনিক শ্রীঅরবিন্দ ঘোষ (১৮৭২-১৯৫০)—যার কাছে ধর্ম ও জাতীয়তা ছিল এক ও অভিন্ন। শ্রীঅরবিন্দ চেয়েছিলেন অতিমানস সিদ্ধি। তাঁর লক্ষ্য ছিল মানুষকে দেবত্বে পরিণত করা, একটা নতুন মানবজাতির সৃষ্টি করা—নতুন ধর্ম, নতুন চেতনা নিয়ে চলবে তারা। সর্বত্র বিরাজ করবে সুসঙ্গতি ও সামঞ্জস্য। পৃথিবী হবে স্বর্গরাজ্য। মানুষকে আনন্দের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করা, তাকে অমৃতত্ত্ব দান করা। বিশ্বের সুপ্রতিষ্ঠিত ধর্মসমূহের মধ্যে ইহজাগতিকতার প্রতি অনীহা ও পারত্রিক জীবনের প্রতি যে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে শ্রীঅরবিন্দ-দর্শন তার একটি আধুনিক ব্যতিক্রম। তাঁর পূর্ণযোগ হচ্ছে পরিপূর্ণ ঈশ্বর উপলব্ধি, পরিপূর্ণ রূপান্তর। এর তাৎপর্য— এই অস্তিত্বময় জগতেই জীবনের পরিপূর্ণতা বিধান, অনন্ত পরিপূর্ণতার জন্য অন্য কোথাও প্রত্যাবর্তন নয়। শ্রীঅরবিন্দ তাঁর Life Divine গ্রন্থে এই অনন্ত জীবনের দর্শন ব্যাখ্যা করেছেন। দর্শনকে ধর্মীয় অন্তর্দৃষ্টি বা রাজনৈতিক প্রজ্ঞা লাভ করবার জন্য সহায়ক মনে করেছেন। অরবিন্দ মনে করতেন, কেউ যদি ঠিক বোঝে দর্শন কী, তাহলে সে তাতেই সম্পূর্ণ শান্তি পাবে, এমনকী আন্তর ‘আধ্যাত্মিক’ আকুতিও দর্শন অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে পরিপূর্ণ তৃপ্তি লাভ করবে। দর্শন সম্পর্কে অরবিন্দের এই ধারণা দর্শন একটি স্বতন্ত্র আধ্যাত্মিক কর্মের মর্যাদা লাভ করেছে। আর উনিশ শতকের ধর্ম আন্দোলনের বিশিষ্ট নেতা ও সমাজ সংস্কারক, বাংলা সাহিত্যে সফল কথ্যরীতির অন্যতম প্রধান প্রচারক স্বামী বিবেকানন্দ (১৬৬৩-১৯০২) ভারতীয় জনগণকে দেখতে চেয়েছিলেন ‘বৈদান্তিক মস্তিষ্কে ইসলামীয় দেহ’ রূপে।

বিশ্ব বীক্ষায় বাঙালির দর্শন

কীভাবে দর্শন এই পৃথিবীতে প্রাসঙ্গিক হতে পারে? প্রাসঙ্গিক হওয়ার একটি রাস্তা হল সমাধান করতে পারা, নিদেনপক্ষে পৃথিবী যেসব সমস্যা নিয়ে বিচলিত, তার সমাধানের দিকে একটি সূত্র নির্দেশ করা। কিন্তু সমস্যার সমাধান কীভাবে হবে যদি সমস্যাটা ভালো করে বুঝতে না পারা যায়? এর অর্থ এই নয় যে, তাৎক্ষণিক সমাধানের দরকার নেই বা তাৎক্ষণিক সমাধানের প্রস্তাব আসবে না। দর্শন কী জাতীয় সমস্যা আলোচনা করতে পারে এবং তার দ্বারা কোন সমাধানের পথ খুলতে পারে কি না এটি চিন্তা করাই জরুরি। দর্শন যদি কোন সমাধানসূত্র দেখাতেও পারে, তাহলেও সে কোন ব্যক্তিকে অথবা কোন দেশকে তার কথা শুনবার এবং অনুসরণ করার জন্য বাধ্য করতে পারে না, ঠিক যেমন কোন রোগীকে কেউ বাধ্য করতে পারে না বিশেষ কোন চিকিৎসাপদ্ধতি মেনে নিতে

এখনকার মত, অবশ্য আমাদের দেখতে হবে যে আধুনিক বা বলা ভালো উত্তর-আধুনিক দাবিগুলি সনাতন দর্শনের কিছু অংশকে অপ্রয়োজনীয় করে তুলছে। এর ফলে আমাদের চিন্তাভাবনার ধারায় অনেক মৌলিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাচ্ছি। তাই, আধুনিক বিশ্বের পক্ষে উপযোগী দর্শনের বৈশিষ্ট্যগুলিকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পৃথিবীতে যেসব পরিবর্তন ঘটে গেছে তা সব ক্ষেত্রে না হলেও, কিছু কিছু ক্ষেত্রে নতুনভাবে চিন্তাভাবনা দাবি করে। যেমন :

১. আধুনিক পৃথিবীর দর্শন দারুণভাবে আপেক্ষিকতাবাদী, যদিও বিভিন্ন মাত্রায়। বিভিন্ন পৃথিবীর মধ্যেকার ফাঁক পূরণ করার জন্য, মানুষদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া আর সংযোগের ধারা প্রস্তুত করার জন্য, কিছু প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতাবাদ নৈতিক আপেক্ষিকতাবাদ-সহ) আজকের দিনে পছন্দের বিষয়।

২. তা সত্ত্বেও অদম্য একটি ‘এক বিশ্বের প্রবল ধারণা এখনও আছে। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থে, প্রযুক্তির মাধ্যমে বিশ্ব একত্র হচ্ছে। এক ‘বিশ্বগ্রামের’ ধারণা হল এখনকার আদর্শ, যেটা ব্যাপকভাবে মূল্যবান এবং ব্যবহৃত।

৩. সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের ধারণা, তাত্ত্বিক দিক থেকে যাকে ‘বহুসংস্কৃতিবাদ’ বলা হয়, তাকে জাতি-রাষ্ট্রের বহুত্ব বা বিশ্বের বহু ধর্ম অথবা বৃহৎ ভাষাভাষী নানা গোষ্ঠীর সঙ্গে, একাত্ম করে ফেললে কিন্তু ভুল বোঝা হবে। প্রত্যেক জাতি-রাষ্ট্র অথবা বৃহৎ ভাষাভাষী সম্প্রদায় অথবা বিশ্বধর্মের মধ্যে থাকে অসংখ্য অন্তর্নিহিত বিভিন্নতা। এদের যখন আমরা একতার নিদর্শন বলে ধরে নিই, আমাদের অবশ্য মনে রাখতে হয় যে এগুলি হল উচ্চস্তরের নির্মাণ। বহুসংস্কৃতিবাদ ছোট ক্ষেত্রগুলির দাবি পুরণের জন্যই তৈরি হয়, যাতে ওই বৃহৎ নির্মাণগুলি অন্তর্নিহিত বৈচিত্র্যকে ধ্বংস না করে দিতে পারে।

৪. রাজনৈতিকভাবে, উত্তর-আধুনিক চিন্তা পার্থক্যের স্বীকার দাবি করে। সবকিছু গলে মিশে এক হয়ে যাবে—এই ধারণার এটি বিরোধী, সংখ্যাগুরুর শাসনের বিরোধী, নিঃশর্ত সমতা এবং নিরপেক্ষ বিচারের মাধ্যমে ন্যায়-প্রতিষ্ঠার বিরোধী। প্রাথমিকভাবে বলা যায় যে এ হল সংখ্যালঘুর মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতির কথা, যাতে তারা তাদের আত্মপরিচয় রক্ষা করতে পারে। এটি সম্প্রদায় কর্তৃক স্বশাসনের গান্ধীবাদী তত্ত্বের সমান।

এই চারটি বিষয় যদি মনে রাখি, তাহলে দেখা যাবে যে আধুনিক বিশ্ব যথার্থ অর্থে বহু সংস্কৃতির দর্শন চাইছে, চাইছে একটি আন্তর-সাংস্কৃতিক বোঝাপড়ার তত্ত্ব। বহুত্বকে সহ্য করে এমন একটি ঐক্যের তত্ত্ব, এটি ন্যায় বিচারের তত্ত্ব, যেটা নিছক পদ্ধতিনির্ভর নয়, বরং বাস্তবানুগামী এবং সমতাস্থাপনের প্রবণতার পরিবর্তে পার্থক্যকে যথার্থ স্বীকৃতি দেয়।

এখন আধুনিক বিশ্বের অন্য দিকগুলির প্রতি আমরা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই— বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির দিকে। আমরা এমন দর্শনও চাই, যা আধুনিক বিজ্ঞানকে বুঝতে সাহায্য করবে, ঠিক যেমনভাবে কান্টের দর্শন নিউটনের পদার্থবিদ্যাকে বুঝেছিল।

৫. আধুনিক বিজ্ঞানের তিনটি স্তরের মধ্যে আমরা পার্থক্য করতে চাই। বিশের দশকে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার উন্নতি, আশির দশকে আণবিক কোষ এবং ডিএনএ জীববিজ্ঞানের উন্নতি, নব্বইয়ের দশকে একসঙ্গে কম্পিউটার, তথ্য এবং মস্তিষ্ক বিজ্ঞানের উন্নতি। কোয়ান্টাম বলবিদ্যাকে দার্শনিকভাবে বোঝার জন্য প্রথমদিকে অনেকগুলি চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু একটিও একে অন্য উন্নতির সঙ্গে যুক্ত করে বোঝার চেষ্টা করেনি। আমরা বলি বিজ্ঞানের এই উন্নতিগুলি নিজেরাই তথ্যের ধারণার মধ্যে একত্রিত হোক এবং যেখানে প্রযুক্তি বিক্ষিপ্ত তথ্যগুলিকে সঞ্চয় করার, উদ্ধার করার এবং ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, সেখানে দর্শনের প্রাসঙ্গিক ধারণাগুলিকে ব্যাখ্যা করবার দায়িত্ব থাকে। একটি যথার্থ বিজ্ঞানের দর্শন আমাদের প্রয়োজন যাতে বিজ্ঞানের সঙ্গে খাপ খাইয়ে দেওয়া সম্ভব।

৬. আধুনিক প্রযুক্তি কেবল শ্রম-বাঁচানোর একটি পদ্ধতিমাত্রই নয়, এমনকি নতুন পদ্ধতিতে শক্তি উৎপাদন এবং ব্যবহার করে, কাজ করার দক্ষতা বাড়ানোর উপায়ও নয়। এক কথায় এটি অন্তর্জগতের বস্তুর সঙ্গে সম্পর্ক হারিয়ে ফেলেছে। আধুনিক প্রযুক্তি মানুষকে তার বাসভূমি, এই পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছে এবং বিভিন্ন গ্রহের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করার সম্ভবনার ইঙ্গিত দিচ্ছে। শুধু মাঝামাঝি আকারের বস্তুখণ্ড নিয়ে কাজ করার থেকে মুক্তি পেয়েছে মানুষ, সে এখন দেশে কালে ক্ষুদ্র এবং অতিবৃহৎ বস্তুও জানছে ও ব্যবহার করছে। আমাদের প্রয়োজন হল প্রতিক্রিয়াসহ এই প্রযুক্তিকে বোঝা, আমাদের নিজেদের সঙ্গে, অন্যের সঙ্গে আর বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কের জন্য। ‘ভালো’ অথবা ‘মন্দ’-এর মত অতি সরল নৈতিক বিচারের এখন আর কোন মূল্য নেই। পারমাণবিক অস্ত্রের বিধ্বংসী শক্তির ভয়সংক্রান্ত বিচার দিয়েই এখন আর নতুন প্রযুক্তির অর্থ বোধগম্য হবে না। বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির দর্শন এখন খুবই প্রয়োজন।

আজকের জগৎ সম্পর্কে দর্শন কী বলতে পারে? রাজনীতিকে, অর্থনীতিবিদ, সমাজতাত্ত্বিক, ভবিষ্যৎবক্তা, সাংবাদিক এইরকম মানুষেরা যা যা বলেছেন তার অতিরিক্ত আজকের জগৎ সম্বন্ধে আর কছু বলার আছে? দর্শন কি এমন কিছু বলতে পারে যা ওপরে উল্লিখিত এঁরা বলে ফেলেননি? সব প্রাপ্তি আর গুণগুলির মতই অথবা হয়ত তার চেয়েও বেশি, আমাদের আলোড়িত করে পৃথিবীতে দেখা সব অমঙ্গল, অপূর্ণতা আর ক্ষয়ক্ষতি। মানুষ আশা করে যে দর্শন আমাদের পরামর্শ দিতে পারবে, কেমন করে এই অভাবাত্মক বিষয়গুলির প্রতিকার, প্রতিরোধ এবং অতিক্রান্তি সম্ভব এবং পরামর্শ দেবে কেমন করে লাভগুলি সুবিন্যাস্ত হয়ে আমাদের অংশীভূত হবে। এর অধিকাংশই এমন সব নৈতিক উপদেশ হবে যার কোন কমতি নেই। বর্তমান অবক্ষয় থেকে এই পৃথিবী কী করে বেরিয়ে আসতে পারে, এই বিষয়ে সব নীতিবাগীশ, ধর্মগুরু এবং আধ্যাত্মিক পুনরুজ্জীবনকারীদের উপদেশবাণী আছে। দর্শনকে যদি এই সবকিছুর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয়, তবে তাকে এমন কিছু হয়ে উঠতে হবে যাকে আমরা মনে করি প্রাজ্ঞতা।

দর্শনের আজ এমনই একটি বিশেষ প্রাসঙ্গিকতা আছে যা আগেকার দিনে ছিল না। দুটি ভিন্ন পদ্ধতিতে আমরা এই দাবিটি ব্যাখ্যা করতে পারি। প্রথমত, আর কোন যুগেই বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির এমন আমূল আবর্তন ঘটেনি, আমরা এখনও তার সম্পূর্ণ প্রকৃতি এবং তাৎপর্য অনুধাবন করতেও পারনি না। বিশেষ করে আমাদের চিন্তাধারা নিয়ন্ত্রণ করত যে ধর্মীয় বিশ্বাস, সেসব সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাওয়াতে, বা দারুণভাবে দুর্বল হয়ে পড়াতে এটি আরও গুরুত্ব লাভ করেছে। অতীত দিনে ধর্ম জীবনের অর্থ আর তাৎপর্য এনে দিতে। যখন সেই উৎস থেকে আর কিছু আমাদের পাওয়ার নেই, যে প্রশ্ন এমন তীব্র হয়ে উঠেছে সেটা হল, জীবনের অর্থ পাব তাহলে কীভাবে? অতীতে দর্শন বিজ্ঞানের ভিত্তি প্রস্তুত করার প্রয়োজনেও লাগত। কিন্তু বর্তমানে আমাদের বিজ্ঞানকেই ভালো করে বুঝতে হবে। আর এই কাজ দর্শনের ভিত্তি। বাঙালির চিন্তাধারায় পাওয়া যায় বৈশ্বিক ধর্মদর্শনের অণুরণন। বাঙালির ধর্মদর্শন স্থানিক, বৈশ্বিক ভাবনার অঙ্গিভূত এক মিশ্র ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় আবর্তিত।

ভারতীয় দর্শনে নব্যপ্লেটোনিক দর্শনের সম্পর্কসূত্র

খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে রোম সাম্রাজ্যের বড় দুটি শহর ছিল ইস্তাম্বুল (তৎকালীন নাম বাইজানটিয়াম) ও আলেকজান্দ্রিয়া (মিশরে)। শুধু বাণিজ্যের দিক থেকেই নয়, প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের ধর্ম-কৃষ্টি-দর্শন বিনিময়েরও অন্যতম প্রধান কেন্দ্ৰ ছিল তখন এই দুটি শহর। খ্রিষ্টপূর্ব তিন শতাব্দীতে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের জন্য সম্রাট অশোক- গ্রিসসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভিক্ষু প্রেরণ করেছিলেন। আলেকজান্দ্রিয়াতেও তাই তখন মঠ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আলেকজান্দ্রিয়াবাসী ভিক্ষুদের নিকট থেকেই ভারতীয় ধর্ম-দর্শন সম্পর্কে প্রথম অভিজ্ঞতা অর্জন শুরু করেন।

বাণিজ্যের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক সুপ্রাচীন। ভারতীয় বণিকগণ বাণিজ্য উপলক্ষে বিদেশে যত্র তত্র অবস্থান করায় তাদের নিকট থেকেও গ্রিকরা ভারতীয় ধর্ম-দর্শন সম্পর্কে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের সুযোগ পান। গ্রিসের রাষ্ট্রীয় অধঃপতন জনিত দুঃসময়ে তাই হতাশ গ্রিক পণ্ডিতগণ প্রাচ্যের সাধু-সন্ন্যাসী-যোগীদের যোগ, তপস্যা প্রভৃতির প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন। শুধু তাই নয়, সংসারের অসারতা ও পরলোকবাদের প্রতিও তাঁরা আগ্রহী হয়ে ওঠেন প্রবলভাবে। এরই ফলে হাজার হাজার শিক্ষিত সভ্য গ্রিক-উপবাসের মধ্যে যোগ-সাধনা ও ভজন গান করে তাঁরা দিন কাটাতেন। জগতের দিকে পৃষ্ঠ প্রদর্শনকারী এই লোকদের মধ্যে সৈনিক, ব্যাপারী, দার্শনিক, মহাত্মা সকল শ্রেণির মানুষই ছিলেন। ফলে আলেকজান্দ্রিয়ায় অ্যারিস্টটলের যথার্থবাদী দর্শন অনাদৃত এবং ধ্বংসোম্মুখ হয়ে পড়ে। —অবশ্য এরই ফলে পূর্ববর্তী অধ্যাত্মবাদী প্লেটোনিক দর্শন যা পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হতে চলেছিল এবং যা পতিত হয়ে পড়েছিল অসংস্কৃত অবস্থায়—তা নতুন করে জনগণের নিকট আদৃত হতে শুরু করে।

বিভিন্নদেশ কর্তৃক আক্রান্ত হলে তো বটেই, নিজ দেশেও যদি কখনো অত্যাচারী রাজার আবির্ভাব ঘটে এবং চলতে থাকে অনবরত শোষণ, বঞ্চনা ও অত্যাচারের মত মর্মান্তিক ঘটনা; তাহলে জনগণের মনে দুঃখ থেকে ক্ষোভ এবং হতাশা থেকে নৈরাশ্য চরমভাবে আত্মপ্রকাশ করে। অবশ্য দুর্ভিক্ষ, মহামারি, বন্যা প্রভৃতি কারণে সম্পদহানীর ঘটনা ঘটলে এবং এ থেকে সহসা পরিত্রাণ লাভের কোন সম্ভাবনা না থাকলেও এমন অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ-সপ্তম শতাব্দীতে ভারতীয় উপনিষদের নৈরাশ্যবাদ রহস্যবাদের উদ্ভব এমন একটি পরিস্থিতি থেকেই হয়েছিল বলে ঐতিহাসিকদের ধারণা। পরবর্তীকালের বৌদ্ধ ও জৈন দর্শনের নৈরাশ্যবাদ, রহস্যবাদ পূর্ববর্তী মতবাদের নব্য সংস্করণ মাত্র।

খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর গ্রিস-রোমের নায়ক-শাসক সমাজ ভোগ-বিলাসে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে সামাজিক বৈষম্য ও নোংরামির জন্য অনিশ্চিৎ ভবিষ্যৎ তথা বদহজমের শিকার হয়েছিল। তারাও এই পরিস্থিতি থেকে পালাতে চেয়েছিল, এই কাজে তাদের স্বদেশী নেশা প্লেটোর দর্শন যথেষ্ট ছিল না, বুঁদ হওয়ার জন্য দরকার ছিল আরও কড়া বোতলের; তাই তারা ভারতীয় রহস্যবাদ ও নৈরাশ্যবাদকে প্লেটোর দর্শনের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিল।

ভারত ও গ্রিক (প্লেটো) দর্শনের সমন্বয়ে সৃষ্টি নব্যপ্লেটোনিক দর্শন নিম্নরূপ : ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষ জগৎ মায়া, ভ্রম, ইন্দ্রজাল।

ভাবজগৎই যথার্থ সত্য।

জীবন-বিচ্ছিন্ন মানুষই সত্য ও মানসিক শান্তির সন্ধান পায়।

জানতে পারে, ফলে তার হৃদয়ের বন্ধন কেটে যায়।

সংসারমুক্ত এই মানুষের লক্ষ জন্মের ত্রুটি (কর্মফল) হয় লয় প্রাপ্ত।

পরবর্তীকালে ভারতীয় দর্শনে এই নব্যপ্লেটোনিক দর্শনের সাথে ক্রমশ মিশে যায় আরব আগত ইসলামি দর্শন, শিয়া দর্শন, সর্বোপরি সমন্বয়বাদী সুফি দর্শন।

ইসলামি দর্শন

ইসলাম ধর্মের উৎপত্তি আরবে। এই ধর্মের অনুসারীগণ স্রষ্টার একমাত্র নিরাকার রূপের উপাসক। তাঁরা সৃষ্টি সম্পর্কে একত্ববাদী; তবে স্রষ্টা ও সৃষ্টি সম্পর্কে দ্বৈতবাদী। মোহম্মদ বরকতুল্লার ভাষায় ‘আরবেরা সৃষ্টি ও স্রষ্টা সম্পর্কে দ্বৈতবাদী (Dualistic) তাহারা সৃষ্টিকে স্রষ্টা হতেই পৃথক করিয়া দেখেন’। যেমন শিল্পী ও তাঁর রচনা। অর্থাৎ, তাঁদের মতে, স্রষ্টা এক এবং তার কোন শরিক নেই। তবে এ জগতে তিনি ব্যতীত তাঁর সৃষ্ট বস্তুসমূহ বর্তমান। মুসলমানগণ সৃষ্টিকর্তার কোন রূপে বিশ্বাসী নন বিধায় মূর্তি পূজার ঘোর বিরোধী। এতদ্ব্যতীত তাদের নিরাকার উপাসনা পদ্ধতিও বৈদিক নিরাকার উপাসনা পদ্ধতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর।

ইসলামি দর্শন মতে, সৃষ্টিকর্তা (আল্লাহর) এই বিশ্বজগৎ থেকে বহু দূরে ছয় আকাশের পরে অবস্থান করেন। তিনি কেবল ‘হও’ উচ্চারণ করেই ভাব জগৎ নির্মাণ করেছেন এবং আগুন ও মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন যথাক্রমে ফেরেশতা ও মানুষ। ফেরেশতাদের মধ্যে কেউ কেউ নীতিচ্যুত হয়ে আল্লাহর শত্রুতে পরিণত হয়েছেন। তারা মানুষকে পথভ্রষ্ট করার জন্য সদা তৎপর। এজন্য এদের বলা হয় শয়তান। শয়তানদের মধ্যে ইব্লিশ দলনেতা। ফেরেশতা থাকাকালীন তার নাম ছিল আজাজিল।

মুসলমানগণ জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী নন। তাঁদের মতে, মানুষ তথা জীব একবারই জন্মগ্রহণ করে এবং কোরান বা আল্লার বিচার অনুযায়ী কর্মফল ভোগ করে। কর্মফল স্বরূপ সৎলোক অনন্তকালের জন্য স্বর্গে (বেহেস্তে) এবং অসৎলোক একই কালের জন্য নরকে (দোজখ) গমন করেন। স্বর্গে মনোরম অসংখ্য অপ্সরী (হুর) বর্তমান। সৎলোক স্বর্গের এই সুখবর বস্তু লাভে ধন্য হন।[১৬]

[১৬. পবিত্র কোরআনে উল্লিখিত হয়েছে, “ফিহিন্না কাছিরাতুত্ব তারফি লাম ইয়াতমিছহুন্না ইনচুন ক্বালাহুম ওয়ালা জ্বান্ন।’ (৫৫ : ৫৬)। অর্থাৎ ‘যেথায় থাকিবে আনতনয়না তরুণীগণ, যাহাদিগকে পূর্বে মানুষ অথবা জিন স্পর্শ করে নাই’ (ইফা)। ইসলামী বিশ্বকোষ-এ কোরআনের হুরকে ‘পবিত্র সঙ্গিণী’ বলা হয়েছে। সঙ্গিনী সম্পর্কে বিশ্বকোষটিই আবার প্রশ্নের অবতারণা করেছে এই বলে যে, ‘বেহেশতে স্ত্রী সহবাসের আদৌ কোন প্রয়োজন আছে কিনা? যৌন মিলনের প্রধান উদ্দেশ্যই যদি না থাকে তা হলে সঙ্গিণী থাকার তাৎপর্য কোথায়? যেমন সহবাসের প্রধান উদ্দেশ্য বংশরক্ষা করা কিন্তু সেখানে এর প্রয়োজনীয়তা অবান্তর।’ এই সমস্যার মীমাংসাকল্পে বলা হয় : ‘যদিও খাদ্য, নারী ইত্যাদির নাম পার্থিব নামের অনুরূপ, তথাপি উহা রূপক হিসাবে ব্যবহৃত; বাস্তবপক্ষে তাহারা এক নহে’ (সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ, ২য় খণ্ড, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৮২)।]

ইসলামে শিয়া দর্শন

শিয়া শব্দের অর্থ দল বা গোষ্ঠী। ইসলামের ইতিহাসে শিয়া হচ্ছে তাঁরাই যারা হজরত আলী (রা.) কে বিশেষভাবে অনুসরণ করে এবং তাঁর ইমামত ও খেলাফতকে হজরত মহম্মদ (সা.)-এর ইচ্ছা এবং তাঁরই শিক্ষাদানেরই ফলস্বরূপ মনে করে। কেননা শিয়ারা এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী যে হজরত আলী (রা.) কে এজন্য অনুসরণ করতে হবে কারণ এটি হজরত মুহম্মদ (সা.)-এর আদেশ ও তাঁরই ইচ্ছার বাস্তবায়ন, হজরত আলী (রা.)-এর ইচ্ছার নয়। হজরত মুহম্মদ (সা.)-এর মৃত্যুর পর তাঁর স্থলাভিষিক্ত নির্ধারণকে কেন্দ্র করে হজরত আলীর সমর্থকদের দ্বারা ‘শিয়ান-এ আলী’ নামে ইসলামে এই সমর্থক গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটে। পরবর্তীকালে এটি সংক্ষেপে ‘শিয়া’ নামে পরিচিতি লাভ করে। তাই ‘শিয়া’ শব্দের প্রকৃত ব্যাখ্যা হল : শিয়া হচ্ছে তারাই যারা হজরত আলী (রা.) কে অনুসরণ করে এবং তাঁকে হজরত মুহম্মদ (সা.) এর অব্যবহিত পরে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে মেনে থাকে। ইসলামের ইতিহাসে হজরত আলী (রা.)র চিন্তাদর্শনের অনুসারিরা একটি স্বতন্ত্র মাযহাব হিসেবে পরিগণিত হয়। প্রকৃতপক্ষে হজরত আলী (আ.)- এর সমর্থকদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হজরত আবু বকর (রা.) কে খলিফা নির্বাচিত করার ঘটনাকে কেন্দ্র করেই ইসলামে এই মাযহাবের সৃষ্টি হয়। কেননা হজরত আলীর (আ.) সমর্থকরা অর্থাৎ শিয়ারা মনে করেন হজরত মুহম্মদ (সা.)-এর স্থলাভিষিক্তর পদ একটি ঐশী পদ। যেরূপ হজরত মুহম্মদ (সা.) আল্লাহ তা’য়ালার পক্ষ থেকে মনোনীত হয়েছেন, সেইরূপ তাঁর স্থলাভিষিক্ত ও আল্লার পক্ষ থেকে মনোনীত এবং হজরত মুহম্মদ (সা.) মানুষের নিকট তাকে উপস্থাপন করবেন। যেহেতু শিয়া দৃষ্টিভঙ্গিতে হজরত আলী (আ.) হজরত মহম্মদ (সা.)-এর ঠিক পরবর্তী স্থলাভিষিক্ত।

উল্লেখ্য যে, হজরত মুহম্মদ (সা.)-এর জীবনাদর্শ যারা বিশেষভাবে অনুসরণ করেন এবং তাঁর মৃত্যু পরবর্তী চার খলিফা কর্তৃক ইসলামের সম্প্রসারিত নীতিমালা মেনে চলেন এঁরা সুন্নি মাযহারের অন্তর্গত। ইসলামে শিয়া ও সুন্নি মাযহাবের মধ্যে সর্বাধিক স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য হল শিয়ারা ইমামতের অনুসারি এবং সুন্নিরা রেসালতের অনুসারি।

ইসলামে সুফিদর্শন

সুফিগণ মূলত সমন্বয়বাদী। বৈদিক দর্শনের একত্ববাদ মেনে নিয়ে স্রষ্টা- সৃষ্টিতত্ত্বকেও তারা গ্রহণ করেছেন। এদিকে তারা মুসলমানদের মত জগৎ ও প্রাণীকে স্রষ্টার সৃষ্টি বলে মত দিয়েছেন। আবার একই সঙ্গে সৃষ্ট বস্তুকেও তারা স্রষ্টার অংশ বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁদের মতে, মাকড়সা যেমন স্বীয় দেহস্থিত উপাদান দ্বারা জাল তৈরি করে। তেমনি ঈশ্বরও নিজ দেহের অংশ দ্বারাই জীব- জগৎ তৈরি করেন। এ অর্থে সবকিছুই ঈশ্বরের অংশ; প্রকৃতি এমনকি মানুষও নয় এর ব্যতিক্রম।

সুফিগণ বৈদিক উপাসকদের মত সংগীতের মাধ্যমে স্রষ্টার আরাধনা করেন। তারা যে সংগীতের মাধ্যমে ঈশ্বরের আরাধনায় ব্রতী হন; তার নাম সামা। অবশ্য রুবাই, গজল, ক্বাসিদাকেও ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে রচিত সংগীত বলে মনে করা হয়।

সুফি সাধকগণ নিজেদের জীবাত্মা তথা প্রেমিকা তথা আশিক এবং স্রষ্টাকে পরমাত্মা তথা প্রেমিক তথা মাশুক রূপে কল্পনা করে ঈশ্বরের ধ্যানে মগ্ন হন। বাউল তো বটোই, মুর্শিদি, মারফতি, মাইজভাণ্ডারি প্রভৃতি গানেও সুফিদের এই সংগীতের প্রভাব প্রত্যক্ষ হচ্ছে। অবশ্য সুরের প্রভাবের বিষয়টি শাহজালাল, শাহপরান, খোরাসানি, খানজাহান আলী, কাশেম বাবা প্রমুখ ব্যক্তিবর্গকে কেন্দ্র করে রচিত গানেও যথেষ্ট পরিমাণে প্রত্যক্ষ করা যায়। পরবর্তীকালে অন্যান্য সংগীতও এসব সংগীতের সুর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে বলে অনুমিত হয়।

বিশিষ্ট গবেষক আবু জাফর শামসুদ্দীন বলেন, ‘পারসিক এবং রোমান সাম্রাজ্যের এশিয়া ও আফ্রিকীয় অংশের বিরাট ভূ-ভাগ বিজিত হওয়ার পর আরবীয় মুসলমাগণ গ্রিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হয়। অপরদিকে মুসলিম অধিকার আফগানিস্তান, সিন্ধু ও মুলতান পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভের পরে আরবীয়রা ভারতীয় দর্শন বিজ্ঞানেরও সন্ধান পায়। খলিফা আল-মামুনের রাজত্বকালে (৮১৩-৮৪৭ খ্রি.) বিপুল সংখ্যক গ্রিক, সিরীয়, কলতীয় এবং সংস্কৃত গ্রন্থ আরবী ভাষায় অনুদিত হয়। সংস্কৃতগ্রন্থ অনুবাদ করার জন্য বাগদাদের দরবারের ব্রাহ্মণ পণ্ডিত নিযুক্ত ছিলেন।’

কাজেই এসব ধর্ম-দর্শনের সমন্বয়ে আরবীয়রাই এই মতবাদ সৃষ্টি করে বলে তাদের ধারণা। কিন্তু এ সম্পর্কে খানিকটা ভিন্ন ধারণাও প্রচলিত। উল্লেখ্য সুফিবাদ এমন এক ধরনের মরমীবাদ যার মধ্যে বৈরাগ্যবাদ ও সর্বেশ্বরবাদের অপূর্ব সমন্বয় দৃশ্যমান। আরবদের নিকট অগ্নি উপাসক পারসিকগণ পরাজিত হলে তাঁদের মধ্যে যে নৈরাশ্যবাদের উদ্ভব ঘটে তাই ক্রমশ এঁদের বৈরাগ্যবাদের দিকে ধাবিত করে; আর এই বৈরাগ্য ও সর্বশ্বেরবাদী চিন্তা চেতনা থেকেই উৎপত্তি লাভ করে সুফিবাদ। উল্লেখ্য, সুফিবাদ মূল আরব ভূ-খণ্ড থেকে উদ্ভূত বলে মনে করা হলেও প্রাচীন আর্য অধ্যুষিত ইরানে তার পরিবৃদ্ধি। পারস্যের অধিবাসীগণ বিজয়ীদের ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ ধর্মের প্রতি অনুগত ছিলেন না। বরং প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির গর্বসম্পন্ন এ জাতি নতুন ধর্মের অনুশাসন ও আনুষ্ঠানিকতার প্রতি ছিলেন সম্পূর্ণরূপে উদাসীন। নতুন পুরাতনের সংঘর্ষ ও মিশ্রণে ভিন্ন একটি মতের উদ্ভব ঘটা তখন তাই ছিল খুবই স্বাভাবিক। একদিকে প্রাচীন বিশ্বাস ও ঐতিহ্য, অন্যদিকে নতুন ধর্ম ও রাজনৈতিক হতাশা; এসবের ফলস্বরূপ পারসিকদের মনে জন্ম নেয় সর্বেশ্বরবাদ ও বৈরাগ্যবাদী চেতনা। এ কারণে এতদ্‌ঞ্চলে সর্বপ্রকার পার্থিব ভোগসুখের প্রতি উদাসীন একটি গোষ্ঠী গড়ে ওঠে; বলা বাহুল্য, এঁরাই সুফি সম্প্রদায়। অর্থাৎ, আরবীর কিংবা ইরাকি নয়; পারসিক বা ইরানিদের হাতেই উৎপত্তি ঘটে মানবতাবাদী সুফি মতের। অবশ্য এ সময় মোতাজেলাবাদী সহ প্রায় একই ধরনের আরো কয়েকটি ক্ষুদ্র মতের সৃষ্টি হয়েছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে ইমাম জাফর সাদেক (র.)-এর মতে, সুফীবাদ কোরান-সুন্নাহর বহির্ভূত কোন বিষয় নয়, কেউ তা মনে করলে সে বিভ্রান্তিতে রয়েছে।

বস্তুত ভারতে আগত পীর দরবেশ সুফিদের অধিকাংশ ছিলেন আজমী। অর্থাৎ অনারব এবং ইরানী, গ্রিক, ভারতীয় দর্শন আত্মস্থকারী মুসলিম (?) প্রচারক।… ফলে এঁদের অধিকাংশই ছিলেন মাতবতাবাদী এবং বিভিন্ন ধর্মের সমন্বয়কারী। এই সমন্বয়কারী অনারবদের হাতেই উদ্ভব ঘটেছিল সুফিমত বা সুফি ধর্মের। অনেকে মনে করেন, কোরান ও সুন্নাহ অর্থাৎ একমাত্র শরিয়তের অনুসারীরাই প্রকৃত মুসলমান; আর তার বাইরে তরিকার অনুসারীরা সুফি। আবার কারো কারো মতে, সুফি ও ইসলাম সম্পূর্ণই স্বতন্ত্র দুটি ধর্ম; মোহম্মদ বরকতুল্লার ভাষায়— ‘ইসলাম জগতের শাস্ত্রবিদ্রোহ আরবে উদ্ভুত হলেও পারস্যের অবতারবাদ ( idea of incarnation) ও একত্ববাদ (monism) এই দুটি অনৈস্লামিক প্রেরণার সংশ্রবে এসে তা রূপান্তরিত ও পরিপুষ্ট হয়’। তাঁর মতে, ‘আরবেরা সেমিটিক সম্প্রদায়ভুক্ত। তাদের স্বাভাবিক প্রবণতা বহির্মুখীন, পারস্যবাসীরা আর্য সম্প্রদায়ভুক্ত। তাদের চিন্তাধারা অন্তর্মুখীন। আরবেরা প্রত্যক্ষবাদী ( empirel) পারস্যরা ভাববাদী (metaphysical)… পারস্যবাদীরা সৃষ্টির মধ্যেই স্রষ্টার অস্তিত্ব স্বীকার করেন’। (পারস্য প্রতিভা, ২য় খণ্ড)।

কিন্তু অনেকে সুফিবাদকে ইসলামেরই একটি অংশ বলে মনে করেন। তাঁদের মতে, ইসলামের অন্যতম আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক মতবাদ সুফিবাদ। অবশ্য সুফিবাদকে শরিয়তসহ অপর তিন তরিকার সমন্বিত রূপ বলেও তাঁরা মনে করেন। তাঁদের মতে, সুফিবাদই সত্যিকার অসাম্প্রদায়িক প্রেমময় ইসলাম।

বস্তুত ইসলাম সম্পূর্ণই একটি সাংসারিক ধর্ম। অনুসারীদের জন্য গৃহত্যাগের কোন বিধান এতে নেই। হজরত মুহম্মদ নিজেও ধর্ম প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে সংসার জীবন পালন করেছেন। কিন্তু সুফি ইসলামের সংসার ত্যাগের বিষয়টি অনুসৃত হয়েছে। এমনকি নিরামিষ ভোজনও এতে অনেকাংশে স্বীকৃত। হজরত শাহজালাল দিল্লিতে পায়রা ও গজার মৎস্য প্রাপ্ত হলেও সেগুলোর প্রাণ সংহার পূর্বক আহার করেননি। বরং পরম যত্নে সিলেট পর্যন্ত আনয়ন পূর্বক তিনি এদের বংশ বিস্তারে সহায়তা করেছিলেন।

সুফি সাধকগণ ধ্যান-জপের সঙ্গে যাদু বিদ্যারও (কেরামতি) অনুশীলন করতেন। শুধু তাই নয়; এ বিদ্যায় তারা যথেষ্ট দক্ষ ছিলেন বলেও অনুমিত হয়। এতদ্ব্যতীত এঁদের দ্বারা পরিবেশিত সংগীতের প্রতিও ভারতবাসীর যথেষ্ট আকর্ষণ ছিল। ফলে এতঞ্চলে তাঁরা বেশ সাদরেই গৃহীত হন। ভারতবর্ষও একারণেই সুফি সাধকদের নিকট একটি নিরাপদ ও পবিত্র ভূখণ্ড রূপে আবির্ভূত হয়।

সুফিদের আধ্যাত্মিক সাধনার পথ বেশ দীর্ঘ। এই পথে বেশ কয়েকটি স্তর বা ‘মকাম’ বর্তমান। এই মকাম সমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—

১. তওবা—(এর মাধ্যমে সুফিগণ সংসার ত্যাগ পূর্বক স্রষ্টার ধ্যানে মগ্ন হওয়ার প্রতিজ্ঞা করেন)।

২. জিহাদ বা ধর্মযুদ্ধ–(বহিঃশত্রু নয়; সুফিগণ জিহাদ করেন অন্তরের শত্রুর বিরুদ্ধে)।

৩. ওয়ারা—(পেশা থেকে বিরত থাকা)।

৪. জোহদ– (সুখ ভোগ থেকে বিরত থাকা)।

৫. জো’ওরক আল-শাহওয়া–(ক্ষুধায় ধৈর্য ধারণ)।

৬. একিন-(দৃঢ় বিশ্বাস)।

৭. সিক–(কর্ম ও চিন্তায় সত্যবাদিতা)।

৮. জিক্র—(স্রষ্টার উদ্দেশ্যে জপ)।

৯. ফকর–(স্বেচ্ছা দারিদ্রবরণ)

১০. তসাওফ—(পবিত্রতা রক্ষা করা)।

১১. আদব-(ব্যবহারে ভদ্র থাকা)।

১২. সফর—(ভ্রমণ)।

১৩. শওক—(স্রষ্টার সাহচর্যের জন্য ব্যাকুল হওয়া)।

১৪. মারিফ-(মহাজ্ঞান লাভের চেষ্টা করা)

১৫. ইরাদা (সকল কর্ম ঈশ্বরের ইচ্ছায় সম্পাদিত হচ্ছে এরূপ মনে করে কর্মফল ও ফলাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করা)।

১৬. মহৎ মৃত্যু বা দেহ ত্যাগের জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকা—প্রভৃতি।

বাউলদের মত সুফি সম্প্রদায়ও একসময় নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিলেন। এঁরাও ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে উপাসনা আরাধনার চর্চা শুরু করেছিলেন। তবে তত্ত্বের দিক থেকে তাঁরা মোটামুটি অভিন্ন অবস্থানই সংরক্ষণ করতেন। মানুষ এবং মানুষের হৃদয়ই ছিল তাঁদের একমাত্র আরাধ্য বিষয়।

সুফিরা তিন-তিনটি মার্গ অতিক্রম করে ক্রমাগত একটি আনন্দময় চিন্তার স্তরে পৌঁছানোর চেষ্টা করেন। তাঁরা ইসলামের নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ও কলেমাকে অস্বীকার করেন না। আবার কেবল এই আচারের মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধও রাখতে চায় না। যথোচিত সংযম ও বিভিন্ন কঠোর নিয়মাবলির মাধ্যমে তাঁরা তরিকতের পথে অগ্রসর হন। বাউলদের মত এঁরাও মুর্শিদ বা গুরুকে স্মরণ করেন এবং স্রষ্টা সৃষ্টি সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশ্নের সমাধান লাভের চেষ্টা করেন। নিজেদের কামনা-বাসনার স্বরূপ ও পরিসীমা সম্পর্কেও এসময় তারা পরিজ্ঞাত হতে সচেষ্ট হন।

–তৃতীয় স্তরটি মূলত জ্ঞানের স্তর। একেই বলা হয় মারিফত। এ স্তরে ধর্মানুশীলনের সঙ্গে সঙ্গে পঠন-পাঠনেরও যোগাযোগ ঘটে।

চতুর্থ স্তরটি আনন্দময় স্তর। এর নাম হকিকত। আবদুল হাফিজ এ সম্পর্কে বলেন— ‘এখানে অগ্নিপরীক্ষা, সংশোধন এবং কঠোর সাধনার মাধ্যমে প্রিয়- মিলনের জন্য প্রস্তুত থাকেন সুফীরা’। হকিকতের স্তরটিকে সার্থকভাবে কাজে লাগাতে পারলে ‘ফানা-ফিল্লাহ’র অর্থাৎ আল্লাহর মধ্যে বিলীন হতে পারা যায়।

বস্তুত সুফিবাদ একটি অসাম্প্রদায়িক, উদার, প্রেমময় ও মানবতাবাদী মতবাদ। বৈদিক মতবাদ যেভাবে বিভিন্ন রূপান্তর সংস্কারের মাধ্যমে আজকের হিন্দুধর্মে পরিণতি লাভ করেছে। তেমনি শরিয়তী ইসলামও বিভিন্ন মতের সমন্বয় সুফিবাদকে জন্মদান করেছে। দর্শন-ভাবনার দিক থেকে এইমত বৈদিক এমনকি গ্রিক মতের সমীপবর্তী হলেও আচার-আচরণের দিক থেকে তা ইসলাম ধর্মেরই অনুসারী। এ হিসেবে সুফিবাদকে ইসলামের একটি প্রগতিশীল ধারা হিসেবে বিবেচনা করা যায়।

চিশতিয়া, কাদেরিয়া, সোহরাওয়ার্দিয়া প্রভৃতি সুফিবাদের কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন তরিকা। (বিস্তারিত আলোচনার জন্য ষষ্ঠদশ অধ্যায় দেখুন)।

সুফিদর্শনে সুফিদের অভিব্যক্তি

১. আরব কর্তৃক পারস্য বা ইরান অধিকার কেবল একটি দেশের উপর আর একটি দেশের কর্তৃত্ব স্থাপন করেনি; একটি জাতির উপর অন্য একটি জাতির এবং একটি মতের উপর আর একটি মতাদর্শেরও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তবে এরই মধ্যে যারা অপেক্ষাকৃত উদার ও জ্ঞানী তারাই উভয়ের সমন্বয়ে ভিন্ন একটি মত সৃষ্টি করে পাশাপাশি অবস্থান করার চেষ্টা করেছিলেন। দেশ কাল ভিন্ন হলেও বাংলা তথা ভারতবর্ষেও একই অবস্থা প্রত্যক্ষ করেছে। সাম্য-মৈত্রীর এই আন্দোলন কতটা জনপ্রিয় হয়েছিল জন মার্শাল কর্তৃক নিম্নে বর্ণিত উপাখ্যানের মাধ্যমে তা প্রমাণিত হয়। উল্লেখ্য মার্শাল ১৬৬৮-৭২ খ্রিষ্টাব্দে অর্থাৎ সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়ে (১৬৫৮-১৭০৬ খ্রি.) ভারতবর্ষ ভ্রমণ করেছিলেন। ভক্তিবাদী ফকির কর্তৃক শিষ্যদের উদ্দেশ্যে উপস্থাপিত একই কাহিনি তিনি মনোযোগের সহিত শ্রবণপূর্বক তাঁর দিনপঞ্জিতে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। কাহিনিটি নিম্নরূপ :

এক হিন্দু ফকির (সন্ন্যাসী) পিঁপড়াদের খাওয়াচ্ছিলেন। সেখানে এক মুসলমান এলেন। তিনি পিঁপীলিকাদের মধ্যে আহার্য বিতরণের কারণ জানতে চাইলেন। হিন্দু ফকির বললেন আগামীকাল ঝড়-বৃষ্টি হবে। পিঁপড়েগুলো খাদ্যাভাবে মরতে পারে। এ কথা ভেবে ওদের খাওয়াচ্ছি। মুসলমানটি জিজ্ঞেসে করলেন, আপনি এ কাজের কী প্রতিফল আশা করেন? হিন্দু ফকির জবাব দিলেন, এই প্রাণীগুলোকে আহার্য দান করাতে ঈশ্বর খুশি হবেন। মুসলমানটি বললেন, সব অবিশ্বাসী (Heatten) দোজখে যাবে। মুসলমান ব্যতীত অপর কেউ মুক্তি পাবে না। কিছুদিনের মধ্যে উভয়ের মৃত্যু হল। উক্ত হিন্দু ফকিরকে বেহেশতে অবস্থান করতে দেখে মুসলমানটি আল্লাকে জিজ্ঞাসা করল। এই বিধর্মী কেমন করে বেহেশতে এল? মহম্মদ (দ.) আমাদের বলেছেন, মুসলমান ব্যতীত অপর কেউ মুক্তি পাবে না। হিন্দুরা কটু স্বাদের লোক (Sour and bitter people)। আল্লাহ তায়ালা বললেন, সত্য বটে হিন্দুরা Sour and bitter কিন্তু এই কটু স্বাদের লোকেরা যদি মিষ্টি ফল নিয়ে আসে। তাহলে এখানে তারা মিষ্টি স্থান পাবে না কেন? আমি পুনরায় তাদের কটু বানাবো? (আবু জাফর শামসুদ্দীন, ইসলাম ও বাংলার লোকসংস্কৃতি, পৃ. ১৭)।

২. পারস্যের সুফি মওলানা রুমির একটি বয়েত নিম্নরূপ-হেডল্যান্ড ডেভিসের ‘মসনবী রুমি’র মুল ইংরেজি থেকে অনুবাদ :

দেখ আমি আমার নিজের স্বরূপ জানিনা, আমি কী করিব। আমি খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী নই, ইসলাম ধর্মাবলম্বীও নই, ইহুদীও নই। পূর্ব পশ্চিম জল স্থল কোন স্থানেরই আমি অধিবাসী নই। ফেরেস্তা অথবা শয়তান কারো সাথে আমার আত্মীয়তা নেই। আমি সুদূর চীন, সরাসিন, বুলগার, পঞ্চনদী সমন্বিত ভারত, ইরাক, খোরাসান কোন স্থানেই জন্ম নেই নাই। আমি ইডেন উদ্যান ও স্বর্গ হতে পতিত হই নাই। আমি আদমেরও বংশধর নই। সমস্ত স্থানের ঊর্ধ্বে চিহ্ন ও উদ্দেশ্যবিহীন দেশে দেহ ও আত্মাকে অতিক্রম করে আমি আমার বন্ধুর বুকে চির নবীন বেশে বাস করি।

তিনি আরো বলেন-

‘তাঁকে আমি খুঁজে ফিরেছি পৃথিবীর আনাচে-কানাচে। কোথাও তাঁর সন্ধান আমি পেলাম না। মন্দিরে, মসজিদে, গির্জায় কোথাও না। তাঁর সন্ধান কেউ আমায় দিতে পারল না। হেরার পর্বত গুহা থেকে শুরু করে কাবুল কান্দাহার পর্যন্ত পাগলের মতো তাঁকে আমি খুঁজে ফিরেছি। কিন্তু তবুতো তাঁকে পাওয়া আমার হল না। তারপর সব খোঁজাখুঁজির শেষে যখন আমি আমার নিজের হৃদয়ের দিকে তাকালাম। তখন দেখলাম সে আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি মধুর হেসে বলছে— এই ত আমি।’ (আনোয়ারুল করিম; বাউল কবি লালন শাহ; আষাঢ় ১৩৭৩ পৃ. ৯১)।

৩. হাবিবুর রহমান খোরাসানীর শিষ্য জাহিদ আলী বলেন,

‘মুসলমান’ শব্দের অর্থ হচ্ছে আল্লাহর (স্রষ্টা) নিকট সমর্পিত হওয়া। অর্থাৎ যিনি আল্লাহ বা সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছেন তিনিই মুসলমান। আপনি যদি সৃষ্টিকর্তাকে বিশ্বাস করে থাকেন; তবে আপনিও মুসলমান। নজীবী সকল মানুষকে মুসলমান হতে বলেছেন— শরদিন্দুকে করিম হতে বলেননি।

৪. সুনামগঞ্জ নিবাসী পীর তাজুদ আলী বলেন,

যারা ধর্মকে স্বার্থ সিদ্ধির জন্য ব্যবহার করে তারাই ভুল ব্যাখ্যা করে মানুষকে বিভ্রান্ত করে। নতুবা ইসলাম অন্য ধর্মকে ঘৃণা করার কথা বলেনি। এই দেখুন আমার কাছে গীতা আছে; আমি তা পাঠ করি এবং কোরান শরিফের মতোই শ্রদ্ধা করি। প্রত্যেক মুসলমানেরই সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত। আমার অনেক হিন্দু শিষ্য ও ভক্ত আছে। তারা আমার লেখা গান গায়। ব্ৰহ্মা- বিষ্ণু-আল্লায় তারা ভেদ করে না।

৫. এ প্রজন্মের সুফিসাধক বাংলাদেশের মানিকগঞ্জে নিবাসী সাইদুর রহমান বয়াতি বলেন,

…অনেকেই এর আগে বলত বাউল সম্রাট অমুক, বাউল অমুক, আসলে বাউল আমাদের দেশে নাই। আসলে সত্যিকার বাউল যারা আছে; তারা ঐ কুষ্টিয়ার লালন শাহ পন্থী; তাদেরকেই বাউল বলা যায়। তাদের বেশভূষা আলাদা, তাদের কথাবার্তা, তাদের ধর্মও আলাদা। এখন বাউল পোশাক পরে যারা গান করে তাদেরকে বাউল বলা হয়। এরা কিন্তু বাউল না।…বাউল ধর্মকে বিশ্বাস করি। ধর্ম তো একজনেরই। সবাই এক স্রষ্টাকে পেতে চায়। কাজেই ধর্মের বিচ্যুতি ঘটতেছে বাউলদের ভিতরে তা আমি বলব না। এক পরমেশ্বর— কেউ আল্লাহ কয়, কেউ হরি কয়, কেউ গড় কয়, কেউ গোপ কয়, কেউ যিশু কয়, কেউ মানুষরূইে সেই বিধাতা কয়। কাজেই দেখা গেল মূলে একজনই হল স্রষ্টা—যাঁর জন্য জগৎ খুঁজতেছেন। বাউলরা যাঁকে খুঁজে, সুফিরাও তাঁকে খুঁজে, মওলানারাও তাঁকে খুঁজে, ঐ যারা পূজাপার্বণ করতেছে তারাও তাঁকে খুঁজে।’ (সাইদুর রহমান বয়াতির জন্ম ১৩৩৮ বঙ্গাব্দে মানিসকগঞ্জের হাসলি গ্রামে। পূর্বপুরুষেরা ইরাকের বাসিন্দা ছিলেন)।

গোসাঁই বলাই চাঁদের ভাষায়—

‘ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোমে/ দেহের গঠন হয় ক্রমে।
এই পঞ্চতত্ত্বে পঁচিশ তত্ত্ব ভুলিস না ক্রমে।’

পঞ্চতত্ত্বের পঁচিশ তত্ত্বের ব্যাখ্যায় শাস্ত্রকার বলেন—

ক্ষিতি : অস্থি, চর্ম,নাড়ি, লোম ও মাংস

অপ : মল, মূত্র, শুক্র, শ্লেষ্মা ও শোণিত

তেজ : ক্ষুধা, তৃষ্ণা, নিদ্রা, মোহ ও ক্ষান্তি

মরুৎ : বিরোধ, আক্ষেপণ, আকুঞ্জন, ধারণ ও তৃপ্তি

ব্যোম : রাম, দ্বেষ, মোহ, ভয় ও লজ্জা।

শরিয়ত একটি পূর্ণাঙ্গ ঐশী আইনব্যবস্থা। তাতে মানুষের গোটা জীবন এবং জীবনের সব কর্মকাণ্ডের দিকনির্দেশ রয়েছে। অর্থাৎ মানবজীবনের এমন কোন দিক বা বিষয় নেই যা শরিয়তের অন্তর্গত নয়। তবে মানবজীবনের বিভিন্ন দিক বিবেচনার জন্য শরীয়তেরও একাধিক দিক রয়েছে। কোন কোন পণ্ডিতব্যক্তি শরীয়তকে উপাসনাক্রিয়া (এবাদত) ও পার্থিব কাজকর্ম (মুয়ামালাত), এ দুটি শাখায় বিভক্ত করেছেন। এই গতানুগতিক বিবেচনা করতে গিয়ে কোন কোন আধুনিক চিন্তাবিদ এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, শরীয়তের উল্লিখিত এবাদতের দিকটিকে যেখানে সংরক্ষিত বা অপরিবর্তিত রাখা হয় সেখানে দ্বিতীয় শাখাটিকে সময়ের প্রয়োজনে পরিবর্তন করা যায়। তবে শরিয়তের দৃষ্টিতে দুটি দিক সম্পূর্ণরূপে পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয়।

শরিয়ত কোন নিছক তাত্ত্বিক শব্দ নয়, বরং একটি পুরোদস্তুর ব্যবহারিক ধারণা; কারণ তা মানুষের আচরণের সঙ্গে যুক্ত। এ আচরণ দৈহিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক, সবকিছুকে অন্তর্ভুক্ত করে। একই কারণে তা অন্তর্ভুক্ত করে বিশ্বাস ও অনুশীলন, এ উভয়কে। নামাজ রোজা প্রভৃতির অনুশীলন যেমন ধর্মীয় কর্তব্য, তেমনি আল্লাহ বিশ্বাস এবং তাঁর নির্দেশ মোতাবেক কাজ করাও শরিয়তের অন্তর্ভুক্ত। শুধু তা-ই নয়, যাবতীয় ব্যক্তিগত আচার, ব্যবহার তথা সব আইনবিষয়ক ও সামাজিক আদান-প্রদান শরিয়তের অন্তর্ভুক্ত। মোট কথা, শরিয়ত এমন একটি ব্যাপক নীতি যাকে যথার্থই অভিহিত করা যায় একটি সর্বাত্মক জীবনপদ্ধতি বলে।

জীবন ব্যবস্থার দিক থেকে ইসলাম হল ফিত্রাতী ধর্ম। অর্থাৎ প্রাকৃতিক ধর্ম বা আল্লার স্বভাবধর্ম (৩০ : ৩০)। বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে স্বভাবের সমন্বয়সাধনের সর্বাঙ্গীন সুন্দর ব্যবস্থা কোরআনে নির্দেশিত হয়েছে। অতএব কোরআন ফিরাতী ধর্মসাধনের পরিপূর্ণ একটি জীবন বিধান (Complete Code of Life)।

এই জীবনপদ্ধতির মধ্য দিয়েই সে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে একটি পরিশীলিত জীবনপ্রবাহ- যা নৈতিক ও ও মানবিকবোধে বিকাশ ঘটে। এই বিকাশ চিৎপ্রকর্ষের বিকাশ সর্বোপরি আধ্যাত্মিকতার বিকাশ। তাই অন্তর বিকশিত হলে দেখা যাবে ধর্মদর্শনের সর্বাধিক ও সর্বোচ্চ লক্ষ্য হল পরকালের পরিত্রাণপ্রাপ্তি, মোক্ষলাভ কিংবা নির্বাণ অর্জনের উদ্দেশ্যেই আবর্তিত এক মহৎ মানবীয় অনুভূতি। ইসলাম ধর্মে ইন্দ্রিয় (Sense), বিচারবুদ্ধি (Reason) ও স্বজ্ঞা (Intuition)-এই তিনটি জ্ঞানের উৎস হিসেবে স্বীকৃত। তবে বুদ্ধিই জীবনের সব কিছু নয়। কেননা কেবল বুদ্ধিই জীবনের পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে পারে না। জীবনে বুদ্ধির চেয়ে ব্যাপক ও গভীর বিষয় আছে। জীবনের এই গভীর ও ব্যাপক দিকটি ব্যাখ্যার জন্যই প্রয়োজন অতীন্দ্রিয় অনুভূতি বা স্বজ্ঞার। স্বজ্ঞা জ্ঞানের এমন এক উচ্চতম মাধ্যম যাকে ইন্দ্রিয় বা বুদ্ধির সাহায্যে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। তাই শুধু শরিয়তে সমর্পিত জীবনানুশীলনে সম্পৃক্ত থেকেই জ্ঞানের এই উচ্চতম অবস্থানে সংযোগ স্থাপন সম্ভব নয়।

এই অধ্যায়ে ভারতীয় দর্শনের কীর্তিপুরুষ রঘুনাথ শিরোমনি ও তাঁর নৈয়ায়িক ধুরন্ধর এবং প্রখ্যাত বৈদান্তিক বাসুদেব সার্বভৌমসহ প্রায় সকলের ধর্মদর্শনের সারাৎসার উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে। সেই সাথে পরবর্তীকালের ধর্মদর্শনের ভিন্নধর্মী বিশ্লেষক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণ, লোকায়ত দার্শনিক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, হাল আমলের জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিমলকৃষ্ণ মতিলাল, সুকুমারী ভট্টাচার্য, নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী প্রমুখ চিন্তকদের চিন্তার নির্যাস উপস্থাপিত হয়েছে। পাঠক এতে হিন্দু ধর্মদর্শনের চিন্তার অনুরণন বিস্তৃত করতে পারবেন। ইসলামী ধর্মদর্শনেরও সর্বজন মান্য চিন্তকদের ধর্ম দর্শনের মৌলিক বক্তব্য উপস্থাপিত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ইসলাম ধর্মে নানা মতের, নানা শাখা প্রশাখায় চিন্তার বৈপরীত্যের মধ্যে সাদৃশ্য ও স্বাতন্ত্রের স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে। একইভাবে খ্রিষ্টধর্মে ‘ত্রিত্ববাদ’, যিশুর ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা, বাইবেলের ইতিহাস বিতর্কের প্রামাণিকতায় বৈশ্বিক চিন্তকসহ বাঙালি শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদের ধর্মদর্শন আলোকপাত করা হয়েছে। বৌদ্ধ ধর্মেরও হীনযান, বজ্রযানসহ অষ্টাঙ্গিকমার্গ, ইত্যাদির ধর্মদর্শন বাঙালি শ্রেষ্ঠ নির্বাণতত্ত্ব চিন্তকদের চিন্তা উপস্থাপন করা হয়েছে। আরও উপস্থাপিত হয়েছে বিশ্বাবীক্ষায় ভারতীয় ধর্মদর্শন ও হিন্দু দর্শনের দিদিগন্তসহ এর মৌলিক বৈশিষ্ট্য। সেই সাথে লোকায়ত দর্শন, বাউল দর্শন ও সুফি দর্শনের মানবিক চেতনার স্বরূপ। সর্বোপরি বাঙালির চেতনায় সুফি দর্শনে মানব ঐক্যের সমন্বিত রূপের বৈশিষ্ট্য এবং এর সামাজিক সাংঘর্ষিক ইতিবৃত্ত।

বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে অ্যাকাডেমিক পর্যায়ে দর্শন বিষয়ে যাঁরা গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন তাঁদের মধ্যে গোবিন্দচন্দ্র দেব, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, সাইয়েদ আবদুল হাই, সরদার ফজলুল করিম, হাসান আজিজুল হক, আমিনুল ইসলাম, আবদুল মতীন, সোলায়মান আলী সরকার, রশীদুল আলম, আবদুল হাই ঢালী, শরীফ হারুন, নীরুকুমার চাকমা, প্রদীপ কুমার রায়, এম. মতিউর রহমান— বিশেষভাবে স্মরণীয়। এঁদের আলোচনা-গবেষণায় ধর্মদর্শন মুখ্য না হলেও বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে দর্শন আলোচনায় এঁদের অবদান অনস্বীকার্য। শরীফ হারুনের দর্শন-সন্ধিৎসায় আমরা যে-সম্ভাবনা লক্ষ্য করেছিলাম- তা তাঁর অকাল প্রয়াণে অপূর্ণ থেকে গেছে। সেই অপূর্ণতা পূরণ করে এখন আরও অনেকে এগিয়ে আসছেন। এই অগ্রগামীদের মধ্যে রায়হান রাইন একটি প্রত্যাশিত নাম।

নির্বাচিত গ্রন্থপঞ্জি

John Caird, Introduction of Philosophy of Religion, Glasgow : J. Maclehouse and Sons; Sixth Edition, 191০

Mackenzie, Outlines of Social Philosophy, London; George Allen and Unwin Ltd. 1918

Syed Ameer Ali, The Spirit of Islam (A History of the Evolution and Ideals of Islam with a life of the Prophet); Low price publications, Delhi, 1948

G. L. Aberethy and T. A. Langford (ed), Philosophy of Religion; London, 1967

John Hick, Philosophy of Religion; New Jersey, 1984

Brian Dauiesy An Introduction of the Philosohy of Religion; Oxford, 1994

Sleven Cahn and David Shatz, Contemporary Philosophy of Religion, Oxford, 1994

M. M. Sharif, A History of Muslim Philosophy, Lahor : Pakistan Philosophical Congress, 1966

ঋগ্বেদ সংহিতা (দ্বিতীয় খণ্ড) অনুবাদক; রমেশচন্দ্র দত্ত; কলকাতা, প্র.প্র. ১৯৭৬

স্বামী রঙ্গনাথানন্দ, উপনিষদের সন্দেশ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পঞ্চম পুনর্মুদ্রণ, ২০০৫

সৈয়দ জাহিদ হাসান, বাউল কোষ; আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, প্র. প্র. ২০১৫

সরদার ফজলুল করিম, দর্শন কোষ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা ১৯৭৩

শরীফ হারুন, দর্শনের ইতিহাস এবং দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ, উচ্চারণ প্রকাশনী, ঢাকা, প্র.প্র. ১৯৮২

সুবোধ চক্রবর্তী সম্পাদিত বঙ্কিম রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড (উপন্যাস ব্যতীত সমগ্র বাংলা রচনা); কামিনী প্রকাশালয়, প্রথম কামিনী সংস্করণ, কলকাতা, প্র. প্র. ১৯৯১

আমিনুল ইসলাম, পাশ্চাত্য দর্শন প্রাচীন ও মধ্যযুগ, নওরোজ কিতাবিস্তান, ঢাকা, ১৯৯৯

আমিনুল ইসলাম, পাশ্চাত্য দর্শন আধুনিক ও সাম্প্রতিক কাল, নওরোজ কিতাবিস্তান, ঢাকা, ১৯৯৯

এ. এম. এম. সিরাজুল ইসলাম, আল-কুরআনে ঈমান প্রসঙ্গে; ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, ২০০৮

আবদেল মান্নান (সংকলিত), ফকির লালন শাহের সৃষ্টিতত্ত্বের গান; ধ্যান বিন্দু, ঢাকা ২০১৭

এম এ বারী চিশতী, কোরআন কী বলে; সদর প্রকাশনী, ঢাকা, প্র. প্র. ২০১৭

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *