৯ম অধ্যায় – আহুরা-মাজদা ও অগ্নিস্তুতি : পারসি সমাজ ও জরথুস্ট্রীয় ধর্মীয় সংগীত

৯ম অধ্যায় – আহুরা-মাজদা ও অগ্নিস্তুতি : পারসি সমাজ ও জরথুস্ট্রীয় ধর্মীয় সংগীত

সূচনা

পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীনতম ধর্ম ও দর্শনের নাম—’জরস্ট্রিয়ান’ যা আদতে পয়গম্বর জরাষ্ঠারের নাম থেকে উদ্ভূত। জরস্ট্রিয়ান বা জরথুষ্ঠীয় ধর্মের উপাসক বা প্রধান দেবতা ‘আহুরা মাজদা’-র নামে এটি অনেকাংশে ‘মাজদাইজম’ নামেও পরিচিত। প্রাচীন ইরানের এই লোকায়ত ধর্মের বিখ্যাত ধর্মগ্রন্থটি হল আবেস্তা বা জেন-আবেস্তা। একদা এই বিশেষ ধর্মীয় ভাবধারাটি বৃহত্তর ইরান, সিরিয়া, তাজাকিস্তান ও পারস্যের উত্তর পশ্চিমাংশে বিস্তার লাভ করলেও পরবর্তী সপ্তম শতাব্দীতে ইসলামীয় ভাবাদর্শের উন্মেষ ঘটলে এর আধিক্য হ্রাস হয় এবং বিংশ শতাব্দীতে এই ধর্মের মাত্র ১৮০০০ অনুগামী বর্তমান যার অর্ধেকেরও বেশি আজ ভারতে অবস্থিত।

মূলত ১৮৭৪ সালে অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি সর্বপ্রথম ‘জরথুষ্ঠিয়ান’ শব্দটির নথিকরণ করে বিখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক ও দার্শনিক আর্চিবল্ড সেইস-এর ‘প্রিন্সিপলস অফ কমপারেটিভ ফিলোজফি’ থেকে। তারও আগে অবশ্য স্যার টমাস ব্রাউনের (১৬০৫ – ১৬৮২ খ্রি.) লেখা রিলিজিও মেডিসি-তে (১৬৪৩ খ্রিস্টাব্দ) এই ধর্মের আংশিক উল্লেখ পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে অক্সফোর্ড ডিকশনারি মার্চ ২০০১ খ্রিস্টাব্দে সমসাময়িক ‘মাজদাইজম’ শব্দটির ব্যবহার করে। জরথুস্টিয়ান মতবাদে ধর্মকে মূলত ‘মাজদাইসনা’ (Mazdayasana) বলা হয়ে থাকে যেখানে Mazda-র অর্থ আবেস্তান ভাষা ও ‘ইয়াসনা’ (Yasna) মানে ‘পূজা’ অথবা ‘অর্ঘ্যনিবেদন’।

ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য

জরথুষ্টীয় ধর্মাবলম্বীরা নানান ধরনের ধর্মীয় মতবাদ ও বৈশিষ্ট্যে বিশ্বাসী। সেগুলি যথাক্রমে হল :

১. এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এক ও একক এবং এর নিয়ন্ত্রণকর্তা হলেন সর্বশক্তিমান দেবতা আহুরা মাজদা।

২. আহুরা মাজদা-র দুটি ব্যতিক্রমী সৃষ্টি হল—’আসা’ (Asha) যার অর্থ সত্য এবং শৃঙ্খলা যারা অসত্য ও বিশৃঙ্খলার বিপরীত এবং ‘দ্রুজ’ (druj) যার অর্থ অসত্যতা ও অনিয়ম যা সততা ও শৃঙ্খলার বিপরীত। মূলত এই প্রধান দুই বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে মানবজীবনের মোক্ষলাভের নির্দেশ।

৩. সৎচিন্তা, সৎভাবনা, সৎবাক্য ও সৎকর্ম দ্বারা মানবজীবনের মোক্ষলাভের নির্দেশ।

৪. আহুরা মাজদা-র নির্দেশিত পাথেয় অবলম্বন করেই মানুষ ‘অন্ধকার’-এর মধ্য দিয়ে ‘আলোর’ সন্ধান পাবে যা জ্ঞান ও অজ্ঞানতার পরিমেয়।

৫. এই পৃথিবী ও তার সমস্ত সৃষ্টিই আহুরা মাজদা থেকে সৃষ্ট এবং একদিন সমস্ত সৃষ্টিই আহুরা মাজদার সেই পবিত্র ‘আলো-অন্ধকার’-এর জগতে লীন হয়ে যাবে। এবং আবার নতুন করে রচিত হবে সৃষ্টি নবরূপকল্পনা।

অন্যান্য বৈশিষ্ট্য

১. অগ্নি ও জল

জরথুষ্টীয় ধর্মে জল (অপঃ, অবন) এবং অগ্নি-কে (আতার, আদার) পবিত্র ধর্মীয় ভাবধারার মূলসূত্র বা উপাদানরূপে পরিগণিত হয়। এই বিশেষ ধর্মীয় মতবাদটিতে এই দুটি উপাস্য-উপাদান সৃষ্টির মহার্ঘ্য সম্পদরূপে পরিগণিত হয় যা সৃষ্টি, বিনাশ ও স্থিতির শ্রেষ্ঠ মাধ্যমরূপে পূজিত হয়।

২. ধর্মান্তর ও প্রচার

জরথুষ্টীয়-রা মূলত প্রকৃতি-উপাসক (Pagan worshipper)। জরথুষ্টীয়রা কখনওই ধর্মান্তর, ধর্মান্তরীকরণ ইত্যাদিতে বিশ্বাসী নয়। আহুরা মাজদা অনুসারে জরথুষ্টীয়দের ধর্মীয় ভাবনা ও চিন্তা এতটাই ব্যাপ্তি স্বীকার করে যে এতে আলাদা করে ধর্মীয় প্রচার ও ধর্মান্তরীকরণ নিষিদ্ধ।

৩. বৈবাহিক সম্পর্ক

অন্যান্য ধর্মীয় মতাদর্শের মতো জরথুষ্টীয়রাও নিজ ধর্মের সঙ্গে সঙ্গে অন্য ধর্মের একই মত পোষণকারীদের সঙ্গে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হতে বিশ্বাস করে। এই বিষয়টি নিয়ে ‘পার্সি’দের (জরাষ্ট্রীয় ধর্মাবলম্বী) মধ্যে মতোবিভেদ ও বিতর্কের শেষ নেই। যদিও কট্টরপন্থীরা স্বধর্মাবলম্বী ব্যতীত অন্য কোনো ধর্মের মানুষদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে নারাজ কিন্তু আধুনিক যুগের ক্রমবর্ধমান আধুনিক মতাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে এই ধরনের কট্টরপন্থাও আজ পার্সিদের মধ্যে দ্রুত বিলীয়মান।

৪. জন্ম, মৃত্যু ও পুনর্জন্ম

জরথুষ্টীয় ধর্মানুসারে জীবন একটি তাৎক্ষণিক ও আপেক্ষিক পর্যায় যা মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে পরিপূর্ণতা লাভ করে। পুনর্জন্মে বিশ্বাসী এই বিশেষ ধর্মের মানুষরা মনে করেন মৃত্যুর পরেও আত্মার বিকেন্দ্রীকরণের যার ফলে পুনর্জন্মের ধারাটি অব্যাহত থাকে। এই ধর্মেই মৃত্যু-পরবর্তী অন্তেষ্টির বিশেষ বিধান দেয় যেখানে জরথুষ্টীয় ধর্মাবলম্বীদের মৃত্যুর পরে ‘টাওয়ার অফ সাইলেন্স’১০ (পার্শিতে দখমা)-এ শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়। প্রাচীন প্রথা অনুসারে জরথুষ্টীয়রা বুভুক্ষু কাক, শকুন, চিল ইত্যাদি জাতীয় পাখিদের দ্বারা মৃতদেহ ভক্ষণ করাত, তাকে কবর দেওয়া বা পোড়ানো হত না। প্রাচীন রীতিনীতি অনুসারে জরথুষ্টীয়রা মনে করে থাকে মৃত্যুর পরেও এইভাবে মানুষ জগৎসংসারে মোক্ষলাভ করে।

ধর্মীয় সংগীত

জরথুষ্টীয় ধর্মের সঙ্গে সংগীতের সম্পর্ক বহুদিনের। প্রাচীন জরথুষ্টীয় ধর্মের বিভিন্ন লোকাচার ও ধর্মীয় রীতিনীতির সঙ্গে সংগীতের যোগসূত্র যুগোত্তীর্ণ। মূলত ইসলামধর্মের আগমনের বহুপূর্বেই জরথুষ্টীয় ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে একক, দ্বৈত ও গোষ্ঠী সংগীতের (Choral)১১ প্রচলন ছিল।

নানান গ্রন্থ ও পণ্ডিতদের মতানুসারে যেসব প্রাচীন জরথুষ্টীয় ধর্মীয় সংগীতের উল্লেখ আমরা পেয়ে থাকি তা মূলত জরথুষ্টীয়ান ধর্মগ্রন্থ আবেস্তা-র নানান অংশ বিশেষ-এর সাংগীতিক রূপ। আবেস্তা-র প্রথম নথিকরণ হয়েছিল সম্রাট সাপুর দ্বিতীয় (৩০৯ – ৩৭৯ খ্রিস্টাব্দে)-র সময় থেকেই। যদিও এর বেশ কিছু মূল্যবান অংশ ৬৫১ খ্রিস্টাব্দে সাসানিড সাম্রাজ্যের পতনের সঙ্গে বিলুপ্ত হয়। মূলত এরপরে যে প্রাচীন আবেস্তা-র লিপিবদ্ধ রূপ আমরা পাই তার প্রক্রিয়াকরণ শুরু হয়েছিল ১২৮৮ খ্রিস্টাব্দে। পৃথিবীর অন্যান্য প্রাচীন ভাষার মধ্যে ‘দিন দাবিরে’ উল্লেখযোগ্য যাতে আবেস্তা লেখা এবং পরবর্তীকালে যা নানান লোকায়ত সুরের প্রভাবে গাওয়াও হয়ে থাকে। প্রাচীন জরথুষ্টীয় সংগীতে ‘ইয়াসনা’-র১২ উল্লেখ পাওয়া যায়। বস্তুত ‘ইয়াসনা’ আবেস্তার প্রাথমিক লিপিবদ্ধ সংকলন যা বেশ কিছু ‘গাথা’ নিয়ে সজ্জিত যা কিনা মহান পয়গম্বর জরাষ্টারের নিজের রচনা বলে জরথুষ্টীয়রা মনে করেন। সেই জন্য প্রাচীনকাল থেকেই এর বিভিন্ন অংশ নানান জরথুষ্টীয় আচার-আচরণ ও ধর্মীয় উৎসবাদিতে গীত হয়ে থাকে। এছাড়াও এই জরথুষ্টীয় সংগীত ‘ইয়াষ্ট’-এর উল্লেখ পাওয়া যায় যা আহুরা মাজদার উদ্দেশ্যে রচিত স্তুতি।

এছাড়া নানান প্রার্থনা, যেমন পাঁচ ‘নিয়াশেতেও’১৩ (ইসলামের পাঁচ রোজের নামাজের মতো) লোকায়ত সংগীতে ধর্মীয় স্তুতির উল্লেখ পাওয়া যায়। ইরান, তুরস্ক ও মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে এই প্রাচীন জরথুষ্টীয় ধর্মীয়- সংগীতের প্রচলন আজও পাওয়া যায়।

জরথুষ্টীয় ধর্মের অনুসরণকারী বিশেষত যারা দক্ষিণ এশিয়ায় বসবাসকারী তারা ‘পারসি’ নামে পরিচিত। এই প্রাচীন উপগোষ্ঠীর একটি বৃহৎ অংশে আজ ভারতবর্ষে বসবাসকারী যাদের ধর্মীয় রীতিনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সংগীত মূল জরথুষ্টীয় ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় সংগীতচর্চা থেকে অনুপ্রাণিত হলেও অনেকাংশে তা স্বতন্ত্র। দক্ষিণ এশিয়ায় পারসিদের নানান আচার উৎসবে, বিয়েতে, ধর্মীয় জমায়েত বা ধর্মান্তরিতকরণে (যা ‘নভরোজ’১৪ বা ‘নবজোত’ নামে খ্যাত) ‘আবেস্তা’ সংগীত ছাড়াও নানান লোকায়ত সংগীত ও বাদ্যযন্ত্রানুষঙ্গের প্রভাব বর্তমান। ইরানের প্রাচীন কারমানশা প্রদেশের ‘তাম্বুরিন’ সংগীতের প্রভাবও আধুনিক পারসিদের ধর্মীয় সংগীতে বিদ্যমান। এছাড়াও ‘দাবরে মেহের’ ও ‘আহুরামাজদা’র স্তুতি ছাড়াও জরথুষ্টীয়দের মধ্যে ‘অগ্নি’ ও ‘জল’-এর স্তুতিও লক্ষণীয়। প্রাচীন জরথুষ্টীয়দের নানান উৎসবে ‘ফায়ার টেম্পল’১৫ বা ‘অগ্নি উপাসনার স্থান’গুলিতেও নানান ধর্মীয়- সংগীতের রূপ পাওয়া যায়। এই প্রাচীন ধর্মীয় সংগীত বহুলাংশে আজ ক্রমবিলীয়মান হলেও ইসলামিক জগতে ও তার স্বতঃস্ফূর্ত প্রভাবে আজও পৃথিবীর নানান জায়গায় এই প্রাচীন ধর্মীয় সংগীতের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। পারসি থিয়েটারের আধুনিকীকরণে এই সংগীতের সমান যোগদান উল্লেখযোগ্য। বিখ্যাত পারসি সংগীতকার জুবিন মেহতা, কাইখোসরু সাপুরজি সোরাবজি ও ফ্রেডি মারকুরি এবং ভি. বালসারার নানান বিখ্যাত রচনায় প্রাচীন জরথুষ্টীয় ধর্মীয় সংগীতের বিপুল সম্ভার লক্ষণীয়।

পারসি সংগীতের আধুনিকীকরণ তার ধর্মীয় মাহাত্ম্যকে এইভাবেই ধীরে ধীরে বিশ্বের অন্যান্য ধর্মীয় সংগীতের সাপেক্ষে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দান করেছে এবং লোকায়ত ধর্মীয় সংগীতের পরিবেশনের মাধ্যমে তাকে এক পৃথক ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানরূপে মর্যাদা দিয়েছে।

***

৯ম অধ্যায়
 আহুরা-মাজদা ও অগ্নি স্তুতি : পার্শি সমাজ ও জরাথুস্ট্রীয় ধর্মীয় সংগীত

১. Norman Solomon (2000) ; Judaism : A very short introduction, OUP, 9780192863905, p. 6

২. Ibid, p.8

৩. Ibid, p. 14

৪. Karen Armstrong (1994) ; A History of God, Ballentine Books, 9780345384560, pp. 25-29

৫. Ibid, p. 35

৬. Norman Solomon, p. 22

৭. Ibid, p. 68

৮. John R. Hinnells (2005) ; The Zoroastrians Diaspora : Religion and Migration, OUP, 97801988267591, p. 112

৯. Ibid, p.289

১০. Ibid, p. 396

১১. Piloo Nanarutty (2006) ; The Gathas of Zarathustra : Hymns in praise of Wisdom, Mapin Pub., 97818920693, p. 55

১২. Ibid, pp. 37-39

১৩. Ibid, p. 78

১৪. Jesse S. Palsetia (2001) ; The Parsis of India, Brill Indological Library, 9789004121140, p. 149

১৫. Ibid, p. 231

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *